হরিদাসের চুল কাটার দোকান সোবাহানবাগে। তার দোকানের একটু সামনেই ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর রোডের মাথা। সঙ্গতকারণেই হরিদাস তার সেলুনে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছে–
শেখের বাড়ি যেই পথে
আমার সেলুন সেই পথে।
সাইনবোর্ডের লেখা পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তবে হরিদাস পথচারীদের জন্যে এই সাইনবোের্ড টানায় নি। তার মনে ক্ষীণ আশা, কোনো একদিন এই সাইনবোের্ড বঙ্গবন্ধুর নজরে আসবে। তিনি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসবেন। গম্ভীর গলায় বলবেন, সেলুনের সাইনবোর্ডে কী সব ছাতা-মাথা লিখেছিস! নাম কী তোর? দে আমার চুল কেটে দে। চুল কাটার পর মাথা মালিশ।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ ধরনের কথা বলা মোটেই অস্বাভাবিক না, বরং স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি এমন আচরণ করেন বলেই তাঁর টাইটেল ‘বঙ্গবন্ধু’।
হরিদাস চুল কাটার ফাঁকে ফাঁকে খদ্দের বুঝে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প ফাঁদে। খদ্দেররা বেশিরভাগই তার কথা বিশ্বাস করে। হরিদাস কাঁচি চালাতে চালাতে বলে, আমার কথা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। যে কেঁচি দিয়া আপনের চুল কাটতেছি সেই কেঁচি দিয়া স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর চুল কেটেছি। তাও একবার না, তিন বার। প্রথমবারের ঘটনাটা বলি, চৈত্র মাসের এগার তারিখ। সময় আনুমানিক এগারটা…
পনেরই আগস্ট শেষরাতে হরিদাস তার দোকানে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙল, মড়মড় শব্দ হচ্ছে—দোকান ভেঙে পড়ছে। হরিদাস ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে হতভম্ভ। এটা আবার কী?
আলিশান এক ট্যাংক তার দোকানের সামনে ঘুরছে। ট্যাংকের ধাক্কায় তার দোকান ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ট্যাংকের ঢাকনা খোলা। দুজন কালো পোশাকের মানুষ দেখা যাচ্ছে। দোকান ভেঙে ফেলার জন্যে কঠিন কিছু কথা হরিদাসের মাথায় এসেছিল। সে কোনো কথা বলার আগেই ট্যাংকের পেছনের ধাক্কায় পুরো দোকান তার মাথায় পড়ে গেল। পনেরই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সূচনা ঘটল হরিদাসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
ঢাকা মসজিদের শহর। সব মসজিদেই ফজরের আজান হয়। শহরের দিন শুরু হয় মধুর আজানের ধ্বনিতে। আজান হচ্ছে। আজানের ধ্বনির সঙ্গে নিতান্তই বেমানান কিছু কথা বঙ্গবন্ধুকে বলছে এক মেজর, তার নাম মহিউদ্দিন। এই মেজরের হাতে স্টেনগান। শেখ মুজিবের হাতে পাইপ। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি এবং ধূসর চেক লুঙ্গি।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কী চাও? মেজর ব্ৰিত ভঙ্গিতে আমতাআমতা করতে লাগল। শেখ মুজিবের কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব আবার বললেন, তোমরা চাও কী?
মেজর মহিউদ্দিন বলল, স্যার, একটু আসুন।
কোথায় আসব?
মেজর আবারও আমতা-আমতা করে বলল, স্যার, একটু আসুন।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারে নি, সে কাজ তোমরা করবে?
এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে এল মেজর নূর। শেখ মুজিব তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশফায়ার করল। সময় ভোর পাঁচটা চল্লিশ। বঙ্গপিতা মহামানব শেখ মুজিব সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়লেন। তখনো বঙ্গবন্ধুর হাতে তাঁর প্রিয় পাইপ।
বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিতে কিছুক্ষণের জন্যে নরকের দরজা খুলে গেল। একের পর এক রক্তভেজা মানুষ মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।
নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী রমা আদালতে যে জবানবন্দি দেন তা তুলে দেওয়া হলো :
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের ছেলে আবদুর রহমান শেখ
ওরফে রমার জবানবন্দি
আমি ১৯৬৯ সালে কাজের লোক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোর ৫টায় বঙ্গবন্ধু নিহত হন। তখন আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থাকতাম। ওইদিন অর্থাৎ ঘটনার দিন রাত্রে আমি এবং সেলিম দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলাম। আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন যে, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। ওইদিন তিনতলায় শেখ কামাল এবং তার স্ত্রী সুলতানা ঘুমিয়েছিল। ওইদিন শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী এবং ভাই শেখ নাসের দোতলায় ঘুমিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী এবং শেখ রাসেল দোতলায় একই রুমে ঘুমিয়েছিল। নিচতলায় পিএ মহিতুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মচারী ছিল।
বেগম মুজিবের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি লেকের পাড়ে যেয়ে দেখি কিছু আর্মি গুলি করতে করতে আমাদের বাড়ির দিকে আসিতেছে। তখন আমি আবার বাসায় ঢুকি এবং দেখি পি.এ./রিসিপশন রুমে বঙ্গবন্ধু তার সাথে কথা বলিতেছে। আমি পিছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় এসে দেখি বেগম মুজিব দোতলায় ছোটাছুটি করছে। আমি সাথে সাথে তিনতলায় যাই এবং আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে বলে কামাল ভাইকে উঠাই। কামাল ভাই তাড়াতাড়ি একটা প্যান্ট ও শার্ট পরে নিচের দিকে যায়। আমি তার স্ত্রী সুলতানাকে নিয়ে দোতলায় আসি। দোতলায় গিয়ে একইভাবে আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে বলে জামাল ভাইকে উঠাই। তিনি তাড়াতাড়ি প্যান্ট, শার্ট পরে তার মার রুমে যান। সাথে তাঁর স্ত্রীও যান। এই সময়ও খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। একপর্যায়ে কামাল ভাইয়ের আর্তচিঙ্কার শুনতে পাই। একই সময় বঙ্গবন্ধু দোতলায় আসিয়া রুমে ঢুকেন এবং দরজা বন্ধ করে দেন। প্রচণ্ড গোলাগুলি একসময়ে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে আবার বাইরে এলে আর্মিরা তার বেডরুমের সামনে চারপাশে তাহাকে ঘিরে ফেলে। আমি আর্মিদের পিছনে ছিলাম। আর্মিদের লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা কি চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” তারা বঙ্গবন্ধুকে তখন সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ির ২/৩ ধাপ নামার পরে নিচের দিক হতে অনেক আর্মি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। গুলি খেয়ে সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন। আমি তখন আর্মিদের পিছনে ছিলাম। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি করো?” উত্তরে আমি বলি, “কাজ করি।” তখন তারা আমাকে ভিতরে যেতে বলে। আমি বেগম মুজিবের রুমের বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিই। সেখানে বেগম মুজিবকে বলি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছে। ওই বাথরুমে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব ও বঙ্গবন্ধুর ভাই নাসের এবং আমি আশ্রয় নিই। শেখ নাসের ওই বাথরুমে আসার আগে তাঁর হাতে গুলি লাগে, তার হাত হতে তখন রক্ত ঝরছে। বেগম মুজিব শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে তার রক্ত মুছেন। এর পর আর্মিরা আবার দোতলায় আসে এবং দরজা পিটাতে থাকলে বেগম মুজিব দরজা খুলিতে যান এবং বলেন, “মরলে সবাই একই সাথে মরব।” এই বলে বেগম মুজিব দরজা খুললে আর্মিরা রুমের ভিতর ঢুকে পড়ে এবং শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং আমাকে নিচের দিকে নিয়ে আসছিল। তখন সিঁড়িতে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বলেন, “আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলল।” এই কথার পর আর্মিরা তাকে দোতলায় তার রুমের দিকে নিয়ে যায়। একটু পরেই ওই রুমে গুলির শব্দসহ মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনতে পাই। আর্মিরা নাসের, রাসেল ও আমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেখানে সাদা পোশাকের একজন পুলিশের লাশ দেখি। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কে”, তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাহাকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই গুলির শব্দ ও তার মাগো’ বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাই। শেখ রাসেল “মার কাছে যাব” বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পি.এ মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছিল, “ভাই, আমাকে মারবে না তো?” এমন সময় একজন আর্মি তাহাকে বলল, “চলো তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।” এই বলে তাহাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে পাই।
লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় সেলিমের হাতে এবং পেটে দুইটি গুলির জখম দেখলাম। এর পর দেখলাম কালো পোশাক পরিহিত আর্মিরা আমাদের বাসার সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। তখন ডিএসপি নূরুল ইসলাম এবং পিএ/রিসিপশনিস্ট মহিতুল ইসলামকে আহত দেখি। এর পরে আমাদের বাসার সামনে একটা ট্যাংক আসে। ট্যাংক হতে কয়েকজন আর্মি নেমে ভিতরের আর্মিদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে ভিতরে কে আছে, উত্তরে ভিতরের আর্মিরা বলে, All are finished.’ অনুমান বেলা ১২টার দিকে আমাকে ছেড়ে দিবার পর আমি প্রাণভয়ে আমার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া চলে যাই।
স্বাক্ষর
আবদুর রহমান শেখ (রমা)
মন্ত্রী সেরনিয়াবত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি) এবং শেখ মণি-র (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে) বাড়িও একই সঙ্গে আক্রান্ত হলো। সেখানেও রক্তগঙ্গা। শেখ মণি মারা গেলেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে। পিতামাতার মৃত্যুদৃশ্য শিশু তাপস দেখল খাটের নিচে বসে। এই শিশুটি তখন কী ভাবছিল? কেবিনেট মন্ত্রী সেরনিয়াবত মারা গেলেন তার দশ-পনের বছরের দুই কন্যা, এগার বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর। বয়সী এক নাতির সঙ্গে।
কাদের মোল্লা রোজ ফজরের নামাজ আদায় করে তার চায়ের দোকান খোলে। আজও তা-ই করেছে। কেরোসিনের চুলা ধরিয়ে চায়ের কেতলি বসিয়েছে, তখনই সামরিক পোশাক পরা একজন দৌড়ে এসে কাদের মোল্লার দোকানের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। রক্তে তাঁর পোশাক ভেজা। তিনি পেটের কাছে কী যেন ধরে আছেন।
হতভম্ব কাদের মোল্লা ভীত গলায় বলল, আপনি কে?
সেনা কর্মকর্তা ক্ষীণ গলায় বললেন, আমার স্ত্রীকে এই জিনিসটা পৌঁছে দিতে পারবে? তোমাকে তার জন্যে দুই হাজার টাকা দিব। আমার মানিব্যাগে দুই হাজার টাকা আছে।
কাদের মোল্লা বলল, অবশ্যই পারব। জিনিসটা কী?
সেনা কর্মকর্তা তার উত্তর দিতে পারলেন না। তার মুখ থেকে সাঁ সাঁ আওয়াজ বের হতে লাগল। এই সেনা কর্মকর্তা আমাদের পরিচিত। তিনি মেজর ফারুকের ঘনিষ্ঠজন, সুবেদার মেজর ইশতিয়াক। তিনি পেটের কাছে যে জিনিসটা ধরে আছেন তা হলো—বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে চুরি করে আনা চল্লিশ ভরি সোনার নৌকা। নিচে লেখা—‘আদমজি শ্রমিক লীগের উপহার।
কাদের মোল্লা সোনার নৌকা ও মানিব্যাগ নিয়ে সেই দিনই দেশের পথে রওনা হলো।
আনন্দ ও উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। বাইরে থেকে দেখে অবশ্যি মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মুখ হা করা। সে মুখ দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। তার হাতে চটের ব্যাগ। এই ব্যাগে সোনার নৌকা ও মানিব্যাগ। চটের ব্যাগ কোথাও রেখে কাদের মোল্লা শান্তি পাচ্ছে না। একবার কোলে রাখছে, একবার বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে।
বাসে কাদেরের ডানপাশে বসা যাত্রী বলল, আপনার ব্যাগে কী?
কাদের মোল্লা চোখ গরম করে বলল, আমার ব্যাগে কী তা দিয়া আপনার প্রয়োজন কী?
রাগেন কী জন্যে? ব্যাগ নিয়া চাপাচাপি করতেছেন এইজন্যে জিগাইলাম।
কাদের মোল্লা বলল, চুপ। ঘুষি দিয়া নাকশা ফাটাইয়া দিব।
ঘুষি দিয়া দেখেন।
কাদের মোল্লা প্রচণ্ড ঘুষি দিয়ে সহযাত্রীর নাক ফাটিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল।
সকাল সাতটা।
বাংলাদেশ বেতার ঘনঘন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছে। উল্লসিত গলায় একজন বলছে, ‘আমি ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হলো।’
দেশ থমকে দাঁড়িয়েছে।
কী হচ্ছে কেউ জানে না। কী হতে যাচ্ছে, তাও কেউ জানে না।
মানুষের আত্মার মতো দেশেরও আত্মা থাকে। কিছু সময়ের জন্যে বাংলাদেশের আত্মা দেশ ছেড়ে গেল।
মেজর জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, প্রেসিডেন্ট নিহত, তাতে কী হয়েছে? ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছে। কনস্টিটিউশন যেন ঠিক থাকে।
বঙ্গবন্ধুর অতি কাছের মানুষ তাঁর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বসে আছেন রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর সাভারে। আতঙ্কে তিনি অস্থির। রক্ষীবাহিনী আত্মসমর্পণ করায় তাকে নিয়ে পড়েছে। তারা বারবার জানতে চাচ্ছে, তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে কী করবে? বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রক্ষীবাহিনী ঝিম ধরে বসে আছে। একসময়ের সাহসী তেজি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদও ঝিম ধরে আছেন। শুরু হয়েছে ঝিম ধরার সময়।
রাস্তায় মিছিল বের হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেই মিছিল আনন্দ মিছিল।
শফিক বাংলামোটর গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। সেখানে রাখা ট্যাংকের কামানে ফুলের মালা পরানো। কিছু অতি উৎসাহী ট্যাংকের ওপর উঠে নাচের ভঙ্গি করছে।
আমার বাবর রোডের বাসার কথা বলি। বেতারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে একতলায় রক্ষীবাহিনীর সুবেদার পালিয়ে গেলেন। তাঁর দুই মেয়ে (একজন গর্ভবতী) ছুটে এল মা’র কাছে। তাদের আশ্রয় দিতে হবে। মা বললেন, তোমাদের আশ্রয় দিতে হবে কেন? তোমরা কী করেছ? তারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, খালাম্মা, এখন পাবলিক আমাদের মেরে ফেলবে।
এই ছোট্ট ঘটনা থেকে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার এবং তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণাও টের পাওয়া যায়।
খন্দকার মোশতাক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও ফজরের নামাজটা সময়মতো পড়তে পারেন না। তিনি অনেক রাত জাগেন বলেই এত ভোরে উঠতে পারেন না। ফজরের ওয়াক্তের নামাজ নিয়ে তিনি চিন্তিতও না। নবি-এ-করিম (দঃ) একদিন ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পারেন নি। এই কারণেই সবার জন্যে ফজরের নামাজের ওয়াক্ত নমনীয় করা হয়েছে। কেউ দেরি করে পড়লেও তাতে দোষ ধরা হবে না।
পনেরই আগস্ট তার ঘুম ভাঙল আটটায়। শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন—এই খবর তাঁকে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। খবর নিয়ে এসেছে তাঁর ভাইস্তা মোফাজ্জল। তাকে ভীত এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে। মোফাজ্জল বলল, রেডিও ছাড়ব? খবর শুনবেন?
মোশতাক বললেন, না। কড়া করে এক কাপ চা আনো। চা খাব।
মোফাজ্জল বলল, আপনি কি বাড়িতেই থাকবেন, না পালিয়ে যাবেন?
পালিয়ে যাব কোন দুঃখে? আমি অপরাধ কী করেছি?
সদর দরজায় কি তালা লাগায়া রাখব?
না। সদর দরজা থাকবে খোলা। তুমি নিজে সেখানে টুল পেতে বসে থাকবে। আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে তাকে সম্মানের সঙ্গে নিয়ে আসবে।
কে আসবে দেখা করতে?
মোশতাক এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। পরিস্থিতি সামলানোর জন্যে কিছু সময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা দরকার। বাথরুম হলো নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে আদর্শ স্থান।
তিনি অজু করে বাথরুম থেকে বের হলেন। ফজরের নামাজ আদায় করলেন। আল্লাহপাকের কাছে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ শেষ করে নেয়ামুল কোরআন নিয়ে বসলেন। আল্লাহপাকের নিরান্নব্বই নাম পাঠ করে আজকের দিন শুরু করবেন।
ইয়া আল্লাহু (হে আল্লাহ)
ইয়া রহমানু (হে করুণাময়)
ইয়া রাহিমু (হে পরম দয়ালু)
ইয়া মালেকু (হে প্রভু)
ইয়া কুদুসু (হে পবিত্রতম)
ইয়া সালামু (হে শান্তি দানকারী)
‘ইয়া সালামু’ পড়ার পরপরই বিকট ঘড় ঘড় শব্দ শোনা যেতে লাগল। মোশতাক তার তিনতলার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালেন। তার কলিজা শুকিয়ে গেল। বিকটদর্শন এক ট্যাংক তার বাড়ির সামনে। ট্যাংকের কামান তার শোবারঘরের দিকে তাক করা। ঘটনা কী? ট্যাংক কেন? এত দিন যা শুনে এসেছেন তার সবই কি ভুয়া? ট্যাংকের গোলার আঘাতে তাকে মরতে হবে? ট্যাংক কোনো শান্তির পতাকাবাহী যুদ্ধযান না। অকারণে কেউ নিশ্চয়ই তার বাড়ির সামনে ট্যাংক বসাবে না।
সিঁড়িতে বুটজুতার শব্দ হচ্ছে। খন্দকার মোশতাক একমনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে লাগলেন। এই দোয়া পাঠ করে ইউনুস নবি মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তার বিপদ ইউনুস নবির চেয়ে বেশি।
দরজা খুলে মেজর রশীদ ঢুকলেন। তার হাতে স্টেনগান। তার পেছনে দু’জন সৈনিক। তাদের হাতেও স্টেনগান। সৈনিক দু’জন স্টেনগান মোশতাকের দিকে তাক করে আছে।
মোশতাক নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করলেন। মেজর রশীদ বললেন, স্যার চলুন। মোশতাক বললেন, কোথায় যাব?
প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। প্রথমে রেডিওস্টেশনে যাবেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।
ট্যাংক এসেছে কেন?
প্রেসিডেন্টের মর্যাদা রক্ষার জন্যে ট্যাংক এসেছে।
মোশতাক বললেন, শুক্রবারে আমি জুম্মার নামাজের আগে কোনো কাজকর্ম করি না। দায়িত্ব যদি গ্রহণ করতে হয় জুম্মার নামাজের পর।
মেজর রশীদ কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে আমি নিতে এসেছি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। অর্থহীন কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।
মোশতাক বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। তবে আমাকে কিছু সময় দিতে হবে। আপনাকে কোনো সময় দেওয়া হবে না।
কাপড় চেঞ্জ করার সময় দিতে হবে। আমি নিশ্চয়ই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিব না?
সকাল এগারটা পঁয়তাল্লিশে খন্দকার মোশতাক বেতারে ভাষণ দিলেন। তিনি আবেগমথিত গলায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিলেন।
মোশতাকের ভাষণের পর বঙ্গভবনে আনন্দ উল্লাস, কোলাকুলি, একে অন্যকে অভিনন্দনের পালা শুরু হয়ে গেল। শুরু হলো মিষ্টি বিতরণ। মিষ্টি কেউ নিজে খাচ্ছে না। একজন অন্যজনকে খাইয়ে দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ তখনো তাঁর বত্রিশ নম্বর বাড়িতে পড়ে আছে।
সন্ধ্যাবেলা শফিক এসেছে রাধানাথ বাবুর কাছে। শফিকের বিপর্যস্ত ভঙ্গি দেখে তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। শফিক কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর কেউ প্রতিবাদ করল না! কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াল না!
রাধানাথ বললেন, কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায় নি এটা ঠিক না। খবর পেয়েছি ব্রিগেডিয়ার জামিলউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্যে ছুটে গিয়েছিলেন। গুলি খেয়ে মারা গেছেন। পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বাধা দিয়েছিলেন। তারাও মারা গেছেন।
শফিক বলল, কেউ তাঁর পক্ষে রাস্তায় বের হয়ে কিছু বলবে না?
রাধানাথ বললেন, তুমি কি রাস্তায় বের হয়ে কিছু বলেছ? তুমি যেহেতু বলো নি, অন্যদের দোষ দিতে পারবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?
জি।
রাধানাথ বললেন, সাহস আছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলার—মুজিব হত্যার বিচার চাই?
শফিক বলল, আমার সাহস নেই। আমি খুবই ভীতু মানুষ। কিন্তু আমি বলব।
কবে বলবে?
আজ রাতেই বলব।
রাত আটটা। মনে হচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তিন বাহিনীপ্রধান নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। পুরোনো মন্ত্রিসভার প্রায় সবাইকে নিয়েই নতুন মন্ত্রিসভা তৈরি হয়েছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যুক্ত হয়েছেন। আতাউল গনি ওসমানি হয়েছেন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা।
মনে হচ্ছে পুরোনো আওয়ামী লীগই আছে, শুধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই। আপসহীন জননেতা মওলানা ভাসানী, যিনি একমাস আগেও বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনিও নতুন সরকারকে সমর্থন জানালেন।
পনেরই আগস্ট রাত ন’টার দিকে সরফরাজ খানের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক যুবককে চিৎকার করতে করতে সড়কের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত যেতে দেখা গেল। সে চিৎকার করে বলছিল–মুজিব হত্যার বিচার চাই। যুবকের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল ভয়ঙ্করদর্শন একটি কালো কুকুর।
সেই রাতে অনেকেই রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ির জানালা খুলে যুবককে আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধও করে ফেলছিল।
আচমকা এক আর্মির গাড়ি যুবকের সামনে এসে ব্রেক কষল। গাড়ির ভেতর থেকে কেউ-একজন যুবকের মুখে টর্চ ফেলল। টর্চ সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ইংরেজিতে বলল, Young man, go home. Try to have some sleep.
শফিককে এই উপদেশ যিনি দিলেন, তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
যান যান বাসায় যান।
শফিক বলল, জি স্যার। যাচ্ছি।
খালেদ মোশাররফ বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অবন্তিদের বাসায় দেখেছি। আপনি অবন্তির গৃহশিক্ষক।
জি।
গাড়িতে উঠুন। আপনি কোথায় থাকেন বলুন। আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
আমি হেঁটে যেতে পারব। তা ছাড়া আমার সঙ্গে এই কুকুরটা আছে। কুকুর নিয়ে আপনার গাড়িতে উঠব না।
শফিক চলে যাচ্ছে। জিপ দাঁড়িয়ে আছে। খালেদ মোশাররফ সিগারেট ধরিয়ে অবন্তির গৃহশিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
শফিক বলল, স্যার যাই? স্লামালিকুম।
খালেদ মোশাররফ বললেন, আপনি একজন সাহসী যুবক। আসুন আমার সঙ্গে হাত মেলান। সাহসী মানুষদের হাতের চামড়া থাকে মোলায়েম। আপনার হাতের চামড়া দেখি?
খালেদ মোশাররফ অনেকক্ষণ শফিকের হাত ধরে রইলেন। শফিকের হাতের চামড়া মোলায়েম না, কঠিন।
রাত বারোটার কিছু পরে চাদরে নাকমুখ ঢেকে ছানু ভাই উপস্থিত হলেন পীর হাফেজ জাহাঙ্গীরের হুজরাখানায়।
হাফেজ জাহাঙ্গীরের রাতের ইবাদত শেষ হয়েছে। তিনি ঘুমুতে যাচ্ছিলেন। ছানু ভাইকে দেখে এগিয়ে এলেন।
ছানু বললেন, পীর ভাই। রাতে থাকার জায়গা দেওয়া লাগে। বিপদে আছি।
কী বিপদ?
বঙ্গবন্ধু নাই। আমরা যারা তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ তারাও নাই। বাংলাদেশের পাবলিক হলো, ব্রেইন ডিফেক্ট পাবলিক। যে-কোনো একজন যদি বলে—ধরো, ছানুরে ধরো। পাবলিক দৌড় দিয়া আমারে ধরবে।
আপনার থাকার ব্যবস্থা করছি। রাতের খনা কি খেয়েছেন?
রাতের খানা কখন খাব বলেন! দৌড়ের উপর আছি। খানার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আরেকটা কথা—সরফরাজ খান সাহেব কি আছেন।
আছেন।
ভালো হয়েছে, উনাকে তার বিষয়সম্পত্তি বুঝিয়ে দিব। খান সাহেবকে আমি বড়ভাইয়ের মতো দেখি, শ্রদ্ধা করি।
সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ লিগেসি অব ব্লাড-এ উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরপর টুঙ্গিপাড়ায় তার পৈতৃক বাড়িতে স্থানীয় জনগণ হামলা করে এবং বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।(১)
হায়রে বাংলাদেশ!
———–
১. এন্থনি মাসকারেনহাস তার গ্রন্থে সত্যের মতো করে অনেক মিথ্যাও ঢুকিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়ি লুট হওয়ার ঘটনা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।