একদিন আজিজুল হক সাহেবকে নিয়ে স্যারের বাড়িতে গেলাম। তিনি তখন গুলশানে থাকছেন। শীতকাল। স্যার একখানা কথা-গায়ে টেবিলের ওপর ঝুকে পড়ে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে কী একটা অতি পুরোনো হলদে হয়ে আসা বই পড়ছেন। তার চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে। প্রথম দৃষ্টিতে মানুষ চিনতে তাঁর কষ্ট হয়। কণ্ঠস্বর শুনেই আজিজুল হক সাহেব খুব কাছে গিয়ে স্যারকে বললেন, মনে হচ্ছে স্যার অত্যন্ত জরুরি কিছু তালাশ করছেন।
স্যার চিরাচরিত সেই হাসিটা হাসলেন। একটুখানি ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে বললেন, বয়েন। তারপর চেয়ার হাতড়াতে লাগলেন।
আজিজুল হক সাহেব বললেন, স্যার, আপনার পেরেশান হওয়ার প্রয়োজন নাই। এই যে চেয়ার আছে বসতাছি।
আমরা যখন বসলাম, আজিজুল হক সাহেব রসিকতা করে বললেন, যেভাবে কাঁথাকুঁথা গায়ে লাগাইছেন মনে হয় স্যারের খুব শীত লাগছে।
স্যার কবুল করলেন। হা শীত একটু লাগছে। অখন কী খাইবেন কন।
খাওনের লাইগ্যা আপনার এমন উতলা হওয়ার প্রয়োজন নাই। কী বই পড়ছেন কন।
স্যার পঠিত পৃষ্ঠাতে একটি চিহ্ন দিয়ে বইটি সন্তৰ্পণে বন্ধ করলেন। অতি পুরোনো বই। নাড়াচাড়া করলেই ঝুরঝুর করে পাতা ঝরে পড়ে। স্যার বললেন, জন অ্যাডামসের রিপোর্টটা দেখতাছি। বইটা এখন দুষ্প্রাপ্য অইয়া গেছে। আমার কাছে এক কপি আছে।
হক সাহেব বললেন, নতুন খবর পাইলেন?
স্যার বললেন, নতুন কিছু নয়, খবর সব পুরানা। বেঙ্গলের সবচাইতে মিসফরচুন ব্যাপার অইল, এইখানে সাপোর্টিং কলেজ অওনের আগে য়্যুনিভার্সিটি তৈয়ার অইছে। আর মিডল স্কুল তৈয়ার না কইর্যা কলেজ বানাইছে। শুরু থেইক্যাই বেঙ্গলের এড়ুকেশন সিসটেমটা আছিল টপ হেভি। হের লাইগ্যা এইখানে ডিগ্রির লাইগ্যা মানুষের একটা ক্ৰেজ জন্মাইছে। আমাগো সময় পর্যন্ত সেই জিনিসটা চালু রাইছে। গ্রামে গঞ্জে যেখানেই যাইবেন, দেখবেন কলেজ জন্মাইতেছে। অখন আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল। হেইদিকে কারও নজর নাই।
এরই মধ্যে কাজের ছেলেটা বাকরখানি এবং মাংসের দুটো প্লেট দিয়ে গেলেন। আজিজুল হক সাহেব ছেলেটিকে বললেন, স্যারের প্লেট কই?
তিনি বললেন, আমি একটু আগে খাইছি, আপনেরা খান।
আমরা খাচ্ছিলাম এবং স্যারের কথা শুনছিলাম। মিডল স্কুলের সূত্র ধরেই স্যার বলছিলেন, গ্রেট ব্রিটেনের বাজেতে ডিফেন্সের চাইতে এডুকেশনে বেশি অর্থ অ্যালট করা হয়। এখন দেখতে পাইবেন, এভারেজ ইংলিশ চিলড্রেনরে স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে এক পাউন্ড দুধ খাইতে অয়। হের লাইগ্যা এভারেজ ইংলিশ চিলড্রেনের হেলথ ম্যাচ বেটার দ্যান ওয়াজ ইন দ্য টাইম অভ এম্পায়ার।
আমরা খাওয়া যখন শেষ করেছি, স্যার নতুন প্রকাশিত একটি বাংলা বই নিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। অমলেশ ত্রিপাঠির ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পার্টির ইতিহাস বইটি সবে প্রকাশিত হয়েছে। ভদ্রলোক কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময়ে তার এক ছেলে বাংলাদেশে ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার ছিলেন। অমলেশবাবুকে বাংলা একাডেমীর তরফ থেকে একটি সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিলো। ওটা বোধহয় কূটনৈতিক গুরুত্বের কারণেই দেয়া হয়েছিলো। হক সাহেব জিগ্গেস করলেন, কেমন লাগল ত্রিপাঠির বই?
স্যার মুখের একটা বিশেষ ভঙ্গি করে বললেন, এক্কোরে মনগড়া সব কথা লেইখ্যা থুইছে।
আমি বললাম, অমলেশবাবুর লেখাটা যখন দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিলো, ছেচল্লিশের রায়ট নিয়ে খুব বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। আরও একটি সাময়িক পত্রিকা চতুরঙ্গেও এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সে সময়ে যে সব ইন্ডিয়ান আইসিএস অফিসার ছিলেন, তাদের মধ্যেও অনেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ ব্যক্তি চল্লিশের দাঙ্গার জন্য মুখ্যত হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দিকে দায়ী করেছেন। সুহরাওয়ার্দি সাহেব মুসলিম পুলিশদের দিয়ে দাঙ্গা করিয়েছিলেন।
রাজ্জার স্যার মন্তব্য করে বসলেন, সুহরাওয়ার্দি সাহেব পুলিশ দিয়া দাঙ্গা করাইছেন, উনারা যখন কইতাছেন, হাচা কইতাছেন মাইন্যা নিলাম। এই কথা ত তারা নতুন কইতাছেন না। ফরটি সিক্স থেইক্যাই কইতাছেন। কিন্তু আমার কথা অইল নাইনটিন ফরটি সিক্স-এ ক্যালকাটায় মুসলিম পুলিশের সংখ্যা আছিল কত? ওয়ান ফোর্থও না। সুহরাওয়ার্দি সাহেব যদি মুসলিম পুলিশের সাহায্য লইয়াও থাকেন, তাগো নাম্বার ওয়ান ফোর্থের অধিক না। বাকি পুলিশ সব আছিল হিন্দু আর শিখ। তারা ত বইয়া আছিল না, তারা কী করছিল?
স্যার তারপর সুহরাওয়ার্দি সাহেব সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলেন। সুহরাওয়ার্দি সাহেব নামে আছিলেন মুসলিম এবং মুসলিম লীগার। তার খাওন উঠাবসা সব আছিল হিন্দু ভদ্রলোকদের সাথে। বিধান রায়, শরৎ বসু এইসব মানুষদের সঙ্গে তিনি চলাফেরা করতেন। তাঁর পার্সোনেল ফ্রেন্ডদের অনেকেই আছিলেন হিন্দু। যতোবারই রাজ্জাক স্যার সুহরাওয়ার্দির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, মনে করিয়ে দিতে ভুল করেননি সুহরাওয়ার্দি টাইটেলটা নকল। এবারেও তার পুনরাবৃত্তি করলেন। তারপর সুহরাওয়ার্দি সম্পর্কে আরও কিছু মজার গহন সংবাদ পরিবেশন করলেন। আমি বারবার জানতে চাইছি সুহরাওয়ার্দি সাহেবের আসল প্রফেশনটা কী ছিল।
আমি বললাম, উনি তা লইয়ার ছিলেন। স্যার হাসলেন, হেইডা ত মাইনষে জানে। কিন্তু তিনি ত প্র্যাকটিস করতেন না।
আমি মিনা পেশোয়ারির নামটা উচ্চারণ করলাম।
স্যার বললেন, স্পেসিফিক নামটাম কাইবার পারুম না।
আকাশে চড়চড়ে রোদ উঠেছে। তিনি গায়ের থেকে কাঁথাটা খুলে চেয়ারের হাতায় রাখলেন। তারপর হুঁকোর নলটা তুলে নিয়ে টানতে আরম্ভ করলেন।
আজিজুল হক সাহেব বললেন, স্যার আপনি যে হুঁকা টানতাছেন, কল্কিতে ত তামুক দেওয়া নাই।
স্যার বললেন, আইজকাল এইরকমই। ডাক্তার তামুক এক্কেরে না করছে। যখন ইচ্ছা অয়, এমনি দুয়েকটা টান দিয়া দেখি।
কথায়–কথায় ভারতের প্রসঙ্গ উঠল। স্যার উনিশশো সাতচল্লিশ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত লাইফ ম্যাগাজিনের একটা কভারের কথা বললেন : হেইবার লাইফ ম্যাগাজিন ইন্ডিয়ার ইনডিপেন্ডেন্সের ওপর একটা কভার স্টোরি করছিলো। অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠানে নেহরু খালি গায়ে বইস্যা মন্ত্র পড়ছেন। তাঁরে ঘিইর্যা বইয়া আছেন মন্ত্রিমণ্ডলী বেদির চাইরপাশে। বেদি থেইক্যা দূরে খাড়াইয়া আছেন দুইটা মানুষ—আম্বেদকর আর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। অনুষ্ঠানটা অইতাছে বেদের নিয়মানুসারে। সেইখানে অহিন্দুর থাকনের পারমিশন নাই। লাইফ ম্যাগাজিন একটা মজার ক্যাপশন দিছিল—বাৰ্থ অব এ সেকুলার স্টেট।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের প্রসঙ্গ ওঠায় রাজ্জাক স্যার মন্তব্য করলেন, মাওলানার সত্য কথা বলার অভ্যাস আছিল খুব কম, অ্যান্ড হি ওয়াজ এ কনজেনিটাল লায়ার। তরজুমানুল কোরআন যে বইটা মাওলানা লিখছেন, ইন্ডিয়াতে সেইটারে মাওলানার মস্ত কীর্তি বইল্যা দেখান অয়, অ্যারাব ওয়ার্ডের কোনো জায়গায় কোথাও এই বইয়ের কোনো ম্যানশন নাই। আরবরা ইন্ডিয়াতে লেখা যে বইটার উপর গুরুত্ব দিয়া থাকেন, হেইড অইল ফতোয়ায়ে আলমগীরী। তারপর রাজ্জাক স্যার আধুনিক ভারতের ভাষা-সমস্যার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আইজাকার ইন্ডিয়ার এড়ুকেটেড মানুষেরা যে ভাষায় পরস্পরের লগে কম্যুনিকেট করেন, হেইডা কোনো ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ না। তাঁরা ইংরেজির মাধ্যমেই পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন। বৃটিশের চইল্যা যাইবার পঞ্চাশ বছর পরেও যারা একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈয়ার করতে পারে নাই, তারা একলগে থাকব কী কইর্যা আমি ত চিন্তা করবার পারি না।
রাজ্জাক স্যার তাঁর স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করতে আরম্ভ করলেন। আমার বাবা আছিলেন পুলিশ অফিসার। বদলির চাকুরি। তিনি বহরমপুরে পোস্টিং পাইলেন। আমরা তিন ভাই বহরমপুর স্কুলে আইস্যা ভরতি অইলাম। টোটাল ছাত্রসংখ্যা আছিল পাঁচশত। মুসলিম ছাত্র হবায় আমরা তিন ভাই। হেই সময়ে স্যার যদুনাথ সরকারের হিস্ট্রি অভ আওরঙ্গজেব বইটা বাইর অইছে। স্কুলে থাকনের সময়ে আমি বইটা পড়ি। অ্যান্ড স্যার যদুনাথ ওয়াজ এ গ্রেট স্কলার। তিনি আওরঙ্গজেবের অনেক সদগুণের উল্লেখ করছেন। লম্বা ফিরিস্তির পর একটা বাট লাগাইয়া লিখলেন, ইসলাম ধর্মের উপর অত্যন্ত নিষ্ঠার জন্য এইরকম একজন সম্রাটের নানাবিধ গুণ কোনো কামে আইল না। এই অংশটা পইড়া মুখটা তিতা অইয়া গেল।