করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে
গাঁধীজি ‘হরিজন’ পত্রিকায় ভাবী আন্দোলনের চেহারা কী হবে তা নিয়ে কিছু আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী কর্মীদের ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে তিনি বা নেতৃবৃন্দ স্পষ্ট কোনও নির্দেশ দিয়ে যাননি। শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নয়, জেলা, মহকুমা এমনকী গ্রাম পর্যন্ত যেসব স্থানীয় নেতা বা কর্মীদের নাম পুলিশের খাতায় ছিল, তাঁদের প্রায় সবাইকে কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। অল্প যাঁরা ক’জন বাইরে থাকলেন তাঁদের উপর পুলিশ কড়া নজর রাখল। সেই নজর এড়িয়েও কয়েকজন নেতা এবং বেশ কিছু কর্মী গা ঢাকা দিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিলেন। এঁদের কাছ থেকে নিয়মিত নির্দেশ দিয়ে ইস্তাহার বের হতে লাগল। কলকাতা শহর দেওয়াললিপিতে ছেয়ে গেল : ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’। আমরা শুনলাম—জয়প্রকাশ নারায়ণ আর অরুণা আসফ আলি সর্বভারতীয় আন্দোলনে নেতৃত্বের ভার নিয়েছেন। প্রদেশে প্রদেশেও বৈপ্লবিক কমিটি তৈরি হয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকেই নির্দেশ পাব।
কে বা কাদের কাছ থেকে জানি না, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কর্তব্য কী হবে তার বিস্তৃত নির্দেশ সংবলিত একগোছা ইস্তাহার আমার হাতে আসে। যে-লোকটি এক সন্ধেবেলা এসে ওগুলি দিয়ে গেল, তাকে আমি কোনওদিন চোখে দেখিনি। সে শুধু বলল, যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে চায় তাদের প্রতি প্রাদেশিক হাইকম্যান্ডের নির্দেশ, নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যাও, আর ফিরে গিয়ে জাতীয়তাবাদী কর্মী, যাঁরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েননি, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। কী কর্তব্য সে সম্বন্ধে তাঁদের কাছ থেকে নির্দেশ পাবে। ইস্তাহারে লেখা ছিল বর্তমান আন্দোলনের প্রকৃতি এবং কর্মপদ্ধতি অসহযোগ আর আইন অমান্য আন্দোলনের থেকে ভিন্ন হবে। আন্দোলনকারীরা কেউ স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবে না। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য–ইংরেজের যুদ্ধ প্রচেষ্টা বানচাল করে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা আবার আলোচনায় বসতে এবং যুদ্ধের পর ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে বাধ্য হয়। অক্ষশক্তির জয় আমাদের কাম্য না, কিন্তু ইংরেজকে বোঝানো দরকার যে, ভারতবর্ষকে পরাধীন রেখে যুদ্ধে ভারতবাসীর সহযোগিতা আশা করা বাতুলতা। আর ভারতবর্ষের সহযোগিতা ছাড়া জাপান-জার্মানিকে হারানো সম্ভব না। সুতরাং আন্দোলনের একটি প্রধান কাজ হবে নাশকতামূলক। সংবাদ চলাচল, রসদ সরবরাহ আর যাতায়াতের ব্যবস্থা বানচাল করতে হবে। নিরঙ্কুশ অহিংসার পথে এইসব লক্ষ্যে পৌঁছন সম্ভব না। সুতরাং শুধু ব্যক্তিমানুষের প্রতি হিংসাত্মক কাজই নিষিদ্ধ, অন্য কোনও ক্ষেত্রে নয়।
এই ইস্তাহার হাতে পৌঁছবার দু’দিন পর বরিশাল রওনা হই। খুলনায় স্টিমারে উঠে দেখি অনেক পরিচিত লোকই দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁদের অনেকের কাছেই ওই ইস্তাহার পৌঁছেছে, যদিও এ নিয়ে সামান্য যা আলোচনা হচ্ছে, তা নিতান্তই ফিসফিস করে। কিন্তু, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী—এ ছাড়া কোনও আলোচনা নেই। ‘৪২-এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জাতীয়তাবাদী ভারতবাসীর মনে এক অসম্ভব আশার সঞ্চার হয়েছিল। চার্চিল যতই তড়পান, ইংরেজ কর্তৃপক্ষ যে বেশ বিচলিত হয়েছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ এখন পাওয়া গেছে। কিন্তু কাণ্ডারীহীন স্বতঃস্ফূর্ত ওই বিপ্লবের পথে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ছিল মনে হয় না। যে-ন্যুনতম সংগঠন এবং বৈপ্লবিক পরিকল্পনা ছাড়া আন্দোলন সফল হতে পারে না, নেতৃবৃন্দ এবং কংগ্রেস তার ব্যবস্থা করেননি।
বরিশাল পৌঁছে শুনলাম– কর্মী এবং নেতারা অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু অনেকেই এখনও জেলের বাইরে। সতীনদা কলকাতায় গ্রেফতার হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে আছেন, সুতরাং বরিশালে আন্দোলনে নেতৃত্ব করার জন্য আছেন শুধু দ্বিতীয় সারির স্থানীয় নেতারা আর আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বেশ কিছু পুরনো কংগ্রেস ভলান্টিয়ার। কিন্তু নতুন আন্দোলনের কার্যক্রম যে-রূপ নিচ্ছে, তার সঙ্গে এঁদের কারওই পরিচয় নেই। ফলে এখন পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি আর পুলিশও এই নিষ্ক্রিয়তা দেখে হাত গুটিয়ে আছে, অকারণে ভীমরুলের চাকে খোঁচা দিচ্ছে না। এই অবস্থায় পুরনো কর্মীরা আমার বাবার কাছে এলেন। কারণ জেলের বাইরে যেসব স্থানীয় নেতা আছেন এবং আন্দোলনে যোগ দিতে অনিচ্ছুক নন, তাঁদের মধ্যে উনিই বয়োজ্যেষ্ঠ। আমাদের বৈঠকখানা ঘরে মিটিং বসল। সেখানে জনা পঞ্চাশেক কর্মী এলেন। আলোচনায় দেখা গেল যে, রেলগাড়ি বর্জিত বরিশাল জেলায় যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়া দুইভাবে সম্ভব। প্রথম, ডাক এবং তার বিভাগের কাজ বিপর্যস্ত করা। দ্বিতীয় পথ, বালাম চাল আর মুসুরির ডালের দেশ বরিশাল জেলায় সরকার যে ভরসা করে আছে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, সেই গুড়ে যথাসম্ভব বালি ঢালা। এই দুই কাজের জন্য প্রস্তুতি গোপনে করতে হবে এবং বিশেষ বিশেষ কাজ পাঁচ-ছ’জনের ছোট ছোট দলের উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রাথমিক সংগঠনের কাজটা অভিজ্ঞ কর্মীরা করবেন।
আমাদের বাড়ির এই মিটিং থেকে বাড়ি ফেরার পথেই কয়েকজন অভিজ্ঞ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মিটিংয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হন। তখন এবং এর পরেও দেখেছি, ওই জাতীয় রাজনৈতিক অবস্থায় মানুষ কিছুটা ভারসাম্য হারায়। আমাদের বাড়িতে ঢোকার রাস্তার একপাশে পুলিশ কোর্ট। সেখানে সব সময়ই থাকি এবং সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকত। আন্দোলনের সময় দিনের আলোয় জনা পঞ্চাশেক সুপরিচিত রাজনৈতিক কর্মী আমাদের বাড়িতে আসছেন, এ তথ্য পুলিশের কাছে গোপন থাকার কোনও কারণ নেই। তাছাড়া মিটিংয়ে ওদের গুপ্তচর দু একজন থাকাও খুবই সম্ভব। কিন্তু যেই গ্রেফতারের খবর শহরে ছড়াতে লাগল, অমনি আলোচনা শুরু হলকার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ব্যাপারটা ঘটছে। একজন অনেকবার জেলখাটা রাজনৈতিক কর্মী প্রথম মিটিং থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। সকলের সন্দেহ পড়ল তাঁর উপর। দুঃখবরণই যদি রাজনৈতিক সততার প্রমাণ হয় তবে ওই লোকটি এবং ওর পরিবারের মানুষদের পাওয়া সোনার মেডেলগুলিতে কোনও খাদ ছিল না। কিন্তু পরে যখন সবাই জেলের একই ওয়ার্ডে বন্দি ছিলাম, তখন দেখতাম এই হতভাগ্য মানুষটির সঙ্গে কেউই কথা বলত না। যাঁরা ওকে একঘরে করেছেন, তাঁদের যদি জিজ্ঞেস করতাম যে ও যদি টিকটিকিই হবে তবে ওকেও জেলে রেখেছে কেন? উত্তর হত, “এটা পুলিশের অতি পুরনো চাল। প্রথম কথা ও আমাদের উপর নজর রাখবে। তাছাড়া, ওকে যাতে আমরা সন্দেহ না করি এটা তারও চেষ্টা। নিশ্চয়ই পুলিশ ওর পরিবারকে মোটা টাকা দিচ্ছে। জেল থেকে ছাড়া পেলে ওকেও ভালভাবে পুষিয়ে দেবে।” জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই হতদরিদ্র অকৃতদার মানুষটির বাড়ির লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মোটা কেন, কোনও টাকারই মুখ ওঁরা কখনও দেখেছেন, তার প্রমাণ কিছু চোখে পড়েনি। এ নিয়ে বিপ্লবপন্থী কর্মী দু-একজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুনেছি, “আরে ওসব বুর্জোয়া ভাবালুতা ছাড়। রাজনৈতিক আন্দোলনে অমন দু-দশটা লোক বেঘোরে মারা পড়েই। ওটা রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ার মতো ব্যাপার। ওসব ভাবতে বসলে আন্দোলন করা চলে না।”
যতদূর জানি, বরিশাল শহরে আগস্ট আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ঘটনা একটিই ঘটেছিল। যুদ্ধ প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসাবে গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল সংগ্রহ করা হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে যে-মিটিং বসে সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এই চাল জাহাজে তুলে কলকাতা নেওয়ার চেষ্টা হলে বাধা দেওয়া হবে। চালের বস্তা রাস্তায় ফেলে তখনই বিলি করে দেওয়া হবে।
এই পরিকল্পনা খুব সুচিন্তিত ছিল না। কারণ সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে যে জনবল এবং সংগঠন দরকার, তা আমাদের ছিল না। আর রাস্তায় চালের বস্তা কেটে লুঠ করানোও অসম্ভব হত। পুলিশ নিশ্চেষ্ট থাকত না। পরিকল্পনাটি আমাদের কর্মীদের অনভিজ্ঞতারই পরিচয় দিচ্ছিল মাত্র। কার্যত কিছুই ঘটল না। যে সব কর্মীরা পুলিশের হাত এড়িয়ে জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা কিছু ছেলেছোঁকরা একত্র করে রাস্তায় জলুস নামালেন। উদ্দেশ্য, এরা জাহাজঘাটায় গিয়ে জেটি থেকে চাল লুঠ করবে। কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জের সামনে শোভাযাত্রাকারীরা দাঁড়াতে পারল না, কয়েক মিনিটের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। লাঠির ঘায়ে কিছু ছেলের হাত-পা বা মাথা ভাঙল। বাকি কিছু গ্রেফতার হল।
এই ঘটনার দু-একদিন পর পুলিশ এক অদ্ভুত চাল চালে। ওরা বাবাকে গ্রেফতার না করে অনির্দিষ্ট কাল গৃহবন্দি থাকার হুকুম নিয়ে আসে। দাদা কাগজটি পড়ে বললে, “এই কাগজে বর্ণিত লোক এখানে থাকেন না”। কারণ হুকুম যাঁর নামে এসেছিল, তিনি হচ্ছেন বিনোদবিহারী রায়চৌধুরীর পুত্র, অমিয়কুমার রায়চৌধুরী। আমার ঠাকুর্দার নাম বিনোদকুমার রায়চৌধুরী। পুলিশ বাধ্য হয়ে হুকুমনামা ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই রাত্রেই কোশ নৌকো করে আমরা কীর্তিপাশা চলে গেলাম। সেখানে বাবা রায়তদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যাতে তারা চাল লুকিয়ে ফেলে সরকারের সরবরাহ প্রচেষ্টা বানচাল করে। এ কাজে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুঁকি ছিল না। সুতরাং কিছুটা সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কার্যত এ চেষ্টাও বিফল হয়, কারণ গ্রামাঞ্চলে আমাদের কোনও সংগঠন বা কর্মী ছিল না। আমাদের শহরের বাড়ির দরজায় অন্তরীণ থাকার হুকুমনামা পুলিশ ফের লটকে দিয়ে যায়। এবার ঠাকুর্দার নাম সঠিক লেখা ছিল। এক মাস পর পুলিশ কীর্তিপাশায় এসে বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। ওঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হল–অভিযোগ, সরকারের আদেশ অমান্য করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া। মামলা টিকল না কারণ বিচারক বললেন, ওঁর অনুপস্থিতিতে হুকুমনামা টাঙিয়ে দেওয়া হয়, আর উনি তখন কোথায় ছিলেন, তা পুলিশের অজানা ছিল না। যে-দুঃসাহসী বিচারক সরকারের আনা অভিযোগ নাকচ করেন, তার নাম আবুল কাসেম খান, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সামসুল হুদার বড় ভাই। পরবর্তী কালে ইনি পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান শিল্পপতি। ফৌজদারি মামলা নাকচ হয়ে গেলে বাবা ভারতরক্ষা আইন অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজবন্দি হলেন।
নেতৃস্থানীয় সবাই গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর আন্দোলন সজীব রাখার দায়িত্ব নিল নেহাতই অর্বাচীন কিছু ছেলে। আমার দাদার বয়স তখন আঠারো-উনিশ। অত্যন্ত রোমান্টিক প্রকৃতির মানুষটি এবার আন্দোলনে এক প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করলেন। কোথা থেকে জানি না, বেশ কিছু ইস্কুল-কলেজের খুবই অল্পবয়স্ক ছেলে একটু রাত হলে আমাদের বাড়িতে এসে জড়ো হত। তারপর রাত বারোটা-একটা অবধি কর্তব্যকর্ম নিয়ে আলোচনা চলত। প্রাদেশিক বিপ্লবী কমিটির ইস্তাহার বলে বর্ণিত যেসব কাগজ আমাদের হাতে আসত, তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজের চেষ্টা হত। কাজ প্রধানত তিনটি : পোস্টাফিস পোড়ান, টেলিগ্রাফের তার কেটে দেওয়া এবং চাষিদের বুঝিয়ে সরকারি খাদ্যসংগ্রহের প্রচেষ্টা বানচাল করা। দাদা গ্রামে গ্রামে ঘুরে এইসব পরিকল্পনা ফলপ্রসু করার চেষ্টা করতেন। আমার কাজ ছিল বিপ্লবপ্রচেষ্টা চালু রাখার জন্য অর্থসংগ্রহ। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, টাকা দিতে কেউ আপত্তি করতেন না। আর দাতাদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলেন সরকারি কর্মচারী, বিশেষ করে দুজন আই. সি. এস. অফিসার। ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে এঁদের বিদ্বেষ কতটা তীব্র ছিল, রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হলেই তা বোঝা যেত। একজন। বিখ্যাত সুপণ্ডিত আই. সি. এস অফিসার আমাকে বলেন, জাপানিরা শত্রুভাবেই আসছে এ কথা ধরে নেওয়ার সপক্ষে কোনও যুক্তি নেই। কারণ ওদের নিজেদের স্বার্থেই ভারতবর্ষের বন্ধুত্ব ওদের প্রয়োজন হবে। কিন্তু সামান্য লোকবল নিয়ে আর কোনও সংগঠন ছাড়া আন্দোলন চালু রাখা সম্ভব ছিল না।
দু-চারটে, পোস্টাফিস পুড়ল, দু-চার জায়গায় টেলিগ্রাফের তার কাটা হল, কোথাও কোথাও চাষিরা নিজেদের স্বার্থেই ধানচাল সরকারকে দিল না। কিন্তু বরিশাল জেলায় আন্দোলন যুদ্ধপ্রচেষ্টায় কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। যুক্ত বাংলার কয়েকটি অঞ্চলে আন্দোলন সত্যিতেই জোরদার হয়েছিল ঠিকই। এ প্রসঙ্গে মেদিনীপুর, আরামবাগ, বালুরঘাটের কথা প্রথমেই মনে পড়ে। কিন্তু সেইসব জায়গায় আগের থেকেই সংগঠনের ঐতিহ্য ছিল—বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। ত্রিশের দশক থেকে সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির চাপে পূর্ববঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন স্কুলে পড়ি তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কোনও দলকে সক্রিয়ভাবে কর্মী সংগ্রহ বা তাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের চেষ্টা করতে দেখিনি। এদিক থেকে যেসব প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল তাদের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানকার সুপরিচালিত ভলান্টিয়ার বাহিনীগুলি ‘৪২ সালে নেতৃত্বগ্রহণ করে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানেও তাদের অবদান ছিল। কিন্তু বরিশালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জনগণের উপস্থিতি আমি দেখিনি, যদিও ওই অঞ্চলে ত্রিশের দশকে আইন অমান্য আন্দোলনেও হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের চাষিরাই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ভেজা তুবড়ির মতো বরিশালে ‘৪২-এর আন্দোলন একটু জ্বলে উঠেই নিভে গেল। ডিসেম্বরের পর ওই জেলায় আর কোনও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা হয়নি। তার আগেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে পঙ্গু করতে পারে এমন কিছু ঘটেনি। অক্টোবর মাসে কোনও গ্রামাঞ্চল থেকে ফেরার পথে স্টিমার ঘাটে দাদাকে গ্রেফতার করে। তার এক মাস পরে বাড়ি থেকে আমাকে। থানা থেকে গোয়েন্দা দফতরের কর্তার অফিসে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ইংরেজ পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের অফিস। সাহেবটি আমাকে মুচলেকা নিয়ে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁর দয়ার দান গ্রহণ না করায়, পুলিশ হাজতে ফিরে গেলাম। সেখানে দুটি ফৌজদারি মামলায় আমাকে আসামি করা হল। কোনও গ্রামে তার কাটা হয়েছিল। অভিযোগ—আমি অপরাধীদের একজন। দ্বিতীয় অভিযোগ—চুরি। কী চুরি করেছি জানতে চাইলে সদুত্তর পেলাম—তার। আমরা নাকি তার কেটে চড়া দরে কালোবাজারিদের কাছে বিক্রি করেছি। আসলে এই রকম সত্যি-মিথ্যা কতগুলি মামলা পুলিশের খাতায় লেখা থাকত। তার কোনও একটার সঙ্গে গ্রেফতার করা ছেলেদের জুড়ে দেওয়া হত। পনেরো দিন অন্তর আমাদের কোর্টে হাজির করে পুলিশ আরও সময় চেয়ে নিত। তিন মাসের মধ্যে মামলা রুজু করতে না পারলে হয় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিত, অথবা বন্দিটি বিপজ্জনক লোক বলে সিদ্ধান্ত হলে তাকে ভারতরক্ষা আইনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি রাখা হত।
তার কাটা এবং চুরির মামলার আসামি হিসাবে আমাকে জেল হাজতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আবিষ্কার করলাম যে, শাস্তির ব্যাপারে ইংরেজ সরকার শ্রেণিসচেতনতা ত্যাগ করেননি। বন্দিদের প্রধানত দুটি শ্রেণি—বি এবং সি। সি-রা ভূমিশয্যায় মৎকুন-অধ্যুষিত কম্বলে শয়ন এবং অখাদ্য ভক্ষণ করে। আর বি শ্রেণির বন্দিরা খট্টাঙ্গশায়ী, আহারাদি—প্রচুর চুরি সত্ত্বেও–ভদ্রজনোচিত।
সদাশয় সরকার বাহাদুরের কল্পনায় ‘এ’ নামে একটি শ্রেণিও ছিল বটে, কিন্তু আমরা দেখলাম ও ব্যাপারটা জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের খেয়ালখুশির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ তিনি ইচ্ছে করলে এ-ক্লাস বন্দিকে বাড়ি থেকে খাবার আনার অনুমতি দিয়ে তার এ-ক্লাসত্বর সম্মান রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু এই উদারতা দেখিয়ে কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার কোনও কারণ তিনি খুঁজে পাননি। ফলে আমার বাবা নামেই এ-ক্লাস হলেন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব তার উদার নীতির প্রমাণস্বরূপ বাড়ি থেকে বাবার জন্য কিছুটা দুধ পাঠাবার অনুমতি দিয়ে পরে শাস্তি হিসেবে হুকুমটি রদ করেন। কিন্তু সত্যিকার রহস্য ছিল শ্রেণিবিভাগের মূল নীতির ভিত্তিতে। এ বা বি ক্লাসের বন্দি হতেন যাঁদের পাকা বাড়িতে বাস, তারাই। আর যেসব হতভাগ্য মাটি, টিন বা দৰ্মার বেড়ায় তৈরি বাড়িতে থাকত, তাদের জন্য সি ক্লাস নির্দিষ্ট ছিল। খুবই ন্যায্য বিচার। তবে বরিশালে দরিদ্র মানুষও ছারপোকার সঙ্গে সহবাসে অভ্যস্ত ছিল না। জেলার জনসংখ্যার ইতিহাস আলোচনা করলে এ কথার সত্যতা প্রমাণ হবে। তা ছাড়া ওখানকার দরিদ্রতম মানুষও পচা ভাত খেতে অভ্যস্ত ছিল না। এ কথার প্রাসঙ্গিকতা পরে আলোচনা করব। এবার আসল রহস্যে আসি। বন্দি বা আসামির বাড়ি কাঁচা না পাকা সে তথ্য পুলিশের জানা না থাকলে, খোঁজ নিয়ে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নিয়ম ছিল। যতদূর জানি বাবা, আমি এবং দাদা একই বাড়িতে বাস করতাম। এবং এ ব্যাপারটা সরকার বা তার পুলিশের কাছে গোপন ছিল—এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাবা যেদিন গ্রেফতার হন সেদিনই এ-ক্লাসের বন্দি হন। আমি কোথায় থাকতাম তা আবিষ্কার করতে এক মাস লেগেছিল। আর দাদার বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের অভিযোগে মামলা তৈরির চেষ্টা চলছিল। ফলে সে কোথায় থাকত নির্ধারণ করতে সময় লেগেছিল ছ’মাস। আসলে যা আপাতদৃষ্টিতে পুলিশের দীর্ঘসূত্রিতা বলে মনে হয়, তা কোথাও সত্যিই গাফিলতি, আর কোথাও চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টার ফল।
জেল হাজতে প্রথম রাত্রের অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। সহবন্দিরা দেখলাম সবাই আমারই বয়সী, কারণ ওটা ছিল জুভেনাইল ওয়ার্ড। প্রথম চমক খেলাম যখন খাবার নিয়ে এল তার বিকট দুর্গন্ধে। ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। বাজার থেকে জেলবাসীদের খাওয়ার জন্য চাল না কিনে ধান কিনে তা থেকে চাল তৈরি করলে সস্তা হয়, সুতরাং জেল কর্তৃপক্ষ সস্তার পথ নেবেন এটা কিছু অযৌক্তিক না। কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে ছিল এই কারণে যে, ধান আধা-সেদ্ধ করে সিদ্ধ চাল তৈরি করার পদ্ধতি জানা না থাকলে সেদ্ধ ধান ভেনে চাল বের করার আগেই তা পচে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। সি-ক্লাসবাসীদের যে-চাল খাওয়ানো হত তা এই পচা ধানের চাল, মানুষ কেন গোরু-মোষেরও খাওয়ার উপযুক্ত না। তা ছাড়া চালের অভাব ঘটতে শুরু হয়েছে এই অজুহাতে রাত্রে আটার রুটি দেওয়া হত। এমনিতেই পূর্ববঙ্গের মানুষ রুটি খেতে পারে না। তার উপরে সে রুটি তুলনাহীন। পাতে পাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ দুটি রুটি দু হাতে নিয়ে ঘষতে হত। ধুলো, বালি, মাটি, বিচিত্র সব খনিজ পদার্থ ওই ঘষাঘষির ফলে থালায় পড়ত। ঘষাপর্ব শেষ হলে রুটি দুটি বেশ ভাল করে কচলে কচলে ধুতে হত। কিন্তু আটা মাখার সময় যে সব অভক্ষ্য তার ভিতরে প্রবেশ করেছে তা নিষ্কাশনের টেকনিক কারও জানা ছিল না। ফলে ওই রুটি সত্যিতে খাওয়ার ক্ষমতা অল্প লোকেরই ছিল। জেল আইনের উদার নীতি অনুযায়ী সি-ক্লাসের হতভাগ্যদের জন্যও দৈনিক এক পোয়া তরকারি বরাদ্দ ছিল। তাই দিনের বেলা শুধু ডাল (ওরফে জল) আর ভাত বরাদ্দ থাকলেও, রাত্রে ডালের সঙ্গে তরকারি আসত। তবে সঙ্গে না, ডালের ভিতরে—মাথাপিছু পোয়াখানেকের একটি চাকা লাউ বা ছাঁচি কুমড়ো। ও বস্তু সিদ্ধ হওয়ার কোনও উপায় ছিল না। ফলে কারও ভোগে লাগত না। আর বস্তুটি যদি কচুর ডেলা হত, তা হলে তার সঙ্গগুণে ডালটাও বিষাক্ত হয়ে উঠত, মুখে দিলে গাল-গলা ফুলে ঢোল হয়ে যেত। ওই অখাদ্য খেয়ে সি-ক্লাসিরা সবাই সর্বক্ষণ নানারকম পেটের অসুখে ভুগত। আর এই হতভাগ্যদের জন্য দুটি ওষুধের বাঁধা ব্যবস্থা ছিল। উদরঘটিত যে কোনও ব্যারামেরই একমাত্র চিকিৎসা কাষ্ঠতৈল অর্থাৎ ক্যাস্টর অয়েল। আর যে-কোনও চর্মঘটিত ব্যাধিরই একমাত্র চিকিৎসা ছিল নারকেলের ছোবড়া দিয়ে শরীরের রোগগ্রস্ত অংশটি বেশ উত্তম রূপে ঘষে নিয়ে ঘটি ঘটি আইওডিন ঢালা। এই নারকীয় চিকিৎসার ভয়ে রুগিরা সহজে হাসপাতালে যেত না। বোধ হয় ওইটাই চিকিৎসার উদ্দেশ্য ছিল। আর প্রাত্যহিক চিকিৎসার সময় হাসপাতাল থেকে যে-আর্তনাদ শোনা যেত, বোধ হয় রৌরব নরকের বাইরে সেরকম সচরাচর শোনা যায় না। একদিনের একটা দৃশ্য কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। আমি তখন নিজেই হাসপাতালে। দেখলাম একটি বিবস্ত্র মানুষ চিত হয়ে শুয়ে আছে। দুজন দশাসই লোক তাকে চেপে ধরে রেখেছে। ব্যাধির প্রকোপে তার শরীর বীভৎসভাবে বিকৃত। কিন্তু তার উপরও দেখলাম নারকেলের ছোবড়া আর আইওডিন চিকিৎসা চলছে। দৃশ্যটা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
সি-ক্লাসে দিন চারেক থাকার পর বেশ রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি ভদ্রসন্তান, সুতরাং আমার ক্ষেত্রে কাষ্ঠতৈল-আইওডিন চিকিৎসার ব্যবস্থা হল না। জেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হলাম এবং সেখানে খাটেপাটেই শোয়ার ব্যবস্থা হল। এমনকী রক্ত পরীক্ষাও হল। শুনলাম কামলা বা জন্ডিস হয়েছে। মাসে এক দিন সিভিল সার্জন জেল হাসপাতাল পরিদর্শন করতে আসতেন। তিনি ব্যবস্থা দিয়ে গেলেন প্রচুর পরিমাণে ঠান্ডা জল, ডাবের জল, তরমুজ, পেঁপে ইত্যাদি ঠান্ডা ফল খেতে হবে। অকৃতজ্ঞ হতে চাই না। স্বীকার করতেই হবে জেল কর্তৃপক্ষ ঠান্ডা জলের ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য করেননি।
আমার তিন মাস কারাবাস থেকে আমি একটি জ্ঞানই অর্জন করি যে, আমরা আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষকে সত্যিই মানুষ বলে মনে করি না। এই জ্ঞান অর্জন করার জন্য অবশ্যি জেলে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কথাটার শত সহস্র প্রমাণ সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে। কিন্তু জেলে অত্যন্ত কাছে থেকে প্রতিদিন সহায়হীন মানুষের উপর যে ধরনের অকথ্য অত্যাচার হতে দেখেছি, তার তুলনা বাইরের জগতে অন্তত আমার চোখে পড়েনি। শুনেছি কৌলীন্য প্রথার যখন সংস্কার হয় তখন যেসব কুলীনদের বংশে আচারগত দোষের ভার বেশি জমেছিল, এক ধরনের শ্রেণিবিপ্লব ঘটিয়ে তাদেরই কৌলীন্যমর্যাদা তুলনায় উঁচু বলে স্থির হয়। জেলে ফৌজদারি মামলায় যারা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের এক উলটপুরাণ চালু ছিল।
যারা ডাকাতি খুন জখম ধর্ষণ ইত্যাদি বাঘা বাঘা কুকার্য করে জেলে এসেছিল, তারা ওখানে নানা অর্থেই সম্মানিত ব্যক্তি। প্রথম কথা, কুকর্মেরও শ্রেণিভেদ আছে। পকেট মারায় কোনও আভিজাত্য নেই কিন্তু নরহত্যা জাতীয় বড় বড় অপরাধের মধ্যে যে-পৌরুষ আছে তা অস্বীকার করার উপায় কী? তাই জেলের ভিতর ছিচকে চোরকেও যদি জিগ্যেস করা যেত কী জন্য তার শাস্তি হয়েছে, তবে সে বুক ফুলিয়ে উত্তর দিত ‘র্যাপ’ অথবা ‘ডাকাইতি’। অপরাধীর শ্রেণিবিন্যাসের ব্যাপারে সরকারও এক অর্থে জাতিভেদের এই মাপকাঠি মেনে নিয়েছিল। যাদের জেলবাস দীর্ঘ মেয়াদের, ওখানকার ভাষায় তারা বি কেলাসি৷ এদের কাজ ছিল–যারা তুলনায় স্বল্প মেয়াদের আসামি তাদের কাজের তদারক করা। তদারকির প্রধান আয়ুধ মোটা চামড়ার বেল্ট, যা তারা ছিচকে আসামিদের উপর বেধড়ক ব্যবহার করত। তার উপর জেলের আইনকানুন কোনওভাবে লঙ্ঘন করলে তার জন্য আলাদা শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রোজ সকালেই দেখা যেত কিছু আসামিকে কোমরে দড়ি দিয়ে জেলের এক প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর সেদিক থেকে ঘণ্টাখানেক ধরে বিকট আর্তনাদ শোনা যেত। অভিজ্ঞ রাজবন্দিরা বলতেন “ও কিছু না। প্রাত্যহিক গাত্রসেবা হচ্ছে।” এক বিশেষ শ্রেণির আসামিদের জন্য গাত্রসেবার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। সমাজতত্ত্বঘটিত কোনও অজ্ঞাত কারণে আসামিদের মধ্যে মেথর জাতীয় লোক ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বেশ ক’জন লোক ওই কর্তব্যটি না করলে বাকি লোকদের পক্ষে জেলবাস অসম্ভব হত। সদাশয় সরকার ওই কাজ করতে যারা রাজি হবে তাদের জন্য ডবল রেশনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাথায় করে ময়লা বয়ে নিয়ে যেতে কেউ রাজি হত না। কিন্তু কারওকে তো রাজি হতেই হবে। সরকারি ব্যবস্থায় রাজি করানোর একটি পন্থাই জানা ছিল। কয়েকটি লোককে বেছে নিয়ে তারা মেথরের কাজ করতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত বেধড়ক চাবকানো হত। শুনেছি কেউ কেউ মাসখানেক চাবুক খাওয়ার পর ময়লা টানতে রাজি হত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা উচিত চাবকানোর কাজটা করত বি কেলাসিরা। বেশ মনপ্রাণ ঢেলেই করত।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলি। যেসব অনাচার অত্যাচারের কথা বললাম, ইংরেজের জেল ব্যবস্থাসংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে তার কোথাও কোনও উল্লেখ কেউ পাবে না। বোধ হয় এই জাতীয় কারণেই সরকারি দলিলপত্রের ভিত্তিতে লেখা ইংরেজ শাসনের ইতিহাস পড়লে শাসকশ্রেণিকে অনেক সময়ই এত শিশুর মতো নিষ্পাপ মনে হয়। তাঁরা তো ভাল ভাল নিয়মটিয়মই করেছিলেন। নেটিভ কর্মচারীরা সব ব্যাপারেই তাদের স্বভাবসিদ্ধ বর্বরতা প্রকাশ করবে, তা নিয়ে প্রভুদের দোষ দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত?
দশ-পনেরো দিন হাসপাতাল বাসের পর বি-ক্লাসভুক্ত হয়ে খাটেপাটে শোয়ার অধিকার পেলাম। মানে ততদিনে পুলিশ জেনে গেছে যে, আমিও পাকা বাড়ির বাসিন্দা। এখানে আর অর্বাচীনদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড নেই। দেখলাম শহরে রাজনৈতিক কর্মী যাদের চিনতাম তাদের এক বড় অংশই ওখানে জমা হয়েছে। দুই সারিতে বিশটি করে পাশাপাশি সব খাট পাতা। এমনকী মশারি অবধি আছে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা অনেকটা বন্দিরাই করেন। ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একঘেয়েমি ছাড়া অন্য কোনও কষ্ট নেই। জেলে থেকেই আই. এ পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেলাম। বাড়ি থেকে বইপত্র আনিয়ে পড়তে বসে গেলাম। বেশ স্বচ্ছন্দ জীবন আর কী!
পশুসংরক্ষক জেরাল্ড ডারেলের লেখায় পড়েছি যে, বন্দিদশায় প্রায় সব প্রাণীরই ব্যবহারে একটা অস্বাভাবিকতা আসে। মুক্ত জীবনে যেসব কাজ তারা কখনও করবে না, চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ার অনেক সময়ই তা করে। এই সাধারণ নিয়ম কি মানুষ নামক দ্বিপদ বানর জাতীয় প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? জেলে থাকার সময় কয়েকটি ঘটনায় এই প্রশ্ন বারবারই মনে হয়েছে। তার একটি উল্লেখ করি। কোনও অজ্ঞাত কারণে জেলে আহারের অনুষঙ্গ হিসাবে কাঁচা লঙ্কা বস্তুটি দুর্লভ ছিল। ভদ্র-অভদ্র সব বরিশালবাসীর কাছেই কাঁচালঙ্কাবিহীন আহার অনাহারেরই শামিল। একদিন দৈবগুণে আহার্যের সঙ্গে অল্প ক’টি কাঁচা লঙ্কা এসেছে দেখা গেল। ছেলেছোঁকরাদের তা নিয়ে কাড়াকাড়ি। একটি লঙ্কা গড়িয়ে এক খাটের নীচে আশ্রয় পেল। জনৈক প্রবীণ ভদ্রলোক ছোঁ মেরে সেটি সংগ্রহ করে সযত্নে লুকিয়ে রাখলেন। মানুষটি বহুবার জেলখাটা কংগ্রেসকর্মী, বড় ঘরের ছেলে, সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। কী ভেবে উনি একটি লঙ্কা সত্যি বলতে গেলে চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন তা এখনও আমার বুদ্ধির অগম্য রয়ে গেছে।
জেলের নিরুপদ্রব জীবনযাত্রায় হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে ছেদ পড়ল। কারাগারের স্বদেশি বাবুদের সঙ্গে সেপাইসান্ত্রীদের বেশ সদ্ভাব ছিল। এই সদ্ভাবের সুযোগ নিয়ে অনেকেই বাইরে চিঠিপত্র পাঠাতেন। মারাত্মক ষড়যন্ত্রমূলক কিছু না, সেন্সরের হাত এড়িয়ে নিতান্ত ব্যক্তিগত কথাবার্তা পরিবারের লোকদের জানানো আর কী! ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষের জানা ছিল এবং ওঁরা এটা বন্ধ করার উপায় খুঁজছিলেন। একটি ঘটনার ফলে ওদের উদ্দেশ্য সফল হল। তা থেকে আমাদের ধারণা হয় যে, ব্যাপারটা ওদের চক্রান্তের ফল। এই সিদ্ধান্তটা সম্ভবত ঠিক ছিল না। কিন্তু ঘটনার পর ওদের কার্যকলাপ দেখে এ রকম সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিকই মনে হয়েছে।
ঘটনাটি এই। জুভেনাইল ওয়ার্ডে কিছু রাজনৈতিক বন্দি রয়েই গিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে যে দু-চারটে পোস্টাফিসে আগুন লাগানো বা টেলিগ্রাফের তার কাটার ঘটনা ঘটে, এরা তার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। সুতরাং এদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া চলে না। এদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে পুলিশ অন্তত দু-চারটে মামলায় শাস্তির হুকুম বার করার জন্য ব্যর্থ। তা ছাড়া এরা সত্যিই গরিব ঘরের ছেলে, কঁচা বাড়ির বাসিন্দা। অতএব এদের ক্ষেত্রে জেল হাজত মানে সি-ক্লাস—মৎকুনসহবাস আর অখাদ্য ভক্ষণ। কিন্তু এদের অফুরন্ত ফুর্তিতে তা সত্ত্বেও কোনও ভাটা পড়ার লক্ষণ দেখা যায়নি। ওয়ার্ডারদের সঙ্গে ওদের দহরম-মহরম বেড়েই চলছিল। একদিন গোলমালটা বাধল তার আতিশয্য ঘটায়। এক গুলিশোর ওয়ার্ডার বালখিল্যদের তার হুইসলটা দেখিয়ে শাসায় “এই, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই বাঁশিটি বাজাব। আর যদি ওটা বাজাই তো পুলিশ এসে তোদের বেধড়ক পেটাবে।” এই কথার পর হুইসলটা নিয়ে টানাটানি শুরু হয় এবং অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে গুলিখোর হুইসলে ফু দেয়। ব্যস, তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। টংটং করে পাগলা ঘন্টি বেজে উঠল। বেশ কিছু পুলিশ লাঠি আর বন্দুক হাতে মার্চ করে জেলের ভিতর ঢুকে এল। তখন বিকেল পাঁচটা নাগাদ, বন্দিদের জেলের ভিতরে খোলা জায়গায় বেড়াবার সময়। এঁদের মধ্যে যাঁরা এ জাতীয় ঘটনা আগেও দেখেছেন, তারা বললেন, “সবাই নিজের নিজের ওয়ার্ডে ফিরে যাও।” ওয়ার্ডে সবাই হাঁটুতে মাথা গুঁজে মণ্ডলাকারে বসলাম। যাঁদের শরীর কিছুটা শক্তপোক্ত, তারা বাইরের দিকে বসলেন, যাতে প্রহারের ধকলটা তাদের উপর দিয়েই যায়। মণ্ডলীর ভিতরে বসলাম আমরা যারা দুর্বলশরীর, নিতান্ত অল্পবয়স্ক আর বয়োবৃদ্ধ। সমস্ত ব্যবস্থাটা মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘটে গেল। একটু পরেই পুলিশ আর বি-কেলাসি ওয়ার্ডারদের প্রবেশ। লাঠি আর চামড়ার মোটা বেল্ট দিয়ে প্রচণ্ড মার শুরু হয়ে গেল। অল্প কয়েক মিনিটের ব্যাপার। পুলিশ চলে গেলে দেখা গেল বেশ কয়েক জনের মাথা ফেটে অঝোরে রক্ত পড়ছে, কেউ কেউ মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে স্ট্রেচার সহ ওয়ার্ডাররা এসে যারা গুরুতর রকমের জখম হয়েছিল তাদের নিয়ে গেল।
তারপর যা ঘটল তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। জেলের ভুড়িম্মান সুপারিন্টেন্ডেন্ট পরদিন হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এলেন। করুণায় লোকটা প্রায় বিগলিত হবার দশা। ঠোঁট ছুঁচলো করে মুখে চুক চুক ধ্বনি, “আহাহা, আপনার তো বড় লেগেছে। কেন যে আপনারা ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে পুলিশের সঙ্গে লাগতে গেলেন! জেলের এই উঁচু উঁচু দেওয়াল, এ ডিঙিয়ে পালানো কি সম্ভব? পুলিশরা ত বোঝেনই অশিক্ষিত মানুষ। ওদের আপনারা আক্রমণ করলে ওরা যে মারধর করবে এ তো জানা কথা। মেরে যে ফেলেনি এই আমাদের ভাগ্য। ভাবুন দেখি সত্যি কেউ মারা গেলে কী দুঃখের কথা হত। আহাহা!” যাদের মাথা ফেটেছিল তাঁদের একজন এবার বেশ হাসিমুখে বিছানায় উঠে বসলেন। তার পর দ্বার্থহীন বরিশালি ভাষায় যা বললেন তা কতকটা নিম্নরূপ, “ক্যান হারামজাদা, তুমি মরলে তো হগলেই খুশি হইত। হুয়ার মরছে দেইখখা সোয়াস্তির নিশ্বাস ফেলাইয়া তোমার বউ আরেকডা নিকা করতে পারত। হারামজাদা এহান থিয়া ভালয় ভালয় যাইতে হয় যাও, না হইলে ঘুষ খাইয়া খাইয়া যে ভুঁড়ি বাগাইছ, হেয়া কইলাম ফাসামু।” অকুস্থলে আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সদালাপের রকম দেখে একটু বিব্রত হয়ে বললেন, “ছিঃ, ভদ্রলোককে কী যা তা বলছ?” নিষ্পাপ শিশুর হাসি মুখে ফুটিয়ে বক্তা বললেন, “ভদ্দর লোক আপনে কোথায় দ্যাখলেন, অমিয়দা? ওইডা? ওইডা ত হুয়ারের বাচ্ছা!” এর পর সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্থানান্তরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলেন। এ কথা মানতেই হবে ওঁকে বরাহশাবক বলে বর্ণনা করাটা ঠিক হয়নি। কারণ ওঁর চরিত্র যা-ই হোক, আচারে তিনি নিষ্ঠাবান মুসলমান। না-পাক জানোয়ারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার কথাটা সাধারণ্যে আলোচনা করাটা নিতান্ত অনুচিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা মনে রেখে এই প্রসঙ্গে ছুঁচোটুচো জাতীয় অন্য কোনও নিম্নবর্গীয় এবং অবিতর্কিত প্রজাতির উল্লেখ করলে বলার কিছু থাকত না!
খেলা কিন্তু ওখানেই শেষ হল না। যারা যারা ভালমতো জখম হয়েছিল তাদের নামে ‘জেল রায়টিং’ অর্থাৎ জেলের ভিতর হাঙ্গামা করার অভিযোগ আনা হল। ইংরাজ শাসনে বে-আইনি কিছু ঘটার উপায় ছিল না, এ কথা সবাই জানে। যাবতীয় বজ্জাতি আইনসঙ্গতভাবেই করা হত। তাই যথা সময়ে বিচারক সরেজমিন তদন্ত করতে এলেন। এই উপলক্ষে চারিদিকে বেশ কিছু পাথর, বড় বড় গাছের ডাল চারি দিকে ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল। কিছু পুলিশ হাতেপায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরছে। পাথরের যা সাইজ, দেখে মনে হল ওগুলি হিমালয় পর্বত থেকে আনা। পলিমাটির দেশ বরিশালে পাথর জিনিসটা ঠিক রাস্তায় গড়াগড়ি যেত না। সুপারিন্টেন্ডেন্ট জানালেন, ওগুলি দিয়ে নাকি বেচারা পুলিশদের রাজবন্দিরা আক্রমণ করেছিল। স্বয়ং যুধিষ্ঠির কথাটা বললেন, অবিশ্বাস করি কী করে? না হলে ভাবতাম সাক্ষাৎ হনুমান ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই যে ও পাথর বা ডাল নাড়াচাড়া করে। অভিযুক্তরা এই প্রহসনে অংশগ্রহণ করেননি, নীরব ছিলেন। প্রত্যেকের দু-চার বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে গেল। তবে ‘৪৫ সনে যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় আলোচনা শুরু হল তখন আর সবার সঙ্গে এরাও ছাড়া পান।
অনেকদিন পরে আমাদের জেলার তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে অক্সফোর্ডে আমার দেখা হয়, সে কথায় পরে আসছি। ভদ্রলোককে এই জেল রায়ট ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করি। একটু ভেবে বললেন, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমরা রাজবন্দিরা জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলে। পুলিশরা খুব মার খেয়েছিল।” আমি বললাম, “তা হবে, মাথা কিন্তু ফেটেছিল রাজবন্দিদেরই, পুলিশের নয়।” একটু চুপ করে থেকে সাহেব বললেন, “জানো, এ কথা আমাকে কিন্তু কেউ কখনও বলেনি।” মনে মনে ভাবলাম, সাহেব, তোমাদের কি কখনও কেউ কিছু বলত?
হঠাৎ এক সকালবেলা জেল অফিসে ডাক পড়ল। গিয়ে শুনলাম, আমার খালাসের হুকুম হয়েছে, জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। কামলার প্রকোপে শরীর তখনও কাবু। বাড়ি পৌঁছে দেখি, গায়ে বেশ জ্বর। কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। দিন দশেকের মতো নিশ্চিন্ত। তখন আমাদের পরিবারের পুরানো বন্ধু ফজলুল হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি আমার ছাত্র বিক্রমজিত দের গবেষণার ফলে জানা গেছে যে, রাজনৈতিক ব্যাপারে তখন সমস্ত ক্ষমতা অল্প কয়েকজন ইংরেজ সিভিলিয়ানের কুক্ষিগত। তবে আমার মতো নির্বিষ চুনোপুটির ক্ষেত্রে ওঁর হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল। শুনলাম, ওঁর হুকুমেই আমার খালাস হয়েছে। কদিন পর হক সাহেব স্বয়ং এলেন। খাটের পাশে বসে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হাত মুঠো করে ছোট্ট একটি ঘুষি মারলেন। বললেন, “জেলে যাওয়ার লোক অনেক আছে। তোমার অন্য কাজ আছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করো।”
জেল থেকে বের হয়ে আর একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। আমাদের সম্পত্তি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসে চলে গেছে। বারো শরিকের সম্পত্তি পরস্পর সমঝোতা করে ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা যখন আর থাকত না, তখন ‘আমরা অপারগ, অপোগণ্ড’ এই বাহানায় সম্পত্তিটি সরকার বাহাদুরের হাতে তুলে দেওয়া হত, তাদের নিযুক্ত ম্যানেজার জমিদারিটি দেখাশোনা করতেন। ব্যাপারটা সম্মানের কিছু না। সম্পত্তি কারও একার না, বারো শরিক ওই রোজগারের উপর নির্ভরশীল। মনে হয়, সেই কারণে জেলে থাকার সময় বাবাও এই অপমানজনক ব্যবস্থায় রাজি হয়ে কাগজে সই দিয়েছিলেন। এখন এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেব জমিদারি থেকে আমাদের মাসোহারা বন্ধ করে দিয়েছেন। বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে মায়ের দিন চলছে। এই সময় আমার চেয়ে বয়সে সতেরো বছরের ছোট কনিষ্ঠ ভ্রাতা অপুর আবির্ভাব হল। ভিক্ষের দানে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠল। পিতৃবন্ধু সরকারি উকিল শরৎ গুহ মশায় বললেন, নতুন ম্যাজিস্ট্রেট পামার সাহেব পণ্ডিত ব্যক্তি, কেমব্রিজের র্যাংলার। জেলায় তোমার ভাল ছাত্র বলে খ্যাতি আছে। চলো তোমাকে পামারের কাছে নিয়ে যাই। উনি নিশ্চয়ই একটা সুব্যবস্থা করবেন। আমি বললাম, “বেল যা করেছে তা তো সম্পূর্ণ বে-আইনি। মামলা করলে কী হয়?” সরকারি উকিল ভদ্রলোক ম্যাজিস্ট্রেটের নামে মামলার কথায় একটু কুঁকড়ে গেলেন। বললেন, “যুদ্ধ চলছে। এখন অনেক আইন-কানুনই কার্যত শিকেয় তোলা। মামলায় জেতার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর এই সময় কোনও উকিল ব্যারিস্টার তোমার মামলা নেবে না”। অতএব পামারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত হল। সেখানে ভালই সংবর্ধনা পেলাম। লোকটা আমাকে বসতে বলল না। আমি নিজেই চেয়ার টেনে বসলাম। তারপর পামারের উক্তি সংক্ষিপ্ত এবং দ্ব্যর্থহীন : “তোমার বাবা পঞ্চম বাহিনীর লোক। তোমাদের যে আমরা ঘরছাড়া করিনি, সেটা নিতান্তই দয়াপরবশ হয়ে”। ব্যস, সাক্ষাৎকার সমাপ্ত। খুব ইচ্ছে হয়েছিল বলি, “আমার বাবা তো বুঝলাম ফিফথ কলাম। কিন্তু তোমার বাবা সত্যিতে কে এবং কোন প্রজাতির জীব, একটু খোঁজ নেবে?” কিন্তু এ ধরনের বীরত্ব দেখাবার বিলাসিতা তখন আমার নাগালের বাইরে।
অনেক বছর পরে অক্সফোর্ডে এক পার্টিতে মিসেস আর্চারের সঙ্গে পরিচয় হয়। উনি কোম্পানি আমলের চিত্রকলা বিষয়ে জগজ্জয়ী পণ্ডিত। ওঁর সঙ্গে ওঁর স্বামীও ছিলেন। তিনিও ভারতীয় চিত্রকলা এবং লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। মিস্টার আর্চার বললেন, “আমি কে জানো তো? ভারতবর্ষে আমার পরিচয় আর্চার দা বুচার!” আমি বললাম—ওঁর এই পরিচয় আমার জানা নেই। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন ভদ্রলোক। ‘৪২-এর আন্দোলনের গোড়ায় পটনা শহরে উনি কর্তাব্যক্তি। খবর পেলেন বিপ্লবীরা সেক্রেটারিয়েট ভবনের উপর যে-ইউনিয়ন জ্যাক উড়ছে সেটা নামাবার জন্য একটি দশ বছরের ছেলেকে ফ্ল্যাগপোস্টে তুলে দিয়েছে। পুলিশের কাছে খবর যে, ছেলেটি সফল হলে ব্যাপারটা এক বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্রোহের সঙ্কেত বলে ধরা হবে। ওকে থামানো বিশেষ প্রয়োজন। আর্চার স্বয়ং ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে চোঙা ফুঁকে ছেলেটিকে নেমে আসতে বললেন। সে ভ্রূক্ষেপও করল না। পুলিশ সাহেব আর্চারকে বললেন, “এখনও ওকে না থামালে সমূহ বিপদ হবে। আমরা সামলাতে পারব না।” নিরুপায় আর্চার গুলি করার হুকুম দিলেন। বাকিটা ওঁর জবানেই বলি। “ছোট্ট অনাহারক্লিষ্ট রোগা একটা শরীর ধনুকের মতো বেঁকে অনেক উঁচু থেকে মাটিতে পড়ল। মাথাটা থেতলে জায়গাটা রক্তে ভরে গেল। রোজ রাত্রে ওই দৃশ্যটা আমি স্বপ্নে দেখি আর সেই থেকে আমার নাম আর্চার দা বুচার।” রিটায়ার করার অল্প দিন পরে আর্চার আত্মহত্যা করেন। কেন তা কাউকে বলে যাননি। আমার ধারণা সাম্রাজ্য চালাতে যে। ধরনের হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার প্রয়োজন হয় ওই সংবেদনশীল মানুষটির চরিত্রে তার অভাব ছিল।
ওই পার্টিতেই মিসেস আর্চার আমাকে বললেন, “ও, তোমার বাড়ি বরিশাল। জানো, আমার ভাই এক সময় ওই জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।” বললাম, “তাকে আমি চিনি।” কী করে? “উনি আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন।” সবাই খুব হো হো করে হাসল। মাস দুই পর বেলের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই : “একটা গুজব শুনলাম, তোমাকে আমি জেলে দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা কী বলো তো!” পিতৃপরিচয় দিয়ে চিঠির উত্তর দিলাম। তার জবাবও এল প্রায় পত্রপাঠ, “আরে আরে তুমি অমিয়বাবুর ছেলে। তাই বলো!” যেন অমিয়বাবু ওঁর প্রাণের বন্ধু, জিগরি দোস্ত। সাহেবকে কলেজে খেতে এবং সেমিনারে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বক্তৃতা করতে নেমন্তন্ন করলাম। বুড়ো রোগা জীবনের ভারে ক্লিষ্ট একটি মানুষ সিনিয়ার কমন রুমে এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। ভারত সাম্রাজ্যের স্বর্গজাত চাকুরে, এক-একটি জেলায় কয়েক লক্ষ লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার বিয়ে ভেঙে গেছে, ছেলেপুলে হয়নি। বাতের রোগী। হাত পুড়িয়ে বেঁধে খেতে হয়। “বুড়ো হয়ে গেছি। এখন আর পেরে উঠি না।” মানুষটার জন্য কেমন যেন কষ্ট হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “জানো, তোমার বাবা লোক ভালই ছিলেন। কিন্তু কিছু মনে কোরো না, ওই সতীন সেন, ও লোকটা মোটেই সুবিধের ছিল না।” মুখে বললাম, ধন্যবাদ। আর মনে মনে ভাবলাম—সতীন সেনরা সুবিধের লোক হলে তোমাদের সাম্রাজ্য তো অক্ষয় হত।
বরিশালে বসেই আই. এ পরীক্ষা দিই। ফল বের হলে কলকাতায় চলে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলাম। জীবনের এক নতুন পর্ব শুরু হল।