১১. একা একা

১১. একা একা

আমি রাস্তা ধরে হাঁটছি। ভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গেছে, তাই আমি যে হু হু করে কাঁদছি সেটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। প্রথম ঘণ্টাখানেক আমি কোথায় কোথায় হেঁটেছি নিজেও জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল –বেঁচে থেকে কি হবে? মরে যাই না কেন? এক-দুই বার যখন রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক বা বাস গিয়েছে, মনে হচ্ছিল, লাফিয়ে পড়ে যাই সেগুলির। সামনে। ঘণ্টাখানেক পর আমার মন একটু শান্ত হল। আমি তখন স্কুলের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। যেখানে বসেছি জায়গাটা একটু অন্ধকার, লোকজন আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। একজন দুইজন হঠাৎ হঠাৎ দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিন্তু আমি গা করলাম না। কোন কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না।

বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন, আমি আর কোনদিন বাসায় ফিরে যাব না। পৃথিবীতে কত বাচ্চাই তো আছে যাদের বাবা নেই, মা নেই, একা একা জীবন কাটিয়ে দেয়। আমি সেভাবে জীবন কাটিয়ে দেব। জুতা পালিশ করে ফেরিওয়ালা হয়ে মিন্তির কাজ করে কোন না কোনভাবে বেঁচে থাকব। সবাই যে পড়ালেখা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে সেটা তো সত্যি নয়। কাউকে কাউকে কুলি মজুর, রিকশাওয়ালা তো হতে হবে। তাই হব আমি। ট্রেনে করে চলে যাব যতদূর যাওয়া যায়। দূরে কোন শহরে, অজানা কোন গ্রামে। অসুখ-বিসুখ হয়ে মরে গেলে তো ভালই। চুপচাপ কোন গাছের নিচে শুয়ে মরে যাব আমি। আমার কথা আর কে ভাববে! গভীর দুঃখে আমার চোখে। পানি এসে গেল হঠাৎ।

আরো যখন রাত হল তখন হঠাৎ করে মশা কামড়াতে শুরু করল। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করছিলাম, প্রথমে ভাবলাম, রেল স্টেশনে গিয়ে শুয়ে থাকি। কত গরিব মানুষ শুয়ে থাকে ঠাণ্ডা মেঝেতে, আর একজন বেশি হলে ক্ষতি কি?

ঠিক তখন আমার জারুল চৌধুরীর গাছঘরের কথা মনে পড়ল! কি আশ্চর্য, সবচেয়ে প্রথমেই তো আমার গাছঘরের কথা মনে পড়ার কথা ছিল। রাগে দুঃখে অভিমানে মাথাটা গরম হয়ে আছে বলে এতক্ষণ মনে পড়েনি। হঠাৎ করে আমি আমার বুকের ভিতর কেমন জানি একটা বল অনুভব করতে থাকি। আমি যতদিন ইচ্ছা গাছঘরে থাকতে পারি। আমার আর ভয় কি?

রাত তখন কয়টা বাজে আমি জানি না। আমি সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। তখন তখনই স্কুলের দেয়াল থেকে নেমে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকটুকু রাস্তা, সলীলের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে গেছি বলে আগে কখনো টের পাইনি। দিনের বেলা রাস্তাটা কত পরিচিত মনে হয়, এখন রাত্রিবেলা সবকিছু কেমন বিচিত্র মনে। হচ্ছে। গাছগুলিকে মনে হয় মানুষ, ঝোঁপগুলিকে মনে হয় কোন ধরনের জন্তু জানোয়ার, আর হঠাৎ হঠাৎ করে যখন রাস্তার পাশে থেকে কুকুর বিড়াল কিছু একটা বের হয়ে আসে, আমি এত জোরে চমকে উঠি যে, সেটা আর বলার মত নয়! অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমার কত কি মনে হয়! কেমন জানি এক ধরনের অভিমান হতে থাকে। কার উপরে অভিমান কে জানে! চোখে পানি এসে যায় একটু পরে পরে।

জারুল চৌধুরীর বাসায় গিয়ে দেখি পুরোটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কে জানে বাসায় নেই নাকি ঘুমিয়ে গেছেন। কত রাত হয়েছে জানি না, কিন্তু জারুল চৌধুরী বলেছেন। তিনি নাকি অনেক রাত জেগে বই পড়েন। হয়তো বাসায় নেই, ঢাকা চলে গেছেন। এই অন্ধকারে বিজন বনে আমি একা চিন্তা করেই আমার কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে।

আমি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে গাছঘরের নিচে এসে সাবধানে গাছের ফোকড়ে হাত দিতেই সত্যি সত্যি ছোট একটা প্লাস্টিকের কৌটা পেলাম। এর মাঝে গাছঘরের চাবিটা। সেটা হাতে নিয়ে আমি হাতড়ে হাতড়ে ঝুলে থাকা দড়িটা বের করে একটা হ্যাঁচকা টান দিলাম, সাথে সাথে উপর থেকে দড়ির মইটা ঝপাং করে এসে নিচে পড়ল। জারুল চৌধুরী গাছঘর নিয়ে যা যা বলেছিলেন সত্যি সত্যি তাই করেছেন! আমি সাবধানে মই বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। অন্ধকারে চাবি দিয়ে দরজায় লাগানো তালাটা খুলতে বেশ কষ্ট হল, শেষ পর্যন্ত সেটা খুলে আমি মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকলাম। বাম পাশে তাকের মাঝে একটা ম্যাচ আর মোমবাতি থাকার কথা। সত্যি সত্যি সেটা পেয়ে গেলাম। মোমবাতিটা জ্বালাতেই ভিতরে কেমন জানি এক ধরনের স্বস্তি আর নিরাপদের ভাব চলে এল। আমি মইটা টেনে তুলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।

গাছের উপর ছোট পুতুলের ঘরের মত একটা ঘর, তার মাঝে গভীর রাতে আমি একা একা বসে আছি। পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার কি বিচিত্র লাগতে থাকে! আমি গাছঘরের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে তাকালাম। ছোট ছোট তাক, তার মাঝে বইপত্র কাগজ কলম। ছোট ছোট টিন, খুলে দেখি সেগুলিতে চিড়া মুড়ি আর গুড়। একটা পানির বোতল, কবেকার পানি কে জানে। দেয়ালে একটা টর্চলাইট, একটা চাকু আর একটা দড়ি ঝুলছে। ঘরের এক কোণায় ছোট একটা তোষকের মত জিনিস গুটানো, এটা নিশ্চয়ই স্লিপিং ব্যাগ হবে। আমি স্লিপিং ব্যাগটা খুলে ফেললাম। সত্যিই চমৎকার একটা বিছানা, ভিতরে ঢুকে গেলে একই সাথে তোষক এবং লেপ হয়ে যায়! বালিশ নেই, কিন্তু বালিশ না হলে আর ক্ষতি কি? কোথায় জানি পড়েছিলাম বালিশ ছাড়া ঘুমানো নাকি স্বাস্থ্যকর!

আমি কয়েক মুঠি চিড়া খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে কি চমৎকার কুসুম কুসুম গরম! আরামে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল। আমি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলাম। সাথে সাথে গাঢ় অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে গেল।

জায়গাটা কি আশ্চর্য নির্জন সুমসাম। হঠাৎ হঠাৎ রাতের পাখি ডেকে উঠে, ডানা ঝাঁপটায়। মাঝে মাঝে নিশাচর কোন একটা প্রাণী ছুটে যায়, কে জানে কি রকম প্রাণী। এ ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই।

আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। আমার বাবার কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা মনে পড়ে, লাবলুর কথা মনে পড়ে। কে জানে লাবলুর জ্বরটা কমেছে কিনা। শুয়ে শুয়ে আমার। মনে হতে থাকে কোন দিন বুঝি ঘুম আসবে না। কিন্তু একসময় সত্যি সত্যি আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাতে খুব ভাল ঘুম হল না, হবে আমি সে রকম আশাও করিনি। একটু পরে পরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল আর আমি চমকে চমকে উঠছিলাম। শেষরাতের দিকে অবিশ্যি আমি বেশ ভালভাবেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়, হঠাৎ করে আমার সব কথা মনে পড়ল আর মনটা এত খারাপ হল যে, বলার নয়। আমি উঠে বসে জানালাটা খুলে বাইরে তাকালাম, আবছা আলো হয়ে। আছে। কি সুন্দর লাগছে চারিদিকে! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভোরবেলা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। মানুষের মন এমনিতেই তখন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীতে এত। যে খারাপ মানুষ আছে আর এত যে খুনখারাপী, চুরি ডাকাতি হয়, আমি একেবারে বাজি ধরে বলতে পারি এরকম ভোরবেলায় কখনো কোথাও কোন খারাপ কাজ হয় না। কিছুক্ষণের জন্যে পৃথিবীর সব মানুষ ভাল হয়ে যায়।

একটু বেলা হলে আমি জারুল চৌধুরীর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তাঁর দরজায় এই এত বড় একটা তালা ঝুলছে। জারুল চৌধুরী এমনিতে নিজের দরজায় কোন তালা লাগান না, নিশ্চয়ই কয়েকদিনের জন্যে অন্য কোথাও গেছে। আমার একটু মন খারাপ হল, কারো সাথে কথা বলার জন্যে আমার বুকটা একেবারে হাঁশফাশ করছে।

জারুল চৌধুরীকে না দেখে আমি ভাবলাম সলীলের বাসায় যাই, কিন্তু আজ স্কুল খোলা, সে নিশ্চয়ই স্কুলে যাবে। আমার বইপত্র খাতা কলম কিছু নেই, স্কুলে যাবার। কোন প্রশ্নই আসে না। কি করব বুঝতে না পেরে আমি হাঁটতে বের হলাম। আমি সবসময়ই গ্রামের বেশ কাছাকাছি থেকেছি কিন্তু গ্রামটা কখনোই খুব ভাল করে দেখা হয়নি। আজকে হয়তো একটু ঘুরে ঘুরে দেখতে পারব।

হাঁটতে হাঁটতে আমি বেশ কিছু জিনিস আবিষ্কার করলাম। গ্রামে অনেক বাচ্চা আছে যারা কখনোই স্কুলে যায় না। স্কুলে না গিয়ে তারা যে খেলাধুলা করে বেড়াচ্ছে সেটা সত্যি নয়। সবাই কোন না কাজ করছে। অনেকে গরু মাঠে নিয়ে যাচ্ছে, অনেকে ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে, অনেকে ঘাস কাটছে, আবার অনেকে মাছ ধরছে। নদীর ধারে একটা ডোবার পাশে অনেকগুলি বাচ্চা মিলে মাছ ধরছিল। প্রথমে কাদামাটি দিয়ে একটা ছোট অংশ আলাদা করে গামলা দিয়ে পানি সেঁচতে শুরু করল। পানি যখন কমে এল তখন দেখি অনেক রকম মাছ সেখানে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাগুলি হাতড়ে হাতড়ে সেগুলি ধরতে লাগল। আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম দেখে একজন বলল, মাছ ধরতে চাও?

আমি মাথা নাড়তেই সে বলল, আস তাহলে ধর!

আমি শার্টের হাতা গুটিয়ে মাছ ধরতে শুরু করলাম। ব্যাপারটা দেখতে যত সহজ মনে হয় আসলে মোটেও তত সহজ নয়। হাত থেকে পিছলে পিছলে বের হয়ে যায়। আমার মাছ ধরা দেখে বাচ্চাগুলি হেসেই বাঁচে না। মাছ ধরার মাঝে যে কোন বিপদ থাকতে পারে আমার একবারও মনে হয়নি, কিন্তু হঠাৎ একটা শিং মাছ বুড়ো আঙুলে ঘঁই মেরে বসল। আমি চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালাম। একজন জিজ্ঞেস করল, শিং মাছ। মেরেছে?

আমি মাথা নাড়লাম, বুড়ো আঙুল থেকে রক্ত বের হয়ে গেছে। ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, শিং মাছ বড় খচ্চর, ঠিক করে ধরতে হয় উপর থেকে চেপে, না হলে ঘাই মেরে দেয়। অনেক ব্যথা করবে এখন।

সত্যি সত্যি অনেক ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ছোট মতন একটা বাচ্চা বলল, আঙুলের মাঝে পেশাব কর, ব্যথা কমবে।

আমি প্রথমে ভাবলাম ছেলেটা আমার সাথে ফাজলেমি করছে, কিন্তু দেখলাম অন্য সবাই মাথা নাড়ল, ফাজলেমি নয়, এটা চিকিৎসা। এরকম চিকিৎসায় আমার বেশি ভরসা নেই, আমি হাত ধুয়ে উঠে এলাম। যখন চলে আসছিলাম একজন বলল, তোমার মাছগুলি নিয়ে যাও।

আমি বললাম, আমার লাগবে না! তোমরা নিয়ে নাও।

দেখতে দেখতে আঙুলটা ফুলে উঠল। আমি হেঁটে হেঁটে ফিরে এলাম। জারুল চৌধুরী এখনো ফিরে আসেননি। আমি খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে আবার গাছঘরে ফিরে গেলাম। মনটা এত খারাপ হয়ে আছে যে, বলার নয়। খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু শুকনো চিড়া চিবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে করল না। আমি গাছঘরের মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলাম। পেটে খিদে, হাতে ব্যথা। মনটা খুব খারাপ। কেন জানি শুধু লাবলুর। কথা মনে হচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ কাদলাম, তারপর মনে হয় একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি খুব বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখলাম। আমি একটা নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নদীর পানি কুচকুচে কাল। সেই পানির নিচে লম্বা লম্বা শুড়ের। অক্টোপাস। সেগুলি আমাকে ধরতে আসছে আর আমি তার মাঝে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ আমাকে কে যেন ডাকল, মুনীর!

আমি তাকিয়ে দেখি, বাবা। বাবার হাতে একটা বন্দুক। বাবা বন্দুকটা আমার দিকে তাক করে ধরে আবার ডাকলেন, মুনীর!

আমি ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করলাম, তখন বাবাও আমার পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলেন। কিন্তু আমি যেরকম পানির উপর দিয়ে দৌড়াতে পারি, বাবা পারেন না। পানিতে পা দিতেই বাবা ডুবে গেলেন আর সবগুলি অক্টোপাস এসে বাবাকে প্যাচিয়ে ধরল। বাবা তখন চিৎকার করতে লাগলেন, মুনীর মুনীর মুনীর।

আর ঠিক তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনি সত্যিই কে যেন আমাকে ডাকছে, মুনীর, এই মুনীর।

আমি চোখ খুলে দেখি সলীল। আমার মুখের উপর উবু হয়ে বসে আছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম, বললাম, সলীল! তুই?

সলীল দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি ঠিক ভেবেছি তুই এখানে থাকবি! ঠিক ভেবেছি।

আমার তখনো চোখে ঘুমের ঘোর, চোখ কচলে বললাম, কেমন করে বুঝলি?

না বোঝার কি আছে? সলীল হাতে কিল দিয়ে বলল, তুই যদি বাড়ি থেকে পালাস তাহলে আর কোথায় যাবি?

আমি বাড়ি থেকে পালাইনি, বাবা বের করে দিয়েছে।

ঐ একই কথা!

মোটেও এক কথা না। বাবাকে তুই চিনিস না। আরেকটু হলে বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ফেলত।

সলীল কিছু বলল না, আমিও আর সেটা নিয়ে কিছু বললাম না। সলীলকে দেখে এত ভাল লাগছে যে, বলার নয়। ইচ্ছে হচ্ছিল একেবারে জড়িয়ে ধরি কিন্তু হাজার হলেও বড় হয়ে যাচ্ছি, কাজেই আর জড়িয়ে ধরলাম না, কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, সলীল হবে আমার সারা জীবনের প্রাণের বন্ধু। যেরকম বন্ধুর জন্যে মানুষ জান দিয়ে দেয় সেরকম বন্ধু।

সলীলের হাতে একটা ঠোঙা, আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা।

কি?

তোর জন্যে পরটা মাংস এনেছি!

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, সত্যি? খোদার কসম?

ধুর গাধা, এইজন্যে আবার খোদার কসম বলতে হয়?

আমি তাড়াতাড়ি ঠোঙাটা খুলে দেখি সত্যিই খবরের কাগজে মোড়া বড় বড় দুইটা পরটা ভিতরে মাংস দিয়ে প্যাচিয়ে এনেছে। আরেকটা ছোট ঠোঙায় দুইটা লাড়ু। সাথে বড় বড় দুইটা কলা। খাবারগুলি দেখে আমার একেবারে জিবে পানি এসে গেল।

সলীল বলল, আমি বুঝেছিলাম তোর নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি। সুবলের রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে এনেছি। দ্যাখ খেয়ে, মনে হয় এখনো গরম আছে।

কেন জানি হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে গেল। খুব সাবধানে আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। সলীল না দেখার ভান করে দূরে তাকিয়ে রইল।

আমি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কেমন করে খবর পেলি?

এরকম খবর কি চাপা থাকে নাকি? তুই রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে গেছিস, লোকজন সেটা জানবে না? আমি গিয়েছিলাম তোদের বাসায়।

সত্যি? গিয়েছিল?

হ্যাঁ।

কি দেখলি?

মাসীমা খুব কান্নাকাটি করছেন।

আর লাবলু? জ্বর কমেছে?

জ্বর ছিল নাকি? দেখে তো মনে হল না। লাবলু কাঁদছে না তবে খুব গম্ভীর।

আমি বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম না, সলীল নিজেই বলল, তোর বাবা খালি লাফ ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তাই?

হ্যাঁ। বলছেন দুইদিন যখন না খেয়ে থাকবি তারপরেই নাকি সুড়সুড় করে ফেরৎ যাবি।

তাই বলছেন?

হ্যাঁ। সলীল মাথা নাড়ল, তুই যখন ফিরে যাবি তখন নাকি তোকে আচ্ছামত ধোলাই দেওয়া হবে।

আমি আর কিছু বললাম না।

সলীলের সাথে আরো নানারকম কথা হল, আমি তাকে শিং মাছের ঘাই খাওয়ার কথা বললাম, তার বিচিত্র চিকিৎসার কথা শুনে সে হেসেই বাচে না। জারুল চৌধুরী। কোথায় যেতে পারেন সেটা নিয়েও কথা হল। রাত্রে কেমন ঘুম হয়েছে, একা একা ভয়। পেয়েছি কিনা সলীল সেগুলিও খুব খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাইল। সন্ধ্যে হয়ে এলে যখন সলীলের বাসায় চলে যাবার সময় হল, হঠাৎ করে সে বলল, তোদের বাসার কাছে আরো একজন পালিয়ে গেছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কে?

তোদের বাড়িওয়ালা উকিল সাহেবের বাসায় গরু রাখে যে ছেলেটা—

জয়নাল?

হ্যাঁ, জয়নাল।

জয়নালের কি হয়েছে?

বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। গরু বাছুর ছেড়ে দিয়েছে, সেই গরু বাছুর নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে, জয়নালের দেখা নেই।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, হতেই পারে না।

হতে পারে। সলীল হাসার মত ভঙ্গি করে বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তোদের উকিল সাহেব এই এত বড় একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জয়নালকে ধরে আনা হলেই এক ঘা মেরে মাথা দুইভাগ করে দেবেন।

আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। মাত্র সেদিন আমি জয়নালের চিঠি লিখে দিয়েছি। লম্বা চিঠি। সেখানে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কোন উল্লেখ নেই। হঠাৎ করে আমার একটা কথা মনে হল। আমি চমকে উঠে বললাম, সর্বনাশ!

সলীল অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?

নাওয়াজ খান!

নাওয়াজ খান কি?

নাওয়াজ খান নিশ্চয়ই জয়নালকে আটকে রেখেছে! নিশ্চয়ই খুন করে ফেলবে।

কি বলিস তুই?

হ্যাঁ। তার আরেক বন্ধু ছিল যে নাওয়াজ খানের কাছে যেতো, কয়দিন আগে খুন হয়েছে, মনে নেই?

হ্যাঁ, তুই বলেছিলি।

আরো অন্যেরা নিখোঁজ হয়ে গেছে, কোন খোঁজ নেই। এখন জয়নালের কোন খোঁজ নেই! তুই বুঝতে পারছিস না?

সলীল ভুরু কুঁচকে বলল, তুই বলছিস জয়নাল খুন হয়ে গেছে?

আল্লাহ না করুক! কিন্তু—

কিন্তু কি?

জয়নালকে আমি চিনি, সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে সে কোনদিন বাসা থেকে পালাবে না। নিশ্চয়ই তার কোন বিপদ হয়েছে। নিশ্চয়ই–

সলীল মুখ সূচালো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই ঠিকই বলেছিস। নাওয়াজ খান খুব ডেঞ্জারাস মানুষ।

কি করা যায় বল তো?

সলীল খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের যেতে হবে তাকে বাঁচানোর জন্যে।

আমরা?

হ্যাঁ, কাউকে বলে লাভ নেই, কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না।

ঠিকই বলেছিস। আমি মাথা নেড়ে বললাম, চল যাই তাহলে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ঠিক রওনা দেওয়ার আগে সলীল বলল, চল জারুল চৌধুরীকে একটা চিঠি লিখে যাই, কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি বলে। আমাদের যদি কিছু একটা হয় তাহলে অন্ততঃ কেউ একজন জানবে!

সলীল খুব সুন্দর বাংলা লিখতে পারে, খুব গুছিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলল। চিঠিটা তার দরজায় লাগিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *