আঞ্চলিক রাজ্যগুলোতে সামন্ততন্ত্র – আনুমানিক ৮০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ
উত্তর ও দক্ষিণ-ভারত এই যুগে ছোট ছোট রাজ্যে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবার পিছনে নানা কারণ আছে। আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের আলাদা একটা আঞ্চলিক আনুগত্য গড়ে উঠছিল। আগের যুগের বৃহৎ ও কেন্দ্রভিত্তিক রাজ্যগুলোর পতনের পর নগরের প্রতি অর্থনৈতিক নির্ভরতা বা কেন্দ্রের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্যের কোনো প্রয়োজন রইল না। বরং সম্পূর্ণ স্থানীয় প্রয়োজন ও সামর্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলো। সারা দেশের সমস্যা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সকলে আঞ্চলিক সমস্যার দিকেই নজর দিল।
এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির একটা ফল হলো ঐতিহাসিক রচনার সংখ্যাবৃদ্ধি ও উন্নতি। কাশ্মীরের মতো ছোট অঞ্চলের এবং ছোট ছোট রাজবংশেরও পারিবারিক ইতিহাস রচিত হলো। সমুদ্রগুপ্তের মতো সম্রাট না হওয়া সত্ত্বেও ছোট রাজাদের নিয়ে প্রশস্তিকাব্য রচিত হতে লাগল। ছোট রাজাদের উল্লেখযোগ্য বংশ পরিচয় তৈরি করার আগ্রহে প্রাচীন বড় রাজাদের সঙ্গে ছোট রাজাদের বংশের একটা সম্পর্ক কল্পনা করে নেওয়া হতে লাগল। কাব্যগাথা ও মহাকাব্য ধরনের রচনা স্থানীয় গৌরবের প্রকাশ মাধ্যম হলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘পৃথ্বীরাজরাসো’ (যদিও বর্তমানে প্রচলিত রচনাটি মূল রচনা নয়)।
কেন্দ্রীয় শাসনের পরিবর্তে এই যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠল, তাকে ব্যাপক অর্থে বলা যায়— সামন্ততন্ত্র। প্রথমে উত্তর-ভারতে ও পরে দাক্ষিণাত্যে এই নতুন পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের পার্থক্য ছিল বলে এই আখ্যা সম্পর্কে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তাই, অনেক ঐতিহাসিক এবং কাঠামোকে ‘প্রায় সামন্ততান্ত্রিক’ বা ‘সামন্ততন্ত্র ধাঁচের’ বলে বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এত সতর্কতার প্রয়োজন হয় না, যদি আগেই বলে দেওয়া হয় যে, ভারতীয় সামন্ততন্ত্র প্রধানত এক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সামন্ত তন্ত্রের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। যেমন, কয়েক ধরনের ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের মতো ভারতের অর্থনৈতিক চুক্তির ওপর তেমন জোর দেওয়া হতো না। তবে এই পার্থক্য এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয় যে, এই যুগের ভারতীয় পরিস্থিতিকে সামন্ত তন্ত্র আখ্যা দিলে কিছু ভুল হবে।
সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তগুলো ভারতবর্ষে ছিল। রাজা তাঁর কর্মচারী বা অনুগ্রহভাজনদের জমির খাজনা ভোগ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়ার প্রথা শুরু হওয়ায় সামন্ততন্ত্রের পথ সুগম হয়ে ওঠে। শূদ্র চাষীরা মাঠে কাজ করত। উৎপন্ন ফসলের একটা নির্দিষ্ট অংশ চাষীরা জমির মালিককে দিয়ে দিত। মালিকরা তাদের জমি চাষীদের দিয়েও দিতে পারত এবং পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসলের অংশ পেত। শস্যের একটা অংশ পাঠাতে হতো রাজাকে। জমির মালিককে রাজার প্রতি তার আনুগত্যস্বরূপ সামন্ততান্ত্রিক করও দিতে হতো। এই চুক্তি ভঙ্গ করা গুরুতর অপরাধ ছিল। সামন্ত প্রভুদের, আদিষ্ট হলে, রাজার সঙ্গে নিজেদের মেয়েদের বিয়েও দিতে হতো। তাঁরা প্রভুর মুদ্রা ব্যবহার করতেন। কোনো সৌধ, শিলালিপি ইত্যাদি করতে হলে তার মধ্যে প্রভু রাজার নাম উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় ছিল।
রাজার সঙ্গে সামন্তদের সম্পর্ক ছিল নিকট, কিন্তু সামন্তরা ছিলেন রাজার অধীন। সম্পর্কের খুঁটিনাটি নির্ভর করত, কিভাবে এই সম্পর্ক শুরু হয় তার ওপর। যুদ্ধে পরাজিত সামন্তদের নিজস্ব স্বাধীনতা ছিল সামান্যই। আবার, ক্ষমতাশীল সামন্তরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভূমিদান করতে পারত। এধরনের সামন্তদের অধীনে কিছু উপ-সামন্ত থাকত। এইভাবে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হতো। গুপ্তযুগের শেষদিকের একটি শিলালিপিতে এই ধরনের ব্যবস্থার উল্লেখ আছে। সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে এটি হলো অন্যতম প্রাচীন সাক্ষ্য। বলা হয়েছে— গুপ্ত সম্রাটের অধীনস্থ সামন্ত ছিলেন সুরশ্মিচন্দ্র এবং তাঁর অধীনে উপসামন্ত ছিলেন মাতৃবিষ্ণু। পরবর্তী চালুক্যদের শিলালিপিতে এ ধরনের ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগের অনেক উল্লেখ আছে। নিয়মিত খাজনা দেওয়া ও রাজার প্রয়োজনের জন্যে কিছু সংখ্যক সৈনিকের ভরণপোষণ করা ছাড়াও সামন্তদের আরো কিছু দায়িত্ব ছিল। রাজার জন্মদিন এবং আরো কোনো কোনো বিশেষ উপলক্ষে রাজসভায় হাজির থাকা সামন্তদের অবশ্য কর্তব্য ছিল। ছোট সামন্তরা তাদের সম্পত্তির পরিচালনার ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন করতে চাইলে রাজার অনুমতি প্রয়োজন হতো। এর পরিবর্তে সামন্তরা নিজেদের পদমর্যাদা অনুসারে নানারকম উপাধি গ্রহণ করতে পারতেন ও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতেন। যেমন, হাতির পিঠে চড়ে শোভাযাত্রা, বিশেষ ধরনের পালকী বা পাঁচ রকমের বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে আগমনবার্তা ঘোষণা ইত্যাদি। পদমর্যাদা অনুসারে উপাধিও নানারকম হতো। ক্ষমতাশালী সামন্তরা ‘মহাসামন্ত’, ‘মহামণ্ডলেশ্বর’ ইত্যাদি উপাধি নিতেন, আর ছোট সামন্তদের উপাধি ছিল ‘রাজা’, ‘সামন্ত’, ‘রাণক’, ‘ঠাকুর’, ‘ভোক্তা’ ইত্যাদি। এইসব উপাধির কোনো কোনোটি এসেছিল গুপ্তযুগের সময় থেকে। তবে, পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেই এগুলোর অনুমোদন আরো যথাযথ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধের সময় সামন্তরা রাজাকে সৈন্যসরবরাহ করতে বাধ্য ছিলেন। সামন্ত- প্রথার এই সামরিক দিকটা বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে যাবার ফলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৈন্য সরবরাহের পরিবর্তে রাজাকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থদানের ব্যবস্থা থাকলেও এটি কোনো সুপ্রচলিত রীতি ছিল না। রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করার পর সামন্তরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে সৈন্য ও অস্ত্র সরবরাহ করবেন, এই ছিল রীতি। শান্তির সময়ে রাজা কিছুদিন অন্তর সামন্ততান্ত্রিক করের পরিমাণ নিজে পর্যালোচনা করতেন ও এইভাবে নিজের প্রভুত্ব সম্পর্কে সামন্তদের সচেতন করে দিতেন। দুর্গ ইত্যাদি সবসময় যুদ্ধের প্রস্তুতিতে সৈন্য সজ্জিত করে রাখা হতো, যাতে যুদ্ধের সময় আত্মরক্ষায় অসুবিধা না হয়। এইসব কারণে সামরিক দিকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় রাজপুত গোষ্ঠীগুলোর উত্থান হলো। মোটামুটি ১০০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সামরিক প্রয়োজন বেড়ে গিয়েছিল। আগের যুগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক রাজ-কর্মচারীদের ভূমিদান করা শুরু হলো। আগের যুগের সামন্তরা প্রধানত ছিল মূলত ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত। জমির রাজস্ব ও সামরিক দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হতো।
পুঁথিগতভাবে ভূমিদান বলতে কেবল ভূমির রাজস্বটুকুই দান করা বোঝাত, ভূমি নয়। রাজাকে রাজস্বের অংশ দিতে অক্ষম হলে ওই জমি রাজা বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারতেন। গ্রহীতাদের জীবনকালের জন্যেই ভূমিদান করা হতো এবং তার মৃত্যুর পর রাজা ইচ্ছে করলে ওই জমি অন্য কাউকে আবার দান করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে সামন্তরা পুরুষানুক্রমেই জমি ভোগ করতেন। দুর্বল রাজাদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা আরো বেশি ঘটত। এরকম ঘটনার কথাও জানা গেছে যেখানে এক ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর পরিবার পাঁচ পুরুষ ধরে দান করা জমি ভোগ করে গেছে এবং পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র পাঁচ পুরুষ ধরেই রাজার মন্ত্রীর পদলাভ করেছে। পুরুষানুক্রমে ভোগদখল করলে শুধু জমির খাজনা নয়, জমির ওপরেও অধিকার দাবি করা অসম্ভব ছিল না। তবে একাজ ছিল বেআইনী।
কোনো অঞ্চলের রাজস্বের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করার জন্যে দাক্ষিণাত্যে দশটি করে গ্রাম একসঙ্গে একক ধরা হতো এবং উত্তরাঞ্চলে, বিশেষত রাজপুত রাজ্যগুলোতে ১২ বা ১৬ গ্রামের একক ধরার প্রথা ছিল। পাল রাজাদের ভূমিরাজস্ব দান করার সময়ে একসঙ্গে ১০টি গ্রাম দেবার উল্লেখ পাওয়া গেছে (দশগ্রামিকা)। প্রতীহারদের রাজত্বকালে একসঙ্গে ৮৪টি করে গ্রাম গণনা হতো। পরে এই ৮৪টি গ্রামের সমষ্টিকে একজন গোষ্ঠীপতির ভূমির সাধারণ পরিমাণ ধরে নেওয়া হয়। এই দশম শতাব্দীর শাসনব্যবস্থার থেকে কখনো কখনো পরবর্তী যুগের রাজপুতকুলের রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। অন্যান্য অঞ্চলে ১২টি গ্রাম নিয়েই একেকটি অঞ্চল গঠিত হতো এবং সেগুলোকে একত্র করে ৮৪টি গ্রামের এলাকা গঠন করতে কোনো অসুবিধা ছিল না।
গ্রামগুলো উৎপাদনের ব্যাপারে মোটামুটি স্বনির্ভর ছিল। বাড়তি উৎপাদন করে ব্যবসা শুরু করার বিশেষ চেষ্টা দেখা যেত না। অতিরিক্ত উৎপাদন করে চাষীর বিশেষ লাভ ছিল না, কেননা বাড়তি ফসল দেখে জমির মালিক বেশি অংশ দাবি করবে। বেশি উৎপাদনের কোনো উৎসাহ না থাকায় নিম্নতম উৎপাদনকেই সবাই স্বাভাবিক মান বলে ধরে নিয়েছিল। চাষীদের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছিল। কিন্তু সে কারণেও নিম্নতম প্রয়োজনভিত্তিক উৎপাদনই চাষীদের পক্ষে ভালো ছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ভারতীয় কৃষকের অদৃষ্টবাদিতার মূলে আছে উৎপাদনে উৎসাহের অভাব। বরং ওইযুগের বাস্তব অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই এই মনোভাব দেখা দিয়েছিল। সীমিত উৎপাদনের ফলে ব্যবসাবাণিজ্য কমে গেল ও মুদ্রার ব্যবহারও কমে এলো। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ওজন ও মাপ প্রচলিত থাকায় দূরে গিয়ে ব্যবসা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াল। সামন্ত বা রাজার বাড়তি সম্পদ কোনো ব্যবসা বা শিল্পে নিয়োজিত হয়নি। এই অর্থব্যয় হতো প্রাসাদ বা বিশাল মন্দির নির্মাণের জন্যে। মন্দিরের জন্যে নানা লোক প্রচুর অর্থ দান করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মন্দিরগুলোর বিপুল ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশি আক্রমণকারীদের আগমন ঘটল। মূর্তি ধ্বংসের চেয়ে লুণ্ঠনই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। সামন্ততন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে উপ-সামন্তদের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা থাকায় জমির ফসলের ভাগীদারের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগল। এর ফলে বেশি ক্ষতি হলো কৃষক ও রাজার। মধ্যস্বত্ব ভোগীরাই উৎপন্ন ফসলের অধিকাংশ ভাগ নিয়ে নিতে লাগল। খাজনা কমে যাওয়ায় রাজা তাঁর সামন্তদের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। এসবের ফলে কৃষকদের ওপর খাজনা আদায়ের জন্যে অত্যাচার বেড়ে গেল। মূল খাজনার ওপর নানা খাজনা চাপিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের চাহিদা মেটানো হতে লাগল। এর আগের শতাব্দীগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকার খাজনার একাংশ ব্যয় করত রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থা ইত্যাদির উন্নতির জন্যে। কিন্তু সামন্ততন্ত্রে ভূমির খাজনা ছাড়াও অন্য কর বসিয়ে অন্যান্য খরচ মেটানো হতো।
মন্দির কর্তৃপক্ষও আলাদা কর বসাত। কারিগরদের উৎপাদিত দ্রব্যগুলোর ওপরও নানারকম কর দিতে হতো। চৌহান ইতিহাস সম্পর্কিত শিলালিপিতে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নানা ধরনের করের বিবরণ পাওয়া যায়। অন্যান্য সামন্ততান্ত্রিক রাজত্বেও ব্যবস্থা ছিল একই রকম। ভূমির রাজস্ব ছিল খুব বেশি— কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষকরা উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশও খাজনা হিসেবে দিতে বাধ্য হতো। তবে খাজনার সাধারণ হিসেব ছিল, ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ। খাজনা ছাড়াও কৃষককে বিনামূল্যে শ্রমদান করতে হতো। উপ-সামন্তদের প্রতিপত্তি ক্রমশই বাড়ছিল এবং তারা গ্রামের গোচারণ ভূমিও দখল করে নিতে শুরু করল। সাধারণ কৃষকের জীবনে কোনো আশার আলো ছিল না।
শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, সামন্ত- তান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কোনো আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। সামন্তরা কর আদায় করত, তা ছাড়া বিচারের দায়িত্বও নিতে পারত। কারণ, বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার মতো তারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সুতরাং সামন্তদের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্বভার ছিল। অন্যদিকে ব্রাহ্মণদের নতুন নতুন বসতি এলাকায় ভূমিদান করা হতো এবং তারা সংস্কৃতাশ্রয়ী সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব নিত।
রাজ্যের সমগ্র অঞ্চলই যে সামন্তদের দখলে থাকত, তা নয়। রাজার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের একটি বিরাট এলাকা থাকত। শাসনকাজের সুবিধার জন্যে রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হতো। প্রদেশগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্রাম নিয়ে কয়েকটি এলাকা থাকত। একেকটি প্রদেশের মধ্যে রাজার নিজস্ব জমি ও সামন্ত দের জমি— দুই-ই থাকত। রাজকর্মচারী এবং সামন্তদের ক্ষমতা ও দায়িত্বের নির্দিষ্ট ভাগ ছিল। শাসনকাজে গ্রামের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই খর্ব হতো ভূস্বামীদের সুযোগ সুবিধার ফলে। ভূস্বামী ও গ্রামের শাসনবিভাগীয় কর্মচারীদের সম্পর্ক সর্বত্র একই রকম ছিল না। একটি চৌহান গ্রামের কথা জানা যায়, যেখানে গ্রামের মন্দিরের জন্যে নতুন করধার্যের জন্যে গ্রাম-পরিষদের অনুমতি নিতে হয়েছিল। সবরকম করধার্যের সময়ই যে এরকম অনুমতি নেওয়া হতো, তা নয়।
কোনো কোনো অঞ্চলে গ্রামপরিষদ বজায় ছিল বটে, কিন্তু তাদের আগেকার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আর ছিল না। সামন্তদের অধীনস্থ গ্রামগুলোতে গ্রামপরিষদগুলো ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল। একটি গ্রামের কথা জানা যায়, যেখানে গ্রামের প্রতিটি পাড়া থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গ্রামপরিষদ গঠিত হতো। কিন্তু গ্রামপরিষদের নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের নাম সম্পর্কে গ্রামপরিষদ গঠিত হতো। কিন্তু গ্রামপরিষদের নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের নাম সম্পর্কে গ্রামশাসকের মতামত দেবার অধিকার ছিল। এইভাবে গ্রামপরিষদ শাসনব্যবস্থার অনুগত যন্ত্রে পরিণত হলো। গ্রামপরিষদ থেকে অল্প কয়েকজনের একটি দলকে নিয়ে গঠিত হতো ‘পঞ্চকুল’ সমিতি। এই সমিতিই রাজস্ব আদায়, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিদানের বিবরণ, ব্যবসাবাণিজ্য এবং বিরোধে মধ্যস্থতার দায়িত্ব নিত। এই সমিতিগুলোকে পরবর্তী শতাব্দীগুলোর পঞ্চায়েতের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
অভিজাত সম্প্রদায় ছিল সামন্তপ্রভু ও ব্রাহ্মণদের নিয়েই। ব্রাহ্মণদের ভূমিদানের উদ্দেশ্য ছিল পুণ্যঅর্জন ও সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ। ব্রাহ্মণরাই রাজাদের জন্যে ধর্মীয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করত। রাজারা বিশ্বাস করতেন যে, এইসব যজ্ঞের অর্জিত পুণ্যের এক-ষষ্ঠাংশ তাঁদের ওপর বর্তাবে। একদিকে রাজা ব্রাহ্মণকে খাতির করে চলতেন ও অন্যদিকে ব্রাহ্মণরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাজাদের গৌরববৃদ্ধির জন্যে মিথ্যা বংশপরিচয় রচনা করে দিতেন।
যে সমস্ত পরিবার সামরিক ব্যাপারে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, সামন্তরা আসত সেরকম পরিবার থেকেই। রাজপুতরা যে তাদের ‘ক্ষত্রিয়’ মর্যাদার ওপর এত জোর দিত, তার উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের যোদ্ধা পরিবারের সন্তান বলে প্রচার করা। এই ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্যে তারা প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতো। যুদ্ধের কারণ হিসেবে, লুণ্ঠনের উদ্দেশ্য ছাড়াও অন্য উদ্দেশ্যের কথাও বলা হতো। এইসব যোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে নানারকম নিয়ম চালু করল। নিয়ম অনুযায়ী কোনো যোদ্ধা সম্পর্কে অন্য কেউ সামান্যতম অশ্রদ্ধাজনক মন্তব্য করলেও সেটা যুদ্ধযাত্রার কারণ হতে পারত। রাজনীতিতে নতুন কিছু ধারণা জন্ম নিল। বলা হলো, আন্তরাজ্য রাজনীতি ‘মণ্ডল’ অনুসারে চলবে, অর্থাৎ প্রতিবেশি রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্তত একটি রাজাকে শত্রুজ্ঞান করতে হবে। ক্ৰমশ যুদ্ধবিগ্রহ একটি সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে পরিণত হলো। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর চেয়ে সম্মানের ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। সকলেই যেন যুদ্ধযাত্রার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকত। চন্দেল্ল রাজ্যে মৃত-সৈনিকদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে গ্রামদান করা হতো। এইভাবে নতুন নতুন সৈনিক সংগ্রহও সহজ হয়ে উঠল। ছোটবেলা থেকে বীরত্বের ধারণা মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। কেউ যুদ্ধ করতে ভয় পেলে তাকে বিদ্রূপ করা হতো। মেয়েদেরও শেখানো হলো, যোদ্ধাপুরুষকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করা উচিত। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীদের স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জন করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হতো। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বা বলপ্রয়োগে হলেও সতীদাহপ্রথা প্রচলিত নিয়ম হয়ে দাঁড়াল।
আভিজাত্যের প্রধান শর্ত ছিল ভূমির মালিকানা। ভূমি ও বর্ণই অভিজাত সম্প্রদায়কে সমাজের অন্যান্য অংশের চেয়ে পৃথক করে রেখেছিল এবং নেতৃত্ব অর্জনে সাহায্য করেছিল। জমি নিয়ে বিবাদ কখনো কখনো কয়েক পুরুষ ধরে চলত এবং দুই পরিবারের বহু সদস্য নিহত হতো। রাজপুতদের মধ্যে গোষ্ঠী মনোভাব ছিল খুব প্রবল। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় রাজপুতরা এ ব্যাপারে বেশি সচেতন ছিল। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়তার ওপর রাজপুতরা বেশি জোর দিত।
অভিজাতরা বড় বড় উপাধি ব্যবহার করতে ভালোবাসত। আগের যুগের সম্রাটের উপাধি ছিল ‘মহারাজাধিরাজ’, কিন্তু এ যুগের ক্ষুদ্রতম রাজাও এই একই খেতাব গ্রহণ করতেন। খেতাবের সঙ্গে ছিল প্রশস্তিসূচক বড় বড় বাক্যরাজি। বড় রাজারা আবার এসবে সন্তুষ্ট না হয়ে নতুন নতুন উপাধি আবিষ্কার করেছিলেন। তৃতীয় পৃথ্বীরাজের বাসনা ছিল সমগ্র উত্তর-ভারতের অধীশ্বর হওয়া। তিনি উপাধি নিলেন ‘ভারতেশ্বর’। দ্বাদশ শতাব্দীতে কণৌজের এক রাজার খেতাব ছিল- ‘পরম মহিমান্বিত, রাজার রাজা, সার্বভৌম শাসক, অশ্ব, হস্তী ও মানবজাতির রাজা এবং ত্রিভুবনের অধীশ্বচর…।’ রাজাদের বাস্তব রাজনৈতিক ক্ষমতা বিচার করলে এ ধরনের খেতাব নিতান্তই বেমানান। রাজারা নিজেদের কল্পনার জগতে বাস করতেন। সামান্য কাজকে বিরাট কীর্তি বলে বর্ণনা করা হতো। রাজসভায় তোষামোদ করাই স্বাভাবিক রীতি হয়ে উঠল। তবে বুদ্ধিমান নৃপতিরা আরো সূক্ষ্ম উপায়ে নিজেদের মহিমা প্রচার করতেন।
অভিজাতরা নিজেরা শস্য উৎপাদনের কাজে হাত লাগাত না, জমির খাজনাই ভোগ করত শুধু। ব্রাহ্মণদের পক্ষে চাষের কাজ করা নিষিদ্ধ ছিল বলে তারাও অন্য চাষী নিয়োগ করত। বৌদ্ধ মঠগুলোরও জমি চাষ করত ভাগচাষীরা। চাষের কাজের দায়িত্ব ছিল প্রধানত শূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত চাষীদের ওপর। এইভাবে কৃষকশ্রেণ সামন্ত প্রভুদের অধীন হয়ে রইল এবং সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে এলো মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। এ যুগের এটিই ছিল বৈশিষ্ট্য। এর আগে ক্ষমতা উপভোগ করত বিভিন্ন ধরনের মানুষ— রাজকর্মচারী এবং ব্যবসায়ী ও কারিগরদের সমবায় সংঘ। গ্রামগুলোর স্বনির্ভরতার জন্যে অন্য গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ অপ্রয়োজনীয় ছিল। এর ফলেই ক্ষমতা চলে গেল অল্প কয়েকজনের হাতে। ফলে বিশেষীকরণ শুরু হয়ে গেল। কৃষকরা অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার কথাও আর ভাবতে পারত না। এইসব কারণে কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণ আরো কড়া হয়ে উঠল।
রাজার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অনুসারে তাঁর সঙ্গে সামন্তদের সম্পর্কের ভারসাম্য নির্ভর করত। তবে খাজন ও সৈন্য সরবরাহের জন্যে সামন্তদের ওপর নির্ভরশীল হলেও রাজারাই সাধারণত সামন্তদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজার সৌভাগ্যক্রমে সাধারণত তাঁর দিকটাই হতো প্রবল, কারণ রাজার পেছনে ছিল রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, সাধারণত ব্রাহ্মণদের কূট পরামর্শ। ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল নিজেদের মঙ্গলের জন্যে অধিষ্ঠিত শক্তিকে বজায় রাখতে সাহায্য করা। রাজার অধিকতর সৌভাগ্য, প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে ব্যাপক অর্থে ধরলে তাঁর অধিকারের সমর্থন পাওয়া যেত। যেমন, শাস্ত্রে খুবই জোর দেওয়া হয়েছে এই রীতির ওপর যে রাজা রাজ্যলাভ করবেন উত্তরাধিকার সূত্রে। রাজা বংশপরম্পরায় স্বতঃসিদ্ধভাবে রাজ্যলাভ করলে তাতে সামন্তদের হস্তক্ষেপ ভালোভাবে প্রতিরোধ করা যেত; এ ব্যবস্থা না থাকলে এক রাজার মৃত্যুর পর পরবর্তী রাজার নির্বাচনের সময় সামন্তে রা হস্তক্ষেপ করতে পারত, তাতে তাদের ক্ষমতাবৃদ্ধির সুযোগ হতো। এই কারণেই পালবংশের রাজা গোপাল যখন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিংহাসন লাভ করলেন, তা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। রাজাকে দেব-বংশোদ্ভূত বলেই ধরে নেওয়া হতো। রাজারও কর্তব্য ছিল ক্ষত্রিয়দের রক্ষা করা। এই নিয়মানুসারেই সামন্তদের রাজার অধীনস্থ বলে ধরা যায়। রাজার সঙ্গে প্রজাদের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সামন্তপ্রভুর কাছেই তাদের সমস্ত আনুগত্য ছিল। একারণেও সামন্তদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছিল। এই নতুন প্রবণতাকে বাধা দেবার জন্যে প্রজার প্রতি রাজার দায়িত্বের কথা বারবার প্রচার করা হতো।
প্রাচীন শাস্ত্র থেকে যুগোপযোগী অংশ চিহ্নিত করে নিয়ে তার যে ভাষ্য রচিত হতো, তার মধ্যেই এ যুগের রাজনৈতিক তত্ত্ব রূপ পেয়েছিল। এর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল পশ্চিম-ভারতের এক জৈন ধর্মাবলম্বী রচয়িতা হেমচন্দ্রের (১০৮৯-১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ) রচনা। জৈনধর্মের বিশুদ্ধিকামিতার প্রভাব হেমচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় দেখা যায়। অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেবার যে সাধারণ প্রবণতা ছিল, তার সঙ্গে হেমচন্দ্রের চিন্তার কোনো মিল ছিল না। হেমচন্দ্রের একটি বক্তব্য প্রচলিত ধারণার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বিরোধী। তিনি বললেন, উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে সমাজের পরিবর্তন আনা সম্ভব। একথার তাৎপর্য হচ্ছে যে, প্রচলিত ব্যবস্থার কোনো কিছুই অলংঘনীয় নয়।
এযুগের ধর্মশাস্ত্রীয় রচনাতেও দেখা যায় যে, প্রাচীন শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচলিত রীতিকে সমর্থন করার চেষ্টা চলছে। এর ফলে প্রাচীন শাস্ত্রের ব্যাখ্যার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতে লাগল। এরমধ্যে ছিল মনুরচিত ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’। দশম শতাব্দীতে মেধাতিথি রচিত ব্যাখ্যা ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কুলুক রচিত ব্যাখ্যা এযুগে বেশি জনপ্রিয় ছিল। প্রাচীন শাস্ত্রের সমর্থন আদায় করতে গিয়ে ওই যুগের সমস্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দিয়ে মূলশাস্ত্রও পুনর্লিখিত হলো। এইযুগের নানা রচনার মধ্যে আইন সম্পর্কিত রচনাগুলো এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
উত্তরাধিকারের সমস্যা ও জমির বিভাজনের নানা সমস্যা (যেহেতু এইযুগে জমিই ছিল ধনী পরিবারগুলোর প্রধান সম্পত্তি) সমাধানের নানা চেষ্টা হয়েছিল। পারিবারিক আইনের দুটি শাখা— ‘দায়ভাগ’ ও ‘মিতাক্ষরা’* দেওয়ানী আইনের মূলভিত্তি ছিল। এমন কি, এই আইন বর্তমানকালেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত চালু ছিল। হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে এই আইনগুলো রচিত। ভূস্বামী পরিবারদের অধিকাংশগুলোতেই একান্নবর্তী প্রথা প্রচলিত ছিল।
[* দুটি শাখাতেই অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের যৌথসম্পত্তির অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘দায়ভাগ’ মতে, কেবল পিতার মৃত্যুর পরই পুত্ররা পিতার সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারে। আর ‘মিতাক্ষরা’ মতে, পিতার জীবনকালের মধ্যেই পুত্ররা সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারে। দুই মতানুযায়ীই সম্পত্তিতে পিতার অধিকার অবাধ নয়।]
জমির মালিকানা সত্ত্বেও অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজকর্মও বাদ যেত না। তবে, জমির আয় বেশি নিয়মিত ও নিশ্চিত ছিল বলে এটিকেই বেশি সম্মানজনক মনে করা হতো। অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্যে গ্রাম ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেল এবং ফলে শহরগুলোর উন্নতিও ব্যাহত হলো। পুরনো শহরগুলো টিকে রইল, কিন্তু নতুন শহর পত্তন বিরল হয়ে পড়ল। এইযুগ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে আরব ভূগোলবিদরা চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা করে এখানকার শহরের সংখ্যাল্পতার কথা উল্লেখ করেছেন। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের ফলেও বাণিজ্যের অসুবিধা হয়েছিল। উপকূল অঞ্চলে অবশ্য নৌবাণিজ্য ভালোভাবেই চলছিল— যেমন, গুজরাটে ও মালাবারে। এছাড়া, তামিল উপকূলের বন্দরগুলো থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যও চলত।
উপকূল শহরগুলোর সমৃদ্ধির একটি কারণ ছিল বিদেশি ব্যবসায়ীদের বসতিস্থাপন। তারাই ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এবং পূর্বদিকের বাণিজ্যেও তারা ধীরে ধীরে অংশ নিচ্ছিল। ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যে ভারতীয় দালালদের হটিয়ে দেবার জন্যে আরব ব্যবসায়ীরা নিজেরাই চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। আরব ভূগোলের মধ্যে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলোর উল্লেখ দেখা যায়। যেমন, দেবল (সিন্ধু উপত্যকায়), কাম্বে, থানা, সোপারা ও কাউলম (কুইলন)। সবগুলো বন্দরেই আরব জাহাজগুলো এসে থামত। বন্দর থেকে ভারতে উৎপন্ন পণ্যসামগ্ৰী, কিংবা আরো পূর্বিদিকের অঞ্চল থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যেসব সামগ্রী নিয়ে আসত, সেগুলো জাহাজে তুলে পশ্চিমী জগতে পাড়ি দিত আরবদের জাহাজগুলো। চীনের সঙ্গে মধ্য-এশিয়া মারফত উত্তর-ভারতীয় বাণিজ্য কমে এসেছিল, কারণ পারস্যদেশীয় ও আরব ব্যবসায়ীরা তখন নিজেরাই মধ্য-এশিয়ায় যেতে পারত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আক্রমণের পর ভারত ও মধ্য-এশিয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এই বাণিজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।
দেশের মধ্যে ব্যবসা খুব কমে গেলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি, যেটুকু নাহলে চলে না সেটুকু ছিল। কারিগররা শহরে ও গ্রামে কাজ করত। তবে শহরেই কারিগরদের সংঘগুলো বেশি স্বীকৃতি পেত বলে গ্রামের চেয়ে শহরেই বেশি কারিগরের বাস ছিল। কিন্তু সমবায় সংঘগুলো শহরে আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। প্রকৃত ক্ষমতা ক্রমশ জমির মালিকদের হাতে চলে আসছিল। এরা শহরের কারিগরদের কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখত, কেননা সংঘগুলোর রীতিমতো নিজস্ব স্বাধীনতা ছিল। ওই যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী সমবায় সংঘগুলো দেখা গেছে দক্ষিণ-ভারতে।
পূর্ব-ভারতে শহরের সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল দুটি কারণে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে শহরে যথেষ্ট কর্মব্যস্ততা চলত। এছাড়া, নিয়মিত ব্যবসার ফলে টাকা-পয়সার লেনদেনও ভালো চলত। সেন রাজাদের আমলে জমির নগদ খাজনা আদায়ে রীতি প্রচলিত হয়। মুদ্রানির্ভর অর্থনীতির পুনঃপ্রবর্তনের ফলে এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা উন্নততর হওয়ায় (যদিও উদ্বৃত্তের পরিমাণ সীমিতই ছিল) নগরগুলো আরো একবার ব্যবসা ও বণ্টনের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছিল। তবে, যথার্থ বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে যে নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য লাভের সম্ভাবনা থাকে, এই অর্থনীতিতে তা ছিল না। কারণ প্রায়শই দেখা যায় যে, গুপ্তযুগের তুলনায় এযুগের মুদ্রাগুলো নিকৃষ্ট ধাতুদ্বারা নির্মিত হয়েছিল। স্বর্ণমুদ্রাগুলো গুপ্তযুগের মুদ্রার তুলনায় অনেক সময় অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ খাদমেশানো ছিল।
ব্যবসায় বৃত্তির মধ্যে একমাত্র মহাজনী কারবার এযুগে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সাধারণত শতকরা ১৫ হারে সুদ নেওয়া হলেও চৌহানদের সময়ে ৩০ ও রাষ্ট্রকূটদের সময়ে ২৫ হারেও সুদ প্রচলিত ছিল। মনে হয়, ব্যবসার অবনতি ও অর্থের অভাবের দরুণ সুদের হার চড়া হয়েছিল। সুদের হারের ব্যাপারে বর্ণসচেতনতা এযুগে স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে উঠল। ব্রাহ্মণরা যেখানে শতকরা ২ হারে সুদ দিত, শূদ্রদের দিতে হতো ৫ বা আরো বেশি। সুদের চড়া হারের জন্য কৃষকরা কিছুতেই ঋণমুক্ত হতে পারত না। সেজন্যে স্থান পরিবর্তনও তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মের বিশেষীকরণ শুরু হওয়ায় নতুন নতুন উপবর্ণের সংখ্যা বৃদ্ধি হলো। এর ফলে সম্পূর্ণভাবে গ্রামের উন্নতি না হয়ে বর্ণ ও উপবর্ণরা প্রত্যেকে পৃথকভাবে নিজেদের গোষ্ঠীর নিজস্ব সংগঠনে আবদ্ধ রইল। বর্ণভিত্তিক সংগঠনগুলোর অস্তিত্বের ফলে রাজনৈতিক আনুগত্য আরো কমে আসছিল। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে বর্ণবিভাগ আরো কঠোর হয়ে ওঠে এবং প্রতি বর্ণের জন্যে পৃথক পঞ্চায়েত এবং বিচারসভা গড়ে উঠে।
ব্রাহ্মণ-লিখিত আকরগ্রন্থগুলোতে ‘জাতি’ কাঠামোয় পরিবর্তনের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণরা এইযুগে বর্ণবিভেদের সমর্থনে প্রাচীন শাস্ত্রের নানা উদ্ধৃতির সাহায্য নিত। তত্ত্বগতভাবেও বর্ণভেদ আরো কঠোর হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণরা সমাজের বাকি অংশ থেকে আরো দূরে সরে আসে। ব্রাহ্মণ ও ব্যবসায়ীদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্রাহ্মণরা জমির মালিক হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তি খর্ব করে দেয়। ব্যবসায়ীদের দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্মও দুর্বল হয়ে পড়ল। বৌদ্ধরা ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। একমাত্র পূর্ব-ভারতেই রাজকীয় সমর্থনের সাহায্যে বৌদ্ধধর্ম পুরনো প্রভাব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এইভাবে ব্রাহ্মণদের প্রধান ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরাও দুর্বল হয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণরা নিজেদের উচ্চবর্ণের অহংকার নিম্নবর্ণের মানুষের সংস্পর্শ পরিহার করে চলত। এমনকি কোনো চণ্ডালের ছায়া মাড়ালেও ব্রাহ্মণকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এইভাবে শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের মর্যাদাও কমে গেল। এমনকি, কোনো উচ্চতর বর্ণও যদি ব্রাহ্মণবিরোধী হতো, তাদেরও ব্রাহ্মণরা অস্পৃশ্য করে রাখত।
ব্রাহ্মণরা নিয়মবিধি বেঁধে দিলেও বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় বর্ণের লোকেরা বর্ণপ্রথা এত কঠিনভাবে মেনে চলত না। বিভিন্ন বর্ণের মিশ্রণেও কিছু কিছু উপবর্ণ গড়ে উঠেছিল। এরমধ্যে কায়স্থরা শাসনব্যবস্থায় করণিকের কাজ করত। দলিলপত্র লেখা ও নানা বিষয়ের বিবরণ লেখার দায়িত্ব এদের ওপর ছিল। একাদশ শতাব্দীতে এদের একটি উপবর্ণ হিসেবে গণ্য করা হতো এবং এদের আদিবৰ্ণ নিয়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে এরা আগে ক্ষত্রিয় বর্ণভুক্ত ছিল। আবার অনেকের মতে, এরা ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের মিশ্রণ থেকে উদ্ভূত। মনে হয়, মিশ বর্ণের ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কারণে,— বর্ণবিভেদের হিসেবে কায়স্থদের স্থান নির্ণয়ের উদ্দেশ্যেই এইকথা বলা হয়েছিল। যাই হোক, রাজসভার সঙ্গে নিকট সম্পর্কের ফলে কায়স্থরাও ভূমিদানের সুবিধা পায় ও জমির মালিকও হয়ে ওঠে।
অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা বা অঙ্কশাস্ত্রের যারা চর্চা করত, তাদের নিয়ে পৃথক পৃথক উপবর্ণ গড়ে উঠল। ব্রাহ্মণদের রচনায় কিন্তু এই ধরনের কাজকর্মকে আক্রমণ করে লেখা হয়েছে। হাতের কাজকে ব্রাহ্মণরা সম্মান দিত না। মেধাতিথি হাতের কাজকে নিচু পেশা বলে ধরেছেন। মনুর রচনায় বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজকর্ম লঘু ধরনের পাপ। এই ধরণের কাজকর্মের মধ্যে ছিল সেতুনির্মাণ ও নদীর বাঁধ নির্মাণ। বোধহয় ব্রাহ্মণরা বুঝেছিল, যান্ত্ৰিক বিদ্যায় পারদর্শিতা একটা গুরুত্বপূর্ণ নৈপুণ্য।
কয়েকটি উপবর্ণ দাবি করে যে, তারা প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণ জাত, কিন্তু অর্থনৈতিক প্রয়োজনে তাদের পেশার পরিবর্তন ঘটেছে। উত্তর-ভারতের ক্ষত্রী উপবর্ণভুক্ত লোকরা এখনো দাবি করে যে, তারা ক্ষত্রিয় বর্ণজাত। কিন্তু ব্যবসা- বাণিজ্য শুরু করায় বর্ণের অন্যান্য লোকরা আপত্তি তোলে ও তারা ক্রমশ বৈশ্যবর্ণভুক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়াও গুর্জর জাঠ ও আহীর গোষ্ঠীর লোকও নিজেদের প্রকৃত ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। বর্ণপ্রথার গোড়া থেকেই উপবর্ণ সৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজে উপবর্ণ গড়ে উঠতে দেরি হতো। পরের যুগে বাণিজ্যের অগ্রগতি ও জনগণের মধ্যে স্থান পরিবর্তনের প্রবণতার ফলে উপবর্ণ সৃষ্টি হতে দেরি হতো না। চারটি প্রধান বর্ণ ঠিকই বজায় ছিল এবং তাদের অধীনেই বিভিন্ন উপবর্ণের উদ্ভব হচ্ছিল। চতুর্বর্ণের কাঠামোর মধ্যেই বিভিন্ন ‘জাতি’র পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হতো। তবে, এই তাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও এই পারস্পরিক সম্পর্ক স্থানীয় পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতো।*
[* আশ্চর্যের বিষয়, বিদেশিদের রচনার মধ্যে চারটির পরিবর্তে সাতটি বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। চারটি প্রধান বর্ণ ও তিনটি উপবর্ণ যোগ করে সাতটি বর্ণের হিসেব দেওয়া হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব লেখক আল-ইদ্রিসি সাতটি বর্ণের তালিকা দিয়েছেন— অভিজাত, ব্রাহ্মণ, সৈনিক, কৃষক, কারিগর, সংগীতশিল্পী ও প্রমোদশিল্পী। মেগাস্থেনিসের বিবরণের চেয়েও এই বিবরণ বেশি বিভ্রান্তিকর।]
সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বর্ণ-সংগঠনের নিকট সম্পর্ক ছিল। ব্রাহ্মণদের শিক্ষা-কেন্দ্রের সংস্কৃত ভাষাভিত্তিক শিক্ষা প্রধানত ধর্ম সম্পর্কিত আলোচনায় পর্যবসিত হয়েছিল। রাজকীয় সমর্থন ও সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষায়তনগুলো তাত্ত্বিকভাবে উপযুক্ত ছিল তিন উচ্চবর্ণের কাছে। কিন্তু কার্যত ক্রমশ ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো বর্ণের ছাত্রই শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশাধিকার পাচ্ছিল না।
অধিকাংশ বড় গ্রামই শিক্ষায়তনগুলো মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো দানের অর্থ থেকে সাহায্য পেত। এ ছাড়া, উত্তর-ভারতের প্রায় সমস্ত তীর্থস্থানে শৈব বা বৈষ্ণবদের যে সব শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, সেগুলোতেও নানা মানুষ দান করত। পুরনো শাস্ত্রের ওপর বেশি গুরুত্বদান ও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবের ফলে শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন মতামতেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে উঠল। প্রচলিত মতকে প্রশ্ন করে বা আলোচনার সাহায্যে আরো জ্ঞানচর্চার কোনো পরিবেশ ছিল না। যেটুকু ভিন্নমতের চর্চা ছিল তার প্রভাব এমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, যার দ্বারা সম্পূর্ণ চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটানো চলে। কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রতি অবহেলাও এই মনোভাবের অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল।
অব্রাহ্মণরা আগের মতোই সমবায় সংঘে বা কারিগরদের কাছে শিক্ষার্থী হিসেবে কিছু কিছু শিক্ষালাভ করতে পারত। বৌদ্ধ মঠগুলোতে ঈশ্বরতত্ত্ব ভিন্ন অন্য ধরনের শিক্ষারও কিছুটা সুযোগ ছিল এবং কয়েকজন অভারতীয় পণ্ডিতের উপস্থিতির ফলে খানিকটা উদার আবহাওয়া বিরাজ করত। তবে, ক্রমশ বৌদ্ধ মঠগুলো কেবল বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চারই কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছিল। পূর্ব-ভারতে এরকম কয়েকটি মঠ ছিল এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে নালন্দা। তুর্কীরা নালন্দা ধ্বংস করে দেবার পর ভারতবর্ষে বৌদ্ধশাস্ত্র চর্চার পরিসমাপ্তি হলো। জৈন শিক্ষাকেন্দ্রগুলো অনেকটা বৌদ্ধ ধরনেরই ছিল। পশ্চিম-ভারতের সৌরাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান ও মহীশূরের শ্রবণ-বেলগোলায় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈনধর্মের প্রভাব ছিল এবং জৈন শিক্ষাকেন্দ্রগুলোও এইসব অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষয় ধর্মতত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। এতে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেও জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য তাতে সীমিত হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু শিক্ষার মাধ্যমে ছিল সংস্কৃত এবং সাধারণ কথোপকথনে সংস্কৃতভাষার কোনো ব্যবহার ছিল না। এর ফলে বুদ্ধিবৃত্তি একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। নতুন চিন্তাবিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদ ক্রমশ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। নতুন আঞ্চলিক ভাষাগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছিল এবং সাধারণ মানুষের ভাবের আদান-প্রদান এতেই হতো। কারিগরি শিক্ষাকে হেয় করে দেওয়ার ফলে শিক্ষাব্যবস্থা দ্বিধাবিভক্ত হয়— যাতে শাস্ত্রীয় শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুগের বৈজ্ঞানিক রচনা প্রকৃতপক্ষে আগের যুগের রচনারই বিস্তারিত আলোচনামাত্র, যেমন— চরক ও সুশ্রুতের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুস্তক। অথবা পুঁথিগত জ্ঞানের বিশ্লেষণ হতো, যাতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের কোনো স্থান ছিল না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেখানে হয়েছে, সেখানে ফলও পাওয়া গেছে। যেমন, চিকিৎসায় লোহা ও পারদের ব্যবহার। জ্যোতির্বিদ্যাকে তখন জ্যোতিষবিদ্যারই শাখা হিসেবে গণ্য করা হতো। এই যুগের অঙ্কশাস্ত্রে একমাত্র উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল বীজগণিত।
সংস্কৃতভাষায় যেসব সাহিত্যচর্চা হচ্ছিল, তাও প্রধানত প্রাচীন রচনাগুলোরই অনুকরণ। কাব্য বা রোমান্টিক গদ্যরচনার মূল উপাদান ছিল পুরাণ ও মহাকাব্যগুলোর নানা কাহিনী। এর ফলে বর্ণনার চেয়ে ভাষার অলংকরণের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ছন্দশাস্ত্র ও কাব্যরচনার নানান খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলত। রাজসভায় সংস্কৃত লেখক ও কবিদের সমাদর ছিল। মনে করা হতো, এইভাবে রাজসভার গৌরব বৃদ্ধি হবে।
গদ্য কাহিনীগুলো তুলনায় কম কৃত্রিম ছিল। প্রাচীন কাহিনী অবলম্বনে রোমান্টিক ভঙ্গিতে এগুলো রচিত হতো। এর একটি ব্যতিক্রম ছিল সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’। এটি একাদশ শতাব্দীতে পদ্যরচনার ভঙ্গিতেই লিখিত হয়েছিল এবং এখনো এটি সমান জনপ্রিয়।
গদ্য রোমান্স রচনা রীতির বিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক আনুগত্যের মিলিত ফল হলো ঐতিহাসিক বিবরণ এবং এগুলো ওই যুগে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করল। গদ্য বা পদ্য দুই ভঙ্গিতেই বিবরণ রচিত হতো যদিও গদ্যরচনাই ছিল বেশি। এগুলোর মধ্যে পদ্মগুপ্ত রচিত মালোয়ার রাজার জীবনকাহিনী বা বিলহনের চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের জীবনী ‘বিক্রমাঙ্কদেব চরিত’ ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, আঞ্চলিক বিবরণ সংবলিত রচনা ছিল কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’। তাছাড়া, ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের উল্লেখ করে অন্য ধরনের রচনার মধ্যে হেমচন্দ্র রচিত ‘পরিশিষ্ট পর্বণ’-এর নাম করা যায়।
রাজসভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও নাটকের মধ্যে আগেকার যুগের নাটকের কিছু কিছু গুণ অবশিষ্ট ছিল। বিশাখদত্ত মৌর্যযুগের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্ৰ করে ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক লিখেছিলেন। এরপর ভবমূর্তি রচিত নাটকগুলোতে কোমলতা ও প্রচ্ছন্ন নাটকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। পরবর্তী যুগের নাট্যকার — মুরারি, হস্তিমল্ল, রাজশেখর ও ক্ষেমেশ্বর রচিত নাটকগুলো মঞ্চে অভিনয়ের চেয়ে পাঠ করার জন্যেই অধিক উপযোগী।
লিরিক বা গীতিধর্মী কবিতা এযুগে অনেক লেখা হয়েছিল। পূর্বোক্ত রচনাগুলোর চেয়ে এই কবিতা অনেক ব্যক্তিগত ও অন্তরঙ্গ সুরে লেখা। এ যুগের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো শৃঙ্গার রসাত্মক কবিতা, যার উদাহরণ পাওয়া যায় ভর্তৃহরির এক স্তবকের রচনাগুলোতে। রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলা ভক্তি- আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শৃঙ্গার রসাত্মক কবিতা বোধহয় প্রধানত এইভাবে ধর্মের অজুহাতে লেখা শুরু হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত জয়দেবের গীতগোবিন্দ রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের স্বচ্ছন্দ আবেগময় অবিস্মরণীয় বর্ণনা আছে। গীতগোবিন্দের লিরিকভাষার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়জ লাস্য আছে, তা পরবর্তী যুগের সাহিত্যে বিরল। অন্যেরা, যেমন গোবর্ধন বা কচি বিলহন (চৌরপঞ্চাশিকা) কবিতায় সোজাসুজি আদিরসের অবতারণা করেছেন- কোনো ধর্মীয় প্রতীকের দোহাই না দিয়ে।
শৃঙ্গাররস ও দেহতত্ত্বকে উপজীব্য করে কাব্য ছাড়া ভাস্কর্যও রচিত হলো। তান্ত্রিক পূজাপদ্ধতিতেও এই একই প্রবণতা দেখা গেল। এইযুগের ভারতে নৈতিক অবনতি সম্পর্কে নানাকথা নানাজনে বলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌন্দর্যবোধ ও সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয়ও কিছু কম পাওয়া যায়নি। উদাহরণ হলো- গীতগোবিন্দ বা খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য। বলা হয়, যেকোনো সংস্কৃতির অবক্ষয়ের লক্ষণ হলো নরনারীর দৈহিক সম্পর্ক নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ। কিন্তু একথা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। সংস্কৃতি বিবর্তনের অন্যান্য যুগেও এই ধরনের আগ্রহের নিদর্শন আছে, যদিও তার প্রকাশের ভঙ্গি সবসময় এক নয়।
অবাধ উচ্ছলতার যুগ ছিল সেটা। বৌদ্ধধর্মের কঠোর নীতিবাদে সুখ ও পাপবোধকে সম্পর্কিত বলে ধরা হতো। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে, শিল্পেও ভাস্কর্যে নরনারীর দৈহিক সম্পর্ক সোজাসুজি বর্ণিত হতে শুরু করল। সামন্তপ্রথায় পুরুষের শৌর্যবীর্যকে প্রাধান্য দেবার পর থেকে নারীপুরুষের মেলামেশা কমে গিয়ে সমাজের উচ্চস্তরে এক ধরনের পর্দাপ্রথা প্রচলন হয়েছিল। এর পরোক্ষ ফল হলো স্ত্রীপুরুষের সামান্যতম সম্পর্ক নিয়ে রোমান্টিকতার আতিশয্য। অনুরূপ পরিস্থিতি অন্যান্য সভ্যতাতেও দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসনা ও কামনাকে অন্যভাবে রূপান্তরিত করা হতো। ভারতবর্ষে তার অবাধ প্রকাশের স্বাধীনতা দেখা যায়। হয়তো অস্বাভাবিক সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার এটাই ছিল একটা উপায়। অনেকে ভারতীয় সংস্কৃতির যৌনপ্রতীকগুলোকে আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু এই যুগের কবিতা ও শিল্পের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সংস্কৃতভাষার নানা অসুবিধা সত্ত্বেও এই ভাষাতেই রাজসভায় সাহিত্য রচিত হচ্ছিল। উত্তর-ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলো তখনো যথেষ্ট উন্নত হয়ে ওঠেনি। পালিভাষাতে কেবল কিছু বৌদ্ধধর্মীয় বিবরণ, ব্যাখ্যা, ব্যাকরণ, আইনবিষয়ক রচনা পাওয়া যায়। সংস্কৃত ও নতুন ভাষাগুলোর মধ্যে পড়ে প্রাকৃতভাষারও উন্নতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। জৈনদের ধর্মীয় ভাষা আগে ছিল প্রাকৃত। কিন্তু তারাও এবার সংস্কৃতভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতি হয়ে উঠল। প্রাকৃতভাষায় সংস্কৃত আলংকারিক ভঙ্গির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রাকৃতভাষার প্রাচীন পরম্পরায় শেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা হলো— কণৌজের রাজা যশোবর্মনের জীবনী অবলম্বনে বাকপতি রচিত ‘গৌড়বধ’।
ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে প্রাকৃতভাষার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ ও তারপর স্থানীয় ভাষার ক্রমবিবর্তন ঘটেছিল। অপভ্রংশ ছিল প্রাকৃতের বিকৃত সংস্করণ। সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে যেসব মানুষ হুণ আক্রমণের পর মধ্য ও পশ্চিম-ভারতীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তারাই অপভ্রংশ ভাষার জন্মদাতা। জৈনদের ব্যবহৃত প্রাকৃতভাষার ওপর অপভ্রংশের বেশ প্রভাব পড়েছিল এবং এখানে প্রাচীন থেকে নতুন ভাষার রূপান্তর বেশ বোঝা যায়, বিশেষত জৈন মহারাষ্ট্রী গুজরাটীতে।
মহারাষ্ট্রের ভক্তি-আন্দোলনের মাধ্যমে মারাঠীভাষার উন্নতি হয়, কারণ সাধুসন্তদের ব্যবহৃত ভাষা ছিল এটাই। আধুনিক সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে গুজরাটী ভাষার প্রচলন ছিল। জৈন সাধুরা এই ভাষাকে উৎসাহ দেন। তাছাড়া, রামলীলা নৃত্যের সঙ্গে যে কাব্য রচিত হয়েছিল তাও ছিল গুজরাটী ভাষাতেই। বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া এবং বিহারের আঞ্চলিক ভাষাগুলো (ভোজপুরী, মৈথিলী ও মাগধী) মগধ অঞ্চলে কথিত প্রাকৃতভাষা থেকেই এসেছে। নতুন ভাষাগুলোর উন্নতির ব্যাপারে নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর দান আছে। কারণ, এরা সাধারণ লোকের ভাষার মাধ্যমেই ধর্মপ্রচার করতে চেষ্টা করছিল।
আঞ্চলিক রীতি ও বৈচিত্র্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল নানারূপে। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যেও এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এইযুগের মন্দিরগুলোতে ক্লাসিক্যাল শৈলীর স্থানে নতুন রীতির প্রকাশ দেখা যায়। উত্তর-ভারতের তিনটি অঞ্চলে এ যুগের বৃহৎ মন্দিরগুলো এখনো দেখা যায় : পশ্চিম-ভারতের রাজস্থান ও গুজরাটে, মধ্য-ভারতের বুন্দেলখণ্ডে এবং পূর্ব-ভারতের উড়িষ্যায়। সব মন্দিরগুলোর মূল স্থাপত্যে উত্তর-ভারতের ‘নাগর’ রীতির মন্দির ছিল বর্গাকৃতি। কিন্তু বর্গের চারটি বাহুর মধ্যভাগ থেকে কিছু অংশ বেরিয়ে থাকায় সমগ্র মন্দিরটি ক্রুশের আকৃতি পেত। কেন্দ্রীয় শিখরটি হতো সুউচ্চ, দুদিক থেকে ঈষৎ বেঁকে ওপরে উঠে যেত।
পশ্চিম-ভারতের মন্দিরশৈলীর উদাহরণ দেখা যায় শ্বেতপাথরে নির্মিত আবু পাহাড়ের জৈন মন্দিরগুলোতে। মন্দিরগুলোতে ভাস্কর্যের প্রাচুর্য থাকলেও ভাস্কর্য এখানে স্থাপত্যের অধীন।
বুন্দেলখন্দ অঞ্চলের মন্দিরের নমুনা হলো খাজুরাহের মন্দিরগুলো। এগুলোতেও প্রচুর ভাস্কর্যের নিদর্শন আছে। মন্দিরগুলো আকার, আয়তন ও গঠনরীতির সমন্বয়ে বিশিষ্ট শিল্পকর্মে পরিণত হয়েছে। খাজুরাহের (কোনারকের মতোই) দেহপ্রেমের ভাস্কর্য দেখে অনেকেই এই মন্দিরগুলোকে অশ্লীল শিল্প প্রদর্শনী আখ্যা দিয়েছেন। মন্দির যাঁরা দেখতে যান, তাঁদেরও নরনারীর মিথুনমূর্তি দেখতে এত আগ্রহ থাকে যে মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অন্য সৌন্দর্য অনেক সময় দর্শকদের কাছে অবহেলিত রয়ে যায়। উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর, পুরী ও কোনারকের মন্দিরগুলো আরো বিশালকায়। এগুলোর উচ্চতাও অনেক বেশি এবং ক্রমোন্নতির বক্ররেখাগুলো আরো স্পষ্ট ও সুন্দর।
দ্রাবিড় মন্দিরগুলোর তুলনায় উত্তর-ভারতের মন্দিরগুলোর চারপাশের জমির পরিমাণ ছিল কম। দাক্ষিণাত্যের মতো উত্তর-ভারতে মন্দির সমাজজীবনের কেন্দ্র ছিল না। খাজুরাহের মতো মন্দিরগুলো ব্যবহার করত কেবল উচ্চবর্ণের মানুষরা। জনপ্রিয় দেবমূর্তির পূজা কিন্তু মূলমন্দিরে হতো না। মন্দিরের সংলগ্ন অঞ্চলে কখনো কখনো এইসব মূর্তি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হতো। এই যুগের পর উত্তর-ভারতের মন্দির-স্থাপত্যের বিবর্তন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ পরবর্তী মন্দিরগুলো পুরনো ধাঁচেই তৈরি করা হয়েছে।
পূর্ব-ভারতে পাথর ও ধাতু, উভয়ের মাধ্যমেই এক বিশিষ্ট ভাস্কর্যরীতির জন্ম হয়েছিল। কালো বা গাঢ় ধূসর রঙের পাথর পালিশ করলে ধাতুর মতোই চকচক করত। নালন্দার বৌদ্ধমূর্তি নির্মাণের সময়ই এই পদ্ধতির সূচনা হয় এবং পালযুগে হিন্দু মূর্তিনির্মাণেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। চারুকলার ক্ষেত্রে ভারতের দান প্রধানত ভাস্কর্যে। এ যুগের চিত্রকলার যেটুকু নিদর্শন এখন পাওয়া যায়, ভাস্কর্যের তুলনায় তার মান অনেক নিচু। পরবর্তী শতাব্দীতেও ভাস্কর্যের স্বাধীন ক্রমবিকাশ ঘটলে ভাস্কর্য তার নিজের বিবর্তনের রীতি অব্যাহত রাখতে পারত। কিন্তু স্থাপত্যের অঙ্গ হিসেবেই ভাস্কর্যের প্রয়োগ সীমাবদ্ধ থাকায় এর সৌন্দর্য পরবর্তী যুগের মন্দিরের মতোই ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল।
উত্তর-ভারতের উচ্চবর্ণভুক্ত মানুষ জনপ্রিয় দেবতাদের ধর্মের মধ্যে স্থান দিতে অনিচ্ছুক ছিল। সমাজের উচ্চস্তরবাসীদের ধর্ম এবং সাধারণ মানুষের ধর্মের মধ্যে প্রভেদ এ যুগে আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ধর্ম থেকে সাধারণ মানুষের দেবদেবীকে একেবারে বাদ দেওয়াও সম্ভব ছিল না। সমাজের উচ্চস্ত রের মধ্যে হিন্দুধর্মের ‘মার্জিত’ রূপগুলো প্রচলিত রইল। বৈষ্ণব ও শৈব, উভয় সম্প্রদায়কেই বোঝাতে ‘হিন্দু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হলো আরব ও তুর্কীদের আগমনের পর। এরা প্রাথমিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত অধিবাসীকেই হিন্দু বলত।* তাদের নিজেদের, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মানুগামীদের অ-ঐসলামিকদের থেকে পৃথক করে বোঝাবার জন্যেও তারা ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করত। এই আখ্যাটি থেকে গেল এবং এখন উপমহাদেশের ব্রাহ্মণ্যধর্ম বোঝাতে ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। আরব বা তুর্কীরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের যে সবসময় এক করেই দেখত এমন নয়, কিন্তু পার্থক্য তেমন স্পষ্ট ছিল না। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মের দুই প্রধান শাখা,— বৈষ্ণব ও শৈবদের সম্পর্কেই ‘হিন্দ’ আখ্যাটি প্রচলিত হয়ে গেল।
[* আরবরা উপমহাদেশের নাম দিয়েছিল ‘আল-হিন্দ’। শব্দটি এসেছিল গ্রীক শব্দ ‘ইনডাস’ ও পারস শব্দ ‘সিন্ধু’ থেকে।]
এই যুগের শেষদিকে উত্তর-ভারতে দুটি ধর্মগোষ্ঠীই প্রধান হয়ে ওঠে জৈনধর্ম পশ্চিম-ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল এবং বর্তমান ভারতে ও পশ্চিমাঞ্চলেই বেশি জৈন-ধর্মাবলম্বী দেখা যায়। বৌদ্ধধর্ম আগেই পূর্ব-ভারতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং এখন ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। বুদ্ধদেবকে হিন্দুধর্ম বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সব হিন্দু এই ব্যাখ্যাকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। অ-বৌদ্ধদের বুদ্ধপূজা বড়জোর একটা সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টামাত্র ছিল। এই যুগের সামন্ততান্ত্রিক আবহাওয়ায় সামরিক শক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বৌদ্ধ-জৈনধর্মের অহিংসার নীতি আকর্ষণীয় মনে হয়নি। হিন্দু দেবতাদের মধ্যে শিব ও বিষ্ণুর দুই অবতার কৃষ্ণ ও রাম কেউই অহিংসা প্রচার করেননি। তবে, ভক্তি-আন্দোলনের নেতারা হিংসার বিরোধী ছিলেন।
এযুগে হিন্দুধর্মে যেসব পরিবর্তন হয়েছিল, তার মূলে ছিল প্রাচীন বিশ্বাস ও নতুন ব্যক্তিগত ঈশ্বরপূজার ধারণার দ্বন্দ্ব। মূর্তিপূজা ক্রমশ বেড়ে গেল এবং নতুন নতুন দেবদেবীর জন্যে নতুন মন্দির গড়ে উঠল। বিষ্ণু ও তাঁর নানা অবতাররা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। পুরাণ ও মহাকাব্যগুলো স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে প্রচারলাভ করল। অবতারদের নানা কাহিনী এভাবেই বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল।
অবতারদের মধ্যে কৃষ্ণই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর আগে কৃষ্ণ একজন বীর যোদ্ধা ও ভগবদ্গীতার দার্শনিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এবার গোষ্ঠের রাখাল কৃষ্ণের প্রণয়লীলার কথাই বেশি জনপ্রিয় হলো। কৃষ্ণকে তামিল দেবতা ময়োন-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে— উভয়ের নামের অর্থই কালো। বংশীবাদক দেবতা গোপিনীদের সাহচর্যে সময় অতিবাহিত করতেন। উত্তর- ভারতেও এই কাহিনীর মতোই মথুরার গোপালক কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে জড়িত। মনে হয়, উপদ্বীপ অঞ্চলের এক মেষপালক গোষ্ঠীর দেবতা ছিলেন ময়োন। এই গোষ্ঠী উত্তর দিকে এসে মধ্য ও পশ্চিম-ভারতে বসবাস শুরু করে। কৃষ্ণলীলার এই নতুন কাহিনী মথুরা থেকে সারা উত্তর-ভারতেই ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ কৃষ্ণ ও তাঁর প্রিয় গোপিনী রাধাকে পূজা করত উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসেবে। এরপর এর একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হলো যে, কৃষ্ণের জন্যে রাধার প্রেম হলো পরমাত্মার জন্যে মানবাত্মার আকুতি।
দাক্ষিণাত্য থেকে দার্শনিক বিতর্ক উত্তর-ভারতে চলে এসেছিল, যদিও এখনো দাক্ষিণাত্যের নানা অঞ্চলে এই বিতর্ক ছিল সবচেয়ে জীবন্ত। ষড়দর্শনের বিভিন্ন অঙ্গের পুরনো বিতর্ক এযুগেও চলেছিল। তবে, বিতর্কের মধ্যেও ঈশ্বরবাদের প্রবণতা বাড়ছিল। গোড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের বিভিন্ন শাখাগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৌদ্ধধর্মের বিরোধিতা শুরু করে দিল। এর উদাহরণ পাওয়া যাবে বাচস্পতি মিশ্র ও উদয়ন-এর রচনায়। ছয়টি দর্শনের মধ্যে বেদান্তদর্শন প্রাধান্য লাভ করছিল। অনেক বিতর্কের কেন্দ্র ছিল বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মমতে পার্থক্য। শঙ্করাচার্য ও রামানুজের শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে এই বিতর্ক চলত।
দক্ষিণ-ভারত থেকে ভক্তি-আন্দোলন ক্রমশ উত্তর-ভারতে এলো। কোনো কোনো জায়গায় আগেকার প্রচলিত ধর্মমতবিরোধী গোষ্ঠীগুলো নতুন ভক্তি মতবাদকেই গ্রহণ করে নিল। বলা বাহুল্যে, ভক্তিবাদ এইসব গোষ্ঠীগুলোর মতবাদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিল। বৈষ্ণব ও শৈব— এই দুই গোষ্ঠীরই সমর্থন পেয়ে ভক্তিবাদ কেবল যে এই দুটির মধ্যেই সেতু বন্ধনের কাজ করল তাই নয়, হিন্দুধর্মের অন্যান্য গোষ্ঠীর বিভেদও কমাতে সাহায্য করল। প্রকৃতপক্ষে ভক্তিবাদ ছিল কারিগরি পেশাভিত্তি গোষ্ঠীগুলোর প্রতিবাদের মাধ্যম। জনপ্রিয় ধর্মগোষ্ঠীগুলো অনেক সময় চমকপ্রদভাবে তাদের প্রতিবাদ জানাত। যেমন, কালামুখ ও কাপালিক। তবে, তাদের কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান ছিল সমাজবহির্ভূত অস্পৃশ্য গোষ্ঠীদের আদিম আচারের পুনরাবৃত্তি মাত্র। এরা কোনোদিন ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংস্পর্শে আসেনি, সেজন্যে প্রতিবাদের প্রশ্ন তাদের কাছে অবান্তর ছিল।
ধর্মীয় আচারের এত রকম বিভিন্ন রূপের সঙ্গে সমন্বয় ও আপোস করে তবেই ব্রাহ্মণ্যবাদ নিজের প্রতিষ্ঠা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এই সমন্বয় অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে করা হয় এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভবিষ্যতের জন্যে এই আপোসী মনোভাব খুব প্রয়োজনীয় ছিল। কোনো ছোট গোষ্ঠীর ধর্মমত ও আচার-অনুষ্ঠান যদি খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়ত, ব্রাহ্মণরা ক্রমশ তাকে প্রাচীন পরম্পরাগত ধর্মব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে তাকে মর্যাদা প্রদান করত। সমস্যার সৃষ্টি হতো শুধু তখনই, যখন এই নতুন আন্দোলনকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের পরিপন্থী মনে হতো।
শৈবদের মধ্যে নানারকম ভাগ ছিল। শঙ্করাচার্যের উপদেশমতো সরল পদ্ধতিতে উপাসনা থেকে তান্ত্রিক পদ্ধতি পর্যন্ত সবরকম পন্থাই অনুসরণ করা হতো। তান্ত্রিক পদ্ধতিই সবচেয়ে অদ্ভুত ধরনের ছিল এবং বৌদ্ধ ও শৈব পূজা- পদ্ধতিকে প্রভাবিত করেছিল।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে তন্ত্রবাদের জন্ম হলেও তান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত হতে শুরু করে অষ্টম শতাব্দী থেকে। উত্তর-পূর্ব ভারতে এর প্রভাব ছিল বেশি। তিব্বতের সঙ্গে তান্ত্রিকদের যোগাযোগ ছিল এবং কিছু কিছু আচার এসেছিল তিব্বতীয়দের পূজা পদ্ধতি থেকেই। দাবি করা হতো, তন্ত্রবাদ বৈদিক মতবাদের সরল সংস্করণ। সকল বর্ণ এবং নারীরাও তন্ত্রবাদের চর্চা করতে পারত। তান্ত্রিক পূজা- পদ্ধতির অঙ্গ ছিল— উপাসনা, রহস্যময় মন্ত্র, যাদুকরী চিহ্ন এবং কোনো বিশেষ দেবতার পূজা। মাতৃমূর্তিকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হতো, কেননা মাতৃগর্ভের জীবনের শুরু। এই উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে শাক্ত শক্তি-উপাসনার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এই মতানুসারে নারীর সৃষ্টি ক্ষমতাকে ‘শক্তি’ অভিহিত করা হতো এবং বলা হতো যে, এই শক্তিই সর্ব কর্মের মূল।*
[* শক্তি এবং মাতৃদেবতার ওপর এতখানি গুরুত্ব দেওয়া থেকে মনে হয়, আর্য-পূর্ববর্তী সংস্কৃতির মধ্যেই তন্ত্রবাদের বীজ লুকিয়েছিল। আরো উল্লেখযোগ্য যে, তন্ত্রবাদ শুরু হয়েছিল যেসব জায়গায়, সেগুলো ছিল প্রধানত অনাৰ্য অঞ্চল।]
তন্ত্রবাদের অনুগামী হতে গেলে গুরুর প্রয়োজন হতো প্রথমেই। তান্ত্রিক পূজাপদ্ধতির শেষ পর্যায়ে পঞ্চম-কারের প্রয়োজন হতো। এই পঞ্চ-ম-কার হলো— মদ্য, মৎস্য, মাংস, মুদ্রা (শস্য) ও মৈথুন। এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ভক্তরা যখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছত, তখন সমস্ত মানুষ ও সমস্ত বস্তু সমপর্যায়ভুক্ত। এই ধরনের প্রক্রিয়ার জন্যে গোপন আচার-অনুষ্ঠান প্রয়োজন হতো। অভিযোগ উঠেছে যে, তন্ত্রবাদে নৈতিক চরিত্র কলুষিত হতো। অভিযোগ যাই হোক না কেন, তন্ত্রবাদের জন্ম হয়েছিল গোঁড়া হিন্দু পূজা-পদ্ধতি ও ব্রাহ্মণশাসিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যে। তাই, তন্ত্রবাদে অন্য ধরনের আচার- অনুষ্ঠান, শক্তিপূজার ব্যবস্থা রেখে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। আবার, তন্ত্রবাদে যাদুবিদ্যার প্রতি আগ্রহ থেকে নানা ধাতু ও রাসায়নিক বস্তু নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষার শুরু হয় এবং তার ফলে কিছু কিছু আবিষ্কারও হয়েছিল। তান্ত্রিকরা মনে করে, কোনো কোনো বিশেষ রাসায়নিক বস্তুর সঙ্গে পারদ মিশিয়ে খেলে দীর্ঘজীবন লাভ হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার জন্যে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল, তন্ত্রবাদ তা নিয়েও চর্চা করে— এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের ওপর তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব পড়েছিল। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের যেসব যাদুকরী মন্ত্র ছিল, তার মধ্যে একটি জনপ্রিয় তিব্বতী মন্ত্ৰ হলো— ওম্ মণিপদ্মে হুম্। অর্থাৎ, দেখো মণি পদ্মের মধ্যে রয়েছে। ঐশ্বরিক মৈথুনের প্রতীক হিসেবেই এই মন্ত্রটি ব্যবহার হয়েছে।
ছোট ছোট উপাসনাপদ্ধতি ধর্মগোষ্ঠীগুলোকে গোঁড়া ব্রাহ্মণরা সবসময়ই অস্বীকার করেছে, এমন নয়। কতকগুলোকে সহ্য করে যাওয়া হতো। আবার কতকগুলোকে উৎসাহও দেওয়া হতো। কারণ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাহায্যেই পুরোহিতরা জীবিকানির্বাহ করত। ধর্মতাত্ত্বিকদের তুলনায় স্থানীয় পুরোহিতরা এইসব ছোট ছোট ধর্মগোষ্ঠীগুলোর প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল। পশ্চিম-ভারতের ফারসিদের প্রভাবে এইযুগে জরথুস্ত্র মতবাদের সূর্য-উপাসনাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্রমশ প্রচলিত দেবতাদেরও জনপ্রিয়তা বাড়াতে লাগল এবং নতুন দেবতাদেরও উপাসনা শুরু হলো। গ্রামাঞ্চলে গণেশ বা গণপতি দেবতার যে পূজা হতো, তাও জনপ্রিয়তা লাভ করল। মনে হয়, গোড়ায় গণেশকে পশুর মূর্তিতেই পূজা করা হতো। পরে ব্রাহ্মণরা তাকে শিব ও পার্বতীর সন্তান বলে বর্ণনা করে নতুন মর্যাদা দিল। এছাড়া উর্বরতার উপাসনার সঙ্গে যুক্ত মাতৃদেবতার পূজাও চলছিল অপ্রতিহতভাবে।
কর্ণাটকে লিঙ্গায়তদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে জৈনধর্ম দুর্বল হয়ে পড়ল। পশ্চিম-ভারতের জৈনরা প্রধানত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোক ছিল। জৈনরা ছোট হলেও সমৃদ্ধিশালী গোষ্ঠী ছিল। এদের পক্ষে কৃষিকাজ নিষিদ্ধ ছিল। তাই, ব্যবসায়ের লাভের টাকা আবার নতুন ব্যবসাতেই খাটাত। এছাড়া, জৈনরা গুজরাটের রাজার সমর্থন পেয়েছিল। সোমনাথের মন্দির ধ্বংসের ২০০ বছর পর, ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে আবু পাহাড়ে জৈনরা এক বিরাট মন্দির তৈরি করেছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ধর্ম হিসেবে জৈনধর্ম অত্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল এবং এটিকে প্রায় হিন্দুধর্মেরই ছোট একটি সম্প্রদায় হিসেবে মনে করা হতে লাগল। ওদিকে বৌদ্ধধর্মের এটুকু প্রভাবও অবশিষ্ট রইল না। এর জনপ্রিয়তা কমছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব দ্রুত বিলুপ্ত হতে থাকে। বৌদ্ধধর্মের যাদুকরীবিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিছুটা বিভ্রান্তিকর ঘটনা। ফলে, বৌদ্ধধর্মের সমস্ত নীতিশিক্ষার বদলে কিছু আচার-অনুষ্ঠানই প্রধান হয়ে উঠল। পূর্ব-ভারতে পালরাজা এবং উড়িষ্যা, কাশ্মীর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখল। তবে, রাজাদের সমর্থন ছাড়া সাধারণ মানুষও কিছুটা সমর্থন করেছিল। না হলে বৌদ্ধধর্ম একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু এরপর আঘাত এলো ইসলামের কাছ থেকে। বৌদ্ধধর্ম ও ইসলাম— দুটিই ছিল ধর্ম হিসেবে সংগঠিত; দুটি ধর্মই ধর্মান্তর গ্রহণের সাহায্যে নিজেদের ধর্মের সমর্থক বৃদ্ধি করত। এই নিয়ে দুই ধর্মের মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। বৌদ্ধ মঠগুলোর ওপর আক্রমণের ফলে বৌদ্ধরা পূর্ব-ভারত ত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পালিয়ে গেল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল-গুলোতেই বেশি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর পর থেকে উত্তর-ভারতে ভক্তিআন্দোলন খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল এবং বৌদ্ধদের শূন্যস্থান পূরণে কিছুটা সাহায্য করল। এর কারণ হলো, পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর কাছে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়েছিল।
এরপর আরব, তুর্কী ও আফগানদের আগমনের পর ভারতে এক নতুন ধর্মের উদয় হলো— ইসলাম। মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক প্রভাব এসেছিল পারস্য থেকে আগত মুসলিম অতীন্দ্রিয়বাদীদের মাধ্যমে। এদের বলা হতো, ‘সূফী’। এরা সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করে। এখান থেকে এদের শিক্ষার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল গুজরাট, দাক্ষিণাত্য ও বাংলাদেশে। প্রথমদিকে সূফীরা পারস্যের দার্শনিক চিন্তাই প্রচার করছিল। তারপর ইসলামী ও ভারতীয় চিন্তার সমন্বয়ে নতুন দার্শনিক চিন্তার জন্ম হলো। ঈশ্বরের সাধনায় সূফীরা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করত। মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকরা এদের পছন্দ করত না। এদের মতে, সূফীদর্শন ছিল অতিরিক্ত উদারনৈতিক। কিন্তু ভারতবর্ষে সূফী মতবাদ লোকপ্রিয় হয়। বিশেষত, যারা অতীন্দ্রিয়বাদ ও তপশ্চর্যায় আগ্রহী ছিল, তারা সূফী মতবাদে আকৃষ্ট হলো। এর অব্যবহিত পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে সূফীরা ভক্তিবাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল।
অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়টিকে অনেক সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন ‘যুগ’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই সময় ক্লাসিক্যাল হিন্দুসংস্কৃতির পতন ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগে বিদেশি শক্তির হাতে উপমহাদেশের পরাজয় ঘটেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সময় অন্ধকার যুগ নয়। বরং এই সময় ছিল গড়ে ওঠার যুগ। এ সম্পর্কে এখনো যথেষ্ট গবেষণার অবকাশ আছে। আধুনিক ভারতের নানা প্রতিষ্ঠান এই যুগেই স্থায়ীরূপ নিতে শুরু করেছিল।
ব্যাপক অর্থে সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো হিসেবে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব প্রায় আধুনিক যুগ পর্যন্ত বজায় ছিল এবং সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনে সামন্ততন্ত্রের বিশেষ প্রভাব দেখা গেছে। এইযুগে যেসব উপবর্ণের সূচনা হয়েছিল, তারা ক্রমশ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর আঞ্চলিক ভাষাগুলো থেকেই আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্ম। বর্তমানে ভারতের গ্রামাঞ্চলে (যেখানে অধিকাংশ ভারতীয়ের বাস) প্রচলিত মূলধর্ম ছাড়াও যেসব বিভিন্ন ধর্মীয় পূজা-পদ্ধতি দেখা যায়,— এগুলোও জন্ম নিয়েছিল ওই যুগেই। তাছাড়া, এই যুগের ঐতিহাসিক উপাদানের প্রাচুর্যের জন্যে ওই সময়ের সম্পূর্ণতর একটি চিত্র গড়ে তোলা সম্ভব।