একাদশ পরিচ্ছেদ
এখনও যেন ভাল করে বুঝতে পারেন না শ্যামা। এত দ্রুত, এত অল্প কদিনের মধ্যে এতগুলো ব্যাপার ঘটে গেল– এত সাংঘাতিক, কল্পনাতীত সব ঘটনা– আর সেগুলো একটু নিঃশ্বাস ফেলবার সময় না দিয়েই এমন পর পর প্রবলভাবে ঘা দিয়ে গেল তাঁর মনে ও মস্তিষ্কে যে, ভাল করে ভেবে দেখা তো দূরের কথা, সেগুলো পরিষ্কার ধারণাই করতে পারেন না সম্পূর্ণভাবে। কেমন যেন তালগোল খিচুড়ি পাকিয়ে গেছে সবটা। এখন ভাবতে গেলে ঠিক ঠিক মাথায় আসে না। সব ঘটনাগুলোই যে সত্যি সত্যি ঘটেছে তাও মনে হয় না। মনে হয় এসব স্বপ্নে দেখছেন তিনি, অসুখের মধ্যেকার বিকার এগুলো। কিম্বা আর কোন লোকের সংসারে এসব ঘটেছে, লোকমুখে শুনছেন। আঘাত পেয়েছেন যে একটা খুব, তাও মনে হয় না। শুধু শরীরটা নয়, মনটাও যেন জড়ভরত হয়ে গেছে কেমন।
শরীরটা তাঁর খুবই ভেঙ্গে গেছে এই কদিনে। সেইটে প্রত্যক্ষ, সেইটে টের পাচ্ছেন তিনিও সবাই বলত তাঁর পাথরের শরীর, রোদে, জলে, অনিয়মে, উপবাসে তাঁর কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। তিনিও তাই জানতেন। এত অত্যাচারে, এত অনাহার ও অপুষ্টিতেও কখনও শক্ত অসুখ তাঁর হয় নি। স্বামী কোন সাংঘাতিক ব্যাধির বীজাণু তাঁর দেহে সংক্রামিত করে গেছেন বলেই তাঁর বিশ্বাস–কিন্তু তাও আজ পর্যন্ত বিশেষ মাথা তুলতে পারে নি। কোন শক্ত অসুখই তাঁর করে নি কখনও। সব অবস্থাতেই নিজের অভ্যস্ত কাজ করে যেতে পারেন–এ অহঙ্কারও ছিল তাঁর মনে। এবার সে সব অহঙ্কারই ঘুচেছে।
উমার ঐ ঘটনাটা যেদিন ঘটে– সেদিন তিনিও একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিলেন আঘাটায় নেমে শুষুনি শাক তুলতে গিয়ে শামুকের খোলায় পা কেটে রক্তারক্তি। এতখানি ফালা হয়ে কেটে গিয়েছিল গোড়ালির কাছটা। তারই তাড়সে প্রবল জ্বর আসে, পা-টা বোধহয় বিষিয়েই উঠেছিল, ফুলে উঠেছিল সমস্ত পাটাই। গোবিন্দ যখন খোকাকে পাঠিয়ে খবর দিলে, তিনি তখন অজ্ঞান-অচৈতন্য। ভাগ্যে কান্তি ওঁর ঐ জ্বর আর পা ফোলা দেখে সেইদিনই ফকির ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল, নইলে কী হত বলা যায় না। ফকির ডাক্তার নাকি বলে গেছেন আর একদিন দেরি হলে পা কেটে বাদ দিতে হত।
সবাই বলে যে যমজ ভাই কি বোন একজন গেলে অপরজন ঠিক টের পায়। শ্যামা কিছু টের পান নি। অবশ্য টের পাবার মতো অবস্থাও ছিল না তাঁর। চটখন্ডীদের গিন্নী যেটা বলেছেন সেইটেই ওঁর মনে লেগেছে। যম তাঁকে ধরেও টেনেছিল। যমজের একজন যখন মরে, আর একজনেও প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। নিহাৎ ওঁর সব পাপের সাজা এখনও ভোগ হয় নি বলেই যমদূত ছেড়ে দিয়ে গেছে।
উমার খবর শুনলেন উনি অনেক পরে। স চুকে-বুকে গেছে তখন। একটু ভাল রকম জ্ঞান হতে তবে ওরা বলেছে– তাও একসঙ্গে বলে নি, সইয়ে সইয়ে বলেছে। হেম নাকি কদিন এখানে আসতেই পারে নি। লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল– ওর শ্বশুররা এসে কনককে রেখে গেছেন। অসুখের মধ্যে চোখ খুলে কনককে দেখে প্রথমটা ওঁর ভুরু কুঁচকে উঠেছিল। এরই মধ্যে– তারপর নিজের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। এই জন্যেই ওরা এনেছে। কে কার মুখে ভাত জল দেয়। কান্তি তো কিছুই পারে না। দুদিন নাকি মুড়ি চিবিয়ে আছে।
এত কাণ্ড হয়ে গেছে উমার, তখনও শোনেন নি। আর দুদিন পরে শুনলেন। হেম সব কাজ শেষ করে ফিরে এসে বলল।
গোবিন্দ খবর পেয়েই হাসপাতালে গিয়েছিল। প্রাণ ছিল তখনও কিন্তু সে প্রাণরক্ষার জন্য কিছুই করেন নি ওরা। কী হয়েছে কতদূর হয়েছে তাও কেউ দেখে নি। অত রাতে নাকি কিছুই করা যাবে না। কাল বড় ডাক্তার না দেখলে তেমন ব্যবস্থা কিছু করা সম্ভব নয়। শুধু মাথায় বরফ দিয়ে ফেলে রেখেছে। রক্তও মুছিয়ে পরিষ্কার করা হয় নি। নিঃসাড়ে পড়ে আছেন উমা– খুব লক্ষ্য করলে বোঝা যায় বুকের কাছটা একটু উঠছে নামছে।
অনেক কাণ্ড করে ‘আর-এস’-কে খুঁজে বার করেছিল গোবিন্দ–তাতেও কোন লাভ হয় নি। তিনি মুখ বাঁকিয়ে বলছেন ‘আমার তো মনে হয় ও আর বাঁচবে না। হাউএভার, বড় সার্জন কেউ না দেখলে ঠিক বলতে পরছি না। তাও এক্স-রে না নিলে তাঁরাও যে কিছু ডেফিনিট বলতে পরবেন– তা মনে হয় না। সেও কাল সকালের আগে তো নয়। আমাদের যেটুকু করবার করেছি– আর কিছু করবার নেই। মরফিন ইঞ্জেকশন পড়েছে, মাথায় বরফ চলছে– আর কী করব বলুন? যদি বাঁচার হয় তো ঠিক সারভাইভ্ করবে– নিত্য দেখছি তো!’
পরের দিন বড় ডাক্তার এলেন যখন তখন বেলা বারোটা বাজে। তখনও প্রাণ আছে কিন্তু আর তখন নাকি কিছু করার নেই। তিনি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘মনে হচ্ছে স্কাল্-এ খুব বড় একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে, ব্রেনে সুদ্ধ চোট লেগেছে। তার মানে জটিল অপারেশন। সে সব যন্ত্রপাতিও নেই আমাদের, তা ছাড়া যা অবস্থা পেসেন্টের এখন এক্স-রে করিয়ে অপরেশনের তোড়জোড় করতে করতেই ও মারা যাবে। বাইরে থেকে টের পচ্ছেন না আপনারা, ভেতরে ভেতরে খুব হেমারেজ হয়েছে। শক্ত হার্ট বলেই এখনও টিকে আছে–’
কিন্তু তখনই শব হাসপাতালের ভাষায় ‘লাশ পাওয়া গেল না। এ নাকি পুলিশ কেস, পোষ্টমর্টেম পরীক্ষা করতে হবে। গোবিন্দ আর হেম– হেমকে হাওড়া স্টেশনে ধরে সকালেই খবর দিয়েছিল গোবিন্দ, সে অফিসে সই করেই চলে এসেছে– থানায় গিয়ে দারোগাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করল; ব্রাহ্মণের শব, সকলের সামনেই তো দুর্ঘটনা হয়েছে– মিছিমিছি কাটা-ছেঁড়া করবেন কেন, ডোমে ছোঁবে–যদি দয়া করে এমনিই ছেড়ে দেন উনি, চিরকৃতজ্ঞ থাকবে এরা ইত্যাদি; কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। পরে সকলে বলল যে কিছু প্রণামী পেলেই ছেড়ে দিত– কিন্তু সেটা হেমরা জানত না। অত মাথাতে যায় নি। সঙ্গে টাকাও ছিল না। তবে জানা থাকলে হয়ত শরতের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যেতে পারত, ধার করেও দিত হয়ত। ওরা কিছুই জানত না, আগে কেউ বলেও দেয় নি। তবে সেও তো অনুমান।
ফলে বাসিমড়া পড়ে রইল। শেষ পর্যন্ত পরের দিন যখন মর্গ থেকে লাশ ছাড়া হল তখন বেলা একটা বাজে।
শরৎ সেই রাত থেকে কমলার ওখানেই আছেন। তাঁকে ও-বাড়ি মানে ওঁদের সে-বাড়ি যাবার কথা কেউ বলে নি, তিনিও তোলেন নি। এখানে যে আছেন– এদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা– তাও জিজ্ঞাসা করেন নি। কোথায় আছেন সেটাও অত মাথাতে যায় নি বোধহয়। সহজ ভাবেই থেকে গেছেন। সেই যে এসেই ধপ করে বসে পড়েছিলেন, সেই ভাবেই বসে ছিলেন। ওঠেন নি, নড়েন নি, কারও সঙ্গে কথা বলেন নি। অনেক রাত্রে –প্ৰায় শেষ রাত্রে কমলা এসে জোর করে শুইয়ে দিতেই শিশুর মতো শুয়ে পড়েছিলেন। কোন বাধা দেন নি– কোন প্রশ্ন করেন নি। শুধু কিছু খাবেন কিনা গোবিন্দ জিজ্ঞাসা করাতে একটা অদ্ভুত অনুরোধ করেছিলেন। গোবিন্দকে কিছু না বলে কমলার দিকে চেয়ে অনুরোধের সুরে বলেছিলেন, ‘ঐ যে পুঁটুলির মধ্যে ক্ষীরের বরফিগুলো পড়ে আছে–তুলে রেখে দেবেন দিদি? ও এনেছিল আমার জন্যে। আমি ভালবাসি বলে। আজ নয়–কাল সকালে আমি খাবো।
পরের দিনও চুপ করে বসেই ছিলেন এক জায়গায়। হাসপাতালে যাবার কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি– কেমন আছে তাও জানতে চান নি। সকালে কমলাই কথাটা তুলেছিলেন, ‘একবার দেখতে যাবে না ভাই?’
মৃদু মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘না দিদি, কাজ নেই। কাল দেখার চেষ্টা করেছিলুম, দেখতে পাই নি। সব ঝাপসা দেখেছিলুম। ও অবস্থায় দেখতে পারবও না।…. না-ই বা দেখলুম আর। এক যদি–যদি–বাঁচে–’
আর কিছু বলতে পারেন নি। স্বর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মৃত্যুসংবাদটা পাবার পরও চুপ করে বসেছিলেন। কান্নাকাটি করেন নি, কাউকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নি। গোবিন্দ নিজে থেকেই বলেছিল পোস্টমর্টেমের কথা, তাও কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। স্থির দৃষ্টিতে সামনের দেওয়ালের রঙিন ক্যালেন্ডারটার দিক চেয়ে বসে ছিলেন।
কমলা আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদছিলেন। তাঁকে সান্তনা দিতে গিয়ে হেম গোবিন্দ খোকা সকলেরই চোখে জল এস গিয়েছিল– কিন্তু শরৎ তখন কাঁদেন নি। কেঁদেছিলেন অনেক পরে রাত্রিবেলা। অন্ধকারে বসে কেঁদেছিলেন। রানী দেখেছে, রানীই বলেছে হেমকে, গোবিন্দকে।
রানীকে কেউ খবর দেয় নি, সে এমনই এসে পড়েছিল বিকেলে। এদের ভাগ্যক্রমেই সে এসে পড়েছিল বলতে হবে। সে এসেই জোর করে নিজের ছেলেমেয়ে কোলে দিয়ে কতকটা শান্ত করল কমলাকে। সে না এলে সেদিন সন্ধ্যায় এদের ঘরে বোধহয় আলো জ্বলত না, কারও মুখে জল পড়ত না এক বিন্দু। হেম আর গোবিন্দ তো ছুটোছুটি করছিল। খোকা গিয়েছিল মহাশ্বেতাদের বাড়ি খবর দিতে। কমলা কাঁদছেন– শরৎ চুপ করে বসে আছেন, রানী যখন এল।
রানী বৌ-ই সন্ধ্যার পর চা করে শরৎকে দিতে গিয়ে দেখেছিল তাঁর দু-চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে, কান্নার বেগ নেই– শুধু নিঃশব্দে জল পড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই পড়ছে বোধহয়, সামনের গেঞ্জিটা ভিজে গেছে।
রানী ফিরেই আসছিল। কী ভেবে আবার কাছে গিয়ে কুণ্ঠিত মৃদুকণ্ঠে বলেছিল, মেসোমশাই, চা এনেছি।’
শরৎ মুখ তুলে চেয়েছিলেন। তারপর নিঃশব্দে চায়ের কাপটা ওর হাত থেকে নিয়ে পাশে নামিয়ে রেখেছিলেন। বোধহয় খেয়েছিলেনও, সেটা আর রানী দেখে নি। দেখতে পারে নি। তার দুই চোখ জ্বালা করে জল ভরে এসেছিল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে হয়ত সে-ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ত।…
পরের দিন মর্গ থেকে কখন শব পাওয়া যাবে খোঁজ করে সেই মতো লোকজন ঠিক করে হেমকে খাট এবং দুর্গাপদকে ফুল কিনতে পাঠিয়ে গোবিন্দ শরৎকে ডাকতে এল।
‘আপনাকে একটু উঠতে হবে মেসোমশাই এবার। একবার যেতে হবে আমাদের সঙ্গে–’
উনি যেন অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি–আমি যাব? আমি কেন বাবা?’
একথার জবাব গোবিন্দ দিতে পারত না! এ ধরনের কথার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। সে হকচকিয়ে গিয়েছিল। কমলা আবার হাহাকার করে কাঁদছেন। ওদের সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন রানী বৌ-ই। কাছে এসে পাশে বসে পড়ে বললে, ‘শেষবারের মতো সিঁদুরটা যে আপনারই দেবার কথা মেসোমশাই, ঐটুকু না করলে তিনি, পরলোকে গিয়েও শান্তি পাবেন না। আপনার কাছে এটা তাঁর পাওনা যে। আপনারও তো ঋণ কম নয় তাঁর কাছে!
হঠাৎ শরতের একটা কথা মনে পড়ে যায়। কে যেন কবে বলেছিল, কোন্ দূরশ্রুত, প্রায়-বিস্মৃত কথাটা– এ জীবনে দেবার মধ্যে দিয়েছ তো এই লোহাটা আর সিঁদুরটুকু, তা সেইটুকুও সহ্য হচ্ছে না বুঝি?’…..
‘আমারই সিঁদুরটা দেওয়ার কথা, না মা? তাহলে যাই। আর কি দিতে হয়? লোহা কি দেয় এ সময়ে? না শুধুই সিঁদুর?…. ঠিকই বলেছ মা, অনেক ঋণ আমার, কিছু শোধ করা হল না!’
তারপরই–এই প্রায় দুদিন পরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন, ‘আমারই ভুল হয়েছিল মা– ওর কাছে আসা। আমি না এলে হয়ত এমনভাবে মরত না, এত তাড়াতাড়ি। আমারই নিশ্চয় রাক্ষসগণে জন্ম– আমি যাকে ধরেছি সে-ই মরেছে। আমার কেউ বাঁচে নি, আমার আর কেউ রইল না। আমার জন্যেই সে গেল। কখনও কিছু দিতে পারিনি, অপঘাত মৃত্যুটা দিলুম শেষকালে–’
শ্মশান পর্যন্ত সঙ্গে গিয়েছিলেন শরৎ, দাঁড়িয়েও ছিলেন শেষ পর্যন্ত–কিন্তু মুখাগ্নি করেন নি। অনেক করে বলেছিল হেম আর গোবিন্দ, অভয়পদ নিজে এসে অনুরোধ করেছিল কিন্তু তিনি রাজি হন নি। বলেছিলেন, মুখ-অগ্নি করলেই শ্রাদ্ধ করতে হয়। আমি ওকে পিণ্ডি দেব না। আমার ভাত খেতে ওর বড় আপত্তি ছিল, দিনরাত ও ভগবানকে ডাকত আমার ভাত না খেতে হয়। আমি সে ভাত দেব না। জ্যান্তেই যখন একদিনও ভাত দিলুম না, মরার পর আর দিই কেন। তাছাড়া ব্রাহ্মণের মেয়ের পিণ্ডি ব্রাহ্মণের হাতে পাওয়াই উচিত। আমার আর ব্রাহ্মণত্ব কিছু নেই। আমি– আমি অতি নীচ অন্ন খেয়েছি। হেমই দিক– ওকেই সবচেয়ে ভালবাসত, ও-ই করুক শেষ কাজটা। খরচপত্র সব আমি করব– কিন্তু ওটি বলো না তোমরা!
আগত্যা হেমকেই দিতে হয়েছল মুখাগ্নি। সেইজন্যেই এতদিন আসতে পারে নি। অপঘাত মৃত্যুর ত্রি-রাত্র অশৌচ। একেবারে শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকিয়ে নিয়মভঙ্গ সেরে এসেছে।
‘কোথায় শ্রাদ্ধ হল?’ শ্যামা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘কালীঘাটে গিয়েই সেরে এলুম। আর কোথায় হ্যাঁঙ্গামা করব! অবশ্য জিনিসপত্র মেসোমশাই ভাল ভাল দিয়েছে দানে। বারোটি ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হয়েছে–সেও বেশ পরিতোষ করে।’
‘সেটা কোথায় হল? ঈষৎ যেন সজাগ হয়ে ওঠেন শ্যামা।
‘সে ঐ যে-বাড়িতে মাসী থাকত সেইখানেই। মেসোমশাই বললেন, এতক্কাল ওখানে ছিল, ওখানে কিছু করা দরকার। ব্রাহ্মণ খাওয়ানোই নাকি আসল, সে পুরুতও বললে। তাই ওখানেই করা হল। বাড়িওলারা অনেক করেছে অবশ্য। …. রান্না করলে বড় মাসী আর রানী বৌদি–বামুন রাখতে চেয়েছিলেন মেসোমশাই, ওরা রাজি হল না।’
তা শরৎ জামাই এখন কোথায় রইলেন? ঐ বাড়িতেই?’
‘না না। ওখানে কোথায় থাকবেন! বড়দা ওদের ওখানে এনে রেখেছে। বেশিদিন থাকবেন না তো– প্রেসের খদ্দের খুঁজছেন দালালও লাগিয়েছেন, প্রেস বিক্রি করে দিয়ে কাশী চলে যাবেন। সেখানে কে ওর দূর-সম্পর্কের বোন আছে, তার কাছেও থাকবেন না– তাকে লিখেছেন কম ভাড়ায় একটা ঘর খুজতে–’
‘তা সব জিনিসপত্তর– ‘
হেম একটু অপ্রতিভভাবে হাসল। বলল, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেসোমশাই, যে, তোমরা কিছু নেবে– না সব বেচেকিনে দিয়ে তারই নামে টাকাটা কোথাও দিয়ে দেব–কোন সৎকাজে?
‘তা তুই কি বললি?’ কথাটা শেষ করতে দেন না শ্যামা–তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করে ওঠেন। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই আবার বলেন, ‘যে মুখে আগুন দেবে, তারই তো সব পাওনা!’
‘হ্যাঁ–সব ঐ হাড়পেকের বোঝা কে ঘাড়ে করবে!… আমি বললুম, একেবারে সব বেচে না দিয়ে কিছু কিছু আমাদের কাছে রাখা ভাল–তাঁর স্মৃতি তো।… তা মেসোমশাই ঠিক করেছেন দিদিমার দরুন বাসনের সিন্দুকটা আর মাসীর কাপড়চোপড় সুদ্ধ তোরঙ্গটা আমাদের দেবেন। বড়দাকে দেবেন ঘড়িটা। আর হাতের রুলি দুটো আর দিদিমার দরুন কী সামান্য দু এক কুচি বুঝি আছে–সেগুলো রানী বৌদিকে দিয়ে বাকি সব বেচে দেবেন।’
‘তাহ’লে বড়বোয়েরই জিৎ হ’ল বলো।’
‘তা সে যা বোঝ।’
‘কোন, বাসনকোশন কি আমরা কিছু পেতে পারি না?’
‘সে কিছু কিছু বাড়িওলাদের দিয়ে দিয়েছেন, মাসীর ভাতখাবার থালাটা আর জলখাবার ঘটিটা মেসোমশাই নিজে রাখবেন। বাকি সব কালই বিক্রি হয়ে গেছে। সব টাকা বড়মাসীর কাছে থাকবে– মেসোমশাই বলেছেন, তুমি তো রেলের পাস পাও, একসময় গিয়ে ঐ টাকাতে গয়াটা সেরে এসো। অপঘাতে মরেছে– গয়া না করলে মুক্তি নেই। ঐ-ই নাকি আসল। পিণ্ডি দিয়ে ঐখানেই ব্রাহ্মণ খাইয়ে আসতে বলেছেন!’
শেষের দিকের কথাগুলো আর শ্যামার কানে যায় নি। তিনি ভাবছিলেন অন্য কথা।
সুদূর অতীতে চলে গিয়েছিল তাঁর মন। অনেক, অনেকদিন আগেকার কথা ভাবছিলেন তিনি।
ওঁদের মা রাসমণি তখন প্রায় মৃত্যু-শয্যায়। ওঁদের সকলকে ডেকে মার যা ছিল ক্ষুদকুঁড়ো– সামান্য একটু সোনা ও বাসন কখানা– ভাগ করে নিতে বলেছিলেন। তাঁর সামনে সব আনতে বলেছিলেন– অর্থাৎ তিনি যাকে যা দেবার বলে দেবেন, সেই মতো নেবেন ওঁরা।
সমান ভাগ করারই কথা। রাসমণির সেই রকমই ইচ্ছা আন্দাজ করেছিলেন শ্যামা। কিন্তু উমাকে ওঁদের সমান ভাগ দিতে শ্যামার আপত্তি ছিল। ওর কেউ নেই, ওঁদের ছেলেপুলে আছে– ওঁর মেয়ে আছে, বিয়ে দিতে হবে, জমাই আসবে কুটুম-সাক্ষাৎ আসবে– উমা কেন ওঁদের সঙ্গে চুল-চেরা ভাগ পাবে? ইঙ্গিতে সে কথাটা জানিয়েও ছিলেন মাকে। মা রাগ করেছিলেন তাতে। বলেছিলেন, ওঁদের ছেলেমেয়ে আছে সেইটেই তো বড় কথা, তারা এরপর ওঁদের দেখবে। উমার তো কেউ নেই, ওর কোন একটা ব্যবস্থাও কিছু করে যেতে পারলেন না তিনি ভালমতো– ওরই তো বেশি দরকার এসবের। দরকার হলে এই বেচেই খেতে পারবে তবু দু-চার মাস।
দিয়েছিলেনও তাই। অন্তত শ্যামার যা বিশ্বাস। উমার দিকেই যেন পাল্লাটা একটু বেশি ঝুঁকল। শ্যামার সেটা পছন্দ হয় নি। মনে মনে রাগ করেছিলেন, মার ভীমরতি হয়েছে মনে করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য প্রকাশ্যে সে বিদ্রোহ জানাবার সাহস ছিল না। রাশভারীলোক ছিলেন রাসমণি– তাঁর স্থির শান্ত দৃষ্টির দিকে চাইলেই মুখের কথা মুখে থেকে যেত। শ্যামা অন্য পথে গিয়েছিলেন, কিছু বাসন সরিয়ে রেখেছিলেন সকলের অজ্ঞাতে, বয়ে নিয়ে আসার অজুহাতে। কিন্তু মার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এড়ায় নি সেটা। তখনও পযন্ত আশ্চর্য রকমের স্মরণশক্তি ছিল তাঁর। ওঃ, সে নিয়ে কী অপমানটাই করেছিলেন সেদিন শ্যামাকে।
সেই সব বাসনই আজ তাঁর ঘরে আসছে। কোনটাই উমার ভোগে আসে নি। সবই বুকে করে রেখে দিয়েছিল সে, একটিও খোয়ায় নি। অনেক দুঃখ কষ্ট করেছে তবু প্রাণ ধরে বেচতে পারে নি একটা।
সে-ই আসছে তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি কি খুব একটা আনন্দ বোধ করছেন? খুব একটা বিজয়গর্ব? মজ্জাগত অর্থলোলুপতার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এগুলো সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠেছিলেন বটে– কিন্তু এখন যেন কেমন ভয়-ভয় করছে। উমার কোন কাজে লাগে নি, তাঁরই কি লাগবে? এই তো সবই ফেলে চলে যেতে হল একনিমেষে। কাকে কি দেবার ইচ্ছে ছিল তাও বলে যেতে পারল না। কে জানে তাঁরই বা কখন কিভাবে ডাক আসবে। এই যে সব জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকছেন, তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস, আরও চাইছেন, প্রাণপণ আকাঙ্ক্ষায় সর্বদা যেন দুই-হাত বাড়িয়ে রয়েছেন– এও কি একদিন এমনি বিনা নোটিশে ছেড়ে যেতে হবে! তাঁর এত কষ্টের এত দুঃখের জিনিস সব পাঁচভূতে নষ্ট করবে– তিনি বাধা পর্যন্ত দিতে পারবেন না, নিজের ইচ্ছাটা পর্যন্ত জানাতে পারবেন না।…. ভাবতে ভাবতে যেন শিউরে ওঠেন শ্যামা।…. এসব কি ভাবতে শুরু করলেন তিনি? দুর্বল শরীর বলেই বোধ হয় এইসব ছাইভস্ম কথা মনে আসছে!….
জোর করে মনকে প্রকৃতিস্থ করার চেষ্টা করেন।
এই তো দুনিয়ার নিয়ম– তাই বলে কি সকলে সব বিলিয়ে নাগা-ফকির হয়ে যাচ্ছে? তুমিও যেমন!
কান দেন হেমের দিকে। কী যেন বলছে হেম–?
‘বরাত বটে ছোট মাসীর–মরেও কি শান্তি আছে? শেষ পর্যন্ত পোড়াটাও সুশৃঙ্খলে হল না পুরো দেহটা পোড়ানোই গেল না।’
‘সে আবার কী রে? কি বলছিস?’
‘আর কি বলছি! শয়ে তো চাপানো হল, বেশ জ্বলছে, আমরা একটু এদিকে সরে আছি, কাছাকাছি আছেন বরং মেসোমশাইই–অকস্মাৎ একটা সোরগোল, মেসোমশাইও চিৎকার করে উঠলেন। কী ব্যাপার– না চেয়ে দেখি একটা সন্ন্যিসী-মতো লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে আর তার পিছুপিছু কতকগুলো লোক দৌড়চ্ছে তাকে ধরবার জন্যে। কিছুই বুঝতে পারি না– কী হল জিজ্ঞাসা করতে একজন বললে, আপনাদের চিতা থেকে ঠ্যাং নিয়ে গেল যে মশাই! মেসোমশাই কোথায়? চেয়ে দেখি তিনিও দৌড়েছিলেন, শ্মশানের বাইরেটায় এসে বুক চেপে বসে পড়ে হাঁপাচ্ছেন। একে ওর হাঁপানির ব্যায়রাম তায় বুড়ো মানুষ, পারবেন কেন? তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম– ঐ লোকটা আস্তে আস্তে এসে একটা কাঠ দিয়ে মাসীর একটা ঝলসানো পা টেনে বার করে সেই আগ-জ্বলন্ত পা-টা নিয়েই দৌড় দিয়েছে–’
‘সে কি রে? কে সে? করবেই বা কি ওটা দিয়ে?’
ভয়ে শিউরে ওঠেন তিনি। কনকও পিছনে বসে শুনছিল, সে ছেলেকে বুকে চেপে ধরে কাঠ হয়ে যায় একেবারে।
‘কী করবে জানো? সে তোমরা চোখে দেখলেও বিশ্বাস করতে না।… খাবে, খাবে। খাবার জন্যেই নিয়ে যাচ্ছিল।’
ধ্যৈৎ! খাবে কি? ওসব গল্প-কথা রামায়ণে লেখা আছে। এখনকার দিনে বুঝি রাক্ষস আছে–’
‘রাক্ষস কেন হবে– সন্ন্যিসী। একজন গঙ্গাপুত্তুর আমাদের বললে, ওদের বলে অঘোরপন্থী সন্ন্যিসী– কোন ঘোর থাকে না, আপন মনেই থাকে, যখন হুঁস হয় খিদে পেয়েছে– তখন সামনে যা পায় তাই খায়। একবার অনেকদিন আগে নাকি এমনি এক অঘোরপন্থী জ্যান্ত গোরো সাপ ধরে খেতে শুরু করেছিল–তাও ধরেছিল ল্যাজের দিক থেকে, সেও ছোবল দিয়েছে তিন-চারটে পরের দিন দেখা গেল দুটোই মরে পড়ে আছে!
‘বলিস কি– পিশাচ বল!’
‘তবে আর বলিছ কি! এ লোকটা নাকি কদিন ধরেই ওখানে আছে। শ্মশানের বাইরে একটা গাছতলায় বসে থাকে থুম হয়ে– তা সন্ন্যিসী তো অমন কতই থাকে শ্মশানের ধারে, বিশেষত নিমতলায় তো লেগেই আছে– কেউ তাই অত গ্রাহ্য করে নি। পরে শোনা গেল এ লোকটা দিনকতক খড়দা না পেনেটি কোথায় গঙ্গার ঘাটে বসেছিল অমনি। কেউই তত লক্ষ করে নি,–হঠাৎ একদিন মার সঙ্গে একটা চারপাঁচ বছরের ছেলে যাচ্ছিল গঙ্গা নাইতে, তাকে ধরে হাতটা কামড়ে এতখানি মাংস তুলে নিয়েছে একেবারে। তারা সব ধরে খুব গোবেড়েন মার দিয়েছে–তাইতেই পালিয়ে এখানে এসেছে!’
এতক্ষণে কনক কথা বলে। শাশুড়ী স্বামী একত্রে থাকলে আগে সে কথাই কইত না, এঁরা পছন্দ করেন না বলে– এখন দু-চারটে কথা বলে, যদিচ খুব জরুরি অবস্থায় না পড়লে সোজাসুজি স্বামীর সঙ্গে বলে না, শাশুড়ীকে উপলক্ষ করে বলে। আজও তাই বলল, ‘তা যার হুশ নেই, খিদে পেলে যা সামনে পাবে তাই খাবে– সে তো গু-গোবর ও খেতে পারে। বেছে বেছে মাংসটি খাবে, তা আবার মানুষের মাংস– চুপিচুপি এসে চিতা থেকে ঝলসানো মাংস নিয়ে পালাবে এ আবার কেমন অঘোর–হ্যাঁ মা?’
তুমি রেখে ব’সো দিকি বৌমা? ও বজ্জাতী, বেজ্জাতী। সন্ন্যিসী না হাতী– ধরে গরম সাঁড়াশি দিয়ে ঐ জিভ টেনে বার করলে তবে ও নোলা জব্দ হয়।’
তারপর মনে পড়ে গেল আসল কথাটা—’তা হ্যাঁরে, শেষ অবধি কি হল তারপর? পাওয়া গেল?’
‘পাওয়া গেল–কিন্তু পুরোটা নয়। তখন দু-তিন কামড় খেয়ে ফেলেছে। বেগতিক দেখে বেশ খানিকটা কামড়ে তুলে নিয়ে বাকিটা গঙ্গার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে পালাল। আবার একজন গঙ্গাপুত্তুর গিয়ে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আসে– ‘
কনকের ছেলে কেঁদে উঠতে সে তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল। তার নিজেরও যেন হঠাৎ নতুন করে চোখে জল এসে গেল আবার। খুব বেশি দেখে নি সে ছোট মাসীমাকে কিন্তু তার সব কথাই শুনেছে সে। কী বরাত নিয়েই এসে ছিল মানুষটা, এমন ভাগ্য যেন অতিবড় শত্রুরও না হয়। জীবনের একটা দিনও মানুষ অন্তত সুখী হয়– এঁর অদৃষ্টে ও জিনিসটা যেন দিতেই ভুলে গিয়েছিলেন বিধাতা।… সারা জীবনটাই তো দগ্ধে গেলেন, আবার মরেও শান্তি পেলেন না। মরণটা এল–তাও একটা ভয়ানক কাণ্ড করে মরার পরে পুরো দেহটা পর্যন্ত দাহ করা গেল না। এমন কখনও শোনে নি কনক, আর কারও মুখে শুনলে বিশ্বাস করত না।… লোকে বলে গতজন্মের পাপে নাকি এ জন্মে দুঃখ পায়। সারা গতজন্ম ধরেই কি পাপ করে এসেছিলেন উনি?–যাকে বলে নির্জনে বসে আপন মনে পাপ করেছিলেন, বাধা দেবার কেউ ছিল না? তাই মরার পরেও সে পাপ ধাওয়া করল?….
কে জানে এ-জন্মেই শেষ হল কিনা। আর যেন সে পাপের ফল পরজন্ম পর্যন্ত না জের টানে। এ-জন্মে তো কোন পাপ করেন নি, সতীসাধ্বী — সাধ্য মতো পরের ভালই করে গেছেন; আসছে জন্মে যেন সুখী হন্, স্বামীপুত্র নিয়ে যেন মনের শান্তিতে ঘর করতে পারেন– হে ভগবান!
মনে মনে উদ্দেশে প্রণাম করে সে ভগবানকে।
বাইরে প্রথম অপরাহ্নের সোনালী আলো গাছপালার পত্রপল্লবে ঝলমল করছে- জানালার বাইরে সজনে গাছের পাতাগুলো খেলা করছে সে আলোতে–একটা সিরসির শব্দ হচ্ছে তার। মৃদু বাতাসে পুকুরের কাকচক্ষু জলে অতি সামান্য লহর উঠেছে– অদ্ভুত দেখাচ্ছে জলটা। ঠিক লহর বললেও ভুল বলা হবে– যেন পুলক-শিহরণ। সে শিহরণ শুধু পুকুরের জলেই সীমাবদ্ধ নেই, জলের ধারে শুধুনিকলমী দলেও তা বিচিত্র আলোড়ন জাগিয়েছে। শান্তি, শান্তি। চারিদিকেই অপূর্ব শান্তি একটা। কোলে তার আধোঘুমন্ত দেবশিশুর মতো ছেলে, স্তন্য পান করতে করতে চোখ দুটো বুজে আসছে ওর– এখনও যেটুকু খোলা আছে, সেই অর্ধনিমীলিত-অক্ষিপল্লবের ভেতরকার ঢুলুঢুলু দৃষ্টিতে অপরিসীম তৃপ্তি ও মার প্রতি নির্ভরতা। এ সময় বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না যে কোথাও কোন দুঃখ, কোন অশান্তি আছে। কনকেরও যেন নিজের মনেই একটা আশ্বাস জাগে।… সুখী হবে, নিশ্চয় সুখী হবে এ জন্মে মাসীমা। আর এমন করে দুঃখ পাবে না।
ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে চাপড়াতে চাপড়াতে হঠাৎ মনে হল, ‘আচ্ছা যদি আমার কাছেই আসে আবার!… মাগো, তা আসবে নাকি? অতবড় মানুষটা আবার এতটুকু হয়ে আমার কোলে শুয়ে দুধ খাবে?’
পরক্ষণেই বিষম লজ্জা করতে লাগল তার– কথাটা কল্পনা করার জন্যে। আচ্ছা কাণ্ড বটে! যত কি বিদঘুঁটে কথা তার মাথাতে আসে!
।।২।।
বাইরে তত প্রকাশ না পাক– উমার মৃত্যুতে একটা বড় রকমেরই আঘাত পেয়েছিলেন শ্যামা। সংবাদটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তত বোঝা যায় নি; এতই আকস্মিক যে সংবাদের সম্পূর্ণ অভিঘাতটা তখন উপলব্ধি করতে পারেন নি। সেটা ক্রমে ক্রমে একটু একটু করে করলেন। শূন্যতাটা সম্বন্ধে সচেতন হ’তে অনেকখানি সময় লাগল তাঁর। দীর্ঘজীবনের পৃষ্ঠপটে স্মৃতির রেখায় আঁকা যে ছবিটা অল্পে অল্পে স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর মনের পর্দায়– তার মধ্যে উমা অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে। সেই উমা তাঁর জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল, সেই উমা আর নেই– আর কোনদিন তার দেখা পাবেন না, আর কোনদিন তার কাছে ছুটে যেতে পারবেন না দুঃখ জানাতে, তার কাছ থেকে কোন কিছু আর আশা করারও রইল না– দ্বেষ-রোষ-কলহ-ঈর্ষা– সমস্ত রকম মানবিক ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল সে–এই নির্মম সত্যটা অতি ধীরে ধীরে অনুভূত হতে লাগল তাঁর। আর যেমন সেটা একটু অনুভব করতে পারলেন, অমনি যেন হাঁফিয়ে ছটফট করে উঠলেন এই ভয়ঙ্কর শূন্যতা থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য। এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না কথাটা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। বিস্ময়ও বোধ হয়। সেটা বোধহয় অন্য কারণে। উমা যে এতখানি জড়িয়ে ছিল তাঁর জীবনের সঙ্গে–আজও, এটাও একটা নূতন উপলব্ধি। সেই জন্যেই বিস্ময়।
কিন্তু এ আঘাত সামলাবার মতো সাতটা দিনও সময় পেলেন না শ্যামা। এ আঘাতে দুঃখ ছিল, সেই সঙ্গে স্মৃতি-রোমন্থনের একটা অভিনবতাও ছিল। এবার যে আঘাত এল তা শুধুই তিক্ততা এবং মর্মান্তিকতা নিয়ে এল– তার মধ্যে কোথাও কোন আশ্রয় কি অবকাশ রইল না।
কদিন এইসব হ্যাঁঙ্গামে হারানের খবর কেউ বিশেষ নিতে পারে নি। কান্তির ওখানে থাকার কথা ছিল কিন্তু সেও থাকতে পারে নি মার অসুখের জন্যে। তবু মধ্যে মধ্যে গিয়ে সে-ই খবর নিয়ে আসত। ভালই ছিল হারান। কথাও দুটো একটা কইতে পারছিল ইদানীং জড়িয়ে জড়িয়ে– কেউ কিছু বললে বুঝতেও পারছিল। উমা তার এখানে আসার জন্য ফল কিনে ফিরছিলেন– গাড়ি চাপা পড়েছেন শুনে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। এইসব দেখে সবাই আশা করেছিল যে এ-যাত্রা বেঁচে উঠবে। হেম এর মধ্যে একদিন রাত্রে ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করেছিল। তিনিও বলেছিলেন, ‘বোধহয় এ ধাক্কাটা সামলে গেল। এখন কথাটা যদি ঠিকমতো ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে ধীরে ধীরে হাত- পাও ফিরে পাবে। তবে সময় লাগবে। আর খুব সাবধানে থাকতে হবে এখন দীর্ঘকাল। কোন রকম উত্তেজনা কি দৌড়ঝাঁপ চলবে না।’
অকস্মাৎ খবর এল একেবারে সব শেষ হয়ে গেছে।
সেদিন রবিবার, খোকাকে সঙ্গে নিয়ে উমার দরুন মালপত্র আনতে গিয়েছিল। শরতের ছাপাখানা বিক্রি হয়ে গেছে, এধারেও সব গুছিয়ে এনেছেন তিনি, কাশী চলে যাবেন দু’একদিনের মধ্যে– মাল সরানো দরকার। ঠেলাগাড়ির ওপর সিন্দুক আর তোরঙ্গ চাপিয়ে পাথরের ভারি বাসনগুলো পুঁটুলি বেঁধে হাতে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ঢুকছে হেম, তরুদের পাড়ার একটি ছেলে এসে খবর দিলে।
শ্যামা আছড়ে পড়লেন কিনা সেদিকে আর তাকায় নি হেম। কনক আছে– যা হয় করবে। খোকাও থাক– এইমাত্র এই চার-পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হেঁটে এসেছে, ছেলেমানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নিশ্চয়– কান্তিকে মহাশ্বেতাদের বাড়ি পাঠিয়ে হেম একাই ছুটল সেখানে।
তখন অবশ্য কিছুই জানা যায় নি। এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণ কি, বা শেষ উপসর্গ কি হল– সেটা জানা গেল অনেক পরে। তরুর মুখ থেকেও সব জানা যেত না– কারণ প্রথমত সে ঠিক সেই সময়টায় ছিল না– দ্বিতীয়ত তার তখন একটা স্তম্ভিত অবস্থা। বললেন, ওদের পাশের বাড়ির দত্তগিন্নী। তরুর কথাও তিনিই বললেন। সেই সময়টা– অর্থাৎ যখন ঠিক প্রাণটা বেরিয়ে গেল–নাকি একটা বুকফাটা চিৎকার ক’রে উঠেই ফিট হয়ে যায় ওর। তখন কে কাকে দেখে কী ব্যবস্থা করে, কোথায় লোকজন, পাড়ার ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া– একটা আতান্তর অবস্থা, তবু তারই মধ্যে ওরা মুখে মাথায় জল দিয়ে বাতাস করে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছেন বটে কিন্তু তার পর থেকেই ঐ অবস্থা। চুপ করে বসে আছে–ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে। কথাও কইছে না কাঁদছেও না। অনেক প্রশ্ন করলে একটা আধটা জবাব দিচ্ছে। এ অবস্থা হেম জানে, আগেও একবার হয়েছিল। ওকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা এ অবস্থায় বৃথা। সে চেষ্টাও সে করে নি।
হারানের খবরটাও দত্তগিন্নীর কাছে শোনা গেল। তিনি তরুকে ভালবাসেন তাই বড়বৌ পছন্দ করেন না জেনেও না এসে থাকতে পারেন না। মধ্যে মধ্যেই আসেন, বিশেষত দুপুরের দিকটা তিনি এসে বসলে তরু অনেকটা কাজ পায়।
সেদিনও খাওয়া-দাওয়া সেরেই একটা পান মুখে দিয়ে এসে বসেছিলেন। তরু গিয়েছিল এক বালতি ক্ষারসিদ্ধ নিয়ে পুকুরে কাঁচতে। ইত্যবসরে হারানের শ্বশুর এসে ঘরে ঢুকেছিলেন।
হারানকে ওর শ্বশুরের কীর্তি-কলাপ কেউ বলে নি। অসুস্থ অবস্থা, ডাক্তারে পই- পই করে বলে দিয়েছ যে রাগ হয় কি উত্তেজনা হয় এখন কোন কথা না ওর কানে যায়। আজকাল বুঝতে পারছে যখন সব কথা, তখন বুঝে সমঝে চলতে হবে। ওঁরাও সাবধান ছিলেন সকলে। কিন্তু হারান বোধহয় এদের কথাবার্তার মধ্যে বা এদের আচারে-আচরণে কিছু আঁচ করে থাকবে। আরও কথা যে টাকাকড়ির ব্যাপারটা একেবারে গোপন করা যায় নি। দত্তগিন্নীর এক ছেলেই বাজার-হাট করে দিত, সে এসে একদিন টাকা চাইতে তরুর মুখটা একটু বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। সেই দেখে হারান উঁ-উঁ শব্দ করে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আলমারীটার দিকে বার-বার চায়। অর্থাৎ আলমারী খুলে টাকা বার করে দিতে বলে। তরু কিছু বলে নি কিন্তু আলমারীও খুলতে পারে নি ওর সামনে। কী একটা বাজে কথা বলে দত্তগিন্নীর ছেলেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বাইরে। সম্ভবত সে বাজে কথায় হারান ভোলে নি, সেই সময়েই বুঝতে পেরেছিল খানিকটা। বোধহয় তরুর মুখের চেহারা দেখেই আঁচ করেছিল। কারণ ও বেরিয়ে চলে যাবার পরই অব্যক্ত কতকগুলো শব্দ করে খুব অস্থির হয়ে ঘন ঘন মাথা চালতে শুরু করে। সেদিনও ঠিক সেই সময়টাতেই দত্তগিন্নী এসে পড়েছিলেন, তিনিই বকে ধমকে ভুলিয়ে ওকে শান্ত করেছিলেন।
কিন্তু ঠিক অতটা যে বুঝেছিল তা কেউ ভাবে নি। তাছাড়া ওর শ্বশুর অনেক দিন আসেন নি, হঠাৎ এসে ঘরে ঢুকবেন তাও কেউ জানত না। আগে দেখতে পেয়েছিল হারানই, দত্তগিন্নী দরজার দিকে পিছন ফিরে বসেছিলেন, তিনি দেখলেও ফিরিয়ে দিতে পারতেন আগেই। শ্বশুরকে দেখেই হারান বিষম উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আর সেই উত্তেজনারই ফলে প্রাণপণ চেষ্টায় বাক্শক্তি ফিরে পায়। চিৎকার করে ওঠে, ‘নিকাল যাও, আভি নিকাল যাও হামারা বাড়িসে–শুয়ার কাঁহাকা! গেট আউট!’
দত্তগিন্নী ওকে থামাবার কি ওর শ্বশুরকে ঘর থেকে বার ক’রে দেবার কোন চেষ্টা করবার আগেই যা ঘটবার তা ঘটে গেল। কথা বলতে বলতে মাথাটা একটু উঁচু করেছিল, হঠাৎ ধপ্ করে পড়ে গেল। গলার কাছে কী একটা ঘড়ঘড় শব্দ হ’ল–প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাক দিয়ে ও মুখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল। তারপরই সব স্থির হয়ে গেল। ডাক্তার অবশ্য ওর শ্বশুরই ছুটে ডাকতে গিয়েছিলেন, দত্তগিন্নীর চিৎকারে পাড়ার লোকজনও জড়ো হয়েছিল, তাদের কে একজন দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারকেও ডেকে আনলে কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। ডাক্তার দেখে বললে, ঐসময়ই প্রাণ বেরিয়ে গেছে।…
তরুকে এবার পাকাপাকিভাবেই এ বাড়িতে এনে তুলতে হল। ওখানে থাকার উপায় নেই। কার কাছে থাকবে এবং কিসের ওপর নির্ভর করে থাকবে। জমিজমা যা আছে তা নিজেরা তদ্বির করলে কিছু আয় হয়–নইলে কিছুই না। লোকও নেই কেউ। ওর সতীনকে তার বাবা এসে পরের দিনই নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘাট করাবার জন্যও এখানে আনেন নি। শ্রাদ্ধ করল তরুই–ছেলে নিতান্তই ছোট, শ্রাদ্ধ করবার মতো নয়। তরু এখনও সেইরকম জড়ভরত হয়ে আছে–পাশে বসে জোর করে করাতে হ’ল হেমকে। বস্তুত হেমই করল কাজটা। তরু বোধহয় ভাল করে কিছু বুঝতেও পারল না–কী হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে। তার কত বড় সর্বনাশটা হয়ে গেল তাও মাথায় পুরো ঢুকেছে বলে মনে হল না।
শ্রাদ্ধের আগেই একদিন লোকজন এনে ওর সতীনের বাবা জিনিস-পত্র অর্ধেক বার করে নিয়ে গেছেন। অর্ধেক অবশ্য তাঁর মতে, পাড়ার লোকের মতে বেশিই নিয়ে চলে গেছেন তিনি। হঠাৎ এসেছেন, তরু তো অমনি চুপ, কান্তি ছিল বটে, সে একা কি করবে ভেবে না পেয়ে মহাদের বাড়ি ছুটেছিল খবর দিতে–কিন্তু যাওয়া আসায় সাড়ে তিন ক্রোশ পথ, মহার ছেলেরা আসতে আসতে সব কাজ সেরে চলে গেছেন তাঁরা। অভয়পদদের তখন বাড়ি থাকার সময় নয়, আর থাকলেও তাঁরা ছেলেদের আগে আসতে পারতেন না।
শোনা গেল দুই গোরুর গাড়ি বোঝাই মাল নিয়ে গেছেন ওঁরা। আলমারী, বাক্স–বহু জিনিস। সবই নিয়ে যেতেন বোধহয়, দত্তগিন্নীর আর আশপাশের বাড়ি থেকে আরও দু- চারজন মহিলা এসে খুব রাগারাগি চেঁচামেচি করায় বাসনকোশন কিছু কিছু রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
পাড়ার লোকেরা পরামর্শ দিলেন, ‘কেস করো। আমরা সাক্ষী দেব। জেল হয়ে যাবে ও শালার। যেমনকে তেমনি। চশমখোর শয়তান!
দত্তবাবু বললেন, ‘আমার হাতে ভাল উকিল আছে, তুলো ধুনে ছেড়ে দেবে বাছাধনকে। ওর মালে হাত দেবার অধিকার কি? তাছাড়া টাকা ছিল অনেক, আমরা জানি। সে টাকা কি করলে হিসেবে দিক! টাকা ঐ ছেলের, নাবালকের টাকা–চালাকি নাকি?’
কিন্তু অভয়পদ বারণ করলে, ‘ও কাজ ক’রো না। অগাধ জলে গিয়ে পড়বে। আলমারী সিন্দুকে যে টাকা ছিল তা প্রমাণ করতে পারবে না। ওসব সাক্ষীর কোন দাম নেই, ওরা উড়ো উড়ো জানত যে বুড়ির হাতে টাকা ছিল, সঠিক কেউ বলতে পারবে না। দু-তিনজন একরকম না বললে কিছুই টিকবে না। থাকলেও ওরাই যে নিয়েছে–সে কে দেখেছে? এক অফিসের ঐ টাকাটা নিয়ে এসেছে প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু সে এমন কিছু নয় যে তার জন্যে কেস করা পোষাবে! একটা যা হয় খরচের হিসেব তো দেবেই, আর সত্যি কিছু খরচ হয়েছেও, জামানো টাকার কথাটা প্রমাণ না হ’লে এ থেকে বিশেষ কিছু আদায় করা যাবে না। যেটুকু আদালত দেবে তাতে এত কাণ্ড করার মজুরি পোষাবে না। এক জিনিসপত্তর–তা তারই বা কত দাম, দাম ঠিক করবে কে? তাছাড়া তারও মেয়ে আছে, কিছু তো পাওনা হয়ই। গেরস্তালির জিনিস আটকানো যায়ও না বোধহয়। অর্ধেকের বেশি নিয়েছে তাই বা প্রমাণ করা যাবে কি করে?…আমার তো মনে হয় জমিজায়গাতেও বোধহয় টান দিতে পারে ওরা।… যাইহোক, সে পরের কথা, পরে দেখা যাবে, জমি কিছু উঠিয়ে নিয়ে পকেটে পোরা যায় না–এখন এসব নিয়ে কেস করতে গিয়ে লাভ নেই। ও আশা ছেড়ে দাও।’
হেম তা জানে। তাদের মতো লোকের কোন আশাই রাখতে নেই। আর এসব করবেই বা কে, পুঁজি কৈ? তদ্বির আর টাকার অভাবেই তো রতনের অতবড় সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে গেল, মামলার ঝুঁকি নিতে ভরসা হ’ল না। তার তো তবু কিছু সাক্ষীসাবুদ ছিল।….
অফিসেও গণ্ডগোল কম নয়। মাইনের টাকা ছাড়াও হারানের শ্বশুর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা খানিকটা বার করে এনেছে। সেটা বে-আইনী। কিন্তু আইনের প্রশ্ন তুলতে গেলে ওর সেকশ্যানের তিনজন বাবু বিপদে পড়েন। তাঁরা সরল বিশ্বাসে হারানের চিকিৎসা আটকে গেছে শুনে জামিন হয়ে টাকাটা বার করে দিয়েছেন। শুধু শুধু তাঁদের বিপন্ন করে লাভ নেই।
এই টাকাটা তোলার ফলেও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা খুব কমার কথা নয়। কিন্তু দেখা গেল কিছুদিন আগে হারান নিজেই বেশ খানিকটা টাকা ধার নিয়েছিল। তার সইসাবুদ সব ঠিক ঠিক মিলে গেছে, সে নিজেই নিয়েছে তাতে কোন ভুল নেই। কী করল এ টাকাটা নিয়ে তা কেউ বলতে পারল না। ওর সেকশ্যানের একটি বাবু বললেন, ‘একবার আমায় বলেছিল কোন্ বন্ধুর বোনের বিয়ে হচ্ছে না, কিছু টাকা ধার দেবে। তা আমি তো পই পই করে বারণ করেছিলুম, তখন আমার সামনে বলেছিল–তা তুমি যখন বারণ করছ প্রকাশদা, তখন আর দেব না। কিন্তু তারপর বোধহয় মুখ এড়াতে পারে নি–লুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কে বন্ধু তা তো বলে নি। এর মধ্যে আমাদের আপিসে তিনজনের বোনের বে হয়েছে, হয়ত ওর পাড়া-ঘরেও কাউকে দিয়ে থাকতে পারে–ক্লাবের বন্ধুও তো বেস্তর, তিনটে ক্লাবে থিয়েটার করত ও–কাকে ধরব বলুন?’
এসব বাদ দিয়ে বাকি যা–তাও সবটা পেল না তরু।
সাহেবরা বললেন, ‘তাহলে আদালত থেকে সাক্সেশ্যন্ সার্টিফিকেট দিতে হবে। নইলে যেখানে দুই স্ত্রী বর্তমান এবং প্রথম স্ত্রী ইতিমধ্যেই নোটিশ নিয়ে এর অর্ধেক দাবি করেছেন–সেখানে আমরা ওকে সব টাকাটা তো দিতে পারি না।’
ঐ টাকার জন্য সাকসেশ্যন সার্টিফিকেটই বা নেয় কে! ওরা হয়ত সেখানেও আপত্তি করবে, সেও দীর্ঘকাল কোর্টঘর করতে হবে। হারানের প্রথম পক্ষের শ্বশুর নাকি বিখ্যাত মামলাবাজ, তার পয়সাও আছে সময়ও আছে–তার সঙ্গে হেম পেরে উঠবে কেন? অতএব বিনা মামলায় যে অর্ধেক টাকা পাওয়া গেল তাই নিয়ে এল হেম।
টাকাটা নেবার সময় হেমের সঙ্গে তরুকে যেতে হয়েছিল। মূর্তিমতী বিষাদের মতো নির্বাক স্তম্ভিত তরুকে দেখে ওর অল্পবয়সের কথা চিন্তা করে সাহেবরা খুবই দুঃখ প্রকাশ করলেন–নিজেরা পকেট থেকে যে যা পারলেন দিয়ে আরও শ আড়াই টাকা করে দিলেন–কিন্তু তা মিলিয়েও দু হাজার টাকা পুরো হল না।
ঐ সামান্য টাকা, কিছু বাসনকোশন, একটা সিন্দুক এবং কিছু কাপড়জামা ও গোটা দুই পুরনো তোরঙ্গ নিয়ে এক মেঘমেদুর অপরাহ্নে তরু আবারও বাপের বাড়ি এসে উঠল–দীর্ঘকাল হয়ত বা চিরকালের জন্যই। ঐ একরত্তি গুঁড়োটুকু যদি মানুষ হয়ে উঠে কোন দিন আবার সংসার পাততে পারে, তবেই আবার স্বাধীন হবে তরু–না হলে আর কোন আশা আর ওর জীবনে রইল না কোথাও।
ওকে দেখে শ্যাম ও কনক হাহাকার ক’রে কেঁদে উঠলেন কিন্তু তরু কাঁদল না, কাঁদতে পারল না–শান্তভাবে এসে রান্নাঘরের দাওয়াটায় বসে পড়ল। তার শূন্য উদাস দৃষ্টির দিকে চেয়ে কনকের যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এইরকমই হয়ে থাকবে নাকি?
আবার মনে হল–না, ছেলে যখন আছে তখন ওকে অবলম্বন করেই আবার বুক বাঁধতে পারবে, শক্ত হয়ে দাঁড়াবে আবার।…
।।৩।।
এবার তরু আসার কয়েকদিন পরেই কোথা থেকে ঐন্দ্রিলা এসে হাজির হ’ল। কেন এল কদিনের জন্য এল, তা কেউ জিজ্ঞাসা করল না তাকে, সেও বলল না। তবে সঙ্গে কাপড়-চোপড়ের পুঁটুলিটা দেখে মনে হল হয়ত যেখানে কাজ করছিল এতদিন, সেখানকার কাজ ছেড়েই চলে এসেছে।
অর্থাৎ বেশ কিছুকাল স্থিতি এবার।
ওকে দেখেই যৎপরোনাস্তি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন এঁরা কিন্তু এবার আর সে তরুর দুর্ভাগ্যে সে রকম উল্লাস প্রকাশ করল না, বরং দু’ফোঁটা চোখের জলই ফেলল। তবে এও বলল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ‘তাও তো তুই জিতে গেলি রে!… হাজার হোক তোর তো ছেলে, কোনমতে যদি বেঁচে থাকে বড় হয়ে মোট বয়েও খাওয়াবে। একদিন স্বাধীনভাবে বেটার সংসারে বসে খেতে পারবি। …আমার মতো মেয়ে নিয়ে তো জ্বলেপুড়ে মরতে হবে না। এই পরের বাড়ি হাঁড়ি-হেঁসেলের সঙ্গে যুদ্ধ করে যা ঐ পাঠাচ্ছি, তাই মেয়ে খেতে পাচ্ছে। খুব বিয়ে হ’ল মেয়ের! জামাইয়ের ছেলেরা তো দয়া করে দুটি চাল ফেলে দেয় ভিক্ষের মতো। তাও বলে, বাপকে খাওয়াতে পারি–তার মেয়েমানুষকে খাওয়াতে যাব কিসের জন্যে? নতুন মা কে ছোট মা বলে না–বলে বাপের মেয়েমানুষ!’
এ খবরটা এদের জানা ছিল না। তাই যদি হয় তো কাজ ছেড়ে দিয়ে এল কিসের ভরসায় তাও বুঝতে পারে না। অবশেষে কনকই কথাটা বার করলে। অথবা ঐন্দ্রিলাই বলবার সুযোগ খুঁজছিল, বলতে পেয়ে বেঁচে গেল সে। কারণ, তারও না বললে নয়। ও পক্ষ থেকে কৌতূহল প্রকাশ পাওয়াতে তার সুবিধাই হ’ল।
আর, সে জানে এ বাড়ির মধ্যে একমাত্র কনকই যা সহানুভূতির সঙ্গে শুনবে সব কথা। মা কি দাদাকে বলতে গেলে হয়ত সূচনাতেই থামিয়ে দেবে বরং কনকই তাদের শোনাতে পারবে। কনকের দ্বারা তার উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হতে পারে।
কাজ ঐন্দ্রিলা ছেড়ে আসে নি, তারাই ছাড়িয়ে দিয়েছে।
মেয়েকে টাকা পাঠাতে হয় নিয়মিত। কিন্তু কীই বা পাঠাতে পারে সে। পায়ই তো খাওয়া-পরা আর মোটে আটটি টাকা মাইনে। আট টাকাই পাঠাত সে, নিজের জন্যে এক পয়সাও না রেখে–কিন্তু তাতেও সীতার কুলোয় না। শুধু ধান ছাড়া সতাতো ছেলেরা কিছু দেবে না, ধান ভেনে চাল ক’রে নিতে হয় সীতাকে। ঐ চাল আর বাগানে যা আনাজ- পাতি হয়–এই ভরসা। তাও দেয় ভিক্ষের মতো, নিজে থেকে নিতে গেলে যাচ্ছে তাই অপমান করে। বলে, ‘এ কী তোর বাপের সম্পত্তি পেয়েছিস?’ বুড়ো কিছু বলতে সাহস পায় না–ছেলেরা গুণ্ডার মতো রাগী, বদমেজাজী–তারা বাপের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, মামলা-মোকদ্দমা করতে গেলে প্রাণে বাঁচবে না। ওরা ‘গুম-খুন’ করে ফেলবে। বুড়োমানুষ প্রাণের ভয়ে যেন জন্তুর মতো হয়ে গেছে–সব অপমান নিঃশব্দে হজম করে।… এর ভেতর গত শীতের সময় সীতা চিঠি লিখল যে, গায়ে দেবার লেপ কুটি কুটি হয়ে গেছে, পরনে একটা গোটা কাপড় পর্যন্ত নেই; শীতে বিষম কষ্ট পাচ্ছে। ছেলেদের বলতে দুখানা পুরনো কাঁথা বার করে দিয়েছে, তাতে শীত ভাঙ্গে না। আরও, সীতার মা টাকা পাঠায় একথা তারা টের পেয়েছে–সেই জন্যে এখন কিছুই দিতে চায় না। ওদের ধারণা মোটামুটি কিছু পাঠায়। দোষ এদেরই–সীতা পাড়ার একটি ভদ্রলোকের ঠিকানা দিয়েছিল, ঐন্দ্রিলা সেখানেই টাকা পাঠাত মনিঅর্ডার ক’রে, তিনি নিয়ে ওকে দিতেন। তাইতেই কত পাঠায় তা তারা জানতে পারে নি–পাঠায় এটা জেনেছে। না জানিয়ে উপায়ও নেই তো, এক বাড়িতে থাকা, খরচ করলেই ধরা পড়বে যে কোথাও থেকে টাকা আসছে। এখন বাড়িতেই পাঠায় অবশ্য, তাও তারা বিশ্বাস করে না–ভাবে যে ওখানে লুকিয়ে আরও কিছু আসে। এখন কিছু চাইতে গেলে বলে, বড়লোক মা মোট-মোট টাকা পাঠাচ্ছে, সেটা জমিয়ে আমাদের কাছে ভাগের ভাগ চাইতে এসেছ বুঝি? ও-সব হবে-টবে না, ঐ টাকা ভাঙ্গিয়ে খরচ করগে!……
সীতার ঐ চিঠি পেয়ে ঐন্দ্রিলার মাথা খারাপ হয়ে গেল। একবার ভাবল এখানে এসে এদের কাছ থেকে কিছু চায়। কিন্তু মা কিছু দেবে না তা সে জানত। এক দিলে দিতে পারে দিদি–তা সে হয়ত বড়জোর দশটা টাকা দেবে–ওর যাওয়া-আসায় গাড়ি-ভাড়াই পড়ে যাবে ছ’টাকার ওপর–লাভ কী হবে?
অকুল-পাথার ভাবনা–কাউকে জানাবার কি পরামর্শ করবার লোক নেই। বাবুরা আগাম দিতে পারে–কিন্তু তাতে মাসের টাকা পাঠাতে পারবে না। কোন লোক না পেয়ে সে ওদের ঝি-স্থানীয় একটি মেয়ে একাদশীকে মনের কথা জানিয়েছিল, পরামর্শ চেয়েছিল তার কাছে। একাদশী বোধ হয় এই সুযোগই খুঁজছিল বহুদিন থেকে–ঐন্দ্রিলার চাল-চলন দেখে কিছু বলতে সাহস করে নি। সে বললে, ‘তেল-ঘি-চাল-ডাল সবই তো তোমার হাতে, কিছু কিছু সরাও, আমি লুকিয়ে বেচে দেব।’ প্রথমটা খুব আপত্তি করেছিল ঐন্দ্রিলা। কিন্তু একাদশী বোঝাল যে, এতে কোন দোষ নেই, সবাই তাই করে। তাছাড়া ব্রাহ্মণের মেয়ে দু-বেলা আগুন-তাতে মুখের রক্ত তুলে মরছে–তাকে ঐ আটটি টাকা দেওয়া এদের মানুষের মতো কাজ হচ্ছে? এদের কি টাকার অভাব আছে কিছু? যেমন-কে-তেমনি-জব্দ করা উচিত চুরি করেই।
ক্রমশ ঐন্দ্রিলাও বুঝল, গরজ বড় বালাই। না বুঝে তখন আর উপায় ছিল না। অন্তত কোন উপায় সে দেখতে পায় নি।
ঐন্দ্রিলা কিছু কিছু সরাতে শুরু করতেই একাদশী আগাম দশটা টাকা এনে দিল কোথা থেকে। সে হাত বাড়িয়ে স্বর্গ পেল। কিন্তু তারপরই ভুল বুঝতে পারল। একাদশীর চাপ বড় বেশি, তার খাই আর মেটে না। সে চায় ঐন্দ্রিলা পুকুর চুরি করুক। ঐন্দ্রিলার অত সাহস হত না। তা ছাড়া, সে বুঝেছিল যে এর বেশির ভাগই–টাকায় বারো আনা–উঠছে একাদশীর ঘরে। শেষে একাদশী ওকে ভয় দেখাতে শুরু করল। চুরি না করলে বাবুদের বলে দেবে এমন ভয়ও দেখাল। ঐন্দ্রিলা ভয়ে দিশেহারা হয়ে একাদশীকে খুশি করতে– অর্থাৎ চুরির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হল
টাকাটা যেত মনিঅর্ডারে–ঠিকানাটা থাকত একাদশীর। স্থানীয় ডাকঘর–পোস্ট- মাস্টার বাবুদের সবাইকে চেনেন। তাঁর সন্দেহ হতে তিনি গোপনে এঁদের জানালেন। বাবুরা তক্কে তক্কে থেকে যে মুদীর দোকানে একাদশী আধাকড়িতে মাল বেচত–তাকে ও একাদশীকে হাতে-নাতে ধরে ফেললেন। মারের চোটে সব কথাই বেরিয়ে পড়ল। ঐন্দ্রিলা সামনা-সামনি অস্বীকার করতে পারল না। করলেই বা তাঁরা শুনবেন কেন? ওর যোগসাজস ছাড়া এসব জিনিস বেরোনো সম্ভব নয়। ওকেই তাঁরা বিশ্বাস করতেন সবচেয়ে বেশি, ঝি- চাকরের ভাঁড়ারে যাওয়ার নিয়ম ছিল না।
বামুনের মেয়ে ব’লে মার-ধোর করলেন না–শুধু তখনই বিদায় করে দিলেন–খাড়া খাড়া, সেই দিনই।
অথচ বিপদের ওপর বিপদ–মাসখানেক আগেই চিঠি পেয়েছে–সীতা অন্তঃসত্ত্বা। কিছু বেশি টাকা তাকে না পাঠালেই নয়। এমনিই তো মাস-কাবারে টাকা না পাঠালে তারা শুকিয়ে মরবে। অথচ সে টাকাই বা কোথা থেকে পাবে। বাবুরা টিকিটটা কিনে দিয়ছেন তবু দয়া করে–নইলে তো ভিক্ষে করে আসতে হত!…
দীর্ঘ ইতিহাস বিবৃত করে কনকের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চায়, ‘তুমি ভাই দাও একটা ব্যবস্থা করে–নইলে মেয়েটা শুকিয়ে মরবে। এই প্রথম পোয়াতী, কোথায় ভাল-মন্দ খাওয়াবার কথা, তায় একেবারেই উপোসের ব্যবস্থা। লক্ষ্মী ভাই বৌদি, আমি কাজকর্ম খুঁজে নেবই একটা, মাসে এক টাকা করেও অন্ততঃ শোধ করব; তোমার কোন ভয় নেই!
কনক তো অবাক।
‘তুমি কি ভাই ঠাকুরঝি তোমার দাদাকে চেন না? একটা টাকাও কি আমার হাতে দেয় কোন দিন? সেই মানুষ কি? আমি কোথায় পাব?
‘কিচ্ছু দেয় না তোমাকে? তুমি কিচ্ছু জমাও নি? ওমা, তবে আর বব্লকে কি হাত করলে? ছেলে হয়েছে–এখন তো তোমার জোর।… কিছু নেই তোমার হাতে এ আমি বিশ্বাস করি না। দেবে না তাই বলো!’
অনেক দিব্যি-দিলেশার পর খানিকটা বিশ্বাস করে।
তখন অন্য অনুরোধ, ‘তুমি একটু মাকে কি দাদাকে বুঝিয়ে বলো। মা তো সুদে টাকা খাটায়–আমি সুদ দোব। কুড়িটা টাকা আমাকে ধারই দিক!’
এ অনুরোধের ফল কি হবে তা তো জানাই–ঐন্দ্রিলারও জানা উচিত, কারণ সে মাকে কনকের চেয়ে অনেক বেশি দিন দেখেছে–তবু ওর অনুনয় ও মিনতি এড়াতে না পেরে বলবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
.
রাত্রে হেমের কাছে কথাটা পাড়বার উপক্রম করতেই সে বলে, ‘ওসব প্যান- প্যানানিতে কান দেবার তোমার দরকার কী? ওর সঙ্গে আত্মীয়তা করতে যাও কেন? কী গুণের বোন আমার! খাচ্ছে-দাচ্ছে সে-ই ঢের, তার ওপর আবার দক্ষিণে দিতে পারব না। টাকা এত সস্তা নয় আমার!’
হেমের এ গলার আওয়াজ এতদিনে ভালই চিনেছে কনক। এর ওপর কথা কইতে যাওয়াই বৃথা
পরের দিন শাশুড়ীকে বলতে গিয়ে আরও কর্কশ কথা শুনতে হ’ল।
‘কেন, তোমাকে উকীল পাড়ে বলতে হ’ল কেন? তাঁর মুখ কি হ’ল? সে পোড়ার-মুখ তো এখনও পোড়ে নি, সে তো ঠিক আছে।… আসলে বুঝেছে যে এখন বৌদিই বাড়ির গিন্নী, গিন্নী বললে মা মাগী ভয়ে ভয়ে দিতে পথ পাবে না। দাসী-বাঁদী বৈ তো নয় মা।… তা এতই যখন গিন্নী হয়েছ বাছা, টাকার জন্যে সুপারিশ করতে এসেছ কেন–তুমিই ফেলে দাও না টাকা কটা! ভাতার তো মোট মোট টাকা এনে শ্রীপাদপদ্মে ঢালছে, সে কি আর আমরা টের পাই না?–না, আমরা ধানের চালের ভাত খাই না। বেটা বিইয়ে দিয়ে ভাতারের সো হয়েছ–এখন তো হাতের মুঠোর মধ্যে ভাতার।… টাকাটা ফেলে দিলেই পারতে–ছলনা করে আবার আমাকে বলতে এসেছ কেন? লোক-দেখানো কাষ্টনৌকতা না করলেই নয়?’
অবশ্য মেয়ের উদ্দেশ্যেও হ’ল তারপর, ‘সুদের কড়ারে টাকা ধার করতে এসেছেন উনি–দেবে কে ওঁকে, কিসের ভরসায় দেবে? ভারী তো ওঁর মুরোদ–বলে টিকে ধরাতে জামিন লাগে, সম্পত্তি বলতে আধ পয়সার জিনিস নেই কোথাও–উনি আবার বড় গলায় সুদের লোভ দেখান। এত যখন দরের মানুষ হয়েছেন উনি–যান না, বাজারে মহাজনের অভাব আছে! কাকে কত সুদের লোভ দেখাতে পারেন–দেখিয়ে আসুন না!’
এসব কথা বলা যায় না ঐন্দ্রিলাকে, বলতে পারেও না কনক। শুধু টাকাটা পাওয়া যাবে না, ওঁরা দিতে পারবেন না–এই কথাটাই বলে। ফলে ঐন্দ্রিলা মনে করে, কনক বিশেষ কোন চেষ্টাই করে নি–হয়ত আদৌ কোন চেষ্টা করে নি। সে কনকের ওপর পর্যন্ত বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠে।
দিনকতক ছট-ফট ক’রে শেষে একদিন তরুকে গিয়ে ধরে, ‘এই, তোর হাতে তো টাকা আছে–হাতে না থাক, তোরই তো টাকা–মাকে বল্ আমায় কুড়িটা টাকা ধার দিতে–আমি তোকে দুটাকা বাড়িয়ে বাইশ টাকা করে শোধ দোব। হয়ত এক মাসেই পারব না–তিন-চার মাসে শোধ করব, তবে ঐ টাকাটা পুষিয়ে দোব।
তরু হাঁ-ও বলে না, না-ও বলে না, উদাসীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আজকাল তার সঙ্গে কথা কইতে গেলে বক্তার মুখের দিকেই চেয়ে থাকে বটে, তবে তার মুখ দেখে বোঝা যায় না কথাগুলো সে শুনতে পাচ্ছে কি না।
‘কী লো দিবি–না দিবি না? সেইটে পষ্ট বলে দে না বাবু।’
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে ঐন্দ্রিলা অল্পক্ষণেই।
তাতেও কোন জবাব না পেয়ে নিজমূর্তি ধরে সে, নেকী! কত কল্লাই জানিস্ মাইরি!… এই কল্লা ক’রে মা-ভাইকে তো ভুলিয়েও রাখিস! আমরা এসব কিছু শিখলুম না বলেই আমরা চিরকাল পাজি বদমাইশ হয়ে রইলুম সকলের কাছে। আমরাও একদিন হাত-শুধু করে এসেছিলুম এ বাড়িতে–তোর চেয়ে ঢের কম বয়েস–তবু কেউ আহা-উঁহু করে নি। আমরা যে কল্লা শিখি নি-তার কী হবে ‘
কিন্তু এসব কথারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না–অব্যর্থ অস্ত্র পাষাণ-প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে যেন। এবার ঐন্দ্রিলা ছিটকে উঠোনে নামে, গলা চড়িয়ে মাকে উদ্দেশ করে বলে, ‘এত টাকা আসছে–এক-এক জন গিয়ে শয়ে চড়ছে আর সিন্দুক-ভরা বাসন, বাক্স-ভরা টাকা তো এসে ঢুকছে ওঁর পেটে–তবু পয়সার মায়া এত! নিজের মেয়ে-নাতনীকে একটা পয়সা দেওয়া যায় না! আর কত লোকের সব্বনাশের পয়সা খাবেন উনি, কত খেলে ওঁর পেট ভরে–সেইটে জানতে পারলে যে হ’ত! কাউকে রেখে যাবেন না উনি, সব কটিকে গব্বায় পুরবেন–তবে যাবেন। তখন ঐ বাসন আর পয়সা পাঁচভূতে খাবে, এই বলে দিলুম। আমাদের সঞ্চে-বঞ্চে করা ঐ পয়সা!’
মর্মান্তিক আঘাত, শ্যামার বুকেও তা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। কদিন আগে তরুর বাসনের সিন্দুক যখন নামছে তখন তিনি নিজেই সেই কথা ভেবেছেন। এত জিনিসের শখ তাঁর–কিন্তু এ কী জিনিস আসছে, এ তো তিনি চান নি। ভগবান তার আকাঙ্ক্ষাকে এ কী পরিহাস করছেন। আর মেয়ের এই কথায় সেই ক্ষতটাই আবার দগ্দগিয়ে উঠল যেন। তাঁর মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠে আবার তা বিবর্ণ হয়ে গেল। চোখে জলও এসে পড়ল। তবু তিনি প্রাণপণে আত্মসম্বরণই করলেন। তরল ময়লায় ঢিল ছুড়লে সে ময়লা ছিটকে নিজের গায়েও এসে লাগে। দরকার নেই।
এর পর ঐন্দ্রিলার হিংসা ও হিংস্রতা নিরাবরণ হয়ে উঠল। একটু শান্ত থাকত শুধু হেমের বাড়ি থাকার সময়টায়। সে অফিসে চলে গেলেই নিজমূর্তি ধারণ করত। অকারণ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করত–সেটা ঠিক বাধত না বলেই আরও ক্ষেপে যেত যেন। গালাগাল দিয়ে চেঁচিয়ে অভিসম্পাত করে জীবন দুর্বহ করে তুলত সবাইকার। বোধ হয় এটুকু সে বুঝে নিয়েছিল যে, যাকে লাগানো-ভাঙ্গানো বলে–কনক তা করবে না। অন্তত তার সব অত্যাচারের কথা পুরোপুরি হেমের কাছে বলবে না। মা-ও–বললে খানিকটা বলবে, সবটা বলতে পারবে না।
অসহ্য হ’ত অবশ্য শ্যামারই। শুধু তাঁকে বললে অত গায়ে লাগত না তাঁর–কিন্তু সদ্যোবিধবা ঐ মেয়েটা–একে শোকে-দুঃখে নীরব নিথর হয়ে গেছে–ওকে যখন আক্ৰমণ করত, অসহ্য কটু কথা শোনাত–তখন তাঁর ধৈর্যের বাঁধ রাখা অসম্ভব হয়ে উঠত এক একদিন। কিন্তু প্রতিবাদ বা তিরস্কারে কোনই ফল হ’ত না। এমন কাণ্ড করত ঐন্দ্রিলা, আরও অজস্র কুবাক্য এমন জলপ্রপাতের মতো অবিরল ধারায় বেরিয়ে আসত তার মুখ দিয়ে–যথাযথ অঙ্গভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বরের সহযোগিতায় যে, সেদিক দিয়ে তার ওপরে ওঠা কোন ভদ্রমহিলার পক্ষেই সম্ভব নয়। কনক অবাক হয়ে যেত এইসব শুনে। সে ভেবে পেত না যে ও এত শিখলে কোথায়, শিখলে কার কাছে! এ সবই কি অন্যত্র শুনে শেখা ওর–না স্বকপোল–কল্পনা?
‘বেরিয়ে যাও’, দূর হয়ে যাও’ এসব বলেও কোন ফল হ’ত না। সদম্ভে জবাব দিত ঐন্দ্রিলা, ‘কেন, কিসের জন্যে বেরোব আমি? আমি শুনেছি মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার বেশি। বাড়ি তোমার নামে–আমি তো জোরের সঙ্গে থাকব। চিরকাল বাঁচবে নাকি তুমি? আকন্দর ডাল মুড়ি দিয়ে এসেছ?…. মরতে হবে না একদিন ভেবেছ? তখন তো এ-সব আমাদের হবে।…. তবে কিসের জোর তোমার? এক মেয়ে যখন বসে আছে আমিই বা বসে থাকব না কেন? আমি তোমার মেয়ে নই? তাড়াতে হলে ওকেও তাড়াও। ইত্যাদি।
পাগলকে যুক্তি দিতে যাওয়া বৃথা। বিশেষ সে এমনই চিৎকার করে যে তার ওপর গলা চড়িয়ে ওকে কোন কথা শোনাবেন–সে ক্ষমতা শ্যামার আর আজকাল নেই। অত চেঁচাতে গেলে তাঁর কষ্ট হয়।
এক উপায় হেমকে বলা। কিন্তু সে হয়ত মার-ধোর করবে শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে। সে এক কেলেঙ্কারী। এমনিই তো পাড়াঘরে মুখ দেখাতে লজ্জা করে তাঁর। তা- ছাড়া, বয়স হ’লেও ঐন্দ্রিলার সে অসামান্য রূপ এখনও এমন কিছু নষ্ট হয় নি– শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আর পথ নেই তার, মেয়ে তো বলতে গেলে ভিখিরী –তাড়িয়ে দিলেই বা কোথায় কার কাছে গিয়ে উঠবে। হয়ত গুণ্ডা-বাদমাইশের পাল্লায় পড়বে–কে কোন্ দিকে টেনে নিয়ে যাবে তার ঠিক কি! আরও সেই ভয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন। চাকরি-বাকরি কি আর একটা জুটবে না। সে তবু কোন ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকা, কতকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন। পাজি হোক–বজ্জাত হোক–নিজে থেকে স্বেচ্ছায় খারাপ পথে পা দেবে না ও –সে বিষয়ে শ্যামা নিশ্চিন্ত।
মধ্যে মধ্যে আজকাল বেরিয়েও যায়–তিন ঘণ্টা, চার ঘণ্টা, কোন কোন দিন বা আরও বেশিক্ষণ অনুপস্থিত থাকে। কাজের জন্য ঘুরছে কি টাকা ধার করতে–তা ঠিক বুঝতে পারেন না। সম্ভবত দুই উদ্দেশ্যেই।… যাই হোক–সেই সময়টা একটু শান্তিতে, একটু স্বস্তিতে থাকেন। ….
এর মধ্যে একদিন একখানা মনিঅর্ডারের রসিদ ফিরে এল। সীতার নামে কুড়ি টাকা পাঠানো হয়েছিল, তারই রসিদ। কোথা থেকে টাকাটা পেলে ও? দুর্ভাবনায় মুখটা কালো হয়ে উঠল শ্যামার! অন্য কোথাও ধার করে করুক–কুটুমবাড়িতে মুখটা পোড়াচ্ছে না তো? অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি খোকাকে পাঠালেন মহাশ্বেতার কাছে। চুপি চুপি জিজ্ঞসা করে আসবে।
খোকাকে এখানের স্কুলে ভর্তি করা হয় নি। ওখান থেকে ছাড়িয়ে সার্টিফিকেট আনিয়ে এখানে ভর্তি করতে গেলে নাকি এক গাদা টাকা খরচা। হেম বলেছে, এখন বাড়িতে পড়ুক, আসছে জানুয়ারিতে কোথাও পড়ে না বলে এখানকার ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে–তাতে টাকা অনেক কম লাগবে। শ্যামা আপত্তি করেন নি। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে কমলার ওখানেই থাক, কমলাও রাজি ছিলেন, কিন্তু গোবিন্দ রাজি হয় নি। অল্প যে ক’দিন ছিল ওখানে–গোবিন্দ ওকে লক্ষ করেছে। সে নাকি বলেছে যে, ‘ও ছেলের হাবভাব ভাল নয়, বাইরে অমনি ঠাণ্ডা ভিজে বেড়ালের মতো থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও বিগড়ে গেছে। ওকে রাখবে–তারপর যদি কিছু হয়, আরও বকে যায় তো আজীবন খোঁটা শুনতে হবে মাসীর কাছ থেকে। পয়সা কে পয়সাও যাবে–একটা ছেলেকে রেখে তার খরচা টানা কি সোজা–আমার গুনিও তো বড় হচ্ছে–মিছিমিছি তার ওপর দুর্নাম কিনি কেন!’
গোবিন্দর এ কথা হেম গোপন করে নি। শ্যামা খুবই চটে গেছেন তাতে। বলেছেন, ‘আসলে খরচার কথাই বড় কথা। অতগুলো লোক খাচ্ছে, আমার ছেলে কি একেবারে য়্যাত য়্যাত খেত…. না হয় ইস্কুলের মাইনে, জামা-কাপড় আমিই দিতুম। শুধু খোরাকিটা–তাও দিতে পারলে না!…. সেই বলে না–ধান ভানাবি গা?–না না ভানাবার গা! তা পারবি না পারবি না–মিছি-মিছি একটা দুর্নাম দেবার দরকার কি? আমার ঐটুকু গুয়ের গোবলা ছেলে–চোদ্দ-পনরো বছর বয়স হয়েছে–এর মধ্যে ও কী বিগড়ে গেল? কী বিগড়ে যেতে দেখলেন তিনি! একটা গেছে বলে কি সব কটাই যাবে? তাও সে গেছে বলে কি আর ঐ বয়সে গেছে!’ ইত্যাদি–
এ তো শুধু হেমের সামনে। হেমের আড়ালে গোবিন্দ সম্বন্ধে আরও যে-সব মন্তব্য করেছেন, তা ভদ্রতার সীমায় আবদ্ধ থাকে নি–বলাই বাহুল্য।
খোকা ফিরে আসতে বোঝা গেল, তাঁর আশঙ্কাই ঠিক। তাও মহাশ্বেতা নয়–চেয়েছে জামাইয়ের কাছেই, তাঁর মুখটা ভাল করেই পুড়িয়ে এসেছে।
মহাশ্বেতা বলেছে, ‘আমিই তো বললুম ছুঁড়িকে–যা না, তোর দাদাবাবুকে গিয়ে ধর না। আমিও হয়ত দিতে পারি–কিন্তু সে আর কত, পাঁচটা সাতটা না হয় বড় জোর দশটা। তা সে থাক না, তোর কি আর দরকার হবে না? এযাত্রা তোর দাদাবাবুকে গিয়ে বলগে যা সব দুঃখু জানিয়ে–দিয়ে দিতে পারে। তা মিনসেও তো তেমনি, নিজের কাছে কি এক পয়সা রাখে–সব তো এনে ঐ মহারাজার শ্রীপাদপদ্মে। সুদে খাটায় যে টাকা সেই টাকা শুধু থাকে, তা তা থেকে দেবে না আমি জানি–আর সে পড়েও থাকে না। সে খাটেও তো আমার টাকাই বেশি। তা বলবামাত্তরই ওর দাদাবাবু মেজকত্তাকে গিয়ে বললে–এক রকম দায়ে পড়েই, কী করবে এখন? কী ভাগ্যি মেজভাই সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে টাকাটা বার করে দিলে। এও বলে দিয়েছে যে–এ আর শোধ দিতে হবে না, এ তোমার মেয়েকে আমরা দিলুম। দিয়েছে তাই–না দিলে কি আমি অমনি ছাড়তুম নাকি, ওর শালীর ছেলেকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে না?
আবার বলেছে, ‘তা মারই বা কী আক্কেল–হাজার হোক পেটের মেয়েই তো–পর তো আর নয়! মেয়ে আর নাতনী–একটা দুঃসময়ে পড়েছে–ঐ কটা টাকা দিতে পারলে না! এই যে সুদে খাটাচ্ছে টাকা–কিছু কি আর মারা পড়ে না? না হয় ভাবত যে তেমনি মারাই পড়েছে। বলিস মাকে যে কথাটা শুনে দিদি খুব অসন্তোষ হয়েছে!’
খোকা আনুপূর্বিক এসে বলে মাকে যা যা দিদি বলেছে, সব।
শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে শ্যামা, ‘তবেই তো আমি তাঁর ভয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁজতে বেরোলুম আর কি–লুকোবার জন্যে। এত যদি তোর টান নিজে দিলি নে কেন–আমার মুখটা পোড়াতে জামাইয়ের কাছে পাঠাতে গেলি কেন।…. সারা কুটুমবাড়িময় জানাজানি হয়ে গেল–মুখটা পুড়তে কোথাও আর বাকি রইল না। বুদ্ধি না থাকে, হায়াপিত্তিও তো থাকে মানুষের–তুই কী বলে জামাইয়ের কাছে পাঠাতে গেলি! হাত্তোর ভাল হোক রে!
তিনি বহুক্ষণ পর্যন্ত গজরাতে থাকেন।
।।৪।।
অশান্তি কমে না–বেড়েই যায় দিন দিন। ঐন্দ্রিলা খুবই ঘুরছে চাকরির জন্যে কিন্তু চাকরি কোথাও পাচ্ছে না ভালমতো। একজন রাজি হয়েছিলেন, মাইনেও পুরো দশটা টাকাই দিতে চেয়েছিলেন–তাছাড়া একাদশীতে একাদশীতে দু’আনা করে পয়সা –কিন্তু ঐন্দ্রিলাই পিছিয়ে এল শেষ পর্যন্ত। শোনা গেল লোকপরম্পরায় সে বাড়িতে নাকি কোন ঝি-রাঁধুনী দশদিনের বেশি টেকে না–কর্তার দোষ আছে। কর্তাই দেখে শুনে পছন্দ করে নেন–অল্পবয়সী না হলে পছন্দ হয় না তাঁর, ইত্যাদি। এসব শুনে আর সাহস হয় না সে বাড়িতে কাজে যেতে।
এধারে যত দেরি হয়–ততই মেজাজ আরও খারাপ হতে থাকে তার। মাস শেষ হতে চলল–মেয়েকে আবার টাকা পাঠাবার সময় হয়ে এল। আর কোথায়ই বা পাবে টাকা। এখন কাজ ধরলেও এক মাস পরে টাকা–অথচ এখন কাজই ধরতে পারল না। ফলে মনের সব দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা বিষ হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। সারাদিনই চেঁচামেচি করে সে– যতক্ষণ বাড়িতে থাকে। কাকচিল বসতে দেয় না বাড়িতে –এমন চিৎকার করে।
কনকের আর যেন সহ্য হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। সারাদিনে ছেলেকে ঘুম পড়াতে পারে না সে, ননদের চেঁচানির চোটে।
আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে ইদানীং–শাশুড়ীর অহেতুক বিদ্বেষ তার প্রতি।
এটার কোন মানেই বুঝতে পারে না কনক। সে কি দোষ করল? প্রাণপণে খাটছে সংসারে, সকলের সেবা করছে–শাশুড়ীও তার বিশেষ খুঁত ধরতে পারেন না আজকাল। সেও তো তাঁর মন-যুগিয়ে চলবারই চেষ্টা করছে অহরহ।… মেয়ের প্রতি যে রোষ রুদ্ধ আবেগে জমতে থাকে মনের মধ্যে, প্রকাশের পথ খুঁজে পায় না–সেটাই যেন তির্যক গতিতে এসে ওর ওপর আছড়ে পড়ে। বৌয়ের ওপর আক্রোশ চেপে থাকার প্রয়োজন হয় না–কারণ সে প্রতিবাদ করতে পারবে না, করতে সাহস করবে না–সেই ভরসাতে নিশ্চিন্ত হয়েই সব বিষটা ঐখানে উদ্গার করেন। দিনে দিনে সে আক্রোশটা যেন বড় বেশি উগ্র বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। কনক অনেক সয়েছে এ-বাড়িতে এসে, অনেক কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকে সে আজকাল–কিন্তু তারও সহ্যের সীমা যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আগে সে ভাবত যে সব রকম লাঞ্ছনাই তার গা-সওয়া হয়ে গেছে–এখন চোখের জলে বুঝেছে যে তার অভিজ্ঞতা খুবই সীমাবদ্ধ। এমনই কথা বলেন শ্যামা–এমন চোখা চোখা আঘাত করেন কথার দ্বারা–যে কনকের মনে হয় এর চেয়ে হাত দিয়ে মারা ঢের ভাল ছিল।’বাক্যবাণ’ শব্দটা বহু লোকেই ব্যবহার করেন বটে কিন্তু সে বস্তুটি ঠিক কি তা কেউ জানে না। এখানে না এলে জানা সম্ভব নয়।
সবচেয়ে দুঃখ এই, আঘাতগুলো আসে সম্পূর্ণ অকারণেই–তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপলক্ষ ধরে। এ কেউ বিশ্বাসও করবে না বললে। সেই জন্যেই সে বলেও না হেমকে। তাছাড়াও, কেমন যেন বাধে তার–মার নামে নালিশ করবে ছেলের কাছে? ছেলে যদি ভুল বোঝে হাজার হোক তার মা। এখনও সে স্বামীর মনোরাজ্যে সম্পূর্ণ প্রবেশ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না তার। হয়ত সে কনকের ওপরই বিমুখ হয়ে উঠবে।
বলে না–তবে হেম তার মুখ দেখে কিছু কিছু বুঝতে পরে বৈকি। প্রদীপের সামান্য আলোতেও ঢাকা পড়ে না এক একদিন। বোঝে যে তা মুখে না বললেও তার ব্যবহারে প্রকাশ পায়। হয়ত মুখে বলে না বলেই হেমের সহানুভূতি বেশি। সে যে সহ্য করছে– নালিশ করছে না, লাগাচ্ছে না তার কাছে–এতে শ্রদ্ধাই বাড়ছে হেমের। রানী বৌদি ঠিকই বলেছিল–এ রত্ন হেমই চিনতে পারে নি।
হেম একদিন নিজের কানেও শুনল। শনিবার বিকেলে কলকাতা যাবে বলে বেরিয়েও ফিরে এসেছিল সে–শরীরটা খারাপ লাগাতে। জ্বর জ্বর ভাব বলে এসে অন্ধকারেই শুয়ে পড়েছিল। শ্যামা টের পান নি। ছেলের সামনে একটু সতর্কই থাকেন তিনি। কত তুচ্ছ কারণে কী বিষ তিনি ঢালছেন শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে ওঠাতে হেম তেড়ে বেরিয়ে এল, ‘ও কি হচ্ছে কি! ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো বুঝি? শক্ত মাটিতে দাঁত বসাতে পারো না– মেয়ের কাছে ধ্যাতানি খেয়ে সেই ঝালটা ওর ওপর ঝেড়ে গায়ের জ্বালা মেটাও–না?’
এর ফল যে ভাল হল না–তা সহজেই অনুমেয়। ছেলেকে মনে মনে একটু সমীহ করলেও সামনাসামনি সেটা অস্বীকার করবার লোক নন শ্যামা। তিনি জানেন যে একেবার মেনে নিলে আর কোন দিন নিজের অধিকার মানাতে পারবেন না।
তিনি সমান তেজের সঙ্গেই জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা মেটাই তো। তার জন্যে কী করবি কি? মারবি নাকি? সেইটে হলেই মাগপূজোর ষোড়শোপচার পূর্ণ হয়।… তুই তোর
মেগের পা ধুয়ে পাদোক জল খেতে পারিস–আমি কেন খেতে যাব? আমার বাড়ি আমার ঘর। ….বেশ করব বলব–না পোষায়, ভাল না লাগে মাগ ঘাড়ে করে বেরিয়ে যা। ভাবিস নি যে ঐ কুড়ি টেক্লো করে মাসে ঠেকিয়ে আমার মাথা কিনে রেখেছিস–না দিলে আমার দিন চলবে না। ব’লে তোর জন্মদাতাই আমাকে উপোস করিয়ে মারতে পারলে না–তা তুই!’
বৌয়ের ওপর ঝালটাও আর গোপন করবার দরকার হয় না।
ভেডুয়া ভাতার পেয়েছিস, ভাবছিস দুনিয়ার সবাই তোকে ভয় করে চলবে, না? বলা হয়েছে ওঁৎ পেতে শোন তোমার মা মাগী কি রকম বলে, দ্যাখো ব্যাভারটা।…তা শোনানো তো হ’ল–এইবার কি হবে কি? আমার কাঁচা মাথাটা উলিয়ে নেবে তোর ভাতার? নাকি হেঁটে-কাঁটা ওপরে-কাঁটা দিয়ে উঠোনে পুঁতবে আমায়? যা পারে করতে বল–আর সাধ্যি থাকে তুইও আয়! হারামজাদার বংশ–হ্যারামজাদী আমার সংসার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক্ করে দিলে গা! যেদিন থেকে ভিটেয় পা দিয়েছে সেইদিন থেকে অশান্তি। কী আয়পয় দেখেই বৌ এনেছি আহা! এসে পর্যন্ত মড়াই মরছে শুধু। সবাইকে খেয়ে উনি একা এখানে রাজত্ব করবেন! করাচ্ছি রাজত্ব তোমাকে। তেমন তেমন দেখব–খ্যাংরা মারতে মারতে বাড়ি থেকে দূর করে দেব। দেখি তোর কোন্ বাবা রাখে।’…
ঘরের মধ্যে রুদ্ধস্বরে কনক হেমকে বলে, ‘কেন তুমি কথা কইতে গেলে। এই সওয়া আমি নিত্যি চার প্রহর সইছি–তুমি একদিন সইতে পারলে না? আরও বিষ বাড়লই শুধু। তোমার কি, তুমি তো দিনে বারো ঘণ্টার ওপর বাইরে থাক–আমায় তো দিনরাত থাকতে হয়। এর পর আরও কি কাণ্ড হবে তা বুঝতে পারছ!’ হেম গুম হয়ে বসে থাকে তখন, কথা কয় না।
রাত্রে স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘পীড়ন হচ্ছে বুঝতে পারি কিন্তু এতটা বুঝি নি। তুমিও তো বল নি কখনও?’
এ কথার কি উত্তর দেবে কনক! এইটুকুই হেমের পক্ষে যথেষ্ট সপ্রেম ব্যবহার, এই সামান্য স্নেহের সুরেই তার চোখে জল এসে গেছে। কথা কওয়ার শক্তিও নেই তখন
হেম একটু চুপ করে থেকে আবারও বলে, ‘কেন এমন করছে মা–যেন কী এক বিষের জ্বালায় ছিটফিটিয়ে বেড়াচ্ছে। কী করলে কি তুমি?’
এ কথারও উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ওর যা মাঝে মাঝে মনে হয় তা কাউকেই বলা সম্ভব নয়। ওর মনে হয় বিষ নয়–রীষ এটা… ওঁর মেয়েরা একে একে এ জন্মের মতো সব সৌভাগ্য ঘুচিয়ে এসে ঢুকছে তাঁর কাছে–বৌ পরের মেয়ে, স্বামী পুত্র নিয়ে মনের সুখে ঘর করবে কেন–যেন এই ধরনেরই ঈর্ষা একটা ওঁর!
কথাটা ভাববে না বলেই মনে করে কনক, বড় নোংরা কথা, বড় খারাপ কথা–তবু ঘুরে-ফিরে বারবারই মাথায় আসে কথাটা। আজও, হেমের এই প্রশ্নে কথাটা মনে হতেই, শিউরে উঠে কথাটাকে মন থেকে তাড়াতে চাইল সে।
হেম ওর মনের কথাটা বুঝল না কিন্তু শিহরণটা টের পেল। সে আরও সস্নেহে ওকে একটু কাছে টেনে বলল, ‘আর কটা দিন একটু ধৈর্য ধরে থাকো। আমি চেষ্টা করছি কিছুদিন থেকেই–বদলির অর্ডারও হয়ে গেছে–সেখানে কোয়ার্টার এখনও তৈরি হয় নি সব, কোয়ার্টার পেলেই চলে যাব। যা শুনছি, বড়জোর আর দুটো মাস।’
সংবাদটা এতই অপ্রত্যাশিত, এত আনন্দের যে, কনকের মনে হল একটা চিৎকার করে সে উল্লাস প্রকাশ করে। পাবে সে–একদিন মুক্তি পাবে! তোমরা সবাই শোন–সে চলে যেতে পারবে এই জীবন্ত সমাধি থেকে!
কিন্তু এ সব আনন্দ ও অধীরতা মুখে প্রকাশ করতে নেই–এই অসহ সুখের মধ্যে সে জ্ঞান তার ছিল। অতি কষ্টে আত্মসম্বরণই করল সে, মুখে শুধু প্রশ্ন করল, ‘তারপর, এখানে?’
‘এখানে মা রইল, তরু রইল–কান্তি রইল। যা হয় হবে–আমি আর ওদের কথা ভাবতে পারব না। ঢের ভেবেছি। কান্তেটা বলেছে সামনের বার এগজামিন দেবে, দিতে পারে দিক। মেসোমশাই বলেছেন যে, ও যদি এগজামিন দিতে চায় তো তাঁকে জানালেই তিনি ফিয়ের টাকা পাঠিয়ে দেবেন। পারে পাস করতে, একটা চাকরি-বাকরির চেষ্টা দেখতে হবে। বড়দাকে বলেছি কোন বাঙ্গালী বাড়ির কাজ খুঁজতে–যা দু-চার পয়সা দেয়। সাহেবের চাকরি তো আর হবে না ওর দ্বারা। সরকারি কাজও পাবে না।’
তারপর একটু থেমে বললে, ‘খোকাটাকে মনে করছি আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। তোমার হাত-নুড়কুৎ হবে একটু–ওখানের ইস্কুলে ভর্তি করে দেব! তবু চোখে চোখে রাখা যাবে। কে জানে বড়দা কী বোঝে, সে তো বলে, ওর পিপুল পেকেছে, ওর আর কিছু হবে না।’…
কিন্তু গোবিন্দ যা-ই বলুক তার কথাটা যে এত শিগগির ফলে যাবে তা বোধহয় সেও ভাবে নি।
ঘটনাটা ত্বরান্বিত করলেন অবশ্য শ্যামাই।
অনেকদিন পরে এক কাঁদি ভাল কালীবৌ কলা পড়েছিল বাগানে। কদিন আগে কান্তিই সেটা কেটে নামিয়ে রেখেছে। সেদিন সকালে উঠে ছালা সরিয়ে শ্যামা দেখলেন, যে সবগুলোই পেকে উঠেছে, সেদিনই বিক্রির ব্যবস্থা না করলে কালো হয়ে যাবে সব
তিনি কান্তিকে বললেন, ওপর দিককার মাথার ছড়াগুলো কেটে সাবধানে একটা ধামাতে সাজাতে, আর খোকাকে বললেন ধামাটা নিয়ে বাজারে গিয়ে ফলওয়ালাদের কাছে বেচে আসতে।
কথাটা তাঁর কাছে এতই স্বাভাবিক যে, কোন প্রতিবাদ আশাও করেন নি। কিন্তু খোকা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘সে আমি পারব না।’
‘পারবি না!’ আশ্চর্য হয়ে যান শ্যামা, ‘পারবি না কেন?…. ও কালা-মানুষ কি শুনতে কি শোনে, ওকে ঠকিয়ে দেয়–তুই রয়েছিস তুই যাবি, এই তো সোজা কথা। বেশ ভাল ফল হয়েছে, ভাল দাম পাওয়া যাবে দরদস্তুর করতে পারলে। তা তোমার কি হ’ল কি?’
সে তেমনি মুখ ফিরিয়েই উত্তর দিলে, ‘বাজারে মোট ঘাড়ে করে বেচা বেচতে যাব– আমি কি ছোটলোক!
‘ও আবার কি কথা! নিজের বাগানের জিনিস নিজে বেচবি–তাও তো আমি তোকে বাজারে বসে খুচরো বেচতে বলছি না, তাতে তো দু’পয়সা বেশিই পাওয়া যায়–পাইকিরি বেচবি একজনকে, তা আবার ছোটলোক ভদ্দরলোক কি! যা বলছি–! কান্তি এই তো কতদিন ধরে করছে, ও পারে–তুমি পার না? ও ছোটলোক হয়ে গেছে–না?’
যে পারে পারে–আমি পারব না। এমনিই আমাদের দেখলে পাড়ার ছেলেরা হাসে। তার ওপর ধামা মাথায় করে কলা বেচতে গেলে আর কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’ শ্যামা এই কথাতে আরও ক্ষেপে যান। পাড়ার লোক তাঁকে একটু বিদ্রূপের চোখে, অবহেলার চেখে দেখে তা তিনি জানেন। কিন্তু সেই কথাটারই কেউ ইঙ্গিত দিলে সহ্য করতে পারেন না।
‘পারবি না কি, পারতেই হবে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!… আমার মুখের ওপর পারব না বলা! গোবিন্দ দেখছি ঠিকই বলেছে, পিপুল পেকেছে তোমার!…. দুদিন কলকাতার জল গায়ে পড়ে ধরাকে সরা দেখছ, না? চাল বেড়েছে! চাল বার করছি। দুদিন ধানের চাল পেটে না পড়লেই সব চাল চলে যাবে। ভিরকুট-বীচি ও, ওর বড় দাম; পাড়ার ছেলেরা কি বলবে এই ভয়ে আমার দুটো পয়সা আয় বন্ধ করে দেব, না? এত বড় সংসারটা চলবে কিসে? পাড়ার ছেলেরা খেতে দেবে তোকে–না, আমাকে দুটো টাকা দিয়ে সাহায্য করবে! যাদের ছেলেরা হাসে তারাই দেখিস না মাথা হেঁট করে টাকা ধার করতে আসে আমার কাছে?…নে ওঠ বলছি, ভাল চাস তো! মাথায় করতে হবে কেন, হাতে ক’রেই নিয়ে যাও না।’
কিন্তু শ্যামা যতই যা বলুন, খোকা নড়ে না। বজ্জাত ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ ক’রে। কথা যে সে শুনবে না সেটা স্পষ্ট সবাইকার কাছেই–
এত বেয়াদপি শ্যামার সহ্য হয় না। তিনি এক চড় বসিয়ে দেন ওর গালে। পাতা- কুড়নো আর পাতা-চাঁচা, মাটি কোপানো হাত–পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে যায় ওর গালে।
কিন্তু এতেও এক ইঞ্চিও নড়ে না সে।
তখন পাগলের মতো মারতে থাকেন শ্যামা। কনক ধরতে এসে পিছিয়ে যায়– শ্যামার সে সময় রণরঙ্গিনী মূর্তি! পাখার বাঁটের এক ঘা সজোরে তার হাতেও পড়ে ঝনঝনিয়ে ওঠে হাত। ছুটে আসে ঐন্দ্রিলাও। কান্তি এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘আমি যাচ্ছি মা। আমিই তো যাই।… ওকে ছেড়ে দাও।’
ঐন্দ্রিলার ব্যঙ্গেই বেশি কাজ হয়, ‘কেন গো, তোমার ছেলেমেয়ে সবাই তো লক্ষ্মী, সব ভাল। যত বদ তো আমি। …তবে আবার এ মূর্তি কেন? … কেউ তোমার কথা শুনবে না, কেউ না–এটি মনে রেখো। মারের চোটে আর কদিন শোনাবে? এর পর ওরাই ধরে মারবে যখন?’
শ্যামার হাতের মুঠো থেকে এইবার পাখাটা টেনে নেয় কনক।
‘আচ্ছা, আমিও দেখে নোব তোমার এ ভিরকুটি কদিন থাকে। ও ভিরকুটি ভাঙ্গতে আমি জানি। বালাম চাল পেটে পড়ে কদিনেই বড় বাড় হয়েছে তোমার। ঐ চাল বন্ধ করলেই টিট্ হয়ে যাবে তুমি! আজ থেকে ভাত বন্ধ তোমার এ বাড়িতে। মাথায় করে আনাজ নিয়ে বাজারে গিয়ে বেচে আসবে তবে ভাত পাবে আবার। যে কথা সেই কাজ আমার–আমাকে তুমি চেন না!’
সত্যিই সেদিন ভাত দেন না শ্যামা। দালানের জানালায় সেই যে কাঠ হয়ে বসে থাকে খোকা–বসেই থাকে তেমনি। ঘামে গা ভিজে যায়–কিন্তু চোখে এক ফোঁটা জল বেরোয় না। সারা গায়ে দাগড়া দাগড়া দাগ হয়ে গেছে, দেখে কনকের মন-কেমন করে। আহা, ঐটুকু ছেলে–কী চোরের মারই খেলো। ইচ্ছে হয় কাছে টেনে নিয়ে গা মুছিয়ে দেয়– সান্ত্বনা দেয় একটু–কিন্তু শ্যামার ভয়ে পারে না। তবু শ্যামা যে সত্যিই ওকে খেতে দেবেন না–তা কখনও ভাবে নি ওরা। সবাই শুকিয়ে বসে আছে, শুধু তরুকে ডেকে খাইয়ে দিয়েছে কনক। বেলা দেড়টা নাগাদ শ্যামা গম্ভীরভাবে নিজের ভাত বেড়ে নিয়ে যখন খেতে বসলেন, ঐন্দ্রিলাকে ডেকে বললেন, ডাল-তরকারি কি কি হয়েছে দিয়ে যেতে– তখন সে সুদ্ধ অবাক হয়ে গেল।
‘তা ও–?’ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে ইঙ্গিতে দালানের দিক দেখিয়ে প্রশ্ন করে সে।
‘ওর কথা তো একবার বলে দিয়েছি বাছা। আমার কথা না শুনলে এ বাড়িতে ওর অনু নেই–সাফ্ কথা। কেউ যেন কোন রকম দয়াধম্ম না করতে যায়–শুনলে আমি কিন্তু তাকে সুদ্ধ সেই দণ্ডে বাড়ির বার ক’রে দেব!’
এর পর ওকে ডেকে ভাত দেবে সে সাহস কারও নেই।
অনেক ইতস্তত করে ঐন্দ্রিলা ভাত নিয়ে নিজেও খেতে বসল। কিন্তু কনক পারল না। তারও সেদিন দুপুরে খাওয়া হ’ল না।
শ্যামা খাওয়া-দাওয়ার পর একটু জিরিয়েই যথারীতি প্রশান্ত বদনে বাইরের রকে গিয়ে পাতা নিয়ে বসলেন।
ঐন্দ্রিলা খেয়ে এসে ছোট ভাইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ফ্যাশ ফ্যাশ ক’রে বলল, ‘এই– যা না, গিয়ে একবার মাপ চাইগে যা না। উপোস করে থাকবি নাকি! এখনই তো তোকে বাজারে পাঠাচ্ছে না। আর কী আছে ঘরে যে পাঠাবে? সে কলা তো কান্তি বেচেই এল।… যা ওঠ– । …আ মর, তেজ দ্যাখো, কথা শোনে না। মরুক গে, মরলে তুই-ই মরবি– আমার কি! পিপীলিকার পালক ওঠে মরিবার তরে!’
হেসে অঙ্গভঙ্গি করে ঘরে চলে গেল ঐন্দ্রিলা।….
কনক দাওয়াতেই বসে ছিল চুপ করে। সে-ই দেখল খানিক পরে খোকা উঠে খিড়কীর দোর দিয়ে বাগানের দিকে গেল। সে ভাবল পাইখানায় যাচ্ছে বোধহয়, এসে স্নান করবে। কিন্তু বহুক্ষণ কেটে গেল যখন–এদিকে ফিরল না, পুকুরেও কারুর স্নান করার সাড়া পাওয়া গেল না–তখন সে উদ্বিগ্ন বোধ করল। বাগানে বেরিয়ে দেখল পাইখানার দিকে কেউ যায় নি–পিছনটা সব দেখে এল–যদি কোন গাছতলা-টলায় বসে থাকে, সেখানেও নেই। তখন বাইরে এসে সাহসে ভর করে শাশুড়ীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মা–ছোট্ ঠাকুরপো কোথায় গেল বলুন তো?
‘গেল?’ একটু চমকেই উঠলেন শ্যামা, ‘কোথায় যাবে? কই–এদিকে তো আসে নি। ওখানে নেই?’
তখন কনক বল, উঠে বাগানের দিকে যাবার কথাটা।
তাহলে বোধহয় ওদিক দিয়ে বাইরে চলে গেছে–আমার সামনে দিয়ে যাবে না বলে। যাক না–বন্ধুবান্ধব ঢের হয়েছে পাড়ায়, কে কত খাওয়াতে পারে খাওয়াক না! যাবে কোথায় বাছা, ঠিক ফিরে আসবে। তুমি খেয়ে নাও গে–একজন সোহাগ করে বসে আছে দেখলে জব্দ হবে না।
কনক যে খায় নি তা শ্যামা লক্ষ করেছেন। গলার কোমল সুরে বোধ হল মনে মনে খুশিই হয়েছেন তাতে।
কিন্তু বিকেলেও ফিরল না খোকা। সন্ধ্যার পরও না। এবার শ্যামা সুদ্ধ উদ্বিগ্ন বোধ করলেন। তিনি নিজেই বেরোলেন পাড়ায় খোঁজ করতে। ঐন্দ্রিলাও কতকগুলো বাড়িতে গেল। খালি গায়ে এক কাপড়ে বেরিয়েছে, কোথায়ই বা যাবে?… কিন্তু পাড়াঘরে কোথাও খবর পাওয়া গেল না। কেউ দেখে নি তাকে।
হেম এসে সব শুনে খুব বকাবকি করল মাকে। শ্যামা চুপ করে রইলেন। তাঁর ভয় হয়েছে–অনুশোচনাও হয়েছে। ইতিমধ্যে কান্তিকে পাঠানো হয়েছিল মহাদের বাড়ি, সে ফিরে এল। সেখানেও যায় নি। ওর সঙ্গে বুড়ো ন্যাড়ারা এসেছিল খবর পেয়ে–তারা আলো নিয়ে স্টেশন লাইনের ধার খুঁজে এল। হেম তখনই গেল কলকাতায় বড়মাসীর বাড়ি। সেখানেও নেই।
জানাশুনো কোন জায়গাতেই খবর পাওয়া গেল না তার। পরের দিনও সবাই যতটা পারল ঘোরাঘুরি করল। হেম আপিস কামাই করে থানায় থানায়, হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াল–কিন্তু কেউই কোন খোঁজ দিতে পারল না। অত বড় ছেলেটা যেন উবে গেল একেবারে।
শ্যামা পরের দিন থেকে অন্নজল ত্যাগ করলেন; কান্নাকাটিও ঢের করলেন। গালাগাল দিলেন সদ্য-মৃতা বোনকে! বিশ্বাস করে তার কাছে রেখেছিলেন, সে এত ছেলে-মেয়ে চরাত সে লক্ষ করে নি যে ছেলে বিগড়ে যাচ্ছে? গোবিন্দ তো একদিনেই চিনল!…. বিশ্বাস করতে নেই কাউকে, খুব শিক্ষা হল তাঁর। তার নিজের ছেলে হয় নি তো, কী বুঝবে পেটের একটা নষ্ট হলে কী দুঃখ হয়।
কদিন পরে আবার ঠেলে উঠলেন নিজেই। আবার শুরু হল নিয়মিত প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা। যেমন চলছিল সব তেমনই চলতে লাগল। সবাইকে শুনিয়ে বোধ করি নিজেকেই সান্ত্বনা দিলেন, ‘যাবে আর কোথায়? মরে নি এটা তো ঠিক, মরলে হয় এখানেই রেলে গলা দিত, নয়ত কোন পুকুরে ডুবত।… সে খবর পাওয়াই যেত এতদিনে কলকাতার হাসপাতালেও তো খবর নেওয়া হল।…. না মরে নি। আমার মন বলছে ফিরে আসবে সে। তবে কী মূর্তিতে আসবে সে-ই হল কথা। কোন্ গুণ্ডাদের খপ্পরে গিয়ে পড়ল, নেশা-ভাঙ বদখেয়ালী শিখে আসবে–চোর ডাকাত খুনে হবে–সেই এক ভাবনা।… তা আমি আর কি করব। মায়ের পেটের বোনকে দিলুম বিশ্বাস করে সে-ই যখন–’ ইত্যাদি।
কিন্তু শ্যামার আশা বা আশঙ্কা কোনটারই আশু কোন চেহারা দেখা যায় না। দিন সপ্তাহ-মাস কেটে যায়–গাছপালায় প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তনের ইতিহাস রচিত হতে থাকে–তবু খোকা ফেরে না। শ্যামার মন ভার হয় আবার, সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে বসে চোখের জল ফেলেন–কিন্তু ছেলেকে ফিরিয়ে আনার কোনও উপায় খুঁজে পান না। কোথায় আছে যদি জানতে পারতেন!
মন খারাপ হয় সকলকারই। কনকের তো আরও বেশি, নূতন সংসারে তার সঙ্গে থাকবার কথা। কোথায় গেল কে জানে, দুটো দিন যদি ধৈর্য ধরে থাকত! অতবড় ছেলেটা বরবাদে চলে গেল!
তার কথা ভাবলেই সেই মার-খাওয়া ম্লানমুখ চেহারাটা মনে পড়ে যায়। চোখ ফেটে জল আসে যেন। আহা, যেখানেই থাক, সুখে থাক, মানুষ হোক!