১১. এখন রাত প্রায় এগারটা

১১

এখন রাত প্রায় একটা।

আন্দাজে বলছি, কারণ আমার ঘড়ি নেই। রাতের বেলা আন্দাজে সময় ঠিক করি। দিনের বেলা এই অসুবিধা হয় না। বেশির ভাগ মানুষের হাতেই ঘড়ি থাকে। জিজ্ঞেস করলেই সময় জানা যায়।

যে আমার এই লেখা পড়বে, সে বুদ্ধিমান হলে ধরে ফেলবে যে আমি আজেবাজে কথা লিখে সময় নষ্ট করছি। আসলে তা না। কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।

মিসির আলি সাহেব আমাকে চমৎকার বাঁধান খাতা দিয়েছেন। শুধু তাই না, সঙ্গে খুব দামী একটা কলম। বল পয়েন্ট না, ফাউনটেন পেন। কালির দোয়াতও কিনেছেন। দোয়াতটার দামই সত্তর টাকা। কলমটার দাম কত কে জানে। দুই তিন শ’ টাকা তো হবেই। এত দামী কলম, কিন্তু লেখা ভালো না। অর্থাৎ আমি লিখে আরাম পাচ্ছি না।

মিসির আলি সাহেব বলেছেন, আমি যেন রোজ লিখি। প্রতিটি খুঁটিনাটি যেন লিখি। কিছুই যেন বাদ না দিই। ভ্রমণের ব্যাপারটাই যেন লিখি। ভ্রমণ বলতে তিনি অন্য জগতে যাবার ব্যাপারটা বোঝাচ্ছেন। তিনি নিজে এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন কি করেন না, তা আমি এখনো বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় বিশ্বাস করেন, আবার মাঝে-মাঝে মনে হয় করেন না। পুরো ব্যাপারটাই এক জন নিঃসঙ্গ যুবকের কল্পনা ধরে নিয়েছেন।

আমি তাঁকে একটি চিঠি এবং দুটি ছবি এনে দিয়েছি। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি কথাও বলছেন না। আমি একবার ছবিটা চাইলাম। তিনি বললেন, ‘পরে পাবে।’

তিনি যে চুপচাপ বসে আছেন তাও মনে হয় না। আমার ব্যাপারে তিনি খুলনা গিয়েছিলেন, এটা হঠাৎ জানতে পারি। সেখান থেকে তিনি কী জানলেন, আমি জানি না।

ফুলেশ্বরীর শ্বশুরবাড়িতেও তিনি গিয়েছিলেন। আমার সম্পর্কে তথ্য সংগ্ৰহ করছেন বলে মনে হয়। আমি নিজে যা জানি, সবই তাঁকে বলেছি। এর বেশি তিনি কী জানতে চান কে জানে। লোকটির ধৈর্য অসীম। মমতাও অসীম। তাঁর মমতার নানান পরিচয় পেয়েছি। কঠিন ঋণে তিনি আমাকে আবদ্ধ করেছেন। আমার পক্ষে ঋণমুক্ত হবার কোনো পথ আছে কি না আমি জানি না। ঋণমুক্ত হতে চাইও না। কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতে ভালো লাগে। মিসির আলি তেমন এক জন মানুষ।

আবারো আজেবাজে কথা বলছি। কি করব, আমি তো আর লেখক নই, যে, গুছিয়ে ঘটনার পর ঘটনা সাজাব। আমি তা পারি না। লেখক ছাড়া অন্য কেউই বোধ-হয় পারেন না।

যাই হোক, মূল ব্যাপারে ফিরে আসি। আমি এখন প্রায় এক শ’ ভাগ নিশ্চিত যে, আমার পাশাপাশি দু’টি জীবন চলছে। এক জীবনে আমার বাবা শৈশবে মারা গেছেন। প্রবল দুঃখ কষ্ট ভোগ করে বর্তমানে এই অবস্থায় আছি। অসহায় নিঃসঙ্গ এক জন মানুষ।

অন্য জীবনটি চমৎকার! এই জীবনে বাবা বেঁচে আছেন। আমি বড় কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসা করছি, এখনো ঠিক জানি না। বিয়ে করেছি। জীবনটা বেশ সুখের বলেই মনে হচ্ছে। এই জীবনটাকে আমি স্বপ্নজীবন নাম দিচ্ছি বোঝার সুবিধের জন্যে। স্বপ্ন-জীবনটাও পৃথিবীর মধ্যেই। কারণ, সেখানেও আমি আকাশে চাঁদ দেখছি। দুটি পাশাপাশি জীবন কিভাবে চলছে? দুটি কি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ? দুটি পৃথিবী দুটি চাঁদ? সব মানুষই দু’ জন করে? এইসব প্রশ্নের আমি কোনো কূল-কিনারা পাই না। কাজেই খুব বেশি ভাবিও না। চিন্তা-ভাবনার দায়িত্ব আমি মিসির আলি সাহেবের ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

আমি লক্ষ করেছি যে, এখন আমি এ জগৎ থেকে স্বপ্ন-জগতে খুব সহজেই যেতে পারি। নিয়মটা খুব সহজ। নিজেকে প্রথমে খুব ক্লান্ত করে নিতে হয়। উপবাস এবং পরিশ্রম এই দুটি জিনিস একত্রে চালিয়ে যাবার পর চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন-জগৎটির কথা ভাবলেই হয়।

একবার স্বপ্ন-জগতে চলে যাবার পর সেই জগৎটাকে সত্যি মনে হয়। বর্তমানে যে জীবন যাপন করছি, তাকে মনে হয় মিথ্যা জীবন। কোনটি সত্যি কে জানে? প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিরা বলতেন–জীবনটাই একটা মায়া। আসলেই বোধহয় তাই। সবটাই বোধহয় মায়া। আমার এখন এ-সব জানতে ইচ্ছে করে না। যে-কোনো একটি জীবনে আমি স্থায়ী হতে চাই।

যদি এটা এক ধরনের অসুখ হয়, তাহলে আমি চাই যেন অসুখটা সেরে যায়। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে চাই। মুক্তি চাই। পরিপূর্ণ মুক্তি।

আজ এর বেশি কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। এখন তৈরি হব ভ্রমণের জন্যে। অদ্ভুত এক ভ্রমণ। এই জীবন ছেড়ে অন্য এক জীবনে।

মুনির খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। বাতি নিভিয়ে সিগারেট ধরাল। মনে-মনে বলল–ভ্রমণের প্রস্তুতি। যাত্রা হবে শুরু। এ-রকম যদি হত—ওয়ান ওয়ে জার্নি, আর ফিরে আসতে হবে না–তাহলে কেমন হত? স্বপ্ন-জীবনটি কি খুবই সুখের? মৃত্যু ঐ জীবনেও হানা দিয়েছে। টগরের মৃত্যু হল। বাবা-মার কাছে কত তীব্রই না ছিল সেই শোক! সে এখন বুঝতে পারছে না, কিন্তু ঐ জীবনের মুনির কী গভীর শোক পেয়েছে, তা সে রক্তের মধ্যে অনুভব করে। শোক এবং শোক, চারদিকেই শোক। জাপানি একটি কবিতায় আছে না?

‘বল দেখি কোথা যাই
কোথা গেলে শান্তি পাই?
ভাবিলাম বনে যাব
তাপিত হিয়া জুড়াব
সেখানেও অর্ধ-রাত্রে
কাঁদে মৃগী কম্প গাত্রে।।’

মুনির সিগারেট ফেলে নিজেকে তৈরি করল। মুহূর্তে ঘরের চেহারা পাল্টে গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়, তারা কোথায় যেন বেরুচ্ছে। ঐ তো বিনু। আশ্চর্য, কী সুন্দর লাগছে বিনুকে। অসম্ভব সুন্দর! বিনুর চুলগুলো পিঠময় ছড়ান। এ-রকম খোলা চুলে সে কোথায় যাচ্ছে! নাকি বিনু যাচ্ছে না, সে একাই যাচ্ছে? একটি কাজের লোক বড়-বড় দুটি স্যুটকেস নিয়ে নামছে। তারা নিশ্চয়ই দূরে কোথাও যাচ্ছে। ঘরে দিনের আলো। ক’টা বাজছে কে জানে। মুনির হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল–দশটা পনের। ঘড়ির ডায়াল সবুজ রঙের। বাহ্, ইন্টারেস্টিং তো! এটা তো স্বপ্ন। স্বপ্নে তো রঙ দেখার কথা নয়। সে রঙ দেখছে কেন? কে বলেছিল, স্বপ্নে রঙ দেখার কথা নয়? মনে পড়ছে না। নামটা মনে পড়ছে না। ম দিয়ে শুরু। মিহির? মুনির? না না, মিসির মিসির আলি। মিসির আলি বলেছেন-ভ্রমণের সময় খবরের কাগজ হাতে নেবে। খবরের কাগজ হাতে নিতে হবে কেন? মিসির আলি বলেছেন, একটা খবরের কাগজ হাতে নেবে। কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কেন বললেন এ-রকম কথা! বিনু কেমন যেন বিরক্ত মুখে তাকাচ্ছে।

‘টগর। টগর।’

মুনির চমকে উঠল। টগরকে কেন ডাকছে? টগর চার বছর বয়সে মারা গেল না? বিনু কি ভুলে গেছে? এত বড় একটা ঘটনা কি ভোলার কথা। অবশ্যি ভোলাটা অস্বাভাবিকও নয়। এই তো সে নিজেই অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে। কি কি যেন তাকে বলেছিলেন মিসির আলি। এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না।

‘টগর। আমি কিন্তু খুব রাগ করছি। আর এক বার মাত্র ডাকব। এর মধ্যে তুমি যদি আস ভালো কথা, না এলে তোমাকে ছাড়াই রওনা হব।’

মুনির অবাক হয়ে দেখল, টগর এসেছে। আট-ন’ বছর বয়সের চশমাপরা একটা ছেলে। টগর বলল, ‘আমি যাব না, মা।’

বিনু বলল, ‘খুব ভালো কথা, থাক তুমি।’

বিনু তরতর করে নেমে যাচ্ছে। টগর হাসিমুখে মুনিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে কি টগর বেঁচে আছে? চার বছর বয়সে ও তাহলে মারা যায় নি? এটা কোন জীবন? অন্য আরেকটা? এর মানে কী?

মুনিরের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে ঘোর কেটে গেল। সে আছে তার পরিচিত জায়গায়। ভ্রমণ শেষ হয়েছে।

মুনির বাতি জ্বালাল। খাতা খুলে লিখল, ‘মানুষের জীবন দুটি নয়। অনেক। হয়তো-বা অসংখ্য।’

ক্লান্তিতে খাতার ওপরই মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাত সেই ঘুম ভাঙল না। কত বিচিত্র স্বপ্ন দেখল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে! কখনো মনে হচ্ছে সে মেঘে-মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে, আবার কখনো-বা তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অতলে। কী গাঢ় নীল সেই পানি! চারদিকে শব্দহীন সময়। কী অসহ্য নীরব। এই নীরবতার মধ্যেও কে যেন নিচু গলায় তাকে ডাকছে। বিনু ডাকছে নাকি? এটা কি বিনুর গলা? আহ্! কী সুন্দর করেই না সে ডাকছে! আবার সব চুপচাপ। অসহ্য নীরবতা। মুনির স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদছে। চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলছে–আমাকে মুক্তি দাও। কিন্তু তার চিৎকারেও কোনো শব্দ হচ্ছে না। কী অদ্ভুত অবস্থা!

তার ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। প্রথম খানিকক্ষণ বুঝতেই পারল না, সে কোথায় আছে। কোন জগতে! সে ঠিক করল, আজ অফিসে যাবে না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। দুপুরবেলার দিকে যাবে মিসির আলির কাছে। এমনি খানিকক্ষণ গল্প করবে। দুপুরবেলা বা দিনের আলোয় তাঁর কাছে কখনো যাওয়া হয় নি। দিনের আলোয় লোকটিকে দেখতে কেমন দেখায় কে জানে! তবে দুপুরবেলা ওঁকে হয়তো পাওয়া যাবে না। ক্লাসে থাকবেন কিংবা লাইব্রেরিতে থাকবেন।

মিসির আলি ঘরেই ছিলেন, অবাক হয়ে বললেন, ‘অসময়ে তুমি, ব্যাপার কি বল তো? অফিসে যাও নি?’

‘জ্বি-না। আপনি ইউনিভার্সিটিতে যান নি?’

‘না। আজ বৃহস্পতিবার না? বৃহস্পতিবারে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকে।’

‘কী করছেন স্যার?’

‘রান্না করছি। রোজ-রোজ হোটেলে খাওয়া ভালো লাগে না।’

‘কী রান্না করছেন?’

‘নতুন ধরনের রান্না, আমিই তার আবিষ্কারক। নাম হচ্ছে মিসির মিকচার। চাল, ডাল এবং আলু একসঙ্গে মিশিয়ে দু’ চামচ ভিনিগার, এক চামচ সয়া সস, একটুখানি লবণ, দুটো কাঁচা লঙ্কা এবং আধা চামচ সরিষা বাটা দিয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেদ্ধ হয়ে যাবার পর এক চামচ বাটারওয়েল দিয়ে দমে দিতে হয়–অপূর্ব একটা জিনিস নামে। খেয়ে দেখ।’

জিনিস যেটা নামল, তার চেহারা দেখলে খেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু স্বাদ সত্যি চমৎকার। মুনির অবাক হয়ে গেল।

‘কি, কেমন লাগছে?’

‘জ্বি স্যার, ভালো।’

‘আরো কিছু বিশেষণ দিয়ে বল। শুধু ভালো, এর বেশি কিছু না?’

‘চমৎকার স্যার!

‘এখন বল, তুমি যে ভ্রমণে যাচ্ছ, সেখানে কখনো খাওয়াদাওয়া করেছ? চট করে বলতে হবে, না-ভেবে বল।’

‘পানি খেয়েছি।’

‘পানিতে হবে না, স্বাদ আছে এমন কিছু।’

‘মনে পড়ছে না স্যার।’

‘এই জিনিসটা খুব ভালো করে খেয়াল করবে।’

‘কেন?’

‘স্বপ্নে আমরা প্রায়ই প্রচুর খাওয়াদাওয়া করি। তাতে কিন্তু কোনো স্বাদ থাকে না।’

‘আপনি এখনো স্বপ্ন ভাবছেন?’

‘হ্যাঁ, ভাবছি। তবে তুচ্ছ স্বপ্ন ভাবছি না।’

‘সব স্বপ্নই তো তুচ্ছ।’

‘না, তা না। তা ছাড়া স্বপ্নকে তুচ্ছ করাও খুব মুশকিল। ফ্রয়েড সাহেব ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রীম লিখে স্বপ্নের মহিমাকে খর্ব করেছেন, কিন্তু তাঁর শিষ্য ‘জাং’ পরবর্তী সময়ে ভিন্ন কথা বলেছেন।’

‘কি বলেছেন?’

‘ঐ সব থিওরি তোমার ভালো লাগবে না। তারচে বরং তোমার কথা শুনি। যা যা করতে বলেছিলাম, করেছ তো? সব কিছু লিখছ তো?’

‘লিখছি।’

‘খুব খুঁটিয়ে লিখবে। কোনো কিছু বাদ দেবে না।’

‘কি হবে স্যার এসব দিয়ে?’

‘হয়তো কিছু হবে না। তাতে কি? কই, আমার সিগারেট এনেছ?’

মুনির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। মিসির আলি হেসে ফেললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *