জাঁ-জাক রুশো (নারীর শত্রুমিত্ৰ)
মার্ক্স-পূর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো, যাঁর রচনা অন্তত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলো। সাম্যবাদী মার্ক্সের রচনায় যেমন শ্রেণীসংগ্রাম, রোম্যানটিক রুশোর রচনায় তেমনি প্রকৃতি; এবং প্রকৃতি নামক মিথ্যার শেকলে রুশো বন্দী করেছেন নারীকে। রুশো বিভিন্ন রচনায় বিচার করেছেন নারীর প্রকৃতি বা স্বভাব, শিক্ষা, ও সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারীর স্থান। নারী সম্পর্কে তাঁর আবেগতাড়িত মত পশ্চিমকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো, পশ্চিমের দেশেদেশে তাঁর মতকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো উগ্রভাবে, কেননা পশ্চিম রুশোর মধ্যে পেয়েছিলো এক নতুন বিধানকর্তাকে। রুশো, ফরাশি বিপ্লবের দার্শনিক, বিরোধী ছিলেন সমস্ত শৃঙ্খলের, ভাঙতে চেয়েছিলেন সমস্ত শেকল ও মূর্তি; কিন্তু নারীর জন্যে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেকগুলো শক্ত শেকল, এবং অবিনশ্বর করে রাখতে চেয়েছিলেন পিতৃতন্ত্রেব তৈরি নারীমূর্তিটি। তাঁর বিখ্যাততম উক্তি : ‘মানুষ জন্মে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’–সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য শুধু পুরুষ-মানুষের ক্ষেত্রে। ‘মানুষ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘পুরুষ’, নারী রুশোর কাছে মানুষ ছিলো না। নারী পরাধীনভাবে জন্ম নিলেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, খুবই সুখী বোধ করতেন। তিনি, কেননা তাহলে নারীকে সুচারুরূপে পুরুষাধীন করার জন্যে এতোগুলো বই তাকে লিখতে হতো না। নারী সম্পর্কে রুশোর দর্শনের সম্পূর্ণটাই ভ্ৰান্ত, যার সারকথা হচ্ছে: ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, এবং তাকে চিরকাল পুরুষাধীন রাখতে হবে’ বা ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, তবে কোনো নারী যদি স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, তবে পুরুষের কাজ হচ্ছে তাকে পুরুষাধীন করা।’ মানুষ ও রুশোর জন্যে বিশেষ মর্মান্তিক যে সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক রচনা করেছিলেন নারীকে বন্দী করার দর্শন, যা বাতিল ক’রে দেয় তাঁর মূল দার্শনিক প্রতিপাদ্যকে। রুশো ছিলেন পিতৃতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নারীপুরুষের যে-বিভেদ ও চালিয়েছে যে-পীড়ন, রুশো তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের জন্যে তিনি নির্দেশ করেন। সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ও বিপরীত স্থান ও ভূমিকা। তবে তিনি নারীপুরুষের ভিন্ন স্থান ও ভূমিকাকে দাবি করেছেন ধ্রুব সত্যরূপে; তাঁর মতে, নারীপুরুষের প্রথাগত স্থান ও ভূমিকা কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যাপার নয়, তা প্রাকৃতিক। তবে তাঁর কাছে পুরুষের জন্যে যা প্রাকৃতিক নারীর জন্যে তা প্রাকৃতিক নয়, নারীপুরুষ রুশোর দর্শনে দুই প্রকৃতির অন্তর্গত। তাই প্রকৃতির এ-দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন কী প্রাকৃতিক নারীর জন্যে, আর কী প্রাকৃতিক পুরুষের জন্যে। নারীর প্রকৃতি রুশো নির্দেশ করেন নারীর ভূমিকা বা উপযোগিতা অনুসারে, অর্থাৎ নারীর যৌন ও সন্তান জন্ম দানের উদ্দেশ্য দিয়ে; আর পুরুষের প্রকৃতি নির্দেশ করেন পুরুষের চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার অশেষ সম্ভাবনা দিয়ে। রুশোর নারী জৈবিক, পুরুষ অজৈবিক; নারী মাংস, পুরুষ দেবদূত। রুশোর নারী শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত; আর পুরুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল। এসব ধারণা রুশো পেয়েছেন প্রথা থেকে; এবং প্রথা থেকে পেয়েছেন নারী সম্পর্কে আরো অনেক অশীল ধারণা। পশ্চিমের পিতৃতন্ত্র যেমন নারীকে মনে করে সমস্ত অশুভর উৎস, রুশোর চোখেও নারী পৃথিবীর সমস্ত অশুভর প্রধান উৎস। নারী সম্পর্কে রুশোর সমগ্র দর্শনই ভ্ৰান্ত; তিনি তার চারপাশে যা দেখেছেন, তাকেই ধ্রুবসত্য ব’লে গণ্য করে চর্চা করেছেন দর্শনের।
রুশোর দর্শনে নারী হচ্ছে পুরুষের কামসামগ্ৰী, এবং তার স্থান পুরুষের অধীনে। নারী পুরুষের কামের তৃপ্তি যোগাবে, কিন্তু নিজে থাকবে কামবাসনাহীন। রুশোর মতে পুরুষের কাম অত্যন্ত মূল্যবান; নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের মূল্যবান কামকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করা। রুশোর দর্শন হচ্ছে পুরুষ তার প্রবল কামবেগ ও প্রমোদের জন্যে চায় যে নাস্ত্রী হবে পরম কামবেদনময়ী ও চরম কামোত্তেজক; এবং একই সাথে পুরুষ আরো চায় যে নারী নিয়ন্ত্রণে রাখবে পুরুষের অনন্ত কামাবেগকে; তাই নারী হবে অযৌন ও শীতল সতী; নারীকে, একই সাথে ও শরীরে, হতে হবে তীব্ৰ কামজাগানো অগ্নিগিরি ও তুষারের মতো পরিশুদ্ধ; অতিকামময়ী ও নিষ্কাম। নারীর কাছে রুশো চান যে নারী একই সাথে পরিপূর্ণ থাকবে লােজনম সতীত্বে ও চিত্ৰতারকার প্রচণ্ড যৌনাবেদনে; নারী হবে মর্মরের মতো শুদ্ধ, আবার তীব্রতম সুরার মতো কামোদীপক, সবার জন্যে নয় শুধু স্বামীর জন্যে। একই শরীরে একই সাথে নারী হবে শুদ্ধতমা কুমারী ও বিলোল বেশ্যা। রুশো নিজে ছিলেন কামার্ত লম্পট, অনেক অবৈধ সস্তানের দায়িত্বহীন জনক, যিনি অনুরাগিণীদের গর্ভবতী ক’রে ফেলে যেতে দ্বিধা করেন নি, কিন্তু তিনিই আবার দর্শনচর্চার সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন সঠিক পিতৃত্বের ব্যাপারে। বারবার তিনি বলেছেন যে স্বামীদের নিশ্চিত হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে, যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান। সাবধান থাকতে হবে যাতে তাদের পুকুরে মাছ না ধরে অন্য কেউ। রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে প্রস্তাব করেছেন ভিন্ন নৈতিকতা। নারীদের সতী রাখার জন্যে আবদ্ধ ক’রে রাখতে চেয়েছেন বাড়িতে, যাতে নারীরা অন্য পুরুষের সংসর্গে এসে হারিয়ে না ফেলে তাদের সতীত্বের হীরের টুকরোটি। রুশোর কাছে সতীই শ্রেষ্ঠ নারী; সতীত্ব ছাড়া নারীর আর কোনো গুণ থাকতে পারে না। সাম্য ও মুক্তির এ-দার্শনিক নারীপুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচার করেন নি, এটা বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। রুশো বিখ্যাত মূর্তিভগ্নকারীরূপে, কিন্তু নারীর ব্যাপারে তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের চূড়ামণি।
রুশো নারীর বিরুদ্ধে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত চক্রান্তকে, নারীর অধীন অবস্থা ও পীড়নকে, শুধু প্রথা হিশেবেই মানেন নি, একেই তিনি মনে করেছেন সত্য বা ধ্রুব। রুশো অবশ্য পিতৃতন্ত্র, পরিবার ও রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ঠিকমতো বোঝেন নি; রোম্যানটিক হিশেবে তিনি যা কল্পনা করেছেন, যা তাঁর আবেগকে তৃপ্ত করেছে, তাকেই তিনি ধ্রুব বা প্রাকৃতিক বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা একান্তভাবেই প্রাকৃতিক। তিনি বিশ্বাস করেন পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও আইনে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তা মানুষের সৃষ্টি নয়; তা শাশ্বত, প্রাকৃতিক, এবং যুক্তিসঙ্গত। রুশো মনে করেন প্রকৃতিই নারীপুরুষকে ভিন্ন ক’রে সৃষ্টি করেছে, পুরুষকে দিয়েছে যুক্তি ও শক্তি, নারীকে দিয়েছে রূপ; পুরুষ যে কামে সাহসী আর নারী লাজনাম, তা স্থির ক’রে দিয়েছে প্রকৃতিই। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শব্দ দুটি পুরোনো কাল থেকেই বারবার ব্যবস্তৃত হয়েছে নারীর অধীন অবস্থাকে শোভন ও গ্রহণযোগ্য, এবং নারীকে বশীভূত করার জন্যে। রুশো, রোম্যানটিকতার পুরোধা, পুরোধা ছিলেন প্রকৃতিতত্ত্বের। নারী অক্রিয়, অধীন, সতী, যুক্তিরহিত, স্পর্শকাতর, লাজুক, ছলনাময়ী, ও আরো বহু কিছু; একথা পুরুষতন্ত্র রটাচ্ছে অনেক শতাব্দী ধ’রে; আর রুশো এগুলোকে ক’রে তোলেন তাঁর দার্শনিকতার ভিত্তি। নারীর এ-বৈশিষ্ট্যগুলো যে বিশেষ সামাজিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি, তা না মেনে বা না বুঝে রুশো। ধ’রে নিয়েছেন যে প্রকৃতিই নারীকে নির্ভুলভাবে সাজিয়ে দিয়েছে এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে। রুশো প্রকৃতিকে ব্যবহার করে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন নারীর পুরুষাধীন শেকলপারা অবস্থা। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় ‘প্রকৃতি, প্রকৃতি, এবং প্রকৃতি’, এবং ‘প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না’র মতো ধ্রুবপদ। যা কিছু রুশো যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি বা চান নি, তাতেই সহায়তা নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি নামক অবৈজ্ঞানিকতার। প্রকৃতি রুশোর ও রোম্যানটিকদের একটি বড়ো কুসংস্কার; ওই কুসংস্কারের মন্দিরে রুশো বলি দিয়েছেন নারীদের। নারী সম্পর্কে রুশোর ধারণা দু-শো বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছিলেন নারীবাদের প্রথম পুরোহিত, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, তাঁর ‘এ ভিনডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান’ (১৭৯২, পঞ্চম পরিচ্ছেদ) গ্রন্থে।
নারীর প্রকৃতি, ভূমিকা, অবস্থা, শিক্ষা প্রভৃতি নির্দেশ ও ব্যাখ্যা করার জন্যে রুশো লিখেছেন একটি উপন্যাস : জুলি বা ল্য নোভেল এলোইজ (১৭৬১) ও একটি উপন্যাসসন্দর্ভ এমিল বা শিক্ষা (১৭৬২) , এবং নানা সন্দর্ভ। রুশো সভ্যতাবিরোধী, কেননা সভ্যতা নষ্ট করে মানুষকে। এমিল-এর (খণ্ড ১, ৫) শুরুতেই রুশো বলেছেন, ‘বিধাতা সব কিছু সৃষ্টি করে শুভরূপে; মানুষ তাতে হাত দেয়। আর সে-সব হয়ে ওঠে অশুভ।’ তার কাছে শুভ হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক থাকা; রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন মানুষ, ক্রীতদাস, এমনকি কুকুর, আর ঘোড়ার মুক্তির জন্যে, শুধু নারীকে ছাড়া। তিনি নারীর অধীন অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্যে এসব রচনা জুড়ে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে। তিনি নারীকে ক’রে তুলতে চেয়েছেন প্রাকৃতিক নারী, আর পুরুষকে প্রাকৃতিক পুরুষ; কিন্তু পুরুষকে প্রাকৃতিক করার জন্যে যে-রীতি অবলম্বন করেছেন নারীকে প্রাকৃতিক করার জন্যে অবলম্বন করেছেন তার বিপরীত রীতি। নারীকে প্রাকৃতিক করার নামে তিনি করেছেন পুরুষের দাসী। তাঁর এমিল উপন্যাসসন্দর্ভের নায়ক এমিল, আর নায়িকা সোফি, যাদের তিনি দূষিত পৃথিবীর ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে ক’রে তুলতে চেয়েছের প্রাকৃতিক নরনারী। কিন্তু তাদের তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষা। এ-উপন্যাসে মানুষরূপে বিকশিত করা হয়েছে এমিলকে, যে হবে স্বামী; আর নারীরূপে তৈরি করা হয়েছে সোফিকে, যে হবে প্রাকৃতিক পুরুষের অধীনস্থ প্রাকৃতিক স্ত্রী। এমিলকে শেখানো হয়েছে যে ‘পিতৃতান্ত্রিক পল্পীজীবনই মানুষের আসল জীবন, যা সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আর সবচেয়ে প্রাকৃতিক’; আর সোফিকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে : ‘যখন এমিল তোমার স্বামী হবে, তখন সে হবে তোমার প্রভু; প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি অনুগত থাকবে তার’ [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৪)]। রুশোর কাছে নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক ও ধ্রুব (এমিল, ৫:৩২৪) :
‘নারীপুরুষের আপেক্ষিক দায়িত্ব এক নয়, ও এক হতে পারে না। যখন নারী তার ওপর পুরুষের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় অসাম্য সম্পর্কে অভিযোগ করে, তখন নারী ভুল কবে; এ-অসাম্য কোনো মানবিক প্ৰথা নয়, অন্তত এটা কোনো কুসংস্কারের ক্রিয়া নয়, বরং যুক্তিরই ক্রিয়া : যে-লিঙ্গের ওপর প্রকৃতি ভার দিয়েছে সন্তান ধারণের, সে-লিঙ্গ অবশ্যই সে-জন্যে জবাবদিহি করবে। অন্য লিঙ্গের কাছে।‘
স্ত্রীকে হ’তে হবে নিখুঁত সতী, কেননা সে স্বামীর সন্তান ধারণ করে গর্ভে; তবে, রুশোর মতে, স্বামীকে সৎ হওয়ার বিশেষ দরকার নেই। পুরুষকে একশো ভাগ নিশ্চিত হতে হবে তার নারীর গর্ভে জন্মেছে যে-সন্তান, যে হবে তার উত্তরাধিকারী, সে আর কারো নয়, তার। রুশো কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা সহ্য করেন না। এ-কারণে রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে স্থির করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতা ও নৈতিক শিক্ষা।
রুশো তাঁর প্রাকৃতিক নারী শনাক্ত করার জন্যে জোর দিয়েছেন লিঙ্গ বা কামের ওপর। এমিল-এ (৫,৩২১) সোফির শিক্ষা সম্পর্কে রুশো বলেছেন, ‘তার লিঙ্গ ছাড়া, নারী হচ্ছে পুরুষ; তার আছে একই প্রত্যঙ্গ, একই প্রয়োজন, একই গুণ’; এবং একটু পরেই রুশো বলেছেন, ‘তবে যেখানে কাম বা লিঙ্গ জড়িত, সেখানে পুরুষ ও নারী ভিন্ন; তারা পরস্পরের পরিপূরক।’ রুশোর কাছে নারী হচ্ছে নিজের লিঙ্গনিয়ন্ত্রিত; এবং তাঁর মতে, ‘একটি খাটি নারী ও একটি খাটি পুরুষের মধ্যে মুখে যতোখানি মিল রয়েছে মনেও তার চেয়ে একটুকুও বেশি মিল নেই।’ (এমিল ৫:৩২২)। রুশো প্রথম দিকে, অসাম্য সম্পর্কে প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫), মনে করেছেন যে সঙ্গম একটি সহজাত দরকারি ক্রিয়া, যাতে নারীপুরুষ অংশ নেয় স্বাধীনভাবে; কিন্তু পরে কাম উপভোগ রাখেন তিনি পুরুষের জন্যে, নারীকে দেন পুরুষের কাম পরিতৃপ্ত করার দায়িত্ব। পুরুষ হয়ে ওঠে আক্রমণকারী, নারী আক্রান্ত। তবে নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের কাম জাগিয়ে তোলা, তাকে আক্রমণকারী ক’রে তোলা; তাই নারীকে হতে হবে পুরুষের কাছে আবেদনময়ী; নারীকে হ’তে হবে লাজনম্র সতী, কিন্তু তার থাকতে হবে সুখকর ছেনালিপনা। কারণ পুরুষ সতী চায়, আবার নারীর ছলাকলা না থাকলে পুরুষ উদ্দীপ্ত হয় না। রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন, কিন্তু আসলে তিনি প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে প্রাকৃতিক ব’লে মনে করেছেন তাঁর সময়ের ফরাশিদের কামাচরণকে। নারীকে সতী হতে হবে, তবে তা নারীর নিজের জন্যে নয়; পুরুষের কাম জাগানোর জন্যে, কেননা নারীর ‘সতীত্ব প্রজ্জ্বলিত করে পুরুষদের’। রুশোর মতে নারীকে তৃপ্ত করা পুরুষের কাজ নয়, তবে ‘নারীকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের প্রমোদের জন্যে’ (এমিল, ৫:৩২২)। রুশো প্রকৃতিকে পরিণত করেছেন ছেনাল পতিতায়। নারী পুরুষের কাম জাগাবে, পুরুষের কামকে পরমভাবে পরিতৃপ্ত করবে, আবার নারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অতিকামে পুরুষ ধ্বংস হয়ে না যায়। কেননা তাতে- ‘ধ্বংস হয়ে যাবে উভয়েই, আর মানবজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা’ (এমিল, ৫:৩২২)। নারীকে দিয়েছেন রুশো দুটি বিপরীত দায়িত্ব : নারী হবে উর্বশী ও সীতা; নারী প্রলুব্ধ করবে পুরুষকে, আবার নিবৃত্ত করবে তাকে; নারী হবে কামোদীপক, রূপসী, সংরাগপূর্ণ, আবার হবে সুচারু সতী–এক দেহে মেরি ও মেরেলিন মনরো।
রুশোর মতে পুরুষের জীবনে তার লিঙ্গের প্রভাব কম, আর নারীর সম্পূর্ণ জীবনই তার লিঙ্গের পরিণতি; অর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে মানুষ, কিন্তু নারী সব সময়ই নারী। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২৪): ‘পুরুষ কখনো কখনো পুরুষ, নারী সব সময়ই নারী, অন্তত তার যৌবনকাল ভ’রেই নারী; তার সব কিছুই মনে করিয়ে দেয় তার লিঙ্গকে।’ তার মতে সন্তানধারণই হচ্ছে নারীর ‘প্রকৃত কর্তব্য’। তাই নারীকে শিক্ষা দিতে হবে। এমনভাবে, যাতে ‘নারী পরিতৃপ্ত করতে পারে পুরুষকে ও অধীনে থাকতে পারে পুরুষের’; কেননা ‘প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।‘ রুশো প্রকৃতির কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন প্রতারণারূপে; তাঁর নারদর্শনে প্রাকৃতিক কিছু নেই. এর সবটাই পিতৃতান্ত্রিক। রুশো পিতৃতন্ত্রকেই মনে করেছিলেন প্রকৃতি, যদিও তা একটি সুপরিকল্পিত শোষণমূলক ব্যবস্থা। রুশোর অনেক আগে প্লাতো নারীপুরুষকে দিতে চেয়েছিলেন একই শিক্ষা; রুশো তার প্রতিবাদ করেছেন। নায়িকা জুলিকে দিয়ে রুশো বলিয়েছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৮)]; ‘আক্রমণ ও প্রতিরোধ, পুরুষের সাহস আর নারীর লাজনম্রতা, তোমাদের দার্শনিকেরা যেমন ভাবেন তেমন প্রথা নয়, এগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার। এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় সহজেই, এবং এগুলো থেকে বের করা যায় আর সমস্ত নৈতিক ভিন্নতা।’ তাই রুশো এমিল-এর নায়ক এমিলের জন্যে উদ্ভাবন করেছেন এক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা, আর নায়িকা সোফির জন্যে আরেক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা। সোফিকে তৈরি করেছেন তিনি পুরুষের কামসামগ্ৰী, পতির অনুগত সতী স্ত্রী ও সন্তানবৎসল মাতারূপে। এমিলকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে স্বাধীন পুরুষরূপে বিকশিত হওয়ার, সোফিকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এমিলের নারী হওয়ার : এ হচ্ছে রুশোর প্রকৃতির নির্দেশ। রুশো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁর ‘প্রাকৃতিক নারী’র অবস্থান নির্দেশ করেছেন। পুরুষের পদতলে (এমিল, ৫:৩২৮) :
‘নারীপুরুষ সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের জন্যে, তবে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা সমান নয় : পুরুষ নারীর ওপব নির্ভরশীল তার কামনার জন্যে; নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল তার কামনা ও প্রয়োজন দুয়েরই জন্যে; পুরুষ নারী ছাড়া চমৎকার চলতে পারে। কিন্তু নারী পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। পুরুষের সাহায্য, সদিচ্ছা, শ্রদ্ধা ছাড়া নারী তার জীবনের লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারে না; তারা আমাদের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, তা নির্ভর করে আমাদের কাছে তাদের যোগ্যতা, তাদের রূপ আর সতীত্ব কতোটা মূল্যবান বলে মনে হয়, তার ওপর। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে নারীরা, তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জন্যে, পুরুষের বিচারবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।‘
রুশো শোষণমূলক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে প্রাকৃতিক মনে ক’রে নারীর জন্যে এমন দর্শন ও ব্যবস্থা রচনা করেছিলেন, যা মানুষ সম্পর্কে তাঁর দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। রুশো ঘেন্না করতেন তাঁর সময়ের পুরুষদের, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের সহজাত অনন্ত শক্তিতে; মনে করতেন প্রতিবেশ ও শিক্ষার দোষেই বিকাশ ঘটতে পারছে না তাদের শক্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীও রয়েছে পুরুষের নষ্টের মূলে; নারী কাম দিয়ে নষ্ট করছে পুরুষদের। নারীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়েই পুরুষ ব্যর্থ হচ্ছে মহান সব অর্জনে, হারাচ্ছে জ্যোতির্ময় পৌরুষ ও প্রতিভা!
রুশো নারীর বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা তৈরি করেছেন এমিল-এ (৫:৩৩২-৩৪৫), এবং দাবি করেছেন নারীর ওই সব বৈশিষ্ট্য সহজাত। লজ্জা, নমতা, সাজসজ্জা ও অলঙ্কারপ্রিয়তা, অন্যদের খুশি করার স্বভাব, বিনয়, চতুরতা রুশোর মতে নারীর সহজাত; এমনকি অন্যায় সহ্য করারও নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। রুশো মনে করেন দাসীত্ব নারীর জন্যে প্রাকৃতিক; এবং এসব থাকলেই নারী হয়ে ওঠে খাঁটি নারী! রুশোর মতে, নারীকে যেহেতু পুরুষের অনুগত থাকতে হবে, এমনকি অবিচার সহ্য ক’রে বাঁচতে হবে, তাই নারীর থাকা দরকার সহজাত মাধুর্য। নারীর যে রয়েছে মেধা, রুশো তা স্বীকারই করেন না। তিনি বলেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১২৯)], ‘নারী সাধারণত কোনো শিল্পকলা পছন্দ করে না, সেগুলোর কিছু জানে না, এবং তাদের কোনো প্রতিভা নেই। যে-সমস্ত তুচ্ছ কাজে লাগে ত্বরিৎ বোধ, রুচি, শোভা, কখনো কখনো লাগে সামান্য দর্শন ও যুক্তি, সেগুলো তারা পারে। কিন্তু তাদের নেই প্ৰতিভার অলৌকিক শিখা’। রুশোর নারীর কোনো মেধা নেই, সে কামসামগ্ৰী; নারী হবে স্ত্রী ও মা, তাই তার থাকতে হবে মেধা ছাড়া সমস্ত মেয়েলি গুণ। নারীর মেধাহীনতা সম্পর্কে রুশোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য পুরোপুরি উদ্ধৃত ক’রে, একবার ‘কী ছাইপাশ’ ব’লে, রুশোকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্ (১৭৯২, ১২৪, ও পঞ্চম পরিচ্ছেদ)। নারীর মেধাশূন্যতা সম্পর্কে রুশোর সারকথা (এমিল, ৫: ৩৪৯-৩৫০) :
‘বিমূর্ত ও প্রকল্পনিক সত্য অনুসন্ধান, বিজ্ঞানের নীতি ও সূত্র উদঘাটন, যা কিছুতে দরকার পড়ে চিন্তার সাধারণীকরণ, তা নারীর আয়ত্তের বাইরে; তাদের বিদ্যা হবে ব্যবহারিক, তাদের কাজ হচ্ছে পুরুষের আবিষ্কৃত সুত্র প্রয়োগ করা, এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সব পর্যবেক্ষণ করা, যা ভিত্তি ক’রে পুরুষ রচনা করবে সাধারণ সূত্র। নারীর সমস্ত ভাবনা চলবে পুরুষকে ঘিরে, এবং তারা আয়ত্ত করার করার চেষ্টা করবে সে-সব সুখকর সাফল্য, যা সুন্দর; কেননা প্ৰতিভার কাজ তাদের আয়ত্তের বাইরে। তাদের নেই বিজ্ঞানে সফল হওয়ার মতো যথেষ্ট যথাযথতা বা মনোযোগশক্তি, আর পদার্থবিদ্যায় সফল হতে পাবে তারাই, যারা সক্রিয়তম, চবম অনুসন্ধিৎসু, যারা অনুধাবন করতে পারে বিচিত্র ধরনের বস্তু, এটা তাদের এলাকা, যাদের রয়েছে। তীব্ৰতম শক্তি, যারা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য সত্তা ও প্রকৃতির নিয়মের সম্পর্ক বিচাবের জন্যে চরমভাবে প্রয়োগ করে তাদের শক্তি। নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল,এবং নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না।… নারীর আছে বোধশক্তি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী পর্যবেক্ষণ করে, পুরুষ প্রয়োগ করে যুক্তি।’
রুশোর মতে, ‘চিন্তার ব্যাপারটি নারীদের অচেনা নয়, তবে তাদের উচিত যুক্তির ওপরে শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া’; তাই রুশোর কাছে নারীর মানসিক শক্তির কোনো মূল্য নেই। রুশোর বিধান হচ্ছে নারীকে শরীর-মনে হ’তে হবে তাই, পুরুষ তাকে যা হওয়াতে চায় : নারী হবে পুরুষের সহচরী বা সহকারী বা রক্ষিতা। গবেষণাগারে পুরুষ হবে বৈজ্ঞানিক, আর নারী, বড়োজোর, হবে তার গবেষণা সহকারী।
নারী স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীর কোনো দরকার ছিলো না, পুরুষ আছে বলেই নারী দরকার। বাইবেলের বিধাতা ও রুশোর মধ্যে রয়েছে সুন্দর মিল; বিধাতা স্বর্গে একটি পুরুষ সৃষ্টির পর তার সহচরী বা পত্নীরূপে সৃষ্টি করে একটি নারী। রুশোও এমিলকে সৃষ্টি করার পর, বইয়ের চারখণ্ড জুড়ে তাকে বিকশিত ক’রে, পঞ্চম খণ্ডে এসে এমিলের জন্যে সৃষ্টি করেন একটি নারী, যার নাম সোফি। এমিল-এর পঞ্চম খণ্ডের নাম ‘সোফি, বা নারী’। এ-খণ্ডের (৫:৩২১) শুরুতেই বিধাতার স্বরে রুশো বলেন, ‘পুরুষের একলা থাকা ভালো নয়। এমিল এখন পুরুষ, এবং তাকে আমাদের দিতে হবে তার প্রতিশ্রুত পত্নী [হেল্প্মিট : সহচরী]। সে-পত্নী হচ্ছে সোফি।’ রুশো নারীকে দেখেছেন। পুরুষের পত্নী বা সহকারী-সহচরীরূপে, নারীকে হতে হবে এই অন্য কিছু হওয়া নারীর জন্যে অশুভ। রুশো তাঁর জুলি বা ল্য নভেল এলোইজ-এর নায়িকা জুলিকে করেছেন নিজের কণ্ঠস্বর; ওই নারী তার প্রেমিককে উচ্চকণ্ঠে জানায় যে নারীপুরুষের সমশিক্ষা সম্বন্ধে প্লাতো যা বলে গেছেন, তা ভুল; কারণ প্রকৃতির উদ্দেশ্য” ও ‘স্রষ্টার অভিলাষ’ থেকে স্পষ্ট যে নারীপুরুষ একধরনের নয় [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৩২)]। প্রকৃতি আর স্রষ্টা নারীর নিয়তিই করেছে মাতৃত্ব, সন্তানলালন ও ঘরকন্ন; পুরুষের জন্যে রেখেছে বাইরের জগতের সাফল্য; তাই ‘এক লিঙ্গের আরেক লিঙ্গকে অনুকরণ করা চরম নির্বুদ্ধিতা’। রুশোর কোনো উৎসাহ ছিলো না নারীর শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে; তিনি চেয়েছেন নারীকে পুরুষের অধীনে পুরুষের পরিপূরক ক’রে গড়ে তুলতে। বালিকাদের মধ্যে তিনি মাঝেমাঝে পরিচয় পেয়েছেন বুদ্ধির, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে বালিকাদের ওই বুদ্ধিটুকু বিধাতা দিয়েছেন তাদের সতীত্বের দামি রত্নটিকে রক্ষা করার জন্যে। জুলি বলেছে, নারীর রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সম্পদ, যার নাম সতীত্ব, আর তাদের বুদ্ধি দরকার শুধু ওই সম্পদটিকে রক্ষার জন্যে। রুশোর কাছে নারীপুরুষ, নৈতিক ও মননগতভাবে, পরস্পরের পরিপূরক; একা তারা অসম্পূর্ণ, কিন্তু একত্রে তারা গড়ে তোলে এক সম্পূর্ণ সুষম সত্তা। নারীর আছে সামান্য স্ত্রীবুদ্ধি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী শুধু দেখে, পুরুষ রচনা করে আভ্যন্তর সূত্র। রুশোর মতে, নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক না হ’লে বিয়ে ব্যাপারটি হবে বিপদসঙ্কুল, এবং বিপদগ্ৰস্ত হবে সামাজিক স্থায়িত্ব। পরিপূরক শব্দটি বেশ প্রতারক; নারী ও পুরুষ ঠিক তেমন পরিপূরক পরস্পরের যেমন পরিপূরক প্ৰভু ও দাস, ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্ৰ।
রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে দু-রকম শিক্ষার প্রস্তাব করেছেন। পুরুষকে দিয়েছেন তিনি এমন শিক্ষা, যাতে সে হয়ে ওঠে নাগরিক বা স্বাধীন-প্ৰাকৃতিক মানুষ, আর নারীকে দিয়েছেন এমন শিক্ষা, যাতে নারী স্বাধীন বা প্রাকৃতিক হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে পুরুষের অনুগত স্ত্রী। তাকে শেখাতে হবে লােজনম্রতা, গৃহপালন, আর প্রথার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ বেড়ে ওঠে মুক্ত মানুষরূপে, নারী বেড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিতভাবে, তার জীবনের উদেশ্য অনুসারে। তাই এমিল বেড়ে উঠেছে তার মাতারূপে। রুশো নারীর জন্যে প্রস্তাব করেছেন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উপযোগিতামূলক শিক্ষা, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয় (এমিল : ৫ ) :
‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হবে পুরুষের আপেক্ষিক। তাদের খুশি করা, তাদের কাছে উপকারী হওয়া, তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হওয়া, শিশুকালে তাদের লালন করা, বয়স্ককালে তাদের যত্ন করা, তাদের পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেয়া, তাদের জীবনকে মধুর ও সুন্দর করা হচ্ছে নারীর সব সময়ের দায়িত্ব, এবং শিশুকালেই তাদের এসব শেখাতে হবে। এ-নীতি আমরা যতোটা অমান্য করবো, ততোটা বিচ্যুত হবো। আমাদেব লক্ষ্য থেকে, এবং এছাড়া আর যে-শিক্ষাই নারীদের দেয়া হোক-না-কেনো, তা তাদের বা আমাদের জন্যে সুখের হবে না।’
তাই নারীকে কোনো মননগত শিক্ষা দেয়া যাবে না, তাদের দিতে হবে নারীশিক্ষা। নারী মেনে চলবে স্বামীর অধীনতা, লালন করবে সন্তানদের। সতী নারী থাকবে কোথায়? রুশোর উত্তর হচ্ছে, নারী জীবন কাটাবে অবরোধের মধ্যে। রুশোর মতে, ‘সম্পূর্ণ অবরোধ ও গৃহিণীপনার মধ্যে জীবন কাটানোই নারীর জন্যে প্রকৃতি ও যুক্তির বিধান’। পেরিক্লেসের আদর্শে তিনি আস্থা পোষণ করেন যে সেই উৎকৃষ্ট নারী, যার সম্পর্কে কেউ কখনো কোনো কথা বলে না। রুশো শিক্ষা দিয়ে নারীকে অভ্যস্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন অধীনতার মধ্যে বাস করতে। এ-উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছেন মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল বিধান (এমিল, ৫:৩৩৩) :
‘নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে একরকম বশমানা ভাব, যা নারীর দরকার সারা জীবনভর, কেননা সে সারা জীবন থাকবে পুরুষের অধীনে, বা পুরুষের বিচারবিবেচনার অধীনে, এবং সে কখনো পুরুষের মতের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না নিজের মত। নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার ভদ্রতা; নারী তৈরি হয়েছে পুরুষ নামক এমন এক ক্রুটিপূর্ণ, এমন এক দুশ্চরিত্র ও ভ্ৰান্তিপূর্ণ প্রাণীর কাছে অনুগত থাকার জন্যে যে নারীকে শিশুকালেই শিখতে হবে অন্যায়ের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে এবং বিনাপ্রতিবাদে স্বামীর সমস্ত অন্যায় সহ্য করতে।‘
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণামূলক দর্শন রচনা করেছেন যে-দার্শনিক, তিনি নারীর জন্যে বিধান তৈরি করেছেন। পুরুষের অধীনে থাকার, অন্যায়ে অভ্যস্ত হওয়ার। তবে রুশো বিপদে পড়েছেন তার নারী নিয়ে। নারীকে তিনি একই দেহে করতে চেয়েছেন কামোদ্দীপক যৌনসামগ্ৰী ও পরম সতী; কিন্তু দেখেছেন এমন নারী তাঁর প্রাকৃতিক পুরুষের প্রাত্যহিক সাথী হ’তে পারে না। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ ও আবেদনময়ী সতীর নিয়তি হচ্ছে অধিকাংশ সময় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা!
রুশোর প্রাকৃতিক নারী প্রাকৃতিক নয়, বানানো; রুশোর নারী পুরুষতন্ত্রের কলে উৎপাদিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় সামগ্ৰী। রুশো প্ৰবক্তা সাম্যমুক্তির; তবে তাঁর দর্শনে সাম্যমুক্তির মতো মানবিক ব্যাপারগুলো পুরুষের জন্যে, নারীর জন্যে নয়। মানুষের অসাম্যে ক্ষুব্ধ রুশো উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন এমন সামাজিক-রাজনীতিক পদ্ধতি, যাতে দূর হবে মানুষের অসাম্য। রুশো অবশ্য বৈজ্ঞানিকের বস্তুনিষ্ঠ চোখে, মার্ক্সের মতো, অসাম্যকে দেখেন নি, দেখেছেন ব্যক্তিগত মন্ময় দৃষ্টিতে; অসাম্য সম্পর্কে তাঁর ঘৃণা জন্মেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। রুশো অসামাবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) দেখিয়েছেন কীভাবে আদিম স্বাধীন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের ফলে সমাজে উৎপত্তি ঘটে অসাম্যের। রুশো বলেছেন [ দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪২)] :
‘অগণন মানুষ বলি হবে মুষ্টিমেয়র কাছে, আর সাধারণের সুবিধা বলি হবে ব্যক্তিগত সুবিধার কাছে। সুবিচার ও অধীনতার মতো আপাতসুন্দর শব্দগুলো সবসময় কাজ করবে সন্ত্রাসের উপকরণ ওঅবিচারের অন্ত্ররূপে; এভাবে উচ্চশ্রেণীগুলো, যারা নিজেদের পাবি করে অন্যদের জন্যে উপকারী ব’লে, আসলে অন্যদের শুষে সেবা করছে নিজেদের।‘
রুশোর মতে বেশি শক্তি বা সম্পদ কাউকে বৈধ অধিকার দিতে পারে না। তাঁর বিশ্বাস প্রকৃতি একজনকে দেয় নি অন্যের ওপর প্রভুত্বের অধিকার, এবং কেউই বলপ্রয়োগে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। রাজনীতিক আধিপত্যের সমস্যাটির বৈধ সমাধান হতে পারে শুধু সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে, যাতে মানুষের অভিলাষ হয়ে ওঠে। সার্বভৌম। এমন চুক্তি ছাড়া রাজনীতিক ব্যবস্থা হয় ‘উদ্ভট, স্বৈরাচারী’। রুশো পুরুষের জন্যে চান সার্বভৌম অভিলাষ, কিন্তু নারীকে রাখেন পুরুষের উদ্ভট স্বৈরাচারের অধীনে।
রুশো বিশ্বাস করেন সব পুরুষের অসীম সম্ভাবনায়; তিনি মনে করেন সুযোগ পেলে ভূমিদাসও ভূষিত হতে পারে জমিদারের সমস্ত গুণে। রুশোর কাছে ক্রীতদাসত্ব সম্পূর্ণ অবৈধ; কেননা ক্রীতদাসত্ব মনুষ্যত্বের অবমাননা; এতে একটি মানুষ নিজের জীবন, স্বাধীনতা, অধিকার সমর্পণ করে আরেকটি মানুষের কাছে। প্রকৃতি মানুষের এমন স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার বিরোধী। কিন্তু সাম্যমুক্তির এ-প্রচণ্ড প্রবক্তা নারীর ক্ষেত্রে ভুলে যান সাম্যমুক্তির কথা; তিনি সাম্যমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। তিনি নারীর ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ করেন অসাম্য ও অধীনতা। রুশোর মতে, নারী অধীনে থাকবে পুরুষের, আর পুরুষকে বশে রাখার জন্যে ব্যবহার করে যাবে তার রূপ, বুদ্ধি, বোধি; এর সাহায্যেই নারী ক্ষতিপূরণ করে নেবে নিজের অসাম্য ও অধীনতার। রুশোর কাছে পুরুষ শক্তিমান আর নারী পুরুষের অধীন, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য; নারী জীবনযাপন করবে। এ-সত্য মেনে নিয়ে রুশোর চিন্তায় নারীর রাজনীতিক অধিকারের কথাই ওঠে নি; নারীর ভোটাধিকারের কথা তিনি ভাবেন নি। ‘জেনেভার মধুর ও সতী নারীদের’ তিনি বলেছেন যে তাদের নিয়তি হচ্ছে পুরুষদের শাসন করা, অর্থাৎ তারা প্রভাব বিস্তার করবে স্বামীদের মাধ্যমে। রুশোর রাজ্যে পুরুষ রাজা শাসন করবে, আর রাজাকে নিজের ‘সতীত্বের শক্তি’তে শাসন করবে নারী! নারী সতী আর অনুগত হয়ে পুরুষের ওপর বিস্তার করবে। ‘আনুগত্যমূলক আধিপত্য’! এই হচ্ছে নারীর রাজনীতিক অধিকার। শুধু রাষ্ট্রে নয়, রুশোর বিধানে পরিবারের মধ্যেও নারীর কোনো কর্তৃত্ব নেই, স্বামীই পরিবারের প্রভু। রুশোর কাছে পরিবার একটি প্রাকৃতিক সংস্থা, তার প্রাকৃতিক প্ৰভু স্বামী। রুশো বলেছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪৬), ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের’; আর ‘জীবন ধারণ করবে তার স্বামীর নিরঙ্কুশ আইনের অধীনে।’ পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ছলেবলে খুশি রেখে অর্জন করবে সামান্য ক্ষমতা। রুশো যে-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা মোটেই প্রাকৃতিক নয়; তা একটি সুশৃঙ্খল, সম্পদভিত্তিক, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। রুশোর মতে, পরিবারে কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েবই থাকতে পারে না, কেননা পরিবারে থাকা দরকার একজন প্রধান, যে নোবে সমস্ত সিদ্ধান্ত। সাধারণ অভিলাষের এ-প্রবক্তা পরিবারের মতো একটি সংস্থায়ও সাধারণ অভিলাষের মূল্য দেন নি। রুশো নারীকে পুরুষের অধীনে রাখতে চেয়েছেন নারীর গর্ভধারণের জন্যেও, কারণ তখন নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; রুশোর মতে, ‘নারীকে কর্তৃত্ব না দেয়ার এ-ই যথেষ্ট কারণ।’ আরেকটি কারণেও পুরুষের অধীনে রেখেছেন তিনি নারীকে, তা হচ্ছে নিশ্চিত পিতৃত্বের পরিচয়; পুরুষকে ঠিকমতো বুঝে নিতে হবে তার নারীর গর্ভে যারা জন্মাচ্ছে তারা তার কিনা? নারীপুরুষের সাম্য স্বীকার না করার পেছেনে ছিলো রুশোর একটি গোপন ভীতি। রুশোর ভয় হচ্ছে যদি পুরুষের অধীনে না রাখা হয় নারীকে, তাহলে নারী পুরুষের ওপর স্থাপন করবে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। রুশোর বিশ্বাস ছিলো যে নারীকে প্রকৃতি দিয়েছে এমন কামক্ষমতা, যা দিয়ে নারী বশীভূত পরাভূত ক’রে রাখতে পারে পুরুষকে; নারী পুরুষকে ক’রে তুলতে পারে অসহায়। অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী নিয়ন্ত্রক। রুশো নারীভীতি পেয়েছেন ঐতিহ্য থেকে; নারীকে দেখেছেন তিনি কামদানবী অশুভ শক্তিরূপে। একটি কবিতায় নারীকে সম্বোধন ক’রে রুশো লিখেছিলেন, ‘সম্মোহিনী ও ভয়ঙ্করী, যাকে আমি পুজো আর ঘৃণা করি,… পুরুষকে যে পরিণত করে ক্রীতদাসে।’
রুশোর দর্শনে সাম্যের মতোই মূল্যবান মুক্তি বা স্বাধীনতা; তবে সাম্য যেমন পুরুষের ব্যাপার, মুক্তিও পুরুষেরই ব্যাপার, নারীর নয়। নারীর মুক্তি খুঁজেছেন রুশো পুরুষের পায়ে; মুক্তি নারীর জন্যে নয়, নারীকে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করেছেন পুরুষের অধীনে। রাজনীতিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) রুশো [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৫৪)] বলেছেন, ‘শুধু স্বাধীন মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব স্পষ্ট; স্বাধীনতা মানুষের গুণাবলির মধ্যে মহত্তম’; এবং ‘স্বাধীনতা অস্বীকার করা মনুষ্যত্ব অস্বীকার করা, মনুষ্যত্বের অধিকার, এমনকি তার দায়িত্ব, বর্জন করা। এমন অস্বীকার অসামঞ্জস মানুষের প্রকৃতির সাথে, এবং তার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে তার নৈতিকতা হরণ করা।’ তবে রুশো হরণ করেছেন নারীর স্বাধীনতা ও নৈতিকতা দু-ই, কেননা রুশোর চোখে নারী মানুষ নয়, মেয়েমানুষ। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২২), ‘দু-লিঙ্গের মিলনে প্রত্যেকে কাজ করে একই উদ্দেশ্যে, তবে ভিন্ন উপায়ে। তারা ‘ভিন্ন উপায়ে’ কাজ করে, কেননা তারা ভিন্ন; একজন প্ৰভু, আরেকজন তার দাসী। ‘ভিন্নতা’ ধারণাটিও প্রতারক, নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন বলার অর্থ হচ্ছে নারী ‘নিকৃষ্ট’। রুশোর কাছে পুরুষ হচ্ছে শক্তিমান ও সক্রিয়, নারী দুর্বল ও অক্ৰিয়। তাই নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, কেননা পুরুষ শক্তিমান; রুশোর কাছে শক্তিমানের অধীনে থাকাই প্রকৃতির বিধান। কিন্তু ফরাশি বিপ্লবেও নারী পালন করেছিলো অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা, যদিও ওই বিপ্লবের দার্শনিক বলেছেন নারী দুর্বল ও অক্রিয়! নারী রুশোর দর্শনের জন্যে শোচনীয় এলাকা, এ-এলাকায়ই রুশো এমনভাবে পদস্থলিত হয়েছেন যে তার অজ্ঞাতে তার দর্শনের মূল বক্তব্য বাতিল হয়ে গেছে। রুশো নারীর স্বাধীনতা পুরোপুরি অস্বীকার ক’রে নারীকে করেছেন। পুরুষের ক্রীতদাসী, যার কাজ পুরুষের বিনোদ যোগানো ও সেবা করা। রুশোর নারী প্রাকৃতিক নয়, স্বাধীন নয়, তা পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে বানানো পুরুষভোগ্য সামগ্ৰী। রুশো নারী সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সামান্যও অভিনব নয়; পিতৃতন্ত্রের সমস্ত পুরোনো গ্রন্থে এসব বিধিবিধান অনেক আগেই প্রণীত হয়েছিলো; রুশো শুধু সেগুলোকে রোম্যানটিক রীতিতে প্ৰকাশ ক’রে আঠারো-উনিশ শতকের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ক’যে তুলেছিলেন, এবং নারীকে বেঁধেছিলেন নতুন শক্ত শোকলে।
সামাজিক ভাবে রুশোর অভিমত টি পুরো পুরি না মানা হলেও আজ তার মত আমি কিছুটা মানি।কারণ আজকের কিছু নারি পুরষদের কে হাতের পুতুল বানাতে আগ্রহী।নিজ কামনার মোহে তারা তাদের সতীতো বিকয়ে দেই। আর পরে ছেলেদের দোশারোফ করে। বোন সন্মান আপনার আর তা রক্ষা করার দায়িক্ত ও আপনারই।