1 of 3

১১. কাল রাতে বামাচরণে আর রামজীবনে

১১

কাল রাতে বামাচরণে আর রামজীবনে তুমুল হয়ে গেছে। সে এমন ব্যাপার যে মনেই হয়নি এরা ভদ্রলোকের ছেলে। ও একে আর এ ওকে শুয়োরের বাচ্চা, খানকীর বাচ্চা থেকে শুরু করে এমন সব গালাগাল দিয়েছে যা সহোদর ভাইরা পরস্পরকে দিতে পারে না। মুখে মুখে যতক্ষণ হচ্ছিল ততক্ষণ একরকম ছিল, তারপর দুজনেই একজন দা আর একজন টাঙ্গি নিয়ে উঠোনে নেমে পড়ল। বউ দুটো আর নয়নতারা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল। নয়নতারা ভয়ে আর বউ দুটো রাগে। লোকজন যারা জুটেছিল তারাই শেষ অবধি খুনোখুনি হতে দেয়নি। উঠোনে যখন এ কাণ্ড চলছিল তখনও বারান্দায় জলচৌকিতে বিষ্ণুপদ ঝুম হয়ে বসা। নড়াচড়া নেই, ঝগড়া থামনোর উদ্যোগ নেই। বিষ্ণুপদর ভিতরটা কি মরে পাথর হয়ে গেছে? বিষ্ণুপদ নিজেই সেটা বুঝতে পারে না।

গাঁয়ের মাতব্বররা এসে বিষ্ণুপদকে বলল, এর একটা বিহিত তো করতে হবে বিষ্টুখুড়ো! সম্পত্তি ভাগ করে দিচ্ছেন না কেন?

বিষ্ণুপদ নিস্তেজ গলায় বলল, ভাগ তো ওরাই করে নিয়েছে। আর ভাগের কী?

রাজু হালদার বলল, ভাগের কাগজপত্র নকশা না থাকলে ভাগের মূল্যটা কী বলুন! বামাচরণের জমির মধ্যেই তো রান্নাঘর তুলে ফেলল রামজীবন। তা হলে আইনটা কী হবে?

এত লোক সোরগোল করছিল যে, বিষ্ণুপদর মাথাটা ভাল কাজ করছিল না। তবে এ কথা ঠিক যে, আজ দুপুরে হঠাৎ ইরফান মিস্ত্রিকে দিয়ে পশ্চিম দিকে একটা ছোটো ঘর গাঁথিয়ে ফেলছিল রামজীবন। তখনই বামার বউ শ্যামলী বেরিয়ে এসে চেঁচিয়েছিল, এটা কী হচ্ছে? ও তো আমাদের ভাগের জমি, ওখানে ঘর তুলছেন কেন?

রামজীবন প্রথমটায় জবাব দেয়নি, শুধু ইরফানকে তাড়া দিচ্ছিল ঘরখানা ঝটিতি বানিয়ে ফেলতে।

শ্যামলী তখন থাকতে না পেরে সোজা গিয়ে ইরফানকে এক ধাক্কা মেরে বলেছিল, খবর্দার আর একটাও ইট গাঁথবেন না। তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।

আর তখন রামজীবন চোখ রাঙিয়ে উঠেছিল, চোপ মাগী!

শ্যামলী তার দেওরের দিকে ফিরে বলেছিল, অতই যদি মুরোদ তবে উনি বাড়ি থাকতে ঘর তোলেননি কেন? যেই উনি বেরিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে ঘর তুলে ফেলছেন! মহা শয়তান তো আপনি!

সেই থেকে ঝগড়া চলছে।

শ্যামলী একবার এসে বিষ্ণুপদকেও বলেছিল, আপনি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন যে বড়! আপনার চোখের সামনে এত বড় অন্যায়টা হয়ে যাচ্ছে দেখেও চুপ করে বসে আছেন! মুখে কি পুটিং ঠেসে দিয়ে গেছে কেউ? না কি গুণধর ছেলের পাকা ঘরে থাকবেন বলে সব অন্যায় মেনে নিচ্ছেন?

বিষ্ণুপদর মুখে কোনও জবাব এল না। মাথাটা বড় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তার চোখের সামনে বহু অন্যায় বহুবার হয়ে গেছে, বিষ্ণুপদর মুখে একটিও প্রতিবাদ কেউ শোনেনি। শ্যামলীর দিকে বিষ্ণুপদ শুধু চেয়ে ছিল।

নয়নতারা এসে পক্ষিণী যেমন শাবককে আড়াল করে তেমনি করেই বিষ্ণুপদকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, ওঁকে এর মধ্যে টানছো কেন বউমা? এ লোক তো সাতে-পাঁচে থাকেনি কখনও। ভীতু মানুষ। ও সব তোমাদের গণ্ডগোল, তোমরা বুঝে নাও।

আহা, ন্যাকা! কিছু বোঝে না! ভীতু! অমন ছেলের জন্ম তাহলে দিল কি করে?

নয়নতারা বিষ্ণুপদকে বলল, যাও তো, জলচৌকি হাতে করে নিয়ে গিয়ে জামতলায় বসে থাকো তো। বাড়িতে থাকার দরকার নেই।

ভাগ্যিস বৃষ্টিটা তখন ছিল না। বিষ্ণুপদ গুটি গুটি গিয়ে বাইরের জামতলায় বসে রইল। কিন্তু গায়ে গু মাখলেই কি যমে ছাড়ে? সন্ধেবেলাতক বসে থেকে যখন বিষ্ণুপদ ঘরে এল তখনও উঠোনে দাপাচ্ছে শ্যামলী, বিস্তর বউ-ঝি কাচ্চা-বাচ্চা, দু-চারটে উটকো লোকও জুটে গেছে মজা দেখতে। রামজীবন বাড়িতে নেই। ইরফান কাজ বন্ধ রেখে চলে গেছে। তবে রান্নাঘরের দেয়াল চারটে প্রায় ছাদ অবধি গেঁথে ফেলেছে।

বামাচরণ ফিরল সন্ধের কিছু পর। ফিরতেই শ্যামলী এমন চেঁচিয়ে উঠল যেন তার নিকটজন কারও কাল হয়েছে। বামাচরণ এক সরকারী অফিসে পিওনের কাজ করে। সে খুব ফিকিরের লোক, দালালি-টালালি কিসের যেন একটু বাড়তি দু’পয়সা আয় আছে। তবে সে সব সে কখনও ফাঁস করে না। এক বাড়িতে থেকেও, এক হাঁড়ি হয়েও তারা খুব আলগোছ হয়ে থাকে। তবে হাঁড়ি আর এক রাখা যাবে না, বিষ্ণুপদ বুঝতে পারছিল। এক থাকলেই কি আর আলাদা হলেই বা কি? বিষ্ণুপদর আর সে সব ভেবে কাজ নেই।

ঝগড়াটা জম্পেশ করে লাগল সন্ধের পর। রামজীবন একটু মাতাল হয়েই রোজ ফেরে। আজও ফিরল। সে ফিরতেই বামাচরণ লাফ দিয়ে উঠোনে নামল। তারপর দুজনে গঙ্গাজলের মতো গালাগাল দিতে লাগল দুজনকে। তারপর খুনোখুনির জোগাড়।

বিষ্ণুপদ মাতব্বরদের কথার খেই ধরে বুঝতে পারছিল, তারা বামাচরণের পক্ষে! কাজটা অন্যায় হয়েছে।

রাজু হালদার বলল, আপনার চোখের সামনেই অন্যায্য ব্যাপারটা হয়ে গেল, এটা কেমন কথা? বামাচরণ কি আপনার ছেলে নয়? আমাদের একটা খবর দিলেই আমরা এসে মীমাংসা করতাম।

রামজীবনকে তার ঘরের কাছে কয়েকজন ঘিরে রেখেছিল। সেখান থেকেই সে গলা তুলে বলল, কোনও হারামীর বাচ্চার সালিশ মানব না। শালারা মাতব্বরী দেখাতে এসেছে! আবে এই খানকীর ছেলে রাজু, আমার বাবাকে চোখ রাঙাচ্ছিস কেন রে? বাপের ব্যাটা হয়ে থাকলে আমাকে চোখ রাঙাবি আয়! চোখ গেলে দেবো।

বিষ্ণুপদ টের পেল, মাতব্বরদেরও আর সেই দিন নেই। রামজীবনের হুমকিতে রাজু থিতিয়ে গেল।

ঘর তুলেছি বেশ করেছি। বুকের পাটা থাকলে একটা ইটও খসিয়ে দেখ, দেখ খসিয়ে কী হয়!

রাজুর বয়স পঞ্চাশের ওপর। এক সময় গাঁয়ের রাজনীতিতে বেশ নামডাক ছিল। এখন আর সেসব নেই। লোকেও তেমন মানে না। আগে এই রাজুরই কত হাঁকডাক ছিল। বিষ্ণুপদর একটু কষ্টই হল রাজুর জন্য।

রাজু বিষ্ণুপদকে বলল, শুনলেন রামজীবনের কথা? ওর যদি এরপর একটা বিপদ হয় তখন কিন্তু আমাদের দুষবেন না। রামজীবন কিন্তু খারাপ সংসর্গে পড়েছে।

বেশ চাপা গলায় বলল, যাতে রামজীবন শুনতে না পায়। রামজীবন অবশ্য শুনতে পেল না, কারণ সে নিজেই চেঁচিয়ে মাতব্বরদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করছিল।

বামাচরণ তার দাওয়া থেকে নেমে এসে বিষ্ণুপদকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে রাজুকে বলল, এই শালা বুড়োর জন্যই যত গণ্ডগোল বুঝলেন রাজু দাদা? কবে থেকে বলে আসছি, বাবা, বাড়িটা ভাগজোখ করে বেড়া তুলে দাও। শালা বসে বসে ঝিমোয় আর কাঁড়ি কাঁড়ি খায়। গা করে না। কেন করে না জানেন? ওই হারামজাদা রেমো ওকে হাত করেছে। রামজীবন ছাড়া উনি চোখে অন্ধকার দেখেন।

বামাচরণ বাপকে শালা বলাতেও কেউ তেমন কোনও আপত্তি করল না। শুধু কে যেন—লণ্ঠনের আলোয় মুখটা ভাল দেখা গেল না—বিড়বিড় করে বলল, ওভাবে বলছো কেন? ওভাবে বলা কি ঠিক?

বিষ্ণুপদর অবশ্য রাগ-টাগ হল না। কোনওদিনই হয় না। বামাচরণ হয়তো ঠিকই বলে।

বামা চেঁচাচ্ছিল, কেন ওই খচ্চর বুড়ো রামজীবনের পক্ষ নেয় জানো? রামজীবন পাকা ঘর তুললে সেখানে আরামসে থাকবে সেই লোভে। রামজীবন লুচি খাওয়ায়, রসগোল্লা খাওয়ায়, মাঝে মাঝে জামা জুতো দেয়; আর সেই সঙ্গে যত কু পরামর্শও দেয়।

ওপাশ থেকে রামজীবনও কী যেন বলে উঠল।

বিষ্ণুপদর হল গণ্ডারের চামড়া। সে শুধু অন্ধকার উঠোন পেরিয়ে ওপাশে রামজীবনের ঘরখানার দিকে চেয়ে রইল। বড় তাড়াতাড়ি কাজ হচ্ছে এখন। একটু বেশী তাড়াতাড়ি কি?

আর এক মাতব্বর কপিল ঘোষ বলল, আচ্ছা খুড়ো, আপনার বড় ছেলে কৃষ্ণজীবনের তো আর এই গাঁয়ের বাড়ির ভাগ দরকার নেই। তা তার ভাগেরটা এদিকে বাঁটোয়ারা করে দিলেও তো হয়।

সতীশ পাল মাথা নেড়ে বলে, আইন জানো না বলে বলছো। সে বা তার পুত্র পৌত্রাদি কেউ দাবি তুললে তো ছাড়তেই হবে বাপু। তার ওপর মেয়েদের ভাগের কথাটা ধরছে না কেন? জমি পুরো কুড়ি কাঠাও নয়। ছ’ভাগ করতেই হবে।

ভাগজোখের কথায় বিষ্ণুপদ ফের ভাবনায় পড়ে গেল। ভাগের বড় জ্বালা। ভাগ করতে করতে একশ বছর পর থাকবেই বা কি?

সতীশ পাল বলে উঠল, রামজীবনের রান্নাঘর সরাতে হবে। না সরাতে পারলে জমির দাম ধরে দিক। বখেরা মিটে যাবে।

রামজীবন ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে বলে, যে গু-খেগোর ব্যাটা এ কথা বলে তার মুখে পেচ্ছাপ করি, পেচ্ছাপ। বুঝলে! জমি এখনও বাবার। কোন শালাকে মূল্য ধরে দেবো?

খুব হতে লাগল তুমুল সব কাণ্ড। বিষ্ণুপদ শুনল, শব্দের পর শব্দ, আরও শব্দ। এ সব শব্দের যেন ঠিক মানে হচ্ছে না। এ সব যেন ফাঁকা কার্তুজের আওয়াজ।

একটু রাত হচ্ছিল। আরও গড়াত। হঠাৎ একটা ভেজা হাওয়া ছাড়ল। জয়ঢাকের শব্দ তুলল মেঘ। আর তারপর তেরচা ছাঁটের বল্লমের মতো বৃষ্টি নেমে এল। দুনিয়াকে গেঁথে ফেলতে লাগল যেন। লোকজন সব বেমালুম গায়েব হয়ে গেল ভোজবাজির মতো। দাওয়ায় দু-তিনজন শুধু গাঁ বাঁচিয়ে বসে থেকে কিছুক্ষণ পর ভিজেই রওনা হয়ে গেল।

তারপরই নয়নতারা এসে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল বিষ্ণুপদকে।

আজও রোদ নেই। মাঝে মাঝে ছ্যাড় ছাড় করে বৃষ্টি হচ্ছে। থামছে। আবার হচ্ছে। রামজীবনের কাঁচা সিমেন্ট ধুয়ে যাচ্ছে। ইরফান আসেনি।

আজ সকাল থেকে বাড়িটা বড় নিঝুম। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঘুলিয়ে উঠছে, পাকিয়ে উঠছে কত আক্রোশ, রাগ; তবে বাইরেটা আজ ভারি নিঝুম। যে কোনও সময়ে হঠাৎ বোমা ফাটানোর মতো ধুন্ধুমার লেগে যেতে পারে। দু’ছেলের কেউ বাড়ি নেই। শ্যামলী সকাল থেকে ঘরের বার হয়নি। সবই দেখছে বিষ্ণুপদ। দেখে যাওয়া ছাড়া তার কী কাজ?

বিষ্ণুপদর ঘড়ি নেই। কটা বাজে জানে না। কিন্তু সে ঠিক টের পায়, এইবার নয়নতারা একবার আসবে। এসে দেখে যাবে তাকে। কিছুক্ষণ পর পর এসে তাকে একবার করে দেখে যায় এই কদিন হল। বুড়িটার প্রাণে ভয় ঢুকেছে, বুড়োটা কখন টুকুস করে মরে যায়। ওই কালঘড়ি দেখার পর থেকেই ভয়টা খুব ধরেছে বুড়িকে। মানুষের শোকের একটা বড় কারণ হল, একা হয়ে যাওয়া। বিষ্ণুপদ চলে গেলে বুড়িটা খুব একা হয়ে যাবে। বড্ড আতান্তরে পড়ে যাবে।

ভয়-ডর আরও কত আছে। কাল রাতে যখন দু ভাই সুন্দ উপসুন্দের লড়াই করছিল তখন বুড়ি ভয়ে সেঁদিয়েছিল ঘরে। ঠাকুর দেবতার কাছে মাথা কুটছিল। কাল রাতে তারা বুড়োবুড়ি কেউ ঘুমোতে পারেনি। নয়নতারা বিস্তর কেঁদেছে। মেলা দুঃখের কথা বলেছে।

নয়নতারার বাবুগিরি হল তামাকপাতা দিয়ে পান খাওয়া। কলাইকরা একখানা বাটিতে তার পান সুপুরি চুন আর খয়ের থাকে ছোটো ছোটো কৌটোয়। সেই বাটিখানা হাতে করে নয়নতারা ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃসাড়ে কাছে এসে উবু হয়ে বসল। বর্ষাকালে পান বেজায় সস্তা, তবু ভারি কৃপণের মতো একখানা পানের একটুখানি ছিঁড়ে নিয়ে তাতে চুন দেয়। সুপুরিগাছ বাড়িতেই আছে কয়েকটা। ভাগজোখ হয়েও যা পায় তাতে নয়নতারার বছর চলে যায়। কিন্তু কিছুটা বিক্রি করে দিতে হয় বলে নয়নতারা সুপুরি খায় এক চিমটি। দাঁতের জোর নেই বলে ছোটো হামানদিস্তায় ফেলে গুঁড়ো করে নেয়। তাতে খরচাও হয় কম। এক চিলতে কাঁচা তামাকপাতা ঠেসে মুখে পানটা পুরে দেয়। অনেকক্ষণ পানটা মুখেই থেকে যায়, রসস্থ হয়। সারা দিন ওই জিনিসই নয়নতারাকে চাঙ্গা রাখে।

পান সাজা থেকে মুখে দেওয়া অবধি লক্ষ করল বিষ্ণুপদ। দেখতে বেশ ভাল লাগল। কত যত্নে টুকটুক করে ভালবেসে পানটা সাজল নয়নতারা! পানের মধ্যেই যেন ওর প্রাণভোমরা।

কিছু বলবে বলে মুখটা তুলল বুড়ি। বিষ্ণুপদ চেয়েই ছিল। একটু হাসল।

নয়নতারা হাসল না। বলল, শ্যামলী আজ ঘর থেকে বেরোলো না। দেখলে?

দেখলাম।

আবার লাগবে বোধ হয়।

তা লেগে যাবে।

রামজীবনের ওই পাকাবাড়িটাই অপয়া। ওটা যখন উঠতে শুরু করল তখন থেকে অশান্তি।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, শান্তি আবার কবে ছিল?

শ্যামলী বলে, বীণাপাণি নাকি নটী হয়ে গেছে। লাইনে নেমেছে। খারাপ খারাপ সব কথা। আমি বলি কি, পাঁচজনের কাছে না শুনে একবার নিজেই খবর নাও না। যাত্রায় নামা কি ভাল?

হঠাৎ বীণার কথা উঠছে কেন?

কাল রাতে তাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপন দেখেছি। কী সব যেন দেখলুম, ভাল মনে নেই। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ভাল খবর কি আর পাবে? অজান থাকাই তো ভাল।

তুমি এমন করে বলো যে, ভয় খেয়ে যাই।

আর ভয় কিসের! ডাক এসে গেছে। মনটা তুলে নাও।

তুমি ওরকম বোলো না তো!

তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলিনি। আমার কি মনে হয় জানো, ওরা সব আমাদের চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধি-বিবেচনাওলা মানুষ। আমরা কি দুনিয়াটাকে বুঝি? যা সব ঘটে যাচ্ছে চারদিকে তা বুঝি? এই হাবলা-ভ্যাবলা মাথায় কি সব সেধোয়? আমাদের চেয়ে ওরা বোঝে অনেক ভাল। তা ওরাই দুনিয়াটাকে বুঝে-সুঝে নিক না। আমাদের আমল তো এটা নয়।

সে কথা ঠিক। তবে ভয় হয়, যদি নষ্ট পায়।

সেটাও ওরাই বুঝবে। নষ্ট কি ভাবে পায় তা কি তুমি জানো, নাকি আমিই জানি!

কিন্তু এ কথাও বলি, বীণার বিয়েটা তুমি ভাল দাওনি। নিমাই কি আর তেমন ছেলে? খাওয়াতে পরাতেই তো পারে না। পেটে টান না পড়লে বীণা কি আর যাত্রায় নামত?

ওই কথাই তো বলি, আমি বড় আহাম্মক। তাই আজকাল ভয়ে আর রা কাড়ি না। মুখ খুললেই কত কি ভুলভাল বলে ফেলব। বীণার বিয়েটাও তো ওই আহাম্মকিই হল কি না। ছেলেটা দেখলুম বড় সৎ। মা-বাপের ওপর অগাধ ভক্তি। ওই দেখেই বুকটা নেচে উঠল, এ আমলে তো এ জিনিস মেলে না। কিন্তু এখন বুঝি, কত বড় বোকার মতোই কাজটা হল। মেয়ে হয়তো আমাকে কত শাপশাপান্ত করে।

আজ আমার বীণার জন্য বড় মনটা খারাপ লাগছে। স্বপন দেখা ইস্তক বুকটা ভার।

তাহলে একবার রামজীবনকে বলো। সে তো এধার ওধার ঘোরাফেরা করে। সে গিয়ে খবর এনে দেবেখন।

সে কি আর এখন যেতে চাইবে? ঘর উঠছে, সে এখন ঘরের নেশায় বুঁদ। হা-টাকা জো-টাকা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে নড়ানো যাবে না।

তাও বটে।

আমি বলি কি, আমরা বুড়োবুড়ি তো অনেককাল ভিটে আকড়ে পড়ে আছি, কোথাও যাই-টাই না। তা একবার যাবে নাকি বনগাঁ? বুড়োবুড়ি মিলে যাই চলো। বেশী দূর তো নয়।

বিষ্ণুপদ হাসল, সে আর বেশী কথা কি! কিন্তু তোমাদেরই তো কিসে যেন বাধে। ছেলেপুলে না হলে নাকি মেয়ের বাড়ি যেতে নেই!

ও বাবা! তাই তো! মনে ছিল না কথাটা। তা হলে একখানা পোস্টকার্ড লিখে দাও, পটল আজই ডাকে দিয়ে আসবে। রিপ্লাই কার্ডে দিও। পটলকে পাঠাচ্ছি পোস্টকার্ড আনতে।

পাঠাতে হবে না। আমার কাছে একখানা জোড়া পোস্টকার্ড আছে। লিখে দিচ্ছি।

তাকে আসতে লিখো একবারটি। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে।

লিখব’খন। তবে এই অশান্তির মধ্যে এসে তার তো তেমন সুখ হবে না।

তবু আসুক। নিমাইকে নিয়েই যেন আসে।

সব দিক বুঝে-সুঝে বলছো তো!

বুঝবার আবার কি আছে! সেই কবে একবার এসেছিল, বছর চারেক হবে বোধ হয়। মুখখানাই তো ভুলতে বসেছি। আর বুঝসুঝ দরকার নেই, মনটা বড় খারাপ। একবার আসুক। তোমার তাকে দেখতে ইচ্ছে যায় না?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, না। আমি বড় একা হয়ে গেছি। কেবল মনে হয় আমার আর কেউ নেই।

বলো কি গো! সর্বনেশে কথা যে!

থেকেও কি আছে! তুমিই বলো। ওরা কি আর আমার তোমার? ওরা সব নিজের নিজের। কাউকে আপনার জন ভাবতে পারি না। কৃষ্ণজীবনের কথা ভাবো তো একবার!

তার কথা আবার কি ভাবব?

ভাবো। ভাবলেই বুঝবে।

তুমিই বুঝিয়ে দাও না! জানো তো আমার মাথা নেই।

কৃষ্ণজীবন তো আমাদেরই ছেলে, নাকি?

তবে কার ছেলে?

তাকে কি আমাদের ছেলে বলে মনে হয়? সে যদি রামজীবন বা বামাচরণের মতো হত তাহলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হত। তা তো হল না। কত বিদ্যে শিখে সে এক লাফে কোথায় উঠে গেল। বিলেত-আমেরিকা অবধি ঘুরে আসছে। দুনিয়া-জোড়া নাম। এটা কেমন হল বলো তো! আমাদের ছেলের কি এ রকম হওয়ার কথা? আমরা দুটো বোকাসোকা মেয়েপুরুষ, আমাদের ছেলেপুলেরা তো আমাদের মতোই হবে নাকি! তা তো হল না কৃষ্ণজীবন!

লোকের পাঁচটা ছেলে কি একরকম হয়?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, না। কিন্তু কেন হয় না তাই তো বুঝি না। রামজীবন, বামাচরণ এরাও কি আর আমাদের ছেলে? তুমি তো জানো, জীবনে আমার সঙ্গে কারও ঝগড়াঝাঁটি হয়নি, মুখে একটাও দূষিত কথা উচ্চারণ করিনি, কাউকে গালাগালি অপমান করিনি। রামজীবন বা বামাচরণ তাহলে ওরকম করে কি করে?

সে কপালের দোষে।

তাই হবে। আমি ভেবে দেখেছি, ছেলেপুলে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। আমরা তো আর তৈরি করিনি ওদের, আমাদের ভিতর দিয়ে জন্মেছে। যার যার নিজের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আর ওদের নিয়ে ভেবে কি লাভ?

ভাবনা কি ছাড়ে?

আমাকে তো ছেড়েছে। যখনই কৃষ্ণজীবনের কথা ভাবি তখনই বড় অবাক লাগে। আমার প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ানোর বিদ্যে, বিষয়বুদ্ধি নেই, তেমন বড় কোনও বাবু-মানুষ এসে দাঁড়ালে কথা কইতে ভয় খাই। সেই আমার ছেলে ওরকম বাঘা বিদ্বান হয়ে ওঠে কি করে? এ যে অশৈলী কাণ্ড! আর সে অমনধারা হয়ে উঠল বলেই তো এদের সঙ্গে বনল না। একরকম মেরেধরে তাড়াল তাকে।

পুরনো কথা তুলে কি লাভ? তুমি কি বসে বসে ও সব ভাবো?

দুটো জিনিস খুব ঘোরাফেরা করে মনের মধ্যে। একটা হল কৃষ্ণজীবনের কথা। ইদানীং খুব তার কথা মনে হয় আর বড্ড অবাক লাগে। আর দু নম্বর হল রামজীবনের ওই বাড়িটা। কেন যে মনে হয়, ওই বাড়িটা যেই শেষ হবে অমনি আমার ঘড়ির সময় ফুরোবে।

সর্বনেশে কথা! তাহলে ওই অলক্ষুণে বাড়ি এখনই বন্ধ করে দিতে বলি।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, বোলো না। ও সব আবোল তাবোল ভাবনা, ওর মধ্যে কোনও সার নেই। মন হচ্ছে এক নিষ্কর্মা মানুষ, সারাদিন অকাজ করে যাচ্ছে। দুনিয়াতে যারা বড় মানুষ তাদের মন হল বিশ্বকর্মা। কত কী ভাবছে আর করে ফেলছে। সেই জন্যই তো দুনিয়ায় কত অশৈলী কাণ্ড ঘটছে। আকাশে এরোপ্লেন উঠছে, চাঁদে মানুষ যাচ্ছে, লোকে টি ভি দেখছে ঘরে বসে। ও সব তো আমার মতো বোকাসোকা মানুষের কর্ম নয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বেঁচে আছি মাত্র। নাড়ী চলছে, বুক ধুকপুক করছে, খাচ্ছি হাগছি, এইমাত্র। বিষ্ণুপদ থাকলেই কি, গেলেই কি। দুনিয়ার লাভও নেই, লোকসানও নেই।

নয়নতারা পানের একটুখানি পিক ফেলে হেঁচকি তুলে বলল, আর আমার কথা বুঝি ভাবতে নেই?

সেই তো কথা। তুমিই একমাত্র মানুষ যার কাছে বিষ্ণুপদ একটা তালেবর লোক। তোমার জন্যই তো দড়ি ছিঁড়তে চাইছে না আমার।

এ কথায় নয়নতারা হয়তো কেঁদে ফেলত, কিন্তু এ সময়ে বৃষ্টি মাথায় করে উঠোনে চারটে সাইকেল এসে ঢুকল পর পর।

ঘটনা পুরনো, বহুবার ঘটেছে। তবু নয়নতারা ‘ওই আবার এসেছে’ বলে একটা চাপা আর্তনাদ করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, বলল, তুমি কথা কইতে যেও না ওদের সঙ্গে। রাঙাকে ডেকে দিচ্ছি।

চারটে জোয়ান মর্দ ছেলে এসে দাওয়ার সামনে পা ঠেকিয়ে সাইকেল থামাল, নামল না।

কালো চেহারার একটা ছেলে বিষ্ণুপদর দিকে চেয়ে থমথমে গলায় বলল, রামজীবন কোথায়?

নয়নতারা কথা কইতে বারণ করে গেছে। কিন্তু রাঙাকে এখন পাবে না নয়নতারা। রাঙা একটু আগে পুকুরে গেছে এক ডাঁই বাসি কাপড় নিয়ে। বিষ্ণুপদ ছেলেটাকে দেখল ভাল করে। শক্ত পোক্ত শরীর, বয়সে রামজীবনের চেয়ে ছোটো, চোখের নজর মোটেই সাদা-সরল নয়। চোখে একটু ধমক আছে।

বিষ্ণুপদ নিরীহ গলায় বলে, সে তো সকালে বেরিয়ে গেছে।

সোডার বোতল খোলার আওয়াজের মতো পরের প্রশ্ন এল, কোথায় গেছে?

সে তো বলে যায়নি।

পিছনে তিনটে ছেলে পাথরের মূর্তির মতো সাইকেলে বসা। বৃষ্টিকে গ্রাহ্য নেই।

সামনের ছেলেটা বিষ্ণুপদর দিকে পলক না ফেলে চেয়ে থেকে বলে, কাল তার বটতলায় যাওয়ার কথা ছিল। যায়নি।

বিষ্ণুপদর একটুও ভয় হল না। ছেলেটার চোখের দিকে সেও নিষ্পলক চেয়ে থেকে বলল, কাল তার যাওয়ার উপায় ছিল না।

কী হয়েছিল?

একটু ঝামেলায় ছিল।

বটতলা দিয়ে আজকাল সে যাতায়াত করছে না। তাকে বলবেন আজ সন্ধের পর যদি না যায় তা হলে কিন্তু মুশকিল আছে।

বিষ্ণুপদ নিরীহ গলায় বলে, মুশকিল! কেন, সে কি কোনও খারাপ কাজ করেছে?

তাকে বলবেন, আমরা সন্ধের পর বটতলায় থাকব। কথা আছে।

বিষ্ণুপদ মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে নাড়ল। সে কিছু বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি হঠাৎ চেপে নামল। চারজন সাইকেলবাজ আবছা হয়ে গেল বৃষ্টিতে। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে। যেন একটা পরোয়ানা ধরিয়ে দেওয়ার ছিল, কাজ শেষ করে ফিরে গেল।

উঠোনটা ফাঁকা হয়ে গেল বটে, কিন্তু মনটা কি হল? চারজন সাইকেলবাজ এখন অনেক সময় ধরে মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। কিছুতেই যাবে না।

বামাচরণের ঘরের দরজা খুলে শ্যামলী বেরিয়ে এল। বিষ্ণুপদ প্রথমটায় ভেবেছিল, বোধ হয় পুকুরে বা কুয়োতলায় যাবে। কিন্তু ঘোমটা টেনে জলময় উঠোনটা পেরিয়ে শ্যামলী উঠে এল দাওয়ায়।

আপনাকে একটা কথা বলছি। আপনার এক ছেলে যদি আর এক ছেলেকে খুন করাতে গুণ্ডা লাগায় তাহলেও কি আপনি এ রকম নির্বিকার বসে থাকবেন?

বিষ্ণুপদ সচকিত হয়ে বলে, কে কাকে খুন করাবে বললে?

আপনার আদরের রামজীবন যে আমার স্বামীকে খুন করানোর সাঁট করছে তা কি জানেন?

বিষ্ণুপদ ভারি বেকুব হয়ে গেল। চেয়ে রইল শ্যামলীর দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *