দশম পরিচ্ছেদ
হৈমন্তীর ঘরের দেওয়ালে দরজার মাথায় অপুর একখানা ছবি টাঙানো হইয়াছে। সারাজীবনে অপু ছবি তুলিয়াছে খুব কম। বিবাহের পরে পরেই হঠাৎ কী খেয়ালে কলিকাতার এক স্টুডিয়ো হইতে ছবিটা তুলিয়াছিল। রোজ স্কুলে যাইবার সময় কাজল বাবার ছবিকে প্ৰণাম করিয়া বাহির হয়। ছবিটা উঠিয়াছিল সুন্দর, মনে হয়। অপু হাসিহাসি মুখে ফ্রেমের ভিতর হইতে তাকাইয়া আছে। পারতপক্ষে হৈমন্তী ছবির দিকে তাকায় না, তাকাইলে বুকটা কেমন করিয়া ওঠে।
স্কুলে মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক পরীক্ষা লওয়া হয়। এক পরীক্ষায় কাজল বাংলা রচনা লিখিতে গিয়া বিদেশী উপন্যাস হইতে একটা উপমা দিয়াছিল, পরদিন তাহা লইয়া খুব হৈ-চৈ। বাংলার শিক্ষক অখিলবাবু ক্লাসে তাহার খাতাখানা লইয়া আসিলেন। প্রথমেই কাজলের খোঁজ করিলেন।
–অমিতাভ এসেছে? কোথায় সে?
কাজল ভীতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল।
–এসেটা তোমার নিজের লেখা?
–হ্যাঁ সার।
অখিলবাবু চোখ লাল করিলেন–আবোলতাবোল এসব কী লিখেছ?
আবোলতাবোল কোনখানটা কাজল ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।
–কী সার?
–যে বইটার কথা তুমি লিখেছে, সেটা পড়া আছে তোমার? না জেনে লেখো কেন? নাকি অন্য কারুর লেখা মুখস্থ করে লিখেছে? সত্যি কথা বলো।
কাজল লেখার মধ্যে ড়ুমার ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’-এর উল্লেখ করিয়াছিল। ইংরাজিতে বইটির শিশুপাঠ্য সংস্করণ সে পড়িয়াছে।
–বইটা আমি পড়েছি। সার।
–আবার তর্ক? মিছে কথা বলছে কেন? এই বই পড়েছে তুমি?
–মিছে কথা নয়। সাব, গল্পটা আপনাকে আগাগোড়া বলতে পারি।
কাজলের বয়সী কোনো ছেলে ‘থ্রি মাসকেটিয়ার্স’ পড়িয়া থাকিতে পারে, এ কথা অখিলবাবু বিশ্বাস করিলেন না। তাহার দৃঢ় ধারণা হইল কাজল মিথ্যা কথা বলিয়াছে, এবং একবার বলিয়া ফেলিয়া এখন আর কথা ঘুরাইতে পারিতেছে না।
অল্প বয়সে যাহা হয়–সে যে অনেক পড়িয়াছে, ইহা লোককে না জানাইয়া কাজল শান্তি পাইতেছিল না। বাহাদুরি দেখাইবার জন্য সে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও বইটাব কথা উল্লেখ করিয়াছিল। অখিলবাবু চটিয়া হেডমাস্টার মশায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করিলেন। ললিতবাবু হেডমাস্টার, তিনি কাজলকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। অন্য ছেলেরা ভয় দেখাইল—যাও না, মজা দেখবে। ফিরে এসে পিঠে মলম লাগাতে হবে।
ললিতবাবু বলিলেন—অখিলবাবু বললেন, তুমি তাঁর সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছ। সত্যি?
–না।সার। উনি বললেন আমি মিথ্যে কথা বলছি, আমি নাকি বইটা পড়িনি। আমি বললাম যে গল্পটা ওঁকে শোনাতে পারি।
–সত্যি পড়েছে তুমি?
–সত্যি সার।
-ইংরাজিতে?
-হ্যাঁ সার। বাবা আমাকে বইটা উপহার দিয়েছিলেন। আমি এমন অনেক বই পড়েছি সার। কেন আমি শুধু শুধু অখিলবাবুর কাছে মিথ্যে কথা বলবো?
—আর কী কী বই পড়েছে তুমি?
–‘ডেভিড কপারফিল্ড’ পড়েছি, ‘গালিভারস ট্রাভেলস’, ‘ববিনসন ক্রুসো’, ‘টলস্টয়ের গল্প’一
—‘রবিনসন ক্রুসো’ কার লেখা?
–ডানিয়েল ডিফো-র।
ললিতবাবু টেবিলের ওপরে রাখা পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন–তোমাকে ইংরাজি কে পড়ান বাড়িতে।
-আমার বাবা পড়াতেন সার। বাবা মারা যাওয়ার পর দাদু পড়ান।
—বেশ। পড়াশুনা করা ভালো, তবে মাস্টারমশাইদের মুখের ওপর তর্ক কোরো না। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। পড়ে যাও, পড়া ভালো।
কাজল চলিয়া গেলে হেডমাস্টার অখিলবাবুকে ডাকাইলেন।
–ছেলেটি মিথ্যে কথা বলেছে বলে তো মনে হলো না অখিলবাবু।
–বাচ্চা ছেলে ওইসব বই পড়েছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন? তাছাড়া এই বয়সে ওইসব পাকামির বই পড়া কি ভালো?
–জিনিসটা ওভাবে দেখবেন না অখিলবাবু। বই তো খারাপ নয়। বিষয়বস্তুর কথা যদি বলেন, তবে বলতে হয়–
অখিলবাবু আলোচনা চাপা দিয়া দিলেন। বইটি তাঁহারও পড়া নাই।
বিকাল চারটায় স্কুলের ছুটি হয়। মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়া কাজল রোজ বাড়ি ফেলে। আজ ছুটির পরে বেশ ক্ষুধা অনুভব হওয়ায় অন্যদিন হইতে বেশি জোরে হাঁটিয়া সে বাড়ি ফিরিতেছিল। পথে স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক আদিনাথবাবু ডাকিয়া বলিলেন–অমিতাভ, শোন।
আদিনাথবাবু কাজলকে খুব ভালোবাসেন। ক্লাসে ছেলেদের উপদেশ দেন তাহাকে অনুসাবণ করিতে। পড়িতে পড়িতে কাজলের নিজস্ব একটা ইংরাজি লেখার ভঙ্গি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা আদিনাথবাবুর ভালো লাগে।
কাজল আগাইয়া গেল।–কী সার?
—আজ তোকে নিয়ে কী গোলমাল হয়েছে রে স্কুলে?
কাজল খানিকটা বলিতে তিনি বলিলেন-যে যা বলে বলুক। কারও কথায় আমল দিবি নে। পড়াশুনার অভ্যোস কখনও ছাড়বি নে, জীবনে উন্নতি হবে, দেখিস।
হৈমন্তী বসিয়া কী-একটা বই পড়িতেছিল। কাজলকে ঢুকিতে দেখিয়া বলিল–আয়। আজ এত দেরি হল যে আসতে? হাতমুখ ধুয়ে আয়, খেতে দিই।
স্কুল হইতে ফিরিয়া কাজল ভাত খাদ্য। হৈমন্তী আসন পাতিতে পাতিতে বলিল– আজকে রাত্তিরে শুয়ে সেই গল্পটা বলবি কিন্তু—
রাত্রে মায়ের কাছে শুইয়া কাজল মাকে গল্প শুনাইয়া থাকে। অপুর একটা ইংরাজি বইতে সে একটা ভূতের গল্প পড়িয়াছিল, সেই গল্পটা সম্প্রতি হৈমন্তীকে বলিতেছে।
দাদুর কাছে পড়া সাঙ্গ হইলে হ্যারিকেন লইয়া সে শতবঞ্চিব উপর বসিযা গল্পের বই পড়ে। ভূতের গল্প হইলে পরিবেশটা অদ্ভুত জমিয়া উঠে। হ্যারিকেনের আলোর পরিধির বাইরে যেন অজানা রাজ্য—আলোকবৃত্তের সামান্য পরিসবের ভিতরেই তাহার থাকিতে ইচ্ছা করে। গল্প খুব জমিলে কাজল কল ঘুরাইয়া পলতে আর একটু বাড়াইয়া দেয়।
খাওয়ার পর কাজল বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিল। হৈমন্তী বলিল—আবার বেবুবি নাকি? তোর দেখা পাওয়া যায় না সারাদিন। এখন আবার টই টই করে বেরুবার কী দরকার? থাক, বাড়িতে থাক–
বোধহয় খুব একটা ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই কাজল এক কথায় রাজি হইয়া গেল। বলিল–তুমি খাটে শোও মা। আমি পাশে শুয়ে গল্প করি। ব
হৈমন্তী প্রায়ই ছেলেকে নিজের ছোটবেলার গল্প শোনায়। যে দিনগুলি কাজল দেখে নাই, কাজলের ধারণা সেগুলি বর্তমানের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। অতীতের প্রতি তাহার যে স্বপ্নময় কল্পনা রহিয়াছে, তাহাই হৈমন্তীর গল্পকে তাহার নিকট বাস্তব করিয়া তোলে। সেই দুর্গাপূজার আগে শিউলি ফুল তুলিতে যাওয়া, শিউলি ফুলের বোঁটা দিয়া কাপড় রঙিন করা, দল বাঁধিয়া হৈ হৈ করিয়া ঠাকুর দেখি, বাহির হওয়া কাজলের ধারণা সে দিনগুলি অনেক ভালো ছিল—অনেক, অনেক ভালো। মাকে বলে–মা, সেই গল্পটা বলো, সেই ঢাকায় যা হয়েছিল।
ঢাকায় থাকার সময়, হৈমন্তী তখন খুব ছোট, কাজলের দিদিমা একবার গভীর রাত্রে উঠিয়া ঘুমের মধ্যেই দোতলা হইতে একতলায় আসিয়া গিয়াছিলেন। গভীর রাত, কেহ কোথাও নাই, হঠাৎ দিদিমা বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, বাবা এসেছেন–আমি দরজা খুলে দিই গে যাই। সুরপতি উঠিয়া পেছন পেছন গেলেন। দরজা খুলিয়া দেখা গেল, কিছুই নাই। তখনও দিদিমার ঘুম ভালো করিয়া ভাঙে নাই।
গল্প শুরু হইল। এক গল্প হইতে অন্য গল্পে যাইতে যাইতে ক্রমশ সন্ধ্যা হইয়া আসিল। জানালার বাহিরে দিনের আলো শেষ হইয়া আসিতেছে, ঘরের ভিতর এখনই আরছা অন্ধকার। হৈমন্তী গল্প থামাইয়া বলিল–যাই, সন্ধেটা দেখিয়ে আসি। দিদি বোধহয় চা করে ফেলল। এতক্ষণে।
কাজল চুপ করিয়া ছিল। পুরাতন দিনের গল্প, সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। উঠিতে গিয়া হৈমন্তী কী একটা মনে পড়িয়া যাইবার ভঙ্গিতে বলিল–একটা ব্যাপার হয়েছে, জনিস?
-কী?
–আজ কদিন ধরে দেখছি, যার কথা খুব ভাবি সে এসে হাজির হয়। বিয়ের আগে বকুলের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল, যাকে বলে গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। তার বিয়ে হয়েছে কোন্নগরে। আজ দুপুরে বকুলের কথা খুব মনে পড়ছিল। ওমা, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, দুপুরেই বকুল এসে হাজির। বললে-বেড়াতে এসেছি, তোমাদের এখান থেকে ঘুরে গেলাম। দুদিন আগে এলো উমা, তার কথাও ভাবছিলাম সেদিন।
কাজল হৈমন্তীর দিকে তাকাইল।
–যাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, সে-ই এসে হাজির হচ্ছে?
হৈমন্তী মাথা নাড়িল।
কাজল দরজার উপরে বাবাব ছবিটার দিকে তাকাইল। যদিও ঘর অন্ধকার, তবুও বাবার মৃদু হাসি ঠিক ধরা যায়।