১১. অন্য রকম খাওয়া-দাওয়া
যাদের ঘেন্না একটু বেশি তাদের এই লেখাটা পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই–লিখতে গিয়ে আমারই একটু গা গুলিয়ে আসছিল, অন্যদেরও তাই হতে পারে।
এমন কী হতে পারে যে, সকালে সবাই নাস্তা করতে বসেছে। সবার সামনেই একটা খালি প্লেট, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ সবাই তাদের খালি প্লেটে হড়হড় করে বমি করে দিল, তারপর হাতে চামচ নিয়ে মহাউৎসাহে সবাই সেটা খেতে শুরু করে দিল? (আমার সতর্কবাণী না শুনে যারা একটু পড়ে ফেলেছেন এবারে নিশ্চয়ই তাদের পড়া বন্ধ করে ফেলার কথা) শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু এই ব্যাপারটা কিন্তু সবসময়ই ঘটছে। খুব বিচিত্র কোনো প্রাণী কালেভদ্রে এটা করছে তা নয়–এটাই হচ্ছে তাদের জীবনধারা। সেই প্রাণীটি আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে, হয়তো এই মুহূর্তেই সেটা কারো মুখের কাছে ভন ভন করছে। কারণ এই প্রাণীটি হচ্ছে মাছি। হ্যাঁ, আমাদের সুপরিচিত মাছি।
এরকম অত্যন্ত কুৎসিত বদঅভ্যাসের জন্যে মাছির উপরে রাগ করে লাভ নেই। আসলে বেচারা মাছিদের যদি বলে দেয়া হয় তাদের এই বদঅভ্যাস ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্য সব প্রাণীদের মতো ভদ্রভাবে খেতে হবে তাহলে তারা সবাই না খেয়ে মারা যাবে, কারণ তাদের আর অন্য কোনোভাবে খাওয়ার উপায় নেই। মাছিদের মানুষের মতো দাঁত নেই, ব্যাঙের মতো কামড় দেয়ার মুখ নেই, মশার মতো রক্ত শুষে খাবার হুল নেই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা কঠিন কোনো খাবার খেতে পারে না। তাদের খেতে হয় তরল খাবার। মাছিরা যে খাবার খেতে পছন্দ করে সেটা তো তরল নয়। আমরা নিজের চোখেই দেখেছি একটা মরা ইঁদুরের উপর ভন ভন করছে, সেখান থেকে উড়ে আসছে জন্মদিনের কেকে, সেখান থেকে রাস্তার পাশে সাজিয়ে রাখা জিলাপির উপর–তারা কোথায় নেই? মাছি যেহেতু শক্ত খাবার খেতে পারে না তাই তারা যেটা খেতে চায় তার উপর হড়হড় করে বমি করে দেয়, পেটের ভেতর থেকে যে তরলটা বের হয়ে আসে সেটাতে শক্ত খাবার গলে একটা তরল স্যুপের মতো তৈরি হয়। মাছি তখন মহাউৎসাহে সেই তরল চেটেপুটে খায়। কাজেই আমরা যদি মাছিদের নিজের বমি চেটেপুটে খাওয়ার বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করতে বলি এই বেচারারা না খেতে পেরে মারা যাবে।
মাছির খাওয়ার অভ্যাসটি আমাদের জন্যে তত গুরুতর নয়, তার চাইতে অনেক বেশি গুরুতর তাদের আঠালো এবং রোমশ পা! মিষ্টির দোকানে গিয়ে কোন মিষ্টিটা খেতে ভালো হবে বোঝার জন্যে আমরা সবকিছু পা দিয়ে টিপে টিপে দেখি না–মাছিরা দেখে। তাদের পায়ে সূক্ষ্ম যে লোম রয়েছে সেটা দিয়েই তারা বুঝতে পারে কোনটা তারা খেতে পারবে কোনটা খেতে পারবে না! আমরা নিজেরাই দেখেছি মাছি খাবার ব্যাপারে মোটেও খুঁতখুঁতে নয়-ঝোলা গুড় তারা যে রকম পছন্দ করে মরা ইঁদুর ঠিক সেরকম পছন্দ করে। তারা যেখানেই বসে সেখানেই তাদের পাটা ঘষে আসে আর সেই পায়ে তখন সেই জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ জীবাণু লেগে যায়। বিজ্ঞানীরা মাছি ধরে তার শরীরে লেগে থাকা জীবাণুগুলো গুনে দেখেছেন যে সাধারণ একটা মাছির গায়ে সাড়ে বারো লক্ষ জীবাণু থাকে! কাজেই আমরা যখন রাস্তার পাশে বসে ফুচকা খাই এবং ফুচকার উপর বসে থাকা মাছিটাকে হাত দিয়ে উড়িয়ে দেই তখন কী কখনো কল্পনা করেছি যে মাছিটি শুধু আমার ফুচকার উপর বমি করে দেয় নি তার শরীরে ঝুলে থাকা সাড়ে বারো লক্ষ জীবাণুর কয়েক লক্ষ জীবাণু ঝেড়ে রেখে চলে গেছে?
নিজের বমি নিজে খেয়ে ফেলাটা খুব ঘেন্নার ব্যাপার কিন্তু তার চাইতেও সেটা অনেক বেশি ঘেন্নার যখন সেটা নিজে না খেয়ে অন্য কাউকে খাইয়ে দেয়া হয়। আমরা আমাদের পরিচিত কাউকে সেটা করতে দেখি না কিন্তু পাখি মহলে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ঘুঘু, ফ্লিঞ্চ বা বক রুটিন মাফিক তাদের বাচ্চাদের মুখে পেটের ভেতর থেকে খাবার উগলে দেয়। সিগাল পাখি আরেকটু খবিস ধরনের, তারা বাচ্চার মুখে না দিয়ে বাসার ভেতরে খাবার উগলে দেয়, চারিদিকে সেটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, পাখির বাচ্চারা মহাআনন্দে সেটা খুঁটে খুঁটে খায়।
আমরা যদি বিষয়টাকে একটু বৈজ্ঞানিকভাবে দেখি তাহলে এটাকে আর এত ঘেন্নার মনে হবে না, মোটামুটি একটা কার্যকর পদ্ধতি বলেই মনে হবে। ডিম ফুটে যখন পাখির বাচ্চার জন্ম হয় তখন তার থাকে প্রচণ্ড ক্ষুধা, মা পাখির তখন তার বাচ্চাদের খাওয়াতে খাওয়াতেই গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। পাখির বাসায় বাচ্চার খাবার রাখার জন্যে তো আর ফ্রিজ বা কেবিনেট নেই, তাই তাদের জন্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে নিজের পেটের ভেতর রেখে দেয়া। পাখির বাচ্চা যখন খাবার জন্যে ব্যস্ত হবে তখন বাইরে উড়ে গিয়ে খুঁজে খুঁজে পোকামাকড়, কেঁচো ধরে আনা থেকে অনেক সহজ পেটের ভেতর জমা করে রাখা খানিকটা খাবার উগলে দেয়া।
পাখিরা যে প্রক্রিয়ায় তাদের বাচ্চাদের পেটের ভেতর থেকে খাবার বের করে খাওয়ায় তার একটা গাল ভরা বৈজ্ঞানিক নাম আছে, সেটা হচ্ছে রিগার্গিটেশান–উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা। সত্যি কথা বলতে পাখিরা যখন তাদের বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্যে রিগার্গিটেশান করে তখন খাবারটা পাকস্থলী থেকে আসে না। এটা আসে গলার কাছে খাবার জমা রাখার একটা ঝোলা থেকে, এই ঝোলার নাম হচ্ছে ক্রপ। যে খাবারটা এখানে থাকে সেটা হজম হয় না, তাই মা পাখি তার বাচ্চা পাখিদের বারবার সেটা খাওয়াতে পারে! সন্তানের জন্যে মা-বাবা অনেক কষ্ট করতে প্রস্তুত সেটা মানুষই হোক আর পাখিই হোক–একই ব্যাপার।
পাখির রিগার্গিটেশান আমরা দৈনন্দিন জীবনে খুব একটা দেখি না, তার কারণ পাখিরা থাকে বনে-জঙ্গলে, গাছের উপরে। আমাদের চারপাশে যেসব পোষা জন্তু থাকে তাদের মাঝে আমরা অবশ্যই আরেকটা জিনিস দেখেছি সেটা হচ্ছে জাবর কাটা। অলস মানুষকে ঢিলেঢালাভাবে বসে থাকতে দেখলে আমরা কৌতুক করে বলি, “মানুষটা জাবর কাটছে”! আসলে জাবর কাটা গরু ছাগল ভেড়া উট হরিণ এরকম তৃণভোজী প্রাণীদের দৈনন্দিন কাজ। একটা গরু দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে প্রায় নয় ঘণ্টাই জাবর কাটে।
কিন্তু জাবর কাটা ব্যাপারটা। কী? দ্র মানুষের ভাষায় সেটা হচ্ছে নিজের বমি নিজে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া আর বৈজ্ঞানিক ভাষায় সেটা হচ্ছে রুমিনেন্ট বা চর্বিতচর্বণ। গরু-ছাগলকে যারা ঘাস খেতে দেখেছে তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে তাদের ভেতর ধীরেসুস্থে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবার কোনো আগ্রহ নেই, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে সবুজ ঘাস পেটে কোনোভাবে ঠেসে ঢোকাতে পারলেই যেন তারা খুশি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ঘাস ছিঁড়ে তারা কিন্তু সরাসরি পেটে ঢোকায় না! তাদের পাকস্থলী আমাদের মতো নয়, সেটা চার ভাগে বিভক্ত! গরু মাঠেঘাটে ঘাস কামড়ে ছিঁড়ে তার পাকস্থলীর একেবারে প্রথম অংশ রাখে। সেই অংশটার নাম হচ্ছে রুমেন। এই রুমেনকে বলা যেতে পারে একটা ভয়ঙ্কর জায়গা কারণ সেটা গিজগিজ করছে নানারকম জীবাণু আর প্রোটোজায়া দিয়ে। রুমেনের এক ফোঁটা রসের ভেতর রয়েছে দশ বিলিয়ন অণুজীব–পৃথিবীর পুরো মানব সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ! এই অণুজীবগুলো ঘাসের মতো একটা “অখাদ্য” জিনিসকে ভেঙেচুরে হজম করার একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। গরু-ছাগল যখন অবসর পায় তখন রুমেন থেকে ঘাস বের করে মুখে এনে চিবাতে থাকে। চিবিয়ে চিবিয়ে সেটাকে তুষ করে দিয়ে আবার সে তার পেটে পাঠিয়ে দেয়–এভাবে ধাপে ধাপে তার খাওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
খাওয়ার এই নানা রকম পদ্ধতি যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে আমার মনে হয় সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে তারা মাছের খাওয়ার স্টাইল। সত্যি কথা বলতে কী সমুদ্রের বেলাভূমিতে পড়ে থাকা নিরীহ তারা মাছ বা স্টার ফিশের খাওয়ার প্রক্রিয়াটাই যে শুধু বিচিত্র তা নয়, এই প্রাণীটাই বিচিত্র। কেউ যদি স্টার ফিশকে বর্ণনা করতে চায় তাহলে তার বর্ণনাটা হবে এরকম : এর কোনো মাথা নেই, মগজও নেই। সাধারণত পাঁচটা বাহু কিন্তু কোনো আঙ্গুল নেই। বাহুর নিচে কোনো পা নেই–কিন্তু রয়েছে পায়ের পাতা। পায়ের পাতার সংখ্যা একটি দুটি নয়–হাজারখানেক। বাহুগুলোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে দাঁতহীন একটা মুখ এবং সেই মুখ দিয়ে খাওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিচিত্র! যখন দরকার পড়ে তখন পুরো পাকস্থলীটাই সে বের করে ফেলে খাবার জন্যে! একজন মানুষ যদি খাবার টেবিলে বসে ওয়াক করে তার পুরো পাকস্থলীটাই উগলে বের করে নিয়ে আসত সরাসরি খাবারটা সেখানে রেখে আবার পাকস্থলীটা গিলে ফেলত তাহলে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতো কেউ কল্পনা করতে পারবে?
স্টার ফিশ বা তারা মাছ কিন্তু এটাই নিয়মতিভাবে করে। ঝিনুক তার খুব প্রিয় খাবার। কখনো ঝিনুক পেলে সে তার বাহুগুলো দিয়ে সেটাকে জড়িয়ে ধরে। তার বাহুর নিচে যে হাজার খানেক পা আছে সেগুলো দিয়ে ঝিনুকের খোলসটাকে চুষে ধরে সে তখন ঝিনুকটাকে খোলার চেষ্টা করে। খুব বেশি নয় অল্প একটু খুলতে পারলেই সেই ফুটো দিয়ে সে তার পাকস্থলীটা ঝিনুকের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। স্টার ফিশের পাকস্থলীর জারক রস ঝিনুকের ভেতরকার নরম শরীরটাকে প্রায় হজম করে ফেলে–হজম হওয়া অংশটুকু পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে পাকস্থলীটা আবার সুড়ুৎ করে স্টার ফিশ নিজের ভেতর নিয়ে নেয়। ভাগ্যিস আমাদের সেভাবে খেতে হবে না, তাহলে কী সমস্যাই না হতো!
অন্য প্রাণীদের খাওয়া নিয়ে আমরা কত রকম সমালোচনা করে ফেলছি, সেই প্রাণীগুলোও যদি আমাদের মতো সমালোচনা করতে পারত তাহলে তারা আমাদের খাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে না জানি কী সমালোচনাই না করত! মা পাখি হয়তো তাদের বাচ্চাদের বলত–”তোমরা কী ভদ্র, আমরা তোমাদের খাইয়ে দিই তোমরা খাও! মানুষের বাচ্চা কী ভয়ঙ্কর–সরাসরি মায়ের শরীরে লেপটে থাকে, চুষে চুষে মায়ের দুধ খেয়ে ফেলে! কী ভয়ঙ্কর!”
ভাগ্যিস আমরা পাখির কথা শুনতে পাই না!