১১. কবোষ্ণ জীবন

কবোষ্ণ জীবন

রুদ্রর সঙ্গে যখন জীবন দেওয়া নেওয়া ইত্যাদি সব সারা তখনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। চিঠিতেই আলাপ, চিঠিতেই প্রেম, চিঠিতেই যা কিছু খেলার ছলে ওই জীবন দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটি ঘটেছে। রুদ্র জানাল, ২৯ আশ্বিন তার জন্মদিন।

জন্মদিনে কি চাও বল। তুমি যা চাও, তাই দেব তোমাকে।

যা চাই তা দেওয়া কি তোমার পক্ষে সম্ভব হবে?

কেন হবে না?

হবে না আমি জানি।

বলেই দেখ না।

রুদ্র জানাল তার চাওয়া হবে খুবই কঠিন, কষ্টকর এবং দুঃসাধ্য কিছু।

পরের চিঠিতে তার প্রশ্ন, যা চাই তা কি তুমি সত্যিই দিতে পারবে?

আমি কাধঁ ঝাঁকিয়ে,বাহ পারব না কেন? বলেছি যখন দেব, দেবই বলি। চড়ুই পাখির মত দেখতে একটি অহঙ্কার আমার কাধঁ থেকে উড়ে নাকের ডগায় এসে বসে।

ধর আমি যদি তোমাকে চাই?

এ আর এমন কি! এইসব খুঁটিনাটি খুনসুঁটিতে ঠিক আছে যাও, এই আমাকেই আমি দিলাম।

আমার সঙ্গে প্রেম রুদ্রের শব্দের সঙ্গে, উপদ্রুত উপকূলের কবিতার সঙ্গে, তার চিঠির অক্ষরের সঙ্গে। পেছনের মানুষকে আমি চিনিনা, দেখিনি কোনওদিন কিন্তু কল্পনা করে নিই অপূর্ব এক সুদর্শন পুরুষ ওপারে আছে, যে পুরুষ কোনওদিন মিথ্যে বলে না, মানুষের সঙ্গে কোনও অন্যায় আচরণ করে না, যে উদার, অমায়িক, প্রাণবান, যে পুরুষ কোনও মেয়ের দিকে এ যাবৎ চোখ তুলে তাকায়নি ইত্যাদি একশ রকম গুণ। রুদ্র যখন জানাল ময়মনসিংহে আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে বারবারই গেলাস গেলাস ঠাণ্ডা জল খেতে হচ্ছিল, গলা বুক শুকিয়ে আসছিল। তা দেখা হবে কোথায়! মাসুদের বাড়ি, মাসুদও কবিতা লেখে, এমনিতে গানের ছেলে মাসুদ, ছোটদার বয়সে ছোট-বড় বিশাল বন্ধুমহলে সেও একজন, তার সঙ্গে রুদ্রর আলাপ ঢাকায়, টিএসসির আড্ডায়,তার বাড়িতেই উঠবে রুদ্র, সানকিপাড়ায়, আমাকে সকাল এগারোটায় ওখানে যেতে হবে। সকাল সাতটা থেকে ঘড়ি দেখছি, ঘড়ির কাঁটা যত এগারোটার দিকে এগোয়, তত আমার বুকের ধুকপুক ঘন হয়, দ্রুত হয়।

চোখে একটি কায়দার রোদচশমা পরা, যত না আধুনিক, দেখতে তার চেয়ে।জামা পাজামা পরনে, তখনও ওড়না পরি না, কলেজের ইউনিফর্মের লাল ওড়না ছাড়া আর কোনও ওড়নাও নেই বাড়িতে, চন্দনার মত ওড়নার ওপর আমারও বড় রাগ বলে ওড়না পরার বয়স হওয়ার পরও ওড়না না পরে ঘরেও থাকি, বাইরেও যাই। মাকে নানিবাড়ির কথা বলে লম্বা চুলের মেয়ে, চিকন চাকন মেয়ে, মেদ-নেই-মাংস-নেই-মেয়ে, পুকুরঅলা মাঠের ওপর ছোট্ট টিনের বাড়ির দিকে, মাসুদের বাড়ির দিকে। ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট ঘরে ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট বুকের সব ধুকপুক অকস্মাৎ থেমে গেল, যখন এক দাড়িঅলা, লম্বা চুলঅলা, লুঙ্গিপরা ছেলে বলল এসে যে সে রুদ্র। প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম দেখা লুঙ্গিতে! রুদ্র দেখতে তখন গাঁ থেকে আসা রিয়াজউদ্দিনের শালাগোছের কেউ। কালো চশমার আড়ালেও নামিয়ে ফেলি চোখ।

চশমাটা খোল। আমি তোমার চোখ দেখতে পাচ্ছি না।

যার সঙ্গে জীবন বিনিময় হয়ে গেছে সহস্র লিখিত বাক্যে, তার প্রথম বাক্য, মুখোমুখি প্রথম বসে।

রুদ্রর ভারি স্বর আমাকে চমকায়, চশমা খুলি, কিন্তু তাকিয়ে থাকি মাসুদের ঘরের আসবাবে।

নৈঃশব্দ।

কী কথা বলছ না যে!

চপ্পলে পায়ের আঙুল ঘসতে থাকি। বাঁ হাতের নখের কিনারে দেখার কিছু নেই, তবু চোখ ফেলে রাখি ওতে, যেন এ মুহূর্তে শুশ্রূষা না করলে নখটি পচে গলে খসে যাবে। রুদ্রর দিকে না তাকালেও স্পষ্ট বুঝি সে আমাকে দেখছে, আমার চুল চোখ নাক চিবুক সব দেখছে। একঘর অস্বস্তির মধ্যে মাসুদ চা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকে। আমি চায়ের কাপে, সোফার রং উঠে যাওয়া হাতলে, শোকেসের পুতুলে আর মাঝে মাঝে মাসুদে তাকিয়ে চা শেষ করেই উঠে দাঁড়াই।

কী ব্যাপার অস্থির হচ্ছ কেন? রুদ্র বলে। আবারও সেই ভারি স্বর।

আমার চোখ তখন জানালায়। গাছের পাতাগুলো কড়া সূর্যের তলে ঝিমোচ্ছে। পুকুরটিও ঝিমোচ্ছে, জলপোকারা গায়ে বসতেই মৃদু তরঙ্গ তুলে নেচে উঠছে জল।

রুদ্রও দাঁড়ায়, একটু একটু করে এগিয়ে আসে আমার দিকে, শরীরটির দিকে এক পলক চেয়ে বুঝি, লম্বায় আমার চেয়ে দু বিঘৎ খাটো সে। জাহাঙ্গীর নামে তাঁর এক বেটে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর দাদা প্রায়ই আস্ফালন করতেন, পুইট্যা লোক হইল খোদার দুশমন! বেঁটে তো বেঁটেই,তার ওপর রুদ্রর মখু ভর্তি দাড়ি মোচ, মোচ জিনিসটি দেখলেই আমার ঘেন্না হয়, দাড়ি দেখলে তো আরও।

আমি শরমে নাকি ভয়ে জানি না, খানিকটা সরে দাঁড়াই।

রুদ্র বলল এক্ষূনি যাবার কি হল?

নৈঃশব্দ।

চিঠিতে তো খুব কথা বল। এখন বলছ না যে!

নৈঃশব্দ।

ইস কী মুশকিল। তুমি কি বোবা নাকি!

বোবা মেয়ে জল আর জলপোকাদের প্রায় গা ঘেঁষে মাসুদের বাড়ির মাঠ পেরিয়ে চলে গেল।

যাবার আগে, দরজায় দাঁড়িয়ে, কাল আসছ তো! প্রশ্নের উত্তরে কেবল মাথা নেড়েছে হ্যাঁ আসছে।

গিয়েছি পরদিনও। পরদিনও ওর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি, আমার সমস্ত শরীরে, চুল থেকে পায়ের নখ অবদি, শরম। নিজেকে বারবার বলছি, কথা বল মেয়ে, কথা বল, ও তোর প্রেমিক। ওর সবকিছু তুই জানিস, ওর উপদ্রুত উপকূল পড়ে মখু স্ত করে ফেলেছিস, এবার দুটো তিনটে বাক্য বল। পারিনি। হয়নি।

রুদ্র চলে গেল। ঢাকা থেকে চিঠি লিখল, সে নাকি এমন মেয়ে দেখেনি। এমন লাজুক।

লাজুক মেয়ে উত্তরে বারো পাতার চিঠি পাঠাল। এই হয় আমার, লিখতে বল, আমার মত বাচাল আর কেউ নেই। কাছে এসো, এমন গুটিয়ে যাব যে ভাববে চিঠির মানুষটি নিশ্চয়ই অন্য কেউ! আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখার আমি আর রক্তমাংসের আমি যে আমি নানিবাড়ি আর অবকাশের চৌহদ্দির মধ্যে বেড়ে ওঠা, দুজন। একজন পেখম মেলে পাখনা মেলে আকাশে ওড়ে, আরেকজনের মাটির পৃথিবীতে, অন্ধকারে, বন্ধ ঘরে বাস, গায়ে পায়ে শেকল, মস্তিষ্কেও।

 

রুদ্র এরপর আরও দুবার এল ময়মনসিংহে। মাসুদের দু একজন বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে, এ শহরে সময় মন্দ কাটে না তার। রুদ্রর সঙ্গে দেখা হলে আমার কিন্তু সেই একই হাল, বুকের ধুকপুক এত দেখাতেও এমন হয়নি যে কিছু কমেছে। ভাই বন্ধুদের সঙ্গে আমি চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারি, কিন্তু প্রেমিকের সামনে পড়লে গা হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। মুখে তালা, চাবি অদৃশ্য।

রুদ্রর তো আসা হচ্ছে, কিন্তু দেখাটা হবে কোথায়, বসব কোথায় দুজন! মাসুদের বাড়িতে তার দাদারা আপত্তি তুলেছে, ও বাড়িতে আর নয়। শহরের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলে চেনা লোক কেউ দেখে ফেলবে আর মুহূর্তে বাবার কানে খবর চলে যাবে, সর্বনাশ! কোথায় তবে, ইশকুলের বান্ধবী নাদিরা আর মাহবুবার বাড়ি যাই, ওরা চা বিস্কুট খেতে দেয়, কিন্তু ফিসফিস করে বলে বাড়িতে নাকি জিজ্ঞেস করছে কে এই লোক! তখনও আমার বয়সী মেয়েদের কোনও প্রেমিক নিয়ে কারও বাড়িতে যাওয়া অশালীন একটি ব্যাপার, প্রেম করা ব্যাপারটিই যখন অশালীন! মেয়ে বড় হলে বাবা মা পাত্র খুঁজে মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে, মেয়ে মখু বুজে জানা নেই শোনা নেই লোককে দিব্যি স্বামী মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঘর করতে যাবে—এ নিয়মের বাইরে মেয়েরা যে প্রেম করে না তা নয়, কিন্তু গোপনে, এত গোপনে যে কাক পক্ষী জানতে না পারে। কাকপক্ষী তো বটেই দএু কজন বন্ধুকে ব্যাপারটি জানাতে আমার আপত্তি ছিল না। চন্দনা আদ্যোপান্ত জানিয়েছি, রুদ্রকেও জানিয়েছি চন্দনার সমস্ত দুজনকেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছি, পরস্পরকে লিখতে। লেখালেখি চলছে দুজনে। রুদ্রকে লেখা আমার চিঠির অনেকটা জুড়েই থাকে চন্দনা। চন্দনা যে আমার প্রাণের সঙ্গে কতটুকু জড়িয়ে আছে, তা বোঝে রুদ্র। মাঝে মাঝে অভিমান করে বলে, কেবল চন্দনা চন্দনা চন্দনা। তোমার তো একজন বন্ধু হলেই চলে, আমার কি আর প্রয়োজন আছে তোমার জীবনে! রুদ্রকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার, কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে একদিন নানিবাড়ি বেড়াতে যাই। নানি আমাদের জন্য চা করে নিয়ে আসেন, মখু টিপে হেসে রুদ্রকে বলেন, এই মেয়েকে পাইতে হলে আগে প্রতিষ্ঠিত হইতে হবে, বুঝলা! আমি শরমে মুখ নিচু করি। তবু নানিবাড়িতে যা সম্ভব, অবকাশে তা নয়। রুদ্রকে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি নানা বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবি, কিন্তু কখনও অবকাশে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। সুতরাং, পার্কে বসে থাকো, বোটানিক্যাল গার্ডেনে বস গিয়ে, গাছের ছায়ায় বসে কথা বল। বোটানিক্যাল গার্ডেন শহর থেকে খানিকটা দূরে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, ওখানে ব্রহ্মপুত্রের শুকিয়ে যাওয়া জলের দিকে মুখ করে ঘাসে বসে থাকি, দএু কটি বালু টানা নৌকা যায়, তাই দেখি বসে আর হ্যাঁ বা না জাতীয় কিছু শব্দ উচ্চারণ করি রুদ্রর অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে। বাগানে হাঁটতে আসা লোকেরা অদ্ভুত চোখে আমাদের দেখে।

মেডিকেল কলেজে ঢোকার পর একটি নিয়মিত জায়গার ব্যবস্থা হল, কলেজ ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে প্রথমদিন হাবিবুল্লাহকে নিয়ে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাই, হাবিবুল্লাহ যেহেতু বন্ধু যেহেতু আমার গভীর বিশ্বাস, ছেলেতে মেয়েতেও বন্ধুত্ব হতে পারে, ঠিক ছেলেতে ছেলেতে বা মেয়েতে মেয়েতে যেমন, হাবিবুল্লাহ আর চন্দনাতে যেহেতু আমি কোনও তফাৎ দেখি না, রুদ্রর মুখোমুখি বসে আমি যে কটা বাক্য ব্যয় করি, তা হাবিবুল্লাহর সঙ্গেই। আর কিছু শব্দ কেবল কাপের ভেতর চা আর দধু চিনির মিশেলের রঙ খুঁজতে খুঁজতে, যখন রুদ্র জিজ্ঞেস করে ক্লাস শেষ হয়েছে?

হয়েছে।

আরও ক্লাস আছে?

আছে।

করতে হবে?

হু।

হু মানে কি? না করলে চলে না?

চলে।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রুদ্রর সঙ্গে বসে থাকি। দুপুরের পর ক্যাম্পাস খালি হয়ে যায়, ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায়, চত্বরে ঘাসের ওপর, নয়ত কলেজের সিঁড়িতে বসে আমাদের প্রেমালাপ চলে, প্রেমালাপ এরকম,

চিঠি পাচ্ছ ঠিকমত?

পাচ্ছি।

আমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখবে,বুঝেছ?

আচ্ছা।

কবিতা লিখছ?

এই একটু আধটু।

পারলে মাত্রাবৃত্তে লিখবে।

মাত্রাবৃত্ত তো ছয় ছয় করে। তাই না?

হ্যাঁ। শেষে দুই যোগ করতে পারো। ছয় ছয় দুই।

অক্ষরবৃত্তটা বুঝতে পারি, মাত্রাবৃত্তটা কঠিন লাগে..

লিখতে লিখতেই ঠিক হবে। অক্ষরবৃত্ততেই প্রথম প্রথম লিখতে থাকো।

আট চার ছয়ে?

তাও করতে পারো, আবার আট চার দুই, ছয় চার দুই, ছয় চার দুই করলে অবশ্য মাত্রাবৃত্তের ছন্দটা চলে আসে..

উপদ্রুত উপকূলের কবিতাগুলো তো বেশির ভাগ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, তাই না?

হ্যাঁ তাই।

আমি তো লিখি আর অক্ষর গুনি, কী যে ঝামেলা লাগে..

ঝামেলার কি আছে, ছন্দটা হচ্ছে শোনায়. কানটা সজাগ রাখবে.. .

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এসব কবিতাই হয় না।

হয় হয়, লিখতে থাকো। তোমার কবিতার খাতাটা কাল এনো তো দেখব!

ভাল কবিতা লিখে নিই, পরে দেখাবো।

এনো তো বাবা! যা বলছি শোনো।. আচ্ছা একটা কথা…

কী?

তুমি আমাকে কোনও সম্বোধন কর না কেন?

কি রকম?

না ডাকো রুদ্র, না বল তুমি।

বলি তো!

কই বল!

চিঠিতে।

সে তো চিঠিতে। চিঠিই তো জীবন নয়। সামনে ডাকো না কেন?

লজ্জা আগুনের শলা ছোঁয়ালো সারা মুখে। প্রতিবারই রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার আগে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অথবা মনে মনে রুদ্র তুমি রুদ্র তুমির মহড়া দিই। রুদ্র তুমি কি খাবে বল, রুদ্র তুমি কি আজই চলে যাবে, এসব বাক্যের চর্চাও চলে। কিন্তু তার সামনে এলেই, মূল মঞ্চেই, আমার মহড়া মখু থুবড়ে পড়ে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও আমার ভাববাচ্যের শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি না।

তোমাকে এত দূরের মনে হয় কেন! একটওু তোমাকে স্পর্শ করতে দাও না। কত বলছি, হাতটা দাও। দিচ্ছ না। এত ভয় কিসের, আমি কি বাঘ ভালুক নাকি!

রুদ্র বাঘ ভালুক নয় তা জানি। রুদ্র সত্তর দশকের উজ্জ্বল তরুণ। সত্তর দশক যুদ্ধের মৃত্যুর ভাঙনের দশক, সত্তর দশক কবিতার দশক, কবিতায় লাশের গন্ধ, চিৎকার, প্রতিবাদ। রুদ্র তার কবিতায় এই দশকটির চিত্র চমৎকার এঁকেছে। যখন সে তার ঢাকার জীবনযাপনের গল্প করে, মগ্ধু হয়ে শুনি। তার ওই জীবনটি বড় দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পুলিশের গুলিতে আহত মানুষ নিয়ে শহরে মিছিল করি, ইচ্ছে করে প্রতিবাদের লিফলেট ছেপে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিই। ইচ্ছে করে রুদ্রর মত আমিও টিএসসির মাঠে বসে চা খেতে খেতে লাকি আখন্দের গান শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সারা বিকেল ঝালমুড়ি খেতে খেতে সাহিত্যের আড্ডায় মেতে উঠি। মহিলা সমিতিতে সেলিম আল দীনের নাটক হচ্ছে, দেখি। কদিন পর পরই কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, অনুষ্ঠানগুলোয় যাই, কবিতা শুনি। রুদ্র যেন আমার অল্প অল্প করে জাগা কবিতার চারার আশপাশ থেকে আগাছা সরিয়ে জল ঢালে, অথবা বলা যায় ছিল বারুদ, সে আগুন জ্বালে। প্রবল তৃষ্ণা জাগে কোনও এক অদেখা অচেনা কবোষ্ণ জীবনের জন্য। না মেটা তৃষ্ণা নিয়ে আমাকে বিকেল বিকেল উঠতে হয়, যেতে হয় বাড়িতে, হিশেব দিতে হয় দেরি হওয়ার, মিথ্যে বলতে হয়, বলতে হয় যে ক্লাসের পর মেয়েদের হোস্টেলে ছিলাম, মিথ্যে বলার সময় আমার গলা কাঁপে, দুচোখ হয় মাটিতে নয় বইপত্রে। ঢাকায় রুদ্রর ওই জীবনটিও পরে দেখা হয়েছে আমার। বেহিসেবি, বেপরোয়া, উদ্দাম, উত্তাল জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, টি এস সি চত্বরে, চা সিগারেট খেতে খেতে কতরকম মানুষের সঙ্গে যে রুদ্র কথা বলে! রাজনীতির কথা। সাহিত্যের কথা।ঠা ঠা করে হাসে। তার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে, বন্ধুরা হয় কবি নয় গল্পকার, নয় গায়ক, নয় নায়ক। তখনও আমি অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারা লাজুকলতা, পাতাকাঠির মত শরীর আর ফিনফিনে চুলের মেয়ে। রুদ্রর জীবনের দিকে আমি আকন্ঠ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। চমৎকার এক মুক্ত জীবন, কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না কোথায় যাচ্ছে কী করছে, ঘরে ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন। ঢাকাতেও আমার সময় বাঁধা থাকে রুদ্রর সঙ্গে সময় কাটানোর, রুনুখালা এক ঘন্টা কি দেড়ঘন্টা সময়ের জন্য আমাকে হাতছাড়া করেন। রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি জেনেই করেন। ঝুনু খালার নিজের প্রেমের গল্প আমাকে নিদ্বির্ধায় শুনিয়ে যান, আমারটি বলতেও আমি ঝুনুখালার কাছে দ্বিধাহীন হই। তিনি রক্তচক্ষু অভিভাবকের মত আমাকে এ ব্যাপারে শাসন করেন না মোটেও। অনেক আগেই বড়মামার বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে উঠেছেন রুনুখালা,প্রেম করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক আপিসে চাকরি করা মতিউর রহমান নামের এক বরিশালির সঙ্গে। বরিশালির সঙ্গে যখন তিনি দেখা করতে যান, বগলদাবা করে নিয়ে যান আমাকে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ঘাসে বসে তিনি বরিশালিকে নিজের বাড়ির আর আত্মীয় স্বজনের গল্প করেন, শুনে এত চেনা রুনুখালাকেই আমার বড় অচেনা লাগে। যে কেউ ধারণা করবে ধনে মানে রুনুখালার আত্মীয়রা সাংঘাতিক কিছু লাখপতি কোটিপতির নিচে কোনও আত্মীয়ই নেই তাঁর, এমন। রুনুখালার গা ঘেঁষে বসে বরিশালির চিকচিক চোখদুটো দেখি। ঝুনুখালার সবকিছু আমার খুব ভাল লাগে, তিনি একা যেখানে খুশি যাচ্ছেন, ঢাকা থেকে ছুটিছাটায় একা একা ময়মনসিংহ চলে যাচ্ছেন, এমনিতে তাঁর মাথা বোঝাই বুদ্ধি, কেবল একটি সময়ই তাঁকে খুব বোকা বোকা লাগে যখন তিনি বরিশালির সঙ্গে দেখা করেন। একেবারে ছোট্ট খুকির মত হয়ে যান তিনি, আমি যে বোকা, আমার চেয়েও বোকা তখন বুদ্ধির ঢেকিটি। একবার ঢাকা থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহ আসার সময় স্মৃতিময় বন্দোপাধ্যায় নামে এক গল্পলেখকের সঙ্গে কথা হল, কথা হল আর তিনি লোকটিকে অবকাশে নিয়ে উঠলেন। চা বিস্কুট দেওয়া হল অতিথিকে। স্মৃতিময়ের সামনেও রুনুখালাকে বড় বোকা লাগছিল, মুখে একটি লাজরাঙা হাসি ছিল রুনুখালার, যেন স্মৃতিময় ঝুনুখালার দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের প্রেমিক গোছের কিছু ঝুনুখালা ময়মনসিংহ এলে অবকাশে সারাদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে যান। আমার আবদারে তিনি মার অনুমতি নিয়ে আমাকে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যান একদিন বা দুদিনের জন্য, আমার তৃষ্ণা না ফুরোতে দিয়েও যান আমাকে মার হাতে বুঝিয়ে। ঝুনুখালার সঙ্গে আমাকে যেতে দিতে খুব আপত্তি ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারি মেয়ে রুনুখালা, বাবাও রুনুখালাকে অবজ্ঞা না করে কথা বলেন।

রুদ্রর সঙ্গে মুখোমুখি প্রেম না হলেও চিঠির প্রেমটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তার দাবি, প্রতিদিন তাকে চিঠি লিখতে হবে। প্রতিদিন সে নিজেও চিঠি লেখে। একদিন যদি বাদ পড়ে আমার চিঠি, রুদ্র চরম উৎকন্ঠা নিয়ে লেখে, কি হয়েছে কি তোমার, আমাকে কি ভুলে যাচ্ছা না, রুদ্রকে আমি ভুলে থাকি না। কিন্তু তাকে চিঠি লেখার জন্য আমার যে খানিকটা আড়াল চাই, বাড়ির লোকেরা আমার গায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকলে আমার পক্ষে যে সম্ভব নয়, তা তাকে বোঝাতে পারি না। রুদ্রর আশংকা ধরে বেঁধে খুব শিগগির আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন আমার বাবা। আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিই যে এ কাজটি আমার বাবা কোনওদিনই করবেন না, আমাকে খুন করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু ডাক্তারি পাশ করার আগে তিনি আমার বিয়ে সম্পর্কে কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে দেবেন না কাউকে। রুদ্র অবিশ্বাসে আশংকায় উদ্বেগে দিন যাপন করতে থাকে। মোংলা আর মিঠেখালিতে অঢেল সময় কাটিয়ে সে ঢাকা ফেরে, ঢাকা থেকে একদিন বা দুদিনের জন্য ময়মনসিংহে আসে। নৈঃশব্দকে সঙ্গী করে আমরা আগের মত বসে থাকি মুখোমুখি। রুদ্র একদিন নৈঃশব্দের শরীরে সুচ ফুটিয়ে বলে,চল বিয়ে করি।

বিয়ে?

হ্যাঁ বিয়ে।

আমি হেসে উঠি। চল মঙ্গলগ্রহে যাই, বা চল সমুদ্রে ডুবে মরি, এধরনের অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব শুনছি বলে মনে হয়। না হেসে আমার উপায় থাকে না। রুদ্র ভুরু কুঁচকে বলে, কি হাসছ যে!

হাসি আসছে।

হাসি আসে কেন?

আসে।

আমরা কি বিয়ে করব না নাকি?

বিয়ের কথা উঠছে কেন?

কেন উঠবে না!

পাগল নাকি?

পাগল হব কেন?

পাগল না হলে বিয়ে বিয়ে করে কেউ!

বাজে কথা বোলো না।

এ বুঝি বাজে কথা।

হ্যাঁ বাজে কথাই।

রুদ্র বিষণ্ন বসে থাকে। বিষণ্নতা আমার দিকেও হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। অনেকক্ষণ নখ খুঁটি, অনেকক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ ফেলে রাখি অহেতুক। কণ্ঠে না-বোঝা বিষাদ।

বাবা মেরে ফেলবে।

বাবার সঙ্গে চল দুজন দেখা করি। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে। গাম্ভীর্যের গলা মুচড়ে দিয়ে আমার অট্টহাসি স্ফূতর্ হয়।

হাসছ যে!

আমার আবারও হাসি পায়। কিছু কিছু অস্বাভাবিক দৃশ্যও কষ্টেসৃষ্টে কল্পনা করা যায় হয়ত কিন্তু এই দৃশ্যটি, যে, আমি আর রুদ্র বাবার সামনে দাঁড়িয়েছি, বলছি যে আমরা বিয়ে করব, অনুমতি দিন বা কিছ-ু -কল্পনাতেও আনা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমি অন্যমনে ঘাস ছিঁড়ি।

কি, তুমি হাসছ কেন, বল। বিয়ের কথা ভাববে না কোনওদিন?

বিয়ে আবার এখনই কি? আমি ডাক্তারি পাশ করে নিই। তারপর দেখা যাবে। আমার উদাসীন উত্তর। শব্দগুলো উত্তাপহীন, শীতল।

সে অনেক দেরি। উৎকণ্ঠা গেড়ে বসেছে রুদ্রর কণ্ঠে।

দেরি, তাতে কি?

রুদ্রর দেরি সয় না। এক্ষুনি সে কিছু একটা করে ফেলতে চায়। এক্ষুনি বিয়ে করে সংসার করার মত স্বপ্নও সে দেখে ফেলছে। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হতে থাকে, মানুষটিকে আমি চিনি না। খুব দূরের মানুষ। মামার বাড়ির আবদার করা জ্বালিয়ে মারা বুড়ো খোকা।পরীক্ষা দাও, এমএ টা পাশ কর, তারপর তো বিয়ের প্রসঙ্গ, এক্ষুনি কিসের তাড়া! চিঠিতে জানাই। রুদ্র লেখে, পরীক্ষা দেওয়া না দেওয়া সমান কথা তার কাছে। ওসব ফালতু ডিগ্রিতে তার কোনও উৎসাহ নেই। উৎসাহ তার না থাক, আমি তো জানি, আমার বাড়ির লোকের আছে। আর এমএ পাশ করা কোনও ছেলেকেও যে আদৌ আমার যোগ্য মনে করা হবে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। তার ওপর রুদ্র কবি, কবিদের ভাত নেই, কবিরা টুডাইল্যা জাতীয় লোক হয়, বাবার বদ্ধ ধারণা। রুদ্র বলে দেয় সে কবি, এই তার পরিচয়, সে কখনও কোনওদিন কোনও চাকরি বাকরি করবে না, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার কোনও যুক্তি নেই।

না তবু..

কিসের তবু?

বাবার ভয়ে ওষ্ঠে প্রাণ আমার। রুদ্রকে বোঝানো সম্ভব হয় না বাবার হৃদয় কী ধাতু দিয়ে গড়া।

 

বাবা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। কোনও অধ্যাপক না থাকায় তিনিই বিভাগটির হর্তা কর্তা। সকালবেলা প্রায়ই বাবার সঙ্গে রিক্সা করে কলেজে যাই। অর্ধেক পথ তিনি উদার হসে ্ত উপদেশ বিতরণ করেন। এক চান্সে মেডিকেলটা পাশ করতে যেন পারো, সেইভাবে লেখাপড়া কর। ভাল যে বাবা বলছেন না পরীক্ষায় তারকাখচিত কিছু না পেলে তিনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। মেডিকেলে একবার ঢোকা মানে একদিন না একদিন ডাক্তার হয়ে বেরোনো, এ জিনিসটি তিনি বিশ্বাস করেন, তাই বেশ নিশ্চিন্ত দেখায় তাঁকে। মেডিকেলের পরীক্ষাগুলো শাদামাটা পাশ করে যাওয়াই অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার, ভাল ছাত্রছাত্রীদের দ্বারাও সবসময় এ কাজটি সম্ভব হয় না। এনাটমি ফিজিওলজির জটিল জিনিসগুলো নিয়ে, যেগুলো মাথায় ঢুকেও ঢুকতে চায় না, কোনও প্রশ্ন করলে বাবা এমন সহজ সরল করে উত্তর দেন যে সুড়সুড় করে সব মগজে প্রবেশ করে। এমন কোনও প্রশ্ন নেই, যার উত্তর তিনি জানেন না। তিনি এখনও রাত জেগে পড়াশোনা করেন। যেদিন তিনি ক্লাস নেবেন, তার আগের রাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত পড়ে তবে বিছানায় যান। একসময় তিনি লিটন মেডিকেল ইশকুলে এনাটমির শিক্ষক ছিলেন। সেই লিটন তো কবেই উঠে গেছে, এখন আর বিদ্যালয় নেই, এখন মহাবিদ্যালয়, লাগোয়া মহা-হাসপাতাল, মহা-ক্যাম্পাস, আর আর মহা-শিক্ষকমণ্ডলির বেশির ভাগই, বাবা বলেন বাবার ছাত্র ছিলেন। একধরনের সুখ হয় শুনে, আমি যত না নিজের নামে চেনা, তার চেয়ে বেশি চেনা রজবআলীস্যারের মেয়ে হিসেবে, অন্তত কলেজে।

জটিল চিকিৎসাশাস্ত্রের জট খুলে দিতে থাকা বাবাকে আমার বড় আপন বলে মনে হয়। এ এক নতুন বাবা। বাড়ি ফিরেই আমাকে তিনি কাছে ডাকেন। সঙ্গে নিয়ে খেতে বসেন। খেতে খেতে গল্প করেন। নতুন কোনও বিদ্যা অর্জন হয়েছে কি না জানতে চান। যদি বলি না কিচ্ছু হয়নি, মোটেও বিরক্ত হন না, বরং পরম আগ্রহে তিনি কোনও একটি বিষয়ে উত্থাপন করেন। ধরা যাক লিভার, ফস করে বলে দিই, লিভারের কিচ্ছু আমি বুঝতাছি না। তিনি, হেসে, আমাকে পাশে বসিয়ে, আমার হাতখানি টেনে নিজের বুকের ওপর রেখে, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে লিভার দেখতে কেমন, লিভার কোথায় থাকে, লিভার কি করে, লিভারে কি কি অসখু হয়, সেই অসুখের ওষুধ কি করে দিতে হয় সব গল্পের মত করে বলে যান। এই যে আমি নিদ্বির্ধায় বলে দিই যে আমি লিভার সম্পর্কে কিছু জানি না, তিনি কিন্তু একবারও দাঁত খিঁচিয়ে বলেন না, কেন জানস না? বইএর প্রথম পৃষ্ঠা থেইকা শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মখু স,্থ ঠোঁটস্থ, অনঃ্ত স্থ কইরা ফালা। আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে এরকম দুশ্চিন্তা না করা বাবাকে আমি আর আগে দেখিনি। আমাকে তিনি পড়ার টেবিলে দেখতে চান, এরকম কোনও দাবিও আর জানান না। আমি আড্ডা দিলে বা পড়ে পড়ে ঘুমোলে বাবা রাগ করেন না। বাবার দৃষ্টি ইয়াসমিনে। ওকে টেনে ঘুম থেকে ওঠানো, ঘাড় ধরে পড়তে বসানো, খেলা থেকে তাড়ানো, মনীষীদের বাণী শোনানো, মেট্রিকে তারকাখচিত নম্বর না পেলে ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি শোনানোর কর্তব্য নিরলস ভাবে পালন করে যান। আমাকে নিয়ে বাবার নিশ্চিন্তি দেখে ছোটবাজারের হরিপদ মল্লিকের বাদ্যয−ন্ত্র্রর দোকান সুর তরঙ্গ থেকে দেখে শুনে একটি গিটার কিনে গিটারে টুং টাং শব্দ তুলি, গিটারে গান বাজানোর স্বপ্নটি টুং টাং করে হৃদয়ে সুর তোলে সারাদিন। ভাল গিটারবাদক হিসেবে নাম আছে শাহাদাত হোসেন খান হিলুর, কেবল গিটারবাদক হিসেবে নয় হিলুকে এক ডাকে শহরের সবাই চেনে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিলু সর্বদা বিরাজমান, তাঁকে গুরু বলে মানার লোকেরও অভাব নেই, মাসুদের গুরু তিনি, রুদ্রর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর রুদ্ররও গুরু মত হয়ে গেলেন, মোহাম্মদ আলী মিনার বলে একটি লম্বামত নবীন গল্পলেখককে নিয়ে রুদ্র একবার ময়মনসিংহ এসেছিল, সেই মিনারও শিষ্য হয়ে গেল হিলুর, হিলু এমনই সম্মোহনী শক্তি ধারণ করেন। ছোটদা আর গীতার সঙ্গেও হিলুর ঘনিষ্ঠতা ছিল, দাদারও নাকি বন্ধু। একদিন আকুয়ায়, নানিবাড়ির খুব দূরে নয়, তাঁর বিশাল পুকুরঅলা বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করি আমাকে যেন তিনি গিটার শেখান। শুনেছিলাম তিনি কাউকে শেখান না গিটার, গীতা বলেছে মেয়েমানুষদের নাকি দুচোক্ষে দেখতে পারেন না, সেই হিলু যখন রাজি হয়ে যান আমাকে শেখাবেন গিটার, আমি হাতে কি পেয়ে যাই, তা ঠিক তক্ষুনি ঠাহর করতে পারি না। অসম্ভবকে সম্ভব করলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন হয় আমার। হঠাৎ যেন সোনার মোহরের কলস পেয়ে গেছি, কলসের গলা পেঁচিয়ে থাকা সাপ চলে গেছে কোথাও কামিনীর গন্ধ শুঁকতে। সপ্তাহে তিন সন্ধেয় তিনি আসেন গিটার শেখাতে, তিনি এলে আর সব গৃহশিক্ষককে যেমন চা বিস্কুট দেওয়া হয়, তাঁকেও দেওয়া হয়। মাও হিলুকে চেনেন, হিলুর বড় ভাই হাশেমমামার বন্ধু। হিলুর জন্য মা বেশি করে মিষ্টি দিয়ে পায়েশ বানান। হিলু আমাকে উদারা মুদারা তারা ইত্যাদি শিখিয়ে মার হাতের চা আর পায়েশ খেয়ে উঠে যান। দাদা এক সন্ধেয় মুখোমুখি হন হিলুর। দাদার মখু টি হিলুকে দেখেই ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে, ফ্যাকাসে মখু টিতে ম্লান একটি হাসি ধরে রাখেন তিনি। হিলু চলে যাওয়ার পর ফ্যাকাসে মখু থেকে হাসিটি বিদেয় করে বলেন, হিলুরে কইছস কেন গিটার শিখাইতে?

তাতে কি হইছে?

কি হয়েছে তা তিনি বলেন না। কেবল জিভে অপছন্দের চুক চুক শব্দ করেন।

মাস গেলে হিলুকে শাদা খামে দুশ টাকা পুরে দিতে যাই সম্মানী।

জিজ্ঞেস করেন, এইটা কি?

টাকা।

টাকা কেন?

টাকা কেন, তা না বোঝার কথা নয় হিলুর। ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি, বলেন, তোমারে গিটার শিখাই বইলা তুমি কি আমারে বেতন দিতাছ নাকি?

আমি চপু হয়ে থাকি। হিলু টাকা নেননি। শত অনুনয়েও না। হিলু ধনীর ছেলে, টাকার তাঁর প্রয়োজন নেই সে জানি। কিন্তু মাগনা শিখতে আমার যে অস্বস্তি হয়! আমার অস্বস্তি থাকে, সেই সঙ্গে আমার জন্য হিলুর এই ত্যাগ, সন্ধের অনুষ্ঠানাদি ফেলে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য থাকে হিলুর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ এই বোধের মধ্যে একদিন সামনে দাঁড়ালেন বাবা। হিলু বৈঠকঘরে বসে আমাকে গিটার শেখাচ্ছেন দৃশ্যটি দেখে তিনি এমন চমকে উঠলেন যেন ভূত দেখছেন। বাবাকে দেখি দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন হিলু। সালামের প্রত্যুত্তর ঘণৃ ্য কটাক্ষ। বাবা ভেতর ঘরে গিয়ে বাড়ি ফাটিয়ে আমাকে ডাকেন। সামনে আমি আর আমার হৃদকম্প দাঁড়ায়।

হিলু আইছে কেন?

গিটার শিখায় আমারে।

গিটার শিখা তর পুটকি বাইর করাম হারামজাদি। বেডারে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ভাগা।একটা বদমাইস আমার বাড়িতে আইছে। কত বড় সাহস!

হিলু নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন বাবার বাক্যগুলো, আমি না পারছি শ্বাস ফেলতে না পারছি নিতে। না এটি ঘটছে না, বাবা কিছুই বলছেন না, হিলু ওঘরে হতভম্ব দাঁড়িয়ে নেই, তাঁর কানে কোনও মালকোষ রাগের সুর ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করছে না, আমি প্রাণপণে নিজেকে বোঝাতে চাইছি, কোনও অঘটন ঘটছে না বাড়িতে, এ আমার দুঃস্বপ্ন কেবল। একঘর অন্ধকার নিয়ে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকি, মাথাটি গ্যাস বেলুনের মত আমাকে ছেড়ে উড়ে যেতে থাকে আকাশে,মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হতে। শরীর, আমি লক্ষ করি, চলৎশক্তিহীন। পাথর চাপা পড়া হলদে ঘাসের মত মরা শরীর, ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে শরীর। হিলুকে সে রাতে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন বাবা। তাড়িয়ে দেবার পর আস্ফালন করতে থাকেন বাড়িময়।

হিলুরে কে না চেনে! শহরের নামকরা গুণ্ডা। এই নোমান, নোমান, দাদাকে চিল্লিয়ে কাছে এনে হাপাঁতে হাপাঁতে বলেন,তুই কি জানতি হিলু এই বাড়িতে আসে?

দাদা হ্যাঁ সূচক না সূচক দুরকমই মাথা নাড়েন।

লেলিহান আগুনের পাশে এক আঁজলা ঠাণ্ডা জল নিয়ে দাঁড়ান মা, হিলু তো এই বাড়িতে কোনও গুণ্ডামি করতে আসে নাই!

মার মন্তব্যের দিকে বাবা ফিরেও তাকান না। আগুন আগুনের মত জ্বলে, জল মার আঁজলা থেকে পড়ে মেঝে ভিজিয়ে দেয়। সারারাতই কড়িকাঠের দিকে মেলা আমার অনড় দুই চোখ থেকে বাবার প্রতি ঘণৃা আর ক্ষোভ চুইয়ে পড়ে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিছানায় আমার পাশে এসে বসেন।

এত দেমাগ তর বাপের! কিয়ের এত দেমাগ, বুঝি না! মাইনষে অভিশাপ দিব। মাইনষের সাথে অন্যায় আচরণ করলে মাইনসে অভিশাপ দিব না কেন? নিশ্চয়ই দিব।

গিটার শেখা জন্মের মত বন্ধ হল। ঘরের এক কোণে জিনিসটি পড়ে থাকে, পড়ে থেকে থেকে ধুলো আর মাকড়সার বাসা হয়ে ওঠে। অনেকদিন ভেবেছি হিলুর কাছে গিয়ে একদিন করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইব, কিন্তু এত ছোট মুখ নিয়ে অত বড় মানুষটির সামনে দাঁড়াতে আমার সঙ্কোচ হয়েছে।

 

এর পরপরই মিতু এল, সাজ সাজ রব পড়ে গেল বাড়িতে। বাড়ির আগাপাস্তলা সাজানো গোছানো হল। দাদার কোম্পানীর বড় কর্তার মেয়ে মিতু। ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি হবে, এ বাড়িতেই থাকবে, যদ্দিন না হোস্টেলের ব্যবস্থা হয়। যেদিন তার বাবা মা সহ গাড়ি করে মিতু এল, গালে ব্রণ ভরা, হাসিতে মুক্তো ঝরা,কোকঁড়া চুলের ফর্সা ত্বকের মেয়ে মিতু এল, সেদিনই বাড়ির সবার সঙ্গে ও ভাব করে নিল। আমি ওর এক ক্লাস ওপরে হলেও নিদ্বির্ধায় আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করল, ইয়াসমিনকে বলল, কোনও আপনি টাপনি নয়, তুমি। বাড়িতে পোলাও মাংস রান্না হয়েছে, মিতুর জন্য বাড়ির সবচেয়ে ভাল ঘরটি, ভাল ঘরটি মানে দাদার ঘরটি গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিতু চটপট ঝটপট উচ্ছঅল উজ্জ্বল মেয়ে, রাজ্যির গল্প করে ফেলল ঘন্টাখানিকের মধ্যেই। মিতুর মাও তাই, যেন আমরা ওদের জন্ম জন্ম চেনা। মিতুর মত গুছিয়ে গল্প বলা আমার হয় না। বলতে নিলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আমি নৈঃশব্দের হাতে নিজেকে সমপর্ণ করে কেবল দেখে যাই, শুনে যাই। মিতুর মত অনর্গল ইংরেজি বলা আমার হয় না। এত শীঘ্র মানুষের আপন হয়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জন করা আমার হয় না। মিতুকে রেখে তার বাবা মা ফেরত যান ঢাকায়। কলেজে ভর্তি হল মিতু। বাড়ির সবাই ওর সেবায় চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত মিতুর কখন কি চাই, এগিয়ে দাও। মিতু গোসল করবে, দৌড়ে যাও, গোসলখানায় পানি আছে কি না দেখ, না থাকলে কল চেপে দু বালতি পানি ভরে গোসলখানায় দিয়ে এসো। বাড়ির সবচেয়ে ভাল তোয়ালেটি, সাবানটি হাতে দাও। মিতু এখন খাবে, সব চেয়ে ভাল থালাটি ওকে দাও, মাছ মাংসের সবচেয়ে ভাল টুকরো তুলে দাও। মিতু এখন টেলিভিশন দেখবে, সোফার সবচেয়ে ভাল জায়গাটি ওকে দাও। মিতু ঘুমোবে, দৌড়ে যাও বিছানা ঝেড়ে মশারি ফেলে দিয়ে এসো। মিতু ঘুমোচ্ছে, কোনও টুঁ শব্দ যেন কোথাও না হয়। বাবাও বাদ পড়েন না মিতুর সেবা থেকে। অঢেল মাছ মাংস পাঠিয়ে দিচ্ছেন বাড়িতে, মিতুর জন্য রান্না হবে। ইংরেজি জানা মেয়ে শার্ট প্যান্ট পরা মেয়ে প্রতিরাতে টেলিভিশনের ইংরেজি ছবি দেখে, অবসরে ইংরেজি গল্পের বই পড়ে, ইংরেজি গান শোনে, মিতু ঘরেই থাকে ঘরের মেয়ের মত, অথচ প্রচণ্ড বাইরের মেয়ে ও। গলাগলি করলেও আমাদের সঙ্গে ওর বিস্তর তফাত থেকে যায়। ধনীর কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার কোনও বন্ধুত্ব হয় না। আমি ঠিক কি বলতে হয় ওদের সঙ্গে বুঝে পাই না। ওদের ফ্যাশনের গল্পে, বিদেশ ভ্রমণের গল্পে, বিদেশি সংস্কৃতির গল্পে আমি এক মাথা অজ্ঞতা নিয়ে নিরেট শ্রোতা হয়ে বসে থাকি। ইশকুলের চশমা পরা বড়লোকের মেয়ে বড়লোকি কায়দায় কথা বলা চলা আসমা আহমেদের সঙ্গেও কখনও ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি, যদিও আসমার বাড়িতে গেছি, যদিও আসমা আমার কবিতার খাতা প্রায়ই পড়তে নিয়ে যেত, যদিও আসমা আমার কবিতাকে খুব ভাল খুব ভাল বলে প্রশংসা করত। মুন্নি যখন মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে আসত ওর মার সঙ্গে বেড়াতে, মা অবলীলায় বসে যেতেন মুন্নির মার সঙ্গে গল্প করতে, মুন্নি যেহেতু আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত, আমারই যাওয়া উচিত ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিন্তু আমি ঠিক বুঝে পেতাম না কি কথা বলব ওর সঙ্গে। কেমন আছো দুশব্দের এই বাক্যটি আওড়ে আমি আর কোনও বাক্য খুঁজে পাইনি বলার। মেট্রিকে তৃতীয় বিভাগে পাশ করার পর মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল গোবরে পদ্মফুলের সঙ্গে, ফুলটি কোনও এক অজ পাড়াগাঁর লেখাপড়া না জানা এক দরিদ্র কৃষকের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। স্বামী নিয়েও মুন্নি বেড়াতে এসেছিল এ বাড়িতে, বৈঠকঘরে একটু শুধু উঁকি দিয়েই ঠেলে সামনে পাঠিয়েছি ইয়াসমিনকে, মাকে। মা আর ইয়াসমিন যে কারও সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের গল্পগাছায় পটু না হলেও কায়ক্লেশে চালিয়ে নিতে পারেন। আমারই হয় না। অথচ এই মুন্নি যার সঙ্গে রিক্সা করে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের ইশকুলে যেতাম। চতুথর্ থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেছি,নতুন ক্লাসে ওঠার উত্তেজনা তখনও আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যায়নি। নতুন বই কিনে দিয়েছেন বাবা, রঙিন কাগজে বইগুলোর মলাট বেঁধেছি, পড়ে ফেলেছি বাংলা গদ্য পদ্য দুটো বই-ই। আড়াআড়ি দাগ টানা বাংলা খাতা, চার দাগঅলা ইংরেজি,আর দাগহীন অঙ্ক খাতাও সাজিয়ে রেখেছি টেবিলের ওপর। সাড়ে নটা বাজার আগেই আমি তৈরি হয়ে নিই ইশকুলের পোশাক পরে, ঘি চিনি মেখে গরম ভাত খেয়ে, কালো একটি ছোট সুটকেসে বইখাতা ঢুকিয়ে। হেঁটেই যাওয়া যায় ইশকুলে, মোড়ের সরস্বতী মণ্ডপ পেরিয়ে সের পুকুর পাড় ধরে হেঁটে মনোরঞ্জন ধরের বাড়ির সামনে দিয়ে বড় রাস্তায় উঠলেই রাস্তার ওপারে লাল দালানের বিদ্যাময়ী ইশকুল। কিন্তু হেঁটে ইশকুলে যাওয়ার অনুমতি বাড়ি থেকে পাইনি। হাঁটতে গেলে গাড়ি গরুর তলে পড়ে হাত পা ভাঙব, এ ব্যাপারে বাড়ির সবাই নিশ্চিত। বাবা সকালে চার আনা পয়সা দেন, সেই চারআনা নিয়ে অবকাশ থেকে বেরিয়ে বাঁ রাস্তায় তিন বাড়ি পর এম এ কাহহারের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, আমাকে দেখে ভেতর ঘরে ইস্ত্রি করা পোশাক পরে, দামি জুতো পরে মোটা মেয়ে, ফর্সা মেয়ে, ধনীর মেয়ে, লেখাপড়ায় গোল্লা পাওয়া মেয়ে মুন্নি তৈরি হয়। কুঁচি কেটে শাড়ি পরা মুন্নির মার আঁচলে চাবির গোছা। হাঁটলে চাবিতে চাবিতে লেগে টিং টিং শব্দ হয়। আমাকে দেখে মুন্নির মা পান খাওয়া দাঁতে হেসে বলেন, কি মেয়ে, তোমার মা কেমন আছে? আমি মাথা নাড়ি, ভাল। আমার মা ভাল আছেন, রান্নাঘরের বারান্দায় বসে মাটির চুলোয় নারকেলের শুকনো পাতা গুঁজে আগুন ধরাতে চাইছেন, ফুঁকনি ফুঁকছেন, ধোঁয়ায় ঢাকা মা, ধোঁয়ায় ঢাকা মাঞ্চর মলিন শাড়ি। মার শাড়ির আঁচলে কোনও চাবির গোছা থাকে না, চাবির গোছা বাবার কাছে, বাড়ির কোনও দরজা কিংবা আলমারিতে তালা দিতে হলে বাবাই দেন, ভাঁড়ার ঘরেও সময় সময় তালা দেন, চাবি থাকে বাবার পকেটে, সে পকেট ছোঁয়ার সাধ্য অবকাশে কারও নেই। মার সঙ্গে মুন্নির মার তফাত অনেক। মুন্নির মার গা ভরা সোনার অলংকার, খোপাঁ করে রাখা চুল, পায়ে রঙিন ফিতের চটি, মার কাদা পা খালি পা, মার এলো চুল, মার ধোঁয়া মখু , মার শুকিয়ে চড়চড় ঠোঁট। মুন্নির সঙ্গে আমারও তফাত অনেক। মুন্নি দেখতে পুতুলের মত, ঝকঝকে। আমি সেরকম নই, না হলেও আমরা এক রিক্সায় বসে ইশকুলে যাই, ইশকুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া আমি দিই, ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরারটি দেয় মুন্নি। মুন্নির মা প্রতিদিন আঁচলে বাঁধা বড় চাবি দিয়ে শোবার ঘরের আলমারি খোলেন, খুলে আরেক চাবি দিয়ে আলমারির ড্রয়ার, সেই ড্রয়ার থেকে বের করেন সোনালি রঙের কৌটো, কৌটোর ভেতর আরেক কৌটো, সেই কৌটোর ভেতর থেকে চার আনা পয়সা বের করে মুন্নির হাতে দেন। ইশকুলে যাওয়ার পথে মুন্নি অনর্গল কথা বলে, আমি কেবল শুনি। প্রায় বিকেলে ওর ছোট ভাই পাপলুকে নিয়ে যখন আমাদের বাড়ির উঠোনে লাল ফিতেয় চুলে দুবেণী গেঁথে খেলতে আসে, তখনও ও একাই কথা বলে, আমি শুনি।

সেই মুন্নির হাস্যোজ্জ্বল ঝলমলে মার পায়ের আঙুলের ডগা একদিন লাল হতে থাকে, লাল হতেই থাকে, লাল ছড়াতে থাকে, বাবা নানা রকম ওষধু দিয়ে আঙুলের লাল সারাতে না পেরে একদিন কেটেই ফেললেন বুড়ো আঙুল। আঙুলহীন মুন্নির মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে আবার বিকেলে সন্ধেয় পাড়া পড়শির বাড়িতে গল্প করতে যেতে লাগলেন। মাস কয় পর আবার তাঁর আঙুলের ডগা লাল হতে শুরু করে। আবার সেই লাল ছড়াতে থাকে। ছড়াতে ছড়াতে ঠ্যাং বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে, বাবা বললেন ত্বকের ক্যান্সার এটি, পুরো পা কেটে ফেললে ক্যান্সার রোধ করা যাবে। পা কাটতে ও বাড়ির কেউ রাজি হয়নি। বাবা নিয়মিত মুন্নির মাকে দেখতে যান। মাও যান দেখতে। গিয়ে নিজে পানি গরম করে মুন্নির মার পা-টি পানিতে ডুবিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে তাঁকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন। শেষে এমন অবস্থা হয়, মুন্নির মার সারা শরীর থেকে গন্ধ বেরোতে থাকে, মশারির তলে তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়। শিশি শিশি আতর ঢেলেও গন্ধ দূর করা যায় না। বাড়ির লোকেরাই মুন্নির মার ঘরে ঢুকতে চায় না, অথচ বাইরের মানুষ হয়ে মা গিয়ে সেই গন্ধের ভেতর ঢোকেন, ঢুকে তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে বলেন আল্লাহ আপনেরে সুস্থ কইরা তুলবেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন। মার দরদ সবার জন্য। মা বস্তিতে গিয়েও বস্তির নোংরা মেয়েমানুষের গায়ে হাত বুলোতে পারেন, বড়লোকের বাড়ি গিয়েও বড়লোকের বউএর গায়ে পারেন। মা অনেকদিন আমাকে সেধেছেন, চল যাই মুন্নির মারে দেইখা আসিগা, মানুষটা খুব কষ্ট পাইতাছে। আমি না বলে দিই। মা একা যান। মা পারেন, আমিই পারি না। কণ্ঠুা, ভয়, লজ্জা আমাকে আমার হাড়গোড়ের ভেতর সেঁধিয়ে ফেলে। তাঁর মলিন কাপড়চোপড়, মলিন শরীর বা মলিন জীবনটি লোকে কি চোখে দেখবে, এ নিয়ে মা আর ভাবেন না। মুন্নির মাকে দেখে এসে মা বলেন, বড়লোকের বউ হইলে কি হইব, অসুখ হইছে, শরীরে গন্ধ বইলা কেউ আর তার কাছ ঘেঁষে না। কাজের মানুষ রাখছে, সে-ই কাছে থাকে। মেয়েমানুষের, সে দরিদ্রের কি ধনীর বউ হোক, কষ্টের সীমা নেই, মার ধারণা। মাকে বস্তির লোকেরা, ভিক্ষে নিতে আসা মানুষেরা বড়লোকের বউ বলে জানে। মা শুধরে দেন ওদের,বড়লোকের বউ হওয়া আর বড়লোক হওয়া আলাদা কথা। আমার স্বামী বড়লোক হইতে পারে, আমি কিন্তু গরিব মানুষ। আমার কোনও পয়সাকড়ি নাই। মা মাঝে মাঝে বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ কইরা পাঁচটা টাকাও যদি কামাইতে পারি, সেইডা ত আমার রোজগার হয়। পাঁচটা টাকাই কি কেউ আমারে দেয়? বাড়ির কামের বেডিগোরও আমার চেয়ে ভাগ্য ভাল। বড়লোকের বউ হয়ে মা যা পেয়েছেন, তার চেয়ে হারিয়েছেন অনেক। অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত তিনি, এদিক ওদিক সেলাইএর কাজ পাওয়ার জন্যও ঘুরেছেন, কাজ পাননি। মাকে বড় কাজ কেউ দেয় না মার লেখাপড়া নেই বলে, ছোট কাজও দেয় না মা বড়লোকের বউ বলে। মার এই সংসারের কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ জোটে না। ইয়াসমিনের মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। ইয়াসমিনকেও মা ধরেন,আমারে একটু প্রাইভেটে মেট্রিকটা দেওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিবা? তুমি যদি অঙ্কটা একটু দেখাইয়া দেও, আমি ঠিক পাশ কইরা যাব। ইয়াসমিনের বইগুলো মা ঘাঁটেন। খুব যতে ্ন পাতা ওল্টান, গড়গড় করে পড়ে ফেলেন কোনও কোনও পাতা, বলেন এ তো এমন কিছু কঠিন না! মার মেট্রিক পরীক্ষা দেবার শখের কথা শুনে বাড়ির সবাই মখু টিপে নয়, সশব্দেই হো হো করে হাসে, এমনকি আমেনাও।

এর মধ্যে ঝুনু খালা সেই বরিশালিকে বিয়ে করে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছেন। বরিশালিকে নিয়ে আসার আগে রুনুখালা নিজে একা এসে কি করে বাড়িঘর আগাগোড়া গোছাতে হবে, কে কি পোশাক পরে থাকবে, বাড়িতে কে কেমন আচরণ করবে, কি জিজ্ঞেস করলে কি বলতে হবে, কি কিই বা রান্না হবে ইত্যাদি নানা কিছ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সবাইকে। আমাদের বাড়ি এসেও বরবউকে নেমন্তন্ন করার কথা বলে গেছেন। রুনুখালা আর তাঁর বরিশালি স্বামীকে দেখতে নানিবাড়ি গিয়ে দেখি সবাই গলা নামিয়ে কথা বলছে, নানি নানা পদের রান্না করছেন, রুনুখালা এ ঘর ও ঘর ছুটোছুটি করছেন, আর নতুন চাদর পাতা বিছানায় নতুন কড়কড়ে লুঙ্গি আর শাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে মখু চুন করে বসে আছেন বরিশালি। বরিশালি অবকাশে যেদিন এলেন সেদিন মুখের চুনটি দূর হল। জুতোর মচমচ শব্দ তুলে হাঁটা বাবাকেও বেশ পছন্দ হল তাঁর। রুনুখালার বোনের স্বামী ডাক্তার, তাও আবার মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক-ডাক্তার, বরিশালি পলকহীন চোখে বাবাকে দেখেন আর বলেন, আত্মীয় বলতে তো আপনারাই। রুনুখালা চলে যাওয়ার পর মা বলেন, ঝুনু অত তোয়াজ করে কেন জামাইরে? নিজে সে এমএ পাশ করা মেয়ে। সে এখন বড় চাকরি বাকরি করবে। তার তো ঠেকা পড়ে নাই জামাইরে মানাইয়া চলার!

মার সুযোগ নেই বলে লেখাপড়া করতে পারেননি। মাঝে মাঝে ভাবি, আবার সুযোগ থাকলেও কেউ হেলায় সে সুযোগ নষ্ট করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় রুদ্রর নাম আছে, ওটুকুই। ক্লাসও করে না, পরীক্ষাও দেয় না, আমি তাকে অন্তত মাস্টারডিগ্রিটা পাশ করতে বলি, তার নিজের জন্যই বলি। তার দ্বারা হবে না এসব, কারণ, স্পষ্ট বলে দেয়, এসব একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের সে থোড়াই কেয়ার করে। সে সারাজীবন কবিতা লিখবে, কবিতাই তার নেশা পেশা যা কিছু। রুদ্র ট্রেনে করে পাঁচ ঘন্টায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসে, বাসেও এলেও ওই একই সময়। একবার ভিড়ের ট্রেনে ঝুলতে থাকা নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে ঝুলে পড়ল গুণের ঘাড়ে। গুণের বাড়ি আমাদের দেখা করার নতুন একটা জায়গা হল। কিন্তু ঠায় কতক্ষণই বা বসে থাকা যায় অন্যের বাড়িতে! ওদেরও তো ঝগড়াঝাটি আছে, চিৎকার চেঁচামেচি আছে! সুতরাং রিক্সা করে চল ঘুরে বেড়াই! শহরের কেউ যেন না দেখে ফেলে আমাদের, শহরের ভেতর দুজন দুটো আলাদা রিক্সা নিই, শহর থেকে দূরে গিয়ে একটি রিক্সা ছেড়ে দিয়ে দুজন এক রিক্সায় পাশাপাশি বসি। রুদ্রর স্পর্শ বিষম পুলক জাগায় মনে! শহরের বাইরে যাবার মত জায়গা এক মুক্তাগাছা, নির্জন গ্রামের রাস্তায় রিক্সা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সারি বেঁধে দাঁড়ানো কড়ইগাছের তল দিলে, ছোট ছোট নদীর ওপর ছোট ছোট সেতু পার হয়ে চলে। আমার চোখ পড়ে থাকে সবুজ শস্যে, বিলের জলে ন্যাংটো ছেলেদের দাপাদাপিতে, শীণর্ গরুর নির্বিকার রাস্তা পারে, আর মন পড়ে থাকে রুদ্রে। রুদ্রর চুমু খাওয়ার নিরন্তর চেষ্টাকে শরমে সরিয়ে সরিয়ে মুক্তাগাছা পোঁছি। সাপে শ্যাওলায় আগাছায় পরগাছায় আর মাকড়শার জালে ছেয়ে থাকা জমিদারবাড়ির আঙিনা ঘুরি ফিরি, রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটলেও ভয় নেই, এ শহরে ঢিঢি ফেলার মত চেনা লোক নেই।

রুদ্র সেবার ঢাকা ফিরে যাবার পর, কদিন পর আর, সাতদিন, ক্লাসে ঢুকতে যাব, ওপরের ক্লাসের এক মেয়ে এসে জানাল নীরা লাহিড়ী খবর পাঠিয়েছে, এক্ষুনি যেন তার বাড়ি যাই।

ক্লাস ফেলে দৌড়োলাম গুণের বাড়ি।

দেখি রুদ্র বসে আছে গুণের বসার ঘরে। ঘরে দুটো কাঠের চেয়ার, একটি চৌকি। চৌকিতে। দেখে মন নেচে ওঠে। রুদ্রকে দেখলে এই হয় আমার, মন নাচে।

কী ব্যাপার হঠাৎ!

হ্যাঁ হঠাৎ। চিঠিতে জানাবার সময় পাইনি।

ও।

এরপর মুখোমুখি বসে থাকা নৈঃশব্দের সঙ্গে দুজনের। নৈঃশব্দের নীলিমা জুড়ে রুদ্রর স্টার সিগারেটের ধোঁয়া।

রুদ্র তার কাঁধের কালো ব্যাগ থেকে একখানা কাগজ বের করে বলল, এই কাগজে একটা সই করতে হবে তোমার।

কিসের কাগজ এটা?

পরে বলব। আগে সই কর।

কেন?

এত কথা বোলো না।

কাগজটা কিসের?

প্রশ্ন করি, কিন্তু আমি নিশ্চিত রুদ্র কোনও স্মারকলিপিতে অথবা নতুন কোনও কবিসংগঠন তৈরি করেছে, আমাকে সেই সংগঠনের সদস্য করতে সই চাইছে। আমার নিশ্চিত চোখদুটোয় ভোরের স্নিগ্ধ আলো। আমার নিদ্বির্ধ ঠোঁটে এক ঝাঁক পাখির ওড়াওড়ি। কাগজটি নিতে হাত বাড়ালে রুদ্র সরিয়ে নেয় কাগজ।দ্বন্দ্বে পড়ি, ধন্ধে পড়ি।

কিসের কাগজ এটি? না পড়ে তো সই করব না!

রুদ্রর শ্যাওলা পড়া চোখ স্থির হয়ে থাকে আমার চোখে।

বিয়ের কাগজ। রুদ্রর ভারি কণ্ঠ, ভাঙা কণ্ঠ।

কান ঝাঁ ঝাঁ করে। ঝাঁ ঝাঁর ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ঝরঝরে হই।

বিয়ের কাগজ?

হ্যাঁ বিয়ের কাগজ।

কেন?

কেন মানে?

বিয়ের কাগজ কেন?

কেন তা বোঝো না?

না।

সই করবে কি করবে না বল।

আশ্চর্য, এভাবে, এরকম করে বিয়ে করব কেন?

তাহলে তুমি সই করবে না?

কী লেখা আছে দেখি!

আমি কাগজটি হাতে নিতেই রুদ্র হাঁ হাঁ করে উঠল, বৌদি আসছে, লুকোও।

লুকোবো কেন?

বুঝে ফেলবে।

কি বুঝবে?

বুঝবে যে বিয়ের কাগজ।

কি করে?

আরে বুঝবে বললাম তো!

বুঝলে কি ক্ষতি?

ক্ষতি আছে।

কি ক্ষতি, শুনি!

রুদ্র টেনে নিল কাগজখানা হাত থেকে। পাথুরে গলায় বলল তুমি সই করবে কি না বল, হ্যাঁ বা না।

এ কি আশ্চর্য! বিয়ের কথা উঠছে কেন হঠাৎ!

উঠছে।

কে উঠিয়েছে?

আমি।

আমি তো বলিনি আমি বিয়ে করব!

আমি বলছি।

এক হাতে তালি বাজে?

সই করবে?

না।

কাগজটি ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র, বলল ঠিক আছে, চললাম।

বিস্ময় আমার জগত ধোঁয়াটে করে আনে, কোথায়?

ঢাকায়।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ।

কেন, কি হয়েছে?

থাকার আর প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন নেই?

রুদ্রর নিরুত্তাপ কন্ঠ। না।

কাগজে সই করিনি বলে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল?

কোনও উত্তর না দিয়ে দরজা হাট করে খুলে বেরিয়ে যায় রুদ্র। বেরিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে। ভালবাসায় উপচে ওঠা আমার হৃদয়খানা সে পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি সে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে। পেছনে আমি একা, রুদ্র ফিরে তাকাচ্ছে না। আমি আর তার কেউ নই। সে ফিরছে না।

তীব্র এক বেদনা আমাকে উঠিয়ে বারান্দায় নিল, তার চলে যাওয়ার দিকে নিল, তার চলে যাওয়াকে দুহাতে থামাল।

কই দেখি, কাগজটা দেখি তো!

কেন?

কেন আবার, সই করব!

রুদ্র কাগজ বের করে দিল।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে খচখচ করে কি লেখা না পড়ে না দেখে সই করে, কাগজটি রুদ্রর হাতে দিয়ে, মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা তার চোখের দিকে আমার বেদনাতর্ দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম এই সইএর যে এত মূল্য তা আগে বুঝতে পারিনি। সই হল। এবার খুশি তো! চলি।

গুণের বাড়ির আঙিনা পার হয়ে রাস্তায় উঠলাম। দ্রুত।

পেছন থেকে রুদ্র শোনো, দাঁড়াও বলে ডাকছে।

আমি পেছন ফিরিনি।

রিক্সা নিয়ে সোজা কলেজে। পরের ক্লাসগুলো খুব মন দিয়ে করলাম।

তখনও আমার ভেতর এই বোধটিই আসেনি, যে, অভিমানের ওই সইটিই আমার বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছে। তখনও আমি রুদ্রকে রুদ্র বলে ডাকি না, তুমি বলে সম্বোধন করি না। তখনও কোনও চুমু খাইনি আমরা, স্পর্শের মধ্যে কেবল হাতের আঙুল। তখন সবে আমার উনিশ বছর বয়স।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *