নারীর শত্রুমিত্ৰ : রুশো, রাসকিন, রবীন্দ্রনাথ, এবং জন স্টুয়ার্ট মিল
পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা; তৈরি করেছে ধর্ম, দর্শন, আইন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা; এবং পৃথিবী ভ’রে জন্ম দিয়েছে তার প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ প্রতিভাদের। ওই প্রতিভারা মনীষী, মানুষপ্ৰজাতির গৌরব; অমর তাঁরা। তাঁদের স্তবে মুখর মানুষ; পুরুষেরা মুখর, পুরুষের কাছে শুনে শিখে নারীরাও মুখর। পুরুষ নারীদের এমনভাবে ছাঁচে ফেলে নিজেদের উপযুক্ত ক’রে নিয়েছে যে নারীরা স্তব করে নিজেদের শত্ৰুদেরও। পুরুষ প্রতিভারা বিকাশ ঘটিয়েছেন সভ্যতার, মানুষপ্ৰজাতির অনন্ত সম্ভাবনার প্রতিমূর্তি তারা; তাদের ছাড়া মানুষের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস অন্ধকার। মহাকালের আলোকশিখা তারা; বাল্মীকি, ব্যাস, হোমার, সফোক্লিস, প্লাতো, আরিস্তাতল, দান্তে, শেক্সপিয়র, কনফুসিয়াস, রুশো, রবীন্দ্রনাথের মতো অজস্র শিখায় উজ্জ্বল সৌরলোক। ওই শিখার পুরুষের শিখা, ওই প্রতিভার পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি, ওই মনীষীরা সবাই পুরুষতন্ত্রের পুরোহিত। তারা, প্রায়-সবাই, মানুষ বলতে বুঝেছেন নিজেদের লিঙ্গকে অর্থাৎ পুরুষকে; নারীকে মনে করেছেন। শুধুই নারী, মানুষ নয় বা বিকলাঙ্গ মানুষ। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে জন্মেছেন যতো মহাপুরুষ, তারা সবাই মগজ চূৰ্ণবিচূর্ণ ক’রে ভেবেছেন পুরুষের বিকাশ, প্রতিষ্ঠা ও মহিমার কথা, নারীকে করেছেন উপেক্ষা; আর যখন নারীর কথা ভেবেছেন, তখন তাৰে- দেখেছেন অবিকশিত মানুষরূপে, যার কোনো স্বায়ত্ত্বশাসিত অস্তিত্ব নেই। তাঁদের কাছে নারী হচ্ছে পুরুষের পাদটীকা। তাঁরা রচনা করে গেছেন বহু বাণী, ওই বাণী পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছে এবং পেছনের দিকে টেনে ধরেছে; তাদের উদঘাটিত অনেক সত্য আলো দিয়েছে, আবার তাদের অজস্র মিথ্যা অন্ধকার ক’রে রেখেছে মানুষের চারপাশ। ওই অন্ধকার কেটে নতুন আলো সৃষ্টি করতে লাগছে দীর্ঘ সময়, ওই অন্ধকার রখনো কাটে নি। নারী সম্পর্কে তারা ছড়িয়েছেন অন্ধকার, রচনা করেছেন অভিনব অনন্ত কুসংস্কার; আর পুরুষতন্ত্র তাদের অন্ধকার ও কুসংস্কারে ঢেকে রেখেছে নারীকে। প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের মনীষীদের নারীবিষয়ক সমস্ত সিদ্ধান্ত ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল, এবং নারীদের জন্যে অশেষ ক্ষতিকর। নারীদের সম্পর্কে পুরুষরা বইয়ের পর বই লেখে, বিধানের পর বিধান দেয়। ভার্জিনিয়া উলফ (১৯২৯, ৪০-৪১) নারীদের সম্বোধন ক’রে বলেছেন :
‘আপনাদের কি ধারণা আছে প্ৰত্যেক বছর নারীদের নিয়ে কতো বই লেখা হয়? আপনাদের কোনো ধারণা আছে তার কতোগুলো পুরুষের লেখা? আপনারা কি অবগত যে আপনারা, সম্ভবত, মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্ৰাণী?… নারী আকর্ষণ ক’রে সাধারণ প্রাবন্ধিকদের, লঘু ঔপন্যাসিকদের, এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত তরুণদের; এবং সে-সব পুরুষদের যাদের কোনো ডিগ্রি নেই; যাদের একমাত্ৰ যোগ্যতা হচ্ছে তারা নারী নয়।‘
পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের চোখে পুরুষ সূর্য ওই পুরুষ-সৌরলোকে নারী তুচ্ছ অবজ্ঞেয় গ্রহের মতো, যে জীবন পেয়েছে পুরুষসূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার জন্যে। তারা কখনো মুখর হয়েছেন নারীনিন্দায়, নারীর মুখে মেখে দিয়েছেন সবচেয়ে কালো কলঙ্ক, এমন কোনো অপবিশেষণ নেই যাতে তারা নারীকে তিরষ্কার করেন নি। তারা তৈরি করেছেন নারীকে বেঁধে রাখার শক্ত শেকল; আর যারা একটু নারী ও আবেগকাতর, নৃশংস হ’তে যারা কুষ্ঠা বোধ করেছেন, তাঁরা নারীকে পরিণত করেছেন। পোষা আদুরে বেড়ালে। তাঁদের কাছে নারী বিশেষ উপযোগী প্ৰাণী, যাকে সম্ভোগ করা যায়, যে সন্তান জন্ম দিয়ে টিকিয়ে রাখে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে; এ ছাড়া নারীর আর কোনো উপযোগিতা নেই তাদের কাছে। নারী যে মানুষ, পুরুষের মতোই মানুষ বা পুরুষ তারই মতো মানুষ, পুরুষের মতোই যে নারী সম্ভাবনাময়, এটা মনে হয় নি তাদের : নারীকে তাঁরা ক’রে রাখতে চেয়েছেন। পুরুষের দাসী, ভোগ্যপণ্য, তৃষ্ণার শান্তি। এ-লক্ষ্য থেকে তারা যা-কিছু লিখেছেন, সে-সবকে বলা হয় দর্শন, কাব্য, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা! ওই প্ৰতিভারা সবাই নারীর শত্ৰু, কেউ হিংস্রভাবে, মনোরমভাবে কেউ কেউ নারীর দিকে পাথর ছুঁড়েছেন, কেউ আলিঙ্গন করতে গিয়ে পিশে মেরেছেন নারীকে। নারীর শক্রতে ভ’রে আছে সময় ও সভ্যতা; নারীর মিত্র বেশি নেই, উনিশ শতকের আগে মিত্ররা দেখা দেন নি। পুরুষতন্ত্রের প্রতিভারা নারীদের বিরুদ্ধে ও বশে রাখার জন্যে লিখেছেন হাজারহাজার পৃষ্ঠা, খণ্ডখণ্ড রচনাবলি, পেয়েছেন অমরতা; তারা নারী সম্পর্কে সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ধারণা, যদিও ওগুলোকে পরম সত্য বলে পুজো করা হয়েছে শতকের পর শতক। এখনো করা হয়। তাদের সবার মত বিচার করা অসম্ভব ও নিরর্থক; খুব পুরোনো মনীষীদেব মতও বিচার করার দরকার নেই। আধুনিক সময়ের পুরুষতন্ত্রের প্রতিভাদের কয়েকজনের মত বিচার করলেই আধুনিক পিতৃতন্ত্রের নারীদর্শনের রূপটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। আমি বেছে নিচ্ছি চারজনকে : রুশো। [১৭১২-১৭৭৮], রাসকিন (১৮১৯-১৯০০), রবীন্দ্ৰনাথ (১৮৬১–১৯৪১), যারা পড়েন নারীদের শক্রগোত্রে; এবং মিলকে (১৮০৬—১৮৭৩), যিনি নারীদের মহান মিত্ৰ।
এ-চারজনকে অকারণে নিচ্ছি না, নিচ্ছি বিশেষ কারণে। মানবমুক্তি ও সাম্যের রোম্যানটিক দার্শনিক জ্যাঁ-জাক রুশোর প্রভাব পড়েছে পৃথিবী জুড়ে, তার চোখেই তথাকথিত আলোকপ্ৰাপ্তরা নারীর মুখ দেখছে দু-শো বছর ধরে। রুশো সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে অধিকাংশের:- যেহেতু তিনি চেয়েছিলেন মানুষের মুক্তি, তাই অনেকেরই ধারণা যে তিনি চেয়েছিলেন নারীরাও মুক্তি, কেননা নারী মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিস্ময়কর ও শোকাবহ সত্য হচ্ছে যে মানুষের সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক চেয়েছিলেন পুরুষের সাম্যমুক্তি। নারীকে তিনি প্ৰবল উৎসাহে ধার্মিকের মতো বলি দিয়েছিলেন পুরুষের যুপকাঠে। নারীর বেলায় রুশো পাড় প্রতিক্রিয়াশীল, নারীর তিনি অদ্বিতীয় শত্ৰু। জন রাসকিন ছিলেন ভিক্টোরীয় কপট নৈতিকতার এক বড়ো প্ৰবক্তা; নারীকে ‘রানী’ বলে ডেকেডেকে বেঁধে রাখার কৌশল বের করেছিলেন তিনি। তার প্রতিক্রিয়াশীল নারীবিষয়ক বক্তব্য নারীমুক্তির বাধারূপে কাজ করেছিলো পশ্চিমে; এবং তার প্রভাব পড়েছিলো। উনিশ শতকের শেষভাগের শিক্ষিত বাঙালির ওপরও। তারা নারীকে দেখেছিলেন কপট রাসকিনের চোখে। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আধুনিক বাঙালির ওপর অশেষ। রোম্যানটিক এ-মহাকবিকেও মনে করা হয় মানুষের মুক্তির মহাপুরুষ ব’লে, কিন্তু তিনিও পুরুষেরই মহাপুরুষ। তিনিও নারীকে সম্পূর্ণ মানুষরূপে গণ্য করেন নি; নারীকে তিনি ধারাবাহিকভাবে বিসর্জন দিয়েছেন নারী নামক এক ভুল ধারণার পায়ে। রবীন্দ্রনাথ রুশো ও রাসকিনের মিশ্রণ, আবার তাতে লাগিয়েছেন ভারতীয় ভেজাল; এবং হয়ে উঠেছেন নারীর মুক্তির এক বড়ো প্রতিপক্ষ। পশ্চিমে প্রথম নারীদের পক্ষে যে-পুরুষ যুদ্ধে নেমেছিলেন, পুরুষতন্ত্রের সমস্ত কপটতা ও মিথ্যাচার উদঘাটন ক’রে নারীমুক্তির পথটিকে প্রশস্ত করেছিলেন, তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল। স্টুয়ার্ট মিলের পথ ধ’রেই দেড় দশক পরে এসেছিলেন এঙ্গেলস, যিনি সম্পূর্ণ প্রগতিশীল, এবং যাঁর পিতৃতন্ত্রের ভাষ্যের পরিচয় আমি আগেই দিয়েছি। এ-চারজনের পরিচয়েই ধরা পড়ে নারীর সাথে আধুনিক পিতৃতন্ত্রের শত্রুমিত্রতার রূপটি।