১১. ঈশ্বরের লিপির রহস্য (প্রথম পর্ব)

ঈশ্বরের লিপির রহস্য (প্রথম পর্ব)

‘আচ্ছা, ধরো তোমার কাছে একটা খুব দামি বই আছে। কিন্তু সেটা জার্মান ভাষায় লেখা। তুমি পড়তেই পারবে না। তখন তুমি কী করবে?’

ভবেশদার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম,

‘এ আবার কী, এমন বই রাখবই-বা কেন যেটার ভাষা আমি জানি না!’

‘যদি বলি, বইটা অমূল্য! পৃথিবীতে মাত্র একটাই এমন বই আছে, মলাটটা আবার সোনা দিয়ে বাঁধানো, তাহলে কি রাখবে এমন বই?’

পিজি ফুট কাটল এবারে,

‘তখন তো আর সেটা শুধু বই থাকল না। ওরকম অ্যান্টিক জিনিস তো সবাই রাখতে চাইবে নিজের কাছে।’

‘ঠিক বলেছ। রোসেটা স্টোনটা পেয়ে ব্রিটিশদেরও এই একই হাল হয়েছিল। জেদ করে নিজের দেশে নিয়ে তো চলে এল। কিন্তু ওতে কী লেখা আছে সেটা বুঝতে না পারলে তো ওটা একটা দামড়া পাথরের চাঁই ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমাদেরকে তো বললামই পাথরের ওপরে হায়রোগ্লিফ, ডেমোটিক আর গ্রিক ভাষায় লেখা ছিল। গ্রিক ভাষাটা অনেকে পড়তে জানত। তাই লেখাগুলোকে কপি করার কাজ শুরু হল।’

পিজি বলল,

‘ওরে বাবা, ছবিতে দেখে যা বুঝলাম অনেকগুলো লাইন লেখা ছিল তো! একটা অচেনা ভাষার অত লেখা দেখে কপি করা কি সোজা নাকি!’

‘না, একদমই সোজা ছিল না কাজটা, আর ওইভাবে কপি করতে গিয়ে প্রচুর ভুল ত্রুটিও হচ্ছিল। তাই এবারে অন্য পন্থা নেওয়া হল। নিকোলাস কন্তের নাম শুনেছ?’

‘না তো।’

image98.jpg

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রোসেটা স্টোন আগে যেভােব ছিল (ছবি উপরে) আর এখন যেভাবে আছে (ছবি নীচে)

image99.jpg

‘এই ভদ্রলোক গ্র্যাফাইটের পেনসিল আবিষ্কার করেন। এই লোকটিই আবার রোসেটা স্টোনের কপি তৈরি করেন। লিপিগুলো পাথরের ওপরে খোদাই করা ছিল। এই খোদাই করা জায়গাগুলোতে গ্রিজ লেপে দেওয়া হল। আর পাথরের বাকি অংশে প্রলেপ দেওয়া হল রাবার আর নাইট্রিক অ্যাসিডের একটা মিশ্রণের। তারপরে পাথরের ওপরে কালি ঢালার পরে সেই কালি খোদাই করা জায়গাতে গিয়ে বসল। তখন একটা সাদা পাতা তার ওপরে চেপে ধরতেই সেই পাতায় গোটা লিপিটারই একটা ছাপ চলে এল। কন্তে এমন অনেকগুলো কপি তৈরি করেছিলেন। এইসব কপি ছড়িয়ে দেওয়া হল ইউরোপ আর আমেরিকার শহরগুলোতে। অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, ডাবলিন আর এডিনবরা ইউনিভাৰ্সিটি পেল একটা করে কপি। একটাই আশায়, যদি কেউ এই লিপির মানে উদ্ধার করতে পারেন। তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী আর ভাষাবিদরা নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ রেখে একটা প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল। কে আগে হায়রোগ্লিফের রহস্যভেদ করতে পারে!’

‘গ্রিক লেখাটার মানে উদ্ধার করা গেল না? সেটা করা গেলেই তো হায়রোগ্লিফের মানে বের করে ফেলা যেত।’

‘হ্যাঁ, গ্রিক ভাষায় লেখা লাইনগুলোর মানে তো কয়েকজন ভাষাবিদ করেই ফেলেছিলেন। সেগুলোকে আবার ল্যাটিন আর ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদও করা হয় সাধারণের বোঝার জন্য। সেখান থেকেই বোঝা যায় এই পাথরে নাম লেখা আছে টলেমি বংশের রাজার।’

‘টলেমি?’

‘হ্যাঁ, এঁরা জাতিতে গ্রিক ছিলেন। যিশুর জন্মের আড়াইশো বছর আগে এঁদের রাজত্ব ছিল মিশরে। রোসেটার পাথরে এই রাজাদেরই জারি করা আদেশ লেখা ছিল। তাই একই কথা তিনটে ভাষায় থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। গ্রিক ভাষা গ্রিকদের জন্য। সাধারণ মানুষের জন্য ডেমোটিক। অন্যদিকে রাজা হলেন ফারাও, আর ফারাওরা ঈশ্বরেরই রূপ, সেইজন্যই পবিত্র ভাষা হায়রোগ্লিফও ছিল। যাঁরা এই লেখার মানে উদ্ধারের জন্য লড়াই করছিলেন তাঁররা ভেবেছিলেন যে কোনো একটা লাইনে গ্রিক শব্দ কত নম্বরে আছে দেখে সেই হায়রোগ্লিফের সেই লাইনের সেই শব্দটা আইডেন্টিফাই করতে পারলেই হল। তাহলেই বোঝা যাবে যে অক্ষরগুলো কী মানে বোঝাচ্ছে। কিন্তু সেইভাবে এগোতে গিয়ে কূলকিনারা হারিয়ে ফেললেন সবাই। অবাক হয়ে দেখলেন হায়রোগ্লিফে কোনো কোনো শব্দ শুধু একটা অক্ষরেরই। আবার কোনো শব্দে চার পাঁচটা অক্ষর। অক্ষর বলাটা অবশ্য ঠিক না। কয়েকটা ছবি যেমন সাপ, পেঁচা, গোরু, পালক, পর পর সাজানো। সেগুলোই অক্ষর! তবে দু-জন মানুষ এই লিপির মানে উদ্ধারে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন ইংল্যান্ডের, আরেকজন ফ্রান্সের।

‘জঁ ফ্রাঁসোয়া শাম্পোলিয়নের জন্ম হয়েছিল ১৭৯০ সালে, ফ্রান্সের ছোট্ট শহর ফিজেকে, বেশ গরিবের ঘরে। ওর বাবা ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করতেন। দশ বছর বয়স থেকে ও ওর দাদার কাছে গ্রেনোবেল শহরে থাকতে শুরু করে। ছোটোবেলা থেকেই ভীষণ গোঁয়ার ছিল এই শাম্পোলিয়ন। অঙ্ক, বিজ্ঞান ওর ভালো লাগত না। কিন্তু নতুন নতুন ভাষা শেখার ব্যাপারে ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। মাত্র এগারো বছর বয়সেই ল্যাটিন, গ্রিক, আরবিক, হিব্রু আর সিরিয়াক ভাষায় লিখতে পড়তে পারত সে। গ্রেনোবেল শহরেই ওর হাতে আসে প্যাপিরাসের একটা ছোটো টুকরো। নতুন দেখা একটা লিপির মানে বোঝার জন্য এবারে উঠে পড়ে লাগে শাম্পোলিয়ন। সেই শুরু, এর পরে প্রায় গোটা জীবনটাই কেটে যায় হায়রোগ্লিফের মানে উদ্ধারের নেশায়। 

‘শাম্পোলিয়নের দাদার কাছে রোসেটা স্টোনের একটা কপি ছিল। সে নিজেও শখের বশে একবার এই লিপি নিয়ে নাড়াঘাঁটা করে রণে ক্ষান্ত দেয়। তবে এই কপিটা পেয়ে শাম্পোলিয়নের একটা বড়ো লাভ হল। একটা ব্যাপার ও বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছিল। হায়রোগ্লিফের মানে জানতে গেলে আগে মিশরের সাধারণ মানুষের ভাষা ডেমোটিককে বুঝতে হবে। সেই কাজটা করতেই কয়েক বছর কেটে গেল। সারা দিনরাত এক করে একটাই কাজ করে যেতে লাগল শাম্পোলিয়ন। অবসাদও কম হত না সেই সময়। মনে হত যদি অন্য কেউ তার আগে হায়রোগ্লিফ পড়ে ফেলে! তাহলে তো এত খাটনি সব জলে যাবে।’

‘হ্যাঁ, আপনি তো বললেন আরও অনেকেই এটা নিয়ে কাজ করছিল।’

‘হ্যাঁ, করছিল তো অনেকেই। কিন্তু শাম্পোলিয়নের মতোই বাকিদের থেকে এগিয়ে ছিলন আরেকটি মাত্র মানুষ। সেই লোকটা আবার ব্রিটিশ।

‘ড থমাস ইয়ং, একটা লোক যিনি চিকিৎসক ছাড়াও ছিলেন একজন নামকরা বিজ্ঞানী, অ্যাস্ট্রোনমার আর মিউজিশিয়ান! শাম্পোলিয়নের মতোই তিনিও অন্তত পাঁচটা ভাষা লিখতে পড়তে পারতেন অনায়াসে। ইনি কিন্তু হায়রোগ্লিফের চল্লিশখানা চিহ্নর মানে বের করে ফেলেছিলেন! ওঁর এই আবিষ্কার শাম্পোলিয়নকে অনেক সাহায্য করেছিল। দু-জনেই দু-জনের কাজের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। চিঠির আদান-প্রদান চলত। কিন্তু একটা চাপা প্রতিযোগিতাও ছিল। তবে ড ইয়ং-এর কাছে এই কাজটা ছিল একটা হবির মতো। অন্যদিকে শাম্পোলিয়নের কাছে এটাই ছিল সব কিছু।

‘এই একটা কাজের নেশাতে শাম্পোলিয়ন নিজের জীবনটাকেই ভুলতে বসেছিলেন। শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছিল, সারাদিন একটা ঘরে নিজেকে বন্দি করে রাখতেন। প্রতিবেশীরা ওকে পাগল ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু ১৮২১ সালের শেষের দিকে ওঁর কাজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ৩০০টা হায়রোগ্লিফের চিহ্নের মানে বের করতে পেরেছিলেন শাম্পোলিয়ন। সেগুলোকে সাজিয়ে শব্দ বানানোও শিখে গিয়েছিলেন।

‘১৮২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সেইদিন যেদিন শাম্পোলিয়ন এতদিনের সাধনার ফল পেলেন। আবু সিম্বেলের মন্দিরের নাম শুনেছ?’

‘না তো।’

‘বাঙালির ইজিপ্টের জ্ঞান পিরামিড, মমি আর তুতানখামেনেই শেষ হয়ে যায়। তোমরাও তেমনই। আবু সিম্বেলের মন্দির বানিয়েছিলেন ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস। হাজার বছর ধরে এই মন্দির মরুভূমির বালির তলায় চাপা পড়ে ছিল। এর আবিষ্কার নিয়ে একটা দারুণ গল্প আছে! পরে কোনো একসময় মনে করিয়ে দিয়ো। বলব ’খন।

‘তো, এখন যেটা বলছিলাম, ১৮২২ সালের ওই দিন শাম্পোলিয়নের হাতে আসে আবু সিম্বেল মন্দিরের গায়ে খোদাই করা হায়রোগ্লিফের কপি। সেই কপি হাতে পেয়েই শাম্পোলিয়ন চমকে উঠলেন! অনেকগুলো শব্দ তো উনি বেশ ভালোমতোই পড়তে পারছেন! এর জন্য তো আর অন্য কোনো ভাষার সাহায্য লাগছে না। তাহলে তিনি সত্যিই হায়রোগ্লিফের রহস্যভেদ করে ফেলেছেন! তুমুল উত্তেজনা আর আনন্দের চোটে ‘‘পেয়েছি পেয়েছি’’ বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেন শাম্পোলিয়ন। কাছেই ছিল ওঁর দাদার অফিস। সেখানে পৌঁছে দাদাকে খবরটা দিয়েই অজ্ঞান হয়ে যান। এতদিনের পরিশ্রমের ধকল আর শরীর নিতে পারেনি।

‘২৭ সেপ্টেম্বর ১৮২২ সালে প্যারিসের অ্যাকাদেমি অফ ইনস্ক্রিপশন থেকে শাম্পোলিয়নের একটা পেপার পাবলিশ করা হয়। বাকিটা ইতিহাস। ওই পেপার আরও আরও অনেক ভাষায় ট্রান্সলেটেড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করে শাম্পোলিয়নই প্রথম যিনি হায়রোগ্লিফকে পুরোপুরি জেনে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে শাম্পোলিয়নের ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে। তিনি তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হায়রোগ্লিফের লিপির মানে উদ্ধারে ব্যস্ত। প্রাচীন মিশর সেই প্রথম মানুষের সামনে এল। ধরা দিল ওদের আচার, ব্যবহার, দর্শন, পুরাণ সব কিছু। ১৮২৬ সালে শাম্পোলিয়নকে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের ইজিপশিয়ান কালেকশনের কিউরেটর করে দেওয়া হয়। কায়রো মিউজিয়ামের পরে সবচেয়ে বেশি ইজিপশিয়ান প্রত্নসামগ্রী আছে এই ল্যুভর মিউজিয়ামেই।

‘যে মানুষটা নিজের গোটা জীবনটা ইজিপ্টকে দিয়েছিলেন, ১৮২৮ সালে সেই শাম্পোলিয়ন মিশরে যান। সেই প্রথম আর শেষবারের মতো। অবাক হয়ে দেখেছিলেন গিজার পিরামিড। আর আবু সিম্বেলের সেই মন্দির যার গায়ের হায়রোগ্লিফের ছবিটুকুই শুধুমাত্র তাঁরর কাছে ছিল।

‘কিন্তু এত বছর ধরে নিজের শরীরের ওপরে করা অযত্নের মাশুল দিতে হল শাম্পোলিয়নকে। ৪ মার্চ ১৮৩২ সালে ব্রেন স্ট্রোকে মারা গেলেন শাম্পোলিয়ন। তার আগে ভুগেছিলেন ডায়াবেটিস, গাউট, কিডনির রোগে। ওঁর শেষ কাজ ছিল হায়রোগ্লিফের ব্যাকরণের বই, যেটা বেরোয় উনি মারা যাওয়ার পরে।’

একটানা এতটা বলে ভবেশদা দ্বিতীয় রাউন্ডের চা-টা একটা লম্বা চুমুকে শেষ করলেন। আমি আর পিজি হাঁ করে দারুণ একটা মানুষের অধ্যবসায়ের গল্প শুনছিলাম এতক্ষণ ধরে। কিন্তু একটা প্রশ্ন এবারে করতেই হত।

‘ভবেশদা, একটা কথা বলুন, হায়রোগ্লিফের মানে আবিষ্কারের ইতিহাস তো শুনলাম। কিন্তু হায়রোগ্লিফ কী করে পড়তে হয় সেটা তো বললেন না।’

‘বলব ভায়া। আমি যতটুকু জানি না হয় বলব। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেল তো।’

পিজি বলল,

‘এখনই তো সাড়ে এগারোটা বাজে। কী করবেন আর বাড়ি গিয়ে। একটা ফোন করে বলে দিন আজ আর ফিরবেন না। ব্যস, মিটে গেল।’

‘বাড়িতে প্রাণী বলতে তো আমি একাই ভাই। ফোন করার দরকার নেই।’

‘বাহ! তাহলে তো খুব ভালো! আমাদের সঙ্গে মেসে খেয়ে নিন। আপনি না হয় রাতে আমার খাটে শুয়ে পড়বেন। আমি আর স্পন্দন একটা খাট শেয়ার করে নেব। নো চাপ।’

মেস থেকে খেয়ে এসে আমরা যখন আবার বসলাম, তখন রাত সাড়ে বারোটা। গোটা মেসটাই তখন একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে।

আর তখনই আমরা সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো একটা ভাষা শেখা শুরু করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *