১১. কাব্যে অলংকারের সীমা

কাব্যে অলংকারের সীমা

সংস্কৃত অলংকারসাহিত্যে নানা প্রস্থান; অলংকারের সংজ্ঞানিরূপণে এই প্রস্থানকর্তাদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ চোখে পড়ে। আপাত ভাবে সব প্রস্থানেরই লক্ষ্য হল কাব্যের আত্মার সন্ধান, অর্থাৎ ঠিক কোন বস্তুটি থাকলে কাব্য প্রাণ পায়, না থাকলে পায় না। কয়েকটি পরিচিত কাব্যসংজ্ঞা দিয়ে আরম্ভ করা যাক। প্রথম দিকের আলংকারিকদের মধ্যে অষ্টম শতকের বামন তাঁর কাব্যালংকার গ্রন্থে কাব্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন: ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য— কাব্যের আত্মা হল রীতি।’ (১:২:৬) নবমশতকে আনন্দবর্ধন ধ্বন্যালোক-এ বললেন: ‘কাব্যসাত্মা ধ্বনিঃ— কাব্যের আত্মা হল ধ্বনি। (১:২) দশম শতকে কুন্তক তাঁর বক্রোক্তিজীবিত-এ বলছেন: ‘বক্রোক্তিঃ কাব্যজীবিতম্— বক্রোক্তিই কাব্যের প্রাণ।’ ওই যুগেরই ক্ষেমেন্দ্র তাঁর ঔচিত্যবিচারচর্চা গ্রন্থে বলছেন: ঔচিত্যং রসসিদ্ধস্য স্থিরং কাব্যস্য জীবিতম্— রসসিদ্ধ কাব্যের স্থির প্রাণ হল ঔচিত্য।’ (১:৫) চতুর্দশ শতকে বিশ্বনাথ তাঁর সাহিত্যদর্পণ গ্রন্থে বললেন: ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্— রসাত্মক বাক্যই হল কাব্য।’ (১:৩) তার অনেক পরে সপ্তদশ শতকে শেষ উল্লেখযোগ্য আলংকারিক জগন্নাথ তাঁর রসগঙ্গাধর গ্রন্থের সূচনাতে বলেন: ‘রমণীয়ার্থপ্রতিপাদকঃ শব্দঃ কাব্যম্— রমণীয় অর্থের প্রতিপাদন করে যে শব্দ তাই কাব্য।’ তাহলে এ ক’জন আলংকারিকদের সংজ্ঞায় রথাক্রমে রীতি, ধ্বনি, বক্রোক্তি, ঔচিত্য হল কাব্যের প্রাণ অথবা রসযুক্ত বা রমণীয় অর্থের প্রতিপাদক শব্দই কাব্য। এ পর্যন্ত সংজ্ঞা কটির মধ্যে অলংকারকে কেউই কাব্যের প্রাণ বা আত্মা বলেননি। তাহলে কাব্যে অলংকারের স্থান কোথায়? সপ্তম শতকের আলংকারিক দণ্ডী বলছেন: ‘কাব্যশোভাকরান্ ধর্মানলংকারান্ প্রচক্ষতে— কাব্যের যে ধর্ম কাব্যের শোভা সৃষ্টি করে তাই অলংকার।’ (কাব্যাদর্শ ২:১) আনন্দবর্ধন বলছেন:

রসবন্তি হি বস্তুনি সালংকারাণি কানিচিৎ।
প্রায়েণৈব পরাং ছায়াং বিভ্রলক্ষ্যে নিরীক্ষতে।।

অর্থাৎ, কোনও কোনও রসযুক্ত কাব্যবস্তু অলংকৃত হয়ে প্রায়ই উৎকৃষ্ট কান্তি ধারণ করে কাব্যে লক্ষিত হয়। (২:১৭:১)

কুন্তক বলছেন:

উভাবেতাবলংকার্যৌ তয়োঃ পুনরলংকৃতিঃ।
বক্রোক্তিরেব বৈদগ্ধ্যভঙ্গীভণিতিরুচ্যতে।।

শব্দ এবং অর্থ এ দুয়েরই অলংকরণ প্রয়োজন। এদের মধ্যে কুশল ভঙ্গির উক্তি যে বক্রোক্তি তা-ই অলংকার। (১:১০)

একাদশ শতকে মম্মট তাঁর কাব্যপ্রকাশ গ্রন্থে বলেন :

উপকুর্বন্তি তং সন্তং যে অঙ্গদ্বারেণ জাতুচিৎ।
হারাদিবদলংকারাস্তো নুপ্রাসোপমাদয়ঃ।।

অর্থাৎ, কাব্যের যে প্রাণ বিদ্যমান তাকে অঙ্গরূপে কখনও কখনও হার ইত্যাদির মতো যা অলংকৃত করে সেই অনুপ্রাস উপমা ইত্যাদিই অলংকার। (৮:৬৭)

এই মম্মটই ‘যঃ কৌমারহরেঃ, ইত্যাদি শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলছেন ‘অত্র স্ফুটোং কশ্চিদল কারঃ/রসসৈব্য প্রাধান্যান্নালংকারঃ— এখানে স্পষ্ট কোনো অলংকার নেই; রসের প্রাধান্যের জন্যেই অলংকার নেই।’ ক্ষেমেন্দ্রও অলংকারকে প্রাধান্য দেননি, বলেছেন :

কাব্যস্যালমলংকারৈঃ কিং মিথ্যাগণিতৈঃ গুণৈঃ।
যস্য জীবিতমৌচিত্যং বিচিন্ত্যাপি ন দৃশ্যতে।।

জগন্নাথের কাব্য সংজ্ঞার ওপরে নাগেশভট্ট বলছেন, ‘লক্ষণে গুণালংকারদিনিবেশোপিন লক্ষ্যতে, বস্তুলংকারপ্রধানানাং কাব্যানামকাব্যত্বাপত্তঃ— রসগঙ্গাধর যেখানে রমণীয় অর্থের প্রতিপাদক শব্দাবলীকে কাব্যসংজ্ঞা দিলেন সেখানে গুণ বা অলংকারের উল্লেখই নেই (কারণ) যে কাব্যে বস্তু ও অলংকার প্রধান তা হল অকাব্য।’ অন্যত্র অলংকারের প্রসঙ্গে নাগেশ বলেন, ‘প্রাগভিহিতলক্ষণস্য কাব্যসাত্মনো ব্যঙ্গ্যস্য রমণীয়তাপ্রয়োজকা অলংকারা নিরূপ্যন্তে— অর্থাৎ ব্যঞ্জনালভ্য যে কাব্যের আত্মা অলংকারসমূহ তার রমণীয়তা বিধান করে। বিশ্বনাথ বলেন:

শব্দার্থয়োরস্থিরা যে ধর্মাঃ শোভাতিশায়িনঃ।
রসাদীনুপকুর্বত্তোলংকারাস্তেঅঙ্গদাদয়ঃ।।

অর্থাৎ, শব্দার্থের শোভাসমৃদ্ধ যে অস্থির ধর্ম রস ইত্যাদির উপকার করে, তা হল অঙ্গদ ইত্যাদির মতো অলংকার। আনন্দবর্ধন ধ্বনি বা ব্যঞ্জনাকে কাব্যের প্রাণ বলে অভিহিত করেছেন, সেই ধ্বনিপ্রধান কাব্যে অলংকারের স্থান নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন,

অপৃথগ্যত্ননিবর্ত্যঃ সোলংকারো ধ্বনৌ মতঃ।।

ধ্বনিকাব্যের সেই অলংকার পৃথক কোনও চেষ্টার দ্বারা নিষ্পন্ন হবে না, অর্থাৎ সে অলংকার আসবে অনায়াসে, তাকে সৃষ্টি করতে বা অনুধাবন করতে কোনও স্বতন্ত্র প্রয়াসের প্রয়োজন হবে না। (২:১৬) তিনি আরও বলেছেন:

মুখ্যা মহাকবিগিরিমলংকৃতিভূতামপি।
প্রতীয়মানচ্ছায়ৈষা ভুষা লজ্জেব যোষিতাম্।।

অলংকারযুক্ত যে মহাকবিদের সৃষ্ট কাব্য তার মধ্যেও এই রসধ্বনিই হল মুখ্য একটি প্রতীয়মান কান্তি, তা-ই অলংকার, যেমন লজ্জা রমণীর ভূষণ। (৩:৩৭)

তাহলে দেখছি ব্যঞ্জনা এবং রসধ্বনি যখন থেকে কাব্যে প্রাণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তখন থেকেই অলংকার গৌণ হয়ে গেছে। প্রথম যুগের আলংকারিকরা ভামহ, বামন, উদ্ভট, রুদ্রট— এঁরা কাব্যে অলংকারকে যত মর্যাদা দিয়েছেন পরবর্তী কালের আলংকারিকরা, বিশেষত আনন্দবর্ধনের পর থেকে যাঁরা প্রখ্যাত প্রস্থানকৃৎ যাঁরা তাঁরা অলংকারকে সেই মর্যাদা আর দেননি। শুধু তাই নয়, রীতি, বক্রোক্তি, ঔচিত্য, ধ্বনি, রস, ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুকে আলংকারিকরা কাব্যের আত্মা বলেছেন, একমাত্র অলংকারকেই কেউ তা বলেননি। পাশ্চাত্য আলংকারিকদের কয়েকজনের কথা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের সিসেরো কাব্যের পক্ষে অত্যাবশ্যক যে চারটি গুণের কথা বলেছেন তা হল Coorectness বা দোষরাহিত্য, clarity বা প্রসাদগুণ, propriety বা ঔচিত্য এবং ornamentation বা অলংকার। অলংকারের মধ্যে তিনি রূপককেই শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি অলংকারকে কাব্যে একপাদরূপে স্বীকার করলেন। তাঁর কয়েক বছর পরে এপল্লোডোরস্ অব্ পেগামম্ অলংকার সম্বন্ধে আলোচনা করে বললেন এ হল incomprehensibilia, সংস্কৃতে যাকে বলা হয়েছে, ‘অনন্তা হি বাগ্‌বিকল্পাস্তৎপ্রকারা এব অলংকারাঃ— বাক্যের (বা সাহিত্যের) বিকল্প অনন্ত, তার মধ্যে একটি বিকল্প হল অলংকার।’ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের কবি ডিওনিসস অব্ হালিকার্নেস কাব্যের অপরিহার্য গুণের প্রসঙ্গে বলেছেন সেগুলি হল melos (মাধুর্য), rhythmos (ছন্দোময়তা), metabole (বৈচিত্র্য বা বিস্থিতি) আর to prepon (ঔচিত্য)। ইনি সঙ্গে kalon (সৌন্দর্য) ও Hedone (আকর্ষণী শক্তি-র কথাও বলেছেন; এগুলি সৃষ্ট হয় কাব্যে ঐ চারটি থাকার ফলে। লক্ষণীয়, দিওনিসস্ অলংকারের উল্লেখই করেননি। প্রায় দেড়শো বছর পরে কুইন্টিলিয়ান বললেন schema হল dianoia বা চিন্তাগত বস্তুর Trope পরিবর্তনবিন্দু, আর lexis বা শব্দাবলীরও একটা পরিবর্তনবিন্দু যা জাগতিক সত্যের (বা তথ্যের) অনুরূপ নয়। অর্থাৎ, কাব্যের শব্দ এবং অর্থ (চিন্তাগত বস্তু-র মধ্যে এক সময় বাস্তব থেকে সরে যাওয়ার যে মুহূর্তটি— যা আসে কাব্যে শোভাসম্পাদন করার জন্যে) তাই হল অলংকার। লক্ষ্য করলে দেখি dianoia-তে অর্থালংকার ও lexis-এ শব্দালংকার স্বীকৃতি পেল, আর বাস্তব থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে স্বীকৃতি পেল ভঙ্গীবণিতি বা বক্রোক্তি। এরও কিছু পরে লঞ্জিনস্ On Sublimity নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে বললেন কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে hypsos বা চমৎকারিত্বের উপরে এবং সেটির মূলে পাঁচটি গুণ: thought (চিন্তা); emotion (আবেগ); figures, (অলংকার); diction, (শব্দসম্ভার) এবং exalted composition (উচ্চগ্রামে রচনা)। এগুলির মধ্যে প্রধান হল চিন্তা ও আবেগ: অতএব গৌণ হল অলংকার।

তাহলে দেখছি অলংকার যে কাব্যের বহিরঙ্গ তা নিয়ে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে মতভেদ নেই; যদিও অন্তরঙ্গ কী তা নিয়ে, অন্তত আপাদদৃষ্টিতে, মতানৈক্য আছে। এ দেশে আমরা বলেছি, অলংকার রসকে সাহায্য করতে পারে তার পরিপূর্ণ বিকাশে: ‘রসাদুনীপকুৰ্বন্তঃ’, কিংবা কাব্যাত্মনো ব্যঙ্গ্যস্য রমণীয়তাপ্রযোজকাঃ’ অথবা ‘কাব্যশোভাকরা ধর্মাঃ’। কিন্তু রসকে থাকতে হবে আগে, ‘তং সন্তম্’, তবে তো ‘উপকুর্বন্তি’। এবং সেও ‘অঙ্গদ্বারেণ’, কারণ অঙ্গী তো রস; এবং তাও ‘জাতুচিৎ’ কখনও কখনও। অর্থাৎ কাব্যের আত্মার অপেক্ষায় গৌণ অলংকার— তার অধীন। অলংকারের উপযোগিতা অপরিহার্য নয়, কাব্যে তার সত্তা বা অধিকার আপেক্ষিক, একান্ত নয়। মম্মট তাঁর কাব্যপ্রকাশ-এ বলছেন, ‘তদদোষৌ শব্দার্থৌ সগুণাবনলংকৃতী পুনঃ ক্বাপি।’ (১:৪) অতএব দোষরহিত শব্দ ও অর্থ যা গুণযুক্ত, কিন্তু কখনও কখনও অলংকৃত, তাই কাব্য। আগেই দেখেছি জগন্নাথ তাঁর কাব্যসংজ্ঞা-য় অলংকারের উল্লেখই করেননি। এ প্রসঙ্গে টীকাকার নাগেশভট্ট বলছেন, ‘কাব্যানামকাব্যত্বাপত্তেঃ’; বস্তু বা অলংকার যে কাব্যে প্রধান তা কাব্যই নয়, তা হল অকাব্য। ‘যঃ কৌমারহরঃ’ শ্লোকটিতে অলংকার না থাকার প্রসঙ্গে নাগেশ বলছেন ‘রসস্যৈব প্রাধান্যান্নালংকারঃ’, অর্থাৎ রসেরই প্রাধান্য থাকার ফলে অলংকার নেই। জগন্নাথ বলছেন, ‘কাব্যাত্মনো ব্যঙ্গ্যস্য রমণীয়তাপ্রযোজকা অলংকারাঃ’, ব্যঞ্জনায় যে রসকে পাওয়া যায় তা-ই কাব্যের আত্মা আর সৌন্দর্যবিধান করতে পারে অলংকার; অর্থাৎ রস না থাকলে অলংকার সম্পূর্ণ নিষ্ফল। তাহলে অলংকার কাব্যের বহিরঙ্গই শুধু নয়, তা স্থানবিশেষে পরিহার্য; কাব্যের পক্ষে একান্ত আবশ্যক নয়, এ কথা ভারতীয় অঅলংকারিকরা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে গেছেন। মম্মট তো কাব্যের সংজ্ঞাতেই ‘অনলংকৃতী পুনঃ ক্বাপি’ বলেছেন।

এ প্রবন্ধে আমাদের আলোচ্য হল অলংকার কাব্যের কতটা শোভা সম্পাদন করতে পারে, কখন পারে, কখন পারে না। খুব সাধারণ একটা শ্লোক ধরা যাক: রঘুবংশ-এ দিলীপ ও সুদক্ষিণা রথে করে কুলগুরু বশিষ্ঠের আশ্রমে চলেছেন, কালিদাস বর্ণনা করছেন:

কাপ্যভিখ্যা তয়োরাসীদ ব্রজতোঃ শুদ্ধবেষয়োঃ।
মেঘনিমুক্তয়োর্যোগে চিত্রাচন্দ্রমসোরিব।।

শুদ্ধবেশ এই রাজদম্পতির যাত্রাকালে কি শোভাই না হয়েছিল, যেন নির্মেঘ আকাশে চিত্রানক্ষত্রসমেত চন্দ্ৰ। (১:৪৬)

উপমা অনুষঙ্গের দ্বারা পাচ্ছি ঊর্ধ্বলোকের ব্যঞ্জনা, নিত্যমিলিত একটি দম্পতির ব্যঞ্জনা এবং উজ্জ্বল দুটি জ্যোতিষ্কের গৌরব। শোনা যায় ‘উপমা কালিদাসস্য’, তার অর্থ এই নয় যে উপমান ও উপমেয়ের সাদৃশ্য কালিদাসে অন্য কবিদের চেয়ে বেশি; তার অর্থ কালিদাসের উপমা অভিধাগত আক্ষরিক বিবক্ষিত বিষয়ের গৌরবকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনার দ্বারা একটি অতিরিক্ত গৌরবের মাত্রা লাভ করে। অন্য দিকে ভারবির কিরাতার্জনীয়-তে সেই বিখ্যাত শ্লোকটি দেখা যেতে পারে:

উৎফুল্লস্থল কমলিনীবনাদমুম্মাদুদ্ধতঃ সরসিজসম্ভবঃ পরাগঃ।
বাত্যাভির্বিয়তি বিবর্তিতঃ সমস্তাদাধওে কনকময়াতপত্র শোভাম্।।

সংক্ষেপে অর্থ হল, প্রবল বাতাসে স্থলপদ্মের বন থেকে পুষ্পরেণু মণ্ডলাকারে আবর্তিত হয়ে যেন স্বর্ণচ্ছত্রের শোভা ধারণ করছে। (৫:৩৯)

এখানে বিষয়গৌরব যৎসামান্য, তার ওপরে অলংকারে কষ্টকল্পনা, তাই এর দ্বারা কবি ‘ছত্রভারবি’ সংজ্ঞা লাভ করলেন, কিন্তু এটা সৎকাব্য হয়ে উঠল না।

অনেক আগের যুগে ফিরে গেলে ঋগ্বেদ-এ অলংকার প্রয়োগের একটা অন্য যুগ পাই। ঊষার বর্ণনা করছেন কবি; ‘মাতৃমৃষ্টের যোষা’, যে মেয়েটির দেহ তার মা যত্ন করে মার্জনা করে দিয়েছেন তার মতো। এখানেও স্নেহ কমনীয়তা আদর সবই উপমায় ধ্বনির দ্বারা এসেছে। বেদের উপমায় অন্য এক ধরনের বলিষ্ঠতাও দেখি:

যথা বিদ্যুদ্ধতো বৃক্ষ আমূলাদনুশুষ্যতি।
এবং স প্রতিশুষ্যতু যো মে পাপং চিকীর্ষতি।।

যেমন বাজপড়া গাছ মূল থেকে শুকিয়ে ওঠে তেমনই করেই সে শুকিয়ে উঠুক যে আমার অনিষ্ট করতে চায়।

দেবতার বর্ণনা, ‘মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠা— প্রবল পাহাড়ি জন্তুর মতো’ ঊষা পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করুক; ‘জায়েব পত্যৈ উশতী সুবাশঃ— যেমন কামনাবতী সুসজ্জিতা বধূ তার স্বামীর কাছে নিজেকে প্রকাশ করে।’(১:১২৪:৭) শক্তির প্রকাশ একটি ঊষস্-সূক্তে কী প্রবলভাবেই না আত্মপ্রকাশ করেছে। কবি বলতে চান প্রত্যেক ঊষাই মানুষের পরমায়ু একদিন করে নাশ করে দেয়; ঊষা নিজে চিরতরুণী অথচ মানুষকে সে জরা, অক্ষমতার দিকে ঠেলে দেয় প্রতিদিন, যেমন করে ব্যাধস্ত্রী পাখি ধরে তার ডানাদুটো ছিঁড়ে দেয়: শ্বঘ্নীব কুতুবিজ আমিনানা। (১:৯২:১০)

এ সব জায়গায় অলংকার কাব্যার্থের গৌরব বৃদ্ধি করে, ব্যঞ্জনার দ্বারা অভিপ্রেত আবেগটিকে তীক্ষ্ণতর করে প্রকাশ করে— লক্ষণীয় বেদে শতকরা নব্বইটি অলংকারই উপমা। কাজেই অলংকার এখানে কাব্যশোভাকর ধর্ম। কিন্তু মনে রাখতে হবে মূল আবেগটি নিজের জোরে অভিভূত করবার ক্ষমতা রাখে বলেই অলংকার তার প্রকাশকে তীক্ষ্ণতর করে তুলতে পারে, তং সন্তং। রসটি খাঁটি বলেই রসাদীনুপকুন্তি।

আদি মহাকাব্য দুটিতেও মাঝে মাঝে এমন শক্তিশালী অলংকারের দেখা পাওয়া যায়। রাবণ সীতাকে হরণ করবার সময়ে তাঁকে নিজের পট্টমহিষী করবার লোভ দেখায়, তুচ্ছ মানুষ রামের চেয়ে সে কত প্রতাপশালী তা বলে তাঁকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে; তখন সীতা বলেন:

আশীবিষস্য বদনাদ দ্রংষ্ট্রামাদাতুমিচ্ছসি।
মন্দরং পর্বতশ্রেষ্ঠং পাণিনা হতুমিচ্ছসি।।
কালকূটং বিষং পীত্বা স্বস্তিমান্ গন্তুমিচ্ছসি।
রাঘবস্য প্রিয়াং ভার্যামধিগন্তুং ত্বমিচ্ছসি।।

সাপের মুখ থেকে দাঁত তুলে নিতে চেষ্টা করছ, হাত দিয়ে পর্বতশ্রেষ্ঠ মন্দরকে তুলতে চাইছ, কালকূট বিষ পান করে স্বস্তিতে চলে যেতে চাইছ (ঠিক এই রকমই ব্যাপার হল) রামের প্রিয়বধূকে তুমি অধিকার করতে চাইছ। (অরণ্যকাণ্ড ৪৭:৩৯-৪০)

এখানে অলংকার শক্তিশালী করে তুলছে রাবণের সম্বন্ধে তাঁর প্রগাঢ় অবজ্ঞাকে এবং রামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গভীর বিশ্বাসকে। প্রকরণের মধ্যে এ আবেগ দুটি না থাকলে শুধু উপমায় তা আসত না।

মহাভারত-এ কাব্যগুণে অলংকারের স্থান নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছি; তারই দু-একটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ভীষ্ম শিখণ্ডির আড়াল থেকে অর্জুনের শরনিক্ষেপে বিদ্ধ হয়ে বলছেন:

অর্জুনস্য ইমে বাণা নেমে বাণাঃ শিখণ্ডিনঃ।
কৃন্তন্তি মম গাত্রাণি মাঘমাং সেগাইব।।

এ বাণ ত শিখণ্ডির নয় এ অর্জুনের, এ আমার দেহ ভেদ করে আসছে, কাঁকড়াবিছের ছানা যেমন মায়ের দেহ কুরে কুরে খায়। (১২:১১৯:৬৫] বঙ্গবাসী সংস্করণ)

এটা জনশ্ৰুতি: কিন্তু উপমার শক্তি তার গভীর ব্যঞ্জনায়: ভীষ্মের সঙ্গে শিখণ্ডির কোনও সম্পর্ক নেই; অর্জুন অপত্যস্থানীয়, তাই অর্জুনের শরে যে মরণান্তিক যন্ত্রণা সে হল অপত্যধর্ম পদদলিত হওয়ার যন্ত্রণা, মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও তা মর্মন্তুদ। বেদ-এ, রামায়ণ-মহাভারত-এর শ্রেষ্ঠ অলংকারগুলি গভীর হৃদয়াবেগকে গভীরতর করে প্রকাশ করেছে। রসকে সমৃদ্ধ করেছে, সে রস আগে থেকেই, প্রকরণেই ছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছে। অলংকার রসকে সৃষ্টি করেনি।

কালিদাসের সাহিত্যে অলংকারের সার্থক প্রয়োগ অগণিত। একে তো কবির অলংকার-প্রয়োগ সম্বন্ধে সহজাত সংযম আছে, কোথাও আতিশয্য নেই, তার ওপরে কোথায় কোন অলংকারটি কতটা উজ্জ্বল করে তুলবে বক্তব্যকে, সমৃদ্ধ করবে রসকে এ সম্বন্ধে তাঁর অভ্রান্ত একটি বোধ সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায়। সীতাকে বনে বিসর্জন দিয়ে এসে লক্ষ্মণ রামচন্দ্রকে খবর দিলেন :

বভূব রামঃ সহসা সবাষ্পস্তুষারবর্ষীব সহস্য চন্দ্রঃ।
লোকাপবাদেন গৃহান্নিরস্তা ন তেন বৈদেতীসুতা মনস্তঃ।।

হঠাৎ রামের দু চোখে জল ভরে এল যেন পৌষ মাসের চন্দ্র হিম বর্ষণ করছে; লোকাপবাদে তিনি সীতাকে গৃহ থেকেই নির্বাসন দিয়েছিলেন, মন থেকে দেননি। (রঘুবংশ ১৪:৮৪)

এখানে চোখে হঠাৎ জল ভরে আসায় পৌষের ঝাপসা চাঁদের উপমানে রামচন্দ্রের মুখকান্তি এবং অশ্রুভরাতুর নেত্র দুটির সাদৃশ্যই শুধু নেই, শীতের রাতের আকাশে একা নীরব চাঁদের ওপরে একটা হিমেল আচ্ছাদন সহসা এসে পড়ার মধ্যে গোপন শোকের নীরব প্রকাশের ব্যঞ্জনাটিও আসছে। আরও লক্ষ্য করলে দেখি এ শ্লোকের অন্তর্নিহিত গভীরতর কবিত্ব কিন্তু এর অনলংকৃত শেষার্ধে যত উপমাসসম্বলিত প্রথমার্ধে তত নয়।

ম্যাকবেথ নাটকে যখন ম্যাকবেথ লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুসংবাদ শুনলেন তখন প্রথমে একটি সহজ উক্তি করলেন She should have died hereafter / There would have been time for such a thing। কিন্তু মৃত্যু তো মানুষের সময় সুবিধা বুঝে আসে না, তাই হঠাৎ ম্যাকবেথের মনে হল দিনের পরে দিন যত পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষ অনিবার্য ভাবে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যেন একটা মধ্যযুগীয় পুরনো প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে কেউ দোতলার শোবার ঘরের দিকে উঠছে। নিচের সিঁড়িতে ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে, সে তার অতীত দিনগুলো: ওপরের সিঁড়িগুলো, মায়াবী ভবিষ্যতের দিনগুলো, যেগুলো একে একে পেরোলে শেষে ক্লান্ত মুখটা পৌঁছবে তার মহানিদ্রার শয়নকক্ষে। নিভে যাবে বাতিটা, জীবন তো একটা চলন্ত ছায়ামাত্র, একটা ছোটখাট ভূমিকার নট মঞ্চে প্রচুর আস্ফালন করে সহসা মিলিয়ে যায় নেপথ্যে। একটা জরদ্‌গবের মুখে বলা একটা গল্প তাতে কত না আস্ফালন, কিন্তু আসলে সে গল্পটা সম্পূর্ণ নিরর্থক। এ বর্ণনায় পদে পদে উপমা এবং অতি সার্থক উপমা, জীবনের নিঃসারতা প্রতিপাদন করে মৃত্যুর অনিবার্যতার পটভূমিকায়। এমনই আর একটি দীর্ঘ স্বগতোক্তি হ্যামলেটের; তারও শুরুতে নেহাৎ আটপৌরে একটা মৌলিক প্রশ্ন: to be or not to be, that is the question— তার পরে দীর্ঘবিলম্বিত স্বগতোক্তি; উপমাশ্রেণির মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হচ্ছে জীবনের আত্যন্তিক নিরর্থকতা। কিন্তু মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে শেপীয়র কত অনলংকৃত ভাষায় বলছেন; হ্যামলেট বন্ধু হোরেশিওকে বলছেন, যদি আমাকে ভালবেসে থাকো, বন্ধু কয়েকটা দিন উৎসব থেকে সরে থেকো, এই কঠোর সংসারে কষ্টে শ্বাস নিতে নিতেই বোলো আমার কাহিনি। কোনও অলংকার নেই। তেমনই কিং লীয়ার-এ প্রিয়কন্যা কর্ডেলিয়ার মৃত্যুর পরে লীয়ার বলছেন: কেন একটা কুকুর, একটা ঘোড়া একটা ইঁদুরের প্রাণ থাকবে, অথচ, কেন তোমার একটু নিঃশ্বাসবায়ু জুটবে না। আরও কম শক্তিমান নাট্যকার ওয়েবস্টারও তাঁর ডাচেস্ অব মাফি নাটকে নিজের ষড়যন্ত্রের ফলে মৃত বোনের দেহের সামনে দাঁড়ানো ভাইকে দিয়ে বলালেন: ‘ঢেকে দাও ওর মুখ, আমার চোখে সইছে না, বড় অল্প বয়সে মৃত্যু হল ওর।’

কালিদাস বিরহের কাব্য রচনা করেছেন নানা স্থানে। প্রথম দিকের রচনা কুমারসম্ভব-এ রতি বিলাপ করছেন মদনের মৃত্যুর পরে; সে বিলাপে কত অলংকার:

শশিনা সহ যাতি কৌমুদী সহ মেঘেন তড়িৎ প্রলীয়তে।
প্রমদা পতিবত্মগা ইতি প্রতিপন্নং হি বিচেতনৈরপি।

চাঁদের সঙ্গেই জ্যোৎস্না মিলিয়ে যায়, মেঘের সঙ্গে বিদ্যুৎ, নারী যে পতিপথগামিনী এ তো অচেতনরাও প্রতিপন্ন করেছে। (কুমারসম্ভব ৪:৩৩)

কিংবা, মদন তুমি চলে গেছ— নলিনীং ক্ষতসেতুবন্ধনো জলসংঘাত ইবাসি বিদ্রুতঃ—সেতু ভেঙে গিয়ে জলপ্রবাহ এসে যেমন করে পদ্মিনীকে ভাসিয়ে দেয়, তেমনই করেই। পুরুষের লেখনীতে নারীর বিরহের বর্ণনা, খাঁটি সুরটি যেন বাজেনি, যেমনটি বেজেছে পরিণততর রচনা রঘুবংশ-এ অজবিলাপে। কোথায় অলংকার সেখানে?

গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।
করুণাবিমুখেন মৃত্যুনা হরতা ত্বাং কিং ন মে হৃতম্।

সদ্যোমৃত বধূ ইন্দুমতীর উদ্দেশে অজ বলছেন, ‘(তুমি ছিলে) গৃহিণী, সচিব, গোপনের সখী, ললিতকলায় ছিলে প্রিয়শিষ্যা। নিষ্করুণ মৃত্যু তোমাকে হরণ করে কীই না আমার নিয়ে গেল।’ (রঘুবংশ ৮:৬৭)

এখানে সমস্ত কবিত্বটা ওই ‘কিং ন মে হৃতম্’——এতেই আছে। আরও সহজ ভাষায় এই বিরহেরই বর্ণনা অজের মুখে:

ধৃতিরস্তমিতা রতিচ্যুতা বিরতং গেয়মৃতুনিরুৎসবঃ।
গতমাভরণপ্রয়োজনং পরিশূন্যং শয়নীমদ্য মে।

ধৈর্য শেষ হয়েছে, প্রেম নিরাশ্রয়, সংগীত থেমে গেছে, ঋতু উৎসববিহীন, অলংকারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আমার শয্যা আজ শূন্য। (রঘুবংশ ৮:৬৬)

এরও আগে অজ বলছেন, ‘ত্বয়ি মে ভাবনিবন্ধনা রতিঃ—তোমার প্রতি আমার প্রেমেরই আসক্তি।’ (রঘুবংশ ৮:৫২) এত স্বল্প কথায় নিরলংকার ভঙ্গিতে লিখতে পারেন শুধুমাত্র মহাকবিরাই। কালিদাসে এটি বারেবারে দেখি: অলংকার-প্রয়োগে যিনি এত সিদ্ধহস্ত তিনিই আবেগের চরম মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিরলংকার অভিব্যক্তির ওপরেই ভরসা রাখেন। সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরবার সময়ে রামচন্দ্র আকাশে রথ থেকে দেখাচ্ছেন নিচে অরণ্যবাসের

স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চলগুলি। সীতা নেই। অরণ্যে বর্ষা নেমেছে।

গন্ধশ্চ ধারাহতপল্বলানাং কাদমর্ধোত কেসরঞ্চ।
স্নিশ্বাশ্চ কেকাঃ শিখিনাং বভুবুর্ষস্মিন্নসহ্যানি বিনা ত্বয়া মে।।

পুকুরে বৃষ্টি পড়ছে তার গন্ধ, আধফোটা কদমফুল, ময়ূরের স্নিগ্ধ কেকাধ্বনি— এ সবই এইখানে তোমার অভাবে আমার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। (রঘুবংশ ১৩:২৭)

কোনও অলংকারই নেই, কিন্তু বিরহের যন্ত্রণার তীব্রতা কত সহজে পৌঁছল পাঠকের মনে। অন্যান্য আবেগ ও রসেও এ ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। রঘুবংশ-এরই চতুর্দশ সর্গে রাম-লক্ষণ-সীতা অযোধ্যায় ফিরেছেন, কৌশল্যা সুমিত্রা পুত্রের অদর্শনে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়েছিলেন (২য় শ্লোক), তাঁরা রামলক্ষ্মণকে কাছে পেয়ে ‘রাক্ষসদের অস্ত্রের ক্ষতচিহ্ন পুত্রদের অঙ্গে যেন এখনও (রুধিরে) আর্দ্র এমন কোমল ভাবে সে ক্ষতচিহ্নগুলি স্পর্শ করতে লাগলেন। ক্ষত্রিয়নারীর ঈপ্সিত বীরপ্রসবিনী সংজ্ঞাও আর তাঁর কামনা করলেন না।’

তে পুত্ৰয়োর্নৈঋতশস্ত্রমার্গানাদ্রানিবাঙ্গে সদয়ং স্পৃশন্ত্যৌ।
অপীপ্সিতং ক্ষত্ৰকুলাঙ্গনানাং ন বীরসূশব্দমকাময়েতাম্।। (১৪:৪)

যা সব ক্ষত্রিয়নারীরই কাম্য সেই বীরপ্রসবিনী সংজ্ঞার জন্যে মর্মান্তিক মূল্য দিতে হয়েছে এ দুটি রাজবধুকে, চতুর্দশ বৎসরের অদর্শন, পুত্রদের সর্বাঙ্গে ক্ষত এবং তারা জীবিত অবস্থায় ফিরবেন কিনা সে বিষয়ে সুদীর্ঘকালের অনিশ্চয়, এ মূল্যে ওই সংজ্ঞা পেয়েছেন তাঁরা; তাঁদের মনে হল এ অত্যধিক মহার্ঘ সংজ্ঞা।

বেণীসংহার বীররসের নাটক। সেখানে দেখি, যুধিষ্ঠির কৌরবদের প্রস্তাবে সন্ধি করতে উদ্যত জেনে ক্রোধে অধীর ভীমসেন বলছেন:

মন্থামি কৌরবশতং সমরে ন কোপাদুঃশাসনস্য রুধিরং ন পিবাম্যুরস্তঃ। সঞ্চুর্ণয়ামি গদয়া ন সুযোধনোরূ সন্ধিং করোতু ভবতাং নৃপতিঃ পণেন।।

আমি সক্রোধে শত শত কৌরব সৈন্যকে যুদ্ধে মন্থন করব না? দুঃশাসনের বক্ষ থেকে রুধির পান করব না? গদা দিয়ে দুর্যোধনের উরু দুটো চূর্ণ করব না? তোমাদের রাজা মূল্য দিয়ে সন্ধি করুন গিয়ে। (২:১৭)

এখানে ভীমসেনের সারা জীবনের ক্ষত্রিয়োচিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার সব ক’টি স্বপ্ন যুধিষ্ঠিরের অক্ষত্রিয়সুলভ ক্ষমাবৃত্তির ফলে ব্যর্থ হতে চলেছে, উত্তাল হয়ে উঠেছে বীরের হৃদয় চরম ব্যর্থতাবোধে, তাঁর অসহিষ্ণু ক্রোধের ও প্রতিহিংসার নগ্ন ও অত্যন্ত শক্তিশালী প্রকাশ এ শ্লোকে— এবং এই তীব্রতা শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পৌঁছবার জন্যে কোনও অলংকারেরই প্রয়োজন হয়নি; কটি প্রশ্নই যথেষ্ট হল। অথবা অশ্বত্থামার সেই উক্তি:

যো যঃ শস্ত্রং বিভর্তি স্বভুজগুরুমদঃ পাণ্ডবীনাং চমূনাং
যো যঃ পাঞ্চালগোত্রে শিশুরধিকবয়া গর্ভশয্যাং গতো বা।
যো যস্তৎকর্মসাক্ষী চরতি ময়ি রণে যশ্চযশ্চ প্রতীপঃ
ক্রোধান্ধস্তস্য তস্য স্বয়মিহ জগতামন্তকস্যান্তকোহম্।।

নিজের বাহুবলের গর্বে অতিশয় গর্বিত পাণ্ডবপক্ষে যে যে অস্ত্রধারণ করছে, পাঞ্চালগোত্রে যে যে শিশু, বৃদ্ধ বা মাতৃগর্ভস্থও (ভ্রূণের আকারেও) আছে, আমার পিতার বধের যে যে সাক্ষী আছে, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করছি এখনও প্রতিযোদ্ধা যারা আছে— ক্রোধে অন্ধ আমি তাদের সকলের, এমনকী স্বয়ং মৃত্যুরও, (আজ) হত্যাকারী। (৩:৩২)

পিতৃবধের ক্ষোভে ও নিরুপায় যন্ত্রণায় উন্মত্ত অশ্বত্থামার প্রচণ্ড ক্রোধ ও বিধ্বংসী প্রতিহিংসার এই জ্বলন্ত প্রকাশের জন্যে কোনও অলংকারের প্রয়োজন হয়নি, রসোত্তীর্ণ অভিধাগত অর্থই পর্যাপ্ত মনে হয়েছে কবির।

প্রিয়জন প্রিয় হয় প্রিয়কাজ করে বলে নয়, এমনিই হয়। উত্তরামচরিত-এ দু’বার শুনি কথাটা:

অকিঞ্চিদপি কুৰ্বাণঃ সৌখৈদুঃখানপোহতি।

তত্তস্য কিমপি দ্রব্যং যো হি যস্য প্রিয়ো জনঃ।। (২:১৯, ৬:৫)

কিছু না করেই আনন্দ দিয়ে দুঃখ দূর করে; যে যার প্রিয়জন সে যে তার কী বস্তু।

সমস্ত কবিত্বটাই আছে ওই অনির্বচনীয় ‘কিমপি দ্রব্যম্’ এর মধ্যে। যে যার প্রিয়জন সে যে ঠিক তার কী তা উচ্চারণ করে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করে বলা যায় না— কবির অভিপ্রেত ভাবের গাঢ়তা এরই মধ্যে বিধৃত। এমনই আর একটি উদাহরণ পাই ওই নাটকেই রামচন্দ্র যখন সীতাকে বনে বিসর্জন দিয়ে জনস্থানের অরণ্যে একাকী ভ্রমণ করছেন, তখন বাসন্তী তাঁর ক্ষত থেকে পুনর্বার যেন রক্তক্ষরণের ব্যবস্থা করলেন, বললেন:

ত্বং জীবিতং ত্বমসি মে হৃদয়ং দ্বিতীয়ং
ত্বং কৌমুদী নয়নয়োযোরমৃতং ত্বমঙ্গে।
ইত্যাদিভিঃ প্রিয়শতৈরুনুরুধ্য মুগ্ধাং
তামেব— শান্তমথবা কিমিহোত্তরেণ।।

তুমি আমার প্রাণ, আমার দ্বিতীয় হৃদয়, চোখে আমার জ্যোৎস্না তুমি, অঙ্গে তুমি অমৃত,’ এই সব শতশত প্রিয়কথা সেই মুগ্ধা মেয়েটিকে বলে, তাকেই বলা— ‘থাক, আর বাকিটা বলে কীই বা হবে!’ (৩:২৬)

শ্লোকটি সম্পূর্ণ নিরলংকার। স্বামীর মুখে নানা প্রিয়বাক্য শুনে শুনে সীতা মুগ্ধ প্রেমে সবই বিশ্বাস করেছিলেন। সেই সব কথা বলার পর সীতাকেই বিসর্জন দিয়েছেন। প্রতারিতা সখীর মর্মান্তিক দুঃখে বিহ্বল বাসন্তী বাক্যটি শেষ না করে অতল বিষাদ এবং ধিকৃতির সঙ্গে বাক্যের মাঝপথে থেমে গেলেন। সমস্ত গভীরতা ওই নিষ্ফল উচ্চারণের অর্ধসমাপ্ত বাক্যটির মধ্যে অঙ্কুশের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে রামচন্দ্রকে বিদ্ধ করল। এ কাজ কোনও অলংকার কি এত সার্থক ভাবে করতে পারত?

