আমাকে ওরা কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই বাড়িরই সব দায়িত্ব পালন করতে-করতে আর সন্তানের জন্ম দিতে দিতে, আর তাদের বড় করতে-করতে আমি মৃত্যুর দরজায়। আমি চোখে ভালো দেখতেও পাচ্ছি না।
আমার হাত কাঁপছে। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
তবু দু-একটা কথা এখনও লিখতে বাকি। আমার নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে শেষ দুটি বন্ধু পেয়েছিলুম–
আমার দুই মেয়ে, মাধুরীলতা (বেলা) আর রেণুকা।
গত বছর ১৫ জুন রবি ঠাকুর মাধুরীলতাকে জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে খুব ভেবেচিন্তে! কার সঙ্গে? সেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলের সঙ্গে, যে বিহারীলাল ছিলেন নতুন বউঠানের ভক্ত বন্ধু!
বেলার বয়স মাত্র পনেরো।
আমি রেণুকাকে বুকে করে বেঁচে ছিলুম।
বেলার বিয়ের মাত্র একমাস চব্বিশ দিন পরে ও তাকেও কেড়ে নিল আমার বুক থেকে।
বিয়ে দিয়ে দিল মাত্র দশ বছর বয়সে।
কারণ বাবামশায় ১৮৯৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শেষ উইল করেছেন। সেই উইল অনুসারে বাবামশায় বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বিয়ের খরচের প্রায় সবটাই পাওয়া যাবে জোড়াসাঁকোর তহবিল থেকে! কী চমৎকার হিসেব!
আমার কোলের ছেলে শমী, মাত্র ছ’বছর বয়েস, কী দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।
ওকে কতবার বললুম, যাওয়ার আগে শমীকে একটিবার দেখে যাই, ওকে নিয়ে এসো!
কোথায় শমী?
রথী, তাকেও তো আসতে দিলেন না।
এখন আর আমার কারও সঙ্গে কথা বলার শক্তি নেই।
লিখতেও আর পারছিনে।
শুধু থামবার আগে আরও দু-একটা কথা লিখতেই হবে।
খুব এলোমেলোভাবে লিখেছি। সেই জন্যে ক্ষমা চাইছি।
কী করব—শরীর যে আর পারছে না।
রবি ঠাকুরকে কখনও তুমি, কখনও আপনি বলেছি এই লেখায়।
যখন কাছের, তখন তুমি।
যখন দূরের তখন আপনি। ব্যস।
আমি লেখাটা আমার সিন্দুকের একটা গোপন কোঠরে লুকিয়ে রাখছি।
যদি কোনওদিন এমন কারও হাতে পড়ে, যিনি এটিকে ঠাকুরবাড়ির বাইরে নিয়ে যাবেন…।
আমার শেষ ইচ্ছে ছিল—চলে যাওয়ার আগে শমীকে একবার শুধু দেখা—একটি চুমু দেওয়া ওর ছোট্ট নরম ঠোঁটে।
ভালো থাকিস বাবা!
তোরা সব্বাই ভালো থাকিস।
উনিও যেন ভালো থাকেন।
ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে থাকুন।
১৩ই নভেম্বর, ১৯০২।