উজ্জ্বলতম আলো : বৈষ্ণব পদাবলি
মঙ্গলকাব্য থেকে বৈষ্ণব পদাবলিতে আসা হলো একটি গুমোট স্বল্পালোকিত দালানের ভেতর থেকে উজ্জ্বল সবুজ দক্ষিণের বাতাসে মাতাল বনভূমিতে আসা। মঙ্গলকাব্য পড়তে পড়তে ক্লান্তি আসে; কেননা এগুলোর আকার বিরাট, আর এতো অকাব্যিক বিষয় এগুলোতে ইনিয়েবিনিয়ে বলা হয় যে বেশিক্ষণ পড়া যায় না। অন্যদিকে বৈষ্ণব পদাবলি হচ্ছে কেবল কবিতার রাজ্য, সেখানে বাজে বিষয়ের বাড়াবাড়ি নেই, ভালো কবিতার যা ধন কবিরা এ-কবিতাগুলোতে সে-সব চয়ন করেছেন থরেবিথরে। আর এতো আবেগও যে আছে মানুষের, তা এ-কবিতাগুলো না পড়লে সত্যি বোঝা অসম্ভব। বৈষ্ণব কবিতার জন্যেই অনেক কিছুর নাম শুনলেই আমরা আবেগে কাতর হয়ে পড়ি। কোনো বাঙালি যদি শশানে যমুনা নদীর নাম, বা তমাল তরুর কথা, তাহলে তার পক্ষে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আনমনা না হয়ে উপায় থাকে না। এ-বিষয়গুলো বৈষ্ণব কবিরা এতো মধুর-নিবিড় আবেগে বর্ণনা করেছেন যে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে সেগুলো স্থান করে নিয়েছে। আমরা অনেকেই তমাল তরু দেখি নি, দেখি নি যমুনা নদী, তবু কেননা এরা আমাদের স্বপ্নে ভরে তোলে? এর মূলে আছে বৈষ্ণব কবিতা, যার প্রধান পাত্রপাত্রী রাধা আর কৃষ্ণ। রাধা এবং কৃষ্ণকে নিয়ে মধ্যযুগে সবচেয়ে সৌরভময় ফুল ফুটেছিলো, সে-ফুলের নাম বৈষ্ণব কবিতা। বৈষ্ণব কবিতা বাঙলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। একে যদি আলোর সাথে তুলনা করি তাহলে বলবো মধ্যযুগে এমন আলো আর জ্বলে নি।
চতুর্দশ শতকের শেষ দিক থেকে বৈষ্ণব কবিতা রচিত হতে থাকে। এর প্রধান পাত্রপাত্রী রাধা ও কৃষ্ণ। এ-সময়ে বিশেষ কোনো ধর্মীয় আবেগে রচিত হয় নি বৈষ্ণব পদাবলি। ১৪৮৬ অব্দে জন্ম নেন চৈতন্যদেব [১৪৮৬-১৫৩৩]। তিনি প্রচার করেন বৈষ্ণব ধর্ম এবং তার পর থেকে এ-কবিতার মধ্যে বৈষ্ণব দর্শন স্থান পেতে থাকে। অসংখ্য কবি রচনা করেছেন বৈষ্ণব কবিতা, সকলের নামও আমরা জানি না। কেবল বৈষ্ণব কবিরাই একবিতা রচনা করেন নি, অনেক মুসলমান কবিও রয়েছেন, যারা পরম আবেগে চমৎকার বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন। অনেক কবি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ভক্ত কবি। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন [১৮৬৬-১৯৩৯] ১৬৫ জন বৈষ্ণব কবির নাম জানিয়েছেন আমাদের। এ ছাড়াও ছিলেন আরো অনেক কবি, যাঁদের নাম কালস্রোতে হারিয়ে গেছে। কোনো কোনো বৈষ্ণব কবি আবার বেশ মজার কাজ করেছেন। তাঁরা খ্যাতি কামনা করেন নি, তাঁরা চেয়েছেন নিজেদের রচিত কবিতাকে শুধু আমোদের উদ্দেশে ভাসিয়ে দিতে। তাই তাঁরা কবিতায় নিজেদের নাম ব্যবহার না করে ব্যবহার করেছেন কখনো ছদ্মনাম, কখনো ব্যবহার করেছেন পূর্ববর্তী কোন মহৎ কবির নাম। তাই তাঁদের আর পৃথক করে আজ চেনা যায় না। কয়েকজন কবি আছেন অতি বিখ্যাত কবি, বৈষ্ণব কবিতার কথা উঠলেই তাঁদের নাম মনে আসে। তারা হচ্ছেন বিদ্যাপতি ]জন্ম ১৩৭৪], চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস [জন্ম ১৫২০–১৫৩৫], গোবিন্দদাস [১৫৩৪–১৬১৩]। বৈষ্ণব কবিতার তাঁরা চার মহাকবি। আরও যে অনেক কবি আছেন, তাদের কিছু নাম : অনন্তদাস, উদ্ধবদাস, নরোত্তম দাস, নাসির মামুদ, বলরাম দাস, বৈষ্ণব দাস, লোচন দাস, শ্যাম দাস, সেখ জালাল, শেখর রায়, তুলসী দাস। বৈষ্ণব কবিতা ছোটোছোটো। কবিরা রাধা ও কৃষ্ণের মনের কথা একবিতাগুলোতে বলেছেন। মনের কথা মানেই হলো আবেগ, সুখের আবেগ, বেদনার আবেগ। আসলে এ-কবিতাগুলোতে রাধাকৃষ্ণের নামে কবিদের মনের আবেগ লক্ষধারায় প্রবাহিত হয়েছে। আর কে না জানে যে ভালো কবিতার বিষয় হলো মনের কথা? মধ্যযুগে এ-রকম আর দেখা যায় নি। মঙ্গলকাব্য পড়লে বুঝতে কষ্ট হয় যে মানুষের মন বলে একটি বস্তু আছে এবং সে-মন সুখে উল্লসিত হয়, বেদনায় হয় কাতর। বৈষ্ণব কবিতায় এসে দেখা যায় মনের রাজত্ব, যেননা মন আর তার আকুলতা ছাড়া বিশ্বের সব কিছু মিথ্যে। বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের কবিতায় ঘর সংসার সমাজ বিশ্ব সকল কিছুকে মিথ্যে বলে ঘোষণা করেছেন; একমাত্র সত্যি বলে দেখিয়েছেন হৃদয়কে। তাই বৈষ্ণব কবিতায় সর্বত্র দেখা যায় হৃদয়ের জয়। হৃদয়ই বৈষ্ণব পদাবলির বিশ্ব।
বৈষ্ণব কবিতার বিষয় রাধা ও কৃষ্ণের ভালোবাসা। এরা একজন চায় অপরজনকে, কিন্তু এদের মধ্যে বিপুল বাধা। এ-বাধাকে সরাতে চেয়েছেন কবিরা। এ-প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখা দরকার, তা হচ্ছে মধ্যযুগের সব কবিতাই ধর্মের বাহন। বৈষ্ণব কবিতাও তাই। বৈষ্ণবরা মনে করে এই যে সৃষ্টি তার একজন স্রষ্টা আছে। এ-স্রষ্টা কিন্তু নির্দয় নয়, সে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসে। সৃষ্টিও তার স্রষ্টাকে ভালোবাসে। তাই সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়ে চায় মিলিত হতে, কিন্তু পারে না। যে-তত্ত্বের কথা বললাম, বৈষ্ণব কবিরা রাধা ও কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে সে-কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। রাধা হচ্ছে সৃষ্টি বা বৈষ্ণবদের ভাষায় জীবাত্মা, এবং কৃষ্ণ হচ্ছে স্রষ্টা বা বৈষ্ণবদের ভাষায় ‘পরমাত্মা’। এ-জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনবিরহের কথা বলতে চেয়েছেন বৈষ্ণব কবিরা। কিন্তু আমাদের ধর্মের বা তত্ত্বের দিকে বিশেষ আকর্ষণ নেই, আমরা প্রাণভরে চাই শুধু অসাধারণ এ-কবিতাগুলোকে। বৈষ্ণব কবিতা গীতিকবিতা। যেনো প্রাণের ভেতর থেকে আকুল হয়ে বেরিয়ে এসেছে সুরের মালা। বৈষ্ণব কবিতার কোনোটির বিষয় কৃষ্ণের রূপ, কোনোটির বিষয় রাধার রূপ, কোনোটির বিষয় দুজনের মিলন। এ-রকম অনেক বিষয়কে তাদের কবিতার মধ্যে ধরে রেখেছেন কবিরা। বিষয় অনুসারে এ-কবিতাগুলোকে নানা ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলোর কোনোটির নাম অনুরাগ, কোনোটির নাম বংশী, কোনোটির নাম আক্ষেপ, আবার কোনোটির নাম বিরহ ইত্যাদি। এর ফলে সমস্ত বৈষ্ণব কবিতা মিলে গড়ে উঠেছে এক চমৎকার গীতিনাট্য। অন্য এক রকমেও এ-কবিতাগুলোকে ভাগ করা যায়। সেটি হলো রসের ভাগ। মানুষের মনের যে-আবেগঅনুভূতি নিয়ে রচিত হয় সাহিত্য, তাকে প্রাচীনকালের সাহিত্যতাত্ত্বিকেরা কতকগুলো ‘রস’-এ ভাগ করেছেন। যেমন করুণরস, বীররস ইত্যাদি। বৈষ্ণবদের মতে রস পাঁচ প্রকার। তারা পাঁচ রকমের রস পরিবেশন করেছেন কবিতায়। রসগুলো হচ্ছে শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য, মধুর।
বৈষ্ণব কবিরা যেমন সংখ্যাহীন, তেমনি অসংখ্য তাঁদের রচিত কবিতা। কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয় ঠিক কতোগুলো বৈষ্ণব কবিতা আছে বাঙলা ভাষায়। মধ্যযুগে কবিতা রচিত হতো মুখেমুখে, গাওয়া হতো গানের আসরে। সাধারণত ওগুলো লিখে রাখা হতো না; মানুষ ওগুলোকে গেঁথে রাখতে নিজেদের স্মৃতিতে। কিন্তু স্মরণশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং যিনি মুখস্থ করে রেখেছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে ওগুলো হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এভাবে অনেক পদ হারিয়ে গেছে, আমাদের কাছে এসে পৌছোতে পারে নি। তাই মধ্যযুগেই শুরু হয়েছিলো এ-গানগুলোকে সংকলিত করার চেষ্টা। এর ফলে বেঁচে আছে গানগুলো। বৈষ্ণব কবিতা যিনি সবার আগে সংকলন করেন, তার নাম বাবা আউল মনোহর দাস। হুগলি জেলার বদনগঞ্জে তার সমাধি রয়েছে। তিনি সম্ভবত সোড়শ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে বৈষ্ণব কবিতা সংকলন করেন। তাঁর এ-সংকলনগ্রন্থটি আকারেও বিশাল, এর নাম পদসমুদ্র। আসলেই এটি এক মহাসাগর, কবিতার মহাসমুদ্র। তিনি এ-গ্রন্থে সংগ্রহ করেন পনেরো হাজার বৈষ্ণব কবিতা। তাঁর পরে যিনি বৈষ্ণব কবিতা সংকলন করেন, তিনি রাধামোহন ঠাকুর। তাঁর বইয়ের নাম পদামৃতসমুদ্র। আঠারোশতকের প্রথম দিকে আরো একটি বৈষ্ণব কবিতাসংকলন প্রকাশ করেন বৈষ্ণব দাস। তাঁর বইয়ের নাম পদকল্পতরু। এর পরে আরো অনেক সংকলন হয়েছিলো, যেমন গৌরীমোহন দাস কবিতা সংকলন করেছিলেন পদকল্পলতিকা নামে, হরিবল্লভের সংকলনের নাম গীতিচিন্তামণি, প্রসাদ দাসের সংকলনের নাম পদচিন্তামণিমালা। এ-সব সংকলনে তিরিশ হাজারেরও অধিক কবিতা সংকলিত হয়েছিলো।
বৈষ্ণব কবিতা আকারে ছোটো; এ-কবিতায় জীবনের সমস্ত মোটা কথা পরিহার করে ঘেঁকে তোলা হয়েছে মনের আবেগের সারটুকু। তাই এখানে পাওয়া যায় মানুষের দুঃখের এবং আনন্দের সারসত্তা। রাধার আনন্দ, রাধার বেদনায় আমরা নিজেদের আনন্দবেদনাকে পাই। মধ্যযুগে এ-কাজটি করতে পেরেছিলেন বৈষ্ণব কবিরা। বৈষ্ণব কবিরা ছিলেন অতিশয় সৌন্দর্যচেতন। সেকালে তাঁরা সৌন্দর্যের যে-সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। রাধা বা কৃষ্ণের সৌন্দর্য বর্ণনার কালে, বা তমালের একটি শাখা বর্ণনার কালে, অথবা যমুনার নীলজলের কথা বলার সময় তারা পৃথিবীকে স্বপ্নলোকে পরিণত করেছেন। তাঁদের সাথে তুলনা করা যায় শুধু আর একজন কবিকে, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যদি মধ্যযুগে জন্ম নিতেন, তবে তিনি হতেন একজন বৈষ্ণব কবি।
অপূর্ব এ-সব কবিতার উপমা; অতুলনীয় এগুলোর ছবি। ভাষার ওপর তাঁদের অধিকার ছিলো বিধাতার মতো; তারা বেছে নিয়েছিলেন বাঙলা ভাষার সে-সব শব্দ, যা মনোহর, মায়াবী, স্বপ্নের মতো। তাই বিদ্যাপতির কবিতা, চণ্ডীদাসের কবিতা আমাদের আকুল করে তোলে। তারা যখন উপমা দেন মনে হয় এ-রকম আর হয় না; তাঁরা যখন হৃদয়াবেগ প্রকাশ করেন তাতে আমরা আবেগাতুর হয়ে পড়ি। বিদ্যাপতি কবিতা রচনা করতেন ব্রজবুলি নামক এক ভাষায়। এটি বাঙলা ভাষা নয়, আবার একে অবাঙলাও বলা যায় না। এতে সামান্য কৃত্রিমতা আছে, তবে এতে আছে সুমধুর ধ্বনি, সুর; তাই এতে মুগ্ধ হয়ে থাকা যায় না। বিদ্যাপতির একটি পদ তুলে আনছি এখানে, যার ভাষা আর কল্পনার মধুরতায় বিভোর হতে হয় :
যব—গোধূলি সময় বেলি।
ধনি–মন্দির বাহির ভেলি।।
নব জলধর বিজুরি রেহা
দ্বন্দ্ব পসারি গেলি।।
ধনি–অল্প বয়েসী বালা।
জনু–গাঁথনি পুহপ-মালা।।
ভাষাটি বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে উল্লসিত হ’তে হবে। রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে এ-ভাষার যাদুতে এতো মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি এ-ভাষা শিখে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। এ-ভাষার নামই ব্রজবুলি। এ-ভাষায় কোনো অমধুর শব্দ নেই। কঠিন শব্দ নেই। যে-সকল শব্দ উচ্চারণ করলে শুনতে ভালো লাগে না, তাদের বলে এখানে সুন্দর করা হয়। এজন্যে ব্রজবুলি খুব মিষ্টি, সুরময়, গীতিময় ভাষা। ওপরের অংশে এজন্যে ‘বেলা হয়েছে ‘বেলি’, ‘বিদ্যুৎ’ হয়েছে ‘বিজুরি’, ‘রেখা হয়েছে ‘রেহা’। কবি রাধার বর্ণনা দিচ্ছেন কবিতাটিতে। রাধা খুব রূপসী, তখন গোধূলি বেলা। কবি বলছেন, যখন গোধূলি বেলা, তখন রাধা ঘর থেকে বাইরে এলো। সে এক অপরূপ দৃশ্য। কবি রাধার বাইরে আসার দৃশ্যকে একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, হঠাৎ যেন মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। তারপর বলছেন, রাধা অল্প বয়সের মেয়ে। কিন্তু কেমন মেয়ে? যেনো ফুলের গাঁথা মালা।
সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বৈষ্ণব কবিতায় যেমন শিউলি ভোরের বেলা ছড়িয়ে থাকে শিউলি বনের অঙ্গনে। এ-কবিতায় ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যে বিশ্ব ভেসে যায়। কৃষ্ণ এখানে সৌন্দর্য ছড়ায়, রাধা এ-কবিতায় সৌন্দর্যের দেবী হয়ে আসে। চারদিকে ভাসে রাধার মনের আকুল কান্নার মধুর ধ্বনি। বৈষ্ণব কবিতার রাজ্যে সারাক্ষণ বাঁশি বেজে যাচ্ছে, সে-বাঁশিতে পাগল হয় রাধা, পাগল হই আমরা, সবাই। এমনকি নাম শুনেও রাধা আকুল হয়ে ওঠে কৃষ্ণের জন্যে। চণ্ডীদাসের একটি পদে রয়েছে :
লাল নীল দীপাবলি ৩৫
সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।
না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমন পাইব সই তারে।।
এ-পদটি সহজ সরল, কিন্তু এর আবেগ তীব্র বাঁশরির সুরের মতো। রাধা শুধু শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণের নাম শুনেছে, তাতেই সে আকুল হয়ে উঠেছে। কবি তার হৃদয়ের আকুলতাকে ছন্দে গেঁথে দিলেন, আর যুগযুগ ধরে সে-ছন্দের ঢেউ রাধার আকুলতা হয়ে আমাদের বুকে এসে দোলা দিতে লাগলো।
বৈষ্ণব কবিতার চার মহাকবি বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস। তাঁদের মধ্যে বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস লিখেছেন ব্রজবুলি ভাষায়, আর চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস লিখেছেন খাটি বাঙলা ভাষায়। বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস বেশ সাজানোগোছানো, তাঁরা আবেগকে চমৎকাররূপে সাজাতে ভালোবাসেন। ভেবেচিন্তে, চমৎকার উপমাউৎপ্রেক্ষায় গেঁথে এ-দুজন কবিতা লিখেছেন। অন্যদিকে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস সহজ সরল আবেগ প্রকাশ করেন সহজ সরল ভাষায়; কিন্তু ভাষার মধ্যে সঞ্চার করে দিয়েছেন নিজেদের প্রাকৃত হৃদয়ের তীব্র চাপ। এ-দুজনের কবিতা যেনো বনফুল; আর বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের কবিতা বাগানের লালিত পুষ্প। জ্ঞানদাসের একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে আনছি :
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।
গোবিন্দদাসও মহান কবি, তাঁর কল্পনা মোহকর। তিনি কল্পনাকে চমৎকার অলঙ্কার পরিয়ে দেন। তার কয়েকটি পংক্তি :
যাহাঁ যাহাঁ নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাহাঁ তাহাঁ বিজুরি চমকময় হোতি।।
যাহাঁ যাহাঁ অরুণচরণ চল চলই।
তাহাঁ তাহাঁ থল-কমল-দল খলই।।
গোবিন্দদাসের ভাষাটি একটু কঠিন, কিন্তু এর ভেতরে আছে সৌন্দর্য। কবি এখানে রাধার বর্ণনা দিচ্ছেন। রাধা খুব সুন্দর, তা সবাই জানি; কবি সে-সৌন্দর্য কী রকম, তা বলছেন। রাধা তার সখীদের সাথে যাচ্ছে। কবি বলছেন, রাধার শরীর থেকে যেখানে ছলকে পড়ছে সৌন্দর্য, সেখানে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানে রাধা রাখছে তার আলতারাঙানো পা, সেখানেই যেনো রাধার পা থেকে ঝরে পড়ছে স্থলপদ্মের লাল পাপড়ি। এমন অনেক সুন্দর বর্ণনা আছে বৈষ্ণব কবিতায়। বৈষ্ণব কবিতা মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিতা।