১০. HellMyth Game-Level 4 (হেলমিথ গেম-লেভেল ৪)
আমি কি আসতে বেশি দেরি করে ফেললাম?
অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বির হাতে বিশাল এক ফুলের তোড়া, এটা খুঁজে পেতে নির্ধারিত সময় থেকে এত বেশি সময় লেগে গেল।
ঠাকুমার ঝুলির আসরের মতো প্রতি মাসের শুরুর দিনটাতে সিআইডি প্রধানের ঘরে নৈমিত্তিক জালিয়াতি, প্রতারণার কেসের আলোচনা নিয়ে নয়, বরং চারজন অপার হয়ে বসে থাকে অদ্ভুত গল্পকথা নিয়ে আসর জমাবে বলে। পার্থক্য কেবল এই-ঠাকুমার ঝুলির গল্পগুলো উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত, বহুল চর্চিত। আর এই চারদেওয়ালের মাঝে শোনা গল্প আজগুবি মনে হলেও কেবল গল্প নয়। গল্প হলেও সত্যি, আর চূড়ান্ত গোপনীয়।
এই ঘরটা বড় উষ্ণ আর আরামদায়ক।
আবরার নিজের রোমহর্ষক একেকটা লেভেলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, আর গুটিসুটি মেরে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের উষ্ণতার আড়ালে থাকা জুণের মতো ডিপার্টমেন্টের চারজন মনোযাগী শ্রোতা হয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে আবরারের বলা প্রতিটি শব্দ।
না স্যার, আপনাকে ছাড়া এর আগে কখনো শুরু করেছি?
একনজরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন ফজলে সাহেব। চাদরে গোল হয়ে সবাই বসে আছে। জানালার ভারী পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে, হালকা নীল রঙের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পুরো ঘরে রহস্যময় আবহ। সিআইডি প্রধান গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ পরপর মাথা নাড়ছেন। ডিআইজি তামিম সাহেবের হাতে বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্সের একটি টিকেট।
আমেরিকান মুভি ভায়োলেটের ফার্স্ট ডে ফাস্ট শোর টিকেটটা অবশ্য বেশ পুরোনো হয়ে গেছে, কাগজের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। ওদিকে অবন্তি হাতে দুটো কাগজ নিয়ে একমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে।
একটু কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে ফজলে সাহেব বুঝতে পারলেন, কাগজ নয়, অবন্তির হাতে বাচ্চাদের পরীক্ষার দুটো উত্তরপত্র।
আবরারের মুখ ভাবলেশহীন, শরীরের কার্নিশে কার্নিশে রহস্য আর রোমাঞ্চের বহতা পলি জমে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে, ভাবালুতা থাকবেই বা কী করে!
কংগ্রাচুলেশনস! গেমের চার চারটা লেভেল দেখতে দেখতে সাফল্যের সাথে পার হয়ে গিয়েছ। তাই ভাবলাম ফলেল শুভেচ্ছা না জানালে কেমন দেখায়। কাঁচা ফুল খুঁজতে খুঁজতেই এত দেরি হয়ে গেল।
ভালো করেছেন, এখন চুপচাপ বসে পড়ুন তো মশাই।
সিআইডি প্রধানের কণ্ঠে আদেশমিশ্রিত অনুযোগ।
তামিম সাহেব চোখের ইশারা করতেই মাটিতে পাতা চাদরে বসে পড়লেন ফজলে রাব্বি।
মৌনতা ছেদ করল অবন্তি,
আপনার গেমের ব্যাপারে জানার পর আমি গ্রিক মিথোলজি পুরোটা কয়েকবার করে পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছি। তারপরেও প্রথম কো অর্ডিনেটের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, রিলেট করা তো দূরের কথা!
আহা অবন্তি, আবরারকে শুরু তো করতে দেবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
সবার চোখের দিকে একবার করে তাকিয়ে শুরু করল আবরার,
ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আমার কাছে আসে প্রথম কো-অর্ডিনেট। স্টার সিনেপ্লেক্সে দেখানো হলিউড মুভির ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শোর টিকেট। মুভির নাম ভায়োলেট। জাস্টিন বেটম্যান পরিচালিত এই মুভি প্রযোজনা করেছে রিলেটিভিটি মিডিয়া নামে এক বিখ্যাত আমেরিকান প্রোডাকশন কোম্পানি।
প্রথমে মুভির নাম, পরিচালকের নাম, রিলিজ ডেট-সবকিছু থেকে গ্রিক মিথোলজির সম্পর্ক খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। তারপর প্রোডাকশন হাউসের নাম নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতেই অদ্ভুত একটা সম্ভাব্যতার কথা মাথায় এলো। মিডিয়া নামে গ্রিক মিথথালজির একটা চরিত্র আছে। কলচিসের রাজা ইটিজের মেয়ের নাম মিডিয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মিডিয়া কমপ্লেক্স নামে একটি বিশেষ রোগ আছে।
আই গেট ইট ফাইন্যালি! স্টার সিনেপ্লেক্স অবস্থিত বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের টপ ফ্লোরে। আর ভায়োলেট নামের যে হলিউডের মুভির টিকেট দেওয়া হয়েছে, সেটা প্রডিউস করেছে রিলেটিভিটি মিডিয়া।
দুই জায়গা থেকে দুটো কি ওয়ার্ড কমপ্লেক্স আর মিডিয়া নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে মিডিয়া কমপ্লেক্স।
অবন্তির চোখেমুখে আনন্দের আভাস। অনুমোদনের ভঙ্গিতে অবন্তির দিকে তাকিয়ে হাসল আবরার। বাকিরা কেউ কিছু বুঝতে না পেরে আবরারের দিকে তাকাল।
মিডিয়ার স্বামীর নাম ছিল জেসন। ভিনদেশী বহিরাগত জেসনকে নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন উপকথায় জেসন ও আর্গো জাহাজের অভিযান বহুল প্রচলিত। ইউরোপের দুঃসাহসী ইতিহাসশ্রেষ্ঠ গ্রিক বীররা এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
আর্গো জাহাজে করে স্বর্ণ মেষের চামড়া উদ্ধার করতে কলচিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে গ্রিক বীরেরা। আর্গো জাহাজে করে যাত্রা করার কারণে
অভিযাত্রীদের একসঙ্গে বলা হতো আর্গোনট।
কোনো সেরা বীর ছিলেন না এই অভিযানে! হারকিউলিস, থিসিউস, অর্ফিয়াস, ট্রয়খ্যাত হেলেনের ভাই ক্যাস্টর, এডমিটাস, অ্যাসক্লেপিয়াস।
গম্ভীর থেকে গম্ভীরতম হয়ে গেলেন সিআইডি প্রধান।
জেসন নামটা শুনেই পরিচিত মনে হচ্ছিল। আরে, জেসন অ্যান্ড দ্য আর্গোনটস নামে এক বিখ্যাত হলিউডের সিরিজের ডিভিডি পাওয়া যেত ২০০০ সালের দিকে।
আচ্ছা, এই অভিযান সম্পর্কে ইতিহাস কী বলে? ট্রয়ের যুদ্ধের আগে না পরে এই অভিযান সংঘটিত হয়?
তামিম সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছু সময় অপেক্ষা করল আবরার।
যত দূর মনে পরে খ্রিস্টের জন্মেরও ১৩০০ বছর আগে। তবে আমার ধারণা পুরোটাই গল্পগাথা। হয়তো কোনো এক অভিযান হয়েছিল ঐ সময়। কিন্তু সাহিত্যিকরা রংচং মেখে এই অভিযানে গ্রিক দেবতা আর তাদের পুত্রদের বীরগাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
মিডিয়ার কো-অর্ডিনেট সম্পর্কে বলো। তারপর কী হলো?
বাবা ইটিজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের জাদুকরি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জেসনকে চ্যালেঞ্জ জিততে সাহায্য করলেন মিডিয়া, প্রথম দেখায়ই যে ভালোবেসে ফেলেছিলেন জেসনকে। অভিযানে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে মিডিয়াকে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলেন জেসন।
কিন্তু যা হয় আর কী, ক্ষমতা হাতে পেয়ে গেলে মানুষ বদলে যায়। জেসনও বদলে গেলেন। আরও ক্ষমতার মালিক হতে চাইলেন, হতে চাইলেন করিন্থের রাজা। তাই করিছের রাজা তার কন্যা গ্লাউসের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে জেসন এই প্রস্তাব লুফে নিলেন। মিডিয়াকে ছেড়ে দিতে চাইলেন।
যেই স্বামীকে ভালোবেসে মিডিয়া নিজের বাবা আর ভাইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, নিজের চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে বিদেশবিভূঁইয়ে স্বামীর হাত ধরে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছেন, সেই স্বামীর এই পরিবর্তন দেখে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। ঠিক করলেন প্রতিশোধ নেবেন। চরম প্রতিশোধ।
বিশ্বাসঘাতক স্বামীকে হত্যা করে ফেললে তো এক নিমেষেই যন্ত্রণার অবসান হয়ে যাবে। মিডিয়া তাই জেসনকে তিলে তিলে শাস্তি দেবার জন্য বেছে নিলেন এক অভিনব পন্থা। নিজের গর্ভজাত দুই পুত্রসন্তানকে হত্যা করলেন। স্বামীর ঔরসের চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করে স্বামীকে শাস্তি দিলেন বীভৎস উপায়ে।
এ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন এক মানসিক ব্যাধিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত মায়েরা অসচেতনভাবে বা সচেতনভাবে নিজের সন্তানকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করে, ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা পর্যন্ত করে। আর এর মাধ্যমেই তারা মনে করে তারা তাদের স্বামীদের অত্যাচার কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিচ্ছেন।
আমার যত দূর মনে পড়ে, হুমায়ুন আহমেদের এমন একটা ছোটগল্প পড়েছি। জ্বীন কফিল। কিন্তু গল্পের মুনশি সাহেবের স্ত্রী যে মিডিয়া কমপ্লেক্সে আক্রান্ত, গল্পটা পড়ার সময় বুঝতে পারিনি।
আরে কী আশ্চর্য! আমিও তো গল্পটা সম্পর্কে জানতাম। এর মাঝে যে। আবরারের অ্যাসক্লেপিয়াস মহাশয়ও ঘাপটি মেরে বসে আছে তা কী আর তখন জানতাম।
চোখ পাকিয়ে বললেন তামিম সাহেব। অ্যাসক্লেপিয়াস টার্মটা আবারের হেলমিথ গেমের কল্যাণে সিআইডির এই চারজন সদস্যের কাছে যতটা পরিচিত, বাইরের পৃথিবীর সবার কাছে ততটা নয়। সবাই তো গ্রিক মিথের ভুল প্রয়োগ ক্যাডুসিয়াস চিহ্নকেই কেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে জানে।
ভিডিওটাতে কী দেখলে সেটা তো বলো।
ফজলে সাহেবের কন্ঠে স্পষ্ট অনুনয়, যেন আর তর সইছে না।
গ্রিক মিথোলজির কো-অর্ডিনেট থেকে কোড ঠিকঠাক ডিকোড করার সাথে সাথেই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও পাঠানো হয়।
ভিডিওর শুরুতেই সাদা পোশাক পরা রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রীকে দেখানো হয়-অর্ধ উলঙ্গ হয়ে এক ফাইভ স্টার হোটেলের সুইমিংপুলের কিনারায় পা ডুবিয়ে বসে আছেন।
সাদা পোশাক পরা দেখেই তুমি বুঝে গেলে উনি মন্ত্রী?
হাসান সাহেব বেশ যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন করে ফেলেছেন ভেবে তার খানিকটা আত্মরম্ভ হলো।
না স্যার! ভিডিও শেষে যখন ভিকটিমের পরিচয় রিভিল করা হলো, তখন তার বাবার মন্ত্রী পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়েছিল। পুরোটা শুনলে বুঝতে পারবেন।
ভিডিওটা আমরা দেখতে চাই।
অবন্তির আদুরে গলার প্রত্যুত্তরে আবরার অননুমোদনের স্বরে বলে উঠল,
আসলে এই মিশনে নিজের আগের মোবাইল হারিয়ে আপাতত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে আছি। নতুন মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করলে আপনাদের ভিডিওটা দেখাতে পারব।
যাহোক, যা বলছিলাম….মন্ত্রী মশাইয়ের হাতে ভদকার গ্লাস। ছিপছিপে লাস্যময়ী পাঁচ ছয়জন সুন্দরী বেষ্টন করে রেখেছে সুমহান মন্ত্রীকে।
দলাইমলাই করে অতিকায় উঁড়িবিশিষ্ট হোদল কুতকুতে কুৎসিত দর্শন শরীরটার প্রতি ইঞ্চি মালিশ করে দিচ্ছে। সুতন্বী এক মডেল কোলের উপর বসে আঙুর খাইয়ে দিচ্ছে।
পরের দৃশ্যে দেখানো হলো মন্ত্রী মশাইয়ের স্ত্রীকে। অসম্ভব সুন্দরী, অবশ্য বর্ধিত সৌন্দর্যের সাথে অর্থকড়ির যে সমানুপাতিক সম্পর্ক-এ কথা তো বলাই বাহুল্য। মুকেশ আম্বানির স্ত্রীর কয়েক দশক আগের ছবি আর আজকের ছবি দেখলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, Money can enhance beauty!
স্বামীর অবিশ্বস্ততার প্রতি বীতশ্রদ্ধ স্ত্রী নিজের সন্তানকে খুন করার মাধ্যমে স্বামীর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
ডামি ভিডিওটা সম্ভবত ইন্ডিয়ান মডেলদের দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ভিডিও শেষে সত্যিকারের ভিকটিম যে হতে যাচ্ছে, তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়।
পাঁচ-ছয় বছরের এক ছোট বাচ্চা ছেলের ছবি ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। বেশ সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। ছবির নিচে ভেসে ওঠে বাচ্চাটির নাম-আবির রায়হান, জানানো হয় তার বাবার পরিচয়ও, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মন্ত্রী স্বয়ং।
শীর্ষস্থানীয় সেই মন্ত্রীর সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখতে পেলাম ভিডিওতে দেখানো কুৎসিত দর্শন নেতার মতোই সত্যিকারের সেই রাঘব বোয়ালের বাহ্যিক রূপ। ছেলে সম্ভবত নিজের রূপগত জিন মায়ের থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।
হাউ ক্যান ইউ বি সো শিওর ডিয়ার আবরার? হয়তো নিজের ভেবে বড় করা সন্তানটি মন্ত্রী মশাইয়ের নিজেরই নয়! এক জরিপে বলা হয়েছে, ডিএনএ টেস্টের মতো নিশ্চিত প্রযুক্তি থাকার পরেও সারা পৃথিবীতে ৯ থেকে ১৫ ভাগ পুরুষ অন্যের সন্তানকে নিজের ভেবে বড় করে, ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি যে একেবারে নেই, তা তো হতে পারে না।
সিআইডি প্রধানের জ্ঞানের পরিধি দেখে চমৎকৃত হলো আবরার।
আমি এই টার্মটা সম্পর্কে জানি স্যার। এটাকে বলা হয়। Cuckolding।
যখন কোনো মহিলার স্বামীকে প্রতারণা করে নিজের জিন ঐ মহিলার গর্ভে বিস্তার করে অপর কোনো পুরুষ, তখন প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় Cuckolding। দুজন পুরুষ এভাবে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ে।
অবন্তির জ্ঞানগর্ভ কথার রেশ ধরে এবার মৌনতা ছেদ করলেন ডিআইজি তামিম সাহেব,
স্বামী পুরুষটির ভূমিকা থাকে অনেকটা কাকের মতো।
নিজের অজান্তেই কোকিলের সন্তানকে নিজের সন্তান ভেবে বড় করে তোলে। Cuckoo থেকেই সম্ভবত Cuckold শব্দের উৎপত্তি।
একজ্যাক্টলি স্যার। এবার তাহলে প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। গতানুগতিক টাকার কুমিরের মতো আধুনিক যুগের হারেমখানায় রাখা অসংখ্য সুন্দরীর সাথে দিনরাত ফুর্তি করেই কেটে যায় নেতা মশাইয়ের একেকটা দিন।
তবে যাই করে বেড়াক না কেন, নিজের অপত্যের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আছে তার। ছেলের জন্য এমন কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই, যা তিনি করেননি।
ঐদিকে স্বামীর কপর্দকশূন্যতার অবস্থান থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী, কিন্তু রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছানোর পর যে স্বামী এতটা বদলে যাবে, ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি বোধ হয়। তাই ভদ্রমহিলা গ্রিক মিথোলজির মিডিয়ার মতো নিজের সন্তানকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-এতটুকু বুঝতে পারলাম।
তবে বাইরে থেকে স্পাই লাগিয়ে যে মহিলার গতিবিধির উপর নজর রাখব, সেই উপায় নেই।
বুঝতেই পারছেন, আমাকে চব্বিশ ঘণ্টাই আংটির মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। যতক্ষণ না ওরা চাইবে, নিজ থেকে কিছু করার সুযোগ আমার নেই। আর রাজনৈতিক পরিবার মানেই বিশাল প্রভাবশালী, বাইরে থেকে নিজের উদ্যোগে নজরবন্দি রাখা সম্ভবও নয়। তাই আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম গেমের তৃতীয় কো-অর্ডিনেট পাবার।
অবন্তি নিজের হাতে রাখা দুটো কাগজ সবার উদ্দেশে তুলে ধরল, বাচ্চাদের পরীক্ষার এই দুটো উত্তরপত্র আবরারকে তৃতীয় কো অর্ডিনেট হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস ওয়ানের গণিত আর ইংরেজি-এ দুটো বিষয়ের দুটো ভিন্ন ভিন্ন উত্তরপত্র।
অবাক করা ব্যাপার হলো, গণিতের উত্তরপত্রে দেখা যাছে একটা বাচ্চা ২০/৪০ পেয়েছে, কিন্তু ইংরেজিতে বাচ্চাটা পেয়েছে ৬/৬।
অদ্ভুত তো! ৬ নম্বরের উপর কে পরীক্ষা নেয়! সাধারণত ক্লাস টেস্টগুলোতে পূর্ণ নম্বর ৫, ১০, ২০ বা ৫০, ১০০এমন দেখতে হয়ে থাকে।
ফজলে রাব্বি সাহেবের কণ্ঠের উদ্বিগ্নতায় আরও রহস্যের সঞ্চারণ ঘটালেন তামিম সাহেব,
আমি হলে তো বাপু জীবনেও এই কো-অর্ডিনেট থেকে কোড ডিকোড করতে পারতাম না।
সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল আবরার। সিআইডি প্রধান কুঞ্চিত দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকালেন।
এই যে মিস্টার! তুমি কি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছ নাকি? দেখো, আমরা পরীক্ষা দিতে নয় বরং তোমার থেকে রহস্যের সমাধান জানতে এসেছি।
স্মিত হাসিকে মুখ জুড়ে বিস্তৃত হতে দিলো আবরার। সত্যি, গেমের একেকটা লেভেল পার হয়ে মনে হচ্ছে যেন বুক থেকে গ্রিক মিথোলজির চরিত্র পাপী সিসিফাসের পাথরখণ্ড নেমে যাচ্ছে।
আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না স্যার, এই থার্ড কোডটা ডিকোড করতে পেরে আমার পরস্পর বিপরীতধর্মী আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছিল।
যে কোডটা তৈরি করেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। আবার যখনই মনে পড়ছিল এরা এই চমৎকার কোডের মাধ্যমে এক বীভৎস হত্যাযজ্ঞের আগাম আভাস দিচ্ছে আমাকে, প্রচণ্ড ঘৃণায় কুঁকড়ে। যাবার অনুভূতি হচ্ছিল।
অবন্তির হাতে দুটো উত্তরপত্র দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। প্রথমটাতে ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চা গণিতে চল্লিশ নম্বরের মাঝে বিশ নম্বর পেয়েছে। দ্বিতীয় উত্তরপত্রে ইংরেজিতে পেয়েছে ৬ এ ৬।
ক্লুয়ের আগামাথা কোনো কিছু বোঝা না গেলেও আপনারা যদি ভালো করে লক্ষ করেন, দেখতে পাবেন দুটো উত্তরপত্রই সুতো দিয়ে সেলাই করা আছে, প্রথম উত্তরপত্রে গেমের লোগোর নিচে ছোট করে লেখা আছে :
৬/৬
⇅
২০/৪০
আচ্ছা, প্রাইমারি লেভেলে আমরা সবাই কিন্তু পানির তিনটি ভৌত অবস্থা সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এক ভৌত অবস্থা থেকে অন্য ভৌত অবস্থানে পরিবর্তন বোঝাতে ⇅ বা ⇌ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
বরফ ⇌ পানি ⇌ বাষ্প
মনে থাকবে না কেন? এটা তো খুব সাধারণ পর্যায়ের জ্ঞান।
অদ্ভুত দর্শন উত্তরপত্রের দিকে সিআইডি প্রধানের সরীসৃপসুলভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কণ্ঠে আরোপিত গাম্ভীর্য। আবরার কিছুক্ষণ নীরবতার পর বলে উঠল,
আপনারা সবাই এর আগের তিনটি লেভেলে যে হত্যাপদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে একবার ভেবে দেখুন। লেভেল ওয়ানে কনট্যাক্ট লেন্সের কৃত্রিম দ্বিস্তরী আবরণীর মাঝে ব্যবহার করা হয়েছিল স্ট্রাইকনিন পয়জন।
লেভেল টু-তে কৃত্রিম টিউমার তৈরি করা হয়েছিল প্রস্থেটিক স্কিনের সাহায্য নিয়ে, ভেতরে ছিল সালফিউরিক অ্যাসিডে ভরা অসংখ্য বিস্ফোরণযোগ্য এম্পুল। লেভেল থ্রিতে ছিল এইচআইভি ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হাইপোডার্মিক সুচ। লক্ষ করলে দেখবেন, চোখের লেন্স, টিউমার, এইচআইভি ভাইরাস-প্রত্যেকটি পদ্ধতির মাঝেই কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
গেমের লোগোতে অ্যাসক্লেপিয়াসের চিহ্নও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিচয় বহন করে।
তাই সাদা চোখে যা দেখা যায়, সেভাবে না ভেবে একটু অন্য রকমভাবে এবারের কো-অর্ডিনেটটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ৬, ২০, ৪০ এর মাঝে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কী প্রয়োগ থাকতে পারে!
কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, গ্যাসট্রোএন্টারোলজি, ইওরোলজি-নাহ, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ অপথ্যালমোলজি (চক্ষুবিজ্ঞান) নিয়ে ভাবতেই নিমেষেই সব রহস্যের জট খুলে গেল।
আমরা মেডিকেলে পড়ার সময় ভিজুয়াল অ্যাকুইটি নিয়ে বিস্তারিত পড়েছি। এর আগে এসএসসি, এইচএসসি লেভেলেও এ সম্পর্কে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বইয়ে কিছু কথাবার্তা ছিল।
ইউ মিন মাইওপিয়া? ঐ যে দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হলে মাইনাস পাওয়ারের চশমা লাগে, তারপর কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা হলে প্লাস পাওয়ারের চশমা–এসব?
হ্যাঁ অনেকটা তেমনই। মাইওপিয়া আর হাইপারমেট্রোপিয়া টার্ম দুটো মনে রাখুন, পরবর্তীসময়ে জিগ-স পাজেলের ব্লক মেলাতে গেলে আমাদের কাজে আসবে। তো এখন ৬, ২০ আর ৪০-এর প্রসঙ্গে আসা যাক।
অ্যাভারেজ ভিশনের আমেরিকান মানদণ্ড অনুযায়ী অপথ্যালমোলজিতে ২০/২০, ৬/৬ ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী ৬/৬ বা ২০/২০ দিয়ে পারফেক্ট ভিশনও বোঝায়।
৬/৬ বলতে বোঝায় কোনো বস্তু থেকে ৬ মিটার দূরত্বে অবস্থান করা কোনো স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ঐ নির্দিষ্ট বস্তুটি দেখতে পাবে। আপনি যদি ঐ বস্তুটি থেকে ৬ মিটার দূরে অবস্থান করে বস্তুটি দেখতে পান, তাহলে আপনি স্বাভাবিক ভিশনের অধিকারী।
ভিজুয়াল অ্যাকুইটি টেস্টে আপনি পাস করেছেন, ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ২০/৪০ বলতে বোঝায় স্বাভাবিকের চোখ যে বস্তুটি ৪০ ফিট দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পায়, আপনার সেই বস্তুটি দেখার জন্য লক্ষ্যবস্তু থেকে মাত্র ২০ ফিট দূরে অবস্থান করতে হবে।
অর্থাৎ আপনি দূরের জিনিস ভালো দেখতে পান না।
ওয়ান মোর থিং, আমাকে কনফিউজড় করার জন্যই একবার ২০ আরেকবার ৬-এর মাধ্যমে কু দেওয়া হয়েছে। আদতে ফুট এবং মিটারের মাঝে ইন্টারকনভার্সন হলে ২০ ফিট আর ৬ মিটার একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
এখন আসা যাক, লেভেল ফোরে এই কু দেওয়ার মাধ্যমে কীভাবে হত্যাপদ্ধতি সম্পর্কে গেমের অথোরিটি আমাকে কু দিচ্ছে। লক্ষ করে দেখুন, কিছুক্ষণ আগেই কিন্তু আমি বললাম = চিহ্নের মাধ্যমে ভৌত পরিবর্তন বোঝানো হয়।
৬/৬ এর পরে এই চিহ্নের মাধ্যমে পরিবর্তন বোঝানো হয়েছে। এরপর দেওয়া আছে একটি অসংগতিপূর্ণ ভিজুয়াল অ্যাকুইটি টেস্টের ফলাফল-২০/৪০ অর্থাৎ মাইওপিয়া।
যেহেতু পুরো ব্যাপারটির সাথে একটি হত্যাপদ্ধতি জড়িত, তাই সম্ভবত সেই পদ্ধতিটি হতে যাচ্ছে ভিকটিমের চশমার লেন্স বা চোখের কনট্যাক্ট লেন্স পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিক দৃষ্টিকে হ্রস্ব দৃষ্টিতে পরিণত করা।
এর মাধ্যমে কোনো দুর্ঘটনা ঘটানো, যাতে ভিকটিম কোনো দূরের জিনিসকে কাছে ভেবে দু-পা এগোলেই তলিয়ে যাবে মৃত্যুর অতল গহ্বরে।
যদি চোখের কনট্যাক্ট লেন্স পরিবর্তন করা হয়, তাহলে ভেনু সম্ভবত হতে যাচ্ছে গেম অথোরিটির নির্বাচিত জায়গাতেই।
আর যদি কাঁচের লেন্স পরিবর্তনের মাধ্যমে অবতল কাঁচ ব্যবহার করা হয়, তবে লেভেল থ্রির মতো গেম হতে যাচ্ছে আমার চিরপরিচিত গণ্ডির মাঝেই যেকোনো জায়গায়-এই সম্ভাবনার কথাই মাথায় এসেছিল, দেরি না করে অনুমিত সমাধানটা লিখে ফেললাম।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলাম আংটির দিকে তাকিয়ে, কোনো অ্যাপ্রুভাল মেসেজ আসে কি না দেখার জন্য। কিন্তু সবুজসংকেতের দেখা নেই।
হঠাৎ মনে পড়ল, আবির রায়হান সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি, ছেলেটিকে কখনোই চশমা পরতে দেখিনি। হঠাৎ করে সম্পূর্ণ নতুন এক হাইপোথিসিসের কথা আমার মাথায় আসে।
হয়তো বাচ্চাটি যে গাড়িতে করে দুর্ঘটনার দিন স্কুলে যাবে ৰা বাড়ি ফিরে আসবে, সেই গাড়ির সাইড ভিউ মিরর এবং রিয়ার ভিউ মিররে কনভেক্সের পরিবর্তে কনকেইভ লেন্স ব্যবহার করা হবে।
কনকেইভ বা অবতল লেন্সের সূত্র অনুযায়ী, খুব কাছের কোনো বস্তুকে খুব দূরের মনে হবে।
হয়তো গাড়ি টার্ন করার সময়ে আগে থেকেই সেই গাড়ির জন্য মৃত্যুর দূত হয়ে অবস্থান করবে অন্য কোনো গাড়ি, যার সাথে সামান্য ছোঁয়া লাগলেই বিস্ফোরিত হবে কোনো ভয়ংকর বিস্ফোরক। আমি আমার নতুন হাইপোথিসিসটা লিখে ফেললাম নোটপ্যাডে।
ঠিক তখনই হাতের আংটিতে সবুজসংকেত ভেসে উঠল আর যান্ত্রিক সেই কণ্ঠটা গ্রিক ভাষায় বলে উঠল- écheis dikio। You are right-এর গ্রিক অনুবাদ শুনলে অশরীরী ভাষার কোনো মৃত্যুসংগীত বলে মনে হয়।
পুরো ঘরের পিনপতন নীরবতার সাথে সখ্য বজায় রেখে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আবরারের বর্ণনাভঙ্গিতে বুঁদ হয়ে উঠেছিল সবাই।
আবরার থামতেই চারজন সিআইডি সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডিং ওভেশন জানালো আবরারকে। তামিম সাহেব আবরারের হাত দুটো ঘোর লাগা চোখে রাখলেন নিজের হাতে, আমার এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না! এত জটিল একটা কোড কীভাবে এক নিমেষেই ডিকোড করে ফেললে তুমি! ইউ আর নট অ্যান অর্ডিনারি হিউম্যান বিইং। ইউ আর এক্সট্রাঅর্ডিনারি।
আসলেই তাই আবরার। তারপর কী হলো বলে ফেলো। গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে!
ফজলে রাব্বি সাহেবের দিকে একনজর তাকাল আবরার। চোখেমুখে কী প্রশস্তির ছোঁয়া! সত্যি, আবরারকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টের সবাই দারুণ গর্বিত। সকলের প্রত্যাশার ভারে কখনোই ন্যুজ হওয়া যাবে না, আবরারকে নিজের তীক্ষ্ণধী পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে আরও বেশি শাণ দিয়ে যেতে হবে-ভাবের জগতে যেন হারিয়ে গেল আবরার কয়েক মুহূর্তের জন্য।
থামলেন কেন মহাশয়। তারপর কী হলো বলুনই না!
অবন্তির চোখে নিজের জন্য শ্রদ্ধা আনত মুগ্ধতা খুঁজে পেল আবরার। কিছুক্ষণ থেমে শুরু করল, এরপরের ঘটনাটুকু আমার পরিকল্পনা অনুসারেই ঘটে গেল। তৃতীয় কো-অর্ডিনেট ব্রেক করার কয়েক দিনের মাঝে আমাকে চতুর্থ কো-অর্ডিনেট পার্সেল আকারে পাঠানো হলো।
একটা গোলাপি রঙের কাগজে মোড়ানো দুটো বই, সিডনি শেলডনের মাস্টার অব দ্য গেম আর ইসরাইলি লেখক লিওর সুচার্ডের লেখা মাইন্ড রিডার।
দুটো বই থেকে মাস্টার আর মাইন্ড কিওয়ার্ড নিয়ে আবিরের ধানমন্ডিস্থ স্কুল মাস্টারমাইন্ড নির্দেশ করা হয়েছে।
অবশ্য সেই মন্ত্রী সম্পর্কে পড়াশোনা করার সময় স্কুলের নাম আগেই জানতে পেরেছিলাম। আসল ক্রু ছিল গোলাপি রঙের কাগজটায়।
আই গেজ, আই ক্যান অ্যাজিউম। গোলাপির ইংরেজি Pink? আর Pink-এর আদ্যক্ষর থেকে P নিয়ে Picnic অর্থাৎ বনভোজন।
অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বি সাহেবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল আবরার।
একেবারে ঠিক ধরেছেন স্যার। খুব তো কিছুক্ষণ আগেই আমাকে এক্সট্রা অর্ডিনারি বলে মজা নেওয়া হচ্ছিল। সিআইডি ডিপার্টমেন্টের সবাই-ই তো দেখছি এক্সট্রা অর্ডিনারি।
উফ…থেমো না আবরার। বলে যাও তো। তারপর কী হলো?
স্যার, ফেব্রুয়ারির শেষ দিন অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ক্লাস ওয়ান এবং টুয়ের বাচ্চাদের পিকনিকের দিন ছিল। পিকনিকের জন্য ক্লাস ওয়ান এবং টুর জন্য দুটো ভিন্ন ভিন্ন বাস বরাদ্দ ছিল।
তার মানে যে বাসে আবিরের যাবার কথা, সেই বাসের সাইড ভিউ মিরর আর রিয়ার ভিউ মিরর বদলে দেওয়া হয়েছিল?
একজ্যাক্টলি স্যার! সাধারণত গাড়ির সাইড ভিউ মিরর আর রিয়ার ভিউ মিররে উত্তল বা কনভেক্স মিরর ব্যবহার করা হয়। কনভেক্স মিরর ব্যবহারের কারণ, কনভেক্স লেন্স ব্যবহার করলে যে ইমেজ দেখতে পাওয়া যায়, সেটা আমাদের অক্ষিগোলকের বিশাল পরিসর জুড়ে হয়ে থাকে। দূরের যেকোনো বস্তু কাছ থেকে দেখতে এই ধরনের লেন্স আমাদের সাহায্য করে।
এর ফলে দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা যায়। কিন্তু গেম অথোরিটি লোক পাঠিয়ে বাসের কনভেক্স লেন্স বদলে কনকেইভ লেন্স ব্যবহার করাতে পুরো দৃশ্যপটটাই ১৮০° অ্যাঙ্গেলে পাল্টে যায়, কাছের জিনিস বরং দূরের বলে মনে হয়।
ফোকাল লেন্থ ইচ্ছেমতো পরিবর্ধন করে কাছের জিনিসকে বহু দুরের জিনিস হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে খুন বলে চালানোর জন্য এর থেকে চমৎকার পদ্ধতি আমি কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসের পাতায়ও দেখিনি।
কী বীভৎস! নিছক খেলাচ্ছলে একটা বাচ্চাকে খুন করার জন্য পুরো বাসের প্রত্যেকের জীবন অমানুষগুলো এভাবে ঝুঁকিতে ফেলল? স্রেফ বিনোদনের জন্য!
নিজের মুখে আসা থুথু গলনালির গভীরে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন ফজলে রাব্বি সাহেব! এরকম দৈত্যপুরীর দৈত্যরা এই পৃথিবীর তাবৎ তাবৎ উঁচু পদগুলো দখল করে রেখেছে, ভাবা যায়! আবরার বলে চলেছে, আমাকে নিজের কাজ করার জন্য গেমের অথোরিটি যথেষ্ট সময় দেয়, এই জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারির শেষ কো-অর্ডিনেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি দুই দিন বিভিন্নভাবে স্কুলের উপর নজর রাখতে শুরু করি, ধীরে ধীরে প্ল্যান করি কীভাবে সবাইকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাব।
ঘটনার দিন সকালেই আমি আমার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শুরু করে দিই। স্কুলের প্রবেশমুখেই দাঁড়িয়ে ছিল দু-দুটো বাস।
সকাল দশটায় ফ্যান্টাসি কিংডমের পথে একসঙ্গে দুটো বাসের যাত্রা শুরু করার কথা। নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই বাচ্চারা নিজ নিজ ক্লাসরুমে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
আমি দশটা বাজার ঠিক ঘণ্টা খানেক আগে কয়েকটা স্মোক বম্বের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পাসে আগুন লেগেছে-এমন একটি প্রোপাগান্ডা ছড়াই। দুটো ক্লাসের শ খানেক বাচ্চা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত শিক্ষকেরা ছাদে চলে যায়। অভিভাবকদের মধ্যেও প্যানিক ছড়িয়ে পড়ে।
ঠিক সেই ফাঁকে আমি মেকানিকের থেকে সদ্যলব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে ফেলি। গাড়ির কনকেইভ মিরর বদলে আবার কনভেক্স মিররকে নিজের জায়গা ফিরিয়ে দিই।
এর আগে দুদিন গ্যারেজে টানা প্র্যাকটিস করলেও অনভ্যস্ততায় হাত কাঁপছিল বারবার। আংটি থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠের শীতল পুনরাবৃত্তি ঠিক তারপরই শুনতে পেলাম-লেভেল ফোরে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
প্রধান দায়িত্ব শেষ। তারপর চলে আসি পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশে।
বেলা এগারোটার দিকে কোনো আগুনের উত্স খুঁজে না পেয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই বুঝতে পারে, ধোয়ার কারণ আগুন নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই শিক্ষকেরা বাচ্চাদের নিয়ে ক্লাসরুম থেকে নিচে নেমে আসতে শুরু করেন।
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের স্টাফের পোশাকের মতো দেখতে একটা খাকি রঙের পোশাক আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম। রাস্তার পাশের এক হোটেলের ওয়াশরুম থেকে সেটা পরেই স্কুলের ভেতরে ঢুকলাম।
আবিরের ক্লাসরুম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে রেখেছিলাম দুদিন আগে। বলতে পারেন, দুই দিনে যতটা সম্ভব হোমটাস্ক করে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। তাই আবিরকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না।
তখনো ধোয়ার আচ্ছন্ন বলয় পুরোপুরিভাবে কাটেনি। স্টাফদের উপর দায়িত্ব ছিল-সুশৃঙ্খলভাবে বাচ্চাদের সিঁড়ি থেকে স্কুলের প্রধান প্রবেশ ফটক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালাম।
আবিরকে ক্যান্টিনের পাশে একটু একাকী পেয়েই সাথে সাথে হাতের ক্লোরোফর্ম আর রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে ঘাড়ের উপর তুলে নিলাম। সুযোগ বুঝে স্কুলের পেছনের দেওয়াল টপকে আবিরকে নিয়ে ছুটে চললাম পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রীর অধিদপ্তরে, আবিরের বাবার কাছে।
কিন্তু সেই রাক্ষুসে মায়ের কী হলো? মন্ত্রী সাহেব যখন সব জানতে পারলেন, স্ত্রীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিলেন?
হাসান সাহেবের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আবরার। গেমের নিয়ম অনুযায়ী লেভেল ফোর সাফল্যের সাথে অতিক্রম করলেও আবরার জানে, আসলে সত্যিকারের জিত হয়েছে গেম কর্তৃপক্ষের, জিত হয়েছে। পুঁজিবাদের।
নিজের ইমেজ বজায় রাখতে মন্ত্রী সাহেব স্ত্রীর বিরুদ্ধে সামান্যতম ব্যবস্থা নিলেন না। তবে লাম্পট্যে যতই আপাদমস্তক অবগাহন করে থাকুক, পিতৃস্নেহের সাথে লাম্পট্যের সাপলুডু খেলায় পিতৃস্নেহ জিতে গেল।
ছেলেকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর নাম করে মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিজের ভাইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
মার্কিন পুঁজিবাদে নেমে আসা যিশুর সিলেক্টিভ মোরালিটির ঝান্ডাবাহী সোশ্যাল ইমেজ-এর র্যাপিং পেপার রাক্ষসী মাকেও সমাজের চোখে পূতপবিত্রের আসন দিয়ে আপাদমস্তক মুড়িয়ে রাখল। বরাবরের মতো।
১১. HellMyth Game-Level 5 (হেলমিথ গেম-লেভেল ৫)
প্রোজেক্টরে ভেসে ওঠা অসম্ভব সুন্দর মুখশ্রীর দিকে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ে। ১৭ কি ১৮ বছর বয়সি এক অনিন্দ্যসুন্দরী অঙ্গনা, ডরোথি স্ট্রাটেন।
নিখুঁত শরীর, প্রতিসাম্যময় মুখ, দাগহীন ত্বক-একই সাথে সৌন্দর্য এবং আবেদনময়তার দুটো স্রোত যেন মিশে গেছে এক মোহনায়। অবন্তির মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটল সিআইডি প্রধানের কণ্ঠস্বরে
ছবিতে হলিউডের বিখ্যাত মডেল ডরোথি স্ট্রাটেনকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মাত্র বিশ বছর বয়সে প্লেবয় ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা প্লেমেট মডেল হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। সামান্য ক্যাফে কর্মচারী থেকে রাতারাতি তারকা বনে যান ডরোথি।
স্নাইডার ছিল ডরোথির স্বামী। স্নাইডারই আবিষ্কার করেছিল ডরোথির সৌন্দর্যকে, এর আগে নিজের ভুবনভোলানো সৌন্দর্য সম্পর্কে ন্যূনতম অবগত ছিলেন না ডরোথি। স্নাইডারই ডরোথিকে চাপাচাপি করেন মডেল হবার জন্য। জোর করে সেমি ন্যুড ফটোশ্যুট পর্যন্ত করতে বাধ্য করেন।
ছবিগুলো প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা হেফনারের কাছে পাঠানোর মাত্র দুই দিনের মধ্যেই উত্তর আসে প্লেবয় ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে। ডরোথি প্রথমে মডেল হিসেবে, পরবর্তীসময়ে টিভি অভিনেত্রী হিসেবে ডাক পান। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের প্লেবয় ম্যানশনে উঠে আসেন।
ডরোথির মতো এত সুন্দরী নায়িকা হলিউড খুবই কম পেয়েছিল, তাই তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় সব প্রযোজক-পরিচালকদের মধ্যে।
এদের মধ্যেই একজন ছিলেন হলিউডের উঠতি পরিচালক পিটার বোগদানোভিচ। ডরোথিকে নিজের ছবি They All Laughed-এর জন্য নির্বাচিত করলেন।
অবধারিতভাবে, নায়িকা-পরিচালকের চিরাচরিত রসায়ন গড়ে উঠতে সময় লাগল না। পিটারের সাথে গোপন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠল ডরোথির। পিটারও চালচুলোহীন স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য ক্রমাগত ডরোথিকে মন্ত্রণা দিতে লাগলেন।
ধীরে ধীরে স্বামী স্নাইডারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন ডরোথি। রুপালি জগতের লাল-নীল স্বপ্নে বিভোর ডরোথি একপর্যায়ে পরিচালকের প্রলোভনে স্বামীর সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চাইলেন।
স্নাইডার নিজেও বুঝতে পারছিলেন, সাধারণ স্ত্রী নয় বরং জ্বলজ্বলে তারকা স্ত্রী চেয়ে তিনি কী ভুল করেছেন! হতাশায় নিজের ভেতরে কুঁকড়ে যেতে থাকলেন ক্রমশ। বিচ্ছেদের আগে একবার ডরোথির সাথে শেষ দেখা করতে চাইলেন স্নাইডার।
ডরোথি রাজিও হলেন, শত হলেও স্নাইডারের কারণেই তো তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে। যেই মানুষটার জন্য খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন, তাকে দেবার জন্য অ্যালিমনির বেশ কিছু টাকাও সঙ্গে নিলেন।
কিন্তু মানুষ থেকে দানবে বদলে যেতে যে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা বিশ বছর বয়সি ডরোথির ছিল না। স্বামীর সাথে সেই বিদায় সাক্ষাৎ করতে যাওয়াই কাল হলো তার।
ডরোথির মাথায় শটগান তাক করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করলেন স্নাইডার। নিজেও আত্মহত্যা করলেন। এ ঘটনা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে পরবর্তীসময়ে।
আবরারের লেভেল ফাইভের গেমের ডিটেইল শুনে আমার মাথায় এই ঘটনাটার কথাই প্রথম মাথায় এলো। ইনফ্যাক্ট, আবরারের হোয়াটসঅ্যাপে যে ডামি ভিডিও পাঠানো হয়েছিল, সেখানেও নিজের স্ত্রীর তারকা খ্যাতিতে জেলাস হয়ে স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করছে দেশের এক স্বনামধন্য গায়িকার স্বামী।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাসান সাহেবের কথার মাঝে পুঁদ হয়েছিল সবাই। তামিম সাহেব নীরবতার ধূম্রজাল ভেদ করলেন বাক্যবাণে, আসলেই তো। আবরারের লেভেল ফাইভের গেমের সাথে এই মডেলের ঘটনার পার্থক্য হলো, আমাদের কমরেড শেষ পর্যন্ত তারকা কণ্ঠশিল্পীকে জীবিত বাঁচিয়ে আনতে পেরেছে।
কংগ্রাচুলেশনস ডিয়ার আবরার। উই অল হোপ, পরের লেভেলগুলোও তুমি একইভাবে পার হয়ে যেতে পারবে।
আজকেও ফুলের তোড়া আনতে ভুলে যাননি অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে সাহেব।
আবরারের পাশে রাখা ফুলের তোড়াটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অবন্তি, বুনোফুলের লতানো বাহারের পাশে যেন এক মায়াহরিণ বসে আছে। কী অদ্ভুত সুন্দর দুটো চোখের মালিক ছেলেটা! পৃথিবীর বিশালত্ব বিসর্জন দিয়ে যেকোনো ললনা ঐ চোখের মাঝে আগুন-উন্মুখ পতঙ্গের মতো মৃত্যুকে করতে পারে সরস আলিঙ্গন।
কিন্তু অহংকারী ছেলেটাকে কমপ্লিমেন্ট দেওয়া আর না দেওয়া সমান, সেই তো নির্লিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে বিদায়ী সংবর্ধনার দিন মানপত্র পাঠ করা ছাত্রের মতো মনটাই ভেঙে দেবে।
তাই আজ পর্যন্ত দেব দেব করেও কখনোই আবরারকে কমপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়নি অবন্তির। আজই বা কেন দেবে! তার থেকে বরং একটু তর্কাতর্কি করা যাক।
আচ্ছা আবরার। আপনার এই লেভেল ফাইভের গেমের প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে পড়ল। আশা করি আপনার থেকে উত্তর পাব।
নিশ্চয়ই। বলুন কী জানতে চান।
আচ্ছা, আপনারা পুরুষ জাতি এত হিপোক্রেট কেন? সব ছেলেই চায়, তার স্ত্রী হবে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। চারপাশের সবাই মুগ্ধ হয়ে ভাববে, কী মহামূল্যবান রত্নকেই না বাগে পেয়েছে ছেলেটি।
কিছু প্রাচীনপন্থী ছেলে বাদে অধিকাংশ ছেলেই চায় তার স্ত্রীর রূপ আর গুণের স্তুতি ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে। তারকা স্ত্রী পাওয়ার জন্য কত সাধ্য সাধনা, কত তপস্যা। অথচ, স্ত্ররত্নটিকে কুক্ষিগত করে ফেললে গিরগিটির মতো রং বদলাতে থাকে পুরুষেরা।
স্ত্রী মডেলিং করছে, স্ত্রী নায়িকা অথবা বড় কণ্ঠশিল্পী বা অন্য কোনো তারকা-আরে বাবা সব জেনেশুনেই তো পুরুষেরা এদের বিয়ে করে। পেশাগত কাজের খাতিরেই এদের অসংখ্য পুরুষের সাথে সখ্য রাখতে হয়-এ কথা কে না জানে!
অথচ, সব জেনেশুনে বিয়ের পরেও কারণে-অকারণে সন্দেহ, স্পেস না দেওয়া, শেষমেশ ঘটনা গড়ায় অযাচিত হত্যাকাণ্ড অথবা ডিভোর্সে! পুরুষ জাতির এই দ্বিমুখী নীতির কারণটা আসলে কী?
অবন্তির প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসল আবরার। নাহ, যথেষ্ট যুক্তিসংগত প্রশ্ন। তবে গতি-স্থিতির অনতিক্রম্যতা যেমন আপেক্ষিক, আপাতদৃষ্টিতে কাউকে প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করা গেছে ভেবে আত্মম্ভরতায় ভোগা প্রশ্নকারীর আপাত প্রসন্নতাও আপেক্ষিক।
আপনি আসলে একদিক থেকে ঠিকই বলেছেন। তবে শুধু পুরুষ নয়, মানুষই আসলে জিনগত কারণে দ্বিমুখী প্রাণী।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে সাপ দেখতে পেলে যদিওবা নিজের দুচোখ শতভাগ নিশ্চিত থাকে যে এটা সাপ, নিউরোসায়েন্সের লিম্বিক সিস্টেম বা যাকে আপনারা সাধারণ মানুষেরা মন বলে থাকেন, সে কিন্তু শুরুই করবে দ্বিধা আর একই সাথে নির্ভরতা দিয়ে-আরে বেটা আগেই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? দড়িও তো হতে পারে।
পুরুষ মানুষের প্রসঙ্গে যখন জানতে চাইলেন, নারীদের দ্বিমুখী স্বভাবের প্রসঙ্গটা আপাতত মুলতবি থাক। পুরুষদের নিয়েই বলি।
পুরুষ একই সাথে জিনের মধ্যে স্বার্থপরতা এবং সংশয়কে বহন করে। ডরোথির ঘটনাই বলুন বা আমার এই হেলমিথ গেমের লেভেল ফাইভে যিনি ভিকটিম ছিলেন, প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পত্ৰলেখা চৌধুরী-দুজনের ঘটনাটা আরও একবার ভালো করে দেখুন।
ডকিন্সের সেলফিশ জিনের তত্ত্ব অনুযায়ী পুরুষ চাইবে তার সঙ্গিনী নারীর গর্ভে কেবল তারই জিনের প্রতিলিপি তৈরি হোক।
একই সাথে সেই সেলফিশ জিনের মালিকেরই আরেক লোকাসে অবস্থান করা জিন আবার দারুণ দ্বিচারী। সেখানে খোদাই করা আছে সুপ্ত ইচ্ছার কথা, প্রজননগত উপযোগিতায় তার সঙ্গীটি যেন সকলের ঈর্ষার কারণ হয়।
মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, পারিবারিক মর্যাদা বলুন বা মেয়েদের বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে বছর বছর হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগই বলুন–সবকিছুর পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য থাকে। সেটা হলো প্রজননগত সর্বোচ্চ উপযোগিতা পেতে সবার সেরা সঙ্গী নির্বাচন।
আমরা মেয়েরা মোটেই কেবল সেরা সঙ্গী পেতে সাজগোজ করে বেড়াই না! এই আপনার প্রজ্ঞার নমুনা!
আবরারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ঝড়ের বেগে বলে উঠল অবস্তি।
আহা, আমার কথা তো শেষ করতে দেবেন। এটা আসলে আমার উক্তি যে আমার প্রজ্ঞার সাথে এর যোগাযোগ থাকবে। এটা বিজ্ঞানের কথা।
যাহোক, যা বলছিলাম। পুরুষের অন্য এক লোকাসে আরেক জিন ঘরবসত করে, সে জিন বড়ই নাছোড়বান্দা। সেই জিনে জৈব অণুর অক্ষরে লেখা আছে প্রজননগত ঈর্ষার কথকতা। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষেরা নারীদের থেকে অনেক বেশি প্রজননগত ঈর্ষায় ভোগে।
আর সত্যি বলতে, এই ঈর্ষার পেছনেও মূল ইন্ধন জোগায় পুঁজিবাদ। প্রতারিত পুরুষের সঙ্গী গর্ভধারণ করলে একজন পুরুষ কালের পরিক্রমে খুনি পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এখানে থাকে অন্য পুরুষের প্রতিলিপিকৃত জিনের পেছনে অভিভাবকত্বসুলভ অর্থ বিনিয়োগের সম্ভাবনা।
স্বার্থপর জিন নিজের জিন বাদে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষের জিনের টিকিটিরও দেখা পেতে চায় না, আর এটা কেবল মানব সম্প্রদায়ের ভেতরই নয়, প্রাণিজগতেও দেখা যায়।
veliidae water spider নামে এক মাকড়সা অনেক সাধ্য-সাধনা করে সঙ্গী নারী মাকড়সাকে বাগে এনে পুরো এলাকায় চষে বেড়ায়।
বাকি সব মাকড়সার হৃদয়ে ঈর্ষার সঞ্চারণ ঘটায়। তারপর নিজের বাসায় ফিরে এসে সঙ্গিনীর গায়ের সাথে লেপ্টে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত শুয়ে থাকে, সঙ্গম করুক আর নাই করুক।
এর উদ্দেশ্য হলো, অন্য কোনো পুরুষ যাতে তার সঙ্গিনীর শরীরের উপর দখল না নিতে পারে।
পুরুষও অনেকটা ভেলিড মাকড়সার মতো। একই সাথে তার জিনে আছে প্রজননগত সেরা উপযোগিতা পাবার বাসনা।
তাই সবার থেকে সেরা, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সুনিপুণ দেহবল্লরীর অধিকারিণীকে সে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য দিনরাত এক করে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকতেও রাজি থাকে।
এর প্রধান উদ্দেশ্য দুজনের মিলনে সেরা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিনের বিস্তার। দ্বিতীয়ত, পুরুষের জিনে আছে অন্যের অন্তরে ঈর্ষার সঞ্চারণ ঘটানোর অদম্য বাসনা। সেলফিশ জিন মহাশয় নিজের অধিকারে থাকা সেরা সামগ্রীটিকে ঘরের মাঝে কিংবা লকারে তালা মেরে রাখতে কখনোই পছন্দ করে না।
যদিও বা ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতিগত কারণে এমনটা দেখা যায় কিছু সমাজে, তবে এটা জিনগত নয়।
জিনগতভাবে পুরুষ চায় নিজের অধিকারে থাকা সঙ্গীকে দেখে আর দশজন পুরুষ আত্মগ্লানিতে জ্বলেপুড়ে মরুক-শালার ভাগ্যটা দেখ এই বলে।
তৃতীয়ত, পুরুষের অন্য আরেকটি জিন বহন করে এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য-সংশয়প্রবণতা।
আমার সঙ্গী কেবল আমারই তো? নাকি আমার জিনের জায়গায় অন্য কোনো পুরুষের জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে চলেছে আমার সঙ্গীর গর্ভাশয়-এ জাতীয় দ্বিধাজড়িত চিন্তাভাবনা প্রত্যেক পুরুষের অন্তরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
কখনো অবদমিত, কখনো প্রকাশিত হয় এই চিন্তাভাবনা।
যদি কোনো কারণে পুরুষটি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সঙ্গীর থেকে পিছিয়ে পড়ে, এই দ্বিধা আর সংশয় দানবীয় আকার ধারণ করে।
হাসান স্যারের দেখানো ডকুমেন্টারিতে ডরোথির ঘটনা কিংবা আমার গেমের লেভেল ফাইভের ঘটনার মূলে পুরুষের এই জিনগত বৈশিষ্ট্যই দায়ী।
যখন সম্পদের তাৎক্ষণিক জোগান, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে পুরুষ নিজের অবস্থান হারিয়ে ফেলে, হীনম্মন্যতা পুরুষকে রাক্ষসে পরিণত করে।
ফলাফল-সাধারণ ক্ষেত্রে ডিভোর্স আর চরমতম ক্ষেত্রে সঙ্গীকে খুন করে ফেলা, যার নমুনা আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন।
চতুর্থত, পুরুষ জিনগতভাবেই বহুগামী। সকল প্রতিষ্ঠিত ধর্মেই পুরুষের বহুগামিতা নিয়ে বহু উপকথা-গাথা আছে। রাজা-বাদশাহদের আমল থেকে শুরু করে জমিদারদের হেরেমখানা সেই সাক্ষ্যই দেয়। অর্থসম্পদ নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে কেবলমাত্র একজন সঙ্গীর পেছনে প্রজননগত উপযোগিতার পুরোটুকুকে বিনিয়োগ করা পুরুষের ধাতে সয়না।
এখন লক্ষ করে দেখুন, XY ক্রমোসোমের অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটা নিজের জিনের ভেতর একই সাথে চার চারটা ভিন্নধর্মী বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে চলেছে। একই সাথে পুরুষ বহুগামী, একই সাথে সঙ্গীর বিশ্বস্ততার ব্যাপারে চূড়ান্ত ঈর্ষাপ্রবণ।
একই সাথে পুরুষ নিজের সঙ্গীর স্তুতি বাইরের মানুষের থেকে শুনতে পছন্দ করে, আবার একই সাথে পুরুষ চায় তার নির্বাচিত সেরা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গীটি কেবল তার হয়েই থাকুক, অন্য কারও কুনজরে না পড়ুক।
বিশ্বসংসারে পুরুষের মতো এই বিরল প্রজাতির প্রাণী প্রজাতি আর কটা পাবেন বলুন। তবে হ্যাঁ, গর্ভধারণগত ঝুটঝামেলা না থাকলে আমার ধারণা মেয়েরাও পুরুষের সমপরিমাণে বহুগামী হতো।
অবশ্য আধুনিকতার ধোয়া তুলে নব্য পুঁজিবাদ মেয়েদের বহুগামিতাকে নানাভাবে প্রশ্রয়-আশ্রয় দিয়ে মাহাত্ম আরোপ করে চলেছে।
বহুদিন এত চমৎকার গোছানো উত্তর পায়নি অবন্তি, যা জানতে চেয়েছিল, তার পুরোটুকুই যুক্তিসংগতভাবে ব্যাখ্যা করেছে আবরার। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সিআইডি ডিপার্টমেন্টের বাকি তিন সারথিও।
বাহ! অসম্ভব সুন্দর বলেছ। তবে আবরার, আমার ধারণা ডেমি মনডেইন নিয়ে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
তামিম সাহেব উৎসুক ভঙ্গিতে তাকালেন সিআইডি প্রধানের দিকে।
ডেমি মনডেইন! সে আবার কী?
ডেমি মনডেইন বলতে সমাজের উঁচু স্তরের কিছু নারীদের বোঝায়। এরা শিক্ষাদীক্ষায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বৈচিত্র্যময় প্রেমিকদের থেকে নিত্যনতুন বিলাসসামগ্রী উপহার পেয়ে ফুলে কেঁপে ওঠে এই শ্রেণি।
হয় ক্যাশ না হয় ভোগ্যপণ্য, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী আর উঁচু স্তরের পুরুষের দৈহিক মনোরঞ্জনের জন্য এরা নিজেদের রূপ-যৌবন নিবেদিত করে।
এই ডেমি মনডেইনদের মাঝে যারা বুদ্ধিমতী, তারা নিজেদের রূপের বিনিময়ে অর্জিত অর্থকে ভবিষ্যতের লাভের আশায় ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। তা না হলে রূপ শেষ হবার সাথে সাথে পথে বসতে হয়। নায়িকা বনশ্রীর করুণ জীবনের ভিডিওটা সেদিন ইউটিউবে চোখে পড়ল।
রূপপোজীবিনীদের পেশা বড়ই নির্মম এক পেশা! যৌবন শেষ, চাহিদা শেষ। কসমেসিউটিক্যালসের বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি তো শুধু শুধু সব দেশে রাজ করছে না!
সিআইডি প্রধানের কথার রেশ ধরে অনুমোদনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ফজলে সাহেব,
ব্যোমকেশ বক্সীর মগ্নমৈনাক নামের একটা গল্পে ডেমি মনডেইন শব্দটা প্রথম ব্যবহার করতে দেখি। দু-তিন শতক আগে এই শব্দটা ব্যবহার করা হতো। আজকালকার বিউটি কনটেস্টগুলো তো আর কিছু নয়, সোজা বাংলায় ডেমি মনডেইন খুঁজে বের করার প্রতিযোগিতা। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের প্রযোজনা ছাড়া নায়িকা-মডেলদের বিলাসী জীবনযাপনের উপায় কী? বিশ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত শিল্পপতি-ব্যবসায়ী আর আমলাদের খাট কাঁপিয়ে, তাদের সাথে দেশ-বিদেশে ট্যুরে গিয়ে দুর্দান্ত কামাও, নাটক-সিনেমা তো কেবল একটা সাইনবোর্ড। তিরিশের কোটার মাঝামাঝিতে এক আদর্শ স্বামীর খোঁজে নেমে পড়-এই তো দেখে আসছি।
কয়েকটা ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি-তারপর মাথাটাথা ঢেকে কমপ্লিট হিজাবি হয়ে দীনের পথে আসা। সিনেমাটিনেমার কী আর ভালো গল্প আছে! সব টাকা এই ডেমি মনডেইনদের পেছনে ওড়ালে কী দ্বিতীয় কোনো সত্যজিৎ বের হয়ে আসবে এই বাংলায়? হালের এক নায়িকা আছে না, কিছু হলেই লাইভে এসে কান্নাকাটি করে…কী যেন নাম শামসুন্নাহার…
পরীমনি অ্যাডিশনাল ডিআইজির বিস্মৃতির পালে স্মৃতির হাওয়া লাগিয়ে দিলো আবরার। পরীমনির আসল নাম তো স্মৃতিই-আসলেই ডেমি মনডেইনের এর থেকে ভালো উদাহরণ আর পাওয়া সম্ভব নয়।
হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ পরীমনি। বিখ্যাত এক শিল্পপতির সুবাদে দুবাই ঘুরে আসার পর রিসোর্টে, জেট প্লেনে নায়িকার ছবি দেখে এদের আরেকটা প্রতিশব্দও খুঁজে বের করেছিলাম-জেট সেট (Jet Set)। তুমি নায়িকা ছাড়া ভার্সিটি পড়ুয়া সোসাইটি গার্লদের মাঝেও জেট সেটদের খুঁজে পাবে। বাসায় ঢুর, বন্ধুর বিয়ের কথা বলে টাকার বিনিময়ে উচ্চবিত্তদের সাথে দেশে-বিদেশে সফরসঙ্গী হয়ে থাকে এরা।
উফ! সব সমস্যা দেখছি এই উচ্চবিত্ত, বুর্জোয়া শ্রেণিটার মাঝে। আল্লাহই জানে এরা এত নারী দিয়ে করেটা কী! এতক্ষণ কথার কথকতা বেশ ভালোই উপভোগ করছিল অবন্তি। তবু উচ্চবিত্ত শব্দটা শুনলেই আজকাল তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
অবশ্য ডেমি মনডেইন শব্দটা এখন আর ব্যবহার করা হয় না। নিউ উম্যান শব্দটাই নাকি ডেমি মনডেইনের সাবস্টিটিউট। এই শব্দটা দিয়েই আজকাল রূপপোজীবিনীদের ইন্ডিকেট করা হয়। ফজলে রাব্বি স্যারের কথায় অবন্তির ভেতর থেকে সুপ্ত বিপ্লবী সত্তাটা জানান দিয়ে গেল,
স্যার, নিউ উম্যান সম্পর্কে আপনার ধারণার সাথে আমি পুরোপুরি ডিজঅ্যাগ্রি করছি।
পশ্চিমের ফেমিনিজমের জোয়ার প্রাচ্যে এসে লাগার পর থেকেই পুরুষের অধীন থেকে বেরিয়ে এসে মেয়েদের মাঝে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় সৃষ্টির প্রবণতা দেখা দেয়। এমন নয় যে সব মেয়ের রূপপোজীবিনী হতে ভালো লাগে।
স্বাধীনচেতা, ক্যারিয়ার-ওরিয়েন্টেড একটা মেয়ে মানেই ফেমিনিস্ট নয়। এমন মেয়েদের ডানা হেঁটে দিতে করপোরেটের মোড়কে রূপপোকর্মজীবিনী নামে নিউ উম্যানদের প্রতিষ্ঠিত করেছে বুর্জোয়ারা।
রূপ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ না করে মেধা, প্রজ্ঞা আর গুণ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে চাও? করতে পারবে, তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। মেধা, প্রজ্ঞা, গুণে কাজ হবে না-করপোরেটের বদ্ধ ঘরে শরীরের বাঁক দেখিয়ে, রূপের জাদুতে মুগ্ধ করতে হবে ঊর্ধ্বতনকে। তবেই না মিলবে প্রমোশন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে করপোরেটে আর মিডিয়াতে ব্যতিক্রম পাওয়াটা অমাবস্যার চাঁদ পাবার মতো।
এই ভয়ংকর চর্চা পুঁজিবাদেরই আউটকাম। আমি পুরো ব্যাপারটিকে নারীদের বিরুদ্ধে হওয়া বিশ্বব্যাপী এক ভয়ংকর নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই ভাবি না।
শুধু কী অভিনেত্রী আর কাস্টিং কাউচ? উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, আইনজীবী থেকে আমার মতো পুলিশ। আবার উচ্চশিক্ষার পথে পথে হাই সিজিপিএর লোভ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে পর্যন্ত…
এই তো এত ক্ষণে আসল প্রসঙ্গে এসেছেন। লোভ দেখিয়ে এটাই শুনতে চাইছিলাম আপনার থেকে। তা মেয়েরা লোভে পড়ে কেন সেটা বলুন।
আর বেনিফিট অব ডাউটে পার পেয়ে যাওয়া পুরুষের প্রসঙ্গ বাদই দিই। করপোরেটসুলভ কৃত্রিম প্লাস্টিক মুখের নারীর কারণে নিজের ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়ে কত যুবক যে সিস্টেমের বলি হচ্ছে সেই প্রশ্ন যদি আমি তুলি?
আবরারের তীক্ষ্ণধী প্রশ্ন হিমশীতল হাওয়া বইয়ে দিলো অবন্তির শরীর জুড়ে। আসলেই তো। কিছু মেয়ে এত লোভী কেন?
ভালো থাকার জন্য কী দরকার হয় জীবনে অনেকগুলো বাড়ি, রিসোর্ট? ইয়ট? মাসে মাসে বিদেশে ট্যুর? বেঞ্জ মার্সিডিস, রোলস রয়েস। নাকি দিনশেষে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার জন্য পরম নির্ভরতার একটা কঁধ? নাকি সব কটিই? নাহ, সবকিছুর মূলে আসলে পুঁজিবাদই দায়ী। আচ্ছা, লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে তোমাদের কচকচানি একটু বন্ধ করো তো দেখি। লেভেল ফাইভ সম্পর্কে আবরারের থেকে আমার কয়েকটা জিনিস জানার ছিল। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হতে হতেও বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কিছুটা দমে গেল আবরার। হাসান সাহেবের চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসল।
জি স্যার বলুন কী জানতে চান।
গ্রিক মিথোলজির সবগুলো চরিত্র নিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তর পড়াশোনা করলাম।
হলিউডের মেগা মাইন্ড অ্যানিমেশন মুভির পোস্টারের যে ছবি তোমাকে কো-অর্ডিনেট হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে কিছুতেই কোনো গ্রিক মিথের কু খুঁজে পাইনি।
আজকে তোমার থেকে লেভেল ফাইভের গেমের ডিটেইল শুনে জানলাম ফাস্ট কো-অর্ডিনেট ডিকোড করে তুমি সেফালাস-প্রক্রিসের উপকথা খুঁজে পেয়েছ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে?
উপস্থিত প্রত্যেকে উসুক ভঙ্গিতে তাকাল আবারের দিকে। প্রত্যেকের চোখে একই প্রশ্নের প্রতিচ্ছবি। আবরার হলরুমের মাঝে রাখা টেবিল থেকে এক চুমুক পানি দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল, যেন আসর জমানোর প্রস্তুতি।
আসলে, এত দিন তৃতীয় কো-অর্ডিনেটে হত্যার পদ্ধতিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংক্রান্ত কু থাকত। কিন্তু এবার প্রথম কো-অর্ডিনেটেই দেওয়া হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত কু।
মেগামাইন্ড চরিত্রের সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কী সম্পর্ক, এটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।
স্যার, মেগামাইন্ডের নীল শরীর আর অদ্ভুতদর্শন মাথা থেকে দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়-হয় কোনোভাবে রোগী সায়ানোসিসের পেশেন্ট অথবা ক্ষুদ্র শরীরের অনুপাতে বিশাল ত্রিকোণাকার মাথাটা হাইড্রেসেফালাসের রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সায়ানোসিস থেকে কাছাকাছি কোনো গ্রিক মিথোলজির কো-অর্ডিনেট অনুমান করতে পারিনি। বাকি থাকল মেগা মাইন্ড আর হাইড্রোসেফালাস। মেগা মাইন্ড থেকে কোনো গ্রিক মিথের চরিত্র খুঁজে না পেলেও হাইড্রোসেফালাস থেকে হাইড্রো প্রিফিক্সটা বাদ দিলেই কিন্তু সেফালাস নামটা পাওয়া যায়। সেফালাস আর প্রক্রিসের কাহিনি গ্রিক মিথে দারুণ জনপ্রিয়। হাইড্রোসেফালাস রোগটা নিয়ে গুগলে ঘাটাঘাটি করলাম অনেকক্ষণ। তেমন কিছু বুঝতে পারিনি। কী কঠিন কঠিন টার্মে লেখা-বাবাগো! সহজ ভাষায় একটু বোঝাও দেখি।
তামিম সাহেব মানুষটা বেশ রসিক। ছোটখাটো বেঁটে, ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা দুর্বোধ্যতার পাথুরে জমিতে যেন কালোরঙা কাশফুল। আবার মনে মনে একচোট হেসে নিলো। আচ্ছা কাশফুল যদি সাদা না হয়ে কালো হতো বা বেশ কয়েক রঙের ভ্যারিয়েন্ট দেখতে পাওয়া যেত, তাহলে কাশবনের আবেদন কী মানুষের কাছে একই থাকত?
না বোধ হয়। মানুষের অন্তর শুভ্র নয়। জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি অতিবাহিত দিনের সাথে সাথে মনের সম্পূর্ণ সাদা প্লেটে লেখা হতে থাকে কালো অক্ষরে কত না বিষাক্ত গোপনীয় সূত্র।
জলছাপে জেনেটিক ভাষাতে বংশানুক্রমে বয়ে নিয়ে আসা কত না আপাত-অকৃত কিন্তু ঘটিতব্য পাপের ফিরিস্তি! ভাবের জগতে হারিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। তামিম সাহেবের তাগাদায় সংবিৎ ফিরে পেল। স্যার, হাইড্রোসেফালাস মানুষের মস্তিষ্কের একটা বিশেষ শ্রেণির রোগ। সেরেব্রোস্পাইনাল নামের এক বিশেষ ফ্লুয়িড মস্তিষ্কে পুষ্টি সরবরাহ এবং বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের কাজ করে। কোনো কারণে যদি এই তরল মস্তিষ্ক থেকে ঠিকমতো বের না হতে পারে, তবে মাথার ভেতরে জমে গিয়ে এই রোগের সৃষ্টি করে।
আই সি। কিন্তু প্রক্রিস আর সেফালাসের সাথে ভিডিওর রিলেশনটা কী?
স্থানীয় গ্রিক মিথের এক বর্ণনা অনুযায়ী, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের রাজা এরিকথিয়াসের কন্যা ছিলেন প্রক্রিস। প্রক্রিসের বিয়ে হয় সেফালাস নামের এক যুবরাজের সাথে। সেফালাস ছিলেন অসম্ভব স্ত্রীভক্ত। হবেন নাই বা কেন। স্ত্রী প্রক্রিস যে অসম্ভব সুন্দরী-কোটিতে একজন। যেমন রূপ, তেমন তার গুণ। অসম্ভব সুন্দর গানের গলা তার। তার উপর বিদুষী। পুরুষ অনুরাগী, ভক্ত আর গুণগ্রাহীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। এখনকার যুগ অনুযায়ী বলা যায়, প্রক্রিস ছিলেন একজন লোকাল গ্রিক তারকা।
তবে প্রক্রিস নিজের রূপ আর গুণ দিয়ে পুরুষদের ভুলিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না, ডেমি মনডেইনদের মতো অসংখ্য প্রেমিকদের কাছ থেকে দামি দামি উপহারের বিনিময়ে বিছানায় যেতেন। ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও মনেপ্রাণে সেফালাস তার স্ত্রীকেই ভালোবাসতেন।
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর স্বভাব পরিবর্তন হয়েছে কি না, পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেফালাস এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে প্রক্রিসের কাছে গেলেন এবং মুকুটের লোভ দেখালেন। চিরাচরিত লোভী আর ব্যভিচারিণী প্রক্রিস সামান্য মুকুটের লোভে ছদ্মবেশী স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সাথে শুতে রাজি হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশ খুলে ফেললেন সেফালাস। স্ত্রীর স্বভাবে কোনো পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে যারপরনাই ভেঙে পড়েন। অবশেষে একদিন স্বামীর নিক্ষিপ্ত জ্যাভেলিনের আঘাতে প্রাণ হারান প্রক্রিস। আমি গ্রিক মিথোলজির কো-অর্ডিনেটটা ঠিকঠাক ডিকোড করার পরপরই ডামি ভিডিওটা পাঠানো হয়। ভিডিওতে আপনারা দেখতেই পেলেন, এক তারকা নারীর বহু পুরুষে আসক্তির জন্য তার স্বামী সেই নারী তারকাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। ভিডিও শেষে যার ছবি দেখানো হয়েছে, তাকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি। আমাদের দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পত্রলেখা চৌধুরী।
তার সম্পর্কে যতটুকু খোঁজখবর নেওয়া গেছে, তাতে করে জানতে পেরেছি যে তার স্বামী একজন সাধারণ ব্যাংকার, প্রভাবশালী গোছের কেউ নন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্যামিলি লাইফ নিয়ে খুব বেশি সরব নন পত্রলেখা।
কিন্তু একটা ইংরেজি গ্রামার বইয়ে আর্টিকেলের চ্যাপ্টারে The Padma Is A Big River লাইনটা সবুজ কালিতে লেখা দেখেই তুমি কী করে ফোর্থ কোডটা ডিকোড করে ফেললে?
সিআইডি প্রধানের দিকে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে তাকাল আবরার।
স্যার, আমাকে গ্রামার বইটা যখন পার্সেল করে পাঠানো হয়েছিল, উপরে গেমের সেই লোগোটা ছিল সবুজ রঙের। ভেতরে সবগুলো চ্যাপ্টার কালো কালিতে লেখা হলেও আর্টিকেলের চ্যাপ্টারে একটা লাইনমাত্র সবুজ কালিতে লেখা ছিল-The Padma is a big river। এখান থেকে ক্রাইম ভেন্যু খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
প্রথমে পত্রলেখা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছিলাম তিনি এক রিসোর্টে ছুটি কাটাতে গিয়েছেন। এখন আসুন কোডটা ব্রেক করা যাক। গ্রিক ভাষায় La শব্দটি দিয়ে ইংরেজি আর্টিকেল A, An, The-কে বোঝায়। তাই আর্টিকেল চ্যাপ্টারে ইন্ডিকেশন দেখে রিসোর্টের নামের একটা কমন প্রিফিক্স অর্থাৎ উপসর্গ মাথায় এলো-La।
আর River আর Padma শব্দ দুটির আগে পরে La লাগিয়ে রিসোর্টের নাম গুগল করতেই পেয়ে গেলাম La Riveria Resort, পূর্বাচল কাঞ্চন ব্রিজ থেকে মাত্র ১০ মিনিট হাঁটার পথে।
পত্ৰলেখা চৌধুরীর স্বামী ছিলেন ঢাকায়। সংগত কারণেই ধরে নিয়েছি, তার বর্তমান মিউজিক ভিডিওতে যেই পুরুষ মডেলকে কাস্ট করা হয়েছে, তার সাথেই রঙ্গলীলা করতে গিয়েছেন পত্রলেখা। তিনি আবার নিদারুণ সৌন্দর্যের পূজারি কিনা। ইন্ডাস্ট্রিতে আসা সুদর্শন তরুণদের শয্যাসঙ্গী করা তার প্রিয় শখের একটি। মহিলা মিডিয়া মাফিয়া বলা যেতে পারে তাকে।
পত্রলেখার স্বামী বহুগামী স্ত্রীকে হত্যার জন্য যে নিউরোটক্সিন কনিয়াম ম্যাকুলেটাম ব্যবহার করতে যাচ্ছেন-থার্ড কো-অর্ডিনেটে সক্রেটিসের ছবি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।
হ্যাঁ, এবারের থার্ড কো-অর্ডিনেটটা বেশ সহজ ছিল। সক্রেটিসকে যে হেমলক বিষ দিয়ে মারা হয়েছে, এটা কে না জানে! নাহ, এবার আপনার বুদ্ধির পরীক্ষাটা বেশিই সহজ হয়ে গেল! গেমের প্ল্যানাররা কাজটা ঠিক করল না।
চোখ পাকিয়ে আবরারের দিকে তাকাল অবন্তি, সূক্ষ্ম খোঁচাটা গায়ে মাখাল না আবরার। কণ্ঠে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে চলল,
৩১ তারিখ গেম ভেন্যুতে সকাল থেকে খুব সূক্ষ্ম নজর রাখি। রুম নম্বর ৪০৮-এ ভদ্রমহিলা উঠেছেন-এতটুকু জানতে পারি। বিশাল এক চিত্রপরিচালক শাহাবুদ্দিনের ছবিতে পত্ৰলেখার পরবর্তী প্লেব্যাকের কাজ করার কথা। পরিচালকের এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে পত্রলেখা চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলেও অনুমতি মেলেনি।
শেষমেশ বুদ্ধি করে হোটেল ম্যানেজারের মাধ্যমে ভয়েস টেক্সট পাঠালাম যে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে খবর আছে, পত্রলেখা চৌধুরীর জীবনহানির সম্ভাবনা আছে। এই ব্যাপারে কথা বলার জন্যই আমি এসেছি।
এতে কাজ হলো। পুলিশ থেকে লোক এসেছে শুনে তিনি দেখা করতে রাজি হলেন। রিসোর্টের লবিতে বসে আছি, এমন সময় লম্বা আর ফর্সা, অসম্ভব সুদর্শন এক তরুণ এসে রিসিপশনিস্টকে বলল রুম নম্বর ৪০৮-এ প্যাপায়া জুস পাঠিয়ে দিতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুবককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। বেশ পরিচিত মুখ। মডেলিং পাড়ায় ভালোই নাম করেছে।
এরই সাথে তবে অবসর যাপন করতে এসেছেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মনে মনে ভাবতে ভাবতেই কান খাড়া করে শুনলাম রিসিপশনিস্ট বলছে, স্যার, আপনি রুমে যান। ১০ মিনিটের মধ্যেই জুস পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ইন্টুইশন বলে কোনো কিছু আছে, এমনটা আমি আগে বিশ্বাস করতাম না। তবে ঐ মুহূর্তে কেন যেন মনে হলো, জুসের মধ্যেই মেশানো হবে প্রাণঘাতী হেমলক-Conium Maculatum।
ওদিকে আমাকে লবিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে, সম্ভবত জুস খেয়ে ফ্রেশট্রেশ হয়েই আমাকে রুমে ডাকার প্ল্যান করছেন পত্ৰলেখা। নাহ, যা করার সর্বনাশ ঘটার আগেই করতে হবে। আমার হাতেও প্ল্যান বি ছিল। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এলিভেটরে ঢুকে ৩-এ প্রেস করলাম। ৪০৮ নম্বর ঘরের পাশেই ঘাপটি মেরে দাঁড়ালাম, কেউ জুস নিয়ে আসার সাথে সাথেই যেন তার নাগাল পাই। মিনিট সাতেকের মাথায় জুস নিয়ে মাঝারি উচ্চতার একজন স্টাফ রুমের দরজার নবে হাত রাখতেই ক্লোরোফর্ম মেশানো রুমাল মুখে চেপে ধরে হাত থেকে গ্লাস দুটো সরিয়ে নিলাম।
লোকটা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগেই আরেক হাত দিয়ে ধরে ফেললাম। আশপাশে ভালো করে তাকিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চেতনাহীন শরীরটা টানতে টানতে পাশের রেস্টরুমে নিয়ে গেলাম। আংটি থেকে যান্ত্রিক মহিলা কণ্ঠ বরাবরের মতো বলে উঠল,
লেভেল ফাইভে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
পরের অংশটুকু বেশ সংক্ষিপ্তভাবেই বলা যেতে পারে। পত্রলেখাকে তার স্বামীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সব বুঝিয়ে বললে প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চাইলেন না।
তবে ঢাকায় ফিরে জুসের ফরেনসিক টেস্টের রিপোর্ট আসতেই আমার কথার সত্যাসত্য নির্ধারণ হয়ে গেল। হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায় তার স্বামীকে পুলিশ অ্যারেস্টও করল। আবরারের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন সিআইডি প্রধান,
আবরার, কী জানো তো? লেভেল ফাইভের এই গেমে সত্যিকারের জিত কিন্তু পুঁজিবাদেরই হয়েছে। স্বামী ছাপোষা ব্যাংকার। সেলিব্রেটি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করলে আইন তো তাকে ছেড়ে দেবে না, তাই না। আইন তো কেবল মধ্যবিত্তদের আর নিম্নবিত্তদের করায়ত্তে রাখার জন্য!
আবরার ধীর পায়ে হেঁটে জানালার সামনে দাঁড়াল। জানালার গ্রিল দিয়ে দেখতে পাওয়া রাতের আকাশে স্তিমিত চাঁদের আলো। আধিভৌতিক আবহে যেন মনে হলো, শৈলের গহ্বরে ছেয়ে গেছে গোটা আকাশটা-তরঙ্গভঙ্গের গত্যন্তর নেই। থাকবে কী করে, এই শৈল গহ্বর যে বুর্জোয়াদের গ্রাসেরই প্রতীতি!
১২. HellMyth Game-Level 6 (হেলমিথ গেম-লেভেল ৬)
পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট সাইট থেকে সোজা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় পুলিশের গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অবন্তি। আকাশের সাদা মেঘের ভেলা যেন নরম আঙুলের ডগা দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়া যায়।
দক্ষিণ পাশে লামা, থানচি। পূর্ব দিক থেকে তাজিংডং আর কেওক্রাডং পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ি সরু রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি দেখতে পাওয়া যায় কালেভদ্রে। অবন্তি ফাস্ট গিয়ারে সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে উপরে উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে স্তিমিত গতিকে ক্রমশ আরও স্তিমিত করে ফেলেছে। পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভিংয়ে একেবারেই সাবলীল নয় অবন্তি, সুযোগই তো হলো এই প্রথম। পাশের সিটে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে আবরার। চোখ দুটো গাড়ির কাঁচ পেরিয়ে অসীমের দিকে। মাদক পাচারের একটা কেস ইনভেস্টিগেট করতে সিআইডি টিম পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে দুদিন হলো। আবরার এবার কিছুতেই আসতে চাচ্ছিল না, অবন্তির জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত না এসে পারেনি। লেভেল সিক্সের গেমটাতে ব্যর্থ হবার পরে বেচারা খুব ভেঙে পড়েছে। আজকে ইনভেস্টিগেশনের অব ডে ছিল। তাই আবরারের মন ভালো করতেই হোটেল থেকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। এলাকাটা কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলে যদি মহাশয় একটু স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলেন-অবন্তির ক্ষীণ আশা! পাহাড় আবরারের ভীষণ প্রিয়। দিগন্তবিস্তৃত সাগরের আদ্যোপান্ত রহস্যের মাঝে বৈচিত্র্য নেই, এক নিমেষেই কেমন যেন আপাত দুর্লঙ্ঘ্য রহস্যের আদ্যোপান্ত ভেদ হয়ে যায়।
কিন্তু বিপিনের সবুজের মাঝে উঁকি দেওয়া পাহাড়, বুকচিরে ঝিরিঝিরি শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণার মাঝে রংধনুর সাত রঙের মতো বহুস্তরী রহস্যের পরত আছে।
সাবধানে চারপাশে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা দাঁড় করাল অবন্তি। আবরারের চোখ এখনো শূন্যে। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না, কোন রহস্যের জগতে হারিয়ে গেছে কে জানে! অবন্তি ঈষৎ দ্বিধা-শঙ্কিত বুকে আবরারের কাঁধে হাত রাখল।
এই যে মশাই! কী হয়েছে আপনার বলুন তো! তখন থেকে মৌন সন্ন্যাসী সেজে বসে আছেন। আরে বাবা, মাত্র একটা লেভেলেই তো আনসাকসেসফুল হয়েছেন। বাকি সবগুলো লেভেল ইনশাআল্লাহ ভালোয় ভালোয় পার হয়ে যাবেন। সংবিৎ ফিরে পেয়ে অবন্তির চোখে চোখ রাখল আবরার। না না, লেভেল সিক্সে আনসাকসেসফুল হয়েছি দেখে মনটা বিক্ষিপ্ত, এমন নয়। আসলে, মানুষের কিছু অদ্ভুত সাইকোলজি নিয়ে ভাবছিলাম।
উৎসুক দৃষ্টিতে নিজের গোল গোল বড় বড় চোখ দুটোকে আরও স্ফীত করে আবরারের মুখের দিকে তাকাল অবন্তি। কী সাইকোলজি?।
একটা মানুষ নিজের থেকে বেশি কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু একজন মা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও নিজের আসন্ন মৃত্যুর অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ককে ভুলে গিয়ে অনাগত সন্তানটাকে বাঁচাতে চায়-কীভাবে সম্ভব এটা! এটাই ভাবছিলাম আর কী।
আপনি যে লেভেল সিক্সের হ্যাং ওভার থেকে এখনো বের হতে পারেননি, তা বেশ বুঝতে পারছি। যাহোক, আমার ধারণা, প্রত্যেক প্রাণী প্রজাতির ক্ষেত্রেই, মা-বাবারা সন্তানদের সুখী দেখতে পাওয়ার জন্য পারলে নিজের প্রাণটুকুকে পর্যন্ত হাতের মুঠোয় নেয়। সেদিন নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতে এক ভিডিওতে দেখলাম, একটা নিউলি ওয়েড কাপল গাড়িতে রোমান্স করছে, এমন সময় একজন মাঝবয়সি মহিলা হাত দিয়ে গাড়ি থামালো। পুরুষটি গাড়ি থেকে নেমে দেখতে পেলেন, মহিলার কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। মহিলাটি অনুনয় করে বলল, তার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে পাশের খাদে পড়ে গেছে, নিজের সন্তানটিকে কিছুতেই উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
সদ্য বিবাহিত কাপল মহিলার পিছু পিছু খাদের পাশে গেলেন। ভদ্রলোক প্রায় বিধ্বস্ত গাড়ির পেছনের সিট থেকে দুবছর বয়সি ছোট একটা শিশুকে উদ্ধার করে ড্রাইভিং সিটের দিকে এগোতেই ভয়ের শীতল স্রোত তার কাঁধ বেয়ে নেমে এলো।
ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং হুইলে মাথা দিয়ে আছে সেই ভদ্রমহিলা, যে কিছুক্ষণ আগেই সন্তানকে বাঁচাতে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। ডাইভিং সিটে পড়ে থাকা দেহে নেই প্রাণের স্পন্দন। আশপাশে তাকিয়ে কোথাও তার ছায়া খুঁজে পাওয়া গেল না আর। যদিও পুরো ভিডিওটা একটা অ্যালিগরি, তবু আমার কেন যেন মনে হয়, পারলৌকিকতা বলে কিছু থাকলে, মায়েরা মৃত্যুর পরেও চায় তার সন্তানের যেন কোনো অমঙ্গল না হয়।
নিটোল দৃষ্টিতে অবন্তির দিকে তাকাল আবরার।
সত্যি বলতে কী অবন্তি, যদিও আমি তখন বলেছি কারণটা কী ভাবছি, সত্যিকারের কারণটা কিন্তু আমি জানি। আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ সাবকনশাস মাইন্ড থেকে কনশাস মাইন্ডে তথ্যটা পাঠাব কী পাঠাব না করে লুকোচুরি খেলা খেলছিল।
কারণ কী জানেন? কারণ আমার কনশাস মাইন্ড মা-সন্তানের সম্পর্কে যৌক্তিকতা নয়, উষ্ণতা আর মাহাত্ম আরোপ করতে চাইছিল। আমরা মানুষেরা যতই নিজেদের যুক্তিবাদী দাবি করি না কেন, আমরা কারণে অকারণে অযৌক্তিকতাকে আঁকড়ে ধরতে ভালোবাসি। আচ্ছা, আমরা কী এখানে বসেই কথা বলতে থাকব নাকি? চলুন না, পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঐ পথটা ধরে একটু হেঁটে আসি।
প্রস্তাব শেষ করে আবরারের অনুমোদনের অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। আবরার গাড়ি থেকে নেমে অবন্তির পাশে দাঁড়াল। গুটি গুটি পায়ে দুজন পাহাড়ের ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। যেন বীথিকার বৈতালিক শান্তিনিকেতনি সুরের মাঝে আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে চলা এক জোড়া কপোত-কপোতী।
তা এবার বলুন। কনশাস মাইন্ড তো এখন আপনাকে সত্যটা জানিয়েছে। সেটা কী?
মানুষসহ যেকোনো প্রাণী প্রজাতিদের অধিকাংশ অপত্যস্নেহ প্রদর্শন কিংবা সন্তানদের প্রাণ রক্ষা করার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয়। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এর কারণ ট্রান্সক্রিপ্টেড জিন অভিযোজনের তাড়না।
ইউ মিন ঐ যে ম্যাট্রিক-ইন্টার লেভেলে পড়েছিলাম DNA থেকে RNA তৈরির পদ্ধতি, ট্রান্সক্রিপশন?
একজ্যাক্টলি! মেডিক্যাল টার্মগুলোর পরিভাষার দরকার কী জানি না বাপু! ইংরেজি টার্মগুলোই সবাই মনে রাখে। যাইহোক, যা বলছিলাম…মানুষের পরবর্তী জিন রক্ষা না পেলে, নিজের দেহ যত প্রতিসম আর মননামুগ্ধকর হোক না কেন, তার কোনো অভিযোজিত মূল্য নেই।
একধরনের ইঁদুর আছে, যারা কেবল জিন সঞ্চালনের জন্য বেঁচে থাকে। আবার একধরনের ক্যানিবাল মাকড়সা আছে, যাদের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাকড়সাটি মিলনের পর পুরুষ মাকড়সাটিকে খেয়ে ফেলে।
নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কেবলমাত্র নিজের অপত্যে জিন সঞ্চালনের জন্য পুরুষ প্রজাতি বেঁচে থাকে। প্লিজ, এখন আবার বলে বসবেন না মানুষও জিন সঞ্চালনের জন্য বেঁচে থাকে। অ্যাট লিস্ট টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে এসে এই কথার গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না। শিল্পসাহিত্য, বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে এত উৎকর্ষের পেছনে যেই প্রজাতি, তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য নাকি জিন সঞ্চালন! ছ্যা ছ্যা ছ্যা। আমি আপনারই মতো ভেতরে ভেতরে জেনেটিক্যাল ব্যাপারটা মানতে পারছিলাম না দেখেই মস্তিষ্কের অবচেতন অংশে এই তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
তবে, মানুষের জাংক ডিএনএ অর্থাৎ সেগ্রিগেশন ডিসটরশন জিনের ধর্ম কিন্তু এটাই নিজের শরীরের ক্ষতি করে হলেও পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখা।
এই জিনগত কচকচানি আপাতত মুলতবি করা যাক। নতুন কেসের প্রেশারে আপনার গেমের লেভেল নিয়ে এবার আর বসা হলো না।
উমম…লেভেল ওয়ান না যেন টুতেও আপনি হেরার কু পেয়েছিলেন। এবার কী করে আমিনা আর হেরা রিলেটেড মিথটা অনুমান করলেন? গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী আমিনা মর্ত্যের অতি সুন্দরী এক মানবী ছিলেন। যথারীতি লম্পট জিউস এবার প্রেমে পড়লেন আমিনার। আল্কমিনার স্বামী এম্ফিট্রিয়নের ছদ্মবেশে জিউস তাকে ভোগ করলেন। গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। আমিনা। এই ঘটনার পর জিউস ঘোষণা দিলেন, পারসিউসের বংশে যে নতুন অতিথি আসছে, সে-ই মাইসিনিয়া শাসন করবে।
যথারীতি হেরা নিজের লম্পট স্বামী জিউসের কোনো শাস্তিই দিলেন না, বরং নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি যাবতীয় ঘৃণা উগড়ে দিলেন।
সিদ্ধান্ত নিলেন, আমিনার সন্তান প্রসব দেরিতে করাবেন, যাতে তার অনাগত সন্তান রাজা না হতে পারে। পারসিউসের বংশের ছেনেলাউসের স্ত্রী নিকিপ্পেরও সন্তান প্রসবের সময় আমিনার কাছাকাছি সময়ে ছিল। দেবী হেরা শিশু জনের দেবী ইলেইইথিয়াকে আমিনার কাছে পাঠালেন, যাতে তার সন্তান প্রসব দেরিতে হয়। পরিকল্পনামতে, আস্কৃমিনার সন্তান হেরাক্লেস, যাকে আমরা রোমান ভাষায় হারকিউলিস নামে জেনে থাকি, তার জন্য ঠিক সাত দিন পিছিয়ে দেওয়া হলো।
ফলে স্থেনেলাউসের সন্তান ইউরিস্থিয়াসই হলেন মাইসেনিয়ার শাসক, নিজের দেওয়া কথা ফিরিয়ে নেবার ক্ষেত্রে জিউসের সীমাবদ্ধতা ছিল। এবার আমি প্রথম কো-অর্ডিনেট পাই মেডিক্যাল কলেজে লেকচার দেওয়ার সময় স্টাফের হাত থেকে হাজিরা খাতা নিয়ে রোল কল করতে গিয়ে।
হাজিরা খাতার মাঝে একটা লাল রঙের খামের উপর গেমের লোগো।
খামের ভেতরের কাগজে কালার প্রিন্ট অবস্থায় Brucellosis নামে এক ব্যাকটেরিয়ার ছবি আঁকা, আর তার ঠিক পাশে গ্রিক অক্ষরে সাত লেখা। এই কো-অর্ডিনেট থেকে গ্রিক মিথোলজির কোড ডিকোড করতে আমার প্রচণ্ড পরিশ্রম হয়েছে।
দাঁড়ান, আগেই রিভিল করবেন না। উমমম…সাত শুনে বুঝতে পেরেছি, কিছুক্ষণ আগে বাচ্চা ডেলিভারি সাত দিন পেছানোর যে ঘটনা শোনালেন, তার আভাস ছিল কোডে। কিন্তু Brucellosis থেকে গ্রিক মিথ…উম্মমম…
শত চেষ্টার পরেও তেমন কিছু কোরিলেট করতে পারল না অবন্তি। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাল আবরারের দিকে। গ্রিক মিথোলজির আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত দুবার করে পড়ে ফেলেছে এ কয়েক মাসে। অবন্তি কিছুতেই বুঝতে পারল না, দায়বদ্ধতার উপহাসে কোলাহল ক্ষীণ হয়ে এলে, মৃত্যু খড়গ মাথার উপর ঝুলতে থাকলে, আবরারের মতো স্থিতধী হয়ে রহস্যের সমাধান কীভাবে করা সম্ভব! মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকিয়ে আবরারের ঠোঁট গোল করে বলা প্রত্যেকটা শব্দকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে অবন্তির। আবরারের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল।
এই কোডটা খুব একটা সহজ নয়। চেষ্টা করে লাভ নেই। সোজা আঙুলে নয়, এবার একটু বাঁকা আঙুলে ঘি তুলতে হয়েছে। আমার পাক্কা দুই দিন সময় লেগেছে কেবল এই কোডটা ডিকোড করতে। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, Brucellosis একধরনের জুনোটিক ডিজিজ।
জুনোটিক ডিজিজ সম্পর্কে গুগল করলেই দেখতে পাবেন। মানুষ ছাড়া অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মানুষে যেসব রোগ ছড়ায়, সেগুলোকে বলে জুনোটিক ডিজিজ। ইউ মিন ঐ যে অ্যানাক্স নামে একটা ডিজিজ নিয়ে যে অনেক লেখালেখি হলো পেপার-পত্রিকায়, ওটাও একধরনের জুনোটিক ডিজিজ, রাইট?
ঠিক ধরেছেন। জুনো শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ব্লু। গ্রিক মিথোলজিতে যিনি হেরা, রোমান মিথোলজিতে তাকেই জুনো বলে ডাকা হয়। হেরা আর সাত-এই দুটো কু থেকেই আমিনার সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া পেছানো হবে-এতটুকু অনুমান করতে পারি।
সাথে সাথেই হোয়াটসঅ্যাপে ডামি ভিডিও পাঠানো হয়। ইউক্রেইনের বিখ্যাত মডেলদের ব্যবহার করা হয়েছে এবারের ভিডিওতে। ফেসবুকে তেমন একটা থাকার সময় না পেলেও ইনস্টাগ্রামে থাকা হয় মাঝেসাঝে। সেই সুবাদে বিভিন্ন দেশের সুন্দরী মডেলদের খোঁজখবর রাখা হয়।
বুকে ঈর্ষার সূক্ষ্ম তীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো অবন্তিকে। হাঁটার গতি কমিয়ে বিষদৃষ্টিতে তাকাল আবরারের দিকে। আবরারের চাহনি ভাবলেশহীন, কণ্ঠে কৌতুকাবহতা।
অবন্তির দিকে আপাত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকালেও অনুসন্ধিৎসার তৃতীয় চোখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে কয়েকবার করে।
সিভিল ড্রেসে দারুণ মানিয়েছে ওকে। ছিপছিপে শরীরে ফুলের নকশা কাটা ফতুয়া, ফেডেড জিন্স, ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস। পশ্চিমা পোশাকেও কাজল চোখে মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে! আগে কখনো এমনটা দেখেনি আবরার। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের পোশাকি সম্মেলন যে চোখের কাজল আর জিন্স-টপেও পাওয়া যেতে পারে, এই বৈপরীত্য আশাই বা করবে কোথায়। সব মেয়ে তো আর অবন্তি নয়। ঝর্ণাচোখে ডুবে যাওয়া তৃষ্ণার্ত ডুবুরির মতো ঐ কাজল চোখে ডুবসাঁতার দিয়ে যে কেউ লিখে ফেলতে পারে মহাকাব্যের সমান উপাখ্যান। কবিতার মতো সুন্দর কিছু মেয়ে থাকে, অসংখ্য ছেলেছোকরা তাকে কাছে না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস পিদিমের শিখায় কিংবা লিম্বিক সিস্টেমের তীব্র দাবানলে পুড়িয়ে খাক করে দেয়। মেয়েটা সম্ভবত ছাত্রজীবনে এমন অজস্র ছাইয়ের জাতিকা ছিল।
ভালোই তো সুন্দরী মডেলদের ইনস্টাগ্রামে স্টক করে বেড়ানো হয়!
ভাগ্যিস স্টক করেছি! কোথায় কখন কবে কোন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ কাজে লেগে যায়, তা কে বলতে পারে। আমাকেই দেখুন না। আমি কি ভেবেছিলাম যে ইনস্টাগ্রামের মডেলদের স্টক করে লব্ধজ্ঞান এত দিন পরে এসে এক কিম্ভুতকিমাকার গেমের পোশাক পরবে। তারপর স্কন্ধকাটা ভূতের মতো আমার কাঁধের উপর ভর করে নিজেকে জাহির করবে?
কী ছিল ভিডিওটাতে?
ডামি ভিডিওতে দেখানো হয়েছে দুজন নারীকে। একজন মধ্যবয়স্কা, অন্যজনের বয়স বিশ-বাইশ হবে। অবশ্য মেয়েদের আজকাল দেখলে কিছুতেই বয়স অনুমান করা যায় না।
চেহারার গঠন বাঙালিদের মতো নয়, না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা ডামি ভিডিও।
তরুণী নারীটি প্রেগন্যান্ট। চল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওর শুরুতেই দেখা যায়, মধ্যবয়স্কা মহিলা বিজাতীয় ভাষায় গালি দিতে দিতে প্রচণ্ড জোরে চড় থাপ্পড় মারছে তরুণীটিকে।
ভিডিওর নিচে স্ক্রিনে ইংরেজি সাবটাইটেল থাকায় অপভাষার মর্মার্থ বুঝতে সমস্যা হয়নি। মহিলার প্রভাবশালী স্বামী তাকে ফাঁকি দিয়ে কচি মাংসের লোভে অসম্ভব সুন্দরী তরুণীটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পর দিন এক বিলাসবহুল বাংলো বাড়িতে রেখে ভোগ করেছে, তরুণীটির ভাষ্যমতে এতটুকু জানা যায়।
শেষ পর্যন্ত নিজের স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে গেছে প্রভাবশালী দানবটি। তবু নিজের স্বামীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে স্বামীর রক্ষিতাকে শারীরিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি, স্পষ্ট ভাষায় হুমকি দিচ্ছেন, তোর পেটের ঐ কীটটা কেমনে বাঁচে আমি দেখে নেব নটী মাগি ইংরেজি সাবটাইটেলের বঙ্গানুবাদ করলে অনেকটা এমনই অর্থ দাঁড়ায় সেই হুমকির। ডামি ভিডিও শেষে এক নারীর ছবি ভেসে উঠল স্ক্রিনে।
অসম্ভব সুন্দরী, কাশ্মীরিদের মতো কাটাকাটা চোখ-মুখ। তবে গায়ের রং দেখে মেয়েটি যে বাঙালি বুঝতে পারা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, এই-ই হতে যাচ্ছে লেভেল সিক্সের ভিকটিম। ছবির নিচে নাম স্ক্রল করতে দেখা গেল, রায়না ইসলাম। ন্যাশনাল আইডির ডেটাবেজ থেকে মেয়েটির নাম আর ছবির ভিত্তিতে বাসার ঠিকানা জানতে পারলাম। তবে মেয়েটি সেখানে বর্তমানে থাকে না। প্রভাবশালী কোন লোকের সাথে মেয়েটি লিভ ইন সম্পর্কে জড়িয়ে আছে কিনা-এ সম্পর্কে অবশ্য ন্যূনতম ব্লু পেলাম না।
বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ে না অবন্তির।
কী বিচিত্র মানুষের সাইকোলজি। কেবল নিজের স্বামী সমাজের চোখে অনেক কেউকেটা দেখে স্বামীকে কিছুই না করে অন্য ঘরের এক মেয়েকে শাস্তি দিচ্ছেন। স্বামীকে শাস্তি দেবেন কী করে? স্বামীর অর্থের জোরেই তো রানির হালে জীবনযাপন করছেন, দশজনের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, তাই নয় কি?
সম্পূর্ণ ভিন্ন পারিবারিক অবস্থান, প্রেক্ষাপট থেকে আসা, বয়সে অনেকটা ছোট এক নারী, যে কিনা আরেক মহিলার স্বামীর লালসার স্বীকার-একজনের কৃত পাপের ফল ভোগ করতে হচ্ছে আরেকজন নিরপরাধ নিষ্পাপ মানুষকে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও মাৎস্যন্যায়ের যুগ থেকে আমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। নামেই কেবল একুশ শতক। আমাদের মস্তিষ্কের করোটি তো এখনো পড়ে আছে সেই আদিম যুগে।
অবন্তি, তরুণীটিকে নিরপরাধ বা নিষ্পাপ বলা যাবে কি না-এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হতে পারে। একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে টাকার লোভে সম্পর্কে জড়ানো নারীকে আমি নিরপরাধ মনে করি না।
দেখুন আবরার! মানছি, যেসব মেয়ে শুগার ড্যাডির কালচার চর্চা করে, তাদের একেবারে নিরপরাধ বা নিষ্পাপ বলা যায় না। এসব মেয়ের পতনের কারণ তাদের টাকার লোভ। কিন্তু ডামি ভিডিওতে ইউক্রেনের মডেল দিয়ে আমাদের দেশের যে প্রেক্ষাপট দেখানো হয়েছে, সেখানে মেয়েদের আর্থসামাজিক অবস্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
আপনি তো তরুণীটির সম্পর্কে কিছু জানেন না। এমনও তো হতে পারে, পিতৃহীন এক সুন্দরী নারী ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ হয়ে থাকার চেয়ে বয়স্ক বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানোকে অধিকতর নিরাপদ ভেবেছে।
আগপিছ বিবেচনা না করেই মেয়েটিকে আপনি কীভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন। আর যেখানে মানি ইজ দ্য সেকেন্ড গড-অর্থের লোভে লোভী হবার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর হলে একা একটি সুন্দরী তরুণী কেন, একজন বাঙালিও বোধ হয় আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে থাকতেন না।
অবন্তির কণ্ঠে ঝরে পড়ছে দ্রোহ মাখানো বিপ্লবের সুর। তর্কটাকে জমে ওঠার সুযোগ দিতে মন সায় দিলো না আবরারের।
আচ্ছা বেশ! আমার কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম।
পটলচেরা চোখ দুটোকে কুটিল ষড়যন্ত্রীর মতো সরু করে আবরারের দিকে তাকাল অবন্তি। বিতর্কের সুযোগ থাকতেও আবরার সেই সুযোগ হেলায় হারানোর ছেলে নয়। তার মানে নিশ্চয়ই লেভেল সিক্সের ট্রমা থেকে এখনো বের হতে পারেনি।
তৃতীয় কো-অর্ডিনেটের কথা জিজ্ঞেস করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াটা সমীচীন হবে কি না, ভাবতে ভাবতেই আবরারের গম্ভীর গলা শুনতে পেল অবন্তি। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে গাড়িটা পেছনে রেখে অনেকটা দূর চলে এসেছে।
তৃতীয় কো-অর্ডিনেটটা পাঠানো হয় দিন তিনেক পরে। একটা সবুজ রঙের খামের উপর গেমের জ্বলজ্বলে লোগো। খামের ভেতর পোলারয়েড একটা ছবি।
ছবির দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলাম। টার্বাইনের এত সুন্দর স্পষ্ট ছবি ওয়ার্ল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা দিয়ে এতটা দৃষ্টিনন্দন করে তোলা যেতে পারে, ধারণাই ছিল না আমার।
ঐ যে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে চাকার মতো মেশিন…ছোটবেলায় পড়েছিলাম।
আবরারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে অবন্তির ত্বরিত অনুমান। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। এরই সাথে পাঠানো হলো একটা স্লেটে অনেকগুলো ছোট বিন্দুর সমন্বয়ে একটা সরলরেখার ছবি। কী বিচিত্র! হত্যাপদ্ধতি অনুমান করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি এবার আমাকে। প্রথমে অবশ্য ভাবছিলাম, টার্বাইনের মাধ্যমে কোনো হত্যাযজ্ঞ ঘটানো হবে কি না! কিন্তু এর আগে প্রত্যেক লেভেলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে হত্যাপদ্ধতি কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
টার্বাইন আর সরলরেখা-দুটো থেকে অনেক চিন্তাভাবনা করে খুঁজে বের করলাম একটা ড্রাগের।
নাম-টার্বুটালাইন (Terbutaline)। টার্বাইন থেকে টার্ব আর সরলরেখার ইংরেজি করলে পাওয়া যাচ্ছে লাইন।
কী! টা…টার্তুমারবু…। ধুর মশাই! আপনারা ডাক্তাররা কেমন করে যে এত কঠিন কঠিন ডাগের নাম মনে রাখেন কে জানে!
একরাশ গাম্ভীর্যের মাঝে ফিক করে হেসে উঠতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হতে গিয়েও কোনোমতে নিজেকে থামাল আবরার। টাবুটালাইন এমন এক বিশেষ শ্রেণির ড্রাগ, যেটার মেকানিজম অনেকটা এ রকম : এটা প্রধানত আমাদের স্বরযন্ত্রের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে বেশি বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং ফুসফুস থেকে বাতাস বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে টাবুটালাইন শ্বাসকষ্ট, কাশি কমায়। তবে এর একটা অন্য ব্যবহারও আছে। গেম ডেভেলপাররা যে এই ব্যবহারটাকেই প্রাধান্য দেবে আমি বুঝে গিয়েছিলাম।
কী সেটা? লক্ষ করে দেখুন, ডামি ভিডিওটাতে দেখা গেছে, তরুণীটি প্রেগন্যান্ট। টার্বুটালাইন ড্রাগের অন্য একটি ব্যবহার হলো, এটি প্রিম্যাচিউর লেবারকে দেরি করিয়ে দেয়।
প্রিম্যাচিউর লেবার বলতে ডেলিভারির সম্ভাব্য সময়ের আগে বাচ্চা ডেলিভারিকে বোঝায় না?
হাহা…আপনার কমন সেন্স অ্যাভারেজ মানুষের তুলনায় যথেষ্ট ভালো।
হয়েছে, হয়েছে। কথায় কথায় খুঁত ধরে এখন আর খুশি করতে হবে না। বলতে থাকুন।
আমি কাউকে খুশি করতে তেমন একটা অভ্যস্ত নই। আমার থেকে কমপ্লিমেন্ট পেলে, সেটাকে জেনুইন ভেবে নিতে পারেন। টাবুটালাইন ওভারডোজ-সংক্রান্ত সম্ভাব্য সব পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। গ্রিক মিথোলজির কাহিনি।, আমিনার সন্তান হেরাক্লেসের জন্মকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল হেরার আদেশে। আর হেলমিথ গেমে এই মিথোলজিক্যাল ভার্সন টার্বুটালাইন ড্রাগের মাধ্যমে রিক্রিয়েট করা হচ্ছে–এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম।
হায়রে! মিথে সন্তান জন্মের দেবী ইলেইইথিয়া আধুনিক যুগে এসে হয়ে পড়ল টাবুটালাইন ড্রাগ। খ্রিস্টপূর্ব দু-তিন হাজার আর দুই হাজার একুশ খ্রিস্টাব্দ–এক যুগে যা ছিল ফ্যান্টাসি, কেবল জন্মের দেবীকে পাঠিয়ে জন্মের সময় পাল্টে দেওয়ার গালগপ্পো-আজ আপনাদের মেডিক্যাল সায়েন্সের কল্যাণে তা বাস্তব।
কিন্তু আমাকে দিয়ে ওরা ঠিক কী করাতে চাইছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না কিছুতেই। অবশেষে চতুর্থ কো-অর্ডিনেটে প্রথম দুবারের মতো ওরাকলের কুঁ দেওয়া হলো। গেমের ভেন্যু গেম ডেভেলপারদের নির্বাচিত ভেন্যু হতে যাচ্ছে, জানতে পারলাম মূল ঘটনার দিন তিনেক আগে।
তার মানে এবার আপনাকে অজ্ঞান করে লেভেল ওয়ান আর টুর মতো একটা অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?
হ্যাঁ। জ্ঞান ফেরার পর বরাবরের মতো নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম সেই সাদা রঙের হলঘরে। সেখান থেকে যখন আমাকে গেমের সেটে নিয়ে যাওয়া হলো, দেখতে পেলাম কারাবন্দিদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের আদলে পুরো সেট নির্মাণ করা হয়েছে।
আবছা আলো-আঁধারের খেলা পুরো ঘরজুড়ে। নির্দিষ্ট ব্যবধানে প্রায় ১৬টির মতো বেড বর্গাকারে পুরো ঘরকে বেষ্টন করে আছে-ঠিক মাঝখানের বেডের দিকে চোখ পড়তেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে লেভেল ফাইভের ভিকটিম। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম অনিন্দ্যসুন্দর একটি মুখ, ভিডিও শেষে দেখানো ছবির থেকে বাস্তবে রায়না নামের মেয়েটি আরও অনেক লাবণ্যময়। প্রসবযন্ত্রণার প্রচণ্ডতা সেই লাবণ্যে ভাটার চিহ্ন আনতে আনতেও শেষ মুহূর্তে ঠিক পেরে ওঠেনি।
হোল্ড অন আ সেকেন্ড আবরার। আচ্ছা এটা কেমন করে সম্ভব? একেবারে ঘড়ি ধরে কি কারও প্রসবের দিন ধার্য করা সম্ভব? একেবারে এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ দিবাগত রাত ১২টার মধ্যেই কীভাবে মেয়েটির প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলো?
আপনার মতো একই প্রশ্ন আমার মনেও জেগেছিল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। যাহোক, মেয়েটিকে দেখতে পাবার পরেই হলুদরঙা ক্যাটকেটে দেয়াল অদৃশ্য হয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে নিদর্শন ভেসে উঠল, আবার শুনতে পাওয়া গেল সেই যান্ত্রিক গলা-প্রিয় খেলোয়াড়, ঠিক মাঝখানের বিছানায় শায়িত তরুণী এবং তার অনাগত সন্তানকে বাঁচাতে আপনি সময় পাবেন এক ঘণ্টা।
গেমের জন্য আপনার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বেডের ঠিক পাশে দুটো বাক্সে রাখা আছে। আপনার সময় শুরু হচ্ছে এখন। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে স্টপওয়াচের শব্দ শুনতে পেতেই আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। এগিয়ে গেলাম রায়নার দিকে। ধীরে ধীরে ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি।
হত্যার পদ্ধতি হিসেবে কু ছিল টাবুটালাইন, যার কাজ ডেলিভারির সময় পিছিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখানে তো দেখা যাচ্ছে অলরেডি ডেলিভারি পেইন শুরু হয়ে গেছে। দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় বেডের পাশে রাখা বাক্স দুটো খুলে ফেললাম। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, প্রথম বাক্সে সিজারিয়ান সেকশনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রাখা-অ্যানেস্থেটিক এজেন্ট, ছুরি-কাঁচি, ফোরসেপ, পেইন ম্যানেজমেন্টের জন্য এপিডুরাল ব্লক মেডিকেশন আর টিউবসহ আরও অনেক কিছু।
সম্ভাব্য অনেক কিছু ভেবে রাখলেও আমাকে যে ডেলিভারি করতে হতে পারে–এই সম্ভাব্যতার কথা কেন যেন মাথায় আসেনি। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করে নিলাম। প্রাকটিসিং গাইনোকোলজিস্ট না হলেও ডেলিভারি করাবার মতো দক্ষতা যে আমার নেই, এমনটা নয়।
এরপর দ্বিতীয় বাক্সের দিকে হাত বাড়ালাম। এর আগে নির্বাচিত ভেন্যুতে যতবারই খেলা হয়েছে, খেলার সরঞ্জামের মাঝে কেবলমাত্র একটি কাজে লেগেছে, অপরটি নয়। এবারেও সেই সম্ভাব্যতার কথা মাথায় ছিল।
দ্বিতীয় বাক্সটা খুলতেই দেখি গ্যাস্ট্রিক ল্যাভেজ অর্থাৎ বিষ অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, অ্যাকটিভেটেড চারকোল পাউডার। মনে আছে, শুরুতেই আপনি একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কীভাবে ওরা সাড়ে নয় মাসের গর্ভবতী রায়নার ডেলিভারির পেইন শুরু হবার সময়টা নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই প্রশ্নের সাথে সাথে টাবুটালাইন প্রয়োগ সম্পর্কেও আমার মনে দ্বিধা ছিল। দুটো প্রশ্নের উত্তরই লুকিয়ে ছিল দ্বিতীয় বাক্সতে।
কী উত্তর? দেখুন, আমি আপনার মতো ডাক্তার নই। তাই একটু সহজ ভাষায় যদি বুঝিয়ে বলতেন।
সহজ করেই বলার চেষ্টা করছি। মেয়েটির লেবার পেইন শুরু করার জন্য পিটোসিন নামে সিন্থেটিক অক্সিটোসিন দেওয়া হয়েছিল। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বাচ্চা হবার সময় মেয়েদের জরায়ুর দেয়ালে প্রবল সংকোচন ঘটে, মেডিকেলের ভাষায় আমরা যেটাকে ইউটেরাইন কন্ট্রাকশন বলি। এই কনট্র্যাকশন শুরু করতেই অক্সিটোসিন কাজ করে।
একই সাথে সম্ভবত গেম শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে মেয়েটিকে হাই ডোজ টাবুটালাইন দেওয়া হয়েছে। টার্বুটালাইনের কাজ জরায়ুর দেয়ালের মাংসপেশিকে শিথিল করা, যাকে আমরা বলি ইউটেরাইন রিলাক্সেশন। সর্বনাশ! দুটোর কাজ তো সম্পূর্ণ আলাদা।
একজ্যাকলি। প্রচণ্ড ভয়ে সিটিয়ে গেলেও যথাসম্ভব মাথাটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলাম। মা এবং বাচ্চা দুজনকে এক সাথে বাঁচানোর সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়–এতটুকু ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম।
যদি সত্যি টাবুটালাইন এবং অক্সিটোসিন পরপর কিংবা একসঙ্গে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে টাবুটালাইন নিজের অ্যাকশন শুরু করামাত্র মায়ের অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন এবং শেষ পর্যন্ত মেজর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। গ্যাসট্রিক ল্যাভেজ দিয়ে ব্লাড সার্কুলেশন থেকে টার্বুটালাইন ড্রাগ সরিয়ে দিলেই যে মাকে বিপদ-মুক্ত করা যাবে, এমনটাও নয়।
আর তাছাড়া লেবার পেইন শুরু হয়ে যাওয়ায় ঐ সময়টুকু ছিল না, ঠিক কোন মুহূর্তে টার্বুটালাইন দেওয়া হয়েছিল, এটাও আমি জানতাম না।
ঐদিকে মেয়েটির অক্সিটোসিন নিজের কাজ শুরু করে দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, সিজারিয়ান সেকশন করব, নরমাল ডেলিভারি করতে গেলে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক মুহূর্ত শিউরে উঠল অবন্তি।
তার মানে আপনি নিজে ডেলিভারি করালেন! অবিশ্বাস্য গেম।
ঐ সময়ের অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। আইনস্টাইন থাকলে হয়তো কালের দীর্ঘায়নের সূত্র নতুন করে লিখতেন। একেকটা মুহূর্তকে মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল।
তারপর?
প্রথমে যা অনুমান করেছিলাম, সেটাই সত্যি ছিল। গেম শুরু হবার কিছুক্ষণ আগেই অক্সিটোসিন আর এরপর টার্বুটালাইন দেওয়া হয়েছিল। অক্সিটোসিন কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের কাজ শুরু করে দিলেও টার্বুটালাইন মিনিট তিরিশেক সময় নিলো।
ততক্ষণে আপনার অপারেশন কমপ্লিট না হলে তো সর্বনাশ! আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলে উঠল অবন্তি, হাঁটতে পর্যন্ত ভুলে গেছে দুজনে। সংক্ষিপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবরার, এখন দিন না হয়ে রাত হলে অমাবস্যার অন্ধকারে বুক ভরা ক্ষোভকে কাগজের প্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দিত, প্লেনের শেষ গন্তব্যস্থল চাইলেও দেখতে পেত না।
ঠিক ধরেছেন। সর্বনাশটা শেষ পর্যন্ত আর আটকাতে পারিনি। টার্বুটালাইন অ্যাকশন শুরু করে দিতেই মেয়েটিকে বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, তবে মৃত্যুর আগে নিজের সন্তানের মুখ দেখাতে পেরেছি দুঃখী মেয়েটিকে। সি সেকশন করে বাচ্চাটাকে বের করার কিছুক্ষণ পর মেয়েটি মারা যায়। পোস্ট অপারেটিভ একটা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থাকলে হয়তো বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারতাম। জন্মের পর থেকেই বাচ্চাটার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, তবে ভুলেও বুঝতে পারিনি মায়ের চলে যাবার কয়েক মিনিটের মাঝে বাচ্চাটাকেও হারিয়ে ফেলব। একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানেন?
কী? অবন্তির কণ্ঠে গাঢ় বিষাদের সুর।
রায়না নামের তরুণীটি পুরোটা সময় চোখ বড় বড় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, চোখে ছিল অদ্ভুত এক আকুতি। একবারের জন্যও কথা বলেনি। বুঝতে পেরেছিল আমি ডাক্তার, চোখের কোণে কোথায় যেন প্রগাঢ় ভরসার ছোঁয়াও ছিল। সি সেকশন করার আগে অ্যানেস্থেসিয়া দেবার সময় হঠাৎ আমার হাত ধরে প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠেছিল, ডাক্তার সাহেব, আমি বাঁচি আর না বাঁচি, আমার বাচ্চাটা যেন বেঁচে থাকে!
দুপাশে পাহাড়, মাঝে পাথুরে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ আর পথের প্রান্তে বসে আছে দুজন, আর চারপাশে ন্যাপথালিনের মতো উদ্বায়ী হাহাকার। সেই হাহাকারের সুরে কান পেতে দুজন মানব-মানবী সমাধান খুঁজে চলেছে, এক অদ্ভুত রহস্যের–
হোক বৈধ অথবা জারজ সন্তান, এক দলা মাংস থেকে পূর্ণ অবয়ব পাওয়া ছোট একটা শরীরের প্রতি মায়েদের এই অকারণ অযৌক্তিক আর আত্মত্যাগী ভালোবাসার উৎসমূল কী শুধুই জিন সঞ্চালন?
১৩. HellMyth Game-Level 7 (হেলমিথ গেম-লেভেল ৭)
আহ, ইশ-শীৎকার ধ্বনির মাঝে পূর্ণ যৌবনা সুন্দরী নারীটিকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলছে ভুড়িওয়ালা বেটপ আকারের এক লোক। চোখের দৃষ্টিতে লালসা আর কাম। নারীর মাঝে এত সুখ বহুকাল পায়নি ধনবান কর্পোরেট মহাশয়টি।
আহ! কচি বয়সি সবগুলো মেয়ের মাঝেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভাগ্যিস ঠিক মনের মতো এক মেয়েকে বাগিয়ে নিয়েছে। অল্প বয়সি তরুণী গত বছর রিসিপশনিস্ট হিসেবে অ্যাপ্লাই করেছিল তার কোম্পানিতে।
স্ত্রীর মেদবহুল শরীর, নিত্যদিনের অশান্তি আর ঝুটঝামেলায় লোকটি প্রায়ই ভুলতে বসে, তরুণ বয়সে লজ্জাবনত দৃষ্টিতে এক নজর দেখার জন্য মন আঁকুপাঁকু করা নারীটির স্বাদ বিস্বাদ মনে হবে কয়েক দশক পরে।
নাহ স্ত্রীর কথা এখন ভাবছে না লোকটি। এখন তো সে প্রেমিক। দুর্দমনীয় টেস্টোস্টেরনের জোয়ার যৌবনের মোড়কে আবার ফিরে এসেছে। শরীরে। কামরাঙা চপলা-কিশোরীর রাঙা ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে দিলো দেখতে দেখতে।
ঊরুসন্ধি থেকে পেটের ঈষৎ উপরে দুটো রঙিন বুদ্বুদীয় পটকাবহুল তারামাছ, সারা শরীরে সুস্বাদু মাংস আর সুপেয় মসলার ঘ্রাণ। ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো খুবলেছিড়েফুঁড়ে হরিণীর মাংস খাওয়ার মতো নিখুঁত-অপলার শরীরে নখর আর কামড়ের চিহ্ন রেখে যেতে লাগল বেঢপ পশুর মতো দেখতে জীবটা।
অবশ্য একই খাবার বারবার খেতে ভালোও লাগে না। রসনাবিলাসের সর্বোচ্চ মেয়াদ কয়েক মাস। এত অর্থ-সম্পদ আর বিত্তবৈভবের সার্থকতাই বা কী যদি কেবল এক নারীর পেছনেই সিংহভাগ বিনিয়োগ করা হয়! জীবনের প্লে লিস্টে নারীরই যদি বদল না ঘটে, তবে খ্যাতি আর ধনের মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় এই ধরনের মানুষদের কাছে।
বেঢপ শরীরটা কোনোমতে নারীদেহের নিম্নাংশে ঝিনুকের মতো সুখানুভূতির আকরিকের মাঝে আদিম প্রক্রিয়ায় আকণ্ঠ ডুবে যেতে থাকল।
ক্রমাগত শীৎকার স্তিমিত হয়ে গেলে বেঢপ লোকটা সুন্দরী তরুণীটিকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যেতেই তরুণীটির মুখে জিঘাংসা ফুটে উঠল।
বিড়বিড় করে মিহি কণ্ঠের তরুণীটি বলে উঠল, Get ready for death, you pig, fool, idiot! লুপ অন হয়ে পুরো ভিডিওটার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও সিআইডি প্রধানের সুবিশাল লিভিং রুমে ল্যাপটপটা অফ করবার মতো কেউই ছিল না। সিআইডি টিমের পাঁচজনের ছোট দলটা হাসান সাহেবের বাড়ির লনে চা খেতে খেতে আসন্ন লেভেল সেভেনের গেম নিয়ে আলোচনায় মত্ত। হাসান সাহেবের স্ত্রী-সন্তানরা গেছেন দেশের বাইরে। স্ত্রী বাড়ির বাইরে থাকলে কাজের লোক আর হাউজমেডদের ছুটি দিয়ে দেন তিনি। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে হাসান সাহেব যেমন আকণ্ঠ স্বাধীনতায় ডুবে থাকতে পারেন, তারই বাড়িতে খেটে খাওয়া মানুষগুলোরও সেই অধিকারটুকু আছে। মধ্যবয়স্কা প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণকারী রমণীদের মনস্তাত্ত্বিকগত পরিবর্তন তাদের আরোপিত নানা নিয়মকানুনেরই প্রতীতি। অনুশাসনের শৃঙ্খলে চারপাশকে যেন আরও নতুন করে এ বয়সের মহিলারা বেঁধে ফেলতে চায়-কোথাও গিয়ে এক অনাহূত অস্তিত্বসংকট আর কর্মবৃত্তিগত সংকটই এর জন্য দায়ী।
কী হে আবরার! এবার তো তোমাকে পাঠানো ভিডিওটা দেখতে না দেখতেই আমাদের সবাইকে লজ্জায় ছুটে আসতে হলো লনে। এরা তো দেখছি গেম খেলানোর নাম করে তোমাকে প্রায় এক্স ভিডিও দেখিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য, তোমার যা বয়স, তাতে এসব ভিডিও একা একা দেখাই…।
কথা শেষ না হতেই অবন্তির দিকে চোখ পড়তে মিইয়ে গেলেন সিআইডি প্রধান। এতগুলো পুরুষের মাঝে এ জাতীয় আলোচনায় মেয়েটির অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হেঁড়ে গলায় হঠাৎ গান ধরলেন,
আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে, আমায় উদাসী বানাইয়া গেল বসন্তেরই কালে গো মরার কোকিলে হাসির একটা তরঙ্গে আলোড়িত হলো সবুজাভ লনের পরিবেশ। হাসান সাহেবের রুচি আর পারিপাট্যের স্পষ্ট ছাপ লনের প্রতি অংশে। বিকেলের এই পড়ন্ত সময়টুকুতে লনে রাখা চেয়ারে পা দুলিয়ে চায়ের কাপে এনার্জি প্লাস বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিল ফজলে রাব্বি সাহেবের, ঠিক কিশোর বেলায় মফস্বলে টংয়ের দোকানে বসে চা-বিস্কুট খাবার দিনগুলো স্মৃতিকোষে আলোড়ন তুলছে।
চোখ পাকিয়ে সিআইডি প্রধানের দিকে তাকালেন ডিআইজি তামিম সাহেব।
আপনার গানের গলা হেঁড়ে, তা জানতাম, তবে এতটা যে বেসুরো গাইতে পারেন, তা তো জানতাম না!
উপস্থিত সবার মাঝে আরেক দফা হাসির আলোড়ন বয়ে গেল, ডিআইজি তামিম সাহেব অবশ্য পরক্ষণেই বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন, আবরারকে উদ্দেশ করে বললেন,
সেদিন যে Cuckolding নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হলো! ইশ! তখন যদি জানতাম, লেভেল সেভেনেই তোমাকে কো-অর্ডিনেট হিসেবে কাকের বাসায় কোকিল বসে আছে-এমন একটা ছবি দেওয়া হবে!
কথা হচ্ছে, এখান থেকে স্পেসিফিক্যালি আফ্রোদিতির কাহিনীই যে বলা হচ্ছে, এটা তুমি অনুমান করলে কী করে?
আবরার লম্বা একটা দম নিয়ে আর্দ্র গলায় দীর্ঘ বক্তব্যের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করল,
কাকের বাসায় কোকিল বসে আছে, এমন একটা অ্যানিমেটেড ছবি ছাড়াও আমাকে একটা ছোট প্যাকেটে কিছু লোহার পেরেকও ফাস্ট কো অর্ডিনেট হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
পেরেক! বলো কী?
লেট মি অ্যাজিউম প্লিজ! গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী হেফাস্টাস হচ্ছে কামার দেবতা। লোহা গলিয়ে বিচিত্র যন্ত্র তৈরি করতে হেফাস্টাসের জুড়ি ছিল না। তাই পেরেক দিয়ে লোহা আর কোকিল দিয়ে cuckolding বোঝানো হয়েছে। এই দুটো কু থেকে আপনি ধারণা করে নিলেন, এবারের গেমটিতে পরকীয়াঘটিত ব্যাপারস্যাপার থাকবে। কী তাই তো?
অবন্তির চোখমুখে ঠিকরে পড়ছে অনুসন্ধিত্স। ঠিক ধরেছেন। গ্রিক মিথোলজির কাহিনিটা এ ক্ষেত্রে একটু সংক্ষেপে না বললে আপনারা কেউই কো-রিলেট করতে পারবেন না।
গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী, আফ্রোদিতি ছিলেন ভালোবাসা আর কামের দেবী। আর হেফাস্টাস ছিলেন দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিত দর্শন দেবতা। জিউস কারও সাহায্য ছাড়া একা একা নিজের মাথা থেকে এথেনার জন্ম দিলে জিউসের স্ত্রী হেরারও ইচ্ছে হয়, কারও সাহায্য ছাড়া সন্তান জন্ম দেবার। এভাবে তিনি জন্ম দিলেন হেফাস্টাসকে।
কিন্তু হেফাস্টাসের জন্ম হলো বিকলাঙ্গ, কুৎসিত হিসেবে। ঘৃণায় মা হেরা স্বর্গ থেকে হেফাস্টাসকে মর্ত্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলে বীর অ্যাকিলিসের মা নদীর দেবী থেটিস হেফাস্টাসকে লালন-পালন করেন। হেফাস্টাস কাজ শিখতে শিখতে হয়ে ওঠেন দক্ষ কামার। ঐদিকে জিউস আর হেরার পুত্র এরিসের সাথে প্রেম ছিল সুন্দরী আফ্রোদিতির। ভাগ্যের পরিহাসে কুৎসিত হেফাস্টাসকে স্বামী হিসেবে বরণ করতে হয় আফ্রোদিতিকে।
আফ্রোদিতি শুধু প্রেম-কামের দেবীই ছিলেন না। ছিলেন ভয়ংকর বহুগামী। বিয়ের পর প্রেমিক অ্যারিসের সাথে গোপনে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন দীর্ঘদিন। এ ছাড়া মর্ত্যের অসংখ্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি উপহারের বিনিময়ে হার্মিস, পসাইডনসহ বিভিন্ন দেবতাদেরও শয্যাসঙ্গী হতেন তিনি। আফ্রোদিতির নির্দেশনায় আর ইশারাতে মর্ত্যের বহু নারী বিবাহের বন্ধনে থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গীদের ঠকাতো। কো-অর্ডিনেট থেকে এতটুকু বুঝতে পারলাম সম্ভবত কোনো প্রতারক চক্র নিয়ে এবারের লেভেল সেভেনের গেম। বিত্তশালী পুরুষরাই যেই নারীকেন্দ্রিক প্রতারক চক্রের প্রধান শিকার। আমার সন্দেহ যে ঠিক তা আজকের ভিডিওটাতেই আপনারা দেখতে পেলেন। এক বিত্তশালী পুরুষকে নিজের রূপের জালে ফাঁসিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করছে এক সুন্দরী তরুণী।
ডামি ভিডিওতে এবারের মডেল দুজনই কোরিয়ান হলেও ভিডিও শেষে যেই ছবি দেখানো হয়েছে, তাতে করে দেখা যাচ্ছে, একজন অ্যাড ফার্মের মালিক আবুল হাসনাত হতে যাচ্ছে এই গেমের ভিকটিম। কোরিয়ানদের মাথায় টাকের টিকিটি দেখতে না পাওয়া গেলেও সত্যিকারের ভিকটিম আবুল হাসনাতের মাথায় চকচক করছে স্টেডিয়ামের মতো বিশাল এক টাক। আবুল হাসনাত সম্পর্কে খুব বেশি খোঁজখবর করতে পারিনি। তিনি আপাতত একটা ট্যুরে বাংলাদেশের বাইরে আছেন।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ আবরার, এর আগের প্রত্যেক লেভেলের গেমে বুর্জোয়ারা ভিকটিম ছিল না, ছিল কেবল মধ্যবিত্ত বা সাধারণ আমজনতা। এবারই প্রথম ভিকটিম হতে চলেছে একজন বিত্তশালী, প্রোডাকশন হাউজের মালিক।
উমম…স্যার, যতটুকু আমরা দেখতে পেরেছি, আমার মনে হয় এটাই পুরো ঘটনা নয়। অ্যা ফ্রাগমেন্ট অফ দ্য হোল ইন্সিডেন্ট। সম্ভবত মেয়েটি কোনো না কোনো উপায়ে বিত্তবান লোকটির প্রপার্টির একটা বড় অংশ হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এবং কাজ হাসিল করে লোকটিকে হত্যার পরিকল্পনা করছে।
আমার ধারণা, মেয়েটি একা নয়। আফ্রোদিতির ইশারায় যেমন বহু নারী প্রতারণা করত, এই নারীর পেছনেও সম্ভবত খুব প্রভাবশালী কোনো নারী প্রতারকের চক্র আছে। হো হো করে হেসে উঠলেন হাসান সাহেব,
ওরে বাবা! এ দেখছি চোরের উপর বাটপারি!
অবন্তি কিছুটা ফুঁসে উঠল, মোটেই না। এটাকে বলা যায় নারীলোভীর উপর বাটপারি। বেশ হয়েছে!
বাটপারি পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়! কিন্তু খুন কেন করতে হবে! এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
তামিম সাহেবের কথা শেষ হতেই অখণ্ড স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে টুকরো অংশ হাতড়ে খুঁজে বের করার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন ফজলে রাব্বি সাহেব,
আপনাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, বছর দুই আগে রাহাত আরা খানম তূর্ণা নামের এক প্রতারক চক্রের হোতাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল আমাদের ডিপার্টমেন্টের অ্যাডিশনাল এসপির নেতৃত্বে? কী নিদারুণ অবস্থা! প্রতিদিন এই চক্রের বিভিন্ন সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হতে আট থেকে দশ লাখ টাকা।
রোমন্থনের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন সিআইডি প্রধান, মনে থাকবে না আবার! ঐ চক্রকে গ্রেফতারের সময় আমি ছিলাম দেশের বাইরে। তূর্ণাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় কয়েকবার অবশ্য উপস্থিত ছিলাম। নাইরেজিয়ানদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এই প্রতারক চক্রটি পরিচালিত হতো। এরা মূলত কাস্টমস অফিসার সেজে গ্রাহকদের সাথে কথা বলত। শিক্ষিত, সুন্দরী, শুদ্ধ উচ্চারণে পারদর্শী বাংলাদেশিদের দলে টানত নাইজেরিয়ানরা।
আমাদের সিআইডি ডিপার্টমেন্টে তো এই কেসটা সবচেয়ে বেশি চর্চিত কেসের মধ্যে একটা। ওরে কী ড্রামাটিক কাহিনি রে! বেনারসিপল্লির ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিল ঠগবাজদের আলিশান অফিস। তিন শিফটে ঐ তূর্ণার নেতৃত্বে ডেস্ক কম্পিউটার আর ল্যাপটপে অসংখ্য কর্মচারী বিভিন্ন ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকদের সাথে ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল চ্যাটিং করত।
তামিম সাহেবের দিকে উৎসুক ভঙ্গিতে তাকাল আবরার, এই কেসটার কথা ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না। অবশ্য তখন সিআইডি ডিপার্টমেন্টের সাথে কোনো সম্পর্কই তো ছিল না ওর।
ওরা ঠিক কীভাবে টাকা হাতিয়ে নিত?
চক্রে পঞ্চাশের বেশি সদস্যদের ছিল ভিন্ন ভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। আমেরিকান আর্মিদের ইউনিফর্ম পরিহিত ছবি দিয়ে আইডি খুলত এই চক্রের সদস্যরা। দিনরাত চ্যাট করে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেত। দেশের বিত্তশালী নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলাই ছিল এই প্রতারক চক্রের মূল উদ্দেশ্য।
ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে সম্পর্ক এগিয়ে যাবার পর আমেরিকান আর্মির সদস্য পরিচয় দেওয়া প্রতারকেরা জানাত, সিরিয়ার যুদ্ধে জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছে, যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। পৃথিবীতে তাদের আপন বলে কেউ নেই। এই সময়ে তার কাছে মূল্যবান যা কিছু আছে, তা ঐ নারীর কাছে আমানত হিসেবে রাখতে চায়। একপর্যায়ে মেসেঞ্জারে এসব ভুয়া সামগ্রীর এয়ারলাইন্স বুকিংয়ের ভুয়া ডকুমেন্ট পাঠায়, বাক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলে ভুক্তভোগীকে জানায়।
একপর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কল করে তুর্ণা–
হ্যালো আমি কাস্টমস কমিশনার বলছি…। আপনার একটি পার্সেল এসেছে। এতে অনেক মূল্যবান স্বর্ণ এবং ডলার রয়েছে। শুল্ক পরিশোধ করে পার্সেল বুঝে নিতে হবে। বিপুল টাকার গিফটের আশায় অনেকে সহজেই তিন থেকে সাত লাখ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করতেন। কেউ টাকা দিতে গড়িমসি করলে মামলার ভয় দেখানো হতো।
এ যে দেখছি আফ্রোদিতি বনাম আফ্রোদিতি! তা বিত্তশালী মহিলাদের আর্মির পরিচয়ে ফাঁসানো হলে নিশ্চয়ই বিত্তশালী পুরুষদেরও ফাঁসানো হয়ে থাকে?
ছেলেদের সঙ্গে প্রতারণার ক্ষেত্রে ভিনদেশি নারীর নাম, ছবি দিয়ে আইডি খোলা হতো। শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতে পারদর্শী সদস্যদের চক্রের অন্তর্ভুক্ত করা হতো। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বেশ কিছু ইউরোপিয়ান নারীও ছিল নাইজেরিয়ান নিয়ন্ত্রিত এই প্রতারক চক্রে। গত দেড় বছরে এই চক্র অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
আরে কী বলছ তামিম? দেড় বছরে কোটি কোটি টাকা কী! দুই মাসেই একশোর বেশি ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়েছে এরা!
সিআইডি প্রধান যেন সংশোধন করে দিলেন ডিআইজি তামিম সাহেবের অনুমিত সাংখ্যিক হিসেবকে। অবন্তির কণ্ঠে নারী জাতির কলঙ্কের ভাগীদার হবার অবাঞ্ছিত জগদ্দল গুরুভার,
পূর্ণা মেয়েটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যবিজ্ঞান আর গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়ালেখা করেছে। এইচএসসি ১১-১২ সেশনের ছিল। লেখাপড়া শেষে চাকরি খুঁজছিল। নিউমার্কেটের দিকে একদিন পরিচয় হয় ডেনিস নামের এক নাইজেরিয়ানের সাথে। ডেনিসের হাত ধরেই তূর্ণার এই অন্ধকার জগতে আসা। মাঝে মাঝে ভাবি, খুব কী ক্ষতি হতো-হাজার পঞ্চাশেক টাকার একটা চাকরি, সুখী ছিমছাম একটা জীবন কাটালে! কিছু কিছু মানুষের অল্প সময়ে কোটিপতি হবার বাসনা না থাকলে পৃথিবীটা আরও অনেক সুন্দর হতো!
অবন্তি, সব মানুষ কিন্তু শর্টকাটে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করে না। কেউ কেউ নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় কনসেপ্টেও বিশ্বাস করে। ফজলে রাব্বি স্যারের চোখের দিকে তাকাল অবন্তি। সত্যি, মানুষটাকে দেখলে শ্রদ্ধায় অন্তর আনত হয়ে আসে।
এত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, চাইলে নিজের যাবতীয় উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়ন। করতে পারতেন এক চুটকিতেই। তবুও তার আপাদমস্তক দেখলে মনে হবে মানুষের মাঝে যা কিছু অনির্বচনীয়, সারল্য আর সাধারণ্য, তারই প্রতিমর্তি মানুষটা! বাহুল্যের কোনো চিহ্নই নেই তার জীবনযাপনে। লেট নাইট পার্টি, চামচামি, বিশৃঙ্খল জীবনধারা, কাড়ি কাড়ি টাকা, বাড়ি-গাড়ি, জায়গাজমি-উচ্চপদস্থ সরকারি কোনো কর্মকর্তার জীবনাচরণের সাথে ন্যূনতম মিল নেই মানুষটার। সর্বসাকুল্যে দু-তিন সেট প্যান্ট-শার্ট, একটা পুরোনো মডেলের গাড়ি, দোতলা একটা বাড়ি-এত অনন্যসাধারণ সরকারি কর্মকর্তা কেউ আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। ডিপার্টমেন্টে ফজলে রাব্বি সাহেবের অনাড়ম্বর জীবন্যাপনের জন্য বিশেষ সুনাম আছে। নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়-এমন ব্যতিক্রমী মানুষের জীবনেরই ধুনটে বোয়া বোধ হয় এই গানের পঙক্তি।
সিআইডি প্রধান হাসান সাহেব সংক্ষিপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস শেষে তাকালেন উপস্থিত সবার দিকে।
আবরারের কো-অর্ডিনেটের প্রসঙ্গে তো আর জানাই হলো না। কী হে আবরার…সেই ডিগক্স যা ডিজক্স-ধুর বাবা! তোমাদের খটমটে ওষুধের নামই মনে থাকে না! কোড় কীভাবে ডিকোড করলে?
আবরার যথাসম্ভব শান্ত ভঙ্গিতে বলল, স্যার, এবারের থার্ড কো অর্ডিনেটটা পাই আমার ভাগ্নে রাতুলকে স্কুল থেকে পিক করতে গিয়ে। রাতুলের মিড টার্ম এক্সাম চলছিল।
ওর স্কুলের গেটের সামনে এক অচেনা লোক আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। প্যাকেটের নিচের দিকে ছিল গেমের লোগো।
রুদ্ধশ্বাসে সবাই তাকিয়ে আছে আবরারে দিকে। সত্যি, আবরার হেলমিথ গেমের একেকটা লেভেল পার হয়, আর চাতকের মতো প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব সবাই জেমস বন্ডের সিরিজের থেকে বেশি অ্যাড্রেনালিন প্রবাহের জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করতে থাকে। আবরার ক্ষণিক বিরতি দিয়ে আবার বলতে শুরু করল,
খামের ভেতর একটা নকিয়া ১২০০ মডেলের মোবাইল ফোন আর মানুষের মেরুদণ্ডের একটা বিশেষ অস্থি, অ্যাটলাস। নিজের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে এই প্রথম একটা মেডিক্যাল টার্ম থাকায় অবন্তির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,
অ্যাটলাস! ইয়েস ইয়েস আই ক্যান রিমেম্বার! নাইন-টেনে থাকতে পড়েছিলাম। মেরুদণ্ডের প্রথম হাড়টাকে বলে অ্যাটলাস, রাইট? অনুমোদনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল আবরার।
দারুণ ইন্টারেস্টিং তো! আমার তো শুনেই কেমন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!
তামিম সাহেবের কণ্ঠে করপোরেট অফিসারের টুকে নেওয়া শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধি সূচকের মতো ক্রমবর্ধমান ঔসুক্য। আবরার বলে চলেছে,
মোবাইলটা ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখে কোনো ক্ল পেলাম না। একেবারে অব্যবহৃত মোবাইল ফোন, কোনো সিম কার্ড পর্যন্ত নেই। শুধু কনট্যাক্টে একটা নম্বর সেভ করা।
নম্বরটা ভালো করে চেক করে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম। কোনো পূর্ণাঙ্গ ফোন নম্বর নয়, কেবল একটা নম্বরের সাতটা ডিজিট সেভ করা On নামে।
নম্বরটা ছিল- ০১৭১৩৭৩….বিস্ময়ের সীমা ছিল না আমার। অবশ্য মেরুদণ্ডের কশেরুকা দেখে গ্রিক মিথোলজির একটা চরিত্রকে ডিটেক্ট করতে পেরেছিলাম। গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা নাড়লেন হাসান সাহেব,
তোমার জন্য গ্রিক মিথোলজি মুখস্থ করে রাখায় বেশ সুবিধা হয়েছে, তোমার কথা শুনতেই রিলেট করতে পারছি! গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী অ্যাটলাস ছিলেন একজন টাইটান। তার আরেকটা পরিচয় হলো তিনি ছিলেন প্রমিথিউসের ভাই।
প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, দুই প্রজন্মের টাইটানদের যুদ্ধের সময় জিউসের বিরোধিতা করার জন্য অ্যাটলাসকে শাস্তি হিসেবে নিজের মাথার উপর স্বর্গ, আকাশ এবং পৃথিবীকে ধরে রাখতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের শাস্তি বলতে পার।
আবরারের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।
স্যার, আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু এই গ্রিক মিথ থেকেই মেরুদণ্ডের প্রথম অস্থির নাম রেখেছে অ্যাটলাস। মিথ অনুযায়ী, গ্রিক দেবতা অ্যাটলাস যেমন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল নিজের মাথায় ধরে রাখে, সারভাইক্যাল ভার্টিব্রা, তেমনি আমাদের মানুষদের মাথার পুরো ওজন নিজের মাথায় ধরে রাখে।
সত্যি আবরার, তুমি একেকটা লেভেল পার হতে হতে আমাদের সবার গুজবাষ্প হচ্ছে। ইভেন, এত অজানা জিনিস জানতে পারছি যে এখন মনে হচ্ছে বয়স জ্ঞানের পথে কোনো বাধাই হতে পারে না।
স্যার, হত্যাপদ্ধতি সম্পর্কে এবার অনুমান করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। প্রথমে মাথায় এলো, সাত ডিজিটের নম্বরের মাঝে কোনো কু লুকিয়ে থাকতে পারে। হয়তো যেই উপাদান দিয়ে হত্যা করা হবে, সেটির সাথে সাত সংখ্যার কোনো সম্পর্ক আছে-এটাই ছিল আমার প্রথম অনুমান।
পরবর্তীসময়ে অনেক ভেবে বের করলাম, সেভেন ডিজিট (Seven Digit)-এর মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে দুটো কু-Digit থেকে Dig আর সাত সংখ্যার মাধ্যমে হয়তো বোঝানো হচ্ছে-হত্যার কাজে যেই উইপন বা ওষুধ ব্যবহার করা হবে, তার নামের মাঝে সাতটি অক্ষর থাকবে। আমার এই অনুমানটি সঠিক ছিল। প্রথম ব্লু থেকে Dig শব্দাংশটা খুঁজে পেয়ে একটা সম্ভাব্য ওষুধের নামের প্রথমাংশের কথা মাথায় এসেছিল। অনুমানটা সত্য কি না, তা যাচাই করার জন্য এরপর অ্যাটলাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলাম। গ্রিক মিথোলজিতে অ্যাটলাসকে বলা হতো Celestial Axis অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালসহ পৃথিবীর অক্ষীয় দেবতা। Axis থেকে ধার করলাম xi এই দুটো অক্ষর। আর আপনারা প্রথমেই জেনেছেন, সাত ডিজিটের নম্বরটা নকিয়া ১২০০ সেটে On নামে সেভ করা ছিল।
এখন প্রথম ক্ল থেকে পাওয়া Dig-এর অব্যবহিত পরে on, xi-দুটো শব্দাংশকে আগপিছ করে বসানোর চেষ্টা করা যাক। Dig-এর পর যদি on থেকে o বসানো হয়, পাওয়া যায় Digo 1 এরপর Axis থেকে পাওয়া xi বসালে শব্দটা দাঁড়ায় Digoxi।
রইল বাকি n। on থেকে 0 আগেই ব্যবহার করা হওয়ায় এবার Digoxi-এর পরে n বসালে পাওয়া যায় এক বিশেষ ওষুধের নাম Digoxin। Digoxin শব্দটাতে মোট সাতটি অক্ষর আছে। সেভেন ডিজিটের মাহাত্ম আশা করি এখন ধরতে পেরেছেন। Digoxin নিয়ে যদি বলতে যাই, এটা একধরনের ওষুধ, যেটা মানুষের হার্ট ফেইলিওরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
রিয়েলি আবরার! হ্যাটস অফ টু ইউ! কিন্তু Digoxin দিয়ে লোকটাকে মারা হবে কীভাবে? ওভারডোজে?
ঠিক ধরেছেন স্যার। Digoxin ওভারডোজেই হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, অনুমান করার পর অ্যাজ ইউজুয়াল আংটি থেকে গ্রিন সিগন্যাল আসে। গতকালই চতুর্থ কো-অর্ডিনেট পাই। কিন্তু কোডটা ডিকোড করে এখনো গেমের ভেন্যু সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। হাতে সময়ও খুব বেশি নেই, আজ মাসের ২৬ তারিখ।
অবন্তি গভীর মনোনিবেশ দিয়ে চতুর্থ কো-অর্ডিনেট হিসেবে পাঠানো পেইন্টিংটা দেখছে। চোখধাঁধানো অয়েল পেইন্টিং। দারুণ জীবন্ত মনে হচ্ছে উঁচু-নিচু টিলা আর টিলাঘেরা সবুজে মোড়ানো চা-বাগানটাকে। শুধু সবুজ আর সবুজ।
টিপ টিপ বৃষ্টিতে একজন চা-বাগানের কর্মী চা-পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পিঠের সাথে বাঁধা বাঁশের টুকরিতে রেখে দিচ্ছে। আবরার চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকাল পেইন্টিংটার দিকে।
উমমম…এই কো-অর্ডিনেট থেকে এতটুকু বুঝতে পারছি, চা-বাগানের মাধ্যমে গেম ভেন্যু যে সিলেট হবে, এই নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একজ্যাক্ট লোকেশনটা বের করতে পারছি না। তামিম সাহেব এক মুহূর্ত থেমে কী যেন ভাবলেন।
কিন্তু আবরার, তুমি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছ যে গেমের ভেন্যু সিলেটেই হবে? চা-বাগান আছে, এমন অনেক জায়গা তো সিলেট ছাড়াও আছে।
তা আছে স্যার। কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, কয়েকটা ক্ষেত্র বাদে এর আগের লেভেলের কোডগুলো কখনোই আহামরি কঠিন ছিল না। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের যেকোনো মানুষকে চা-বাগানের ছবি দেখালে মাথায় সবার আগে সিলেটের কথাই আসবে।
কিন্তু আপনি তো সাধারণ মানুষ নন, আপনি তো লিজেন্ড! আপনাকে এত সাধারণ ক্ল কেন দেওয়া হবে!
অবন্তির কণ্ঠে আদুরে আবহ আর ঈষৎ খুনসুটির আহ্বান। তবে আবরারের নির্লিপ্ত মুখভঙ্গি দেখে তার খুনসুটি করার মানসিকতা যে আপাতত নেই, বুঝতে পারল অবন্তি। সিআইডি প্রধান গম্ভীর ভঙ্গিতে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন পেইন্টিংটার দিকে, যেন কিছু একটা ধারণা করার চেষ্টা করছেন।
আচ্ছা আবরার, আপনি তো এবারের লেভেল সেভেনের ভিকটিমের নাম-পরিচয় জানেন। নিজের উদ্যোগে কাউকে নিযুক্ত করে লোকটার উপর নজর রাখা যায় কোনোভাবে?
তাহলে তো সে কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে–এত কিছু জানার জন্য আপনার কষ্ট করে কোড ডিকোড করার প্রয়োজন নেই।
কথা শেষ করতে না করতেই আবরারের চাহনিতে ঈষৎ বিরক্তির আভাস দেখে মিইয়ে গেল অবন্তি। কে জানে, বেশি উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলেছে কি না! ছেলেটা এভাবে তাকাচ্ছে কেন!
দেখুন অবন্তি, আপনি খুব ভালো করেই জানেন, লেভেল ওয়ান থেকে এই গেমের ডেভেলপারদের কাছে আমার হাত-পা বাঁধা। আমার হাতের আংটির মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা ওরা আমাকে আউটস্মার্ট করে চলেছে। আমি কেবল তাই-ই করতে পারব, যা গেমের নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। ওরা যে ফ্যাসিলিটিস প্রোভাইড করবে, সেগুলো ছাড়া বাইরের কারও সাহায্য নিতে গেলে হয়তো সেই সাহায্যকারীকেই গুম করে ফেলা হবে–এমন আশঙ্কাও বিচিত্র নয়। আপনার মাথায় যেই প্ল্যান এসেছে, লেভেল ওয়ানে থাকতে এটা আমার মাথায়ও এসেছিল। কিন্তু সেই আসমা খাতুন সম্পর্কে আমি ঠিক ততটুকুই জানতে পেরেছি, যতটুকু ওরা চেয়েছিল যে আমি জানব।
কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল আবরার,
ব্যাপারটাকে অনেকটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ধরুন, আমাকে এক বহুতলা ভবনের নিচতলা থেকে একশো তলায় পায়ে হেঁটে সিঁড়ির সাহায্যে উপরে উঠতে হবে। ভবনে লিফট, এক্সেলেটরসহ আরও যাবতীয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু আমার জন্য সেসব ব্যবহারে আছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। নিচ থেকে উপরে ওঠার সময় প্রত্যেক ফ্লোরে থাকবে গ্রিক মিথোলজির সাথে মিলসম্পন্ন একেকটা জীবনের গল্প–যেখানে পরতে পরতে একটি জীবনপ্রদীপের নিশ্চিতভাবে নিভে যাবে। আমাকে ওদের সরবরাহকৃত উপকরণের ভেতরেই প্রতিটি জীবন বাঁচাতে হবে, যদি ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো বাহ্যিক শক্তির সাহায্য নেই, তাহলে তা কেড়ে নেওয়া হবে।
অনেকটা এমন যে যদি পা হাঁটার পথ কষ্টসাধ্য দেখে লিফটের সাহায্য নিয়ে আগেভাগে ভিকটিমদের সম্পর্কে স্টাডি করতে যাই, কে বলতে পারে, হয়তো ডিনামাইট দিয়ে লিফটই ধ্বংস করে দেবে
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল অবন্তি।
কার্ল মার্ক্স এখন আপনাকে গাড়ায় ফেলে চার-হাত পা, বিশটি নখর, বত্রিশ দাঁত, দীর্ঘ চুলদাড়িকে অস্ত্র বানিয়ে উপরওয়ালার সাথে বাগবিতণ্ডা করছে। তা আপনি চে গুয়েভারার ভক্ত, আবার ধর্মেও বিশ্বাসী-এমনটা কী করে হলেন বলুন তো?
মানুষের দ্বিচারী স্বভাব নিয়ে সেদিন বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে। রিপিট করতে ইচ্ছে করছে না। সিআইডি প্রধানের দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কিছু মুক্ত আর কিছু গুচ্ছ শব্দেরা আসি আসি করেও আসছিল না, এতক্ষণ ধরে অপলক দৃষ্টিতে পেইন্টিংয়ের কো-অর্ডিনেটটা থেকে কিছু একটা অনুমান করতে পেরেছেন। তবে কীভাবে সাজিয়ে বলবেন, ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। আবরার আর অবন্তির বাক্য বিনিময়ের মাঝের বিরতিতে আর্কিমিডিসের মতো ইউরেকা বলার ভঙ্গি ফুটে উঠল তার কণ্ঠে,
আবরার, আমি বোধ হয় অনুমান করতে পেরেছি, ঠিক কোন ভেন্যুতে এবারের গেম হতে যাচ্ছে।
চেয়ারে উপবিষ্ট বাকি চারজন হাসান সাহেবের দিকে একবার আর তার হাতে ধরে রাখা পেইন্টিংটার দিকে কয়েকবার করে তাকাল, আবরারের কুঞ্চিত ভু আরও কিছুটা কুঞ্চিত হয়ে গেল।
দেখো আবরার, বেশ কিছুদিন আগেই আমি সপরিবারে সিলেট থেকে ঘুরে এসেছি। সেখানে আমরা যেই রিসোর্টে উঠেছিলাম, তার নাম হচ্ছে Rainbow Resort। পেইন্টিংটাতে ভালো করে লক্ষ করে দেখো। চা বাগানের মাধ্যমে সিলেট নির্দেশ করা হচ্ছে। একনজর দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে। এখান থেকে সহজেই Rain কুটা পাওয়া যায়।
গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে গেল আবরারের মুখ। সে বুঝে গেছে হাসান সাহেব কী বোঝাতে চেয়েছেন। উবু হয়ে চা-পাতা তোলা নারীটির শরীরের ভঙ্গিকে ইংরেজিতে বলে Bow। সত্যি, এত বেশি ঝুঁকে কাউকে চা-পাতা তুলতে দেখেছে বলে আবরার মনে করতে পারে না। হাসান স্যারের আগেই কোডটা ডিকোড করা উচিত ছিল।
মানুষের মুখ থেকে পারফেকশনিস্ট তকমা পেতে পেতে ভিতরে ভিতরে একগুঁয়ে হয়ে উঠেছে, এটা আবরার ভালোই বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে হোঁচটের শিক্ষাসফর প্রয়োজন, জীবনের প্রয়োজনেই।
***
এক দৃষ্টে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে আবুল হাসনাত। বেঁটেখাটো শরীর, ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা মুখের সাথে একেবারেই মানানসই নয়। এক মাথা টাক। লোকটির চোখের দৃষ্টিতে একরাশ খেদ মিশ্রিত বিস্ময়!
অবশ্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্ন হলে সামনে উপবিষ্ট সৌম্যদর্শন ছেলেটার কোনো কথাই বিশ্বাস করতেন না তিনি। তবে কিছুক্ষণ আগে নিজ চোখে যা দেখলেন, তারপর আর সংশয়ের অবকাশ থাকার কথা নয়।
রিসোর্টের বিশাল ঘরের একপ্রান্তে পিছমোড়া অবস্থায় বাধা অনিন্দ্যসুন্দরী এক নারী, মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। আপাতদৃষ্টিতে খুব নিষ্পাপ মনে হলেও মেয়েটি আদতে ভয়ংকর। গেমের শেষ দিন খুব সকাল থেকেই আবরার সতর্ক নজর রাখছিল Rainbow Resort-এর উপর। সৌভাগ্যক্রমে রিসোর্টের এক স্টাফের ছদ্মবেশে রুম সার্ভিসের নাম করে ২০১ নম্বর রুমে ঢুকে ফুলের টবের ভেতর টু ওয়ে কমিউনিকেটিং ডিভাইস আর স্পাই ক্যামেরা রেখে আসতে পেরেছিল সকালবেলাতেই। সারা দিন ল্যাপটপের মনিটরে কয়েক দফা বিষম বয়সি দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার রামলীলা দেখতে দেখতে সত্যিকারের অঘটনের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছিল।
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই করতেই আবুল হাসনাত সাহেবের চোখ দুটো ঘুমে এলিয়ে আসে। টেকো মাথার পেছনের অংশে অবশিষ্ট হাতে গোনা অল্প কিছু চুলে বিলি কাটতে কাটতে রোজি নামের সুন্দরী তরুণীটি নিশ্চিত হয়ে নেয়, হাসনাত সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছে কি না।
রোজি অবশ্য হাসনাত সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে জয়েন করা তরুণীটির সত্যিকারের নাম নয়। প্রতিটি মিশনের আগেই প্রতারক চক্রের মাধ্যমে তাদের এজেন্টদের নকল নাম, পরিচয় আর সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
কিছুক্ষণের মাঝে নিজের কাজ শুরু করে দেয় শিউলি, এটিই মেয়েটির আসল নাম। নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে অটোমেটিক বেল্ট, দড়ি, স্কচটেপ বের করে হাসনাত সাহেবের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে মেয়েটি। এরপর ঘুমন্ত বেটপ শরীরটাকে ছেড়ে এগিয়ে আসে মুখের কাছে, চোখ দুটোকে বেঁধে ফেলে। অতর্কিতে ঘুম ভেঙে কিছু দেখতে না পেয়ে চিৎকার করার অবকাশটুকুও পেলেন না হাসনাত সাহেব। কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না যেন! দেখতে শুকনো মনে হলেও মেয়েটির শরীরের জোর নেহাত কম নয়। লোকটি চিৎকার করে ওঠার আগেই স্কচটেপ দিয়ে মুখটা ভালোভাবে আটকে দিলো, এরপর সারা শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল; প্রতিরোধের সামান্য অবকাশটুকু পেলেন না লোকটা। এরপর ইনজেকশন আর এম্পুল নিয়ে ধীর পায়ে লোকটির দিকে এগিয়ে আসতে লাগল মেয়েটি। ঠিক সেই মুহূর্তে আবরার টু ওয়ে কমিউনিকেটরের মাধ্যমে বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল-খবরদার, একদম কাছে এগোবেন ভৌতিক আবহের শিহরণে মেয়েটির হাত থেকে সিরিঞ্জ পড়ে যায় মুহূর্তেই।
খুনিরাও তবে ভূতের ভয় পায়ল্যাপটপে লাইভ ভিডিও দেখে পরিযায়ী পাখির মতো এই-ই ছিল আবরারের ক্ষণিকের ভাবনা।
সিরিঞ্জের ভেতরে থাকা ডিজক্সিন সাধারণত হার্ট ফেইলিওরের রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ডিজক্সিন ওভারডোজ শরীরে ভয়ংকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন। শরীরে পটাশিয়াম লেভেল মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়া, যাকে বলে হাইপারক্যালেমিয়া। ডোজ বাড়াতে থাকলে কিছুক্ষণের মাঝেই নিশ্চিত মৃত্যু। পরবর্তী কাহিনি বেশ সংক্ষিপ্ত। রিসোর্টের ম্যানেজারের সহায়তায় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আবুল হাসনাতকে উদ্ধার করে মেয়েটিকে আটক করে আবরার।
প্রচণ্ড জিঘাংসায় হাতের সিরিঞ্জ আবরারের শরীরে ঢুকিয়ে দিতে উদ্যত হতেই অনেক কষ্টেসৃষ্টে মেয়েটিকে বেঁধে ফেলে।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে কিছু জানাতে না চাইলেও সিআইডির ভয় দেখাতেই গড়গড় করে সব স্বীকার করে মেয়েটি।
শোবিজ জগতের এক প্রভাবশালী নারী নায়িকার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক সুবিশাল প্রতারক চক্র। আশি-নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ আর বড় পর্দা কাঁপিয়ে শেষ বয়সে এসে প্রতারক চক্রের মাধ্যমে হাজার গুণ বেশি সম্পদের মালকিন বনে গেছেন সহজেই।
বিভিন্ন পর্যায়ের নামীদামি ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের টার্গেট করে অসম্ভব সুন্দরী কিছু তরুণীদের কাজে লাগানো হয়।
কোনো না কোনোভাবে বিত্তশালীদের কাছাকাছি এসে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে ধীরে ধীরে হাতিয়ে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের টাকা। কোনো প্রমাণ যাতে না থাকে, তাই মিশনের প্রথম থেকেই তরুণীদের দেওয়া হয় মিথ্যে নাম-পরিচয় আর সার্টিফিকেট।
শিউলি নামের মেয়েটিও এমনই একজন এজেন্ট। মিশনে তার নাম রোজি। বিশাল অ্যাড ফার্মের মালিক আবুল হাসনাতের পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজে নিযুক্ত হয় সে।
মফস্বলের ভোলাভালা, নিজের রূপের ব্যাপারে অসচেতন অথচ অসম্ভব সুন্দরী এক তরুণী হিসেবেই বসের নজর কাড়ে সে।
নারীলোভী পুঁজিপতি স্বভাবসুলভগত কারণেই প্রেমে পড়ে রোজির। স্ত্রীর ভয়ে অবশ্য নিজের প্রেমের কোনো চিহ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় রাখতেন না হাসনাত সাহেব।
অনেক কষ্টে ভুলিয়ে ভালিয়ে রোজিকে রাজি করেন তার সাথে অবকাশ যাপনে রিসোর্টে আসতে। তিনি তো আর জানতেন না-যখন তিনি সুন্দরীর সাথে রং-তামাশায় মত্ত, অটোমেটেড সিগনেচার এক্সট্র্যাকশন টেকনোলজি ব্যবহার করে তার সিগনেচার নকল করে বিভিন্ন উৎস থেকে তিরিশ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে ফেলা হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে।
মূলত এই প্রতারক চক্র টাকা হাতিয়েই কেটে পড়ে, খুন-জখমের ঝামেলায় জড়ায় না। তবে প্রতারক চক্রের হোতা সাবেক নায়িকার সাথে হাসনাত সাহেবের ব্যক্তিগত কিছু টানাপড়েন থাকায় তাকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল রোজিকে।
পুরো হত্যা প্রক্রিয়াটিকে ন্যাচারাল হার্ট অ্যাটাক হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ডিজক্সিন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উপস্থিত সবাই দেখল, পিছমোড়া করে বাঁধা শিউলি নামের তরুণীটির চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আবরার। তবে আবরারের দৃষ্টি মেয়েটির চোখের স্লেরা কিংবা আইরিশ ভেদ করে এক অদৃশ্য টাইম ট্যানেলে।
পারস্য সাগর পেরিয়ে গ্রিক সভ্যতার সূতিকাগারে ফেনিল আফ্রোদিতির বেশে প্রতারক চক্রের হোত কিংবা নারীলোভী জিউসের বেশে এই অ্যাড ফার্মের মালিক-কারোরই শাস্তি হয় না।
শাস্তি হয় কেবল শিউলি নামের সাধারণ মেয়েগুলোর। যারা দাবার খুঁটি হয়ে কেবল দুই পক্ষের মনোরঞ্জন করে চলে, বিনিময়ে পায় কিছু লভ্যাংশ। আংটি থেকে, লেভেল সেভেনে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন যান্ত্রিক নারীকণ্ঠের অভিবাদনটুকু ন্যূনতম স্পর্শ করতে পারল না আবরারকে। কারণ সে জানে, সে আদতে জেতেনি, হেরে গেছে।
১৪. HellMyth Game-Level৪ (হেলমিথ গেম-লেভেল ৮)
আবরারের ঘরের বাঁ দিকের দেয়ালে স্ট্রাইপ ডিজাইনে চে গুয়েভারার ছবিটার নিচে দাঁড়িয়ে গোল্ডলিফ ধরালেন ডিআইজি তামিম সাহেব। ডাক্তার অবশ্য পইপই করে বারণ করে দিয়েছে, পঞ্চান্ন পার হওয়া শরীর-যন্ত্রটাকে আরও কিছুদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে ধূমপানটা ছেড়ে দিতে। কে শোনে কার কথা!
যৌবন বয়স থেকে শিরায় শিরায় বহন করে আসা নিকোটিনিক রোমাঞ্চ মন্থনের অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসা কি এতটাই সহজ? অবশ্য ফুসফুস নয়, দাঁতের ব্যথায় প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন বেশ কয়েকদিন ধরে। ডাক্তার দেখাব দেখাব করেও কিছুতেই সময় করে উঠতে পারছিলেন না।
চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেস নিয়ে এই এক মাস পুরো টিম নিয়ে টানা দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছে।
পুরো বাংলাদেশ জুড়েই যে এই সর্বনাশা চক্র অক্টোপাসের মতো পা ছড়িয়ে আছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি কেউ। এই কেস নিয়ে ব্যস্ততার কারণে আবরারের সাথে দীর্ঘদিন দেখা সাক্ষাও হয়নি ডিপার্টমেন্টের কারও।
আজ তাই কলাবাগানে ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত দেখাতে এসে তামিম সাহেব আবরারের সাথে একবার দেখা না করে ফিরতে চাইছিলেন না।
লেভেল এইট সম্পর্কে জানার জন্য ভেতরটা আঁকুপাঁকু করছিল। তবে ওয়ার্ক ইজ টু বি ওরশিপড় তত্ত্বের ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব ছিল না।
আবরারের কাছে একা এসেছেন–এ কথা বাকিরা জানলে বেশ মন খারাপ করবে। করুক গিয়ে। কত দিন ধরে গেমের পরবর্তী লেভেল সম্পর্কে জানতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল! আবরারের বর্ণনাভঙ্গি শুনে সব সময় মনে হয় আবরার নয়, বরং তিনি নিজেই খেলছেন।
দু-দুটো সিগারেট শেষ করে ধীর পায়ে আবারের ওয়াল বুকশেলফের দিকে এগিয়ে এলেন তামিম সাহেব। অবন্তির মুখে এই বিশাল সংগ্রহশালার প্রশংসা শুনে শুনতে ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকের সব মুখস্থ হয়ে গেছে। বিশ্বসাহিত্যের জন্য বরাদ্দকৃত তাকের কাছে এসে ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাকের জোগাড় হলো! এত বড় সংগ্রহ এর আগে কবে দেখেছেন, মনে করতে পারলেন না।
রহস্য আর গোয়েন্দা সাহিত্যের বইগুলোর পাশে এসে থমকে দাঁড়ালেন। শার্লক হোমস সমগ্রের পাশে একটা খাকি রঙের প্যাকেট রাখা, প্যাকেটের উপরে জ্বলজ্বল করছে গেমের লোগো।
কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা নিজের দিকে বাড়ালেন তামিম সাহেব। ভেতরে একটা ছোট চিরকুট। অসম্ভব সুন্দর ইংরেজি হাতের লেখা
1st June
2022,
U.S.A
My Dear Edward
ব্যস এইটুকুই। ভারি অবাক হলেন তামিম সাহেব। এটা আবার কেমন কোড! চিঠির মতো শুরু হয়ে সেখানেই শেষ!
আবরার সেই যে ঘরে বসিয়ে রেখে ভিতরে গিয়েছে, ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। এক মনে কোডটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ঘাড়ে হাতের স্পর্শ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠলেন। আরে, আবরার যে! কী একটা মজার জিনিস দেখাবে বলে সেই যে ভেতরে গেলে, তোমার ফেরার তো দেখি নামগন্ধ নেই।
আবরার হাত থেকে বিশাল এক বাক্স মেঝেতে রেখে বড় বড় শ্বাস ফেলছিল, চোখ গোল গোল করে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন তামিম সাহেব। প্যাকেটের মাঝে শাকসবজি-আলু, পটল, টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক, লালশাক, ডাটাশাক, এমনকি জুন মাসের তীব্র গরমের মাঝে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরও আছে।
তামিম সাহেব বেশ খানিকটা হতভম্ব, চোখের দৃষ্টিতে এক গাদা প্রশ্ন। তবে কোন প্রশ্নটা রেখে কোনটা আগে করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। স্মিত হাসল আবরার। স্যার, বুঝতে পারছি আপনার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছে। ধাপে ধাপে উত্তর দেওয়া হবে। প্রথমেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আপনাকে এতক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখার জন্য। তামিম সাহেব কোনোমতে জিজ্ঞাসার ভারে টলে ওঠা মাথাটা নিয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলেন স্টাডি টেবিল ধরে।
এই শাকসবজিও কি তোমাকে কো-অর্ডিনেট হিসেবে দেওয়া হয়েছিল নাকি?
তামিম সাহেব হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। জি স্যার। এটা ছিল থার্ড কো-অর্ডিনেট। বাক্সের ওপর ছিল গেমের লোগো আর ভেতরে আইস প্যাক।
কিন্তু এই ঠাটা গরমের মাঝে এতগুলো শীতের সবজি! মানতেই হবে আবরার, এই গেম প্ল্যানাররা ঋতুকেও হাতের মাঝে রাখতে জানে। স্যার, আজকাল স্টোরেজ সিস্টেমের এত ব্যাপক হারে উন্নতি হয়েছে যে এক সিজনের ফলমূল আরেক সিজনে পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
থার্ড কো-অর্ডিনেট নিয়ে পরে শোনা যাবে। এই চিরকুটের মাঝে চিঠির মতো মাই ডিয়ার এডওয়ার্ড লেখা লাইনটার অর্থ আগে বোঝাও দেখি।
খাটের উপর দু-পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলেন তামিম সাহেব, যেন ভরদুপুরে ভাতঘুম দেবার পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ ছোটগল্পের আসর!
স্যার, আমাকে দেওয়া চিরকুটটা ভালোভাবে লক্ষ করুন
প্রথমেই 1st June-এর মাধ্যমে গেমের নিয়মানুযায়ী কো-অর্ডিনেট দেবার সময় নির্দেশ করা হয়েছে।
এরপর ২০২২ দিয়ে গেম সংঘটনের সাল নির্দেশ করা হয়েছে। এরপর লেখা আছে U.S.A1 এই U.S.A-এর প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চিঠির মতো সম্ভাষণ দিয়ে শুরু হয়েছে My Dear Edward প্রত্যেকটার আদ্যক্ষর M, D, E কে আগপিছ করে একসঙ্গে বসালে আমরা পাই, MED। এখন দেখুন, আগের লাইনে ঠিকানার মতো করে লেখা ছিল U.S.A U, S, A অক্ষর তিনটিকে MED-এর পরে বাসয়ে পাওয়া যায় MEDUSA। স্থিরদৃষ্টিতে আবরারের দিকে চেয়ে আছেন তামিম সাহেব। আবরার বলে চলেছে,
গ্রিক মিথোলজিতে মেডুসা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ফাস্ট কোডটা ডিকোড করার পরপরই ডামি ভিডিওটা আসে। এবারের মডেল ছিল অ্যারাবিয়ান।
ডামি ভিডিওতে কী ছিল সেটা জানার আগে মেডুসার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আপনার জানাটা জরুরি।
মিথ অনুযায়ী, সমুদ্রদেব পসাইডন একদিন এক সাগর পারে মেডুসাকে দেখে প্রবল কামে জর্জরিত হন। মেডুসা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যের স্থল ছিল সম্ভবত তার চুল।
পসাইডন মেডুসাকে নানাভাবে প্ররোচিত করেন, কিন্তু মেডুসা কৌশলে পসাইডনকে এড়িয়ে যেতে থাকেন। পসাইডন ছিলেন নাছোড়বান্দা, নির্লজ্জের মতো মেডুসার পেছনে পড়ে রইলেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, মেডুসার কুমারিত্ব হরণ করা।
সাধারণত এখনকার বুর্জোয়ারা কোনো সুন্দরীর পেছনে একবার লাগলে ঠিক এমনই নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠেন। গ্রিক চরিত্রগুলো তো জীবন থেকেই নেওয়া। খ্রিস্টপূর্ব হোক বা খ্রিস্টাব্দ-পুঁজিবাদী আর বুর্জোয়াদের নারীলোভ ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে প্রতিটি যুগেই বহাল তবিয়তে ছিল।
মেডুসা ছিলেন দেবী এথেনার মন্দিরের সেবাদাসী, তাই তিনি আজীবন কুমারী থাকার ব্রত পালন করছিলেন। সমুদ্রদেব পসাইডন মেডুসার ক্রমাগত আপত্তিতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে একদিন মেডুসার পিছু নেন। মেডুসা দেবী এথেনার মন্দিরে গিয়ে দেবীর কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু পসাইডন কোনোভাবে মেডুসাকে রাজি করতে না পেরে এথেনার মন্দিরে ঢুকে জোর করে মেডুসাকে ধর্ষণ করেন। এথেনা নিজের মন্দিরকে অপবিত্র হতে দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলেন, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে শাস্তি দিলেন মেডুসাকে। পসাইডনকে কিছুই করলেন না।
করবেনই বা কী করে! দু-তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বে যারা এসব গপ্পো কেঁদেছে, তারাও জানতেন যে দেবতা নামধারী নীতিনির্ধারকের কাছে কোনো অন্যায়ই অন্যায় নয়।
তারপর?
দেবী এথেনা মেডুসাকে কঠিন শাস্তি দিলেন। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী বদলে গেল কুৎসিত ডাইনির মুখে, সরীসৃপের মতো বীভৎস দর্শন হয়ে গেল তার লাবণ্যময় ত্বক।
মেডুসার রূপের সবচেয়ে বড় শক্তি, তার অনিন্দ্যসুন্দর চুল নিমেষেই পরিণত হলে শত শত কিলবিলে সাপে। মেডুসাকে আরও অভিশাপ দেওয়া হয়-দেবতা ব্যতীত তার চোখের দিকে যেই তাকাবে, সে-ই পাথরে পরিণত হবে। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, পসাইডন ধর্ষণ করলে গর্ভবতী হয়ে পড়েন মেডুসা। পরবর্তীসময়ে গ্রিক বীর পার্সিয়াস যখন মেডুসাকে হত্যা করেন, মেডুসার মাথার এক ফোঁটা রক্ত সাগরে পড়ে। সেখান থেকেই জন্ম হয় পেগাসাস অর্থাৎ ডানাযুক্ত ঘোড়ার। পঙ্খীরাজের ঘোড়ার ওয়াইড স্পেড কনসেপ্ট মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রাচ্যদেশীয় যত সাহিত্য-উপকথায় স্থান পেয়েছে, সেগুলো এই পেগাসাসেরই বর্ধিত রূপ।
শুধু পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কোথা বলছ! আমার তো গ্রিক মিথ নিয়ে পড়াশোনা করার পর আরও অনেকগুলো মিল চোখে পড়েছে। ঐ যে কী যেন একটা দেবতা আছে না গ্রিক মিথে, ছোটমতো সাইজ! তীর ধনুক নিয়ে ঘুরতে থাকে, যখন তখন মর্তের মানুষের শরীরে তীর ছুঁড়ে মারলেই সামনে প্রথম যে মানুষটি আসে, তার প্রেমে তীরবিদ্ধ মানুষটি পাগল হয়ে যায়। এই তো মনে পড়েছে কিউপিড। কিউপিড তো রোমান নাম। গ্রিক মিথে কিউপিডের নাম ইয়োস।
একটা হলেই হলো! তো এই ইরোসের সাথে হিন্দু মিখোলজিতে কামদেবের প্রধান কাজ পুরোটাই মিলে যায়। দুজনেই মানুষের মনে কামের সঞ্চার করে…হাহাহা… মন্দ বলেননি, স্যার। হিন্দু মিথের যম আর গ্রিক মিথের হেডিসকেও তাহলে ইকুইভ্যালেন্ট বলা যেতে পারে। অবশ্য অনেকে হেডিসকে ইভিলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলেও আদতে হেডিসই সবচেয়ে বেশি কর্মনিষ্ঠ আর কম নারীলোভী ছিলেন।
হিন্দু মিথের রতি আর গ্রিক মিথের আফ্রোদিতিকেও তাহলে ইকুইভ্যালেন্ট বলা যেতে পারে। হাহাহা, লেভেল সেভেনে হেফাস্টাস আর আফ্রোদিতির কো-অর্ডিনেট ডিকোড করার পর রতির সাথে আফ্রোদিতির তুলনার প্রশ্নই আসে না। আফ্রোদিতির মতো কঠিন বহুগামিনী দ্বিতীয় কোনো দেবী ছিলেন না। ওদিকে রতি তার স্বামী কামদেবের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা ধরে রেখেছিলেন কট্টরভাবে। শিব কামদেবকে একবার আগুনে পুড়িয়ে ফেললে রতি দিনের পর দিন কঠোর সাধনা করে স্বামীর পুনর্জন্ম নিশ্চিত করেন। তবে…
তবে?
তবে আমার ধারণা, ইতিহাসবেত্তারা ইচ্ছে করেই প্রাচ্যদেশে, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে নারীদের বহুগামিতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অন্যান্য দেশীয় পুরনো মিখোলজির থেকে বিভিন্ন এলিমেন্ট নিয়েছেন। মূলসুর ঠিক রেখেছেন কিন্তু এই উপমহাদেশে নারীদের মনোগামী, এক-পত্ৰিতী, সতী-লক্ষ্মী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একই সাথে পুরুষদের বহুগামিতায় মাহাত্ম আরোপ করেছেন।
এক হিসেবে তোমার কথা ঠিকই আছে আবরার। কিন্তু মিথের বিবর্তন ঘটিয়ে নারীদের কামকে এভাবে চাপিয়ে রাখার প্রধান কারণ কী বলে তুমি মনে করো?
স্যার, এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রভাবক থাকতে পারে। এশিয়ান নারীরা, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা পাশ্চাত্যের নারীদের থেকে অনেক বেশি উর্বর। আর পুরুষের মাঝে সেলফিশ জিন নিয়ে তো সেদিন বিস্তর আলাপ-আলোচনা হলোই। তাই প্রজননগত ঈর্ষা থেকে সুন্দরী নারীদের নিজের অধীনে রাখার জন্য নিজেরা যত ইচ্ছা নারী গমন করলেও মেয়েদের বহুগামিতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতেরা।
ভেরি ইন্টারেস্টিং! তোমার কথার পেছনে দারুণ যুক্তি আছে। তবে আবরার, আগে তো হিন্দু মিথোলজি এসেছে, তারপর গ্রিক মিথোলজি, তাই না? তাহলে তো সমীকরণটা মিলছে না।
স্যার, আসলে প্রাচীন সভ্যতা বিকাশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী-ইরাক, সিরিয়া আর তুরস্কে সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে। এর নাম ছিল মেসোপটেমীয় সভ্যতা।
এরপর উত্তর ভারত, পাকিস্তান আর আফগানিস্তানভিত্তিক সিন্ধু সভ্যতাও কিন্তু কম সমৃদ্ধ ছিল না। পরবর্তীসময়ে মিশরীয় সভ্যতা এবং তার অব্যবহিত আগে হিন্দু মিখোলজি বিকাশ লাভ করে। টাইমলাইন ঘটলে গ্রিক মিথোলজির বিকাশ লাভ করার সময়কাল বেশ পরেই, আমি মানছি। তবে আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, মিথোলজির মিথস্ক্রিয়ার দরজা কখনোই সিলগালা করে বন্ধ করা হয়নি। তাই বিভিন্ন পর্যটক, বিজ্ঞ পণ্ডিত, ইতিহাসবেত্তা আর পরিব্রাজকদের মাধ্যমে বিভিন্ন মহাদেশীয় মিথোলজিগুলো বিকাশ লাভ করতে থাকে। হিন্দু, মিশরীয়, নর্ডিক, গ্রিক, আরব্য রজনীর গল্প থেকে শুরু করে আমাদের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুমার ঝুলি-উপকথাগুলোর মাঝে এত এত মিল দেখে আপনার মনে কখনো প্রশ্ন জাগেনি, মিলগুলো কী করে এলো?
আসলেই তো! আরব্য রজনীর অনেক গল্পের ছায়া ঠাকুমার ঝুলিতে দেখা যায়। আবার উপেন্দ্রকিশোরের কান কাটা রাজার গল্পের সাথে গ্রিক মিথোলজির চরিত্র মিডাসের আশ্চর্য মিল দেখা যায়। যাহোক, আমরা তো প্রসঙ্গ থেকে আবার দূরে সরে গেলাম। ডামি ভিডিওটাতে কী দেখলে, তা তো বলো।
ডামি ভিডিওটাতে দেখানো হয়েছে, এক বিশাল রাজকীয় বাড়িতে এক বিত্তশালী ভদ্রলোকের প্যারালাইজড স্ত্রীর জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে এক নারী কাজ করেন। এক রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে ঐ স্বামীটির দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন সেই ফিজিওথেরাপিস্ট।
এরপর থেকে নারীটি হয়ে পড়েন ভয়ংকর পুরুষবিদ্বেষী। কেউ সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে বা ন্যূনতম বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাইলেও তাকে শেষ করে দেন তিনি। চল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওতে মেডুসার পুরো থিমটাকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এত চমৎকারভাবে দৃশ্যায়ন করা যায়-স্বপ্নেও ভাবিনি! ভিডিও শেষে ভিকটিমের নাম পরিচয় প্রকাশ করা হয়।
মেডুসার সাথে যা হয়েছিল, এখানেও অনেকটা তাই। প্রভাবশালীর মাধ্যমে ধর্ষিত হলেও ধর্ষককে শাস্তি না দিয়ে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষকে! অ্যাম আই রাইট?
ঠিক ধরেছেন স্যার।
ভিকটিমের নাম পরিচয় থেকে কী জানতে পারলে?
ভিকটিমের নাম গৌরব। মায়ের ফিজিওথেরাপির সেশনের জন্য এক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে বেশ কিছুদিন যাবৎ নিয়মিত আসা যাওয়া করছেন।
সেই ফিজিওথেরাপিস্ট সম্পর্কে কী গেমের আগে কিছু জানতে পেরেছিলে? না, তবে ডামি ভিডিও থেকে ধারণা করে নিয়েছিলাম-সম্ভবত কোনো শিল্পপতির দ্বারা ধর্ষিত হবার পর তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই তার সাথে কোনো পুরুষ বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করলে বা নূ্যনতম হেসে হেসে কথা বললেও তিনি সেই পুরুষকে পটেনশিয়াল রেপিস্ট হিসেবে গণ্য করছেন। কিংবা কে বলতে পারে, হয়তো সাইকোসিসের পেশেন্ট হবার কারণে তার চোখের সামনে একটা ডিলিউশনাল বা ভ্রান্তির জগৎ তৈরি হয়েছে। আমাদের সাধারণের জগতে, ধরুন, তার সাথে পরিচয় ঘটল কোনো পুরুষের। সেই পুরুষের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। সেই ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে তার সম্পর্ক নিখাদ বন্ধুত্বের। কিন্তু তারপরেও হয়তো তার ডিলিউশনাল জগতে সেই পুরুষ কোনো ভয়ংকর নারী নির্যাতক।
কী ভয়ংকর! এ দেখি মেডুসার নতুন যুগের ভার্সন, যে রেপ করল, সেই পসাইডনের কোনো ক্ষতি না করে যাবতীয় পুরুষজাতির মুণ্ডুপাত করার মিশনে নেমেছেন।
ঠিক তাই! তবে তুমি যেই প্যাটার্নের কথা বললে, এমনটা কিন্তু হলিউডের অনেক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফিল্মে দেখা যায়। কোনো কারণে মলেস্টেশনের স্বীকার হয়ে প্রতিষ্ঠিত পুরুষবিদ্বেষী হয়ে যাওয়া! আমার নাতির বয়স কম হলে কী হবে, হলিউডের ফিল্মের পোকা হয়েছে। ওর সাথে থেকে থেকে আমিও ছোটখাটো পোকা হয়েছি বলতে পারো। হো হো হো।
আড়চোখে তামিম সাহেবের দিকে তাকালো আবার। বেঁটেখাটো ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না, তার নাতিও আছে। কিছু কিছু মানুষ এমন থাকেন, নিত্যদিনের ক্রুশে নিয়ত নিজেদের ঝোলাতে ঝোলাতে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলোর মতো স্বল্পপ্রাণ হওয়া তাদের ধাতে সয় না। দীর্ঘ মনস্তাপ আর লঘুভার-গুরুভার কৃত অথবা হলেও হতে পারত পাপের স্মৃতিতে তারা নিজেদের আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখেন না। মানুষটি এই গোত্রের।
এখন আমাকে এই শাকসবজির মাজেজাটা খুলে বলো তো দেখি।
স্যার, এবার থার্ড কো-অর্ডিনেট হিসেবে শাকসবজি দেখে আমি কিন্তু একদমই অবাক হইনি। বলতে পারেন, আমি এমনই একটা কোডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
সবার তো তোমার মতো আট্রা লেভেলের আইকিউ হয় না। আর যত দূর জানি, হত্যার পদ্ধতিগুলোর সাথে সব সময় তোমাদের মেডিক্যাল সায়েন্সের কোনো না কোনো মিল থাকে! তবে কি সবজির ভেতর বিষ দিয়ে…।
স্যার, মেডুসার মিথটা যদি আপনি ভালোভাবে লক্ষ করেন, তাহলে একটা জিনিস দেখতে পাবেন-অভিশপ্ত হবার পর মেডুসার চোখের দিকে যে ই তাকাত, সে-ই কিন্তু পাথর হয়ে যেত। চিকিত্সাবিজ্ঞানে এমন কোনো পদ্ধতি নেই যার মাধ্যমে মানুষকে পাথরে পরিণত করা সম্ভব। তবে…
তবে?
মানুষকে কিন্তু কৃত্রিমভাবে ভেজিটেবলে পরিণত করা সম্ভব। ডিআইজির কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল আবরারের কথা বুঝতে। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল সাথে সাথে!
ইয়েস ইয়েস ইয়েস, আই গেট দ্যাট! আবরার, ইউ আর ইনক্রেডিবলি জিনিয়াস, মাশাআল্লাহ! আমরা তো প্রায়ই বলতে শুনি, অমুক প্যারালাইসিসের পর পুরোপুরি ভেজিটেবল হয়ে গেছে।
এর মানে হলো, গৌরব নামের ছেলেটিকে কৃত্রিমভাবে প্যারালাইজড করে দেওয়া হয়েছে?
উমমম…বলতে পারেন, অনেকটা তাই। তবে ভেজিটেবল বলতে মেডিক্যাল সায়েন্সে কী বোঝায়, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্কের কয়েকটা নির্দিষ্ট অংশ থাকে। সেরেব্রাম, সেরেবেলাম, হাইপোথ্যালামাস, মিডব্রেইন, স্পাইনাল কর্ড-এসব সম্পর্কে তো জানেন।
ভেজিটেটিভ স্টেজ বলতে বোঝায়, যখন সেরেব্রামের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু হাইপোথ্যালামাস আর ব্রেন স্টেম নিজের কাজকর্ম ঠিকই চালিয়ে যায়। কোন পার্টের কাজ কী খুলে বলো তো শুনি। সেরেব্রাম সাধারণত চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া, আচার-আচরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল-এসব নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপোথ্যালামাস, ব্রেন স্টেম শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সামলে নেয়। যেমন : তাপমাত্রা, হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার।
ভেজিটেবল হয়ে গিয়েছে বললে বুঝতে হবে, শরীরের মৌলিক কাজকর্মগুলো চললেও একটা মানুষ স্বাভাবিকভাবে আর জীবনযাপন করতে পারবে না?
অনেকটা তেমনই ধরে নিতে পারেন। কো-অর্ডিনেটটা পাবার পরপরই আমি বুঝতে পারলাম, কৃত্রিমভাবে ভিকটিম গৌরবকে এমন কোনো ড্রাগ দেওয়া হতে চলেছে, যার ফলে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ছেলেটি চলে যাবে ভেজিটেটিভ স্টেজে। অ্যাজ ইউজুয়াল, আংটি থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলাম।
যেসব সম্ভাব্য ড্রাগ দিয়ে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে ভেজিটেটিভ স্টেজে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেগুলো নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করতে লাগলাম। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর জন্য পুরো লেভেলে আরও বেশ কিছু এলিমেন্ট ছিল। যেমন, এই হেলমিথ গেমের মেডুসা কিন্তু পেশায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট। আর একজন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে এভেইলেবল এমন কোনো ড্রাগ কী থাকতে পারে, যা মানুষের মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে-ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো Beclofen নামের ড্রাগের কথা। Beclofen অবশ্য জেনেরিক (ওষুধের উপাদানের ভিত্তিতে প্রদেয় নাম) নাম। বাজারে এই ওষুধ পাওয়া যায় Lioresal নামে। একজন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে Baclofen ওষুধটা আমাদের দেশে বেশ সহজলভ্য। এই ওষুধ মূলত আমাদের মাংসপেশির খিচুনিকে প্রতিরোধ করে, মাংসপেশিকে শিথিল করে।
Beclofen ওভারডোজের ফলে পেশেন্ট প্রথমে ডিলেরিয়াম স্টেটে চলে যায়। ডিলেররিয়াম সম্পর্কে সহজ বাংলায় বলতে গেলে, চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ভিকটিমের কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, চিন্তাশক্তি লোপ পায়।
ডোজ বাড়াতে থাকলে প্রথমে মস্তিষ্কের সেরেব্রামে অক্সিজেনশূন্যতা এবং পরবর্তীসময়ে হাইপোথ্যালামাস আর ব্রেইন স্টেমেও অক্সিজেনশূন্যতা দেখা দেয়। তাই ডিলেরিয়াম এর পরে পেশেন্ট প্রথমে ভেজিটেটিভ স্টেটে এবং ডোজ বাড়াতে থাকলে ভেজিটেটিভ স্টেট কন্টিনিউড হয়ে পার্মানেন্ট ব্রেন ডেথ পর্যন্ত হতে পারে।
মাংসপেশিসংক্রান্ত যেসব ড্রাগের ওভারডোজ ভেজিটেটিভ স্টেজ থেকে পার্মানেন্ট ব্রেন ডেথ ঘটাতে পারে, সেগুলোর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে মেকানিজম প্রায় একই রকম। এসব ড্রাগের সম্ভাব্য সব অ্যান্টিডট নিয়ে তুমুল পড়াশোনা করতে লাগলাম। কিছুদিনের মাঝেই এলো চতুর্থ কো-অর্ডিনেট।
দেখাও দেখাও প্লিজ।
ডিআইজির অনুরোধসূচক কণ্ঠের রেশ কাটতে না কাটতেই আবরার হাতে একটা বড় পোস্টার ধরিয়ে দিলো। বিস্ময়ের সীমা রইল না ডিআইজি তামিম সাহেবের। মনে হচ্ছে, বাচ্চাদের জন্য কেনা কোনো একটা পোস্টার। আজকাল এরকম অ্যানিমেটেড সব কাজ অনলাইনেই দেখতে পাওয়া যায়। পোস্টারের বিকিকিনি কবেই বন্ধ হয়ে গেছে বলেই জানতেন তিনি। একটা হাতির অ্যানিমেটেড ছবি দেখা যাচ্ছে পোস্টারে। ধূসররঙা বাচ্চা হাতিটা মানুষের মতো দুপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হাতিটার মুখের অভিব্যক্তিকে অনেকটা মানুষের অভিব্যক্তির মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে-যেন রাগে ফেটে পড়ছে হাতিটা। মানুষের বাচ্চার মতো হাতির পরনে কমলা রঙের ক্যাটকেটে একটা আন্ডারওয়্যার। বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ে না ডিআইজির। আবরারের চোখের দিকে তাকাতেই হাতে আরও একটা চিরকুট গুঁজে দিল সে। এটাও পোস্টারটার সাথেই চতুর্থ কো-অর্ডিনেট হিসেবে এসেছে।
চিরকুটটা খুলে দেখতে পেলেন, প্রাইমারির লেভেলের বাচ্চাদের একটা গড় অঙ্কের প্রশ্ন লেখা :
ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের বাছাইপর্বে চিলি, উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ব্রাজিলের গোলের সংখ্যা ২, ২, এবং ৪। প্রীতি ম্যাচগুলোতে ব্রাজিলের গোলের গড় কত?
আবরারের বুদ্ধিদীপ্ত দুচোখের চাহনির দিকে তাকিয়ে তামিম সাহেব বুঝতে পারলেন, ছেলেটা ক্রাইম ভেন্যুর এই কু প্রথমবারেই ভেদ করে ফেলেছে। বারকয়েক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিলেন। হচ্ছে না তাকে দিয়ে। করুণ মুখ করে আবরারের দিকে তাকাতেই আবরার বলে উঠল,
স্যার, এবারের ক্রাইম ভেন্যুর কো-অর্ডিনেটটা পাওয়ার পর আমার দারুণ অদ্ভুত লেগেছিল। অবশ্য সাদা চোখে পোস্টারটার দিকে তাকালে কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি আপনাকে কয়েকটা ক্ল দিতে পারি। ভালো করে লক্ষ করে দেখুন তো, হাতিটির বাহ্যিক অবস্থা দেখে কী মনে হচ্ছে? একটা হাতি মানুষের মতো রাগী রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
হাতিটা কী পরে আছে এটা একবার বলুন।
ক্যাটকেটে কমলা রঙের একটা আন্ডারপ্যান্ট।
এই তো ঠিক রাস্তায় এগোচ্ছেন। এখন পুরো ছবিটা থেকে পাওয়া সিনারিওটাকে বাংলা ফ্রেজে যদি প্রকাশ করি তাহলে দাঁড়ায়-কমলা রঙের আন্ডারপ্যান্টে একটা রাগী হাতি!
ধূসর রঙের রাগি বাচ্চা হাতিও তো হতে পারে ডিআইজির তাৎক্ষণিক প্রতি উত্তরে মৃদু হাসল আবরার।
তা হয়তো পারে। কিন্তু স্যার, এখানে আমাদের এক্স ফ্যাক্টরের কথা ভাবতে হবে। সাধারণত, সব হাতিই ধূসর রঙের হয়। তাই এই নির্দিষ্ট হাতিটার এক্স ফ্যাক্টর ইম্পরট্যান্ট। ঠিকই বলেছ। মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি আর আন্ডারওয়্যারটা আসলেই চোখে পড়ার মতো।
এবার বাংলা ফ্রেজটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যাক। An Angry Young Elephant In Orange Underwear
An Angry Faced Young Elephant Wearing Orange Underwear-ও তো হতে পারে।
পারে হয়তো। তবে এর আগের সব কো-অর্ডিনেটগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমেই বাঁকা আঙুলে ঘি উঠানোর চেষ্টা না করে সোজা আঙুলেই চেষ্টা করেছি।
রহস্য সমাধানে ধাপে ধাপে সরলীকৃত সমীকরণ থেকে কঠিন সমীকরণের দিকে গেলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। এখন দেখুন, An Angry Young Elephant In Orange Underwear RODICO e os অক্ষরগুলো হচ্ছে A, A, Y, E, I, 0, U–অক্ষরগুলোর কোনো বিশেষত্ব দেখতে পাচ্ছেন কী?
হোল্ড অন আ সেকেন্ড! এখানে A, E, 1, 0, U-ইংরেজি বর্ণমালার এই পাঁচটি ভাওয়েলই আছে।
ঠিক ধরেছেন স্যার। অবশ্য শুধু ভাওয়েলের কু থেকে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতাম কিনা জানি না, যদি সাথে স্টিকি কাগজে এই গড় অঙ্ক না পাঠানো হতো। ভাওয়েল আর গড় অঙ্ক-দুটো থেকে একটা জায়গার নাম পাওয়া যায়, ভাওয়াল গড়।
দারুণ চমৎকৃত হলেন তামিম সাহেব। ছেলেটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ।
মধুপুর এবং ভাওয়াল গড় অবস্থিত গাজীপুর, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে। আমার আরও স্পেসিফিক কুর দরকার ছিল। আপনার মনে আছে, লেভেল সেভেনে ক্রাইম ভেন্যু হিসেবে রেইনবো রিসোর্ট নামে একটা রিসোর্টের কু দেওয়া হয়েছিল?
ভাওয়াল রিসোর্ট নামে কোনো রিসোর্ট আছে কি না, খুঁজে বেড় করার চেষ্টা করলাম। নিরাশ হতে হয়নি। গাজীপুরেই এক বিশাল রিসোর্ট আছে, যার নাম ভাওয়াল রিসোর্ট।
ঘটনার দিন সকালবেলা থেকে নজর রাখা শুরু করতে পারিনি। কী একটা অনশন চলছিল ঐদিন, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। গাজীপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল।
ডামি ভিডিওর শেষে দেখানো ভিকটিমের ছবি দেখিয়ে তেমন একটা লাভ হলো না। নিজের পরিচয় দেবার পরেও রিসোর্ট অথোরিটি বেশ ঝামেলা করতে লাগল। ঐদিকে সময় বয়ে যাচ্ছিল। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটা রিসিপশনিস্টদের আগেই খুলে বলাটা উচিত বলে মনে করছিলাম না।
কারণ, এবারের আক্রমণকারী সাধারণ কেউ ছিল না। একজন ম্যানিয়াক বা সাইকোসিসের পেশেন্ট যদি ঘুণাক্ষরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়, ভয়ংকর হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এক স্টাফের ছদ্মবেশে অনেক সাধনার পর যখন আসলে ভেন্যুতে ঢুকতে পারলাম, ততক্ষণে ঘড়িতে রাত আটটা ছুঁই ছুঁই। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। নিজের কাজ শেষ করে পাখি পগার পার। মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল এবারের ভিকটিম গৌরব।
বেশ অল্প বয়সী ছেলে, কতই বা হবে বয়স! পঁচিশ কি ছাব্বিশ। বেশ সুপুরুষ, সুঠাম দেহ, মায়াভরা মুখে নীলাভ যন্ত্রণার স্পষ্ট চিহ্ন। পাশেই পড়ে আছে ইনট্র্যাথিক্যাল ইঞ্জেকশন।
কী থিক্যাল?…
ইনট্র্যাথিক্যাল। বুঝিয়ে বলছি। আমাদের মস্তিষ্কে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড নামে বিশেষ একধরনের তরল থাকে, যেটা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের পুষ্টি জোগায়।
আবার বিভিন্ন বইয়ে পড়ে থাকবেন, মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যাওয়া। এই দণ্ড মূলত স্পাইনাল কর্ড।
আমাদের ঘাড়, পিঠে হাত দিয়ে দেখুন। এখান দিয়ে স্পাইনাল ক্যানাল চলে গেছে, যা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে পিঠ এবং কোমরের বিভিন্ন কশেরুকার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ইনট্র্যাথিকাল সিরিঞ্জ বিশেষ ধরনের এমন এক সিরিঞ্জ, যার মাধ্যমে স্পাইনাল ক্যানালে এমন কিছু প্রবেশ করানো সম্ভব, যেটা সরাসরি মস্তিষ্কে গিয়ে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে মিশে গিয়ে নিজের কাজ শুরু করবে।
ফিজিওথেরাপিস্টের মেডিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় তার জন্য ইট্র্যাথিক্যাল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে Beclofen প্রবেশ করানোটা কোনো ব্যাপারই নয়। গৌরবের মাঝে মাসল রিলাক্সেন্ট (মাংসপেশি শিথিলকারী) ড্রাগ ওভারডোজের লক্ষ্মণ দেখেই বুঝতে পারলাম আমার অনুমান ঠিক। ডিলেরিয়ামের অংশ হিসেবে চোখে শর্ষেফুল দেখা বলতে যা বোঝায়, সেই মুহূর্তে ছেলেটির তাই-ই হচ্ছিল।
আমি অবশ্য প্ল্যান A, B, C, D-চার চারটা ফুলভ প্ল্যান নিয়েই গিয়েছিলাম। ছেলেটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম, সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে গিয়ে ড্রাগ ইতোমধ্যে নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে। মুখের মাধ্যমে বিষ দেওয়া হয়নি দেখে চারকোলের মাধ্যমে স্টমাক ওয়াশের প্রশ্নই আসে না। তাই প্ল্যান A বাদ দিয়ে দিলাম। মাসল রিল্যাক্সেন্টের ওভারডোজ দেওয়া হয়েছে বুঝতে পারলেও একজ্যাক্ট Beclofen-ই দেওয়া হয়েছে কিনা সেটা জানতাম না। তাই প্ল্যান B-তে Beclofen-এর অ্যান্টিডট হিসেবে Atropin ব্যবহারের যে পরিকল্পনা ছিল, সেটাও বাদ দিলাম। গৌরবের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তাই Benzodiazepine এর মাধ্যমে চিকিৎসা দেবার যে প্ল্যান C ছিল সেটাও বাদ দিলাম। কারণ, এতে গৌরবকে বাঁচানোর সম্ভাবনা তেমন একটা নেই, অলরেডি স্টেজ ২ তে চলে যাচ্ছে ছেলেটা। উপায় না দেখে শেষমেশ প্ল্যান D অনুযায়ী কাজ করারই সিদ্ধান্ত নিলাম। হয়ে গেলাম সার্জন।
সত্যি আবরার! মেডিক্যাল টার্মগুলোকে এত সহজ করে তুমি ব্যাখ্যা করছ, শুনে মনে হচ্ছে তোমার কাছে ক্লাস করলে কয়েক মাসেই এম.বি.বি.এস ডাক্তার হয়ে যেতে পারব। তা সার্জারি করার মেন্টাল প্রিপারেশনও নিয়ে গিয়েছিলে নাকি? ওরে বাবা!
জি স্যার। লাম্বার পাংচার (Lumer Puncture) বলে একটা সার্জারি আছে, যেটার মাধ্যমে স্পাইনাল ক্যানাল থেকে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড সংগ্রহ করা যায়।
ড্রাগ পুরো সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে ছড়িয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে গৌরবকে ভেজিটেটিভ স্টেজে নিয়ে যাওয়ার আগে ঠিকঠাক লাম্বার পাংচার করতে পারলে ছেলেটাকে বাঁচানো সম্ভব-বুঝে গেলাম। প্ল্যান D-এর অংশ হিসেবে লাম্বার পাংচারের জন্য বিশেষায়িত নিডল আগেই নিয়ে গিয়েছিলাম। নিজের কাজ শুরু করে দিলাম। প্রত্যেকটা মুহূর্তকে মনে হচ্ছিল একেকটা শতাব্দী।
আমি পেশাদার নিউরোসার্জন নই, গোয়েন্দা বিভাগের ফরেন্সিক ডাক্তার। তবুও অর্জিত জ্ঞান আর এতদিনের প্রস্তুতির সম্পূর্ণটা সমর্পণ করলাম একটা তাজা প্রাণ বাঁচাতে।
আবেগে কেঁপে গেল আবরারের গলা, মানুষের জন্মের প্রক্রিয়ায় নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনার মতোই আরেক আনন্দদায়ক অনুভূতির আকর হলো কোনো মরণাপন্ন মানুষের প্রাণ বাঁচানো।
তারপর?
ছেলেটাকে শেষ পর্যন্ত সুস্থ করে তুলতে পারলাম। তার থেকেই পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানলাম কিছুদিন পর। ফিজিওথেরাপিস্টের নাম অর্চনা। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, বছর দশ আগে এক বিশাল শিল্পপতির বাড়িতে বাড়ির মালকিনের দেখভালের জন্য নিয়োগ করা হয় অর্চনাকে। গ্রামের মেয়ে, অভাবের সংসার। তবে অর্চনার পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ। কর্তামশাই গ্রামের দূর সম্পর্কের আত্মীয়াকে নিজের প্রাসাদে স্থান দেন, ঢাকায় ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে এসব কিছুর পেছনে পেডোফাইল লোকটার যে বিকৃত উদ্দেশ্য ছিল, তা ছোট অর্চনা জানত না। ধীরে ধীরে আপাতদৃষ্টিতে ফেরেশতার মতো লোকটার পুঁজিবাদী মুখোশটা খুলে আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। দিনের পর দিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে অর্চনাকে বিকৃত উপায়ে নির্যাতন করত লোকটা। গরিব ঘরের মেয়ে, এত বড় শিল্পপতির বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি কোনোভাবেই ছিল না। ছোট মেয়েটার মধ্যে একটা অল্টার পারসোনালিটি গড়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে এই বিকৃত পরিবেশেই মেয়েটি বড় হয়ে ওঠে, পড়ালেখা শেষ করে হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্টের চাকরি নেয়।
এরই মাঝে লোকটার মৃত্যু ঘটে। শেষ পর্যন্ত দানবের হাত থেকে মুক্তি ঘটে। তবে তত দিনে অৰ্চনার মনোজগতে এক ভয়ংকর বিকৃতি ঘটে গেছে, ভয়ংকর পুরুষবিদ্বেষ আর পুরুষের প্রতি জিঘাংসা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
চলার পথে যেকোনো পুরুষ অর্চনার সাথে সদ্ব্যবহার করলে বা কোনো রকম বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করলেই তার অল্টার ইগো জেগে উঠত।
মেয়েটি এমনিতে খুবই গোবেচারা ধরনের, খুবই স্বাভাবিক জীবনযাপন করত। সরকারি হাসপাতালে চাকরি-নিজের খরচ নিজেই চালাত, গ্রামেও টাকা পাঠাত। সেই শিল্পপতির পরিবারের কারো সাথে কোনো রকম যোগাযোগ ছিল না আর। তবে পুরুষের প্রসঙ্গ এলেই মানৰী থেকে দানবীতে বদলে যেত। এই পরিবর্তন অবশ্য সাধারণের চোখে ধরা পড়ত না। সাইকোসিসের পেশেন্ট হিসেবে এমন প্যাটার্ন তুলনামূলক রেয়ার। অর্চনা গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে সাতজন পুরুষকে বিভিন্নভাবে মেডিকেলীয় জ্ঞান প্রয়োগ করে খুন করেছে। গৌরব হতে যাচ্ছিল তার অষ্টম ভিকটিম। শিউরে উঠলেন ডিআইজি।
গৌরবের সাথে অনার দেখা হয় হাসপাতালে। ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে অর্চনা ছেলেটির মায়ের দায়িত্বে ছিল।
সবকিছুই ঠিক ছিল, তবে রিলিজের দিন অর্চনাকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ফুলের তোড়া উপহার দিয়েই আদতে নিজের কবর খোঁড়ে গৌরব। অর্চনার ভেতর জেগে ওঠে তার খুনি সত্তা। আর অল্টার ইগো সত্যিকারের মানুষটার থেকে অনেক গুণ বেশি ঠান্ডা মাথার খুনি।
বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা অর্চনাই করে। ধীরে ধীরে গৌরবের সাথে সখ্য বাড়ায়। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। রিসোর্ট বুক করে। আর বাকি ঘটনা তো শুনলেনই।
আগের সাতটা ছেলের ক্ষেত্রেও কি ছেলেরা নিষ্কাম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবার পর অর্চনার অল্টার ইগো জেগে উঠেছিল? প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্চনা খুনগুলো করেছে?
প্রত্যেকটা কেস নিয়ে আমার স্টাডি করা হয়নি। তবে, ধরে নিতে পারেন, অনেকটা তাই।
মেয়েটিকে তো পরে খুঁজে পেয়েছিলে। পুলিশের হাতে তুলে দাওনি কেন? আর্দ্র চোখে ডিআইজির দিকে তাকাল আবরার।
মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ। তার বিকারগ্রস্ত দিকটি সারিয়ে তোলার জন্য ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করে দিয়েছি। আমার ব্যস্ততা একটু কমলেই রেগুলার কাউন্সেলিং করব। আপাতত অন্য ডাক্তাররা অর্চনাকে দেখছেন।
জানালার বাইরে দূরে তাকিয়ে আছেন তামিম সাহেব। ঠোঁট, উরু, নাভি, বক্ষ আর উরুসন্ধির মাঝে আবরণীকলার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সৌন্দর্য বিমূর্ত অবয়বটি নোংরা মাছির খোরাক হবার কারণেই কী জগতের যাবতীয় অপরাধবিজ্ঞানীর বেগার খাটনি যুগ যুগ ধরে বেড়ে চলেছে? এই মাছি দমনের কীটনাশক কী আছে? নাকি নেই?