১১. আজ সতেরো তারিখ

আজ সতেরো তারিখ।

বাবা কপালে অদৃশ্য ইসমে আযম নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। বারবার কারণে অকারণে জাজ সাহেবের দিকে হাসিমুখে তাকাচ্ছেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটায় তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন। একবার আমাদের দিকেও তাকালেন।

আমরা তিনজন এসেছি। মা, ভাইয়া এবং আমি। মা বসেছেন মাঝখানে, আমরা দুই ভাই মায়ের দুই দিকে।

ভাইয়ার চোখ-মুখ শক্ত। তার দুটা হাতই কাঁপছে। এই তুলনায় মা স্বাভাবিক। তিনি ভাইয়াকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললেন, মাগিটা তার মেয়ে নিয়ে আসে নাই? মাগিটা কই?

ভাইয়া কঠিন গলায় বললেন, মা, চুপ করে থাকতো।

আমাদের পক্ষের উকিল তার মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করার মতো ডানহাত মাথার ওপর দিয়ে বুলাচ্ছেন। তার মুখ এবং চোখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আজ একটা ম্যাজিক দেখাবেন। আদালতে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। জাজ সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, অর্ডার! অর্ডার! এতে আদালতের হৈচৈ কমল না। হৈচৈ হতেই থাকল। আমাদের উকিল বললেন, ইয়োর অনার, আপনার অনুমতি সাপেক্ষে আমি একটা ক্যাসেট আপনাকে শোনাতে চাই।

জাজ সাহেব অনুমতি দিলেন কি দিলেন না তা বোঝা গেল না। তবে আমাদের উকিল ক্যাসেট চালু করলেন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রেকর্ড করা বাবামায়ের কথাবার্তার ক্যাসেট। বাবার হাসি হাসি মুখ হঠাৎ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। তিনি এদিক-ওদিক তাকালেন। চোখ থেকে চশমা খুলে পাঞ্জাবির খুঁটে কাচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।

আমাদের উকিল ক্যাসেট বন্ধ করে বাবার কাছে এগিয়ে গেলেন। ধমকের গলায় বললেন, ক্যাসেটে এতক্ষণ যে পুরুষকণ্ঠ শুনলাম সেটা কি আপনার?

বাবা জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকালেন। এক পলক তাকালেন মার দিকে। তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।

উকিল সাহেব আবারো বললেন, কথার জবাব দিন। পুরুষকণ্ঠটি কি আপনার?

দ্রুত বিচার আইনের মামলা। একদিনেই রায় হয়ে গেল। ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আমাদের উকিল কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মার কাছে এসে বললেন, বুবু, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম সাত বছর। সাত বছর পারলাম না। সরি। এবারের জন্যে ক্ষমা করে দিন।

মা বললেন, মাগিটা আসে নাই? মাগিটার মুখের ভাব দেখার ইচ্ছা ছিল।

উকিল সাহেব বললেন, উনি আসেন নাই।

মাগিটার নাম যেন কী?

মালতী।

হিন্দু না-কি?

জি হিন্দু।

মা এমনভাবে চমকে উঠলেন যেন তাকে সাপে কামড়েছে। এতটা চমকানোর কারণ ছিল না। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হিন্দু এবং তার নাম মালতী— এই তথ্য মা জানেন। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে।

 

মালতী যদি মুকুল ভাইয়ের কোনো নাটকে অভিনয় করতেন তাহলে খুব বকা খেতেন। বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি তার আসছে না। তিনি বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

মুকুল ভাই ডিরেক্টর থাকলে চিৎকার করে বলতেন, অ্যাক্সপ্রেশন দাও। অ্যাক্সপ্রেশন। এত বড় খবর প্রথম শুনলে! তোমার স্বামীর ছয় বছরের জেল। অ্যাক্সপ্রেশন কোথায়? চোখ বড় বড় করে তাকাও। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেল।

মালতী (বাবা যাকে বিয়ে করেছেন তাঁকে নাম ধরে ডাকতে খারাপ লাগছে, কিন্তু কী করব, আর কিছু মুখে আসছে না) প্রায় ফিসফিস করে বললেন, উনার

ছয় বছরের সাজা হয়েছে?

আমি বললাম, জি।

জেলখানায় নিয়ে গেছে?

জি।

আপিল হবে না? আপিল?

আমি তো জানি না।

আজ যে তার মামলা এটাও আমাকে বলে নাই। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ল। কোনোদিন নামাজ পড়ে না, আজ পড়েছে। তারপর বলল, জরুরি কাজ আছে। ফিরতে দেরি হবে। তুমি যদি এসে আমাকে না বলতে তাহলে তো আমি জানতামই না যে, তাকে জেলখানায় নিয়ে গেছে।

আমি চুপ করে আছি। বলার তো নেইও কিছু।

বাবলু, এখন আমি কী করব বলো? কার কাছে যাব?

ঢাকায় আপনার কোনো আত্মীয় নেই?

না। খুলনায় আমার বড়বোন থাকেন। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। বাবা, তুমি একটু বসো।

উনি হঠাৎ করেই ছুটে শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি চাপা গলার কান্না শুনতে পাচ্ছি। যূথী আগের মতোই খেলনা নিয়ে খেলছে। আমি তার সামনে বসলাম।

যূথী কী করো?

খেলছি।

আজ কি তোমার জ্বর আছে?

না।

তুমি কি ছবি আঁকতে পার?

পারি।

আমাকে একটা ছবি এঁকে দাও।

রঙপেন্সিল নাই তো। বাবাকে বলেছি। বাবা কিনে দেবে, তখন আঁকব।

আমার নাম কি তোমার মনে আছে?

আছে। বাবলু ভাইয়া।

যূথীর মা প্রায় আধঘণ্টা পরে দরজা খুললেন। তাঁর চোখ-মুখ ফোলা। নাক দিয়ে পানি ঝরছে। তিনি সহজ গলায় বললেন, বাবা, চা খাবে? চা করি?

না।

যূথীর বাবাকে যখন জেলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কি সে কিছু বলেছে?

না। আপনার কাছে কি টাকা আছে?

সতেরশ টাকা আছে।… ঠিক আছে বাবা, তুমি যাও। তুমি বসে থেকে কী করবে?

 

সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে হালকা উৎসবের আমেজ। মা মিলাদের ব্যবস্থা করেছেন। বাদ মাগরেব মিলাদ হবে। মিলাদের শেষে হাজির তেহারি। মা নিজে নতুন (কিংবা ইস্ত্রি করা) শাড়ি পরেছেন। সাজগোজও মনে হয় করেছেন। তাকে সুন্দর লাগছে।

নীলা ফুপুকেও সুন্দর লাগছে। তার কারণ অবশ্যি ভিন্ন। তিনি হেভি সাজ দিয়েছেন। নতুন এক অল্পবয়েসী পরিচালক মিউজিক ভিডিও করছে। তিনিও একজন মডেল। আমাকে দেখে নীলা ফুপু বললেন, ভাইজানকে নাকি জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে?

আমি বললাম, হুঁ।

নীলা ফুপু বললেন, ভাইজানের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার ছিল। তবে এতদিনের জেল না হয়ে তিন-চার বছরের হলে ঠিক হতো।

আমি বললাম, তোমাকে সুন্দর লাগছে ফুপু।

ফুপু আনন্দিত গলায় বললেন, ফুল মেকাপ এখনো নেওয়া হয় নি। চোখ আঁকা বাকি। কপালের টিপ মাঝখানে হয়েছে নাকি দেখ তো।

হয়েছে।

আমার সমস্ত টেনশন টিপ নিয়ে। তাড়াহুড়া করে যখন টিপ দেই তখন মাঝখানে পড়ে। সময় নিয়ে যখন দেই তখন হয় ডানে বেশি যাবে কিংবা বামে বেশি যাবে।

আনন্দিত মানুষজন দেখতে ভালো লাগে। ফুপুকে দেখতে ভালো লাগছে। তাঁর ভাইজানের দুঃখও তাকে স্পর্শ করছে না। তিনি এখন মিউজিক ভিডিওর জন্য তৈরি।

আমি বললাম, গান কোনটা হবে ফুপু?

ফুপু বললেন, কূলহারা কলংকিনীটা হবে। ফোক গান, কিন্তু করা হবে মডার্ন ফরম্যাটে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুই আমাকে একটা ক্যাব ডেকে দে। বলবি উত্তরা যাব।

ফুপুর জন্যে ক্যাব ডাকতে হলো না। মিউজিক ভিডিওওয়ালারা একটা মাইক্রোবাস পাঠিয়েছে। ফুপুর আনন্দের সীমা রইল না। যেন তিনি তাঁর নিজের কেনা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন এমন অবস্থা।

মাগরেবের নামাজের পর মিলাদ হলো। যে মাওলানা মিলাদ পড়াতে এসেছেন তিনি খুবই হতাশ। কারণ মিলাদে আর কেউ আসে নি। আমি একা। মাওলানা সাহেব বললেন, লোকজন কই?

আমি বললাম, লোকজন নেই, আমি একা। আমার বড়ভাই থাকতেন কিন্তু উনার মাথা ধরেছে, উনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আপনি শুরু করে দিন।

তুমি আর আমি? আর কেউ আসবে না?

না।

এমন মিলাদ আমি আগে পড়াই নাই। কি বললা শুরু করব?

জি, শুরু করে দিন।

কিসের উদ্দেশ্যে মিলাদ এটা বলো। সেইভাবে দোয়া করতে হবে।

একজনকে জেলে ঢুকানো গেছে, সেই আনন্দে মিলাদ।

কাকে জেলে ঢুকানো হয়েছে?

আমার বাবাকে।

মাওলানা সাহেব কথা বাড়ালেন না। মিলাদ শুরু করে দিলেন।

ইয়া নবী সালাম আলাইকা।
ইয়া রসুল সালাম আলাইকা।

হে নবী, আপনার প্রতি সালাম।
হে রসুল, আপনার প্রতি সালাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *