আজ এতদিন পরে ভাবতে অবাক লাগে, সেদিন সেই প্রথম দেখা ছোটমা’র চেহারাটা কেমন করে অমন সুন্দর লেগেছিল। ভূতনাথ যেন অত রূপ মানুষের শরীরে আর কখনও দেখেনি। এক এক জনের রূপ আছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, প্রশান্তির প্রলেপ লাগায়, আলা ধরায় না—সে-ও বুঝি তেমনি। হঠাৎ তার সমস্ত শরীরে কে যেন চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে দিলো। চোখ নাক মুখের অমন শ্ৰী বুঝি মানুষের মধ্যে দুর্লভ। কিন্তু তা ছাড়াও সব মিলিয়ে যে-টা সব চেয়ে প্রথম নজরে পড়ে সে তত ছোটমা’র চেহারার খুটিনাটি নয়। ভূতনাথের মনে হয়েছিল—সেই চারটে দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে যেন কোটি কোটি মানুষের প্রাণের নিভৃততম কল্পনা। যুগযুগান্তের লাখ লাখ যুগের সমস্ত সৌন্দর্যের তিল তিল আহরণ করে যেন ছোটমা’র অবয়বে তিলোত্তমা মূর্তি নিয়েছে। তবু সে রূপ যেন শারীররূপ নয়, যেন তাকে স্পর্শ করা যায় না, ধরা ছোঁয়ার অনেক ঊর্ধ্বে সে, চাওয়া-পাওয়ার জগতের বাইরে এক অব্যক্ত বাণীময় রূপক কাব্য। যেন দেহ স্পর্শ করলে দেখা যাবে–দুধের ফেনার চেয়ে তা নরম, কাছে গেলে মনে হবে–আকাশের রামধনুর চেয়ে তা বর্ণাঢ্য। এতখানি প্রশান্তি বুঝি প্রশান্ত মহাসাগরেও নেই।
ভূতনাথের দিকে চোখ তুলে ছোটমা এক বার ছোট করে ঘোমটা তুলে দিলে মাথায়।
তারপর বংশীই যেন চোখের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলে—এই-ই মালাবাবু।
ছোটমা বললে—এসো-বোসো এখানে।
মেঝেতে একখানা গালচে পাতা। ভূতনাথ বসলো।
ছোটমা বললে—বংশী তুই একটু বাইরে দাঁড়া গিয়ে, আমি ডেকে পাঠাবো।
চিন্তাকেও কী একটা কাজের হুকুম করে বাইরে পাঠিয়ে দিলে ছোটমা। কেমন যেন প্রচণ্ড এক অস্বস্তিতে ঘামতে লাগলো ভুতনাথ। ছোটমা’র চেহারার দিকে বিশেষ করে মুখের দিকে যেন হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখলেও তৃপ্তি হয় না। মাথা নিচু করে বসেছিল ভূতনাথ। কিন্তু কেবল মনে হচ্ছিলো–আর একবার মুখ তুলে দেখা যায় না মুখখানার দিকে।
ছোটমা’র গলা শোনা গেল—ওরা তোমাকে শালাবাবু বলে ডাকে সবাই। আসল নামটা কেউ জানে না। বংশীকে বলেছিলুম,
ও-ও বলতে পারলে না।
ভূতনাথ মাথা নিচু করেই বললে—আপনিও ওই নামেই ভাকবেন।
—তবু বাপ মায়ের দেওয়া একটা নাম তত আছে তোমার।
–বাপ মাকে চোখে দেখিনি, আমার নাম রেখেছিল পিসীমা। আমার নাম শ্ৰীভূতনাথ চক্রবর্তী। নামটা সকলের পছন্দ হয় না।
—তুমি ব্রাহ্মণ–তা হোক, তবু তোমাকে আমি ভূতনাথ বলে ডাকবো–কেমন? বয়সে আমি তোমার ছোট হলেও সম্পর্কে তো বড়-আমাকে তুমি বৌঠান বলে ডেকো।
ভূতনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর চোখ তুলে বললে—আমাকে ডেকেছিলেন কী জন্যে, বংশী বলছিল—
—বলছি, কিন্তু তার আগে তুমি একটু জল খেয়ে নাও। আমার হাতে খেতে তোমার আপত্তি নেই তো?
বৌঠানের চাবির আর চুড়ির শব্দ কানে এল। পায়ের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। চওড়া পাড় শান্তিপুরে শাড়ির নিচে যে-টুকু দেখা যায় তা হয় তো শরীরের এক সামান্যতম অংশ। ছোট ছোট আঙুলগুলো আলতার বেষ্টনীতে অপরূপ অনবদ্য মনে হলো। ধবধরে দুধের মতো সাদা নখ—আলতায় ঘেরা। টোপা কুলের মতো যেন রসে ভরা।
চিন্তা শ্বেতপাথরের রেকাবীতে এনে রাখলে খাবার।
বৌঠান বললে—সব আমার যশোদাদুলালের প্রসাদ-তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—চিন্তা একটু জল দে ভূতনাথের হাতে।
বৌঠানের মুখে নিজের নামটা যেন আজ কেমন সুন্দর মনে হলো। ও নামটা আগে আর কারুর মুখে তো এত সুন্দর ঠেকেনি। মন্ত্রচালিতের মতো এক-একটা করে মিষ্টি মুখে পুরতে লাগলো ভূতনাথ। তারপর আশে পাশে চেয়ে দেখলে। ঘরের এক পাশে একটা প্রকাণ্ড পালঙ্ক। ছাদের কড়িকাঠ থেকে একটা রঙিন মশারি ঝুলছে। চূড়ো করে বাঁধা। এতখানি পুরু গদির ওপর শাখের মতো সাদা চাদর ঢাকা। দুটো মাথার বালিশ। সবই প্রকাণ্ড। পঙ্খের কাজ করা দেয়ালের গায়ে অনেক ছবি। পটের ছবি, শ্রীকৃষ্ণের পয়স ভক্ষণ। গিরি-গোবর্ধনধারী যশোদাদুলাল। ‘ময়ন্তীর সামনে হাসরূপী নলের আবির্ভাব। মদন ভস্ম-শিবের কপাল দিয়ে ঝাটার মতন আগুনের জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। আরো কত কি। একটা কাচের আলমারিতে কত পুতুল! বিলিতি মেমঘাগরা পরা। গোরা পল্টন-মাথায় টুপি। খোপ মাথায় কালীঘাটের বেনে-বউ। আর মেঝের এক কোণে ছোট একটা জলচৌকির উপর ধূপ ধুনো জ্বলছে। ফুল আর বেলপাতার ভিড়ের মধ্যে রূপোর সিংহাসনের ওপর বসা শ্ৰীকৃষ্ণ। বৌঠানের যশোদাদুলাল। সোনার মূর্তি। বাঁশিটা পর্যন্ত সোনার তৈরি।
–পান খাও?
–না তো।
—খাও, একদিন খেলে দোষ হয় না, বৌঠান দিচ্ছে খেতে হয়।
পান চিবুতে চিবুতে ভূতনাথ ভাবছিল, হঠাৎ কীসের জন্যে এত আয়োজন আপ্যায়ন। এখন যদি হঠাৎ কোনো কারণে ছোটবাবু এসে পড়ে ঘরের মধ্যে। বংশী অবশ্য বলেছে—ছোটবাবু রাত্রে কোনোদিন বাড়ি থাকেন না। চুনীর কাছে থাকেন। রূপো দাসীর মেয়ে চুনীবালা। বাড়ি করে দিয়েছেন তাকে জানবাজারে। ভূতনাথ বললে—এখন আসি তা হলে বৌঠান—
—সে কি, আসল কথাটাই যে বলা হলো না—বংশী বলছিল, তুমি নাকি ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে কাজ করে?
–সে এমন কিছু নয়, ব্ৰজরাখাল বলেছে, যদ্দিন ভালো চাকরি পাই…তারপর ওদের আপিসে চাকরি খালি হলেই সায়েবকে বলে…
আমি সে-কথা বলছি না—’মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয় বলতে পারে?
হঠাৎ এবার ভূতনাথ সোজাসুজি বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। পাতলা দুটি ঠোট। লালচে আভা বেরোচ্ছে। কানের হীরে দুটো টিক টিক করে দুলছে। আর কপালের ওপর দু একটা অবাধ্য চুলের ওড়া। ঠিক তার নিচে দুটো কালো চোখের সহজ অথচ সুগভীর চাউনি। কাজল পরেছে নাকি বৌঠান!
বৌঠান আবার বললে-বংশী কিছু বলেনি তোমায়?
ভূতনাথ জবাব দিলে–বংশী শুধু বললে—আপনি আমায় ডেকেছেন। আমি আসবো-আসবে করে আসতে পারিনি—আপিস থেকে ফিরতেই দেরি হয়ে যায় রোজ।
–খুব বুঝি কাজ সেখানে? সহানুভূতি মেশানো বৌঠানের গলায়।
–একা তো সব আমাকেই করতে হয় কিনা—সুবিনয়বাবু শুধু টাকাকড়ির হিসেবটা রাখেন।
–সুবিনয়বাবু কে? তোমার মনিব বুঝি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, ব্রাহ্ম ওঁরা, কিন্তু তোক খুব ভালো। আমার জন্যে ওদের ঠাকুরটাকেও তাড়িয়ে দিয়েছেন।
–কেন?
ভূতনাথ সবিস্তারে সব বললে। কত টাকা মাইনে, জবার ব্যবহার, জবার মা’র পাগল হওয়ার কথা—বাদ দিলে না কিছুই। যেন অনেক কথা বলতে আজ ভালো লাগলো ভূতনাথের। কোনো নারী আগে কোনোদিন ভূতনাথের কথা এমন করে মন দিয়ে শোনেনি, শুনতে চায়নি। এখানে এই বড়বাড়ির অন্দরমহলে এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে কে জানতো। সহজ সাদাসিধে দুঃখের কাহিনী ভূতনাথের। ভালো করে গুছিয়ে বলবার ক্ষমতাও নেই তার। অথচ কে এমন করে ওকে আদর করে বসিয়ে খাইয়েদাইয়ে তার মুখ থেকে গল্প শোনে। এখন বৌঠানের মুখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতেও যেন আর লজ্জা হলো না ভূতনাথের। বৌঠানের হাতে চাবির গোছাটা মাঝে মাঝে টুং-টুং করে বাজছে। সঙ্গে সঙ্গে চুড়িগুলোও। সিঁথির ওপর জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সিঁদুরের রক্তিমা। মনে হয়, বৌঠান যেন এখনই সিঁদুর পরে উঠলে টাটকা। পাতাকাটা চুলের ওপর এখনও জল চকচক করছে। অল্প অল্প হাসি-হাসি মুখ। পাতলা ঠোট দুটো গল্প শুনতে শুনতে একটু একটু দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে বৌঠান। ভূতনাথের এমন ভালো আর যেন আগে কখনও লাগেনি। ভূতনাথ আবার বললে—এবার আসি বৌঠান, আপনার খুব দেরি করে দিলাম।
কিন্তু কথাটা বলে ভয়ও হলো। যদি সত্যি সত্যিই এখনি উঠে চলে যেতে হয়।
বৌঠান বললে—খুব তো বুদ্ধি তোমার-সাধে কি আর জবা তোমায় বোকা বলে—এতদিন এ-বাড়িতে আছো, এখনও টের পাওনি কিছু? এ-বাড়িতে রাত বারোটায় সন্ধ্যে হয়, জানো না?
ভূতনাথ চুপ করে রইল এবার।
বৌঠান এবার বললে—তা হলে কত দাম ওর—এই ‘মোহিনীসিঁদুরে’র?
—দাম, দু’ টাকা সওয়া পাঁচ আনা—কিন্তু এখন আমার টাকার দরকার নেই।
—কেন? চুরি করে আনবে বুঝি? তা হচ্ছে না। তারপরে বৌঠান ‘চিন্তা’ বলে ডাকতেই চিন্তা ঘরে ঢুকলো। বৌঠান বললে—এই চাবি নে চিন্তা, ভূতনাথকে পাঁচটা টাকা বের করে দে তো।
—পাঁচ টাকা আমি কী করবে? ভূতনাথ প্রতিবাদ করতে গেল।
—বাকিটা না হয় ফেরৎ দিও—বলে পাঁচটা চকচকে রূপোর টাকা হাতের মধ্যে গুজে দিলে বৌঠান। তারপর বললে সিঁদুরের কথাটা কাউকে যেন বলল না আবার।
ভূতনাথের ততক্ষণে বাকশক্তি রোধ হয়ে গিয়েছে। মনে হলো “বৌঠানের হাতের মধ্যে যেন কোনো যাদু আছে! এত নরম। এত স্নিগ্ধ! বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। এখন যেন হঠাৎ বড় গম্ভীর দেখাচ্ছে বৌঠানের মুখটা।
বৌঠান বললে—সিঁদুরের ব্যাপারটা কাউকে বলবে না—মনে থাকবে তো?
–আপনি যখন বারণ করছেন, তখন কাউকেই বলবো না।
–বারণ না করলে বুঝি বলে বেড়াতে? বৌঠান হেসে ফেললে। ভূতনাথ এ-হাসির অর্থ ঠিক বুঝতে পারলে না। বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে বোবার মতো চুপ করে রইল।
বৌঠান বললে হাঁ করে দেখছো কী? জানো না, এ-সব কথা কাউকে বলতে নেই।
এবার আরো হেঁয়ালি ঠেকলে ভূতনাথের। সিঁদুর কিনতে দেওয়ার মধ্যে এমন কী গোপনীয় থাকতে পারে! কত লোকই তে সিঁদুর চেয়ে চিঠি পাঠায়। দোকানেও আসে কত লোক। কিন্তু কোন্ দুর্বোধ্য রহস্য আছে বৌঠানের এই সিঁদুর চাওয়ার পেছনে?
ভূতনাথ বললে—আপনাকে কথা দিচ্ছি বৌঠান–আমি কাউকে বলবো না।
—এমন কি বংশীকেও নয়।
–বংশীকেও নয়-কথা দিচ্ছি।
–তোমার ভগ্নীপতিকেও নয়।
–কথা দিলাম।
–এমন কি জবাকেও নয়—সে-ও ঠিক বুঝতে পারবে না, বিয়ে হলে বুঝতো।
ভূতনাথ নিজের অজ্ঞাতসারেই প্রশ্ন করল—কেন?
সে তুমি বুঝবে না ভাই, বিয়ে হবার আগে সব মেয়েমানুষরাও বোঝে না।
ভূতনাথ আবার প্রশ্ন করলো—আর রাধা? রাধার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বেঁচে থাকলে সে-ও বুঝতে পারতো তো?
বৌঠানের চোখে মুখে কেমন ফিকে হাসি ফুটে উঠলো। বললে—তা কি বলা যায়, যার কপাল ভাঙে, সেই বোঝে, মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় লজ্জা, এর চেয়ে বড় অপমান আর যে নেই ভাই।
ভূতনাথ বৌঠানের গলার আওয়াজে কেমন যেন চমকে উঠলো। ভালো করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। কাঁদছে নাকি বৌঠান! তবে চোখে মুখে অত হাসির ছটা কেন! সেই ভাবে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক সময়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হেসে উঠলো বোঠান। সাদা সাদা ঝিনুকের মতো দাঁত চিক চিক করে উঠলো বৌঠানের। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এবার হরদম হাসতে লাগলো। বললে—এ এক অবাক বাড়ি ভাই—অবাক-বাড়ি। আমার বাপের বাড়িও দেখেছি—-আমার মা-র কথাও একটু-আধটু মনে পড়ে। আমি গরীব লোকের মেয়ে বটে—কিন্তু এ এক অবাক বাড়ি—অবাক বাড়ি এটা-আবার মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তেমনি হাসতে লাগলো বৌঠান। ভূতনাথ যেন কেমন অভিভূতের মতো বসে রইল সেই দিকে চেয়ে। পাগল নাকি ছোটমা। এতক্ষণ কি উন্মাদের সঙ্গে বসে সে গল্প করছে ধবধবে ফরসা হাত, মুখ, পা-সব থর থর করে কাঁপছে বৌঠানের। টোপাকুলের মত আলতা মাখা পায়ের আঙুলগুলো এক একবার বোধহয় হাসির দমকে সঙ্কুচিত হচ্ছে।
একবার মনে হলো হাত দিয়ে জোর করে বৌঠানের আঁচলটা টেনে নিয়ে দেখে বৌঠান কাঁদছে না সত্যি সত্যি হাসছে।
কিন্তু আঁচল যখন খুললো বৌঠান তখন একেবারে স্বাভাবিক মানুষ। বললে—আমাদের বাড়ির পুরুষমানুষদের দেখছো তো ভাই, শুনেছোও নিশ্চয় অনেক কিছু–এক এক সময় ভাবি, এ কী রকম করে হলো, এত বড় বাড়ি, এত নাম-ডাক, এত পয়সা এঁদের, কার পাপে এমন হলো এরা, কিন্তু তখনি মনে হয়, দোষ আর কারো নয়, দোষ আমারই কপালের। আর জন্মে কত পাপ করেছিলাম—তাই সব পেলাম, মেয়েমানুষ যা চায় সব’ পেলাম, রূপ পেয়েছি জগদ্ধাত্রীর মতো, লোকে তো তাই বলে, অমন দেবতার মতো বাপ, মায়ের অভাব বুঝতে দেননি, এত বড় বাড়ির বউ হলাম, টাকাকড়ি, গাড়ি, বাড়ি, চাকর, বাঁদি-যা কেউ পায় না—কিন্তু আসল জিনিষেই ফাঁকি—এর চেয়ে—
ভূতনাথ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলো।
বৌঠান বললে—স্বামিজীকে তুমি চেনো না, আমার বাপের বাড়ির কুলগুরু, তাঁকে বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন—পটুর কপাল এমন করে ভাঙলো কেন গুরুদেব?—( আমার ভালো নাম পটেশ্বরী কি না, বাবা আমাকে তাই পটু বলে ডাকতেন) তা গুরুদেব বললেন:..। যাকগে সে-সব তোমার শুনে কাজ নেই ভাই।
ভূতনাথ কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলোনা, বলুন বৌঠান—শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে কিন্তু–
বৌঠান বললে—স্বামিজীকে তুমি দেখোনি ভাই, তাই হয় তত বিশ্বাসও হবে না তোমার—কিন্তু বাবা বলেন—উনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ, ওর কথা মিথ্যে হয় না, হিমালয়ে গিয়ে তিনি পঞ্চাশ বছর ধ্যানে কাটিয়েছেন, তারপর এখানে এসে এখন ধর্ম প্রচার করছেন।
-কী বললেন তিনি?
বৌঠান এবার মুখে আঁচল চাপা না দিয়েই খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললে-গুরুদেব বললেন, পটু আর জন্মে ছিল দেবোলা, দেবসভায় বাহ্মণের অপমান করেছিল—তারই শাপে এ-জন্মে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে—এ জন্মটা ওর এমনি করেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন—কীসে মুক্তি হবে ওর?
গুরুদেব বললেন–স্বামী সেবায়।
–স্বামী সেবায়?
—হ্যাঁ ভাই, স্বামী সেবায়, এ-বাড়ির ছোটকর্তাকে দেখছে তো? এতদিন আছো দেখেছো নিশ্চয়ই, তোমার কী মনে হয় জানিনে ভাই, কিন্তু আমাদের ভাড়ারে যে রাঙাঠাকমা আছে–সবাই তাকে রাঙাঠাকমা বলে, এ-বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো ঝি, আমার শাশুড়ীর বিয়ের সময় এ-বাড়িতে আসে, তা তারই মুখে শুনেছি ছোটবেলায় ছোটকর্তাকে নাকি দেখতে ছিল ঠিক দেবকুমারের মতো–যেমনি সুন্দর শ্ৰী, তেমনি সুন্দর গড়ন, তা শুনে ভাবি আমিই যদি দেবোলা হতে পারি তো ছোটকর্তারও দেবকুমার হতে দোষ কী! হয় তো শাপভ্রষ্ট দেবকুমারই হবেন, কী বলে ভাই, পৃথিবীতে এসেছেন প্রায়শ্চিত্ত-কাল পূর্ণ করতে। তা যেন হলো, কিন্তু একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয় ভাই-একএকদিন যখন রাত্রে ঘুম আসে না, যশোদাদুলালের পায়ের তলায় মাটিতে শুয়ে পড়ে থাকি, তখন এক-একবার ভাবি আমার বিধাতা পুরুষের দেখা পেলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতুম।
–কী কথা বৌঠান?
বৌঠান থামলো। বললে—না ভাই থাক, তুমি এক কাজ করো—সিঁদুরটা নিয়ে এসো–আর যদি পারো তত তোমার মনিবকে জিজ্ঞেস করে, মানুষদের বেলায় তোমাদের মোহিনীসিঁদুর’ যদিই বা খেটে থাকে, দেবকুমারদের বেলায় এ-সিঁদুর খাটবে কি না—
ভূতনাথ হেসে উঠলো।
বৌঠান বললে—হাসি নয় ভাই, আমি সত্যিই বলছি, বাবা আর গুরুদেব তো বলেছেন স্বামীসেবা করতে—কিন্তু স্বামীকে কাছে পেলে তবে তো সেবা করবো! তাই সেদিন পাঁজি পড়তে পড়তে হঠাৎ ওই বিজ্ঞাপনটা নজরে পড়লো তারপর বংশীও বললে কথায় কথায়—তুমিও নাকি কাজ করে ওখানে।
অনেক দিনের আগেকার সব কথা। সাইকেল-এ যেতে যেতে ভূতনাথের আজো যেন সে-দৃশ্যটা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ মনে পড়ে। সেই বড়বাড়ির তেতলার শেষ ঘরখানার কথা। পটেশ্বরী বৌঠানের ঘর। উঁচু পালঙ্ক। বিলিতি পুতুলে ভর্তি আলমারি। আর সামনে বসে অপরূপ রূপসী বাড়ির ছোটবউ। যে-ঘরে ছোটকর্তার পদধূলি পড়ে না। যে-ঘরে বসন্ত-বাহার করুণ আর্তনাদ করে রাত্রের নির্জনে। যশোদাদুলালের সেবায় স্বামী-সেবা যেখানে হাস্যকর হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের হিন্দু-আভিজাত্য যেখানে মোগল আমলের চৌকাঠ পেরিয়ে ব্রিটিশ আমলের নাচ-দরবারে গিয়ে থেমেছে। অনেক কোতল-কচ্ছলের পর শাসন মানতে চায় না নবজাগ্রত মন। নিয়মানুবর্তিতাকে যখন শৃঙ্খল বলে মনে হয়। কিন্তু ওদিকে চোখ রাঙিয়ে ছুটে আসছে আর এক সভ্যতা। ঘড়ির কাটার মতো সময়নির্দেশ করে পদক্ষেপ করে করে চলে যন্ত্রযুগ। গম-ভাঙা কন্স থেকে শুরু করে রেল-চলা পর্যন্ত অনেক পথ অনেক প্রান্তর পার হয়ে আসছে ১৮৯৭ সন। ওরা চেয়ে দেখলে না কেউ। মুখ ফিরিয়ে রইল। ওই হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণিরা। বড়বাড়ির ইট চুন সুরকীর মধ্যে গাছের শেকড় তখন হাত বাড়িয়েছে অনেকখানি। মিছিমিছি মাদুলি পরে ছোটবউ, যশোদাদুলালকে মিছরিভোগ দেয়, শাড়ি গয়না আলতা পরে সারারাত প্রতীক্ষায় বসে থাকে। আর পাঁজির পাতায় উদ্গ্রীব আগ্রহে ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র বিজ্ঞাপনটায় চোখ বুলোয়।
অত বড় বাড়ির বউ। ঠিক এমন করে আলাপ পরিচয় হবে ভাবা যায়নি। ভূতনাথ ভেবেছিল-দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে সে আর পর্দার আড়াল থেকে কথা হবে ঝি-র মারফৎ। কিন্তু এ যেন কেমন হলো। এত ঘরোয়া। এত ঘনিষ্ঠতা। প্রথম দিনের পরিচয়ে বিশ্বাস না হবার মতো। তফাৎ তো কিছু নেই আর পাঁচজনের সঙ্গে। তবে হয় তো আড়ালে থাকে বলেই এত কৌতুহল, এত কল্পনা-বিলাস ওদের নিয়ে। কিম্বা হয় তত বৌঠান গরীব ঘরে মেয়ে বলেই এ-বাড়িতে এক ব্যতিক্রম।
যাবার আগে বৌঠান কললে—আমার যশোদাদুলালকে প্রণাম করলে না ভূতনাথ।
ভূতনাথ সপ্রতিভ হয়ে এগিয়ে গেল বিগ্রহের দিকে। যশোদাদুলাল একপদ হয়ে সোনার বাঁশি বাজাচ্ছেন। টানা টানা প্রকাণ্ড দুটি চোখ। সামনে গিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করলো ভূতনাথ। কিন্তু মনে হলো তার সে-প্রণাম যেন ঠাকুরের পায়ে গিয়ে পেঁছিলো না। বাইরে বেরিয়ে এসেও তার যেন মনে হয়েছিল-প্রণাম সে কাকে করেছে? সত্যি সত্যিই কি বৌঠানের ঠাকুরকে? না আর কাউকে। অথচ ঠোনকে প্রণাম করার তো কোনো অর্থ হয় না। বৌঠানকে দেখে কি শুধু ভক্তিই হয়েছিল? আর কিছু নয়?
চলে আসবার আগে বৌঠান বলেছিল—সিঁদুরটা নিয়ে তুমি নিজেই চলে এসো, বংশীকে বললেই বংশী তোমায় পথ দেখিয়ে দেবে।
বাইরে বেরিয়ে এসে ভূতনাথের মনে হলো—বৌঠান যেন তাকে আগে থেকেই চিনতো। কিন্তু কেমন করে চিনলে! তবে কি বংশীই তাকে সব বলেছে।
বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে বংশী বললেন শালাবাবু, আমি কেন বলতে যাবো, আমি তো কিছু বলিনি—আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ছোটমা-শালাবাবু লোক কেমন। তা আমি যা যা জানি সব বলেছি—মাইরি বলছি, আমি আপনার নিন্দে করিনি আমি তেমন লোক নই শালাবাবু।
বংশী চলে গেল কাজে।
ছুটুকবাবুর গানের আসর তখনও চলছে। চামেলি ফুলি চম্পা। হৈ হৈ শব্দে সমে এসে গান থামলো। এখন আর আসরে যাওয়া যায় না।
সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। ইব্রাহিমের ঘরের ওপর টিম টিম করে বাতিটা জ্বলছে। কলকাতার শহরও নিস্তব্ধ। বাইরের গেটে নাথু সিং পাহারা দিচ্ছে অবিশ্রান্ত। ঘরে গিয়ে দেখলে— ব্ৰজরাখাল অনেকক্ষণ এসে গিয়েছে। কী যেন একটা পড়ছে। ব্ৰজরাখালকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখে ভূতনাথ যেন কেমন চমকে উঠলো। একটু আগেই যেন কী একটা মহা অপরাধ করে এসেছে সে। মুখ দেখাতে যেন লজ্জা হলো।
ব্ৰজরাখাল সব শুনে বললে—তা বৌঠান কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল—বললে কেন আমাকে?
—তোমাকে সবই বলা যায় ব্রজরাখল।
শেষে ব্রজরাখাল বললে—তা ভালো, কিন্তু কাজটা ভালো কররানি বড়কুটুম, ওরা হলে গিয়ে সাহেব বিবি আর আমরা হলাম গোলাম—ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম ভালো নয়—কাজটা ভালো করোনি বড়কুটুম।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়েও সেই কথাটা মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। কাজটা কি সত্যিই ভালো করেনি সে।
বৌঠানের ডাকে না গেলেই কি ভালো করতে সে। কিন্তু খারাপটাই বা হলো কোথায়। প্রণাম তবে করেছিল সে কাকে? শুধু কি বৌঠানের যশোদাদুলালকে?