সোমবার তিতলীর তিনটা ক্লাস
সোমবার তিতলীর তিনটা ক্লাস। তিনটাই পার পর। ন’টার মধ্যে শুরু হয়ে বারটার মধ্যে সব ক্লাস শেষ। ঝড়-বৃষ্টি-টর্নেডো যাই হোক না সোমবার বারটায় হাসান লালমাটিয়া কলেজের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। এক জায়গায় থাকে না। একেক দিন একেক জায়গায়। তিতলীর দায়িত্ব হচ্ছে কলেজ থেকে বের হয়ে তাকে খুঁজে বের করা। একদিন সে হাসানকে পেয়েছে নাপিতের দোকানে মাথা মালিশ করাচ্ছে। কুৎসিত দৃশ্য। চোখ বন্ধ করে আয়েশ করে সে বসে আছে। নাপিত শব্দ করে মাথা বানাচ্ছে { তার জীবনে এমন ভীতু কোনো ছেলে দেখে নি। তিতলীর ধারণা, হাসানের তুলনায় তার সাহস অনেক বেশি। যেমন–হাসান কখনো তাকে নিয়ে রিকশায় উঠবে না। কোথাও যেতে হলে বেবিট্যাক্সি নেবে। বেবিট্যাক্সির সিটের দু প্রান্তে দুজন বসে থাকলে নাকি বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। বেবিট্যাক্সিতে উঠেও শান্তি নেই— হাসান বলবে, তিতলী ওড়নাটা দিয়ে নাক আর মুখ ঢেকে রােখ। নাকমুখ ঢাকা থাকলে মানুষ চেনা যায় না। তোমার পরিচিত কেউ যদি তোমাকে দেখেও ফেলে চিনতে পারবে না।
চিনতে পারলে চিনবে। তোমাকে এত ভাবতে হবে না। তুমি সহজ হয়ে বস তো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ‘উইজার্ড অব ওজের’ কাঠের পুতুল।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি হাসান কখনো তিতলীর হাত ধরে না। বেবিট্যাক্সিতে উঠে হাত ধরার কাজটা তিতলীকে করতে হয়। হাত ধরার পর হাসান বাইরের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন ভেতরে কী হলো সে জানে না।
ছেলেদের এত ভীতু হলে মানায় না। ছেলেরা হবে সাহসী, বেপরোয়া। তাদের দাবি থাকবে অনেক বেশি। মেয়েরা সেই সব দাবি সামলে সুমলে মোটামুটি একটা সাম্যাবস্থায় নিয়ে আসবে। এটাই নিয়ম। যে ছেলের দাবি এক শ তাকে দেবে কুড়ি কিন্তু এমন ভাব করতে হবে যেন সত্তর দেয়া হয়ে গেল। হাসানের বেলায় সব নিয়ম উল্টো। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তিতলীর অনেক সাহসী দাবি সে সামলে সুমলে চলছে।
ফার্স্ট পিরিয়ড শেষ হবার পর জানা গেল বাকি দুটা ক্লাস হবে না। ক্লাস না হওয়া সবসময়ই আনন্দজনক ব্যাপার। তিতলীর আনন্দ হচ্ছে না। কারণ, তাকে বারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বারটার পর হাসানকে খুঁজে বের করতে হবে। এই দুঘণ্টা সময় কী করা যায়? কলেজ ক্যান্টিনে চা খাওয়া যায়। দশ মিনিট গেল সেখানে—তারপর? লাইব্রেরিতে যাবে? অসম্ভব। লাইব্রেরিতে গেলেই তার মাথা ধরে যায়। সঙ্গে কোনো গল্পের বই নেই। গল্পের বই থাকলে কোনো একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে। গল্পের বই পড়া যেত।
তিতলী ক্যান্টিনের দিকে এগোচ্ছে। ক্যান্টিনে কাউকে পেলে তাকে নিয়ে আড়ঙ-এ চলে যাওয়া যায়। আড়ঙ-এ শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।
এই তিতলী!
তিতলী তাকাল–নাসরিন হাত ইশারা করে ডাকছে। তার তোকানো এবং হাত ইশারার ভঙ্গি সবই রহস্যময়। নববর্ষে নাসরিন খেতাব পেয়েছে সপিণী। নাসরিন লম্বা ও ছিপছিপে। সপিণী নাম তার জন্যে মানানসই। মাছ, যেমন প্রতিবছর খোলস ছাড়ে নাসরিনও নাকি খোলস ছাড়ে। তবে তার জন্যে এক বছর অপেক্ষা করতে হয় না। পছন্দের কোনো মানুষ তাকে খোলস ছাড়তে বললেই নাকি সে ছাড়ে।
তিতলী অপ্ৰসন্নমুখে নাসরিনের দিকে এগিয়ে গেল। আশপাশে কেউ নেই। তবু নাসরিন গলা নামিয়ে বলল, তোর কাছে পঞ্চাশটা টাকা আছে? সহজ স্বাভাবিকভাবে সে কোনো কথাই বলতে পারে না। তার সবকিছুতেই খানিকটা রহস্য।
না।
তাহলে ভালো একটা জিনিস মিস করলি। আমার কাছে পাঁচটা ছবি আছে। একেকটা ছবি দেখতে দশ টাকা করে লাগবে।
কী ছবি?
কী ছবি বুঝতে পারছিস না? ওইসব ছবি—হুঁ হুঁ।
ওইসব ছবি দেখার আমার কোনো শখ নেই।
না দেখেই বলে ফেললি? ছবিগুলো সব টিভি স্টারদের। এদের কাণ্ডকারখানা দেখলে মাথায় হাত দিয়ে বসে যাবি।
আমার মাথায় হাত দিয়ে বসার দরকার নেই। তুই ছবি দেখিয়ে টাকা নিচ্ছিস আশ্চর্য তো!
টাকা না নিলে হবে? পাঁচটা ছবি আমাকে কি কেউ মাগনা দিয়েছে। নগদ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। গলাকাটা ছবি না। একজনের মুখ কেটে আকেজনের শরীরে বসানো না। জেনুইন ছবি।
বুঝলি কী করে জেনুইন ছবি?
যে দেখবে সেই বুঝবে জেনুইন ছবি। তুই দশ টাকা দিয়ে একটা ছবি দেখ। তারপর যদি তোর মনে হয় ছবি জেনুইন না, আমি টাকা ফেরত দেব।
কোনো দরকার নেই। ছবি দেখার পর তাদের নাটক দেখব। তখন শরীর ঘিনঘিন করবে।
আচ্ছা যা তোর টাকা লাগবে না। তোকে বিনা টাকায় দেখােব। আমাকে চা আর আলুর চাপ খাওয়া। দারুণ ক্ষিধে লেগেছে।
ক্যান্টিনে এখন ভিড় কম। টিফিন টাইমে বসার জায়গা থাকে না। আজ ফাঁকা ফাঁকা। সর্পিণী তিতলীকে নিয়ে কোণার দিকে একটা টেবিলে চলে গেল। কাধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে পাঁচটা ছবি বের করে তিতলীর হাতে দিল। ছবি হাতে নেবার পর তিতলীর সারা শরীর কাপতে লাগল। সে ছবিগুলোর দিকে তাকাতেও পারছে না। আবার চোখ সরিয়েও নিতে পারছে না। নাসরিন পা নাচাতে নাচাতে শিস দিচ্ছে। শিস দেয়া বন্ধ করে সে তিতলীর দিকে একটু ঝুকে এসে বলল, এই জাতীয় ছবি তুই আগে দেখিস নি?
না।
তোর দেখি শরীর কাঁপছে। ফোঁসফোঁসানি শুরু হয়ে গেছে। ছবিগুলো আমার কাছে দিয়ে নরমাল হ।
তিতলী ছবিগুলো দিয়ে দিল-নরম্যাল হওয়া বলতে যা বুঝায় তা হতে পারল না। এখনো তার হাতপা কাঁপছে। নাসরিন বলল, তোকে দেখে আমার ভয় লাগছে তুই বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি চায়ের অর্ডার দিচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে এসে চা খা।
আমি চা খাব না। বাসায় চলে যাব।
ন্যাকামি করিস না তো। তোর ন্যাকামি অসহ্য লাগছে। বাসায় চলে যাবে? তোর নায়ক বারটার সময় আসবে তখন কী হবে?
প্লিজ চুপ কর।
ছবিগুলো আরেকবার দেখবি?
না।
আচ্ছা তুই একটা কাজ কর একটা ছবি আমি তোকে দিয়ে দিচ্ছি। তুই নিয়ে যা।
কী আশ্চৰ্য কথা! আমি ছবি নিয়ে কী করব?
তোর নায়ককে দেখাবি। এইসব ছবি দুজনে মিলে দেখার মধ্যে অনেক মজা। পাঁচটার মধ্যে কোনটা নিবি?
কী অদ্ভুত কথা! আমি কোনোটা নেব না। এক কাজ করা পাঁচটাই নিয়ে যা। রাতে দরজা-টরজা বন্ধ করে আরাম করে দেখ। কাল নিয়ে আসিস। ক্যান্টিনে বসে টেনশনে এইসব ছবি দেখে কোনো মজা পাওয়া যায় না।
এই নিয়ে আর কোনো কথা বলবি না তো নাসরিন। আমি তোর কাছে হাতজোড় করছি।
তিতলী উঠে দাঁড়াল। নাসরিন বিস্মিত গলায় বলল, তুই যাচ্ছিস কোথায়? তোর না আমাকে চা আর আলুর চাপ খাওয়ানোর কথা।
বাথরুমে যাচ্ছি। হাতমুখ ধোব।
সামান্য ছবি দেখে এত গরম হয়েছিস যে শীতল জলে হাতমুখ ধুয়ে শরীর ঠাণ্ডা করতে হবে?
নাসরিন প্লিজ।
হাতমুখ ধুয়ে এসেও তিতলী ঠিক স্বাভাবিক হতে পারল না। মাথার ভেতরটা তার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নাসরিন চা আলুর চাপ খেল। তিতলীর কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে চলে গেল। তার নাকি আজ বাসায় ফেরার রিকশা ভাড়া নেই।
তিতলী ক্যান্টিনেই বসে আছে। তার সময় কাটছে না। এখন বাজছে মাত্র দশটা চল্লিশ। চিঠি লিখতে শুরু করলে হয়। তাহলে কিছুটা সময় কাটে। তিতলী খাতা বের করল। চিঠি লেখার জন্যে সে পাঁচশ পৃষ্ঠার একটা খাতা কিনেছে। না পাঁচ শ, পৃষ্ঠা না। সে গুনে দেখেছে চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠা। তিতলী ঠিক করেছে সে চারশ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখবে। যদি শেষ পর্যন্ত লিখতে পারে তাহলে তার চিঠিই হবে কোনো মেয়ের তার প্রেমিকের কাছে লেখা দীর্ঘতম প্রেমপত্র। মাত্র আঠার পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। সে একসঙ্গে বেশিক্ষণ লিখতে পারে না। তার শরীর বিমঝিম করতে থাকে। ছবিগুলো দেখার পর আজ যেমন হয়েছিল, অবিকল সে রকম হয়।
তিতলী ঠিক করে রেখেছে। চিঠি শেষ হবার পর হাসানকে সে খাতাটা দেবে তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে। কদিন ধরে অবশ্যি অন্যরকম একটা পরিকল্পনা মাথার ভেতর ঘুরছে। এই খাতাটা বাসর রাতে হাসানের হাতে দিলে কেমন হয়? হাসান বিক্ষিত হয়ে বলবে এই গাব্ববুস খাতাটা কীসের? সে বলবে–পড়ে দেখা। এটা একটা চিঠি, চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার চিঠি।
চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার চিঠি! বল কী তুমি! কী লিখেছ?
পড়ে দেখ। বাসর রাতে হাসান তার স্ত্রীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিঠি পড়বে তা মনে হয় না। শুকনা চিঠির চেয়ে রহস্যময়ী রমণী কি অনেক প্ৰিয় হবার কথা না?
তিতলী চিঠিটা লিখেছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। শুরু করেছে তাদের প্রথম দেখা হবার দিন থেকে। শুরুটা ভালোই। তিতলী খাতা বের করল। খাতার প্রথম পাতায় লেখা–বাংলা দ্বিতীয় পত্র। লালমাটিয়া কলেজ। যেন হঠাৎ কারো হাতে খাতাটা পড়লে সে কিছু বুঝতে না পারে। চিঠির শুরুতে কোনো সম্বোধনও নেই।
তোমার সঙ্গে আমার প্রথম করে দেখা হয়েছিল তোমার কি মনে আছে? আমি এক লক্ষ টাকা বাজি রাখতে পারি তোমার মনে নেই। আমার কিন্তু সব মনে আছে। এমনিতে আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ। কিছু মনে থাকে না। এস.এস.সি. পরীক্ষার আগে ইংরেজি রচনা মুখস্ত করেছিলাম–A Journey by boat. পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি এই রচনাটাই এসেছে। সবার আগে রচনা লিখতে বসলাম। দুটা লাইন লেখার পর সব ভুলে গেলাম। এই হলো আমার স্মৃতিশক্তির নমুনা। কিন্তু তোমার প্রতিটি ব্যাপার। আমার মনে আছে। উয়ারীতে আমরা পাশাপাশি ফ্লাটে থাকতাম সেটা অবশ্যই তোমার মনে আছে। আচ্ছা তোমার কি মনে আছে শবেবরাতের হালুয়া নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি তুমি নামছ? হঠাৎ কী হলো তুমি হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে আমার গায়ে পড়ে গেলে। তারপর দুজন গড়াতে গড়াতে একেবারে সিঁড়ির নিচে। পিরিচ ভেঙে তোমার ঠোঁট কেটে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগিল। সারা গা হালুয়া দিয়ে মাখামাখি। লজ্জায় তুমি মরে যাচ্ছিলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকানো তো অনেক পরের কথা। আমি সিঁড়ির নিচে পড়েই রইলাম, তুমি রক্ত এবং হালুয়ায় মাখমাখ অবস্থাতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালে এবং দৌড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেলে। এই ঘটনা তোমার অবশ্যই মনে আছে। যেমন–ওই দিন তোমার গায়ে ছিল হালকা সবুজ রঙের একটা ফুলশার্ট। শার্টে কালো স্টাইপ ছিল। ওইদিন যে তুমি দৌড়ে পালিয়ে গেলে বাসায় ফিরলে ঠিক রাত এগারটা পাঁচ মিনিটে। আমি তখন বারান্দায় বসে ছিলাম। বারান্দার বাতি নেভানো ছিল। যাতে তুমি আমাকে দেখতে না পাও৷ তুমি কখন ফের তা দেখার জন্যেই আমি বসেছিলাম। ওইদিন কত তারিখ ছিল তোমার মনে আছে? দুই লক্ষ টাকা বাজি তোমার মনে নেই। আমার মনে আছে-১২ তারিখ। কী বার মনে আছে? জানি মনে নেই–রোববার। এতসব খুঁটিয়ে কেন মনে রেখেছি? মেয়েদের স্বভাব হলো তুচ্ছ ব্যাপারগুলো মনে করে। রাখা / আমি তো সাধারণ একটা মেয়ে তাই না? শোনা ওইদিনটা ছিল আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। ওই দিনের কথা মনে হলেই তোমার লজ্জিত, ব্যথিত মুখের কথা আমার মনে হয়। ভয়ঙ্কর লজ্জায়। ওইদিন তোমার মাথা কাটী যাচ্ছিল। তোমার চোখ ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো পানিতে। তুমি জলভর্তি চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। তোমার ব্যথিত মুখ দেখে আমার কিশোরী হৃদয়ে এক ধরনের হাহাকার তৈরি হল। ইচ্ছে করল। তোমার হাত ধরে বলি–এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? অ্যাকসিডেন্ট হয় না? আমি অবশ্যই বলতাম। তুমি বলার সুযোগ দিলে না। দৌড়ে পালিয়ে গেলে…
তিতলী খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। মাত্র এগারোটা বাজে। এখন একবার কলেজের বাইরে গিয়ে খুঁজে দেখা যেতে পারে। হাসান যে কাঁটায় কাঁটায় বারোটার সময়ই আসবে তা তো না। বারোটার আগেই তার আসার কথা। হয়তো এগারটার সময় এসে নাপিতের দোকানে বসে মাথা বানাচ্ছে। নাপিত তার নোংরা হাতে হাসানের সুন্দর চুলগুলো ছানাছানি করছে। অসহ্য। অসহ্য।
তিতলী কলেজের গেটের বাইরে এসেই দেখে রাস্তার ওপাশে হাসান দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। হাতে চায়ের কাপ। ফুটপাতের দোকান থেকে চা কিনে বাবুর খুব আয়েশ করে চা পান করা হচ্ছে। কী অদ্ভুত মানুষ! সত্যি সত্যি এক ঘণ্টা আগে এসে বসে আছে। হাবলার মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তিতলী এক দৌড়ে রাস্তা পার হলো। আজ সে একটা কাণ্ড করবে চুপি চুপি হাসানের পেছনে দাঁড়িয়ে ‘হালুম করে একটা চিৎকার দেবে। এমন চিৎকার যেন হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়। বেচারাকে চায়ের কাপের দাম দিতে হবে। ভালো হবে। উচিত শিক্ষা হবে। এক ঘণ্টা আগে এসে বসে থাকার শিক্ষা।
তিতলী বলল, চিঠি এনেছ।।
হাসান হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল। তিতলী লক্ষ করেছে কলেজের আশপাশে হাসান তার সঙ্গে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে ইশরায় জবাব দেবার চেষ্টা করে। তিতলী বলল, কই চিঠি দাও।
দেব।
দেবটেব না, এখনই দাও।
হাসান অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাচ্ছে। তিতলীর খুব মজা লাগছে। এমন অস্বস্তি বোধ করার কী আছে? সে কি ভয়ঙ্কর কোনো পাপ করছে? এমন পাপ যে এক্ষুনি ফেরেশতারা এসে দোজখে ঢুকিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেবে।
কই চিঠি দিচ্ছে না কেন?
বললাম তো দেব। দাঁড়াও একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসি। বেবিট্যাক্সি না। বেবিট্যাক্সিতে ভটভটি শব্দ হয়, কোনো কথা শোনা যায় না। চল একটা রিকশা নিই। ওই রিকশাওয়ালাটাকে ডাক। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র। বারবার পেছনে ফিরে আমাদের দেখার চেষ্টা করবে না। আমাদের কথা শোনার চেষ্টাও করবে না।
হাসান একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে এল। তিতলী ভাব করল খুব বিরক্ত হচ্ছে, তবে সে বিরক্ত হয় নি। খুশি হয়েছে। বেবিট্যাক্সিতে চিঠি পড়তে পড়তে যাওয়া যায়। রিকশায় চিঠি পড়া যায় না। সবাই তাকিয়ে থাকে।
হাসান বলল, বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে খানিকক্ষণ ঘুরবে?
তিতলী বলল, ঘুরব। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। নৌকা ডুবলে তুমি টেনে তুলবে।
হাসান বলল, আমিও সাঁতার জানি না।
তিতলী খুশি খুশি গলায় বলল, তাহলে চল। নৌকা ডুবলে দুজন একসঙ্গে তলিয়ে যাব। একজন পানির নিচে আরেকজন বেঁচে আছি–তাহলে খারাপ হতো।
হাসান বলল, বুড়িগঙ্গায় ওইপারে। আমার স্কুলজীবনের এক বন্ধু থাকে। ধূপনগর। সে মাছের খামার করেছে সেখানে যাবে?
তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানে যাব। তুমি যদি আমাকে সস্তা কোনো হোটেলে নিয়ে যাও হোটেলের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও তাতেও আমার আপত্তি নেই।
এসব কী ধরনের কথা?
বাজে ধরনের কথা। আচ্ছা যাও আর বলব না। চল ধূপনগরে যাই। মাছের খামার দেখে আসি।
ধূপনগরে গেলে ফিরতে কিন্তু দেরি হবে। পাঁচটার আগে ফিরতে পারবে না। দেরি হলে অসুবিধা হবে না। বাবা দেশের বাড়িতে গেছেন। রাত আটটার ট্রেনে ফিরবেন। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে নটা। s
তোমার মা চিন্তা করবেন না?
মা তো সবসময়ই চিন্তা করছেন। একদিন না হয় একটু বেশি করলেন। কই চিঠি দাও।
হাসান চিঠি বের করল। বেবিট্যাক্সি চলছে। তিতলী হাসনের গা ঘেঁষে বসেছে। তার সমস্ত মনোযোগ চিঠিতে। চিঠির লেখক পাশে বসে আছে সেটা কোনো ব্যাপার না। হাসানের চিঠি তিতলী যেভাবে পড়ে আজ সেভাবে পড়তে পারল না। হাসানের সামনে তা সম্ভবও নয়। তিতলীর চিঠি পড়ার নিয়ম হচ্ছে–পড়ার আগে খানিকক্ষণ চিঠিটা সে গালে ছুঁইয়ে রাখবে। তারপর চিঠি পড়বে। চিঠি পড়তে পড়তে অবশ্যই তার চোখে পানি আসবে। চিঠি দিয়েই সে চোখের পানি মুছবে। চিঠি পড়তে গিয়ে চোখে যে জল এসেছে সেই জল চিঠিতেই জমা থাকুক।
তিতলী চিঠি শেষ করে নিচু গলায় বলল–তুমি লম্বা চিঠি লিখতে পার না? অনেকক্ষণ ধরে পড়া যায় এমন চিঠি? ক্লিপের মতো ছোট্ট কাগজ–কয়েকটা মাত্র লাইন–পড়ার আগেই চিঠি শেষ।
হাসান কিছু বলল না। তিতলী বলল, এ পর্যন্ত তুমি আমাকে কটা চিঠি লিখেছি বলতে পারবে?
না।
তবুও একটা অনুমান করা দেখি কাছাকাছি হয় কি না?
এক শ?
চুয়াত্তরটা। আজকেরটা নিয়ে চুয়াত্তর।
তুমি সব চিঠি জমা করে রাখ?
জমা করে রাখব না তো কী করব, পড়া শেষ হলেই কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দেব?
ফেলে দেয়াই তো ভালো–কখন কার হাতে পড়ে!
হাতে পড়লে পড়বে। আমার এত ভয়ডর নেই।
তোমাকে দেখে কিন্তু খুব সাহসী মনে হয় না। ভীরু টাইপের। লাজুক লাজুক একটা মেয়ে মনে হয়।
আমি আসলেই ভীরু এবং লাজুক লাজুক টাইপের মেয়ে। তারপরেও প্রয়োজনের সময় আমি খুব সাহসী।
এটা ভালো।
আমিও জানি এটা ভালো। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে। শবনম। খুব সাহসী। টিচারদের সঙ্গে টক টক করে তর্ক করে। রাজনীতি করে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের একবার একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল তখন শবনম সমানে পুলিশের দিকে ঢিল জুড়েছে। কিন্তু যখন সত্যিকার সাহস দেখানোর প্রয়োজন পড়ল তখন সে মিইয়ে গেল। কোনো সাহস দেখাতে পারল না।
প্ৰয়োজনটা কী?
সেটা তোমাকে বলব না। মেয়েদের অনেক ব্যাপার আছে—যা ছেলেদের জানা ঠিক না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। যদিও আমরা সবসময় বলি–একটা ছেলেও মানুষ, একটা মেয়েও মানুষ। তারা আলাদা কিছু না–আসলে কিন্তু অনেকখানিই আলাদা।
হাসান হাসল। তিতলীকে নিয়ে বাইরে বের হলেই সে হড়বড় করে ক্রমাগত কথা বলতে থাকে। সেসব কথা হাসান যে খুব মন দিয়ে শোনে—তা না। তবে একটা মেয়ে মনের আনন্দে কথা বলে যাচ্ছে—ব্যাপারটাই মজার।
তিতলীর কথা বলার মধ্যে আবার হাত নাড়ােনাড়িও আছে। মনে হবে তার শ্রোতা একজন না। সে আসলে একদল ছাত্রছাত্রীকে বোঝাচ্ছে।
একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের মধ্যে আসলে কোনো মিলই নেই। শরীরের অমিল খুব ক্ষুদ্র অমিল–আসল অমিল হলো মনে, মানসিকতায়। একটা ছেলের মানসিকতা এবং একটা মেয়ের মানসিকতা–আকাশ এবং পাতাল পার্থক্য। কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়ের মনের ভেতরটা একবার দেখতে পারত। তাহলে সে বড় ধরনের চমক খেত।
এত কিছু বুঝলে কী করে?
বোঝা যায়। চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। বাবাকে দেখে বুঝি, মাকে দেখে বুঝি, তোমাকে দেখে বুঝি, নিজেকে দেখে বুঝি।
আমাকে দেখে কী বোঝা?
তোমাকে দেখে বুঝি যে তোমার সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে। আমাদের বিয়ের পর কী হবে জান?
কী হবে?
তুমি তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকবে না–অফিসে যাবে। কাজকর্ম করবে। আমি ওই সময়টা সহ্য করতে পারব না। আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে যাবে। সেটা আবার তোমার খারাপ লাগবে। তুমি ভাববে। এ কী বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাম। আর আমি তখন বন্ধন তো আলগা করবই না আরো নতুন নতুন শিকলে তোমাকে জড়োনোর চেষ্টা করব।
ইন্টারেস্টিং।
আমি আরো অনেক ইন্টারেস্টিং কথা জানি। সেসব কথা বলছি না, জমিয়ে রাখছি–বিয়ের পর বলব।
তুমি যে এত সহজে বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আস অস্বস্তি লাগে না?
না অস্বস্তি লাগে না। উল্টোটা হয়–ভালো লাগে। বাসর রাতে তোমার সঙ্গে আমি কী নিয়ে গল্প করব। সব ঠিক করে রেখেছি।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। আমি সেই রাতে খুব মজার একটা ব্যাপার করব।
মজার ব্যাপারটা কী?
এখন বলব না। আগে বললে তো মজা থাকবে না। আচ্ছা শোন আমার ক্ষিধে লেগেছে। আজ বাসা থেকে নাশতা না খেয়ে কলেজে এসেছি।
নাশতা না খেয়ে এসেছে কেন?
মা ঢেলঢেলা একটা খিচুড়ি রান্না করেছে। মুখে দিয়ে বমি আসার মতো হয়েছে। এখন ক্ষিধেয় মারা যাচ্ছি। আচ্ছা শোন এতক্ষণ হয়ে গেছে তুমি সিগারেট খাচ্ছ না। ব্যাপারটা কী? সিগারেট ধরাও। বিয়ের আগ পর্যন্ত তোমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে কিছু বলব না। বিয়ের পর–নো সিগারেট।
বিয়ের পর নো কেন?
তোমার ওপর যে আমার অধিকার আছে এটা জাহির করার জন্যেই নো।
হাসান পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তিতলী তার ব্যাগ থেকে দেয়াশলাই বের করল। হাসানের সিগারেট ধরিয়ে দেবে। হাসানের সঙ্গে বাইরে বের হবার সময় তার ব্যাগে একটা দেয়াশলাই থাকে। সে ঠিক করে রেখেছে টাকা জমিয়ে জমিয়ে সে সুন্দর একটা লাইটার কিনবে। লাইটারটা থাকবে তার কাছে। শুধু যখন হাসান সিগারেট ঠোঁটে দেবে তিতলী ধরিয়ে দেবে।
আজ কয়েকটা অদ্ভুত ছবি দেখেছি।
অদ্ভুত ছবি মানে?
না থাক ছবির ব্যাপারটা থাক।
তুমি আজ এমন ছটফট করছ, কেন?
আর ছটফট করব না। আচ্ছা শোন তুমি আমার হাতটা ধরে বসে থাক না কেন? এমন দূরে সরে আছ কেন?
সদরঘাট পৌঁছে হাসান ছইওয়ালা একটা নৌকা তিন ঘণ্টার জন্যে ভাড়া করল। ঘণ্টায় পঞ্চাশ টাকা হিসেবে দেড় শ টাকা ভাড়া, পঞ্চাশ টাকা বিকশিশ। সব মিলিয়ে দুশ টাকা। হাসান তার বন্ধুর বাড়িতে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে। হুট করে একটা মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলে সে কী ভাববে কে জানে। হাসানের স্কুলজীবনের বন্ধুর সঙ্গে তার মাও থাকেন। তিনি প্রচীনপন্থী মহিলা। তার কাছে ব্যাপারটা নিশ্চিয়ই ভালো লাগেবে না। এরচে নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়ানো ভালো। হাসান দু প্যাকেট মোরগ পোলাও একবোতল পানি এবং চারটা মিষ্টি পান। কিনেছে। বাসা থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে এলে ফ্লাস্কে করে চা নেয়া যেত। ফ্লাঙ্ক আনা হয় নি। পরের বার অবশ্যই ফ্লাস্ক আনতে হবে।
নৌকা ছোটখাটো হলেও সুন্দর। পাটাতনে শীতলপাটি বিছানো। দুটা ফুলতোলা বালিশ আছে। নৌকার বালিশ তেল চিটাচিট হয়–এই দুটা বালিশ পরিষ্কার। তিতলী বলল–মাঝিভাই শুনুন, আমরা দুজনই কিন্তু সাঁতার জানি না। নৌকা সবসময় তীরের আশপাশে রাখবেন। মাঝনদীতে যাওয়া একদম নিষিদ্ধ।
মাঝি দাঁত বের করে বলল, কিছুই হইব না আফা। এক্কেবারে লিচ্ছিন্ত থাকেন।
আচ্ছা বেশ ‘লিচ্ছিন্ত’ থাকব। তারপরেও শুনে রাখুন। নৌকা যদি ডুবে যায়আপনি কিন্তু আমাদের দুজনের একজনকেও বাঁচাতে চেষ্টা করবেন না। ভয় পেয়ে তখন হয়তো আমরা দুজনই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করব। আপনি আমাদের বাঁচাবেন। না-নিজে সাঁতরে তীরে উঠে পড়বেন।
মাঝি দাঁত বের করে হাসছে। মেয়েটার পাগলামি ধরনের কথায় সে খুব মাজা পাচ্ছে।
বেবিট্যাক্সিতে তিতলী সারাক্ষণ কথা বলছিল। নৌকা ছাড়তেই সে একেবারে চুপ হয়ে গেল। পানির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। তার চোখও কেমন ছলছল করছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।
হাসান বলল, তিতলী খাবার গরম আছে, হাত ধুয়ে খেয়ে ফেল। ঠাণ্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
তুমি-না বলেছিলে ক্ষিধে লেগেছে।
একসময় লেগেছিল এখন ক্ষিধে নেই।
কী হয়েছে তিতলী?
কিছু হয় নি। মন খারাপ লাগছে।
মন খারাপ লাগছে কেন?
গান জানি না। এই জন্যে খুব মন খারাপ লাগছে। গান জানলে তোমাকে গান গেয়ে শোনাতাম। তোমার কত ভালো লাগত।
আমার যথেষ্টই ভালো লাগছে।
আমার গানের গলা কিন্তু ভালো। বাবার টাকা পয়সা নেই, গান শিখতে পারলাম না। একটা হরমোনিয়াম কিনে দেবার জন্যে মার কাছে বাবার কাছে কত কান্নাকাটি যে করেছি? বিয়ের পর তুমি কিন্তু আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবে। তোমার টাকা থাকুক বা না থাকুক।
অবশ্যই কিনে দেব। আমার প্রথম চাকরির বেতনের টাকায় কিনে দেব।
পানিতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা কর। ঠাট্টা না। সত্যি।
হাসান পানিতে হাত দিয়ে রাখল। তিতলী মেয়েটাকে মাঝে মাঝে তার অদ্ভুত লাগে। ঠিক বুঝতে পারে না। একটা মেয়ের ভেতরে আসলেই অনেকগুলো মেয়ে বাস করে।
আমি গান জানলে তোমাকে কোন গানটা গেয়ে শুনাতম জান?
না—কোনটা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
তিতলীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
কী হয়েছে তিতলী?
কিছু হয় নি।
কাঁদছ কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। হঠাৎ খুব মনটা খারাপ লাগছে।
মন খারাপ লাগছে কেন?
জানি না কেন? জানলে তোমাকে জানতাম।
বাসায় চলে যাবে?
হুঁ।
বেশ তো চল যাই।
তিতলী চারটার আগেই বাসায় পৌঁছে গেল এবং রাত আটটায় তার বিয়ে হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজির এক লেকচারের সঙ্গে। ছেলের মামারা বললেন–অনুষ্ঠান পরে হবে, আকদ হয়ে যাক। আজকের দিনটা খুব শুভ। ছেলের দাদি খুবই অসুস্থ। পিজিতে ভর্তি হয়েছেন। যে-কোনো সময় মারা যাবেন। মৃত্যুর আগে নাতবউয়ের মুখ দেখে যেতে চান।
কীভাবে কী ঘটল তিতলী নিজেও জানে না। তিতলীর শুধু মনে আছে তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন–তুই আপত্তি করিস না মা। আমি দরিদ্র মানুষ–এমন ভালো ছেলে তোর জন্যে আমি যোগাড় করতে পারব না। তোর কী সমস্যা আমি কিছু শুনতে চাই না। মা রে তুই আমার প্রতি দয়া কর। তুই রাজি না হলে আমি বিষ খাব রে মা। সত্যি বিষ খাব। তোর মারি নামে আমি কসম কেটে বলছি বিষ খাব। তিতলী তার বাবাকে কোনোদিন কান্দতে দেখে নি–সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। সে তাকাল তার মার দিকে। ফিসফিস করে বলল, মা আমি কী করব? সুরাইয়া জবাব দিলেন না। তিনিও কাঁদছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। নাদিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তিতলী নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, নাদিয়া আমি কী করব?
নাদিয়া বলল, আপা তুমি একজনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ। প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ কোরো না।
কিন্তু বাবা কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন। বাবাকে তিতলী কখনো কাঁদতে দেখে নি।
পিজি হাসপাতালের আঠার নম্বর কেবিনে তিতলী দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে সুন্দর চেহারার একটি যুবক। যুবকের মুখ হাসি হাসি। এই যুবকটি তার স্বামী। তার নাম যেন কী? আশ্চর্য নামটা মনে পড়ছে না।
বৃদ্ধ এক মহিলা আধবোজা চোখে তাকিয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। কাঠির মতো সরু সরু হাত। হাতের নীল রগ বের হয়ে আছে। ভদ্রমহিলার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে।
খুব গয়না-টয়না পরা এক মহিলা তিতলীকে বললেন, তোমার দাদিশাশুড়ি, সালাম কর।
তিতলী নড়ল না। বৃদ্ধা অস্পষ্ট জড়ানো স্বরে কী যেন বললেন। তিতলী সেই কথার কিছু বুঝতে না পারলেও অন্যরা বুঝল। বৃদ্ধার বালিশের নিচ থেকে গয়নার বাক্স বের করে আনল। বাক্স খুলে গয়না বের করে বৃদ্ধার হাতে দেয়া হলো। বৃদ্ধ তিতলীর দিকে চোখের ইশারা করলেন। গয়নাটা নিতে বললেন। পুরনো দিনের পাথর বসানো হার। বেদানার দানার মতো লাল লাল পাথর–।
তিতলীর মনে হচ্ছে লাল পাথরগুলো যেন চোখ। যেন বৃদ্ধার হাতের হারটা অনেকগুলো লাল চোখে তিতলীকে দেখছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটা হাসছে। এই যুবক তার স্বামী। তার নাম তিতলীর মনে পড়ছে না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না।
গানটার সুর যেন কী? আচ্ছা এই বৃদ্ধার কী হয়েছে? ক্যানসার?
খুবই বেদনাদায়ক একটা মুহুর্ত