অথবা অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর ষষ্ঠ অঙ্কে যখন ধীবরের কাছে সেই হারানো অঙ্গুরীটি পাওয়া গেল তখন দুষ্যন্ত বলছেন:

কথং নু তং বন্ধুরকোমলাঙ্গুলিং করং বিহায়িসি নিমগ্নমন্তসি।
অচেতনং নাম গুণং ন লক্ষয়েন্ময়েব কস্মাদেবধীরিতা প্রিয়া।।

অঙ্গুরীটিকে ভর্ৎসনা করে দুষ্যন্ত বলছেন, ‘সেই কোমল বন্ধুর অঙ্গুলিযুক্ত হাতটি চেড়ে দিয়ে তুমি কেন জলে পড়েছিলে? অথবা এ অচেতন বস্তু না হয় গুণ সক্ষ্য করতে পারেনি, আমিই বা কি করে প্রিয়াকে অবহেলা করেছি।’ (৬:১৬)

এখানে বিনা অলংকারে দুষ্যন্তের আত্মধিক্কারের সমস্ত তীব্রতা সঞ্চারিত হচ্ছে শ্রোতার মনে, তাৎপর্যপূর্ণ দুটি শব্দের মাধ্যমে। প্রথমত, ‘অচেতন’, অর্থাৎ সোনার আংটি তো জড় পদার্থ, গুণগ্রাহী নয়, শকুন্তলার হাত ছেড়ে চলে গেছে; আমি তো সচেতন, আমি কী করে তার হাত ছেড়ে দিলাম? দ্বিতীয়ত ‘প্রিয়া’; আংটির সঙ্গে আঙুলের তো অন্তরের সম্পর্ক নয়, কিন্তু সে তো আমার প্রিয়া ছিল, আমি তাকে ত্যাগ করলাম কী বলে?

উত্তররামচরিত-এর প্রথম অঙ্কে সুপ্ত সীতাকে কোলে নিয়ে রামচন্দ্র প্রেমভরে বলেছেন:

ইয়ং গেহে লক্ষ্মীরিয়মমৃতবর্তিনয়নয়োরসাবস্যাঃ স্পর্শো বপুষি বহলশ্চন্দনরসঃ।
অয়ং কণ্ঠে বাহুঃ শিশিরমসৃণো মৌক্তিকসরঃ কিমস্যা ন প্রেয়ো যদি পুনরসহ্যস্ত বিরহঃ।।

এ (আমার) গৃহের লক্ষ্মী, চোখে অমৃতের অঞ্জনশলাকা, এই ওর স্পর্শ দেহে (যেন) গাঢ় চন্দনরস, আমার কণ্ঠে এই বাহু এ (যেন) স্নিগ্ধশীতল মুক্তামালা; কী-ই না এর প্রিয়, শুধু বুঝি এর বিরহই অসহ্য। (১:৩৮)

আসন্ন বিরহের পূর্ব মুহূর্তে এ উক্তির নাটকীয় শ্লেষ বাদ দিলেও এই কবিতার প্রেমিক হৃদয়ের সদাজাগ্রত শঙ্কাটি যেন অকম্পিত অনলংকৃত চতুর্থ চরণে। প্রথম তিনটি অলংকৃত চরণের মুগ্ধ উচ্ছ্বাসের চেয়েও এই আবেগকম্প্র উক্তিটি রসে অনেক বেশি সমৃদ্ধ।

বিক্রমোর্বশীয়-এর চতুর্থ অঙ্ক বিরহের আর্তিতে মুখর কিন্তু তার আগে তৃতীয়ে ছোট একটি দৃশ্যে যেখানে রাজবধূ ঔশীনরী জানতে পেরেছেন স্বামী বিক্রম (পুরূরবা) ঊর্বশীর প্রেমে আচ্ছন্ন। এক পূর্ণিমার সন্ধ্যায় রাজাকে ছাদে ডেকে পাঠিয়ে বললেন :

দেবী। এষাহং দেবতামিথুনং রোহিণীমৃগলাঞ্ছনং সাক্ষীকৃত্যার্যপুত্রমনুপ্রসাদয়ামি, ‘অদ্য প্রভৃতি যাং স্ত্রিয়মার্যপুত্রঃ প্রার্থয়তে যা চার্যপুত্রস্য সমাগমপ্রণয়িনী তয়া সহ ময়া প্রীতিবন্ধন বর্তিতব্যমিতি।

বিদূষক। ভবতি! কিং তাদৃশস্তে প্রিয়স্তত্রভবান্?

দেবী। মূঢ়! অহং খলু আত্মনঃ সুখাবসানেনার্যপুত্রং নির্বতশরীরং কর্তুমিচ্ছমি। এতাবতা চিন্তয় তাবৎ প্রিয়ো ন বেতি।

(দেবী। এই আমি রোহিণী ও চন্দ্র এই দেবতাযুগলকে সাক্ষী রেখে আর্যপুত্রের প্রসন্নতা বিধান করছি, আজ থেকে যে নারীকে আর্যপুত্র কামনা করেন, যে নারী আর্যপুত্রের সঙ্গে মিলনে অভিলাষিণী সেই নারীর সঙ্গে আমি প্রীতির সম্পর্কে থাকব।

বিদূষক। দেবি! আর্যপুত্র কি তোমার তেমনই প্রিয়?

দেবী: মুর্খ! আমি আমর সুখে জলাঞ্জলি দিয়ে আর্যপুত্রের জীবন জুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এতেই বোঝ, তিনি ততটা প্রিয় কিনা।)

যখন ঔশীনরী চিরমিলিত চন্দ্ররোহিণীকে (সাতাশটি নক্ষত্রবধূর মধ্যে রোহিণীই চন্দ্রের প্রিয়তমা) সাক্ষী রেখে প্রিয়কে প্রসন্ন করার ব্রত উদ্যাপন করেন চূড়ান্ত এবং মর্মান্তিক আত্মত্যাগের মধ্যে, তখন এই অনলংকৃত অতিশয়োক্তিরহিত কথা ক’টির মধ্যে ঔশীনরীর মর্মমূলে রক্তক্ষরণটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় কতকগুলি ব্যঞ্জনায়। প্রথমত, চন্দ্র রোহিণীকে সাক্ষী রাখা, এই সে দিন পর্যন্ত এই দেবদম্পতি উপমান ছিলেন পুরূরবা ও ঔশীনরীরই প্রেমের; আজ সেই প্রেমের প্রতীককে সাক্ষী রেখে প্রেমিককে দান করছেন অন্য এক রমণীকে। এই চরম দানের হেতু কী? প্রেমের যা প্রাথমিক শর্ত: পুরূরবা যাকে কামনা করেন এবং পুরূরবার সঙ্গে মিলন যাঁর কাম্য; সেখানে ঔশীনরী যে নিতান্তই তৃতীয় ব্যক্তি, তাই সসম্মানে সরে যাওয়া ছাড়া তাঁর আজ গত্যন্তর নেই। বিদষকের প্রশ্নের উত্তরে ক্ষুব্ধ এই মহীয়সী নারী বলছেন: নিজের মর্মমূল উৎপাটন করে প্রেমিককে উপহার দিলাম যেন তিনি শান্তি পান, সার্থকতা লাভ করেন প্রেমে; এর জন্যে নিজেকে চিরবিচ্ছেদে নির্বাসিত করছি, আর তুমি প্রশ্ন করছ এঁকে ভালবাসি কিনা। কত সহজে সম্পূর্ণ স্বভাবোক্তির মধ্যে দিয়ে এই আত্মবলিদান রূপ পেল ভাষায়। অলংকার এখানে বাহুল্য হত, বাধা হত, ক্ষুণ্ণ করত এর ঋজু মহিমাকে।

কুমারসম্ভব-এ পার্বতী তপস্যা করছেন মহাদেবকে পাওয়ার জন্য; না থাকতে পেরে মহাদেব তরুণ ব্রহ্মচারীর বেশে তপোবনের দ্বারে উপস্থিত। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে পার্বতীর সখী পার্বতীর তপস্যার বিবরণ দিচ্ছেন; এক সময়ে বললেন:

ত্রিভাগশেষাসু নিশাসু চ ক্ষণং নিমীল্য নেত্রে সহসা ব্যবধ্যত।
ক্ব নীলকণ্ঠ! ব্ৰজসীত্যলক্ষ্যবাগসত্যকণ্ঠাপিতবাহুবন্ধনা।।

ত্রিযামা রজনীর শেষ যামে চোখ দুটি বুজে আসে, সহসা জেগে ওঠেন; ‘কোথায় চললে, নীলকণ্ঠ?’ এই কথা বলে অসত্য কণ্ঠে বাহুবন্ধন অর্পণ করেন। (৫:৫৭)

পার্বতীর প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল তৃতীয় সর্গে, তখন মহাদেব হিমালয়ের সে অঞ্চল ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান তপস্যার জন্যে।— এখন সমস্ত রাত জাগেন পার্বতী, তপস্যায় এবং বিরহে। ভোররাত্রে যখন দুটি চোখ বন্ধ হয় স্বপ্নে দেখেন মহাদেব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে কোথায় চলে যাচ্ছেন। সেদিন বাধা দিতে পারেননি, এখন দু হাতের আলিঙ্গনে তাঁকে বাঁধতে চান, কিন্তু কোথায় নীলকণ্ঠ? এ তো স্বপ্ন শুধু। এই দ্বিতীয়বারের বঞ্চনার তীব্রতা এমন করে কি কোনও অলংকারে প্রকাশ পেত? পেলে কালিদাস অলংকারের আশ্রয় অবশ্যই নিতেন। ঠিক তেমনই ছদ্মবেশী শিবের মুখে অনেক শিবনিন্দা শোনার পর পার্বতী বললেন :

অলং বিবাদেন যথাশ্রুতত্ত্বয়া তথাবিধস্তাবদশেষমস্ত সঃ।
মমাত্র ভাবৈকরসং মনঃ স্থিতং ন কামবৃত্তির্বচনীয়মীক্ষতে।।

‘বিবাদ নিষ্ফল; তুমি যেমন শুনেছ, (শিবের বিষয়ে) সে সম্পূর্ণ সেই রকমই হোক, আমার মন এখানে ভাবে একরস, যে নিজের ইচ্ছেমত চলে সে নিন্দাকে গ্রাহ্য করে না।’ (৫:৮২)

অর্থাৎ শিব নিন্দনীয় মেনেও যদি নিই, তাহলেও আমি আমার সংকল্পে অটল থাকব, কারণ, আমার মন এ ব্যাপারে প্রেমের ভাবে একরস। অর্থাৎ তুমি শিবের সম্বন্ধে আমার জুগুপ্সা উৎপাদনের চেষ্টা করছ কিন্তু সে-ও তো একটা রস, আমার মন প্রেমে এমনই পরিপূর্ণ যে দ্বিতীয় কোনও রসের স্থানই নেই সেখানে। পার্বতীর প্রেমের গভীরতা ঐকান্তিকতা এমন করে কি অলংকারের মধ্যে দিয়ে পৌঁছত আমাদের কাছে যেমন পৌঁছেছে ওই ‘ভাবৈকরস’ শব্দটি দিয়ে?

অমরুশতক-এ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মানসিক সম্পর্ক যখন আর অবশিষ্ট নেই, তখনকার একটি বর্ণনা হল,

কোপো যত্র ভ্রুকুটিরচনা নিগ্রহো যত্র মৌনং যত্রান্যোন্যস্মিতমনুনয়ো দৃষ্টিপাতঃ প্রসাদঃ।
তস্য প্রেষ্ণস্তদিদমধুনা বৈশসং পশ্য জাতং ত্বং পাদান্তে লুঠসি ন চ মে মন্যুমোক্ষঃ খলায়াঃ।।

যেখানে ভ্রুকুটিই (ছিল) ক্রোধ, মৌন (ছিল) অত্যাচার, পরস্পরের প্রতি স্মিতহাস্যই (ছিল) অনুনয় এবং চোখের চাহনি (ছিল) প্রসাদ, সেই প্রেমের এখন (কী ভাবে) মৃত্যু হয়েছে দেখ, তুমি আমার পদতলে লুণ্ঠিত, আর খলস্বভাবা আমার ক্রোধ এখনও যায় না।

অর্থাৎ যে দম্পতির মিলিত জীবনে মান-অভিমান মিলিয়ে যেত সামান্য একটু স্মিতহাস্য দৃষ্টিপাতে আজ তাদের মধ্যে প্রেম এমনই একান্ত বিলুপ্ত যে, স্বামী পদতলে লুণ্ঠিত তবু স্ত্রীর ক্রোধ যায় না। প্রেমের মৃত্যু জীবনে ঘটলেও সংস্কৃত সাহিত্যে প্রায় দেখা যায় না, এখানে সেই গভীর প্রেমের নিষ্করুণ মৃত্যুর এমন দুর্লভ মর্মস্পর্শী চিত্রটি নির্মিত হয়েছে কোনও অলংকারের প্রয়োগ ব্যতিরেকেই। এই অতলান্ত হতাশা ও বিষাদ অলংকৃতবচনে এমন করে প্রকাশ পেত না।

অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর সপ্তম অঙ্কে দুষ্যন্ত ও সর্বদমনের যখন দেখা হল তখন দুষ্যন্ত যদি বা সবেমাত্র জেনেছেন যে সর্বদমন তাঁর পুত্র, সর্বদমন কিন্তু জানে না আশ্রমে এই নবাগত ব্যক্তিটি কে; সে মাকে জিজ্ঞাসা করছে ‘ক এষঃ?’শকুন্তলা উত্তর দিচ্ছেন ‘বৎস তে ভাগধেয়ানি পৃচ্ছ— ‘বাছা, তোমার ভাগ্যকে প্রশ্ন কর।’ অর্থাৎ পঞ্চম অঙ্কে একদিন তিনি বড় আশা করে রাজসভায় দুষ্যন্তের স্ত্রী বলে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বিদ্রূপে জর্জরিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, আজ সন্তানকে পিতৃপরিচয় নিজের মুখে জানাতে তাই সাহস পাচ্ছেন না। ভাগ্য তাঁর সঙ্গে চরম বঞ্চনা করেছিল সে আশঙ্কা এখনও যায়নি, তাই ছেলেকে বলছেন সে তার ভাগ্যকে প্রশ্ন করুক। শকুন্তলার মর্মান্তিক লাঞ্ছনা ও ক্ষোভ যেন উদ্বেল হয়ে উঠেছে ওই আপাত সংযত ছোট বাক্যটিতে। বাক্যটি নিরলংকার তা নিতান্ত সংক্ষিপ্ত।

এমনই এক অবস্থায় সদ্য বনে বিসর্জিত সীতাকে লক্ষ্মণ যখন রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলেন ফিরে রামচন্দ্রকে তিনি সীতার কাছ থেকে কী কথা জানাবেন তখন সীতা বলেন:

বাচ্যত্বয়া মদ্বচনাৎ স রাজা বহ্নৌ বিশুদ্ধামপি যৎ সমক্ষম্।
মাং লোকবাদশ্রবণাদহাসীঃ শ্রুতস্য কিং তৎ সদৃশং কুলস্য।।

আমার কথায় রাজাকে বোলো, তাঁর চোখের সামনে অগ্নিতে শুদ্ধ প্রমাণিত হয়েছি যে-আমি, লোকের নিন্দায় আজ সেই-আমাকে যে তিনি ত্যাগ করছেন এ কি তাঁর বিদ্যা বা বংশের উপযুক্ত কাজ হল? (রঘুবংশ ১৪:৬১)

অপমানিতা চিরদুঃখিনী নিরপরাধা নারীর মর্মবেদনা এখানে তীক্ষ্ণ একটি প্রশ্নের উপরে কাঁপছে যেন। এ প্রশ্নের উত্তর নেই; সমস্ত বঞ্চিতার হয়ে এই নিদারুণ অনুযোগ অনুত্তরিত রইল চিরকাল ধরে। অলংকারে বিড়ম্বিত হত এই ঋজুভাষণের গৌরব। এত অপরাধে ও রামচন্দ্রের প্রতি তাঁর প্রেম অবিচল তাই বলছেন:

সাহং তপঃ সূর্যনিবিষ্টদৃষ্টিরূং প্রসূতেশ্চরিতুং যতিষ্যে।
ভুয়ো যথা মে জননান্তরেহিপি ত্বমেব ভর্তা ন চ বিপ্ৰয়োগঃ।।

(বোলো রামচন্দ্রকে) আমি সন্তনজন্ম পর্যন্ত সূর্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তপশ্চরণে যত্নবতী হব যেন পরের জন্মে তোমাকেই স্বামী পাই, আর বিচ্ছেদ যেন না হয়। (১৪:৬৬)

এখানে সমস্ত কাব্যটি রয়েছে ওই চতুর্থ চরণে— ‘আর বিরহ যেন না হয়।’ এ জন্মের সবচেয়ে সুখ পেয়েছেন বনবাসের বছর ক’টিতে। অদর্শনের, বিচ্ছেদের দুঃখের মধ্যেই ছিল লোকনিন্দার সূত্র, পরজন্মে যেন নিত্য মিলিত জীবন পান এই আর্ত প্রার্থনা, এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যে ওই কঠিন তপস্যা— এ সবই যেন একটি সংবাদ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলা, অথচ সীতার সম্পূর্ণ মর্মপীড়া কত তীক্ষ্ণ ভাবেই না প্রকাশ পেল এই শ্লোকে। এ-কাজ অলংকারে এমন করে হত না।

মেঘদূত-এ পূর্বমেঘে অলংকারের প্রাচুর্য, উত্তরমেঘে পরিমিত হলেও সুপ্রযুক্ত অলংকারে কাব্যে দীপ্তি এসেছে বহুবার। মেঘের কাছে যক্ষ তার স্ত্রীর বর্ণনা করে বলেছে, সেই স্বল্পভাষিণী মেয়েটিকে আমার দ্বিতীয় জীবন বলে জেনো, আজ আমি দূরে, সে যেন রাতের চক্রবাকীর মতোই একা। উৎকণ্ঠায় গুরুভার এই দিনগুলো যাচ্ছে, সে যেন হিমে মথিতশোভা পদ্মসরোবরের মতো বিবর্ণ।’ (উত্তরমেঘ ২০) এখানে অনুপ্রাস উৎপ্রেক্ষার দ্বারা যক্ষবধূর বিরহক্লিষ্ট অবস্থাটি সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। যক্ষ তার বধূর বিরহিণী রূপটিকে সৃষ্টি করছে: সে হিমে দলিত পদ্মফুলের মতো, অথবা ভোরের পুব আকাশে প্রতিপদের চন্দ্রকলার মতোই ক্ষীণ তনুদেহটি। সম্ভবত এ উপমার ওপরে বাল্মীকির প্রভাব আছে; অশোকবনে সীতার বর্ণনাতেও এ উপমানটি আছে। (৫:১৫:১৯) ‘দর্শ শুক্লপক্ষাদৌ চন্দ্ররেখামিবামলাম্‌— শুক্লপক্ষের শুরুতে নির্মল চন্দ্রকলার মতো দেখলেন’ (উত্তরমেঘ ২৬) বা, মেঘলা দিনের স্থলপদ্মনির মতো— ঠিক জাগ্রতও নয় প্রসুপ্তও নয় (২৭); এ সব নানা উপমায় তার বিরহদীন মূর্তিটি ফুটে উঠেছে। কিন্তু যক্ষ যখন তার নিজের বিরহের বর্ণনা করছে তখন সে অলংকার ব্যবহার করছে না। একবার বলছে:

শব্দাখেয়ং যদপি কিল তে যঃ সখীনাং পুরস্তাৎ
কর্ণে লোলঃ কথয়িতুমভূদাননস্পর্শলোভাৎ।
সোহতিক্রান্তঃ শ্রবণবিষয়ং লোচনাভ্যামদৃষ্ট—
স্তামুৎকণ্ঠাবিরচিতপদং মন্মুখেনেদমাহ।।

যে কথা সখীদের সামনে অনায়াসেই উচ্চারণ করে বলা চলত সে কথাও যে কানে কানে বলবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠত তোমার আনন স্পর্শ করার লোভে, সে-ই আজ শ্রবণপথের বাইরে অতিক্রান্ত, চোখে দেখারও বাইরে, (তাই) তার উৎকণ্ঠায় পদ রচনা করে আমার মুখে এই কথা বলে পাঠিয়েছে। (উত্তরমেঘ ৪০)

এখানে সমস্ত কবিতাটির প্রাণকেন্দ্র হল একটা বৈসাদৃশ্য— কাছাকাছি থেকেও আরও কাছে এসে প্রিয়ামুখের স্পর্শ পাওয়ার লোভে অতি সহজ কথাও যে-মানুষ কানেকানে বলতে চাইত, সে আজ এত দূরে যে সেখানে চোখের দৃষ্টি পৌঁছয় না, কথার শব্দ শোনা যায় না। এই দুস্তর ব্যবধান স্পর্শলোভী যক্ষের কাছে কত যে দুর্বিষহ তা ব্যক্ত করার জন্যে অলংকারকুশল কবি কোনও অলংকারই ব্যবহার করলেন না। যক্ষ বধূকে বলে পাঠাচ্ছে:

ত্বামালিখ্য প্রণয়কুপিতাং ধাতুরাগৈঃ শিলায়া—
মাত্মানং তে চরণপতিতং যাবদিচ্ছামি কতুম্।
অস্ত্রৈস্তাবন্মুহুরুপচিতৈদৃষ্টিরালুপ্যতে মে
ক্রুরস্তস্মিন্নপি ন সহতে সঙ্গমং নৌ কৃতান্তঃ।।

ধাতুর রঙে শিলাখণ্ডের ওপরে প্রণয়কুপিতা তোমাকে এঁকে যখনই নিজে তোমার পায়ে পড়তে যাই তখনই চোখে জল ভরে এসে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যায়; নিষ্ঠুর দুর্ভাগ্য সেখানেও আমাদের মিলন সহ্য করে না। (উত্তরমেঘ ৪২)

সম্পূর্ণ অনলংকৃত একটি বিবরণ। এক বিরহাতুর যক্ষ বিরহবিনোদনের জন্যে রামগিরি পর্বতের নানারঙা পাথর দিয়ে শিলাখণ্ডের ওপরে প্রিয়ার চিত্র আঁকে। কেমন প্রিয়া? প্রেমের কলহে কুপিতা। কুপিতা বলেই যেন সে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, তাকে কাছে পাচ্ছে না যক্ষ। তাই সে আলেখ্যগতা প্রিয়ার পদতলে লুণ্ঠিত হয়ে মানভঞ্জন করতে উদ্যত হয়, যদি প্রিয়া প্রসন্ন হয়ে কাছে আসে। কিন্তু প্রিয়াকে প্রসন্ন করাই হয় না, সহসা দুচোখ জলে ভরে ওঠে, যেন নিষ্ঠুর দুনিয়তি চিত্রগতা প্রিয়ার সঙ্গেও তার মিলন সইতে পারে না; অভিশাপ যে বিচ্ছেদের। সমস্ত করুণ ভাবটি আছে একটা অসম্ভব চেষ্টার ব্যর্থতায়, যে চেষ্টার পিছনে আছে যক্ষের বিরহোন্মাদ। মেঘদূত-এ যেমন অনাড়ম্বর শব্দসম্ভার, তেমনই অতি সহজ অন্বয়, তেমনই অলংকারবিরল এর রচনা। এখন, এই পরিণততম বিরহকাব্য রচনার ঋতুকে কালিদাস রসের আরও গভীরে প্রবেশ করতে বলেই অলংকার এখন তাঁর কাছে পরিহার্য বহিরঙ্গ। তাই কাব্য রসের গভীরতায় পৌঁছতে পেরেছে বলেই তিনি বিশুদ্ধ স্বভাবোক্তির দ্বারাই বোদ্ধাকে রসলোকের গভীরে উত্তরণ করে দিতে পারেন।

রামায়ণে সীতাকে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে বলায় তিনি বললেন:

মনসা কর্মণ বাচা যথা রামমভ্যচয়ে
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।।

যদি মনে, কাজে ও কথায় রামকেই অর্চনা করে থাকি তো পৃথিবী আমাকে বিবরে (আশ্রয় দান করুন। (৭:৯৭:২৫)

রামায়ণ-এ এইটি সীতার শেষ উক্তি, রামচন্দ্র, সমাজ এবং জীবনের ওপরে প্রগাঢ় ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে উচ্চারিত কথা ক’টি। কোনও অলংকারের প্রয়োজন হয়নি, স্বভাবোক্তিই যথেষ্ট হয়েছে, কারণ সীতার বেদনা নিজের তীব্রতাতেই রসোত্তীর্ণ।

যেখানে উপলব্ধির মধ্যে জটিলতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব বা মিশ্র আবেগ থাকে, সেখানে আপাতসরল অনলংকৃত বাক্যে এগুলি আরও সার্থক ভাবে প্রকাশ পায়। মহাভারত-এ যুদ্ধের পূর্ব রাত্রে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে সপ্তদ্বীপা বসুমতীর বর্ণনা প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের বর্ণনা বিশেষ করে শুনতে চাইলেন:

যদিদং ভারতবর্ষং যত্রেদং মূর্ছিতং বলম্
যতত্রদ্ধতিমাত্ৰলুব্ধোহয়ং পুত্রো দুর্যোধনো মম।।
যত্র গৃদ্ধাঃ পাণ্ডুপুত্রা যত্র মে সজ্জতে মনঃ।

‘এই যে ভারতবর্ষ, যেখানে বলের প্রকাশ যেখানে আমার পুত্র দুর্যোধন অতিমাত্র লুব্ধ, যেখানে পাণ্ডুপুত্ররাও লুব্ধ, যেখানে আমার মন আসক্ত।’ (৬:১০:১, ২)

বল এবং লোভের নগ্ন প্রকাশ যে ভারতবর্ষে, নিজের পুত্রের মাত্রা-ছাড়ানো লোভ, তার সঙ্গে পাণ্ডুপুত্রদের লোভের সংঘাতে যেখানে আগামী কাল থেকে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ শুরু হবে। এই কদর্য, রিপুপ্রাবল্যের পরিবেশ সূচনা করে ধৃতরাষ্ট্র ঘৃণা বা নির্বেদের ভরে যদি বলতেন, ‘এ দেশে বাঁচতে আর রুচি নেই’, তাহলে প্রত্যাশিত সংবেদনে জাগা সহজ হত, কিন্তু ওই কদর্যতার নগ্ন রূপ বর্ণনা করেই ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমার মন এখানেই, এই হতভাগ্য দেশেই আসক্ত। এখানে পরস্পর-বিরুদ্ধ আবেগের যুগপৎ বা আনুপূর্বিক সমাবেশ থাকায় উপলব্ধির জটিলতা আছে, এবং এই আবেগের বিরোধের মধ্যে জীবনবোধের এক ঋদ্ধ প্রকাশ আছে। যে প্রকাশ অনলংকৃত বাগ্‌ভঙ্গিতে যত শক্তিশালী, অলংকারে ততটা হত না। রামায়ণ-এ এবং বিশেষ করে মহাভারত-এ আপাতবিরুদ্ধ আবেগের নিকট সমাবেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আবেগের সংঘাতে সমৃদ্ধতর এক কাব্য স্পষ্ট হয়েছে, যা পরবর্তী যুগে ক্রমেই বিরল হয়ে এসেছে। বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ জনক যাজ্ঞবল্ক্যকে বলছেন:

‘যাজ্ঞবল্ক্য, কিংজ্যোতিরয়ং পুরুষোহতি— যাজ্ঞবল্ক্য, কোন্ জ্যোতিতে পুরুষ জ্যোথিষ্মান্?’

যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ‘আদিত্যজ্যোতিঃ—সূর্যের জ্যোতি।’

‘আর আদিত্য অস্ত গেলে?’

‘চন্দ্ৰমা।’

‘চন্দ্ৰমা অস্তে গেলে?’

‘অগ্নি।’

‘অগ্নি নির্বাপিত হলে?’

‘বাক।’

‘বাক্ শান্ত হলে?’

‘আত্মা। (বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ৪:৩:২-৬)

বাইরের সমস্ত জ্যোতি নির্বাপিত হলে মানুষের অন্তরাত্মাই জ্যোতিষ্ক হয়ে তাকে আলো দেখায়, সেই অন্তরাত্মার অনির্বাণ দীপ্তিই সর্বতমিস্রার অন্তিম প্রতীকার। এত বড় এবং এত জটিল উপলব্ধির কী সার্থক প্রকাশ ঘটল বিনা অলংকারে। উপলব্ধির গাঢ়তাতেই অলংকার নিষ্প্রয়োজন হয়ে উঠল।

স্বভাবোক্তি অলংকার কী না এ নিয়ে বিস্তার আলোচনা হয়েছে। কারণ একটিমাত্র, স্বভাবোক্তি বারবার অলংকৃত বাক্যকেও পরাস্ত করেছে নিজের মহিমায়। স্বভাবোক্তি মাত্রই শ্রেষ্ঠ কাব্য নয়, কিন্তু এমন অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে স্বভাবোক্তির দীপ্তি অলংকৃত বাক্যে পাওয়া যেত না। মৃচ্ছকটিক নাটকে আশৈশবের সহচরী মদনিকা শর্বিলককে বিবাহ করে বসন্তসেনাকে প্রণাম করে বিদায় নিচ্ছেন: বসন্তসেনা তাকে তুলে বলছেন ‘ইদানীং ত্বমেব বন্দনীয়া সংবৃত্তা/গচ্ছ ইদানীং, আরোহ প্রবহণং স্মরমাম্— এখন তুমিই হলে বন্দনীয়া, এখন যাও, গাড়িতে ওঠ গিয়ে, আমাকে স্মরণ কোরো।’ নিতান্তই আটপৌরে বাগভঙ্গি, কিন্তু এর মধ্যে বসন্তসেনার একটি প্রবল চাপা দীর্ঘশ্বাস রয়ে গেছে। নিষ্ক্রয়মূল্যে না হোক বসন্তসেনার দাক্ষিণ্যে মদনিকা আর গণিকা নয়, সে শর্বিলকের বধূ হয়ে গণিকাত্ব থেকে মুক্ত হয়ে কুলনারীর মর্যাদা পেল, আর যার আনুকূল্যে এটা সম্ভব হল সেই বসন্তসেনা নিজে গণিকাই রয়ে গেলেন। এর সমস্ত বেদনা প্রকাশ পাচ্ছে ওই কাটাকাটা বাক্যবিন্যাসে, যেন নিজের নিষ্পরিণাম প্রেমের বেদনা এবং আসন্ন সখীবিচ্ছেদের দুঃখে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে, এ মুহূর্তে দীর্ঘ বাক্যবিন্যাস সম্ভব নয়। কোন অলংকার এ দুঃখের তীব্রতাকে এমন করে স্পর্শ করতে পারত? (তুলনীয় অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর চতুর্থ অঙ্কে শকুন্তলাকে বিদায় দিতে হবে, এ দুঃখে পালকপিতা কম্বের সেই বিখ্যাত শ্লোকটি: যাস্যত্যদ্য শকুন্তলেতি হৃদয়ং সংস্কৃষ্টমুকণ্ঠয়া।’ সম্পূর্ণ নিরলংকার, শুধু স্বভাবোক্তি দিয়ে এ বর্ণনা এত শক্তিশালী হয়ে উঠল।) এখানে বিবক্ষিত বস্তুটির নিজেরই এমন ঐশ্বর্য আছে যে, অলংকার এখানে রসসৃষ্টির ব্যাঘাত ঘটাত। সপ্তম অঙ্কে শকুন্তলার বর্ণনা ‘বসনে পরিধূসরে বসানা’ সে কি প্রথম অঙ্কের ‘ন প্রভারলং জ্যোতি-র থেকে কাব্যমূল্যে কোন অংশে হীন? মনে পড়ে মন্মটের কথা— ‘রসস্যৈব প্রাধান্যান্নালংকারঃ।’

তাহলে দেখছি সুকবি, যিনি তাঁর কাব্যের অন্যত্র অলংগের প্রয়োগে সিদ্ধহস্ততার বহু প্রমাণ দিয়েছেন তিনিও স্থানবিশেষে অলংকারকে বাহুল্য বা বাধা জ্ঞান করে পরিহার করেন। তাঁরা জানেন উপলব্ধির এমন জ্বলন্ত রূপও আছে, যা তার আপন তেজে অলংকারকে পরিহাস করে। এ বোধ যতক্ষণ কবিদের থাকে ততক্ষণই কাব্যে অলংকারের প্রয়োগ সুপরিমিত থাকে; না হলে মাঘ ও নৈষধের উদয় হয়। এই পরিমিতি বোধের মধ্যেই মহাকবি ও হীনকবির পার্থক্য এবং এ বোধ আসে অলংকারের পরিহার্যতার স্থানকালপাত্রের বোধ থেকে। সৎকবি বহু অলংকার সার্থক ভাবে প্রয়োগ করতে জেনেও প্রয়োজন মতো ক্ষেত্রে সে লোভ সংবরণ করতে জানেন। শুধু যখন অলংকার তাঁর উপলব্ধি প্রকাশের একমাত্র বাহন হতে পারে তখন, এবং ঠিক যতটুকু এবং যে অলংকার প্রয়োগ করলে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তখন ততটুকু সেই অলংকার প্রয়োগ করেন। কিন্তু এরও একটা শর্ত আছে সৎকাব্যে, তা হল অলংকারপ্রয়োগের পূর্বেই কাব্যটিকে তার উপলব্ধির স্তরে খাঁটি ও সজীব হতে হবে, নইলে সেটা শবদেহে অলংকার বিন্যাসের মতো নিরর্থক প্রয়াস হবে। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ সপ্তম শতাব্দী থেকে বহু কাব্যে-নাটকে পাওয়া যায়।

আলংকারিকরা কখনো অলংকারকে কাব্যের আত্মা বা প্রাণ বলে অত্যধিক মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেননি, করেছেন, মন্দ কবিযশঃপ্রার্থীরা। কাব্যে যাঁদের মূলধন নেই, অর্থাৎ জীবনবোধে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তাঁরাই এই বড় ফাঁকিটা ঢাকবার জন্যে অত্যধিক অলংকারপ্রয়োগে তৎপর হয়ে উঠেছেন। রসবোদ্ধা পাঠকের কাছে এই অধম কাব্য নিরতিশয় পীড়াদায়ক হয় ওঠে। এই অন্তঃসারশূন্য অলংকারবহুল রচনা সপ্তম শতাব্দীতে খুব বাড়তে থাকে। বাণভট্ট হর্ষচরিত-এ বলছেন,

‘প্রায়ঃ কুকবয়ো লোকে রাগাধিষ্ঠিতদৃষ্টয়ঃ।
কোকিলা ইব জায়ন্তে বাচালাঃ কামকারিণঃ।।
সন্তি শ্বান ইবাসংখ্যা জাতিভাজো গৃহে গৃহে
উৎপাদকা ন বহবঃ কবয়ঃ।।’

অর্থাৎ, ‘রিপুতে আরক্তদৃষ্টি কুকবিরা কোকিলের মতোই বাচাল এবং স্বেচ্ছাচারী। নামেই কবি অসংখ্য গৃহে গৃহে আছে যেমন থাকে কুকুর, এরা সৃষ্টি করতে পারে না।’ (১:৫, ৬) এ ব্যাপার সর্বদেশে সর্বকালেই ঘটেছে কিন্তু তেমন সমালোচনা না থাকার ফলে মুড়িমিছড়ির একদর হয়ে গেছে প্রায়ই, তাই কালিদাসের কাব্যও মহাকাব্য আর মেণ্ঠের হয়গ্রীববধ কাব্য ও মহাকাব্য। শুধু তাই নয় এদের মতো অনুপ্রাণিত কবিদের জন্য কবিশিক্ষা গ্রন্থ রচনা হয়েছে যাতে প্রেরণার অভাব এরা পূর্ণ করতে পারে পাণ্ডিত্যে ও কৌশলে। এমনকী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে দণ্ডীও একটু স্থান রেখেছেন এদের জন্যে।

কাব্যের নানা অবান্তর ভেদের মধ্যেও অকবির সৃষ্টির জন্যে আসন রাখা আছে— গুণীভূতব্যঙ্গ্য কাব্য, চিত্রকাব্য ইত্যাদি। অলংকারশাস্ত্রের উদাহরণে যে বহুল পরিমাণ কুরুচিপূর্ণ প্রেরণাহীন অলংকারসর্বস্ব শ্লোক ইতস্তত ছড়ানো আছে— এবং সৎকাব্য থেকে কম উদাহরণ আছে— তাতেই প্রতিপন্ন হয় কাব্যের সংজ্ঞা না হোক কাব্য সম্বন্ধে বোধটা স্থূল ও সংবেদনাবর্জিত হয়ে উঠেছিল। তথাকথিত সহৃদয় কাব্যে কবি খুঁজতেন কৌশল এবং ভট্টিকাব্যের কবি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে বললেন:

ব্যাখ্যাগম্যমিদং কাব্যমুৎসবঃ সুধিয়ামলম্।
হতা দুর্মেধসশ্চাস্মিন্ বিদ্বৎপ্রিয়তয়া ময়া।।

(এই রাবণবধ কাব্যটি) ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝতে হবে। এতে পণ্ডিতের উৎসব, যারা মেধাবী নয় তাদের আমি এ কাব্যে হনন করেছি আমার বিদ্বৎপ্রীতির জন্যে। (রাবণবধ ২২:৩৪)

সুবন্ধু শ্লাঘাসহকারে বললেন, প্রত্যক্ষরশ্লেষময় তাঁর কাব্য। অর্থাৎ পরবর্তী কবিরা আর উদ্দেশ্য ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করলেন না, সরাসরি বহিরঙ্গপ্রধান কৌশলনির্ভর কাব্য রচনা করতে লাগলেন এবং শ্রোতারা বাহবা দিতে লাগলেন।

কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি অলংকারশাস্ত্র কাব্যকে পাঠকের মনোরঞ্জনের অমঙ্গলনাশের, উপদেশের, যশের, অর্থের উপায়ই বলেছেন (কাব্যং যশসেহর্থকৃতে শিবেতরক্ষতয়ে/সদ্যঃ পরনিবৃতয়ে কান্তাসম্মিততয়োপদেশযুজে। )

অর্থাৎ অনেক অবান্তর ফলপ্রাপ্তির কথা বললেও এঁরা কখনওই বলবেন না কাব্য জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে, এর মুখ্য উদ্দেশ্য হল জীবনের পুনর্মূল্যায়ন। জীবনের গভীরতম সমস্যা ও সংঘাতের প্রতিফলন ও তার মাধ্যমে জীবনের মূল্যবোধের যাচাই করাই কাব্যের প্রাথমিক করণীয়— এই সংজ্ঞা নিরূপণ করলে কাব্য বিনোদনমাত্র না হয়ে উচ্চতর স্তরে আরোহণ করতে পারত। বিয়োগান্তকে কাব্যে স্বীকার করা হয়নি— সংস্কৃত কাব্য ও অলংকারশাস্ত্রে এ এক চূড়ান্ত অভিশাপ। রামায়ণ-মহাভারত-এর মূল সুরটি এবং প্রকৃত উপসংহার এদের আদিমতম মহাকাব্যকলেবরে বিয়োগান্ত, রঘুবংশও অবক্ষয়ের গ্লানিতে মলিন, বিষণ্ণ, খণ্ডকাব্য; মেঘদূত বিরহের আর্তিতে করুণ। উত্তররামচরিত-এ ভবভূতি ছুঁয়ে গেছেন সে গভীরতাকে, উচ্চারণ করে বলেওছেন, ‘একো রসঃ করুণ এব নিমিত্তভেদাৎ পৃথক পৃথগিবাশ্রয়তে বিবর্তান্— রস একটিই, করুণ, প্রয়োজন অনুসারে নানা পৃথক রূপে তা বিবর্তিত হয় মাত্র।’

আর একটি কারণ হল কাব্যের আপেক্ষিক মান নির্ণয়ের কোনও সুস্থ সমালোচনার ধারা সমাজে বা আলংকারিক মহলে প্রবর্তিত হয়নি। কাব্যগুলিকে বিশ্লেষণ করে অংশত ও/বা সম্পূর্ণত উৎকর্ষ-অপকর্ষের বিচার হত না। এ-ও অবক্ষয়ের একটি কারণ। হয়তো এ ধরনের মানদণ্ড সৃষ্ট হওয়া সহজ ছিল না— এতগুলি বিভিন্ন অলংকার প্রস্থানের প্রাদুর্ভাব ও প্রসারের জন্যও! অনেক পরে সংহতি প্রবর্তনের চেষ্টা দেখা যায় বিশ্বনাথ, মন্মটে, কিন্তু অলংকার ততদিনে শবব্যবচ্ছেদে পরিণত হয়েছে, কারণ, সংস্কৃত কাব্য ততদিনে নিষ্প্রাণ। কালিদাসের পরে যখন ভট্টি, ভারবি, মাঘ, নৈষধকার কাব্য রচনা করছেন তখনও, কালিদাস কেন ভাল, এঁরা কোথায় দীদনতর, কেন হীনতর তার কোনও সার্থক আলোচনাই হল না। একটা প্রমাণ, অধিকাংশ আলংকারিক উদাহরণ সংকলন করেছেন অর্বাচীন অ-কবিদের গ্রন্থ থেকে অথবা স্বরচিত অ-কাব্য থেকে; কালিদাস থেকে উদাহরণ শোকাবহরূপে কম। পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে সামগ্রিক ও আপেক্ষিক মূল্যবিচারের যে ধারাটি চলিত ছিল তাতে প্রায়শই সুস্থ সাহিত্য অভ্যর্থনা পেত এবং অসৎকাব্য অসৎকাব্য বলেই বিবেচিত হত। বিশুদ্ধ ভঙ্গিবৈচিত্র্য ও অলংকারের প্রাচুর্যে কাব্যের কাব্যত্ব সেখানে কখনওই নির্ভর করেনি, বোধহায় রোম সাম্রাজ্যের আমলে যাকে ল্যাটিন সাহিত্যের ‘রজত যুগ’ বলে অভিহিত করা হয় সেই শ’দুই বছর বাদে। যে সব শ্লোক শুধুই অলংকার শাস্ত্রে দোষের বা অ-কাব্যের উদাহরণ হতে পারত তাই পরিবেশিত হল কাব্যের নানা আলোচনায় সাহিত্যের ভূমিকায়।

তৃতীয় একটি কারণ মনে হয় সাহিত্য লঘু প্রমোদের অঙ্গন ছেড়ে জীবনের অন্দর-মহলে বিশেষ প্রবেশ করল না, যেখানে জীবনের তাৎপর্য সার্থকতা উদ্দেশ্য নিয়ে বিচিন্তা বা অন্বেষণা। মনে পড়ে কীটসের কাব্য The Fall of Hyperion-এ কবি এসেছেন কাব্যলক্ষ্মী মনেটার মন্দিরে, মহৎকাব্য রচনার গূঢ় তত্ত্বটি জানতে। দেবী প্রথমে তাঁকে ধিক্কার দিলেন পরে ব্যক্ত করলেন কবিত্বের চরম রহস্যটি:

‘None can usurp this height,’ returned that shade
But those to whom the miseries of this world
Are miseries, and will not let them rest.

‘(কবিত্বের) এই (দুরারোহ) শিখরে কেউ সহজে উত্তরণ করতে পারে না, পারে শুধু তারা এ জীবনের আর্তি যাদের কাছে আর্তিই এবং তাতে যারা অস্থির হয়ে ওঠে।’

এই মানদণ্ডের সাক্ষাৎ সংস্কৃত অলংকারের কোনও গ্রন্থে পাই না। মহৎ কাব্য যশ অর্থ আনন্দ ছাড়াও যে আরও কিছু দিতে পারে বলেই তা মহৎ কাব্য, জীবনের দুরূহ ও জটিল নৈতিক মূল্যবোধের, আবেগের, প্রত্যয়ের সংঘাতেও দিশারী হওয়াই যে মহৎ কাব্যের যথার্থ ভূমিকা এ বোধ না পাই অধিকাংশ অলংকারশাস্ত্রে, না পাই কালিদাসোত্তর কাব্যে

কাব্যের অবক্ষয়ের চতুর্থ একটা ঐতিহাসিক কারণও আছে। দশম একাদশ শতক থেকে কথ্যভাষাগুলির অভ্যুত্থান ঘটল, এবং সজীব, জীবনজিজ্ঞাসার কাব্য কথ্যভাষাতেই রচিত হতে লাগল। ফলে সংস্কৃত মজা নদীর শুকনো খাত হয়ে পড়ে রইল, বহতা নদীর স্রোতেই কাব্যপিপাসুর তৃষ্ণা মিটতে লাগল। কবীরের দোঁহায় দেখি: ‘বহতা পানী নির্মলা, বদ্ধা গন্ধিলা জায়— যে জলে স্রোত আছে তাই নির্মল, বদ্ধ জলার জল দুর্গন্ধ।’ আবার দেখি ‘সংস্কৃত কূপজল, কবীরা, ভাসা বহতা নীর— সংস্কৃত হল কুয়োর জল, কবীর, ভাষা হল বহতা জল।’ জনসাধারণও বুঝতে পারছে সংস্কৃতে পাণ্ডিত্যপ্রকাশের অবকাশ আছে, প্রাণের উপলব্ধি প্রকাশের পক্ষে তা অব্যবহার্য, সে-কাজের জন্যে আছে কথ্যভাষা। দ্বাদশ শতকের পর থেকে প্রথম ক্রমে ক্রমে রাজসভার ভাষা হিসেবে সংস্কৃত অপসারিত হল, বিজয়ীদের ফারসি ভাষাই রাজকার্যের বাহন হয়ে উঠল। রাজসভায় সংস্কৃতের পৃষ্ঠপোষকতা আর রইল না রাজসভায় এ ভাষা তখন মুষ্টিমেয়ের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম; এই মুষ্টিমেয় তখন জমিদারদের ও দেশীয় রাজাদের সভাপণ্ডিত ও সভাসদগণ— এঁরা বিদ্বান কিন্তু রসবোদ্ধা নন। কাজেই কাব্যের কাছে এঁদের প্রত্যাশা পাণ্ডিত্যের, রসসিদ্ধির নয়। দেহের অবয়বের ভঙ্গি ও বিন্যাসেই ভরতনাট্যম্ ও মণিপুরী, ইত্যাদি নৃত্যশিল্পকৃতির সৃষ্টি হয়, আবার দেহাবয়বের ভিন্ন প্রকারের সঞ্চালন ও বিন্যাসে সার্কাসও হয়। একটি রসোত্তীর্ণ, মানুষকে অভিভূত তন্ময় করবার ক্ষমতা রাখে, অন্যটিতে বিস্ময় ও চমক আছে কাজেই তা বাহাদুরি দেখিয়ে বাহবা পায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা কাব্যে ভঙ্গিবৈচিত্র্য ও অলংকারপ্রাচুর্য খুঁজলাম, একশো চৌষট্টি রকমে বলতে পারলাম তোমার মুখ চন্দ্রের মতো বা পদ্মের মতো; কিন্তু এর জন্যে কোনও উপলব্ধির প্রয়োজনই হয় না, কাব্য বা অলংকারশাস্ত্র পড়া থাকলেই চলে। কাব্যে রূপ পেলাম, সৌন্দৰ্য বা রমণীয়তা পেলাম না। অথচ আমরাই বলেছি, ‘তদেব রূপং রমণীয়তায়া মুহুর্মুহুৰ্ষন্নবতামুপৈতি— যা মুহুর্মুহু নূতন হয়ে প্রতিভাত হয় তা-ই হল রমণীয়তার রূপ। কোথায় সে মুহুর্মুহু নবীনতা? তা,কেবল অলংকারবৈচিত্র্যে মুখ পদ্মের মতো বলার শ’ দেড়েক ভঙ্গি। এর মধ্যে কাব্য যে দেউলে হয়ে গেছে সে বোধটা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ভাবে কোনও অলংকারগ্রন্থে নেই।

পরোক্ষ ভাবে আছে। যখন দেখি ব্যঞ্জনাপ্রস্থান আক্রান্ত হচ্ছে, বিদ্রূপের লক্ষ্য হচ্ছে তখন বুঝি এ হল প্রাণবানের সম্বন্ধে মুমূর্ষুর ঈর্ষা। তবু বলব, বিস্ময়ের বস্তু হল এই যে, কাব্যে যখন প্রাণ অন্তর্হিত তখনও আলংকারিকরা কখনও বলেননি অলংকার কাব্যের প্রাণ। একেবারে প্রথম দিকের ভামহ বামন প্রভৃতিরা ছাড়া অলংকারকে তত প্ৰাধান্য পায় কেউই দেননি (পরে অবশ্য রুষ্যক ও রুদ্রটও দিয়েছিলেন); সম্ভবত অলংকারের চর্চা দিয়েই কাব্যালোচনার সূত্রপাত বলেই এর নাম অলংকারশাস্ত্র। কিন্তু দুটি ব্যাপার প্রণিধানযোগ্য: একটি হল রস-ও ধ্বনি প্রস্থানের মতো সুস্থ, সার্বজনীন ও সূক্ষ্ম আলোচনাপ্রসূত দুটি প্রস্থান যখন এসেছেন তখনও কাব্যে কোনও নতুন প্রাণসঞ্চার হল না, ভঙ্গিবৈচিত্র্য এবং অলংকারবাহুল্যের মর্যাদা হ্রাস পেল না। দ্বিতীয়ত, কাব্যের কাব্যত্ব সম্বন্ধে যতগুলি প্রস্থান সৃষ্টি হয়েছে তখনও সবগুলিকে সংহত করে একটি সুস্থ সর্বাঙ্গীন মানদণ্ড নির্মিত হল না কাব্যে সম্পূর্ণাঙ্গতা বিচারের জন্যে। সম্ভবত সংস্কৃত ভাষা বহু পূর্বেই শুধু বিদগ্ধজনের পরিশীলিত ভাষা হয়ে যাওয়ায় এবং প্রাকৃত ভাষাগুলি অবহেলিত থাকায় এই মারাত্মক অভাবগুলি সাহিত্য সমালোচক সমাজে থেকেই গেল।

কারণ যাই হোক, ফলটা শোচনীয় হল। শুধু যে সৎ, সুস্থ, গভীর এবং রসোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হল অবিরত অলংকার চর্চায় ও প্রয়োগে তা-ই নায়, অসৎ অসুস্থ কাব্য ও কাব্যপদবাচ্য হয়ে উঠল। যে বাণভট্টে সত্যকার সৃষ্টিপ্রতিভার স্বাক্ষর আছে, তাঁর কাব্যে বারেবারে তিনিও বিকৃতরুচি অলংকারপ্রিয় রসবোধহীন পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্যে লেখনী ধারণ করতে দ্বিধা করলেন না। স্বয়ং বাণভট্টেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যে পরে কা কথা

