চতুর্থ অনুবাক
প্রথম সূক্ত : উচ্ছিষ্ট ব্ৰহ্ম–সূক্তম
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : উচ্ছিষ্ট, অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, উষ্ণিক, বৃহতী]
উচ্ছিষ্টে নাম রূপং চোচ্ছিষ্টে লোক আহিতঃ। উচ্ছিষ্ট ইন্দ্রশ্যাগ্নিশ্চ বিশ্বমন্তঃ সমাহিতম ॥১॥ উচ্ছিষ্টে দ্যাপৃথিবী বিশ্বং ভূতং সমাহিত। আপঃ সমুদ্র উচ্ছিষ্টে চন্দ্রমা বাত আহিতঃ ॥২৷৷ সমুচ্ছিষ্টে অসংক্ষোভৌ মৃত্যুবাজঃ প্রজাপতিঃ। লৌকা উচ্ছিষ্ট আয়ত্তা ব্ৰশ্চ দ্রশ্যাপি শ্রীময়ি ॥৩॥ দৃঢ়ো দৃংহস্থিরো নন্যা ব্ৰহ্ম বিশ্বসৃজো দশ। নাভিমিব সর্বতশ্চক্রমুচ্ছিষ্টে দেবতাঃ শ্রিতাঃ ॥৪॥ ঋক সাম যজুরুচ্ছিষ্ট উগীথঃ প্রস্তুতং স্তুত। হিঙ্কার উচ্ছিষ্টে স্বরঃ সাম্নে মেড়িশ্চ তন্ময়ি ॥৫৷৷ ঐন্দ্রাগ্নং পাবমানং মহানাম্নীৰ্মহাব্রত। উচ্ছিষ্টে যজ্ঞস্যাঙ্গানন্তর্গর্ভ ইব মাতরি ॥৬॥ রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ। অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্টে জীববহিমীদিন্তমঃ ॥৭॥ অগ্ন্যাধেয়মথো দীক্ষা কামপ্রচ্ছন্দসা সহ। উৎসন্না যজ্ঞঃ সত্ৰাণচ্ছিষ্টেহধি সমাহিতাঃ ॥৮॥ অগ্নিহোত্রং চ শ্রদ্ধা চ বষট্কারো ব্রতং তপঃ। দক্ষিণেষ্টং পূর্তং চোচ্ছিষ্টেহধি সমাহিতাঃ ॥৯॥ একরাত্রো দ্বিরাত্রঃ সদ্যঃক্রীঃ প্ৰক্ৰীরুথ্যঃ। ওতং নিহিতমুচ্ছিষ্টে যজ্ঞস্যানি বিদ্যয়া ॥১০৷৷
বঙ্গানুবাদ –হবনের পর হুতাবশিষ্ট যে ওদন প্রাশনার্থে রক্ষিত থাকে, তাকে উচ্ছিষ্ট বলা হয়। সেই উচ্ছিষ্টে বা ওদনে (অর্থাৎ অন্নে) নামধেয়াত্মক ও রূপধেয়াত্মক পৃথিবী ইত্যাদি প্রপঞ্চ আহিত (অর্থাৎ আস্থিত বা সমাশ্রিত) হয়ে রয়েছে। সেই উচ্ছিষ্টে দ্যুলোকাধিপতি ইন্দ্র ও পৃথিবীস্বামী অগ্নি উভয়ে আহিত হয়ে রয়েছেন। অধিক কি (কিং বহুনা), এতৎ উপলক্ষিত ঐ উচ্ছিষ্টের মধ্যে সর্ব জগৎ সমাহিত (অর্থাৎ ঈশ্বরের দ্বারা স্থাপিত) হয়ে রয়েছে। ১৷
সেই উচ্ছিষ্টরূপ ব্রহ্মে আকাশ ও পৃথিবী আহিত হয়ে আছে; সেইগুলিতে বাসকরণশীল জীবও সেই উচ্ছিষ্টে সমাহিত (সম্যগ নিহিত) হয়ে আছে। ব্যাপনশীল প্রথমসৃষ্ট জগকারণভূত সমুদায়াত্মক জলরাশি ও সমুদ্র সেই উচ্ছিষ্টে সমাহিত। সেই সমুদ্র মথ্যমান হলে চন্দ্র উৎপন্ন হয়েছেন এবং অন্তরিক্ষাধিপতি বায়ুদেবতাও সেই উচ্ছিষ্টরূপ ব্রহ্মে আহিত (অর্থাৎ আশ্রিত) হয়েছেন। ২৷
সৎ ও অসৎ উভয় সেই উচ্ছিষ্টে কার্যাত্বের কারণে বর্তমান। সেই সৎ-অসতের সাথে সম্বন্ধিত মারক মৃত্যু দেবতা, তার বল (বাজঃ), ও সকলের স্রষ্টা প্রজাপতি সেই উচ্ছিষ্টে বর্তমান রয়েছেন। লোসম্বন্ধি প্রজাগণও সেই উচ্ছিষ্টে স্থাপিত। তথা বারক (ব্ৰঃ) বরুণ ও দ্রাবক (দ্রঃ) অমৃতময় সোমও সেই উচ্ছিষ্টে আশ্রিত হয়ে রয়েছেন। সেই উচ্ছিষ্টের প্রসাদে (অথবা, উচ্ছিষ্টে আশ্রিত ঐ সকলের প্রসাদে) আমাতে সম্পদ (শ্রী) আস্থিত হোক৷ ৩৷৷
দৃঢ় অঙ্গসম্পন্ন দেব, স্থিরীকৃত লোক, এবং তত্রস্থ প্রাণীবর্গ, জগকারণ ব্রহ্ম, নয়জন বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মা ও তাঁদের রচয়িতা দশম ব্রহ্মা (অথবা নয়টি প্রাণ ও এক মুখ্য প্রাণ–এঁরাই প্রথম সৃষ্ট বিশ্বের স্রষ্টা)-এঁরা সকলে উচ্ছিষ্টে সমাহিত। অপিচ, ইন্দ্র ইত্যাদি সকল দেবতা সেই উচ্ছিষ্টে অর্থাৎ কারণরূপ ব্ৰহ্মকে আশ্রয় করে আছেন, যেমন রথচক্রের মধ্যস্ত নাভি সর্বতঃ আবেষ্টন করে থাকে। ৪
ঋক্ (অর্থাৎ পাদবদ্ধ যে মন্ত্রগুলি যাজ্যা-অনুবাক্য ইত্যাদি রূপে যজ্ঞে বিনিযুক্ত), সাম (অর্থাৎ প্ৰগীত মন্ত্রসমূহ স্তোত্রসাধনত্বে বিনিযুক্ত), যজুঃ (অর্থাৎ অনুষ্ঠেয়ার্থ-প্রকাশক মন্ত্র),–এই ত্রিবিধ মন্ত্ররাজি উচ্ছিষ্যমাণ ব্রহ্মে সমাশ্রিত। তথা উষ্মীথ (অর্থাৎ উদ্গাতা কর্তৃক সামবেদের গীয়মান ভাগ), প্রস্তুত (অর্থাৎ প্রস্তোতা কর্তৃক গীয়মান প্রস্তাবাখ্যো ভাগ), স্তোত্র (অর্থাৎ স্তবনকর্ম), হিঙ্কার (অর্থাৎ উদ্গাতাগণ কর্তৃক অগ্রে প্রযুজ্যমান হিং শব্দ), স্বর (অর্থাৎ কৃৎস্নসামাশ্রিত সপ্তবিধ স্বর), তথা ঋক-অক্ষরের ও গান বিশেষের মিলন (অর্থাৎ সংসর্গজনিত বা একত্রাবস্থানে উৎপন্ন স্তোভবিশেষ)–এই সবই, অর্থাৎ উষ্মীথ ইত্যাদি সবই, উচ্ছিষ্টে সমাশ্রিত। এই সকলই আমার যজ্ঞসমৃদ্ধির নিমিত্ত হোক। ৫৷
ঐন্দ্রাগ্ন (প্রাতঃসবনে প্রযুজ্যমান ইন্দ্র ও অগ্নির স্তুতি), পাবমান (সবনের প্রথমে গীয়মান পবমান-সোমদেবতাক সাম), মহানামী ঋক (বা গীয়মান শাক্কর সাম), মহাব্রত (বা রাজন গায়ত্র বৃহৎ রথন্তর ও ভদ্রখ্য পঞ্চ সামরূপ ক্রিয়মান স্তোত্র) যজ্ঞের এই অঙ্গ সমূহ মাতার গর্ভে স্থিত অভিবর্ধনশীল জীবের ন্যায় উচ্ছিষ্টে আশ্রিত থাকে৷ ৬ ৷৷
সার্বভৌম রাজা কর্তৃক অনুষ্ঠেয় পশু-সোম-দর্বি-হোমাত্মক শস্ত্রপ্রধান) রাজসূয়, (বাজ অর্থাৎ অন্ন দ্রবীকৃত পূর্বক পেয় বা ঘৃত পানাত্মক যে কর্ম, সেই) বাজপেয়, (চরমস্তোত্রে যজ্ঞাযজ্ঞীয়ে অগ্নি স্তুতিপ্রধান) অগ্নিষ্টোম, (হিংসাপ্রত্যবায়রহিত) সোধ্বরঃ, (বিরাডাত্মক উপাস্যমান চিত্যাগ্নিরূপ) অর্ক, (বিরাডাত্মক অশ্বের উপাসনা প্রধান) অশ্বমেধ, (জীরাবস্থাভিন্ন যাগবিশেষ) জীববৰ্হি এবং দেবগণের তৃপ্তিবিশেষকর অন্যান্য সোমবাগ সমূহ সেই উচ্ছিষ্টমান নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মে সমাশ্রিত হয়ে আছে। ৭।
গার্হপত্য ইত্যাদি অগ্নিসমূহের আধানের (অর্থাৎ স্থাপনের) পর সোমবাগের যে দীক্ষণীয়েষ্টি ইত্যাদি যজমানের অভিলষিত ফলবিশেষগুলি আছে, তা গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ ইত্যাদি ছন্দসমূহের সাথে নিষ্পন্ন হয়ে থাকে। ইদানীং দুরধিগম্য হওয়ায় অনুষ্ঠানের অভাবে লুপ্তপ্রায় এই যজ্ঞসমূহ উৎসন্ন যজ্ঞ নামে উক্ত হয়। (কিম্বা অল্পায়ু সম্পন্ন জনের পক্ষে এই সত্রগুলির অনুষ্ঠান সম্ভব না হওয়ায় এইগুলি উৎসন্ন যজ্ঞ নামে অভিহিত)। বহু যজমানের কর্তৃত্বে (অনুষ্ঠিতব্য) এই সোমযাগসমূহ সত্র নামে উক্ত। এইরকম অনুক্রান্ত সকল যাগ সেই উক্তৃষ্ট ব্রহ্মে সমাশ্রিত ৷ ৮
(সায়ং ও প্রাতে সাগ্নিকগণের দ্বারা অগ্নির উদ্দেশে কৃত হোমমূলক) অগ্নিহোত্র, (অনুষ্ঠেয় যজ্ঞ কর্মে আস্তিক্যবুদ্ধিমূলক) শ্রদ্ধা, (যাজ্যান্তে হবিঃপ্রদানে প্রযুজ্যমান বৌষ শব্দমূলক) বষট্কার, (মিথ্যাকথা বর্জন, চৌর্য বর্জন, হিংসা বর্জন, অশৌচ বর্জন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়নিগ্রহমূলক) ব্রত, (শরীরসন্তাপকর কৃচ্ছু চান্দ্রায়ন ইত্যাদি) তপস্যা, (ঋত্বিকগণকে দেয়) দক্ষিণা, (শ্রুতিবিহিত যাগহোম ইত্যাদি) ইষ্টকর্ম এবং (স্মৃতি-পুরাণ অভিহিত বাপী-কূপ-তড়াগ-দেবায়তন-উদ্যান ইত্যাদি নির্মাণমূলক) পূর্তকর্ম– এইগুলি সবই উচ্ছিষ্যমান মায়া-সংস্পৃষ্ট ব্রহ্মে সমাশিত হয়ে আছে। ৯
(এক রাত্রি ব্যাপী বর্তমান সোমবাগ) একারা, (দুই রাত্রি ব্যাপী বর্তমান অহীন নামে উক্ত) দ্বিরাত্র, (একটি দিন ব্যাপী ক্রীয়মান দুই বিশেষ সোমবাগ) সদ্যঃক্রী ও প্রক্রী, (অগ্নিষ্টোম সংস্থা ইত্যাদি যে সোমযাগ উথ মন্ত্রে কৃত হয়, সেই) উকথ্য–এই যাগগুলি উদীরিতলক্ষণ উচ্ছিষ্টে নিক্ষিপ্ত হয়ে সূক্ষ্ম রূপে ব্রহ্মে আশ্রিত রয়েছে। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –চতুর্থেনুবাকে ষট্ সূক্তনি। তত্র আদৈস্ত্রিভিঃ সূক্তৈব্রক্ষৌদনাখ্যে সবযজ্ঞে হুতশিষ্টস্য ওদস্য সর্বজগকারণভূতব্রহ্মাভেদেন স্তুতিঃ ক্রিয়তে। তত্রৈব এষাং বিনিয়োগো দ্রষ্টব্যঃ। (১১কা, ৪অ. ১সূ.)।
.
দ্বিতীয় সূক্ত : উচ্ছিষ্ট ব্ৰহ্ম–সূক্তম
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : উচ্ছিষ্ট, অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, উষ্ণিক, বৃহতী]
চতুরাত্রঃ পঞ্চরাত্রঃ ষড্রাত্রস্টোভয়ঃ সহ। যোড়শী সপ্তারাত্ৰশ্চোচ্ছিষ্টাৰ্জ্জজ্ঞিরে সর্বে। যে যজ্ঞা অমৃতে হিতাঃ ॥১॥ প্রতীহাররা নিধনং বিশ্বজিচ্চাভিজিচ্চ যঃ। সাহ্নাতিরাত্রাবুচ্ছিষ্টে দ্বাদশাহোহপি তন্ময়ি ॥২॥ সূতা সন্নতিঃ ক্ষেমঃ স্বধোৰ্জামৃতং সহঃ। উচ্ছিষ্টে সর্বে প্রত্যঞ্চঃ কামাঃ কামেন তাতৃপুঃ ॥৩. নব ভূমীঃ সমুদ্ৰা উচ্ছিষ্টেহধি শ্রিতা দিবঃ। আ সূর্যো ভাত্যুচ্ছিষ্টেহহোরাত্রে অপি তন্ময়ি ॥৪॥ উপহব্যং বিষুবন্তং যে চ যজ্ঞা গুহা হিতাঃ। বিভর্তি ভর্তা বিশ্বস্যোচ্ছিষ্টো জনিতুঃ পিতা ॥৫৷৷ পিতা জনিতুরুচ্ছিষ্টোহসোঃ পৌত্রঃ পিতামহঃ। স ক্ষিয়তি বিশ্বস্যেশানো বৃষা ভূম্যামতিগ্নঃ ॥৬৷৷ ঋতং সত্যং তপো রাষ্ট্রং শ্রমো ধৰ্মশ্চ কর্ম চ। ভূতং ভবিষ্যদুচ্ছিষ্টে বীর্যং লক্ষ্মীর্বলং বলে ॥৭॥ সমৃদ্ধিরোজ আকৃতিঃ ক্ষত্রং রাষ্ট্রং ষড়ুঃ। সম্বৎসরোহধচ্ছিষ্ট ইড়া প্রৈষা গ্রহা হবিঃ ॥৮॥ চতুহোতার আপ্রিয়শ্চাতুর্মাস্যানি নীবিদঃ। উচ্ছিষ্টে যজ্ঞা হোত্রাঃ পশুবন্ধাস্তদিষ্টয়ঃ ॥৯॥ অধর্মসাশ্চ মাসাশ্চাতবা ঋতুভিঃ সহ। উচ্ছিষ্টে ঘোষিণীরাপঃ স্তনয়িত্নঃ শ্রুতির্মহী ॥১০।
বঙ্গানুবাদ –(চারি রাত্রে আবর্তমান সোমাগ) চতুরাত্র, (সেরূপ পঞ্চরাত্রে আবর্তমান সোমবাগ) পঞ্চরাত্র, (এইরকম) ষড়রাত্র, সপ্তরাত্র ইত্যাদি এবং এদের দ্বিগুণ দিনশালী, অর্থাৎ অষ্টরাত্র, দশরাত্র, দ্বাদশরাত্র, চতুর্দশাত্র এবং সোড়শী (অর্থাৎ যোড়শসংখ্যা পূরক উথ স্তোত্র ও শাস্ত্র সমন্বিত সোমবাগ) এবং এইরকম অমৃতলক্ষণ ফলজননে সমর্থ অন্যান্য যাগসমূহ উচ্ছিষ্যমান জগকারণ ব্রহ্ম হতে (ব্রহ্মেদিননাচ্ছেষণাৎ) জাত হয়েছে ৷ ১৷
প্রতীহার (প্রতিহর্তা কর্তৃক উচ্যমান সাম), নিধন (উগাতা কর্তৃক উচ্যমান সংহিতার যে ভাগের দ্বারা সাম পরিসমাপ্ত হয়), বিশ্বজিৎ ও অভিজিৎ (দুই সোমযাগের অগ্নিষ্টোম-সংস্থা), সাহ্ন (একদিনে সমাপ্যমান সবনত্রয়াত্মক সোমবাগ), অতিরাত্র (রাত্রি অতীত পূর্বক ঊনত্রিংশস্তুত শস্ত্রবান সোমযাগ), এবং দ্বাদশাহ (দ্বাদশ দিনের সমাহারে অনুষ্ঠিত ক্রতু)–ব্রহ্মে অর্থাৎ উচ্ছিষ্টে সমাশ্রিত এই সকল যজ্ঞ আমাতে স্থিত হোক। (অর্থাৎ অনুক্রান্ত যজ্ঞজাত ফল আমি যেন লাভ করি) ॥ ২
সুনৃত (অর্থাৎ প্রিয়সত্যাত্মিকা বাক), সন্নতি (অর্থাৎ সেই বাকের উপস্থিতি), ক্ষেম (অর্থাৎ সেই উপস্থিতির ফলের পরিরক্ষণ), স্বধা (অর্থাৎ পিতৃবর্গের তৃপ্তিকরী অন্ন), ঊর্জা (অর্থাৎ সর্বপ্রাণীর বলকর অন্ন), অমৃত (অর্থাৎ দেবতার উপভোগ্য অমৃতত্বপ্রাপক পীযুষ) ও সহ (অর্থাৎ অপরজনকে অভিভবনক্ষম বল)–এই সকল যে কাম্যমান ফলবিশেষ ব্রহ্মময় উচ্ছিষ্টে আশ্রিত আছে, সেগুলি যজমানের আত্মাভিমুখে আগত হয়ে তাকে তৃপ্ত করুক৷ ৩৷৷
নবখণ্ডাত্মিকা (নয়ভাগে খণ্ডিতা) পৃথিবী, সপ্তসংখ্যক সমুদ্র ও উপরিতন দুলোক–এইগুলি সেই উচ্ছিষ্যমান ব্রহ্মে আশ্রিত। সূর্যও সেই উচ্ছিষ্যমান স্বপ্রকাশ পরব্রহ্মে আশ্রিত হয়ে সর্বত্র দীপ্ত করছে। দিবা ও রাত্রও তার আশ্রিত হয়ে প্রভান্বিত। এইগুলি সবই আমার হোক। ৪৷
উপহব্য নামক সোমবাগ, গরাময়নাখ্য ছয়মাস-সাধ্য বিষুবান নামক সোমবাগ, এবং যে সকল যজ্ঞ অজ্ঞাতরূপে রয়েছে, সেগুলি সেই উচ্ছিষ্যমান ওদন বা পরমাত্মা পোষণ করেন। (তিনি কীদৃশ? না, তিনি সর্ব জগতের ভর্তা ও পরমাত্মপক্ষে এই লোকে যিনি জনক, তারও তিনি জনয়িতা। (অর্থাৎ তিনি সর্বকরণের কারণভূত) ॥ ৫॥
হুতাবশিষ্ট ওদন (উচ্ছিষ্ট) আপন ৮ উৎপাদকের পিতা (অর্থাৎ লোকান্তরে দিব্যশরীরের উৎপাদক, তথা তিনি প্রাণের পৌত্র (অর্থাৎ প্রাণচলনের দ্বারা শরীরের চলন, এই জন্য ওদনের পৌত্রত্ব), তথা সেই প্রাণের পিতামহ (অর্থাৎ ভাবী স্বর্গভোগযোগ্যের শরীরের তিনিই তাবৎ পিতা; আবার সেই শরীরের উৎপত্তির পরে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে পিতামহ)। এবষ্কৃত সেই উচ্ছিষ্ট সর্ব জগতের ঈশ্বর, কামবর্ষিতা ও অতিক্রান্তহনন (অর্থাৎ অবধ্য) হয়ে পৃথিবীতে (অর্থাৎ পৃথিবীর সকল প্রাণীর শররে) বিরাজিত হয়ে আছেন। ৬৷৷
ঋতম্ (অর্থাৎ মনের যথার্থ সঙ্কল্প), সত্যম্ (অর্থাৎ বাক্যের যথার্থ ভাষণ), তপঃ (অর্থাৎ শরীরসন্তাপকর ব্রত-উপবাস ইত্যাদি নিয়মবিশেষ), রাষ্ট্রং (অর্থাৎ রাজ্য), শ্রমঃ (অর্থাৎ শান্তি বা শব্দ ইত্যাদি বিষয় উপভোগের উপরতি), ধর্মঃ (তার জন্য অপূর্ববিশেষ), কর্ম (অর্থাৎ বর্ণাশ্রম অনুসারে বিহিত যাগ-দান-হোম ইত্যাদি), ভূত (অর্থাৎ উৎপন্ন জগৎ), ও ভবিষ্যৎ (অর্থাৎ উৎপস্যমান বা উৎপাদিতব্য জগৎ)–এই সবই সেই উচ্ছিষ্ট ব্রহ্মে বা তদাত্মক ওদনে কার্যাত্বে নিত্য আশ্রিত হয়ে আছে। তথা বীর্যম্ (অর্থাৎ সামর্থ্য), লক্ষ্মীঃ (অর্থাৎ সর্ববস্তু-সম্পত্তি), বলম্ (অর্থাৎ সর্বকর্ম নিবর্তনক্ষম শরীরগত সামর্থ্য) সেই বলবান্ উচ্ছিষ্টে আশ্রিত রয়েছে। ৭৷
সমৃদ্ধি (অর্থাৎ ইষ্টফলের অভিবৃদ্ধি), ওজঃ (অর্থাৎ শরীরবল বা অষ্টম ধাতু), আকৃতি (অর্থাৎ ইষ্টফল-বিষয়ে সঙ্কল্প), ক্ষত্র (ক্ষাত্ৰ-তেজঃ), রাষ্ট্র (ক্ষত্ৰধর্মের দ্বারা পরিপালনীয় রাজ্য), ষট সংখ্যক উর্বী (অর্থাৎ মন্ত্রান্তরে পরিগণ্য দ্যৌ, পৃথিবী, দিবা, রাত্রি, জল ও ঔষধি), সম্বৎসর (অর্থাৎ দ্বাদশমাসাত্মক কাল), ইড়া (অর্থাৎ যে দেবতার প্রীতির নিমিত্ত যজ্ঞের হুতাশিষ্ট হতে পুরোডাশ ইত্যাদির ভাগ প্রদান করা হয়ে থাকে), প্রৈষা (অর্থাৎ যজ্ঞে ঋত্বিকগণের প্রেরক মন্ত্ৰসমূহ), গ্রহ (অর্থাৎ বায়ব্যের দ্বারা গৃহ্যমান ঐন্দ্ৰবায়ব ইত্যাদির সোমবিশেষ), হবি (অর্থাৎ চরু, পুরোডাশ ইত্যাদি লক্ষণ আজ্য)–এগুলি সবই সেই উচ্ছিষ্যমান ব্ৰহ্মরূপ আধারে সমাশ্রিত। ৮।
চতুর্যোতৃ সংজ্ঞক মন্ত্ররাজি, আল্লী বা আপ্রিয়। সংজ্ঞক পশুগসম্বন্ধি যাজ্যা সমূহ, চারিটি মাসে ক্রিয়মান, বৈশ্বদেব-বরুণপ্রঘাস-সাকমেধ ও শুনাসীরিয় নামে আখ্যাত চারিটি পর্বসমম্বিত চাতুর্মাস্য, নিবিদ অর্থাৎ স্তোতব্য-গুণ প্রকর্ষ নিবেদনপর মন্ত্র সমুদায়, যজ্ঞ অর্থাৎ যাগ, হোত্ৰা অর্থাৎ হোতৃপ্রমুখ সপ্ত বষর্তা, পশুবন্ধা অর্থাৎ অগ্নীষোমীয়-সবনীয়-অনুবন্ধ্যাত্মক সোমাঙ্গভূত পশুগ সকল, এবং অঙ্গভূত স্বতন্ত্র ইষ্টি বা যজ্ঞও সেই উচ্ছিষ্যমান ব্রহ্মে বা তদাত্মক ওদনে সমাশ্রিত হয়ে আছে। ৯।
পঞ্চদশদিবসাত্মক পক্ষ বা অর্ধমাস, চৈত্র ইত্যাদি মাস সমূহ, আর্তব (অর্থাৎ সেই সেই ঋতু সম্বন্ধী পদার্থসমূহ)–এগুলি সবই উচ্ছিষ্টে সমাশ্রিত তথা ঘোষযুক্ত (শব্দকরী) জল, গর্জনকারী মেঘ, শুদ্ধামহতী ভূমি (শ্রুতির্মহী)– এগুলিও সেই উচ্ছিষ্টে সমাশ্রিত ॥ ১০
টীকা— পূর্ব সূক্তের মতো এই সূক্তেও ব্রহ্মৌদন নামে আখ্যাত সবযজ্ঞে হুতাবশিষ্ট ওদনের সাথে সর্বজগকারণভূত ব্রহ্মের অভেদত্বের স্তুতি করা হয়েছে ৷ (১১কা. ৪অ. ২সূ.)।
.
তৃতীয় সূক্ত : উচ্ছিষ্ট ব্ৰহ্ম–সূক্তম
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : উচ্ছিষ্ট, অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, উষ্ণিক, বৃহতী]
শর্করাঃ সিকতা অশ্মান ওষধয়ো বীরুধণা। অভ্রাণি বিদাতো বর্ষমুচ্ছিষ্টে সংশ্রিতা শ্রিতা ॥১॥ রাদ্ধিঃ প্রাপ্তিঃ সমাপ্তির্ব্যাপ্তিমহ এধতুঃ। অত্যাপ্তিরুচ্ছিষ্টে ভূতিশ্চাহিতা নিহিতা হিতা ॥২৷৷ যচ্চ প্রাণতি প্রাণেন যচ্চ পশ্যতি চক্ষুষা। উচ্ছিষ্টাৰ্জ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥৩৷৷ ঋচঃ সামানি চ্ছন্দাংসি পুরাণং যজুষা সহ। উচ্ছিষ্টাৰ্জ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥৪॥ প্রাণাপাণৌ চক্ষুঃ শ্রোমক্ষিতিশ্চ ক্ষিতিশ্চ যা। উচ্ছিষ্টাৰ্জ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥৫৷৷ আনন্দা মোদাঃ প্রমুদোহভীমোদমুদশ্চ যে। উচ্ছিষ্টাৰ্জ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥৬॥ দেবাঃ পিতরো মনুষ্যা গন্ধর্বাঙ্গরস যে। উচ্ছিষ্টাজ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥৭॥
বঙ্গানুবাদ –শর্করা (ক্ষুদ্র পাষাণবিশেষ), সিকতা (বালুকা), অশ্মান (পাষাণ), ওষধি সমূহ (ব্রীহি যব ইত্যাদি), বীরুধ (বিরোহণশীলালতা), তৃণ (গগা ইত্যাদির ভোগ্য ঘাস), অভ্রসমূহ (জলপূর্ণ মেঘরাশি), বিদ্যুৎ, বর্ষ (বৃষ্টি)–এই সবই সেই উচ্ছিষ্টে সমস্থিত ৷৷ ১৷
রাদ্ধি (সংসিদ্ধি বা সম্যগ নিষ্পত্তি), প্রাপ্তি (ফলের অধিগম), সমাপ্তি (সম্যগ আপ্তি), ব্যাপ্তি (বিবিধ আপ্তি), মহ (তেজঃ বা উৎসব), এধতু (অভিবৃদ্ধি), অত্যাপ্তি (অধিক প্রাপ্তি), ভূত(সমৃদ্ধি)–এগুলি সবই সেই উচ্ছিষ্টে স্থিত। ২।
যে সকল প্রাণিজাত প্ৰাণবায়ুর দ্বারা জীবনধারণ করে বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের দ্বারা গন্ধ গ্রহণ করে, যে সকল প্রাণিজাত চক্ষুরূপ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নীলপীত ইত্যাদি দিককে সাক্ষাৎ বা দর্শন করে, সেই সকল প্রাণী উচ্ছিষ্যমান ব্রহ্মের নিকট হতে (সকাশাৎ) উৎপন্ন হয়েছে। তথা দ্যুলোকে স্থিত ও অন্য দ্যুলোকে বর্তমান যে দেবতাগণ আছেন, তাঁরা সকলে সেই উচ্ছিষ্টে উৎপন্ন হয়েছেন ৷৷ ৩৷
পাদবদ্ধ মন্ত্ররাজি (ঋক), গীতবিশিষ্ট মন্ত্রাবলি (সাম), গায়ত্রী-উষ্ণিক ইত্যাদি চারি অক্ষরের অধিক বা সপ্তসংখ্যক ছন্দ, পুরাতন বৃত্তান্তকথনরূপ আখ্যান (পুরাণ), এগুলি সবই, যজুর্মন্ত্রের সাথে এবং দ্যুলোকস্থ ও অপর দ্যুলোকস্থ দেবতাগণের সাথে সেই উচ্ছিষ্ট হতে জাত হয়েছে। ৪।
প্রাণবৃত্তি ও অপানবৃত্তি, রূপদর্শন-সাধন চক্ষুরিন্দ্রিয়, শব্দগ্রহণ-সাধন শ্রোত্র, ক্ষয়াভাব (অক্ষিতি) ও ক্ষয় (যা চ ক্ষিতি ) বা অক্ষীয়মান ও ক্ষয়াভিমানী দেবতা–এই সকল পদার্থ এবং দ্যুলোকস্থ ও অপর দ্যুলোকস্থ দেবতাগণ উচ্ছিষ্যমান ব্ৰহ্ম হতে জাত। ৫৷৷
আনন্দ (বিষয়োপভোগজনিত সুখবিশেষ), মোদ (বিষয়দর্শনজন্য হর্ষসমূহ), প্রমুদ (প্রকৃষ্ট বিষয়লাভজন্য হর্ষসমূহ), অভিমোদ (অভিমুখে বর্তমান আমোদ) এবং মুদ (সন্নিহিত সুখহেতু পদার্থনিচয়)–এই সবই সেই উচ্ছিষ্যমান ব্ৰহ্ম হতে জাত। তথা যে দেবগণ দ্যুলোকে স্থিত এবং যে দেবগণ অন্য দ্যুলোকে বর্তমান, তারা সকলেই এই উচ্ছিষ্ট হতে জাত ৬
দেবগণ (অর্থাৎ অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র ইত্যাদি), পিতৃগণ (অর্থাৎ পিতৃলোক-নিবাসী পূর্ব-পুরুষগণ), মনুষ্য (অর্থাৎ মনের নিকট হতে উৎপন্ন মনুষ্যজাতি), গন্ধর্ব (অর্থাৎ বিশ্বাবসু প্রভৃতি দেবযোনিবর্গ), অপ্সরা (অর্থাৎ উর্বশী প্রভৃতি স্বর্গকামিনীগণ)–এই সকলেই সেই উচ্ছিষ্যমান ব্ৰহ্ম হতে বা ব্রহ্মেদিন হতে জাত। তথা যে দেবগণ দ্যুলোকে স্থিত এবং যে দেবগণ অন্য দ্যুলোকে বর্তমান, তাঁরা সকলেই সেই উচ্ছিষ্ট হতে জাত ॥ ৭।
টীকা –উপযুক্ত সুক্তটি পূর্ববর্তী দুটি সূক্তের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এটির বক্তব্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি সবই পূর্ব সূক্ত দুটির অনুরূপ ৷৷ (১১কা. ৪অ. ৩সূ.)।
.
চতুর্থ সূক্ত : অধ্যাত্মম
[ঋষি : কৌরুপথি। দেবতা : মন্যু, অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি]
যন্মনর্জোয়ামাবহৎ সঙ্কল্পস্য গৃহাদধি। ক আসং জন্যাঃ, কে বরাঃ ক উ জ্যেষ্ঠবরোহভবৎ ॥১॥ তপশ্চৈবাস্তাং কর্ম চান্তর্মহত্যর্ণবে। ত আসং জন্যাস্তে বরা ব্ৰহ্ম জ্যেষ্ঠববোহভবৎ ॥২॥ দশ সাকমজায়ন্ত দেবা দেবেভ্যঃ পুরা। যো বৈ তা বিদ্যাৎ প্রত্যক্ষং স বা অদ্য মহৎ বদেৎ ॥৩॥ প্রাণাপাণী চক্ষুঃ শ্রোমক্ষিতিশ্চ ক্ষিতিশ্চ যা। ব্যানোদানৌ বাঙ মনস্তে বা আকূতিমাবহ ॥৪৷৷ অজাতা আসন্বতবোহথো ধাতা বৃহস্পতিঃ। ইন্দ্রাগ্নী অশ্বিনা তৰ্হি কং তে জ্যেষ্ঠমুপাসত ॥৫৷৷ তপশ্চৈবাস্তাং কর্ম চান্তৰ্মহত্যর্ণবে। তপোহ জজ্ঞে কর্মণস্তৎ তে জ্যেষ্ঠমুপাসত ॥৬॥ যেত আসীদ ভূমিঃ পূর্বা যামদ্ধাতয় ইদ বিদুঃ। যো বৈ তাং বিদ্যান্নামথা স মন্যেত পুরাণবিৎ ॥৭॥ কুত ইন্দ্রঃ কুতঃ সোমঃ কুততা অগ্নিরজায়ত। কুতষ্টা সমভবৎ কুততা ধাতাজায়ত ॥৮ইন্দ্রাদিন্দ্রঃ সোমাৎ সোমো অগ্নেরগ্নিরজায়ত। ত্বষ্টা হ জজ্ঞেতষ্ঠুর্ধাতুর্ধাতাজায়ত ॥৯॥ যে ত আসন্ দশ জাতা দেবা দেবেভ্যঃ পুরা। পুত্রেভ্যো লোকং দত্ত্বা কস্মিংস্তে লোক আসতে ॥১০
বঙ্গানুবাদ –মনু (অর্থাৎ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত সর্বদেবাত্মক পরব্রহ্ম) সৃষ্টিকর্মের উদ্দেশে আপন সঙ্কল্প হতে (সঙ্কল্পের গৃহ হতে) মায়াশক্তিস্বরূপাকে (লৌকিকবিবাহাত্বের দ্বারা) বিবাহ করেছিলেন। (সঙ্কল্প যেন শ্বশুরগৃহ এবং মায়াশক্তি তার জায়া। সৃষ্টির ইচ্ছা সমন্বিতা পরমেশ্বরী, হলেন মায়াশক্তি)। সেই জায়া আবাহনকালে বধূ ও বরপক্ষীয় বান্ধবগণ কারা ছিল? কে আর কন্যাবরণের কর্তা ছিল। সেই সময়ে প্রধানভূত বর অর্থাৎ উদ্বাহকর্তার নাম কি? (কো নাম তস্মিন্। সময়ে জ্যেষ্ঠবরঃ অভবৎ)। ১৷৷
সেই সৃষ্টিকালে প্রলয়কালীন মহতি অর্ণবের মধ্যে (অর্থাৎ মহাসমুদ্রের অভ্যন্তরে) সৃষ্টিব্যাপার পর্যালোচনাত্মক যে জ্ঞানময় তপস্যা ও সুখদুঃখফলোন্মুখ পরিপক্ক কর্ম ছিল, সেই উভয়ের প্রকাশই ছিল বিবাহপ্রবৃত্ত বন্ধুজন ও বরয়িতা (বরণকর্তা)। সেই সৃষ্টি-অভিলাষী জগকারণ ব্ৰহ্ম ছিলেন মায়াশক্তিরূপার (জায়ার) প্রধানভূত উদ্বাহকর্তা (জ্যেষ্ঠবর) ॥ ২॥
যে সশক্তক ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, তার নিকট হতে অধিষ্ঠাত্ অগ্নি ইত্যাদির উৎপত্তির পূর্বে দশসংখ্যক দেবতা (অর্থাৎ জ্ঞানকর্মেন্দ্রিয়; বা সপ্ত শীর্ষণ, দুই অধো-প্রাণ ও এক মুখ্য-প্রাণ; অথবা প্রাণ, অপান, চক্ষু, শ্রোত্র ইত্যাদি উত্তরোত্তর বক্ষ্যমান দশসংখ্যক দেবতা) উৎপন্ন হয়েছিলেন বলে শ্রুত হওয়া যায়। যে উপাসক এই দেবগণকে অপরোক্ষভাবে জ্ঞাত, সেই বিদ্বান্ (উপাসক) ইদানীং দেশকালকৃত পরিচ্ছেদরহিত সর্বগত ব্ৰহ্ম সম্পর্কে বলবেন বা উপদেশ করবেন (বদেৎ উপদিশেৎ) ৩॥
হৃৎ-কমলের মধ্যে অবস্থিত ক্রিয়াশক্তিরূপ মুখ্যপ্রাণের বৃত্তিসমূহ হলো–প্রাণ, অপান, চক্ষু, শ্রোত্র, অক্ষিতি (অর্থাৎ অক্ষীয়মাণ জ্ঞানশক্তি), ক্ষিতি (অর্থাৎ ক্ষীয়মাণা বা নিবাসহেতুভূতা ক্রিয়াশক্তি), ব্যান (অর্থাৎ সকল নাড়ীতে অন্নরস প্রেরণকারী), উদান (উরব্যাপার নিষ্পন্নকারী)–এগুলি প্রাণের বৃত্তি। এতদ্ব্যতীত বদনসাধন ইন্দ্রিয় বাক্ ও সর্বেন্দ্রিয়ানুগ্রাহক বা সুখ ইত্যাদি জ্ঞানসাধন অন্তঃকরণ বা মন–এই দশ আকুতি (বা দেবগণ), পুরুষকৃত সঙ্কল্পকে অভিমুখে প্রাপ্ত করায়। (অর্থাৎ পুরুষের অভিমত অর্থ নিষ্পদন করে) ॥ ৪
সৃষ্টিকালে বসন্ত ইত্যাদি ঋতু বা কালবিশেষসমূহ অনুৎপন্ন ছিল। অতএব সেগুলির অধিপতি দেবগণ অর্থাৎ অদিতি-পুত্র ধাতা, সুরগুরু বৃহস্পতি, ইন্দ্র ও অগ্নি, অশ্বিন্দ্বয়–এই ছয় দেবতাও সেই কালে অজাত ছিলেন। তাহলে তারা নিজেদের উৎপত্তির নিমিত্ত কোন বৃদ্ধতম (কারণভূত) জনয়িতার উপাসনা করেছিলেন? (এই প্রশ্নের উত্তর অনন্তর ভাবিনী অর্থাৎ পরবর্তী ঋকে প্রাপ্তব্য) ৷৷ ৫
(পূর্ব ঋকে ব্যাখ্যাত হয়েছে যে,) সৃষ্টিকালে প্রলয়কালীন মহতি অর্ণবের মধ্যে স্রষ্টা পরমেশ্বরের সৃষ্টিব্যাপার পর্যালোচনাত্মক জ্ঞানময় তপস্যা ও সুখদুঃখফলোন্মুখ পরিপক্ক কর্ম বিদ্যমান ছিল। অতএব ঋতুর অধিপতি ধাতা ইত্যাদি দেবগণ সেই সৃষ্টির কারণাত্মক স্বকৃত কর্মের নিকট স্ব-উৎপত্তির নিমিত্ত উপাসনা (বা প্রার্থনা) করেছিলেন। (বক্তব্য এই সে, দেব-মনুষ্য ইত্যাদি-রূপ সকল জগতের মূল কারণ কর্মই)। ৬।
এই পুরোবর্তিনা ভূমির পূর্বভাবিনী অতীতকল্পস্থা যে ভূমি ছিল, যে ভূমি অতীত ও অনাগত সম্পর্কে জ্ঞাত মহর্ষিগণ প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই ভূমি ও তার বস্তুনিচয়কে নামপ্রকারের দ্বারা যিনি সম্যক পরিচিত বা জ্ঞাত, সেই পুরাণবিৎ (অর্থাৎ পুরাতন সম্পর্কে অভিজ্ঞ) বিদ্বান ইদানীন্তন কালেরও সকল ভূমি জানতে পারেন (বা জানতে, সমর্থ)। ৭।
কোন কারণ হতে ইন্দ্র উৎপন্ন হয়েছেন?, কোন্ কোন কারণ হতে সোম, অগ্নি, ত্বষ্টা ও ধাতা উৎপন্ন হয়েছেন? (এই প্রশ্নসমূহের প্রতিবচন পরবর্তী ঋকে দেওয়া হয়েছে) ৮
পূর্ববর্তী কল্পে যেমন রূপে ইন্দ্র ছিলেন, সেই ইন্দ্ৰ হতেই ইদানীন্তন ইন্দ্র জন্মেছেন (অর্থাৎ সেই সমান রূপে জাত হয়েছেন)। এইরকমেই পূর্বকল্পের সোম হতে এই কল্পের সোম, পূর্বকল্পের অগ্নি হতে বর্তমান অগ্নি, পূর্বকল্পের ত্বষ্টা হতে ইদানীন্তন ত্বষ্টা এবং বিগত কল্পের ধাতা হতে অধুনাতন ধূল্পের ধাতা জাত হয়েছেন। (অর্থাৎ পূর্বপূর্ব সৃষ্টি অনুসারে ইদানীন্তনের ইন্দ্র ইত্যাদি। দেবগণ সৃষ্ট হয়েছেন– এটাই বক্তব্য)। ৯।
অগ্নি ইত্যাদি দেবতা হতে পূর্বোক্ত প্রাণাপান রূপ যে দশ-সংখ্যক দেবতা উৎপন্ন হয়েছিলেন, তারা আপন আপন আত্মজদের (অর্থাৎ পুত্রদের) নিকট আপন আপন স্থান প্রদান পূর্বক কোন্ লোকে (বা স্থানে) স্থিত হয়েছিলেন? (যথা লৌকিক জনগণ পুত্ৰ উৎপদিত করে তাদের নিকট আপন স্থান প্রদান করে স্থানান্তরে নিবাসিত হয়–সেইরকম ইন্দ্রিয়গণ ও সেগুলির যথাযথ অধিষ্ঠাতৃবৃন্দ কোথায় আশ্রয়াম্বিত হয়ে গিয়েছিলেন–এটাই প্রশ্নার্থ। এই প্রশ্নের প্রতিবচন পরবর্তী সূক্তের তৃতীয় মন্ত্রে দেওয়া হয়েছে)। ১০
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –যন্মর্জায়াং ইত্যদি সূক্তত্ৰয়ং অর্থসূক্তং। অস্য সূক্তত্রয়স্য ব্রহ্মযজ্ঞ জপে বিনিয়োগঃ।…ইত্যাদি। (১১কা, ৪অ. ৪সূ.)৷৷
টীকা— এইটি এবং এর পরবর্তী দুটি সূক্ত অর্থসূক্ত। এই সূক্ত ত্ৰয় ব্রহ্ময়জ্ঞজপে বিনিয়োগ করা হয়। এই সূক্তগুলিতে যাইকৌশিক শরীরের মধ্যে আত্মারূপে প্রবিষ্ট ব্রহ্ম কর্তৃক শরীরের ও তার সাধনভূত ইন্দ্রিয়সমূহের সৃষ্টি সম্পর্কিত উপদেশাবলী প্রশ্ন ও প্রতিবচনরূপে উঘাটিত হয়েছে।….ইত্যাদি। (১১কা. ৪অ. ৪সূ.)।
.
পঞ্চম সূক্ত : অধ্যাত্মম
[ঋষি : কৌরুপথি। দেবতা : মন্যু অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি]
যদা কেশানস্থি স্নার মাংসং মজ্জানমাভরৎ। শরীরং কৃত্বা পাদৰৎ কং নোকমনু প্রাবিশৎ ॥১॥ কুতঃ কেশা কুতঃ স্নাব কুততা অস্থীন্যাভরৎ। অঙ্গা পর্বাণি মজ্জানং কো মাংসং কুত আভরৎ ॥২॥ সংসিচো নাম তে দেবা যে সম্ভারাসমভর। সর্বং সংসিচ্য মর্তং দেবাঃ পুরুষমাবিশন ॥৩॥ ঊরূ পাদাবষ্ঠীবন্তৌ শিরো হস্তাবখো মুখম্। পৃষ্টীবর্জহ্যে পার্শ্বে কস্তৎ সমদধাদৃষিঃ ॥৪॥ শিরো হস্তাবধো মুখং জিহ্বং গ্রাবাশ্চ কীকসাঃ। ত্বচা প্রাবৃত্য সর্বং তৎ সন্ধা সমধান্মহী ॥৫৷৷ যত্তচ্ছরীরমশয়ৎ সন্ধয়া সংহিতং মহৎ। যেনেদমদ্য বোচতে কো অস্মিন্ বর্ণমাভরৎ ॥৬॥ সর্বে দেবা উপাশিক্ষন্ তদানাদ বধূঃ সতী। ঈশা বশস্য যা জায়া সাস্মিন্ বর্ণমাভরৎ ॥৭॥ যদা ত্বষ্টা ব্যতৃণৎ পিতা ত্বষ্টুর্য উত্তরঃ। গৃহং কৃত্বা মর্তং দেবাঃ পুরুষমাবিশ ॥৮॥ স্বপ্নে বৈ তন্দ্ৰীনিঋতিঃ পাম্মাননা নাম দেবতাঃ।– জরা খালত্যং পালিত্যং শরীরমনু প্রাবিশন ॥৯৷৷ স্তেয়ং দুষ্কৃতং বৃজিনং সত্যং যজ্ঞো যশো বৃহৎ। বলং চ ক্ষমোজশ্চ শরীরমনু প্রাবিশন্ ॥১০৷
বঙ্গানুবাদ –সৃষ্টির সময়ে সেই বিধাতা কেশ, অস্থি, স্নায়ু, মাংস ইত্যাদি শরীরোপাদানভৃত সামগ্রী (অর্থাৎ ধাতু) সঞ্চিত করেছিলেন। তারপর সেগুলির দ্বারা হস্ত, পদ ইত্যাদি অঙ্গ-উপাঙ্গের সাথে শরীর নির্মাণ করেছিলেন। তখন (তদানীং) তিনি কোন্ লোকে প্রবেশ করেছিলেন? (তদেব তিনি আত্মভাবের দ্বারা শরীরে প্রবেশ করেছিলেন–এটাই অর্থ)। ১।
স্রষ্টা ঈশ্বর কোন উপাদান-কারণ হতে কেশ সমূহ সংগৃহীত করেছিলেন? তথা স্নায়ু কোথা হতে প্রকট হয়েছিল? অস্থিসমূহ কোথা হতে আগত হয়েছিল? অঙ্গোপাঙ্গ অর্থাৎ হস্তপদ ইত্যাদি পর্ব সমূহ এবং তৎসম্বন্ধী মজ্জা (অর্থাৎ অস্থির অন্তর্গত রস), মাংস কোথা হতে প্রাপ্ত হয়েছিল? (বস্তুতঃ এ সবই আর কেউ নয়, সেই উপাদানভাবের দ্বারা স্থিত ও বিচিত্রশক্তিযোগে একেরই মধ্যে কর্তৃত্ব ও কর্মত্ব সম্পন্ন ঈশ্বরের দ্বারাই একত্রে সংগৃহীত হয়েছিল। তিনি ব্যতীত আর কে-ই বা সংগ্রহ করবে?) ২
পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়াত্মক অধিষ্ঠাতৃ দেবগণ বা প্রাণাপান ইত্যাদির সঞ্চয়কারীর কথা বলা হয়েছিল, তারা সংসেচনসমর্থ (অর্থাৎ সংচিত বা সন্ধায়ক নামে অভিহিত)। তারা মরণশীল দেহকে রক্তের দ্বারা আদ্রীকৃত পূর্বক তাকে পুরুষাকৃতি সম্পন্ন করে তারই মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। (ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে–যাবৎ শরীরে প্রাণ নিবাস করে, তাবকাল প্রাণাধিষ্ঠিত শরীর সর্বব্যবহারক্ষম হয়ে থাকে। তখন প্রাণদেবগণ পৃথিবী ইত্যাদি পঞ্চভূতমাত্ৰ হতে সমুদ্ভুত প্রা-কথিত ধাতুময় পুরুষ-শরীরে প্রবেশ করে বিদ্যমান থাকে) ॥ ৩॥
জানুর উপরিভাগে বর্তমান উরুদ্বয়, জানুর নিম্নভাগে বর্তমান পাদদ্বয়, ঊরু ও পাদদ্বয়ের মধ্যস্থানবর্তী জানুদ্বয়, শির, বাহুদ্বয়, মুখ বা আস্য, পৃষ্টবংশের উভয় দিকে বর্তমান পঞ্জর, বর্জহ্যে নামক অবয়বদ্বয়, উভয় পার্শ্ব–এই সকল অনুক্রান্ত সকল অঙ্গজাতকে কোন সন্ধানোপায়-জ্ঞানবান (ঋষি) পরস্পর সংশ্লিষ্ট করেছেন? ৪
শির, হস্ত, মুখ, জিহ্বা, গ্রীবা, অস্থিসমূহ ইত্যাদি ও এতদ উপলক্ষিত প্রাক্-উক্ত অস্থি-স্নায়ু ইত্যাদি ও ঊরু-পাদ ইত্যাদি সমগ্র অঙ্গসমূহ চর্মের দ্বারা প্রাবৃত বা আচ্ছন্ন করে মহতী সন্ধানকত্রী দেবতা, পরস্পর সংশ্লিষ্ট করণ পূর্বক আপন আপন ব্যাপারক্ষম করেছেন (অর্থাৎ আপন আপন কর্মে প্রবৃত্ত করেছেন)। ৫৷
উক্তপ্রকার যে শরীরে কৃতাবয়বসন্ধান (অর্থাৎ অবয়বসমূহ, যুক্তকারী) যে সন্ধায়ক নামক দেবতা (সন্ধয়া) শায়িত বা অবস্থিত হয়ে আছেন, সেই শরীর ইদানীং কৃষ্ণ গৌর ইত্যাদি রূপে দীপ্যমান হয়ে আছে। কোন্ দেবতা এই শরীরে বর্ণ সম্পাদন করেছেন? ॥ ৬।
ইন্দ্র ইত্যাদি সকল দেবতা এই শরীরের সমীপে অবস্থানে সমর্থ হতে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। পরমেশ্বরের দ্বারা কৃতোদ্বাহা (বিবাহিতা) ভগবতী আদ্যা পরচিপিনী শক্তি দেবতাগণের কৃত সেই আকাঙ্ক্ষা জ্ঞাত হয়েছিলেন (তৎ দেবৈঃ কৃতং অজানাৎ জ্ঞানবতী)। যিনি এই সর্ব জগতের নিয়ন্ত্রী মায়াশক্তি, সেই পরমেশ্বরী শক্তি, তিনিই এই ষাটুকৌশিক শরীরে গৌর-পীত-নীল ইত্যাদি বর্ণ আরোপ (বা উৎপাদন) করেছেন ৷৷ ৭৷
মনুষ্য-গো-অশ্ব ইত্যাদি প্রাণী সমূহের বিকর্তা ত্বষ্টাদেবের উৎপাদক উৎকৃষ্টতর ত্বষ্টা, যিনি বিচিত্র জগতের নির্মাতা, তিনি যেকালে পুরুষের শরীরে বিবিধ চক্ষু-শ্রোত্র ইত্যাদি ছিদ্রসমূহ সৃষ্টি করেছিলেন, তখন সেই ছিদ্র-সমন্বিত পুরুষ-শরীরকে আবাসস্থান করে ইন্দ্রিয় ইত্যাদি এবং প্রাণাপান ইত্যাদি দেবগণ (দেবাঃ) সেই পুরুষে প্রবিষ্ট হয়েছিল। ৮।
(এই শরীরের উৎপত্তি অভিধায়ে ইন্দ্রিয় সমূহ ও প্রাণাপান ইত্যাদি কর্তৃক তাতে প্রবেশের কথা উক্ত হয়েছে। তারই ফলে সেই শরীর সর্বব্যবহারক্ষম হয়েছিল। এইবার সর্ববিকারের আশ্ৰয়ত্ব উক্ত হচ্ছে)।–স্বপ্ন (নিদ্রা), অলসতা (তন্দ্রী), নির্ঋতি (পাপদেবতা দুর্গতি), পাপমান (ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি পাপসমূহ)–এই সকল দেবতা পুরুষ-শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল। তথা জরা (বয়োহানিকরী চরমাবস্থা), খালভ্য (চিত্তের ও চক্ষু ইত্যাদির স্থলন), পালিত্য (পলিতত্ব অর্থাৎ বার্ধক্কহেতু কেশ ইত্যাদির শুক্লতা)–এই সকলের অভিমানী দেবগণ সেই শরীরে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। ৯।
স্তেয় (তস্করত্ব), দুস্কৃত (সুরাপান ইত্যাদি জনিত পাপ), সত্য (যথার্থকথন), যজ্ঞ (যাগ), বৃহৎ যশ (প্রভূত কীর্তি), বল (প্রসিদ্ধ সামর্থ্য বা শক্তি), ক্ষত্র (ক্ষত্রিয়সম্বন্ধি তেজঃ), ওজঃ (শরীরগত বলহেতু অষ্টম ধাতু–এগুলি পুরুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল। (অর্থাৎ জীব-শরীরে আশ্রিত বা উৎপন্ন হয়েছিল। ১০।
টীকা –এই সূক্তের বিনিয়োগ ইত্যাদি পূর্ব সূক্তের অনুরূপ ৷ (১১কা. ৪অ. ৫সূ.)।
.
ষষ্ঠ সূক্ত : অধ্যাত্মম
[ঋষি : কৌরুপথি। দেবতা : মন্যু, অধ্যাত্ম। ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি]
ভূতিশ্চ বা অভূতিশ্চ রাতেয়োহরাতয়শ্চ যাঃ। ক্ষুধশ্চ সর্বাস্তৃষ্ণাশ্চ শরীরমনু প্রাবিশ ॥১॥ নিন্দাশ্চ বা অনিন্দাশ্চ যচ্চ হন্তেতি নেতি চ। শরীরং শ্রদ্ধা দক্ষিণাশ্রদ্ধা চানু প্রাবিশন ॥ ২॥ বিদ্যাশ্চ বা অবিদ্যাশ্চ যচ্চান্যদুপদেশ্যম্। শরীরং ব্রহ্ম বিশদৃচঃ সামাথো যজুঃ ॥৩॥ আনন্দা মোদাঃ প্রমুদোহভীমোদমুদশ্চ যে। হসো নরিষ্টা নৃত্তানি শরীরমনু প্রাবিশ ॥৪॥, আলাপাশ্চ প্রলাপাশ্চাভীলাপলপশ্চ যে। শরীরং সর্বে প্রাবিশন্নাযুজঃ প্ৰযুজো যুজঃ ॥৫॥ প্রাণাপানৌ চক্ষুঃ শ্রোমক্ষিতিশ্চ ক্ষিতিশ্চ যা। ব্যানোদানৌ বাঙ্নঃ শরীরেণ ত ঈয়ন্তে ॥৬॥ আশিষশ্চ প্রশিষ সংশিষো বিশিষশ্চ যাঃ। চিত্তানি সর্বে সঙ্কল্পাঃ শরীরমনু প্রাবিশন্ ॥৭॥ আস্তেয়ীশ্চ ব্যস্তেয়ীশ্চ ত্বরণাঃ কৃপণাশ্চ যাঃ। গহ্যাঃ শক্ৰা ভুলা অপস্তা বীভৎসাবসাদয়ন ॥৮॥৷ অস্থি কৃত্বা সমিধং তদষ্টাপো অসাদয়ন। রেতঃ কৃত্বাজ্যং দেবাঃ পুরুষমাবিশন্ ॥৯॥ যা আপো যাশ্চ দেবতা যা বিরাড় ব্ৰহ্মণা সহ। শরীরং ব্ৰহ্ম বিশচ্ছরীরেহধি প্রজাপতিঃ ॥১০। সূর্যশ্চক্ষুর্বাতঃ প্রাণং পুরুষস্য বি ভেজিরে। অথাস্যেতরমাত্মানং দেবাঃ প্রাচ্ছন্নগ্নয়ে ॥১১৷৷ তস্মাৎ বৈ বিদ্বান্ পুরুষমিদং ব্রহ্মেতি মন্যতে। সর্বা হ্যস্মিন্ দেবতা গাবোগোষ্ঠ ইবাসতে ॥১২৷৷ প্রথমেন প্রমারেণ ত্রেধা বিম্ব বি গচ্ছতি। অদ একেন গচ্ছত্যদ একেন গচ্ছতীহৈকেন নি ষেবতে ॥১৩৷৷ অন্দু স্টীমাসু বৃদ্ধাঙ্গু শরীরমন্তরা হিত। তস্মিংম্বোহধ্যন্তরা তস্মাচ্ছবোহধচ্যতে ॥১৪৷৷
বঙ্গানুবাদ –ভূতি (সমৃদ্ধি), অভূতি (অসমৃদ্ধি), রাতয় (মিত্ৰতা), অরাতয় (শত্রুতা), ক্ষুধা (বুভুক্ষা বা অন্নাকাঙ্ক্ষা), তৃষ্ণা (পিপাসা)–এই সবই পুরুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল ॥১॥
নিন্দা (কুৎসা), অনিন্দ (অকুৎসা), হন্ত (হর্ষোৎপাদক বস্তু), নেত্যয় (হর্যের নিষেধ), শ্রদ্ধা (অভিলাষবিশেষ), দক্ষিণা (ধনসমৃদ্ধি), অশ্রদ্ধা (শ্রদ্ধার অভাব অর্থাৎ অভিলাষরাহিত্য)–এই সবই পুরুষের শরীরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে। (অর্থাৎ প্রাদুর্ভূত হয়েছে)। ২।
বিদ্যা (শাস্ত্রজনিত জ্ঞানরাশি), অবিদ্যা (বেদবিরুদ্ধ অজ্ঞানরাশি) ও উপদেশ্য (উপদেশের দ্বারা অধিগম্য বিদ্যা) এগুলিও পুরুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করেছে। সেই সঙ্গে ঋক্-সাম-যজুরাত্মক (এবং তার অঙ্গভূত পুরাণ ইত্যাদি সম্পর্কিত) বিদ্যাও পুরুষের শরীরে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে ৷৩৷
আনন্দ, মোদ, প্রমুদ, অভিমোদ, মুদ (৪অ. ৩. ৬ মন্ত্রে ব্যাখ্যাত), হসঃ (হাস্য), নরিষ্ট (মনুষ্যের ইচ্ছাগোচর শব্দস্পর্শ ইত্যাদি বিষয় সমূহ), নৃত্য (ভরতশাস্ত্রোক্ত নর্তন)–এই সবগুলি পুরুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল। ৪
আলাপ (আভাষণ অর্থাৎ সার্থক বচন সমূহ), প্রলাপ (অর্থহীন বচন সমূহ), অভিলাপলপ (সঙ্কল্পের অঙ্গীভূত বাক্যের বা শব্দের উচ্চারণ)–এই সবগুলি পুরুষের শরীরে অনু; প্রবিষ্ট হয়েছিল। আযুজঃ (অর্থাৎ আয়োজন সমুদায়), প্রযুজঃ (অর্থাৎ প্রয়োজন নিচয়) ও যুজঃ (অর্থাৎ যোজন বা সঙ্টন সমুচয়)–এই ক্রিয়া নিবহও শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল ৷৷ ৫
প্রাণ, অপান, চক্ষু, শ্রোত্র, অক্ষিতি, ক্ষিতি, ব্যান, উদান, বাক্য ও মন (পূর্বে ব্যাখ্যাত)–এইগুলিও শরীরে, অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আপন আপন ব্যাপারে (পুরুষকে) প্রবর্তিত করেছিল ৷ ৬ ৷৷
আশিষ (আশাসন অর্থাৎ ইষ্টফলপ্রাপ্তির প্রার্থনা-পূরক বাক্যসমূহ), প্রশিষ (প্রশাসন সমূহ), সংশিষ (সংশাসন সমূহ), বিশিষ (বিবিধ শাসন সমূহ)–চিত্তের এই সকল সঙ্কল্প বা বৃত্তিসমূহ পুরুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল। ৭৷
আসমন্তাৎ স্নান (আয়ে) অর্থাৎ সর্বাঙ্গ নিমজ্জন পূর্বক স্নানের নিমিত্ত আপঃ (অর্থাৎ জল), শরীরে প্রাণাবস্থানের নিমিত্তভূতা জল, শীঘ্র গমনকারিণী জল, কৃপণা অর্থাৎ অল্প জল, গুহ্যাঁ অর্থাৎ গুহায় সৃষ্ট জল, শুক্লবর্ণা বা শুক্রে পরিণতা জল, স্থলা অর্থাৎ ব্যাপনশীলা নদী ইত্যাদি রূপে বর্তমান জল এবং সর্বব্যবহারাস্পদ জল–এই সকল জল জুগুপ্স্যমান (অর্থাৎ অপবাদগ্রস্ত) পুরুষের দেহে স্বকার্যে প্রাপ্ত (অসাদয়ন) হয়েছে ৷ ৮
প্রাণীশরীর-সম্বন্ধি অস্থিজাত সমিধসমূহ শরীরপরিপাকের নিমিত্ত করে সেই ষাটকোশিক শরীরে পূর্বোক্ত অষ্টসংখ্যক জলকে স্থাপন (বা প্রাপ্ত) করেছে। সেই সমিন্ধনের অভিবৃদ্ধির কারণে আজ্যকে রেত বা শুক্ররূপে। পরিকল্পনা করে ইন্দ্রিসমূহ বা তার অধিষ্ঠাতা অগ্নি প্রমুখ দেবগণ সেই শরীরে প্রবেশ করেছে। (এই স্থানে পুরুষশরীরান্তৰ্গত অস্থি সমুদায় শরীরবৃদ্ধির হেতুত্বে সমিধত্বে আরোপিত হয়েছে (সমিত্বেন রূপ্যন্তে); এবং আপন শরীরের বৃদ্ধির হেতুত্বে ও পুত্র ইত্যাদির উৎপত্তির হেতুত্বে রেতঃ বা শুক্র আজ্যত্বে আরোপিত হয়েছে ॥৯॥
পূর্বকথিত (প্রাপ্তদীরিতা) যে জলরাশি, ইন্দ্রিয়াভিমানী যে দেবগণ, তারা এবং বিরাট-নামক যে দেবতা ব্ৰহ্মণা অর্থাৎ ব্রাহ্মণতেজের সাথে বর্তমান, তারা সকলে শরীরে প্রবেশ করেছিলেন। তারপর যিনি জগকারণ পরম ব্রহ্ম, তিনিও অন্তর্যামীরূপে সেই শরীরে প্রবেশ করেছিলেন। সেই শরীরে প্রজাপতি (অর্থাৎ প্রজাগণের পালয়িতা পুত্র ইত্যাদির উৎপাদক জীব) অবস্থান করছেন। (তস্মিন্ শরীরে (অধি) প্রজাপতি প্রজানাং পালয়িতা পুত্ৰাদ্যুৎপাদকো জীববা বর্তন্তে) ১০
চক্ষুরাভিমানী সূর্যদেবতা পুরুষের সম্বন্ধি চক্ষুরিন্দ্রিয়কে আপন ভাগরূপে স্বীকার করেছেন (আত্মীয়ভাগত্বেন স্বীকৃতবা)। প্রাণদেবতা বায়ু ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে স্বীকার করেছেন। এই প্রকারে পুরুষসম্বন্ধিনী ইন্দ্রিয়গুলি সেই সেই অধিদেবতা কর্তৃক তাঁদের নিজ নিজ ভাগরূপে স্বীকৃত হয়েছিল। অনন্তর সকল দেবতা প্রাণেন্দ্রিয়ব্যতিরিক্ত ষাটুকৌশিক স্থূলশরীরকে অগ্নির ভাগ রূপে স্বীকার করেছেন। (মরণের পরে অগ্নি কেবল স্থলশরীরকেই দহন করেন; ইন্দ্রিয় সমূহের অধিষ্ঠাত্ দেবতাগণকে নয়) ॥১১।
এই কারণে বিদ্বান ব্যক্তি এই পুরুষ শরীরে অপরোক্ষ ব্রহ্মের অবস্থিতি জ্ঞাত হন; যেহেতু এই দেহ সকল দেবতার নিবাসস্থান। (তার দৃষ্টান্ত এই যে,) গাভীগণ যেমন স্বকীয় গোষ্ঠে (স্থানে) স্বচ্ছন্দে নিবাস করে। (অর্থাৎ সেই রকমেই সকল দেবতার আশ্রয়ভূত পুরুষশরীরকে ব্রহ্মের আবাসরূপে বিদ্বান ব্যক্তি সাক্ষাৎ করেন)। ১২।
প্রথমোৎপন্ন স্থূলশরীরের অবসান ঘটলে, সেই ত্যক্তদেহ আত্মা তিন রকম গতি প্রাপ্ত হয়ে থাকে বা নিয়মে বদ্ধ হয়। শরীরভোগকালে পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা স্বর্গ নামক স্থান, পাপকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা বিপ্রকৃষ্ট নরক নামক স্থান এবং পুণ্য-পাপাত্মক মিশ্রিত কর্মের দ্বারা এই ভূলোকে নিরন্তর সুখ-দুঃখাত্মক ভোগের ভোগী হয় ॥ ১৩ ৷৷
সমগ্র শুষ্ক জগৎসংসারকে আর্দ্র করণশালী প্রবৃদ্ধি জলরাশির মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধী দেহ স্থিত আছে। সেই ব্রহ্মাণ্ড উপরে ও মধ্যভাগে সর্বাধার ভূতবস্তুরূপ (ভূতত্ত্বাত্মকঃ) পরমেশ্বর বিরাজমান থাকেন। (সমষ্টিশরীর হতে অধিক হওয়ার কারণে সেই (শবঃ) বলাত্মক সূত্ৰাত্মা নামে উক্ত হয়ে থাকে)। ১৪
টীকা –এই সূক্তের বিনিয়োগ ইত্যাদি পূর্ব সূক্তের অনুরূপ। (১১কা. ৪অ. ৬সূ.)।