গভীর রাতে আমাকে কে যেন ডেকে তুলল, ইবু, এই ইবু ওঠ! দেখ কে এসেছে।
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। রাশেদ আরেকবার আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল, দেখ ইবু, দেখ।
হারিক্যানের আবছা আলোতে আমার সামনে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা চুল মুখে খোচা খোচা দাড়ি। মাথায় একটা গামছা বাঁধা। পরনে খাটো একটা লুঙ্গি কিন্তু পায়ে সবুজ রঙের বুট। আমি আবার ভাল করে তোকালাম তখন হঠাৎ করে চিনতে পারলাম, শফিক ভাই!
শফিক ভাই আমাকে আর রাশেদকে এত শক্ত করে ধরলেন যে ছাড়তেই চান না। খানিকক্ষণ পর বললেন, এখন দেখো তো তোমরা একে চিনতে পারো কি না। আগেই দেখো না, চোখ বন্ধ করে রাখে।
আমি আর রাশেদ চোখ বন্ধ করে রাখলাম, বুঝতে পারলাম সবাই মিলে একজনকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাল। তারপর শফিক ভাই রহস্য করে বললেন, ঠিক আছে এখন চোখ খুলো।
আমরা তোকালাম, আমাদের সামনে কাদের দাঁড়িয়ে আছে। খাটো করে লুঙ্গি পরা, কোমরে গামছা হাতে একটি রাইফেল।
কাদের! তুই!
আমি আর রাশেদ ছুটে কাদেরকে এত জোরে ধরলাম যে সে একেবারে মাটিতে আছিড়ি খেয়ে পড়ল। সাথে আমরাও।
কাদের বলল, আর কি করিস! কি করিস! ছাড়, ছাড় আমাকে। ছাড় বলছি—
তুলি হবে না।
আমরা কাদেরকে ছাড়ি না। আমাদের ক্লাসের ছেলে কিন্তু কখনো কাদেরের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয় নি— কিন্তু হঠাৎ মাঝরাতে হারিক্যানের আবছা আলোতে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমাদের কি গভীর একটা ভালবাসা হয়ে গেল। কাদের বলল, ছড়ি! ছাড়া আমাকে! ভাল হবে না বলছি- একেবারে ব্রাশ ফায়ার করে দেব।
আমরা তবুও কাদেরকে ছাড়ি না, কোন কথা বলতে পারি না। শুধু বলি, তুই কাদের তুই! তুই!
আমাদের ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমরা কাদেরকে ছাড়লাম। কাদের উঠে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে ধূলা ঝেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। কাদেরকে দেখতে কেমন বড় মানুষের মত দেখাতে থাকে। আর আমি রাশেদ কাদেরকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম।
তুই সত্যি সত্যি মুক্তি ত গেছিস?
কেমন করে গেলি?
তোকে নিল?
আমরাও যাব তাহলে!
আমাদেরকে কি নেবে?
যুদ্ধ করেছিস তুই?
সত্যি সত্যি যুদ্ধ?
কাদের কথা না বলে বড় মানুষের মত হাসে। আমরা যখন বললাম। আমরাও মুক্তিবাহিনীতে যাব তখন মাথা নেড়ে বলল, তোরা বেশি ছোট, তোদের নেবে না।
তাহলে তোকে যে নিল?
আমি এতবার পরীক্ষায় ফেল করেছি বলে তোদের সাথে এক ক্লাসে। না হলে আমার এতদিনে কলেজে যাবার কথা!
ধুর মিথ্যুক কোথাকার।
তোর তো মুক্তিবাহিনীতে আছিসই। কাজল ভাই বলেছেন তোরা নাকি সাংঘাতিক নিখুঁত একটি ম্যাপ তৈরি করছিস। মিলিটারী ক্যাম্পের ম্যাপ। তোদের ম্যাপ দিয়ে একটা অপারেশান হবে। হবে না?
আমরা মাথা নাড়লাম।
তাহলে? কাদের আস্তে আস্তে বলল, বড় কষ্ট মুক্তিবাহিনীতে। খাওয়ার কষ্ট, ঘুমের কষ্ট, থাকার কষ্ট। এই জুতা পরে কাদার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের মাঝে ঘা হয়ে গেছে। মাথার মাঝে উকুন এই বড় বড়, বিশ্বাস করবি না। দুই দিন তিন দিন হয়ে যায়। ভাত খাই না, খালি শুকনা চিড়া। আর একেকটা গুলীর বাক্স যে কি ভারি তোদেরকে বোঝাতে পারব না।
কাদের হঠাৎ একটু হেসে বলল, কিন্তু যখন গ্রামের মানুষেরা আমাদেরকে দেখে তখন এত যত্ন করে তোরা বিশ্বাস করবি না। সেদিন একজন বুড়ি আমাকে ধরে হাউমাউ করে কান্না, বলে বাবা এই ছোট কেন যুদ্ধ করতে যাও, তুমি আমার সাথে থাক, আমার কোন ছেলে পূলে নাই। আমার ছেলে তুমি আমার ধন!
তাই বলল?
হ্যাঁ। আমরা যদি কোন গ্রামে থাকি তখন গ্রামের মানুষ গরু জবাই করে খাওয়ায়। কিন্তু নিষেধ আছে আমাদের।
নিষেধ?
হ্যাঁ। কারো বাড়িতে খেলে জানাজানি হবে, পরে খবর পেয়ে মিলিটারী এসে বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে দেবে।
হঠাৎ কান্দেরের কিছু একটা মনে পড়ল। চোখ বড় বড় করে বলল, আমরা তো একটা রাজাকার ধরে এনেছিা!
রাজাকার ধরে এনেছিস?
হ্যাঁ কদমতলার পুলের নিচে পাহারা দিতে দিতে শালার ব্যাটা ঘুমিয়ে গেছে আমরা চুপি চুপি গিয়ে পিছন থেকে চেপে ধরে ফেলেছি। তারপর পিছমোড়া করে চোখ বেঁধে নিয়ে এসেছি।
চোখ বেঁধে?
হ্যাঁ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি করবে এখন?
কাদের উদাস ভঙ্গি করে বলল, মেরে ফেলবে মনে হয়।
মেরে ফেলবে? আমি আতংকে একেবারে চমকে উঠলাম।
মনে হয়।
তু-তু-তুই মানুষ মারতে দেখেছিস?
দেখেছি। উল্লাপুর গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে মারলি যখন আমি কাছে ছিলাম। কাদের শব্দ করে মাটিতে থুথু ফেলে বলল, এক নম্বর দালাল।
তুই কখন কাউকে মেরেছিস?
কাদের কোন উত্তর না দিয়ে পা দিয়ে মাটি খুঁটিতে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে, জানি না। যুদ্ধের ব্যাপার। কার গুলীতে কি হয়, কে কখন মারা যায় কেউ জানে না। কিছু বলা যায় না। চরের ওদিকে কয়েকবার এমবুশ করেছি। তো।
কাদের হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, আয় দেখি রাজাকার শালা কি করে।
আমরা কান্দেরের সাথে সাথে বাইরে এলাম। ওঠানে কাছে একটা গাছের সাথে একটা মানুষ দড়ি দিয়ে বাধা। মনিষটা কুঁজো হয়ে বসে আছে, হাত দুটি পিছনে শক্ত করে বেঁধে রাখা। চোখ দুটিও একটা গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কাছে একটা কুপী বাতি জ্বলছে। কুপী বাতির অস্পষ্ট আলোতে এই মানুষটির একদম কুঁজো হয়ে বসে থাকার দৃশ্যটি দেখে আমার কেন জানি গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।
কাদের কাছে গিয়ে ডাকিল, এই শালা।
রাজাকারটি কোন কথা বলল না।
এই শালা পাকিস্তানের দালাল।
রাজাকারটি তবু কোন কথা বলল না। কাদের তখন একটু এগিয়ে গিয়ে পা দিয়ে মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলল, শুওরের বাচ্চা হারামখের কথা বলিস না কেন? দেব রাইফেলের বট দিয়ে একটা?
কাদের সত্যি রাইফেলের বট দিয়ে তার মাথায় দিত। কিনা জানি না। কিন্তু ঠিক তখন দেখলাম কাজল ভাই এবং আরো কয়েকজন হেঁটে আসছেন। কাছে এসে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, একে খুলে দাও দেখি। যেভাবে বাধা হয়েছে ব্লাড সাকুলেশন তো বন্ধ হয়ে যাবে।
একজন একটু অবাক হয়ে বলল, খুলে দেব?
হ্যাঁ। একটু কথা বলি।
তারপর কি গুল্লী?
কাজল ভাই কোন উত্তর দিলেন না।
রাজাকারটির চোখ খুলে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেবার পর সে তার হাতের কব্জিতে বুলাতে বুলাতে ভয়ে ভয়ে আমাদের দিকে তাকাল। একেবারে গ্রামের একজন মানুষ। মুক্তিবাহিনীর একটা ছেলের সাথে চেহারার কোন পার্থক্য নাই। কাজল ভাই একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তোমার নাম কি?
লোকটা অস্পষ্ট গলায় বলল আফজাল।
আফজাল?
জ্বী।
আফজাল তুমি কি জান পাকিস্তানী মিলিটারী এদেশে কি করেছে?
রাজাকারটি কোন উত্তর দিল না।
কাজল ভাই গলার স্বর উচু করে বললেন, জান?
জানি।
কি করেছে?
বাড়িঘর জ্বলিয়েছে।
আর কি করেছে?
খুন খারাপী করেছে।
কত খুন খারাপী করেছে।
রাজাকাবটি কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল। কাজল ভাই ধৰ্মক দিয়ে বললেন, কত জন খুন খারাপী করেছে?
অনেক। তাহলে তুমি কেন ওদের সাথে যোগ দিলে? রাজাকারটি মুখ তুলে কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কাজল ভাই বললেন, কি বলবে, বল।
হাজী সাহেব বললেন রাজাকারের যোগ দিতে। ভাল বেতন। আমি মূর্খ মানুষ এত কিছু বুঝি না।–
তাই গিয়ে রাজাকারে যোগ দিলে? চোখ খুলে দেখলে না। কার দলে যোগ দিচ্ছ?
রাজাকারটি মাথা নিচু করে বসে রইল।
তুমি কিছু বুঝি না, মূর্খ মানুষ, কিন্তু দেশ তো বুঝো।
রাজাকারটি মাথা নাড়ল।
দেশের মানুষ বুঝ?
বুঝি।
তুমি তোমার দেশ আর সেই দেশের মানুষের সাথে বেঈমানী করেছ। দেশের সাথে বেঈমানী করতে তার শাস্তি কি জান?
রাজাকারটি কোন কথা বলল না, কাজল ভাই হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন, জানি শান্তি কি?
রাজাকারটি এবারে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বয়স্ক মানুষকে কাঁদতে দেখলে খুব খারাপ লাগে। সেদিন আজরফ আলীকে কাঁদতে দেখেছিলাম আজ একে দেখলাম। আমার কেমন জানি গা শির শিরা করতে থাকে।
কাজল ভাই আবার চিৎকার করে বললেন, কি হল কথার উত্তর দাও না কেন? বল।
রাজাকারটি তবুও কোন উত্তর দিল না, দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কাজল ভাই অনেকক্ষণ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর হঠাৎ গলার স্বর নরম করে বললেন, আফজাল–
লোকটা আস্তে আস্তে মাথা তুলে কাজল ভাইয়ের দিকে তাকাল, বলল, জী।
উঠ।
লোকটা যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না। কাজল ভাই কি বলছেন। বসে অবাক হয়ে কাজল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কাজল ভাই একটু এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে টেনে তুললেন, বললেন, তোমার কোন ভয় নাই। তোমাকে আমার কিছু করব না।
কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তুমি রাজাকারে যোগ দিয়েছ। সেইটা দেশের সাথে— দেশের মানুষের সাথে, অনেক বড় বেঈমানী। কিন্তু আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি—তুমি না বুঝে গিয়েছ। তুমি ভুল করেছ, অনেক বড় ভুল। ভুল করলে সুযোগ দিতে হয়। আমরা তোমাকে আবার সুযোগ দিব। তোমাকে ছেড়ে দেব–
রাজাকারটি হঠাৎ মাটিতে পড়ে কাজল ভাইয়ের পা চেপে ধরে বলল, আমি যাব না। আমি আপনাদের সাথে থাকব। আমাকে মুক্তিবাহিনীতে নেন—
কাজল ভাই লোকটিকে টেনে তুলে বললেন, ছিঃ, কারো পা ধরতে হয় না।
আমি হাজী সাহেবের টুটি ছিঁড়ে আনব—
না—না—না। কারো টুটি ছিঁড়তে হবে না। আফজাল আমরা নিজের দেশের মানুষ মারতে আসি নাই। সেটা পাকিস্তানীরা করছে। আমার দেশকে বাঁচাতে এসেছি—
লোকটি হাউমাউ করে কাদতে কাঁদতে বলল, আমি জান দেব স্যার আপনাদের জন্যে। জান দেব। দেশের জন্যে জানি দেব। খোদার কসম। আল্লাহর কসম।
ভেরী গুড। কাজল ভাই লোকটার পিঠে হাতে দিয়ে বললেন। দরকার হলে দেশের জন্যে জান দিও। আল্লাহ খুশি হবে। নিজের দেশকে ভালবাসা হচ্ছে ঈমানের অংশ। যে দেশকে ভালবাসে না সে হচ্ছে বেঈমান। যত নামাজ পড়ুক রোজা রাখুক সে তবু বেঈমান। বেঈমানের জায়গা হচ্ছে জাহান্নামে।
কাজল ভাই একজনকে বললেন, আফজালকে কিছু খেতে দাও। আজকের দিনটা থাকুক আমাদের সাথে। কাজকর্ম একটু দেখুক। তারপর চলে যেতে দিও।
আমি যাব না। স্যার। যাব না। থাকিব আপনাদের সাথে।
থাকতে চাইলে থাকবে। কিন্তু আগে তোমাকে তোমার গ্রামে ফিরে যেতে হবে। তোমার সাথে আর যারা রাজাকারে যোগ দিয়েছে সবাইকে বলতে হবে তারাও যেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। ঠিক আছে?
লোকটা বাধ্য মানুষের মত মাথা নাড়ল।
যাও এখন কিছু খাও।
কয়েকজনের সাথে আফজাল ভিতরের দিকে চলে যাবার পর কাজল ভাই গলা নামিয়ে বললেন, খুব চোখে চোখে রাখবে। কথাবার্তাও খুব সাবধান, কোন রকম খবরাখবর যেন না পায়। সবাইকে বল যেন খুব ভাল ব্যবহার করে।
তাই বলে একটা রাজাকারকে—
একটা রাজাকারকে যদি দলে আনতে পার ডাবল লাভ।
তা ঠিক।
আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে, রাজাকারদের বুঝিয়ে দিলে তারা মুক্তিবাহিনীতে এসে যায়। পরীক্ষা করে দেখি না ব্যাপারটা সত্যি কি না। তবে খুব সাবধান। যখন ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবে, আবার চোখ বেঁধে নিয়ে যাবে।
চোখ বেঁধে?
হ্যাঁ, যদি বিট্রে করতেও চায় কোন কিছু যেন করতে না পারে।
কি মনে হয় আপনার, বিট্রে কি করবে?
মনে হয় না। নিজের দেশের সাথে বেঈমানী করবে। এরকম মানুষ আর কয়জন আছে বলা!
কাজল ভাই এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি গো পিচ্চি মুক্তিযোদ্ধা? চা হবে নাকি এককাপ?
আমার মাথা নাড়লাম।
চল। তাহলে। চা খেয়ে দেখো আবার ঘুমানো যায় কি না। সকালে তোমাদের পৌঁছে দিতে হবে।
কাদের মৃদু স্বরে বলল, সকাল তো দেখি হয়েই যাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তোকালাম। সত্যি সত্যি অন্ধকার কেটে আলো হয়ে আসছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ভোেররাতের ঠাণ্ড বাতাসে হঠাৎ আমার কি ভালই না
লাগল।
আহা। এই দেশ যখন স্বাধীন হবে কি আনন্দই না হবে। কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল।