১১. গুপ্তচরবৃত্তি কি আদৌ প্রয়োজনীয়?

অধ্যায় : ১১ – গুপ্তচরবৃত্তি কি আদৌ প্রয়োজনীয়?

Is It All Necessary?

“আমাদের অবশ্যই গুপ্তচরদের বিদূরিত করতে হবে, কারণ ওরা শুধু যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করে, মানুষকে অপরিমেয় দুঃখ, কষ্টের গোপন ইন্ধনদাতা হিসেবে কাঁদায়।” যারা এ কথা বলেন, তারা ভুল বলে থাকেন, কারণ গুপ্তচররা যুদ্ধের সৃষ্টিকর্তা নয় বরং তারা যুদ্ধের উপজাত সৃষ্টি। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পৃথিবীকে শুধুমাত্র যুদ্ধের একটি উপাদান থেকে মুক্ত না করে সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধ থেকে মুক্ত করা। এটা কোনো ছেলে ভোলানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু বার্নার নিউম্যান তাঁর ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ল্ড অব এসপায়োনেজ’ গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে তাঁর মতামতের ইতি টানতে গিয়ে উল্লেখ্য করেছেন যে, একবার যদি কখনো যুদ্ধের ভয়াবহ উপস্থিতি থেকে কোনো মতে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তবে ‘গুপ্তচর’ নামক পেশাজীবী শ্রেণীটিকে অবলুপ্ত করা যেতে পারে এবং তখন তার কোনো প্রয়োজনও নেই।

ইতোমধ্যে তাঁর বই প্রকাশের আঠার বছর (১৯৮১ সালে হিসেবে ধরে আঠার বছর হয় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ‘যুদ্ধ’ নামক বিভীষিকাটি দোর্দণ্ড প্রতাপে পৃথিবীতে ভয় প্রদর্শন করে চলছে। স্নায়ু যুদ্ধ বা ছোট খাট যুদ্ধ সারা পৃথিবী জুড়ে অহরহই সংঘটিত হচ্ছে। ভারত নিজেও-এর মাঝে ১৯৬২ সালে চৈনিক আগ্রাসনে, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্ত ানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে এ অধ্যায়ে অংশগ্রহণে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধ পৃথিবীর শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। আফগানিস্তানে রাশিয়ার উপস্থিতি, চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধ, পাকিস্তানের নিত্যনৈমিত্তিক অস্ত্রের ঝনঝনানি, যুদ্ধের ভয়াবহতাকে আমাদের দরজার একদম ওপাশে নিয়ে এসেছে। কোনো কোনো সময় স্নায়ুযুদ্ধ হঠাৎ করে উত্তপ্ত ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয় ও রণদামামা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে শোনা যেতে পারে যেমন হয়েছে ইরাক-ইরানের ক্ষেত্রে।

এ ধরনের সরাসরি যুদ্ধ ছাড়াও গুপ্তচরদের যুদ্ধ সব সময় চলতে থাকে। ‘এসপায়োনজ যুদ্ধ’ সংক্রান্ত কোনো খবরাখবর কদাচিৎ কখনো আমরা শুনে থাকি। এ ব্যাপারে প্রথম সারির প্রতিযোগীরা হচ্ছে পরাশক্তিসমূহ। আঞ্চলিক প্রভুত্ব লাভের তৃষ্ণায় তারা চিরদিনই অতৃপ্ত। আর বর্তমানে তাদের লক্ষ্যস্থল হলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। সাধারণত এ ধরনের অস্পষ্ট আশঙ্কা ও ভীতিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য সার্বক্ষণিক একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি কার্যকরি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া একটি কার্যকরি ও দক্ষ ইন্টেলিজেন্স সংস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক।

জনতা সরকারের সময় একবার বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার জোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ‘র’-এর বাৎসরিক বাজেট কমিয়ে ও নিয়মিতভাবে-এর লোক ছাঁটাই করে এ প্রক্রিয়াকে প্রায় সফলতার পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সে উদ্যোগের প্রতিক্রিয়া এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।

ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর রটনা (1) তৈরি করার একটি ভৌতিক দক্ষতা আছে; বিশেষ করে এরা যখন এদের সম্পর্কে কোনো গুজব রটনাতে অত্যন্ত সংযমী (!) থাকার চেষ্টা করে। কেবিনেট সচিবালয়ের অধীন ‘সর্বব্যাপী ব্যাপ্ত’ বিদেশে দেশের ‘চোখ ও কান’ স্বরূপ ‘র’-ও এ সংস্কারের বাইরে কিছু নয়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে গোপনীয়তায় মিশিয়ে রাখার পরও, ‘র’-জন প্রচারণার আজগুবী কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন স্থানে এর বিষময় ফল প্রকাশ পায়। ‘র’ ইতোমধ্যে তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর অতিক্রম করছিল। ১৯৮০ সালে মে মাসের শেষ দিকে সংস্থার দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সংস্থা হতে তাদের বিযুক্তির আদেশ পান। এরা হলেন অতিরিক্ত পরিচালক শিব রাজ বাহাদুর ও যুগ্ম পরিচালক এম, এস, ভাটনগর। এ বদলি আদেশে অনেকে হতবাক হয়ে পড়েন। সংস্থার অসন্তুষ্ট অংশ তখন থেকে উত্তপ্ত হতে শুরু করে ও জ্ঞাতসূত্র মতে পরিবর্তনের হাওয়া সংস্থা প্রধান এস, এন সানটুককে পদচ্যুত করার পর্যায়ে উপনীত হয়। সানটুকের উত্তরসূরি নির্ধারণে এমনকি বাজি ধরা হয়েছিল অথচ সানটুক দু’বছর পূর্বে এক গোলমেলে বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ সংস্থার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সত্য হোক বা মিথ্যে হোক, কোনো ইন্টেলিজেন্স সংস্থার প্রধান পদে এরূপ যখন তখন’, হরহামেশা পরিবর্তন কোনো শুভ লক্ষণ নয়। এভাবে সংস্থায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তার জন্য এ সংস্থা পরিচালনাকারীদের কাউকে দায়ী করা সঙ্গত নয় বরং রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা একে নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই এরূপ বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য দায়ী বলে বিবেচিত হতে পারেন।

‘র’ সূত্র মতে, নতুন উদ্ভাবিত ‘ওলট-পালট’ অবস্থা সরকারের নতুন চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পুনঃআগমনের সাথে সাথে একটি শক্তিশালী ইন্টেলিজেন্স সংস্থার প্রয়োজনীয়তা পুনরায় ভালোভাবে অনুভূত হয়। এভাবে পুনরায় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরুর পর্যায়ে শোনা যায় বেগম গান্ধী তাঁর দপ্তরে পাঠানো পরস্পরবিরোধী তথ্য সম্পর্কে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্য স্থির করার সিদ্ধান্ত নেন। যতোদূর জানা যায়, তাতে স্থির নিশ্চিত খবর পাওয়া যায় যে, শ্রীমতি গান্ধী একটি ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা একই সাথে ‘র’-এর সকল তথ্য-উপাত্ত ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্যাদির ওপর নজর রাখার কাজ চালিয়ে যাবে। এ সংক্রান্ত একটি খবর ১৯৮০ সালের ১৬ জুন সংখ্যা ইন্ডিয়া টুডে’তে প্রকাশিত হয়েছিল।

দু’মাস পর ‘দি ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ায়’ টি, এন, কাউলও অনুরূপ একটি তথ্য উপস্থাপন করেন। কাউল উল্লেখ করেন যে, ‘জাতীয় সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায় হতে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত’। এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি’ গঠনের আলোচনা চলতে থাকে, যেখানে ওই কমিটি জরুরি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী সমাধান বাৎলে দেবে, তথ্য ও ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসমন্বিত সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। এ কমিটি তার কাছে পাঠানো বিষয়াদির উপর সুপারিশমালা প্রণয়ন অথবা ন্যূনপক্ষে রূপরেখা তৈরির ব্যাপারে ধারণা দিতে পারে। এ ধরনের একটি অনিয়মিত কমিটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলাদেশ অপারেশনের’ সময় তৎপর ছিল। এ ধরনের কমিটির প্রয়োজনীয়তা আজকের দিনেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর কাজ হবে প্রধানত উপদেশভিত্তিক ও সুপারিশমূলক কিন্তু ‘নির্বাহী’ প্রকৃতির নয়। এটা মন্ত্রণালয়গুলোর দৈনন্দিন কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর বাইরের প্রমাণিত যোগ্যতা ও দক্ষতা সমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি ‘অনুঘটক’ বা ‘বিশ্বস্ত বুদ্ধিদাতা’র কাজ করবে।

আমলাতান্ত্রিক কার্যপদ্ধতি অত্যন্ত জটিল, কষ্টকর ও ধীরলয়ের; অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৈনন্দিন ঝামেলা সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন। পরিস্থিতি এমন একটি পদ্ধতি বা সংস্থার উপস্থিতি দাবি করে যা সমস্যা ও সুপারিশকৃত সমাধানের মধ্যে সুসমন্বয় সাধন করে জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনের চাহিদা পূরণ করবে। যদি এ প্রক্রিয়া অল্পদিনের মধ্যে আশাব্যঞ্জক ফললাভে সমর্থ হয় তবে স্তরভেদে একে পরিপূর্ণ অবয়ব প্রদানের যুক্তিসঙ্গত অবকাশ আছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও দলগত চাপের ঊর্ধ্বে এমন কিছু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির প্রয়োজন যারা প্রয়োজনীয় ও জরুরি সমস্যাগুলোর একটি সুন্দর ধীরস্থির ও যুক্তিপূর্ণ সমাধান দিতে পারবেন। ভারতে একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রয়োজন নেই, বরং এমন একটি নমনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংসদীয় পদ্ধতি অবলম্বন করা আবশ্যক যা দেশের বিশেষ প্রয়োজন ও পরিস্থিতির সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠা এ ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ উদ্যোগ।

কংগ্রেস সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘র’-এর পুনঃসজ্জিতকরণ, বছরের পর বছর ধরে হতাশ একটি সংস্থার জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক বলে প্রতিফলিত হয়। জনতা সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের পর হতে ‘র’-একটি ক্ষয়িষ্ণু সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। কারণ জনতা সরকারের বিশ্বাস মতে শ্রীমতি গান্ধীর জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে ‘র’ দেশের জরুরি কাজ অপেক্ষা গান্ধীর ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের প্রতি বেশি নজর দেয়, যার জন্য দেশাই সরকারের সময় প্রতিহিংসাবশত এ সংস্থার শক্তিশালী ‘ডানা’ বা ‘বাহু’কে ‘কেটে’ কিছুটা শাস্তি প্রয়োগ অবধারিত ছিল। ‘র’-পরিচালকের সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে তাঁর বেতন স্কেলও কমিয়ে আনা হয়। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী দেশাইয়ের মতে ‘র’-এর পরিচালক পদটিতে কোনো উচ্চ মর্যাদার পূর্ণ সচিবের আদৌ প্রয়োজন ছিল না, বিধায় আমলাতন্ত্রের ডজন ডজন আমলার পদমর্যাদার নীচে ‘অতিরিক্ত সচিব’ পদে ‘র’-প্রধানের পদটি নামিয়ে আনার জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেন। এ সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে কে, শংকর নায়ার যাকে উক্ত পদটি গ্রহণের জন্য আদেশ দেয়া হয়, তিনি সে ব্যাপারে মোটেই কোনো উৎসাহ দেখাননি।

অত্যন্ত নির্দয়ভাবে ‘র’-এর বাজেট কমিয়ে ফেলার পর পর অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় (MEA = Ministry of External Affairs), ‘র’- এর কিছু কিছু কাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং ‘র’কে প্রধান কমগুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগের মাধ্যমে মূলত পদাবনতি করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তখন মূখ্যত বড় বড় শিকারের জন্য বড়শি পাতা শুরু করে।

এ ধরনের পরিস্থিতির সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহ এমন অবস্থায় উপনীত হয় যেখানে অসন্তোষের ‘ঢাক ঢাক গুড়গুড়’ শব্দ শোনা না গেলেও তা তখন অনুভব করা যাচ্ছিল। ১৯৮০ সালের জুলাই সংখ্যা ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকা একটি ‘র’ সূত্রকে উদ্ধৃত করে উক্ত সংস্থার সুইপারদের ধর্মঘট সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করে। যদিও এ ঘটনা অফিসারদের সে ঘটনার মতো ততোটা বিপর্যয়কর ছিল না কিন্তু এরমধ্যে বেশকিছু অনাহুত ঘটনা ঘটতে শুরু করায় ‘র’-এর ‘কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির’ ট্রাক কাউন্সিলের উচ্চ পর্যায়ের একটি অংশ সভা চলাকালীন তাদের নির্দিষ্ট কিছু ওপরওয়ালার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে সভা থেকে বেরিয়ে আসেন। এ ধরনের সুপ্ত অসন্তোষ যদিও যথেষ্ট আশ্চর্যজনক ব্যাপার কিন্তু তবুও প্রায় সকল পর্যায়ে এ ধরনের চাপা ‘গুড়গুড়’ শব্দের আলামত শোনা যেতে থাকে।

‘র’-এর একটি সূত্র মতে ‘র’-এর জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কিছু হতে পারে না, এবং এ হতাশাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীচুমানের ক্ষয়িষ্ণু মনোবল অবশ্যই নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট এবং ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করবেন, আপনি কিভাবে এ ধরনের সমস্যায় জর্জরিত একটি সংস্থার কাছে সর্বোৎকৃষ্ট উৎকর্ষতা দাবি করতে পারেন?”

বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে খুব একটা ভুল ব্যাখ্যা দেননি এবং এবং আফগানিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানে বাবরাক কারমালের ক্ষমতা গ্রহণের পরপর আমি যখন সেখানে যাই তখন একটি হতোদ্যম সংস্থার কর্মক্ষমতা হ্রাসের সুস্পষ্ট লক্ষণ আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হয়। সেখানে ঘটমান ‘ঠাণ্ডাযুদ্ধ’ সোভিয়েত সৈন্যের উপস্থিতিতে কিছুটা রূপান্তরিত আকার ধারণ করেছিল।

‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ শব্দটি ওয়াল্টার লিপম্যান’ নামক একজন সাংবাদিক ১৯৪৭ সালে প্রথম ব্যবহার করেন তাঁর লিখিত পত্রিকার কলামে ও পরবর্তীতে ওই নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়। এ শব্দটি এখন পর্যন্ত অবিকৃতরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু আফগানিস্তানের অনেকের কাছে, যেমন একজন মুজাহিদের ভাষ্যমতে “ঠাণ্ডা যুদ্ধ শব্দটি হচ্ছে রাজনীতিবিদদের সুবিধা আদায়ে ব্যবহৃত একটি অর্থহীন শব্দ মাত্র; ঠাণ্ডা হোক আর গরমই হোক ফলাফল তো একই হতে দেখা যায়।”

আফগান মুজাহিদের উপরোক্ত মন্তব্যের পরপর প্রেসিডেন্ট কার্টারের বিশেষ দূত ক্লিফোর্ড ক্লার্ক নয়াদিল্লীতে আয়োজিত এক সাংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন, ‘সোভিয়েতরা যদি পারস্য উপসাগরের দিকে ধাবিত হয় বা হওয়ার চেষ্টা করে তবে সহজ কথায় তার অর্থ হচ্ছে যুদ্ধ।’

ক্লিফোর্ড ক্লার্ক বা আফগান মুজাহিদের মনের কথা’ স্পষ্টভাবে বলার একমাস পূর্বে ১৯৭৯ সালে ১৪ই অক্টোবর হাফিজুল্লাহ আমিনের জীবনের ওপর প্রথম আঘাত হানা হয়। এর ক’সপ্তাহ পূর্বে তিনি প্রেসিডেন্ট নূর মোহাম্মদ তারাকীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজে প্রেসিডেন্টের আসন দখল করেন। সে দিনই বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ব্যবসায়ী রূপী একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসের একজন ‘র’ অপারেটিভের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় ও তারা ভারতীয় সরকারের সাথে আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং এ ব্যাপারে শুধুমাত্র ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার দাবি জানায়। পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ কালক্ষেপণ করার ফলশ্রুতিতে যখন এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন কাবুলের রাষ্ট্রদূত বদলি হয়ে ঐ জায়গায় নতুন একজন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সুতরাং সবকিছু আবার নতুন করে শুরু হয়।

ইতোমধ্যে ‘র’ সদর দফতরের পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হয়েছে। জনতা সরকার ক্ষমতা গ্রহেণর ফলে ‘র’-এর আওতাধীন অনেক কাজ, বিশেষ করে যেখানে কোনো দূতাবাস জড়িত তা পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত করা হয়। যে বিশেষজ্ঞ উক্ত মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান সংক্রান্ত কার্যাদির দায়িত্বে ছিলেন তাঁর কাছে তথ্যের বিশ্লেষণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই ছিল না যতোনা তিনি ‘নিজে’ নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।

কাবুলের বহিঃসীমানার বিদ্রোহীদের নেতা ডঃ ওয়াখমানের সাথে একজন ‘কন্টাক্ট’-এর মাধ্যমে কাবুলের একটি ‘সেফ হাউসে’ আমার আফগান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছিল। তাঁর সাথে দেখা করার পরই কেবল কাবুল দূতাবাসের ব্যর্থতার কথা আমি জানতে পারি। কাবুলের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ও বিদ্রোহীদের নেতার মধ্যে ‘র’- অপারেটিভের মাধ্যমে উভয়ের পছন্দনীয় একটি সেফ হাউসে দেখা করার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর মিটিংয়ে ‘র’ অপারেটিভের অংশগ্রহণ নির্বুদ্ধিতা ও ক্ষতিকর বলে প্রতীয়মান হবে বিধায় দূতাবাসের একজন সদস্যকে সাক্ষাৎ করে এলাকা নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয় (!)। আফগান গুপ্ত পুলিশের (KAM) অত্যন্ত সতর্ক নজরদারির মধ্যে দূতাবাসের নির্বাচিত নিরাপত্তা কর্মকর্তা যিনি পূর্বে ভারতীয় পুলিশে কর্মরত ছিলেন তিনি পর্যবেক্ষণ কাজ সম্পন্ন করেন। তার দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী উক্ত বাড়ি (সেফ হাউস) আফগান গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারির আওতায় থাকায় ওই পরিকল্পনা বাতিল বলে ঘোষিত হয় এবং এরপর বিদ্রোহীদের নেতা আর কখনই ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দেখা পাননি।

পরবর্তী মাসগুলোয় হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যার জন্য দু’বার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। এর একটি ছিল ২৭ নভেম্বর ‘৭৯ তারিখে অন্যটি ১ ডিসেম্বর ‘৭৯ তারিখ, কয়েকবার প্রাণে রক্ষা পেলেও “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে’ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে আমিন তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ নিহত হন এবং বাবরাক কারমাল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হন।

অভ্যুত্থান ও এর ফলাফল সারা পৃথিবীতে একটি সম্পূর্ণ অজানা ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা বলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যদি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে মজিদের (আফগান বিদ্রোহীদের নেতা, যিনি সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন) সাক্ষাৎকারটি সময়মতো সংঘটিত হতো তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অন্তত আমীনের ক্ষমতাচ্যুতির আশঙ্কার কথা ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত অনুপ্রবেশের আগাম সংবাদ জানতে পারত। ড. ওয়াখমান (যা তাঁর আসল নাম নয়) আমাকে বলেছিলেন, তিনি ভারতীয় দূতাবাসের ‘সাক্ষাতের পরিকল্পনা’ বাতিল করায় অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, এ পদক্ষেপ ভারতীয় নীতি পরিবর্তনের কোনো ব্যাপার নয় বরং এটি ছিল পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতা। কারণ ড. ওয়াখমানের মতে ‘সেফ হাউস’ এলাকা কখনই আফগান গুপ্ত পুলিশ (KAM) পর্যবেক্ষণের আওতায় ছিল না এবং বিদ্রোহীরা তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ও পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। ড. ওয়াখমানের ভাষায়, ‘আপনি কল্পনা করতে পারেন যে, আবদুল মজিদ, যার মাথার মূল্য অনেক এবং যাকে পেলে কে, জি, বি ও আফগান পুলিশ সানন্দে গ্রেপ্তার করবে; সে পাহাড়ি এলাকা হতে কাবুলে এসেছিল পর্যাপ্ত কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই? কাজেই দেখা করার এলাকা অবশ্যই অত্যন্ত গোপনীয় বাড়িতে নির্ধারিত হবে ও তা বাবরাক কারমালের নিয়ন্ত্রণে নয় বরং আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটা ভাবাই স্বাভাবিক। এ ছাড়াও বাড়ির চতুর্দিকের তিন মাইল এলাকায় আমরা কড়া নজর রেখেছিলাম। সুতরাং আমরা ভারতীয়দের বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু বর্তমানে আমি জানি না এ ব্যাপারে আর কিইবা বলার আছে?

যদি দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণে না গিয়ে এ ক্ষেত্রে ‘র’-অপারেটিভ পর্যবেক্ষণে যেতেন তবে তিনি, যারা নজর রাখছিল তাদের কয়েকজনকে চিনতে পারতেন। যদি কোনো প্রকারে বিদ্রোহী নেতার সতর্কবাণী যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছতো তবে তা হয়তো ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধের’ গতি পরিবর্তন করে দিতে পারতো। তবে এ প্রশ্নটির উত্তর না দেয়াই শ্রেয় কারণ ইতিহাস নিজেই হয়তোবা নিকট ভবিষ্যতে এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিবে। তবে একটি ব্যাপার এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিষ্কার যে, একজন অপেশাদার ব্যক্তির বিশ্লেষণ ও তথ্য নিরূপণই এ ধরনের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ। পৃথিবী আজ যে সকল প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছে, আশা করি এ ঘটনার মধ্যে তার অনেক উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।

কারমালের ক্ষমতা গ্রহণের পরপর কে জি বি ও সি আই এ উভয়েই ‘বিকৃত বা অসত্য তথ্য যুদ্ধ’ (Disinformation war) শুরু করে এবং একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে। এদিকে পরিস্থিতি ঘোলাটে আকার ধারণ করায় আফগানিস্তানে কি ঘটছে তা কেউ সঠিকভাবে জানতে পারছিলেন না। কেবলমাত্র প্রথমবারের মতো পৃথিবী কিছু কিছু ঘটনা জানতে পারে যখন সাংবাদিকরা বাবরাক কারমাল আয়োজিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে যাবার অনুমতি লাভ করেন। তবে কেন এ সব ঘটনা ঘটছে তা এরপরও জানা যাচ্ছিল না। আফগান সরকার শুধুমাত্র জানিয়েছিলেন ‘রাশিয়ানরা নিজ থেকে আফগানিস্তানে আসেনি, সাম্রাজ্যবাদীরা সীমান্তের ওপার হতে (পাকিস্তান হতে) সমস্যা সৃষ্টি করছিল, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি জোট গঠন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে; আফগানিস্তানে কোনো বিদ্রোহী তৎপরতা নেই ও আফগানিস্তানে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন আছে এবং পশ্চিমা সংবাদ সংস্থার ব্যাপারে যতোদূর বলা যায় যে, তারা মিথ্যাবাদী’ এবং বাবরাক কারমালের ভাষায় বিশেষ করে বি বি সি হচ্ছে ‘পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মিথ্যাচারকারী সংস্থা’। ইতোমধ্যে ভারতীয় দূতাবাস তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণের আলোকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং একটি অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ভারতীয় দূতাবাস আফগানিস্তানের মাটিতে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী সাংবাদিকদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করে ও সে সমস্ত সাংবাদিকদের বলা হয়, “আফগানিস্তানে কোনো বিদ্রোহী তৎপরতা নেই, যা ছিটেফোঁটা আছে তা হচ্ছে পাকিস্ত ান ও ইরান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়।”

কিন্তু কাবুলে আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরের পর কাবুল যখন কে জি বি ও কে এ এমের অপারেটিভে ভর্তি ছিল তখন কাবুল হোটেলের একেবারে পাশেই (ওই হোটেলে তখন রাশিয়ান উপদেষ্টারা অবস্থান করছিলেন) হঠাৎ করে একজন মুজাহিদের সাথে আমার দেখা হয়ে যায় যা আমাকে একদম হতভম্ব করে ফেলে। এভাবে শত্রুর ঠিক নাকের নিচেই তারা তৎপর ছিল। কাবুলের ঠিক হৃৎপিণ্ডে কে জি বি সদর দপ্তরের খুব বেশি দূরে নয় এমন একটি জায়গায় আমি ডা. ওয়াখমান ও লায়লার (দোভাষী) সাথে দেখা করেছিলাম।

ডা. ওয়াখমানের দেয় সূত্রমতে আমি পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রদত্ত পর্যটক ম্যাপে বিপ্লবীদের কিছু অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হই। বিপ্লবীরা মোহাম্মদ জামানের নেতৃত্বে ‘মিমানা’র এলাকাসমূহ, সাইদ আহমেদ ও সাফি মাহমুদের নেতৃত্বাধীনে যথাক্রমে ‘নূরস্তান’ ও ‘বামিয়া’র এলাকাসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ডা. ওয়াখমান মূলত কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে বাদবাকিরা পাহাড়ি এলাকায় তাদের তৎপরতা জোরদার করায় ব্যস্ত ছিল। তাঁকে চীনা ও মার্কিনিদের সীমান্ত এলাকায় তৎপরতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল বলে মনে হয়েছে। চীনা ও মার্কিনিরা সীমান্তব্যাপী কিছু মুজাহিদ সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল; এ সমস্ত মুজাহিদদের ডা. ওয়াখমান সুযোগ সন্ধানী বৈ কিছুই মনে করতেন না এবং তাঁর ভাষায়, “এরা শুধু খেলাফতের রাজত্ব কায়েমেই তৎপর, অথচ অন্যদিকে সাধারণ জনগণের রক্ত ঝরার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।” তিনি এ ব্যাপারে উদাহরণস্বরূপ জিয়া নেজারী ও জিয়া নেসারী নামক দু’জন স্বঘোষিত মুজাহিদ নেতার নাম উল্লেখ করেন যারা উভয়েই মার্কিন পাসপোর্টধারী এবং পেশোয়ার হতে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন যেখানে সি আই এ’র একটি অপারেশনাল ঘাঁটি রয়েছে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর এ মূল্যায়ন তাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স সংস্থার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে আফগান ও গুপ্ত পুলিশ-এর (KAM) প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন আরো অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করেন। অবশ্য আমি কাবুলে থাকাকালীন অবস্থায়ই আফগান গুপ্ত পুলিশ (KAM) সংগঠনকে অবলুপ্ত করা হয়।

হাফিজুল্লাহ আমিন একজন অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ‘কৌশলবিদ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি তাঁর নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে KAM-কে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পুনর্গঠন করে ইনফর্মারদের একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তার ক্ষমতার মূল উৎস ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, যাদেরকে তিনি ১৯৭৮ সালের এপ্রিলের পরপর নিজে নিয়োগ দান করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি মস্কোতে পাঠানো এক ব্যক্তিগত বার্তায় রাশিয়ান সাহায্যের ব্যাপারে সম্মতি প্রদানের আভাস দেন। অবশ্য রাশিয়ান উপদেষ্টারা এপ্রিলের ‘সাউর’ বিপ্লবের দু’বছর পূর্ব হতেই আফগানিস্তানে অবস্থান করছিলেন। চিঠি পাঠানোর ব্যাপারটি আমিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীই শুধু জানতেন এবং সে ভদ্র মহিলা আমিন নিহত হবার পর পর লন্ডনে চলে যান। রাশিয়ান সৈন্য প্রবেশের তারিখ ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি নির্ধারিত থাকলেও সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে অনেক আগেই কঠিন আঘাত হানা হয়। কারণ রাশিয়ানদের ধারণা ছিল যে, আমিন মার্কিনিদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ‘ডাবস’-এর (যাকে পরবর্তীতে কিডন্যাপ করে হত্যা করা হয়েছিল) সাথে আমিনের যোগাযোগ রাশিয়ানদের প্রচণ্ড রকম ক্ষেপিয়ে তোলে; তাই তারা প্রতিপক্ষের যে কোনো রকম সুযোগ গ্রহণের পূর্বেই নিজেরা সুযোগ গ্রহণ করেছিল। ঘটমান আফগান পরিস্থিতির জটিলতা নিয়ে একজন আমেরিকান জেনারেলের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখের দাবি রাখে। ১৯৭৮ সালের জুনে এ্যানাপোলিসে ২৭০ জন জেনারেল ও কূটনীতিবিদের সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেন, “রাশিয়ানরা যদি কোনোভাবে পাকিস্তান দখল করতে পারে তবে তারা আরব সাগর পর্যন্ত একটি বাধা বিঘ্নহীন পথ পেয়ে যাবে এবং হরমুজ প্রণালী বরাবর গিয়ে পারস্য উপসাগরের প্রবেশ পথে ঘাঁটি তৈরির মাধ্যমে পুরো এলাকায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে।”

পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে সুস্পষ্ট ধারণা যাই হোক না কেন, দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই মূলত: চীনা উস্কানিতে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল (এটি লেখকের নিজস্ব মতামত)। এদিকে যখন সোভিয়েত সৈন্য সংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে ঠিক তখনই আমি ‘আনাহিতা রাতেজবাদ’ নামক একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও আফগান মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যের সাক্ষাত লাভ করি। ভদ্র মহিলা আমাকে একটি অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর চীনা-মার্কিন পরিকল্পনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে উক্ত উভয় দেশই ওয়াখান’, ‘বদখশান’ ও ‘উত্তর-পশ্চিম পাখতিয়ার’ প্রদেশ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে প্রবাসে একটি ‘পুতুল সরকার’ গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাদের ধাপে ধাপে স্বীকৃতি দিয়ে শেষ পর্যায়ে আফগানিস্তানের বিধিসম্মত সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

এ সব পর্যালোচনা একটি ধ্রুব সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার আগের ও পরের কোনো ঘটনা সম্পর্কেই ভালোভাবে কিছু জানতো না। যেদিন অন্য সকল সাংবাদিকের সাথে আমিও আফগানিস্তান হতে বহিষ্কৃত হই, সেদিনই আমি কাবুলে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জনাব তেজার সাথে একত্রে দুপুরের খাওয়া খাবার সুযোগ পেয়ে যাই। এরপর যখন বিমানে দিল্লী ফিরছিলাম তখন ওই একই বিমানে দিল্লীতে নবনিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ হাসান শারাকও ভ্রমণ করছিলেন। সুযোগ পেয়ে আমি তাঁর সাথে দেখা করার আশা করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী ক’মাস না যাওয়া পর্যন্ত আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। অবশেষে বেশ কয়েকমাস পর একটি পত্রিকার জন্য আমি তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ লাভ করি।

এদিকে ড. তেজা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ভালো বলে তাঁর মত ব্যক্ত করেন, যদিও তিনি এমন এক সময়ে সেখানে নিযুক্ত হন যখন একটি অভ্যুত্থান আরেকটি নতুন অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। অবশ্য তাঁকে যাঁরা আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন তাঁরা সকলেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরাম কেদারায় বসে সুদূর দিল্লী হতে অবস্থার বিশ্লেষণ করেছিলেন। যাদের মাঠপর্যায়ে কর্মরত থাকার কথা, তারা কেউই ‘র’- এর অপারেটিভ ছিলেন না এবং সে জায়গায় নিয়োজিত কূটনীতিবিদগণ তাঁদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে ‘সকল সাংবাদিকদের সম্মিলন স্থল’ কাবুলের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দিন কাটাতে পছন্দ করতেন। নিজেদের মধ্যে আড্ডা মেরে আর কূটনৈতিক বৃত্তে আলাপ-আলোচনা করে তাঁরা আফগানিস্তান সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করে দিল্লীতে পাঠিয়ে দিতেন। তবে অন্যান্য জায়গায় খোঁজ না নেয়ার জন্য কেউই তাদের কোনো দোষ দিতে পারেন না, কারণ তাঁরা ওই ধরনের বিশেষ কাজে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ লাভ করেননি এবং কূটনীতিবিদ হিসেবে তা তাদের প্রয়োজনীয়ও নয়। আমি কাবুলে বেশ কিছুদিন থেকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি যে, এসপায়োনেজ সংক্রান্ত কাজ কারবার পেশাদার অপারেটিভদের হাতে ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার আফগানিস্তান সম্পর্কে এতকিছু বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার বর্ণিত ঘটনাবলী “প্রশিক্ষিত কারও পক্ষে তথ্য সংগ্রহের ব্যর্থতা প্রমাণ করার জন্য একটি উদাহারণ হিসেবে প্রতিবিম্বিত হতে পারে।”

যদিও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ আমার মতামত বা তাদের গৃহীত পদক্ষেপের আলোকে ‘কথিত ব্যর্থতার’ উপযুক্ত জবাব দিবেন ও তৎসঙ্গে বলতে পারেন যে, ভারত পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাবলী যদি সময়মতো জানতেও পারত, তবুও মার্কিনী, সোভিয়েত বা চীনা কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত বা প্রভাবিত করার কোনো ক্ষমতা তার ছিল না আর তাই তথ্য সংগ্রহের সফলতা ব্যর্থতায় এমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু কে জানে বা কেউ কি একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন যে, “ভারত সময়মতো সঠিক তথ্য পেলে কিছু একটা করতে পারত না?” আমার মূল প্রশ্নে পুনরায় ফিরে এসে প্রশ্ন করা যায় “কেন ‘র’ আফগানিস্তানে আসল পরিস্থিতি সংক্রান্ত খবরাখবর প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিল?” এর উত্তরে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায় “ ‘র’ কে আফগানিস্তানে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়নি।”

ক। এবার কী হবে? (What Next?)

কখনো কখনো যখন বাস্তবতা রূপকথায় বিলীন হয়ে যায় তখন আমাদের একটি অত্যন্ত কঠিন, রূঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। “গুপ্তচরবৃত্তি কি আদৌ প্রয়োজনীয়?” এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের খুব দূরের ইতিহাসে অবগাহন করার কোনো প্রয়োজন নেই বরং বিশ শতকের নিকট অতীতের দিকে দৃষ্টি দেয়াই যথেষ্ট।

এ ধরনের একটি পৃথিবীব্যাপী সাড়াজাগানো ঘটনা হচ্ছে ‘ফ্রান্সিস গ্রে পাওয়ার্সকে’ নিয়ে বিখ্যাত ইউ-২ (U-2) অপারেশন’। পাওয়ার ছিলেন বিমান বাহিনীর একজন পাইলট। তাঁকে পেশোয়ারের সি আই এ নিয়ন্ত্রিত ‘বিমান ঘাঁটি’তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিশেষ যন্ত্রপাতি সজ্জিত লকহীড কোম্পানির একটি ইউ-২’ ‘গুপ্ত-পর্যবেক্ষণকারী’ বিমান ৬৮,০০০ ফুট উচ্চতায় চালিয়ে রাশিয়ান ভূখণ্ড অতিক্রম শেষে উত্তর নরওয়ের ‘বোদো’- তে অবতরণে নির্দেশ দেয়া হয়। এটি ছিল ১৯৬০ সালের ১ মে’র ঘটনা। (পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি গোপনীয় স্থান হতে এ ধরনের আরো অনেক অপারেশন চালানোর পর এক পর্যায়ে রাশিয়ান সরকার মিসাইল আক্রমণের হুমকি দিলে সি আই কে বাধ্য হয়ে উক্ত এলাকা পরিত্যাগ করতে হয়। অবশ্য পাকিস্তান সরকারও মার্কিনীদের চলে যাবার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল – অনুবাদক)।

পাওয়ারের বিমান অত্যাধুনিক পর্যবেক্ষণ সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত ছিল এবং তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল ১৩ মাইল উচ্চতায় ঘণ্টায় ৬০০ মাইল বেগে উড়ন্ত অবস্থায় রাশিয়ার নির্দিষ্ট এলাকাসমূহের ছবি তোলা। বিমানের ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি ছবিতে ১৩০ বর্গমাইল এলাকার ছবি তোলা সম্ভব ছিল। যখন তিনি প্রায় অর্ধেক পথ পার হয়ে ‘শোভাদুর্লভস্কের’র আকাশে ৬৮,০০০ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন তখন সোভিয়েত বিমান বাহিনীর প্লেনগুলো তাঁর বিমানকে বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হয়। তবে পাওয়ার ‘বেইল আউট’ করে প্রাণে রক্ষা পান। স্থানীয় পুলিশরা তাঁকে গ্রেফতার করে ও পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কে জি বি’র কাছে হস্তান্তর করে। সোভিয়েত সরকার এ ঘটনা ‘শীর্ষ সম্মেলন’ (Summit Conference) অনুষ্ঠানের ঠিক পূর্বমুহূর্তে জনসমক্ষে প্রকাশ করে, যার ফলশ্রুতিতে সারা দুনিয়া, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ, তৃতীয় বিশ্বের নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহ, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচণ্ড বিরূপ সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। ক্রুশ্চেভের এ ধূর্ত পদক্ষেপের দরুন একই সাথে ‘শীর্ষ সম্মেলন’ ও ‘ইউ-২’ প্রকল্প অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বমোট ৫০টি ‘ইউ-২’ বিমান তৈরি করেছিল ও সোভিয়েত রাশিয়ার আকাশ সীমায় আনুমানিক ‘বার’ বার গোপন বিমান অপারেশন পরিচালনা করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়াও তারা কিউবা, চীন ও উত্তর কোরিয়াতেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়। অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়াও এ ব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। ‘নিউম্যান’ তাঁর ‘The world of Espionage ‘ বইয়ে এরূপ একজন রাশিয়ান পাইলটের কথা উল্লেখ করেছেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক), যিনি ‘স্ক্যানডিনেভিয়ান’ দেশসমূহে বিমান চালিয়ে এসপায়োনেজ কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীতে পশ্চিমা কোনো একটি দেশে পালিয়ে যাবার পর তাঁর এ কাহিনী প্রকাশিত হয়। অন্যান্য অনেকের মতে, সোভিয়েত রাশিয়া পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ ‘মানচিত্র’ ও ‘আকাশ চিত্র’ সংগ্রহকারী দেশ হিসেবে পরিচিত।

যখন এ ধরনের কার্যকলাপের ইতিবৃত্ত জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, তখন সাধারণ জনগণ এ সব বন্ধ করার জন্য তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এদিকে পৃথিবীতে অভাবনীয় প্রযুক্তিগত উন্নতি হওয়ায় ‘গুপ্তচর বিমানের’ দিন শেষ হয়ে গেছে ও নতুন উদ্ভাবিত উন্নতমানের একটি টেলিস্কোপ বা উপগ্রহের মাধ্যমে অনেক সহজে ও নিরাপদে যে কোনো স্থানের ছবি তোলা বর্তমানে অনেক সহজ কাজ। বিজ্ঞানের এতো উন্নতি হওয়ার পরও মাঠপর্যায়ের একজন গুপ্তচরের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কষ্টকর; কারণ তাঁকে প্রতিস্থাপন করার অন্যকোন কার্যকর উপায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

যদিও আজ পর্যন্ত ভারতে কোনো ‘হ্যারল্ড কিম ফিলবী’ (পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে অনুপ্রবেশকারী সবচেয়ে সাৰ্থক কে জি বি এজেন্ট যিনি বিশ বছর ধরে মস্কোর পক্ষে নির্বিঘ্নে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যান ) ধরা পড়েনি কিন্তু বেশকিছু ‘ছোট মাপের’ ও অল্পকিছু ‘বড় মাপের’ গুপ্তচর ধরা পড়েছে। কিন্তু এদের সম্পর্কে বিশেষ কোনো কিছু জানা সম্ভব নয়।

গত সাত বছর যাবত (১৯৮১ সাল পর্যন্ত) ভারতে সর্বমোট ২৩ জন বিদেশী গুপ্তচর ধরা পড়ে। (যার মধ্যে পাকিস্তানী ১৪ জন, কে জি বি’র ৭ জন ও সি আই এ’র ২ জন) এ ছাড়াও অন্য আরো কিছু দেশের বেশ কিছু গুপ্তচর ভারতে তৎপর, যাদের বেশিরভাগই হচ্ছে ভারতীয় নাগরিক যাদের এসপায়োনেজের ঐতিহ্যগত ধারায় গুপ্তচরবৃত্তিতে টেনে আনা হয়েছে। ধৃত গুপ্তপচরের সংখ্যা কম হওয়ায় গুপ্তচরবৃত্তির মাত্রা হ্রাসের কথা অনেকে বলতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সে ধরনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি আর তাই ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’-এর মাত্রাতেও কোনো হেরফের হয়নি। পাকিস্তানী, রাশিয়ান ও মার্কিনীদের ধৃত গুপ্তচরদের সংখ্যানুপাতে মনে হতে পারে যে, একদেশ অন্যদেশ হতে বেশি বা কম ক্রিয়াশীল। কিন্তু গত তিন বছরের পর্যালোচনায় যা প্রতিফলিত হয় তাতে ভারতে গুপ্তচরবৃত্তির মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে বলে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে চীন বা রাশিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ অপেক্ষা গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করা অনেক সহজ ব্যাপার। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে মূলত সামরিক শক্তির ওপর গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করা হচ্ছে। যে সমস্ত এজেন্সি এখানে বেশ ভালোভাবে সক্রিয় তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাশিয়ান গুপ্তচর সংস্থা ও এরপর পর আমেরিকান, পাকিস্তানী, জার্মান, জাপানী, বৃটিশ, ফরাসী, পোলিশ, চেকোস্লাভ এবং ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থার নাম উল্লেখ করা যায়। অবশ্য এগুলো ছাড়াও অন্যান্য দেশের এজেন্সি ও কমবেশি তৎপর এবং বর্তমানে ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞদের ধারণানুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু দেশের সংস্থাও ভারতে খুঁটি বেড়ে বসেছে। তবে ইরান, মিসর ও চীনা সংস্থাগুলো সবচেয়ে কম ক্রিয়াশীল বলে জানা যায়।

রাশিয়ানদের, অন্য দেশ অপেক্ষা তথ্যের উৎসে অনুপ্রবেশের সুযোগ কিছুটা বেশি কারণ তাঁরা উপদেষ্টা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থাপনায় নিয়োজিত থাকার সুবাদে ওই সমস্ত সংস্থা বা স্থাপনার সম্ভাবনাময় কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের এজেন্ট হিসেবে সহজেই নিয়োগ করতে পারেন; আবার অন্যদিকে নিজেরাও প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার সুযোগ পান। বিগত কয়েক বছর যাবত যেহেতু ভারতীয় সমরোপকরণের চাহিদা রাশিয়ানদের মাধ্যমেই পূরণ হয়ে আসছে, তাই তাদের ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত সহজ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও এটা লক্ষ্য করা গেছে সোভিয়েতরা পরোক্ষ উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনার জন্য আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থ খরচ করে থাকে।

সি আই এ এবং কে জি বি উভয়েরই দু’ধরনের রেসিডেন্ট আছে (এদের অবশ্যই পূর্বে উল্লেখিত রেসিডেন্ট এজেন্টের সাথে তুলনা করা যাবে না। এদের কভার ও কার্যক্রম ভিন্ন প্রকৃতির)। প্রথমত সম্ভ্রান্ত সরকারি ক্যাডার কূটনীতিবিদগণ এবং দ্বিতীয়ত ছাত্র, ডাক্তার, শিল্পী ও সর্বশেষ আধুনিকতম সংযোজন হিসেবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন একজন উপদেষ্টা বা কনসালট্যান্ট। ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে, কে জি বি ভারতে সর্বোচ্চ সংখ্যক (প্রায় ৫০ জন) অপারেশনাল এজেন্ট নিয়োগ করেছে। এরপর পর সি আই এ’র ২০ জন হতে ২৫ জন এজেন্ট আমাদের দেশে সক্রিয়। অন্যদিকে চীনারা মূলত কূটনৈতিক পরিমণ্ডলের আওতায় প্রচার প্রপাগান্ডা পরিচালনায় ব্যস্ত। এদের ঠিক পরবর্তী আসনটি দখল করে আছে পাকিস্তান যারা ভারতের প্রায় সকল পর্যায়ে অনুপ্রবেশ করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের একজন বা দু’জন করে এজেন্ট কূটনৈতিক আড়ালে কর্মরত আছে। তবে জার্মানরা কূটনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে তাদের গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করে থাকে যা প্রচলিত প্রথার অনুকূল নয়।

সাধারণত: সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত কূটনৈতিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদান-প্রদান করা হয়, কিন্তু পাকিস্তানীরা এ ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে আলাদা বেতার যন্ত্র ব্যবহার করেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধরাও পড়েছে।

কে জি বি সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যম মানের কর্মচারীদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। এদের মাধ্যম হিসেবে সরকারি অফিসের কেরাণী, আকাশবাণীর বেতার অপারেটর ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট সংস্থার লোকজনের কথা উল্লেখ করা যায়। এ পদ্ধতিটি ভারতে কে জি বি’র মৌলিক কর্মপ্রক্রিয়া হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। অন্যদিকে মার্কিনীরা ও অন্যান্যরা মূখ্যত উচ্চশ্রেণীর ব্যবসায়ী বা কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ‘থমাস পাওয়ার্স’ তাঁর ‘The Man Who Kept Secrets’ গ্রন্থে শ্ৰীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিপরিষদে সি আই এ’র এজেন্টের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছিলো, তখন ভারত পশ্চিম পাকিস্তানেও একই সাথে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ আক্রমণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ৭ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার সি আই এ কে নির্দেশ দেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর সি আই এ এব্যাপারে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে, কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের ভারতে নিযুক্ত কেস অফিসার, যিনি মিসেস গান্ধীর মন্ত্রিসভার রাজনীতিকদের ওপর নজরদারি করতেন, তিনি দিল্লি হতে খবর পাঠান, “ভারত এই মাত্র পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” এ বার্তাটি তৎক্ষণাৎ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়। নিক্সন পরবর্তীতে প্রায়ই এই বার্তাটির উল্লেখ করে মন্তব্য করতেন “সি আই এ কেবল এ সংবাদটিই তাঁকে সময়মতো জানাতে পেরেছে।” কিন্তু এ বার্তাটি হোয়াইট হাউসে যত্রতত্র এতো আলোচিত হয় যে, এটি পুরো বিবরণসহ জ্যাক অ্যান্ডারসন নামের এক সাংবাদিকের হস্তগত হয় এবং তিনি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তা পত্রিকায় প্রকাশ করে দেন। এর ফলশ্রুতিতে সি আই এ ও সংশ্লিষ্ট এজেন্টরা হতচকিত হয়ে পড়ে এবং দিল্লীর এজেন্টের গুপ্তচর জীবনের ইতি ঘটে। এ ব্যাপারে নিক্সনের মন্তব্য ছিল, “তোমরা সব জাহান্নামে যাও।” (‘র’-সূত্রের দাবি অনুযায়ী এ সবই ছিল সি আই এ’র বিকৃত তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ফায়দা লোটার প্রচেষ্টা এবং এন্ডারসনের কাছে পরিকল্পিত উপায়ে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা হয়েছিল। সে সময় ভারতীয় মন্ত্রিসভায় কোনো এজেন্ট থাকার প্রশ্নই আসে না এবং ১৯৭১ সালের ভারতীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে সি আই এ কিছুই জানতো না।)

সোভিয়েতরা পরবর্তীতে মার্কিনিদের মতো ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রতি তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে, বিশেষ করে তারা রফতানিকারকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে রফতানিকারকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সি আই তাদের পদ্ধতি পরিবর্তন করে, কিন্তু ভুল পদক্ষেপের দরুন সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সোভিয়েতদের অনুসরণে তারা ডকইয়ার্ড এলাকায় এমন লোকদের এজেন্ট নিয়োগ করে যারা মালামাল খালাসের কাগজপত্র তদারকিতে নিয়োজিত। ওই সময় জাহাজ থেকে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ক্রয় করা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নামানো হচ্ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে সি আই এ বেশ কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখে, কিন্তু একপর্যায়ে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সব কিছু ফাঁস হয়ে পড়ে এবং তাদের নিয়োজিত ‘কেস অফিসার’ একজন ডক শ্রমিকের নিকট হতে মালামাল খালাসের তালিকা সংগ্রহের সময় হাতে নাতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় সি আই এ কে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়েছিল।

ভারতে গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর পাশাপাশি সি আই এ ও কে জি বি একে অপরের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর জন্য তাদের প্রায় অর্ধেক সময় ব্যয করে। উভয়েই অপর পক্ষের ড্রাইভার ও সুইপারদের ঘুষ দিয়ে তথ্য আদায়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক পরিমন্ডলে নিজেদের ‘যা করার’ তা তো করছেই।

সোভিয়েত গুপ্তচরদের শনাক্ত করা অন্যদের চেয়ে সহজ, কারণ তারা তাদের নিজস্ব পরিমন্ডলের মধ্যে অবস্থান করতে চায়। এ ছাড়াও যারা কূটনৈতিক এলাকা বা এর বাইরে অবস্থান করে তারা নগরীর কোন অভিজাত এলাকায় বসবাস করলেও দূতাবাস ও অন্যান্য পর্যায়ে চিহ্নিত হয়ে যান। অভিজাত পোশাক-আশাক পরে উচ্চপর্যায়ে ঘোরাফেরা করার পরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের শনাক্ত করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে মার্কিনি ও অন্যদের চালচলন সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় তাদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন। তারা সব সময় একই পদ্ধতি অনুসরণ না করে সময় ও পরিস্থিতির আলোকে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে। তবে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য কিছু কৌশল অবলম্বন করে এদের চিহ্নিত করা যায়। একবার একজন ইন্টেলিজেন্স পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, “একজন সি আই এ এজেন্টকে অনেকের মধ্য থেকে বেছে বের করতে হলে আপনাকে দূতাবাসে গিয়ে দূতাবাস ডিরেক্টরিতে এমন পদমর্যাদার কাউকে খুঁজে পেতে হবে যার পদটি সঠিক ও প্রচলিত বলে মনে হয় না; এবং এ ধরনের কাউকে চিহ্নিত করা গেলে, আপনি আশা করতে পারেন যে কোনো একজন সি আই এ এজেন্টকে আপনি চিহ্নিত করে ফেলেছেন।” যদিও এ পদ্ধতিটি ‘অত্যন্ত সহজ’ বলে মনে হয়, কিন্তু এভাবে অনেককে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

কোনো দেশ কখনো গুপ্তচর নিয়োগের কথা স্বীকার করে না। প্রাচীনকাল হতে এটাই প্রচলিত ‘আপ্তবাক্য’ হিসেবে স্বীকৃত। কোনো একজন লেখকের ভাষ্যমতে (আমি এ মুহূর্তে তাঁর নাম মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত), “ধরুন, ‘ক’ নামক কোনো একটি দেশ ‘খ’ নামক দেশের একজন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করলো, তখন অতি অবশ্যই তাঁকে তাঁর নিজ দেশ অস্বীকার করে বসবে। এর কদিন পর যদি ‘খ’ দেশে ‘ক’ দেশের কোনো গুপ্তচর ধরা পড়ে তবে আবার সেই পুরানো নাটকের অবতারণা হবে। তবে শেষমেশ দেখা যাবে যে, কয়েকদিন অতিবাহিত হবার পর উভয় দেশই একে অন্যের সাথে গ্রেফতারকৃত গুপ্তচরদ্বয়ের বিনিময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” সুতরাং ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রম কখনো বন্ধ হয় না বরং ক্রমাগত এর উৎকর্ষ সাধন করা হয়। কখনো কখনো ইন্টেলিজেন্স পরিমন্ডলে লক্ষ্য করা যায় যে, তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচারযুদ্ধ শুরু করে দেন। এরূপ একটি ঘটনা হচ্ছে সি আই এ’র প্রকাশিত ও অর্থ সাহায্যে প্রচারিত ‘জন ব্যারন’ লিখিত ‘KGB – The Secret Work of Soviet Secret Agents’ নামক বইটি যা ভারতসহ সারা পৃথিবীতে সর্বত্র সহজলভ্য। অন্যদিকে এ বই প্রকাশের কিছুদিন পর কে জি বি সারা পৃথিবীর সেরা সি আই এ এজেন্টদের তালিকাসহ একটি বই প্রকাশ করে।

পৃথিবীতে অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় গুপ্তচর জগতেও ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ একটি সার্বক্ষণিক ব্যাপার, আর তাই গুপ্তচরের প্রয়োজনীয়তাও আরো অনেক বেশি বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আসুন আমরা সমস্যাটিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বিবেচনা করি। পৃথিবীতে ভবিষ্যতে কী কী অবস্থান ও দিক থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, পারমাণবিক অস্ত্রের আবির্ভাব ও বিস্তার লাভের পর যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ হতে যুদ্ধ নিম্নলিখিত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অর্থাৎ যুদ্ধ লাগতে পারে-

১। সমান পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন এমন দুটি দেশের মধ্যে,

২। একটি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ ও অন্য একটি পারমাণবিক ক্ষমতাহীন দেশের মধ্যে, অথবা এমন দুটো পক্ষের মধ্যে,

৩। যারা প্রচলিত উন্নত অস্ত্রের অধিকারী।

এখন, যুদ্ধ যদি প্রথমে উল্লিখিত দুটি দেশের বা জোটের মধ্যে সংঘটিত হয় তবে তা উভয়ের জন্য হবে আত্মহত্যামূলক পদক্ষেপ। এটি প্রতিরোধের সম্ভাব্য সমাধান হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তিতে উপনীত হওয়া। এ ক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো চুক্তি ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করার জন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে উল্লিখিত যুদ্ধাবস্থায় পারমাণবিক ক্ষমতাহীন কোনো দেশ যদি পারমাণবিক ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয় তবে তার গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষে অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই অনুসরণ করা হবে।

‘লিড্‌ল হার্ট’, (ক্যাপ্টেন লিড্‌ল হার্ট- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীর অফিসার ছিলেন) যিনি একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে সমধিক পরিচিত, তিনি যুদ্ধ সম্পর্কিত চমৎকার কিন্তু অতি বাস্তব একটি মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মতে, “যদি একপক্ষ আণবিক শক্তির অধিকারী হয়, তবে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিছক নির্বুদ্ধিতা। তাই এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই এবং প্রতিরোধের উপায় হওয়া উচিত অন্তদর্শী বা ধূর্ত কুটনীতির আশ্রয় নেয়া বা অহিংস উপায়ে অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে গেরিলাযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া। যেখানে উভয়পক্ষই পারমানবিক ক্ষমতাসম্পন্ন সেখানেও যুদ্ধ করা একেবারেই বোকামী বৈ কিছু নয়, কারণ পারমাণবিক ক্ষমতা নিয়ে সীমাহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে বোকামি হতেও চরম বাজে সিদ্ধান্ত এবং সবশেষে তা উভয়ের জন্য আত্মঘাতী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য এ সব কিছুর আলোকে দৃঢ়ভাবে বলা যাবে না যে যুদ্ধ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাবার আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যুদ্ধোম্মাদ নেতারা যুদ্ধের জন্য উন্মত্ত হওয়া ব্যতিরেকে যুদ্ধ বিগ্রহের প্রসার কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসতে পারে এবং এটা দু’পক্ষের অনুমোদিত নিয়ম রীতির আওতায় চলে আসবে বলে ধারণা করা যায়। এ ধরনের বন্ধনের ফলশ্রুতিতে নতুন প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটা স্বাভাবিক… অনুপ্রবেশ হয়ে উঠবে মৌলিক পদ্ধতি… যতো বেশিমাত্রায় ও গভীরতায় অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়া সচেষ্ট হবে ততই প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে আনবিক শক্তির মোতায়েন বা ব্যবহার সীমিত হয়ে আসবে।” (Liddell Hart, The Revolution of Warfare’, Faber, London, 1946, Yale, U. P. New Haven. 1947. Also See Brian Bond Liddell Hart – “A Study of his Military Thought”, Cassell and Company Ltd. London, 1971).

যুদ্ধ প্রতিরোধ সম্পর্কেও ‘লিড্ল হার্ট” একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেন, “যদি বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তবে এতোদিনে আমাদের যুদ্ধ প্রতিরোধের একদম নিশ্ছিদ্র কোনো ব্যবস্থায় মনযোগ কেন্দ্রীভূত করার বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয় এবং সাথে সাথে বাস্তব ভিত্তিক প্রয়োজনীয়তার ওপর নজর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ যাতে যুদ্ধ প্রতিরোধ করা না গেলেও যেন পর্যায়ক্রমিক শান্তি প্রক্রিয়ায় কোন বাঁধা না পড়ে।”

আমি কখনই একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টা বা সমরবিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু ‘লিড্‌ড্ল হার্টের’ পর্যবেক্ষণ আমার কাছে স্বাভাবিক ও সাধারণ মাত্রাজ্ঞান প্রতিফলিত করেছে বলে মনে হয়। তাঁর পর্যবেক্ষণ এ ধারণাকে আরো দৃঢ় করে যে, যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য অতি অবশ্যই একটি শক্তিশালী ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি থাকা প্রয়োজন। ‘থমাস পাণ্ডার্সের’ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, “আধুনিক যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র বাহিনী, টেলিফোন, ডাক ও রাজস্ব বিভাগের মতো, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।”

তবে ‘র’-এর ক্ষেত্রে হয়তো প্রশ্ন করা যায়, ‘র’-কে কি কাজে লাগানো হবে?” এর উত্তর নিহিত আছে ভবিষ্যতে, আর-এর পূর্ববর্তী ১২ বছর মিশে আছে ইতিহাসের পাতায়।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *