১১. আজকের দিনের এক স্ত্রীর পত্র

১১. আজকের দিনের এক স্ত্রীর পত্র

তোমাকে,

গল্পগুচ্ছের–”স্ত্রীর পত্র” বারবার পড়েও যেন পড়া শেষ হয় না। তার কারণ হয়তো এর বিষয়ের গভীরত্ব বা জীবনবোধ, যা মানুষের মনকে অন্তহীন চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দেয়। মানুষকে করে তোলে ভাবুক। ঘর ছেড়ে এসে মৃণালের মতো মনে হলো তোমাকেও এরকম একটা চিঠি লেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। আজ সেই সময়। আজ সেই গোধূলিলগ্ন। তবে কেমন করে তা লিখবো সে নিয়ে বিড়ম্বনা। লেখার বিষয় এত বেশি, আর সমস্যাগুলো এত অন্যরকম যে সেজন্যেই হয়তো আমার মধ্যে এই। জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন কি বলবো, কি লিখবো, কেমন করেই-বা ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মৃণালকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিলেন, সে কাজটা শুরুতেই। তিনি স্পষ্টভাবে করিয়ে নিয়েছেন।”আমি তোমাদের মেজো বৌ। আজ পনেরো বছর পরে এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, আমার জগৎ এবং জগদীশ্বরের সঙ্গে অন্য সম্পর্কও আছে। তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি। এটা তোমাদের মেজো বৌয়ের চিঠি নয়। কোথায়রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল! আইন দিয়ে গড়া কাটার বেড়া। ঐ তো মৃত্যুর হাতে উড়ছে জীবনের জয় পতাকা। …আমি আর তোমাদের সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না।”

আমিও সংসারের সকল বন্ধন উপড়ে ফেলে, অর্থের সকল প্রাচুর্য, মোহ, ত্যাগ করে ফিরে এসেছি সুদূর থেকে এই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। আমার শৈশবের স্মৃতিঘেরা-নদী। আমারও মাথার ওপরে আষাঢ়ের জলভরা আকাশ। দূরে, মাছ ধরা। নৌকো থেকে কিছু আলো জোনাকির মতো ভেসে আসছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। এখন। অনেক রাত। লোকেরা এত রাতে একটা মেয়েকে এভাবে একা একা বসে থাকতে দেখলে ভাববে আস্ত পাগল। ভাবুক। পাগল ভালো। কারণ তারাই একমাত্র অতীত ভুলে যেতে পারে। অতীত, যা আমি ভুলতে পারবো না। কারণটা বড় জটিল, ভীষণ নরক।

সেই জটিল, সেই নরক থেকে সরে এসে এখন আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা এই জায়গাটায় অনেক সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপরে ধুয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল। সবখানেই কাদা। অন্ধকারে দূর থেকে দু’একটা ব্যাঙের ডাক শোনা। যায়। কিছু দূরে অনেকগুলো ছোট বড় গাছের আভাস, নদীর গতিকে বুঝিয়ে দিতে। ঝিঁঝি পোকাগুলো করাত দিয়ে কাটছে বর্ষার অন্ধকার রাত। ঐ দূরে একটি আগুনের শিখা। অনবরত জ্বলছে। জানতাম, ঐখানেই কোথাও হবে, ব্রহ্মপুত্রের পারে, বহু পুরোনো একটা আদি শ্মশান। শ্মশান, যার নাম শুনলে আগে ভয়ে কাঁপতাম। আজ সেসব অতিরিক্ত ভয়গুলো আমার আর নেই। কারণ যে নরক দেখেছে, শ্মশানে মরা পোড়ানোর নিষ্ঠুরতা তার কাছে অনেক কম যন্ত্রণাদায়ক। আর আমি সেই নরক তোমার মধ্যে দেখে দেখে শুশানের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছি।

তবুও বিশ্ব নামের এত বড় বিশাল সংসার থেকে মুক্তি, বন্ধন ছিন্নতা সহজ কর্ম নয়। আপন সংসারের যে মায়া, যে মাধুর্য, সেখান থেকে শেকল কাটাও সহজ নয়। সংসার একটি দৈত্যসুলভ সর্বনেশে মায়া ও বন্ধনের সমুদ্র। এখানে অক্টোপাসের আটটির বদলে ষোলটি বাহু। আর সে তার বাহুগুলোতে আমাকে সংসার সন্তানের মায়া মরীচিকা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু আমার ওপর তোমার অন্যায় অবিচার এত মাত্রাহীন হয়ে উঠলো যে বোধ একদিন আমাকে তাড়া করলো। আর সেজন্যেই আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছি। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কারণে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটতে ঘটতে চলে গেল জীবনের অনেকটা সময়। জীবনটা যে এত দ্রুত এরকম বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়ে হয়ে যাবে সে আমি একেবারেই যে বুঝিনি তা ঠিক নয়, তবে ভেবেছিলাম হয়তো বর্ষণ হয়ে একদিন ঝরে যাবে আমাদের মধ্যেকার দুর্যোগের এই মেঘ। কিন্তু সময় যত যায় ততই দেখি দুর্যোগ, নৌকোভর্তি মেঘ ঢেলে দিয়ে দ্রুত চলে যায়, শুধু ফিরে আসতে আরো দুর্যোগে ভেজা মেঘ সঙ্গে করে নিয়ে।

আমি জানি, মৃণাল ও আমার সময়, জীবনযাত্রা, পরিস্থিতি এক নয়। তবে মুক্তির পথ, এক। গৃহহীন হয়ে ফিরে যাওয়া প্রকৃতির কাছে, যেখান থেকে আমরা এসেছি। জলে, সমুদুরে। আমাদের দেহের শতকরা আশি ভাগই তো জল দিয়ে তৈরি। তাই এই ব্রহ্মপুত্রের বিশালতার কাছে আমার ক্ষুদ্রতা ধুয়ে নিজেকে ফিরে পেতে, এখানে ফিরে এসেছি আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। এসে প্রতিদিনই নিজেকে চিনতে চেয়েছি, ক্ষুদ্রতা ধুয়ে। আজ মনে হচ্ছে এখনই সময়। এই দশ বছর সময় আমার জীবনে একটি হিমালয়ের মতো এতই বিস্ময়কর পাহাড়, যার জঙ্গলে বসে আমি নিজেকে খুঁজে নিয়েছি। তবুও অতীতের সেই সংসারের কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে! মনে পড়ে সুন্দর এক যুবকের কথা, যে ছিল আমার হৃদয়ের মধ্যমণি। মনে পড়ে বিয়ের পরপর সংসার নিয়ে আমার রোমাঞ্চের কথা। কাজের পর বাড়ি ফেরার জন্যে মনটা চঞ্চল হয়ে থাকতো। কাজশেষে বাড়ি ফিরে রান্না করবো, একসঙ্গে খাবো। বিছানায় শুয়ে তোমার সঙ্গে গল্প করবো গভীর রাত অবধি। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে একটি শিশুর মতো অবুঝ হয়ে ভুলেই যাবো আমি কে। তোমার বুকের ওম আমার শরীরে জাগাবে, ভালোবাসা। যেন একটা নেশায় পেয়ে বসলো।

বিয়ের পাঁচ বছর অবধি, তোমার মধ্যে আমি অন্যান্য পুরুষের মতো হীনমন্যতা দেখিনি। বরং তুমি আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সাংসারিক বিভিন্ন জটিলতার সময়ে আমার পক্ষেই কথা বলেছ। কিন্তু বিদেশে আসার প্রায় সাত বছর পর হঠাৎ যেন। তোমার মধ্যে কি ঘটে গেল। অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখলাম যখন বহু প্রতীক্ষার পর প্রথম সন্তানটি পেটে এলো। তুমি বললে বাচ্চা হয়ে গেলে কাজ ছেড়ে বাসায় বাচ্চা মানুষ করতে হবে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। একি কথা শুনছি তোমার মুখে! যেন এক অন্য তুমি! মাতৃত্ব ভালো, কিন্তু মাতৃত্ব যে অভিশাপও হতে পারে সেইদিনই প্রথম অনুভব করলাম, যেদিন এই তুচ্ছ ব্যাপারটি নিয়ে ফের দারুণ গণ্ডগোল শুরু হলো। এ নিয়ে ঝগড়া হয়ে উঠলো নিত্যদিনের বিষয়। এই প্রবাসে চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকা! অসম্ভব! মা হওয়ার আগাম সমস্ত সুখই নষ্ট হয়ে গেল। বললাম, টাকার অভাব। যখন নেই, না হয় তোক রেখে নেবো। তুমি বেশ রূঢ় কণ্ঠে বললে, না। বললে, আমার সন্তান মানুষ হবে তার মায়ের কোলে। আমি বললাম, আমিও তো আমার মায়ের সন্তান। মা আমাকে পড়িয়েছেন। তাছাড়া এত ভালো কাজ। বিদেশে কি কেউ বসে থাকে! বললাম, তা কি থাকা যায়? কথায়, কথায় তর্ক বাড়লো। রাগ যখন চরমে, বললাম, তুমিই না হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা মানুষ করো। কেন করবে না? চাকরিটা আমি কেন ছাড়বো? তুমি এক চড় মেরে বললে, তোমার এই বাইরে থাকা আর ছেলেদের সঙ্গ আমার আর ভালো লাগছে না। আমি বুঝে গেলাম তোমার আসল তোমাকে! তুমিও সবার মতো সাধারণ। হঠাৎ ভীষণ উত্তেজনায় আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু জানি না।

সেদিন চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। বিছানায় রাখা চার্টে লেখা–উচ্চ রক্তচাপ। স্যালাইনের সুই ডান হাতের কবজির ওপরে। বাম হাতে রক্তের ব্যাগ। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে! ডাক্তার বললো, আপনি এখন ঘুমোন। ডাক্তার, সেও লুকিয়ে গেল। বুঝলাম, আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গ্যাছে। প্রথম যখন জানলাম আমার অনুমানই সত্যি–তখন তুমি কাছে ছিলে না। না থাকাটাই ভালো ছিল। থাকলে না জানি কি ঘটতো। হয়তো দুই হাতের সুই ছিঁড়ে ফেলে হাসপাতালেই এক ভীষণ কেলেঙ্কারি বাধাতাম। তার তিনদিন পর প্রচণ্ড রক্তপাতশেষে জ্বণের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। তৈরি হলো এক অদৃশ্য দেয়ালের ভিত তোমার আর আমার মধ্যখানে। সৃষ্টি হলো দূরত্বের আকাশ, দু’জনের–আচরণে। আমি অনেক পুরুষের মধ্যে নারী বিষয়ে–হীনমন্যতা দেখেছি। কিন্তু তোমার মধ্যে সেই একই হীনমন্যতা, সেই সন্দেহ, যা আমি বরাবরই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি, দেখে নড়ে উঠলাম।

বাড়িতে তুমি আমি দু’জনেই গম্ভীর। এই গাম্ভীর্যের ভাবখানা এরকম যে তুমি আমাকে বলছো সব দোষ আমার। আর আমি বলছি তোমার। চোখ দিয়ে ঘৃণা আর শাসন করা এবং তখনকার জন্যে এটাই ছিল বরং সবচেয়ে সহজ কাজ। কেননা দোষ দিয়ে নিজের অন্যায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারলে ভালো লাগে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো তোমার ভালোমানুষি পুরুষের আস্তিনের তলায় ছদ্মবেশী এক রক্ষণশীল স্বভাবের পুরুষের প্রকৃত চেহারা। এই চেহারা, যা পুরুষের শাশ্বত রূপ। যা আমার সংসারে নবাগত।

জেনেছিলাম–সাদা, কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের চেয়ে। সবল, দুর্বলের চেয়ে। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুর চেয়ে পুরুষ নারীর চেয়ে। তুমিও দিন যত যায়, বোঝালে সংসারে পুরুষ নারীর চেয়ে বড়। কি করে বুঝলাম! বুঝাবার যথেষ্ট কারণ তুমি দেখিয়েছ। ক’টা বলবো! তবে সবচেয়ে বেশি বুঝলাম, যেদিন দেশ থেকে আমার ছোট বোনটার বিয়ের খবর এলো। রমা লুকিয়ে বিয়ে করেছে এক মুসলিম ছেলেকে। ছেলেটিকে আমি চিনতাম। অনেক নিষেধ সত্ত্বেও এই ভয়ই সত্য হলো। রমার ব্যাপারটা, তুমিও জানতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সঙ্গে সঙ্গে তুমি বললে, রমা একটা নষ্টা। একটা জারজ। ও যেন এখানে কখনো যোগাযোগ না করে। বললাম, কি বলছো এসব! বিদেশে তুমি তাহলে কাঁদের সঙ্গে থাকছো, কাজ করছো! ভিন জাতের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাচ্ছে। অথচ সব দোষ হয়ে গেল রমার! জানি না হিন্দু আর খ্রিষ্টানের বিয়ের সঙ্গে কি তফাত হিন্দু-মুসলিমের।

যখন প্রয়োজন তোমার সমবেদনা, তখন তুমি দেখালে ঘৃণা। তুমি জেদ ধরে বসলে যে, আমি আমার নষ্ট জারজ পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে পারবো না। রমার এই সংবাদে, বাড়িতে শোকের ছায়া। যেন কেউ মারা গেছে। এই সংবাদটি ফোন করে জানালো বিল্ট, আমার ছোট ভাই। বললো গ্রামে ভীষণ হৈ-চৈ হচ্ছে। লোকজন বাড়িতে এসে হট্টগোল করছে। বাবাকে অপমান করছে। বাবার হার্ট এ্যাটাক হয়ে সে হাসপাতালে, প্রায় মৃত্যুমুখে। অপারেশনের জন্য টাকা লাগবে, প্রায় দু’লক্ষ। তোমার ভয়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কি করি! কি করা যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করি, লুকিয়ে। টাকা পাঠালাম, লুকিয়ে। বুঝতে পেরে, আমাকে ভীষণ গালাগাল করলে। অন্যদিন, ধরে মারলে। তোমার এই মনুষ্যত্বহীনতা আমাকে–উভয় সঙ্কটে ফেলে দেয়। এ কথা কাউকে না পারি বলতে, না পারি গিলতে। এতকাল পুরুষের দানব চরিত্রের যেসব কাহিনী শুনে এসেছি, সে জিনিস এখন সত্য হলো আমারই কপালে!

রমার ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তে তুমি রইলে অটল এবং ক্ষমাহীন। দুজনের মধ্যে একরাশ নীরবতা আমাদের ঘরটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। তা সত্ত্বেও –বছরখানেক পর, মুহূর্তের আবেগে কি যেন ঘটে গেল! ফের আমার পেটে বাচ্চা এলো। বাচ্চাটা পেটে এসে বিপদ আবার নতুন করে বাড়লো। মনে শান্তি নেই। মনে হয় পঙ্গু বাবার কথা। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুধু রমা রমা করেন। রমা-তুই, কি করলি! বলেন, আর কেঁদে-কেটে বুক ভাসান। আমাদের সমাজ। যেখানে মানুষের মন ক্ষমাহীন, নিচু। মর্ত্যের নরক। রমাকে নিয়ে সামাজিক গণ্ডগোল তুঙ্গে। মানুষের অত্যাচারে বাড়ির ওরা ভারতে চলে যাবেন বলে ভাবছেন। অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। মা বললেন, তুই একবার আয়। দেশে তোর আসাটা খুবই জরুরি। পাড়ায় একটা মীমাংসারও ব্যাপার আছে। তাছাড়া, হিন্দু-মুসলিমের বিষয় নিয়ে যে নোংরামো এবং কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে, মার বিশ্বাস এতে করে ওদেরকে হয়তো সব সম্পত্তি বিনে পয়সায় দিয়ে, ভারতে চলে যেতে হবে। পড়শিদের দু’একজন এই সুযোগে আমাদের বাড়িঘর দখলের ষড়যন্ত্র করছে বলে মা জানালেন। সুতরাং বুঝতেই পার আমার যাওয়াটা, কতটা জরুরি। কিন্তু পেটের বাচ্চার অজুহাত দেখিয়ে তুমি যেতে দিলেই না। বাবা মৃত্যুপথে। তুমি সেটা বুঝলে না। তবে ডাক্তারেরও নিষেধ ছিল বলে সেদিন আমিও জোর করিনি।

আমি ছোটবেলা থেকেই সময়ে বিশ্বাসী। সময়ই সব ক্ষত শুকিয়ে দিতে পারে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। এরপরে প্রিতু হলো। বাবা মারা গেলেন। রমার জীবনটা আস্ত নরক হলো। আমিও অপারক। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কথা ভেবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে বিরত রইলাম। তুমি কাজে চলে যাও সকালে। আমি বেলা অবধি মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে। তখন আমি মা। আমার অন্য আরেকটা কাজের জায়গা, দু’ দুটো কম্পুটার, দুটা টেলিফোন, বছরে চল্লিশ হাজার ডলার বেতন সবই অন্যের দখলে। ড্রাইভওয়েতে আমার নতুন গাড়িটা বেকার সময় কাটায়। রাত জাগা আমি দিনে ঘুমোই। মেয়ের মুখে তুলে দিই স্তনের বোটা। অনবরত স্তনের এই দুর্দশা, আমাকে মাতৃত্ব বিষয়ে বিশ্রী অনুভূতি দেয়। স্বাভাবিক কর্মজীবন থেকে এই বিচ্যুতি আমাকে প্রবল ক্রোধের দ্বারস্থ করে তোলে। বাচ্চা হওয়ার পর নীল অনুভূতি আমাকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে, হতাশায়। মাতৃত্ব আমাকে নরক যন্ত্রণা দিতে শুরু করে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো, দু’হাতে প্রিতুর গলা টিপে মেরে ফেলি। কারণ ওর জন্যই তো আমার এই বন্দি জীবন। না হলে বাবাকে দেখতে পেতাম। প্রিতুকে একদিন গলা টিপে প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম। তুমি বাড়ি ছিলে না বলে টের পাওনি। ও খুব কেঁদেছিল। তুমি শুধু বললে, ও এত কাঁদছে কেন? বলেছিলাম, খিদে পেয়েছে তাই। আজ বলতে বাধা নেই, প্রিতু, সেদিন প্রায় মরেই গিয়েছিল।

মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই বলতেন, মেয়ে হয়েও ওর খুব বুদ্ধি। গাছের মতো মা আমাকে সর্বক্ষণ তার ছায়ায় রাখতেন। আমাকে নিয়ে তার একটি বিশেষ অহঙ্কার ছিল। বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে বসেও তিনি বলেছিলেন এই মেয়েটি একদিন অনেক বড় আর ভালো মানুষ হবে। তার এই অসম্ভব বিশ্বাসের ভিত্তি বা সম্ভাবনা নিয়ে কেউ বিশেষ সন্দেহ করেনি। এবং বড় হয়ে আমি তার আশা পূর্ণ করেছিলাম। সবাই বলে আমি নাকি একজন ভালো মানুষ, সহজ-সরল। আজ মনে সন্দেহ জাগে এই সারল্যই কি আমার অভিশাপ? এই সারল্যেরই কি তবে প্রয়োজন ছিল? যদি তাই হবে তাহলে, রমা এবং বাবার এই কষ্ট, মা একাই কেন ভোগ করলেন? -কেন আমি সেদিনই সংসার ত্যাগ করিনি? কেন? এর উত্তর, প্রিতু। তুমি আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করেছ। একাকিনী মা। তার একটা চোখে ছানি। দু’পায়ে গিঁট বাত। তুমি সবই জানো। কিন্তু পুরুষত্ব–অন্যদের মতো তোমাকে পশুত্বে রূপান্তর করেছে।

ভার্সিটিতে যেদিন পরীক্ষার ফল বের হলো, বাড়িতে বেজায় খুশিতে আমার নিরক্ষর মা আবারো বললেন, মেয়ে নয় ও আমার ছেলে। কিন্তু যখন শিক্ষিত কোনও মানুষ আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় যে আমি মেয়েমানুষ এবং সেরকম আচরণ করতে, তখনই আমার নিরক্ষর মায়ের কথা মনে করে তোমাদের জন্য বড় আফসোস হয় যে, তার তুলনায় বড় বড় ডিগ্রির সার্টিফিকেট সত্ত্বেও তোমরা কত অল্পশিক্ষিত! মার কথা ভেবে বিশ্বাস করি যে, বড় বড় কলেজে গেলেই শুধু শিক্ষিত হওয়া যাবে না। শিক্ষার আলো, শুধু শিক্ষায় নয়, তার বোধের আলো দ্বারা প্রথমে উদ্ভাসিত হয়। বোধ। যা, আমার মায়ের আছে প্রচুর। যা তোমার মধ্যে তুলনায় যৎসামান্যই।

মনে রেখো, প্রদীপের তলায় থাকে বিশাল অন্ধকার। এই সুশিক্ষিত সমাজেও আজ বোধের যে বিশাল শূন্যতা; তোমাদের মতো বুদ্ধিমানদের বোধের অবক্ষয় বোঝাতে বোঝাতে জ্ঞানী-গুণীদের ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যাবে। কারণ তোমরা যে জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপীদেরকে বোঝানো আর সমুদ্রে মুক্তো খোঁজা সমান কাজ। এরপর থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, এটা করি, সেটা করি। করতে করতে সেই কাজও ফুরিয়ে যায়। ভাবি, আর কি নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায়! বন্ধু খুঁজে বেড়াই। ভালো বন্ধু, যাদের সাথে কথা বলা যায়। যারা আমার সমমনা।

তাদেরই উৎসাহে নারীবাদ, সাহিত্য এসব নিয়ে অনুসন্ধানে লিপ্ত হলাম। সেজন্যে লাইব্রেরিতে যাই। এখানে-সেখানে বিভিন্ন ছোটখাট অনুষ্ঠানে যাই। এভাবেই পরিচয় হয় একগুচ্ছ মেয়ের সঙ্গে যে মেয়েগুলো বেকার সময় কাটাতে ঘুরে বেড়ায় দোকানে, রাস্তায়, পার্কে। কেনে যা কেনার প্রয়োজন নেই। কিনে কিনে ঘর ভরে। ভরে গেলে, জায়গার অভাবে আবর্জনার স্তূপে তা ফেলে দিয়ে আসে। ঘরকন্না এই মেয়েগুলো প্রায় সবাই শিক্ষিত। এদের মধ্যে গৃহিণী এক মেয়ে আইন বিশেষজ্ঞ। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সি.পি.এ.। কেউ সেলস্ গার্ল। স্বামীর সংসার করতে গিয়ে ওরা সবাই বিসর্জন দিয়েছে। ওদের পেশা এবং পেশার ভালোবাসা। কেউ স্বেচ্ছায়, অধিকাংশই অনিচ্ছায়। এদের মধ্যে একটা মেয়ে ছিল যে ছয় ঘরের বেতনে চাকরি করতো একটি বিশাল ল ফার্মে। সুন্দরী, স্মার্ট, প্রতিশ্রুতিশীল। স্বামী তাকে চার চারটি সন্তান উপহার দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে রাখার উত্তম বন্দোবস্ত করে রেখেছে।

মৃণাল জেগেছিল শতবর্ষ আগে যখন আধুনিকতার অভাব ছিল। আর শতবর্ষ পরে, প্রবাসের এবং দেশের বিপুল অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি যে, আমাদের আজকের মেয়েরা নিজে নিজে জাগে না, ওদেরকে কেউ জাগাতে পারে না। পারবে না মুক্ত করতে পুরুষের দাসত্ব থেকে। নাহিদকে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও সংসারী হতে হলো, আমেরিকার মতো জায়গায়। তিনটে সন্তান মানুষ করছে সে। কিন্তু কাজে গেল ওর স্বামী। শিক্ষিত মেয়েরা সার্টিফিকেটের যে কি অপচয় করে এর উদাহরণের কি কোনও শেষ আছে? শিক্ষিত গৃহিণীদের ঘরে যত যাই, ততই অবাক হই। এরাই আত্মঘাতী; এরাই সংরক্ষণশীল। শিক্ষিত মেয়েরা বরং বিশ্বাস করে নারীর স্থান গৃহে। স্রেফ সামাজিক কুসংস্কার। স্রেফ ধর্মান্ধতা, যা অজুহাতে রূপান্তরিত হয়। বুঝি, ভার্সিটি পাস মেয়েদেরকে তোমরা কেন বিয়ে করো। যেন ওরা তোমাদের জন্যে শিক্ষিত সন্তান উপহার দিতে পারে। নয় কি? তার মানে এই যে, ঘরে শিক্ষিত স্ত্রী থাকলে, সন্তানও শিক্ষিত হবে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত মেয়েরা যাবে স্বামীর ঘরে ফের শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে। যাদের মধ্যে থেকে মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবে ভবিষ্যতে শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে, ছেলেরা যাবে কাজে। অর্থাৎ চক্রটা বৃত্তাকার।

তোমার সন্দেহকে সেবার প্রত্যাখ্যান করলাম। ছেলে বন্ধুগুলোকে নিয়ে এলাম বাড়িতে। তুমি বাধা দিয়ে বললে, শেফালী-রিতু-সেতু ওরা নেই কেন? এই প্রশ্নের ফলে আমার জগৎ আরো সীমিত হতে থাকলো। বাড়িতে একদিন এক অনুষ্ঠানে মুখের ওপর অপমান করে বসলে বয়স্ক প্রবীণদাকে। সে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। প্রবীণদা বয়োজ্যেষ্ঠ এক কবি, যিনি লুকিয়ে করিডোরে সিগ্রেট ফুঁকছিলেন। তুমি তাকে তক্ষুণি বের করে দিলে। প্রবীণদা, ভয়ে দৌড়ে বের হতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ব্যথা। পেলেন। ভারি বিব্রতকর এক পরিস্থিতি, তাকে আমি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। প্রবীণদার ডান পাটা ভেঙে গিয়েছিল। শুধু আমার অনুরোধে তিনি এ নিয়ে উকিল-আদালত করেননি। তা না হলে কি ঝামেলায় তুমি জড়াতে তোমার কোনও ধারণাই নেই। আমি তাও সইলাম। আর তখন আমার পেটে আবার তিন মাসের ভ্রূণ। তুমিও জানতে না। আমি চলে গেলাম ওম্যানস্ ক্লিনিকে। গর্ভপাত করিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এরপর থেকে প্রিতুকে গল্পের ছলে তৈরি করি, মা ছাড়া পৃথিবীর জন্য। কারণ আমি জানি এ সংসার ছেড়ে আমাকেই যেতে হবে। আমি চলে গেলেও, প্রিতুকে তুমি দেবে না এবং এ দেশের কোর্টও তা দেবে না। আমি প্রিতুকে কোনও নিষ্ঠুরতার যুদ্ধে দাঁড় করাতে রাজি নই। নই, কোনও প্রতিযোগিতার যুদ্ধে। আগে আমি বাঁচবো। তারপর প্রিতুকে এমন মনোভাব নিয়ে, মনে মনে এগোতে থাকলাম মুক্তির চিন্তায়। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মৃণালের মতোই সংসার ছেড়ে, দূরে কোথাও চলে যাওয়ার। শুরু হলো উঁকিলের সঙ্গে কাগজপত্র নিয়ে। ডিভোর্সের ঝুট-ঝামেলা। লাভ-লোকসানের হিসেব তো বটেই।

এদিকে প্রবীণদাকে কেন্দ্র করে তোমার সঙ্গে আমার মানসিক দূরত্ব দ্রুত বাড়তে থাকে। একটা অকারণ জেদ, প্রতিশোধের আগুন, অধিকারবোধ তখন থেকে আমার মনে তীব্রভাবে কাজ করতে শুরু করলো। দেখা হলেই ঘৃণা। দেখা হলেই এড়ানোর প্রতিযোগিতা। চললো তাচ্ছিল্যের ম্যারাথন।

বাতিকগ্রস্ত তুমি সব পুরুষকেই সন্দেহ করতে। কথা বলতে দেখলে, কোথাও একসঙ্গে বসলেই। সন্দেহ যা একটা অসুস্থতা। একটা নরক। এই নরক পুরুষের নিজস্ব। আর তুমি হলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তোমাদের ধারণা কথা বললেই মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে শোয়। অসীমকে তুমি সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করতে। ভাবতে, ওর সঙ্গে আমার শুধু প্রেমই নয়, দৈহিক সম্পর্কও আছে। ভাবতে সাহিত্য-টাহিত্য কিছু নয়। সব, ছুতো। তবে হ্যাঁ, অসীম আমার বিশেষ বন্ধু। আমার সবচেয়ে বেশি মানসিক যোগাযোগ ওরই সঙ্গে। তোমার সঙ্গেই বেশি করে আমার সেই যোগাযোগ থাকার কথা। কিন্তু শূন্যতা মেটাতে তোমার স্থান পূরণ করলো অসীম। অসীমকেও তুমি একদিন তাড়িয়ে দিলে। আর সেইসঙ্গে হৃদয়টা ওর জন্যে ব্যথায় গুমরে উঠলো। শুধু সন্দেহ আর সন্দেহ নিয়ে ভরে গেল তোমার পৃথিবীটা।

দেশে ফিরে যাবো সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছি। এদিকে ডিভোর্সের কাজ চলছে। এর মধ্যে জীবনের আরেকটা মোড় হঠাৎ ঘুরে গেল। সেবার কবি-সাহিত্যিকদের একটা সম্মেলন হবে আপ স্টেইটে। অসীম ফোন করে বললো, আমাকে সেখানে যেতে হবে। অসীমরা দল বেঁধে যাচ্ছে। শুনে মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। গেলাম আমিও। আর সেখানেই কখন যেন তোমারই সন্দেহ আর গুমরে ওঠা হৃদয়, ভালোবাসা হয়ে ফুটে উঠলো। হলো, অসীমের প্রতি অসীম ভালোবাসা।

আপ স্টেইটের পাহাড়ের কোলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম, নতুন অভিজ্ঞতার ঝুলিভর্তি অসীমের ভালোবাসায়। আমার ভালোবাসাহীন শুকনো হৃদয় আর দীর্ঘদিনের বিবর্ণ ঘাসে যেন অনন্ত জলধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ফিরে এলাম, তোমারই সংসারে অন্য মানুষের জন্যে, অন্য অনুভূতি হৃদয়ে নিয়ে।

প্রিতুর তখন পাঁচ বছর। আর আমার বয়সটা মেয়েদের জীবনে নানারকম পরিবর্তন আর জটিলতার সময়ে। তোমার সন্দেহকেই শেষ পর্যন্ত সত্যি করে তুলোম। পরকীয়া। যা আগে কোনওদিন আমার ভাবনায় উদয় হয়নি। অসীম আমাকে শূন্যতার যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি দিয়েছিল। পরকীয়া, আমার দুঃসময়ে আমাকে বাঁচায়নিই শুধু, মুক্তিও দিয়েছিল সীমাহীন যন্ত্রণা থেকে।

বন্ধন ছিন্ন করার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এবং সেই চুলোয় আরো আগুন জ্বালাতে হঠাৎ উপস্থিত হলো রমা। যেন ভূত দেখার মতো। কি করে যেন ভিসা জুটিয়ে ওরা দু’জনেই চলে এলো। আর ওদের দেখেই তুমি উঠলে জ্বলে। হলো ঝগড়া। আমাকে সেদিন। জখম করেছিলে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে। তোমার ভাগ্য ভালো-যে, প্রিতুর জন্ম হয়েছিল। তাই ওর কষ্ট হবে ভেবে পুলিশ ডাকতে চাইলেও পারিনি।

তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে, এই দেশটা সম-অধিকারের। ভেবেছিলে যে মানা না মানার ক্ষমতা আমারও ছিল! তোমার মতো পশুর সঙ্গ দ্রুত ত্যাগ করতে হলে, প্রিতুকে সাময়িক হারাতে হবে। আমি তো সে সত্য মেনে নিয়েছি। সুতরাং আমার আবার ভয় কিসের? যুদ্ধ হবে, রণাঙ্গন তৈরি। রমাকে বললাম, কোথাও যাবি না। এ বাড়িতেই থাকবি যতদিন আমি আছি। এ নিয়ে হাঁকাহাঁকি পুলিশ ডাকাডাকি হলো। ঝগড়া, কান্না, চিৎকার। আমি রইলাম অনড় আমার অধিকারে। পুলিশই সেকথা বলেছিল। আর তুমি। ভয় পেলেও, জেদটাকেই অধিক তুলে ধরলে।

প্রস্তূতি খুব দ্রুত চলছে। এবং সেজন্যে আমি উকিলকে অতিরিক্ত কিছু অর্থও দিলাম। এ দেশের আইনে বলে, ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না। তোমারই জয় হলো। সে এক দৃশ্য! আমি সুটকেইস হাতে। তুমি প্রিতুকে কোলে করে। আমি বিদায় নিলাম তোমার সংসার থেকে। জেনে রেখো, মাতৃত্ব কেড়ে নেয়া যায় না। যেমন যায় না পিতৃত্ব। প্রিতু, আমাদের দু’জনের। আমি জানি প্রিতু ফিরে আসবে আমার কাছে, আসতে বাধ্য। আজ না হোক, কাল। কথা আর না বাড়িয়ে, অপেক্ষমাণ ট্যাক্সিতে বসে চলে এলাম রমাকে নিয়ে, বন্ধুর বাড়িতে। তারপর সেখান থেকে-এখানে।

পুরুষ, তোমরা সবই পারো। আমার মতো আধুনিক, শিক্ষিত মেয়েকেও তোমরা যখন ছাড়লে, তখন বিশ্বের হাজার হাজার সখিনারা তো কোন ছার! আমার মতো কর্মক্ষম একটি মানুষকেও ধরেবেঁধে তোমরা ঘরে বসিয়ে রেখেই শুধু নয়, তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছ ঘৃণিত সন্দেহের তীর। নিয়ত হেলাফেলা। মৌখিক আর শারীরিক অত্যাচার। আমায় ঠেলে দিয়েছো পরকীয়ায়। মধ্য বয়সে পৌঁছে আমার উপলব্ধি, মৃণালের উপলব্ধির সাথে দেখলাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। যৌবনের সব পুঞ্জীভূত অবিচার, মধ্য বয়সে এসে আমাদেরকে বাধ্য করে তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। যা মৃণাল করেছিল শত বর্ষ আগে। কিন্তু দু’জনেরই সমস্যা শত বর্ষ আগে ও পরে, এক। কারণ, আমরা পাল্টালেও পাল্টাওনি তোমরা। মৃণালের চিঠিতে কবিগুরু একে কোনও সঙ্কট নামে চিহ্নিত করেননি, তবে আমি জানি মৃণাল আর আমার সমস্যা এক এবং অভিন্ন। অর্থাৎ উপলব্ধি জীবনের একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে দেয় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। এবং মৃণাল এবং আমি দু’জনই তা অর্জন করেছি, সাহসের সঙ্গে। নয় কী?

যাদের অন্তরে সুখ নেই, জন্ম থেকেই যারা সর্বক্ষণ দগ্ধ, তারা পৃথিবীর সুখ দেখতে নারাজ। তুমিও তাদেরই একজন। আজ আমার কষ্ট শেষ। তোমার শুরু। যারা জগৎটিকে দেখতে পায় অন্তের বদলে-অনন্ত, সুখ তাদেরই জন্যে রক্ষিত। আমি সেই অর্থে-সুখী। বিত্ত-বৈভব-সন্তান ও সংসার তোমার চোখে তার যে অর্থ, আমার চোখে তা এক নয়। আমি সবখানেই অনন্ত দেখতে পাই। তলের জায়গায়, অতল। আমার কাছে জগৎটা অনেক বড়। সমস্ত পৃথিবীটাই আমার সংসার। যেসব ছেড়ে দিতে পারে, তাকে আর কি দিয়ে অসুখী করবে! তোমার বিলাসিতার শিকার, সংসারের খাঁচা খুলে পালিয়ে গেছে।

তোমার চত্বর ছেড়ে, আজ আমিও মুক্ত। স্ত্রীর পত্রে’র মৃণালের মতো আমিও আর তোমার ঐ নরকের গলিতে ফিরছি না। এমনকি প্রিতুর জন্যেও না। আমি জানি, আমি কত নিষ্ঠুর মা, যে তার মেয়েকে ফেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে একজন মা এই কাজটি করতে পারে ভেবে দেখছো কখনও? হ্যাঁ, আমি সেই পরিস্থিতিরই শিকার যেখানে বাধ্য হয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। নিজের বোধের মৃত্যু ঠেকাতে, কোলের আদরিনীকেও সাময়িক ছাড় দিতে হয়। সে আমার। চিরদিনের জন্যে আমার। সে ভরে আছে আমার বোধ-হৃদয় আর মনে। আমার সকল পৃথিবীটাই প্রিতু আর প্রিতুময়। যেখান থেকে কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারে না। এমনকি তুমিও না। প্রিতু আজ প্রায় প্রাপ্তবয়স্কা। এখান থেকে সে স্বাধীন। এতকাল তুমি তাকে মা ছাড়া করে রেখেছিলে। তাই আজ এই চিঠি লেখা। আর নয়। এবার ফেরার সময়। মায়ের কাছে মেয়ে। জগতের ভ্রান্তির কাছে, সত্যের।

–ইতি,

প্রিতুর মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *