১১. অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী

ইয়াসমিন, তুমি আমার দক্ষিণ পার্শ্বে উপবেশন কর। ইহা অত্যন্ত নিশ্চিত ও মূল্যবান সামগ্রী। বহুকষ্টে জোগাড় করিয়াছি।

ভিনসেন্টের নির্দেশে তার ডান পাশে গিয়ে ইয়াসমিন বসে। বাম পাশে গ্যাবি, তারপরে পিটার, কোকো, জো, প্যাম, মার্ক, মার্কের পরেই ইয়াসমিন–এইভাবে বৃত্ত রচনা করে বসেছে ওরা। ইয়াসমিন ভেবেছিল, বস্তুটা গাঁজা জাতীয় কিছু হবে, সিগারেটের মতো টানতে হবে। কিন্তু না, আয়োজন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিনসেন্ট দ্রুত হাতে অথচ সাবধানে একটা ছোট গোল শিশি বের করে, তার ভেতরে শাদা গুঁড়ো। অতি সূক্ষ্ম সেই গুঁড়ো। পাউডারের মতো।

ইহা তুমি পছন্দ করিবে।

ধূপদানেব মতো ছোট্ট একটা জিনিস বের করে ভিনসেন্ট। হাত বাড়ায়। কেউ তাকে একটা দেশলাই দেয়।

ইহা নাসিকা দিয়া গ্রহণ করিতে হয়।

ভিনসেন্ট ধারাবিবরণী দিয়ে চলে। ধূপদানের মতো বস্তুটির ভেতরে গুঁড়ো সামান্য একটু ঢেলে, শিশির মুখ বন্ধ করে সে।

তুমি প্রস্তুত, ইয়াসমিন। পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই বলিয়া, শ্রবণ কর। দুই হাত পেয়ালার মতো করিবে। পাত্র সমুখে ধরিব আমি, তুমি চক্ষু পুঁজিয়া, পাত্রটিকে করতলের দুই পেয়ালার ভেতর লইয়া ঘ্রাণ গ্রহণ করিবে। অতঃপর, পাত্রটিকে গ্রহণ করিয়া তোমার দক্ষিণ পাশে যে উপবিষ্ট তাহার সম্মুখে ধরিবে। সে ঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া পাত্রটি অনুরূপভাবে তোমার হাত হইতে লইবে। এইভাবে আমার কাছে সর্বশেষে ফিরিয়া আসিবে। আরম্ভ করিতেছি। ইয়াসমিন চোখ বুজে অপেক্ষা করে। ফস করে দেশলাই জ্বলে ওঠার শব্দ পায়। মুহূর্তকাল পরেই ভিনসেন্ট ফিসফিস করে বলে, লও।

ইয়াসমিন দুই করতল পেয়ালার মতো করে, চোখ বুজে থেকেই পাত্রটিকে ঘিরে মুখ নামিয়ে আনে, ঘ্রাণ নেয়, সাধারণ ধোঁয়ার মতোই মনে হয় তার, পাত্রটিকে ধরে এবং ডানপাশে মার্কের সম্মুখে ধরে। মার্ক দ্রুত ঘ্রাণ নিয়েই পাত্রটি তার হাত থেকে সরিয়ে নেয়।

প্রথমে কিছুই মনে হয় না ইয়সমিনের। চোখের ভেতরে ঘন বেগুনি রঙটা স্থির হয়ে থাকে। সেখানে ভিন্ন রঙের কোনো চিড় ধরে না। সাধারণ অবস্থায় চোখ বুজে থাকলে, চোখের ভেতরে রঙ যেমন সমুদ্র তরঙ্গের মতো ফুলে ফুলে ওঠে, তাও ওঠে না। সব কিছু স্থির এবং স্বাভাবিক মনে হয়। তবু সে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে হঠাৎ কোনো দীপ্তির, বিদ্যুতের, স্তব্ধতার অথবা সংগীতের জন্যে। পাত্র আবার তার কাছে ফিরে আসে।

আবার সে ঘ্রাণ নেয়। প্রথমে হয়তো নতুন বলে ভালো করে নিঃশ্বাস টানে নি, এবার সে বুক ভরে ধোঁয়া নেয়। অচিরে তার মনে হয়, বড় দ্রুত পাত্রটি তার কাছে ঘুরে ঘুরে আসছে। অবিরাম সে ঘ্রাণ নিচ্ছে। তার দেহ অতি ধীরে সম্মুখের দিকে চলছে, ফিরে আসছে, দুলছে, ফিরে আসছে।

ইয়াসমিন।

বহুদূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত সেই ডাকে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে এতক্ষণ এক ভয়াবহ স্তব্ধতার ভেতরে সে ছিল। সেই স্তব্ধতা এখন অপার্থিব অনুরণনে নীলবর্ণ ধারণ করছে এবং তার নামের ধ্বনিপর্বগুলো দীপ্তিময় গোলকের মতো ওঠা নামা করছে।

ইয়াসমিন, শুনিতে পাইতেছ?

হাঁ, ভিনসেন্ট, আমি শুনিতে পাইতেছি।

নীলবর্ণ দেখিতে পাও?

হাঁ। ঘন নীল।

উহা আকাশের নীল।

কয়েকটি গোলক দেখিতেছি।

শীঘ্রই উহারা একটি গোলকে পরিণত হইবে।

হাঁ, এখন একটি গোলক দেখিতেছি।

তুমি গোলকের দিকে তাকাইয়া থাক।

হাঁ, আমি তাকাইয়া আছি। আমার চক্ষু ঝলসিয়া যাইতেছে।

তুমি নতুন চক্ষু প্রাপ্ত হইবে।

গোলক বৃহৎ হইতেছে।

হাঁ, লক্ষ করিয়া দ্যাখো, নীল আর নাই।

নীল আর নাই।

আমার হস্ত ধারণ কর।

করিলাম।

তোমার সম্মুখ ভাগ এখন ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ।

হাঁ, অন্ধকার।

চক্ষু খুলিও না, জাগতিক চক্ষু আর তোমার কাজে লাগিবে না। তোমার নতুন চক্ষু দিয়া মহাশূন্যের নিস্তব্ধ অতল কৃষ্ণ শূন্যতা প্রত্যক্ষ কর।

করিতেছি।

তোমার দুই পার্শ্ব দিয়া সেই অসীম শূন্যতা প্রবল বেগে বহিয়া যাইতেছে।

কোথায় যাইতেছে?

এক শূন্যতা হইতে আরেক শূন্যতায়।

আমি গতি অনুভব করিতেছি, ভিনসেন্ট।

উত্তম। তুমি মুক্তি পাইয়াছ।

আমি ছুটিয়া যাইতেছি।

উত্তম। উত্তম।

আমার ভয় করিতেছে।

ইয়াসমিন, ভীত হইও না। আমার হস্ত ধারণ কর।

আমি কোথায়?

একটি চন্দ্রযানে।

চন্দ্রযান?

হাঁ, তুমি এখন চন্দ্রযানে, তুমি এখন দীপ্তিমান গোলকের দিকে ধাবিত হইতেছ, পৃথিবী তুমি পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছ।

আমি সেখানে ফিরিতে চাহি না।

 তবে তুমি ফিরিবে না।

আমি গতির বেগ অনুভব করিতেছি। এই গতি আমি হারাইতে চাহি না।

তবে তুমি হারাইবে না। আমার দেহের ভেতরে তীব্র আনন্দ কল্লোলিত হইয়া বহিয়া যাইতেছে। আমার রক্তপ্রবাহ আমি প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছি। আমার করোটি হইতে পূর্ণচক্ক নির্গত হইতেছে। আমার হৃদয় ফাটিয়া যাইতেছে। আমি আলোক ভিন্ন কিছু দেখিতেছি না। বিশুদ্ধ সেই আলোক কাহাকেও আলোকিত করে না। আমি সেই আলোকের ভেতরে লীন হইয়া যাইতেছি। আমার চন্দ্রযান আলোক নির্মিত বোধ হইতেছে; আমি অবতরণ করিতে চাহি না, আমি অবতরণ করিতে চাহি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *