হরিনাথ মজুমদারের আহ্বানে লালন এখন দু-একজন সঙ্গীকে নিয়ে তার বাড়িতে যায় মাঝে মাঝে।
হরিনাথ সম্পর্কে ভালো করে জানার পর লালন বুঝেছে, এই মানুষটার। অনেক গুণ আছে।
লালনেরই মতন হরিনাথও বাল্যে পিতৃহীন, খুবই দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছে। সে অবশ্য ইস্কুল পাঠশালায় পড়েছে কিছুদিন, তবে নিতান্ত অর্থের অভাবেই বেশিদূর এগোতে পারেনি। বাকি সব অর্জন তার নিজের চেষ্টায়। এবং বাল্যের সেই কথা স্মরণ করেই সে দরিদ্র বালকদের জন্য। একটা ইস্কুল খুলেছে নিজের গ্রামের মধ্যে।
এখনও হরিনাথের আর্থিক সংগতি তেমন নেই, কিন্তু সমাজে খানিকটা। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তার কারণ, সে একটা পত্রিকা চালায়। এ জন্য তাকে ধার করতে হয়, প্রায় ভিক্ষে করতেও হয়, তবু সে পত্রিকাটি বন্ধ হতে দেয় না। এবং ছাপার অক্ষরের এমনই জোর যে, উচ্চ শ্রেণির অনেক মানুষ এখন তাকে মান্য করে।
হরিনাথ অবশ্য নিজের বাল্যকালকে মুছে দিয়ে ভদ্রলোকদের সঙ্গে গা ঘেষাঘেঁষি করে তাদের শ্রেণিতে উন্নীত হবার জন্য একটুও লালায়িত নয়। সে সবসময় অসহায়, নিপীড়িত মানুষদের পক্ষে এবং নিজেকে তাদেরই একজন মনে করে এখনও। তার এই মনোভাবটাই আকৃষ্ট করে লালনকে।
হরিনাথের কুটির সদৃশ বাড়িতে বহু ধরনের মানুষ আসে। হরিনাথ লালনকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করলেও তার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে আলাপচারিতা করবার সুযোগ পায় না লালন। সব সময়েই অনেক লোক ঘিরে থাকে হরিনাথকে। এবং তারা দেশ, সমাজ, জমিদার, ম্যাজিস্ট্রেট, কোতোয়ালি, বন্যা, খাজনা এই সব বিষয়েই আলোচনা করে উত্তেজিতভাবে। কেউ নিজের মনের অন্দরমহলের কথা বলে না।
লালন একধারে বসে চুপ করে শোনে।
তার ওই জঙ্গলের বসতি, কাছাকাছি কয়েকটি গ্রাম, এর বাইরের যে-জগৎ সে সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল যৎসামান্য। তার চেনা এই পরিবেশের বাইরে রয়েছে বিশাল এক দেশ। যশোর আর বহরমপুর ছাড়া সে আর কোনও শহর দেখেনি, তাও বহরমপুরের কথা সে ঠিক মনে করতে পারে না। এখানে সে শোনে, ঢাকা, দিল্লি, লক্ষ্ণৌর নানা কাহিনি। এখানে অনেকেই বলে, কত জমজমাট ছিল বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ, এখন সেই মুর্শিদাবাদ ম্লান হয়ে গেছে, কলকেতা নামে একটা নতুন শহর অনেক দূরে গজিয়ে উঠেছে। এদিককার বেশির ভাগ জমিদারই এখন ঠাঁই নিয়েছে কলকেতায়।
লালন কোনও কথা বলে না, তবু তার দিকে একসময় হরিনাথের দৃষ্টি পড়ে। তখন হরিনাথ বলে, ওহে সাঁই, তুমি তো কিছুই বলছ না, বলতেও হবে না, তুমি বরং গান শোনাও!
লালন গান ধরে।
হরিনাথ বাক্যবাগীশ মানুষ। নিজের কথার তোড়ে সে অন্যদের কথা শুনতেই চায় না, কিন্তু মানুষটি সত্যিই গান ভালোবাসে। গান শোনার সময় সে চুপ করে থাকে, এক-এক সময় তার চক্ষু দিয়ে অশ্রু বর্ষণ হয়। লালনকে পরপর কয়েকটি গান গাইবার অনুরোধ করার পর সে হঠাৎ উঠে এসে লালনকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, তুমিই ধন্য, ধন্য ফকির, তোমার সত্য উপলব্ধি হয়েছে, নইলে এমন গান রচনা সম্ভব নয়। আমরা এখনও রয়ে গেলাম বিষয়ে আবদ্ধ জীব।
একদিন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল।
সেদিনও লালন তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে হরিনাথের বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে বসে অন্যদের কথা শুনছে। হরিনাথ এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছে জমিদারদের বিরুদ্ধে। এমন সময় এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে এসে হরিনাথের কানের কাছে কী যেন বলল। তো
একটুক্ষণ শোনার পর হরিনাথ উত্তেজিতভাবে বলল, তাই নাকি? চলো, সবাই যাই।
উঠে দাঁড়িয়ে সে লালনকে বলল, চলো বন্ধু, তুমিও চলো।
লালন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
হরিনাথ বলল, নদীর ধারে। বেশি সময় নেই, চলো, যেতে যেতে তোমায় সব বলব।
ঘটনাটি এই-কুমারখালির মানুষের নানারকম অভাব-অভিযোগ রয়েছে। ইস্কুল-মাদ্রাসা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত নেই। বন্যায় ভোরাই নদীর পাড় ভাঙছে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ততা লেগেই আছে। কিন্তু জমিদারের নায়েব এর কোনও প্রতিকার করে না, পুলিশ এসব অভিযোগে কান দেয় না। সর্বত্র অরাজকতা। একমাত্র জেলার হাকিমের কাছে সব কিছু জানালে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু হাকিম সাহেবের কাছে তো পৌঁছোনই যায় না।
খবর আছে, আজই হাকিমসাহেব তার লঞ্চ নামে কলের জাহাজে এই ভোরাই নদী দিয়ে যাবেন। তখন সাহেবের কাছে অনেকে মিলে গিয়ে অভাব-অভিযোগের কথা জানাবার এক সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হয়েছে।
প্রায় হাজারখানেক মানুষ সমবেত হয়েছে ভোরাই নদীর তীরে। হরিনাথের সঙ্গে লালনের দলবলও সেখানে এসে দাঁড়াল।
সত্যিই সে স্টিমার আসবে তো? নাকি সবটাই গুজব? এরকম গুজব আগেও রটেছে। কুমারখালির মতন এক ক্ষুদ্র শহরে সাহেব আসবেন কেন? সবাই অধীর প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে নদীর পূর্ব দিকে।
নদীতে নৌকোর অভাব নেই। কয়েকজন সেই সব নৌকোর মাঝিদের জিজ্ঞেস করল, কলের জাহাজের সংবাদ। কেউ সঠিক কিছু বলতে পারে না।
একসময় দূরে দেখা গেল ধোঁয়া আর কলের জাহাজের ভো। তা হলে আসছে, আসছে! জনতার হর্ষধ্বনি ছুঁয়ে গেল দিগন্ত।
একসময় ভোঁ দিতে দিতে জাহাজটি এসে গেল কাছে। কিন্তু একী, জাহাজের তো কুমারখালিতে থামার কোনও লক্ষণ নেই। জেটি ঘাটে কর্মচারীরা তৈরি হয়ে আছে, অথচ মাঝনদীতে জাহাজের মুখ সামনের দিকে।
জনতা চিৎকার করতে লাগল। তা আকুল আহ্বান হলেও জাহাজ কর্ণপাত করবে না, ভোঁ দিয়ে দিয়ে নৌকোগুলিকে সরে যাবার নির্দেশ জানানো হচ্ছে জাহাজ থেকে।
হরিনাথ হতাশভাবে বলল, যাঃ! কোনও আশা নাই! এইসব সাহেব সুবোর সামনে পৌঁছোনোই এক ঝক্কি-ঝামেলা। যদি কোনওক্রমে মহামান্য হাকিমের কাছে আমাদের কথাগুলি পৌঁছে দেওয়া যেত।
লালন বলল, হাকিমের এই কলের জাহাজ থামানো যায় না?
হরিনাথ বলল, কী করে থামাবে? কোনও নৌকো নিয়ে কাছে এগুতে গেলেও গুলি করতে পারে।
লালন বলল, অন্য উপায়ও আছে। এই যে এত মানুষ, আমরা সবাই মিলে। যদি নদীতে নেমে পড়ি, তা হলে আমাদের ওপর দিয়েও কি কলের জাহাজ চালাতে পারবে? আপনি অন্যদের বলে দ্যান, আমরা জলে নামতেছি।
লালন তার সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে। সঙ্গে সঙ্গে আরও বহু মানুষ, প্রায় হাজারখানেক তো হবেই, তাদের অনুসরণ করল। নদী ভরে গেল মানুষে। হাজারখানেক মানুষ সাঁতার দিয়ে ঘিরে ফেলল সেই কলের জাহাজ।
হাকিমসাহেব সহৃদয়। তিনি এত মানুষ দেখে গুলি চালাতে বললেন না, বরং সকৌতুকে ডেক-এ এসে দাঁড়ালেন। হরিনাথ ও আরও তিনজন জনপ্রতিনিধি সাহেবের আহ্বানে উঠে গেল জাহাজের ওপরে।
সাহেব ধৈর্য ধরে সব কথা শুনলেন। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের প্রতিকারেরও আশ্বাস দিলেন তিনি।
কুমারখালির উন্নতি বা অন্য কিছুর অংশীদার নয় লালন। সে নেতাও হতে চায় না।
তবু রটে গেল যে, জঙ্গলের মধ্যে দলবল নিয়ে থাকে লালন নামে এক ফকির, সে-ই হাকিমসাহেবের জাহাজ থামিয়ে দিয়েছে।
লালন যতই বলে, না, না, ওসব কিছু না। আমরা সাঁতার জানি বলে আগে পানিতে নেমেছি, কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করে না।