জন রাসকিন (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
পুরুষাধিপত্যের প্রতিক্রিয়াশীল রোম্যানটিক রূপটি পাওয়া যায় রুশোর রচনায়; চাটুকারিতাপূর্ণ ভিক্টোরীয় ভণ্ডামোর রূপটি পাওয়া যায় জন রাসকিনের ‘সিসেম অ্যান্ড লিলিজ’ (১৮৬৫) গ্রন্থের ‘লিলিজ : অফ কুইন্স গার্ডেনস্’ (১৮৬৪) নামের বক্তৃতাপ্রবন্ধে। রাসকিনের বক্তব্যে মৌলিক কিছুই নেই, তিনি নারী সম্পর্কে সব কিছু পেয়েছেন প্রথা, সাহিত্য, ও চারপাশ থেকে; তবে তিনি নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় পর্বের কপট, প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ করেছিলেন খুবই বীরত্বের সাথে। ভিক্টোরীয়রা তার কাছে যা শুনতে চেয়েছিলো, তিনি তাদের তা শুনিয়েছিলেন উদ্দীপনার সাথে, এবং অর্জন করেছিলেন অশেষ জনপ্রিয়তা। সব জনপ্রিয় বস্তুই এক সময় হাস্যকর হয়ে ওঠে, রাসকিনের বক্তৃতাটিও তাই; কিন্তু দুঃখ লাগে রাসকিনের আবর্জনা প্রভাব বিস্তার করেছিলো বিপুলভাবে; তিনি প্রভাবিত করেছিলেন এমনকি উনিশশতকের শেষাংশের শিক্ষিত বাঙালিদেরও, যাঁরা রাসকিনের পরামর্শে নিজেদের নারীদের ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘ভদ্রমহিলা’ বা ‘লেডি’। রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’-এর প্রকাশের চার বছর পর বেরিয়েছিলো জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ (১৮৬৯); কিন্তু ওই সত্যনিষ্ঠ বইয়ের ভাগ্যে জুটেছিলো তিরষ্কার। মিলেট (১৯৬৯, ৮৯) বলেছেন, ‘মিলে পাওয়া যায় লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতা, আর রাসকিনে পাওয়া যায় রোমান্স ও রূপকথা।’ রাসকিন বাস্তবতার থেকে বাগিতায়, সত্যের থেকে রূপকথায় বেশি আগ্রহী; তোষামোদে তিনি নির্লজ্জ, পুরুষাধিপত্যে একনিষ্ঠ। নারীদের ডেকেছেন তিনি ‘লিলি’ বা ‘পদ্ম’। ব’লে, ‘রানী’ ব’লে, কিন্তু বন্দী করতে চেয়েছেন গৃহকূপে। ‘পদ্ম’ বা ‘রানী’ ডাকে রয়েছে বেশখানিকটা কাম; ‘পদ্ম’ স্মরণ করিয়ে দেয় অক্ষত শুভ্র সতীত্বের ব্যাপারটিকে, ‘রানী’ও আশ্লেষজাগানো ডাক। রাসকিনকে অনেকখানি নষ্ট করেছে সাহিত্য : তিনি দান্তে, শেক্সপিয়র, ও রোম্যানটিক কবিতার নারীদের ভেবেছেন বাস্তব, কিন্তু ওই নারীরা যে বাস্তব নারী থেকে সুদূরে, তা বোঝেন নি। রোম্যানটিক কবিতা নারীকে দেবী ক’রে শেষ পর্যন্ত পরিণত করে পুরুষের সেবিকায়, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; এখানে দুটি কবিতা উল্লেখযোগ্য, কেননা কবিতা দুটি রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের মনে বদ্ধমূল করেছিলো নারীর বিশেষ রূপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি কবিতার নাম ‘শি ওয়াজ এ ফ্যান্টম অফ ডেলাইট’। কবি বলছেন : যখন সে প্রথম আমার চোখে পড়লো, সে ছিলো আনন্দের মায়ামূর্তি। আবেগের তীব্র মুহূর্তে সে দেবী; কিন্তু আবেগ কেটে গেলে কবি দেখতে পান : সে দেবী, কিন্তু নারীও বটে! তাই আনন্দের মায়ামূর্তি হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহিণী, যার কাজ সংসার দেখাশোনা, মানসসুন্দরী শুরু করে মাছ কোটা। কভেন্ট্রি প্যাটমোরের ‘দি অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ কবিতায় বিয়ে ও নারীত্ব সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ভালোভাবে। রাসকিনের বক্তৃতায় প্রকাশ পায় ওই ‘দেবী, কিন্তু নারীও বটে’ এবং ‘গৃহলক্ষ্মী’র ধারণা।
রাসকিন ১৮৬৪ অব্দে ম্যানচেস্টার শহরের টাউন হলো মধ্যবিত্ত নরনারীদের সামনে দিয়েছিলেন বক্তৃতাটি। বক্তৃতাটিতে পাওয়া যায় এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি পরিপূর্ণ মধ্যযুগীয় শিভালরি ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়; যার চোখে নারীমাত্ৰই নাবালিকা। চাটুবাক্যে শুরু করেছেন তিনি বক্তৃতাটি; শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বসিয়েছেন ‘বিপথগামী ও অশিক্ষিতদের রাজার আসনে, এবং নারীদের বসিয়েছেন ‘রানী’র অসার সিংহাসনে। পরোক্ষভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি সে-সময়ের নারীবাদীদের, যারা বলছিলেন নারীর অধিকারের কথা; কেননা রাসকিন নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন না। সে-সময় জনপ্রিয় ছিলো স্যাপারেট স্ক্যোরিস বা পৃথক এলাকা, অর্থাৎ ঘরে-বাইরে তত্ত্ব, যা তখন সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো নারীদের পোষমানানোর জন্যে। রাজকবি টেনিসন ‘প্রিন্সেস’ (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে বলেছিলেন : ‘নারী অসম্পূর্ণ পুরুষ নয়/ তবে ভিন্ন… অভিন্নরূপে এক নয়, তবে বিভিন্নরূপে এক’, ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা/ অর্ধেক, আর খাঁটি বিয়েতে কেউ/ সমান বা অসমান নয়, প্রতিটি পূরণ করে/ অন্যটির ক্রটি।’ টেনিসনের এ-কাব্যিক ভিন্নতার মধ্যে অভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এমন এক শোভন কৌশল, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষণকে সুখকর ক’রে তোলা। রাসকিন ঘরেবাইরে ও পরিপূরক তত্ত্ব নানাভাবে পেশ করে নারীকে তার অধিকারের কথা ভুলিয়ে চেয়েছেন। পুরুষের সেবিকা ক’রে রাখতে। নারীদের ‘রানী’ ব’লে কপট সম্বোধনের পর রাসকিনের কাজ হচ্ছে ওই রানীরা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী শিখবে তার বিধান রচনা। তিনি নতুন কিছু বলেন নি, পুরুষতন্ত্র যা ব’লে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে, আর তাঁর একশো বছর আগে রুশো, এবং রোম্যানটিক কবিরা যা বলেছেন, তিনি তাই বলেছেন ভিক্টোরীয় নাইটের ভঙ্গিতে।
নারীরা রাসকিনের চোখে রানী, কী ক্ষমতা ওই রানীদের, এবং কীভাবে প্রয়োগ করবে তারা তাদের রানীসুলভ ক্ষমতা? কিন্তু রাসকিন ক্ষমতার কথা বলতে গিয়েই দ’মে গেছেন, তার মনে পড়ে গেছে নারীরা রানী, তবে আসলে তো তারা নারী! তাই আগে ঠিক করতে হবে কী হবে তাদের ক্ষমতা নারী হিশেবে? রাসকিন (১৮৬৫, ৬১) এখন দেখা দেন মুখোশ খুলে; বলেন, ‘নারীদের রানীসুলভ ক্ষমতা কী হবে তা স্থির করতে পারি না, যদি না আমরা একমত হই তাদের সাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে।’ বিপত্তি ঘটে এখানেই, কেননা রাসকিনের বিধানে নারীদের সাধারণ ক্ষমতা খুবই তুচ্ছ, নারীর ক্ষমতা হচ্ছে নারীর ভূমিকা পালন করা। নারী পুরুষের সমান হবে না, নারী হবে পুরুষের সহায়ক। উনিশ শতকে পুরুষতন্ত্রীরা বের করেছিলেন পৃথক এলাকার ধারণা, রাসকিন তা নিজের ক’রে নিয়েছিলেন, এবং একেই ঘোষণা করেছিলেন প্রাকৃতিক ব’লে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পুরুষ ও শোষকতন্ত্রের বড়ো প্রতারণা; রুশো প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে, রাসকিনও প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে। উনিশশতকে প্রকৃতি শুধু আবেগাতুর শব্দ ছিলো না, শোষকতন্ত্র এ-শব্দটিতে পেয়েছিলো সমস্ত সমস্যার সমাধান। তারা যা কিছু বুঝতে পারতো না, বা যা কিছু নিজেদের সুবিধার জন্যে তারা বিধিবদ্ধ করতে চাইতো, তাকেই বলতো তারা ‘প্রাকৃতিক’ : শ্রেণী, স্বৈরাচার, শোষণ সব কিছুই প্রাকৃতিক! রাসকিন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট বলা শোভন ছিলো না, তাই তাদের সুভাষণ বের করতে হয়েছিলো। টেনিসনের প্রন্সেস-এ মেলে নারীপুরুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্ব :
For Woman is not underdevelopt man
But diverse:..
Not like to like, but like in difference…
either sex alone
Is half itself, and in true marriage lies
Nor equal, nor unequal each fulfills
Defect in each
নারী নয় অবিকশিত পুরুষমানুষ
তবে ভিন্ন…
একজন নয় অপরজনের মতো, কিন্তু ভিন্নতার মধ্যে একরূপ…
দু-লিঙ্গের মধ্যে একটি একলা
শুধুই অর্ধেক, আর প্রকৃত বিবাহে
কেউ সমান বা অসমান নয়; প্রত্যেকে পূরণ করে
অপরের ত্রুটি
ভিক্টোরীয় রাজকবির মতে নারী অবিকশিত মানুষ বা পুরুষ নয়, ভিন্ন ধরনের মানুষ; শুনতে এটা ভালো শোনালেও কবি আর ভিক্টোরীয়রা নারীকে অসম্পূর্ণ মানুষই মনে করতো। এ-কবিতার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্বের প্রতিধ্বনি ক’রে রাসকিন (১৮৬৫, ৭২) বলেন :
‘আমরা নির্বোধি, ক্ষমাহীনভাবে নির্বোধ, যখন আমরা এক লিঙ্গের ওপর আরেক লিঙ্গের শ্ৰেষ্ঠতার কথা বলি, যেন তাদের তুলনা করা সম্ভব অভিন্ন বিষয়ে। একটির যা আছে অন্যটির তা নেই; একটি পূর্ণতা দেয় অন্যটিকে, এবং পূর্ণতা পায় অন্যটি দিয়ে : তারা কোনো কিছুতেই একরকম নয়, উভয়ের সুখ ও উৎকর্ষ নির্ভর করে অন্যের যা আছে তা চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে, যা শুধু দিতে পারে অন্যটি।‘
রাসকিনের এ-নাইটপনা হচ্ছে নারীপুরুষের সামাজিক ও মেজাজগত পার্থক্যকে জৈবিক যুক্তির সাহায়ে বৈধ করার কূটকৌশল। তিনি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টতে না গিয়ে গেছেন টেনিসনি ভিন্নতায় ও পরিপূরকতায়, শয্যা থেকে সাম্রাজ্য পর্যন্ত যার সুফল পাবে পুরুষ আর দুর্ভোগ পোহাবে নারী। পুরুষ : নারী ভিন্ন ও পরিপূরক, যেমন ভিন্ন ও পরিপূরক ব্ৰাহ্মণ; শূদ্ৰ, শোষক : শোষিত, যারা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈচিত্র্যের সঙ্গীত! নারীপুরুষের কোনো মৌল পার্থক্য নেই; যোনিলিঙ্গস্তন প্রভৃতি পার্থক্যের নেই কোনো সামাজিক-রাজনীতিক মূল্য, কিন্তু রাসকিনেরা এসবের জন্যেই পুরুষকে প্ৰভু আর নারীকে দাসী ক’রে রাখার কৌশল বের করেছেন চিরকাল।
রাসকিন নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব ও পরিপূরকত্ব প্রস্তাব ক’রেই ধ’রে নিয়েছেন যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে; এবং সাথেসাথেই তিনি আঁকা শুরু করেছেন নারীপুরুষের ভিন্ন ও পরিপূরক জগতের মানচিত্র। তিনি পুরুষকে দিয়েছেন মুক্ত পৃথিবী, নারীকে ঢুকিয়েছেন বদ্ধ ঘরে; সৃষ্টি করেছেন ঘরে-বাইরের ভিন্ন ও বিপরীত পরিপূরক বিশ্ব। রাসকিনের রাজারা পুরুষ, তাই তারা দায়িত্ব পেয়েছে সমস্ত মানবিক কাজের, আরা রাসকিনের রানীরা নারী, তাই তারা পেয়েছে গৃহপরিচারিকার দায়িত্ব : এই হচ্ছে রাজারানীর পরিপূরকতা! নারীপরুষের ভিন্নতা সম্পর্কে আবহমান পুরুষতন্ত্র যা বলেছে, রুশো যা বলেছেন, যা বলেছে ভিক্টোরীয়রা, তাই বলেছেন রাসকিন (১৮৬৫, ৭২-৭৩) :
‘তাদের চাবিত্রিক ভিন্নতা সংক্ষেপে এগুলো। পুরুষের শক্তি সক্রিয়, প্রগতিশীল, প্রতিরোধাত্মক। সে প্রধানত কর্তা, স্রষ্টা, আবিষ্কারক, রক্ষক। তার মেধা প্ৰকল্পনার ও আবিষ্কারের; তার শক্তি অভিযাত্রার, যুদ্ধের, বিজয়ের, যেখানে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত, যেখানে বিজয় দরকার। কিন্তু নারীর শক্তি শৃঙ্খলার, যুদ্ধের নয়; আব্ব তার মেধা আবিষ্কার বা সৃষ্টির নয়, তা মধুর শৃঙ্খলার, বিন্যাসের, এবং সিদ্ধান্তের। তার কাজ প্রশংসার : সে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না, কিন্তু কার শিরে মুকুট পরানো হবে সে তার রায় দেয; তার কাজ ও স্থান দিয়ে সে সব রকম বিপদ ও প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত। পুরুষ, মুক্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন কর্কশ। কাজে, মুখোমুখি হয় বিপদ ও বিচারেব্য;–তাই পুরুষেবই জন্যে রয়েছে ব্যর্থতা, অপরাধ, অনিবাৰ্য ভুল: মাঝেমাঝেই সে আহত বা পরাভূত হবে, বিপথে যাবে, এবং সব সময় কঠিনতর হবে। কিন্তু সে নারীকে রক্ষা করে এসব থেকে; তার গৃহের মধ্যে, যা শাসন করে নারী, যদি নারী নিজে না চায়, তবে নারীকে ঢুকতে হবে না কোনো বিপদ, প্রলোড়ন, ভুল বা অপরাধের মধ্যে। এ হচ্ছে গৃহের আসল প্রকৃতি–এটা শান্তির এলাকা।‘
রাসকিনের বুলির সারকথা : পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সেবিকা। গৃহে থাকা, সংসার শাসন করা, পুরুষের সেবা করাই রাসকিনের মতে ‘নারীর প্রকৃত স্থান ও শক্তি’। নারীকে হ’তে হবে গৃহের উপযুক্ত, ওই বদ্ধকূপে থেকেই সে সফল ক’রে তুলবে তার জীবন। নারী হবে। আপাদমস্তকআত্মা এমন নারী যে সে যেখানেই রাখবে তার পা দুখানি, তাই হয়ে উঠবে গৃহ। তাঁর, ও তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদী গোত্রের, কাছে এই প্রাকৃতিক। রাসকিনের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে প্ৰথাই প্রাকৃতিক; যা চলে এসেছে, তা যতোই নিষ্ঠুর অমানবিক অস্বাভাবিক হোক-না-কেনো, তাদের কাছে তাই প্রাকৃতিক শাশ্বত। নারীকে তার জীবন সফল করার জন্যে আয়ত্ত করতে হবে নানা রমনীয় গুণ। রাসকিন (১৮৬৫,৭৩-৭৪) তাঁর রানীদের ভূষিত দেখতে চেয়েছে আত্মবিনাশী গুণে :
‘সে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে ভালো; সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে জ্ঞানী-জ্ঞানী, আত্মবিকাশের জন্যে নয়, বরং আত্মোৎসর্গের জন্যে : জ্ঞানী, এজন্যে নয় যে সে নিজেবে প্রতিষ্ঠা করবে স্বামীর ওপরে, ববং এজন্যে যাতে সে ব্যর্থ না হয় স্বামীর পাশে থাকতে।‘
রাসকিন পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন নারীদের অস্তিত্ব, কেননা নারীর কিছুই নারীর নিজের জন্যে নয়। নারীকে ভালো হতে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে; জ্ঞানীও হতে হবে সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে; কিন্তু সে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারবে না, সে নিজেকে তৈরি করবে। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পায়ে আত্মোৎসর্গের জন্যে। এ হচ্ছে একধরনের সতীদাহ। রাসকিন নারীদের পরিণত করেছেন শোচনীয় প্রাণীতে, অথচ ভিক্টোরীয় কপটতায় তাদের ডেকেছেন ‘রানী’ বলে।
পুরুষতন্ত্র শুধু পীড়ন ক’রে নারীদের নারী ক’রে তোলে নি, তাদের দীক্ষিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাক্ত মন্ত্রে, যার নাম নারীমন্ত্র। নারীমন্ত্রে দীক্ষণ দেয়ার জন্যে পুরুষতন্ত্র উদ্ভাবন করেছে বিশেষ ধরনের নারীশিক্ষা, যা প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষাই নয়। রুশোর এমিল-এর বিকল্প নাম শিক্ষা, কিন্তু ওই শিক্ষা নারীদের জন্যে অশিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসকিনও ওই শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ অশিক্ষায় অশিক্ষিত করতে চেয়েছেন নারীদের। রাসকিন নারীদের জন্যে রেখেছেন স্বামী ও সংসার, তাই তাদের দিতে চেয়েছেন সে-শিক্ষা যাতে নারীরা সম্পূর্ণরূপে খাপ খায় স্বামী ও সংসারের অন্ধকূপে। রাসকিন বলেছেন, ‘আমি নারীদের স্থান ও শক্তি দেখিয়েছি’; তারপর প্রশ্ন করেছেন নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে, ‘এর সাথে খাপ খাবে কী ধরনের শিক্ষা’ নারীদের জন্যে তিনি বিধিবদ্ধ করেছেন খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা, যার লক্ষ্য নারীদের পুরুষাধীনতায় অভ্যস্ত করে তোলা। রাসকিন (১৮৬৫,৭৬) বলেন, ‘প্রথমে নারীর দেহখানিকে ছাচে ফেলে ঢালাই করতে হবে’; তারপর ওই নমনীয় ভঙ্গুর দেহখানির ভেতর যে-মনটি থাকবে, সেটিকে বদলে দিতে হবে ও ভ’রে তুলতে হবে।’ আত্মোৎসর্গ্র শিক্ষায়। রাসকিনের মতে নারীর জ্ঞান যেমন আত্মবিকাশের জন্যে নয়, তেমনি শিক্ষাও আত্মবিকাশের জন্যে নয়;–নারীর শিক্ষা পুরুষের সেবা করার জন্যে, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার জন্যে। এ-শিক্ষায় নারী বড়েজোর হয়ে উঠবে সখি, সচিব ও প্রিয়শিষ্যা, যা তাকে ক’রে তুলবে পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়, কিন্তু সে কখনো স্বাধীন ব্যক্তি হয়ে উঠবে না।
রাসকিন (১৮৬৫, ৭৬-৭৯) নারীকে দিতে চেয়েছেন পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার শিক্ষা। নারীকে দিতে হবে সে-সব জ্ঞান, যা নারীকে সাহায্য করবে। ‘পুরুষের কাজ বুঝতে, এমনকি সহায়তা করতে’। অর্থাৎ পুরুষ হবে ঔপন্যাসিক, আর তাঁর স্ত্রী হবে পাণ্ডুলিপি।প্রস্তুতকারক ও গ্রুফসংশোধক, পুরুষ বিশ্ববিখ্যাত হবে। আর নারী স্বামীর খ্যাতিতে ধন্য বোধ করবে! এ-প্রসঙ্গে টলষ্টয় ও তার স্ত্রী সোফিয়া স্মরণীয়। টলষ্টয় পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষের স্থান পেয়েছেন, আর নিন্দিত হয়ে আছেন সোফিয়া, যদিও ওই নারী সহচরীরূপে তাঁর সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন টলষ্টয়ের বিখ্যাত নিষ্ঠুর পায়ে। টলস্টয় দুশ্চরিত্র ছিলেন, নিজের অবৈধ পুত্রদের লাগিয়েছিলেন ভূমিদাসের কাজে, পরিচারিকদের গর্ভবতী করেছেন, আর শেষ জীবনে যখন ধর্ম ও নিষ্কামতা প্রচার করছিলেন তখনও জড়িত ছিলেন চেরট্কভের সাথে সমকামে; এবং নিয়মিতভাবে গৰ্ভবতী ক’রে চলছিলেন সোফিয়াকে, আর সোফিয়া ক’রে চলছিলেন স্বামীর সহকারীর কাজ। টলষ্টয় তাকে তেরোবার গর্ভবতী করেন, ওই নারী নটি জীবিত সন্তান লালনপালন করেন, জমিদারি দেখাশোনা করেন, প্ৰকাশ করেন স্বামীর রচনাবলি, এবং বারবার অনুলিপি প্রস্তুত করেন স্বামীর পাণ্ডুলিপির। টলষ্টয়ের অপাঠ্য হস্তাক্ষরে লেখা যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করেন তিনি সাতবার, রাত জেগেজেগে বিবর্ধক কাচ দিয়ে দেখে, এবং নষ্ট করেন নিজের জীবন [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ১৬৩-১৬৪)]। রাসকিন এভাবেই নষ্ট করতে চান নারীকে। রাসকিন বলেন, নারীকে ‘জ্ঞান দেয়া যাবে না জ্ঞান হিশেবে, নারীদের জ্ঞান দিতে হবে এমনভাবে যাতে নারী শুধু ‘অনুভব ও বিচার করতে পারে’। নারীর মাথাটি নষ্ট করে দিয়ে তার বুকের ভেতরে সৃষ্টি করতে হবে স্যাঁতসেঁতে ভাবালুতা। নারীর জ্ঞান ‘নারীর গর্ব বা বিশুদ্ধির জন্যে নয়’; তা শুধু তাকে দয়াবতী ক’রে তোলার জন্যে। রাসকিনের বিধান হচ্ছে নারীকে বিজ্ঞান শেখানোর দরকার নেই, তাকে শুধু বিজ্ঞানের দু-একটি খবর জানানো যেতে পারে। নারীকে জ্ঞানের অভিধানে পরিণত করার দরকার নেই; তবে তাকে ক’রে তুলতে হবে ভাবালুতার ঝরনাধারা। নারীকে ধর্মতত্ত্বও শেখানো যাবে না, এটা বিশেষভাবেই বারণ করেছেন রাসকিন, কেননা এটা এক ভয়ঙ্কর বিজ্ঞান’, যেখানে পদষ্মলন ঘটেছে শ্রেষ্ঠ পুরুষদেরও। নারীরা ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, তবে তাদের ভীরে তুলতে হবে ধর্মভাবে, যাতে তারা হয়ে ওঠে বিনীত ও করুণাময়ী।
স্ববিরোধিতা করে এক সময় রাসকিন বলেন, ‘এটা (ধর্মতত্ত্ব) বাদে, ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, পাঠে ও বিষয়ে, হবে প্ৰায় একই; তবে তাদের শিক্ষার লক্ষ্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন’। ‘প্রায় একই’ অবশ্য অভিন্নতা বোঝায় না, বোঝায় সম্পূর্ণ ভিন্নতা; আর লক্ষ্য তো ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’। রাসকিন চান পুরুষের জন্যে শিক্ষা, আর নারীর জন্যে অশিক্ষা :
নারীর শিক্ষা হবে স্বামীমুখি। স্বামী যা কিছু জানে স্ত্রীকে জানতে হবে সে-সব, তবে ভিন্নভাবে; ওই জ্ঞানে স্বামীর ‘অধিকার হবে মৌলিক ও অগ্রসর’; আর স্ত্রীর অধিকার হবে ‘সাধারণ, যাতে তা প্রাত্যহিক জীবনে উপকারে আসে’। রাসকিনের বিধান হচ্ছে ‘পুরুষ তার জানা ভাষা বা জ্ঞান আয়ত্ত করবে ব্যাপকভাবে, আর নারী ওই ভাষা বা জ্ঞান জানবে ততোটুকু, যতোটুকু হ’লে সে তার স্বামীর আনন্দের সঙ্গে তাল দিতে পারে’। সারকথা হচ্ছে নারীকে কোনো যথার্থ শিক্ষাই দেয়া হবে না, তাদের দিতে হবে নারী হয়ে ওঠার, স্বামীর সহচরী হয়ে ওঠার সবক। তারা হয়ে উঠবে উন্নত জাতের দাসী ও শয্যাসঙ্গিনী। রাসকিনের নারীশিক্ষা হচ্ছে পুরুষের সাথে খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করেন নারী-অধীনতায়; তার শিক্ষাও নারীকে পুরুষের অধীন করার মন্ত্র। নারীশিক্ষা পুরুষতন্ত্রের একটি বড়ো ভীতির ব্যাপার, কেননা শিক্ষা নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের সাথে, তাকে বুঝিয়ে দেয় তার পতনের শোচনীয়তা ও সম্ভাবনাকে।
ভিক্টোরীয় যুগে নানা চক্রান্ত হয়েছে নারীর শিক্ষা নিয়ে, যে-চক্রান্তের একটি আদর্শ রূপ পাওয়া যায় টেনিসনের ‘প্রিন্সেস’-এ (১৮৪৭, ১৮৫৩), যার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত ছিলেন রাসকিন। প্রিন্সেস একটি শিক্ষাবিতর্কমূলক কাব্য। ভিক্টোরীয় যুগে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো; এমনকি এর প্রভাব পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার ওপরও, যার ফলে একটি বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসিত রাজকন্যা হয়ে ওঠে পুরুষের শোচনীয় সহচরী। প্রিন্সেস-এ বিবাহবিরোধী রাজকন্যা আইডা নারীশিক্ষার জন্যে স্থাপন করে একটি নারী-বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ছাত্রীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয় আইডার অনুরাগী মৃগীরোগগ্ৰস্ত এক রাজপুত্র ও তার বন্ধু। রাজপুত্র যখন ধরা পড়তে যাচ্ছিলো, তখন একদিন সে জলমগ্ন আইডাকে উদ্ধার ক’রে প্রাণে বাঁচায়, এবং প্ৰেম নিবেদন করে। আইডা তা প্রত্যাখ্যান করে। এক সময় যুদ্ধ বাধে আইডা ও রাজপুত্রের দলের মধ্যে, যুদ্ধে আহত হয় রাজপুত্র। আইডা আহত রাজপুত্রের সেবা ক’রে নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে; বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানে সে স্থাপন করে হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে ও শিক্ষানুরাগী বিবাহবিরোধী রাজকন্যাকে নার্সে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র প্ৰতিশোধ গ্রহণ করে নারীবাদ ও নারীশিক্ষার ওপর।
প্রিন্সেস-এ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে নারীবাদের ওপর; দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। নারীর শিক্ষা হচ্ছে বাজে কথা, আর নারীপুরুষ কখনো সমান হ’তে পারে না। প্রিন্সেস-এর নায়ক আইডাকে বিয়ে করতে চায়, তবে সে এমন কাউকে বিয়ে করতে পারে না যে তার সমকক্ষ। নারীর সমকক্ষতা দাবি দ্রোহিতা, তাই তাকে পেতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। দ্রোহী নারীকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যাতে সে হয়ে ওঠে অনুগত স্বামীপরায়ণ দাসীস্বভাব স্ত্রী। নারী যদি সমান হয়ে ওঠে। পুরুষের, তাহলে কি বিয়ে টিকতে পারে, সুখের হতে পারে সংসার’ ভিক্টোরীয়রা বিশ্বাস করতো সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে; আর রমণীর শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে পুরুষের নিচে থাকা। শিক্ষা হচ্ছে সে-শক্তি যাতে নারী সমান হয়ে উঠতে পারে পুরুষের, তাই নারীকে সরিয়ে নিতে হবে শিক্ষার দরোজা থেকে। নারীকে থাকতে হবে ঘরে, তাই প্রিন্সেস-এ গানেগানে প্রচার চালানো হয়েছে ঘর আর চুলোর সপক্ষে; হিটলার যেমন প্রচার চালিয়েছে কিন্ডের, কুচে উন্ট কিরচে’র [শিশু, রান্নাঘর ও গির্জা] পক্ষে। তাদের কাছে প্ৰেম/বিবাহ ও শিক্ষা ছিলো পরস্পরবিরোধী; একটি করা যাবে, একসাথে দুটি করা যাবে না। এ-কাব্যে পুরুষাধিপত্যবাদী ভিক্টোরীয় মনোভাব প্ৰকাশ পেয়েছে প্রচণ্ডভাবে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ’৭৮-৭৯)];
মাঠেন্য জন্যে পুরুষ আর চুলোর জন্যে নারী;
তলোয়ারের জন্যে পুরুষ সূচের জন্যে নারী;
পুরুষেব আছে মগজ, নারীর আছে হৃদয়;
পুরুষ দেবে আদেশ, আর পালন করবে নারী;
…
পুরুষ শিকারী; নারীরা শিকার।
মৃগয়ার চকচকে ঝলমলে মৃগ,
আমরা শিকার করি তাদের চামড়ার সৌন্দর্যের জন্যে;
এজন্যেই তারা ভালোবাসে আমাদের
এবং আমরা অশ্ব ছুটিয়ে তাদের ভূপাতিত করি।
হিংস্র পুরুষাধিপত্যের কোমল চতুর রূপ হচ্ছে নারীপুরুষের পরিপূরক পার্থক্যের তত্ত্ব। নারীপুরুষের সাংস্কৃতিক আপাতপার্থক্যকে ভিক্টোরীয় রীতিতে জৈবিক ক’রে তুলেছেন টেনিসন ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা অর্ধেক’ বলে। তাঁর মতে নারীপুরুষ দুজনে মিলে গ’ড়ে তোলে ‘বিশুদ্ধ সঙ্গীত’; তবে এ-দ্বৈত সঙ্গীতে পুরুষই প্রধান সুর। টেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে, জ্ঞানার্থী তরুণীকে নার্সে পরিণত ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে সৃষ্টি করেছেন ভিক্টোরীয় বিবাহের বিশুদ্ধ সঙ্গীত; রাসকিন করেছেন একই কাজ। নারীকে শিক্ষার নামে দিয়েছেন অশিক্ষা, নবীর পুরুষাধীনতাকে ক’রে তুলেছেন মহিমানিত।
রাসকিনের রানীদের রাজ্য গৃহ, সংসারই তাদের রাজদরবার; তবে শিভালরিতে তিনি অদ্বিতীয়, তাই তিনি রাষ্ট্রের সাথে তার রানীদের/নারীদের কী সম্পর্ক হবে, তাও দেখাতে ভোলেন নি। তিনি বলেছেন (১৮৬৫, ৮৭), ‘আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে পুরুষের দায়িত্ব বাইরে, আর নারীর দায়িত্ব ঘরে। তবে আসলে তা নয়।’ তাঁর মতে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব রয়েছে সংসারের প্রতি, তবে বাইরের প্রতিও রয়েছে তার দায়িত্ব। নারীর বাইরের জগত, রাসকিনের মতে, তার সংসারেরই সম্প্রসারণ। পুরুষের নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ‘ভরণপোষণ, উন্নতি ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা, আর নারীর কাজ হচ্ছে সংসারকে সাজানোগোছানো, আরামপ্রদ ও মনোরম করা’। রাসকিন রাষ্ট্রের প্রতি নারীপুরুষের যে-দায়িত্ব নির্দেশ করেছেন, তাতে পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সহায়ক অলঙ্কার। পুরুষের দায়িত্ব ‘রাষ্ট্রকে সচল রাখা, তাব উন্নতি করা, তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা’; আর নারীর দায়িত্ব হচ্ছে ‘রাষ্ট্রকে সাজিয়েগুছিয়ে, আরামপ্রদ ও সুন্দর ক’রে রাখা’। এরপর রাসকিন পুরুষকে ‘ভদ্রলোক’-এর বদলে ভূষিত করেন লর্ড উপাধিতে, নারীকে ‘ভদ্রমহিলা’র বদলে ‘লেডি’তে। তবে তিনি ‘লর্ড’ ও ‘লেডি’ শব্দের যে-অর্থ নির্দেশ করেন, তাতে নারীর সব মহিমা লুটিয়ে পড়ে। ‘লেডি’ শব্দের অর্থ ‘রুটিদানকারিণী’, অৰ্থাৎ যে ভিক্ষা দেয়; আর ‘লর্ড’ শব্দের অর্থ ‘আইনরক্ষণকারী’ বা ‘প্ৰভু। সমস্ত ক্ষমতা থাকছে পুরুষের হাতে, নারী শুধু পালন করবে দান বা ভিক্ষা দেয়ার কাজ। কিন্তু নারী দান করবে কার ধন? সে নিজেই তো সর্বহারা, ভিখিরি; পুরুষের ধন ছাড়া দেয়ার মতো কোনো ধন তার নেই। তাহলে কি তার কাজ প্রভুর ধন থেকে মাঝেমাঝে কিছু ভিক্ষে দিয়ে প্রভুর শোষণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা? রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’ হচ্ছে পুরুষাধিপত্যের ভিক্টোরীয় মন্ত্র ও চক্রান্ত, যার থেকে এখনো উদ্ধার পায় নি মধ্যবিত্ত নারীরা। নিম্নবিত্ত নারীদের কথা তিনি ভাবেনই নি, তার চোখে তারা রানী নয়, নারীও নয়, সম্ভবত মানুষও নয়।