হোগলা বনে
ছপ ছপ ছপ। কে যেন এগিয়ে আসছে। হোগলার বনে আবছা অন্ধকার । সবুজ পাতাগুলো ঠাসাঠাসি ভাবে মিশে আছে । চৈতা মুখ লুকিয়ে ফেলে পাতার আড়ালে। বাঘ আসছে নাকি! বাদাবনে পায়ে পায়ে মৃত্যু। কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে হলুদ ডোরাকাটা বাঘ। হরিণের পাল কমে আসছে হু হু করে। এখানকার বাঘেরা তাই খিদের জ্বালায় এখন মাছ খায়। পারশে, ভেটকি, গলদা চিংড়ি। নদীতে মাছের খোজে প্রায়ই বাঘদের আসতে দেখা যায়। চৈতা ভালো করে কান পেতে শব্দটা শোনার চেষ্টা করে। না, কোনো গাছ কাটার শব্দ না । উত্তরের দিক থেকে আসছে শব্দটা। ছপ ছপ ছপ । চৈতা এসেছে হোগলা পাতা কাটতে। এই পাতাগুলো দড়ি দিয়ে সেলাই করে ছই তৈরি করা হয়। হাটে নিয়ে বিক্রি করে ছই। বাদাবনের মাঝিরা কিনে নিয়ে যায় । পয়সা দিয়ে চাল, তেল, মশলা কিনে আনে চৈতা। বাদাবনের এক কোণায় চৈতাদের হোগলা পাতার ছাউনি দেয়া কুঁড়ে । বুড়ি দাদি ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই। আকালের বছর না খেতে পেয়ে সবাই মরেছে। কোনোমতে শাকপাতা চিবিয়ে, গেঁড়ি শামুক হলুদ গোলা পানিতে সেদ্ধ করে খেয়ে টিকে রয়েছে চৈতা আর তার বুড়ি দাদি। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় চমৎকার গল্প বলতে পারে বুড়ি।
ধলপহর থাকতেই চৈতা চলে এসেছে হোগলা বনে। এতক্ষণ কাস্তে দিয়ে হোগলা পাতা কেটে জড়ো করে রেখেছে। আর কিছু জমালেই বাড়ির দিকে রওনা দিত। এমন সময় এই শব্দ। বাদাবনের শব্দকে বড্ড ভয় করে চৈতা। একবার তার পাশের লোকটাকে থাবা দিয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বাঘ। পরদিন লাল শাপলার বনের কাছে তার শরীরের কিছু অংশ ভাসতে দেখা গিয়েছিল।
কয়েকটা জলপিপি শাপলা পাতার ওপর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে যাচ্ছে। তার মাঝে ভাসছে লাশ। শালতি ডিঙ্গিতে সেখান দিয়ে ভেসে যাবার সময় দৃশ্যটা দেখেছিল । ছপ ছপ ছপ। মনে হচ্ছে কোনো মানুষ যেন আসছে। হোগলা পাতার ঝোপ থেকে একটুখানি মুখটা বের করে আনে চৈতা। উসখুসু চুলের একটা মানুষ। লম্বাটে মুখ। হাতে বেতের ঝুড়ি। লোকটাকে আগে আর কখনও বাদাবনে দেখেনি চৈতা। ওপাশের শরখড়ির ঝোপের কাছ থেকে নিচু হয়ে কি যেন তুলে তুলে ঝুড়িতে রাখছে। চৈতা চুপিচুপি এগিয়ে যায়। লোকটা কাছিমের ডিম তুলছে। বাদাবনের নদীর ধারে যেসব ফণিমনসা, হোগলা আর শরখড়ির ঝোপ সেখানে কাছিমের দল ডিম পেড়ে যায়।
এই, কি করছো?
চমকে যায় লোকটা। ঘুরে তাকায় চৈতার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে। বড্ড সরল মনে হয় হাসিটা চৈতার কাছে।
তুমি কে গো?
আমি চৈতা। হোগলাপাতা কাটি। বাওয়ালির পোলা। বাপ মা, কেউ নাই।
তুমি কে?
আমি থাকি হুই গাঁয়। জঙ্গল ঝাঁট দিয়ে ডিম জমাই।
কিসের ডিম?
কাছিমের ডিম। বনমুরগি, বালিহাঁস, পাতিহাঁসের ডিম। এই ডিম বেচি হাটে। জানো চৈতা, একবার আমি কালো রাজহাঁসের কয়েকটা ডিম পেয়েছিলাম। অনেক দামে বেচে দিয়েছিলাম সেগুলো। পরে বাদাবনে এদিক সেদিক অনেক খুঁজেছি। আর পাইনি।
আরে বসো, আমিও তোমার সাথে খুঁজব। হঠাৎ করে যদি পেয়ে যাই কালো রাজহাঁসের ডিম। জব্বর ব্যাপার হবে তখন একটা ।
ডিম কুড়ানো কিন্তু এত সোজা না। বাদাবনে খুব কম লোকই এ কাজ করে। রাতে হাঁস ডিম পাড়ে। জঙ্গলে হাঁস মুরগি ঘাসবনের মধ্যে ডিম পেড়ে যায়। বেশির ভাগ ডিম খেয়ে ফেলে সাপ। গোখরো, কেউটে, বেনাফুলির দল আমাদের মতোই ডিমের খোজে ছুটোছুটি করে। তাদের চোখ এড়িয়ে এসব জমাই।
রোদ উঠছে তেতে। বাদাবনের ভেতর থেকে কেমন একটা ভাঁপ উঠছে যেন। খুব নিরিবিলি জায়গাটা। লোকটার মুখ ঘামে চিকচিক করছে।
এই, মধু খাবে? টসটসে মধু আছে আমার কাছে।
এতক্ষণ দেখেনি চৈতা। লোকটার কাছে একটা লাল মাটির ছোট হাঁড়ি।
খানিক আগে এনেছি। খাও।
টাটকা মধু খেল চৈতা। মুখটা যেন জুড়িয়ে গেল। বাদাবনে অনেক লোক মৌচাকের নিচে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে মধু সংগ্রহ করে । আগুনের তাপে মৌমাছিরা পালিয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের বলে মউল।
চল আমার সাথে। ওপাশের জঙ্গলে হয়ত মানিকজোড় বা পাতকোয়ার বড় কিছু ডিম পেয়ে যেতে পারি।
লোকটার সাথে হাঁটা শুরু করল চৈতা। সাবধানে হাঁটতে হয় এদিকে। নইলে কাটার চলতে গেলে ধারালো খোঁচা লাগে। সুঁদরি গাছের ফলা কাদাপানির ভেতর মাথা উঁচিয়ে থাকে।
এখন আমি ডিম কুড়াই। আগে ছিলাম পেখোরা। বনে বাদাড়ে ঘুরে পাখি ধরতাম। অনেক পাখি ধরেছি সে সময়। বক, হরিয়াল, কাদাখোঁচা, হলুদমণি, ধানখইরি । ইস রে, এমন দিনও গেছে এক কুড়ি পর্যন্ত পাখি ধরেছি। বিক্রি করে বেশ পয়সা পেতাম। বকের বেশি দাম নাই। দড়ির মতো সিটে মাংস। এই চৈতা, তুমি কখনও বক খেয়েছ?
না ।
একদম মজা না । যে পাখি অনেক বেশি ওড়ে তার গায়ে চর্বি থাকে । চর্বি থাকে বটে শামুকখোল পাখির।
আমি কাল সন্ধেবেলায় কয়েকটি শামুকখোল পাখি দেখেছি।
কোথায়, কোথায়? চকচকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করে লোকটা। ভীষণ লোভী দেখাচ্ছে তাকে।
ঐ দিকের জঙ্গলে পতপত করে নামল।
চলো তো যাই। কয়েকটা শামুকখোল পাখি ধরতে পারলে খুব মজার খাওয়া হবে। অনেকদিন ওদের খাই না। বকের সিটে মাংস খেয়ে খেয়ে মুখটা আমার তেতো হয়ে আছে। যদি আবার শামুকখোল পাই। চলো না চৈতা। তোমাকে আমি সব মধু দিয়ে দেব।
চৈতাও বেশ উৎসাহিত হয়ে ওঠে। শামুকখোল ধরতে পারলে মন্দ হয় না। বুড়ি দাদি খুব খুশি হবে। ওরা দুজন সামনের দিকে এগুতে লাগল।
এক জায়গায় দেখা গেল কয়েকটা লাল কাপড়ের নিশান উড়ছে। এখানে বনবিবির পূজা হয়। ঘুঘু, বটের আর হরিয়াল বলি দেয়া হয়। পূজার সময় একটানা বাদ্যি বাজে। মৃত পাখি ভাই হয়ে জায়গাটা ভরে যায়। রক্তে ভিজে থাকে ঘাসপাতা।
দুপাশে কাঠশোলার জঙ্গল। বছরের এ সময়টায় শোলার ফুল ফোটে থরে থরে। ছোট ছোট হলুদ ফুল। আলো হয় আছে চারদিক। বাদাবনের ভেতরে কত যে রহস্য। কজন তার খোঁজ রাখে।
জলডুমুরের গাছ থেকে কয়েকটা শালিক ফড়ফড় করে উড়ে গেল। এদিকে যতদূর তাকাও, শুধু রক্ত শাপলার বন ঝলমল করছে।
লোক নেই, জন নেই। কেমন লাগে একলা যেতে?
চৈতা বলে, আরে লোকজন লাগে নাকি। গাছগাছালিই তো হলো বন্ধু । আহারে, দেখার চক্ষু থাকা চাই । এত সুন্দর এই বাদাবন। দেখে দেখে আশ যেন আর মেটে না। নীলকণ্ঠ পাখির বাসা। কতদিন আকুল হয়ে খুঁজলাম গো। এই যে, শামুকখোলটা উড়ে গেল ।
চেঁচিয়ে ওঠে চৈতা। শোলাবনের ওপাশে একটা বিরাট শামুকখোল পাখিকে দেখেছে সে। বাতাস পাতা কাঁপিয়ে ঝিরঝির করে বইছে।
প্রচণ্ড খিদেতে চৈতার পেট চিনচিন করছে। লোকটারও খিদে পেয়েছে। ওরা দুজন স্বপ্ন দেখছে পুরুষ্ট শামুকখোলটা মরে পড়ে আছে ঘাসবনে। শামুকখোলের ঠোটের কোণায় রক্ত জমে আছে। নিপুণভাবে ছাড়ানো হলো চামড়া। শুকনো পাতায় দাউদাউ আগুন জ্বলবে। এবার শুধু মশলা মাখিয়ে পেট পুরে খাওয়া।
এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে চৈতা আর লোকটা পাতিবনের দিকে সাবধানে এগুতে লাগল ওখানেই শামুকখোলের আস্তানা। চোখের সামনে সব এখন ঝাপসা। শুধু পাখিটার তেলতেলে মাংস। ঘন ধোঁয়া উঠছে। লোকটার কোমরে গোজা চকচকে ছুরি।
ঠিক এ সময় হোগলা বনের ভেতর একটা হলুদ ঝিলিক। বাঘটা লাফ দিল গড়গড় আওয়াজ তুলে। চৈতা শুধু একপলক দেখল। লোকটাকে তুলে নিয়ে যেতে। তার জমানো ডিমগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পাতিবনে। শামুকখোলগুলো কককক শব্দ করে ভয়ার্ত চিৎকার করে উড়ে চলে গেল।
আবার সব চুপচাপ। কয়েকটা ঘাসফড়িং উড়ছে। চৈতা এগিয়ে চলল হোগলা পাতা কুড়িয়ে আনতে। ওর বুড়ি দাদি বাদাবনের এক কোণায় কুঁড়েঘরের দাওয়ায় অপেক্ষা করে বসে আছে।