কাব্যের মানদণ্ড, উদ্দেশ্য, বিচার, লক্ষ্য সবই অবনমিত হল। সে তখন চিত্তবিনোদনের বস্তু হয়ে উঠল। সচেতন ভাবে মানবিক, আবেগের, নীতির, প্রত্যয়ের সব বাস্তব সমস্যাকে পরিহার করতে লাগল। একটি সৌন্দর্যের কল্পলোক সৃষ্টির প্রয়াসে কাব্য জীবনকে বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করল না। এই সৌন্দর্যের উৎস কোথায়? দেহের, বিশেষত নারীদেহের এবং নিসর্গের বর্ণনার দ্বারা, ভোগবিলাসের নানা বর্ণনার দ্বারা অবাস্তব একটি কল্পলোক সৃষ্টি করে তার উপাদানকে নানা ভাবে বিন্যস্ত করে কাব্য নির্মাণ করতে লাগল। সমস্যা যেটা দেখা দিল তা হল: নিসর্গই হোক নারীদেহই হোক সবই বহুপরিচিত, তার দ্বারা নতুন কিছু— আপাত ভাবেও উপস্থাপিত করা খুবই কঠিন। কবিরা এ সমস্যার সমাধান করলেন অভিনব এক পন্থায়: পরিচিত বিষয়কে অপরিচিত ভঙ্গিতে পরিবেশন করে। এই ভঙ্গি হল মুখ্যত অলংকারবৈচিত্র্য। তাই দেখি সাহিত্যে ও অলংকারশাস্ত্রে অলংকারের প্রকারভেদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। অনুচ্চারিত হলেও সকলেই স্বীকার করছেন রসসৃষ্টির দেবদুর্লভ শক্তি আর নেই। সেই সর্বস্বান্ত অবস্থাকে ঢাকা দেওয়ার কাজে ডাক পড়ল অলংকারের। প্রবল ঘটা করে এল ভঙ্গিবৈচিত্র্য, এল অসংখ্য অলংকার। যা সৃষ্টি হল তাতে চমক প্রচুর, নেই শুধু উপলব্ধি, নেই প্রেরণা, জীবন সম্বন্ধে কোনও নতুন বোধ, প্রকৃতপক্ষে যা হল কাব্যের প্রাণ। দীর্ঘায়ত বর্ণনা, যত তার ঘটা তত ছটা, কিন্তু প্রকৃতি বর্ণনাই হোক আর রূপ বর্ণনাই হোক, যুদ্ধ বর্ণনাই হোক আর সূর্যাস্ত বর্ণনাই হোক— যতক্ষণ না তার প্রাণকেন্দ্রে থাকছে কোনও যথার্থ উপলব্ধি ততক্ষণ তা নিতান্তই বহিরঙ্গ। ওই যে মম্মট বললেন, ‘উপকুর্বন্তি তং সন্তং’, সেইখানেই ঠেকে গেল এই অবক্ষয়ধর্মী সাহিত্য রস। সার্থক কোনও উপলব্ধি, জীবনকে দেখার নতুন কোনও দৃষ্টিকোণ যখন নেই, অর্থাৎ অঙ্গী যখন নেই তখন কার অঙ্গদ্বারেণ আসবে অলংকার? বিশ্বনাথের কথাও তো তাই ছিল ‘শব্দার্থয়োরস্থিরা যে ধর্মাঃ শোভাতিশায়িনঃ। রসাদীনুপকুর্বত্তোহলংকদ্বারাস্তোহঙ্গদাদয়ঃ।।’ শব্দার্থময় কাব্যের শোভাবৃদ্ধিকারী ‘অস্থির’ যে ধর্মগুলি রসাদির উপকার করে। ক্রমে অস্থির ধর্ম শুধু যে স্থির হয়ে উঠল তাই নয় রসাদির অবর্তমানে তার উপকার করার প্রশ্ন যখন আর নেই তখন অলংকারই রসের স্থানে অভিষিক্ত হয়ে রাজত্ব করতে লাগল।

পরিশেষে একটি কথা: বর্ণনা— তা সে যত অলংকারবহুল যত মনোরমই হোক না কেন— কখনও মহৎ সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়ে উঠতে পারে না। মহৎ সাহিত্যের ভিত্তিই হল জীবনবোধ এবং তার প্রকাশে অলংকার থাকলেও তার উপলব্ধিগত জটিলতাও থাকবে; নিঃশেষ অর্থ পাওয়া যায় না। যেমন :

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখং,
তত্তে পূষণ্ণপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে। (বৃহদারণ্যকোপনিষৎ (৫:১৫:১)

এর অর্থ করা হয়: সোনার পাথর দিয়ে সত্যের মুখ ঢাকা আছে, পূষন্ সেই ঢাকা তোমার জন্যে খুলে দিন সত্যধর্ম দেখবার জন্যে। বলা বাহুল্য, অভিধাগত অর্থ ও অলংকার বুঝলেও এ কাব্য সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। কারণ এখানে কবির উপলব্ধির মধ্যেই দুরূহতা আছে, যা ভাবগতও নয় আবার সম্পূর্রত চিন্তাপ্রসূতও নয়, যে, কোনও দর্শন প্রস্থানের শরণাপন্ন হলে সুরাহা হবে। তাতে দার্শনিক ব্যাখ্যা মিলবে ঠিকই কিন্তু কবির উপলব্ধিটির যথার্থ পরিচয় মিলবে না। কিংবা অথর্ববেদের সেই, ‘দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীবতি— দেবতার কাব্যটি দেখ, তা মরেও না জীর্ণও হয় না’—এটা বললে কি পূর্ণ উপলব্ধিটি হৃদয়ঙ্গম করা যায়? ‘দেবতার কাব্য’ কি অলংকার না অভিধাগত অর্থেই বুঝতে হবে। অথবা ‘যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃতঃ।’ এর অর্থের জন্যে দেড় হাজার বছর পরের এক বিশিষ্ট দার্শনিক প্রস্থানের প্রবক্তা শংকরাচার্যের ওপরে ভার দিলে স্বভাবতই একটি প্রস্থানগত ব্যাখ্যাই মিলবে এবং সেটি কবির অভিপ্রেত অর্থ হবে না তা বলাই বাহুল্য। তার পরিবর্তে যদি এ কাব্যাংশটিকে কবির উপলব্ধিরূপেই গ্রহণ করি তাহলে লক্ষ্য করব আপাতবিরোধী (অমৃত/মৃত্যু) অনুভবের জটিলতাতে ও অন্তর্দ্বন্দ্বের গাঢ়তাতে এ-কাব্য সমৃদ্ধ। তেমনই:

ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্যঃ
ভয়াদিন্দ্রশ্চ চন্দ্রশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।। (কঠোপনিষৎ ২:৩:৩)

এর মধ্যে মহাজাগতিক যে পরিবেশটি সৃষ্ট হয়েছে তার মধ্যে সক্রিয় উপাদান হল ভয়— একে কি আক্ষরিক অর্থে নিলে কোনও অর্থ পাওয়া যায়? তার ভয়ে অগ্নি তাপ দেয়, সূর্য তাপ দেয়, ভয়ে ইন্দ্ৰ চন্দ্র ও মৃত্যু ধাবিত হয়। এতে অলংকার নেই, না, সমাসোক্তিতেও এর অর্থ নিহিত নেই, এ কাব্য অলংকারকে অতিক্রম করে কাব্য হয়ে উঠেছে উপলব্ধির গভীরতায়। অথবা যখন শুনি:

ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারক
নেমো বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্ববিদং বিভাতি।। (কঠোপনিষৎ ২:২:১৫)

অর্থ, সেখানে সূর্য আলো দেয় না, বিদ্যুৎ দেয় না, এই অগ্নিই বা কোথায়? দীপ্যমান তার দীপ্তি অবলম্বনে অন্য সব কিছু দীপ্তি দেয়, তার উজ্জলতাতেই এই সব কিছ উজ্জ্বল। এখানে কোনও অলংকার নেই, কাব্যটি নির্ভর করছে উপলব্ধির মহিমার ওপরে। এখানেও সেই ‘রসস্যৈব প্রাধান্যন্নালংকারঃ।’ কাব্য যে অলংকারকে ছাড়াই সম্পূর্ণ রসের মহিমাতেই অনবদ্য হয়ে উঠতে পারে আনন্দবর্ধন ও জগন্নাথ ছাড়া এ কথা স্পষ্ট করে কেউই বলেননি। এবং দুঃখের বিষয় এঁদের কোনও সার্থক প্রভাব কবিদের ওপরে বা আলংকারিকদের ওপরে পড়ল না। অলংকারের প্রাধান্য ঘুচল না বরং ক্রমে ক্রমে অলংকারই হয়ে উঠল সর্বেসর্বা। উপরের শ্লোকটিতে যে নিরলংকার উক্তি তাকে স্বভাবোক্তি নাম দিলেও হয়তো ঠিক হয় না কারণ, এর অর্থ অভিধায় ধরা পড়ে না। ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ রসের গৌরবেই এর গৌরব সম্যক্‌ অনুভূত হয়। যে অনুভবের মধ্যে বিচিত্র অঙ্গ অনুভব আনাগোনা করে তা ওই অঙ্গী ও অঙ্গরসের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে মিশ্র জটিল এক উপলব্ধির রসায়নে পরিণত হয় এবং এইখানেই তার ঐশ্বর্য অর্জুনের রথে শিখণ্ডীকে দেখে ভীষ্ম যখন অস্ত্রত্যাগ করেন, তখন, ‘গ্রীষ্মসন্তপ্ত মানুষ যেমন করে প্রথম বর্ষণের জলধারার প্রতীক্ষা করে তেমনই করেই ভীষ্ম শিখণ্ডীর শণধারা গ্রহণ করলেন।

উষ্ণার্তো হি নরো যদ্বজ্বলধারাঃ প্রতীচ্ছতি।
তথা জগ্রাহ গাঙ্গেয়ঃ শরধারাঃ শিখাণ্ডিনঃ।। (৬:১২৭:২৩, ২৪)

উপমায় এর সবটুকু সৌন্দর্য নিহিত নেই, ব্যঞ্জনার দ্বারা জীবনের তাপে তপ্ত বৃদ্ধের মৃত্যুর মধ্যে মুক্তির প্রতীক্ষা ধ্বনিত হচ্ছে। সমস্ত দৃশ্যটির অন্তর্নিহিত গ্লানি ও ধিক্কার এবং মৃত্যুর মধ্যে এই পঙ্কিল জীবনকে ধুয়ে শুচি হয়ে চলে যাওয়ার, গ্লানিবর্জিত জীবনের স্বস্তি ফিরে পাওয়ার ব্যঞ্জনা— এর কাব্যমূল্য উপমানির্ভর নয়। যদিও এ উপমাটি নিরতিশয় সার্থক।

তবু বলব একেবারে তুঙ্গে পৌঁছে কবিতা নিরলংকারই হয়। পার্বতী যখন বলেন ‘মমাত্র ভাবৈকরসং মনঃ স্থিতং’, বা কিং লীয়ার নাটকের শেষে এডগার যখন বলে

The oldest have borne most; we that are young
Shall never see so much nor live so long.

তখন এই সম্পূর্ণ নিরলংকার বচনের মধ্যে উপলব্ধির যে গাঢ়তা তা কোনও অলংকৃত ভাষণে ধরা পড়ত না। সীতার জীবনের সমস্ত ক্ষুব্ধ বেদনা বঞ্চনা ও অভিমান যেমন প্রকাশ পেল এই শ্লোকে:

মনসা কর্মণা বাচা যথা রামভচয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি।। (৭:৯৭:১৫)

ঠিক এই মুহূর্তে সীতার অন্তর্দাহ এত গভীর যে অলংকারের প্রয়োগটি রসসঞ্চারে বিঘ্ন ঘটাত। একটি স্তরে গিয়ে অলংকার প্রয়োগের নিপুণ কবিও বলেন, ‘আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অহংকার’; একটি স্তরে কাব্য তার সোনার আবরণ উন্মোচন করে নিরঞ্জন উপলব্ধির সত্যের মহিমাতেই সহৃদয়চিত্তকে অভিভূত করে।

চুনি, পান্না, নীলা সবই হীরের জাত, নানা বর্ণের ছটায় সুন্দর তারা, কিন্তু হীরেই সবচেয়ে দামি। বৈজ্ঞানিক বলেন, যে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে হীরে তৈরি হয়, এই মণিগুলির জন্যে ততটা প্রয়োজন হয় না। কবির উপলব্ধিতে যখন সেই তীব্রতা সেই প্রাবল্য থাকে, যার ফলে তার জীবনজিজ্ঞাসা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, কঠিন বেদনার ঘনীভূত চাপ ও তাপে কাব্য তখন নিরঞ্জন মহিমায় কমলহীরে হয়ে ওঠে। এবং এ স্তরের জীবনজিজ্ঞাসায় বেদনার উপলব্ধি কোথাও না কোথাও অন্তর্নিহিত থাকেই (Our sweetest songs are those that tell of saddest thought)। আমরাও ত বলেছি মাথুরেই পদকর্তার শক্তির শেষ স্বাক্ষর। সংস্কৃত কাব্যনাটক দুঃখান্ত পরিণতিকে বর্জন করে, জীবনজিজ্ঞাসাই যে মহৎকাব্যের অন্তিম অন্বেষা এ কথা কোথাও না স্বীকার করে কাব্যে জীবনের গভীরতম প্রকাশের অবকাশ অনেকটাই রোধ করেছে। ক্ষতিপূরণ করতে এসেছে অলংকার তার বিচিত্র চমক নিয়ে, কিন্তু কমলহীরের দ্যুতি সে পাবে কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *