কবির সাহেব সাধারণত অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে ওঠেন। হাত-মুখ ধুয়ে হারিকেন জ্বলিয়ে তাঁর পড়ার টেবিলে বসেন। জরুরি লেখালেখির কাজগুলি সূর্য ওঠার আগেই সেরে ফেলা হয়। আজ তেমন কোনো জরুরি লেখালেখির ব্যাপার নেই। অভ্যাস-বশে লেখার টেবিলে বসেছেন। শুধু শুধু বসে থাকার কোনো মানে হয় না, তিনি একটি প্রবন্ধ লিখতে বসলেন। প্রবন্ধের নাম-স্বাধীনতা। প্রথমে ইচ্ছা ছিল মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভূমিকা এই বিষয়ে কিছু লিখবেন। প্রতিটি লেখারই নিজস্ব প্ৰাণ আছে। সে লেখাকে ঘুরিয়ে দেয়। এই লেখাটিও সে-রকম হল। তিন পৃষ্ঠা লেখার পর কবির সাহেব লক্ষ করলেন, দেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে না লিখে তিনি লিখছেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। তিনি ভুরু কুচকে লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর বয়স হয়ে যাচ্ছে, যা ভাবছেন তা লিখতে পারছেন না। এটা বয়সের লক্ষণ। জরার লক্ষণ। সময় কি তাহলে শেষ হয়ে আসছে? তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষের মতো এমন শক্তিধর একটি প্রাণী এত ক্ষীণ আয়ু নিয়ে আসে কেন? একটি কচ্ছপ বাঁচে আড়াইশ বছর। কচ্ছপের আড়াইশ বছর বাঁচার কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের অপচয়।
শওকত উঠে পড়েছে। সে সাড়াশব্দ করে ডন-বৈঠক করছে। কবির সাহেব বিরক্ত হয়ে তাকালেন শওকতের দিকে। গুনে গুনে সে পঞ্চাশটা ডন দেবে, তারপর কেরোসিন কুকার জ্বালিয়ে চা বানাতে বসবে। বিরাট একটা জামবাটিতে শরবতের মতো মিষ্টি চা এনে টেবিলে রেখে গালভর্তি হাসি দিয়ে বলবে, স্যার, চা। চা তিনি খান না। বহু বার এই কথা শওকতকে বলা হয়েছে। কোনো লাভ হয় নি। সে কাজ করে তার নিজের ইচ্ছায়। অন্য কেউ কী বলছে না-বলছে, তার কোনো তোয়াক্কা করে না। তার ধারণা, সকালবেলা এক বাটি চা দিয়ে সে স্যারের সেবা করছে, এবং স্যারের আপৰ্ত্তিটা মৌখিক—আসলে তিনি মনে মনে খুশিই হন।
শওকত তাঁর সঙ্গে এসে জুটেছে মাস তিনেক হয়। তবে কবির সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের। নীলগঞ্জ স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়বার সময় সে উধাও হয়ে যায়। কোথায় আছে, কী করছে, কেউ বলতে পারে না। মাসখানেক পর খবর পাওয়া গেল সে এক সার্কাস পাটিতে ঢুকে সোহাগী চলে গেছে। নিউ অপেরা সার্কাস। খুব বড়ো দল। কবির সাহেব খবর পেয়ে সোহাগী চলে যান এবং কানে ধরে তাকে নীলগঞ্জে নিয়ে আসেন। কানো ধরা কথাটা মুখের কথা নয়, সোহাগী থেকে নীলগঞ্জ আসার সারাটা পথ তিনি সত্যি সত্যি তার কান চেপে ধরে ছিলেন। পরবর্তী এক বৎসর কোনো রকম ঝামেলা হয় না। সে ক্লাস এইটে প্রমোশন পায়! ক্লাস এইটেই সে মহা গুণ্ড। হিসেবে নীলগঞ্জে মোটামুটি একটা ত্রাসের সৃষ্টি করে। নীলগঞ্জের চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে কী একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে। এবং লাথি মেরে তার পা ভেঙে ফেলে। কবির সাহেব খবর পেয়ে বেত হাতে তাকে ধরতে যান। তার কোনো খোঁজে পাওয়া যায় না; তব বাবা গ্রামের দরবার ডেকে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেন। পুত্রের প্রতি বিরাগ্যবশত এটা অবশ্যি করা হয় না, করা হয় চেয়ারম্যান সাহেবের রোষের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। চেয়ারম্যান হাজি খবিরউদ্দিন খুব সহজ লোক না;
যাই হোক, পরবর্তী চার বছর শওকতের কোনো সন্ধ্যান পাওয়া যায় না। উড়ো খবর আসে, সে চলে গেছে আসাম! এত জায়গা থাকতে আসাম যাবার কারণটি কারোর কাছেই পরিষ্কার হয় না।
চার বছর পর এক সকালবেলা কবির সাহেব দেখলেন তাঁর বাড়ির বারান্দায় শওকত ঘুমাচ্ছে। চেনার উপায় নেই। বিশাল জোয়ান।
কি রে, তুই কোত্থেকে?
স্যারের শরীরটা ভালো?
আমি ভালো, তুই এসেছিস কখন?
রাইতে।
বাড়িতে যাস নি?
না, বাড়িত গিয়া কী হইব?
এইখানেই থাকবি নাকি?
হুঁ।
কবির সাহেবের ধারণা, কিছুদিন থাকবে, তারপর নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। কিন্তু এ-রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। খাচ্ছে—দাচ্ছে, আছে নিজের মতো। এর মধ্যে খবর পেয়েছেন, সে খবিরউদ্দিশ্বকে শাসিয়ে এসেছে। বলে এসেছে, বেশি তেড়িবেড়ি করলে বিলের মইধ্যে পুইও থুইয়াম। ভয়াবহ ব্যাপার!
কবির সাহেব সরবতের মতো মিষ্টি চায়ের খানিকটা খেলেন। সূর্য উঠি-উঠি করছে। বেরিয়ে পড়বার সময় হয়েছে। সূর্য ওঠার আগেই তিনি সমস্ত গ্রামে একটা চক্কর দিয়ে আসেন।
কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাস্তা প্যাচপ্যাঁচে কাদা হয়ে আছে। পা রাখামাত্রই দেবে যাচ্ছে। কবির সাহেব চটি খুলে ফেললেন। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুললেন। এক হাতে একটি ছাতা নিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগুতে লাগলেন। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হবার সম্ভাবনা। এ-রকম দিনে না বের হলেও চলত। কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেছে।–সকালে না ঘুরলে মনে হয় দিনটা ঠিকমতো শুরু হল না। কিছু একটা যেন বাকি রয়ে গেল।
সূর্য এখনো ওঠে নি, কিন্তু গ্রাম জেগে উঠেছে! শহরের সাথে গ্রামের সবচে বড়ো পার্থক্য হচ্ছে, শহরের মানুষরা কখনো সূর্যোদয় দেখে না। কবির সাহেবের মনে হল, সূর্যোদয় দেখাটা অত্যন্ত জরুরি। এই দৃশ্যটি মানুষকে ভাবতে শেখায়। মন বড়ো করে। কবির সাহেবের পরীক্ষণেই মনে হল, মন বড়ো করে, ধারণাটা ঠিক না। গ্রামে অত্যন্ত ছোট মনের মানুষদের তিনি দেখেছেন। মন বড়ো-ছোট ব্যাপারটির সঙ্গে প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক বোধহয় নেই।
মাস্টার সাব, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছ কুদ্দুস?
জ্বি মাস্টার সাব, আপনের দোয়া।
যাও কোথায় এত সকালে?
ইস্টিশনে যাই। ঢাকা যাওন দরকার।
টেন তো সকাল দশটায়, এখনই কোথায় যাও!
কুদ্দুস কিছু বলল না। কবির সাহেবকে এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেবার জন্যে সে প্রায় রাস্তায় নেমে গেল। কবির সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, স্টেশনে এতক্ষণ বসে থেকে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে,এটা ঠিক না। অশিক্ষার জন্যে এটা হচ্ছে। দশটায় টেন, গিয়ে বসে থাকবে ছ টার সময়।
মাস্টার সাবের শইলডা বালা?
হ্যাঁ, ভালোই।
কুদ্দুস তার পেছন পেছন আসতে লাগল। দু জনে হাঁটছে নিঃশব্দে। রাজারামের পুকুর ঘাট পর্যন্ত এসে কবির সাহেব বললেন–
তুমি তো আসছ কুদ্দুস, ইস্টিশানে যাবে ইস্টিশনে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
কুদ্দুস উত্তরের সড়কের পথ ধরল। কবির সাহেব দিঘিতে পা ধোয়ার জন্যে নামলেন। পা ধোয়া অর্থহীন। আবার কাদা লাগবে। কিন্তু রাজারামের এই দিঘির কাছে এলেই পানিতে হাত-পা ডোবাতে ইচ্ছে করে। বিশাল দিঘি। আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি। এই ঘোর বযয়িও এর জল কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ!
হাত পা ধুতে ধুতেই কবির সাহেব লক্ষ করলেন, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুজন ভিখিরি যাচ্ছে। এই দৃশ্যটি নতুন। গ্রামের মানুষজন সহজে ভিক্ষা করে না। এরা কি এই গ্রামেরই নাকি? তিনি হাত ইশারা করে ডাকলেন না, এরা এ গ্রামের না। কবির সাহেব কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন, বাড়ি কোন গ্রামে? কত দিন ধরে ভিক্ষা করছ? বসতবাড়ি আছে? ছেলেমেয়ে নেই? ভিক্ষা করতে করতে কত দূর যাও? রাতে নিজ গ্রামে ফিরে যাও, না থেকে যাও?
ওরা বেশ আগ্রহ নিয়েই প্রশ্নের জবাব দিল। গ্রামের ভিক্ষুকরা শহরের ভিক্ষুকদের মতো নয়, এরা কথা বলতে পছন্দ করে। জীবন সম্পর্কে আগ্রহ এখনো আছে। কবির সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়াতেই ওদের এক জন চিকন সুরে বলল, চাচামিয়া, আট আনা পয়সা দেন। কবির সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমি ভিক্ষা দিই না।
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তিনি উত্তরের সড়ক ধরলেন। সূর্য উঠে গেছে, এখন আর হাঁটতে ভালো লাগবে না। গ্রামে ভিক্ষুক বাড়ছে। খুব খারাপ লক্ষণ। এটা হতে দেওয়া যায় না। গ্রাম হচ্ছে উৎপাদনের জায়গা, এখানে ভিক্ষুক তৈরি হলে চলবে কীভাবে?
স্যার, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। রকিব ভালো আছ?
জ্বি স্যার। একটু বসবেন না?
না, আরেক দিন।
রকিব সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। সে গ্রামে থাকে না। রাজশাহীতে ফুড সাপ্লাইয়ে কাজ করে। অল্প দিনের মধ্যেই পয়সাকড়ি করে ফেলেছে। বাড়ি এসেছে ঘর পাকা করবার জন্যে।
স্যার, একটা দোনলা বন্দুক কিনলাম।
তাই নাকি? বন্দুক কেন?
একটা বন্দুক থাকলে স্যার ডাকাতি হয় না। জানেন তো আশেপাশে খুব ডাকাতি হচ্ছে।
তাই নাকি? জানি না তো।
খুব হচ্ছে স্যার। এই গ্রামেও হবে। বন্দুকটা কিনলাম। এই জন্যেই। আসেন না স্যার, একটু দেখে যান।
বন্দুক-টন্দুকের ব্যাপারে আমার উৎসাহ নেই রকিব। বন্দুক দিয়ে কিছু হয় না।
বলেই তাঁর মনে হল কথাটা ঠিক না। মুক্তিযুদ্ধ বন্দুক দিয়েই করতে হয়েছে। বন্দুক একটা অত্যন্ত দরকারি জিনিস।
রকিব!
জ্বি, স্যার।
বন্দুক দিয়ে কিছু হয় না, তোমাকে যে বললাম-এটা ঠিক না। বন্দুকের দরকার আছে।
জ্বি, স্যার, তা তো আছেই। গ্রামের এক বাড়িতে বন্দুক আছে শুনলে সেই গ্রামে আর ডাকাত আসে না।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
তোমার বন্দুক বাড়িতেই থাকবে?
জ্বি।
তুমি কত দিন আছ?
এক সপ্তাহ থাকব স্যার। কাল এক বার আসব আপনার কাছে?
কোনো কাজে? না, এমনি দেখা-সাক্ষাৎ?
একটা কাজ স্যার আছে!
কখন আসলে পাওয়া যাবে আপনাকে?
সব সময়। যাব। আর কোথায়? ঘরেই থাকি সারা দিন।
রকিব বিদায় নিতে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল। এটা একটা নতুন ব্যাপার। কোনো উদ্দেশ্য আছে কি? উদ্দেশ্য ছাড়া আজকাল কেউ কিছু করে না। তিনি ভুরু কোঁচকালেন। গুডগুড করে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে বোধহয়। খবর পেয়েছিলেন, শিয়ালজানি খালে পানি বাড়ছে। খুব খারাপ লক্ষণ। বন্যা এ বছরও কি হবে? একটু ঘুরে শিয়ালজানি খালটা দেখে গেলে হয়। একটা বীধ-টাধ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। প্রতি বছর বন্যা হলে তো সবাই ভিখিরি হয়ে যাবে। চিন্তিত মুখে তিনি শিয়ালজানি খালের দিকে রওনা হলেন। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। সঙ্গে ছাতা আছে, কিন্তু ছাতা মেলতে ইচ্ছা করছে না। পথে যেতে যেতে তাঁর মনে হল, আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না! কাজে হাত দেওয়া দরকার। মানুষ কচ্ছপ নয়, সে আড়াইশ বছর বাঁচে না। অল্প কিছুদিন বাঁচে। যা করবার, এই অল্প সময়ের মধ্যেই করতে হবে। শুরু করতে হবে একা, তারপর অনেকে এসে দাঁড়াবে পাশে। কোনো স ৎকাজে মানুষের অভাব হয় না। মানুষ এক সময় না এক সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। তাঁর পাশেও লোকজন এসে দাঁড়াবে।
ছাত্রদের কাছে চিঠি লিখতে হবে। দেখা করতে হবে সবার সাথে। অনেক কাজ। শিয়ালজানি খালের পাড়ে কবির সাহেব দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলেন। ঝমোঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মেলতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। পানি সত্যি সত্যি অনেকখানি বেড়েছে। ছোট একটা খাল। কিন্তু কত অল্প সময়ের নোটিশে বিশাল হয়ে যেতে পারে। এ-রকম নজির আছে।
স্নামালিকুম মাস্টার সাব।
ওয়ালাইকুম সালাম।
খালের পানি বাড়তাছে।
হুঁ।
এই বছর কিন্তুক পানি অইত না।
বুঝলে কীভাবে?
পরপর দুই সন বান হয় না। তারপর পানিটা দেখেন, ভারি পানি, বানের পানি অয় পাতলা।
তাই নাকি?
জ্বি।
ভারি-পাতলা বোঝা কীভাবে?
হাতে নিলেই বুঝন যায়।
কবির সাহেব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, খালের তীর বরাবর বাঁধ দেবার ব্যবস্থা করব, বুঝলে মজনু মিয়া?
এইটা সম্ভব না। মাস্টার সাব।
কবির সাহেব রাগী গলায় বললেন, অসম্ভব বলে কোনো জিনিস নেই, মজনু মিয়া, সবই সম্ভব। মানুষের ক্ষমতা খুব বেশি। অবশ্যি বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। এস, ছাতার নিচে এস, ভিজছ কেন?
মজনু মিয়া হাসতে হাসতে বলল, ভিজতে ভালো লাগে মাস্টার সাব।
মজনু মিয়ার দাড়ি বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে। ভালো লাগছে দেখতে।
তিনিও ছাতা নামিয়ে ফেললেন। মজনু অবাক হয়ে বলল ও মাস্টার সাব, তিজতাছেন তো?
বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগছে।
মজনু মনে-মনে ভাবল, আমাদের মাস্টার খুব পাগলা কিসিমের আছে।
সন্ধ্যার দিকে খবর এল, শিয়ালজানি খালের পানি অনেকখানি বেড়েছে। এই হারে বাড়তে থাকলে রাতের মধ্যে গ্রামে পানি ঢুকবে। নীলগঞ্জের সমস্ত মানুষ শঙ্কিত। খালের পাশে লোকজন আছে। অবস্থা তেমন দেখলে হাঁক-ডাক দেবে।
কবির সাহেব সন্ধ্যা থেকেই চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। সকালবেলা বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয় নি। জ্বর এসে গেছে। গলা ব্যথা করছে। ঢোক গিলতে পারছেন না। বয়সের লক্ষণ। শরীর বলছে-এখন আর আমাকে দিয়ে যা-ইচ্ছা-তা করিয়ে নিতে পারবে না। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।
শওকত ঘুরছে শুকনো মুখে। তার খুব ইচ্ছা, এক জন ডাক্তার নিয়ে আসে। কবির সাহেব রাজি নন। সামান্য জ্বরজারিতে ডাক্তার কী? তাছাড়া এ গ্রামে ডাক্তার নেই। বৃষ্টির মধ্যে যেতে হবে ফটিকখালি। কোনো অর্থ হয় না। শওকত কাঁচুমাচু মুখে বলল, স্যার, একটু চিড়া ভিজাইয়া দেই, খান।
না।
রুটি বানাইয়া দেই? দুধ দিয়া চিনি দিয়া খান।
কিছু খাব না রে শওকত। তুই যা, পানির অবস্থাটা কি খোঁজ নিয়ে আয়।
না খাইয়া থাকবেন। সারা রাইত?
হুঁ। একটা কথা মন দিয়ে শোন শওকত। এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পেটে খিদে নিয়ে ঘুমুতে গেছে। সুস্থ মানুষ। আর আমি অসুস্থ। খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি এক বেলা না খেলে কিছু যাবে-আসবে না।
কবির সাহেবের মন অন্য একটি কারণেও বেশ খারাপ। ঢাকা থেকে নীলু হঠাৎ করে তাঁকে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছে। সে চিঠিতে শাহানার সেকেণ্ড ডিভিশনে মাটিক পাশের খবরের সঙ্গে তার বোন বিলুর মৃত্যুসংবাদ আছে। শেষ লাইনটিতে সে লিখেছে, মামা, আপনি তো অনেক জ্ঞানী মানুষ, আপনি আমাকে বলুন, এত কষ্ট কেন মানুষের? চিঠি পড়ে তিনি চোখ মুছেছেন। এটাও বয়সের লক্ষণ। মন দুর্বল হয়ে গেছে। সামান্যতেই চোখ ভিজে ওঠে।
দুপুর-রাতে শওকত খবর নিয়ে এল, পানি কমতে শুরু করেছে। এই খবরের আনন্দেই সম্ভবত কবির সাহেবের জ্বর কমে গেল। তিনি হাসিমুখে বললেন, একটু যেন খিদে–খিদে লাগছে রে শওকত।
ভাত খাইবেন?
দে, চারটা ভাতাই খাই। তরকারি কী?
খইলাসা মাছ ডেঙ্গা দিয়া রাঁধছি। মাষের ডাইল আছে।
খেয়েই ফেলি চারটা।
খেতে খেতেই তিনি মনস্থির করলেন, আগামী কাল ভোরে ঢাকা যাবেন। সুখী নীলগঞ্জের কাজে হাত দেওয়া দরকার। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে 66छ।
শওকত।
জ্বি স্যার।
ঢাকা যাব। কাল। তুইও চল আমার সাথে।
জ্বি আচ্ছা।
বড়ো একটা কাজে হাত দেব। সুখী নীলগঞ্জ নীলগঞ্জের মানুষের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
শওকত তাকিয়ে থাকল। এই অদ্ভুত মানুষটিকে সে খুবই পছন্দ করে। সেও মজনু মিয়ার মতো মনে-মনে ভাবল, আমাদের স্যার খুব পাগলা।
কবির সাহেব যাবেন ঢাকা। ভৈরব রেল স্টেশনে আটকা পড়ে গেলেন। এক গ্লাস পানি খাবার জন্যে স্টেশনের পাশের এক হোটেলে ঢুকেছেন। ক্যাশবাক্স নিয়ে বসা মোটাসোটা লোকটি হী করে তাকিয়ে রইল-যেন ভূত দেখছে। কবির সাহেব বললেন, স্লামালিকুম। লোকটি জবাব দিল না।
পানি খাব। এক গ্রাস পানি দেওয়া যাবে?
লোকটি লাফিয়ে উঠল। কবির সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না।
স্যার, আমি আপনার ছাত্র।
ভালো আছে বাবা?
আমার নাম স্যার, ফজল।
ফজল পা ছুঁয়ে সালাম করল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সে কী করবে: ভেবে পাচ্ছে না। পানির গ্লাসের জন্যে নিজেই ছুটে গেল। কিন্তু ফিরে এল পানি ছাড়াই।
স্যার, বাড়িতে চলেন। বাড়িতে পানি খাবেন! কাছেই বাড়ি, দুই মিনিট লাগবে।
ঢাকার গাড়ি ধরব ফজল!
আমি স্যার গাড়িতে তুলে দেব।
পানিটা এখানেই খেয়ে গেলে হত না?
বাড়িতে খাবেন স্যার।
ফজল, কবির সাহেবের হাত থেকে ব্যাগ প্রায় ছিনিয়ে নিল। কবির সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। এ জাতীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় তাঁর ছাত্র বের হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তাকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এক বার সান্তাহার যাচ্ছিলেন-ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। টিকেট চেকার উঠেছে। টিকিট-নেই যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। টিকিট চেকার দিব্যি বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে এক টাকা দুটাকা করে নিয়ে নিচ্ছে। তার ভাব দেখে মনেই হচ্ছে না যে কাজটা অন্যায় এবং এ-রকম প্রকাশ্যে করাটা ঠিক হচ্ছে না। এক পর্যায়ে কবির সাহেব বললেন, আপনি কী করছেন এসব? টিকিট চেকার রাগী মুখে তাঁর দিকে তাকাল, সে থেমে থেমে বলল, স্যার, আপনি! সে এগিয়ে এসে সালাম করল।
তুমি কি বাবা আমার ছাত্র?
জ্বি স্যার।
তুমি তো আমাকেও লজ্জা দিলে। তোমার মতো ছাত্র তৈরি করল যে মাস্টার, সে কেমন মাস্টার?
টিকিট চেকার গাড়ির দরজার কাছে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে কবির সাহেবের নিজেরই একটু খারাপ লগতে লাগল। কিছু না বললেই হত। মুখের কথায় কি আর অন্যায় বন্ধ হয়? দোষ তো তার একার নয়। লোকগুলি বিনা টিকিটে উঠল কেন? প্রথম অন্যায় তো করেছে। যাত্রীরা। দেশের সব মানুষই কি অসৎ হয়ে যাচ্ছে? নীতিবোধ নেই? ন্যায়-অন্যায় বিচার নেই?
সন্তাহার স্টেশনে টেন বদলের জন্যে কবির সাহেব নামলেন। টিকিট চেকার ছাত্র এসে উপস্থিত। কথা নেই বার্তা নেই, সুটকেস উঠিয়ে নিল হা05!
ব্যাপার কি!
বাসায় যেতে হবে স্যার।
আমি তো রংপুর যাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি।
রাতের বেলা যাবেন স্যার। রাতে একটা টেন আছে।
আজ বাবা বাদ দেওয়া যায় না?
না স্যার। আমার অনেক দিনের শখ, আপনাকে সাথে নিয়ে এক বেলা চারটা ভাত খাই। স্যার, আপনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেন নি।
না।
আপনি স্যার পুরো এক বছর আমার কলেজের পড়ার খরচ দিয়েছেন! প্রতি মাসের তিন তারিখে আপনার কাছ থেকে নিয়ে আসতাম।
যেতে হল তাঁকে। গিয়ে মনে হল, ছেলেটি তাঁকে ইচ্ছা করেই বোধহয় এনেছে। বিশাল পরিবার। নিজের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে ছাড়াও তিনটি বড়ো বড়ো বোন, দুটি ভাই, বাবা এবং মা। সবাই মিলে দু কামরার রেলের কোয়ার্টারে আছে। কবির সাহেবের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল।
ছেলেটি রাতে তাঁকে টেনে তুলে দিল। মৃদুস্বরে বলল, স্যার, বড়ো কষ্টে আছি। আপনি স্যার আমাকে বলেন, আমি কী করব।
তিনি কিছু বলতে পারলেন না। মাঝে মাঝে দারুণ সব অস্বস্তিতে পড়তে হয়।
ভৈরবেও এই জাতীয় অবস্থা হল। পানি খেতে গিয়ে তিনি আটকা পড়ে গেলেন। কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি তাঁর পছন্দ নয়। ফজল সেই জিনিসটিই করতে লাগল। তাঁকে বসিয়ে রেখে—একটু আসি স্যার বলেই উধাও হয়ে গেল এবং ফিরে এল প্রকাণ্ড একটা রুই মাছ নিয়ে। কবির সাহেবের বিরক্তির সীমা রইল না। তাঁর ঢাকা যাবার দরকার।