১১. গোলাপ-মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা
দোজখ থেকে বেরোতে হবে, নইলে বাচবে না সে, বুঝতে পারছে রাশেদ, যেমন তার মতো অনেকে এর আগে এমনভাবে মরে গেছে, এখন মরছে, হয়তো বুঝতে পারছে না মরছে;-বারান্দায় একটি চঞ্চল চড়ইয়ের মুখের ওপর চোখ পড়লো রাশেদের, এক ঝলক রোদ গাছের পাতার সবুজের সাথে মিশে গ’লে এসে পড়েছে মুখটির ওপর, রাশেদ তার রূপের দিকে তাকিয়ে রইলো শিশুর মতো। মৃদু ইস্কুলে চলে গেছে, নইলে মৃদুকে নিয়ে চড়ুইয়ের মুখ দেখা যেতো, যে-মুখ সমাজ সভ্যতা রাষ্ট্রের থেকে অনেক। উজ্জ্বল আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তার। চড়ুইটিকে ডাকতে ইচ্ছে করছে, ডাক শুনে চড়ই যদি তার কাঁধে এসে বসতো, তার কাঁধটিকে মনে করতো একটা শাদা বেগুনের। ডাল, তাহলে সে ভুলে যেতে পারতো এইসব নোংরা সমাজ সভ্যতা রাষ্ট্র রাজনীতি। স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্র। যখন সে ঘর থেকে বেরোলো বুঝতে পারলো চড়ুইটি কৃপণ নয়, সে তাকে কিছু একটা দিয়ে গেছে, যা তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে সমাজ রাষ্ট্র; সব কিছুর দিকে তার তাকাতে ইচ্ছে করছে, আদর করতে ইচ্ছে করছে সব কিছুকে। সামনের রিকশাটিকে ভালো লাগলো তার, রিকশাটির পেছনের অদ্ভুত, প্রায়-পরাবাস্তব, ছবিগুলো ভালো লাগলো, কলসি-কাঁখে মেয়েটিকে খুব ভালো লাগলো, তার স্তন দুটি কাঁখের কলসির থেকে বড়ো, ওই স্তন যার আছে সে কেনো পানি আনবে কলসি ভরে?-তার অলৌকিক স্তন দুটি আঁকার সময় শিল্পীর হৃদয় যে-সুখে ভরে গিয়েছিলো, সে-সুখ, রাশেদকে স্পর্শ করলো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার ঘরটিতে কোমলভাবে ঢুকলো রাশেদ, যাতে ঘরটি টেরও না পায় সে এসেছে; চেয়ারটিতে বসে ঘরটির দিকে তাকালো, আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে ঘরটিকে, কিন্তু নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে; কয়েক বছর ধরে সে বসছে ঘরটিতে, ঘরটির দিকে একবারও ভালোভাবে চেয়ে দেখে নি; মনে। হচ্ছে ঘরটির সঙ্গে যদি কখনো রাস্তা, বাজার, উদ্যান, বা রেলগাড়িতে তার দেখা হয়ে যায় সে ঘরটিকে চিনতে পারবে না। ঘরটি কি তাকে চিনতে পারবে? ঘরটিকে সে। যেমন উপেক্ষা করেছে ঘরটি কি তাকে তেমন উপেক্ষা করে নি? কী কী নিয়ে এটি ঘর হয়ে উঠেছে, যার ভেতর রাশেদ ঢুকছে বেরোচ্ছে কয়েক বছর ধরে? ঘরটিতে কটা। জানালা আছে? পাখা কটা আছে? আলমারি কটা আছে? টেবিল কটা আছে? চেয়ার কটা আছে? আর কী আছে? ঘরটি যদি তাকে এসব জিজ্ঞেস করে সে উত্তর দিতে পারবে না, ঘরটি খুব অপমানিত বোধ করবে, তাকে ঘেন্না করবে, গোপনে গোপনে তার সাথে শক্রতাও করতে পারে। দুটি জানালা আছে ঘরটিতে, রাশেদ চেয়ে দেখলো জানালা দুটি বন্ধ, অনেক দিন সে খোলে নি জানালা দুটি, এই প্রথম তার চোখে পড়লো হলদে রঙ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে জানালার কাঁচ; বেশ হয়েছে, বাইরে গাছগুলো মাঝেমাঝে। যে-ভয়ঙ্কর আগুন জ্বালে, তাতে পুড়ে যেতে পারে রাশেদ, সুবিবেচক কর্তৃপক্ষ তা চায় না, তারা স্থির করেছে এ-ঘরে যে বসবে তাকে কোনো রকম আগুনেই পুড়তে দেয়া। হবে না। রাশেদ নিজেও পুড়তে চায় না। মাথার ওপর দুটি পাখা ঘুরছে দেখে সে অবাক হলো, এতো দিন সে মনে করতো ঘরে আছে একটা পাখা; পাখা দুটির কোনো একটির অস্তিত্বই সে স্বীকার করে নি, সেই অস্বীকৃত পাখাঁটির কথা ভেবে সে দুঃখ পেলো। একটি জীবিত ও একটি মৃত টিউব বাতি আছে ঘরটিতে; জীবিতাটি প্রাণপণে চেষ্টা করছে ঘরটি আলোকিত করে রাখার, যদিও পারছে না, এতোটা কর্তব্যনিষ্ঠা দুর্লভ হয়ে উঠেছে চারপাশে, তার দায়িত্ববোধের জন্যে রাশেদ তাকে ধন্যবাদ জানালো, মৃতটির জন্যে একটু কষ্ট লাগলো, হাসিও পেলো। দরোজার পর্দাটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো সে একটি দেয়াল দেখছে, যেনো ওখানে কখনো একটি সবুজ পর্দা ছিলো না, ওখানে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে একটি শক্ত দেয়াল, তার গায়ে শ্যাওলা ধরেছে। সে শিউরে উঠলো, তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো; একটু পরে পর্দাটি দুলে উঠলে তার ভয় কাটলো। পরমুহূর্তেই আবার একটি দেয়াল দেখতে পেলো রাশেদ, দেয়ালটি তাকে আটকে ফেলেছে; সে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে দেখলো তার সামনে দেয়াল, পেছনে দেয়াল, ডানে দেয়াল, বায়ে দেয়াল। দেয়াল তাকে ঘিরে ফেলেছে, তার কোনো উদ্ধার নেই। তার মনে পড়লো অনেক বছর ধরে সে চাঁদ দেখে নি, চাঁদ দেখতে। গেলেই চাঁদ ঢেকে দিয়ে একটা দেয়াল ওঠে, চাঁদের আলোর নিচে ঘুমন্ত গাছ দেখে নি, দেখতে গেলেই গাছের চারপাশে দেয়াল ওঠে, কুয়াশার ভেতর জোনাকি দেখে নি, রৌদ্রের আক্রমণে শ্রান্ত মানুষ দেখে নি, অনেক বছর বুকের ভেতরে সে শিশিরপাত বোধ করে নি, শিশির পড়তে থাকলেই সেখানে একটা দেয়াল ওঠে। এমন একটা কারাগার পাওয়া ভাগ্যের কথা এ-দেশে, তার সুখী থাকার কথা এ-কারাগারের ভেতরে, কিন্তু রাশেদের মনে হতে লাগলো সে দম ফেলতে পারছে না। তার মনে পড়লো ভোরের চড়ইটির মধুর মুখ।
রাশেদ তখন দরোজায় শুনতে পেলো তার পায়ের শব্দ। বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনির থেকে মধুর সে-স্যান্ডলের শব্দ, যে-শব্দে পাহাড় ভেঙে পড়ে দেয়াল ভেঙে পড়ে, মূখের নির্বোধ উচ্ছাস বলে মনে হয় সমাজ সভ্যতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সামরিক শাসনকে। ভেঙে পড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে সে রাশেদের ঘরে ঢুকলো; নতুন আমপাতার কম্পন অনুভব করলো রাশেদ, ওই কম্পনে তার ময়লাধরা আত্মা আর শরীর থেকে অনেকখানি ধুলো ঝরে পড়লো। রাশেদ তার নাম জানে না, অনেক আগে সে রাশেদের ঘরে ঢুকেছিলো, রাশেদ তার নাম দিয়েছিলো গোলাপ-মেয়ে, যাকে সে আর দেখতে। পায় নি, মাঝে একবার যাকে দেখার পিপাসা জেগেছিলো রাশেদের। রাশেদ একদিন। তাকে দেখার জন্যে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো, সামনের দিক থেকে আসা প্রত্যেক রিকশায় তাকে দেখতে পাচ্ছিলো, আর মনে হচ্ছিলো রিকশাগুলো তাকে নিয়ে রাশেদকে পেরিয়ে দূর দূরান্তে চলে যাচ্ছে, যতো দূরে রাশেদ কখনো যেতে পারবে না। রিকশাঅলাকে রাশেদ মালিবাগের দিকে যেতে বলেছিলো, যদিও রাশেদ জানে না। মালিবাগ কোথায়, শুধু জানে শহরের কোথাও মালিবাগ রয়েছে, নামটি সে অনেকের মুখে শুনেছে; তারপর যেতে বলেছিলো কলাবাগানে, তল্লাবাগে, র্যাংকিন স্ট্রিটে, ইস্কাটনে, মগবাজারে, আজিমপুরে, আরমানিটোলায়, জিগাতলায়, টিকাটুলি, ইব্রাহিমপুর, কচুখেত, নাখালপাড়ায়; একবার গোলাপবাগ নামের একটি জায়গায় যেতে বলেছিলো রিকশাঅলাকে, আর রিকশাঅলা এমনভাবে হেসেছিলো যার অর্থ শহরে। এ-নামে একটা পাড়া থাকলে ভালো হতো, তবে এ-নামের কোনো পাড়া নেই। তাকে খুঁজতে বেরিয়ে রাশেদ তাকে পায় নি, যদিও শহরের প্রায় সবার সাথেই তার দেখা হয়; একটা মন্ত্রী যাবে বলে পুলিশ পাগলের মতো বাঁশি বাজিয়ে তাকে মন্ত্রী দেখিয়েছিলো, পেট-ফোলা মন্ত্রীটাকে দেখে রাশেদ আনন্দ পেয়েছিলো, তার ইচ্ছে হয়েছিলো গাড়ির পতাকাটি তুলে নিয়ে ওই কোলাব্যাংটির পেটে একটা খোঁচা দিতে; মালিবাগের মোড়ে একটা রিকশা থেকে সালাম চোকদার নামে একজন, যে নাকি তার এক পুরোনো বন্ধু, ডাকাডাকি করতে থাকে, রাশেদের রিকশার সাথে তার রিকশা লাগিয়ে রাশেদকে থামায়। রাশেদ কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে, মাঝেমাঝেই এদিকে যায় কিনা, গেলে কখন যায়, সপ্তাহে ক-বার যায় সব বিষয়ে জানতে চায়; রাশেদ তার অন্তরঙ্গতায় মুগ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু রাশেদ কি তাকে বলতে পারে যে সে গোলাপ-মেয়েকে। খুঁজছে? রাশেদের ইচ্ছে হচ্ছিলো চোকদার গোয়েন্দা বিভাগে কতো দিন ধরে আছে। সে-সংবাদ জানার, কিন্তু রাশেদ কিছু না বলে হাত নেড়েছিলো। রিকশায় রিকশায় রাশেদ তাকে খুঁজেছে, প্রত্যেক রিকশায় তাকে দেখতে পেয়েছে, এবং সে রাশেদকে। পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। রাশেদের অবশ্য এম খোঁজা শাস্ত্রসম্মত নয়, কোনো রকম খোঁজাখুঁজিই তার জন্যে সিদ্ধ নয়, তবু রাশেদ খুঁজতে বেরিয়েছিলো, যা কেউ। কোনোদিন জানবে না। সে আজ এসেছে, চড়ুইটির মুখ আবার মনে পড়ে রাশেদের; রাশেদ তাকে বসতে বলে, সে দেয়াল-ঘেঁষে একটি চেয়ারে বসে, রাশেদ আবার পুরোনো গোলাপের গন্ধ পেতে থাকে।
রাশেদকে সে তার নামটি বলে; নামটির গায়েই অনির্বচনীয় সুগন্ধ আছে বলে মনে হয় রাশেদের। রাশেদ গোলাপের গন্ধ পাচ্ছে, অভাবিত গন্ধ, তার ঘরে এমন অভাবিতভাবে কেউ আসে নি, রাশেদের জীবনে অভাবিত বলে কিছু নেই, যেমন আর কারো জীবনেই কোনো অভাবিত শিহরণ নেই। রাশেদ কেনো গোলাপের গন্ধ পাচ্ছে? সে কেনো এসেছে। রাশেদের ঘরে তার মতো বালিকারা নিয়মিতই ঢোকে, যারা কোনো বিস্ময় নিয়ে আসে না, সব বিস্ময় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসে, এমনভাবে আসে যেনো শুকনো কাঠ দিয়ে তৈরি, আর একে মনে হচ্ছে সবুজ উদ্ভিদ, ডাল মেলছে, ডালে ফুল ফুটে আছে। রাশেদ শিউরে ওঠে, এবং বিব্রত বোধ করে। শিউরে উঠে সে অস্বস্তি বোধ করছিলো, বিব্রত বোধ করে সে স্বস্তি পায়। বাইরে গুলির শব্দ শোনা গেলো, মাঠে প্রস্তুতি চলছে গণতন্ত্রের, থেকে থেকে টাশ টাশ শব্দ হচ্ছে, বোমা ফাটছে, মনে হচ্ছে বারান্দায়ই; দৌড়োচ্ছে সবাই, রাশেদ শুকনো বোধ করতে শুরু করছে, কিন্তু বালিকা গোলাপের মতোই ফুটে আছে। রাশেদ বিস্মিত হয়। বালিকা বলে, আপনাকে আমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই। গুলি আর বোমার শব্দের রাশেদ ভয়। পায় নি, কিন্তু বালিকার প্রস্তাব রাশেদকে ভীত করে তোলে;-বালিকা কি জানে না তার বের হওয়ার অধিকার নেই, দেয়ালের ভেতরে থাকাই তার ও সকলের জন্যে স্বস্তিকর, বাইরে যাওয়া বিপজ্জনক? সে বাইরে গেলে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে পড়তে পারে, সমাজ ধসে পড়তে পারে। বালিকা আবার বলে, চলুন আমার সাথে, অনেক দূরে নিয়ে যাবো আপনাকে। বালিকা এমনভাবে কথা বলছে, রাশেদের মনে হচ্ছে সে একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ওই হাত নিয়তির মতো কাজ করছে, রাশেদ তা ফিরিয়ে দিতে পারছে না। রাশেদ তার সাথে ঘর থেকে বেরোয়, তার মনে হতে থাকে সে হাঁটতে ভুলে গেছে, বা কখনো হাঁটে নি, দরোজায় তালা লাগাতে গিয়ে তার ভুল হয়, আবার ভেতরে ঢুকে দেশলাই বাক্স খোঁজে, শেষে পকেটেই খুঁজে পায়। বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রাশেদ বুঝতে পারে বালিকা খুব উপভোগ করছে তার অবস্থা। বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় রাশেদ অনুভব করে সব কিছু কাঁপছে, দালানটি আর ছাদগুলো ধরে রাখতে পারছে না, মাথার ওপর ভেঙে পড়ছে। বাইরে তখন প্রচণ্ড কোলাহল, কজন মারা গেছে রাশেদ জানে না; দূরের বারান্দা দিয়ে দৌড়ে আসছেন ডক্টর আহমেদ, ৬৪, চিৎকার করে বলছেন তিনজন মারা গেছে, ভয় পেয়ে তিনি নিজের ঘরের দিকে দৌড়োচ্ছেন, কিন্তু রাশেদ আর বালিকার কাছে এসে তিনি হঠাৎ দাঁড়ান। বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ, যেনো শেষ মুহূর্তের আগে তিনি শান্তিদায়ক কিছু দেখছেন, তার প্রাণ ভরে উঠছে, এখন তিনি গোলাগুলির ভেতর দিয়ে শান্তভাবে চলতে পারবেন। বালিকা ডক্টর আহমেদের মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে, যেনো সে কোনো ডালে ফুটে আছে, এবং ডক্টর আহমেদের হাত ধরে বলে, আপনার ঘরে চলুন। শিশুর মতো তার সাথে হাঁটতে থাকেন ডক্টর আহমেদ, নিজের ঘরের সামনে এসে বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বলেন, আর ভয় পাবো না।
কতো দূরে যেতে হবে, কতো দূরে গেলে বেঁচে উঠবে রাশেদ, বালিকা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? রাশেদের ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বাল্যকালে, এ-বালিকা, যার মাংস থেকে গোলাপের গন্ধ বেরোচ্ছে, সে কি রাশেদকে বাল্যকালে, খেজুরডালের নিচে কুমড়োপাতার পাশে, নিয়ে যেতে পারবে? বালিকার পাশে হাঁটতে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেনা ভবনটিকেই তার অচেনা মনে হচ্ছে, যেনো এই প্রথম এখানে ঢুকেছে, তিনটি নদী পেরিয়ে বহু মেঠো পথ হেঁটে এখানে এসেছে, দেয়ালের কুৎসিত ভুল বানানের লেখাগুলোকেও মনোরম লাগছে। বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা ঝলমলে আলো এসে পড়লো তার মুখের ওপর, মনেই হচ্ছে না এখানে কিছুক্ষণ আগে লড়াই হয়ে গেছে, তিনজন নতুন শহিদ জন্ম নিয়েছে; দূরে আমগাছের নিচে বসে আছে। একজোড়া বালকবালিকা, দুজনই খুব ক্লান্ত, বড়ো বেশি ক্লান্ত, তাদের হৃদয় আর শরীর কোনোটিই আর প্রেমে রাজি নয়, বা তারা কখনোই প্রেম অনুভব করে নি তবু দিনের। পর দিন বসে আছে আমগাছের নিচে, দুজনই নিজেদের পরিত্যাগ করে তাকিয়ে আছে রাশেদ ও বালিকার দিকে। ওই বালকবালিকা দুটি এখন আর তারা নয়, তারা হয়ে। উঠেছে রাশেদ ও এই বালিকা; রাশেদ কি তাদের ডেকে বলবে এখানে নয়, এ-জীর্ণ আমগাছের নিচে কিছু পাবে না, অনেক দূরে যাও? রাস্তায় আসতেই অনেকগুলো রিকশা ভিড় করে এলো, দুটি বালক যারা রাশেদকে দেখলে মহাপুরুষের মতো সাধারণত চলে যেতো, আজ তারা সালাম দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, গুরুত্বপূর্ণ জরুরি কিছু আলোচনার আছে তাদের; দাঁত-উঁচু ছেলেটাকে বেশ লাগলো রাশেদের, এইমাত্র গাঁজা টেনে সুন্দর হয়ে এলো হয়তো। অধ্যাপক সালামত আলিও এদিকেই আসছেন, নিশ্চয়ই কোনো নতুন তত্ত্ব তাঁর মাথায় ঘুরছে, তিনি হয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কয়েক বছরের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছেন, রাশেদকে তা শুনতে হবে। তিনি রাশেদের সামনে এসে কোনো তত্ত্বই আলোচনা করলেন না, শুধু বললেন, বাহ্, মেয়েটি তো সুন্দর, তবে একে তো আপনার মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। রাশেদ ব্ৰিত বোধ.করছে তিনি বুঝতে পারছেন, তবে তার দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে। রাশেদ কি এ-লোকটিকেও সাথে নিয়ে নেবে, তার তো অনেক আগেই অনেক দূরে। যাওয়া উচিত ছিলো, এখন গেলে কি কোনো উপকার হবে? এখন যদি মমতাজ এসে উপস্থিত হয়? রাশেদ তাকে কী বলবে? মমতাজ এসে যদি দেখে সে বালিকার পাশে রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাঅলারা তাদের ঘিরে ধরেছে, মমতাজ কি বলবে, বাহ্, সুন্দর মেয়ে তো, যাও একটু বেড়িয়ে এসোর বালিকা রিকশায় উঠে বসেছে, রাশেদ কী করে ওই রিকশায় উঠবে? রাশেদের মনে হচ্ছে রিকশাটি মেঘের সমান উঁচু, সে অতত উঁচুতে উঠতে পারবে না; এক সময় সে মেঘকে জুতোর মতো পরে আকাশ। জুড়ে হাঁটতে পারতো, এখন আর তার পা অত উঁচুতে উঠতে অভ্যস্ত নয়। বালিকা বা হাত বাড়িয়ে দিলে রাশেদ একটি আশ্রয় পায়, হাত ধরে সে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে। থাকে, মেঘের ওপর উঠে বসে।
রিকশাঅলা ব্যস্ত হয়ে পড়ে হুড তুলতে; মনে হচ্ছে সে অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ, নাম-না-জানা কোনো শরিয়াবিশেষজ্ঞও হতে পারে, আজকাল পথে পথে শরিয়াবিশেষজ্ঞরা ছড়ানো, বা সে জানে রাশেদ আর বালিকার মতো যারা রিকশায় ওঠে, তারা ওঠে হুডের ভেতরের ঘন ছায়াটুকুর জন্যেই, বাইরের আলোর জন্যে ওঠে না, চারপাশে ছায়ার আকাল আজকাল। রাশেদ কি লুকিয়ে দূরে যাবে? সে কি অপরাধ করে চলছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, জেনার মতো পাপ করছে, তাকে ধরে কি পাথর ছুঁড়ে মারা হবে, সাথে এ-বালিকাটিকেও? সে কি ব্যাংকক সিঙ্গাপুর যাচ্ছে বালিকাটিকে নিয়ে, সে যদি তিরিশ কোটি ঋণকরা শিল্পপতি হতো, তাহলে কি আজ সে থাই বিমানের এক জোড়া। টিকেট কিনতো? বালিকাটি বাসায় বলে আসতো দিল্লি যাচ্ছে, একটি বৃত্তি পেয়েছে এক সপ্তাহের জন্যে, আর রাশেদ গম্ভীরভাবে রটিয়ে দিতো দশ মিলিয়ন ডলারের একটা কাজে টোকিয়ো যাচ্ছে। রাশেদের এক বন্ধু তো মাঝেমাঝেই এমন ব্যবসায়ে দিল্লি ব্যাংকক যাচ্ছে, তার স্ত্রীটিই গর্বের সাথে সংবাদটা পোঁছে দেয় মমতাজকে; ফেরার সময় এতো শাড়ি আর লিপস্টিক নিয়ে আসে যে স্ত্রীটি পাগল হয়ে যায়, স্বামীর যন্ত্রপাতির খবর নেয়ার কথা মনে থাকে না। অবশ্য স্ত্রীকে নিয়ে বছরে একবার সে হজে যায়, দুজনেই নতুন নতুন মাথার পাগড়ি কিনে ফেরে, স্ত্রীটি নামাজ পড়তে পড়তে আর স্বামীর হায়াতের জন্যে দোয়া করতে করতে দুনিয়ার কথা ভুলে যায়। সে কি তেমন। কিছু করছে? রিকশাঅলাকে সে হুড তুলতে নিষেধ করে, সে দূরে যেতে চায় আলোর। ভেতর দিয়েই, গাছের জলের শিশিরের ঘাসের দিগন্তের কাছে যাওয়ার সময় সে নিজের কাছে কোনো পাপ করবে না। তবে সামন পেছন থেকে যে-গাড়ি, ট্রাক, রিকশাগুলো আসছে, আর পথ দিয়ে যারা হাঁটছে, তারা যদি ঘিরে ধরে তাদের? রাশেদ যার মুখের দিকেই তাকাচ্ছে তাকেই মনে হচ্ছে খুব ক্রুদ্ধ, তারা যেনো রাশেদ ও বালিকার সম্পূর্ণ বিবরণ চাইছে, বিস্তৃতভাবে জানতে চাইছে তাদের সম্পর্ক। রাশেদের মনে হয় সবাই। রাশেদ ও বালিকার দিকে তাকিয়ে আছে, এখনই তারা রিকশা থামিয়ে জানতে চাইবে, তারা কোথায় যাচ্ছে? বালিকার সাথে সে রিকশায় উঠেছে কেনো? বালিকার শাড়ির। মসৃণতা সে টের পাচ্ছে, তার শাড়িতে লেগে বাতাসও মসৃণ হয়ে উঠেছে, বালিকার ডান বাহুটি নিশ্চয়ই রাশেদকে ঘেষে পড়ে আছে, রাশেদের মনে হচ্ছে তার বা বাহুটি কয়েক জন্ম ধরে স্থাপিত হয়ে আছে কোনো কোমল বস্তুর ওপর। বালিকা কথা বলছে, শুধু দূরের কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে কখনো কাছাকাছি কোথাও যায় নি, কয়েক জন্ম আগে থেকে সে শুধু দূরেই যাচ্ছে। কিন্তু রিকশার শেকল পড়তে শুরু করেছে অনবরত, রিকশাঅলা সম্ভবত শেকল পড়ার ব্যবস্থা করেই বেরিয়েছে, সে নেমে শেকল লাগাচ্ছে, উঠতে না উঠতেই আবার পড়ছে; দূরে যাওয়া সহজ নয়। রিকশাঅলা আর যেতে পারবে না। দু-মাইলও আসা হয় নি, অনেক দূরে যেতে হবে, রাশেদ রিকশাঅলাকে দশটি টাকা দেয়। রিকশাঅলা তা নেবে না, তাকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে, রাশেদ আর বালিকা খুব অবাক হয়। রিকশাঅলার মুখটা বদলে গেছে, শুয়োরের মুখ এসে সেঁটে বসেছে তার মুখে, ঘোৎ ঘোঁৎ করে সে বলে, মাইয়ালোক লইয়া বেড়াইতে বাইর অইছেন, পঞ্চাশ ট্যাকা দেন, নাইলে অপমান অইয়া যাইবেন। লোকটিকে তো এমন বদমাশ মনে হয় নি, সে তো বালিকাকে আফা আফা করছিলো ওঠার সময়; তবে কি সে রাশেদ ও বালিকার সম্পর্ক এরই মাঝে ভালোভাবে পড়ে উঠেছে, বুঝতে পেরেছে তারা কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না? রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, বালিকা শুধু বলে, অসভ্যে দেশ ভরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে একটি নোট বের করে রিকশাঅলাটিকে কাছে ডেকে বলে, আপনার মতো ইতর আমি দেখি নি, এবং নোটটি তার মুখে ছুঁড়ে দেয়।
দূরে যেতে হলে একটা ইস্কুটার নিতে হবে, রাশেদ হাত নেড়ে একটা ইস্কুটার ডাকে, ইস্কুটারঅলা এসেই জানতে চায় তারা কোথায় যাবে। রাশেদ জানে না কোথায়। যাবে, শুধু জানে দূরে যাবে; ইস্কুটারঅলাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গার নাম বলতে হবে, কিন্তু রাশেদ কোনো নির্দিষ্ট নাম জানে না। রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়; বালিকা বলে, আমরা নদী দেখতে যাবো। ইস্কুটারঅলা মিষ্টি করে হাসে, নদীর ঠিকানায় যাওয়ার জন্যে তার ইস্কুটারে এখন পর্যন্ত কেউ ওঠে নি বলেই মনে হয়, তার হাসিটা খুব নোংরা লাগছে না, তবে হাসিটা এক সময় শুয়োরের হাসি হয়ে উঠবে না তো? সে বলে টঙ্গি গেলে একটি নদী পাওয়া যাবে, নদীটা পুলের নিচ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে, তার নাম তুরাগ, নদী দেখতে ইচ্ছে হলে তারা সেখানে যেতে পারে। রাশেদ আর বালিকা নদীর স্বপ্ন দেখেছে, তবে তার বাস্তবকে কোথায় পাওয়া যাবে তা জানে না, ইস্কুটারঅলা জানে; কিন্তু সত্যিই কি এ-নামে কোনো নদী আছে? তারা ইস্কুটারে উঠে বসে। তুরাগের পারে এসে তারা নদী খোঁজে, কোনো নদী খুঁজে পায় না; ঘাটের মাঝিরা তাদের ঘিরে ধরে, বলতে থাকে এটাই তুরাগ নদী, ডাকতে থাকে নৌকোয়। ওঠার জন্যে, নৌকো করে তারা রাশেদ ও বালিকাকে নদী দেখিয়ে আনবে। ঘাটে বড়ো ধরনের একটা ভিড় জমে গেছে, তাদের কি বড়ো বেশি অচেনা লাগছে এই সব। মানুষদের; তাদের দেখে কি বিস্মিত হচ্ছে মাঝিরা, নাকি তাদের ছিঁড়ে খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে? বালিকার দিকে মাঝিদের চোখ পড়ে থাকছে, মনে হচ্ছে শাড়ি খুলে তারা। দেখছে বালিকাকে, মরিচ দিয়ে পান্তাভাতের মতো তাকে খাচ্ছে, এবং রাশেদের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হয়তো তারা এমন কিছুই ভাবছে না, ভাবছে তাদের বেড়াতে নিতে পারলে বেশ টাকা পাবে। রাশেদ ও বালিকা বুড়ো মাঝিটির নৌকোয় ওঠে, মাঝিটিকে বুড়োই মনে হয়, চুল পেকে এসেছে, খুব রোগা; বালিকা এবং রাশেদ দুজনেই তাকে পছন্দ করে। তারা দুজনেই এ-রোগা মাঝিটিকে পছন্দ। করলো কেনো? ডাকাতের মতো সবল কয়েকটি মাঝি তো তাদের নেয়ার জন্যে কম দামও বলছিলো, কিন্তু তারা একে পছন্দ করলো কেননা? রাশেদ ও বালিকা কি একেই নির্ভরযোগ্য মনে করেছে, এর থেকে ভয়ের সম্ভাবনা কম বলে? গলুইর দিকে দাঁড়িয়ে তারা নদী দেখছে, হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে দেখছে, বালিকার শাড়ির পাড় উড়ে এসে রাশেদের মুখের ওপর পড়ছে, দূরে সারিসারি তালগাছ দেখা যাচ্ছে, বালিকা তার। মুঠোতে রাশেদের বাঁ হাতটি তুলে নিচ্ছে। রাশেদের মনে হচ্ছে সে অনেক দূরে এসেছে, এতো দূরে বহু বছর সে আসে নি। মাঝিটি এমন সময় ডাকে রাশেদকে, তারা দুজনই, মাঝির দিকে তাকায়। মাঝিটি বলে, খাড়ইয়া খাড়ইয়া পানি দেইখ্যা কি অইব, ঝাঁপ লাগাইয়া দুইজনে হুইয়া আনন্দ করেন, আনন্দ করনের লিগাই ত সাবরা নাও ভাড়া। নেয়। বুড়োটার মুখের দিকে তাকিয়ে রাশেদের ঘেন্না লাগে; তার মনে হয় এক নদী মলের ওপর দিয়ে চলছে নৌকোটি, এখনি ডুবে যাবে, তারা দুজন মলের ভেতরে তলিয়ে যাবে। বালিকা মাথা নিচু করে থাকে, সে পানি থেকে তার হাত তুলে নিয়েছে, দূরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, সব কিছু বড়ো বেশি নোংরা হয়ে গেছে, এই মাঝিটি তো নোংরা না হলেও পারতো। দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটি নৌকো বেরিয়ে আসছে, নৌকোগুলো এদিকে আসতে পারে, ওখানেও থাকতে পারে, তারা এক সাথে বেরিয়ে এলো কেনো? ওই নৌকোর মাঝিরা কি দেখতে পেয়েছে তাদের, দেখেছে একটি বালিকা দাঁড়িয়ে আছে ছইয়ের সামনে, এবং এ-নৌকোটিকে ঘিরে ধরতে পারলে চমৎকার হবে? রাশেদ মাঝিকে নৌকো ফেরাতে বলে, তাদের আর মলের নদী দেখার সাধ নেই। মলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের নৌকোটি এসে ঘাটে লাগে।
এখন কোথায় যাবে বালিকা আর রাশেদ? ফিরে গিয়ে মনে মনে দেখতে থাকবে মলনদী, দেখবে মলের ভেতরে ভয়ঙ্করভাবে ডুবে যাচ্ছে তাদের নৌকো, তারা সাঁতার কাটছে মলের ভেতরে, উঠতে পারছে না, আর নিঃশব্দে চিৎকার করবে? নাকি সম্পূর্ণ শহরটাকে ভীষণভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠবে? তাদের কি এখনো সাধ আছে দূরে যাওয়ার? রাশেদের নেই, সে নরকে ফিরে যেতে পারলেই স্বস্তি পাবে; কিন্তু বালিকার চোখ থেকে এখনো দূরের স্বপ্ন মুছে যায় নি। বালিকাটির পাখি হওয়া উচিত ছিলো, ছোটো কোনো পাখি, তাহলে সে উড়ে উড়ে যেতে পারতো; আরেকটি পাখিও হয়তো সে পেতো, উড়ে যেতে পারতো তার সাথে অরণ্যে নদীর পারে শাপলার বিলে। রাশেদ পাখি নয়, অন্তত দশ বছর ধরে পাখি নয়, কখনো আর পাখি হয়ে উঠবে না। বালিকা অরণ্যে যেতে চায়, কয়েক মাইল উত্তরেই অরণ্য, যেখানে শালগাছ দেখা যাবে, পাখি দেখা যাবে, ঘাসের ওপর দিয়ে লাউডগার মতো প্রবাহিত সাপও দেখা যেতে পারে। রাস্তায় আসতেই বাসগুলোর বাচ্চাগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে তাদের দেখে, রাশেদ ও বালিকার চোখমুখ দেখেই বাচ্চাগুলো বুঝে ফেলেছে তাদের অরণ্যে যেতেই হবে। বালিকা আর রাশেদ একটি বাসে উঠে বসে, তাদের ওঠার সময় বাসটি তার সম্পূর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে তাদের সম্পর্কে বিচারবিবেচনা শুরু করে। পেছনের আসনের বুড়ো লোকটি ঘুমোচ্ছিলেন, এখন তিনি চোখ মেলে বালিকা ও রাশেদকে বিশ্লেষণ করছেন; দু-আসন আগের মাস্তান, বা উত্তরের কোনো এলাকার গৌরব দুটি, যারা রাজধানিকে ধন্য করে নিজেদের সাম্রাজ্যে ফিরছেন, পকেট থেকে সোনালি বাক্সের সিগারেট বের করে দামি ধুয়োয় এদিকটা আচ্ছন্ন করে ফেলছেন। গৌরব দুটি তাদের সাথে সাথে বাস থেকে নামবে না তো? অরণ্যের পাশে এসে বালিকা আর রাশেদ বাস থেকে নামে, তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে, কাঞ্চন জ্বলছে সবুজের ভেতর, মুঠো ভরে ওই সোনা বুকে রাখতে পারলে অনেক দিন কোনো অসুখ করবে না। রাশেদের জানা ছিলো না অরণ্যে ঢুকতে হলেও টিকেট কিনতে হয়, পঞ্চাশজনের টিকেট কিনতে হয়। তারা এখন পঞ্চাশজন কোথায় পাবে? রাশেদ কি। বাসের সকলকে অনুরোধ করবে তাদের সাথে অরণ্যে দেখার জন্যে ঢুকতে? তারা কি অরণ্য দেখতে রাজি হবে? আবার সবায় যদি বালিকাটির সাথে অরণ্য দেখার জন্যে বাস থেকে নেমে আসে? রাশেদ ও বালিকা ভেতরে ঢোকে, ঢুকেই বুঝতে পারে তারা নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়েছে, বা অত্যন্ত দূষিত মানুষ তারা, পবিত্র অরণ্য নষ্ট করতে এসেছে; অরণ্যের পবিত্রতা অক্ষত রাখার জন্যে একপাল প্রহরী পাহারা দিচ্ছে তাদের। নাকি এরা অরণ্যের বাঘ, একটু ভেতরে ঢুকলেই লাফিয়ে পড়বে তাদের ওপর? বালিকা প্রায় প্রতিটি গাছের নাম জানে, রাশেদকে গাছের নাম শোনাচ্ছে মন্ত্রের মতো, নামগুলো। রাশেদের ভেতরে ঢুকছে না, সে দেখতে পাচ্ছে দূরে একটা গাছের আড়ালে একটি লোক লুকোনোর চেষ্টা করছে। রাশেদ বালিকাকে নিয়ে ডান দিকের পথটিতে ওঠে, লোকটি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে আসতে থাকে; রাশেদ একটা প্রস্তুতি নেয় মনে মনে, লোকটিকে অবশ্য হিংস্র মনে হচ্ছে না, বিনীতভাবেই সে রাশেদের সামনে। এসে দাঁড়ায়। লোকটির দেশিবিদেশি সব ধরনের জিনিশ আছে; কিন্তু রাশেদের। দেশিবিদেশি, কেরু বা স্কচ, কিছুই লাগবে না; বালিকা প্রথমে বুঝতে পারে নি, বুঝতে পেরে খুব মজা পায়; লোকটিকে বলে, নিয়ে আসুন না, খেয়ে দেখি কেমন লাগে। লোকটি উৎসাহিত হয়, জামার ভেতর থেকে একটা বোতল বের করে বালিকার দিকে বাড়িয়ে দেয়, বালিকা না, না করে ওঠে; লোকটি উত্তর হিশেবে না শুনতে রাজি নয়, বলে যে আফারা আজকাল জঙ্গলে এসেই জিনিশ খেতে পছন্দ করেন। এক আফা তো বোরখা পরেই আসেন, আধা বোতল তাঁর একারই লাগে। বাঙালি মুসলমান বেশ হুইস্কি খাচ্ছে, জঙ্গলে এসেও খাচ্ছে, বা খাওয়ার জন্যেই জঙ্গলে আসছে, বেশ বিকাশ ঘটছে তাদের;–লোকটিকে এড়ানো যাচ্ছে না, চলে যাচ্ছে, আবার ঘুরে আসছে; সে কি ভাবছে রাশেদ সাড়া দেবেই অবশেষে, একটি বালিকাকে নিয়ে জঙ্গলে বসে মাতাল হওয়ার সুখ সে হারাবে না? রাশেদ গাছের দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না, বালিকা পাতার সবুজের দিকে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে তারা মেথরপট্টিতে এসে পড়েছে।
আরেকজন এগিয়ে আসছে, উর্দি দেখে মনে হচ্ছে অরণ্য দেখাশোনার ভার তারই ওপর, চমৎকার সালামও দিতে শিখেছে লোকটি, সালামেই বোঝা যাচ্ছে তার সেবা। পাওয়া যাবে প্রভূতপরিমাণে। আল্লা/ঈশ্বরবুদ্ধ/জেসাসলাত/মানত/উজ্জা/রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ, রাশেদকে সে উদ্ধার করে হুইস্কির গ্রাস থেকে, অরণ্যটা যে বদমাশে ভরে গেছে তার একটা চাঞ্চল্যকর বিবরণ সে দেয়; গতকাল যে-খুনোখুনিটা হয়ে গেছে, তার কাহিনীও শাহেরজাদির দক্ষতায় বর্ণনা করে। বন্ধুর বউকে নিয়ে এক সাব এসেছিলেন, চারটা গারমেন্টস আছে, হাজার টাকা বকশিশ দেন, উঠেছিলেন দূরের কুটিরটিতে, ওই কুটিরটিই তিনি পছন্দ করেন, এবং ঘন্টা দুই পর পিস্তল নিয়ে বন্ধু তার বউকে উদ্ধার করতে আসেন। দরোজা ভেঙে দুজনকে ন্যাংটো ধরে ফেলেন, গোলাগুলি শুরু হয়ে। যায়। সে নিজে বদমাশ নয়, সাধু, সরকার তাকে অরণ্য পাহারার ভার দিয়েছে, কুটিরগুলো সে দেখাশোনা করে, এবং সাবদের। রাশেদ বুঝতে পারে তার নিপুণ কাহিনীবর্ণনা ও দ্রতার পেছনে কী আছে, একটু পরেই সে জানতে চায় রাশেদদের কুটির লাগবে কিনা। ভালো একটা কুটিরের সে ব্যবস্থা করে দেবে, কোনো ভয় নেই, বদমাশরা ধারেকাছে ঘেষতে পারবে না, ইচ্ছে করলে দু-তিন ঘণ্টা দরোজা বন্ধ করে বিশ্রাম করতে পারবে। বিশ্রাম এবং করা। না, তারা বিশ্রাম এবং করতে আসে নি, শালগাছ দেখতে এসেছে, শালগাছের পাতায় তুচ্ছ সোনা দেখতে এসেছে। লোকটির গোপন একটি কথাও আছে রাশেদের সাথে, রাশেদকে সে ডেকে একটু দূরে নিয়ে যায়, বালিকার সামনে কথাটি বলতে চায় না, রাশেদের রাজা লাগবে কিনা খুব অন্তরঙ্গভাবে জিজ্ঞেস করে; কুটির নিলে রাজাও সে সরবরাহ করবে, কোনো অসুবিধা হবে না। রাশেদ কি তাকে বলবে ব্যাগ ভরে সে রাজা নিয়ে এসেছে, যতোটুকু সময় আছে তারা একের পর এক রাজা পরতে ও খুলতে থাকবে। লোকটিকে একটি চড় দিতে পারলে বেশ হতো, কিন্তু এটা চড় দেয়ার জায়গা নয়। রাশেদ লোকটিকে একটু বিব্রত করতে চায়, বলে একটা কুটির তার দরকার, তবে যে-কোনোটি নয়, বড়ো কুটিরটি, যেটা দেখে সত্যিই তার পছন্দ হয়েছে। লোকটি ব্ৰিত হয়, ওটা ভারি গুরুত্বপূর্ণদের জন্যে, বড়োসাবরা এলে ওখানে ওঠেন, আগেই খবর দিয়ে আসেন; তাছাড়া ওটা এখন ব্যস্ত, এক বড়োসাব এক নায়িকাকে নিয়ে উঠেছেন ওটিতে, ওটির ধারেকাছেও ঘেষা নিষেধ। রাশেদ বড়োসাব নয়, বালিকাটিও নায়িকা নয়, বড়োসাব না হওয়ার জন্যে যে কতো কিছু হারাতে হচ্ছে তাকে! লোকটিকে সম্পূর্ণ অসন্তুষ্ট করে কি শালগাছ দেখা যাবে, লোকটির ইশারায় শালগাছ থেকে কি বাঘ নেমে আসবে না? রাশেদ তাকে বিশ টাকার একটি নোট দেয়ে একটি কাজের ভার দেয়; একটু দেখেশুনে রাখতে হবে তাদের, তারা শালগাছ দেখবে, একটু হাঁটবে, তখন যেনো তাদের ওপর বাঘভাল্লুক লাফিয়ে পড়ে।
প্রতিটি ঝোঁপই সুন্দর, দূর থেকে, মনে হচ্ছে সামনের ওই ঝোঁপটির ভেতরে গেলেই গাছের পাতা থেকে গায়ে লাগবে সবুজ রঙ, পত্রপত্রালির অমল সবুজ, নিশ্বাস নিতে সুখ লাগবে, কাছে গেলে আর তেমন লাগছে না, সবুজকে ময়লাধরা মনে হচ্ছে; বালিকা। এক ঝোঁপ পেরিয়ে আরেক ঝোপে যাচ্ছে, কথা বলছে, গাছের মতো সবুজ হয়ে উঠছে, কিন্তু রাশেদের অস্বস্তি কাটছে না, প্রতিটি গাছ পাহারা দিচ্ছে তাকে, ভয় পাচ্ছে -কোনো সময় গাছগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর। দূরের ঝাউগাছটিকে দেখাচ্ছে অনেকটা মমতাজের মতো, চুপচাপ রাশেদ ও বালিকাটিকে দেখছে, কাছে গেলেই অনেকগুলো বিরক্তিকর প্রশ্ন করবে, রাশেদ উত্তর দিতে পারবে না, অনেকগুলো দিনরাত মুমূর্ষ হয়ে উঠবে। এ-ঝোঁপটি বেশ নিবিড়, কাছেই হদে গাছের ছাড়া সবুজ ঘন গম্ভীর হয়ে আছে, মনে হচ্ছে জলের ভেতরে একটা অরণ্য আছে, বালিকা বসতে চাইছে, রাশেদেরও ইচ্ছে করছে বসতে; অনেক বছর এমন ছায়ায় সে বসে নি, যতো দিন বাঁচবে হয়তো বসতে পারবে না। বালিকা ও রাশেদ ঘাসের ওপরে বসে পরস্পরের দিকে। তাকায়, যেনো অনেক বছর পর এইমাত্র দেখা হলো, কুশলবিনিময় করা হয় নি এখনো; এখন জিজ্ঞেস করতে হবে, কেমন আছো? তখন চিৎকার করে দু-দিক থেকে দুটি। লোক তাদের ঘিরে ফেলে, হঠাৎ চিৎকার শুনে রাশেদ ও বালিকা লাফিয়ে ওঠে। লোক দুটি তাদের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, লুঙ্গিপরা লোকটির হাতে একটি কাস্তে, চোখ জ্বলজ্বল করছে তাদের, এখনি আক্রমণ করবে মনে হচ্ছে; তারা চিৎকার করে বলছে, হারামির বাচ্চারা জঙ্গলে আইয়া কুকাম করতাছ, তোমাগ দ্যাখাইয়া দিমু। কী কুকাম করছে তারা? করলে এদের কী? কুকাম করতে চাইলে তারা একটা কুটির ভাড়া নিয়েই তো। করতে পারতো। নরক তাহলে রাশেদকে ছাড়ে নি, সে শহর ছেড়ে নদীতে যেতে পারে, কিন্তু নরক ছেড়ে যেতে পারে না; সে শহর ছেড়ে অরণ্যে যেতে পারে, কিন্তু নরক ছেড়ে যেতে পারে না। রাশেদ কি চিষ্কার করবে? কোনো লাভ হবে তাতে? তর্ক করবে এদের সঙ্গে কোনো উপকার হবে তাতে? মারামারি করবে? সেটা খুবই খারাপ হবে। তারা যেহেতু এখনো আক্রমণ করে নি, সম্ভবত আর আক্রমণ করবে না, তারা শান্তিপূর্ণভাবেই কিছু চায় বলে মনে হচ্ছে। একটা পরিস্থিতি তৈরি করে কিছু খসাতে চায়, তোক দুটি কুকামের কথাটাই বলছে বারবার, এটাই হয়তো সবচেয়ে মারাত্মক যুক্তি, জঙ্গলে এসে একটি পুরুষ আর একটি বালিকা কুকাম ছাড়া কী আর করতে। পারে?-কিন্তু রাশেদ কিছুই খসতে দেবে না, তবে সাবধান হতে হবে। একটা লোক একটু বেশিই চাঁচাচ্ছে, সুনীতির জন্যে তার দরদ একটু বেশিই, লোকটিকে একটা। লাথি মারতে পারলে শান্তি পাওয়া যেতো; রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, বালিকা ভয় পায় নি দেখে স্বস্তি পায়। সে বালিকার হাত ধরে ঝোঁপ থেকে বেরোনোর জন্যে পা। বাড়ায়, সুনীতি-মিয়া তা অনুমোদন করে না, পথ আটকে দাঁড়ায়, তাদের বেরোতে দেবে না ঝোঁপ থেকে। কাস্তে-মিয়ার হাতে বেশি সময় নেই, ঘাস কাটা রেখে হয়তো। সুনীতি-মিয়ার ডাকে উঠে এসেছে; সে কয়েক শো টাকা দাবি করে, ওই টাকাটা দিলে কোনো ঝামেলা হবে না। টাকা যখন ব্যাপার তখন নিশ্চয়ই বেশি জটিলতা নেই, এখন আর আক্রমণ করবে না, বালিকাটিকে ধর্ষণ করতে চাইবে না। কিন্তু রাশেদ কেনো তাদের টাকা দেবে? টাকা দেয়ার অর্থ কি এ নয় যে তারা কুকাম করছিলো, কুকাম করার সময় মৌলভিসাবদের হাতে ধরা পড়ে গেছে, তার দণ্ড হিশেবে টাকাটা দিচ্ছে? এদের সাথে সততা করবে রাশেদ, না, প্রতারণা করার একটা উদ্যোগ নেবে? রাশেদ। একবার তাকিয়ে দেখলো ঝোঁপ পেরিয়ে কাউকে দেখা যায় কিনা, দূরে কয়েকটি লোকের মাথা দেখা যাচ্ছে, ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে হ্রদের পাড়ের পথটিতে নামতে পারলেই তাদের ডাকা যায়। রাশেদ পাছপকেটি হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করার চেষ্টা করতে থাকে, তোক দুটিকে বেশ প্রস্তুত মনে হচ্ছে, ব্যাগটা বেরোলেই লাফিয়ে পড়বে, তবে ব্যাগটা বেরোচ্ছে না, রাশেদ ব্যাগটা এতো শিগগির বের করবে না; রাশেদ। সুনীতি-মিয়াকে বললো যে ঝোঁপের বাইরে গিয়েই সে টাকাটা দেবে। বালিকাকে বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে মানিব্যাগ বের করার চেষ্টা করতে করতে রাশেদ রাস্তায় এলো, সুনীতি-মিয়া তার সাথে সাথে আসছে, কাস্তে-মিয়া দাঁড়িয়ে আছে ঝোঁপের ভেতরে, আজ তাকে আর ছাগলের জন্যে ঘাস কাটতে হবে না। দূরে কয়েকটি লোক দেখা যাচ্ছে, রাশেদ হঠাৎ সুনীতি-মিয়ার মুখে একটা ঘুষি মারলো, জীবনে এটাই তার প্রথম ঘুষি, সে নিজেও ভাবে নি ঘুষিটা এতো শক্ত হবে, সুনীতি-মিয়া উল্টে পড়ে গেলো। রাশেদ চিৎকার করলো না, লোক জড়ো করার দরকার নেই, চিৎকার শুনে যারা ছুটে আসবে তারাও অন্য ধরনের মিয়া হবে। সুনীতি-মিয়া মাটিতে পড়ে গেছে, উঠতে সময় লাগবে, উঠে আর তাদের দিকে আসবে বলে মনে হচ্ছে না, কাস্তে-মিয়া নিশ্চয়ই ঘাস। কাটতে চলে গেছে; রাশেদ আর বালিকা একটু তাড়াতাড়ি, দৌড়ে নয় হেঁটে, গল্প করার চেষ্টা করতে করতে, বড়ো কুটিরটির দিকে এগোতে লাগলো। একটু আসতেই দেখা। হলো সে-লোকটির সাথে, যে রাশেদকে একটা কুটির দেয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা। করেছিলো; সে জানতে চাইলো কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা; রাশেদ বললো, না।
রাশেদ বুঝতে পারছে না তার কেমন লাগছে, বালিকাটিকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হচ্ছে না, জিজ্ঞেস করাটাকে তার মনে হচ্ছে নিষ্ঠুরতা, সবচেয়ে ভালো সম্পূর্ণ ভুলে। যাওয়া যে তারা অরণ্য দেখতে এসেছিলো, দোজখ থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলো। তাদের কি কেউ নিমন্ত্রণ করছে, যতো দূরেই তারা যাক তার জালটি সে ছড়িয়ে দিচ্ছে, ধরে ফেলছে পুঁটিমাছের মতো কিছুতেই তারা দূরে যেতে পারবে না। তাদের সামনে একটা বাসযাত্রা পড়ে আছে, ওই বাসে যে দু-একটা বাঘ বা পুরো বাসটাই বাঘ হয়ে লাফিয়ে পড়বে না তাদের ওপর, তা কেউ জানে না। তাদের মুখে কোনো সবুজ লাগে। নি, চোখে কোনো সবুজ লাগে নি, বুকে কোনো সবুজ লাগে নি, আরো অনেকখানি ময়লা লেগেছে। বালিকা খুব অপরাধী বোধ করছে, বলছে সে রাশেদকে দোজখ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, নদী অরণ্য দেখাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা সে পারে নি, নিজেকে তার অপরাধী মনে হচ্ছে। একটা বাস এলে তারা উঠে বসে, চারদিকে তার তাকাতে সাহস হচ্ছে না, হয়তো বাঘ ভাল্লুক নেকড়ে দেখতে পাবে। বালিকাটিকে এখন ধর্ষিতাই মনে হচ্ছে, সে মুখ নিচু করে বসে আছে, তার কোনো কিছু দেখতে ইচ্ছে। করছে না, যেনো তার বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে, তার মুখে পশুর নখের গভীর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। রাশেদ দেখছে লোকদুটি বালিকাটিকে ছিনিয়ে নিয়েছে, সে আহত হয়ে পড়ে আছে, একটা ময়লা ট্রাউজার আর একটা কাস্তে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে চলছে বালিকাটিকে, বালিকাটি চিৎকার করতে পারছে না, বালিকা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রাশেদ বালিকার দিকে তাকায়, তার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, মন থেকে রক্ত ঝরছে, স্বপ্ন থেকে রক্ত ঝরছে, রাশেদ ভেসে যাচ্ছে, বাস ভেসে যাচ্ছে, পথের দু-পাশ ভেসে যাচ্ছে, দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত মাটি ভেসে যাচ্ছে। রক্তের ওপর দিয়ে ছুটে চলছে অন্ধ বাসটি।