অথর্ববেদ–সংহিতা — একাদশ কাণ্ড
প্রথম অনুবাক
প্রথম সূক্ত : ব্ৰহ্মৌদনম
[ঋষি : ব্রহ্মা। দেবতা : ব্রহ্মৌদন। ছন্দ : পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী, উষ্ণিক, গায়ত্রী।]
অগ্নে জায়দিতির্নাথিতেয়ং ব্রহ্মৌদনং পচতি পুত্রকামা। সপ্তঋষয়ো ভুতকৃতস্তে ত্বা মন্থন্তু প্ৰজয়া সহেহ ৷৷ ১। কৃণুত ধূমঃ বৃষণঃ সখায়োহদ্রোঘাবিতা বাচমচ্ছ। অয়মগ্নিঃ পৃতনাষা সুবীররা যেন দেবা অসহন্ত দস্যু ॥ ২॥ অগ্নেহজনিষ্ঠা মহতে বীর্যায় ব্রহ্মেদিনায় পক্তবে জাতবেদঃ। সপ্তঋষয়ো ভূতকৃতস্তে হাজীজনন্নস্যৈ রয়িং সর্ববীরং নি যচ্ছ৷৷ ৩৷৷ সমিদ্ধো অগ্নে সমিধা সমিধ্যস্ব বিদ্বান দেবান যজ্ঞিয়া এক বক্ষঃ।. তেভ্যো হবি শ্ৰপয়ং জাবেদ উত্তমং নাকমধি রোহয়েমম্ ৷ ৪৷৷ ত্রেধা ভাগো নিহিত যঃ পুরা বো দেবানাং পিতৃণাং মৰ্তানা। অংশা জানীধ্বং বি ভজামি তা বো যো দেবানাং স ইমাং পারয়াতি ৫অগ্নে সহস্বানভিভূরভীদসি নীচে ন্যুজ দ্বিষতঃ সপত্না। ইয়ং মাত্রা মীয়মানা মিতা চ সজাংস্তে বলিহৃতঃ কৃপোতু। ৬। সাকং সজাতৈঃ পয়সা সহৈধ্যদুজৈনাং মহতে বীর্যায়। ঊর্ধ্বো নাকস্যাধি রোহ বিষ্টপং স্বর্গো লোক ইতি যং বদন্তি ॥৭॥ ইয়ং মহী প্রতি গৃহূতু চর্ম পৃথিবী দেবী সুমনস্যমানা। অথ গচ্ছেম সুকৃতস্য লোক ৷ ৮ ৷৷ এতৌ গ্রাবাণৌ সযুজা যুঙগ্ধি চর্মণি নির্ভিন্ধ্যংশূন যজমানায় সাধু। অবতী নি জহি য ইমাং পৃতন্যব ঊর্ধ্বং প্রজামুদ্ভরন্তদূহ। ৯৷৷ গৃহাণ গ্রাবাণৌ সকৃতৌ বীর হস্ত আ তে দেবা যজ্ঞিয়া যজ্ঞমগুরু। এয়ো বরা যতমাংং বৃণীষে তাস্তে সমৃদ্ধীরিহ রাধয়ামি। ১০।
বঙ্গানুবাদ –এই দেবমাতা অদিতি পুত্র-কামনায় ব্রহ্মোদন নামে আখ্যাত যজ্ঞ (জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মার উদ্দেশে স্বাহাকারে দেয় অন্ন, ব্রাহ্মণগণকে ভোজন করানোর নিমিত্ত যজ্ঞানুষ্ঠান) করতে ইচ্ছুক হয়েছেন। হে অগ্নি! তুমি মন্থনের দ্বারা উৎপন্ন হও। মরীচি প্রমুখ সপ্তর্ষিগণ, যাঁরা ভূতসমূহের উৎপাদন-কর্তা, তারা এই দেব-যজ্ঞে যজমানের পুত্র-পৌত্র ইত্যাদির সাথে মন্থনের দ্বারা তোমাকে প্রকট করুন। ১।
হে সপ্তর্ষিবৃন্দ! তোমরা জগৎ-সংসারের মিত্র-স্বরূপ এবং অভীষ্টবষক। তোমরা। মন্থনের দ্বারা ধূমকে পুষ্ট করো। এই অগ্নি যজমানগণের রক্ষক। এই ঋক্ সমূহ (মন্ত্র সমুদায়)-রূপ স্তুতিবাক্যের দ্বারা অগ্নিকে তুষ্ট করো। এই অগ্নি শত্রু-সেনাকে বশ করে থাকেন; দেবতাগণ নিজেদের ক্ষয়করণশালী অসুররূপী শত্রুগণকে এঁরই দ্বারা বশীভূত (পরাজিত) করেছিলেন। ২।
হে অগ্নি! তুমি উৎপন্ন প্রাণীবর্গের জ্ঞাতা হয়ে বিরাজমান এবং মন্থনের দ্বারা প্রকট হয়ে থাকো। তুমি দাহ-পাকে (ব্রাহ্মণগণের নিমিত্ত অন্ন পাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মোদনে) সমর্থ। আমাকে অত্যন্ত বীর্য প্রদানের নিমিত্ত মন্ত্রশক্তির দ্বারা প্রদীপ্ত হয়ে থাকো। সপ্তর্ষিগণ তোমাকে ব্রহ্মোদনের নিমিত্ত প্রকট করেছেন। এই নিমিত্ত এই পত্নীকে (যজমান-পত্নীকে) ধন পুত্র-পৌত্র ইত্যাদি সমন্বিত ধন প্রদান করো। ৩
হে অগ্নি! তুমি মন্ত্রের দ্বারা অধীয়মান এই সমিধের মাধ্যমে প্রজ্বলিত হয়ে দেবতাগণের নিমিত্ত হবিঃ পাক করো এবং এই যজমানের দেহাবসানের পর এঁকে উৎকৃষ্ট স্বর্গলোকে স্থিত করো। ৪।
হে দেবতাগণ! অগ্নি প্রমুখ দেবগণ; পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ তথা ব্রাহ্মণ ইত্যাদির যে ভাগ, সেই তিন ভাগ আমি বন্টন (বা বিভাগ) করে রেখেছি; তার মধ্যে হতে তোমরা আপন অংশকে জ্ঞাত হও। এর মধ্যে দেব-ভাগ অগ্নিতে হবিঃ স্বরূপে হুয়মান হয়ে যজমানের এই পত্নীকে অভীষ্ট ফল দানশালী হয়ে থাকে। (সায়ণাচার্যের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে–দেবগণের ভাগের দ্বারা নির্বাপ অর্থাৎ দান ইত্যাদি কর্তব্য, পিতৃবর্গের ভাগের দ্বারা বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ অর্থাৎ আভ্যুদায়িক বা সমৃদ্ধি-সাধক শ্রাদ্ধ এবং মনুষ্যগণের ভাগের দ্বারা ব্রাহ্মণভোজন অর্থাৎ ব্রহ্মোদন যজ্ঞ কর্তব্য)। ৫।
হে অগ্নি! তুমি শত্রুগণকে বশ করণশালী বলের সাথে যুক্ত; তুমি আমাদের শত্রুবর্গকে নিম্নে পাতিত করো। হে যজমান! এই গৃহের উপনয়ন দ্রব্য ইত্যাদি (বলিঃ) তোমার সমানজন্ম পুরুষদের (সজাতগণকে) উপহার দেবার নিমিত্ত আমার সাথে মিলিত করো ৷ ৬ ৷
হে যজমান! তুমি সমৃদ্ধি লাভ করে। এর অধিক (আরও) পরাক্রমের নিমিত্ত এই পত্নীকে উন্নত করো এবং দেহাবসানের পরে সেই ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করো, যাকে অভিজ্ঞ জনেরা সুকৃতফলভোগের উপযুক্ত দুঃখস্পর্শরহিত স্বর্গলোক নামে অভিহিত করে থাকেন। ৭৷
সম্মুখস্থ এই যজ্ঞভূমি আস্তীর্ণ চর্ম (অজিন) স্বীকার করুন। এই পৃথিবী দেবী (অজিনের দ্বারা আস্তীর্ণ হওয়ার পর) আমাদের উপর কৃপাশালিনী হোন। তার কৃপাকে প্রণাম পূর্বক আমরা যজ্ঞ ইত্যাদি হতে উৎপন্ন পুণ্যফলের কারণরূপ লোক (স্বর্গ) প্রাপ্ত হবো॥ ৮৷
হে ঋত্বিক! তোমরা এই পুরোবর্তী পাষাণবৎ দৃঢ়তর উলুখল ও মুসলকে এই আস্তীর্ণ অজিনে স্থাপিত করো এবং যজমানের নিমিত্ত ধান্যসমূহকে সোমলতাখণ্ডবৎ শোভন করো। হে পত্নী! অবহনন করে (অবহ্বতী) আমাদের প্রজারূপ তোমার পুত্রগণকে বিনাশ করণের উদ্দেশে যে পৃতনা (শত্রুসেনা) আগমন করছে, তাদের স্তম্ভিত (বা নিবৃত্ত) করো এবং হবনের পরে মুসলকে। উথিত করে আমাদের সন্তানগণকে শ্রেষ্ঠ পদ প্রদান করো ॥৯॥
হে বীর্যবান্ অধ্বর্য! তুমি উত্তম কর্মশালী হস্তে উদূখল-মুসলকে গ্রহণ করো। দেবতাগণ তোমাদের যজ্ঞে আগত হয়েছেন। হে যজমান! তুমি যে তিনটি বর (অভীষ্ট) যাচনা করতে চাইছো, সেই কর্মসমৃদ্ধি, ফল-সমৃদ্ধি এবং পরলোকের সমৃদ্ধি, আমি এই যজ্ঞের দ্বারা সেই তিনটিকেই সিদ্ধ করছি। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –একাদশকাণ্ডে পঞ্চানুবাকঃ। প্রথমেনুবাকে সপ্ত সূক্তানি। তত্র অগ্নে জায়স্ব ইত্যাদি সূক্তচতুষ্টয়ঃ অর্থসূক্ত। তেন ব্রহ্মৌদনসবে নিরুপ্তহবিরভিমৰ্শনসম্পাত দাতৃবাচনদানানি কুর্যাৎ.(কৌ, ৮/১, ৮/২)। (১১কা, ১অ. ১সূ.)।
টীকা— পাঁচটি অনুবাক সমম্বিত এই কাণ্ডের প্রথম অনুবাকের সাতটি সূক্তের মধ্যে উপযুক্ত সূক্তটি সহ প্রথম চারিটির দ্বারা ব্রহ্মৌদন-যজ্ঞে বিনিয়োগ হয়। এই যজ্ঞে এই সূক্তগুলির দ্বারা নিরুপ্ত হবিঃ অথর্ববেদ-সংহিতা অভিমৰ্শন পূর্বক দান ইত্যাদি করণীয়। বলা বাহুল্য, আরও কয়েকটি কর্মে এর বিনিয়োগ উপরে উল্লেখিত সূত্রানুসারে করণীয়৷ (১১কা. ১অ. ১সূ)।
.
দ্বিতীয় সূক্ত : ব্রহ্মৌদনম
[ঋষি : ব্রহ্মা। দেবতা : ব্রহ্মৌদন। ছন্দ : পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী, উষ্ণিক, গায়ত্রী।]
ইয়ং তে ধীতিরিদমু তে জনিং গৃহ্নাতু স্বামদিতিঃ শূরপুত্রা। পরা পুনীহি য ইমাং পৃতন্যবোহস্যৈ রয়িং সর্ববীরং নি যচ্ছ। ১৷৷ উপশ্বসে বয়ে সীতা যুয়ং বি বিচ্যধ্বং যজ্ঞিয়াসস্তুষঃ শিয়া সমানানতি সর্বাৎস্যামাধস্পদং দ্বিষম্পাদয়ামি। ২পরেহি নারি পুনরেহি ক্ষিপ্রমপাং ত্বা গোষ্ঠোহধ্যরুক্ষ ভরায়। তাসাং গৃহীতাদ যতমা যজ্ঞিয়া অসন বিভাজ্য ধীরীতরা জহীতাৎ৷ ৩৷৷ এমা অগুর্যোষিতঃ শুম্ভমানা উত্তিষ্ঠ নারি তবসং রভম্ব। সুপত্নী পত্যা প্রজয়া প্রজাবত্যা ব্যাগ যজ্ঞঃ প্রতি কুম্ভং গৃভায় ৷৷ ৪। ঊর্জো ভাগো নিহিতো যঃ পুরা ব ঋষিপ্রশিষ্টাপ আ ভরৈতাঃ। অয়ং যজ্ঞো গাতুবিন্নাথৰিৎ প্রজাবিদুগ্রঃ পশুবিদ ধীরবিদ বো অস্ত ৷৷ ৫৷৷ অগ্নে চরুজ্ঞিয়স্খধ্যরুক্ষণ্ডুচিস্তপিস্তপসা তপৈন। আর্ষেয়া দৈবা অভিংগত্য ভাগমিমং তপিষ্ঠা ঋতুভিস্তপন্তু ৷৬৷৷ শুদ্ধাঃ পূতা যযাতিা যজ্ঞিয়া ইমা আপশ্চরুমব সৰ্পন্তু শুভ্রাঃ। অদুঃ প্রজাং বহুলা পশূ নঃ পক্তৌদনসা সুকৃতামেতু লোকম্ ॥ ৭ব্ৰহ্মণা শুদ্ধা উত তা ঘৃতেন সোমস্যাংশবস্তণ্ডুলা যজ্ঞিয়া ইমে। অপঃ প্ৰ বিশত প্রতি গৃহ্নাতু বশ্চরুরিমং পা সুকৃতামেব লোক৷ ৮৷৷ উরুঃ প্রথস্ব মহতা মহিমা সহস্রপৃষ্ঠঃ সুকৃতস্য লোকে। পিতামহাঃ পিতরঃ প্রজোপজাহং পক্তা পঞ্চদশস্তে অস্মি ॥ ৯৷৷ সহস্রপৃষ্ঠঃ শতধাররা অক্ষিতো ব্রহ্মেদিনো দেবযানঃ স্বর্গঃ। অমূংস্ত আ দধামি প্রজয়া রেষয়ৈনান্ বলিহারায় মৃড়তান্মহ্যমেব। ১০।
বঙ্গানুবাদ –হে শূর্প (কুলা)! চাউল হতে তুষকে পৃথক করাই তোমার কর্ম। তোমাকে মিত্র, বরুণ, ধাতা ইত্যাদি দেবগণের মাতা অদিতি ঝাড়াই-বাছাই করণের নিমিত্ত হস্তে গ্রহণ করুন। এই পত্নীকে হত্যার নিমিত্ত যে শত্রু সৈন্য-সংগ্রহ করতে ইচ্ছা করে, তাদের নিপাতিত করণের নিমিত্ত ব্রীহিরূপ ধন হতে অমঙ্গলরূপ ভূসিগুলি পৃথক করে দাও এবং এই পত্নীকে পুত্র-পৌত্র ইত্যাদি যুক্ত ধন দান করো। ১।
হে চাউল! তোমাদের সত্য ফলরূপ কর্মের নিমিত্ত প্রভূত করছি। তোমরা শূপে অবস্থান পূর্বক তুষসমূহ হতে পৃথক হয়ে যাও। তোমাদের প্রাপ্ত হয়ে শ্রীর (সম্পদের) দ্বারা এ : আমরাও সমানজন্মা পুরুষবর্গকে অতিক্রম করে যাবো এবং শত্রুগণকে পদদলিত করবো। ২।
হে নারী! তুমি জলাশয় হতে জল সংগ্রহ করে শীঘ্র প্রত্যাবর্তন করো। জলকুম্ভ পূর্ণ করে শিরে বহন পূর্বক সেই সময়ের মধ্যে গোষ্ঠে আগমন করো, যে সময়ে গাভীগণ জল পান করে থাকে। এর মধ্যে যা যজ্ঞের যোগ্য জল তা ঘট ইত্যাদি পাত্রে গ্রহণ করো, অযজ্ঞীয় জল, ধীমতী তুমি, বিবেচনা পূর্বক পরিত্যাগ করো ৷ ৩৷৷
শোভন অলঙ্কার সংযুক্তা রমণীগণ জল বহন করে উপস্থিত হয়েছে, হে পত্নী! তুমি আসন হতে উত্থিত হয়ে সেই জল গ্রহণ করো। তুমি সুন্দর পতিশালিনী এবং শোভন পুত্রযুক্ত সৌভাগ্যবতী, তুমি জলের কলশ গ্রহণ করো। এইরূপে এই যজ্ঞ তোমাকে উদকরূপের দ্বারা প্রাপ্ত হোক। ৪
হে জলরাশি! পূর্বকালে ব্রহ্মা যে সারভূত ভাগকে তোমাদের নিমিত্ত পরিকল্পিত করেছিলেন, তা-ই এইস্থানে আনীত হবে। হে ভার্যা! তুমি এই সারভূত জলকে অজিনের উপর স্থাপিত করো। ঋষিদের দ্বারা অনুষ্ঠীয়মান এই ব্রহ্মোদন নামক যজ্ঞ স্বর্গপথ প্রদর্শন করিয়ে থাকে, বল দান করে থাকে এবং পুত্র-পৌত্র গো-ইত্যাদি পশুসমূহকে প্রদানশালিনী হয়ে থাকে। হে যজমানের পত্নী ইত্যাদি! এই যজ্ঞ তোমাদের ঐসব ফলসমূহ প্রদানশালিনী হোক॥৫॥
হে অগ্নি! হবি প্রস্তুতের নিমিত্ত তোমার উপর চরুস্থালী স্থাপিত হোক এবং তুমি আপন শুদ্ধ ও সন্তাপক তেজের দ্বারা একে তপ্ত করো। গোত্রপ্রবর্তক ঋষিগণের জ্ঞাতা আর্ষেয় ব্রাহ্মণগণ তথা ইন্দ্র ইত্যাদির সাথে সম্বন্ধিত দেবতাগণ আপন-আপন ভাগ প্রাপ্ত হয়ে একে (এই হবিঃ বা চরুকে) বসন্ত ইত্যাদি কালবিশেষে তপ্ত করুন ৷ ৬ ৷
এই যজ্ঞের যোগ্য নির্মল জলরাশি চরুস্থালীতে প্রবিষ্ট হোক। এই জলরাশি আমাদের পুত্র ইত্যাদি এবং পশুসমূহ প্রদান করুক। ব্রহ্মোদন পাককারী যজমান পুন্যবানগণের সুখের স্থান স্বর্গলোককে প্রাপ্ত হোন ॥ ৭
মন্ত্রের দ্বারা শুদ্ধ এবং ঘৃতের দ্বারা পাককৃত দোষ রহিত হওনশালী এই চাউলগুলি সোমের অংশরূপ। হে চাউল সমুদায়! তোমরা যজ্ঞের যোগ্য, অতএব চরুস্থালীর মধ্যে রক্ষিত জলরাশির মধ্যে প্রবিষ্ট হও; এই ব্রহ্মোদন পাককারী যজমান পুণ্যলোক প্রাপ্ত হোন। ৮
হে ওদন (অন্ন)! তোমরা সহস্র অবয়বশালী হয়ে আছে। তোমাদের দ্বারা আমাদের পিতৃ-পিতামহ ইত্যাদি ঊর্ধ্বতন সপ্ত পুরুষ এবং পুত্র-পৌত্র ও তাদেরও সন্তান ইত্যাদি অধস্তন সপ্ত পুরুষ (ভাবী বংশধরগণ) তোমার দ্বারাই তৃপ্তি লাভ করুক, আর এর অতিরিক্ত আমিও, এই ব্রহ্মোদনের পাককারী যজমানও তোমার দ্বারা তৃপ্ত হয়ে পঞ্চদশ সংখ্যক পুরুষের পূরক হবো (অর্থাৎ ঊধ্বর্তন সাতপুরুষ ও অধস্তন সাতপুরুষের মধ্যবর্তী আমাকে নিয়ে আমার পঞ্চদশ পুরুষ তৃপ্ত হোক)। ৯।
হে যজমান! তোমার দ্বারা অনুষ্ঠীয়মান এই ব্রহ্মোদন নামক যজ্ঞ সহস্র শরীর এবং শতসংখ্যক ধারাযুক্ত। এ কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হবার নয়। এই ব্রহ্মোদন কর্মশালী যজমান ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতাগণকে প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। হে যজ্ঞ! আমি এই সজাতিগণকে তোমার সকাশে উপস্থিত করছি, তুমি তোমার উপায়নদ্রব্য হরণের কারণে তাদের পুত্র-ভৃত্য ইত্যাদির সাথে উপক্ষীণ করে দাও। তুমি আমাকে সর্বোৎকৃষ্টভাবে সুখী করো। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –ইয়ং তে ধীতিঃ ইতি সূক্তস্য ব্রহ্মৌদনসবে পূর্বসূক্তেন সহ উক্তো বিনিয়োগ। তত্র ইয়ং তে ধীতিঃ ইতি প্রথমায়া ঋচঃ পূর্বার্ধর্চেন পরাপবনার্থং শূর্পং গৃহ্বীয়াৎ…সূত্রিতং হি।..(কৌ, ৮/২, ৮/৯ ইত্যাদি৷৷ (১১কা, ১অ. ২সূ.)।
টীকা –উপযুক্ত সূক্তটি পূর্ব সূক্তের সাথে ব্রহ্মৌদন-সবে বিনিযুক্ত হয়ে থাকে। ব্রাহ্মণগণের ভোজনের নিমিত্ত কুলায় চাউল ঝাড়া, জল আনয়ন জলকুম্ভদাত্রী যজমান-পত্নীকে আহ্বান, দাতৃবাচন, চরুপাক ইত্যাদি যথাযথ সূত্রানুসারে করণীয় ॥(১১কা, ১অ. ২সূ.)।
.
তৃতীয় সূক্ত : ব্রহ্মৌদনম
[ঋষি : ব্রহ্মা। দেবতা : ব্রহ্মৌদন। ছন্দ : পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী, উষ্ণিক, গায়ত্রী।]
উদেহি বেদিং প্রজয়া বর্ধয়ৈনাং নুদস্ব রক্ষঃ প্রতরং ধেহ্যেনাম। শ্রিয়া সমানানতি সর্বাৎস্যামাধম্পদং দ্বিষম্পাদয়ামি। ১৷৷ অভ্যাবর্ত পশুভিঃ সহৈনাং প্রত্যঙেনাং দেবতাভিঃ সহৈধি। মা ত্বা প্রাপচ্ছপথো মাভিচারঃ স্বে ক্ষেত্রে অনমীবা বি রাজ। ২৷৷ ঋতেন তষ্টা মনসা হিতৈষা ব্ৰহ্মেদিনস্য বিহিতা বেদিরগ্রে। অংসদ্ৰীং শুদ্ধামুপ ধেহি নারি তত্রৌদনং-সাদয় দৈবানা৷ ৩৷৷ অদিতেহস্তাং সুচমেতাং দ্বিতীয়াং সপ্তঋষয়য়া ভূতকৃতো যামকৃষ। সা গাত্রাণি বিদুষ্যোদনস্য দর্বিবেদ্যামধ্যেনং চিনোতু। ৪। শৃতং ত্বা হব্যমুপ সীদন্তু দৈবা নিঃসৃপ্যাগ্নেঃ পুনরেনাম প্র সীদ। সোমেন পূত জঠরে সীদ ব্ৰহ্মণামাৰ্ষেয়াস্তে মা রিষ প্রশিতারঃ ॥ ৫॥ সোম রাজসংজ্ঞানমা বপৈভ্যঃ সুব্রাহ্মণা যতমে তোপসীদান। ঋষীর্ষেয়াংস্তপসোহধি জাতা ব্রহ্মৌদনে সুহবা জোহবীমি। ৬। শুদ্ধাঃ পূতা যোষিততা যজ্ঞিয়া ইমা ব্ৰহ্মণাং হস্তেষু প্রপৃথক সাদয়ামি। যকাম ইদমভিষিঞ্চামি বোহমিন্দ্রো মরুত্বাৎস দদাদিদং মে ৷৷ ৭৷ ইদং মে জ্যোতিরমৃতং হিরণ্যং পং ক্ষেত্ৰাৎ কামদুঘা ম এষা। ইদং ধনং নি দধে ব্রাহ্মণেষু কৃথে পন্থাং পিতৃ ষঃ স্বর্গঃ ॥ ৮ ৷৷ অগ্নৌ তুষানা বপ জাবেদসি পরঃ ককা অপ মৃড়টি দূর। এতং শুশ্রুম গৃহরাজস্য ভাগমথে বিদ্ম নিঝতের্ভাগধেয়ম ॥৯॥ শ্রাম্যতাঃ পচতে বিদ্ধি সুন্বতঃ পন্থাং স্বর্গমধি রেহেয়ৈন। যেন লোহাৎ পরমাপদ্য যদ বয় উত্তমং নাকং পরমং ব্যোম। ১০
বঙ্গানুবাদ –হে পকৌদন (পাকনিষ্পন্ন অন্ন)! তুমি বেদীতে হবিঃ রূপে স্থিত হওয়ার নিমিত্ত আগত হও এবং এই যজমান-পত্নীকে সন্তান ইত্যাদির দ্বারা সমৃদ্ধ করো। যজ্ঞ-হিংসকরাক্ষসকে এই স্থান হতে অপসারিত করে দাও এবং এই পত্নীকে প্রকৃষ্টতরভাবে পোষণ করো। আমরা সজাত পুরুষগণ অপেক্ষা অধিক শ্ৰী (অর্থাৎ ঐশ্বর্য) সম্পন্ন হয়ে তাদের অতিক্রম করেছি এবং আমি আমাদের শত্রুগণকে পদদলিত করছি। ১। হে ব্রহ্মৌদন! তুমি যজমান ইত্যাদির সমান পশুবান্ হয়ে পূজ্য দেবতাগণের সাথে আগমন করো। হে যজমান দম্পতি! তোমরা যেন অপরের আক্রোশ প্রাপ্ত না হও। অন্যের দ্বারা কৃত (বা প্রেরিত) অভিচার কর্ম (মারণ-ক্রিয়া) তোমাদের নিকট না আগমন করতে পারে। তোমরা রোগ রহিত হয়ে ঐশ্বর্য ভোগ করতে থাকো। ২।
ব্রহ্মা এই বেদীকে রচনা করেছেন, হিরণ্যগর্ভ এটিকে স্থাপনা করেছেন। ঋষিগণ ব্রহ্মৌদনের নিমিত্ত এই বেদীর কল্পনা করেছিলেন। হে পত্নী! তুমি দেবতা, পিতৃগণ ও মনুষ্যবর্গের আশ্রয়স্বরূপ এই বেদীর সমীপে গমন করো এবং তার উপর দেবগণের অন্ন স্থাপন করো। ৩৷৷
দেবমাতা অদিতির দ্বিতীয় হস্তস্বরূপ, হোমসাধনভূত যে সুককে (যজ্ঞীয় পাত্রকে) প্রাণীগণের স্রষ্টা সপ্তর্ষিগণ নির্মিত করেছেন, সেই দৰ্বী (যজ্ঞীয় সুক বা হাতা) অন্নের পক দেহকে জ্ঞাত হয়ে (অর্থাৎ অন্ন ঠিকমতো পাক হয়েছে কিনা তা জ্ঞাত হয়ে) বেদীর উপর ব্রহ্মেদিনকে স্থাপন করুক। ৪
হে পক্ক ওদন! তুমি হবনযোগ্য হওয়ায় তোমার সমীপে যজ্ঞাহঁ দেবতাগণ আগত হবেন। তুমি অগ্নি হতে বহির্গত (বা উখিত) হয়ে তাদের প্রাপ্ত হও। দুগ্ধ, দধি ইতাদি অমৃতস্বরূপ পদার্থ ও সোমরসের দ্বারা শুদ্ধিকৃত হয়ে তুমি ব্রাহ্মণবর্গের উদরে গমন করো। এঁরা আপন-আপন গোত্ৰ-প্রবরের জ্ঞাতা। তুমি এঁদের হিংসা করো না। ৫।
হে ব্রহ্মেদিন! তুমি রাজা সোমের সাথে সম্বন্ধিত। এই ব্রাহ্মণবর্গকে মোহে পাতিত করো না। যাঁরা তোমার সমীপে স্থিত, সেই ব্রাহ্মণগণকে সম্যক জ্ঞান প্রদান করো। তপস্যা হতে উৎপন্ন (ভৃগু, অঙ্গিরা ইত্যাদি বংশীয়) এই যে ঋষিগণ তোমায় গ্রহণ করেছেন, তাঁদের এবং শোভন আহ্বানা ঋষি-পত্নীগণকে বা মহিলা ঋষিগণকে (ঋষী) ব্রহ্মোদনের নিমিত্ত প্রাপ্ত করছি (বা পুনঃ পুনঃ আহ্বান করছি)। ৬।
আমি যজ্ঞের উপযুক্ত, নির্মল, পবিত্র করণশালিনী, পাপরহিত জলসমূহকে ব্রাহ্মণগণের হস্তে প্রক্ষালনের নিমিত্ত প্রদান করছি (ঢেলে দিচ্ছি)। হে জলরাশি! আমি অভীষ্টের নিমিত্ত তোমাকে অভিসিঞ্চিত করছি, আমার সেই অভীষ্টকে মরুৎ-বর্গের মাধ্যমে ইন্দ্র পূর্ণ করুন।৭৷৷
এই নিধীয়মান (নিধিস্বরূপ) হিরণ্য (হিরণ্যসদৃশ ওদন) অবিনশ্বর, আমার জ্যোতি বা প্রকাশক (অর্থাৎ আমার স্বর্গ-মার্গের প্রকাশক। এই শুদ্ধ ওদন ধান যব ইত্যাদিযুক্ত ক্ষেত্র হতে প্রাপ্ত কামধেনু সদৃশ। আমি এই ওদনরূপ ধনকে দক্ষিণা-রূপে ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করতে রত হয়েছি; এই ধন স্বর্গে কোটি-গুণ হয়ে যাক। তথা পিতৃগণের যে অভিষ্মিত স্বর্গ, এর দ্বারা সেই পুণ্যলোকের মার্গ প্রশস্ত (বা প্রস্তুত) করছি। ৮।
হে ঋত্বিবৃন্দ! ব্রহ্মোদনের চাউলগুলি হতে পৃথক করে তুষগুলিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করো এবং ফলীকরণগুলিকে (ককগুলিকে) পাদের দ্বারা অপমার্জন করো। এই ফলীকরণগুলি গৃহাধিপতি বাস্তুনাথের (বা বাস্তুনাগের) ভাগরূপে নির্ধারিত–এই কথা অভিজ্ঞজনের নিকট হতে শ্রুত হওয়া যায়। তথা এটি নির্ঋতির (অর্থাৎ পাপদেবতার) হবির্ভাগ বলেও আমরা জ্ঞাত আছি.৷ ৯।
হে ব্রহ্মেদিন! তুমি তপঃকরণশীল, ব্রাহ্মণগণের নিমিত্ত অন্নপাকের শ্রমের পর সর্ব যজ্ঞরূপ সোমাভিষবশালী, যজমানগণকে জ্ঞাত হয়ে তাদের স্বর্গমার্গে (স্বর্গ প্রাপ্তির পথে) আরোহণ করাও। পরে এঁরা যেন এই উৎকৃষ্ট শ্যেনপক্ষীর ন্যায় দ্রুতগতি সম্পন্ন হয়ে স্বর্গ-নামক পরমব্যোমে উপনীত হতে পারেন, এমনই করো। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ— উদেহি বেদিং ইতি সূক্তস্য ব্রহ্মৌদনসবে অগ্নে জায়স্ব (১১/১) ইত্যনেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ ….ইত্যাদি। সূত্র-কৌ, ৮/২, ৮/৩, ৮/৪, ৮/৯ ইত্যাদি৷ (১১কা, ১অ. ৩সূ.)।
টীকা— এই সূক্তটিও পূর্ববৎ প্রথম সূক্তের সাথে ব্রহ্মৌদনসবে বিনিযুক্ত হয়ে থাকে। এই সূক্তের বিভিন্ন মন্ত্রের দ্বারা সূত্রানুসারে চরু-উদ্বাসন, চরুস্থালী প্রদক্ষিণ, চারিজন আর্ষেয় (ঋষিপ্রযুক্ত) ঋত্বিকে আসনে উপবেশনের জন্য আহ্বান, হস্ত প্রক্ষালনের নিমিত্ত উদ প্রদান, দাতৃবাচন ইত্যাদি কর্ম সাধনীয়। (১১কা, ১অ, ৩সূ.)।
.
চতুর্থ সূক্ত : ব্রহ্মৌদনম
[ঋষি : ব্রহ্মা। দেবতা : ব্রহ্মৌদন। ছন্দ : পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী, উষ্ণিক, গায়ত্রী।]
বজ্বেরধ্বর্ষা মুখমেত বি মৃঢ্যাজায় লোকং কৃণুহি বিদ্বান্। ঘৃতেন গাত্রানু সর্বা বি মৃড়টি কৃথে পন্থাং পিতৃযু যঃ স্বর্গঃ ॥ ১ বভ্রে রক্ষঃ সমদমা বপৈভ্যোংব্রাহ্মণা যতমে হোপসীদান। পুরীষিণঃ প্রথমানাঃ পুরস্তাদায়োস্তে মা রিষন প্রাশিতরঃ ॥ ২ : আর্ষেয়েষু নি দধ ওদন ত্বা নানার্ষেয়াণামপ্যস্ত্যত্র। অগ্নির্মে গোপ্তা মরুতশ্চ সর্বে বিশ্বে দেবা অভি রক্ষন্তু পক্কম৷ ৩৷ যজ্ঞং দুহানং সদমিৎ প্রপীনং পুমাংসং ধেনুং সদনং রয়ীণা। প্রজামৃতত্বমুত দীর্ঘমায়ু রায়শ্চ পোষৈরূপ জ্বা সদেম। ৪। বৃষভোহসি স্বর্গ ঋষীর্ষেয়ান গচ্ছ। সুকৃতাং লোকে সীদ তত্র নৌ সংস্কৃতম্ ॥ ৫৷৷ সমাচিনুম্বানুসম্প্রয়াহ্যগ্নে পথঃ কল্পয় দেবযানা। এতৈঃ সুকৃতৈরনু গচ্ছেম যজ্ঞং নাকে তিন্তমধি সপ্তরশ্মেী। ৬। যেন দেবা জ্যোতিষা দ্যামুদায় ব্রহ্মৌদনং পা সুকৃতস্য লোক। তেন গেষ্ম সুকৃতস্য লোকং স্বরারোহন্তো অভি নাকমুত্তমম্। ৭৷৷
বঙ্গানুবাদ –হে অধ্বর্যু! এই ব্রভ্র অর্থাৎ ভরণশীল ওদনের মুখ অর্থাৎ উপরিভাগকে বিশেষ ভাবে শুদ্ধ করো, পুনরায় ওদনের মধ্যভাগে আজ্য ধারণের নিমিত্ত গর্তরূপ স্থান প্রস্তুত করো, তথা সকল স্থালীগত ওদনের অবয়বকে ঘৃত-সিঞ্চিত করো। যে মার্গ আমাদের পূর্বপুরুষগণের অভিলষিত স্বর্গলোকের প্রতি ঋজুভাবে চলে গিয়েছে, এই ওদনের দ্বারা আমরা সেই পথকে প্রস্তুত করছি৷৷ ১।
হে বর্ভে (ভরণশীল ব্রহ্মৌদন)! ব্রাহ্মণব্যতিরিক্ত ক্ষত্রিয় ইত্যাদি যারা প্রাশন হেতু তোমার সমীপবর্তী হয়েছে, তাদের রাক্ষসগণের সাথে যুদ্ধ-কলহে প্রবৃত্ত করো, তারা রাক্ষসকৃত পীড়া প্রাপ্ত হোক। এবং যে গোত্র-প্রবর ইত্যাদি জ্ঞাতা ঋষিগণ উপবিষ্ট আছেন, তাঁরা পুত্র-পৌত্র ও পশু ইত্যাদির দ্বারা সমৃদ্ধ হোন। সেই প্রাশন করণশালী ব্রাহ্মণগণ, হে ওদন! যেন বিনাশ প্রাপ্ত হন। ২৷৷
হে ওদন! আমি তোমাকে আষেয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে স্থিত করছি। এই ব্রহ্মেদনে অনার্যের (অর্থাৎ ঋষিগোত্রপবর সম্পর্কে অনভিজ্ঞ) পুরুষগণের সম্ভাবনা (বা স্থান) নেই। অগ্নি, মরুৎ-বর্গ, বরুণ ইত্যাদি সকল দেবতা এই পাকের দ্বারা সংস্কৃত ব্রহ্মেদিনকে রক্ষা করণশীল হোন ॥ ৩॥
এই ব্রহ্মেদিন যজ্ঞসমূহের উৎপাদন করণশালী, প্রবৃদ্ধাত্মক, ধনের আধার এবং পুংরূপা (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ) ধেনু। হে ব্রহ্মেদিন! আমরা তোমার দ্বারা পুত্র-পৌত্র ইত্যাদি ধন-পুষ্টি এবং দীর্ঘ আয়ু (অমরণধর্মতা) প্রাপ্ত হবো। ৪
হে ব্রহ্মৌদন! তুমি বৃষভ (অর্থাৎ কাম-বৰ্ষক); তুমি স্বর্গ-প্রাপ্ত চ করিয়ে থাকো; অতএব আর্ষেয় ব্রাহ্মণগণকে আমার দ্বারা প্রাপ্ত হও এবং পুনরায় পুণ্যাত্মবর্গের স্বর্গে গমন করো। সেখানে আমাদের ও তোমার (ভোক্তৃভোক্তব্যাত্মক) সংস্কার হোক। ৫
হে ওদন! তুমি সমাচয়ন (অর্থাৎ সকলের অঙ্গে সমূহীভবন) করে গন্তব্যকে প্রাপ্ত হও। হে অগ্নি! এই ওদনের গমনের নিমিত্ত দেব-মার্গের (দেবতাগণের গমনের নিমিত্ত দেবযান পথের) রচনা করো এবং আমরাও সেই পথে সপ্তরশ্মিসমন্বিত আদিত্যমণ্ডলের উপরে স্থিত যজ্ঞের অনুগামী হবো। ৬।
ব্রহ্মেদিন যজ্ঞের দ্বারাই ইন্দ্র প্রমুখ দেবতাগণ দেবযান মার্গ অবলম্বন করে সুকৃত ফলস্বরূপ স্বর্গলোকে গমন করেছিলেন। এই হেতু দেবযান মার্গ নামে অভিহিত সেই হেন পথ ধরে আমরাও সব্যজ্ঞাত্মক পুণ্যকর্মের ফলভূত সেই লোক প্রাপ্ত হবো। আমরা প্রথমে স্বর্গলোকে আরোহণ করবো, এবং তার পরে নাক পৃষ্ট নামক উৎকৃষ্টতম স্থানে স্থিত হবো। ৭।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ— বভ্রেরধ্বর্যো ইতি সূক্তস্য ব্রহ্মৌদনসবে অগ্নে জায়স্ব (১১/১) ইত্যনেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ।–ইত্যাদি। (১১কা, ১অ. ৪সূ.)।
টীকা –উপযুক্ত সূক্তটির বিনিয়োগ ইত্যাদি ব্রহ্মেদিনসবে পূর্ববর্তী সূক্তের মতো উল্লেখিত সূক্তানুসারে করণীয়। যেমন, এই সূক্তের প্রথম ঋটির দ্বারা ওদনের উপরিভাগে গর্ত করণ; আবার ঘৃতেন গাত্রা এই পাদের দ্বারা যেমন স্থালীস্থ সমস্ত ওদন ঘৃতে সিঞ্চন করা হয়, তেমনই কৃথে পন্থাং এই চরম পাদে দাতৃবাচন করা হয়ে থাকে।-ইত্যাদি। (১১কা, ১অ. ৪সূ.)।
.
পঞ্চম সূক্ত : রুদ্রঃ
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : ভব ইত্যাদি। ছন্দ : জগতী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ, শক্করী।]
ভবাশবোঁ মৃড়তং মাভি যাতং ভূতপতী পশুপতী নমো বাম। প্রতিহিতামায়তাং মা বি স্রাস্টং মা নো হিংসিষ্টং দ্বিপদো মা চতুস্পদঃ ॥১॥ শুনে ক্রোষ্ট্রে মা শরীরাণি কমলিক্লবেভ্যো গৃধ্রুেভ্যো যে চ কৃষ্ণা অবিষ্যবঃ। মক্ষিকাস্তে পশুপতে বয়াংসি তে বিঘসে মা বিদন্ত ৷৷ ২। ক্রন্দায় তে প্রাণায় যাশ্চ তে ভব রোপয়ঃ। নমস্তে রুদ্র কৃন্মঃ সহস্রাক্ষায়ামর্ত। ৩. পুরস্তাৎ তে নমঃ কৃন্ম উত্তরাদধরাদুত। অভীবর্গাদ দিবম্পর্যন্তরিক্ষায় তে নমঃ ॥ ৪৷৷ মুখায় তে পশুপতে যানি চক্ষুংষি তে ভব। ত্বচে রূপায় সদৃশে প্রতীচীনায় তে নমঃ ॥ ৫অঙ্গেভ্যস্ত উদরায় জিহ্বায়া আস্যায় তে। দত্ত্যো গন্ধায় তে নমঃ ॥ ৬ অস্ত্রা নীলশিখন্ডেন সহস্রাক্ষেণ বাজিনা। রুদ্রেণার্ধকঘাতিনা তেন মা সমরামহি। ৭ স নো ভবঃ পরি বৃণ বিশ্বত আপ ইবাগ্নিঃ পরি বৃণভু নো ভবঃ। মা নোহভি মাংস্ত নমো অস্তস্মৈ ॥ ৮ ৷ চতুর্না অষ্টকৃত ভবায় দশ কৃত্বঃ পশুপতে নমস্তে। তবেমে পঞ্চ পশবো বিভক্তা গাবে অশ্বাঃ পুরুষা অজাবয়ঃ॥৯॥ তব চতঃ প্রদিশস্তব দৌস্তব পৃথিবী তবেদমুগ্রোবন্তরিক্ষম। তবেদং সর্বমাত্মন্বদ যৎ প্রাণৎ পৃথিবীমনু ॥ ১০৷৷
বঙ্গানুবাদ— (এইটি এবং এর পরবর্তী সূক্তদ্বয়ের দ্বারা ভৌম, অন্তরিক্ষ ইত্যাদির উৎপাত দোষ নিবৃত্তির উদ্দেশে অষ্টমূর্তিধারী মহাদেবের নিকট প্রার্থনা জ্ঞাপিত হচ্ছে। আগমশাস্ত্রে মহাদেবের এই অষ্টমূর্তি অনুক্রান্ত হয়েছে, যথা–শর্ব, পশুপতি, উগ্র, রুদ্র, ভব, ঈশ্বর, মহাদেব ও ভীম। এগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে শতপথ ব্রাহ্মণের ষষ্ঠকাণ্ডে অস বা ইদং অগ্র আসীৎ (শ. ব্রা. ৬।১।১।১) ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। উপস্থিত এই সূক্তে ভব, শর্ব, পশুপতি, রুদ্র ও উগ্রের নিকট প্রার্থনা প্রজ্ঞাপিত হচ্ছে)– হে ভব (সর্ব-জগতের সৃষ্টি ইত্যাদি কর্তা মহাদেব)! হে শর্ব (সংহার কালে সর্ব-জগতের লয়কারী মহাদেব)! তোমরা সুখ প্রদান করো। রক্ষার নিমিত্ত আমাদের অভিমুখে গমন করো। হে ভূতেশ্বরদ্বয় (প্রাণীবর্গের প্রভু)! হে পশুপতিদ্বয় (পশুগণের পালক)! আমি তোমাদের নমস্কার করছি। এতে প্রসন্ন হয়ে তোমরা আমাদের দিকে আপন বাণ নিক্ষেপ করো না এবং আমাদের দ্বিপদ (মনুষ্য), চতুষ্পদ (পশু)গণকেও সংহার করো না। ১।
হে ভব ও শর্বদেব! আমাদের দেহের মাংস যেন কুকুর, শৃগাল, শকুন-কাক ইত্যাদি যেন ভক্ষণ না করতে পারে। তোমাদের যে মক্ষিকা ও পক্ষীসমূহ আছে, তারা খাদ্যরূপে যেন আমাদের প্রাপ্ত না হয়। ২।
হে ভব! অন্তকালে সকলকে ক্রন্দন কারক তোমার শক্তি (বা শব্দ) এবং জগৎ প্রাণভূত তোমার মায়াময় মহিমাকে নমস্কার। হে ভব! তুমি জগতের সাক্ষীরূপ (নিরাবরণজ্ঞানরূপ) দেবতা, তুমি অমরণ-ধর্মশীল; তোমাকে আমরা নমস্কার করছি ৷ ৩৷৷
হে রুদ্র! পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অবস্থিত তোমাকে আমরা নমস্কার করছি। আকাশের মধ্যে অবস্থিত হয়ে সকলকে নিয়ন্তারূপে প্রতিষ্ঠিত তোমাকে আমরা নমস্কার করছি ৷৷ ৪।
হে ভবদেব! তোমার মুখ, চক্ষু, ত্বক ও নীলপীত বর্ণকে আমরা নমস্কার করছি। তোমার সমান রূপশালিনী দৃষ্টিকে ও প্রত্যগাতমরূপী (প্রতীচীনায়) তোমাকে নমস্কার। হে দেব! আমার নমস্কার গ্রহণ করো ৷ ৫৷৷
হে দেব! তোমার উদর, জিহ্বা, দন্ত, ঘ্রাণেন্দ্রিয় তথা অন্য অঙ্গসমূহের উদ্দেশে নমস্কার করছি৷৷ ৬ ৷
নীলকেশশালী, সহস্রচক্ষুধারী, অশ্বসম বেগশালী, সেনাবর্গকে শীঘ্র হননকারী রুদ্রের দ্বারা আমরা যেন কখনও আহত না হই। ৭।
যে ভবদেবের মহিমা প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে, তিনি আমাদের সকল উৎপাত হতে পৃথক রূপে রক্ষা করুন। অগ্নি যেমন জলকে পরিত্যাগ করে (অর্থাৎ দহন করে না), ভবদেবও যেন সেইভাবে আমাদের পরিত্যাগ করুন (অর্থাৎ আমাদের হিংসা না করুন)। সেই ভবদেবকে নমস্কার করি ॥ ৮ ॥
শর্বদেবকে চারিবার নমস্কার ও ভবদেবকে অষ্টবার নমস্কার। হে পশুপতি! তোমাকে দশবার নমস্কার। তোমার স্বভূত (অর্থাৎ তোমার দ্বারা উৎপাদিত) বিভিন্ন জাতীয় গো, অশ্ব, অজ, অবি ইত্যাদি একখুর বা দ্বিখুর পশু এবং মনুষ্যগণকে রক্ষা করো। ৯।
হে রুদ্র (রোদনকারক দেব)! তুমি প্রচণ্ড উগ্র (অর্থাৎ ১উর্ণবল)। এই প্রাচী ইত্যাদি প্রধানভূতা চারিটি দিক, পৃথিবী ও ভূলোক তোমার স্বভূতা। এই পরিদৃশ্যমান বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষও তোমার অধীন। এই দিক-বলয় ও লোকত্রয়, এই পরিদৃশ্যমান সব কিছু তোমার শরীররূপ। যা কিছু প্রাণনব্যাপার (অর্থাৎ জীবনধারণের ক্রিয়া), সবই তুমি। সকলের প্রতি অনুগ্রহকারী এই হেন তোমাকে নমস্কার। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ— ভবাশবৌ মৃড়তং ইত্যাদি সূক্তত্ৰয়ং অর্থসূক্তং। তেন অর্থসূক্তেন স্বস্ত্যয়নকামঃ আজ্য সমিৎপুরোশাদিশম্বুল্যন্তানাং ত্রয়োদশদ্রব্যাণাং অন্যতমং জুহুয়াৎ! সর্বানি বা ত্রয়োদশ দ্রব্যানি জুহুয়াৎ। সূত্রিতং হি।…কৌ. ৭/১, ৭/২ ইত্যাদি। (১১কা, ১অ. ৫সূ.)।
টীকা— পুর্বেই উল্লেখিত হয়েছে–এই সূক্তটি এবং এর পরবর্তী দুটি সূক্ত অর্থসূক্ত। এই তিনটি অর্থসূক্তের দ্বারা স্বস্ত্যয়ন কামনায় আজ্য সমিৎ পুরোডাশ ইত্যাদি এয়োদশ দ্রব্যের যে কোন একটি বা সবগুলির দ্বারা হোমে বিনিয়োগ কর্তব্য। তথা রুদ্র-ভূত-প্রেত-রাক্ষস-লোকপাল ইত্যাদির নিমিত্ত অভিঘাতের স্বস্ত্যয়নের নিমিত্ত সরূপ-বৎসা (তুল্য রূপশালিনী বৎসযুক্তা) গাভীর দুগ্ধে পনকৃত চরু তিনভাগে ভাগ করে সমস্ত অর্থসূক্তের দ্বারা তিন রুদ্রদেবতার উদ্দেশে তিনটি আহুতির দ্বারা যজ্ঞ নির্বাপণ করণীয়। বলা হয়েছে মাংসমুখাগ্রপতনলক্ষণাদ্ভূত শান্তির নিমিত্তও এই অর্থসূক্তের দ্বারা রুদ্রের উদ্দেশে আজাহুতি সমর্পণের বিধান আছে। তথা অগ্নিচয়নে এই অর্থসূক্তের দ্বারা অনুমন্ত্রণে বিনিয়োগ হয়। তথা সর্বকামনা প্রাপ্তির নিমিত্ত বা শান্তির নিমিত্ত ক্রিয়মানে লক্ষহোমে এই অর্থসূক্তের বিনিয়োগ হয় ॥ (১১কা, ১অ. ৫সূ.)।
.
ষষ্ঠ সূক্ত : রুদ্রঃ
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : ভব ইত্যাদি। ছন্দ : জগতী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ, শক্করী।]
উরুঃ কোশশা বসুধানস্তবায়ং যস্মিন্নিমা বিশ্বা ভুবনান্যন্ত। স নো মৃড় পশুপতে নমস্তে পরঃ ক্রোষ্টারো অভিভাঃ শ্বানঃ পরো যন্ত্রঘরুদো বিকেশ্যঃ ॥ ১ ধনুর্বিভর্ষি হরিতং হিরণ্যয়ং সহস্রষ্মি শতবধং শিখন্ডিন। রুদ্রস্যেষুশ্চতি দেবহেতিস্তস্যৈ নমো যতমস্যাং দিশীতঃ ॥ ২॥ যোহভিযাতত নিলয়তে ত্বং রুদ্র নিচিকীর্ষতি। পশ্চাদনুপ্ৰযুক্ষে তং বিদ্ধস্য পদনীরিব ৷ ৩৷৷ ভবারুদ্ৰৌ সমুজা সংবিদানাবুভাবুগ্ৰেী চরতো বীর্যায়। তাভ্যাং নমো যতমস্যাং দিশীতঃ ৷৷ ৪৷ নমস্তেহস্তায়তে নমো অস্তু পরায়তে। নমস্তে রুদ্র তিষ্ঠত আসীনায়োত তে নমঃ ॥ ৫॥ নমঃ সায়ং নমঃ প্রাতনমো রাত্রা নমো দিবা। ভবায় চ শৰ্বায় চোভাভ্যামকরং নমঃ ॥৬॥ সহস্রাক্ষমতিপশ্যং পুরস্তাদ রুদ্রমস্যন্তং বহুধা বিপশ্চিতম। মোপারাম জিহুয়েয়মান ৷৷ ৭৷ শ্যাবাশ্বং কৃষ্ণমসিতং মৃণং ভীমং রথং কেশিনঃ পাদয়স্তম্। পূর্বে প্রতীমোনমো অস্তৃস্মৈ ॥৮॥ মা নোহভি ভ্রা মত্যং দেবহেতিং মা নঃ ক্রুধঃ পশুপতে নমস্তে। অন্যত্ৰাম্মদ দিব্যাং শাখাং বি ধূনু। ৯৷ মা নো হিংসীরধি নো ব্রহি পরি গো বৃদ্ধি মা ক্রুধঃ। মা ত্বয়া সমরামহি৷৷ ১০
বঙ্গানুবাদ –হে পশুপতি (পশুগণের পালকরূপী মহাদেব)! নিবাসের কারণরূপ কর্ম (অর্থাৎ পাপপুণ্যরূপ কর্ম) যে স্থানে ধৃত হয়, সেই অণ্ডকটাহাত্মক কোশ তোমারই। এরই মধ্যে এই পরিদৃশ্যমান সকল প্রাণী নিবাস করে থাকে। তুমি আমাদের সুখ প্রদান করো। তোমাকে নমস্কার। তোমার প্রসাদে ক্রোশনশীল শৃগালেরা ও মাংসভক্ষক কুকুরগুলি আমাদের নিকট হতে দূরদেশে গমন করুক। রোদনকারিকা অমঙ্গলকারিণী বিকীর্ণকেশা পিশাচিনীগণও অন্যত্র গমন করুক৷৷ ১৷৷
হে রুদ্র! তুমি সংহারকালে সংহারাত্মক ধনু ধারণ করে থাকো। সেই হরিতবর্ণ, হিরন্ময় ধনু সহস্র সংখ্যককে একই সঙ্গে হননক্ষম, শতসংখ্যক প্রাণীজাতের মারক (অথবা অপরিমিত সংখ্যক বিশ্বকে সংহারক্ষম)। তোমার সেই ধনুকে প্রণাম। রুদ্রের বাণ সকল দিকে অবাধ গতিতে ধাবিত হয়ে থাকে। এই বাণ দেবহেতি অর্থাৎ দেবতাগণের সম্বন্ধিনী শক্তির মত, আমাদের দিক হতে যে দিকেই এই বাণ অবস্থান করুক, সেই দিকেই সেই বাণকে আমরা নমস্কার করছি। ২।
হে রুদ্র! যে পুরুষ অসমর্থ হয়ে তোমার সম্মুখ হতে পলায়ন করে, সেই অপরাধীকে তুমি উচিত দণ্ড দিতে সমর্থ। তার দৃষ্টান্ত, শস্ত্রহত পুরুষের লুক্কায়িত চিহ্নের দ্বারা তার নিবাস স্থানে উপনীত হয়ে হনন করা হয়; তুমি তেমনই করে থাকো ॥ ৩॥
ভব ও রুদ্র দুজনেই সমান মতি সম্পন্ন, এবং পরস্পর মিত্র-রূপে বিরাজমান। সেই প্রচণ্ড পরাক্রমী দুই মূর্তিই কারো দ্বারা অভিভূত না হয়ে আপন শির প্রকট করে পরিক্রমণ করে থাকেন। তাদের নমস্কার। যে দিকেই তারা বিরাজমান আছে, সেই দিকেই তাদের উদ্দেশে আমাদের প্রণাম প্রাপ্ত হোক। ৪
হে রুদ্র! আমাদের সম্মুখভাগে আগমনশীল তোমাকে নমস্কার, আমাদের দিক হতে প্রত্যাগমনশীল তোমাকে নমস্কার। এইরকম আগমন ও পরাগমন ব্যাতিরিক্ত তুমি যেস্থানেই উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান হয়ে আছে, সেই স্থানস্থায়ী তোমাকে আমাদের নমস্কার ॥ ৫॥
হে রুদ্র তোমাকে সায়ংকালে, প্রাতঃকালে, রাত্রিতে বা দিবাতেও আমরা নমস্কার করছি। ভব ও শর্ব, পরস্পর অনুরাগযুক্ত, এই দুই দেবতাকে আমরা নমস্কার করছি ৷ ৬ ৷
অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, সহস্র নেত্রশালী, মেধাবী, অসংখ্য বাণ নিক্ষেপকারী এবং জিহ্বাগ্রে সমগ্র জগৎ ব্যাপ্তকারী রুদ্রের সম্মুখে আমরা উপনীত হবো না। ৭।
কপিশবর্ণ অশ্বশালী, শ্বেত ও কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদধারী, ভয়ঙ্কর স্বভাবশালী, কেশী নামক দৈত্যের রথকে ভূমিতে নিক্ষেপকারী, সেই রুদ্রদেবকে আপন-রক্ষকরূপে জ্ঞাত স্তোতৃগণের পূর্ব হতেই আমরা জ্ঞাত আছি। সেই হেন রুদ্রদেবের উদ্দেশে আমাদের নমস্কার। ৮৷৷
হে রুদ্র! আমরা মরণধর্মশীল মনুষ্য, আমাদের উপর তোমার আপন দেবসম্বন্ধী আয়ুধরূপী বজ্ৰাত্মক বাণ নিক্ষেপ করো না। আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে না। অন্যদেশে বিস্তৃত শাখার ন্যায় আপন দিব্যাস্ত্রকে নিক্ষিপ্ত করো। তোমার উদ্দেশে আমরা নমস্কার করছি। ৯।
হে রুদ্র! আমাদের প্রতি হিংসাত্মকভাব পোষণ করো না। আমাদের আপন অনুগ্রহের যোগ্য বলে সংজ্ঞা (অধিবচনং) প্রদান করো। আমাদের উপর ক্রোধান্বিত হয়ো না। তোমার শাস্ত্রসমূহ আমাদের হতে পৃথক্ থাকুক। আমরা তোমার ক্রুদ্ধ ভাবের সাথে যেন মিলিত না হই। ১০।
সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –উরুঃ কোশঃ ইত্যস্য সূক্তস্য পূর্বসূক্তেন সহ উক্তো বিনিয়োগঃ (১১কা. ১অ. ৬সূ.)।
টীকা— পূর্ববর্তী সূক্তের মতোই এই সূক্তের বিনিয়োগ করণীয়। প্রাক্-বৈদিক যুগ থেকেই শিব বা রুদ্র বা মহাদেবের চিহ্ন বা সূচকরূপে লিঙ্গ পূজা প্রচলিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ শব্দের অর্থই চিহ্ন বা সূচক। সুতরাং বৈদিক যুগে প্রধান প্রধান দেবতার স্তুতির মধ্যেই শিবের বা রুদ্রের মাহাত্ম প্রসঙ্গে তাকে দেবগণের আদিদেব মহাদেব অর্থাৎ দেবাদিদেব মহেশ্বর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। (১১কা, ১অ, ৬সূ.)।
.
সপ্তম সূক্ত : রুদ্রঃ
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : ভব ইত্যাদি। ছন্দ : জগতী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ, শক্করী।]
মা নো গোযু পুরুষেষু মা গৃধো নো অজাবিষু। অন্যত্রোগ্র বি বর্তয় পিয়ারূণাং প্রজাং জহি। ১. যস্য তা কাসিকা হেতিরেকমশ্বস্যেব বৃষণঃ ক্রন্দ এতি। অভিপূর্বং নির্ণয়তে নমো অস্তুস্মৈ। ২৷৷ যোহন্তরিক্ষে তিষ্ঠতি বিষ্টভিতোহযজ্বনঃ প্ৰমৃণ দেবপীযূন। তস্মৈ নমো দশভিঃ শরীভিঃ ৷ ৩৷৷ তুভ্যমারণ্যাঃ পশবো মৃগা বনে হিতা হংসাঃ সুপর্ণাঃ শকুনা বয়াংসি। তব যক্ষং পশুপতে অপস্বন্তস্তুভ্যং ক্ষরন্তি দিব্যা আপো বৃধে ॥ ৪ শিংশুমারা অজগরাঃ পুরীকয়া জষা মৎস্যা রজসা যেভ্যো অস্যসি। ন তে দুরং ন পরিষ্ঠাস্তি তে ভব সদ্যঃ সর্বান পরি পশ্যসি ভূমিং পূর্বম্মাদ্ধংস্যুত্তরস্মিন্ সমুদ্রে। ৫। মা নো রুদ্র তক্মনা মা বিষেণ মা নঃ সং স্র দিব্যেনাগ্নিনা। অন্যত্রাম্মদ বিদুজতং পাতয়ৈতা। ৬। ভবে দিবো ভব ঈশে পৃথিব্যা ভব আ প উর্বন্তরিক্ষম। তস্মৈ নমো যতমস্যাং দিশীতঃ ॥ ৭৷ ভব রাজন্ যজমানায় মৃড় পশূনাং হি পশুপতিবর্ভূথ। যঃ শ্ৰদ্দধাতি সন্তি দেবা ইতি চতুষ্পদে দ্বিপদেহস্য মৃড়ে ॥ ৮। মা নো মহান্তমুত মা নো অর্ভকং মা নো বহন্তমুত মা নো বক্ষ্যতঃ। মা নো হিংসীঃ পিতরং মাতরং চ স্বাং তন্বং রুদ্র মা রীরিষো নঃ ॥ ৯৷ রূদ্রস্যৈলবারেলভ্যাংসংসূক্তগিলেভ্য। ইদং মহাস্যেভ্যঃ শুভ্যো অকরং নমঃ ॥ ১০ নমস্তে ঘোষিণীভ্যো নমস্তে কেশিনীভ্যঃ। নমো নমস্কৃতাভ্যো নমঃ স্যুঞ্জতভ্যঃ। নমস্তে দেব সেনাভ্যঃ স্বস্তি নো অভয়ং চ নঃ ॥ ১১।
বঙ্গানুবাদ –হে রুদ্র! আমাদের গো, পুত্র, ভৃত্য ইত্যাদির প্রতি হিংসা-কামনা করো না। সেই রকমই, আমাদের মেষ ও ছাগসমূহের প্রতিও হিংসা কামনা করো না। তুমি আপন অস্ত্র-শস্ত্রগুলিকে দেববিরোধীগণের উপর নিক্ষেপ পূর্বক তাদের সন্তান ইত্যাদিকেই বিনষ্ট করো। ১
রুদ্রদেবের যে আয়ুধ-রূপ আর্তস্বরকরী পীড়াময় কাস ও জ্বর ইত্যাদি ব্যাধিগুলি বর্তমান, সেগুলি সেচন-সমর্থ অশ্বের হ্রেষার ন্যায় অপকারী (বা অপরাধী) পুরুষগণেরই প্রাপ্য হোক। সেই অস্ত্র-শস্ত্র পূর্ব পূর্ব অপরাধীর কর্মকে লক্ষ্য করে যারা যোগ্যরূপে প্রতীত হয়, তাদের নিঃশেষে বিনাশ করে থাকে। এই হেন সেই জ্বর ইত্যাদি উপদ্রবকারী রুদ্র দেবতার উদ্দেশে আমরা নমস্কার করছি। ২৷৷
যে রুদ্রদেবতা নিরাধার প্রদেশে (অন্তরিক্ষে) অবস্থান পূর্বক অযজ্ঞকারী (বা অজ্ঞানী) জনকে সংহার করে থাকেন, আমরা সেই রুদ্রের উদ্দেশে অজ্ঞলিবদ্ধ হয়ে প্রণাম করছি। ৩।
হে পশুপতি! শার্দুল, মৃগ, শ্যেন, হংস, শকুন, বাজ ইত্যাদি বনচর পশু ও বনবিহারী পক্ষীগণকে তোমার ভাগের নিমিত্ত বিধাতা নির্ধারণ করেছেন; তুমি এদের আপন ইচ্ছানুসারে স্বীকার করো (অর্থাৎ আমাদের গ্রাম্য পশুগণের প্রতি দৃষ্টি দিও না বা তাদের বিনাশ করো না)। তোমার পূজনীয় রূপ জলের মধ্যে। স্থিত রয়েছে। এই নিমিত্ত তোমাকে অভিষিক্ত করতে দিব্য জল প্রবাহমান হয়ে চলেছে। (অর্থাৎ আমাদের উপভোগ্য উদকও স্পর্শ করো না)। ৪
হে রুদ্র! শিংশুমার (জলজন্তু বিশেষ, শিশুমার বা শুশুক), অজগর (বিরাটায়তন সর্পবিশেষ), পুরীকয় ইত্যাদি (জলচর প্রাণীবিশেষ), জষ, মৎস্য ইত্যাদি জলচরও তোমার নিমিত্ত ভাগরূপে নির্ধারিত হয়েছে, তাদের উদ্দেশে তুমি আপন তেজরূপ শস্ত্র নিক্ষিপ্ত করো। হে ভব! তুমি সর্বগত, তোমা হতে দূর বলে কিছু নেই। তুমি ক্ষণমুহূর্তের মধ্যেই সমগ্র পৃথিবীকে দেখতে এবং পুরোবর্তী সমুদ্র হতে উত্তর-দিক্রবর্তী সমুদ্রে পৌঁছাতে পারো। ৫।
হে রুদ্র! তুমি আমাদের জ্বর ইত্যাদি ব্যাধিরূপ অস্ত্রের সাথে মিলিত (বা সংযুক্ত) করো না, এবং স্থাবর-জঙ্গম হতে উদ্ভুত প্রাণঘাতী বিষের সাথেও মিলিত করো না। আকাশের বিদজরূপ অগ্নির সাথেও আমাদের যুক্ত করো না। তোমার আয়ুধ স্বরূপ বিদ্যোতমান অশনিকে অন্যত্র (অর্থাৎ আরণ্য পশু ইত্যাদি উপর) প্রক্ষিপ্ত করো, আমাদের উপর নয় ৷৷ ৬ ৷৷
ভবদেবতা দুলোক ও পৃথিবীর অধিপতি, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থানে স্থিত অন্তরিক্ষকে তিনিই আপন তেজের দ্বারা যুক্ত করে থাকেন। ত্রৈলোক্যব্যাপী এই হেন ভবদেব যে দিকেই থাকুন, তার উদ্দেশে নমস্কার জ্ঞাপন করছি। ৭৷
হে ভব! হে সকলের অধিপতি! তোমার উদ্দেশে যজ্ঞকারী যজমানকে যজমানকে সুখ প্রদান করো। তুমি পশুপতিরূপে গো, অশ্ব প্রভৃতি বহু পশুর পালক। যে পুরুষ ইন্দ্র প্রমুখ দেবতাগণকে আপন রক্ষক বলে মনে করেন, সেই শ্রদ্ধাশীল জনের চতুষ্পদ গো ইত্যাদি পশুকে এবং দ্বিপদ পুত্র-ভৃত্য ইত্যাদিকে সুখ প্রদান করো। ৮
হে রুদ্র! আমাদের জ্যেষ্ঠ গণকে (অর্থাৎ পিতা-মাতা প্রমুখ বৃদ্ধজনদের), ভারবহনক্ষম মধ্যবয়স্কদের (অর্থাৎ ভ্রাতা, পুত্র, ভৃত্য প্রমুখ যুবজনদের), অথবা আমাদের কনিষ্ঠবর্গকে (অর্থাৎ শিশুদের) প্রতি হিংসা (বা, সংহার) করো না, এবং আমাদের শরীরের প্রতিও হিংসা করো না। ৯।
রুদ্রের প্রেরণাযুক্ত কর্মকারী প্রমথগণকে নমস্কার করছি, অশোভনভাষীবর্গকে দণ্ডদানকারী রুদ্রের গণকে (অর্থাৎ গণশক্তিকে) নমস্কার করছি। মৃগয়ার নিমিত্ত কিরাত-বেশধারী বিরাট মুখবিবর সম্পন্ন ভবের কুকুরগণকে নমস্কার করছি ॥১০
হে রুদ্র! তোমার প্রভূত ঘোষযুক্ত সেনাদের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার বিপরীতাকৃতিকেশযুক্ত বা বিকীর্ণকেশশালী সেনাগণের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার চণ্ডেশ্বর ইত্যাদি সেনাদের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার সহ-ভোজনকারী সেনাদের উদ্দেশে নমস্কার। হে রুদ্র! তোমার উক্তব্যতিরিক্ত সেনাদের উদ্দেশে নমস্কার জ্ঞাপন করছি। হে দেব! তোমার প্রসাদে আমাদের স্বস্তি (অর্থাৎ ক্ষেম বা মঙ্গল) ও অভয় (অর্থাৎ ভয়রাহিত্য) ঘটুক ॥ ১১।
টীকা –এই সূক্তটির বিনিয়োগ পূর্বসূক্তবৎ। স্বস্তিশব্দযোগে স্বস্ত্যয়নকর্মগুলির বিনিয়োগ করণীয়। লিঙ্গানুসারের দ্বারা সর্বত্র বিনিয়োগ দ্রষ্টব্য ॥ (১১কা, ১অ. ৭সূ.)।