১১। পূর্ণযৌবনপ্রাপ্ত ভারতের হৃদয়

১১. পূর্ণযৌবনপ্রাপ্ত ভারতের হৃদয়

গ্রামগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যেই গ্রাম আন্দোলনের যাত্রা। তারা সেবার উদ্দীপনায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে নিজেদেরকে সুসংহত করে নিজেদেরই মুখায়ব দেখতে পাবে গ্রামবাসীদেরকে সেবাদান করে…

– মহাত্মা গান্ধী

.

গ্রামগুলো নিয়েই ভারত। গ্রাম থেকেই কৃষ্টি, সভ্যতা, রীতিনীতি আর জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে। আমি জন্মেছিলাম একটা গ্রামে বড়ও হয়েছি একটা গ্রামেই। আমি গ্রাম্যজীবনের ছন্দ হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামগুলো থেকে মানুষের শহরে পাড়ি জমানোর হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে প্রস্থান করা মানুষগুলোর জীবন চরম দুর্দশার মধ্যে বস্তিতে কাটাচ্ছে। তাদের খিদে মেটাতে তারা আয় উপার্জন করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জীবন থেকে ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে গেছে। গ্রামগুলোকে উন্নয়ন করার মাধ্যমেই শুধুমাত্র ভারতের গ্রামগুলোর মানুষের আয় বাড়ানো, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব, আমি বিশ্বাস করি গ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিমূল করার মাধ্যমেই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের স্রোতবন্ধ করা সম্ভব। এই চিন্তাভাবনার আলোকেই পিইউআরএ (প্রোভাইডিং আরবান এমেনিটিস টু রুরাল এরিয়া) এর আইডিয়া গ্রহণ করা হয়েছিল।

কোন রাজ্যের উন্নয়নের জন্য অবশ্যই সেই রাজ্যের গ্রামগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। এই জ্ঞান থেকেই গ্রামগুলো পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত আমি গ্ৰহণ করেছিলাম। ২০০২ এ আমি প্রথম ভোপাল সফরে গিয়ে আমি টোর্নি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেই গ্রামে না ছিল ভালো রাস্তা, না ছিল বিদ্যুত। ওই গ্রামে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করা মাত্র রাজ্যসরকার অনেকগুলো কাজ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমে সব মৌসুমে চলার উপযোগী কয়েক মিটার লম্বা রাস্তা তৈরি করা হয়। তড়িত গতিতে গ্রামটিতে বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়াও হয়।

টোর্নি গ্রাম পরিদর্শনকালে গ্রামবাসীরা ছিল খুবই খুশি। তাদের তৈরি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আর জৈবিক কীটনাশক ব্যবহার পদ্ধতি আমাকে প্রদর্শন করে। আমি জেলা কতৃপক্ষকে বললাম টোর্নি গ্রামের মতো এলাকার অন্যান্য গ্রামগুলোকেও উন্নয়ন করতে হবে। অন্যান্য গ্রামগুলোর মানুষেরাও টোর্নি গ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের গ্রামগুলোকেও উন্নত করতে সক্ষম হবে। আমি রাজ্য সরকারকেও পরামর্শ দিলাম যে গ্রামগুলোকে ক্লাস্টার ভিত্তিক দলে বিভক্ত করে পারস্পরিক যোগাযোগের সুব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে শুধুমাত্র বাহ্যিক যোগাযোগই স্থাপিত হবে না রাস্তাঘাট, পরিবহন ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটবে। ভিলেজ ক্লাস্টারে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ফলমূল শাকসব্জী ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সহ অন্যান্য শিল্পও গড়ে উঠবে। আমি চিফ মিনিস্টার ও জেলা কর্তৃপক্ষকেও পরামর্শ দিলাম, স্যাটেলাইট পিকচারের সাহায্য নিয়ে মধ্যপ্রদেশের গ্রামগুলোর পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উপর জরিপ চালিয়ে গ্রামগুলোতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে। টোর্নি এলাকার যুবকরা তাদের মিডিল স্কুলকে আপগ্রেডিং করে সেকেন্ডারি স্কুলে রূপান্তর করার জন্য আমাকে অনুরোধ জানালেন। রাজ্য সরকার তা করতে সম্মত হলো।

টোর্নি গ্রাম সফর করে আমি উন্নয়নের নানা দিকদর্শন খুঁজে পেলাম। আমি উপলব্ধি করলাম গ্রামগুলোর সাথে শহরের সেতুবন্ধন রচনা করা একান্তই প্রয়োজন।

.

আমি রামেশ্বরম গ্রামে জন্মে ছিলাম, বড়ও হয়েছিলাম ওই গ্রামেই। ওখানকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার মনে প্রায় প্রায়ই ভেসে উঠতো কিভাবে গ্রামের লোকদের আয় উপার্জন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ানো যেতে পারে। আমার পেশাগত কাজ বৃহত্তর নগরীতে হলেও দূরদূরান্তের এলাকাতে যাবার বেশ কয়েকটা সুযোগ ঘটেছিল আমার। ভারতের ৬০০,০০০ গ্রামের উন্নয়ন করার মধ্যেই ইন্ডিয়া ২০২০ প্রোগ্রামের উন্নয়নধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিহিত ছিল। আমার বন্ধু প্রফেসর পি.ভি.ইন্দিরেসান আমার কাছে পিইউআরএ এর আইডিয়াটা আমাকে জানাতে এলে আমি তার সাথে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলাম। একই বিষয়ে আগ্রহী বিশেষজ্ঞদের সাথেও আমার আলোচনা হলো। পিইউআরএ এর মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার হলো। তাদের কাছ থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গ্রামোন্নয়নের জন্য আমি পৌর এলাকার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি বেশি সফর করলাম। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি পিইউআরএ এর জন্য কমপ্লেক্স স্থাপন করতে মনস্থ করলাম। আমরা নগরবাসীর সাথে আলোচনা করে জানতে পারলাম গ্রামের দিকে উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগায় তারা গ্রামের দিকে ফিরে যেতে চায় না। অপর দিকে গ্রামের লোকজন গ্রামে ভালো সুযোগ সুবিধা না থাকায় ভালো জীবন যাপনের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহর মুখী হয়। আমরা কি গ্রামের লোকজন বিশেষ করে যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে শহর মুখী হওয়া রুখতে পারি না?

আমাদের দেশের সরকার, প্রাইভেট, আর পাবলিক সেক্টরগুলো গ্রামের উন্নয়নের জন্য অংশ গ্রহণ করে আসছে। উদাহরণ হিসাবে, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থসেবা কেন্দ্র, রাস্তাঘাট তৈরির মতো কাজ তারা করে থাকে। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জেনেছিলাম এই সমস্ত উদ্যোগ ভালোভাবেই করা হচ্ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পানি সম্পদের বিপর্যয় দেখা দেবার কারণে গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন ব্যহত হয়েছে। আমরা চিন্তাভাবনা করে দেখলাম শুধুমাত্র টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমেই যথাযথভাবে গ্রামোন্নয়ন করা সম্ভব।

.

আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি যে গ্রামোন্নয়ন করা ভারতের উন্নয়নের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গ্রামগুলোর উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? যা বোঝায় সেগুলো হচ্ছে :

১. গ্রামগুলোকে অবশ্যই পাকারাস্তা আর যেখানে প্রয়োজন সেখানে রেলপথের দ্বারা সংযুক্ত করতে হবে। সেগুলোতে অন্যান্য অবকাঠামো যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গড়ে তোলা দরকার। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বাইরের পরিদর্শকদেরকেও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। বাইরের পরিদর্শকদের অবশ্যই গ্রামে স্বশরীরে উপস্থিত হতে হবে।

২. বিকাশমান জ্ঞানভিত্তিক যুগেও দেশীয় জ্ঞানের পাশাপাশি সর্বশেষ টেকনোলজির সরঞ্জামাদি সরবরাহ, প্রশিক্ষণ আর গবেষণার ও ব্যবস্থা রাখতে হবে। গ্রামে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষকদেরকে গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের অবশ্যই উত্তম চিকিৎসা সেবাদান করতে হবে। কৃষি, ফিসারী, হর্টিকালচার এবং খাদ্যপ্রক্রিয়া জাতকরণ এর ব্যবস্থাও রাখতে হবে। এসব করতে গেলে অবশ্যই ইলেক্ট্রোনিক ব্যবস্থাকে গ্রামে আনতে হবে।

৩. একবার গ্রামে সড়ক আর ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলেই জ্ঞানভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ফলে গ্রামগুলোতে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে এবং উৎপাদিত জিনিসের বাজারও খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। উৎপাদিত জিনিসের গুণগতমান সম্বন্ধে সচেতনা বৃদ্ধি, ওয়ার্ক পার্টনারদের সাথে মতবিনিময় সহ বিভিন্ন কাজের দ্বারা জ্ঞানভিত্তিক সম্পৃক্ততা ঘটবে।

৪. এইগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করতে পারলে গ্রামবাসীর আয় উপার্জন অর্জন করতে সক্ষম হবে। পিইউআরএ এর মিশন গ্রহণ করার দ্বারা আমরা গ্রামগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে সমৃদ্ধশালী জ্ঞানভিত্তিক কেন্দ্র গ্রামে গড়ে তুলতে পারবো। তার ফলে গ্রামবাসীরা উন্নয়নমুখী উদ্যোগী হবার সুযোগ পাবে।

পেরিয়ার পিইউআরএ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত ছিল পেরিয়ার মণিআম্মান কলেজ অব টেকনোলজি ফর উইমেন,বাল্লাম। আমি এই কমপ্লেক্সটি ২০০৩ এর ২০ ডিসেম্বর উদ্বোধন করি। ২০০৬-এর ২৪ সেপ্টেম্বর আমি আবার ওই কমপ্লেক্সটি পরিদর্শন করতে যাই। ২০০৩ এ পঁয়ষট্টিটি গ্রামের ১০০,০০০ জন লোক নিয়ে পিইউআরএ গঠিত হয়। আমি দ্বিতীয়বারের পরিদর্শন কালে গ্রামগুলোর চেহারা দেখে বিস্মিত হই। আমি দেখতে পাই গ্রামের যুবক-যুবতী উন্নয়নমূলক কাজে লিপ্ত হবার ফলে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। বিপুল সংখ্যক লোকের কর্ম সংস্থান হয়েছে, উদ্যোক্তাদের দলও গঠিত হয়েছে। ১,৮০০ টি সেল্পহেল্প গ্রুপকে উন্নয়নমূলক কাজ করতে দেখা যায়। পেরিয়ার মণিআম্মান কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। কৃষি, শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে উঠায় পঁয়ষট্টিটি গ্রামের মানুষের জীবনযাপনের স্টাইল উন্নত হয়েছে। আমি তাদের উন্নতি দেখে খুশি হলাম।

.

নানাজী দেশমুখ তার দলের সদস্যদের নিয়ে মধ্যপ্রদেশের চিত্রকুট পিইউআরএ তে দীনদয়াল রিচার্স ইনস্টিটিউট (ডিআরআই) গঠন করেন। ডিআরআই এমন একটা প্রতিষ্ঠান যা ভারতের গ্রামোন্নয়নের মডেল হিসাবে কাজ করতে সক্ষম হয়। প্রতিষ্ঠানটি জনগণের ক্ষমতাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়েও বেশি গুণ স্থিতিশীল করে। ডিআরআই গ্রামগুলোকে একশটা ক্লাস্টারে বিভক্ত করে। চিত্রকূট এর পাশে প্রায় পাঁচটা গ্রামেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। ১৬ টি ক্লাস্টারের ৫০,০০০ লোক এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হয়। দেশীয় ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাতনি নামের একটা গ্রামে ডিআরআই টেকসই উন্নয়ন সাধন করে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি, আর চাকরির ব্যবস্থা সুসংহত হয়। শিক্ষার হার ১০০ পার্সেন্টে উন্নিত করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। নানাজী দেশমুখ তার প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অর্জনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। গ্রামবাসীরা মামলা মোকদ্দমা কোর্টে না পাঠিয়ে নিজেদের উদ্যোগে মিটিয়ে ফেলতে স্বচেষ্ট হয়। চিত্রকূটের পাশের গ্রামগুলোও এই সুবিধা লাভ করে।

আমি দেখতে পাই চিত্রকূট প্রকল্প গ্রামীণ ভারতে উন্নয়নের বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন অটুট হয়। নারী সমাজ এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত গ্রামগুলোতে সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। অর্থনেতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে শিল্প, সাহিত্য, মানবিকতা, মহানুভবতা আর চিন্তাচেতনায়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামগুলোতে ভারতের পাঁচ হাজার বছরের অতীত ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটে। পিইউআরএ এর অভিনন্দিত আন্দোলনের মাধ্যমেই বিভিন্ন এলাকায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারসিপ সংস্থা গড়ে উঠে। আমি নিশ্চিত হই এটা ভেবে যে ভারত অদূরভবিষ্যতে সারা ভারতের গ্রামগুলোতে ৭,০০০ পিইউআরএ কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

গান্ধিজী বলেছিলেন, প্রকৃত ভারত তার গ্রামগুলোর মাঝেই স্থান লাভ করে আছে। এদের বিপুল সংখ্যক জনগণের মানবিকতাই ভারতকে সাহায্য করতে পারে পৃথিবীতে পূর্ণমাত্রায় অবদান রাখতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *