গুপ্ত যুগ
রাষ্ট্র
উত্তরে আর্যাবর্তে কুষাণ সাম্রাজ্য ও দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজত্বের অবসান ঘটে প্রায় একই সময়ে— খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ে আর্যাবর্তে যে বড় সাম্রাজ্যটি ক্ষমতায় আসে তা হল গুপ্ত সাম্রাজ্য। এই রাজবংশটি ক্ষত্রিয় ছিল না, সম্ভবত বৈশ্য ছিল। গুপ্ত সময়ের বিস্তার মৌর্য সাম্রাজ্যের মতো ছিল না; প্রধানত বিহার ও উত্তরপ্রদেশেই তৃতীয় শতকের শেষ দিকে এরা ক্ষমতায় আসে। উত্তরপ্রদেশেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল বলে মনে হয়, কারণ এদের মুদ্রা ও শিলালিপি অন্তত রাজত্বের প্রথম দিকে উত্তর প্রদেশেই বেশি পাওয়া যায়। এখান থেকেই গুপ্ত রাজারা অন্যান্য দিকে ক্ষমতা বিস্তার করে। প্রয়াগে (বর্তমান এলাহাবাদে) এদের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল। এ অঞ্চলে প্রথম দিকের গুপ্ত রাজারা সম্ভবত কুষাণদের বশ্যতা স্বীকার করে কর দিত এবং কুষাণ ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে গেলে গুপ্তরা হয়তো বিনা বাধাতেই এ অঞ্চলের নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। কুষাণ রাজত্ব শেষ হওয়ার পরে তাদেরই আত্মীয়বংশ মুরুগুরা ২৫০] খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে। এর প্রায় পঁচিশ বছর পরে ২৭৫] খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গুপ্তবংশের সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ক্ষমতায় আসেন। ইনি সম্ভবত নেপালের লিচ্ছবি বংশীয়া এক রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। এতে নেপালের রাজবংশের সঙ্গে কুটুম্বিতা হওয়ার ফলে তাঁর সাম্রাজ্য আরও দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, কারণ, বৈশ্য বর্ণের গুপ্ত সম্রাট এই বিয়েতে খানিকটা জাতে ওঠেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ৩১৯-২০] খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ওই সময় থেকে গুপ্ত যুগের পত্তন করেন। পরের যুগের অনেক শিলালিপিতে এই সময় গুপ্ত যুগের কাল নির্ণয় করে উল্লেখ করা আছে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের যুগ নানা দিক থেকেই সমৃদ্ধ ও এর ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। এঁর মৃত্যু হয় ৩৩৫] খ্রিস্টাব্দে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল (৩৩৫] থেকে ৩৮০] খ্রিস্টাব্দ) দীর্ঘ ও প্রসিদ্ধ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র যে রাজার প্রশংসা করেছে তাকে বলেছে— বিজিগীষু, অর্থাৎ যে আশপাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে সেগুলো নিজের দখলে আনতে পারে। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন এমনই এক বিজিগীষু রাজা যিনি অনেক রাজার ও অনেক জাতের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন ধরে যুদ্ধ করেন ও জয়লাভ করেন। সেই কাহিনি এলাহাবাদের একটি প্রকাণ্ড পাথরের থামে তিনি খোদাই করিয়ে রাখেন। সেটি আজও আছে। সমুদ্রগুপ্ত যে সব রাজ্য জয় করেছিলেন তার মধ্যে প্রথম অংশ হল তাঁর রাজ্যের আশপাশে গঙ্গাযমুনা মধ্যবর্তী দেশগুলো। এগুলো সম্পূর্ণ জয় করে সমুদ্রগুপ্ত নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। দ্বিতীয় অংশ হল, যে সব অঞ্চল তাঁর রাজধানী থেকে অনেক দূরে, যেমন, নেপাল, আসাম, বঙ্গদেশ অর্থাৎ পূর্ব দিকের দেশগুলো। সমুদ্রগুপ্ত এগুলোও জয় করলেও তাদের সরাসরি নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি, নিজের অধীন আনেন। তবে এ সব রাজ্যের শাসন আগের মতোই চলতে লাগল। যে গণরাজ্যগুলি তখনও কোনও রকমে টিকে ছিল সেগুলো সমুদ্রগুপ্তের সময়ে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পরিশেষে বিন্ধ্যের কাছে যে আটবিক রাজ অর্থাৎ দুর্ভেদ্য জঙ্গল প্রদেশ ছিল সেগুলো এবং দাক্ষিণাত্যের পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজত্ব জয় করে আবার তাদের প্রশাসনিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন সমুদ্রগুপ্ত। দক্ষিণে তামিলনাড়ুর কাঞ্চী অঞ্চল পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্তের বিজয়যাত্রা পৌঁছেছিল। সেখানকার পল্লব রাজারা সমুদ্রগুপ্তের আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন। সুদূর আফগানিস্তানে যে শক ও কুষাণ রাজারা রাজত্ব করছিলেন সমুদ্রগুপ্ত তাদেরকে দিয়েও বশ্যতা স্বীকার করান। চিনা সূত্র বলে যে, শ্রীলঙ্কার রাজা মেঘবর্মা নাকি সমুদ্রগুপ্তের কাছে গয়াতে একটি বৌদ্ধ নির্মাণ করবার অনুমতি চান। এর থেকে বোঝা যায় সমুদ্রগুপ্তের রাজপ্রতাপ কত সুদূরপ্রসারী ছিল। সমুদ্রগুপ্ত দুর্জয় পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন, যেখানেই যুদ্ধ করেছেন সেখানেই বিজয়ী হয়েছেন।
সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১২] খ্রিস্টাব্দ) গুপ্তবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা। ইনি সরাসরি যুদ্ধ না করে বরং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজের রাজপ্রতাপ প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের মেয়ে প্রভাবতীর বিয়ে দেন মধ্যভারতের ব্রাহ্মণ বাকাটক রাজপুত্রের সঙ্গে, এতে জাতে ওঠাও হল আবার বাকাটকদের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করাও হল। বাকাটক রাজপুত্রের মৃত্যুর পরে প্রভাবতীই বাকাটক মহিষী হয়ে রাজত্ব করেন।
বাকাটক অঞ্চলে এ ভাবে প্রভুত্ব বিস্তার করার ফলে চন্দ্রগুপ্ত শক ক্ষত্রপদের অধীনে পশ্চিম মালব ও গুজরাট জয় করে নেন। উজ্জয়িনী ছিল মালবের রাজধানী। গুজরাট দখল করে গুপ্তরা পশ্চিমে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের পথটির অধিকার পান। এতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে বহির্বাণিজ্যের বিশেষ সুবিধা হল এবং রাজধানী উজ্জয়িনীর ঐশ্বর্য গৌরব বাড়ল। এ শহরটিই বোধহয় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের দ্বিতীয় রাজধানী। এই চন্দ্রগুপ্তের সময়ই চিনা পরিব্রাজক ফাক্ শিয়েন ভারত ভ্রমণে আসেন (৩৯৯-৪১৬] খ্রিস্টাব্দে) চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। উজ্জয়িনীতেই খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সালে এক রাজা বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভায় বহু গুণী পণ্ডিত ও কবি ছিলেন। অমরকোষ-এর অভিধানকার অমরসিংহই শুধু নন, ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিখ্যাত সংস্কৃত কবি কালিদাসও এঁর সভা অলঙ্কৃত করতেন। শোনা যায়, এঁর সভায় ন’জন শ্রেষ্ঠ মনীষী ছিলেন তাঁদের বলা হত ‘নবরত্ন’। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের শেষ দিকে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়। এক দিকে হুন আক্রমণ, অন্য দিকে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীন রাজারা একে একে প্রাধান্য ও শক্তি অর্জন করে গুপ্তসাম্রাজ্য থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করে স্বাধীন হয়ে যান। উত্তর প্রদেশের থানেশ্বর রাজারাও স্বাধীন হয়ে স্বতন্ত্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বিহার ও উত্তর প্রদেশে মৌখরিদের রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়, গুজরাট ও পশ্চিম মালবে বলভীদের। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্কন্দগুপ্তর রাজত্বের পরে গুপ্ত মুদ্রার মূল্যমান নেমে যেতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে ওই রাজবংশের পতন ঘটে।
অর্থনীতি
চিনা পরিব্রাজ ফাক্ শিয়েনের বিবরণ এবং এই সময়ে নির্মিত স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিলালিপি ও সাহিত্য থেকে আমরা গুপ্তযুগের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা জানতে পারি। কেন্দ্রীয় শাসন সারা রাজ্যে সমান ছিল না। রাজধানী থেকে যে অঞ্চল যত দূরে, শাসনব্যবস্থা সেখানে ততই শিথিল। রাজস্ব আদায় বিধিবদ্ধ ভাবে হত। খুব সম্ভব আয়ের এক চতুর্থাংশ থেকে এক ষষ্ঠাংশ রাজস্ব বলে আদায় করা হত। করের বোঝা ধনীদের ওপর যত বেশি ছিল গরিবদের ওপর ততটা ছিল না। সৈন্যদল খুব শক্তিশালী ছিল, রাজকোষ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে বিস্তর খরচ হত। যুদ্ধে রথ ক্রমে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছিল, তার বদলে অশ্বারোহী সৈন্যই প্রাধান্য পাচ্ছিল। ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজরাই এ সময়ে সৈন্যদলে যোদ্ধা ছিল। রাজার সৈন্যদল রাজ্যের যে অঞ্চল দিয়ে যাত্রা করত, সেই সব স্থানীয় লোকজনদের সৈন্যদল এবং ঘোড়াদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হত। সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম ও বিলাসের সব ব্যবস্থাই করতে হত সাধারণ গ্রামবাসীদের। মধ্য ও পশ্চিম ভারতের চাষিদের বিষ্টি বা বেগার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, রাজার সৈন্যদল ও কর্মচারীদের পরিচর্যা করতে হত, এই চাষিদের প্রভুর ক্ষেতখামারে কাজ করতে হত বাধ্যতামূলক ভাবে এবং বিনা পারিশ্রমিক বা যৎসামান্য বেতনে, ফলে নিজেদের ক্ষেতের কাজ পড়ে থাকত।
শাসন
গুপ্ত রাজত্বকালে অনেকগুলি নীতিশাস্ত্র বা আইনের বই রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। এগুলিতেই প্রথমবার দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের বিভাগ দেখা যায়। চুরি ও ব্যভিচার তখন ফৌজদারি আইনের আওতায় এল। সম্পত্তির নানা ধরনের স্বত্বাধিকার নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা দেওয়ানি আইনের আওতায় এল। অধিকাংশ আইনই বর্ণভিত্তিক, অর্থাৎ একই অপরাধে বিভিন্ন জাতের লোকের ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি, এর ফলে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের ওপরে শাস্তির বোঝা বেশি ভারি হত। ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর সাহায্যে রাজা বিচার করত। কিন্তু নানা পেশার যে পূগ বা শ্রেণি ছিল তারা নিজের নিজের পেশায় নিযুক্ত মানুষগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব অভিযোগের বিচার নিজেরাই করত। এলাহাবাদের কাছে ভিটা এবং বৈশালীতে পাওয়া শিলালিপি থেকে বোঝা যায় ওই সব বৃত্তিভিত্তিক পূগ সংস্থাগুলি গুপ্ত আমলে স্বাধীন ও বেশ প্রভাবশালী ছিল। যেহেতু সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির পক্ষে উৎপাদন, শিল্প ও কারিগরি, বিদ্যার চর্চা অত্যাবশ্যক ছিল, তাই এই শ্রেণি বা পূগগুলি যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য ও সম্মান পেত। গুপ্তযুগে রাজ্যের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বলা হত কুমারমাত্য। তখন সমস্ত রাজ্যটাকে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম ভাগ ভুক্তি; প্রত্যেক ভুক্তির শাসনভার থাকত একজন ‘উপরিকের’ ওপরে। ভুক্তিগুলি বিভক্ত ছিল ‘বিষয়’-এ এবং বিষয়ের শাসনকর্তাকে বলা হত বিষয়পতি। পূর্ব ভারতে বিষয়গুলিকে ভাগ করা হত ‘বীথি’-তে এবং সেগুলির মধ্যে থাকত গ্রামগুলি। অর্থাৎ গুপ্ত আমলে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে নিম্নতম একক ছিল গ্রাম। যে বিভাগ কার্যত এখনও চালু আছে। গুপ্ত যুগে গ্রামের মোড়লের আধিপত্য বাড়ে। শাসন ব্যাপারে গ্রামের মতামত ও গ্রাহ্য করা হত। শহরের শিল্পের কারিগরির ভিত্তিতে একটা সংগঠন তৈরি হত। শাসনের ব্যাপারেও তাদের কিছু অধিকার ছিল। শিলালিপিতে দেখি কারিগর, বণিক ও লেখক বা লিপিকের। একই প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত এরা সকলে মিলে শহরের শাসনব্যবস্থা চালাত। জমি কেনাবেচা বা হস্তান্তরের ব্যাপারে এদের সম্মতি দরকার হত। বৈশালী, ভিটা ও মান্দাসোর-এ শ্রেণির কথা শুনি, মান্দাসোরের শিলালিপিতে রেশম শিল্পীদের একটি সমবায়ের উল্লেখ পাই। এই সমবায়গুলি কিছু কিছু বিশেষ সুবিধাও পেত। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শাসন, বিচার, শাস্তি সব এদের নিজেদের হাতেই থাকত। এই ধরনের শাসন বিহার, উত্তরবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের উত্তরপ্রদেশ-ঘেঁষা কিছু অঞ্চলে চালু ছিল। সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসন বিশেষ পৌঁছত না। অঞ্চলগুলির প্রতিনিধিরা গুপ্তরাজাদের রাজসভায় গিয়ে রাজাকে সম্মান দেখাতেন, রাজস্ব দিতেন এবং মধ্যে মধ্যে রাজবধূ হওয়ার জন্য নিজেদের মেয়েদের সম্প্রদান করতেন। এর বিনিময়ে তাঁরা নিরাপদে নিজেদের রাজ্যে সর্বেসর্বা হয়ে রাজত্ব করতে পারতেন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী গুপ্ত রাজারা করদ রাজাদের যে সনদ দিতেন তাতে গরুড় চিহ্ন মুদ্রিত থাকত। রাজারা রাজকর্মচারীদের ভূমিদান করতেন কিনা জানা যায় না, তবে গুপ্ত আমলের মুদ্রার যে বিপুল সম্ভার পাওয়া গেছে তার থেকে মনে হয় নগদ বেতনই দেওয়া হত। রাজকর্মচারী ও পুরোহিতদের খাজনায় কিছু কিছু ছাড় দেওয়া হত। পুরোহিতদের নিষ্কর জমি ব্রহ্মত্র দেওয়া হত, তারা ওই জমির প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত তারা তাদের প্রজাদের বিচার করত ও শাস্তিও দিত। কাজেই পুরোহিতদের ভূমিদান মানে রাজা তাঁর পাওনা খাজনা থেকে বঞ্চিত হতেন, ফলে ব্রাহ্মণদের সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি বাড়ছিল।
সমাজ
এ যুগের আগে থেকে সমাজে বহিরাগত জনগোষ্ঠীগুলিকে ব্রাহ্মণ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করার একটা প্রক্রিয়া চলছিল। এ যুগে নতুন যাদের নিয়ে এ সমস্যা দেখা দিত তারা হল বহিরাগত শত্রু হূণ। বিজয়ী আগন্তুক হিসাবে সমাজে এরা রাজপুতদের ছত্রিশ গোষ্ঠীর একটি বলে স্বীকৃতি পেল; এখনও বেশ কিছু রাজপুত হূণ উপাধি বহন করে। বহু বিভিন্ন বৃত্তির চল হওয়াতে বৃত্তিভিত্তিক নতুন জাতির সৃষ্টি হল। আবার গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসীরা ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল, এদেরও নানা জাতির পরিচয় সৃষ্টি করছিলেন সমাজপতি, শাস্ত্রকাররা। ফলে গুপ্তযুগে বিস্তর নতুন জাতি সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই জন্য পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রগুলি প্রয়োজনমত বিভিন্ন জাতির উৎপত্তির কাল্পনিক বিবরণ তৈরি করছিল, যেন বহু প্রাচীনকালে দেবতারা কোনও কারণে তাদের সৃষ্টি করেছিলেন যাতে সমাজে তাঁদের ওই জাতিগুলিকে মেনে নেওয়া হয়। বোঝাই যায়, আগন্তুক গোষ্ঠী বিজয়ী হলে যেমন সমাজে ‘ক্ষত্রিয়’ পরিচয় পাচ্ছিল, তেমনই প্রান্তিক আদিবাসীরা ব্রাহ্মণ্য সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষ হিসাবে ঠাঁই পেয়েছিল। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে, জাতি-উপজাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এদের মধ্যে নতুন নতুন গোষ্ঠীকে অচ্ছুত বা অস্পৃশ্য নাম দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ ভাবে এদের চণ্ডাল বলা হয়। পঞ্চম শতকে ফাক্ শিয়েন এ দেশের সমাজে বিপুল সংখ্যক চণ্ডাল দেখেছিলেন। এরা মাছ মাংস বিক্রি করত, অন্যান্য নিচু কাজ করত এবং সমাজে এদের ঠাঁই ছিল না; তাই এদের গ্রামের বাইরে থাকতে হত। শহরে এলে উচ্চবর্ণের মানুষ এদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাস্তায় হাঁটত, যাতে এদের অশুচিতা কোনও ভাবেই তাদের স্পর্শ না করে।
সমাজে রাজা ও রাজন্যদের প্রসাদে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রবল ছিল, দানে পাওয়া নিষ্কর জমিতে নিচু বর্ণের প্রজাদের কাছে খাজনা আদায় করে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ব্রাহ্মণরা নিজেদের প্রতিপত্তি ঘোষণা করত। বণিকদের সুরক্ষার জন্য বাণিজ্য সার্থবাহের অনুচর হিসাবে এবং সৈন্যদলে ক্ষত্রিয় হিসাবে এদের যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল। দেশে এবং বিদেশে বাণিজ্যের দরুণ বৈশ্যদের হাতে বিস্তর টাকা জমত। ফলে সমাজে তাদের প্রতিপত্তিও যথেষ্ট ছিল। এ সময়ে শূদ্ররা চাষ ও কারিগরিতে স্বাধীন ভাবে নিযুক্ত থেকে আগের চেয়ে সামাজিক অবস্থানে কিছু উন্নতি লাভ করেছিল। তবে নারী ও শূদ্রদের বেদে কোনও অধিকার ছিল না বটে, কিন্তু এ সময়ে রামায়ণ, মহাভারত ও যে অল্প কিছু পুরাণ রচিত হয় সেগুলি পাঠ করার সময় শূদ্র ও নারীরা শুনতে পেত, তাতে পাপ হত না; ফলে কোনও এক ধরনের ধর্মশাস্ত্র শুনতে নারী ও শূদ্রের অধিকার জন্মেছিল। আগে দরিদ্র বৈশ্য ও শূদ্র নারীরা বাড়ির বাইরে রোজগার করতে যেত, চাষের কাজেও হাত লাগত। এ ছাড়াও উচ্চবর্ণের ধনীদের বাড়িতে দাসীর কাজ করে কিছু স্বাধীনতা পেত। কিন্তু গুপ্ত যুগে সমাজ ক্রমশই রক্ষণশীল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শূদ্রের স্বাধীনতা ক্রমে সংকুচিত হয়ে এল। কৃষ্ণ-কেন্দ্রিক উপাসনার চল হওয়াতে আগে শূদ্র সম্প্রদায় বৈষ্ণব ধর্মে ধর্মাচরণে একটা অধিকার পেল, কিন্তু তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে শাস্ত্রকার পুরোহিতের নির্দেশ অনুসারে তাদের অধিকার নির্ধারিত হত। সংখ্যায় অর্ধেক হলেও নারীর অধিকার, সমস্ত শাস্ত্রে ক্রমশই খর্ব করার চেষ্টা চলতে থাকল। নানা কাহিনি ও তত্ত্বকথা শোনানো হল সাধারণ মানুষকে, যাতে দেখানো হয়েছে নারী স্বভাবত পাপিষ্ঠা, পুরুষের অধঃপতনের হেতু, তার প্রকৃতিই হীন, তার একমাত্র কর্তব্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির দাস্য। এই সময়ে রচিত নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ পড়ি, দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে অকারণে পরিত্যাগ করবার পর কণ্বের শিষ্য শাঙ্গরব রাজাকে বলছে: ‘এ তোমার স্ত্রী, একে ত্যাগ কর বা গ্রহণ কর (যা তোমার ইচ্ছা), কারণ স্ত্রীর ওপরে স্বামীর সর্বতোমুখী প্ৰভুত্ব আছে।’
এই প্রভুত্বের একটা কারণ হল, ভৃত্যের মতোই নারী তখন ভরণপোষণের জন্যে সব রকমে স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল। বস্তুত, আগেই বলেছি ভৃত্য ও ভার্যা, দুটি শব্দই ‘ভরণ করা’ অর্থে ‘ভৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন; মানে যাকে ভরণ করতে হবে। অর্থাৎ স্ত্রীর খাওয়া পরার বিনিময়ে স্বামী তার ওপরে যথেচ্ছ প্রভুত্ব করতে পারে। নারীর উপনয়ন হত না ফলে বেদ পড়ার অর্থাৎ লেখাপড়ার অধিকার ছিল না। দু’চারটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে নারীর শিক্ষার কোনও পথ ছিল না। অন্তত সদর রাস্তায় ছিল না, খিড়কির রাস্তা দিয়ে কিছু নারী নিশ্চয়ই শিক্ষা পেত। কিন্তু কোনও বৃত্তির অর্থাৎ অর্থকরী কাজ করার মতো শিক্ষা সে পেত না। একেবারে নিচুতলার মেয়েরা কিছু কিছু জিনিস হাতে তৈরি করত, কোনও কোনও কারখানায় বা কুটিরশিল্পে যুক্ত থাকত; গরুবাছুর চরানো, ক্ষেতের কাজে সাহায্য করা, সবজি চাষ করে বা হাতে তৈরি জিনিস বিক্রি করে কিছু রোজগার করত; কখনও বা অন্যের বাড়িতে বেতন এবং খাওয়া-পরার বদলে কিছু কিছু কাজ করে কিছু টাকা হাতে পেত। এই সব মেয়েদের ওপরে স্বামীর ও শ্বশুরবাড়ির কর্তৃত্ব হয়তো বা কিছু শিথিল ছিল; সামান্য পরিমাণে হলেও রোজগারের অনুপাতে তাদের হয়তো কিছু স্বাতন্ত্র্য ছিল। একেবারে ওপরতলার মেয়েরা অলংকার, সম্পত্তি ও জমির মালিকানা পেত; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সজ্জন হলে স্ত্রীধন, যৌতুক ও অন্যান্য সম্পত্তিতেও নারীরা অধিকারও পেত। কিন্তু শাস্ত্র বলেছে, দেহ বা ধনের ওপরে নারীর কোনও অধিকার থাকবে না। ফলে নারীর নিগ্রহ শাস্ত্রসম্মত, পুরোপুরি মানুষের মর্যাদা না পাওয়াই এ সমাজে নারীর অবস্থানের যথার্থ চিত্র।
শিল্প সংস্কৃতি
উচ্চবর্ণের অবস্থাপন্ন পুরুষদের হাতে জমি বেশি আসতে লাগল। বাণিজ্যের সম্পত্তি জমত তাদেরই হাতে; ফলে এ সময়ে বহুবিবাহের চলও বাড়ল। দেবতাদের প্রায় সকলের (শিব ছাড়া) একাধিক স্ত্রী ছিল— কৃষ্ণের সবচেয়ে বেশি, পঞ্চপাণ্ডবেরও তাই। এর মধ্যে সমাজে পুরুষের বহুবিবাহের প্রচলন প্রতিফলিত হয়েছে। নারীর বহু বিবাহ অচল ছিল; দ্রৌপদীর বহু বিবাহ তাঁর ইচ্ছাক্রমে ঘটেনি। আর সব রাজপুত্রের (রামায়ণ-এ সীতা, ঊর্মিলা, মাণ্ডবী, শ্রুতকীর্তি বাদ দিলে) একাধিক সপত্নী ছিল। প্রথম সতীদাহের নজির পাই খ্রিস্টিয় ৫৪০ সালে, গুপ্তযুগে। এই গুপ্তযুগে লক্ষ্মী নারায়ণের পদসেবা করেছেন— এমন একটি ভাস্কর্যও পাওয়া যায়। সতীত্ব সাংঘাতিক কঠোর ব্রতের মতো সব শাস্ত্রে ও সাহিত্যে প্রচলিত হচ্ছিল, অসতীর দণ্ডও অমানবিক এবং বীভৎস, অথচ ‘সতী’ শব্দটির ওই অর্থে কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর বিশ্বস্ততা সমাজে অপেক্ষিত ছিল না। বিরল কিছু শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের নির্দেশ থাকলেও ইতিহাসে কাব্যে সাহিত্যে মহাকাব্যে ও পুরাণে কোথাও এর কোনও উল্লেখ নেই।
বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তিবিদ্যাতেও গুপ্ত যুগে বেশ উন্নতি হয়েছিল। জ্যোতিষচর্চায় পাটলিপুত্রের পণ্ডিত আর্যভটের আর্যভটীয় একট যুগান্তকারী গ্রন্থ। নানা ধরনের গাণিতিক হিসেব তিনি নিজে উদ্ভাবন করেন। রোমক সিদ্ধান্ত নামে যে জ্যোতিষের গ্রন্থটি এ সময়ে সংকলিত হয় তাতে গ্রিক জ্যোতিষের প্রভাব আছে। এলাহাবাদে ৪৪৮] খ্রিস্টাব্দের একটি গুপ্ত শিলালেখে দশমিক পদ্ধতির গণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। রসায়ন ও ধাতুবিদ্যাও এ যুগে খুব উন্নতি লাভ করে। লোহা ও ব্রোঞ্জের তৈরি বুদ্ধ ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তিগুলির পিছনে এ সব চর্চার প্রভাব আছে। হাজারেরও বেশি বছরে এগুলিতে একটুও মরচে পড়েনি। এমন ভাবে লোহার রঙকে স্থায়ী রেখে লোহার কাজ পাশ্চাত্য জগৎ প্রথম পেরেছিল মাত্ৰ শ’খানেক বছর আগে। গুপ্ত যুগের সমাজে বিজ্ঞান ও প্রয়োগগত অবসংগঠনটি খুব মজবুত ও উঁচুদরের ছিল। গুপ্তযুগকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। দরিদ্রতম চাষি বা মজুরের ক্ষেত্রে হয়তো এ কথার কোনও সার্থকতাই নেই, কিন্তু সাম্রাজ্যের ওপরতলায় সমৃদ্ধির নানা লক্ষণ ছিল। এ যুগে সোনা ছিল প্রচুর, মোহর ছাপা হত বিস্তর। এই ঐশ্বর্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল শিল্প সাহিত্যে রাজা ও ধনী রাজন্য বা বৈশ্য বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতা। এঁরা শিল্পীদের অর্থ, পুরস্কার ও বৃত্তির ব্যবস্থা করে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় ন’জন বিখ্যাত গুণী ছিলেন, তাঁদের বলা হত নবরত্ন। মহাকবি কালিদাস এঁদের একজন এবং আরও অনেক গুণী শিল্পীও এদের মধ্যে ছিলেন। কাব্য নাটকের মান খুব উঁচু ছিল, নাচগানের চর্চা হত রাজার পৃষ্ঠপোষকতায়। কালিদাসের নাটক মালবিকাগ্নিমিত্র-তে দেখি দু’জন নৃত্যশিক্ষকের ছাত্রী দুটি নর্তকী রাজসভায় নাচের উৎকর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছে। কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয় নাটকের পুরো চতুর্থ অঙ্কটি রচিত হয়েছে নাচে গানে; নাচগানের মান খুব উন্নত না হলে শুধু নাচ ও গান দিয়ে পুরো একটি অঙ্কে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা যেত না। এখানে বিভিন্ন রকমের নাচের ও গানের নাম পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রাতে দেখি রাজা বীণা বাজাচ্ছেন। মেঘদূত-এ ও যক্ষবধূ ও অন্যত্র অন্যান্য নায়িকাদের বীণা বাজানো ও গান গাওয়ার কথা শুনি। অর্থাৎ সমাজের ওপরতলায় নাচ, গান ও কবিতার রীতিমতো চর্চা ছিল। কামশাস্ত্রনাগরিকের জীবনের যে চিত্র দেয় তাতেও শিল্পকলার রীতিমতো চর্চার কথা শুনি।
সাহিত্যসঙ্গীতের উচ্চমানের সঙ্গে তুলনা করা যায় এ যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের। দিল্লিতে গুপ্ত যুগের যে লৌহস্তম্ভ পাওয়া যায় তাতে লোহা যেমন উঁচুদরের, স্তম্ভটির গঠন ও মসৃণতাও তেমনই। কানপুরে ভিটারগাঁওয়ের পোড়া ইঁটের মন্দির, ঝাঁসিতে দেওগড়ে ও গাজিপুরে ভিটারির স্থাপত্য উৎকর্ষে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নালন্দার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোড়া ইঁটের স্থাপত্য অংশটি পঞ্চম শতকের। স্থাপত্যে পাহাড়পুর, উদয়গিরি ও বাদামির প্রাসাদগুলি গুপ্ত যুগের শিল্পের সুন্দর নিদর্শন। জ্যামিতি, বিজ্ঞান ও গঠনসৌষ্ঠবে এগুলির মান বেশ উঁচু। চতুর্দ্বার মন্দিরের পারিভাষিক নাম সর্বতোভদ্র, সেগুলিও এই সময়ে নির্মিত হচ্ছিল। স্থাপত্যের চেয়ে গুপ্তযুগের ভাস্কর্য যেন বেশি উন্নত স্তরের ছিল। ভাগলপুরের কাছে সুলতানগঞ্জে দু মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের সুন্দর বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ যুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যে বিষ্ণু, নটরাজ, শিব, সূর্য, গণেশ, লক্ষ্মী, সিংহবাহিনী, মহিষমর্দিনী, কার্তিক, ইত্যাদি বেশ কিছু ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়। খোটান থেকে বিকানীর হয়ে, মথুরা, পাটলিপুত্র পর্যন্ত বাণিজ্যপথের ধারে ধারে গড়ে ওঠা শহরগুলিতে শিল্পচর্চা গুপ্ত যুগে বিশেষ উন্নতি লাভ করে। এই অঞ্চলে বাসুদেবের মূর্তিও দেখা যায়, তবে এখনও পর্যন্ত বিষ্ণুর সঙ্গে এঁর তেমন যোগ নেই। বরং চতুর্ব্যহের বাসুদেব, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ও সাম্ব, যাঁরা বিষ্ণুর অংশ কিন্তু অবতার নন, তাঁদের বেশি যোগ। এ সব মূর্তি শুধু যে দেহ-সৌষ্ঠবেই সুন্দর তা নয়, অধিকাংশ মূর্তি সুঠাম ক্ষীণতনু এবং বেশ কিছু দেবতার মুখে একটি অনতিস্ফুট স্মিতহাস্য দেখা যায়, যা গুপ্ত যুগের আগে বা পরে কখনও ভারতীয় শিল্পে দেখা যায়নি। মহাযান বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি নির্মিত হচ্ছিল, তাতে গান্ধার শিল্পরীতি মারফৎ গ্রিক প্রভাব কিছু কিছু এসে পড়েছিল; এমনকী গ্রিক অতিকথার চিত্রও কখনও কখনও চোখে পড়ে অমরাবতীর ও অন্য কিছু ভাস্কর্যে। যক্ষী, অপ্সরা ও নাগদের মূর্তি গড়ার পিছনেও গ্রিক উপদেবতা গড়ার প্রভাব থাকতে পারে। সূর্য, চন্দ্র, বায়ু এবং অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও গড়া হত। শেষটির উল্লেখ পাই ষষ্ঠ শতকের গ্রিক স্টোবায়েউস-এর লেখায়। ষাঁড়ের ওপরে চড়া শিব, গিরি-গোবর্ধনধারী কৃষ্ণও ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ মহাভারতের শেষ দিকে ও পুরাণে দেবতাদের নিয়ে যে-সব অতিকথা নির্মিত হচ্ছে, তার প্রকাশ ঘটেছে ভাস্কর্যে। দেবতাদের মূর্তি মানুষের মতো করেই গড়া হয়েছে, অবয়বসংস্থান বসন ও অলংকার বিন্যাস অতি নিপুণ: মেদবর্জিত সুঠাম গড়ন, ভাস্কর্যে এটি সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ দেখা যায়। এর মধ্যে গ্রিক, মধ্যপ্রাচ্য, পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও, এ শিল্প স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর, কারণ সমস্ত প্রভাবকেই ভারতীয় শিল্পী আত্মস্থ করে নতুন একটি শৈলী সৃষ্টি করেছে। চিত্রশিল্পের অজন্তায় রঙের ব্যবহার নিপুণ। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ দেখি দুষ্যন্ত ছবি আঁকছেন। অন্যত্রও এমন উল্লেখ আছে যেমন, প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণ নাটকেও। কবিতায় ও গানে সংস্কৃত ছাড়া মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ব্যবহার হত। শিক্ষিত মেয়েরা ও অশিক্ষিত পুরুষ শৌরসেনী প্রাকৃত বলত। আরও নিচুতলার মানুষ মাগধী প্রাকৃত এবং একেবারে নীচে শাকারী। অর্থাৎ ভাষার ব্যবহার মোটের ওপর শ্রেণিভিত্তিক, কতকটা হয়তো লিঙ্গভিত্তিকও ছিল। ভাষা সম্বন্ধে সচেতনতা লক্ষ করি কোষগ্রন্থ, অভিধান, ছন্দ, ব্যাকরণ, ইত্যাদি রচনায়। এই সময়ে মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃতে কিছু গ্রন্থ এবং সংস্কৃতেও কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ রচিত হয়। সংস্কৃত হল সাহিত্যের ও শাস্ত্রের ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে সংস্কৃত শিক্ষিত লোকের ভাষা হয়ে উঠেছিল। আর্যরা সিন্ধু পঞ্জাবের অঞ্চল থেকে বিহার উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত ছাড়িয়ে পড়ায় এই বিস্তৃত অঞ্চলের বহু আঞ্চলিক ভাষা ছাড়াও এমন একটা ভাষার দরকার হয়েছিল যা পঞ্জাব থেকে পূর্ণিয়ার সব শিক্ষিত লোক বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারবে। বৈদিক সাহিত্যের পরে পালি ও প্রাকৃত আর ধর্মপ্রচারের ভাষা রইল না, দুটি মহাকাব্যের পরে পুরাণ রচনার শুরু থেকেই সংস্কৃত ধর্ম এবং সংস্কৃতির মার্গ-সংস্কৃতি বা ধ্রুপদী সংস্কৃতির বাহন হয়ে উঠল।
এ যুগের কাব্য নাটকের নায়ক প্রায়ই হত রাজা বা বণিক, রস শৃঙ্গার বা বীর, নায়িকা রাজকন্যা এবং রাজার সহচর, বিদূষক বা বিট হত ব্রাহ্মণ। সাধারণ সারির মানুষের জীবনও একটু আধটু প্রতিফলিত হত কাব্যনাটকে; ভাস্কর্যেও সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রিত হত। কিন্তু সাহিত্য এ সময়ে সাধারণ গড়পড়তা মানুষের জীবনের সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল। সাহিত্যে ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর অলংকারের প্রয়োগ বাড়ছিল, সাধারণ লোকের পক্ষে কাব্য পড়ে বোঝা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারে এবং শ্লেষ, যমক, ইত্যাদি দুর্বোধ্য অলংকারের প্রয়োগে সাহিত্য, বিশেষত কাব্য, জটিল হয়ে উঠছিল। শ’খানেক বছর পরে ভট্টি তাঁর রাবণবধ কাব্যে স্পষ্ট উচ্চারণ করেই বলছেন, ‘আমার এই কাব্য ভাষা ছাড়া বোঝা যাবে না, এতে পণ্ডিতদের উৎসব; আমি বিদ্বানদের পছন্দ করি বলে (এ কাব্যে) অবিদ্বান মূর্খদের বধ করেছি, অর্থাৎ অবিদ্বানরা এ-কাব্যে দাঁত ফোটাতে পারবে না।’ বাস্তবিক, ব্যাকরণ, অলঙ্কার ও শব্দপ্রয়োগে অনাবশ্যক জটিলতার আমদানি করে ভট্টি তাঁর কাব্যকে সাধারণ শিক্ষিত লোকেরও নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছেন। পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্য জটিলতা ও দুর্বোধ্যতার সাধনা করে চলছিল বললেও ভুল হয় না। সাহিত্যে এ দলক্ষণের সূত্রপাত গুপ্ত যুগের শেষ দিকেই হয়েছিল। নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের সহ্যবোধ্য রচনাও ছিল, কিন্তু সংস্কৃতির কোষাধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তা সংরক্ষণ করবেন কেন? তাই সে সব কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছয়নি; যেমন নাটকের শাস্ত্রে আমরা যে সব নাটকের নাম পাই তার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। এগুলির রচয়িতা ও দর্শক ছিল নিম্নবর্গের মানুষ, নাট্যবস্তুও ছিল সাধারণ মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে। কাজেই, রাজদরবারে তার অভিনয় হত না এবং সে যুগে তো লেখার ব্যাপক ব্যবহার ছিল না, তাই সে সব লোকায়ত নাটকের কোনও নমুনা আমাদের হাতে আসেনি।
রাজা বা বণিক বা রাজন্য নায়কের জীবনযাত্রার কিছু নির্দেশ পাই খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় (বা তৃতীয়) শতকের গ্রন্থ বাৎসায়নের কামসূত্র-তে। এখানে অবস্থাপন্ন শিক্ষিত ‘নাগরিক’-এর জীবনযাত্রার একটা বিবরণ আছে। তা বিলাস-ব্যসন, কাব্যনাটক রচনা-আলোচনা, প্রহেলিকা, ইত্যাদি তৈরি করে সময় কাটানো; বাগানে নদীর ধারে কুঞ্জবনে অরণ্যে, নৌকায় গণিকা ও পারিষদদের নিয়ে ফূর্তি করা, খাওয়া-শোওয়া এ সবই বর্ণনা করেছেন বাৎস্যায়ন। আমরা দেখি সেই সব ধনীদের যাদের জীবিকার জন্য পরিশ্রম করার কোনও প্রয়োজন ছিল না, সঞ্চিত ধন দিয়ে যারা বহু বন্ধুবান্ধব ও গণিকা নিয়ে নাচ গান শিল্পচর্চা, নৌকা-বাগান-বিহারে সময় কাটাতে পারতেন। বহু অল্পবিত্ত মানুষ এদের ফূর্তির জন্য নিযুক্ত থাকত নানা রকম সেবার পেশায়। কালিদাস, শূদ্রকের কাব্যনাটকের নায়করা মোটামুটি বাৎস্যায়নের নাগরকের আদলেই তৈরি। কাব্যনাটক যে ধনী বিলাসী মানুষের মনোরঞ্জনের জন্যই রচিত হত, তার একটা প্রমাণ হল সাহিত্য কোথাও দুঃখান্ত পরিণতিকে স্বীকার করেনি। যেহেতু অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুঃখ একটা জীবন্ত সত্য, তাই দুঃখান্ত পরিণামকে এড়িয়ে যে সাহিত্য তা জীবন থেকে এক অর্থে দূরে সরে যাচ্ছিল।
ধর্ম
গুপ্ত যুগের শাস্ত্রে ও সাহিত্যে আবার নতুন করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুজ্জীবনের এক সক্রিয় চেষ্টা চোখে পড়ে। যাগযজ্ঞ নতুন করে বিস্তর জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত। বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিক প্রভাবে বৈদিক ধর্ম যেটুকু প্রতিহত হয়েছিল সেই সব ক্ষতিপূরণ করে যজ্ঞ নতুন করে সমাজে এল। এর একটা কারণ হল রাজা ও ধনীদের হাতে বিস্তর সম্পত্তি জমেছিল যাতে তাদের এ সব খরচ বহন করবার সামর্থ্য হয়েছিল। এরই সঙ্গে বৈদিক যুগেরও আগেকার সমাজে যে সব আঞ্চলিক পূজা প্রচলিত ছিল সেগুলো এখন মাথা তুলল। এর সঙ্গে যুক্ত হল নানা আঞ্চলিক প্রাগার্য দেবতার উপাসনার পদ্ধতি, তৈরি হতে লাগল বিভিন্ন পুরাণ। বিভিন্ন দেবতাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন দেবতার অভ্যুত্থান ঘটল, পূজার বিস্তার হল বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিসরে।
সমাজে জন্মান্তরবাদ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতক থেকে শাস্ত্রে দেখা দিয়েছিল। জন্মান্তরবাদ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতকে রচিত পালিজাতকগুলিতেই প্রথমবার অর্থাৎ দেবতারা অবতাররূপে এবং জাতকগুলিতে বারবার মর্তে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষের জন্মান্তর জাতকগুলিতে বুদ্ধে আরোপিত হয়, বুদ্ধ নানা রূপে বারবার জন্মগ্রহণ করে নিজের জীবনের দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষকে পুণ্যপথে চলবার প্রবৃত্তি দেবেন। এর শ’দুই বছরের মধ্যে ঠিক জন্মান্তরবাদ না হলেও কৃষ্ণের চারটি অভিপ্রকাশ উপাসনার কেন্দ্র করে ওঠে। চতুর্ব্যহে বলরাম, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ও সাম্ব। অর্থাৎ কৃষ্ণ পরিবারের তিন পুরুষের মধ্যে চারজন বৃষ্ণিবীরকে (এই নামেই এদের পরিচয় শিলালেখে) অবলম্বন করে ব্যূহ পূজার সূচনা হয়। এরা দেবতার অবতার না হলেও কৃষ্ণের শৌর্য ও দেবত্বের চারটি প্রকাশ। এই ব্যূহ কল্পনা বৌদ্ধ জাতকের অবতারবাদ থেকে ব্রাহ্মণ্য অবতারবাদের মধ্যে একটি স্তর। এরপরে দেখি গুপ্ত যুগেই নারায়ণের দশটি অবতারের কথা (মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি)— কোথাও বা তেইশটি পর্যন্ত। স্পষ্টত, নানা অঞ্চলে প্রাচীন অর্বাচীন নানা রকম দেবতার পুজো চালু ছিল। সেগুলো একসূত্রে গাঁথবার জন্যে এবং বিষ্ণুকে সর্বপ্রধান দেবতা হিসেবে তুঙ্গে তোলবার প্রয়োজনে বিষ্ণুই যেন বারেবারে নানা জন্মে জাতকের বুদ্ধের মতো নানা নামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন— এই রকম কাহিনি তৈরি হতে লাগল। অবতারদের তালিকা বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন রকম এবং সব মিলে এদের সংখ্যা বিস্তর। মনে রাখতে হবে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম রাজশক্তির সহায়তা পেলেও তখনও বৌদ্ধধর্ম একটি জীবিত ধর্ম, বহু মানুষ তা বিশ্বাস ও আচরণ করে। দুটি ধর্মগ্রন্থেই দেবতাদের ব্যাপারে মাত্রা ছাড়ানো গৌরবকীর্তন আছে, অতিশয়োক্তি ও অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়াও সাহিত্যে ও সময়ে জন্মান্তর ও কর্মবাদের স্বর্গনরক এবং অতিলৌকিক ঘটনার বর্ণনা খুব প্রচলিত। এ সব লক্ষণ প্রাচীন সাহিত্যের। এর দ্বারা শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করা যায় বলেই হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মপ্রচারের জন্য এর এত প্রচলন ছিল। সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য বেড়েই চলেছিল, শাস্ত্রকার পুরোহিতরা গরিব দুঃখীদের বোঝাচ্ছিলেন যে তাদের পূর্বজন্মের পাপের ফলে তাদের এ দুর্গতি, অতএব ব্রাহ্মণের সেবা ও পূজা ঠিকমতো করলে দেবতা অলৌকিক উপায়ে তাদের দুঃখমোচন করবেন। সাহিত্য ও শাস্ত্রে তাই এ সব অলৌকিক জাদু কাহিনির এত ছড়াছড়ি।
এই যুগেই ছ’টি প্রধান ব্রাহ্মণ্য দর্শনপ্রস্থানের (মীমাংসা, ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত) গ্রন্থগুলি রচনা এবং আগে রচিত কিছু গ্রন্থের টীকা-ভাষ্য রচনা হতে থাকে। এগুলি সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে এবং এই সব চর্চার মধ্যে স্বাধীন চিন্তার যথেষ্ট উন্নতি হয়।
একদিকে শাস্ত্রে অবতারবাদের প্রবর্তনের দ্বারা আঞ্চলিক লোকদেবতাকে যেমন পূজার মণ্ডপে হাজির করা হল, অন্যদিকে তেমনই মানুষের জীবনে পুনর্জন্ম একটি স্বীকৃত তথ্য হয়ে উঠল। মাঝেমাঝেই দেবতারা কারও না কারও অভিশাপে মানুষ হয়ে মর্তে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য হন— এমন কথা বহু পুরাণে আছে। এর দ্বারা সাধারণ লোকের মনে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের অভিশাপের আতঙ্ক ভাল ভাবেই সঞ্চায়িত করা গেল। তেমন তেমন লোকের দেওয়া শাপ ও বর সম্বন্ধে মানুষের ভয় ও লোভও জন্মায়। সব মিশে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হল তাতে উচ্চ-~র্ণ এবং অবস্থাপন্ন পুরুষের কর্তৃত্ব যেমন কায়েম হল, তেমনই নিম্নবর্ণের দরিদ্র, চণ্ডাল ও অস্পৃশ্য পুরুষ এবং সমস্ত নারীর স্থান ক্রমেই নেমে যেতে লাগল।
গুপ্ত যুগে যে আর্থিক প্রাচুর্য ওপরতলার মানুষের হাতে এসেছিল তার ফলে শুধু উৎপাদন ও বাণিজ্যে নয়, শিল্পে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, সংগীতে, বিজ্ঞানে, গণিতে, জ্যোতিষে, প্রযুক্তিবিদ্যায় একটা প্রেরণা বিপুল ও ব্যাপক ভাবে কাজ করে; নানা দিকে বিদ্যা ও শিল্পচর্চায় বিশেষ ভাবে স্ফূরণ হয়। বলাই বাহুল্য, এগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করছিল রাজা, রাজন্য ও বিত্তবান লোকেরা। লোকায়ত শিল্প সাহিত্যের স্ফূরণ হয়ে থাকলেও তার নজির আমাদের হাতে পৌঁছয়নি; শুধু ভাস্কর্যে ও সাহিত্যের সামান্য কোথাও কোথাও জনজীবনের চিত্র রয়ে গেছে।
ধর্মজগতে এ যুগে পরস্পরবিরোধী নানা মত ও পথ সহাবস্থান করছিল, যজ্ঞ ও পূজা, বৈদান্তিকতা ও নানা সাম্প্রদায়িক উপাসনা ঝাড়ফুঁক, কবচ, মাদুলি ও দুরূহ দর্শনচর্চা এবং তারই সঙ্গে নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মত ও প্রস্থান— এ সব মিলে একটি মিশ্র ও জীবনবোধ সমাজে প্রচলিত ছিল। ধর্মের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অনিবা। ভাবে সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠছিল অভিপৌরাণিক ধর্মের অগ্রগতি, অর্থাৎ যা পরে পুরাণের ধর্ম হয়ে উঠল। এরই আজকের নাম ‘হিন্দুধর্ম’। এর মধ্যে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর ও গাণপত্য, এই পাঁচটি প্রধান মত ছাড়াও বহু গৌণ ছোট ছোট আঞ্চলিক, গ্রামীণ, সাম্প্রদায়িক ধর্মচর্চার চল ছিল। গণ্ডগ্রামের ধর্মাচরণ গ্রাম ছাড়িয়ে গ্রামান্তরে ও শহরে এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে সঞ্চারিত হচ্ছিল। বহু প্রাচীন গ্রাম-দেবতা এখন স্বীকৃতিও পূজা পেল এবং ক্রমে ক্রমে প্রাধান্য পেয়ে নতুন নতুন উপাসক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে সাধারণ দেবমণ্ডলীতে স্থান পেল। এদের নিয়ে কল্পকাহিনি রচনা করলেন পুরাণকাররা। আগেকার, প্রধান দেবতাদের সঙ্গে আত্মীয়তা বা কীর্তির সূত্রে এদের যুক্ত করলেন, যাতে এদ্রে অভিজাত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজে। এই বহু বিভিন্ন ধরনের দেবতাদের নিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের যে নতুন রূপটি দেখা গেল, তার অনেক সামাজিক অনুষঙ্গ ছিল। এ ধর্মে ব্রাহ্মণের মর্যাদা তুঙ্গে, রাজা দেবতার প্রতিনিধি, পুরুষ পরিবারের সর্বময় কর্তা, শূদ্রের কর্তব্য মুখ বুজে উচ্চত্রিবর্গের সেবা করা এবং নারীর কর্তব্য স্বামী সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির নিঃশর্ত সেবা করে চলা।
নতুন যে দার্শনিক বোধটি এখন প্রবল হয় উঠেছিল তা হল নিয়তিবাদ। এর অর্থ হল যে শক্তি জীবনের সুখদুঃখকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই নিয়তি; মানুষের শক্তি নেই সেই অদৃশ্য অজ্ঞেয় শক্তিকে স্বরূপে চেনা বা তাকে প্রতিরোধ করা। শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা যেমন নির্দেশ দেবে অন্ধভাবে সেইগুলো মেনে চললে ইহ-পরকালে কিছু মঙ্গলের সম্ভাবনা আছে। এই নিটোল সামাজিক ছকটিকে দৃঢ় ভাবে রক্ষা করছিল মহাকাব্য দুটির শেষতম সংযোজন ও পুরাণগুলি, শাস্ত্রকার-পুরোহিতরা। তাদের উদ্ভাবিত জন্মান্তর ও কর্মবাদ, শাপ ও বরের ভয় ও লোভ তীর্থ-মাহাত্ম্য, দান-দক্ষিণা ধ্যান-জপ এবং ব্রত-প্রায়শ্চিত্তে পাপক্ষয়ের প্রলোভন। এই সবই ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে গুপ্ত যুগে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে; এরই বর্তমান নাম ‘হিন্দুধর্ম’। গুপ্ত যুগে এ ধর্ম যে রূপ পরিগ্রহ করে সেই কাঠামোয় মৌলিক কোনও পরিবর্তন গত দেড় হাজার বছরে হয়নি, ইতস্তত সামান্য কিছু আঞ্চলিক বিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া হিন্দুধর্ম একই পথে অনিবার্য গতিতে চলে এসে বর্তমানের চেহারাটিতে পৌঁছেছে। এদেশে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত ধর্মধারার তিনটি মুখ্য পর্ব: প্রথম, যজ্ঞ-নির্ভর বৈদিক কর্মকাণ্ডের ধর্ম; দ্বিতীয়, জ্ঞান-নির্ভর বৌদ্ধ, জৈন ও উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ডের ধর্ম, তৃতীয় নিয়তিবাদ। প্রথম দুটি গৌণ, কালিক ও আঞ্চলিক, কিন্তু এগুলির সঙ্গে মিশেছে পূজা তীর্থমানত ইত্যাদি। তত্ত্বের দিকে দ্বিতীয় পর্বে এসেছে জন্মান্তবাদ, তার শ’ দুই বছর পরে তার সঙ্গে মিশেছে কর্মবাদ এবং তার অল্প কিছুকালের মধ্যেই দেখা দিয়েছে নিয়তিবাদ। তৃতীয় মিশ্র পর্বের সঙ্গে নিয়তিবাদ জুড়ে যুক্তিতত্ত্বের কাঠামোকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধর্মধারার যে ছকটি বহু কুসংস্কারকে আশ্রয় দিয়ে গড়ে উঠেছে, বর্তমানেও সেই ধারাটিই অব্যাহত আছে। এই দিক থেকে গুপ্ত যুগের বৈশিষ্ট্য এই যে এই যুগেই প্রথম হিন্দুধর্ম তার বর্তমান রূপ অর্জন করে এবং ইতিপূর্বে এক জন্মে ভাল কাজ করলে পরজন্মে তার ফল প্রাপ্তির আশা থাকায় দেবতাদের কাছে যে বশ্যতার নীতি প্রচলিত ছিল, তার পরিবর্তে নতুন এক দেবী সৃষ্টি করা হল, যার নাম নিয়তি এবং যিনি কোনও স্তবস্তুতি বা পূজায় তৃপ্ত হন না।
গুপ্ত যুগের পরবর্তী সমস্ত ধর্ম-সাহিত্যে নিয়তি অত্যন্ত প্রধান শক্তিরূপে বৰ্তমান। অথচ পূর্বের জন্মান্তরবাদ, পূজা, ধ্যান, জপ, মানত, তীর্থ, ইত্যাদি পরলোকে সদগতি পাওয়ার যত কিছু পথ ছিল, নিয়তির সঙ্গে তার সব কটিরই এমনকী দেবতাদেরও বিরোধ আছে; কারণ এগুলো পরস্পরকে খণ্ডন করে এবং সব কটিকেই নিয়তি খণ্ডন করে। তবু এ সবই নিয়তির সঙ্গে পাশাপাশি থেকে গেল। তত্ত্বের দিকের এই জগাখিচুড়িকেই মেনে নিল গুপ্ত যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত যুগেরই ধর্মবোধ। সাধারণ মানুষের অসহায়তার বোধই শুধু বাড়ল না তার ইহ-পরলোকের মঙ্গলের জন্যে তার ঠিক কী দরকার সে সম্বন্ধে তাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে রাখল এই মিশ্র ধর্ম— যাতে দেবতাদের পাশাপাশি দুর্বোধ্য, এমন এক শক্তি নিয়তির চেহারা দেখা দিল যেখানে মানুষের পুরুষকার সম্পূর্ণ পরাজিত। মানুষ অবশ্য হার মানেনি, কিন্তু সমাজপতি ও শাস্ত্রকাররা তাকে পদানত রাখবার জন্যে, তার আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ চূর্ণ করে দেওয়ার জন্যে যে কাঠামোটি তৈরি করে তার মধ্যে নিয়তির একটা প্রধান ভূমিকা রয়ে গেল।
ইটস গুড