১১. উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদা
আমার সবসময়ই কেমন মনে হয় প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই, সে ধনী হোক, দরিদ্র হোক, বিদ্বান বা মূর্খ হোক– প্রত্যেকের মধ্যেই একটা জীবন-রচনার বৈচিত্র্য আছে। সেই জীবনের মধ্যে মুখ্য কতগুলি চরিত্রের সর্বক্ষণ আনাগোনা তো থাকেই মা-বাবা, ভাই-বন্ধু অথবা স্ত্রী। কিন্তু এমন মুখ্য চরিত্র ছাড়াও আরও কতগুলি পার্শ্বচরিত্র থাকে তারা যে জীবনটাকে খুব পালটে দেয়, তা নয়, তবে জীবনের মধ্যে যে সব ফাঁকফোকর থাকে, ছোট্ট ছোট্ট দুঃখ সুখ থাকে, সেখানে তারা রং লাগিয়ে দেয়। এই চরিত্রগুলি যে সবসময় সামাজিক ব্যবহার এবং সৌজন্য মেনে জীবনের মধ্যে কোনও বিশিষ্ট জীবনধারা তৈরি করে, তাও নয়, কিন্তু আপন নিজস্বতায় তারা এমনই সম্পূর্ণ যে, তাদের বুঝতে হলে ব্যক্তিগত জীবনপটের বাইরে গিয়ে, তাদের দিক থেকেই জীবনটা বিচার করতে হয়।
এই যে মহাভারতের এত বড় চরিত্রটি পাণ্ডব অর্জুন, গাণ্ডীবধন্থ– তিনি কেমন রিক্ত হয়ে গেলেন কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে বিবাহ করে আনার পরেও। প্রথমত দ্রৌপদী-বিবাহের শর্তপূরণ করে মীনচক্ষু লক্ষ্যভেদ করার পরেও অর্জুন দ্রৌপদীর সম্পূর্ণ অধিকার পেলেন না। বৃহত্তর স্বার্থে দ্রৌপদীর এক-পঞ্চমাংশ লাভ করেই তাকে তৃপ্ত থাকতে হল। তাও বা বেশ চলছিল, প্রথম মধ্যম পাণ্ডবের পর তারই ক্রম উপস্থিত হতে পারত নারদ ঋষির নির্দিষ্ট বিধি অনুসারে। এক ব্রাহ্মণের গোরু হারিয়ে গেল– বলিহারি যাই ব্রাহ্মণের, ওই সময়েই তাঁকে গোরু হারাতে হয়, আবার তার চেয়েও বলিহারি মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীর সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করার জন্য যুধিষ্ঠির সেই অস্ত্রাগারেই তখন বসে আছেন, যেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে ব্রাহ্মণের গোধনহারী দস্যুকে শাস্তি দিতে হবে। অর্জুন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলেন, জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে দেখলেন দ্রৌপদীর সঙ্গে এবং নারদের বিধিনিয়ম মেনে শেষ পর্যন্ত বনবাসে চলে গেলেন ব্রহ্মচারী হয়ে, বারো বছর কাটানোর জন্য। সেটাই নিয়ম।
অর্জুন চললেন বনবাসে, তার পিছন পিছন চললেন কত ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, কণ্বক, পৌরাণিক সবাই তারা অর্জুনের বনবাসজীবন গল্পে-কথায়-সঙ্গ-সাযুজ্যে ভরিয়ে তুলবেন। অনেক তীর্থ, অনেক বন-পাহাড়-নদী পেরিয়ে অর্জুন এসে উপস্থিত হলেন গঙ্গাদ্বারে। গঙ্গাদ্বার জায়গাটা তার বেশ পছন্দ হয়ে গেল– আর পছন্দ হবে নাই বা কেন- এই তো অন্য নামে আজকের হরিদ্বার। গঙ্গাদ্বারের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষত গঙ্গা-ভাগীরথীর শোভা দেখে অর্জুনের মন পুলকিত হল। তিনি সেখানে কিছুদিন বাস করার জন্য একটি আশ্রম বানিয়ে ফেললেন স গঙ্গাদ্বারমাসাদ্য নিবেশমকররাৎ প্রভুঃ। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রপাঠ করে যজ্ঞের আগুন জ্বাললেন, আরম্ভ হল অগ্নিহোত্র, পুষ্পহুতি। পবিত্র যজ্ঞের আগুন গঙ্গার ওপার থেকেই দৃষ্টিগোচর হল অনেকের তেষু প্রবোধ্যমানে… তীরান্তরগতে্যু চ।
নতুন স্থানে নতুন আশ্রম-নিবেশ করার পর ব্রাহ্মণদের মাঙ্গলিক এবং নিত্যকর্ম আরম্ভ হতেই অর্জুন এবার নামলের গঙ্গায় স্নান করতে। গঙ্গাদ্বারের শীতল জলে স্নান করে স্নিগ্ধ হবার পর গঙ্গার জলেই পিতৃলোকের তর্পণ করে নিলেন অর্জুন। স্নান-তর্পণের পর এবার বেদবিহিত অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করার ইচ্ছে হল তার। ভাবলেন, এবার জল থেকে উঠে নব নিবেশিত আশ্রমে বসে অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান করবেন তিনি। তাই জল থেকে ওঠা দরকার। গঙ্গার তীরে আশ্রম-নিবেশের পর এমনভাবেই অর্জুন স্নান-তর্পণ পরপর করে যাচ্ছিলেন যাতে তার ধর্মপালনের ক্রমটুকু পরিষ্কার বোঝা যায়। বোঝা যাচ্ছিল যেন এবার তিনি অগ্নিহোত্র করার কথা ভাবছেন। ঠিক এই সময়েই সেই বিরাট বিভ্রাট ঘটে গেল। নাগকন্যা উলূপী এসে জলের ভিতরেই তাকে টেনে নিয়ে গেলেন আরও গভীরে, আরও গভীর জলের মধ্যে, অন্য কোনও স্থানে অবকৃষ্টো মহাবাহুর্নাগরাজস্য কন্যয়া।
মহাভারতের এই কাহিনি বেশ রূপকথার মতো শোনাচ্ছে। যেন রূপকথার ছবির মতো নাগকন্যা উলূপীর পুচ্ছভাগ মৎস্যের মতো। মুখখানি এক সুন্দরী মেয়ের। সে জলপরীর মতো এসে অর্জুনের পা ধরে টেনে নিয়ে গেল কোনও নাগলোকে অর্জুনকে তাঁর ভাল লেগেছে, অতএব তাকে চাই অগ্নিতৃষিত বক্ষে, বাহুর ঘেরে। আর মহাবীর অর্জুনও চললেন জলের মধ্যে, জলের গভীরে তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হল না। দিব্যি অবশের মতো চলে গেলেন নাগ-সুন্দরীর টানে– অন্তৰ্জলে মহারাজ উল্প্যা কামমানয়া।
প্রথমেই জানানো ভাল যে, মহাভারতের কবি কাহিনি বলার সময় রূপকথার ছাঁদ ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু কাহিনির অন্তরে তিনিই ইতিহাস, মানবতত্ত্ব সবই ব্যবহার করেন। মহাভারতের ইতিহাসনিষ্ণাত ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যে, আমাদের দেশে নাগ-জনজাতির অধিষ্ঠান ছিল মহাভারতীয় জনগোষ্ঠীর অনেক আগে থেকে। নাগ অর্থ কখনও হস্তী কখনও বা সর্প। পণ্ডিতেরা বলেন– এই দুই অর্থেই মহাভারতপূর্ব সেই জনজাতিকে সপ্রমাণ করা যায়। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, হস্তিনাম থেকে হস্তিনাপুর বা নাগসাহুয়– এই নামও মহাভারতপূর্ব নাগ-জনজাতির উপস্থিতি বা বসতি প্রমাণ করে। অন্যদিকে মহাভারতের আস্তীক-পর্বে যে বহুতর সর্পনাম বা নাগনাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলিই মহভারতীয় রাজা-মহারাজার নাম। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের নামই আস্তীক-পর্বে উল্লিখিত এক সৰ্পনাম। এবং এই যে নাগকন্যা উলূপী, ইনি যাঁর কন্যা তিনি নামে যতই রূপকথার সর্প হোন, তার নাম কিন্তু ‘কৌরব্য অর্থাৎ তিনি কুরুবংশের জাতক এবং তার বংশ নেমে আসছে ঐরাবত নামের এক বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে। দেখা যাচ্ছে, ইন্দ্রের সুরহস্তী ঐরাবত এবং সর্পরাজ কৌরব্য একাকার হয়ে গেলেন আমাদের জনজাতির ভাবনায় সমস্ত বিভ্রান্তি ঘটিয়ে দিয়ে।
হয়তো হস্তী এবং সর্প– এই দুইয়ের একই পর্যায়-শব্দ নাগ’ কথাটিই বিভ্রান্তির মূলে। আবার এমনও বলা যায় যে, হস্তীই হোন অথবা সৰ্পই হোন, এঁরা অবশ্যই মহাভারতীয় আর্যজনগোষ্ঠীর পূর্বতন জনজাতি, যাঁদের সঙ্গে মহাভারতীয় আর্যগোষ্ঠীর শত্রুতা হয়েছে। কখনও, আবার কখনও বা বন্ধুত্বও হয়েছে; সবচেয়ে বড় ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটা হল, আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে পুরাতন এই গোষ্ঠীর ‘অ্যাসিমিলেশন’ বা তন্ময়ীভবন। যার ফলে অনন্ত, বাসুকি বা শেষনাগ আমাদের পূজনীয় ব্যক্তিত্ব এবং এই তন্ময়ীভবন এতটাই যে, এঁরা
আর্য জনগোষ্ঠীর আচার-ব্যবহারও আত্মসাৎ করেছিলেন। এর শ্রেষ্ঠতম প্রমাণ মিলবে সেই নাগকন্যা উলূপীর আচরণে– যিনি এই এক্ষুনি বিশাল সংহৃত বারিসঞ্চয়ের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলেন অর্জুনকে। একটু আগে অর্জুনকে ধরে নিয়ে যাবার সময় উলূপীকে আমরা প্রথম দর্শনের প্রেমেই পাগলপারা দেখেছি, মহাভারতের ভাষায় তাকে কামার্তাই বলা চলে– উপ্যা কামমানয়া- অথচ অর্জুনকে জলের গভীরে টেনে নিয়ে যাবার পর এতটুকু কামাভাস তার শরীরে নেই, নেই এতটুকু বিচলন, তিনি অর্জুনকে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অগ্নিশরণ-গৃহে, যেখানে অগ্নিহোত্র-কর্ম সমাধা করা যায়। নাগরাজ ভবনে স্থিত হতেই অর্জুন দেখেছেন যে, তিনি পবিত্র অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন– দদর্শ পাণ্ডবস্তত্র পাবকং সুসমাহিতঃ।
অর্থাৎ এই অপ্রবেশ্য নাগরাজ্যেও আর্যজনোচিত অগ্নিসেবা চলে। জলের গভীরে একেবারে পাতালে এই নাগরাজ্যের অবস্থিতি কিনা, সেটা রূপকথার পরিসর বটে, কিন্তু মহাভারতে বর্ণিত নাগদের মনুষ্যরূপ এবং তাঁদের বেশবাস, বাড়িঘর এবং রাজপ্রাসাদ নিশ্চয়ই অন্তর্জলীয় কোনও সত্য হতে পারে না। বিভিন্ন প্রমাণ থেকে বরঞ্চ এটাই প্রতিষ্ঠা করা যায় যে, নাগ-জনজাতির মানুষেরা আর্য-অধ্যুষিত ভূখণ্ড থেকে একটু দূরেই থাকতেন। তারা যে জায়গায় থাকতেন, সেখানে জলের প্রাচুর্য ছিল। নাগরাজ কৌরব্যের রাজগৃহে সমিদ্ধ অগ্নিদর্শন করে অর্জুন পূর্বের ইচ্ছামতো অগ্নিহোত্র সমাধা করলেন নিশ্চিন্ত মনে– তত্রাগ্নিকার্যং কৃতবান্ কুন্তীপুত্রো ধনঞ্জয়ঃ। এতক্ষণ পরে বুঝি নিশ্চিন্ত সময় এল ভাববার কেন এই সুন্দরী নাগরমণী তাকে এইখানে ধরে নিয়ে এসেছে নিশ্চয়ই সেটা অগ্নিহোত্রের সুসমাধানের জন্য নয়।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন– হঠাৎ তুমি এমন একটা সাহসের কাজ করে ফেললে কেন– কিমিদং সাহসং ভীরু কৃতব্যসি ভাবিনি। আর এই সুন্দর দেশটাই বা কার? এ দেশের রাজা কে? তুমিই বা কার মেয়ে। মেয়ে উত্তর দিল– প্রসিদ্ধ ঐরাবতবংশে জন্মেছেন আমার পিতা কৌরব্য। আমি তারই মেয়ে, আমার নাম উলূপী, নাগকন্যা উলূপী– তস্যাস্মি দুহিতা বীর উলূপী নাম পন্নগী। এতক্ষণ রীতিমতো আর্যজনোচিত ব্যবহার করে উলূপী তার নিজের মর্যাদা, ধৈর্য এবং সংযম পরিষ্কার করে দিয়েছেন। কিন্তু এখন যখন অর্জুন প্রশ্ন করছেন– আমাকে এখানে টেনে নিয়ে আসার এই আকস্মিকতার মধ্যে তোমার কী অভিপ্রায়, তখন উলূপী স্পষ্ট জানাতে দ্বিধা করলেন না। বললেন- তুমি যখন গঙ্গায় স্নান করতে নেমেছিলে, তখনই তোমাকে দেখে মোহিত হয়েছি আমি, ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে। তোমাকে পাবার জন্য আমার শরীর-মন দুই-ই উৎসুক হয়ে আছে– দৃষ্ট্রেব পুরুষব্যাঘ্ৰ কন্দর্পেনাস্মি পীড়িতা।
সেকালে যাকে পাবার ইচ্ছে হত- সে পুরুষ হোক অথবা নারীই হোক– অকপটভাবে নিজের অভিলাষ স্বীকার করতে নারী অথবা পুরুষের লজ্জা হত না। উলূপী বলেছেন– তোমাকে পাবার জন্যই আমার শরীর-মন জর্জরিত হয়ে আছে, অতএব তোমারও উচিত আমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। তা ছাড়া এমনও তো নয় যে, আমার একটি স্বামী আছে, যার কাছে আমি আত্মনিবেদন করতে পারি। অতএব আমাকে নিয়ে তোমার দ্বিধার কারণ নেই কোনও। এসো, আজই কোনও নির্জন স্থানে মিলন হোক আমাদের অনন্যাং নন্দয়স্বাদ্য প্রদানেনাত্মনো রহঃ– এবং আমাকে তুমি নন্দিত করো নিজেকে আমার হাতে সমর্পণ করে।
অর্জুনের কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করার মধ্যে উলূপীর নিজস্ব আন্তরিকতার কোনও অভাব ছিল না এবং হয়তো এই গভীর এবং তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণেই তার বক্তব্যে সত্যের সামান্য অপলাপ থেকে গেছে। সেই সত্য খুব প্রয়োজনীয় না প্রাসঙ্গিক, সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে, সেই সত্যের অপলাপটুকুও যথেষ্ট প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
উলূপীর কথা শুনলে কী মনে হবে? এটাই তো বরং পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে, প্রথম দর্শনেই মহাবীর অর্জুনকে তার ভাল লেগেছে এবং তিনি তাকে পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছেন। অর্জুনকে যে তিনি এত তীব্রভাবে মনের কথা বলতে পেরেছেন, তার জন্য অর্জুনের নির্বিবাদ মৌনতাও খানিকটা দায়ী ছিল নিশ্চয়ই। সেই যে স্নানরত অবস্থায় অর্জুনের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলেন– নিয়ে এলেন অন্য কোথাও, গভীর জলবৎ কোনও গহন স্থানে, একেবারে নিজের ক্রীড়াভূমিতে, অর্জুন তো কই বাধা দিলেন না একটুও। যে মহাবীর অর্জুন গুরুর আজ্ঞাপালনের জন্য দ্রুপদের মতো বীরকে জীবিত ধরে আনলেন, যিনি মৎস্যচক্ষু ভেদ করে যুধ্যমান সমস্ত নরপতিদের হারিয়ে দিলেন দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য, সেই মহাবীর অর্জুন নাগকন্যা উলূপীর কোমল বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না, এ-কথা কি বিশ্বাস্য? নাকি সে-বাহুপাশ ছাড়াতে চাননি বলেই উলূপীর টানে ধরা দিয়ে নির্বিবাদে এবং ভারী নিশ্চিন্তে চলে এসেছেন উলূপীর গহন বাসস্থানে– দূরে, বহুদূরে, আর্যনিবাস ছেড়ে অন্য এক আর্যায়িত জনস্থানে।
উলূপী অর্জুনকে বলেছিলেন– এমন তো নয় যে, আমার স্বামী আছেন অথবা আছেন আমার সত্তার কোনও অধিকারী, অতএব আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করো আজই– অনন্যাং নন্দয়স্বাদ্য। কিন্তু এই কথাটা নিয়েই গোল বেধে গেছে। উলূপীর কোনও অধিকারী, অর্থাৎ এমন কোনও পুরুষ, যিনি বলতে পারেন– উলূপী আমার, সে আমার স্ত্রী না, এমন কোনও পুরুষ এখন কেউ নেই বটে, কিন্তু এক সময়ে ছিল–তার মানে উনূপী বিবাহিতা রমণী। এই বিবাহের সবিশেষ প্রমাণ আছে মহাভারতেই। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে উনূপীর গর্ভজাত অর্জুনের পুত্র ইরাবান যখন যুদ্ধ আরম্ভ করলেন, তখন কৌরবপিতা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে সোজাসুজি কোনও প্রশ্ন না করলেও ‘ইরাবান’ নামটা শুনেই প্রশ্নোৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। সঞ্জয় বলেছিলেন–ইরাবান অর্জুনের পুত্র। পিতাকে সাহায্য করার জন্য সে এই যুদ্ধে এসেছে– অর্জুনস্য সুতঃ শ্রীমান ইরাবান্নাম বীর্যবান।
পরিচয় এইটুকুতেই শেষ হয়নি এবং সেই সবিশেষ পরিচয় থেকেই খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, নাগকন্যার পূর্বে একবার বিবাহ হয়েছিল এবং তা হয়েছিল স্বজাতীয় এক নাগ-পুরুষের সঙ্গেই। সেটাই স্বাভাবিক। সুন্দরী কন্যাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন উলূপীর পিতা ঐরাবত কৌরব্য। কিন্তু উলূপীর দুর্ভাগ্য এমনই যে তার সর্প-স্বামীটি পক্ষিরাজ গরুড়ের হাতে মারা পড়লেন। এটা সবাই জানেন যে, সর্পের চিরশত্রু হলেন গরুড় বৈনতেয়। বংশগত কারণে সর্পরা গরুড়ের বৈমাত্রেয় ভাইও বটে আবার শত্রুও বটে। তাদের অনেক বিখ্যাত কলহ মহাভারত-পুরাণে বর্ণিত আছে। লৌকিক দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, একই পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও গরুড় এবং তজ্জাতীয়েরা তৎকালীন আর্যগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসেন তাড়াতাড়ি এবং এতটাই তাঁদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায় যে, গরুড় পুরুষোত্তম নারায়ণের বাহন নিযুক্ত হন। এমন হতে পারে– গরুড় যে গোষ্ঠীর প্রধান, তারা পক্ষীর ‘টোটেম’ ব্যবহার করতেন এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর নাগপুরুষেরা সর্পের ‘টোটেম’ ব্যবহার করতেন। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা ছিল চিরন্তন। ফলে কোনও এক সময় উলূপীর স্বামী গরুড়ের হাতে অথবা গরুড় গোষ্ঠীর কারও হাতে মৃত্যুবরণ করেন। উলূপীর স্বামীর সঙ্গে তার বিবাদের কোনও কারণ ছিল কি ছিল না, সেটা অমূলক; কারণ তাদের বিবাদ-বিরোধ কারণে-অকারণে সংঘটিত হত।
বিবাহের পরপরই নাগকন্যা উলূপীর সুখের দিন ফুরিয়ে গেল। তিনি কম সুন্দরী ছিলেন না, মহাভারতে তাকে বুড়ো বয়সেও সুন্দরী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সুন্দরীর স্বামী মারা গেলেন অকালে। তিনি পিতৃগৃহেই লালিত হতে লাগলেন– মনটা শোকে কাতর, তার জীবনটা অতি অল্প বয়সেই অন্ধকার হয়ে গেল। তার কোনও একটা ছেলেও নেই যে, তিনি তাকে নিয়ে দুঃখের দিনগুলি অতিবাহিত করবেন– পতৌ হতে সুপর্ণেন কৃপণা দীনচেতনা। পিতা ঐরাবত কৌরব্য তার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। এত অল্প বয়সে তার সুন্দরী মেয়েটি বিধবা হয়ে গেল।
কিন্তু সময় এমন জিনিস যে, অতিক্রান্ত কালের সঙ্গে মানুষের মনের ব্যথা, দুঃখ, বেদনা, এমনকী ক্রোধও উপশম করে দেয়। তা ছাড়া এতই অল্পসময় উলূপী স্বামীর ঘর করেছিলেন, এতই স্বল্প ছিল তার সঙ্গকাল যে, স্বামীর কথা ভুলতে তাঁর সময় লাগল না। কিন্তু জীবনে কাঁটা একটা রয়েই গেল– তার এই নবীন বয়সে, যৌবনের শরীরী যন্ত্রণাগুলি এখনই তো সব শান্ত হয়ে যাবার কথা নয়। কিন্তু এখন কেই বা তাকে বিয়ে করবে, আর এই ক্ষুদ্র নাগগোষ্ঠীর মধ্যে তার বিবাহের কথাটাও নিশ্চয়ই এতটাই প্রচারিত যে, সহজে কোনও নাগপুরুষ একজন বিধবাকে বিবাহ করবে না।
উলূপী এটা বুঝেছিলেন যে, তার নিজের ব্যবস্থা তাঁকে নিজেই করতে হবে, কেননা পিতা কৌরব্য নাগও যে খুব তাড়াতাড়ি তার কন্যাটির জন্য স্বামী সংগ্রহে মন দেবেন, এটা ভাবা উচিত নয়। উনূপী যেহেতু স্বল্পকালের জন্য হলেও সামান্য দাম্পত্যের আস্বাদ পেয়েছেন, অতএব শ্বশুরগৃহেই হোক, কিংবা পিতৃগৃহে, তিনি শান্ত হয়ে বসবাস করলেও তার মনের বাসনালোকে অদ্ভুত সেই আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিলই। তিনি তেমনই এক পুরুষ চাইছিলেন, যার সঙ্গলাভে তিনি নন্দিত হতে পারেন। নইলে কেনই বা তিনি এই অকালে নিজের বাসভবন ছেড়ে কোন বাতুলতায় সেই গঙ্গাদ্বারে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন! এসে অবশ্য ভালই হয়েছে। অর্জুনের মতো পুরুষসিংহকে তিনি দেখতে পেলেন এবং দেখামাত্রেই তিনি আর দেরি করেননি, লজ্জা করেননি, সংকুচিত হননি স্ত্রীজনোচিত সীমাবদ্ধতায়। আমরা দেখেছি– অর্জুনকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখে উলূপী মোহিত হয়েছেন এবং তিনি যে নিঃসঙ্কোচে তাকে টেনে এনেছেন তার মধ্যে এতটাই তার সত্যমধুর আত্মনিবেদন ছিল যাতে অর্জুন একটি কথা পর্যন্ত বলতে পারেননি।
উলূপীর মানুষ চিনতে ভুল হয়নি। এইরকম সিংহের মতো এক পুরুষ হঠাৎ গঙ্গাদ্বারে এসে আশ্রম-নিবেশ করে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ওঠা-বসা করছেন– এটা স্বাভাবিক লাগেনি উলূপীর কাছে। দ্রৌপদীর কারণে মনে মনে ভগ্ন হয়েই ছিলেন অর্জুন। কাজেই আজ যখন এই নাগকন্যা তাঁকে স্বেচ্ছায় আত্মনিবেদন করলেন, তখন সামান্য যে-কথাগুলি বলে তিনি কথা আরম্ভ করলেন, তার মধ্যে বীরোচিত ভদ্রতাই প্রাথমিক ছিল, ঠিক যেমন ছিল উলূপীর ভদ্রতা– তিনি অর্জুনকে প্রথমে তার ব্রাহ্মসংস্কার সাঙ্গ করতে দিয়েছেন অগ্নিহোত্রের সমাধান করে– এখনও পর্যন্ত আপন অভিলাষের কথা কিছুই বলেননি উলূপী। কিন্তু অর্জুন তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই মনের সরল-সত্য অভিলাষ একেবারে নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন তিনি এবং প্রয়োজনীয় সত্যটুকু গোপনও করেছেন সমান সরলতায়। কেননা, শুধু বিবাহ হয়েছিল’– এই সত্যটুকু তাঁর রমণী-জীবনের সর্বসার সত্য নয়। শুধু এই সত্য নিয়ে সুন্দরী যৌবনবতী এই রমণী জীবন কাটাতে চান না বলেই অর্জুনের কাছে দ্ব্যর্থহীন আত্মনিবেদন এবং পূর্ব ঘটিত সত্যের স্বেচ্ছাকৃত অপলাপ।
অর্জুন, মহাবীর অর্জুন এতটুকু জটিল প্রশ্ন করেননি আর, উলূপীর প্রস্তাব হৃদয়ঙ্গম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে তিনি নিজের অসহায়তার কথা জানিয়েও কীভাবে উনূপীর কথায় রাজি হওয়া যায়, তার উপায় খুঁজছিলেন তিনি। নাগকন্যার সঙ্গে মিলিত হবার প্রধান অন্তরায় হল পূর্ব প্রতিজ্ঞাত সেই ব্রহ্মচর্য! নারদের কাছে পাঁচ ভাইয়ের প্রতিজ্ঞা ছিল দ্রৌপদীর সঙ্গে যার নির্ধারিত সহবাস চলবে, তখন যদি অন্য কেউ সেই ভাইয়ের ঘরে প্রবেশ করে তবে বারো বছরের বনবাস এবং সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে অর্থাৎ স্ত্রীসঙ্গ বর্জিত অবস্থায় থাকতে হবে তাকে। অর্জুন স্বয়মাগত এই রমণীকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারছেন, অন্যদিকে ব্রহ্মচর্যের স্থলন– এই দুইয়ের দ্বৈরথে উলূপীকেই বিচারক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন, কারণ নাগকন্যার প্রগলভ উচ্ছ্বাস তার ভাল লেগেছে। কঠিন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে পেয়েও যিনি পেলেন না, উপরন্তু এই বনবাস, ব্রহ্মচর্য– অর্জুনের ‘ফ্রাষ্ট্রেশন চরমে উঠেছে তখন।
অর্জুন বললেন আমি কী করব, কল্যাণী! আমার যে এখন বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালনের কথা– ব্রহ্মচর্যমিদং ভদ্রে মম দ্বাদশবার্ষিক ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সকলের সামনে এই নিয়ম স্থির করে দিয়েছেন। কিন্তু কী জানো, আমি তোমার প্রিয় কর্ম করতে চাই। চাই, তোমার ইচ্ছাপূরণ করতে। অর্জুন এবার সমস্যাটা নাগকন্যা উলূপীর ওপরেই ছেড়ে দিয়ে বললেন–দেখ না, এমন কিছু কি করা যায়, যাতে আমাদের ওই নিয়মটাও মিথ্যে না হয়ে যায়, আবার তোমার প্রিয় আচরণও করা যায়– কণ্বঞ্চনামৃতং তৎ স্যাৎ তব চাপি প্রিয়ং ভবেৎ তেমন একটা উপায় বার করো তো দেখি।
এক্ষেত্রে নাগকন্যা উলূপী যা চাইছেন, সেটা ন্যায় কি অন্যায়, তার মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি– যিনি যে বিষয়ের প্রস্তাবক, তাঁকেই যদি নিজের অনুকূলে যুক্তি বার করতে দেওয়া যায়, তবে কি যুক্তির অভাব হয়? বিশেষত মহাভারতে এই ধরনের সংকট মাঝে মাঝে এসেছে স্ত্রী-পুরুষের আকুল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মাঝে মাঝে এমন এক খণ্ড ‘ধর্ম’ অন্তরায়ের প্রাচীর তুলে দিয়েছে। মহাভারতের সংবেদনশীল কবি কখনও কিন্তু ধর্মের জিগির তুলে কোনও রমণীর উদগত হৃদয় স্তব্ধ করে দেননি। অর্জুন বলেছিলেন– তেমন কোনও যুক্তি খুঁজে বার করো যাতে আমার ধর্ম-নিয়ম নষ্ট না হয়– যথা ন পীড়্যতে ধর্মস্তথা কুরু ভুজঙ্গমে।
উলূপী শান্ত উত্তর দিয়েছিলেন। বস্তুত তিনি অর্জুনের সব খবর রাখেন। তিনি বলেছিলেন– আমি জানি কেন তুমি এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছ এখানে-সেখানে। আমি জানি কেন এই ব্রহ্মচর্য এবং বনবাস। দ্রৌপদীর জন্য তোমরা যে নিয়ম করেছিলে তারই প্রতিজ্ঞা মেনে আজকে তোমায় বনে আসতে হয়েছে ব্রহ্মচর্যের অঙ্গীকার করে। কিন্তু আমার যুক্তি একটাই– তোমাদের এই নিয়ম দ্রৌপদীর জন্য এবং সে-নিয়ম তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের পারস্পরিক অবস্থান ঠিক রাখার জন্য তদিদং দ্রৌপদীহেতোরন্যোন্যস্য প্রবাসনম–আমার ব্যাপারে সে নিয়মের তাৎপর্য কী? আমি তো অন্য এক রমণী যে শুধু তোমাকেই চাইছে, সেখানে দ্রৌপদীর কারণে ব্রহ্মচর্য আমার ব্যাপারে খাটবে কেন? দ্রৌপদী-ঘটিত নিয়ম আমার ব্যাপারে খাটে না- কৃতবাংস্তত্র ধর্মার্থ, অত্র ধর্মো না দুষ্যতি।
এর পরে সেই অকাট্য যুক্তি। উনূপী বললেন তুমি না ক্ষত্রিয়! আর্তজনের ত্রাণের জন্যই না তোমার ক্ষাত্রধর্ম। সেখানে আমার মতো পীড়িত মানুষের পরিত্রাণ করাটা কি ধর্ম নয়! উনূপী বুদ্ধিমতী রমণী। তিনি বুঝেছেন যে পূর্বে যে যুক্তি তিনি খাড়া করেছেন অর্থাৎ ওটা দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে খাটে, আমার ক্ষেত্রে খাটে না– ইত্যাদি সব যুক্তি খুব জোরালো নয়। অতএব সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের যে পথে তিনি অর্জুনকে আর্দসিক্ত করে দিতে পারবেন, সেই পথই তিনি বেছে নিলেন। বললেন আমার সঙ্গে আমারই একান্ত অভীপ্সিত এই মিলনে আমার আগের যুক্তিতে যদি কোনও দুর্বলতা থেকেও থাকে, যদি বা তাতে তোমার প্রতিজ্ঞাত ধর্মের সূক্ষ্ম কোনও ব্যতিক্রম ঘটেও থাকে যদি বাপ্যস্য ধর্মস্য সূক্ষ্মোহপি স্যান্ ব্যতিক্রমঃ– তবু সেখানে সব অন্যায়, অধর্ম ধুয়ে মুছে যাবে, যদি তুমি আমার জীবনদান করো। এখানে দ্রৌপদীর কারণে তোমরা কথার কথা একটা নিয়ম করেছ, সেখানে সেই বাক্য রক্ষার ধর্ম থেকে কারও জীবনরক্ষার ধর্ম অনেক বড়। আমি আমার সব দিয়েছি তোমাকে, সেখানে তুমিও আমাকে একইভাবে চাইবে- এই তো ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার– ভক্তাঞ্চ ভজ মাং পার্থ সমেতন্মতং প্রভো। তুমি আমাকে জীবন দাও এটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম।
সত্যিই তো উনূপীর কাছে এটা জীবনদানই বটে। তার বিবাহ হয়েছিল অথচ কতকাল তিনি স্বামীহীনা। বাঁচার জন্য ক্ষণিকের জন্য হলেও এক উত্তরঙ্গ ভালবাসা চাই তাঁর। তার বিবাহ হয়েছিল– শুধুমাত্র এই শাব্দিক পরিতৃপ্তি নিয়ে জীবন প্রাণিত করা কী এক যৌবনবতী রমণীর ঈপ্সিত হতে পারে? পিতা তার যৌবন বয়সের কথা ভেবেও দ্বিতীয় কোনও বিবাহের চিন্তা করেননি, কখনও যে চিন্তা করবেন, তাও মনে হয় না। অতএব নিজের ব্যবস্থা তাকে নিজেই করতে হবে। উলূপী বলেছেন– তুমি ক্ষত্রিয়, কত দীনহীন অনাথকে তুমি রক্ষা করো। আমার বেলাতেই বা সেটা হবে না কেন, আমিও তো একইভাবে তোমার শরণ গ্রহণ করেছি। আমি স্ত্রীলোক হয়ে স্বয়ং তোমাকে কামনা করেছি, অতএব তুমিই বা কেন আমাকে চাইবে না যাচে তঞ্চাভিকামাহং তস্মাৎ কুরু মম প্রিয়ম।
অকাট্য যুক্তি। সজীব প্রাণের বদলে একটি সজীব প্রাণ কামনা করেন উলূপী। অল্প সময়ের জন্য সেই প্রাণের স্পর্শ পেলেও সেই সুখস্মৃতি এবং অর্জুনের স্ত্রী-স্বীকৃতির মর্যাদা নিয়েই জীবন কাটাতে পারেন তিনি। এর বেশি কিছু তিনি চান না। নাগকন্যার যুক্তি-তর্কের চেয়েও যেহেতু তার আত্মনিবেদনই অনেক বেশি মহত্তর হয়ে উঠেছিল অর্জুনের কাছে এবং দ্রৌপদীর অভাববোধ যেহেতু এই মহাবীরের মনে এক স্পর্শকাতর শূন্যতাও তৈরি করেছিল, অতএব এক মুহূর্তের জন্য অর্জুনের ধর্মাধর্ম, নিয়মনীতি, ব্রহ্মচর্য– সমস্ত বাঁধ ভেঙে গেল। আর যদি ধর্মের কথা ধরাও হয় তবে সেকালে এ-ও একপ্রকার ধর্ম ছিল। সেকালে কোনও সকামা রমণী যদি পুত্রলাভের উদ্দেশে পুরুষের কাছে রতি প্রার্থনা করত, তা হলে তাকে ফিরিয়ে দেবার রীতি ছিল না। কোনও রমণীর বাৎসল্যের অধিকার, মা হবার অধিকার, তার শ্রেণীগত অধিকারের মধ্যে পড়ত কিনা জানি না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রমণীকে বঞ্চিত করার রেওয়াজ ছিল না এবং এই মা হবার অধিকারের সঙ্গে পিতৃপরিচয়টুকু যাতে যুক্ত হয়, সে ব্যাপারেও সামাজিক পুরুষের বদান্যতার অভাব ছিল না।
আপনারা বলতেই পারেন– পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এ তো বেশ সুবিধের কথাই ছিল। পুরুষেরা মাঝে মধ্যেই বিনা আয়াসেই ভোগের সুযোগ পেতেন, অতএব একটি পুত্র বা কন্যা সৃষ্টির নির্মল আনন্দ তারা পরিহার করতেন না। এ কথার প্রকট অর্থ আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলতে চাই যে, পুরুষেরা পিতৃপরিচয়ের দায়টুকুও কিন্তু এড়িয়ে যেতেন না এবং এই সামাজিক স্বীকৃতিদানের মধ্যে কোনও সামাজিক লজ্জাও কাজ করত না বলেই ঘটনাগুলি সহজভাবেই মেনে নেওয়া হত। বিশেষত কামনা-প্রশমনের ইচ্ছাটা যদি পুরুষের দিক থেকে গৌণকর্ম না হয়ে মুখ্যকর্ম হত, তা হলে এই অর্জুনের পক্ষেও আরও বেশ কিছুদিন এই নাগ-ভবনে থাকার অসুবিধে ছিল না। কিন্তু তিনি তা থাকেননি। মাত্র একটি রাত তিনি উলূপীর সহবাসে নিযুক্ত ছিলেন– স নাগভবনে রাত্রিং তমুষিত্বা প্রতাপবান এবং তার পরেই তিনি প্রত্যূষে কৌরব্য-নাগের ভবন ছেড়ে ফিরে গেছেন গঙ্গাদ্বারের সেই অরণ্য-নিবাসে। মহাভারতের কবি অর্জুনের এই রাত্রিবাসের কারণ দেখিয়ে বলেছেন– অর্জুন ধর্মের উদ্দেশ্য সাধন করেই এক রাত্রি সহবাস করেছেন উলূপীর সঙ্গে কৃতবাংস্তত্র তৎসৰ্বং ধর্মমুদ্দিশ্য কারণম্। এখানে ধর্ম কি? না, অর্জুন উলূপীকে বিবাহ করেছেন, তার স্বামী-পরিচয় সুগম করেছেন এবং ভবিষ্যতে তার যে পুত্র হবে, তার পিতৃপরিচয়ের জায়গাটাও সুস্থ রেখেছেন অর্জুন। এটাই এখানে ধর্ম, এই ধর্মের মধ্যে প্রাচীন আদিম সংস্কার থাকলেও আজকের দিনের অনেক বাঘা বাঘা আধুনিকও ভীত হয়ে পড়বেন। ব্যাপারটা অত সহজ নয়।
সহজ যে নয়, তার প্রমাণ মহাভারতের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। একটা প্রশ্ন তো অবশ্যই উঠবে যে, অর্জুন কি উলূপীর তীব্র আসঙ্গ-লিপ্সায় সাড়া দিয়ে এক রাত্রি তার সঙ্গে সহবাস করে গেলেন, নাকি অর্জুন তাকে বিবাহ করেছিলেন কোনও নিয়মে এবং সেই কারণেই এক বৈবাহিক রাত্রি অতিবাহিত করেছিলেন নাগবন্ধুর সঙ্গে। বিয়ে যদি বা হয়েই থাকে, সেখানেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রগতিশীলেরা বলেছেন যে, এই তো এক বিধবা-বিবাহের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে। সংরক্ষণশীলেরা তখন মহাভারতীয় শ্লোকের ভয়ংকর পাঠ-ব্যবচ্ছেদ এবং পাঠ-পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন মোটেই না। উলূপী রীতিমতো কুমারী কন্যা। অন্যত্র তার কোনও বিবাহও হয়নি এবং তার ছেলে হওয়ারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না। আর বিধবা-বিবাহ? সে-প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর।
বাপরে বাপ! উলূপীর সঙ্গে বৈবাহিক অথবা অবৈবাহিক সহবাস নিয়ে যে এত স্মৃতিশাস্ত্রীয় গোলযোগ তৈরি হবে, তা ভাবাই যায়নি। এসব জানলে স্বয়ং অর্জুনও যে কত বিপদে পড়তেন, তা ভাবতে ভয় হয়। গোল বেধেছে মহাভারতের ভীষ্মপর্বে উচ্চারিত অর্জুনের পুত্র ইরাবানকে নিয়ে। ভীষ্মপর্বে তখন পাণ্ডব কৌরবদের মহাযুদ্ধ চলছে, সেই সময়ে ইরাবান এসেছেন পিতা অর্জুনের সাহায্যার্থে, পিতা অর্জুনের পক্ষে যুদ্ধ করবার জন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎই এক সুন্দর সুবেশ যোদ্ধা এসে পৌঁছলে, তার পরিচয় জানবার প্রয়োজন হল। মহাভারতের শ্রোতার কাছেও তা দরকার এবং সেই উপলক্ষ করেই চক্ষুহীন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তার পরিচয় দিয়েছেন সর্বদ্রষ্টা সঞ্জয়।
সঞ্জয় বলেছেন- এ হল ইরাবান। নাগরাজের পুত্রবধূর গর্ভে ইরাবান হলেন অর্জুনের পুত্র সুষায়াং নাগরাজস্য জাতঃ পার্থেন ধীমতা। এই সামান্য পরিচয়টুকুতেই আমাদের মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মর্মে বড় আঘাত লেগেছে এবং তার বিড়ম্বনাও বেড়েছে শতগুণ। আমার নিজের একটু অবাকই লাগে। সিদ্ধান্তবাগীশ যথেষ্ট পণ্ডিত মানুষ, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি বঙ্গভাষায় বহুতর সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ এবং সম্পাদনা করে শত শত পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য একাই শোষণ করে নিয়েছিলেন। ঠিক এই মানুষটি তার নিজকৃত মহাভারতীয় টীকার এই অংশে ভীষণ রকমের সংরক্ষণশীল হয়ে উঠলেন। এই সংরক্ষণশীল পক্ষপাত আরও বিপ্রতীপভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই কারণে যে, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কার-আন্দোলন অনেকটাই বঙ্গদেশের অন্তরে সুপ্রাথিত। এইখানে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্তবাগীশ নানা প্রতিযুক্তিতে প্রমাণ করতে চাইছেন যে, এটা কোনও বিধবা বিবাহের ঘটনাই নয়, অর্জুনও এমন বিবাহ করেননি আর নাগদের ঘরেও আর্য-সংস্কারেই বিবাহাদি হত, অতএব তাদের বাড়ির কোনও বিধবা-বধূর বিয়ে হচ্ছে অর্জুনের সঙ্গে এটা তারাও মেনে নিতেন না। এ অবস্থায় অন্য প্রগতিবাদী মানুষেরা যে এটাকে বিধবা-বিবাহের ঘটনা বলে চালাতে চাইছেন, তাঁদের কথা এখানে প্রমাণ বলে মানা যাবে না– অতঃ খলু বিধবা-বিবাহ-পক্ষে নেদং প্রমাণং ভবিতুমর্হতি।
সংশয় হয়, এই অধিক্ষেপ– খবরদার! উলূপীকে নিয়ে বিধবা-বিবাহের পক্ষে উদাহরণ সাজাবেন না– এই অধিক্ষেপ, এই সিদ্ধান্তোক্তি সেই বিদীর্ণ-হৃদয় উদার ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে নির্গত কিনা? অর্থাৎ সিদ্ধান্তবাগীশ কিছুতেই মানবেন না যে, অর্জুন কোনও বিধবা রমণীকে বিবাহ করেছিলেন। বরঞ্চ এটা তবু তিনি মেনে নিতে পারেন যে, অর্জুন অন্য কোনও এক হতস্বামিকা নাগ-রমণীর অনুরোধে তার সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকবেন এবং তার গর্ভে অন্য কোনও পুরুষের আহিত সন্তানের পিতৃত্বও স্বীকার করে থাকতে পারেন, কিংবা তিনি নিজেও তার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করে থাকতে পারেন, কিন্তু কদাচ তার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ হয়নি। হয়তো উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ হয়েছে, কিন্তু তিনি অনাহতা কন্যা বলে তাকে নিয়ে কোনও গণ্ডগোল নেই, অন্তত বিধবা-বিবাহের প্রশ্ন সেখানে উঠছে না। সিদ্ধান্তবাগীশ তার আপন সিদ্ধান্তে এতটাই অবস্থিত যে, তিনি উলূপীর ব্যবহৃত দু’-একটি কথা যেমন আপন সিদ্ধান্তের অনুকূলে ব্যবহার করেছেন, তেমনই মহাভারতের শ্লোকে যে পাঠভেদ আছে, সেখানে সেই পাঠটিকেই তিনি মূল্য দিয়েছেন যেটাতে তার সিদ্ধান্ত বজায় থাকে যথাসম্ভব সযৌক্তিকভাবে। বস্তুত কিছু মানুষ তো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই মহাভারতের অন্তরে তাদের স্থূলহস্তাবলেপ ঘটিয়ে পাঠ পরিবর্তন করেছেন এবং সিদ্ধান্তবাগীশ যে পক্ষ নিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে এ-পাঠ হল সেই পাঠ যা সরংক্ষণশীল কোনও পণ্ডিতই ঘটিয়েছেন পূর্বকালে এবং অন্তহীন ভবিষ্যতে তার যে সমর্থক-পরম্পরা জুটবে, তারও প্রমাণ হয়ে গেল সিদ্ধান্তবাগীশের মতো পণ্ডিত সেই স্থূল পাঠ সমর্থন করায়।
মহাভারতে যেহেতু এ কথা বলা আছে যে, পূর্বে অন্য পুরুষের পরিণীত ঐরাবতকুলের এক নাগরমণীর গর্ভে জাত অর্জুনের পুত্র ইরাবান– এবমেষ সমুৎপন্নঃ পরক্ষেত্রে অর্জুনাত্মজঃ- অতএব মহামহোপাধ্যায় স্মার্ত বিধান দিলেন পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তীর গর্ভেও তো ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রেরা পুত্র উৎপাদন করেছিলেন, তাতে তো আর এমন কথা বলা যায় না যে; ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রেরা কুন্তীকে বিয়ে করেছিলেন। এখানেও তেমনই; অর্জুন অন্য কোনও এক নাগরমণীর তাড়নায় সাড়া দিয়ে তার গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র হিসেবে ইরাবানের জন্ম দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নাগরমণীকে বিবাহ করেননি কোনওমতেই। আর হ্যাঁ, উলূপীকে তিনি বিবাহ করেছিলেন বটে, তবে তিনি বিধবা ছিলেন না। তার গর্ভে অর্জুনের কোনও পুত্ৰও ছিল না- তস্মাৎ কন্যা উলূপী অর্জুনঃ পরিণীতবান, অস্যান্তু বিধবায়ামৰ্জুনঃ ক্ষেত্রজপুত্রভাবেন ইরাবন্তমুৎপাদিতবান্।
অর্থাৎ মূল মহাভারতে স্পষ্ট প্রমাণ থাকায় সিদ্ধান্তবাগীশের যুক্তি ঘেঁটে গেছে। একবার তিনি বলছেন– বিধবা-বিবাহের ব্যাপারে উলূপীর নাম জোড়া যাবে না, আবার বলছেন– উলূপী বিধবাই নন, পুনরায় বলছেন– উলূপী বিধবা যদি বা হন, ইরাবান তার ছেলে নন। শুধুমাত্র বিধবা-বিবাহের পৌর্বাহ্নিক ধারণায় সিদ্ধান্তবাগীশ যে সব যুক্তি সাজিয়েছেন, তা আমরা ভাল করে মেনে নিতে পারিনি। প্রথমত নাগকন্যা উলূপী ছাড়া আরও অন্যতরা নাগকন্যা অর্জুনের কাছে রতি প্রার্থনা করেছিলেন, এমন কোনও সংবাদ আমরা অর্জুনের দ্বাদশবার্ষিক বনবাসকালে পাইনি। যেখানে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা, সবার খবর আছে, সেখান এই অনামিকা নাগকন্যার ওপর বিশালদশী কবির সর্বময়ী দৃষ্টি হারিয়ে গেছে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তবাগীশের যুক্তি হল– ভীষ্মপর্বে এই নাগকন্যার পরিচয়ে বলা হয়েছে নাগরাজ ঐরাবত মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন অর্জুনের হাতে তার মানে ইনি ঐরাবতের মেয়ে, আর উলূপী হলেন গিয়ে কৌরব্য নাগের মেয়ে তার মানে এই দুই মেয়ে দুটি পৃথক অস্তিত্ব। আমাদের মতে এ যুক্তি বলার জন্যই বলা এবং সেটা মহাভারতের কবির আশয়ের সঙ্গে মেলে না।
সিদ্ধান্তবাগীশ ইচ্ছাকৃতভাবে মনে রাখলেন না যে, অর্জুনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে উলূপী বলেছিলেন– আমার পিতা কৌরব্য নাগ, প্রসিদ্ধ ঐরাবতকুলে তার জন্ম, আমি তারই মেয়ে– ঐরাবতকুলে জাতঃ কৌরব্যো নাম পন্নগঃ। মহাভারতে এমন বহু বীর পরিচয় আছে, যেখানে পিতার নামে ছেলে বা মেয়েকে ডাকা হয়নি, বরঞ্চ ডাকা হয়েছে। পূর্বপুরুষের নামে। ধৃতরাষ্ট্র, অর্জুন কিংবা যুধিষ্ঠিরকে একই পূর্বপুরুষের নামে ‘ভরত’, ‘ভারত’, ‘অজমী’, ‘কুরুপুঙ্গব’ বা এইরকম অন্য কোনও বিখ্যাত পূর্ব-পিতামহের নামে সোজাসুজি সম্বোধন করা হয়েছে। কৃষ্ণকে যখন সাত্বত, বৃষ্টি, অন্ধক ইত্যাদি বংশনামে সম্বোধন করা হয়েছে, তখন কি আমরা ভাবব যে, কৃষ্ণ এক পৃথক মানুষ, তাঁর উদ্দেশে সম্বোধিত বংশনাম সেখানে আলাদা? অতএব ঐরাবত নাগ তার মেয়েকে অর্জুনের হাতে তুলে দিলেন– এ কথা বললে অবশ্যই মহাভারতের আদিপর্বের প্রসঙ্গ ধরে বুঝতে হবে যে ঐরাবতবংশীয় কৌরব্য নাগই উলূপীকে তুলে দিয়েছিলেন অর্জুনের হাতে।
সিদ্ধান্তবাগীশ মনে করেন– উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের বিবাহও হয়নি, অতএব বিধবাবিবাহও হয়নি। অর্থাৎ কিনা তিনি উলূপীর রতি প্রার্থনা মেনে নিয়ে তার সঙ্গে সম্ভোগ করেছেন মাত্র এবং তার কোনও পুত্রও ছিল না উলূপীর গর্ভে। আর ইরাবান? ইরাবান অন্য এক অনামিকা নাগ-নায়িকার পুত্র। মানা গেল না সিদ্ধান্তবাগীশের কথা। আমরা মনে করি– অন্য কোনও নাগকন্যার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহ হয়নি; বিবাহ যদি হয়েই থাকে, তা উলূপীর সঙ্গেই হয়েছিল। বলতে পারেন- হ্যাঁ, মহাভারতের সেই ঐরাবতবংশীয় কৌরব্য নাগের ভবনে উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের বৈবাহিক-পর্বে কোনও মঙ্গলশঙ্খ বাজেনি, উচ্চারিত হয়নি পর্বমুখরা রমণীকুলের মুখে কোনও উচ্চ জয়কার। কিন্তু মহাভারতের এমন বহুতর বিবাহ অতি সংক্ষেপে পাণিগ্রহণের মাত্রাতেই সুসম্পন্ন হয়েছে, অথবা শুধুমাত্র সপ্তপদ গমনের সুসমাচারেই স্বীকৃত হয়েছে বিবাহ, এমন অনেক উদাহরণ আছে। তা ছাড়া উলূপী যদি কাৰ্মাত-হৃদয় প্রশমন করার জন্য শুধু সম্ভোগমাত্রেই সন্তুষ্ট হতেন, যদি অর্জুনের মধ্যে তিনি স্বামীলাভের স্বপ্ন না দেখে থাকেন, তা হলে অর্জুনকে পিতার ভবনে এনে অপরিসীম মর্যাদায় অগ্নিশরণ-গৃহে অগ্নিহোত্র সম্পাদনের স্থানে উপস্থিত করতেন না। গঙ্গাদ্বারে, হরিদ্বারে অনেক নির্জন স্থান ছিল সেকালে, যেখানে এই সম্ভোগ-বিলাস চলতে পারত। তা কিন্তু হয়নি। যেহেতু নাগকন্যা উলূপীর ব্যবহারে আর্যজনোচিত মর্যাদাবোধ ছিল এবং যেহেতু তিনি অর্জুনকে পিতৃভবনে নিয়ে এসেছিলেন, তাতেও আরও বেশি করে বুঝি যে, ঐরাবতবংশীয় কৌরব্য নাগ স্বামীহীনা কন্যাটির অন্তর্যাতনা অনুভব করে তাকে অর্জুনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অতিসংক্ষিপ্ত বৈবাহিক প্রথায়।
সিদ্ধান্তবাগীশ উলূপীর পরিচয়ে ‘কন্যা’ শব্দটির উপর খুব জোর দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ‘কন্যা’ শব্দের অর্থ ‘কুমারী’, অতএব উলূপী বিবাহিত ছিলেন না এবং সেখানে বিধবাত্বের প্রশ্ন তো ওঠেই না। আমরা বলি– কোনও মেয়ে যখন বিবাহিত অবস্থাতে অথবা বিধবা অবস্থাতেও নিজের পিতৃপরিচয় দেয়, তখন সবসময়েই আমি অমুকের কন্যা, অমুকের বংশে জন্ম– এই চিরন্তন শব্দই প্রয়োগ করে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃত ভাষা, সর্বত্রই তা একইরকম এবং মহাভারতেই তো এই উদাহরণ সহস্রবার আছে। দ্রৌপদীর মুখের তো শতবার– আমি মহারাজ দ্রুপদের কন্যা, পাণ্ডবদের কুলবধূ– এমন কথা বহুশ্রুত। তা ছাড়া মহাভারতের শব্দমন্ত্রের ওপরেই যদি এত জোর দিতে হয়, তা হলে বিবাহ-সিদ্ধির অন্যতম শব্দপ্রমাণ ‘ভার্যা’-শব্দটি সিদ্ধান্তবাগীশ ভুলে গেলেন কী করে? মহাভারতের সেই অশ্বমেধ-পর্বে উলূপীকে অর্জুনের ভার্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তার অন্যতরা স্ত্রী চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে।
সবচেয়ে বড় কথা, উলূপীর যদি বিবাহিতা স্ত্রীর মর্যাদা না থাকত তা হলে অশ্বমেধের মতো প্রকট ব্রাহ্মণ্য অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ জানাতে পারতেন না অর্জুন। উলূপী অর্জুনভার্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আরও প্রমাণ হয় যে, ঐরাবত কৌরব্য তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন অর্জুনের সঙ্গে এবং তিনি তার মেয়ের কষ্ট দেখেই তার নামমাত্র পূর্ববিবাহের কথা নিজেও স্মরণ করেননি। অর্জুনকেও স্মরণ করাননি। বিশেষত মহাকাব্যের উদার-বিশাল পরিবেশে নামমাত্র বিবাহিতা কোনও বিধবার অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে হল– এইসব স্মার্ত ‘শুচিবাই’ কোনও মানুষেরই ছিল না, অর্জুনের তো ছিলই না। থাকলে, সম্বন্ধে প্রায় ভগিনীপ্রতিম কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার সঙ্গেও অর্জুনের বিয়ে হত না। এই বিয়ে নিয়েও ভট্ট কুমারিলের মতো খ্যাতকীর্তি মীমাংসক প্রশ্ন তুলেছেন এবং সমাধানও করেছেন একভাবে, কেননা বিবাহটা তো মিথ্যে নয়। সিদ্ধান্তবাগীশের মুশকিল হল– তর্কযুক্তি সাজাতে গিয়ে তিনি আর টাল রাখতে পারেননি। মহাভারতের অন্যত্র উলূপীর ভার্যাত্বের স্বীকৃতিতে অর্জুনের সঙ্গে তার বিবাহও সিদ্ধ হয় এবং উলূপীর পূর্ববিবাহ মেনে নিলে বিধবা বিবাহের উদারতাও সিদ্ধ হয়। তা ছাড়া মহাভারতে তেমন ক্ষেত্রে বিধবা বিবাহের সমর্থন আছে। পতির অভাবে দেবর বিবাহ তো ছিলই। সিদ্ধান্তবাগীশ বাগর্থকৌতুকে মহাভারতীয় শ্লোকের অন্য পাঠ সমর্থন করলে কী হবে, ইরাবানের পরিচয় প্রসঙ্গে মহাভারতেই বলা হয়েছে অর্জুন কোনও এক নাগরাজের বধূর গর্ভে এই পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, সেই নাগরাজ অবশ্যই গরুড় কর্তৃক হত উলূপীর স্বামী এবং সেই উলূপীর পুত্র ইরাবান। ইরাবান উলূপীর পুত্র হিসেবেই সর্বজনবিদিত। অতএব শুধুমাত্র স্মার্ত-কঠিন সংরক্ষণশীলতায় মহাভারতের উদার বৈবাহিক পরিবেশ কণ্টকিত করা ঠিক হবে না।
বড় খারাপ লাগে যখন দেখি– সিদ্ধান্তবাগীশ মহাভারতের স্বাভাবিক পাঠ ছেড়ে দিয়ে সেই পাঠভেদটি মেনে নিয়েছেন, যা কিনা মহাভারতের সার্বিক উদার পরিবেশের সঙ্গে মেলে না, দুটি-তিনটি শ্লোকের অর্থ একেবারে পুরোপুরি পালটে গেল শুদ্ধাচারী স্মার্তদের সমাজরক্ষার স্বাঝারোপিত কুশলতায়। স্মার্তস্বার্থে পরিবর্তন করা হল দু’-দুটি ভীষণ প্রয়োজনীয় শব্দ। ভীষ্মপর্বে ইরাবানের পরিচয় বলা আছে– ইরাবান জন্মেছেন নাগরাজের পুত্রবধূর গর্ভে, তার জন্ম দিয়েছেন অর্জুন– সুষায়াং নাগরাজস্য জাতঃ পার্থেন ধীমতা। এখানে ‘সুষা’ শব্দের অর্থ পুত্রবধূ এবং তাতে যেহেতু উনূপীর বিধবাত্ব প্রতিপন্ন হয়, অতএব সিদ্ধান্তবাগীশের বহুকাল পূর্বেই কোনও এক আচার-প্রবীণ পণ্ডিত আমাদের সমাজরক্ষায় কঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে পাঠ-পরিবর্তন করে বললেন– শব্দটা ‘সুষা’ হবে না, ওটা হবে ‘সুতা’ অর্থাৎ নাগরাজের মেয়ে। তাতে আর বিধবাত্বের কথা আসে না, উলূপীরও না এবং ইনি অন্য কোনও নাগকন্যা হলেও আর অর্জুনের বিধবাবিবাহের কলঙ্ক লাগে না। সিদ্ধান্তবাগীশ স্মার্ত-কঠিন-শীতলতায় এই পাঠ মেনে নিলেন।
মহাভারতের দ্বিতীয় শ্লোকের টানা সরল অর্থ এইরকম– নাগরাজ ঐরাবত যখন দেখলেন যে, তারই ঘরের মেয়ে, অথচ বিবাহিতা হওয়া সত্ত্বেও তার স্বামীকে গরুড় মেরে ফেলেছেন এবং মেয়েটির কোনও সন্তান নেই তখন তিনি মেয়েটিকে পরম স্নেহে অর্জুনের হাতেই তুলে দিয়েছেন– ঐরাবতেন সা দত্তা অনপত্যা মহাত্মনা। মহাভারতের কবি ঐরাবত নাগের মধ্যে পরম উদারতা দেখেছেন বলেই তার বিশেষণে ‘মহাত্মা’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন বলে মনে করি। এখানে দ্বিতীয় শ্লোকে ঐরাবত নাগের উল্লেখ থাকায় পূর্বশ্লোকের নাগরাজকে ঐরাবত বলেই মনে করেছেন প্রাচীন টীকাকার নীলকণ্ঠ এবং তাতে সিদ্ধান্তবাগীশের ভারী সুবিধে হয়েছে। তিনি বলেছেন– মহাভারতের আদিপর্বে অর্জুনের সঙ্গে সাক্ষাতে উলূপী নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন– আমি ঐরাবতকুলে জাত কৌরব্য নাগের মেয়ে। অতএব উলূপীর পক্ষে ঐরাবতকুলে জন্মে ঐরাবতেরই পুত্রবধূ হওয়া তো সম্ভব নয়, কারণ নাগদের বৈবাহিক সম্বন্ধেও আর্য-রীতিপদ্ধতি মানা হত।
আমাদের বক্তব্য– সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয়। আপনি তো মহাভারতীয় টীকার বহু স্থানে নীলকণ্ঠের কথা না মেনে নিজের যুক্তি স্থাপন করেছেন। হঠাৎ এখানে নীলকণ্ঠের প্রতি এত শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন কেন? সেকি শুধুই পূর্বশ্লোকের নাগরাজকে ঐরাবতের একাত্মকতায় প্রতিষ্ঠা করে ‘সুষার’ বদলে ‘সুতা’ পাঠটিকে সমর্থন করার জন্য? মহাভারতের আদিপর্বে উলূপীর আত্মপরিচয় যদি সর্বথা মেনে নিই, তা হলে এটাই তো বলা ভাল যে, টীকাকার নীলকণ্ঠ এখানে পরিষ্কার ভুল করেছেন, যেমন অন্য জায়গাতেও এরকম দু-একটি ভুল আছে যা সিদ্ধান্তবাগীশ সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। অতএব মহাভারতের শ্লোকার্থ সোজা সরলভাবে ধরলে তো কোনও স্মার্ত-যন্ত্রণাও থাকবে না। অর্থাৎ কিনা উলূপী কোনও এক নাগরাজের পুত্রবধূ তো বটেই, অল্পবয়সে স্বামী মারা যাবার পরে তার মনোযন্ত্রণা বুঝেই তিনি (নাগরাজ) অর্জুনের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছেন। এতেই তো মহাভারত শুদ্ধ থাকে, কিন্তু অশুদ্ধতার ভয় এমনই, নাকি মহাভারতে বিধবা-বিবাহ প্রতিষেধ করতে হবে বলে আরও একটি অকিঞ্চিৎকর স্মার্ত পাঠ মেনে নিলেন সিদ্ধান্তবাগীশ। মহাভারতে ছিল– সেই নাগকন্যা সকামভাবে অর্জুনের সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করলে অর্জুন তাকে ভার্যা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন– ভার্যার্থং তাঞ্চ জগ্রাহ পার্থঃ কামবশানুগাম। যেন কোনও রমণী সকামভাবে কোনও পুরুষের কাছে রতি-প্রার্থনা জানাতেই পারেন না– এটা ধরেই নিলেন সিদ্ধান্তবাগীশ। তার ওপরে সে যদি আবার কোনওভাবে অন্য এক মৃত-স্বামীর স্ত্রী হয়, তবে তাকে তো আর ভার্যা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না অর্জুন; তবে হ্যাঁ, তেমন হলে তার রতিলিষ্ণুতায় সাড়া দিতে পারেন এবং ধর্মার্থে তার গর্ভে একটি পুত্রও দিতে পারেন– মানে, অন্যের ভার্যার গর্ভে কর্তব্য হিসেবে একটি পুত্রের জন্ম দিতে পারেন কর্তব্যঃ সন্তানোৎপাদনার্থম্ ইত্যেবার্থঃ কর্তব্যঃ।
এখানে জানানো দরকার– প্রথমত ‘ভার্যা’ শব্দটিতেই সিদ্ধান্তবাগীশের আপত্তি। কারণ ‘ভার্যা অর্থাৎ ভরণীয়তার দায়িত্ব নেবার মধ্যে একটা সামাজিক এবং স্মার্ত বৈধতা আছে, সেটা যেমন সামান্যা এক রতিযাচিনী রমণীর প্রার্থনায় পূরণ করাই যায় না, অতএব ‘ভার্যা’ শব্দটি বাদ দিতে হবে মহাভারতের উচিত পাঠ হিসেবে, ওটা করতে হবে–কার্যার্থং তাঞ্চ জগ্রাহ পার্থঃ কামবশানুগাম। মানে দাঁড়াবে যে রমণী কামবশতায় অর্জুনের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন অর্জুন কার্য’ করার জন্য অর্থাৎ সম্ভোগ করার জন্য তাকে গ্রহণ করেছিলেন, কেননা সিদ্ধান্তবাগীশ এমন অনুশাসন স্মরণ করতে পেরেছেন যাতে বলা হয়েছে কোনও রমণী যদি তেমনভাবে রতিপ্রার্থনা করে তবে তার হাত ধরতে পারো অর্থাৎ সাড়া দিতে পারো– রামায়াং জাতকামায়াং প্রশস্তা হস্তাধারণা।
আমি খুব অবাক হয়ে যাই এ-সব কথায়। পাণ্ডব-তৃতীয় অর্জুনকে এক বিধবা রমণীর বৈবাহিকতা থেকে বাঁচানোর জন্য কী বিপরীত এই স্মার্ত অপচেষ্টা! সিদ্ধান্তবাগীশ মহাভারতের সেই বিশাল উদার সামাজিক বৈচিত্র্যের কথা একবার ভাবলেন না। ভাবলেন না– যিনি গাণ্ডীব ধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে শত শত্রুর জীবনসংশয় করতে পারেন, যিনি দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করে বীরোচিত বৈরাগ্যে নিজের ভাইদের বৈবাহিক অধিকার দিতে পারেন, তিনি আরও অনেক কিছু করতে পারেন, যা বৃদ্ধ স্মৃতিশাস্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে না। সিদ্ধান্তবাগীশ বুঝলেন না– মহাভারতের অর্জুনের মতো এক বিরাট নায়কপুরুষ বাঁদিক ছেড়ে ডানদিকে গেলেই যেখানে সংবাদ হয়ে ওঠেন, তিনি উলূপী ভিন্ন অন্য এক নাগরমণীকে ‘কার্য’ করার জন্য গ্রহণ করলেও সেটা খবর হত মহাভারতে এবং তা হত সেই সময়েই যখন তিনি স্মার্ত-কাটি করেছেন। সিদ্ধান্তবাগীশ মনে করেন– অর্জুনের সেই প্রথম বনবাসকালে উলূপীর সঙ্গে বিবাহের পরে পরেই আরও এক নাগ রমণীর সঙ্গে এই কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, যার ফলে ইরাবানের জন্ম হয়– প্রথমবনবাসকালে নাগরাজকৌরব্যকন্যায়া উপ্যাঃ পরিণয়ানন্তরং তত্রাবস্থানাবসরে জ্ঞেয়ম।
হায়! উলূপীর সঙ্গে বিবাহের পর পরই কোনও এক নির্জন অবসরে অর্জুনের জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, তিনি হতস্বামিকা এক রমণীর রতি-প্রার্থনা পূরণ করে তার গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করলেন, অথচ বিশাল-হৃদয় মহাভারতের কবির সর্বপ্রসারিণী দৃষ্টি থেকে সে-ঘটনা বাদ পড়ে রইল, এ অন্তত আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, অন্তত এ জিনিস মহাভারতের বৃহত্ব এবং ভারবত্তার নিরিখে ধোপে টেকে না। আসলে সিদ্ধান্তবাগীশ তার পূর্বকল্পিত স্মৃতি চিন্তামণির ভাবনা মাথায় নিয়ে মহাভারতের বিচার করেছেন, ফলে একদিকে যেমন উলূপীর পাশে আরও এক অন্যতরা নাগরমণীর পরিকল্পনা তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছে স্মার্ত যুক্তিজাল বিস্তার করে, অন্যদিকে তাঁকে মহাভারতের উচিত পাঠ পরিত্যাগ করে এমন পাঠ গ্রহণ করতে হচ্ছে যেখানে ভারতের কৃষ্ণ-দ্বিতীয় নায়ক অর্জুন রীতিমতো এক অভব্যতায় প্রতিষ্ঠিত হন– যেন রতিলিন্দু এক সকামা রমণীকে তিনি ‘কার্য’ করার জন্য গ্রহণ করেন, তার দায়িত্ব নিয়ে ‘ভার্যার্থ’ তাকে গ্রহণ করেন না। আসলে সিদ্ধান্তবাগীশ তার বিংশ-শতাব্দীর পৌরুষেয়তায় এটা ভাবতেই পারেন না যে, কোনও স্ত্রীলোক অল্পবয়সে বিধবা হবার পরেও তার শারীরিক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে এবং সেই শতাব্দীর সংকোচেই তিনি এ-কথাও অনুমান করতে পারেন না যে, অর্জুনের মতো বীর তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে তাঁকে মর্যাদাও দিতে পারেন। তা ছাড়া শুধু মর্যাদাটুকুই তো উলূপী চেয়েছেন, এর বেশি এক কণাও কিছু নয়। কেননা তারও তো কিছু মর্যাদা আছে।
হ্যাঁ, একই সঙ্গে আমি এটাও বুঝি যে, উদারতা, মধ্যস্থতা এবং সংরক্ষণশীলতা সবই এক চলমান সমাজের অঙ্গ। সিদ্ধান্তবাগীশ পণ্ডিত মানুষ, তার তর্কযুক্তি-বিতণ্ডার ছলও আগ্রহ ভরে দেখার মতো, কিন্তু শতাব্দীর সংকোচ তিনি হয়তো অতিক্রম করতে পারেননি। আমাদের বিশ্বাস পূর্বে উনূপীর বিবাহ হয়েছিল সমানবর্ণ অন্য এক নাগ-পরিবারেই। তার স্বামী শত্রুগোষ্ঠীর নেতার দ্বারা হত হওয়ায় তিনি যে পিতৃগৃহে বিধবার মনোযন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন, তাও হয়তো পরিবারের লোকজনের কাছে একেবারে অসহনীয় ছিল না; কিন্তু তিনি যে অন্য জাতি এবং ততোধিক ভিন্ন গোষ্ঠীর এক বীর নায়ককে বিবাহ করে ফেললেন এটা তার পিতা-মাতা ছাড়া পরিবারের অন্য লোকজন মোটেই পছন্দ করেননি, বিশেষ উলূপীর শ্বশুরগৃহের লোকেরা। এ জিনিস আধুনিক সমাজেও আমরা দেখেছি। তথাকথিত নিম্নবর্ণের মেয়ে যদি উচ্চবর্ণের পুরুষকেও বিবাহ করে, তবে সেই মেয়ের বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দু’পক্ষেই বাধা আসে। বাধা আসে আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে। ছেলের ঘরের উচ্চতা সেখানে জটিলতা এবং অকর্মণ্য দাম্ভিকের ঈর্ষা তৈরি করে। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও জটিল। পূর্বে যে বাড়িতে উলূপীর বিবাহ হয়েছিল তারা যথেষ্ট কুলীন নাগগৌরবের অধিকারী এবং নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে যথেষ্টই সচেতন।
উলূপীর স্বামী মারা যেতে তার পুনর্বিবাহেও বুঝি তার শ্বশুরঘরের আপত্তি ছিল না, কিন্তু উলূপী নাগবংশ ত্যাগ করে একেবারে পাণ্ডব অর্জুনকে কামনা করায় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তার তিক্ততা বেড়েছে। হয়তো আরও বেড়েছে উলূপীর পিতা কৌরব্য নাগও এই বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন বলে। অর্জুনের সঙ্গে বিবাহের ফলে উলূপীর পূর্ব-স্বামীর ঘরে যে বিদ্রোহ তৈরি হয়েছিল, তার খবরও আমরা পেয়েছি সেই ভীষ্মপর্বে– সেই যখন সঞ্জয় অর্জুন-পুত্র ইরাবানের পরিচয় দিচ্ছেন। সঞ্জয়ের বিজ্ঞপ্তি থেকে বোঝা যায় যে, উলূপীর পূর্বস্বামী হত হবার পরেও শ্বশুরবাড়িতে তার স্থান অবিচল ছিল, কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে বিবাহের পরেই তার পূর্বস্বামীর ছোট ভাই অশ্বসেন উলূপীর ওপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন। এই ক্ষিপ্ততা অবশ্যই অর্জুনের ওপর অশ্বসেনের রাগের পরিণতি এবং এই ক্ষিপ্ততা চরম আকার ধারণ করে উলূপীর গর্ভে ইরাবানের জন্মের পর পিতৃব্যেণ পরিত্যক্তঃ পার্থদ্বেষাদ দুরাত্মনা। ইরাবানের পিতৃব্য অশ্বসেন উলূপী সহ তার সন্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন শুধুমাত্র অর্জুনের ওপর রাগ করে পার্থদ্বেষাৎ এবং হয়তো এই সময় থেকেই উলূপী তার পিত্রালয়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। ইরাবান বড় হতে থাকেন মায়ের তত্ত্বাবধানে, মায়ের পিতার ভবনে– স নাগলোকে সংবৃদ্ধো মাত্রা চ পরিরক্ষিতঃ।
উলূপীর ক্ষেত্রে সব ধর্মযুক্তিও বুঝি সবিশেষ খাটে না। এই যে উলূপীর রতি-প্রার্থনা, অর্জুনের সঙ্গে তার বিবাহ, আবার সেই বিবাহে তার শ্বশুরকুলের ক্রোধ– এই সব কিছু আমাদের অন্যতর এক বিশ্লেষণের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিশেষত শ্বশুরকুলে ইরাবানের পিতৃব্য অশ্বসেনের ক্রোধ। কেন, কেন এই অশান্তি, কেন এই ক্রোধ, মহাভারতে তো এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, যেখানে স্বামী মারা যাবার পর সেই বিধবা রমণীর গর্ভে পুত্র জন্ম হয়েছে নিয়োগ-প্রথার মাধ্যমে, সেখানে কোনও জায়গায় তো কোনও রকম ক্রোধের আবেশ দেখিনি, তবে এখানে ইরাবানের পিতৃব্য অশ্বসেনের অথবা আরও স্পষ্ট করে বলি, উলূপীর দেবর অশ্বসেনের এই ক্রোধাবেশ কেন এবং কেনই বা তাকে সেই গৃহ ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে আসতে হল। এইখানে আমাদের কিছু ভাবনা থেকেই যায়।
আমাদের বিশেষ ধারণা–সুপর্ণ গরুড় কর্তৃক নিহত হবার পর উলূপী তার শ্বশুরবাড়িতেই অবস্থান করছিলেন, অশ্বসেন তাঁকে সপুত্ৰক তাড়িয়ে দিয়েছেন বলেই উলটোদিকে উলূপীর শ্বশুরগৃহে অবস্থানের ঘটনাই সপ্রমাণ হয়। সেখানে নিঃসন্তান বিধবার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য যে নিয়োগ প্রথা চলত, তার উদ্যোগ নেওয়া হত শ্বশুরবাড়ি থেকেই। তার প্রমাণ মহাভারতেই ভূরিভূরি আছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই পুত্র উৎপাদনে প্রথম কল্প ছিলেন ভাশুর, দেওর– এরাই, অভাবে বাইরের কোনও উপযুক্ত মানুষ। উলূপীর ক্ষেত্রেও এই কল্প সিদ্ধ ছিল, কারণ তার স্বামী নাগরাজ তিনি যেই হোন তিনি নিহত হবার পর দেবর অশ্বসেনই ছিলেন নিয়োগের উপযুক্ততম পাত্র এবং তার বাড়ির গুরুজনেরা এই নিয়োগে আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক– শ্বশুরবাড়ির নাগ পুরুষদের তেমন করে পছন্দ করতে পারেননি উনূপী। অথবা সে-বাড়িতে নিয়োগ প্রথার আয়োজনের আগেই উলূপী পছন্দ করে ফেলেছেন অর্জুনকে। গঙ্গাদ্বারে স্নানরত অর্জুনকে দেখে প্রায়-সম্ভাবিত নাগ-দেবর অশ্বসেনের নিয়োগ-সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতে পারেননি। কারণ অর্জুন, গাণ্ডীবধন্থা অর্জুন, তার এমন বিরহবিধুর বনবাসক্লিষ্ট, শান্ত কঠিন চেহারা দেখে উলূপী মনে মনে ভরসা পেয়েছেন। তাকে সদ্য-বিধবার যৌবনোদ্ভেদী প্রেম নিবেদন করতে দেরি হয়নি উনূপীর। তিনি জানেন- অর্জুন তার জীবনে ক্ষণিকের উৎসব, ক্ষণিকের অতিথি, তবুও পাণ্ডব-তৃতীয় অর্জুনের স্ত্রী হবার ইচ্ছা তার সমস্ত অন্তঃকরণ জুড়ে ছিল। অতএব শুধুমাত্র অর্জুনের আসঙ্গ-লিপ্সায় তার অন্তঃকরণ শান্ত হয়নি, তিনি তাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন।
যে যৌবনবতী রমণীর সরল-দুর্বল তর্কযুক্তিতে অর্জুনের মতো নায়ক-পুরুষ দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীর কথা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পেরেছিলেন, সেই রমণীর ওপর নাগ দেবর অশ্বসেনের নজর ছিল নিশ্চয়। নিশ্চয় তিনি ভেবেই রেখেছিলেন যে, নিয়োগ-প্রথায় বা অন্য কোনও উপায়ে তারই সুযোগ আসবে একদিন, একদিন তিনিই অধিকারী হবেন উলূপীর। কিন্তু ভ্রাতৃবধূর স্বাধিকার-ভাবনাতে সেই সুযোগ যখন নষ্ট হয়ে গেল, তখন যে তিনি ক্রুদ্ধ হবেন, এটাই বোধ হয় স্বাভাবিক– কামাৎ ক্রোবোহভিজায়তে। অন্যদিকে মেয়েরা তাদের ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভূতিতে, তৃতীয় নয়ন দিয়েই বুঝতে পারেন যে, তার উপর কার কেমন নজর। উলূপী কি বোঝেননি অশ্বসেনের তাড়না! বুঝেছেন বলেই অর্জুনকে নিয়ে তিনি সোজা চলে এসেছেন বাপের বাড়িতে কৌরব্য নাগের ভবনে, যেখানে পিতার কাছে তিনি নিজের বিধবাত্বের যন্ত্রণা বোঝাতে পারেন, বোঝাতে পারেন আপন স্বতন্ত্র ইচ্ছার পরিকল্পনাটুকুও।
ভীষ্মপর্বে পাচ্ছি– ঐরাবত তাকে নিশ্চিন্তে তুলে দিয়েছেন অর্জুনের হাতে। আবারও বলি– নীলকণ্ঠের টীকায় বিভ্রান্ত হবেন না। বিভ্রান্ত হবেন না সিদ্ধান্তবাগীশের যুক্তিতে। ভাববেন না যে, ঐরাবত নাগ, কৌরব্য নাগের থেকে ভিন্ন কোনও ব্যক্তিত্ব, কেননা অর্জুনের কাছে উলূপীর মুখে প্রথম পরিচয়টুকুই এখানে সবচেয়ে বেশি গ্রাহ্য হওয়া উচিত। উলূপী বলেছিলেন– ঐরাবতকুলে কৌরব্য নাগের মেয়ে আমি। অন্তত এই সুস্পষ্ট পরিচয়পত্র থেকেই বোঝা যায় যে, ভীষ্মপর্বে উল্লিখিত ‘ঐরাবত’ বলতে তাঁর বংশজাত কৌরব্য নাগকেই বোঝানো হচ্ছে। মহাভারতের আস্তীক-পর্বে বিভিন্ন সৰ্পনাম-কণ্বনের সময় যদিও ঐরাবতবংশীয় নাগ এবং কৌরব্যবংশীয় নাগদের পৃথক নাম কীর্তিত হয়েছে কিন্তু তবুও তাতে ঐরাবত এবং কৌরব্য পৃথকবংশীয়, এমন ভাবার কারণ নেই, বিশেষত ঐরাবতের পরেই কৌরব্য-নাগের বংশকথন করেছেন মহাভারতের কবি। আর বংশনাম কীর্তনের সময় একই বংশের দুই পৃথক ব্যক্তিত্বের নাম পৃথক উচ্চারণ করে তাদের পুত্র-পৌত্রের নাম পৃথকভাবে উল্লেখ করাটাও মহাভারতের একান্ত শৈলীর অন্তর্গত। অতএব এ-বিষয়ে আমাদের সন্দেহ নেই যে, ঐরাবত কৌরব্য, উলূপীকে অর্জুনের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন বৈবাহিকতার বিধি অনুসারেই, আর তাতেই তার দেবর অশ্বসেন উল্পীকে আর শ্বশুরকুলে তিষ্ঠোতে দেননি। এই বিয়েতে অর্জুনের ওপর তার এমনই রাগ হল যে, উলূপীকে তিনি আর পূর্বস্বামীর ঘরে প্রবেশ করতে দেননি। তার পর ইরাবান উলূপীর গর্ভে জন্মানোর পর তাঁর পিতৃব্য অশ্বসেনের ক্রোধ আরও বেড়েছে। নিয়োগজাত যে সন্তানের শ্বশুরকুলেই মানুষ হবার কথা, পিতৃব্যের ক্রোধে তাকেই মানুষ হতে হয়েছে উলূপীর পিতৃগৃহে কৌরব্য নাগের ভবনে।
উনূপী এবং তাঁর পুত্রের জীবনে যে এরকম ঘটনা ঘটে গেল, অর্জুন বুঝি তার কোনও খবরই রাখতেন না, উলূপী অবশ্য তেমন কোনও দাবিও করেননি অর্জুনের কাছে। তিনি যথেষ্ট কঠিন প্রকৃতির রমণী। রমণী হয়েও অর্জুনের কাছে তিনি স্বয়ং রতি-প্রার্থনা করেছিলেন এবং প্রার্থনা পূরণ হতেই একরাত্রির সহবাসের পর তিনি নিজে তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বস্থানে। স্মার্তেরা বলেন– বিবাহের গৌণ ল্ল হল রতি, মুখ্য ফল সন্তান, পুত্র-কন্যা। মহাভারত-রামায়ণে রমণীর মুখে রতিপ্রার্থনায় বহুত্র এমন দেখেছি– রমণী পুত্রলাভের মুখ্যতাতেই প্রায় অপরিচিত পুরুষের কাছেও কাম-যাচনা করেছে এবং এমন অবস্থায় পুরুষের দিক থেকে রমণীর প্রার্থনা পূরণ করার শাস্ত্রবিধি ছিল, কেননা সেখানে রমণীর পুত্রলাভ ঘটছে। এই ধরনের শাস্ত্রীয় অনুমোদনের সঙ্গে হয়তো তখনকার সামাজিক প্রয়োজনও জড়িত ছিল। হয়তো আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যুদ্ধের প্রয়োজনে বীর-পুত্রের প্রয়োজন জড়িয়ে গিয়েছিল পুত্র-প্রার্থনার সঙ্গে। কিন্তু উনূপীকে আমরা অন্যতরা এক অন্য ধাতুর মহিলা হিসেবে পেয়েছি। তিনি এতটাই সপ্রতিভভাবে প্রগলভা এবং ‘স্মার্ট’ যে, যৌবনের যৌবনোচিত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে স্মার্ত বিধির তাড়নায় পুত্রলাভের সংকেতে পরিণত করেননি অথবা বলা উচিত তার হৃদয়ে উপস্থিত সেই মুহুর্তোচিত মুখ্যবস্তুকে গৌণভাবে উপস্থিত করেননি। এতটাই তার ক্ষমতা যে, তিনিই প্রথম অর্জুনের দ্বাদশবার্ষিক ব্রহ্মচর্যের ব্রত বুভুক্ষু তাড়নার ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন; যুক্তি স্থাপন করেছেন নিজের পক্ষে, দ্রৌপদীকে ছোট না করেও। উপরন্তু একরাত্রের মধ্যে যে ক্ষণিক বিবাহ এবং ইচ্ছাপূরণ দুই-ই হল– তারপরে তিনি অর্জুনকে কোনও বন্ধনে আবদ্ধ রাখেননি। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের গর্ভজাত সন্তানকে তিনি নিজে মানুষ করেছেন এবং পুত্র যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনূপী তাকে অর্জুনের কাছে পাঠিয়েছেন পিতার প্রয়োজনে সিদ্ধ করার জন্য।
পাণ্ডবরা তখন যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলার শাস্তিতে বনবাসে। অর্জুন দৈব অস্ত্র লাভ করার জন্য প্রতিস্মৃতি বিদ্যা শিখে তপস্যা করতে গেছেন। ভগবান শিবের কাছে পাশুপত অস্ত্র লাভের পর তিনি দেবলোকে ইন্দ্রের কাছে পৌঁছেছেন নতুন অস্ত্রসিদ্ধির জন্য। ঠিক এই সময়ে উলূপীর গর্ভজাত ইরাবান পাণ্ডবদের অরণ্য আবাসে পিতা অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং দেখা না পেয়ে একসময় দেবলোকেই পৌঁছে যান পিতাকে দেখবার জন্য– ইন্দ্রলোকং জগামাশু শ্রুত্ব তত্ৰাৰ্জুনং গতম। অর্জুনকে দেখার পর ইরাবান ধীরভাবে নিজের পুত্র-পরিচয় দিয়ে মায়ের সঙ্গে কীভাবে অর্জুনের দেখা হয়েছিল, সেই ঘটনা জানান নিজের সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য মাতুঃ সমাগমো যশ্চ তৎ সর্বং প্রত্যবেদয়ৎ। উলূপীর সমস্ত দৃঢ়তা ইরাবানের মধ্যে এতটাই ছিল যে, তিনি একবারও নিজের জন্য অথবা তার মায়ের জন্য কোনও দয়া অর্জুনের কাছে যাচনা করেননি অথবা একবারের জন্যও জানাননি যে, মায়ের পূর্বস্বামীর ভ্রাতা, তার পিতৃব্য অশ্বসেন কীভাবে তাদের জীবন ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। অর্জুনের সঙ্গে দেখা হতে ধীর গম্ভীর বিনয়ে তিনি বলেছেন– আমি ইরাবান। আমি আপনার পুত্র ইরাবানস্মি ভদ্রং তে পুত্ৰশ্চাহং তব প্রভো– আমার মায়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল গঙ্গাদ্বারে।
ইরাবানকে বেশি কথা বলতে হয়নি। অর্জুনের সব মনে পড়ে গেছে উলূপীর কথা, গঙ্গাদ্বার থেকে নাগলোকে গিয়ে সেই উচ্ছল রাত্রিযাপনের কথা এবং অবশ্যই উলূপীর মর্যাদাপূর্ণ আচরণ, তাকে গঙ্গাদ্বারের আশ্রমে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত তচ্চ সর্বং যথাবৃত্ত অনুসস্মার পাণ্ডবঃ। অর্জুন সানন্দপুলকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরেছেন পুত্র ইরাবানকে এবং পুত্র বলে তাকে স্বীকার করে নিতে এতটুকুও বিলম্ব করেননি। বীর পুত্রকে দেখে অর্জুনের অন্য কথাও মনে হল। অর্জুন দিব্যাস্ত্র লাভের আশায় ইন্দ্রলোকে গেছেন, তখন তার মন জুড়ে আছে ভবিষ্যতের সেই বিরাট যুদ্ধ। সে-যুদ্ধ যে হবেই সে-কথা তিনি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আর ক্ষত্রিয়ের কাছে এই ধর্মযুদ্ধের মূল্য অনুভব করেই তিনি বীর পুত্র ইরাবানকে সম্বোধন করে বললেন– বাছা! কৌরবদের সঙ্গে যখন আমাদের যুদ্ধ উপস্থিত হবে, তখন তুমি আমাদের সাহায্য করবে– যুদ্ধকালে ত্বয়াস্মাকং সাহাং দেয়মিতি প্রভো।
উলূপীর এই পুত্রটির ঘোড়ার শখ ছিল বোঝা যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকালে তিনি পিতা অর্জুনকে সাহায্য করতে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, সেখানে তার সমস্ত বীরশোভার মধ্যে অনেকটাই জুড়ে আছে ঘোড়া। কম্বোজ, আরট্ট, যেসব দেশে ভাল ঘোড়া পাওয়া যায়, সেইসব বিভিন্ন প্রকার ঘোড়া ইরাবানের চারদিকে জুড়ে রয়েছে– বাজিনাং বহুভিঃ সংখ্যে সমন্তাৎ পরিবারয়। ইরাবান তার সাধ্যমতো যুদ্ধ করে সাহায্য করেছেন অর্জুনকে, কুচক্রী শকুনির কতগুলি ভাইকে তিনি মেরেও ফেলেছেন বীরোচিতভাবে। কিন্তু এই শত্রু-নিধনের ফল তাকে পেতে হয়েছে নিজের মৃত্যু দিয়ে। দুর্যোধন আর্যশৃঙ্গি নামে এক রাক্ষসকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন ইরাবানকে ধ্বংস করার জন্যে। আর্যশৃঙ্গি বোধ হয় অলঘুষ নামে বিখ্যাত ছিলেন, তাঁর বাণে শেষ পর্যন্ত ইরাবানের মুকুটশোভী মস্তকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ইরাবান মারা গেলেন।
পুত্র ইরাবানের মৃত্যুতে নাগিনী-মায়ের কতটা কষ্ট হয়েছিল, মহাভারতের কবি তার কোনও সংবাদ দেননি, এমনকী যুদ্ধক্ষেত্রে এসে অর্জুনের এই প্রবাসী পুত্র এমনই এক অনাড়ম্বর মৃত্যুবরণ করলেন যে, কুরুক্ষেত্রের অন্যত্র যুদ্ধরত অর্জুনের কাছেও সে-খবর ভাল করে পৌঁছল না। মহাভারতের কবিকে দোষ দিই না। তিনি বড় ব্যস্ত মানুষ। মহাকাব্যের যত মহানায়িকা আছেন দ্রৌপদী, কুন্তী, গান্ধারী তাদের জীবনে এত সমস্যা, এত জটিলতা, তাদের ফেলে রেখে অর্জুনের প্রথম বনবাস-বিলাসের এক সামান্য নাগিনী নায়িকা উলূপীকে নিয়ে তার জীবনবিস্তার দেখানোর সময় নেই মহাভারতের কবির, হয়তো উপায়ও নেই, প্রাসঙ্গিকতাও নেই।
সত্যি, আমরা বহুকাল উলূপীর কোনও সংবাদ পাইনি। ভীষ্মপর্বে একবার মাত্র তার পুত্রের দেখা পেলাম, তো সেখানে ইরাবানকে উলূপীর পুত্র হিসেবে প্রমাণ করার জন্যই আমাদের কত মেহনত করতে হল, তো উলূপীর মনের খবর পাব কোথায়! তবে মহাভারতের কবির ভাবভঙ্গি থেকে বুঝতে পারি যে উলূপী সেই সন্তুষ্ট এবং আত্মতৃপ্ত মহিলাদের একজন, যাঁরা অকারণে প্রেমাস্পদের আশঙ্কা তৈরি করেন না। অর্জুনের স্ত্রীর তকমা লাভ করেই উলূপী পরম তৃপ্তিতে জীবন অতিবাহিত করেছেন, তবে হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, অর্জুনের জন্য, অথবা বলা উচিত, অর্জুনের জীবন এবং আয়ুর জন্য উলূপীর সবিশেষ ভাবনা ছিল। এ সম্বন্ধে রীতিমতো একটা গল্প আছে মহাভারতে, আর গল্পের এই জায়গায় উলূপী ভীষণভাবে জড়িয়ে গেছেন অর্জুনের আর-এক বনবাসকালীন সহচরী চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে। এটা অবশ্য ভেবে নিতে এমন কোনও কষ্ট নেই যে, প্রথম বনবাসে উলূপীর তর্ক যুক্তি এবং সহবাসে অর্জুনের দুর্বল ব্রহ্মচর্যের যুক্তি ধুলোয় মিশে যাবার পরই তো চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে অর্জুনের দেখা হয়েছিল, অতএব উলূপীর সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার কিছু যোগাযোগ থাকাটা এমন কিছু আশ্চর্য নয়। বিশেষত পরবর্তী জীবনে এই দুই স্ত্রীর সঙ্গেই অর্জুনের কোনও পরিষ্কার যোগাযোগ ছিল না, অতএব যোগাযোগটা দুই সপত্নীর মধ্যে গড়ে ওঠাটা কিছু অসম্ভব ছিল না।
আসলে অর্জুনের স্ত্রী হিসেবে উপী এবং চিত্রাঙ্গদার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত মিল আছে। দু’জনের সঙ্গেই অর্জুনের বিবাহ হয়েছে, কিন্তু দুজনের কেউই অর্জুনের বধূবেশে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে চাননি। অর্থাৎ কেউই অর্জুনকে আপন অঞ্চল ছায়ায় ধরে রাখতে চাননি, অবশ্য রাখতে চাইলেও অর্জুন থাকতেন না হয়তো। তবে সেটা অন্য কথা। উনূপী এতটাই বন্ধনমুক্ত যে, একবারমাত্র অর্জুনের মিলন-কামনা করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তিনি, কেননা এই মিলনের ব্যাপারে তারই আগ্রহ ছিল বেশি, অর্জুনের দিক থেকে এটা ইচ্ছাপূরণ করার চেয়ে বেশি কিছু না। অন্যদিকে চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুনই মুগ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু তিনি যে বাপের বাড়ি ছেড়ে যাবেন না, সেটা তার মিলনের পূর্বশর্ত ছিল। কাজেই উলূপী বা চিত্রাঙ্গদা– এই দুই জায়গাতেই প্রেমের বাঁধন ছিল আলগা, এই দুই স্ত্রীই অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করে এবং অর্জুনের মধ্যে আপন আপন পুত্রদের পিতৃত্ব দর্শন করেই খুশি ছিলেন। হয়তো এই মিলের সূত্রটাই উনূপী এবং চিত্রাঙ্গদার মধ্যে একটা যোগসূত্র বজায় রেখেছিল।
উলূপীর কথায় চিত্রাঙ্গদার প্রসঙ্গ এসে গেল এবং চিত্রাঙ্গদাকে অতিক্রম করে যাবার উপায় নেই বলেই, তার বৈবাহিক ঘটনাটাও বলে নিতে চাই। চিত্রাঙ্গদা আমাদের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছেন মহাকবি রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত অনুপানগুলির জন্য। চিত্রাঙ্গদা যে পুরুষের বিদ্যায় দীক্ষিত হয়ে প্রচুরতর পৌরুষেয় আচরণ করেছেন– এমন কোনও সংবাদ মহাভারতে নেই। তবে বাংলার কবি মহাভারত থেকে যে সংকেতটুকু পেয়েছেন, তা এইটুকুই যে চিত্রাঙ্গদার পিতা চিত্ৰবাহন মেয়েকে মানুষ করেছেন পুত্রের কল্পনায়; অর্থাৎ বিবাহের পরেও তিনি তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না এবং কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, তার মাধ্যমেই তিনি পিণ্ডলাভের আশা করেছেন। কিন্তু এছাড়া চিত্রাঙ্গদার মধ্যে আর কোনও পুরুষালি ব্যাপার ছিল না, কিংবা কোনওদিন তাকে আপন কটাক্ষে পঞ্চম শর যোজনার জন্য পঞ্চশরের তপস্যাঁতেও বসতে হয়নি।
বস্তুত সেই পঞ্চম শরের সিদ্ধিটুকুতার মধ্যে এতটাই ঠিল যে, অর্জুন মণিপুর রাজকুমারীকে দেখা মাত্রই মোহিত হয়েছিলেন। ঘটনাটা এইরকম– অর্জুনের সঙ্গে উলূপীর যখন দেখা হয়, তখনও তিনি উত্তর ভারতেই ছিলেন। উলূপীর জীবন সার্থক করে অর্জুন পূর্বভারতে আসেন তীর্থভ্রমণ করতে। সেখানে গয়া-গঙ্গা-গঙ্গাধর, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ অতিক্রম করে অর্জুন অনেকটাই ঢুকে পড়েন দক্ষিণ ভারতে, তার পর আসেন দক্ষিণ-পশ্চিম। চিত্রাঙ্গদার আবাস যে মণিপুর তা এই দক্ষিণ-পশ্চিমের ভারতবর্ষে। মণিপুরের রাজধানীতে ঢোকার সময় অর্জুনের সঙ্গে সহায়ক মানুষজন বেশ কম ছিল। ফলে অর্জুন কিন্তু স্বাতন্ত্র এবং স্বাধীনতা ভোগ করছিলেন। মণিপুরে প্রবেশ করে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করতেই হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে। পিতা তাকে পুত্রবৎ লালন করায় রমণীসুলভ কোনও সংকোচ বা জড়তা তার মধ্যে ছিল না। তিনি নির্দ্বিধায় মণিপুরের রাস্তায় রাস্তায় বিচরণ করে বেড়াচ্ছিলেন যানে, বাহনে অথবা স্বতন্ত্র পদচারণায়– তাং দদর্শ পুরে তস্মিন্ বিচরন্তীং যদৃচ্ছয়া।
রমণীর এই দৃপ্ত উচ্ছল রূপ অর্জুন যেন পূর্বে দেখেননি। পথচারী মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন–ইনি মণিপুরেশ্বর চিত্রবাহনের মেয়ে চিত্রাঙ্গদা চৈত্ৰবাহনী। মহাভারতের কবি যে সমাজচিত্র এঁকেছেন, তাতে অর্জুনের মতো এক পুরুষ যদি এমন এক রমণীকে দৃষ্টিমাত্রেই কামনা করে থাকেন, অর্জুন তাই করেছেন বস্তুত– দৃষ্টা চ তাং বরারোহাং চকমে চৈত্ৰবাহনী– তা হলে সেই মুহূর্তেই সেই প্রণয়সংবাদ চিত্রাঙ্গদাকে সোজা জানানোর কথা অর্জুনের। কিন্তু তিনি বোধ হয় তা পারেননি, পারলে সে কথোপকথন মহাভারতে ধরা থাকত। পারেননি যে, তার কারণ বুঝি চিত্রাঙ্গদার ব্যক্তিত্ব এবং দৃপ্ততা– চিত্রাঙ্গদার চলন-বলন দেখে নিশ্চয়ই এমন মনে হয়ে থাকবে অর্জুনের যে, এই রমণী যদি কোনওভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
চিত্রাঙ্গদাকে দেখে যে অর্জুনের ধৈর্য এবং বনবাসকালীন প্রতিজ্ঞাত ব্ৰহ্মচর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, তার পিছনে অবশ্যই বাধাবন্ধহীন উলূপীর সেই অতীত-যুক্তি। তিনিই তো প্রথম অর্জুনকে বুঝিয়েছিলেন দেখো, তোমার যত ব্রহ্মচর্য সেটা দ্রৌপদীর ব্যাপারেই প্রযোজ্য, আমার ক্ষেত্রে নয়– তদিদং দ্রৌপদীহেরেন্যোন্যস্য প্রবাসনম। উলূপীর এই যুক্তি বুঝি চরম সার্থকতায় ধরা দিল ভেজা মহুয়াফুলের মতো মধুরবর্ণ চিত্রাঙ্গদাকে দেখে যৈষা সবর্ণাদ্রমধুকপুস্পৈঃ- অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে কিছু বললেন না, সোজা চলে গেলেন রাজা চিত্ৰবাহনের কাছে। সবিনয়ে তিনি তার কন্যাটির পাণিগ্রহণের প্রার্থনা জানালেন। অর্জুন এটা বুঝেছিলেন যে, তাঁর পিতৃ-মাতৃ-কুলের প্রতিষ্ঠা এবং নিজের প্রতিষ্ঠা– দুটোই কাজ করবে রাজা চিত্ৰবাহনের কাছে, কিন্তু চৈত্ৰবাহনী চিত্রাঙ্গদা এসব নাও বুঝতে পারেন।
ঠিক তাই। চিত্ৰবাহন প্রত্যাশিতভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন–কী নাম তোমার, কার ছেলে তুমি কস্য পুত্ৰোহসি নাম কিম। অর্জুন উত্তর দিলেন– আমি পাণ্ডব অর্জুন, কুন্তীর গর্ভজাত। চিত্ৰবাহন দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে তার সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন– আমার পূর্বপুরুষ প্রভঞ্জন রাজা পুত্রকামনায় তপস্যা করেছিলেন, তপস্তুষ্ট মহাদেব তাকে বর দিয়েছিলেন আমাদের বংশে প্রত্যেকেরই একটি করে সন্তান হবে– স তস্মৈ ভগবান প্রাদাদ একৈকং প্রসবং কুলে। সে সন্তান ছেলে হবে কী মেয়ে হবে, তার কোনও নির্দিষ্টতা নেই। তবে এমনই কপাল যে, আমার পূর্বপুরুষদের সবারই একটি করে ছেলেই হয়েছে, কিন্তু আমারই সন্তান একটি মেয়ে, অবশ্য মেয়ে বলে তাকে আমি এতটুকু অহবেলা করিনি, আমার সমস্ত ভাবনাতে সে আমার পুত্রের মতোই মানুষ হয়েছে, পেয়েছে পুত্রের সমান মর্যাদা– পুত্রো মমায় ইতি মে ভাবনা পুরুষর্ষভ।
চিত্ৰবাহনের এই একটি কথার সংকেতেই কবিগুরুর কবিচিত্ত নতুন সৃষ্টির রহস্য খুঁজে পেয়েছে, লিখিত হয়েছে চিত্রাঙ্গদা’ গীতিনাট্য নতুন আলোক-সংগীতে। চিত্রবাহন মেয়ে চিত্রাঙ্গদাকে ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন এবং অর্জুনের কাছে শর্ত রেখেছেন একটাই– মেয়েকে তিনি বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে দেবেন না। অবশ্য এ কথা তিনি স্পষ্ট করে সকণ্ঠে অর্জুনের মতো বীরের সামনে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু তার কথার মানে তাই দাঁড়ায়। চিত্ৰবাহন বলেছেন– আমার এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, বিধিমতে সেই আমার পিণ্ডদাতা পুত্রের কাজ করবে এবং সে-ই এই মণিপুর রাজ্যের রাজা হবে ভবিষ্যতে এটাই আমার শর্ত– এতৎ শুল্কং ভবস্যাঃ কুলকৃজ্জায়তামিহ। তুমি যদি এই শর্ত মেনে নাও অর্জুন, তবেই চিত্রাঙ্গদা তোমার।
চিত্রাঙ্গদার রূপমুগ্ধ অর্জুন উলূপীর পূর্ব-তর্কমাহাত্মে স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্যের ব্রত স্থলন করে মেনে নিয়েছেন চিত্রবাহনের শর্ত। বিবাহ করেছেন চিত্রাঙ্গদাকে এবং শুধু তাই নয়, বারো বছর বনবাসের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ সময়, তিন-তিনটে বছর অর্জুন মণিপুরের রাজভবনেই কাটিয়ে দিয়েছেন চিত্রাঙ্গদার সাহচর্যে– উবাস নগরে তস্মিন্ তিস্রঃ কুন্তীসুতঃ সমা। তিন বছর শেষ হবার আগেই চিত্রাঙ্গদার গর্ভে পুত্র হল অর্জুনের। অর্জুন আর মণিপুরে অবস্থান করলেন না। তিনি বেশ বুঝলেন যে, উলূপীর যুক্তিটুকু তার ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োগ না করে অন্য ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োগ করে ফেলেছেন। এবার পুনরায় কিছু ব্রত-আচরণ প্রয়োজন, নইলে গাণ্ডীবধা অর্জুন তিন বছর বসে বসে শ্বশুরবাড়ির অন্ন ধ্বংস করে চিত্রাঙ্গদার মতো আর্দ্র মধুকপুষ্পের মধুকর হয়ে রইলেন, এটা তেমন মানায় না। অবশ্য তার ওপরে শর্ত ছিল– পুত্ৰমুখ না দেখিয়ে মণিপুর ছেড়ে যেতে পারবেন না তিনি। অতএব চিত্রাঙ্গদার গর্ভে তার ভবিষ্যতের কোল-আলোকরা ছেলের সম্ভাবনা হলে চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন করে অর্জুন পুনরায় চলে গেলেন তীর্থযাত্রায় তস্যা সুতে সমুৎপন্নে পরিজ্য বরাঙ্গনাম।
অবশ্য বেশি তীর্থ এবার ভ্রমণ করা হল না। কেননা, অর্জুন জানেন যে, চিত্রাঙ্গদার গর্ভ-সম্ভাবনা হয়েছে এবং এতদিনে তার কোলে পুত্রটিকে দেখতে পাবেন তিনি। অতএব তীর্থভ্রমণে দশ-বারো মাস কাটিয়ে দিয়ে আবারও অর্জুন ফিরে এলেন মণিপুরে চিত্রাঙ্গদার কাছে। দেখলেন তার পুত্রের নাম হয়েছে ববাহন। নাতির নামটা নিশ্চয়ই মণিপুররাজ চিত্ৰবাহনেরও দেওয়া– ‘বাহন’ শব্দটি তারই বংশের স্মরণিকা হয়তো, আর অর্জুন যেহেতু কালো রঙের মানুষ ছিলেন, তাই তার পুত্রের গায়ের রংও হয়তো খানিকটা চাপা ছিল। ব’ শব্দের অর্থ পাঁশুটে-তামাটে রং। যাই হোক অর্জুন কথা রেখেছেন– শ্বশুর চিত্রবাহনের হাতে নিজের পুত্র বভ্রুবাহনকে তুলে দিয়ে অর্জুন বলেছেন- চিত্রাঙ্গদার অধিকারী হবার জন্য আপনি যে মূল্য চেয়েছিলেন, এই নিন সেই মূল্য। আমার পুত্র বভ্রুবাহন আপনার বংশের পুত্র হিসেবেই এখানে রইল চিত্রাঙ্গদায়াঃ শুল্কং ত্বং গৃহাণ বভ্রুবাহন- এবারে আমাকে ঋণমুক্ত করুন মহারাজ!
অর্জুন এবার সত্যিই চলে যাবেন। তিন বছর মণিপুর রাজ বাড়িতে চিত্রাঙ্গদা তার মধুকফুলের নেশা– মহাভারতের কবি চিত্রাঙ্গদার গায়ের রঙের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমনই এত অমোঘ শব্দ উচ্চারণ করেছেন– আহা জলে-ভেজা মহুয়ার রং– মহুয়া তো স্বয়ং চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন এবার নেশা কাটিয়ে ফিরে যাবেন আরও দূরে-দূরান্তে। যাবার আগে চিত্রাঙ্গদাকে শেষ বিদায় জানিয়ে বললেন তুমি এখানেই থাক এবং ভাল থাক, লালন পালন করে বড় করে তোলো আমার পুত্র বভ্রুবাহনকে ইহৈব ভব ভদ্রং তে বর্ধেথা বব্ৰুবাহনম। অর্জুন চিত্রবাহনের মনোভাব থেকে এটা বুঝেছেন যে, জন্মমাত্রেই যে পুত্র বিনা কোনও কৃচ্ছুতায় রাজ্যলাভ করে, তার মায়ের মনও তখন এক অন্যতর তৃপ্তিতে ভরে থাকবে। বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি না যাওয়া চিত্রাঙ্গদাও অনেকটা অবস্থিত হয়ে থাকবেন এই মণিপুরে। সে কথা ভেবেই অর্জুন বললেন– একবার আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থের আবাসে এসো, ভাল লাগবে তোমার–ইন্দ্রপ্রস্থনিবাসং মে ত্বং তত্রাগত্য রংস্যসি। সেখানে আমার জননী কুন্তী আছেন, দাদারা আছেন যুধিষ্ঠির, ভীম, আর আছে দুই ছোট ভাই নকুল, সহদেব। সেখানে সবার সঙ্গে তোমার দেখা হবে, তোমার ভাল লাগবে– বান্ধবৈঃ সহিত সর্বৈর্নন্দসে ত্বমনিন্দিতে।
অর্জুন সবার কথা বললেন, কিন্তু দ্রৌপদীর কথা বললেন না। বলবার দরকারও ছিল না; চিত্রাঙ্গদা নিশ্চয়ই জানতেন সেই বিদগ্ধা সপত্নীর কথা। অর্জুনের ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার কোনও বাসনাও তিনি দেখাননি। তবে অর্জুন ঘটা করে তাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, হয়তো ইন্দ্রপ্রস্থের ঐশ্বর্য দেখানোর জন্যই। একটা কথা অগ্রিম বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, এমনিতে চিত্রাঙ্গদার যাওয়া হবে না ইন্দ্রপ্রস্থে, কিন্তু যুধিষ্ঠির মহারাজ যেভাবে চলছেন, তাতে একদিন রাজসূয় যজ্ঞ তিনি করবেনই। অন্তত সেই রাজসূয় যজ্ঞের বিশাল মহৎ আয়োজনকে উপলক্ষ করে চিত্রাঙ্গদা একবার যেতেই পারেন ইন্দ্রপ্রস্থে। সেই যাবার কারণটা অর্জুন যেন একটু সাহংকারেই জানিয়ে দিলেন চিত্রাঙ্গদাকে। বললেন– সেই রাজসূয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান হবে সমস্ত ভারত জয় করার পর। তখন তোমার পিতা চিত্ৰবাহন অবশ্যই বহুমূল্য রত্নধন নিয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করবেন তার প্রতি বশ্যভাব নিয়ে বহুনি রত্নান্যাদায় আগমিষ্যতি তে পিতা। তখন অন্তত তুমি পিতার সঙ্গেই ইন্দ্রপ্রস্থে যেও। একসঙ্গে এলে তোমার সঙ্গে অন্তত একবার দেখা হবে আমার। আর এখন তো তোমাকে এখানে থাকতেই হবে আমার পুত্র-পালনের সমস্ত ব্যস্ততা নিয়ে দ্রক্ষ্যামি রাজসূয়ে ত্বাং পুত্রং পালয় মা শুচঃ।
‘মা শুচঃ’, অর্থাৎ দুঃখ কোরো না, কষ্ট পেয়ো না। তার মানে যতই বাপের বাড়ি থাকুন চিত্রাঙ্গদা, এই তিন বছরের আসঙ্গে, মিলনে, অর্জুনকে তিনি ততটাই ভালবেসে ফেলেছেন, যাতে পুরুষের দীক্ষায় দীক্ষিত এক রমণীও যথেষ্ট কষ্ট পান। অর্জুন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন আমি চলে যাচ্ছি বলে আমার বিরহে তুমি কষ্ট পেয়ো না যেন– বিপ্রয়োগেন সন্তাপং মা কৃথামনিন্দিতে। আমার পুত্র বভ্রুবাহন যে এখানে রইল, জেনো সে আমার বহিশ্চর প্রাণ। সে মহারাজ চিত্ৰবাহনের বংশধর হিসেবে এখানে রাজা হলেও প্রসিদ্ধ কুরু-ভরতবংশের আনন্দ সংবাদ বহন করে এনেছে সে। একথা খুব ভাল করে মনে রেখো যে, সে আমার ঔরসজাত পুত্র হলেও সে আমাদের পাঁচ ভাই পাণ্ডবের একান্ত প্রিয় পুত্রের সমান। তুমি তাকে যথাশক্তি পালন কোরো– পাণ্ডবানাং প্রিয়ং পুত্রং তস্মাৎ পালয় সর্বদা।
অর্জুনের কথা শুনলে বোঝা যায় যে, দ্রৌপদীর এক-পঞ্চমাংশ পতিত্ব লাভ করেও সেখানে তার গর্ভে এখনও কোনও পুত্রলাভ করেননি অর্জুন। উলূপীর গর্ভজাত পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার না করলেও, তিনি অন্যপূর্বা বা অন্য লোকের পূর্ববিবাহিত স্ত্রী। চিত্রাঙ্গদাই হলেন সেই রমণী যাঁর গর্ভে প্রথম ঔরস-পুত্র লাভ করলেন তিনি। ঠিক সেই কারণেই এখানে তার স্নেহের অভিব্যক্তি কিছু বেশি, আরও বেশি এই কারণে যে, স্ত্রী অথবা পুত্র কাউকেই তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে যেতে পারছেন না।
চিত্রাঙ্গদাকে আমরা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে তেমন করে দেখতে পাইনি। অথবা শত শত রাজা-মহারাজার ভিড়ে মহাভারতের কবি চিত্রাঙ্গদাকে তার আড়াল থেকে আর স্পষ্ট করে দেখানোরই সুযোগ পাননি। সেখানে কৃষ্ণের মতো মানুষকে নিয়ে বিবাদ, শিশুপালকে নিয়ে বিরাট ঝামেলা, দুর্যোধনের হিংসে এতরকম মহাকাব্যিক বৈচিত্র্যের মাঝখানে কোথায় উলূপী, কোথায় চিত্রাঙ্গদা? তা ছাড়া উলূপীকে তো অৰ্জুন নেমন্তন্নও করেননি রাজসূয় যজ্ঞে, চিত্রাঙ্গদাকে করেছিলেন। তিনি হয়তো এসেছিলেন, হয়তো আসেননি, আমরা খবর পাইনি সঠিক। এতটাই না-খবর যে, তার পর কত বড় বড় ঘটনা ঘটে গেল। সেই বিখ্যাত পাশাখেলা, পাণ্ডবদের বনবাস, অজ্ঞাতবাস, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, কৌরবদের পতন এবং শেষপর্যন্ত অনিচ্ছুক যুধিষ্ঠিরের রাজা হওয়া এই সব বিশাল ঘটনা-চিত্রের ভিড়ে চিত্রাঙ্গদা-উলূপীর কোনও স্থান হয়নি।
অষ্টাদশাহ যুদ্ধের মধ্যে তবু একবার আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে উলূপীকে স্মরণ করতে পারি, কিন্তু চিত্রাঙ্গদাকে নয়। উলূপীর চেয়ে চিত্রাঙ্গদার প্রতি অর্জুনের সাময়িক আকর্ষণ বেশি ছিল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদা এতটুকু ঝুঁকি নিয়েও পুত্রকে পিতার সাহায্যে পাঠাননি। কিন্তু উনূপী তার গর্ভে অর্জুনের ক্ষেত্রজ পুত্র ধারণ করলেও সেই একরাত্রির ক্ষণিকের অতিথিকে ভোলেননি কখনও। তিনি জানেন যুদ্ধ মানেই এক ধরনের সংশয় এবং বিপন্নতা, অর্জুনের মতো মহাবীর যুদ্ধ করলেও স্বামীর জন্য স্ত্রীর সংশয় সেখানে কাটে না। অতএব উলূপীর পুত্র ইরাবান নিজেই যুদ্ধে আসুন পিতার সাহায্যে অথবা উলূপীই তাঁকে পাঠিয়ে থাকুন, এটা বেশ বোঝা যায় যে, অর্জুনের জন্য উলূপীর ভাবনা অনেক বেশি। কুমার বভ্রুবাহনকে কিন্তু আমরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পিতার সাহায্যকল্পে উপস্থিত থাকতে দেখিনি। ভবিষ্যতে আমরা তাঁর অনেক বীরত্বের পরিচয় পেলেও যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বভ্রুবাহন উপস্থিত থাকলে অর্জুনের ভাল লাগত নিশ্চয়। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের কাছে উলূপীর চেয়ে প্রিয়তরা হওয়া সত্ত্বেও পুত্রকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের সংশয়ের মধ্যে পাঠাননি। হয়তো পিতা চিত্ৰবাহনের বংশধরকে মণিপুর রাজ্যের রাজা হিসেবে বাঁচিয়ে রাখাটাই চিত্রাঙ্গদার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এদিক থেকে নাগকন্যা উলূপী অর্জুনের জীবনে যতই অনুল্লেখ্যা হোন, তিনি অনেক বেশি ভালবেসেছিলেন অর্জুনকে। তাঁর সেই উষ্ণতা বোধ হয় প্রমাণ করাও যায়, যদিও সে কাহিনি জড়িয়ে আছে চিত্রাঙ্গদার জীবনের সঙ্গে।
তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছেন এবং তাঁর বহুতর জ্ঞাতিবধের পশ্চাত্তাপ প্রশমনের জন্য মুনিঋষিরা তাঁকে অশ্বমেধ যজ্ঞ করার পরামর্শ দিয়েছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রক্রিয়া মেনে মহাবীর অর্জুন বেরিয়েছেন অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে। কোথাও যুদ্ধ, কোথাও বা যুদ্ধ না করে নানান রাজ্যের বশ্যতা অধিকার করে অর্জুন পৌঁছলেন মণিপুর রাজ্যে। চিত্রাঙ্গদার পিতা চিত্ৰবাহন তখন বেঁচে ছিলেন না বোধ হয়, কিংবা বেঁচে থাকলেও রাজকার্য থেকে অবসরগ্রহণ করেছেন। কেননা মণিপুরের রাজা হিসেবে আমরা ববাহনকেই দেখতে পাচ্ছি– মণিপুরপতের্দেশমুপাযাৎ সহ পাণ্ডবঃ।
অর্জুনের মতো মহাবীর যখন অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে আসছেন, তখন রাজ্যে রাজ্যে খবর হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মণিপুরপতি রাজা বভ্রুবাহনের কাছেও সে-খবর পৌঁছল এবং তিনি জানেন যে, অর্জুন তার পিতা ত্বা তু নৃপতিঃ প্রাপ্তং পিতরং বভ্রুবাহনঃ। সেই কোনকালে শিশু বয়সে পিতা অর্জুন তার মস্তক চুম্বন করে চলে গিয়েছিলেন সে কথা জননী চিত্রাঙ্গদার কাছে শুনে থাকবেন ববাহন, কিন্তু জ্ঞান হওয়া ইস্তক সেই মহাবীর পিতাকে তিনি দেখেননি। আজ যখন তিনি এই রাজ্যে উপস্থিত এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রক্রিয়া যখন মণিপুর রাজ্যের বশ্যতা দাবি করে, তখন বভ্রুবাহনের পক্ষে এইটাই স্বাভাবিক যে, তিনি পিতার বশ্য হবেন। অতএব বশ্যতা স্বীকারের বিধি অনুসারেই বভ্রুবাহন ব্রাহ্মণ সজ্জনদের নিয়ে যথোপযুক্ত প্রণামী ধন সহকারে উপস্থিত হবেন পিতা অর্জুনের কাছে সবিনয়ে পরম শ্রদ্ধায়।
এই বিনয়, এই শ্রদ্ধা দেখে এতটুকু বিগলিত হলেন না মহাবীর অর্জুন। পুত্রের শিক্ষা দীক্ষায় তার সন্দেহ উপস্থিত হল। মহাবীর অর্জুনের পুত্রের এই কি সমুচিত ব্যবহার! বভ্রুবাহন ক্ষত্রিয়কুমার বটে, বাইরে থেকে যে কেউ তাকে যুদ্ধে আহ্বান করুক, তিনি পিতা হোন, ভাই বোন বা শ্বশুর হোন, তার সঙ্গেই যুদ্ধ করতে হবে। হারা-জেতা তো অন্য ব্যাপার। কিন্তু এই যে বশংবদজনের মতো অর্থ-ধনের প্রণামী নিয়ে এক ক্ষত্রিয় রাজা যুদ্ধার্থী ব্যক্তির কাছে উপনত হচ্ছে, এই কি ক্ষত্রিয়ের ব্যবহার! ক্ষত্রিয়পুত্রের এহেন বিনয় ব্যবহারে এতটুকুও খুশি হলেন না অর্জুন– নাভ্যনন্দৎ স মেধাবী ক্ষত্রং ধর্মমনুস্মরন। মনে মনে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হলেন যে, অবনত পুত্রকে খানিকটা তিরস্কার না করে পারলেন না।
অর্জুন বললেন- তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যে, তুমি ক্ষাত্রধর্মের আওতার মধ্যে নেই। বাছা! এই যে ঘোড়াটি এসেছে, এটা যুধিষ্ঠির মহারাজের যজ্ঞীয় অশ্ব, আমি এসেছি এই অশ্বের রক্ষক হয়ে, এখন আমি তোমার পিতা নই। অশ্বরক্ষক যুদ্ধার্থী অর্জুনের সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করলে না কেন– নাযোৎসীঃ কিন্তু পুত্ৰক! ক্ষত্রিয়ের ছেলে হয়ে তোমার এই দুর্বুদ্ধি কেমন করে হল, আমি ধিক্কার দিচ্ছি তোমাকে। তুমি বেঁচে থেকে আমার কোন পুরুষার্থ সাধন করবে? আমি যুধিষ্ঠিরের অশ্ব রক্ষায় নিযুক্ত হয়ে যুদ্ধের দ্বারা তোমাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে এসেছি, আর তুমি কিনা একজন স্ত্রীলোকের মতো কোমল মানসিকতায় আমাকে মধুর আলাপে বশীভূত করতে চাইছ– যং স্ত্রীবদ যুধা প্রাপ্তং মাং সাম্না প্রত্যগৃহ্নথাঃ। হ্যাঁ, এমন যদি হত যে, আমি নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার কাছে এসেছি, তা হলে এই এখন যেভাবে এসেছ– ব্রাহ্মণ-সঙ্গে, প্রণামী সহকারে, এগুলো তখন মানাত, নইলে এই কি ক্ষত্রিয়ের ব্যবহার, কুলাঙ্গার কোথাকার প্রক্রিয়েয়ং ভবে যুক্তা তাবত্তব নরাধম।
মহাবীর অর্জুনের এই দুঃখ অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত যাঁর পুত্র অভিমন্যু বীরদর্পে সম্মুখ যুদ্ধে সপ্তরথীর হাতে নিহত হয়েছেন। অর্জুন তার এই পুত্রকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখেননি। যেখানে ইরাবান তার ক্ষেত্রজ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, সেখানে এই পুত্রকে যিনি একসময় বহিশ্চর প্রাণ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সে তো মহাযুদ্ধে যোগ দিলই না, আজ সে আবার মধুরালাপে যুদ্ধার্থী পিতার বশ্যতা স্বীকার করে নিতে এসেছে। অর্জুনের দিক থেকে পিতা হিসেবে ক্ষোভটুকু তাই স্বাভাবিক।
ঠিক এইখানেই মহাভারতের কবি নাগকন্যা উলূপীর প্রবেশ ঘটিয়েছেন পিতা-পুত্র সংবাদের অভ্যন্তরে। উলূপীর এই আবির্ভাব খানিকটা অলৌকিকতায় আচ্ছন্ন, কিন্তু তার লৌকিক প্রতিপত্তি কিছু অসম্ভব নয়। মহাভারতের কবি লিখেছেন– স্বামী অর্জুন তাঁর ছেলেকে এই অকথ্য তিরস্কার করছেন দেখে নাগকন্যা উলূপী নাকি সহ্য করতে না পেরে ভূমি ভেদ করে পাতাল থেকে উঠে এলেন– অমৃষ্যমাণা ভিত্বোবী উলূপী সমুপাগমৎ। এখানে উলূপী ভূমি ভেদ করে এলেন কিনা, অথবা পাতাল থেকেই এলেন কিনা সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেননা মহাকাব্যের বিরাট আড়ম্বরের মধ্যে অতল-পাতাল আর দ্যুলোক-ভূলোকের যোগাযোগ ঘটে মহাকবির বিশাল পরিব্যাপ্ত মনোভূমির সঙ্গে তাল রেখে। লৌকিকতার খাতিরে শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, অর্জুনের একক বনবাসকালে যে দুই রমণীর সঙ্গে পরপর দেখা হয়েছিল এবং যাঁদের সঙ্গে অর্জুন নিজে আর কোনও যোগাযোগ রাখেননি, সেই দুই রমণী কিন্তু নিজেদের মধ্যে হয়তো যোগাযোগ রেখেছিলেন আপন ভাগ্যের একাত্মতায়। মহাভারতের কোথাও এ কথা স্পষ্টভাবে লেখা নেই, কিন্তু যে দুই বহিশ্চরা রমণী দ্রৌপদী-সুভদ্রার মতো অর্জুনের অভ্যন্তরা হননি, তাদের নিজেদের মধ্যে অকালিক যোগাযোগটাও অস্বাভাবিক নয়।
এই যে উলূপী এখানে এসেছেন, তাও এখনও তিনি কত সুন্দরী, মহাভারতের কবি এই বিপন্ন মুহূর্তেও এক ঝলক সেই শরীর বর্ণনা দিতে ভোলেননি। বলেছেন– নাগকন্যাউলূপী উপস্থিত হয়েছেন সপত্নীপুত্রের সামনে, এখনও তিনি কত সুন্দরী, তার শারীরিক সৌন্দর্য্যে এখনও কোনও খুঁত ধরার উপায় নেই। এই রূপ দেখেই না ব্রহ্মচারী অর্জুনের ব্রতভঙ্গের যুক্তি এসেছিল– উলূপী চারুসর্বাঙ্গী সমুপেত্য উরগাত্মজা। উলূপী দেখলেন– সপত্নীপুত্র বভ্রুবাহন অর্জুনের তিরস্কার শুনেও অধোমুখে দাঁড়িয়ে আছেন অর্জুনের সামনে, তখনও তিনি যুদ্ধের বিষয়ে সংশয়াপন্ন হয়ে চিন্তা করে যাচ্ছেন– সা দদর্শ ততঃ পুত্রং বিমৃশন্তমধোমুখম। মহাভারতের কবি কিন্তু বভ্রুবাহনকে উলূপীর সপত্নীপুত্র বলেননি, বলেছেন ‘পুত্র’, অর্থাৎ স্পষ্ট চিনিয়ে দেবার জন্যেও তিনি আমাদের মতো স্পষ্ট অথচ কৃত্রিম শব্দ ব্যবহার করেন না, চিত্রাঙ্গদার পুত্র বলে পৃথক কোনও ভেদদৃষ্টি উলূপীর নেই।
উলূপী বভ্রুবাহনকে বললেন– বাছা! আমি নাগকন্যা বটে, তবে আমাকে তুমি তোমার মা বলে জেনো, আমার নাম উলূপী– উলুপীং মাং নিবোধ ত্বং মাতরং পন্নগাত্মজা। পরিচয় সাঙ্গ হতেই উলূপী কাজের কথায় এসে বললেন– তুমি যদি আমার কথা অনুসারে কাজ করো, তবেই সেটা ধর্ম হবে বাছা! এই হলেন তোমার পিতা যুদ্ধদুর্মদ অর্জুন, এই যুদ্ধার্থী পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করো নির্দ্বিধায়, তাতে একসময় তার প্রীতি ঘটবে, তোমারও ভাল হবে, তুমি যুদ্ধ করো পিতার সঙ্গে যুধ্যস্বৈনং কুরুশ্রেষ্ঠং পিতরং যুদ্ধদুর্মদ।
উলূপী-মায়ের কথা শুনে চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহন যুদ্ধসাজে সেজে বীরদর্পে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন অর্জুনের সঙ্গে। পিতা-পুত্রে দারুণ যুদ্ধ হল এবং সে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল– এটা এমন একটা যুদ্ধ যার ফল যেমন অস্বাভাবিক তেমনই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক এই কারণে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধনায়ক অর্জুন এই যুদ্ধে হেরে গেলেন শুধু নয়, বলা উচিত মারা গেলেন। আর স্বাভাবিক এই কারণে যে, যত বড় নায়কই হোন না কেন অর্জুন, পুত্রের কাছে হেরে যাবার আনন্দ পূর্বে তিনি পাননি। পুত্রের কাছে পিতা এবং শিষ্যের কাছে গুরু যখন হারেন, সেই হারার চেয়ে শিক্ষার গৌরব তখন বড় হয়ে ওঠে। অভিমন্যুর অবর্তমানে এই হারটুকু প্রয়োজন ছিল অর্জুনের। হয়তো বা সেইজন্যই বভ্রুবাহনের মতো বীর বেঁচে আছেন বিরাট কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও। মহাভারতের কবি লিখেছেন– পুত্রের বিক্রম দেখে গাণ্ডীবধন্বা অৰ্জুন মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট হয়ে যুদ্ধে কিছু শিথিল হয়ে পুত্রকে আর তেমন পীড়ন করেননি– সংগ্ৰীয়মাণঃ পার্থানামৃষভঃ পুত্রবিক্রমাৎ– অন্যদিকে ছেলেমানুষ বলেই, বিশেষত পিতার মুখে যা-নয়-তাই ধিক্কার শুনেই, বাল-চাপল্যবশত বভ্রুবাহন বড় বেশি করে চেপে ধরলেন অর্জুনকে– ততঃ বাল্যাৎ পিতরং বিব্যাধ হৃদি পত্রিণা। অর্জুন মূৰ্ছিত হলেন আঘাতে এবং যদি পরবর্তীকালে উলূপীর ভালবাসার মাহাত্ম্য বেশি করে স্বীকার করতে হয়, তা হলে বলা ভাল- অর্জুন সাময়িকভাবে মারা গেলেন। বীর পিতাকে এইভাবে বাণহত মৃতপ্রায় দেখে ববাহনও মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন যুদ্ধস্থলেই।
এইভাবে সুচিরপ্রস্থিত স্বামীর মৃত্যু এবং পুত্রের পতন শুনে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করলেন চিত্রাঙ্গদা মণিপুরের রাজমাতা, অর্জুনের মহিষী। ত্রস্ত, কম্পিত, বিমূঢ় চিত্রাঙ্গদা দেখলেন তার স্বামী মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। হস্তিনাপুরের আবর্তে না-থাকা অর্জুনের দুই বহিশ্চরা স্ত্রীই যে দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন তা যেমন উলূপীর ‘চারুসৰ্বাঙ্গী’ বিশেষণে বোঝা গেছে, তেমনই চিত্রাঙ্গদার বিশেষণ– তিনি অলোকসামান্যা সুন্দরী এখনও– দেবী দিব্যবপুর্ধরা। তিনি উল্পীকেই প্রথম দায়ী করলেন, কেননা তিনি জানেন যে, উনূপীই বভ্রুবাহনকে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্ররোচিত করেছেন। চিত্রাঙ্গদা বললেন– দেখো উলূপী! তোমারই স্বামীর অবস্থাটা দেখো– পশ্য ভর্তারং শয়ানং নিহতং রণে– তোমার জন্যই আমার পুত্রের হাতে এই মহাবীরের মৃত্যু ঘটেছে।
চিত্রাঙ্গদা উলূপীকে দোষ দিয়ে দায়ী করছেন বটে, কিন্তু উলূপীর মর্যাদা সম্বন্ধে এবং অর্জুনের প্রতি উনূপীর অনন্ত ভালবাসা সম্বন্ধেও তিনি যথেষ্ট অবহিত। চিত্রাঙ্গদা বললেন– আর্য পুরুষের রীতিনীতি, ধর্ম তুমি যথেষ্টই জানো এবং স্বামী অর্জুনের প্রতি নিষ্ঠাও তোমার যথেষ্টই আছে– ননু ত্বম্ আর্যধর্মজ্ঞা ননু চাসি পতিব্রতা– তো এহেন তোমার এ কী কুবুদ্ধি হল, যার জন্য তোমার স্বামী তোমারই প্ররোচনায় যুদ্ধে নিহত হলেন– পতিস্তে নিহতো রণে। এই মুহূর্তে নিজের স্বামীকে ‘তোমার স্বামী’ বলে চিহ্নিত করে অর্জুনের মৃত্যুর সমস্ত দায় উলূপীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন চিত্রাঙ্গদা। সঙ্গে সঙ্গে তার মনের মধ্যে এমন একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে যে, কেন উলূপী এমন একটা কাণ্ড করে বসলেন, এমনকী এ বিশ্বাসও তার আছে যে, উনূপী নাগ জনগোষ্ঠীর মানুষ; মণি-মন্ত্র-মহৌষধির নানা তুকতাক তার জানা আছে যাতে তাঁর মৃত পতি আবার জীবিত হয়ে উঠতে পারেন। চিত্রাঙ্গদা বললেন– এমন যদি হয়ে থাকে যে তোমার স্বামী তোমার প্রতি কোনও অন্যায় অপরাধ করেছেন, তবু স্বামী বলেই এই অবস্থায় তাকে তোমার ক্ষমা করা উচিত। আমি চাইছি, যদি পারো এবার তোমার স্বামীকে তুমি বাঁচাও ক্ষমস্ব যাচমানা বৈ জীবয়স্ব ধনঞ্জয়ম।
একটা জায়গাতে চিত্রাঙ্গদা বেশ আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন। উলূপীকে তিনি যথেষ্ট চেনেন। অর্জুনের প্রতি যে তাঁর অনন্ত ভালবাসা আছে, এটা চিত্রাঙ্গদাও জানেন। কিন্তু এমন বিপন্ন অবস্থাতেও উলূপী কেমন ভাবলেশহীন। কোনও দোষারোপে তিনি কাতর হচ্ছেন না, কোনও প্রতিক্রিয়াও নেই তার মধ্যে, এমনকী প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুতেও উনূপী এতটুকু বিকারগ্রস্ত নন। চিত্রাঙ্গদা বুঝতে পারছেন যে কোনও রহস্য আছে এই ঘটনার পিছনে। হয়তো বা রহস্য প্রকাশ এবং এই মৃত্যুর প্রতিকারের আশাতেই তিনি উল্পীকে চেতিয়ে দিয়ে বললেন- “আর্যে। সম্বোধনটা খেয়াল করুন, উনূপী এতটাই অধিগুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যাঁকে ‘আর্যে’ সম্বোধনে চিহ্নিত করছেন চিত্রাঙ্গদা। অবশ্য এই সম্বোধনের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার তিরস্কারটুকুও বাদ গেল না। তিনি বললেন– আর্যে! দুনিয়ার সব কিছু জেনেও তুমি ধর্ম ব্যাপারটাই জানো না, নইলে পুত্রের মাধ্যমে পিতাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েও তুমি নির্বিকার রয়েছে কেমন করে– যদ ঘাতয়িত্বা পুত্ৰেণ ভর্তারং নানুশোচসি। চিত্রাঙ্গদা উলূপীকে প্রায় দায়ী করেই বললেন– আমি আমার ছেলের জন্য ভাবি না, দিদি! কিন্তু যিনি এই দেশে অতিথি হয়ে এসেছিলেন সেই স্বামীর জন্য বড় কষ্ট পাচ্ছি আমি। এ আমরা কেমন আতিথ্য করলাম– পতিমেব তু শোচামি যস্যাতিথ্যম ইদং কৃতম।
উলূপীর প্রতি অনুশোচনার তিরস্কারটুকু জানিয়ে বিমূঢ়া চিক্রাঙ্গদা রণস্থলে শায়িত অর্জুনের কাছে গেলেন। অধোমুখে বললেন– প্রিয় আমার! তুমি কুরুমুখ্য ধর্মরাজের প্রিয় ভাই। তুমি তারই যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে এসেছ এখানে। আমার পুত্র যে অশ্ববন্ধন করেছিল, সেই অশ্ব এই আমি মুক্ত করে দিলাম– অয়মশ্বে মহাবাহো ময়া তে পরিমোক্ষিতঃ। তোমাকে তো এখন এই অশ্বের সুরক্ষার ভার নিয়ে কত রাজ্যে যেতে হবে, সেই তুমি এমন করে মাটিতে শুয়ে থাকলে চলবে কী করে–স কিং শেষে মহীতলে? তুমি জানো– আমার প্রাণ এবং তোমার স্বজন কুরুদের প্রাণ তোমারই আয়ত্ত, সেই প্রাণদাতা মানুষটি এমন প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকলে সবাই কী করে?
চিত্রাঙ্গদা অনেক বিলাপ করলেন। উলূপীর প্রতি সেই পুরাতন তিরস্কার জাগ্রত রেখে এমনই সন্দেহ করলেন, যেন উলূপী ইচ্ছে করেই স্বামী হত্যা করে আবারও বিয়ে করতে চাইছেন। একথাগুলি অবশ্য একেবারেই বিলাপের তাড়নায় যা ইচ্ছে বলা। কিন্তু তার বক্তব্যের উত্তরাংশে উলূপীর প্রতি সেই আন্তরিকতা এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ ছিল, যাতে তিনি যাচনা করেছিলেন যে, আমার ছেলে না বেঁচে থাকে, তাতেও আমি বিব্রত নই, কিন্তু অর্জুন বেঁচে উঠুন– কামং স্বপিতু বাললাহয়ং… বিজয়ঃ সাধু জীবতু। চিত্রাঙ্গদা কেমন করে যেন বুঝতে পারছিলেন যে, এই দুর্ঘটনা, বা অর্জুনের এই মারণ-বাঁচনের মধ্যে উলূপীর হাতে কোনও গভীর উপায় আছে। চিত্রাঙ্গদা বললেন ছেলেকে উত্তেজিত করে যে স্বামীকে তুমি মরণের মুখে ঠেলে দিয়েছ, তাঁকে যদি আজ তুমি জীবিত না দেখাতে পারো, তবে আমি আত্মহত্যা করব। আর যতক্ষণ আমি অর্জুনের এই জীবন না দেখছি, ততক্ষণ আমি প্রায়োপবেশনে বসে থাকব, তারপর মৃত্যুই হবে আমার আশ্রয়।
ইতোমধ্যে কুমার বভ্রুবাহনের সংজ্ঞা ফিরল। তিনিও পিতাকে মৃত্যুর মতো শীতল দেখে অনেক বিলাপ করলেন এবং অনেক অনুশোচনায় মায়ের সঙ্গে প্রায়োপবেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক এইরকম একটা সংকটময় মুহূর্তেও নাগনন্দিনী উলূপীই ছিলেন স্থির এবং অবিচল। সপত্নী চিত্রাঙ্গদা এবং বভ্রুবাহনের মনের অবস্থা দেখে নাগকন্যা উলূপী নাগদের পরম বিশ্বাসের বস্তু সঞ্জীবন মণিটি স্মরণ করলেন। মণিটি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হল। বিহ্বল বভ্রুবাহনের হাতে সেই মণিটি দিয়ে উলূপী বলছেন– ওঠো বাছা! ওঠো। তুমি ভাল করে এটা জেনে রেখো যে, তুমি অর্জুনকে মারোনি, মারতে পারোই না। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে সমস্ত দেবতারা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেও তারা অর্জুনকে মারতে পারবেন না, সেখানে তুমি তাকে মারবে কী করে। আসলে আমি ‘মোহিনী’ নামে এক মায়া তৈরি করেছিলাম এবং তা করেছিলাম তোমার পিতার খুশির জন্যই প্রিয়ার্থং পুরুষেন্দ্রস্য পিতৃস্তেহদ্য যশস্বিনঃ। তোমার পিতা তোমার মধ্যে ক্ষত্রিয়ের শক্তি দেখতে চেয়েছিলেন, আর ঠিক সেইজন্যই আমি তোমাকে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছি, তোমার কোনও অনিষ্ট করার জন্য নয়। তবে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আমি এই অলৌকিক সঞ্জীবন মণি এনেছি, এই মণি তুমি তোমার পিতার বক্ষস্থলে রাখো, তিনি অবশ্য বেঁচে উঠবেন।
বিমাতার প্রস্তাব অনুসারে বভ্রুবাহন সঞ্জীবন-মণিটি অর্জুনের বক্ষস্থলে স্থাপন করতেই অর্জুন সুপ্তোত্থািতের মতো উঠে বসলেন এবং নিজ়াজড়িত রক্তচক্ষু দুটি মুছতে লাগলেন– চিরসুপ্ত ইবোত্তস্থৌ মৃষ্টলোহিতলোচনঃ। অর্জুন সুস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে আনন্দের ধুম পড়ে গেল। পুত্র বভ্রুবাহনকে আলিঙ্গন করে তার মস্তক আঘ্রাণ করলেন পিতা অর্জুন। তার পরেই তাঁর চোখ পড়ল দুই অসহায়া রমণীর দিকে– চিত্রাঙ্গদা এবং উনূপী– কোনও কারণেই যাঁদের রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। চিত্রাঙ্গদাকে খানিকটা শোকক্লিষ্ট দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু উলূপীকে তেমন নয়। অর্জুন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন পুত্র বভ্রুবাহনকে কেমন যেন একটা কিছু ঘটে গেছে বাছা! সে-ঘটনার মধ্যে শোকের ব্যাপারও আছে, আশ্চর্যের ব্যাপারও আছে এবং আনন্দের ব্যাপারও আছে– কিমিদং লক্ষ্যতে সর্বং শোক-বিস্ময়-হর্ষবৎ।
ঘটনা যাই ঘটুক, অর্জুনের কাছে এটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না যে, এই দুই রমণী হঠাৎ এই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত কেন। বিশেষ করে উলূপী, তিনি তাঁর নাগরাজ্যের আবাস ছেড়ে এই মণিপুর রাজ্যে কেন উপস্থিত। অর্জুন বভ্রুবাহনকেই জিজ্ঞাসা করে বললেন যে– আমি জানি তুমি আমার আদেশেই যুদ্ধ করেছ, কিন্তু তাতে এই দুই স্ত্রীলোক কেন এই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত স্ত্রীণাম আগমনে হেতুম অহমিচ্ছামি বেদিতুম। বভ্রুবাহন পিতার কথার কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন– আপনি উলূপী মাতাকে জিজ্ঞাসা করুন– উলূপী পৃচ্ছতামিয়ম।
এতে রহস্য আরও বেড়ে গেল। একদিকে অর্জুনের কাছে, অন্যদিকে পাঠকের কাছেও। অর্জুন পূর্বাপর কিছুই জানেন না, পাঠক তবু তা জানেন, তবু নানান অলৌকিক কাণ্ডকারখানায় পাঠক কিছু বিমূঢ়। আসলে মহাকাব্যের শৈলীমুখর অলৌকিকতার ছায়াটুকু সরিয়ে নিলে এইটুকু বেশ বোঝা যায় যে, উলূপীর সঙ্গে তার কনিষ্ঠা সপত্নী চিত্রাঙ্গদার গভীর যোগোযাগ ছিল। সে যোগাযোগ এতটাই যে, সপত্নীর পুত্রকে নিজের পুত্রের মতো তিনি যুদ্ধে প্ররোচিত করতে পেরেছিলেন। কুমার অভিমন্যু মহাযুদ্ধে হত হবার পর বভ্রুবাহনের মধ্যে ক্ষাত্রতেজের যে প্রাধান্যটুকু অর্জুন দেখতে চেয়েছেন, তা পূরণ করেছেন উলূপী। তিনি অর্জুনের মর্ম এতটাই বোঝেন যে, অর্জুনের প্রীতির জন্য তাঁর পুত্রকে প্ররোচিত করার মধ্যে তিনি কোনও অপরাধ দেখতে পাননি। শেষমেশ সেই মণির কথা–আমাদের ধারণা অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারে মরে যাননি, তবে হ্যাঁ, পুত্রের হাতে তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন অবশ্যই। আর নাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রসিদ্ধ আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রচলন না থাকলেও মণি-মন্ত্র-মহৌষধির স্বপ্রযুক্তির চিকিৎসা তাদের জানা ছিল, ফলে উলূপীর সঞ্জীবন মণির ব্যবহারে অর্জুন সংজ্ঞালাভ করেছেন, এতেও কিছু আশ্চর্য নেই।
বভ্রুবাহনের সংকেত থেকে অর্জুন এটা পরিষ্কার বুঝে গেলেন যে, সমস্ত ঘটনার মধ্যে উলূপীর একটা প্রাধান্য আছে এখানে। মণিপুর রাজ্যে তার উপস্থিতি এই রহস্য আরও ঘনীভূত করে। অর্জুন এগিয়ে গেলেন উলূপীর দিকে এবং একটু চিন্তিতভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন– হ্যাঁগো! কৌরব্যকুলনন্দিনি! হঠাৎ করে তুমি মণিপুরেশ্বর বভ্রুবাহনের রাজ্যে এলে কেন কিমাগমনকৃত্যং তে কৌরব্যকুলনন্দিনি! আর এলেই যদি তা হলে এই যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাকে দেখছি কেন?
অর্জুনের অন্যতর প্রশ্নগুলিতে যাবার আগে আবারও একবার মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশকে স্মরণ করে নিই। এই যে অর্জুন একটা সম্বোধন করলেন, ‘কৌরব্যকুলনন্দিনি’– এই একটা সম্বোধন থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নিজের পিতাকেও সেকালে কুলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হত, অর্থাৎ পিতার নামটিকে সোজাসুজি ব্যবহার না করে সেই নামের ওপরে এক কুলের বৃহত্ব স্থাপন করা। এই কারণেই হয়তো উলূপী ঐরাবত নাগের পৌত্রী হওয়া সত্ত্বেও সেই নামটিকে বৃহত্তর মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন– আমি ঐরাবত-কুলের জাতিকা, আমার পিতার নাম কৌরব্য। আর এখানে সেই পিতার নামটাকেও কুলনাম হিসেবে ব্যবহার করে অর্জুন উলূপীকে সম্বোধন করেছেন–’কৌরব্যকুলনন্দিনি। সিদ্ধান্তবাগীশ মহা ফাঁপরে পড়েছেন। যেহেতু একটি নামকে কুলনাম হিসেবে ব্যবহার করলে উলূপী ঐরাবতবংশীয়া হয়ে ওঠেন এবং তাতে যেহেতু উলূপী তার প্রস্তাবিত অন্য কোনও দ্বিতীয়া নাগরমণী থেকে পৃথক থাকেন না, ইরাবানের জননীত্বও তাতে যেহেতু ব্যাহত, অতএব অর্জুনের সম্বোধনটিকে তিনি অপরিচিত অর্থে ব্যবহার করে অর্থ করেছেন– ‘কুরুকুলানন্দকারিণি নাগনন্দিনি’!’কৌরব্য বলতে যে প্রসিদ্ধ কুরুকুল বোঝায় না, তা আমরা বলছি না, এমনকী ‘নন্দিনী’ বলতেও ‘আনন্দিনী’ অর্থে হতে পারে, কিন্তু কৌরব্য বলতে এখানে যেহেতু সোজাসুজি উলূপীর পিতার নাম আসে এবং নন্দিনী বলতেও যেহেতু তার মেয়েকেই বোঝায়, সেখানে এমন বাঁকা অর্থ তখনই করতে হয়, যখন সেই বিধবা-বিবাহের সংস্কার ব্যক্তিমানুষকে পীড়ন করতে থাকে। অর্জুন এ-অর্থে তার সম্বোধন’ উচ্চারণ করেননি, সরলা নাগরমণীকে তাঁর পিতার পরিচয়েই তিনি সোজাসুজি বলেছেন– কৌরব্যনন্দিনী! হঠাৎ কৌরব্য-পিতার ভবন ছেড়ে মণিপুরে এসেছ কেন?
যুদ্ধক্ষেত্রে উলূপীকে দেখে তাঁর নানান সন্দেহ হচ্ছে। বিশেষত উলূপীর চোখেমুখে কোনও শোকের চিহ্ন নেই, যা চিত্রাঙ্গদার মুখে আছে, বভ্রুবাহনের মুখে আছে; তার ওপর বভ্রুবাহন আবার উলূপীকেই দেখিয়ে দিচ্ছেন উত্তর দেবার জন্য। অর্জুনের নানান সন্দেহ হচ্ছে। অর্জুন বললেন- তুমি হঠাৎ মণিপুর এসেছ তাই এই জিজ্ঞাসা। তুমি রাজা বভ্রুবাহনের মঙ্গলকামনা করো তো? সেই সঙ্গে তুমি আমারও মঙ্গল চাও তো? পুত্র বভ্রুবাহন অজ্ঞানবশত তোমার প্রতি কোনও অপ্রিয় আচরণ করেনি তো, অথবা আমিও এমন কিছু করিনি তো, যা তোমার ভাল লাগেনি অকার্ষম অহমজ্ঞানাদয়ং বা বভ্রুবাহনঃ? এমন তো হয়নি যে, চৈত্ৰবাহনী চিত্রাঙ্গদা তোমার সপত্নী বলেই তোমার প্রতি কোনও অন্যায় অপরাধ করেছে।
নাগনন্দিনী উলূপীকে সেই কবে ছেড়ে এসেছেন অর্জুন, তবু এখনও তার শরীরের আকুল ইশারা টের পান তিনি। এখনও অনেক সমর্যাদ প্রশ্নের মধ্যে অর্জুন তাঁকে সম্বোধন করেন, ‘চপলাপাঙ্গি’, ‘পৃথুলশ্রোণি’। প্রশ্নের মধ্যে এখনও কত মর্যাদা কোনও অপরাধ হয়নি তো। কিন্তু নাগনন্দিনী প্রথমত অর্জুনের প্রতি শারীরিক কামনায় প্ররোচিত হলেও, তিনি গভীরভাবে অর্জুনকে ভালবাসেন, অন্যদিকে অর্জুনের সঙ্গে যতই উলূপীর যোগাযোগ না থাকুক স্বামীকে তিনি সেই যে মন-প্রাণ-শরীর দিয়ে ভালবেসেছিলেন, সে ভালবাসা এক চিরকালীন শাশ্বত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। অর্জুনের এতগুলি প্রশ্ন একবারে শুনেও উলূপী কিন্তু ক্রুদ্ধ হলেন না। অর্জুনের দিকে তাকিয়ে, স্মিতহাস্যে তাকে প্রসন্ন করে বললেন– না গো না! তুমিও কোনও অপরাধ করোনি আমার কাছে, পুত্র বভ্রুবাহনও কোনও অন্যায় করেনি। আর চিত্রাঙ্গদার কথা বলছ, সে তো সর্বদা আমার সঙ্গে দাসীর মতো ব্যবহার করে, তার ওপরে আমি রাগ করব কী করে– ন জনিত্ৰী তথাস্যেয়ং মম বা প্ৰেষ্যবৎ স্থিতা।
উলূপী এবার সম্পূর্ণ ঘটনার আসল রহস্যটুকু ব্যক্ত করে বললেন– আমি যা করেছি, তার জন্য আমার ওপর রাগ কোরো না যেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমি যা করেছি, তোমার ভালর জন্যই করেছি– ত্বৎপ্রিয়ার্থং হি কৌরব্য কৃতমেতন্ময়া প্রভো। ঘটনা হল– পূর্বে কৃত তোমারই এক অন্যায় অপরাধের জন্য পুত্র ববাহনের হাতে তোমায় মরে প্রায়শ্চিত্ত করতে হল। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে তুমি পিতামহ ভীষ্মকে অন্যায় যুদ্ধে মেরেছিলে। তিনি যুদ্ধ করছিলেন না, সেই অবস্থায় শিখণ্ডীর সহযোগিতায় তুমি নিরস্ত্র অবস্থায় ভীষ্মকে মেরেছ। সেই পাপের যা ফল, তার শাস্তি ভোগ না করে তুমি যদি সময়কালে মৃত্যুবরণ করতে, তা হলে তোমায় নরকে যেতে হত। আর পুত্র বভ্রুবাহন তোমার যে অবস্থাটা করেছিল, সেটাই হল ওই পাপের শাস্তি– এষা তু বিহিতা শান্তিঃ পুত্ৰাদ যদ প্রাপ্তবানসি।
পুরো ঘটনা তবু রহস্যাবৃতই রয়ে গেল। এমনকী এ প্রশ্নও উঠতে পারে যে, ভীষ্মের প্রতি অর্জুন কী অন্যায় করেছেন, তার বিচারের ভার উলূপীর ওপর এসে বর্তাল কেন৷ উলূপী এবারে খুলে বললেন সমস্ত ঘটনা। বললেন– পূর্বে ভীষ্ম নিহত হলে বসুগণ গঙ্গাতীরে এসে গঙ্গায় স্নান করার পর তাকে বলেছিলেন– ভীষ্ম রণস্থলে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, সেই অবস্থায় অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মকে বধ করেছে। এই কাজের জন্য আমরা অর্জুনকে অভিশাপ দেব।
উলূপী গঙ্গাদ্বারের আবাসিক। তিনি বলেছেন বসুগণের সঙ্গে গঙ্গার এই যে কথা হল এবং গঙ্গা যে অভিশাপের সমর্থনে আছেন, এ-কথা শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম এবং আমি সমস্ত ঘটনা আমার পিতার কাছে জানালাম। আমার দুঃখ দেখে আমার পিতা কৌরব্য নাগ বসুগণের কাছে গিয়ে তোমার মঙ্গলের জন্য অনেক যাচনা করলেন। তখন বসুগণ আমার পিতাকে বলেছিলেন– অর্জুনের পুত্র মণিপুরাধিপতি কুমার ববাহন অর্জুনকে রণস্থলে ধরাশায়ী করবেন এবং তারপরেই অর্জুন আমাদের শাপ থেকে মুক্ত হবেন। পিতার কাছে। এই বিবরণ শুনে আমি অভিশাপ থেকে তোমাকে মুক্ত করতে এসেছি এই মণিপুরে– তত্বা ত্বং ময়া তস্মাচ্ছাপাদসি বিমোক্ষিতঃ।
এতক্ষণে বোঝা গেল– উলূপী কেন ছুটে এসেছিলেন এই মণিপুর রাজ্যে এবং কেনই বা বভ্রুবাহন পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চাইলেও তাকে জোর করে উলূপী যুদ্ধে প্ররোচিত করেছেন। পুত্রের হাতে যুদ্ধে পরাস্ত হবার মধ্যে যদি এতটুকু অবমাননার প্রশ্ন থাকে, সেখানে সান্ত্বনা দিয়ে উলূপী বলছেন– আমি এ-কথা বেশ জানি যে, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র আসলেও যুদ্ধে তিনি তোমাকে হারাতে পারবেন না, সেখানে যে তুমি পুত্রের হাতে পরাজিত হলে, এতে তোমার অপমানের কিছু নেই, কেননা পুত্র তো পিতার দ্বিতীয় আত্মা বলে শাস্ত্রে চিহ্নিত, তার হাতে পরাজিত হওয়ার মধ্যে কি কোনও দোষ আছে, তোমার কী মনে হয়– ন হি দোষো মম মতঃ কথং বা মন্যাসে বিভো?
প্রত্যুত্তরে অর্জুন উলূপীকে ‘দেবী’ সম্বোধন করে বলেছেন- যা কিছু তুমি করেছ সব আমার প্রীতির জন্য, সব কিছুই আমার ভীষণ ভাল লেগেছে– সর্বং মে সুপ্রিয়ং দেবি যদেতৎ কৃতবত্যসি। এর পরে উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার সামনে অর্জুন পুত্র বভ্রুবাহনকে বললেন– আগামী চৈত্র পূর্ণিমাতে যুধিষ্ঠির মহারাজের অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে তোমার দুই মা-কে নিয়ে, মন্ত্রী-অমাত্য সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত থাকতে হবে তোমাকে– তত্ৰাগচ্ছেঃ সহামাতো মাতৃভ্যাং সহিতো নৃপ। বভ্রুবাহন সবিনয়ে পিতা অর্জুনের নিমন্ত্রণ স্বীকার করলেন। কিন্তু তার আরও কিছু বলার আছে, যেটা অর্জুনের ইচ্ছা সাপেক্ষ। আসলে ববাহন তার দুই মায়ের মনের কষ্টটুকু বোঝেন। সেই কবে মণিপুরে এসেছিলেন অর্জুন, তিন বছর এখানে ছিলেন এবং তাঁর জন্মের পরেই চলে যান। আর উলূপী তো আরও দুর্ভাগা। অর্জুনের সঙ্গ তিনি নিজেই যাচনা করেছিলেন একটিমাত্র দিন-রাতের অবসরে, তার পরে আর তার দেখা পাননি উলূপী। বভ্রুবাহন এখন এতটাই বড় যে, দুই মায়ের এই স্বামী-বিরহের যন্ত্রণা তিনি বুঝতে পারেন, আর ঠিক সেই জন্যই পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি পিতা অর্জুনকে সানুরোধে বললেন আমার প্রতি অনুগ্রহ করে আপনার এই দুই ভার্যার সঙ্গে অন্তঃপুরীতে প্রবেশ করুন এবং এ বিষয়ে আপনি কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, তর্ক-বিতর্কের আশ্রয় নেবেন না– ভাৰ্য্যাভ্যাং সহ ধর্মজ্ঞ মা ভূত্তেহত্র বিচারণা। আপনি আপনার নিজের ঘরে সুখে একরাত্রি বাস করে, আবার এই যজ্ঞীয় অশ্বের অনুবর্তন করবেন আগামীকাল উষিত্বেহ নিশামেকাং সুখং স্বভবনে প্রভো।
পুত্র হলেও পিতার প্রতি ববাহনের বক্তব্যে তাঁর চির-বিরহিত জননী এবং বিমাতার জন্য কিছু সংকেত ছিল, যে সংকেত বুঝতে দেরি হয়নি বিদগ্ধ নায়ক অর্জুনের। তিনি সব বুঝেই বলেছেন– পুত্র! তোমার ভাবনা এবং আগ্রহটুকু আমি বুঝি। কিন্তু আমি এই যজ্ঞীয় অশ্বকে অনুসরণ করার জন্য দীক্ষিত হয়েছি। আমার পক্ষে কোনও নগরের গৃহকোণে থাকা সম্ভব হবে না। যেখানে এই অশ্ব যাবে সেখানে আমায় যেতে হবে, যেখানে থাকবে সেখানেই আমায় থাকতে হবে– যথাকামং ব্রজত্যেব যজ্ঞীয়াশ্বে নরর্ষভ– অতএব কোনও উপায় নেই যাতে আমি রাত্রিবাস করতে পারি তোমার নগর-গৃহে।
অর্জুন চলে গেছেন অশ্ব নিয়ে। উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার জন্য রইল আগামী চৈত্রী পূর্ণিমার অপেক্ষা। বেশি তো দেরি করতে হয়নি। পরের চৈত্রী পূর্ণিমাতে যাবার কথা, হয়তো আগের ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে দুই বহিশ্চরা স্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে গেছেন অর্জুন। বড় বড় যজ্ঞ সেকালে বসন্তকালেই আরম্ভ হত, কিন্তু সেই বসন্তের সঙ্গে অর্জুনের দুই বহিশ্চরা বাসন্তিকা এমন মিলে যাবে, সে-কথা ভাবা যায়নি আগে। আসলে দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা, বিশেষত সুভদ্রা অর্জুনের জীবনে এমনভাবেই সামাজিকীকৃত হয়েছিলেন যাতে উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদাকে সারাজীন বহিশ্চরা অবস্থাতেই থাকতে হয়েছে। এবারে এই অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে মহাভারতের কবি তাঁদের নিয়ে এসেছেন হস্তিনার অন্তঃপুরে, কেননা মহাভারতের কেন্দ্রীয় নায়কের সঙ্গে যাঁদের বিধিসম্মত বিবাহ হয়েছিল, তাদের বাইরে ফেলে রাখা যায় না। অশ্বমেধ যজ্ঞের মাহাত্মে আজ এই দুই বহিশ্চরা রমণীর সামাজিক সিদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন মহাভারতের কবি।
পৃথক একটা অধ্যায়ের আরম্ভটুকুই ব্যয়িত হয়েছে অর্জুনের এই দুই ভার্যার আগমন বর্ণনায় এবং তাঁদের হস্তিনাপুরের অন্তঃপুরে প্রবেশ করাচ্ছেন পুত্র বভ্রুবাহন। বভ্রুবাহন তার জননী চিত্রাঙ্গদা এবং বিমাতা উলূপীকে নিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগ দিতে এলেন– মাতৃভ্যাং সহিতো ধীমান কুরূনভ্যজগাম হ। সেখানে এসে সভাগৃহের মান্যজনদের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন করেই বভ্রুবাহন তাঁর দুই মাকে নিয়ে প্রবেশ করলেন পিতামহী কুন্তীর ঘরে। বেঁচে থাকা নাতিদের মধ্যে তিনিই তো বোধ হয় একমাত্র। নাতি-পিতামহীতে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা হল এবং এবার এই পুত্রের অন্তরাল সরিয়ে দুই রমণী একসঙ্গে এলেন শাশুড়ি কুন্তীর কাছে এবং জ্যেষ্ঠা সপত্নী কৃষ্ণা দ্রৌপদীর কাছে পৃথাং কৃষ্ণাঞ্চ সহিতে বিনয়েনোপজগ্মতুঃ।
বেশ বোঝা যায়, সেকালে জ্যেষ্ঠা সপত্নীর সম্মান ছিল প্রায় শাশুড়ির মতোই। বিশেষত কৃষ্ণা দ্রৌপদী, তার ব্যক্তিত্ব, তার বিদগ্ধতা এবং তাঁর নিজস্বতা তাকে এমন একটা মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল যে, তাকে অতিক্রম করা অর্জুনের সাধ্য ছিল না। যে-কালে অর্জুন কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে বিয়ে করে হস্তিনায় নিয়ে এসেছিলেন, সেইকালেই তাঁকে দ্রৌপদীর অভিমান-উচ্চারণ শুনতে হয়েছিল এবং সেটা এই কারণে নয় যে, অর্জুন আরও একটা বিবাহ করেছেন, তাই। সেটা শুনতে হয়েছিল এই কারণে যে, দ্রৌপদী নিজেকে অতিক্রান্ত বোধ করেছিলেন। কিন্তু সুভদ্রা যে মুহূর্তে দীনবেশে দ্রৌপদীর সামনে এসে নিজেকে দাসী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই সুভদ্রা তাঁর সমস্ত স্নেহটুকু জয় করে নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, মহাকাব্যের যুগে পট্টমহিষীর মর্যাদা ছিল রাজবাড়ির সঙ্গে অনেকটা সংপৃক্ত, তারপরেই প্রশ্ন আসত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বহুঁকালিক সম্পর্কের। ঠিক এই কারণে পট্টমহিষী হবার জন্য দ্রৌপদীর মর্যাদা ছিল রীতিমতো রাজকীয়, অন্যদিকে সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক যেহেতু বহুঁকালিক এবং ঐকান্তিক, তাই তিনি উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার সর্বকনিষ্ঠা সপত্নী হলেও, সুভদ্রার মর্যাদা তাদের চেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছিল। এই জন্যই শাশুড়ির সঙ্গে এবং মর্যাদার অনুক্রমে দ্রৌপদীর সঙ্গে সবিনয়-সাক্ষাতের পরে সুভদ্রার সঙ্গেও দেখা করেছেন উনূপী এবং চিত্রাঙ্গদা– সুভদ্রাঞ্চ যথান্যায়ং যাশ্চান্যাঃ কুরুযযাষিত।
বলতে গেলে এই প্রথম অর্জুনের বিধিসম্মত স্ত্রী-পরিচয়ে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করছেন উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদা। তাদের প্রতি কুন্তী, দ্রৌপদী এবং সুভদ্রার সম্মান-সঙ্কারটুকুও রীতিমতো মহাকাব্যিক উদারতায় চিহ্নিত। তারা অর্জুনের এই বহিশ্চরা দুই স্ত্রীকে বহুতর ধন-রত্ন-বসন উপহার দিয়ে প্রায় নতুন বউয়ের মতো বরণ করে নিয়েছেন হস্তিনার রাজবাড়িতে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এখানে কোনও ঈর্ষার ব্যাপারও ছিল না। দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা অর্জুনের এই দুই স্ত্রীর পরিচয় জানতেন না, বা কোনওদিন তাদের কথা শোনেননি এমন মোটেই নয়, কিন্তু যেহেতু তারা অর্জুনের অন্দরমহলে আসেননি, অতএব এই নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হল সেই মহাকাব্যিক উদারতা।
এটা সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার, অথবা বলা উচিত– খেয়াল করার মতো ব্যাপার যে, দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা– যাঁদের মধ্যে প্রথম জন অর্জুনের মতো স্বামীর অগ্রভাগটুকু পেয়েছিলেন এবং দ্বিতীয়জন অর্জুনের সমস্ত ঐকান্তিকতা লাভ করেছিলেন– এঁরা কেউই উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার ওপরে এতটুকু ঈর্ষা-অসূয়াগ্রস্ত ছিলেন না। বস্তুত যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষের এই আকস্মিক বিচলন নিয়ে মবাকাব্যিক রমণীরা প্রকটভাবে আহত হননি কখনও। হয়তো প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পৌরুষের শক্তির প্রাধান্যেই পুরুষের এই বিচলন মেনে নিয়েছেন বিবাহিত রমণীরাও। কিন্তু পৌরুষেয়তাই বোধ হয় সর্বাংশে সত্যি নয়। কেননা উলূপীর মতো এক নাগ-রমণীও তো আপন স্বাধীনতায় বিচরণ করতে পেরেছেন। তিনি যেমন নিজের কারণে অর্জুনের প্রতিজ্ঞাত ব্রহ্মচর্যের স্বলন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিয়েও করেছিলেন অর্জুনকে, তেমনই অর্জুনও নিজের স্বাধীনতায় যদি অন্য কোথাও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে আত্মলাভ করে থাকেন তাতেও আবার দ্রৌপদী-সুভদ্রা কিছু মনে করেন না। তবে এটাকে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কে– ‘তুমি যখন এটা করতে পারো, আমিও তেমনি ওটা করতে পারি’– এইরকম একটা দ্বন্দ্বের বিষয় না ভেবে মহাকাব্যের রমণীদের স্বাভাবিক উদারতা ভেবে নেওয়াটাই ভাল বলে মনে হয়।
এতকাল পরে যে দুই প্রবাসী রমণী তাদের প্রৌঢ় বয়সে কুরুগৃহে প্রবেশ করলেন বধূর মতো, তাঁদের সানন্দ মনে বরণ করে নিলেন জননী কুন্তী, দ্রৌপদী এবং সুভদ্রাও। প্রচুর ধন-রত্ন দিয়ে তাদের প্রবেশ করানো হল কুরুবাড়ির অন্দরমহলে। তাদের জন্য মহার্ঘ শয়ন এবং আসনযুক্ত পৃথক মহলও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল বোধ হয়। তারা সেখানে থাকতে আরম্ভ করলেন– উষতুস্তত্র তে দেবৌ মহাশয়নাসনে। স্বয়ং কুন্তী তাদের এই বাসস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা দিয়েছেন শুধু অর্জুনের ভাল লাগবে বলে। এতকাল অর্জুন তার এই বিবাহিতা দুই পত্নীকে শ্বশুরবাড়ির ঘর দিতে পারেননি, আজকে কুন্তী সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন নিজে– সুপূজিতে স্বয়ং কুন্ত্যা পার্থস্য হিতকাময়া। কুন্তী এটা বুঝেছেন যে, এই সুদূরপ্রোষিত রমণীদের ওপর কিছু অবিচার ঘটেছে; এঁরা নিজেরাও অবশ্য সাগ্রহে সে বিচার চানওনি, কেননা শ্বশুরবাড়িতে থাকার অধিকার নিয়ে এই স্বাধীনা ব্যক্তিত্বময়ী রমণীদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু স্বয়ং কুন্তী তার পুত্রের বিবাহিতা পত্নীদের প্রতি অবিচার হয়েছে এবং তা অর্জুনের দিক থেকেই হয়েছে মনে করে অর্জুনের অপরাধ প্রশমিত করার জন্যই তাদের যথোচিত ব্যবস্থা করেছেন। হয়তো সেইজন্যই মহাভারতের কবির এই অপরাধবোধী শব্দ উচ্চারণ– পার্থস্য হিতকাম্যয়া।
অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ হয়ে গেছে। সমাগত রাজা-রাজড়ারা সকলে আপন আপন রাজ্যে ফিরে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে ফিরে গেছেন মণিপুরের রাজা ববাহন। অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহন তার জননী এবং বিমাতা উলূপীকে তাদের আযৌবন-হৃদয়-লালিত স্বামীর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে নিজে ফিরে গেছেন রাজ্যে কিন্তু মায়েদের আর সঙ্গে নিয়ে যাননি। তারা যে স্বেচ্ছায় অর্জুনের ঘরে রয়ে গিয়েছিলেন, আর ফিরে যাননি আপন স্বাধীনতার মধ্যে, তার প্রমাণ রয়ে গেছে মহাভারতের কবির বয়ানে। দেখতে পাচ্ছি– পুত্রশোকাহতা বৃদ্ধা গান্ধারীর সবরকম পরিচর্যার জন্য কুন্তী, দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা যে যত্ন নিচ্ছেন, সেই যত্নের সমান দায় বহন করছেন অর্জুনের আর দুই স্ত্রীও, উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদা উলূপী নাগকন্যা চ দেবী চিত্রাঙ্গদা তথা।
একটা সময় তো এসেছে যখন ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী সংসারের সমস্ত সম্পর্ক মুক্ত হয়ে বনে চলে গেছেন এবং তাঁদের সঙ্গে গেছেন কুন্তী, পঞ্চপাণ্ডবের জননী। হস্তিনার রাজধানীতে যারা রয়ে গেলেন, তাঁরা কিন্তু এই বানপ্রস্থ-ব্রতী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভুলতে পারেননি। একসময় কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেবের অনুরোধে দ্রৌপদীর মতো ব্যক্তিত্বময়ী রমণীও যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রার্থনা করেছেন যাতে সকলে মিলে একবার দূরপ্রস্থিনী কুন্তীর সঙ্গে দেখা করে আসা যায়, অনুষঙ্গে দেখা করা যায় গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গেও। যুধিষ্ঠির সকলের সঙ্গে পাণ্ডব-ঘরের সমস্ত বউদেরও নিয়ে গেছেন কুন্তীর নির্জন অরণ্যবাসে।
এইখানেই আরও এক গভীরতর পরিচয়ে দেখতে পেলাম উলূপী আর চিত্রাঙ্গদাকে। দ্রৌপদী, সুভদ্রা এবং পাণ্ডবগৃহের অন্যান্য বউদের সঙ্গে উলূপী আর চিত্রাঙ্গদাও এসেছেন কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে। তারা সকলে এসে দেখলেন– কুন্তী, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী অরণ্যবাসী তপস্বীদের সঙ্গে সহাবস্থান করছেন। তপস্বীরা পাণ্ডব-ভাইদের নাম শুনেছেন, তাদের স্ত্রীদের নামও শুনেছেন, কিন্তু চাক্ষুষ কাউকে চেনেন না। তারা সকলের পরিচয় জানতে চাইলে সর্বাভিজ্ঞ সঞ্জয় একে একে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পাণ্ডব ভাইদের পরে যখন তাদের স্ত্রীদের পালা এল, তখন দ্রৌপদীর পরিচয় দিতে গিয়ে চিরযৌবনবতী কৃষ্ণা দ্রৌপদীর সম্বন্ধেও সঞ্জয়কে একবার বলতে হচ্ছে– মাঝবয়স যাঁকে প্রায় ছুঁয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু উলূপীর কথা বলার সময় তারও তখন নিশ্চয়ই মাঝবয়স ছুঁই ছুঁই– কিন্তু তবু তার সম্বন্ধে বলতে হচ্ছে– জাম্বুনদের কাঁচা সোনার মতো যাঁর গায়ের রং, চিত্রাঙ্গদা সম্বন্ধে শিশিরসিক্ত ভেজা মহুয়াফুলের মতো রং যাঁর– এ-সব কথা থেকে বোঝা যায়– পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের জীবনধারণের একান্ত কৃচ্ছুতাগুলি কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে এতদিনে যত ক্লান্ত ক্লিষ্ট মাঝবয়সি করে তুলেছে, এঁদের তা করেনি। হয়তো চেহারার দিক দিয়ে উলূপী চিত্রাঙ্গদা তখনও দ্রৌপদীর চেয়ে সুন্দরী। কিন্তু সৌন্দর্য্যের থেকেও বড় কথা, তপস্বীদের সঙ্গে এই পরিচয়ে উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার মতো প্রায় অর্ধেক-চেনা অর্জুনের এই দুই স্ত্রীর ‘আইডেনটিটি’-র প্রতিষ্ঠা হয়েছে পূর্ণ মর্যাদায়। চিত্রাঙ্গদার তত প্রয়োজন না হলেও উলূপীর বোধ হয় এই পরিচয়-মাহাত্ম্য প্রকৃত পরিচয়ই ছিল– ইয়ঞ্চ জান্ধুনদশুদ্ধগৌরী পার্থস্য ভার্যা ভুজগেন্দ্রকন্যা।
জাম্বুনদের সোনার তুলনাটা প্রায়ই আত্মেন্দ্রিয়প্রীতিবাঞ্ছাহীন প্রেমের তুলনায় ব্যবহৃত হয়। উলূপীর গাত্রবর্ণের কথা বলতে গিয়ে এই শব্দ স্মরণ, এটা তার প্রেমেরও উপলক্ষণ বটে। হ্যাঁ, এটা মানি যে, প্রথমদিন অর্জুনকে আত্মগত করার জন্য তিনি নিতান্তই আপন শারীরিক আকাঙ্ক্ষার কথা স্বকণ্ঠে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর? তার পর একদিনের জন্যও কি অর্জুনের শরীরসঙ্গ পেয়েছিলেন তিনি? অথচ অর্জুনকে তিনি ভোলেননি কোনওদিন। কোলে যে ছেলেটি পেয়েছিলেন তাকেও পাঠিয়েছিলেন অর্জুনের কাছে; অর্জুন তাঁকে যুদ্ধের কাজে লাগিয়েছিলেন এবং সে মারা যায়। পুত্রের এই আকস্মিক মৃত্যুতেও তাকে শোকগ্রস্ত দেখিনি এবং তার দিক থেকে কোনও দোষারোপও নেমে আসেনি অর্জুনের ওপর। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, যখন চিত্রাঙ্গদার গৃহে তাঁকে ছুটে আসতে দেখি। ভীষ্মের মৃত্যুর কারণে অর্জুনের ওপরে বসুগণের অভিশাপ এবং তাতে অর্জুনের নরকদর্শনের সম্ভাব্যতা তর্কযুক্তির বিষয় হতে পারে, কিন্তু অর্জুনের জন্য উলূপীর দুর্ভাবনার অংশটুকুই এখানে জরুরি, কেননা এই ভাবনা এবং দুর্ভাবনার মধ্যেই অর্জুনের জন্য উনূপীর ভাবটুকু লুকোনো আছে।
সারাজীবন অর্জুনের জন্য এবং অর্জুনের জন্যই শুধু ভেবে গেছেন উলূপী। বস্তুত ক্ষত্রিয়ের ঘরে অর্জুনের ঔরসে যে পুত্র জন্মেছিল, সে ইরাবানই হোক অথবা বভ্রুবাহন– সে যদি যুদ্ধের ভয়ে অথবা পিতার সম্মান রাখার জন্য যুদ্ধ এড়িয়ে কৃতাঞ্জলি হত, এবং তা যদি অর্জুনকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হত, তা হলে সেটাই হত অর্জুনের মতো মহাবীরের পক্ষে নরক-দর্শন। উলূপী অর্জুনকে এই নরকদর্শন থেকে বাঁচিয়েছেন তার আন্তরিক বোধ সমতায়। হতে পারে, হ্যাঁ, উলূপী যেভাবে প্রথমে অর্জুনকে চেয়েছিলেন, তাতে এমন মতেই হতে পারে যে, সে যেন এক তামসী আকাঙ্ক্ষা। আর সে আকাঙ্ক্ষাও তো খুব অস্বাভাবিক নয়, কেননা সেই সদ্য যুবতীর স্বামী মারা গিয়েছিল জীবনের সমস্ত স্বাভাবিক বৃত্তিগুলি ধ্বংস করে দিয়ে। সেই তিনি যদি একবার অর্জুনের মতো পুরুষকে দেখে কামবিদগ্ধ হয়ে তার প্রাথমিক বৃত্তিতে অর্জুনের আসঙ্গলিপ্সায় মত্ত হয়ে ওঠেন, তবে তার মধ্যে রাজসী ভালবাসার লক্ষণ যদি থেকেও থাকে, সে ভালবাসাও একদিন সাত্ত্বিকতায় উত্তীর্ণ হয়েছিল অর্জুনের অপেক্ষায়, হিতকামনায় এবং অন্তরসাম্যের ভাবনায়। ঠিক এই কারণেই তার প্রৌঢ় বয়সে এমন মর্ত্য থেকে স্বর্গে পরিণতি, ফুল থেকে ফলে পরিণতি। উলূপীর অবস্থিতি তখন হস্তিনার অন্তঃপুরে, তার পরিচয় তখন পার্থস্য ভাৰ্য্যা ভুজগেন্দ্রকন্যা।
খেয়াল করে দেখবেন; কাব্যে, নাটকে এবং মহাকাব্যে সর্বত্রই পার্শ্বচরিত্র থাকে। অনেক সময়েই পার্শ্বচরিত্রের আরম্ভ এবং তার কিছু কাব্য-নাট্যোচিত সহায়তাও দেখতে পাই, কিন্তু সেই চরিত্রের শেষ দেখা যায় না, তাদের পরিণতি দেখতে পাই না। যদি মহাকবিদের ঈঙ্গিত অনুসন্ধান করলে বোঝা যায়– যে-সব চরিত্রের আরম্ভ আছে পরিণতি নেই, তারা মূল চরিত্রগুলির সহায়ক-মাত্র, আপন সত্তায় তারা সম্পূর্ণও নন, মূল চরিত্রগুলির জীবন কাহিনিতেও তারা অংশীদার নন। আমরা কিন্তু চিত্রাঙ্গদা বা উলূপীকে এই ছাঁচে ফেলতে পারি না। হয়তো অৰ্জুনের বিশাল-বিচিত্র জীবনের মধ্যে উলূপী বা চিত্রাঙ্গদার অংশ দ্রৌপদী বা সুভদ্রার তুলনায় অকিঞ্চিৎকর, এমনকী উলূপীর জীবনও খানিকটা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে জুড়ে গেছে, কিন্তু তবুও সেই উলূপীরও কিন্তু একটা আরম্ভ, সত্তা এবং পরিণতি আছে। তিনিই অর্জুনের স্বারোপিত ব্রহ্মচর্যের বাঁধন আলগা করে দিয়ে চিত্রাঙ্গদা এবং সুভদ্রার প্রেমের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রৌঢ় বয়সে হলেও তিনি পতিগৃহে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। অবশেষে তার জীবনের শেষ পরিণতি দেখিয়ে দিয়ে উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের স্বামী-স্ত্রী, চিরন্তন সম্পৰ্কটুকু প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন ব্যাস।
মহাকাব্যের শেষ অঙ্কে মহাপ্রস্থানের পথ। স্বভাবতই পট্টমহিষী দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যাত্রা করেছেন দুর্গম যাত্রায়। কুরুবাড়ির অন্যান্য স্ত্রীরা পাণ্ডবদের বিদায় জানিয়ে হস্তিনাতেই রয়ে গেলেন কুমার পরীক্ষিতের কাছে। অর্জুনের স্ত্রীদের মধ্যে সুভদ্রা যেহেতু পরীক্ষিতের পিতামহী এবং তাকে যেহেতু কুমার পরীক্ষিতের অভিভাবিকা হিসেবে হস্তিনায় রেখে গিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, তাই তার অন্য কোথায় যাবার প্রশ্ন উঠল না। কিন্তু অর্জুনের প্রস্থানে চিত্রাঙ্গদার আর মন টিকল না হস্তিনায়। তিনি চলে গেলেন পুত্র বভ্রুবাহনের কাছে মণিপুরে। উলূপী কিন্তু হস্তিনাতেও থাকলেন না, পিত্রালয়েও ফিরে গেলেন না, তিনি ঝাঁপ দিলেন গঙ্গায়– বিবেশ গঙ্গাং কৌরব্য উলূপী ভুজগাত্মজা।
উলূপীর গঙ্গাপ্রবেশের ঘটনা আসলে আত্মবিসর্জন, নাকি গঙ্গা শব্দের লক্ষণায় এটা সেই গঙ্গাদ্বারে অবস্থিত তার পিত্রালয়ে গমন, সে-বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতদ্বৈধ থাকতে পারে, কিন্তু মহাকবির শব্দচয়নে চিত্রাঙ্গদার মণিপুর গমনে যেহেতু কোনও অস্পষ্টতা নেই, সেখানে উনূপী পিত্রালয়ে প্রস্থান করে থাকলে সেটাও স্পষ্টই বোঝা যেত তাঁর শব্দ প্রয়োগের বিশেষত্ব থেকে। বস্তুত উলূপীর গঙ্গাপ্রবেশের ঘটনাকে আমরা আত্মবিসর্জন বা আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে করি। চিত্রাঙ্গদার তবু একটি পুত্র ছিল– তার মানসিক আশ্রয়। উলূপী শুধু অর্জুনকেই চেয়েছিলেন প্রথমে শরীর দিয়ে, পরে মন দিয়ে। অর্জুনের মহাপ্রস্থানের অর্থ উপী বোঝেন, তিনি জানেন যে, মহাপ্রস্থান মানেই মনুষ্যজীবনের অন্তিম পথ। অতএব অর্জুন যে পৃথিবীতে থাকবেন না, উলূপীও সেই পৃথিবী পরিত্যাগ করে প্রবেশ করেছেন গঙ্গায়– যে গঙ্গায় তিনি প্রথম দেখেছিলেন স্নানরত অর্জুনকে, যে গঙ্গা তার প্রিয় মিলনের প্রথম কুঞ্জকুটীর। অর্জুন চলে যেতেই জীবনের সমস্ত সরসতা নীরস ভেবেই উলূপী প্রবেশ করেছেন গঙ্গায়– বিবেশ গঙ্গাং কৌরব্য উলূপী ভুজগাত্মজা। মহাভারতের কবি গঙ্গার মধ্যে যাঁর শারীরবাসর রচনা করেছিলেন, তার অন্তিম পরিণতি রচনা করলেন গঙ্গার গভীরেই, তবে সেটা আত্মবিসর্জনের মাহাত্ম্য, প্রিয়তমের বিরহে, আত্মপীড়নের ঐশ্বর্যে। ঠিক এই উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রইলেন না, মরে গিয়ে তিনি বেঁচে রইলেন রমণীয় স্বতন্ত্রতায়।