১১. গুজরাতের আমন্ত্রণ

গুজরাতের আমন্ত্রণ আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না, কবিকে বেরিয়ে পড়তেই হল সদলবলে। অনেকগুলি সভা-সমিতিতে যোগ দিতে হবে, তবে প্রধান আমন্ত্রক গুজরাত সাহিত্য পরিষদ। কবি আসছেন জেনে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেবার জন্য আগে থেকেই প্রচার চালাতে লাগলেন গান্ধীজি।

আমেদাবাদ পৌঁছোবার আগেই প্রতি রেল স্টেশানে জনতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য উপস্থিত। বহুকালের মধ্যে কোনও রাজকীয় অতিথিও এত সমাদর পায়নি।

গান্ধীজির সঙ্গে কবির রাজনীতি বিষয়ে কিছু কিছু মতভেদ তো আছেই, সাহিত্য বিষয়েও মতের মিল নেই। গান্ধীজি মনে করেন, জনসাধারণের উন্নতিই সাহিত্যিকদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁদের রচনা যেন সাধারণ মানুষের ঈশ্বর উপলব্ধির সহায়ক হয়, যে কারণে বাণভট্টের কাদম্বরীর চেয়েও তুলসীদাসের রামায়ণ অনুসরণযোগ্য। গান্ধী রসের ব্যাপারটা বিশেষ বোঝেন না।

সবরমতী আশ্রমে এক রাত কাটিয়ে কবি রওনা দিলেন ভাবনগর রাজ্যের দিকে। তারপর কাঠিয়াবাড়। ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যের রাজারা বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করছেন, তাই বক্তৃতাও দিতে হচ্ছে অনবরত।

সারাজীবনে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন অনেক, কখনও লিখিতভাবে, কখনও সরাসরি ভাষণ। এখন তিনি এমনই অভ্যস্ত যে অনর্গল সুললিত বাক্য বেরিয়ে আসে। সহজে ক্লান্তও হন না।

তবু এক একটা সভার মধ্য পথে তাঁর মনে হয়, বক্তৃতা দেওয়াই কি তাঁর কাজ? একটি কিশোরী মেয়ে তাঁকে বার বার বলে, আপনি এত বক্তৃতা দেন কেন? সত্যিই তো, এইসব কথা শুনে কার কী লাভ হয়? কেউ কি মনে রাখে? একটা সভায় সে কথা বলেও ফেললেন।

এখানে তাঁকে ইংরেজিতেই ভাষণ দিতে হয়। গান্ধীজি একদিন বললেন, ইংরেজি তো অনেকেই বোঝে না, আপনি হিন্দিতেই বলুন না। যতটুকু পারেন, যেমন করে পারেন।

কবি শুরু করলেন এইভাবে : আপকি সেবামে খড়া হোকর বিদেশীয় ভাষা ক য়হ হম চাহতে নহী। পর জিস প্রান্তমেঁ মেরা ঘর হৈ বহাঁ সভামে কহনে লায়েক হিন্দিকা ব্যবহার হৈ নহী।

মহাত্মা গাঁধী মহারাজকী ভী আজ্ঞা হৈ হিন্দিমে কহনেকে লিয়ে। যদি হম সমর্থ তব ইসসে বড়া আনন্দ ঔর কুছ হোতা নহী। অসমর্থ হোনে পর ভি আপকি সেবামে মৈ দো চার বাত হিন্দিমে বলুংগা।…

কিছুক্ষণ হিন্দিতে বলার চেষ্টা করে তিনি বাংলায় বলতে লাগলেন, আমি কবি মাত্র—বাক্য আমার কণ্ঠে নেই, আছে হৃদয়ে। আমার বাণী এরকম সভায় বেরোতে চায় না, সে থাকে ছন্দের অন্দরমহলে।… সমাদর করে আমাকে আজ মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়েছে, কবির কাছে চাওয়া হচ্ছে বক্তৃতা–বাঁশিকে লাগানো হচ্ছে লাঠির কাজে। …সভায় দাঁড়িয়ে আনন্দ দেওয়া, উপদেশ দেওয়া, কিছু কাজের কথা বলার শক্তি আমার নেই। জনসাধারণ আমার প্রতি যে দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছেন, তার প্রতিদান দিতে না পেরে আমি হার মানছি…এই প্রীতি ও সমাদর ঈশ্বরেরই অযাচিত দান—সেই দানের যোগ্য হবার সাধনা করাই আমার কাজ। সেই সাধনা কবির সাধনা।

গুজরাতের অনেকগুলি জায়গা সফর করে তিনি এলেন বোম্বাই। সেখানে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের দিনটির স্মরণ সভার আয়োজন চলছে। সভাধিপতি বিশিষ্ট ব্যারিস্টার ও কংগ্রেসের নেতা জনাব মহম্মদ আলি জিন্না। তিনি চান জালিয়ানওয়ালাবাগের জমিটি কিনে সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হোক। জিন্না এসে কবিকে ধরলেন, এই প্রস্তাবের সমর্থনে একটা ভাষণ লিখে দিতে। কবি অবশ্য সেই বীভৎস দিনের স্মৃতি স্থায়ী করার সমর্থক নন।

গুজরাত থেকে কিছু অর্থ পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু তাও যথেষ্ট নয়। শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর সব খরচ চালাবার দায়িত্ব কবির নিজের। এদিকে জমিদারির আয় খুবই কমে এসেছে, প্রমথ বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। এতদিন মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির জমিদারি ছিল যৌথভাবে, এবার ভাগাভাগি না করে উপায় নেই। কারণ, মেজদাদার ছেলে সুরেন জমি কেনা-বেচার ফাটকা ব্যবসা করতে গিয়ে দারুণ ঋণগ্রস্ত, সে তার অংশ বিক্রি করে দিতে চায়। এর মধ্যেই বালিগঞ্জে ঠাকুরদের জমি কিনে নিয়েছে বিড়লা নামে এক ব্যবসায়ী, কুড়ি বিঘে জমি বিক্রি হয়েছে মাত্র চার লাখ টাকায়। সুরেনের বোন ইন্দিরাও তার মায়ের কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে পাওয়া ব্রাইট স্ট্রিটের কমলালয়’ নামে সুদৃশ্য বাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

টাকা চাই, আরও টাকা চাই। টাকার খনি এখন আমেরিকা। ইওরোপ এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, কিন্তু আমেরিকার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। সে দেশে বক্তৃতা নিয়েও ব্যবসা হয়। কোনও কোনও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যেসব ব্যক্তিদের নামের চাহিদা আছে, তাঁদের দিয়ে বিভিন্ন শহরে বক্তৃতার ব্যবস্থা করে, টিকিটের লভ্যাংশের কিছুটা বক্তাকে দিয়ে সিংহভাগ নিজেরা নেয়। একবার চুক্তি হলে তার অন্যথা হবার উপায় নেই। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন একবার এরকম চুক্তিতে বাধ্য হয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়েও নিষ্কৃতি পাননি। নোবেল পুরস্কার পাবার পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একবার বক্তৃতা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

কবি ঠিক করলেন, যতই পরিশ্রম হোক, আবার যাবেন আমেরিকায়। এর মধ্যে একবার যাত্রার উদ্যোগ নিয়েও স্থগিত রাখতে হয়েছিল। কিন্তু এবারে কবির এজেন্ট মেজর পল্ড আর উৎসাহ দেখাচ্ছে না। সে জানাল যে আমেরিকায় এখন ভারতীয় নামের বাজার মন্দা। যুদ্ধ ফেরত সৈন্যদের সংবর্ধনা জানাতেই সাধারণ মানুষ বেশি উৎসাহী। ইওরোপীয় উদ্বাস্তুদের জন্য চাঁদা তোলা হচ্ছে চতুর্দিকে, ভারত সম্পর্কে কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। কবির ইংরিজি বইগুলির বিক্রিও কমে আসছে হুহু করে।

তবু কবি ঠিক করলেন, তিনি নিজের উদ্যোগেই যাবেন। একবার গিয়ে পৌঁছেলে বহু মানুষ অবশ্যই শুনতে চাইবে তাঁর কথা। তাঁর মুখে বিশ্বমৈত্রী ও ভারতীয় মহান ঐতিহ্যের বাণী।

প্রথমে থামলেন লন্ডনে। সেখানে তাঁর বন্ধু ও অনুরাগীর সংখ্যা ইংরেজদের মধ্যেও অনেক। সকলকেই খবর দেওয়া হল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সাক্ষাৎ করতে এলেন না, রোদেনস্টাইন-এর মতন যে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হল, তাঁদেরও কথাবার্তা কেমন যেন আলগা আলগা। শুষ্ক ভদ্রতার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব প্রকট।

কবির একান্ত অনুগত উইলি পিয়ার্সন যুদ্ধের সময় নজরবন্দি ছিলেন, এখন তিনি হলেন কবির সফর-সচিব। কবি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলল তো? বন্ধুরা আমাকে হঠাৎ পরিত্যাগ করল কেন?

পিয়ার্সন বুঝেছেন কারণটি কী। কবির নাইটহুড প্রত্যাহার অনেকেই ভালভাবে নিতে পারেনি। বিশেষত যুদ্ধের সংকটের মধ্যে ইংরেজ সরকারকে অপদস্থ করাটা মেনে নিতে পারেনি অনেকেই।

কিন্তু ভারতীয়দের ওপর যে নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে, তা কি এখানকার বুদ্ধিজীবীরা জানে না?

না, অনেকেই জানে না, পত্র পত্রিকায় সঠিক খবর প্রকাশিত হয়নি। তা ছাড়া, ইংরেজ জাতির স্বভাবই এই, যুদ্ধের সময় সরকারের কোনও কাজেরই সমালোচনা করে না। সবাই সমর্থনে এককাট্টা। এখানে কিছু জানাবার উপায় নেই, কোনও কাগজ ছাপবে না।

ইংল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে এসে বরং কিছুটা সমাদর পেলেন কবি। দেখা হল অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিত ও মনীষীর সঙ্গে। ইওরোপের আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে কবি পাড়ি দিলেন আমেরিকার পথে।

নিউইয়র্কে এসে হোটেলে উঠলেন নিজের খরচে। সবকিছুর কী সাংঘাতিক দাম। ইওরোপের প্রায় সাতগুণ। এর আগে সম্পন্ন ব্যক্তিদের বাড়িতে তাঁকে আতিথ্য দেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। এবারে কেউ এল না, দিনের পর দিন বসে রইলেন হোটেলের কক্ষে। সংবাদপত্রে তাঁকে নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কয়েকটি ছোটখাটো সভার আয়োজন হল বটে, তা মোটেই অর্থকরী নয়। এবং শ্রোতাদের আগ্রহেরও বেশ অভাব।

কবি আগে ধারণাই করতে পারেননি যে ইংরেজদের মতন, তাঁর নাইটহুড প্রত্যাহার নিয়ে মার্কিনিরাও বিরাগ পোষণ করবে। যুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিনিরা ইংরেজদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই ইংরেজ সরকারের নিন্দে তারাও বরদাস্ত করতে পারে না। তাছাড়া ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এর মধ্যে তলে তলে এ দেশে কবির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে।

আমেরিকায় অর্থ সংগ্রহের আশা নেই দেখে কবি যখন অবিলম্বে ফিরে যাবার কথা চিন্তা করছেন, তখন মেজর পড় এসে জানাল যে, টেক্সাস রাজ্যে কবির গোটা পনেরো বক্তৃতা সভার আয়োজন করা যেতে পারে।

তাতেই রাজি হয়ে গেলেন কবি। তাতে পরিশ্রম হল প্রচুর, কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস ঘোরাঘুরি করলেন, তবু তাঁর প্রত্যাশা মোটেই পূর্ণ হল না। বিশ্বভারতী গড়ার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছেন, অনেকের কাছে। তা শোনাচ্ছে ভিক্ষে প্রার্থনার মতন। অনেক সময় তাঁর আয়ের চেয়ে ব্যয় হতে লাগল বেশি। আমেরিকার মানুষদের ওপর ইংরেজদের প্রচারের প্রভাব যে এতখানি হতে পারে, তা তিনি বুঝতেই পারেননি। তিনি ভারতে ইংরেজ সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করছেন, ইংরেজরা তার প্রতিশোধ নিচ্ছে অতি গোপনে এবং সূক্ষ্মভাবে তাঁর জনপ্রিয়তায় বাধা দিয়ে। এক মার্কিনি ধনবতী মহিলা বিশ্বভারতীর জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার দিতে প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকেও এক ইংরেজ অফিসার বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিবৃত্ত করে।

এক জায়গায় কবিকে সত্যিই ভিক্ষে নিতে হল। ঘটনাটিকে একটি তিক্ত রসিকতা বলা যেতে পারে।

নিউ ইয়র্ক শহরের উত্তরে ক্যাটস্কিল মাউনটেন্সে এক বিলাসবহুল গৃহে কবি আমন্ত্রণ পেলেন। সেখানে প্রচুর ধনী ব্যক্তির সমাগম হয়। যেমন বিরাট ফাউন্টেনপেন কম্পানির মালিক মিঃ ওয়াটারম্যান, সাবান কম্পানির মালিক মিস্টার কলগেট, কোডাক নামে ফিল্ম কম্পানির মালিক মিস্টার ইস্টম্যান। পার্টিতে প্রচুর লোকজন। তার মধ্যে দু’জন রাশিয়ান শিল্পী কবির ছবি আঁকতে চেয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। এই সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ধনকুবের জে ডি রকেফেলার, গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি মুখ মোছর জন্য পকেট থেকে রুমাল বার করলেন, টুং করে একটা দশ পয়সা মাটিতে পড়ল। রকেফেলারের মতন ধনীরা পকেটে পয়সা রাখেন না, কী করে যেন ওই দশ পয়সাটা রুমালের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই পয়সাটা কবির হাতে গুঁজে দিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন।

কবি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতেই পারলেন না। তিনিও রকেফেলারকে চেনেন না। বিস্মিতভাবে তিনি অন্য লোকদের বলতে লাগলেন, এটা অদ্ভুত না, এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আমার হাতে এই পয়সাটা দিয়ে গেলেন, আমাকে কি দেখে ভবঘুরে মনে হয়? ক্রমে কথাটা গৃহস্বামীরও কানে গেল, তিনি লজ্জা পেয়ে গোপনে খোঁজ করতে লাগলেন জনে জনে। রকেফেলারকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে, এক বুড়ো নিগ্রোকে আমি একটা ডাইম ভিক্ষে দিয়েছি!

শুধু ভারতীয় ভক্ত ও অনুরাগিণীদের চোখেই নয়, ইওরোপের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও যে কবিকে মনে করেন অতি সুদর্শন ও অভিজাত চেহারা, কেউ কেউ তাঁকে তুলনা করেছেন যীশুর সঙ্গে, সেই কবিই এক ধনী আমেরিকানের চোখে ‘বুড়ো নিগ্রো’।

এরকম পরিবেশে কবির নিজস্ব সচিব, অতিভক্ত, শান্ত, নিরীহ পিয়ার্সনের সঙ্গেও একদিন মন কষাকষি হয়ে গেল। কবি যথোচিত সম্মান পাচ্ছেন না দেখে পিয়ার্সন ভক্তির বাড়াবাড়ি শুরু করে দিলেন, যেন শ্বেতাঙ্গদের প্রতিভূ হিসেবে সব দোষ স্খলনের ভার তাঁর ওপর। তিনি লোকজনের সামনে কবির পায় হাত দিয়ে প্রণাম করেন বারবার। সবসময় গুরুদেব গুরুদেব করেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের ব্যাপারে এখানে অনেকেই হতচকিত হয়ে যায়। গুরুদেব শব্দটির মানে শুনেও তাদের ভুরু কুঁচকে ওঠে।

একদিন বিরক্ত হয়ে কবি তাঁকে বললেন, তুমি সবসময় কেন আমাকে গুরুদেব বলে ডাকো? কেন আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো? এ অভ্যেস ছাড়ো! আমি জানি, তুমি এটা মন থেকে করো না, করতে পারো না। আর সেইজন্যই এটা সত্যিকারের অসৌজন্য। তুমি জানো, আমি কখনওই অবতার কিংবা গুরু হতে চাই না। আমার নিকটজনদের কাছ থেকে আমি শ্রদ্ধাভক্তিও দাবি করি না। আমি শুধু চাই ভালবাসা আর সহানুভুতি। আমি শুধুমাত্র একজন কবি, আর কিছু না।

বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে কবি আমেরিকা থেকে ফেরার পথে থামলেন লন্ডনে। এখানেও কয়েকদিন থেকে তিনি বুঝলেন ভুল করেছেন, পুরোনো বন্ধুদের আন্তরিকতাহীন ব্যবহারই তাঁকে বেশি আঘাত দেয়। ঠিক করলেন ফ্রান্সে চলে যাবেন। এলেন বিমানে। এই প্রথম তাঁর আকাশপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হল। দেখা হল আঁদ্রে জিদ ও রোম্যাঁ রোলার সঙ্গে। খাতির যত্ন পেয়ে তাঁর হৃদয় খানিকটা জুড়োলো।

আমেরিকায় পাঁচটি মাস নষ্ট হয়েছে, ইওরোপের বিভিন্ন দেশে কাটালেন প্রায় আড়াইমাস। সুইডেনে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিতে পারেননি, আট বছর পর সেখানে যেতে হল আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা দিতে। অন্যান্য দেশের তাঁর অনুবাদক ও প্রকাশকরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, তাও উপেক্ষা করা যায় না। হুয়ান র্যামোন হিমেনেথ তাঁর সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছেন স্পেনে, এঁর অনুবাদে কবির বেশ কয়েকটি বই জনপ্রিয় হয়েছে। সংবর্ধনার সময় কবির একটি নাটক মঞ্চস্থ হবার কথা, তাতে দু’জন তরুণের অভিনয় সম্পর্কে আগে থেকেই প্রশংসা শোনা যাচ্ছে। তরুণ দুটির নাম ফেডেরিকো গার্থিয়া লোরকা আর লুই বুনুয়েল, তারা কবির খুবই অনুরাগী।

এবারেও খুব অভ্যর্থনা পেলেন জার্মানিতে।

তাতে তিনি মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে থাকলেও দুটি ব্যাপার বুঝতে তাঁর ভুল হল। তিনি ভেবেছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানিতে তরুণ সমাজ আর যুদ্ধ চায় না, এখন শান্তির বাণী শুনতে চায়। প্রকৃতপক্ষে তা নয়, পরাজিত ও অপমানিত জার্মানরা ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। দিন দিন বাড়ছে জঙ্গি মনোভাব, তৈরি হচ্ছে নাৎসি দল। জার্মান লেখকবুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কমে আসছে তাঁর প্রভাব। বেল্ট ব্রেখট, হারমান হেস, স্টিফেন জোয়াইগ, কাউন্ট হারমান কাইজারলিং প্রমুখ তাঁর সুখ্যাতি করলেও অনেকে রইলেন বিমুখ। যেমন রাইনার মারিয়া রিলকে, টমাস মান, অসওয়াল্ড স্পেঙলার, ফ্রানৎস কাফকা প্রমুখেরা রইলেন উদাসীন, কেউ কেউ আড়ালে আবডালে নিলে করতেও ছাড়লেন না। আঁদ্রে জিদের অনুবাদ করা গীতাঞ্জলি পড়েছিলেন রিলকে, তাঁকে ওই বইটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল, রিকে রাজি হননি।

জার্মানিতে বেশ কিছু অর্থ প্রাপ্তি হয়েছিল কবির, কিন্তু অন্যায্য ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মান মুদ্রার এমনই দাম পড়ে গেল যে টাকাগুলো হয়ে গেল নিছক কাগজ!

আর মন টিকছে না, কবিকে হাতছানি দিচ্ছে তাঁর স্বদেশ, বারংবার মনে পড়ছে শান্তিনিকেতনের কথা। তিনি জাতীয়তার সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হতে চান, কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই জাতীয়তাবাদের গোঁড়ামি আরও দৃঢ় হচ্ছে। তবু তিনি জেদ ধরে আছেন, অর্থ সাহায্য পাওয়া যাক বা না যাক, বিশ্বভারতীতে তিনি পূর্ব পশ্চিমের মিলন ঘটাবেনই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞান ও আদর্শের বিনিময়েই সভ্যতার প্রকৃত অগ্রগতি হতে পারে। সিলভ্যাঁ লেভির মতন বিদগ্ধ ব্যক্তি শান্তিনিকেতনে এসে পড়াতে রাজি হয়েছেন এটাও তো একটা দারুণ প্রাপ্তি। এই ভাবেই শুরু হবে কবির আদর্শের বাস্তবায়ন।

দীর্ঘকালীন প্রবাসেও কবি মাঝে মাঝে খবর পান দেশের ঘটনাবলির। গান্ধীজি আবার শুরু করেছেন অসহযোগ আন্দোলন। ছেলেরা ইস্কুল কলেজ ছেড়ে দিচ্ছে, সরকারের সঙ্গে পদে পদে অসহযোগিতার নামে ইতস্তত ঘটছে সংঘর্ষ। এর পরিণাম কী হবে, তা কি গান্ধীজি ভাবছেন না?

মার্সেই থেকে কবি ফেরার জাহাজে চেপেছেন। সহযাত্রী একটি বাঙালি তরুণ একদিন এসে তাঁকে প্রণাম করল, চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েসী এই ছেলেটির নাম সুভাষচন্দ্র বসু, তার মুখমণ্ডলে রয়েছে। প্রতিভার দীপ্তি। সে কেমব্রিজ থেকে ফিরছে, মেধাবী ছাত্র, আই সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সে পদত্যাগ করেছে, ইংরেজ সরকারের অধীনে সে চাকরি করতে চায় না, দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়াই তার অভিপ্রায়। কবির বেশ পছন্দ হল ছেলেটিকে।

সন্ধেবেলা কবি দাঁড়িয়ে থাকেন জাহাজের ডেকে। তাকিয়ে থাকেন বর্ণাঢ্য সূর্যাস্তের দিকে। এক দেশে যখন সূর্যাস্ত, আর এক দেশে তখন প্রভাত। যেমন জীবনের একদিকে বার্ধক্য, অন্যদিকে শৈশব। জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতা, খ্যাতি, সম্মান, অর্থ এই সব কিছু ভুলে কবির ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কৈশোর-যৌবনে। কিছুক্ষণের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন ভানুসিংহ, চোখের সামনে দুলতে থাকে এক প্রাণচঞ্চলা কিশোরীর মুখ।

তিনি আপন মনে বলতে লাগলেন, যৌবনবেদনারসে উচ্ছল আমার দিনগুলি, হে কালের অধীশ্বর, অন্যমনে গিয়েছ কি ভুলি, হে ভোলা সন্ন্যাসী। চঞ্চল চৈত্রের রাতে কিংশুক মঞ্জরী সাথে শূন্যের অকূলে তারা অযত্নে গেল কি সব ভাসি। আশ্বিনের বৃষ্টি হারা শীর্ণ শুভ্র মেঘের ভেলায়, গেল বিস্মৃতির ঘাটে স্বেচ্ছাচারী হাওয়ার খেলায়, নির্মম হেলায়?

বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে দুলে উঠছে জাহাজ। আকাশে যেন নতুন নতুন নক্ষত্র জমা হচ্ছে পুরাতনদের পাশে। আকাশও যেন দুলছে। জীবন যেন চলেছে লক্ষ্যহীন পথে।

কবি ওপরের দিকে চেয়ে ধ্রুবতারাটিকে খুঁজতে লাগলেন।

সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট নাবিকদের এই নক্ষত্রই তো পথ দেখায়।

কবির মনে পড়ল, জীবনে প্রথমবার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড গমনের সময় তিনি একটি গান বেঁধে ছিলেন। তখনও তার মন এক জনের বিচ্ছেদ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল। বিলেত যাওয়ার আকর্ষণের চেয়েও সেই বিশেষ একজনের জন্য পিছুটান ছিল অনেক বেশি।

অনেকদিন পর কবি সেই গানটি গুনগুন করতে লাগলেন : তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথ হারা। যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো, আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণ ধারা। তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে, তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল কিনারা। কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি, অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় হারা।

সেইদিন আর এখনকার মধ্যে কত দীর্ঘ দূরত্ব, তা শুধু সময় দিয়ে মাপা যায় না। সময়ের ব্যবধান অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়, আবার দুটি একটি ব্যাপার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে। প্রথম যৌবনের পরিচিত কত মুখ অস্পষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন বউঠানের মুখখানি চির উজ্জ্বল।

কিশোরী রাণুই যেন নতুন বউঠানের স্মৃতি বেশি করে ফিরিয়ে আনছে। অথচ দু’ জনের কত অমিল। কবিও সেই আমি আর এই আমি এক নেই। তখন ছিলেন সদ্য যৌবনে, আজ তিনি প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায়। বয়েসের হিসেবে প্রৌঢ়ত্ব, শরীরে নয়। শরীর এখনও এই পৃথিবীর রূপরস-গন্ধ উপভোগ করার জন্য উন্মুখ। আর তার মনের অবস্থান যে কোথায়, তা ক’জন জানতে পারে? অন্য সকলে সব সময় তাকে একটা উঁচু বেদীর ওপর বসিয়ে রাখতে চায়, শুধু এই একটি কিশোরীই তাঁকে সেখান থেকে টেনে নামিয়ে খেলার সাথী হতে ডাকে। বড় মধুর সে খেলা। বয়েস কমাবার খেলা।

কতকাল দেখা হয়নি, কেমন আছে সে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *