একাদশ পরিচ্ছেদ
০১.
ইতিহাসের এই এক নিয়ম, তার উপকরণ না-পেলে সংক্ষেপে বলা ভালো। আমাদের অনুমান ইতিহাস-কথাতেও সে রকম প্রথাই থাকা উচিত। মরেলগঞ্জে এবং রাজনগরে এক বিদ্বেষ-প্রীতির টানাপোড়েনের সম্বন্ধ তৈরী হচ্ছিলো। কিন্তু সেই শীতে রানীমার জন্মতিথিতে ডানকানের পক্ষ থেকে কেউ না আসলেও বিদ্বেষটা না বেড়ে প্রীতির ভাবটাই দেখা দিয়েছিলো যেন। দিন চার-পাঁচ পরে ডানকানের এই উপেক্ষার কথা না তুলেও নায়েবমশাই বলেছিলেন, ওকে চাপে রাখো। কেন তা হলো না তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলতে পারে, কিন্তু সঠিক যেটা জানা যায় তা বিশেষ সংক্ষিপ্ত। যেমন জন্মতিথির এক সপ্তাহ গেলো না। নায়েবমশাই অন্য অনেক দপ্তরের কাজের মধ্যে ল-মোহরারের দপ্তর দেখতে দেখতে বলেছিলেন, মনোহর সিং-এর সেই টেরেসপাসের হামলার কী হাল? গৌরী বলেছিলো, আজ্ঞে, আপনি ঢিলে দিতে বলেছিলেন। নায়েব বললেন, আর কেন? তদ্বির করো, সমন বার করাও। কিন্তু সে সকালেই বাড়ি যাওয়ার মুখে যখন, তার নিজের ভাষায় বুড়ো হাড়ে রোদ লাগাতে তিনি বারান্দায়, দেখলেন, মরেলগঞ্জের ফিটন ঢুকলো রাজবাড়ির দরজায়। অবাক কাণ্ড! ফিটন থেকে নামলো মনোহর সিং। এদিক ওদিক না চেয়ে সোজা, চলে গেলে দেওয়ানকুঠিতে। এখন তো সকালের কাছারি ভাঙতে আরো আধঘণ্টা। রোদে রাখা চেয়ারটায় বসেই গৌরীকে ইঙ্গিত করলেন। মনোহর সিং আধঘণ্টা বাদেই ফিরে গেলো। গৌরী দেওয়ানকুঠিতে গেলো। হরদয়ালকে জানালো নায়েবমশায় জানতে চাইলেন, যে এসেছিলো সে সত্যি মনোহর সিং কিনা। দেওয়ানের কাছে গৌরী জানালো, মনোহর সিং কাঁদছিলো! তার বিবাহ একাধিক, কিন্তু ছেলে একটিই। সে নাকি কলকাতায় লেখাপড়া করতো। কী করে কার পাল্লায় পড়ে ক্রিশ্চান হয়েছে কিংবা হবে। আমাদের দেওয়ানজি তাকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন কীনা। নায়েব তামাক খাচ্ছিলেন। তিনি ঠাট্টা করে হেসে উঠতে গিয়ে বেদম হলেন। দশ-বিশ মিনিট কথা বলতে পারলেন না। তার বাড়িতে যাওয়ার পালকি এলো। বাড়িতে যেতে উঠলেন হাসি-হাসি মুখে। পালকির পাশে দাঁড়ালেন। গৌরীকে ডাকলেন। সে এলে কুটি করে ভাবলেন। বললেন, মনোহরের ওই একই ছেলে? আচ্ছা, গৌরী, মামলায় কী বা হয়? তা, তুমি টেরেসপাসের মামলাটা তুলেই নাও। তিনি পালকিতে উঠলেন। নায়েবমশায়ের হঠাৎ এই মত-পরিবর্তন কাছারিকে ধোঁকায় ফেলেছিলো। কিন্তু সেই ধোঁকা দূর করার মতো কোনো বিশদ বিবরণ কি পাওয়া যায়?
.
এরকমই একটা ছোটো ঘটনায় হেডমাস্টার বাগচীর ক্রোধের বিবরণ পাওয়া যায়। অথচ সে তো আদৌ ক্রোধী ছিলো বলে মনে হয় না। তখন বাগচীর স্কুলে সেই পরীক্ষা নেওয়ার পরীক্ষা চলেছে। স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীতে সর্বরঞ্জন ইংরাজির পরীক্ষা নিচ্ছে, অন্যান্য। শিক্ষকেরা নানা শ্রেণী নিয়ে ব্যস্ত। মৌখিক পরীক্ষা সুতরাং শিক্ষকদের পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, তা জন্মোৎসবের পরে এবং সেবারের ক্রিস্টমাসের আগে, কিন্তু ঠিক কখন ধরা যায় না। পরীক্ষার একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। রোল নাম্বার অনুসারে। ষষ্ঠ বালক ইসমাইল আসতে বাগচী বললো–বসো, ইসমাইল, বলল এবার, তোমার ধর্ম কী?
-মুসলমান।
–তোমার ভগবান কজন?
–একজনা, স্যার।
বাহ! তুমি প্রার্থনা করো? কোন দিকে মুখ করে করো?
–পশ্চিম, স্যার।
–কেন, তা কেন? অন্য দিক নয় কেন?
–পশ্চিমে মক্কা স্যার।
–ও, আচ্ছা, আচ্ছা। ওই ম্যাপটার কাছে যাও। বলো পশ্চিম কোন দিক হয় ম্যাপে?
বাঁ দিক।
বাহ! ম্যাপটা?
–আশিয়ার, স্যার।
সুন্দর! মক্কা কোন দেশে?
–আরব দেশে।
–বেশ, আরব দেশ প্রথমে, পরে মক্কা দেখাও।
ইসমাইল মক্কা খুঁজে বার করতে পারলো না। বাগচী তখন তাকে মক্কার গল্প, মহম্মদের গল্প বলে জিজ্ঞাসা করলো, ক্লাসে কখনো মক্কার ম্যাপ দেখেছিলো কিনা? মক্কা কোথায় জানতে ইচ্ছা হয়েছিলো কিনা?
সে কি কিছু মুখস্ত বলতে পারে? ইসমাইল নমাজের একটুখানি আবৃত্তি করলো। বাগচী বললো–তাহলে মক্কা বার করা উচিত ছিলো। এই সময়ে ইসমাইল ভয়ে ভয়ে বললো– চোখে কম দেখছি, স্যার।
কম দেখছো? বাগচী সোজা হয়ে সললো। ভূগোল, ইতিহাস, স্মৃতিশক্তি, সপ্রতিভতা–এসব নিয়ে পরীক্ষা। সব থমকে গেলো। কেন কম দেখছো?
ইসমাইল দ্বিধা করতে লাগলো। তখন হঠাৎ বাগচীর মনে পড়লো, কিছুদিন আগে তার এক ছাত্রের চোখের অসুখ নিয়ে কথা হয়েছিলো। অন্য ছাত্ররাও ছিলো। তার নাম তো ইসমাইলই বটে। সে কি এই ইসমাইল?
বাগচী চেয়ার থেকে উঠে ইসমাইলকে জানলার ধারে আলোয় নিয়ে তার চিবুক তুলে ধরে চোখ পরীক্ষা করলো। তার তো এখন ঠিকই মনে পড়ছে বটে। বিশ্রী রকমের কনজাংটিভাইটিস ছিলো সেটা। সে ইসমাইলকে জিজ্ঞাসা করলো চরণবাবু ওষুধ দিচ্ছিলো কিনা, সে ওষুধ খেয়েছে কিনা? অবশেষে বললো–চরণবাবুকে ডেকে আনো তো, পরামর্শ আছে।
চরণ এলে বাগচী বললো– কী ব্যাপার চরণ, ইসমাইলের চোখটা-কী ওষুধ দিয়েছো?
চরণ বললো–হামোমেলিস, স্যার, আর্নিকা দেবো কিনা ভাবছি।
বাগচী বললো–ডাক্তার হয়েছে, না? বুদ্ধিতে কুলোয়নি, আমাকে খবর দিলে না কেন?
চরণ একটু দ্বিধা করে বললো–আপনি কনজাংটিভাইটিস বলেছিলেন, আসলে ওটা ঘুষির ফলে। কীবল ঘুষি মেরেছিলো।
বাগচী হুড়মুড় করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে কী করবে খুঁজে পাচ্ছে না! তার চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে! তার দুহাত দু পাশে ঝোলানো, তাদের আঙুলগুলো তেলোকে কুরছে। তার চোখে রাগ আর জল যেন প্রতিযোগিতা করছে! সে তোতলাতে তোতলাতে বললল, কীবল? কেন, কেন বলোনি?
চরণ ভুল করে সত্য বলে ফেলোকীবলসাহেব আপনাদের বন্ধুলোক, স্যার।
বাগচী কী বলবে ভেবে পেলো না। তার সম্মুখে বাড়ানো ডান হাতের তর্জনী ডাইনে বাঁয়ে দুলতে লাগলো। বললো–কেন, কেন বলোনি আমাকে? ছেলেটার চোখ নষ্ট করে দিলে? এত অবিশ্বাস আমাকে? এত ঘৃণা করো আমার ধর্মকে? গেট আউট, গেট আউট!
বাগচী নিজেই তার ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
বলা হয়, সাহেব হলে কী হবে, রাগটা বামুনে। অর্থাৎ বাগচীর রাগ পড়েছিলো। লাঞ্চ শেষে যথাসময়ে স্কুলে ফিরে পরীক্ষা নিয়েছিলো। তাকে নাকি রোগা দেখাচ্ছিলো, অসুখে ভুগলে যেমন হয়। কিন্তু একটা যেন পরিবর্তন হলো। কেট দেখলো, বাগচী যেন শীত কাতর হয়েছে। শীতের নাম করে স্কুল ফেরত বাড়ির বার হচ্ছে না। কফি নিয়ে স্টাডিতে ঢোকে, লেখাপড়া করে। পরীক্ষা চলছেই।
লাঞ্চে ফেরবার সময়ও হাতে বই পত্রিকা দেখা যায়। একদিন বললো, স্কুল থেকে দেওয়ানজির কাছে গিয়েছিলাম, আগস্টের টাইমসগুলো নিয়ে এলাম। আর-একদিন তার হাতে বড়ো এক বান্ডিল পত্রিকা দেখে কেট জিজ্ঞাসা করলে বললো– কলকাতার পত্রিকা। হিন্দু পেট্রিয়ট। দেওয়ানজির কাছে নিয়মমতো আসে। গত ছ মাসের কাগজ নিয়ে এলাম। সময় কাটবে।
এটাই আশ্চর্য, যার সময়ের অভাব ছিলো, তার সময় কাটানোর কথা উঠলো। এক সন্ধ্যায় কেট তাকে পত্রিকায় মুখ দিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো কী এমন বিষয়, এতে মনোযোগে? বাগচী হেসে মুখ তুলে বললো, আ, ডারলিং, বসো বসো, তেমন কিছু নয়। ইংরেজিটা গ্রামারে ঠিক, কিন্তু ভাষার যা আসল কথা ইমেজারি নেই, একটু বাসি মনে হয়। আর শুধু রায়তদের কথা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা,নীলচাষ, তার দাদন এইসব। তবে প্রশংসা করতে হবে। এই হরিশ মুখুয্যে সরকারী চাকরি করেন, তার উপরে এই পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, প্রিন্টার একাধারে একাই সব প্রায়। ভদ্রলোক সময় পান কী করে?
কেট বললো–তবে যে বলেছিলে ভাষাটা বড়ো নয়, ভাষা শিক্ষার চাইতে ভুল বানান। হলেও অন্য সব শিখে নেওয়া ভালো। তোমার কি মনে হয় না ভাষা আর কালচার খুব কাছাকাছি ব্যাপার?
বাগচী হেসে বললো–এই দ্যাখো, ডারলিং, আমি কি ইংরেজি ভাষা আর কালচারকে বাদ দিতে বলেছি? একজনের মুখের ইংরেজি শব্দগুলো কীভাবে ঠোঁট দুটিকে ফুলে পরিণত করে তা না দেখলে জগৎ অন্ধকার।
এক রবিবারে ব্রেকফাস্টের পরে কেট বললো– রাজকুমার অনেকদিন এদিক দিয়ে যান না। তুমি তো বিকেলে বার হচ্ছোই না।
বাগচী বললো, তাতে আর কী হলো?
সে নিজের চারিদিকে চাইলো। জীবন সংযুক্ত হলে স্মৃতিও সংযুক্ত হতে পারে। হঠাৎ কেটের তখন মনে হলো বাগচীর এই ভঙ্গিটা তার পরিচিত। এখানে আসার আগে, এমনকী এখানে আসার পরও প্রথম দিকে যেমন নিজেদের বসবার ঘরের বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে নিস্পৃহ ছিলো–এটা যেন তেমনই। তখনো এরকম বই পড়া ছিলো। বাগচী বললো– বটে, তাতে কী হলো, কিন্তু তখনই বললো, তুমি ভাবছো আমি ঘরকুনো হচ্ছি? আদৌ না, আমি এখনই বেরোতে পারি। বলতে কী যোগাযোগ দেখা দিয়েছে। কাল স্কুলে শুনলাম, আমাদের শিরোমণিমশায় পড়ে হাত ভেঙেছেন। না, ওষুধ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ভদ্রতা রক্ষা। তাছাড়া দেওয়ানজির সঙ্গে দেখা করা দরকার। ওই যে সেই চাকরিটার কথা, তার কিন্তু উত্তর দেওয়া হয়নি। শিরোমণির বাড়ি থেকে দেওয়ানজির কাছে যাবো। ডিকেনসের বই যে কখানা আছে তোমার জন্য নিয়ে আসবো ভাবছি।
সেদিন বাগচীরবিবার উপভোগ করতেই বেরিয়ে পড়েছিলো। সেরকম মেজাজ অনেক বিচিত্র সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে। শিরোমণির টোলের খবর, সেখানকার সংস্কার কুসংস্কার এই সংবাদের মধ্যে ছিলো। কেটকে যা সে বলেছিলো তাতে বোঝা যায় সেখানে শিরোমণির চিকিৎসার জন্য এক দরবেশ উপস্থিত ছিলো। সেই দরবেশ দাবী করেছিলো সে বা তার গুরুপরম্পরায় কোনো বৃদ্ধ-গুরু কাছাকাছি থাকলে আলিবর্দি খাঁ সেভাবে মরতো না। হোক তরোয়ালের চোপ, সে সারতেই। তবে কিন্তু আছে, গুরুরা খবর পায়নি এজন্য যে আলিবর্দির পাপের শরীল, মনিবের সঙ্গে বেইমানি, বন্ধুত্বের নাম করে কোন পণ্ডিতকে নাকি খুন করেছিলো। সেই দরবেশের জীবনটা যেমন রহস্যের, সে জীবনটাকেও তেমন রহস্যময় মনে করে। ঠাকুরদা ছিলো ওস্তাদ ঢুলি, শেষ বয়সে এক মুসলমানী বাঈজীর জন্য সমাজের বাইরে গিয়েছিলো; বাপ ছিলো লেঠেল ডাকাত, এক বোষ্ট্রমীকে নিয়ে তিলক সেবা-টেবা করতো। দরবেশ তার গুরুদত্ত গুণ নিয়ে ভালোই আছে, পদস্খলিতা এক ভৈরবী জটা ও ত্রিশূল সত্ত্বেও ওর গৃহ রক্ষা করে। দরবেশের এই এক গুণ, ভাঙা গায়ে হাত দিয়ে ব্যথা অর্ধেক কমায়।
শিরোমণির টোলে ছাত্রসংখ্যা তখন কমতে কমতে পাঁচ। কুড়িজন ছাত্রের জন্য সেই কবে থেকে দেওয়া ত্রিশ বিঘা দু-ফসলী নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর। ছাত্ররাও বিচিত্র। তিনজন উপস্থিত ছিলো, তাদের একজন ন্যায়, একজন স্মৃতি, তৃতীয়জন বেদান্ত পড়ছে। শিরোমণিই পরিচয় করে দিয়েছিলো। সে বলেছিলো, এটির নাম গোপাল। পিতার অর্থশালী যজমান আছে। আশৈশব পিতামহ পিতাকে দেখে পূজা বিবাহাদি ব্যাপারে মন্ত্রে দক্ষ। নিজগ্রামে কবিভূষণ উপাধি পেয়েছিলো। এখানে স্মৃতি পড়েছে। তন্ত্রে কিছু অধিকার আছে। কিন্তু জননীর ইচ্ছায় এবং দৃঢ়তায় এখানে ফিরে নতুন করে ন্যায় পড়ছে। ওই ফুটফুটে ছাত্রটিকে দেখুন, ব্রজ গোঁসাই, অদ্বৈত বংশের। পিতা অনেক ধনী জোতদার মহাজনের কুলগুরু। কথকতায় ইতিমধ্যে জুড়ি পাওয়া ভার। ইতিমধ্যে ন্যায় ও স্মৃতির উপাধি আছে। এই টোলে ফিরেছে। বেদান্তের জন্যে। কোন এক তোতাপুরী সন্ন্যাসী নাকি ওদের গ্রামে বারমাস্যায় ছিলো। তিনি নাকি বলে গিয়েছেন, কৃষ্ণ কালী ইত্যাদি অলীক কাব্যমাত্র। একমাত্র নিগুণ অব্যক্ত ব্ৰহ্মই সত্য, যিনি পূজা ইত্যাদিতে ভ্রুক্ষেপ করেন, ই নেই তার ক্ষেপ। ব্রজ বোধ হয় ব্রহ্মের এরকম ব্যাখ্যায় বিড়ম্বনা বোধ করলো। সে কিছুটা মুখ লাল করে বললো, গুরুমশায়, তোতাপুরী কিন্তু আমার মাকে শুধু নয়, সন্দেহ হয় এখানকার রানীমাকেও মন্ত্রণা দিয়ে থাকবেন। তাছাড়া আপনার কৃত বেদান্তসার-পাণ্ডুলিপিতে–সে থতমত হয়ে মাঝপথে থেমে গেলো। কপিল নামে তৃতীয় ছাত্রটি বয়ঃকনিষ্ঠ। শিরোমণি বলেছিলো, বারান্দার নিচে খড়ি ফাড়ছে, ওর নাম কপিল। একরকমের স্মৃতিধর। গত বৎসর পড়া বন্ধ করে আমার পুত্রের সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলো। ছ মাস ছিলো চাকরির খোঁজে। তারপর সেখান থেকে পদব্রজে পালিয়েছে। আহা, ও আমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসে, একটু খেতে ভালোবাসে। কলকাতায় নাকি নেটিভপাড়া আছে। সেখানে নাকি হাতি গেলা কালো গঙ্গা বয়। একটু রয়ে সয়ে থাকলে দু-তিন বছরে এন্টান্সে পাস করে উকিল মোক্তার হতে পারতো। বাগচী এই জায়গায় জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার এখানে ইংরেজি পড়া হয় না? সেটা তো অর্থকরীও বটে। কপিল খড়ি গুছিয়ে রাখছিলো। কথাটা তার কানে গেলো। গুরুর পক্ষে সে কথা বলেছিলো। বাগচীকে প্রায় চমকে দিয়ে সে বলেছিলো, দি অ্যাজাপশন ইজ রং, স্যার। অলরেডি দেয়ার আর দেয়ার স্কোরস অব আন্ডার এমপ্লয়েড গ্র্যাজুয়েটস্ হু ইক আউট আ মিজারেবল ইগজিস্টেন্স ইন আনক্লিন স্লাম। শিরোমণি বললো–কী বললো– কে জানে! বাগচী কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো তুমি তো কলকাতায় ছিলে, সেখানে রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচরণ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে দ্যাখোনি? কপিল দ্বিধা করলো। দু হাতে জড়ো করা খড়িগুলোকে স্থানান্তরে নিতে বুকে জড়িয়ে তুলে, ইতিমধ্যেই সে লজ্জিতও বটে, বললো–একসেপশস্ টেন্ড টু প্রুভ দা রুল–ডোন্ট দে?
কিন্তু আসল কৌতুকটা অন্য দিকে। এক ঘোর কুসংস্কার যেন তাদের। তারা বহুবিবাহ প্রথা লোপ অথবা বিধবা-বিবাহ প্রথার প্রচলনকে নিতান্ত মূল্যহীন মনে করে, স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে নিজ নিজ জননীর কথা মনে রেখে কৌতুক বোধ করে। বহুবিবাহ সম্বন্ধে তাদের যুক্তি রামলক্ষ্মণাদির একদারনিষ্ঠা, ভীমার্জুনের বহুবিবাহ সমাজে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি করে? বহুবিবাহ কি ভদ্রসমাজে ছিলো? শ্রীচৈতন্যের কাল থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত যাঁদের নাম আমরা জানি সকলেরই পিতা, দেখা যাচ্ছে, একদারনিষ্ঠ। অন্য দিকে বহুবিবাহ গণিতশাস্ত্র অনুসারে অসম্ভব। যেহেতু স্ত্রী পুরুষের সংখ্যা সবসময়ে সমান থাকে, বহুবিবাহ ব্যাপক চলতে থাকলে বহু অবিবাহিত পুরুষ থেকে যায়, যাদের হিংস্রতায় বহুবিবাহকারীরা নিহত হতো। সতীদাহ প্রথা লোপহওয়াকে তারা ভালোই বলে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করে বৎসরে হাজার রমণীর সেই মৃত্যুর চাইতে তেমনি হাজার রমণীর বারাঙ্গনায় পরিণত হওয়াকে হেডমাস্টারমশায় সুখদায়ক মনে করেন কিনা? যারা সতীদাহ প্রথা লোপে অগ্রণী তাদের সমাজে বারাঙ্গনা-প্রীতি যথেষ্ট। তাদের বক্তব্য বিধবাবিবাহ প্রথা হিসাবে অচল হবে, কেননা যে দেশে কুমারীর বিবাহই সমস্যা সে দেশে বিধবার সুযোগ কোথায়? গোপাল একটু বয়স্ক, সে বলেছিলো এই কথাতেই আমরা পুরুষের সমস্যায় আসি। সে বাঁকা করে বলেছিলো, কলকাতার তারা পুরুষের সমস্যার কথা তোলেন না, কারণ তাহলে তাদের পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ শাসকের সঙ্গে বিবাদে অবতীর্ণ হতে হবে। পুরুষের সমস্যা অবশ্যই অর্থ উপার্জনের, সমস্যা বলহীনতার যা নারীকে আদর করে, রক্ষা করে।
তখন টপ-হ্যাট মাথায় ঠিক করে বসিয়ে বাগচী একজন বলশালী পুরুষের মতো দীর্ঘ পদক্ষেপে চলেছে। তার হাতের ছড়ি অনেক সময় শূন্যে চক্র খাচ্ছে, ফরাসী গোটিযুক্ত মুখে হাসি-হাসি ভাব। চতুষ্পঠীতে যা সে শুনে এলো তা সব পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপার, যে পথে সে এবং তার স্কুল শিরোমণির পথটা যেন তার বিপরীত দিকে। কিংবা বলবে সেই টোলটি এক পুরনো মতবাদের গভীর কিন্তু স্রোতহীন দহ? ওটা কিন্তু দারুণ প্রশ্ন-বৈধব্য জীবনযাপন, সতী হিসাবে দগ্ধ হওয়া কিংবা কলকাতার বারাঙ্গনার সংখ্যা বৃদ্ধি করা কোনটি বেশি যন্ত্রণার? ও দিকে দ্যাখো ভীমার্জুন এমনকী দ্রৌপদীর বহুপত্নীত্ব বা বহুপতিত্ব কোন নীতির? তাদের সেই সমাজে কি তাদের কেউ ধিক্কার দিয়েছে? যদিও সেই সমাজে একপতিত্ব নীতির পরাকাষ্ঠা গান্ধারী বর্তমান। এর কারণ কি এই যে ভীমার্জুন বলশালী, দ্রৌপদী ওজস্বিনী। যেন বিবাহের ব্যাপারটাই গৌণ, আলোচনার গুরুত্ব পায় না।
বাগচী ভাবলো, তা নির্বলই এ সমাজ। পুরুষের সমস্যাই তো প্রবল। কলকাতায় যারা ভাগ্যান্বেষণে, তাদের কজনই বা সার্থক? এটা কি সত্য পুরুষের সমস্যা নিয়ে কথা উঠলেই শাসকের সঙ্গে বিবাদ অবশ্যম্ভাবী? এদিকেও দ্যাখো, রাজবাড়ির বাইরে এদেশে দাদনের সমস্যাটাকেই কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। কৃষক তাঁতি সবাই সমান সমস্যাজর্জর। তার মনে একবার ধনঞ্জয়ের একবার চরণের ক্লিষ্ট মুখ ফুটে উঠলো। ধর্ম কি মানুষের অতীত হীনমন্যতা, নীতিহীনতা থেকে মুক্ত করে বলশালী করতে পারে? তার মনে পড়ে গেলো কে এক ব্ৰহ্মবাদী সন্ন্যাসী রানীমার কাছে মূল্য পেয়েছে। কিছুক্ষণ সংবাদটাকে সে মনে মনে। ওজন করলো। সংবাদটানতুন। ওদিকে দ্যাখো, বোধহয় ব্রজগোঁসাই-ইব্ৰহ্ম সম্বন্ধে জানতে শিরোমণির কাছে পড়ছে। তাহলে কিন্তু নতুন ধর্ম-আন্দোলন যা কলকাতায় ইংল্যান্ডের ইভানজেলিস্টদের মতো সরব, তার নতুনত্ব থাকছে না। সেদিন এই শিরোমণি এক নতুন মত বলেছিলো, জন্মটা পাপ থেকে নয়, মৃত্যুও দুঃখের নয়–সবই বড়োজোর সময়ের ব্যাপার।
বাগচী একটু ধীরে চলতে শুরু করে নিজেকে ঠাট্টা করলো, ওদের চিন্তাকে সমর্থন করছো নাকি? না, না, সত্যই তো, বলেরই তো প্রয়োজন-যে বল কৃষক ও কারিগরকে এক নীরোগ সমাজে স্থাপন করে! সে অবাক হয়ে ভাবলো, আশ্চর্য, এমন কী হতে পারে, এইসব-কোন দহে এক আশ্চর্য ফোয়ারা আছে যা অকস্মাৎ দহকে এক বেগবতী নদীতে পরিণত করতে পারে? এমন কী হতে পারে, এমন কোন এক তোতাপুরী দেখা দেবে, যে বলশালী হয়ে ব্রহ্মবিদ্যা আয়ত্ত করবে এবং সমাজকে বলশালী করতে তাঁতিদের, চাষীদের নানা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবে, ধার্মিক হয়েও বলেরই প্রশংসা করবে?
সে অন্যমনস্কের মতো চলে রাজবাড়ির কাছে এসে পড়েছিলো। তখন তো বেশ বেলাই হয়েছে। কিন্তু সে চোখ তুলতেই দেখতে পেলো, সদরদরজার খিলানের নিচে দেওয়ানজি, তার সঙ্গে ফেলিসিটার। দেওয়ান ফেলিসিটারকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। হরদয়ালও বাগচীকে দেখতে পেয়ে ফেলিসিটারকে পিছনে রেখে এগিয়ে এলো। অভ্যর্থনা জানালো। বললো–আপনার কথাই ভাবছিলাম। ডিকেনসের খানতিনেক নভেল সোফার উপরে একত্র দেখে মনে হলো পরে, হয়তো আপনি পড়ার জন্যে নামিয়েছিলেন। আজই আপনার কুঠিতে পাঠাচ্ছিলাম। চলুন, বসি গে।
বাগচী হেসে বললো–সেদিন ডারউইন পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে ওই কাজ। গৃহিণীর জন্য নামিয়েছিলাম ডিকেন্স। এখন সেগুলো নিয়ে যাই। সন্ধ্যায় যদি আসি,বসবো।
হরদয়াল বললো–ডারউইনে এত উত্তেজনা কেন? অ্যাডাম থাকছে না বলে? সেও হাসলো।
দুজনে পাশাপাশি দেওয়ানকুঠির দিকে চলতে লাগলো। এই সময়ে পিছন থেকে ফেলিসিটার বললো–আমার কথাটা একবার ভাববেন, সার!
হরদয়াল চলতে চলতে খানিকটা মুখ ফিরিয়ে বললো–তোমার সেই রোডরোলার তো? তা কিন্তু নৌকোয় আনতে মরেলগঞ্জের সেই এক গ্লোসে ঠোকাঠুকি হয়ে যেতে পারে। সেবাগচীকে বললো, এবার ডানকানের দারুণ ক্রিস্টমাস। অনেক গেস্ট। ইয়াকোভের মতে তা নাকি কমিশন। কিন্তু কমিশনারদের কারো কারো মেমসাহেবও আসছেন, অবশ্য যাদের তা আছে।
তারা তখন দেওয়ানকুঠির সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। পায়ের শব্দে হরদয়াল মুখ ফিরিয়ে বললো–ও, তুমি যাওনি? আরো কিছু আছে নাকি সওদা?
-তাহলে রোডরোলারটা মঞ্জুর তো সার? ও ছাড়া কি পাকা রাস্তা হয়, সার?
-আমি তো বলেছি, নরেশ কলকাতা যাচ্ছে, সে দেখবে। পছন্দ করে নেওয়া হবে। আচ্ছা, রসো। তুমি যখন থেকেই গেলে, তোমাকে সেই আহিরীটোলার বাড়িটা সম্বন্ধে বলে দিই।
তখন বাগচীকে একদিকে ফেলিসিটারকে অন্যদিকে নিয়ে হরদয়াল তার ড্রয়িংরুমে বসলো। বাগচীর কাছে অনুমতি চেয়ে নিয়ে ফেলিসিটারকে একটা বাড়ির নক্সা দেখালো। বললো–নরেশকে সব বলে দেওয়া আছে। সেই সব কাজ দেখে করাবে। তোমাকে প্রয়োজন মত মিস্ত্রি, কুলি সরঞ্জাম জোগান দিতে হবে। নক্সাটা দ্যাখো। নিচের এই হলটাতে ক্রিস্টমাস গাছ হবে। সেটাই সেদিন বসবার ঘর। তার পশ্চিমের এই বড়োঘরটাতে হবে ডাইনিংরুম। এই হল আর ডাইনিং রুমের উত্তরদক্ষিণের ঘরগুলোর সব কটিতেই শোবার ঘর করে সাজাবে। গালচে, খাট, বসার কিছু আসন, আয়না, টেবিল, সাইডবোর্ড। ফার্নিচার যেন খেলো রং-চটা না হয়, ভাড়া নেওয়ার সময় দেখবে। ওসব ঘরে ধরো আমি, বাগচীসাহেব, এমন আরো কেউ কেউ থাকবো। দোতলার ঘরগুলোর জন্য তোমার ভাবনা নেই। সাফসুতরো করাবে ভালো করে। মেঝের পুরনো শ্বেতপাথরে কিছু করাতে পারবে না। কিন্তু দেয়ালে ছাদে দাগ না থাকে। ফার্নিচার সবই এখান থেকে যাবে। ওখানে রানীমা, রাজকুমার, আর তাদের পরিবারের যাঁরা যাবেন থাকবেন। তুমি দেখবে, নরেশ পৌঁছে কোনো অসুবিধায় না পড়ে।
ফেলিসিটার অবশ্যই উকর্ণ হয়ে শুনছিলো। বললো–আপনারা কবে তক গিয়ে পৌঁছবেন?
হরদয়াল বললো–সেটা ভেবো না। নরেশ পরশু সকালে নৌকোয় রওনা হচ্ছে। তুমি তার সঙ্গে যেতে পারবে? নাকি মরেলগঞ্জের কাজ শেষ হয়নি? তাহলে তুমিও পরশু নৌকো ছাড়ো। পনেরোই ডিসেম্বরে বাসা সবদিক দিয়ে তৈরী হওয়া চাই।
য্যাকব ফেলিসিটার এতদিনে অবশ্য বুঝতে পারে দেওয়ানজির কথার সুর কখন কার দরবার শেষ করছে। সে ইয়েস, সার, মোস্ট ডেফিনিটলি সার্টেন, সার বলে উঠে গেলো।
তখন হরদয়াল হেসে বললো–এবার ক্রিস্টমাসে রানীমা কলকাতা যাচ্ছেন। রাজকুমার তোবটেই। তাহলে আপনিও চলুন। বাসাটার কথা তো শুনলেন। আর সবদিক দিয়ে ভালো, সামনের লনটা ছোটো। ও, আচ্ছা, সেই কথাটা। এখনো কিন্তু আপনার মত জানতে পারিনি।
বাগচী বললো–আমি ডিসেম্বরটা ভেবে দেখি। শেষদিকে জানাবো।
-তা মন্দ হবেনা, যদি পয়লা জানুয়ারী থেকেই টেক আপ করেন। হরদয়াল হাসিমুখে বললো, অতঃপর? লাঞ্চের সময় এসে যাচ্ছে, একটু অ্যাপিটাইজার
বাগচী হেসে বললো–না, না। সন্ধ্যায় যদি আসি, তখন অবশ্যই।
বাগচী ডিকেনসের নভেল তিনখানা নিয়ে চলে এসেছিলো। পথে একবার তার মনে হয়েছিলো, ভাগ্যে এখানে দেওয়ানজি আর তার লাইব্রেরি আছে।
সেদিন সন্ধ্যায় কফির কাপ নিয়ে বাগচী তার স্টাডিতে ঢুকলে কেটও তাকে অনুসরণ করলো। কফি শেষ হয়েছিলো। দু-চারটি সংসারের কথার পর কেট ডিকেন্স পেয়ে তা নিয়ে বসেছিলো। বাগচী তো কিছুদিন থেকেই যেন ভারতীয় জার্নালিজমের ভক্ত হয়ে পড়েছে। আজও সে হিন্দু পেট্রিয়টের ফাঁইল নিয়ে বসেছে। ঘণ্টাদেড়েক পার হয়েছে এর মধ্যে একটাই কথা হয়েছে। বাগচী পাইপ সাজিয়ে বলেছিলো–ম্যাচটা?
কেট বাগচীর হাতে ম্যাচবক্স তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু একটানা ডিকেন্স পড়তে চোখ অন্তত ক্লান্ত হয়।
কেট বললো–ও, আচ্ছা, আজ তো রাজবাড়িতেও গেলে না?
বাগচী যেন চমকে উঠলো। পকেট থেকে ঘড়ি বার করে বললো–তাই তো! তারপর হেসে বললো–তাতে কী, আজ তো একবার রাজবাড়িতে গিয়েছিলাম। বই আনলাম না? তাছাড়া গ্রামের লোকের সঙ্গেও মিশেছি। তোমাকে শিরোমণির টোলের গল্প বলবো?
বাগচী শিরোমণির টোলের গল্প করলো রাতের খাওয়ার সময় পর্যন্ত। খেতে খেতে বাগচী বললো–একটু পিয়ানো বাজাও না আজ। ভেবে দেখো, ওটা রাজকুমার রেখেছিলেন এখানে বেশির ভাগ তুমি একা, কখনো কখনো তিনি, বাজাবেন বলে। সে রাতে খানিকটা পিয়ানো বাজানো হয়েছিলো।
কিন্তু কখনো কখনো একটা অনুভূতি হয় যার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কেটের অনুভূতি হলো তারা যেন আবার তাদের সেই মধ্যপ্রদেশের বাংলোর আবহাওয়া তৈরী করে নিচ্ছে। যেন মাঝখানে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছিলো, আবার গুটিয়ে নিজেদের নিঃসঙ্গ করে নিচ্ছে কী আশ্চর্য, বাগচী এই দু সপ্তাহ তো, কি সকালে কি বিকালে, একবারও তাদের সেই ডিসপেনসারিতে যায়নি।
.
০২.
এরকম একটা সংবাদই আছে মরেলগঞ্জের জীবন সম্বন্ধে। নীলকুঠির বাংলোর পুবমুখী বারান্দায় সেদিন ব্রেকফাস্টে বসেছিলো কীবল ও ডানকান। শীতের রোদ টেবিলে, বারান্দা বটে কাঠের ফ্রেমে তারের জালে ঘেরা। বাংলোর দেয়াল পাকা, খড়ের ছাদ। আটচালা। নিচে সুরকির সড়কে ইতিমধ্যে পাশাপাশি দুটি ঘোড়া। টেবলে ইংলিশ ক্ৰকারি, ড্রেসডেনের বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ভাসে গোলাপ। খাদ্যগুলি ইংরেজি হতে পারে না। ডিম, মুরগি, চাপাটিসকালে, লাঞ্চে, ডিনারে। বেকন,হ্যাম, পর্ক আশা করা যায় না, ভালো ব্রেডও নয়। পরশুদিন বীফ হয়েছিলো, কারণ কালেক্টর ম্যাকফার্লান এসেছিলো। তার সঙ্গে কীবল সদর পর্যন্ত গিয়েছিলো, ফিরতে বিকেল।
ডানকান কি বিচলিত? তার কাবার্ডে কি অনেক কঙ্কাল? ইন্ডিগো কমিশন নিয়েই চিন্তা। আলোচনায় আর্চি হিলের নাম উঠেছিলো। ম্যাক আর্চির নাম জানেনা। ডানকান বলেছিলো, আর্চি একজন প্ল্যান্টার যার কথার মূল্য আছে। আলোচনায় লর্ড পামারস্টোন এবং গ্ল্যাডস্টোনের কথা উঠেছিলো। গ্ল্যাডস্টোন, যেনাকি চ্যান্সেলার অব দি এক্সচেকার। ডানকান বলেছিল, হুইরা ব্যবসা বাণিজ্যকে শেষনা করে ছাড়বেনা। ম্যাক কীবলের সমবয়সীহবে। সে কিন্তু খুব সহজভাবে একটা পরিবর্তনের কথা বলেছিলো। সে আর কম্পানির কর্মচারী নয়, সেক্রেটারি অব স্টেটের কর্মচারী।
আজ কথা কম হচ্ছে, ডানকান ভাবছে। হয়তো কমিশন নয়, স্ত্রী-পুত্রের কথাই ভাবছে। তারা সেই ৫৭-তে হোমে গিয়েছে, এদেশে আসতে চাইছে না। যদিও ১৮৫৭-৫৮র ব্যাপারগুলো তারা প্রত্যক্ষভাবে জানে না। ফলে এখন এই ১৮৬০-এর শেষেও এই মরেলগঞ্জ স্ত্রীলোকহীন। এই পর্যন্ত ভেবেই কীবল তাড়াতাড়ি মুখ তুললল, বললো–হোয়াইট, তুমি কি মনে করো কম্পানি রুল আর সেক্রেটারি অব স্টেটের শাসনে সত্যই তফাত হয়? কাল্পনিক নয়?
ডানকান বললো, তুমি কি হোয়াইট মিউটিনির খবর রাখো?
কীবল হেসে বললো–তা আবার কবে করলে, কিংবা করতে চলেছো?
ডানকান রসিকতার দিকে না গিয়ে বললো, দুই শাসন এক হলে কম্পানির দশ হাজার ইংরেজ সৈনিক ও অফিসার পদত্যাগ করতে চায় কেন? তারা কম বোঝে? আর সবচাইতে বড়ো প্রমাণ এই কমিশন! জাস্ট থিংক অব ইট! আমি আমার রায়তদের সঙ্গে কী করেছি, তার বিচার? ম্যাঞ্চেস্টারে কাপড় হবে, কিন্তু তার রং? এদিকে দ্যাখো, ম্যাক ছোকরা বলছিলো, সে চায় না কমিশন তার জেলায় কিছু কেলেঙ্কারি খুঁজে পায়। যেন আমরা তার। অধীন আর আমাদের কাজের জন্য তার দায়িত্ব আছে। এর চাইতে বড়ো, ঔদ্ধত্য স্বপ্নে দ্যাখো? উত্তেজিত ডানকান ঢেকুর তুলো।
ব্রেকফাস্টে হাল্কা বিষয়ই ভালো, তাছাড়া সে কি ক্লান্তনয়? না, সকালে কেন ক্লান্ত হবে? এই ভেবে কীবল বললো, তুমি কি সত্যই যাচ্ছে হোমে?
–নিশ্চয়, ইস্টারে অবশ্যই। তার আগে তোমার পিক আপ করা চাই। তবে কিডিসদের আনবো কিনা ভাবতে হবে।
-কেন, এখানে কি তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বোধ করেছো? ১৮৫৭ বারবার হয় না।
ডানকানের মুখ একটু লাল হলো, সে বললো–ইন এ সেন্স তা বলতে পারো। ১৮৫৯ এর চাষীদের ঔদ্ধত্য ভাবো। আমার মনে হয়, এর চাইতে গায়েনা ভালো, নীলের চাইতে সুগার ভালো; সেখানে অন্তত কোয়েকাররা নেই।
-এখানে কোয়েকার? কোথায়, কলকাতায়?
নয় তো কমিশন বসায়? জাস্ট থিংক অব ইট!
কীবলের গায়ে রোদ। উষ্ণতায় অনুভব করলো, ঘুমিয়ে নিলে হয় ব্রেকফাস্টের পরে। কিন্তু সে নিজেকে সজাগ করলো। বললো–তুমি কিন্তু কোয়েকারদের প্রশংসাই করতে, যদি আমার ঠিক মনে থেকে থাকে।
ডানকান বললো–সে তাদের ধর্মের ভণ্ডামির জন্য নয়। লন্ডন স্টক মার্কেটের বিশিষ্ট ফোর্স হিসাবে। বলা হতো, যত ধার্মিক তত রেলওয়ের স্টক।
প্লেট বদলে দিলো আয়া। কীবল বললো–ধর্মের কথায় বলি, রলের চার্চ মিশনের জন্য একশো একরের টিলাটা আমি আবার দেখেছি। ওটাই ভালো হবে। সদরে কিছু খবরও জেনে এসেছি। ওটা ফরাসডাঙার পিয়েত্রোর ছিলো।
ডানকান গুমরে ওঠার ভঙ্গিতে বললো, তার জন্য সদরে যাওয়া দরকার ছিলো না। ওটা ইদিলপুর পরগনা। মনোহর সব খবর রাখে। পরগনাটা সেই খেকশিয়াল পিয়েত্রোর ছিলো। কিছু খাস ছিলো যার গোটাটাই সে তার তাতিদের, রায়তদের, বরকন্দাজদের মোকরারি দিয়ে গিয়েছে। বাকিটা জোতদারদের। পাঁচ-ছজন তারা। তাদের নাম মনোহর দিতে পারে।
কীবল ডানকানের চাইতে একদিকে অন্তত এগিয়ে তা বোঝানোর সুযোগ নিলো, বললো, কিন্তু পিয়েত্রো জীবিত নয়। রেভেনু কে দিচ্ছে পরগনার? ম্যাকফার্লান নিজেও শুনে অবাক। বললো–জানতাম না তো, খোঁজ নিচ্ছি।
চা নিয়ে এলো ডানকানের আয়া। মাঝখানে চেরা একমাথা খয়েরি চুলের নিচে বড়ো বড়ো চোখ, তার নিচে বাদামী ফুলোফুলো গাল যাতে অনেক ব্রণ, চোখের মণিকে নীলচে গ্রে রং বলতে হবে, ছাপা ছিটের গাউনে ঢাকা পিছন দিকটা ঘোটকীকে পরাস্ত করে। কীবল মুখনা তুলে চোরাচোখে চাইলো। ফুলীততক্ষণে কিচেনের দরজার কাছে। বাইশ হতে পারে বয়স। হয়তো ডানকানের আগে যে ছিলো তার, কিংবা কলকাতা থেকে আনা। কিন্তু কয়েকদিন আগে ভোররাতে স্নাইপ শুটিং-এর জন্য বন্দুক আনতে গিয়ে তাকে ডানকানের শোবার ঘরের দরজা খুলে বেরোতে দেখা গিয়েছিলো। আর সে কিন্তু এতটুকু বিব্রত ছিলো না। বরং কিচেনে ডেকে ছোটোসাহেবকে গরম এক কাপ চা করে দিয়েছিলো।
কিচেনের দরজার পাশে কীবল জুড়ান পাইকের সেই তৃতীয় স্ত্রীকে দেখতে পেলোলা। জুড়ান, তার মনে পড়লো, সে এখানে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে বল্লমের খোঁচায় এক রায়তকে খোঁড়া করে দিয়েছিলো। একটা ঝোপের মাত্র ব্যবধান ছিলো তার আর সেই ঘটনার মধ্যে। সেই রায়তের পা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। সে ডানকানকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাধ্য হয়েই যেন, এটা কী? এরকম কেন হবে? জুড়ান পাইকের তৃতীয় স্ত্রীর পরনে সবজে চেকশাড়ি, দাসীরা যেমন পরে।
কীবল বললো–যাটের রেভেনু তো কেউ না কেউ দিয়েছে। অথচ পিয়েত্রো তখন মৃত। ম্যাক অবাক হয়ে বললো–তাই তো, নীলামে ওঠেনি পরগনা! তুমি বোধ হয় এসর আগে ভাবোনি, হোয়াইট?
ডানকান বললো, ১৮৫৮-৫৯ ভালো ছিলো না। ৬০টা দেখে নেওয়া গেলো। হাতের তাস কি সবসময়ে টেবলে ফেলা যায়? আমার বন্ধু আর্চিবলড হিল কলকাতায় খোঁজ নিচ্ছে।
চা শেষ করে ডানকান উঠলো। তার তো পোশাক পরাই ছিলো। রাস্তায় ঘোড়া ধরে সহিস। এখন প্ল্যান্টেশন দেখতে বেরোবে। দেখা দরকারই তা নয়। আরামদায়ক রোদে ঘোরা, ব্যায়ামও বলতে পারো। তবে নিশ্চয়ই জানিয়ে দেওয়া আমি এখানেই।
কিন্তু আশ্চর্য, সবুজ শাড়ি-পরা স্ত্রীলোকটি কি তাকে লক্ষ্য করছে? কীবল চা শেষ করে উঠলো। ডানকান ঘোড়ায় উঠছে। কীবলের নিজেরও পরনে ব্রিচেস, রাইডিং কোট, হাতে ক্র-হুঁইপ, তার জন্যও ঘোড়া অপেক্ষা করছে।
সে ঘোড়ায় উঠলো। বারান্দা-দেওয়া টুপিটা টেনে দিলো কপালে। সামনে পথের উপরে রায়তদের ছছটো এক জটলা দেখে সেদিকে চললো সে, যেন ভিড়টাকে ভেঙে দিতে। –এখানে কী করছো তোমরা?
তাদের একজন বললো–আমি কৃষ্ণানন্দ। দেওয়ান মনোহর সিং-এর কাছ থেকে ফিরছি। দাদনের সময় যায়, এবার কী বন্দোবস্ত? আমরা কি ধানের দিকে যাবো? বড়োসাহেব মনোহর সিং-এর কাছে শুনতে বলেছিলেন। মনোহর বললো–ছোটোসাহেব ব্যবস্থা করছে।
কীবল ঘোড়ার লাগামে ঢিল দিয়ে ঘোড়র পেটে গোড়ালি দিয়ে আঘাত করে বললো, বড়োসাহেব কিছু না বললে কিছু হবে না।
ঘোড়াটা ক্যান্টারে চলেছে। আচ্ছা, সে ভাবলো, এদিকে প্ল্যান্টেশনের এদিকের সীমায় এসে পড়া গেলো। ঘোড়াটার মুখ ফিরিয়ে বাঁয়ে চক্কর দেবে নাকি? কিন্তু তার মনে পড়লো, বেডশীট দুটোকেই বদলে নিতে হবে। রাগটাকেও। এই ভেবে তার মন থমকে দাঁড়ালো, যদিও ঘোড়া তার হাত ও পায়ের ইঙ্গিতে গ্যালপে চলেছে। তার থমকে-থাকা মন ঘোড়ার খুরের ধপধপ শব্দটাকে যেন গবেষণা করছে।
কিন্তু, আশ্চর্য, ঘটলো কী করে? তখন বিকেল শেষ হচ্ছে। সদর থেকে ফিরে সে কি ক্লান্ত, হাতে পায়ে ব্যথা যেন। বারান্দাতেই ফুলী চায়ের সরঞ্জাম গোছাচ্ছে। দাঁতে বোঁটা চেপে ধরা একটা গোলাপ ঝুলছে চিবুকে। সে নিজে বোধ হয় জিজ্ঞাসা করেছিলো, হোয়াইট কোথায়। ফুলী হেসে তার ইয়ার-ডুপ দুলিয়ে ইঙ্গিত করেছিলো। আটচালা বড়ো হলেও অনেক পার্টিশন কাঠের। গোসলখানা থেকে জলের শব্দ ও ডানকানের মোটা গলার গান আসছিলো। কীবল ফুলীর ডান কনুইয়ের উপরে চেপে ধরেছিলো। ফুলী কিন্তু তার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে হেসেছিলো।
কিন্তু আধঘণ্টা বাদে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে সে নতুন আয়াকে দেখতে পেয়েছিলো, ম্যাকফার্লান আসবে বলে তিন-চার দিন আগে যে নিযুক্ত হয়েছিলো। নীলে সাদা ডুরে খাটো শাড়ি, দাঁতগুলো ছোটো ছোটো, ঝকঝকে সাদা, চোখ দুটো কিন্তু আশ্চর্য রকমের বড়ো। যেন বিছানা ঝাড়ছে। আধঘণ্টা বাদে আবার সেই লণ্ঠন দিয়ে গিয়েছিলো। পোশাক ছেড়ে ডানকানের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার সময়ে তার অনুমান হয়েছিলো, জানলার বাইরে ওপাশের বারান্দায় সে দাঁড়িয়ে আছে।
কীবল বুঝতে পারছে, সে আবাদের অনেক বাইরে এখন। অনেক রোদ যা তাকে স্নান করাচ্ছে যেন। …যখন সে ডিনারে যাচ্ছে সেই আয়া বলেছিলো, সে বাড়ি যাবে কিনা? আর কাজ আছে কিনা? কীবল কোনো উত্তরই দেয়নি।
কীবল বুঝতে পারলো না কখন সে লাগাম টেনেছে। ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার দুই উরুর মধ্যে হাঁপাচ্ছে, কাঁপছে।
ডিনার শেষে ডানকান শিস দিতে দিতে উঠে গেলে সে-ও শিস দিতে দিতে তার শোবার ঘরে ফিরেছিলো। আর তখন দেখেছিলো, শোবার ঘরের অ্যান্টি-চেম্বারের মেঝেতে একটা মমামের আলোর পাশে আয়া বসে আছে। তখন রাত নটা তো বটেই। বাংলো নিঃশব্দ।
এই, খেয়েছো তুমি? দরজা বন্ধ করে দাও। আশ্চর্য যে কত সহজে ঘটে! ঘোড়াটাও, দ্যাখো, আবার গ্যালপ করছে। আর শেষ রাতে সে বলেছিলো, তার নাম মেহের, সে জুড়ান পাইকের তৃতীয় স্ত্রী। ওটাও একটা নিশ্চিন্ত।
সে অবশ্যই জুড়ানকে ভয় করে না। জুড়ান বল্লম সড়কিতে ওস্তাদ। কিন্তু পিস্তলের কাছে? জুড়ান যদি খুলিফাটা হয়ে আবাদে কোথাও পড়ে থাকে, তার এত শত্রু যে তাদের কে দায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর ওটা কি একরকমের নিশ্চিন্তই যে জুড়ানের স্ত্রী শেষরাতে তাকে জানিয়েছে, তার উদরে তিনমাসের বাচ্চা আছে।
কীবল নিজের চারিদিকে চেয়ে বুঝতে পারলো, সে মরেলগঞ্জের সীমার বাইরে তো বটেই, রাজাগ্রামের গঞ্জের কাছে এসে পড়েছে। কী আশ্চর্য, এত কালো, সাধারণ,দাঁতগুলো সুন্দর, শরীর নিটোল, আর এত বোকা যে কিছু গোপন করতে জানে না। তাই বলে একজন কি পরের দিন সকালে উঠেই পালাতে পারে? আর যাই হোক, সে বৃটিশ আর্মির একজন অফিসার ছিলো। কীবল ঢোক গিললো। খুব জোরে জোরে সে ছুটেছে নাকি? ফেঁপাচ্ছে যেন কিছু তার ভিতরে। কিন্তু বেডশীট হয়তো ফুলীই এতক্ষণে বদলে ফেলেছে। রাগটাকে সে নিজেই বদলে নেবে। কী আশ্চর্য, সে, লেফটেন্যান্ট আর্থার হোগাৰ্থ কীবল, কী করে পবিত্রতা হারিয়ে ফেলো?
কীবল তাড়াতাড়ি তার ঘোড়াটাকে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো একটা ঘোড়া আসছে। তার উপরে এক সওয়ার। অবশ্যই সে ডাকঘরে যাচ্ছে না, সে কি এরপরে ম্যাগিকে, অন্তত আজই, চিঠি লিখতে পারে? সামনে বাঁদিকে বরং সেই ক্যাথরীন বাগচীর বাড়ি।
এখন, ক্যাথরীন বাগচীর কুঠির দিকে কেন এসে পড়েছিলো কীবল তা কখনো জানা যাবে না। যদি এ রকম বলা হয়, সে প্রমাণ করতে চাইছিলো মেহের নামে অদ্ভুত সুন্দর, জন্তুপ্রায়, স্ত্রীজন্তুই একজন তাকে চেনার অতীত বদলে দিতে পারে না; আর ক্যাথরীন নামা ইংরেজ মহিলা যদি তাকে আগের মতোই সহাস্যে রিসিভ করে তাহলে বোঝা যাবে সে ময়লা নয়, তাহলে কিন্তু মনের এমন কথা বলা হয় যার প্রমাণ নেই। এর এই এক সমর্থন, সে লাঞ্চের আগে আগে ফিরেছিলো মরেলগঞ্জে, তখন তার কপালে কুঞ্চন ছিলোনা। উল্টো যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। সে লাঞ্চের আগে আগে মরেলগঞ্জে ফিরে গিয়েছিলো, তার ঘোড়াতেই, আর ঘোড়াও ক্যান্টার করছিলো। তখন সে ভাবছিলো–এটা কি খুব ভাবার কিছু? দশ টাকার একট নোট দিলে মিটে যাবে না? দশ টাকা, ত্রিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা? বেশ, আজ রাতে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে এটা এমন ঘটে যাচ্ছে এখানে, জুড়ান পাইক বা ফুলী নতুবা তেমন চোখ পায় কোথায় কালো চামড়ায়? জুড়ান সম্বন্ধে অনেকেই বলে সে মরেলসাহেবের। কিন্তু কাল মেহের বলেছিলো ফুলী জুড়ানের মায়ের বটে, কিন্তু মরেলের নয়। তাহলে? কীবল অবাক হলো আবার–ডানকানেরই! কিন্তু তার মন আবার থমকে দাঁড়ালো–আজ রাতে জিজ্ঞাসা করবে মানে?
কিন্তু সে তখন ঘোটকীটাকে দেখছে। ওয়েলার নয়। মুখটা সরু হওয়ায় ঘাড়টা অপেক্ষাকৃত লম্বা, পাগুলো সরু, যদিও গাঢ় খয়েরি। ঘাম-ধোঁয়ানো নিতম্ব দেখে শক্তির আন্দাজ হয়। ঘোড়াটার পিঠে সুবেশ রূপবান সওয়ার। এটাকেই কি সকাল থেকে খুঁজছিলো? শীতের সকালের রোদে তপ্ত সাদার দাগটানা নীল আকাশের নিচে এমন ঘোটকীটা!
সে নিজেকে বললো–দ্যাখো, দ্যাখো। সে ঝোপটার বাইরে এলো। ছুটন্ত ঘোটকীর পিঠে সেই সওয়ার স্ক্যাবার্ড থেকে লং সোর্ডটাকে টেনে বার করতে চাইছে, কিন্তু সোর্ডটা এত লম্বা যে, দুবার তো তার চোখের সামনেই ঘটলো, তা পেরে উঠছে না। তা করতে গেলে ঘোটকীর বাঁ কানটাই উড়ে যাবে।
অভ্যস্ত ভঙ্গিতে, সে তো ক্যাভালরিরই লোক, কীবল নিজের ঘোড়াটাকে সেই ঘোটকীর প্রায় পাশে এনে ফেলে গ্যালপ করাতে শুরু করে, ক্যাভালরিরই তো কায়দা, বললো–ইউ ডোন্ট ডু ইট লাইক দ্যাট।
অন্য সওয়ার মুহূর্তে ঘোড়ার রাশ টেনে ঘোড়াকে প্রায় পুরো ঘুরিয়ে পাশ থেকে সামনে গিয়ে কীবলের মুখোমুখি হলো, কীবলকেও তখন বিপরীতে চক্কর দিয়ে মুখোমুখি ধাক্কা থেকে নিজেকে আর ঘোড়াকে বাঁচাতে হলো। এক মুহূর্তেই দুজনে দম নিয়ে নিলো। কীবল বললো–আপনি কে হন? প্রিন্স কী? একইসঙ্গে রাজচন্দ্র বললো, তুমি কে? কী তেমন করা যায় না বলছো?
আমি লেফটেন্যান্ট আর্থার হোগাৰ্থ কীবল। ক্যাভালরিতে গ্যালপিং ঘোড়ার উপরে লং সোর্ড টানা হয় না। ঘোড়া এবং পাশের মানুষ ইনজিওর্ড হয়। সেজন্য চার্জের আগেই সোর্ড আনসীফ করা হয়।
কথাগুলো ইংরেজিতে বলে সে প্রিন্সের মুখে বিস্ময় দেখে ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করলো–প্রিন্স ইংরাজি বলেন কিনা?
রাজচন্দ্র খানিকটা বুঝছিলো। সে ফরাসীতে বললো–তুমি কি ফরাসি বলো? একজন দোভাষী পেলে হতো। আমি রায় রাজচন্দ্র খাঁখানা।
রাজকুমার যেন দোভাষীর জন্য এদিক ওদিক লক্ষ্য করলো। তার মুখ ব্যায়ামের ফলে রক্তাভ, এখন যেন খানিকটা বিব্রত হওয়ার কুমারীর ব্রীড়ার মতো রক্ত চলাচল করছে গালে। সে কিছু না বলে অদূরে বাগচীর কুঠিটাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো–কাম।
তার কুঠির এত কাছে দুজনে বলেই বলা যায় ভিন্ন ভিন্ন কারণে তারা বাগচীর বাড়িতেই যাচ্ছিলো।
.
সে সময়ে বাগচী তার স্কুলে ছিলো, মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের ট্যাবুলেশন এবং মডারেশনে সে ব্যস্তই ছিলো। লাঞ্চের পরেই সে বাড়িতে থাকবে স্থির করেছিলো। কেট তাকে বরং সকালের ঘটনাটাকে এ রকম করে বলেছিলো। লাঞ্চের পক্ষে একটু দেরি করেই এসেছিলো বাগচী। কেট বরং অপ্রস্তুত, তার কাজ তখনো শেষ হয়নি। সুতরাং এসো, এসো, কিচেনেই বসো। যেটুকু বাকি তা করতে করতে গল্প করবো। বলে বাগচীকে কিচেনে বসিয়ে কেট বললল : সে তখন সেই লাল সার্জটাকে কাটার জোগাড় করে নিয়েছে, এমন সময় দুজন পুরুষকে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে বিস্ময়ে বাকবন্ধ তার। দুজনেরই মুখ লাল। কপালে ঘাম, দুজনের মাথাই যেন তাদের পার্লারের সিলিং ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একজনের পরনে শালের আচকান,শালের চুস্ত, কুঞ্জাদার মুরেঠা, কোমরে লম্বা সোর্ড। আর একজনের পরনে ফ্ল্যানেলের রাইডিং কোট, ব্রিচেস, হাতে রুপো বাঁধানো ক্রপ। বাগচী মিটমিট করে হেসে বললো–একজন তো রাজকুমার। তখন কেট হেসে বলেছিলো, রাজকুমার হেসে বললেন, কেট, মিট মাই ফ্রেন্ড লেফটেন্যান্ট কীবল, মাই ফ্রেন্ড মিসেস ক্যাথরীন বাগচী। আমার ইংরেজি ফুরিয়ে গেলো। কীবল আমাকে কিছু শেখাতে চায়। তুমি প্রথমে ক্লান্তদের কফি খাওয়াও, পরে দোভাষীর কাজ করো।
কেটের শুধু বিস্ময় নয়, ভয়-ভয়ও করছিলো। কিন্তু গল্পটা বলতে গিয়ে সে অনুভব করলো, তা বোধ হয় বলা যায় না। ভয়ই কি সেটা? কীবলের চাহনিতে কী যেন ছিলো যাকে আগ্রহ জাতের কিছু বলা যায়। এবং তাতে তার মনটা যেন কেমন শিউরে উঠছিলো। যাই হোক, কী করা উচিত বুঝতে না পেরে কেট কফি করতে চলে গিয়েছিলো। ভাবছিলো, সে সময়ে কী না ঘটে। কিন্তু দু মিনিটেই পিয়ানো বাজতে শুনেছিলো। তা যে রাজকুমার তা বুঝতে পেরেছিলো।
কেট কফি নিয়ে এসেছিলো। ততক্ষণে কীবল রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে ফেলেছে, রাজকুমার পিয়ানোর টুল থেকে উঠে এলেন। কিন্তু কফি নামাতে গিয়ে কেট দেখলো সেই সেন্টারপিসটার উপরে লাল মখমলে ঢাকা একটা প্রকাণ্ড তরোয়াল। রাজকুমার সেটাকে কোলে নিয়ে বসলে কফি খাওয়া শুরু হলো। আর আলাপও। দোভাষী হিসাবে তাকে মাঝখানে বসতে হয়েছিলো।
রাজকুমার একবার জিজ্ঞাসা করলেন, কীবল আধুনিক যুদ্ধে যোগ দিয়েছে কিনা? যখন গোলাগুলি চলতে থাকে তখন ঘোড়সওয়াররা কীরকম ভাবে অগ্রসর হয়? কীবল বলেছিলো বটে ঘোড়া ছোটানোর আগেই তরোয়াল হাতে নেওয়া হয়, ঘোড়াই বা কী। গতিতে চলে?
এটাকে কেট ইংরাজিতে অনুবাদ করে দিলে কীবল যা বলেছিলো তা ক্রিমিয়ার গল্প। শদলের ব্যাটারি দখল করতে তাদের ক্যাভালরি চার্জ করেছিলো। শত্রুরা প্রস্তুত ছিলো এটা। জানা ছিলো না। ফলে সাতশো জনের মধ্যে তিনশো জন ফিরেছিলো মাত্র। তখন মনের অবস্থা কী রকম হয় বলা যায় না। নেশা, ভয়, পিছুটান, সম্মুখবেগ সবই থাকে। জীবনের প্রথম। নারী কিংবা প্রথম বেত্রক্রিয়ার কথা মনে এসে যেতে পারে, কিংবা নিজের ঘরের কথা। কিন্তু ঘোড়ার উন্মত্ত গতি; কামানের শব্দ, আঘাত; সঙ্গীদের আর্তনাদ ও রাগের চিৎকার; অফিসারদের চিৎকার করে বলা নির্দেশ; তরোয়াল, বল্লম, লাগাম ঠিক করে রাখা; গোলার গর্ত, পড়ে যাওয়া সঙ্গীকে ও তার ঘোড়াকে টপকে যাওয়া; দুপাশের ঘোড়ার ধাক্কা থেকে নিজেকে ও ঘোড়াকে বাঁচানো–অন্য সবকিছুকে মন থেকে তাড়িয়ে দেয়।
কেটের বেশ স্পষ্ট মনে আছে এই কথাগুলো বলতে বলতে কীবল যেন অতীতকে মনে এনে উত্তেজিত হয়েছিলো। কেট প্রত্যেকটা বাক্যের বাংলা অনুবাদ করে যাচ্ছিলো। এই জায়গায় থেমে কীবল বলেছিলো, অফিসাররা ঘোড়ায় ওঠবার আগেই তরোয়াল খুলে হাতে নেয় বটে, কিন্তু এই রকম নয়, এটা ক্যাভালরির তরোয়াল নয়।
কেট এটাকে অনুবাদ করে দিলে রাজকুমার বলেছিলো, এটা ক্যাভালরির কেন হবে? পিয়েত্রোর দ্যাখো, লেফটেন্যান্ট, এটায় সোনার অক্ষরে পিয়েত্রোর নাম লেখা আছে। এই বলে রাজকুমার খাপসমেত তরোয়ালটাকে কীবলের হাতে দিয়েছিলো। কীবল খাপ থেকে তরোয়াল বার করে সোনা দিয়ে এমবস করে লেখা জাঁ পিয়েত্রো দেখে বলেছিলো, আশ্চর্য, এটা সেই ওয়াইলি ফকস পিয়েত্রোর? কেটের নিজের দ্বিধা হচ্ছিলো, পিয়েত্রোকে যে ফকস বলা হলো তা অনুবাদ করা চলে কিনা। কিন্তু রাজকুমার বলেছিলো, কেট, ডারলিং, ফকস মানে আমি জানি। তুমি হয়তো পিয়েত্রোকে রোঁয়া-ওঠা একটা উলফ মনে করো। তা হোক, তুমি বলো, এটা পিয়েত্রো পায়ে দাঁড়িয়ে ভাজতেন।
কেট অনুবাদ করলে কীবল বলেছিলো, তা কীকরে হবে? এ তো ফেনসিং-এর উপযুক্ত নয়।
কেটের তর্জমা শুনে রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে তরোয়ালটা খাপসমেত নিজের হাতে নিয়ে মুঠি ধরে তাকে টেনে বার করলো। তখন কেট লক্ষ্য করেছিলো, রাজকুমার কীবলের চাইতেও কয়েক ইঞ্চি লম্বা। রাজকুমার হেসে বললো, কিছুক্ষণ আগেই তো এটাকে নিয়ে খেলছিলাম। তাকেই তো ফেনসিং বলে, না কী?
কেটের অনুবাদ শুনে কীবল বলেছিলো, না, রায় খানখানান, তা আপনার পক্ষে উচিত হবেনা। এটা ফেনসিং-এর ফয়েলনয়। এত ভারি এবং ধারালো তরোয়াল যে এতটুকু ভুলেই খেলার সঙ্গীর প্রাণ যাবে। ফেনসিং-এর তরোয়াল হাল্কা, তুলনায় ছোটো হয়, ধার প্রায় থাকেই না। সে রকম ফয়েলের জন্য কলকাতায় খোঁজ করতে হয়।
রাজকুমার শুনে ভাবলো। পরে বলেছিলো, কেট, জিজ্ঞাসা করো, আমি কলকাতা থেকে ফয়েল আনিয়ে নিলে লেফটেন্যান্ট আমাকে ইংরেজি তরোয়াল চালানো শেখাতে পারে কী না, আর তা শেখালে কত করে কী নেবে?
কেটের তর্জমা শুনে কীবল বলেছিলো, আপনি আনিয়ে নিন, আমি যথাসাধ্য করবো যদি আপনি ইংলিশ স্টাইলটা শিখতে আগ্রহী থাকেন।
কেট এই জায়গায় আর একবার প্রস্তাব করলে রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, কীবলকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দাও।
কীবল বলেছিল, প্রিন্সকেও ধন্যবাদ। এখন বিশ্বাস করছি, ডানকান যেমন বলেছিলো, আপনার মতো লোক না থাকলে পিয়েত্রো এখানে রক্তপাত ঘটাতে।
কেট এটাকে অনুবাদ করলে রাজকুমার বেশ জোরে জোরে হেসে উঠলো। বললো, তা বটে, তা বটে। একবার পার্লারে পায়চারি করলো, তারপর কীবলের সামনে এসে বাও করে বললো, মের্সি, শের আমি, বঁজুর মঁশিয়ে লেফতেন্যান্ত।
.
০৩.
কীবল লাঞ্চের জন্য ফিরতে ফিরতে কী ভাবছিলো তা বলা হয়েছে। সে যখন মরেলগঞ্জের কুঠির সামনে তখন ভাবলো, ডানকানের ব্যাপারটা ভাবো। উত্তেজনার মুখে কী করে বোঝালো মেহের, ফুলী জুড়ানের বোন হতে পারে, কিন্তু ডানকানের মেয়ে, যদিও সঙ্গে ঘুমোয়। এ কি অ্যাবসলিউট পাওয়ারের লক্ষণ? যা হোক, এটা তো আর মাস দুয়েকের ব্যাপার, তারপর জুড়ানের কাছে ফিরবে, তখন তো ভুলেও যাবে। গোটা দু-তিন গিনি দিলেই যথেষ্ট। কিন্তু কনডিশন, জুড়ান জানলে চলবে না। একই গাধায় সে আর জুড়ান চড়েছে এটা গোপন রাখা চাই।
যখন সে কুঠির সামনে নামবে, ঘোড়র উপরে থাকায়, দৃশ্যটা কীবলের চোখে পড়লো। একটা ছোটো শোভাযাত্রা যেন এগিয়ে আসছে। কিন্তু ঘোড়া থেকে নেমে সে একটু বিষণ্ণ বোধ করলো আবার। মনে মনে বললো– : ম্যাগি, তুমি নিজেই বলেছিলে তুমি সোলজার, তারা একটু এদিক ওদিক করে, কিন্তু সাবধান, খোরপোষ করতে না হয়। যা শুনি সেখানে তো সবই নেগ্রেস। …তাছাড়া, দ্যাখো, কেট কিছু মনে করেনি।
কীবল অবাক হলো, শোভাযাত্রাটা সুরকির পথ ধরে তাদের বাংলোর কাছাকাছি এসে পড়েছে। সামনের লোকটি কি পাগল? গায়ে কামিজ, কিন্তু কোমর থেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার হাত দুখানা পিঠমোড়া করে বাঁধা, বোধ হয় তারই ধুতিতে। তার বাহু আর পিঠের মধ্যে একটা লাঠি ঢোকানো আর সেই লাঠিটাকে দু প্রান্তে ধরে দুজনে লোকটিকে সামনে ঠেলছে। তারা হাসছে। সেই উলঙ্গ লোকটি ভাঙা গলায় অব্যক্ত চাপা আর্তনাদ করছে।
সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলোকীবল। তারা আর একটু কাছে আসতে কীবল চিনতে পারলো, পিছনের লোকদের মধ্যে একজন জুড়ান পাইক। সামনের লোকটিকেও চেনা-চেনা মনে হলো। একটু ঠাহর করে দেখে নামটা মনে পড়লো। এই সেই অমর্ত্য দাস। লোকটি একদিন ফ্যাক্টরির কাছে খুব প্রতিবাদ করেছিলো বটে। লোকটি ধার্মিক, অবশ্য পেগানরা যেমন হয়, আর কিছু কিছু লেখাপড়াও জানে। আর এখনো তো বোঝাই যাচ্ছে, পাগলরা ধরা দেওয়ার আগে যেমন করে, তেমন ধস্তাধস্তি করে থাকবে, সেজন্য তার গায়ে ধুলো এবং রক্ত।
কীবল বললো–আহা জুড়ান, পাগলকে কষ্ট দেয় না। তাছাড়া এই কুদৃশ্য এদিকে কেন?
কথাটা বলে পিছন ফিরে সে দেখলো, তার আশঙ্কা সত্য হতে চলেছে। ঘেরা বারান্দার জালের ওপারে ফুলী দাঁড়িয়ে, যেন উপভোগ করছে।
জুড়ান জানালো, এখনো পূর্বদিকের গ্রামটাতে ঘোরানো হয়নি। এর আত্মীয়স্বজনরা সেদিকেও আছে, তারা দেখবে না? মুহূর্তে কীবল বুঝতে পারলো, সেটা পাগলকে আটকানোর ব্যাপার নয়। উদ্দেশ্যটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা এক অভূতপূর্বশয়তানী জুড়ানের।
লাঞ্চে সে ডানকানকে বললো, ডানকান প্রথমে না জানার ভান করলো। পরে বললো, মারধোর করলে কমিশন দোষ দেখবে। এটা কি এমন অপরাধ পিনালকোডে কোনো ধারায় পড়বে? সে হাসলো। পরে আবার বললো, যাই হোক লোকটা অসন্তোষ ছড়ায়। তুমি চিনে রাখলে ভালো করবে। রায়তদের বলছে, দাদন নিও না, ঋণ নিও না। পিছিয়ে পিছিয়ে যাও, এড়িয়ে এড়িয়ে চলো।
বুদ্ধিটা তবে তোমার? কীবল জিজ্ঞাসা করলো।
ডানকান হো হো করে হেসে বললো, বিশ্বাস করো, তা নয়।
কীবলের একবার মনে হলো, পুরুষের কি এত চাইতে বড়ো অপমান আছে?
কিছুক্ষণ পরে আবার তার মনে হলো, এ অবস্থায় ভারতীয় স্ত্রীলোকেরাও বোধ হয় রটায় না। তাছাড়া এই তো ডানকানও, সেখানে কেট এমনকী প্রিন্স যেমন, কেউই কিন্তু তাকে দেখে কোনো পার্থক্য বুঝতে পারছে না।
.
লাঞ্চের শেষে কেট ও বাগচী পার্লারে বসবে ঠিক করলো। বাগচী জানালো, তখন আর সে স্কুলে যাচ্ছে না। কেট জানালো, বাগচীর আপত্তি না থাকলে সে সার্জের জামাটাকে কাটা শেষ করবে। বাগচী জানালো, তা করতে করতে কেট যদি গল্প করে তবে বাগচীর আপত্তি থাকবে না।
কিন্তু পার্লারে ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য আবার তারা পুরনো কথায় ফিরে গেলো।
বাগচী বসতে গিয়ে অবাক, বললো–আরে এ কি? এই দ্যাখো, এটাই কি সেই তরোয়ালটা রাজকুমারের, যার গল্প করছিলেন? কী কাণ্ড!
কেটও অবাক। বললো–আচ্ছা অন্যমনস্ক তো রাজকুমার। এখন কী হবে?
বাগচী বললো–তুমিও কম অন্যমনস্ক নও! নইলে এর আগেই দেখতে পেতে। কিন্তু। এখন? এ তো মারাত্মক ব্যাপার। দিয়ে আসবো? নাকি কাউকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে রাজকুমারের কাছে জানতে চাইবো? রসো, না হয় শোবার ঘরের কার্ডে রেখে আসি।
বাগচী খাপসমেত তরোয়ালটা শোবার ঘরে রাখতে গেলো। তখন কেট আবার একটু ভাবলো। তার মুখ তো চিন্তার ফলেই উজ্জ্বল। তার সেই সকালের দৃশ্যটা মনে এলো, পাশাপাশি যেমন কীবল ও রাজকুমারকে দেখেছিলো। সুন্দর! দুজনকেই দু রকম সুন্দর দেখাচ্ছিলো। তফাতও আছে। তার আবার মনে পড়ল,কীবলের চোখ দুটিতে যেন নেশার মতো কোনো আগ্রহ ছিলো। অন্য দিকে রাজকুমারের চোখ দুটি যেন দূরকে দেখছিলো। নাকি অস্থির বলবে? অস্থিরতাই বোধ হয়। দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে কফি করতে গিয়ে সে তো নিশ্চয়ই আশঙ্কা করছিলো, সেই আতপ্ত উত্তেজিত পুরুষ দুটি কী বা ঘটায়! কিন্তু তার মধ্যেই হঠাৎ পিয়ানো শুনেছিলো। কেটের মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হলো।
বাগচী ফিরে বললো–দ্যাখো, একজনের যা খেলার, অন্যের তাতে কত ভয়?
কেট বললো, কিন্তু জানো একটা কথা? কীবল সৈনিক, সে বোঝে। এ নিয়ে কি রাজকুমারের ফেনসিং খেলা উচিত হচ্ছে?
বাগচী ভাবলো, এটা কি ছেলেমানুষের অজ্ঞতা? তাহলে কি আজ সন্ধ্যায় দেখা করে এটাকে খেলায় ব্যবহার করতে নিষেধ করবে? বললো–তুমি একটা অসুবিধায় ফেললে, ডার্লিং ।
কেটও ভাবছিলো। সে বুদ্ধি করে বললো, এক কাজ করলে হয়। আমি কী নয়ন ঠাকরুনকে বলে দেবো?
এই সময়ে কেট ভাবলো, এসব কি রাজকুমারের অস্থিরতা? নাকি চপলতা বলবে? নাকী কিছু না ভেবে যেদিকে খুশি বয়ে যাওয়া?
সময় তখন সন্ধ্যার দিকে। আলোর রাত নয়, অন্তত চাঁদের আলো থাকলেও নিতান্ত ক্ষীণ ছিলো। বাগচীইতিমধ্যে তার স্টাডিতে, কেট সন্ধ্যায় কফি তৈরীকরতে কিচেনে। কেট শুনতে পেয়েছিলো, পার্লারে কারা কথা বলতে বলতে ঢুকছে। সে বেরিয়ে এসে আপাদমস্তক চাঁদরে ঢাকা নয়নতারা এবং পুরো ইংরেজি পোশাকে রাজচন্দ্রকে দেখতে পেলো। তার উচ্চকণ্ঠের অভ্যর্থনার সাড়া পেয়ে বাগচীও বেরিয়ে এসেছিলো।
তাদের বসিয়ে বাগচীকে সেখানে রেখে কফি করে আনলো কেট।
রাজচন্দ্র তখন বললো, দ্যাখো, কেট, কেমন ধরে এনেছি। বাড়ি ফিরছিলেন দিনের কাজ শেষ করে। আমি তো বাপু আজ আমার বেতো চওড়া পিঠের ঘোড়াকে ব্যায়াম করাবো বলে রাস্তার পাশ দিয়ে চলেছিলাম। এদিকে পালকিটা দেখি রাজকুমারকে অগ্রাহ্য করে সার্বভৌমপাড়ায় ঢোকে। থামাতে হলো। তো দেখি পাতার আড়ালে ঘুমন্ত ফুল। বললুম, চলল, না হয় একটু ঘুরি। রাজী কি হয়? শেষে বললুম, যা কখনো দ্যাখোনি তাই দেখাবো। পিয়ানো বাজাবো তোমার সামনে। অবশ্য পথে অন্য সমস্যাও উঠেছে।
নয়নতারা নিভৃতে কেটকে চোখের ইশারা করলো, যেন বললো, সবটুকু বিশ্বাস করবে কি?
উৎসাহিত কেট বললো–তাহলে কফির পরে পিয়ানো হোক। সকালে যেটা একটু হচ্ছিলো।
রাজচন্দ্র বললো–আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে মাস্টারমশাই আমাদের মামলাটা শুনুন।
নয়নতারা বিপন্ন বোধ করলো। কিন্তু এই বুদ্ধি করলো, বাধা দিলে উল্টোপাল্টা ফল হবে, অনেক অর্ধসত্য রসিকতাচ্ছলে বলে যাবেন রাজকুমার। মুখে কিছু আটকাবে?
রাজচন্দ্র বললো, মামলার বিবরণ দেওয়ার আগে একটা ফয়সালা হোক। একজন জমিদার তার প্রজাকে নিঃশর্ত কিছু দান করতে পারে কিনা?
এটা তো একটা হাল্কা মেজাজের কিছু, যা খেলার মতো। বাগচী বললো–দানের অধিকার সকলেরই আছে, আর তা নিঃশর্ত হওয়াই উচিত।
নয়নতারা নিচু গলায় বললো, মাস্টারমশাই ডিক্রি দিলেও, রাজকুমার, মামলাটা উঠে যায় না। দানটা যদি জমি হয় তবে বুঝতে হবে রাজকুমার তা অন্য কোনো প্রজার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দান করবেন।
হাসিমুখে বাগচী বললো–তাহলে আমি বোধ হয় ভুল করেছি। এ কথাটাও ঠিক বটে, রাজকুমারের সব জমিই কোনো না কোনো প্রজার দখলে থাকার কথা। মামলার বিবরণটা শোনা দরকার।
রাজচন্দ্র বললো–জনৈক মহিলার প্রিয়জনের পাপস্খলনের জন্য এই বৈশাখে জলদানের ইচ্ছা দেখা দিয়েছে। জলদান নাকি প্রাণদান। জলদানের সব চাইতে ভালো উপায় দীঘি খুঁড়ে দেওয়া। দীঘি তো শূন্যে হয় না। জমিতে হবে। আর জমি দীঘি হয়ে গেলে সেখানে চাষের জমি কিংবা বসত বাড়ি আর থাকে না। এখন সেই মহিলার ধারণা চাষের জমি কিংবা বসত বাড়ি নাকি শুধু তাই নয়, অনেক স্মৃতিতে জড়ানো নিজের জীবনের অংশ।
বাগচী বললো–তো বটেই। একথা একশোবার সত্য।
-সেই মহিলার মতে প্রত্যেক পুরুষের একমুঠো মাটি থাকা দরকার, যা তার জীবনের দুর্গ, যা গেলে নাকি তার পৌরুষেরও কিছু থাকে না।
বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–জমিদার যদি জমিটা কিনে নেন দান করার আগে?
–সে নাকি আরো খারাপ। তা নাকি টাকার প্রলোভনে নীতিভ্রান্ত করা। ঘুষ দিয়ে দুর্গ দখল। বাগচী এক মুহূর্ত ভেবে নিলো। আন্দাজ হচ্ছে এটা রাজকুমার এবং নয়ন-ঠাকরুনের মধ্যে কোনো ব্যাপার। হয়তো লঘু প্রমোদও আছে। সে বললো, রাজকুমার যদি গ্রামের মাঝখানে একটা দীঘি কাটিয়ে দেন তাহলে কিন্তু জনসাধারণের উপকারই হয়।
নয়নতারা বললো–রাজকুমার, আপনি না হয় আপনার আর্জিটা মাস্টারমশাইকে দিয়ে যান। উনি দেখবেন। কফি খাবেন না কী বলছিলেন? কিংবা নাকি বাজনা হবে?
বাগচী বললো–ও, হ্যাঁ। রাজকুমার আপনার সেই তরোয়ালটা। সেটা তো এখানেই রয়েছে।
কেট বললো–রাজকুমার, ও কফিটা আপনি খাবেন না, জুড়িয়ে গিয়েছে। আমি আবার করে আনছি।
কেট কফি করতে উঠলো। বাগচী তরোয়ালটা আনতে গেলো। রাজকুমার উঠে পিয়ানোর দিকে গেলো। বাগচী তরোয়াল এনে সোফার উপরে রাখলো। রাজকুমার পিয়ানোর ডালা খুলে কিছু ভাবছে তখন। নয়নতারা একেবারে স্থির হয়ে বসে।
কিন্তু পার্লারের দরজার কাছে এসে কেট নয়নতারাকে ডাকলো। নয়নতারা সেদিকে উঠে গেলো। কিছুক্ষণ তারা কিচেনেই আলাপ করলো সম্ভবত। কেট কফি নিয়ে ফেরার আগে নয়নতারা ফিরলো না।
কেট টিপয়ে কফি রাখলে রাজচন্দ্র সেদিকে এসে বসলো।
রাজচন্দ্ৰ কফি নিলে নয়নতারা বললো–একটা কথা বলবো। ভরসা দেবেন? এ ব্যাপারে মাস্টারমশাই আর কেটও আগ্রহী। কীবল নামে একজন গোরা সিপাহী নাকি আছে। সে নিশ্চয় আমাদের চাইতে ভালো চেনে অস্ত্রশস্ত্র।
রাজচন্দ্ৰ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো–সন্দেহ কী? নইলে কি বাহাদুর শা, কি নানা এমন মার খায়? অন্তত ব্রিচলোডার রাইফেল আরো সংগ্রহ করা উচিত ছিলো নামার আগে।
নয়নতারা বললো–আমি শুনেছি কদার সঙ্গে সকালে রোজ তরোয়াল খেলেন আজকাল?
–তাতে কী?
-কীবল বলেছে, কেটও এখন বলছে, এই ধারালো তরোয়াল নিয়ে তা উচিত হয় নানয়নতারা বললো।
বাগচীও বললো–হ্যাঁ, রাজকুমার, নয়নতারা-ঠাকরুন এ বিষয়ে ঠিকই বলছেন।
নয়নতারা হাসতে গেলো, কিন্তু তার স্বরটা গাঢ় হলো। বললো–এটা আমাকে দান করতে হবে, রাজকুমার।
রাজকুমার একটু বিস্মিত হয়ে বললো–ও! কিন্তু সে নয়নতারার মুখের দিকে চাইলো। একমুহূর্ত পরেই হেসে বললো, মাস্টারমশাই, আপনি সাক্ষী, নয়নতারা আমার দান নিতে রাজী হয়েছে। তা হলে বলো, দীঘিটা কোথায় হচ্ছে, কতটা লম্বা চওড়া হবে?
বাগচী ও কেট এতক্ষণের আলাপের এদিকে গতি দেখে কৌতুক ও আনন্দে হাসিমুখে বসে রইলো। কিছু বলতে ভুলে গেলো। নয়নতারা নিচু গলায় চোখ নিচু করে বললো–তাই যদি শর্ত হয় হোক, তাহলে কিন্তু এটা আর খেলা হবে না।
সেদিন কিন্তু পিয়ানো বাজানো হলো না। রাজচন্দ্র পিয়ানোর কাছে গেলো, পিয়ানোর ডালা খুলে বললো–সেই সকালেরটাই বলছো? তাহলে তোমরা কাছে এসো। কিন্তু পিয়ানোর ডালায় আটকানো রূপার ফলকটা আর তাতে লেখা নামটা এই সময়ে তার চোখে পড়লো। রাজচন্দ্র বললো–দেখে যাও নয়ন।
নয়নতারা কাছে গেলে বললো–দেখছো? এটা একটা বিলিতি নাম। উচ্চারণ বাইচে। বলল তো কেন? পিয়েত্রোরা শুধু তরোয়ালবাজ ভাবলে ভুল করবে। এটা তার প্রেমিকার নাম। এই নামে তিনি ডাকতেন তাকে। কেটও বিস্মিত হলো। নয়নতারা তোহবেই। কেটের বাড়িতেই তো পিয়েত্রোর এই পিয়ানো রাখা হয়েছিলো।
পুরনো প্রেমকে লোকে ঠাট্টা করতে পারে। নয়নতারা বললো–সেই ফরাসী মহিলা কি এদেশে আসতে রাজী হয়নি?
রাজচন্দ্র বললো–তাহলে আর একটু গোড়া থেকে বলতে হয়। পিয়েত্রোর জননী ভারতীয় মহিলা ছিলেন তা কি তার আনুকূল্যে বসানো এই স্কুল থেকে আন্দাজ করতে পারোনি? মায়ের নাম পিয়েত্রো আমাকে বলেননি বটে, কিন্তু আমার ধারণা তার নাম জ্ঞানদা ছিলো। পিয়েত্রোর মামা ছিলেন এক স্মার্ত ব্রাহ্মণ। তিনি তাঁর বিধবা বোনকে পিয়েত্রোর পিতার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে স্বদেশ ও স্বসমাজ ত্যাগ করেছিলেন। পশ্চিমের কোনো তীর্থশহরে বাস করতেন বলে ধারণা হয়। তখন পিয়েত্রোর বয়স হয়েছে, চল্লিশের দিকে চলেছে। জাহাজের ব্যবসা করেন। এদেশের রেশম ও মসলিন ইউরোপে পাঠান; উত্তর-ভারতেও বন্দুক, ব্রোকেড ও রেশমের ব্যবসা করেন। পিয়েত্রো কখনো কখনো সেই স্মর্তবাড়িতে যেতেন। সেই স্মাৰ্তমশায়ের পরিবারের কন্যাদের ফরাসিনী না হয়ে স্মার্তকন্যা হওয়াই স্বাভাবিক। চোখে চোখ না পড়লে ভালোবাসাও হয় না। নিজের মনের মতো করে নাম রাখাও যায় না। ওদিকে স্মার্তকন্যারা যে কী নির্দয় হতে পারে!
স্মার্তকন্যা নয়নতারার ভ্রুকুটি কেট ও বাগচী লক্ষ্য করলো না, কারণ কটাক্ষটা হলো শালের অবগুণ্ঠনের ভিতর থেকে।
বাগচী বললো, পিয়েত্রোর কাছে আমি যা শুনেছি তাতে মনে হয়, এটা চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের কথা।
রাজচন্দ্র বললো–তা হতে পারে। সেখানেই পিয়েত্রো সেই ফুটফুটে ননীর পুতুল হেন চতুর্দশীকে দেখে থাকবে, আর সঙ্গে সঙ্গে,তার নিজের ভাষায়, নিজের হৃদয় দুহাতে উপড়ে সেই বালিকার পায়ে রেখেছিলেন। আসলে তার তো আর ইটালীয়ান নাম হয় না। তাকে না পেয়ে অতৃপ্ত মধুর যন্ত্রণায় এক ইটালীয়ান মহিলার স্মরণে তার নাম রেখেছিলেন। বিয়াত্রিচে, যেটা সংক্ষেপে এই বাইচে।
কেট বললো–এমন একটা ছোট্ট মেয়েকে পিয়েত্রোর হৃদয় দেওয়া উচিত হয়নি।
বাগচী বললো–কেট, আমি কিন্তু আসল বিয়াত্রিচেরও এরকম বয়সই ছিলো বলে পড়েছি। তাছাড়া ভালোবাসা বোধ হয় বয়সকে গ্রাহ্যে আনে না। তাকে যখন চিকিৎসা করতাম, পিয়েত্রো বলেছিলেন, সেই বালিকার প্রেম চাপার সুঘ্রাণের চাইতেও সুন্দর ছিলো, এমনকী সর্বশ্রেষ্ঠ ফরাসী মদের বোকেও তার তুলনায় কিছু নয়।
কেট বললো–এটা কিন্তু ফরাসী অতিশয়োক্তি, যদিও সুন্দর।
— নয়নতারা বললো–শেষ পর্যন্ত কিন্তু বয়সের, ধর্মের ব্যবধান বাধা হয়।
বাগচী বললো–আমার তা মনে হয়নি। সেই মহিলা ছিলেন পিয়েত্রোর সেই স্মাৰ্তমামার মেয়ে। হিন্দুদের মধ্যে এ রকম সম্বন্ধ থাকলে বিবাহ হয় না।
বাগচী তার পাইপ ধরালো। রাজচন্দ্র পিয়ানোর উপরে আঙুল রাখায় তার ঝংকার উঠলো। কিন্তু সে বরং কেটের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো–গুড নাইট কেট, এরপরে বাজালে চাপার সুঘ্রাণটা থাকে না। অন্য একদিন এসে সকালের সেই বাজনার স্কোর তোমাকে দিয়ে যাবো। ভালোই। আমি নাম জানতাম না। শ্যা নামে একজনের।
রাজচন্দ্র উঠে তরোয়ালটাকে কোমরে বেঁধে নিলো। নয়নতারা হেসে বললো–এ পোশাকেও তো ওটা বেশ মানায়। তারা দরজার দিকে গেলে বাগচী ও কেট তাদের এগিয়ে দিতে গেলো গেট পর্যন্ত। এই সময়ে কেট দেখতে পেলো পায়রার ডিমের রং-এর শালের ঘোমটা মুখের দুপাশ বেয়ে নেমে এমনকী হাত দুখানাকে ঢেকে নয়নতারার হাঁটু অবধি নেমেছে। শালের ঘেরের নিচে লাল স্বচ্ছ শাড়ি। সারা গায়ে অলঙ্কার নেই, কিন্তু জুতা ছাড়া সুন্দর পা দুটোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেই যেন একজোড়া সুন্দর অ্যাংকলেট, তা সোনারই হবে। রাজকুমারের গায়ের জ্যাকেটটার গাঢ় আকাশী রং, ট্রাউজার্সটার নীলে সাদা টান। একটা ঘোড়া বাঁধা আছেবটে। বাইরের সন্ধ্যা তো এখন প্রায় গাঢ় খয়েরি। চাঁদ আলো করতে পারছে না। কেট শুনলো, নয়নতারা বলছে, পালকিটাকে তাড়িয়েছেন দেখছি।
নয়নতারা ও রাজকুমার হাঁটতে শুরু করলো। ঘোড়াটা নিজে থেকেই পিছনে চললো।
কেট ঘরে ফিরতে ফিরতে সুখী মুখে ভাবলো, রাজকুমার যেমন বলেছিলেন ঘোড়াটাকে। চওড়া পিঠের মনে হচ্ছিলো। তাহলে তারা সরে গেলে রাজকুমার কি নয়নতারাকেও ঘোড়ায় তুলে নেবেন?
.
০৪.
এ রকম সংবাদ আছে, সেই বৎসরের শীতেই সেই প্রথম অ্যালবেট্রস নামে স্টিমশিপ রাজনগরের নদীতে চলাচল করেছিলো, কুতঘাটে একবেলা থেমেছিলো। যে রাজনগরের কাছাকাছি রেলরোড ছিলোনা তখন, যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের কাছে স্টিম-এঞ্জিন মাত্রই তখনো গল্পের বিষয়, সেই এক কুয়াশা-আচ্ছন্ন নদীর বুকে ভোরের অস্পষ্টতার সেই কলের জাহাজ তার আলো এবং হর্ন, এবং কালো আকৃতি নিয়ে নিশ্চয়ই বিস্ময়, কৌতূহল এবং অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করে থাকবে। তা যেন এমন এক একচক্ষু জলদানব যার অশুভ উচ্চ ছাগনিনাদের কথা এমনকী কোনো কাব্যে-পুরাণেও বলা যায়নি। হরদয়ালের চিঠিপত্র থেকে একটা মন্তব্য পাওয়া যায় :
স্টিমশিপ অবশ্যই উন্নয়নের সহায়ক হইবে। ব্যক্তিগতভাবে এই প্রচেষ্টাকে আমরা সমর্থন করি, কেননা যেখানে নদীপথ আছে সেখানে রেলপাতার তুলনায় স্টিমশিপ লাইন প্রবর্তন অনেক কম শ্রমে ও অনেক কম ব্যয়ে হইতে পারে। কিন্তু বলিব কী, হয়তো বহু দিনের সংস্কারে মনে হইল সব দিক দিয়া আচ্ছন্ন হইলেও হয়তো বা রক্তে কোথাও আরোগ্যের বীজ ছিলো, কিন্তু এই স্টিমশিপ যেন নদীরূপ শিরা বাহিয়া দেশের অন্তঃকরণকেও আক্রমণ করিল। কিছু আর অজিত রহিল না।
এই স্টিমশিপ কেন এসেছিলো তা নিয়ে মতদ্বৈধ কিছু আছে। অ্যালবেট্রস জাহাজ যে একবেলা কুতঘাটে ছিলো সে ঠিক নয়। কারণ সেটা পরে নিয়মিত কয়েকবার এসেছিলো। এরকম মত আছে এই অ্যালবেট্রস স্টিমশিপে সেই শীতেই পরে জঙ্গীলাট এসেছিলো রাজনগরে। জঙ্গীলাট যে এসেছিলো এবং প্রায় এক সপ্তাহ ছিলো রাজনগরে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে : রাজবাড়ির সেই বুলন্দ-দরওয়াজার অনুকরণে তৈরী সদরদরজার সামনে রাখা ক্যারেজসমেত দুটি গান মেটালের কামান। কামানের চোং-এ মেরামত করা ফাটল থেকে তার ব্যবহারযোগ্যতা সম্বন্ধে নিশ্চয় সন্দেহ করা যায়। কিন্তু তার গায়ে খোদাই করা সংবাদ থেকে জানা যায় কামান দুটি কানপুরকে বিদ্রোহমুক্ত করতে ব্যবহার হয়েছিলো। এবং তা জঙ্গীলাটের উপহার। অ্যালবেট্রস জঙ্গীলাটকে নিয়ে যাওয়া-আসা করেছিলো তা প্রায় নিশ্চিত।
প্রথমবার তা হয়তো জলপথের গভীরতা নাব্যতা ইত্যাদি পরীক্ষা করতেই এসেছিলো, পরে কিছুদিন কিন্তু মাঝেমাঝেই আসতো, অন্তত যতদিন শীতের ভাবটা ছিলো। বসন্তের মাঝামাঝি হঠাৎ একবার চলে গিয়ে আর আসেনি। ডুবেছিলো কি? পরে, তা অনেকদিন পরেই, অন্য জাহাজ চলতো এই লাইনে। কিন্তু এটা সম্ভব নয় যে ইন্ডিগো কমিশনের সাহেবরা এসেছিলো অ্যালবেট্রসে। কারণ অ্যালবেট্রস প্রথম এসেছিলো সরস্বতী পূজার সকালে, তখন জানুয়ারির শীত, আর ইন্ডিগো কমিশনের সভ্যরা এসেছিলো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ক্রিস্টমাসের বরং আগে।
সুতরাং ডিসেম্বরের কথা আগে বলে নিতে হয়। তখন স্কুলের পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। প্রমোশন শুধু বাকি। বাগচী এবং শিক্ষকেরা নতুন বছরের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আলোচনার জন্যই দুপুরে একবার করে স্কুলে যাচ্ছে। বাগচীর হাতে ঢালা অবসর। ব্রেকফাস্টের পরও সে এখন মাঝে মাঝে স্টাডিতে ঢুকে লাঞ্চের সময় পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়। কেটকেই বলতে হয় স্কুলে যাবে কিনা সে? সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে রাজবাড়িতে যাওয়া আছে। সেখানে রাজকুমারের সঙ্গে অথবা হরদয়ালের সঙ্গে সময় কেটে যায়। একজন হেডমাস্টারের পক্ষে পড়ার ঝোঁক থাকাই স্বাভাবিক। শুধু স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পড়ে নির্বাচন করাই নয়।
নিজের পড়াশোনা আছে। কেট লক্ষ্য করেছে হিন্দু পেট্রিয়টের পুরনো ফাঁইলগুলোর বদলে তারই নতুন সংখ্যাগুলো এখন বাগচীর টেবিলে। ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট বইটা তাকে তোলা, তার বদলে নিও-প্লেটোনিক দর্শন পাঠ হচ্ছে কখনো কখনো।
আগের দিন সন্ধ্যায় রাজবাড়ি থেকে ফিরে বাগচী বলেছিলো, রাজকুমার, রানীমা, দেওয়ানজি ঠিক পনেরোই ডিসেম্বর রওনা হবেন। দুখানা বোট আছে। সঙ্গে আরো কয়েকখানি দেশী নৌকো থাকবে। আমাদের যাওয়া তো একরকম ঠিকই। দেওয়ানজি বলেছেন একটা-দুটো পোর্টম্যান্টোতে পোশাক নিলেই হবে শুধু।
কেট বললো–এখনো দিন সাতেক দেরি। একটা কথা কিন্তু বলি।
বাগচী চোখের সামনে থেকে বই সরিয়ে কেটের দিকে ফিরলোবলো, কিছু ভাবছো মনে হচ্ছে।
একটা কথা কি–না, তোমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে তা কখনোই নয়, কিন্তু কথাটা কি, তুমি কিন্তু বেশ অনেকদিন থেকে বাড়িতেই বসে থাকছে।
–কেন, মাঝে মাঝেই রাজবাড়িতে যাচ্ছি না, স্কুলে ছাড়াও?
বলবো কি? প্রায় সপ্তাহ তিনেক হয়, তুমি কিন্তু কি সকালে, কি বিকেলে তোমাদের সেই ডিসপেনসারিতে একবারও যাওনি বোধ হয়।
বাগচী যেন বিস্মিত হয়ে গেলো এই আবিষ্কারে। কিছুপরে হেসে বললো–কেন যেতে হবে? সেটা কি আমার প্রফেশন? সে বেশ খানিকটা হো হো করে হাসলো কেটের অযুক্তি ধরে ফেলে।
সেদিন সকালে উঠেই বাগচী বললো– কথা তুমি মন্দ বলোনি, ডারলিং। চলো, আজ। সন্ধ্যায় আমরা দুজনেই দেওয়ানকুঠিতে যাবো। তারা সেদিন সন্ধ্যায় দেওয়ানকুঠিতে অনেকটা সময় কাটালো। তারা লাইব্রেরিতেই ইচ্ছা করে বসেছিলো, সুতরাং আলাপে বই এর কথাই বেশি হলো। আসবার সময়ে বাগচী নিজে থেকেই বললো–দেওয়ানজি, আমি ভেবে দেখলাম রাজকুমারের সেই চাকরিটা আমার গ্রহণ করাই উচিত হচ্ছে। তা শুনে হরদয়াল বললো–এটা খুব ভালো সংবাদ। আমি রানীমাকে জানিয়ে দেবো।
তারা যখন পথে বেরিয়েছে, তখন মাঝারি ধরনের জ্যোৎস্না পথে। এতক্ষণ আলাপের পরে তারা দুজনেই নিঃশব্দে চলেছিলো। তারা যখন গঞ্জের কাছে, কেট বললো–চাকরিটা কিন্তু অন্য জাতের। হঠাৎ কথা দিয়ে ফেললে না তো?
বাগচী বললো–কেন? ওটা কি একরকমের শক্তি দেয় না, ওই রকম চাকরি? হঠাৎ কেন?
কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যটা তাদের চোখে পড়লো। গঞ্জের দোকানগুলোতে আলো থাকে, কিন্তু তারপরেই রাস্তাটা বরং আজ আলো-আঁধারি থাকার কথা, কিন্তু কিছুউঁচুতে একটা ফানুসের মতো আলো যেন। কেট তাই বলে বাগচীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কিন্তু ভালো করে দেখে ফানুস বলা গেল না। বিস্মিত কেট জিজ্ঞাসা করলো–স্ট্রিট লাইটিং! আশ্চর্য! এই গ্রামে?
বাগচী বললো–হতেই পারে, হতেই পারে। কে যেন বলছিলো আমাদের গ্রামটা মিদনাপুর না হুগলির মতো শহর হতে চলেছে।
তাদের বেড়াতে ভালোই লাগছে, মনটাও লঘু। কেট বললো, তাহলেও আশ্চর্য হতে হবে। দ্যাখো, মিদনাপুর আর হুগলি কলকাতার কথা নাই তুলোম, সেসব জায়গায় আলো দেয় তো গভর্নমেন্ট, দেশের রাজা। এখানে এঁদের কি এত টাকা? আর এঁরা দেশের রাজাও নন।
বাগচীও লঘুভাবে বললো–অপচয় বলছো? এঁদের উপরে দেশের মঙ্গল দেখার ভার নেই বলছো? দ্যাখো, ডারলিং, আমরা নেহাত মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত নয় এমন এক দলের কাছাকাছি ঘেঁষে কি আমাদের এসব চিন্তা? সে হেসে নিলো। বললো, টাকা থাকলে অপচয় হয় বটে, কিন্তু দ্যাখো তার কিছু ঘটানোর ক্ষমতাও আছে।
কেট বললো–ডারলিং, ইতিমধ্যে তুমি যেন রাজবাড়ির ধরন-ধারণকে ভালোবেসে। ফেলেছো।
বাগচী হো হো করে হেসে বললো–বলছে, চাকরি পাওয়ার আগেই হলো? কিন্তু একটু গম্ভীর হলো সে। বললো, টাকা, টংকা, রূপিয়া, পৌন্ড যে নামেই বলো, ক্রাইস্ট অনেক দিন আগেই বলেছেন, ওটা থাকলে স্বর্গে যেতে দেরি হয়। হয়তো এ রাজবাড়ির পিতামহ পিতার সময়ে লুটপাট ইত্যাদি অর্থ সংগ্রহের ভিত্তি ছিলো। আমার তো মনে হয়, ও জিনিসটার সঞ্চয়ের গোড়ায় লুট, ধ্বংস, নৃশংসতা থাকেই। যদিও এখানকার প্রচুর ধনের কারণ কার্পণ্য। তুমি, উৎসবের রাতে দেওয়ানজি যা বলেছিলেন মনে করো। তিনি হয়তো বলতে চাইছিলেন কলকাতার কোনো কোনো রাজা যেমন সাহেব-মেমেদের মদ আর খানা দিয়ে লাখপতি থেকে কোটিপতি হতে চলেন, এখানে এই এক আধুনিকতা যে ইংল্যান্ডের ধার্মিক মানুষদের মতো রানী স্টকে এবং কম্পানির কাগজে টাকা রেখে যাচ্ছেন।
-তুমি কি সত্যি বিশ্বাস করো–ধর্ম অর্থাৎ পিউরিটানদের যেটা, তার সঙ্গে টাকার যোগ আছে?
–আদৌনা। এখান থেকে লুটপাট করে যারা ন্যেবর হয়ে ফেরেন তারাও স্টকে ঢালেন। কিন্তু আমার সন্দেহ তারা অন্য স্রোতেও ঢালেন। ফলে যারা সেখানে তিল তিল করে সঞ্চয় করে আর আচার ব্যবহারে পিউরিটান, অন্তত নির্দয়ভাবে মর্যালিস্ট তারাই প্রায় সব রেলরোডের মালিক।
-তুমি কিন্তু টাকার শক্তির দিকটাই তুলে ধরছো শুধু।
-তা তো বটেই, তা তো বটেই। এমনকী এখানে ডানকানের যে শক্তি তাও তো তাই। নয় কি?
সেদিন ডিনারে বসেও বোধ হয় তাদের মনে হালকা ভাব ছিলো। তারা যেমন গল্প করছিলো তেমনই করতে লগলো। কিন্তু হঠাৎ কেট বলে বসলো, তোমাকে একটা গল্প বলতে পারি।
বাগচী বললো–নিশ্চয়। বলো।
কেট বললো–কতগুলি শক্তি নয় কি যা আমরা দেখি? যেমন ধরো রাজকুমার এই গ্রামের একরকম শক্তির প্রতীক।
বাগচী বললো–ভেরি গুড। তাই বলে ডানকানের শক্তি থাকলেও তাকে কিন্তু অন্য নাম দিতে হয়।
কেট বললো, বলতে দিচ্ছো না কেন? যেমন ধরো দেওয়ানজি আর একরকমের শক্তির প্রতীক।
–এটা অস্বীকার করা যায় না। তুমি তৃতীয় শক্তির প্রতীক হিসেবে তাহলে রানীমাকে দেখছো? কেমন ধরিনি?
বাগচী খুশিতে হাসলো।
কেট বললো–তা হবে কেন? আমাকে বলতে দিচ্ছে না। তৃতীয়টি এক দারুণ মর্যাল শক্তি। আমার আনন্দ, তার প্রতীক আমার ঘরে।
বাগচী যেন চমকে গেলো। হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলো। ঠাট্টার সুরে বললো, এ একেবারে নিজের কোলে ঝোল টানা। রাজকুমার আর দেওয়ানজির পাশে আমার মতো…। কিন্তু তার এরকম মনে হলো, এ ধরনের চিন্তা কি সেও করেছে সন্ধ্যা থেকে? যেন শক্তি পাওয়ার ইচ্ছা।
সে দেখলো, কেটের গাল দুটো লাল দেখাচ্ছে, চোখ দুটি উজ্জ্বল। সে ভাবতে চেষ্টা করলো, এই অদ্ভুত গল্পটা যা এখন কেট বললো, তার কিছু কি ভিত্তি আছে?
সম্ভবত পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের আগেই বাগচীতার কুঠির পিছন দিকের বাগানটার । গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেখানে একটা কিচেন গার্ডেন। সহিস তদারক করে। সেখানেই তার প্যাডকও, যেখানে তার টাট্টা থাকে। সে রোদে রোদে ঘুরছিলো। শীতে তা আরামই লাগে। সে সহিসকে বাড়তি ঘাস কেটে ফেলতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো–দুএকটা করে ফুলগাছ লাগালে কেমন হয়? অলসভাবে রোদ পোয়ানোর ভঙ্গিতে সে প্রকৃতপক্ষে গোলাপ নিয়ে আলাপ করলো। কিন্তু টাট্টা তাকে দেখে ফেলেছিলো। সে নাক না ঝেড়ে পারলো না। বাগচী হাসলো। কিন্তু তার মনে পড়লো তিন সপ্তাহ, কম করেও, সে টাট্টাকে ব্যবহার করেনি। সে জিজ্ঞাসা করলো–সহিস তাকে হাওয়া খাওয়াচ্ছে কিনা। বলে দিলো, অন্তত মাইল দুয়েক যেন রোজ হাঁটায়। সেখানে কেট এলো তাকে কিচেনের জানলায় দেখে। সে বললো–এখানে কী হচ্ছে? বাগচী হেসে বললো, ভাবছো রোদ পোয়াচ্ছি? মোটেই না। বাগানটার উন্নতির কথা ভাবছিলাম। তুমি হয়তো জানো না, আমাদের কুঠি একেবারে মরেলগঞ্জের কুঠির স্টাইলে। শুধু আকারে ছোটো। কাজেই একটা বাগিচা থাকলে ভালো হয় না? তাছাড়া ভেবে দ্যাখো, আমাদের আয় তো জানুয়ারি থেকে একজন সিনিয়র ডেপুটির সমান বটে।
কেট হেসে বললো–বিউটিফুল।
কিন্তু বাগচী লজ্জিত হলো, অবাক হলো, আবিষ্কার করলো, দ্যাখো কাণ্ড! সত্যিই তো, সহিসের সঙ্গে গোলাপ লাগানোর কথা বলছিলো। এখন যা বললো– তাহলে কি তা ঠাট্টা নয়? এরকমই নিজে না জেনেই ভাবছে?
কিন্তু সেদিন রবিবারও বটে। ব্রেকফাস্ট শেষে তখন তারা পার্লারে, সর্বরঞ্জনপ্রসাদ আজ আবার শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হলো। আজও তার ছোট্ট একটা প্রস্তাব ছিলো, শ্রদ্ধা জানানোর শেষে সে বললো–আমার একটা নিবেদন আছে, সার। ক্রিস্টমাস আগতপ্রায় এখন কি একটা সভার আয়োজন করতে পারি না? স্কুল বন্ধ হতে পারে, কিন্তু আপনি অনুমতি করলে অনায়াসে আমাদের অধিকাংশ ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকদেরও সংবাদ দেওয়া যায়। এটা কি ভালো হয় না যে আমরা শিক্ষকেরা এবং তারা ছাত্রেরা মিলে এই বিশেষ দিনটিতে লোকাতা ঈশ্বরপুত্রকে স্মরণ করি?
বাগচী নিয়োগীর কথার মৃদু টানা স্রোতে যেন ভেসে যাচ্ছিলো। তার মনে হচ্ছিলল, ভদ্রলোক যে উন্নত মনের সন্দেহ কী? প্রস্তাবটা তো ভালোই। কিন্তু হঠাৎ কিছুতে যেন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটালো। সে বললো–আচ্ছা মশাই, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? আপনি কি ক্রাইস্টকে–আচ্ছা, কেন শ্রদ্ধা করেন ক্রাইস্টকে? প্রেমের জন্য কি?
নিয়োগী বললো–সেটাই কি সত্য নয়? প্রেমই কি নয়? তিনি এমন প্রেম করিলেন যে
বাগচী বললো–আচ্ছা মশাই, আপনি হিন্দু না হতে পারেন, ক্রিশ্চিয়ানও তো নন। এমন দুর্বল কেন বলুন তো? আপনি কি কখনো শ্রীচৈতন্যের জন্মদিবসে সভা করার কথা ভেবেছেন? তিনিও শুনি প্রেমের পথেইনা, না, ওসব সভা হবে না। তাছাড়া আপনি কি পারবেন? আচ্ছা, আপনাকে ইন ইমিটেশন অব ক্রাইস্টবইটা পড়তে দেবো। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলো। ক্রিশ্চিয়ানরা পারছে?
নিয়োগী অবশ্যই শ্রীচৈতন্যর ধর্মের সঙ্গে যুক্ত পরকীয়া ইত্যাদির কথা মনে যুক্তি হিসাবে গুছিয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু সেদিন সে ভারাক্রান্ত মনে বিষণ্ণ মুখেই বিদায় নিতে বাধ্য হলো। বাগচীকে নিত্যন্ত চিন্তাকুল দেখাচ্ছিলো।
কেট তার সেলাই-এর ঝুড়ি নিয়ে এলো। আজ সকালেই সে স্থির করেছিলো সারাদিন বুনলে রাজকুমারের সোয়েটারটা শেষ হবে। তারপরে তিনদিনে তার নতুন সার্জের গাউনটাকে সেলাই করে নেওয়া যাবে। তারপর সোয়েটারটাকে নয়নঠাকরুনকে পৌঁছে দিতে হবে কোনোভাবে। নয়ন সেটাকে রাজকুমারের গায়ে তুলে দিলে যে দৃশ্যটা হবে তার আলোটাকে সে অনুভব করছিলো।
কিন্তু কথা অন্যভাবে শুরু হয়। সে বললো–নিয়োগীমশায়…দুর্বলের কথা কী বলছিলেন?
বাগচী বললো–তুমি শুনেছেনাকি আমাদের কথা? ভালো নয়, ভালো বলতে পারিনি। বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি ভাবতে গিয়ে মনে হলো তখন। দ্যাখো, এটা তো ঠিকই ক্রাইস্ট ইহুদিদেরই একজন যারা তখন প্রায় বর্বর ধনী রোমকদের পদানত; দ্যাখো, এটা তো ঠিকই প্রথম যারা তার ধর্মকে নিয়েছিলো তারা তো ছিলো উৎপীড়িত ক্রীতদাস। তখন হঠাৎ মনে হলো, চৈতন্য যখন এদেশে প্রেমের ঈশ্বরের কথা বলেছিলেন তখনো পাঠানের উৎপীড়নে, ছিলো একটা জাতি। মনে হলো দুর্বলতাতেই, পরাজিত হলেই মানুষ প্রেমের প্রচার করে নাকি? বাগচীর মুখটা নিয়োগীর চাইতেও বিষণ্ণ হলো। কেট মুখ তুলে কিছু বলতে গেলো, কিন্তু তার যেন এই ভয় হলো, অত তাড়াতাড়ি এসব বিষয়ে কথা বলতে নেই। তার। অস্পষ্টভাবে মনে হলো, ক্রিশ্চান সব চাৰ্চই তাদের ইউনিটারিয়ান মতকে বিদ্রূপ করে তা সত্ত্বেও ক্যাথলিক রলের চার্চ মিশনের ব্যাপারে বাগচীর উৎসাহ দেখে সে এরকম কিছুই বলতে গিয়েছিলো। সেও বিষণ্ণ হলো।
কেটকে সংসারের কাজে কিছুক্ষণের জন্য উঠে যেতে হলো–তা মিনিট দশেক হবে। সে ফিরে এসে অবাক। ইতিমধ্যে বাগচী ইদানীং-অভ্যস্ত ড্রেসিং-গাউন বদলে বাইরের পোশাক পরা শেষ করে সযত্নে ক্র্যাভাট বাঁধছে। কেট বসলো; যেন কৌতুক ঘটবে কিছু। বাগচী তার টুপিটাকে ব্রাশ করে মাথায় চাপালো। এক টুকরো কাপড় তুলে তার ছড়িটাকেও ঘষে নিলো।
কেট একটু কৌতুকের সুরেই বললো–সে কী, কোথায়?
বাগচী বললো–আজ রবিবার নয়? ডিসপেনসারিতে যেতে হয় না? সহিসকে জানলা দিয়ে বলল ঘোড়া আনতে।
বাগচী ভাবলো-কী আশ্চর্য, কী ভয়ঙ্কর, সে কি ধর্ম থেকে এতদূর সরে গিয়েছে? আজ সম্ভবত বিশ দিন হয়, চরণের সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হয়েছে, কিন্তু ইসমাইলের সেই পরীক্ষার পর থেকে একটা কথাও তার সঙ্গে বলেনি। এও রাগ নাকি? আশ্চর্য!ইসমাইলের চোখেরই বা কী হলো? হয় চরণ তোমার ধর্মকে আঘাত করেছে, তোমার সংস্কৃতিকে বিদ্বেষ করে, কিন্তু ইসমাইলের কীঅপরাধ যে বিনা চিকিৎসায় তার চোখ নষ্ট হবে? সে মনে মনে বললো, ভগবান, আমার জন্য কি ক্ষমা আছে? কুড়ি দিনে অন্তত কুড়িবার মনে হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চরণকে ক্ষমা করতে পারিনি।
পথে বাগচী স্থির করলো, চরণকে গোটা ব্যাপারটা সে বুঝিয়ে বলবে। সে তো যেমন পাদরি, তেমন হেডমাস্টারও। ধর্মের কথা নাই হলো, হেডমাস্টার, শুধু ছাত্রদের নয়, শিক্ষকদের সঙ্গেও তো আলোচনা করে তাদের গাইড করে। হয়তো চরণ বলবে, আমরা তো সার, ক্রীতদাস। তখন কিন্তু বলতে হবে, হ্যাঁ, চরণ, স্বীকার করি যে আমরা পরাধীন, কিন্তু তাই বলে ক্রীতদাস? তুমি কি জাহাজের খোলে বেতের বাঁধনে বাঁধা সেই কালো কালো মানুষের যন্ত্রণা আর গোঙানির কথা জানো? রোসো, তোমাকে পড়তে দেবো। দেওয়ানজির লাইব্রেরিতে পাবে সেই টমচাচার গল্প। সোজা ইংরেজি। তাই বা কেন, আজ চরণকে উইলবারফোর্স আর ক্ল্যাপহ্যাম সেকটের কথা বলতে হবে। সেই যারা ইংল্যান্ডে বসে ক্রীতদাস প্রথাকে লোপ করেছে। বলতে পারো, চরণ, ইংরেজরাই বেশি জাহাজ নামিয়েছিলো ক্রীতদাসের ব্যবসায়। তারাই কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথা লোপও করেছে। তুমি কি কলকাতাতে রাজাদের বাড়িতেও আর ক্রীতদাস দ্যাখো? একটাও পাবে না। হাবসীবাগান আছে বটে, কিন্তু সেখানে ক্রীতদাস নেই। অথচ এই দেশে এমনকী নুরজাহও ক্রীতদাস ছিলো। তোমাকে আরো বলি, সে আপন মনে হাসলো, এরা কিন্তু সকলেই ডানকানের কীবলের জাতি। ক্রিশ্চিয়ানই ধর্মে। তাদের স্বীকার করার সাহস আছে তাদের দেশে কল কারখানায় শ্বেত-ক্রীতদাস আছে। তারা কিন্তু তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করে। বেশ কথা, ইংল্যান্ডের কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, আমেরিকাকে দ্যাখো। সেখানে সবচাইতে বেশি ক্রীতদাস। সেখানেই কিন্তু গত এক দশক সব চাইতে বেশি আন্দোলনও। এমন হতে পারে সেখানে এ নিয়ে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। টাইমস পড়েছো?
তিন সপ্তাহের নিরুদ্ধ আবেগে এসব ভেবে যখন চরণদের পাড়ায় ঢুকছে, নিজের আবেগের দরুন লজ্জিত হয়েই চিন্তাটাকে যেন মাটিতে নামিয়ে আনলো। ব্যাপারটা তো ডানকানের নীল চাষ আর দাদন নিয়ে। নীল চাষ যে করা হয় তা লাভের বলেই। দাদনটাও যে কী তা আমরা তাঁতিপাড়ায় দেখেছি। দাদন পেলেই তবে তাতে রেশম চাপায়। বিক্রির নিশ্চয়তার জন্যই দাদন নেওয়া। নীলেও দ্যাখো, বিক্রির নিশ্চয়তার জন্যই দাদন চলেছে। কেউ তো আর জমিতে নীল চাষ করে নীল বার করে, তারপরে জাহাজ কিনে, জাহাজে মাল চালান দিতে পারে না। দাদন অন্তত এই নিশ্চয়তা দেয়, ফসল মাঠে পড়ে থাকবে না। মুশকিল হচ্ছে এই, মহাজনের সংখ্যা কমলে, প্রতিযোগিতার অভাবে তারা দাদনের পরিমাণ কমায়। নীলের ব্যাপারেও মহাজনের এই সুবিধা–একটাই তো নীলকুঠি ও অঞ্চলে। রাগ করে ভাবতে হবে, যারানীলচাষ নিয়ে ধর্মঘট করেছিলো তারাও নীল চাষই করছে আবার।
কিন্তু ততক্ষণে সে চরণের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে।
তাদের সেই ডিসপেনসারিতে কয়েকজন রোগী ছিলো। বাগচী যেন কিছুই নয় এমন ভাবে গুডমর্নিং বলে বারান্দায় উঠে তার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে চেপে বসে হেসে বললো, ক্যারি অন, চরণ, ক্যারি অন। সে আধঘণ্টা ধরে চরণের চিকিৎসা দেখতে লাগলো। শেষ রোগীটা চলে গেলে বারান্দাটা ফাঁকা যখন,বাগচী বললো–হা, চরণ, আমাদের ইসমাইলের খবর কী? তার চোখটা?
চরণ বললো–সারেনি, কিন্তু অনেকদিন আসছেও না। এরাই বলছিলো, সে নাকি এখন এক সোলোমান সাহেবের সঙ্গে নৌকায় করে মাছ ধরে বেড়ায়। সোলোমান না কী সোলোভান নাম তার।
বাগচী বললো–কীবলের সঙ্গে যখন মারামারি, ইসমাইলদের তাহলে মরেলগঞ্জে জমি ছিলো? ওইটুকু ছেলে, ও কি মাছ ধরে কিছু করতে পারছে?
-নিজের পেট চলছে বোধহয়।
–নিজের পেট? ও কি তার আত্মীয়স্বজন থেকে পৃথক?
চরণ একটু অসুবিধায় পড়লো। সে ভাবলো, একবার কীবলের কথা গোপন করে মুশকিল হয়েছিল, যা আজই মাত্র মিটতে চলেছে। সে স্থির করলো সাধারণত যা বলা হয় না তেমন কথাও গোপন করা উচিত হবে না। সে বললো, মাস ছয়েক আগে ইসমাইলের বাপ মরেছে। সংসারে থাকার মধ্যে মা আর ছেলে। ছেলে চাষ না করে স্কুলে যেতে বলেই জুড়ান তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো ছোটোসাহেবের কাছে। সেজন্যই চোখের ওই অবস্থা। তা এখন নিশ্চিন্ত, জুড়ানই ওর মাকে নিয়ে থাকছে।
বাগচীর মনে করুণা আর ঘৃণায় মিশ্রিত একটা অব্যক্ত ভাব দেখা দিলো। কিন্তু আবার কি ধর্মনীতির কথা ওঠে? এই ভেবে সে একরকম হাসলো। বললো–সলোমান, সোলেভান বললে, সে কি ডিসিলভা কিংবা ওসুলিভান হতে পারে? ফেলিসিটারের সেই লোকটি কি এখনো এই গ্রামে?
–সেই হবে। এক হতভাগা তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকদিন আগে ইসমাইলকে গঞ্জে ধরেছিলাম। বললাম, জলে জলে ভাসছিস! তা, বললো, সাহেবও ভেসে যাওয়ার কথা বলে। ভাসতে ভাসতে একদিন নাকি চোখ ভালো হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু এটা তো এমন নয় যার জন্য সে এসেছে আজ। বাগচী বললো–তোমার সঙ্গে আজ নীল চাষের কথা বলবো। গত তিন সপ্তাহ এ বিষয়ে পড়েছি, ভেবেছি। মনে করো আমরা নীল চাষ করবো না। কী করবো-ধান, কলাই, সরষে, আখ?
চরণ একটু ভেবে বললো–গোপালদা এসব বিষয়ে ভাবছে। বলছিলো, সবাই ধান কলাই করলে তার দাম এমন পড়ে যায় যে তাতে যারা কিনে খায় সেই বাবুদের সুবিধা, চাষীরা কিন্তু না খেয়ে থাকে?
-তাহলে কি আখ?
চরণ আবার ভাবলো। বললো, আগে এদিকে আখ হতো, গুড় হতো। মরেলগঞ্জের পশ্চিমে সোহাগপুরে এখনো গুড় আছে। কিন্তু তারাও অন্য চাষের কথা ভাবছে। বলে, জাহাজী চিনির সঙ্গে, জাহাজী গুড়ের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাচ্ছেনা। পূজা ছাড়া,বামুন কায়েতের বিধবারা ছাড়া কে আর দেশী গুড় আর দেশী চিনি খাচ্ছে?
বাগচীর নিজের ঘরের সুগার বউলের কথা মনে পড়লো। চকচকে বড়ো দানার সেই চিনি যা গঞ্জের বাজার থেকে সহিস নিয়ে গিয়েছে তা কিন্তু দেশী বলে মনে হয়নি।
বাগচী খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। পাইপ ধরালো। তা পুড়িয়ে শেষ করলো। বললো–চরণ, এখন তো টানা ছুটি স্কুলের। ক্রিস্টমাসে একবার কলকাতা যাবে। কিন্তু তার আগে রোজই আসবো। দু-বেলাই। রোগীদের খবর দিও। কলকাতা যাওয়ার আগে ক্রনিক রোগীদের ওষুধ দিয়ে যাবো।
সে ভাবতে লাগলো। এই সময়েই কথাটা তার মনে হলো–আচ্ছা, চরণ, ইন্ডিগো কমিশনের কথা শুনছো কিছু? এ কি সত্য যে মরেলগঞ্জে কমিশন আসছে? তারা কি মরেলগঞ্জের অন্যায় নিয়ে খোঁজখবর করবে?
চরণ বললো–হ্যাঁ, সার। দিন তিনেক আগে সকলকে নুটিশ দিয়েছে। যার যার ইচ্ছা কমিশনকে বলতে পারে অভাব-অভিযোগের কথা। বড়োদিন পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ নেবে। তারপর জানুয়ারির শেষ দিকে তারা আবার এলে সেই দরখাস্তের উপরে জেরা হবে।
একবার বাগচীর মনে হলো সে বলবে, দ্যাখো, তাহলে এখানেও ইংরেজরা কমিশন বসাচ্ছে!এটা কি একটা ভালোর লক্ষণ নয়? কিন্তু সেচরণের মুখে অপ্রীতিকর কিছু শোনাকে এড়িয়ে যেতে অন্য কথায় গিয়ে বললো, তাহলে, চরণ, কঠিন রোগীদের, বিশেষ ক্রনিক রোগীদের যেন সংবাদটা জানানো হয়। কলকাতায় যাওয়ার আগে ওষুধ দিয়ে যাবো।
দিন তিন-চার পরে বিকেলের দিকে সে রোগী দেখা শেষ করে তখন কুঠিতে ফেরার উপক্রম করছে, চরণের বাড়ির দিকে দু-তিনজনকে একত্র আসতে দেখে সে বারান্দার নিচে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ানো চরণকে জিজ্ঞাসা করলো–রোগী নাকি চরণ? ততক্ষণে তাদের দেখতে পেয়ে চরণ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আগন্তুকদের একজন প্রৌঢ় আর দুজন যুবক। চরণ একটু বিরক্তির স্বরেই বললো, অমর্ত্যমামাকে এখন এখানে আনতে গেলে কেন, কৃষ্ণকাকা?
সেই প্রৌঢ় বললো–তুমিই তো লোককে জানিয়েছে, ডাক্তারসাহেব কলকাতা যাওয়ার আগে রোগী দেখবেন–তাই শুনেই অমর্ত্য ধরেছে তাকে একবার দেখতে।
বাগচী কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলো–অমর্ত্য কোনটি, তার কী হয়েছে, এরাই বা কে?
চরণ আবার সমস্যায় পড়লো। আবার কী গোপন করবে, আর তার ফলে আবার এক ভুল বোঝাবুঝি? সে তখন পরিচয় দিয়ে জানালো প্রৌঢ়টির নাম কৃষ্ণানন্দ, তার স্ত্রীর পূর্ব পক্ষের শ্বশুর এবং তারও খুড়ো সম্বন্ধে। অমর্ত্য কৃষ্ণানন্দের সম্বন্ধে শ্যালক। বললে, অমতাঁর কিছুদিন থেকে একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তার স্ত্রী এবং কন্যা, সংসারে নিজের বলতে তারাই। তাদের সঙ্গে ব্যবহারের পরিবর্তন হয়েছে। সংসারের বাইরে যারা তাদের সঙ্গে তো বটেই। সবসময়েই প্রায় চুপচাপ থাকে, কথা বলতে গেলে চিনতে পারে না, অন্য সময়ে রেগে গিয়ে ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট করে।
বাগচী গলা নিচু করে বললো–তুমি কি এটাকে মেন্টাল কেস বলছো?
তখন চরণ কিছুটা ইতস্তত করে কীভাবে অমর্ত্যকে ডানকানের হুকুমে জুড়ান পাইক সারাটা মরেলগঞ্জে উলঙ্গ করে ঘুরিয়েছে তা বললো।
বাগচী স্তম্ভিত হয়ে গেলো। সে হাসবে যেন এমন ভাব হলো তার মনে। পরমুহূর্তে রক্ত যেন মাথায় চড়ে গেলো, কথা বলতে কষ্ট হতে লাগলো। সে অবস্থায় সে ভাবলো, না, বর্বর নয়, শয়তান।
বাসায় ফিরে বাগচী অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলো। এমনকী ডিনারের আগে পর্যন্ত কেটের সঙ্গেও খুব কমই কথা হলো। ডিনারে বসে সে বললো–আচ্ছা কেট, এবারেও ক্রিস্টমাসে যদি কলকাতায় না-যাই আমরা?
পরের দিন সকালে, তখন তো কলকাতায় রওনা হতে আর দিন তিনেক বাকি, সে দেওয়ানকুঠিতে গেলো। হরদয়ালকে পেয়ে জানালো তার পক্ষে কলকাতা যাওয়া একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। মরেলগঞ্জে ইন্ডিগো কমিশন আসছে। ২৫ তারিখ পর্যন্ত তারা নালিশ নেবে। পরে তার উপরে জেরা হবে। মরেলগঞ্জে অনেক নালিশ। কিন্তু কেই বা তাদের সেসব নালিশ লিখে দেয়?
হরদয়াল জিজ্ঞাসা করলো–বাগচী সেখানকার রায়তদের পক্ষে উকিল হিসাবে দাঁড়াতে চাইছে কিনা।
বাগচী হেসে বললো–আপাতত নালিশগুলো লিখে দিতে হবে। আর পরিচিত অপরিচিত মিলিয়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা নালিশ তো হবেই মনে হচ্ছে। সময়ও লাগবে। তাদের জেরা করে নিখুঁত সত্য উদঘাটন করে তা লেখা ২৫ তারিখের মধ্যে পেরে উঠলে হয়।
চরণের বাড়িতে গিয়ে সে বললো–শোনো, আমার গায়ের রং কালো, তা বেশ কালোই; কিন্তু আমি নিজেই জানি ইংরেজিটা আমি ভালো লিখি। একশোটা তো কম করেই নালিশ হবে। আর কদিনই বা বাকি ২৫-এর। এর মধ্যে সকলের সঙ্গে আলাপ করে নিয়ে সত্যকে স্থির করে নিয়ে নালিশগুলোকে লিখতে হবে। চরণ এ তো বুঝতে পারা যাচ্ছে এ নালিশগুলো কখনো যদি প্রকাশ পায় পার্লামেন্টের সভ্যরা লজ্জায় লাল হবে। আমি জানি কী করে চোখের জল আর আগুনের আংরা ইংরেজিতে ভরে দেওয়া যায়। ইসমাইলের মা, ইসমাইল, অমর্ত্য কারো কথা বাদ যাবে না।
এরকম সিদ্ধান্ত করলে, সময় তো তখন বেশি ছিলো না। একশোটা না হোক অন্তত পঞ্চাশটা নালিশ বাগচী খাড়া করেছিলো। যাদের নালিশ তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অতীত ও বর্তমানের অত্যাচার অনাচারের কাহিনীকে সত্যের ভিত্তিতে নির্ণয় করা, তাকে উপযুক্ত ভাষায় লেখা বাগচীর দিনরাত কেটে যেতে লাগলো। কিছুদিন যেমন তাকে বাড়ির বাইরে দেখা যেতো না, তখন আবার খাওয়ার সময়ে ছাড়া কুঠিতেই পাওয়া যায় না। এমনি হলো।
এক রাতে বাগচী বললো–আর দুদিন, ডারলিং। বোধ হয় পেরে উঠবো শেষ করতে। তা তো হবেই, ছাপালে আড়াই তিনশো পাতার বই হবে।
কেট বললো–তোমার শীত করছে না তো? পায়ের উপরে রাগ দেবো?
হয়তো সে নানারকম গরম কাপড়ের কথাই ভাবলো। হঠাৎ যেন গল্পটা মনে পড়লো, মুখ তুলে বললো–সেই বনাতওয়ালা, জানো, ফেলিসিটার তো চলে গিয়েছে কিন্তু বনাতওয়ালা সেই ও সুলিভানকে দেখলাম কাল পথ দিয়ে যেতে।
বাগচী তার কাগজ থেকে মুখ তুলো। অন্যমনস্কভাবে বললো–শুনেছি বটে সে নাকি ভেসে বেড়ানোর কথা বলছে।
–ভেসে বেড়ানো? তুমি কি শ্যাওলার কথা ভাবছো, নাকি জলের উপরে ভাসা স্কাম?
বাগচী আবার কাগজে মুখ নামালো। কেট বললো, আচ্ছা, ডারলিং, এরা কি সবাই রুটলেস? সবাই কি ধর্মহীন? ওসুলিভানের বাবা-মা হয়তো দুই জাতির, তাই নয়?
কেট সম্ভবত পথে ও সুলিভানকে দেখার পরেই কিছু ভেবেছে। সে আবার বললো, আচ্ছা, ডারলিং, মানে এদের মতো মানুষদের বাবা-মায়ের একত্র হওয়া কি অন্য কিছু? ওয়ান ইন গড় হওয়া নয়?
অন্যমনস্ক বাগচী বললো–তা তো বটেই। খানিকটা তো বটেই।
শোবার সময় হলে বাগচীর গায়ের উপরে রাগ বিছিয়ে দিতে দিতে কেট তার বিছানাতেই কিছু সময়ের জন্য বসলো। বললো–আচ্ছা, ডারলিং, আমার ভয় করে, আমরা ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছি না তো?
বাগচী বললো–কেন? সামনে ক্রিস্টমাস। এবার কিন্তু আমরা পরপর দুদিনই বেশ অনেকটা সময় প্রার্থনা করবো।
সে রাতটাকে ক্রিস্টমাস ইভ বলা হয়। ডিনারের অসাধারণ আয়োজন করেছিলো কেট। বাগচীর জানার কথা নয় কেট কখন কী বোনে। নতুন একটা সোয়েটার তাকে পরতেই হয়েছে। খেতে খেতে বাগচীর হাসি দেখে কেট বললো–হাসছো যে একা একা? আমি ভাগ পেতে অধিকারী।
–নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার মনে হচ্ছিলো, খড়ের বাড়িতে খড়ের কুচিতে গা ঢাকলে কি। শীত যায়? তা থেকে আরো মজার কথা মনে হলো। পাগলা ফ্রান্সিসের কথা।
-পাগলা?
নয়? ভাবো ইটালিতে তো এসময়ে বরফও পড়ে। ভাবো খালি গায়ে তুষার, চুলে তুষার, দাড়িতে তুষার। বোধ হয় এরকম কোনো ঋতুতেই বরফ দেখে বলেছিলেন–আগুন আমার ভাই!
-বোন বলেছিলেন বোধ হয়। কেট বললো।
–কেমন, অসাধারণ অনুভব করার শক্তি নয়? যেন এক মহাকবি?
কেট দেখলো-বাগচীর চোখের কোণ দুটো চিকচিক করছে।
রাত তখন এগারোটা হবে। কেটের হাই উঠলো। বাগচী বললো–তুমি একটু শুয়ে নাও ডারলিং, আমি ঠিক রাত বারোটায় তোমাকে ডেকে তুলবো। সারাদিন খেটেছে উৎসবের আয়োজনে।
–ঘুমিয়ে পড়বে না তো?
না না, আমি ঠায় বসে থাকবো। এই সোয়েটার এমন আরামদায়ক, খুলতে ইচ্ছা করছে না।
রাত বারোটার কিছু পরে কেটের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। সে তাড়াতাড়ি সময় ঠিক করতে এসে দেখলো, বাগচী তার টেবিলে আলোর সামনে, কাগজের উপরে ঝুঁকে পড়ে লিখে যাচ্ছে।