১০. সোমনাথ মনস্থির করে ফেলেছে

সোমনাথ মনস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু বাড়ির লোকেরা বুঝতে পারেনি। সেদিন সকালে বেরোবার সময় বউদি আবার সোমনাথকে মনে করিয়ে দিলেন, “বাবা বলছিলেন, আজ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড রিনিউ করবার দিন।”

সোমনাথের যে এ-বিষয়ে আগ্রহ নেই তা বউদি বুঝলেন—তাই বললেন, “বাবা বলছিলেন আজ, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড না থাকলে অনেক অফিসে কথাই শুনবে না।”

সোমনাথ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে সকালটা কাটালো। ওখান থেকে বেরুবার সময়ে বিশুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।

বিশুবাবুর সঙ্গে ফুটবল খেলার মাঠে আলাপ। সুকুমারই বিশুবাবুর সঙ্গে প্রথম ভাব জমিয়েছিল। ভদ্রলোক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বিশ্বস্ত ভক্ত। বিশুবাবু বিজনেস করেন, এ-খবরও খেলার মাঠে অনেকবার শুনেছে সোমনাথ।।

বিশুবাবুর কালো আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রং। মাথার চুলগুলো কপালের দিক থেকে পাতলা হতে আরম্ভ করেছে। তার ফলে কপালটা চওড়া মনে হয়। মধ্যপ্রদেশেও ঈষৎ মেদ জমতে শুরু করেছে বিশুবাবুর। বয়স চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে।

হাতে একটা ফোলিও ব্যাগ নিয়ে বিশুবাবু রাস্তার হিন্দুস্থানী দোকান থেকে বাংলা পান কিনছিলেন। সোমনাথকে দেখে বিশুবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “কী মোহনবাগান? খবর কী?

সোমনাথের মতামত না নিয়েই বিশুবাবু আর একটা পানের অর্ডার দিলেন। পান নিতে সোমনাথ একটু ইতস্তত করছিল। বিশুবাবু বকুনি লাগালেন। “এটা জেনে রাখবে পানের কোনো সময় নেই। যে-কোনো সময় যতগুলো ইচ্ছে চিবোতে পারো—শুধু ওই লাল মসলাগলো খেয়ো না।”

পানওয়ালার কাছে নিজের গণ্ডিমোহিনী বিশুবাবু আলাদাভাবে চেয়ে নিলেন। তারপরে বললেন, “মোহনবাগানের কতগুলো অপয়া ছেলে কালকে ইস্টবেঙ্গল-স্পোর্টিং ইউনিয়নের খেলা দেখতে এসেছিল। উদ্দেশ্য ইস্টবেঙ্গলের একটা পয়েন্ট খাওয়া, দিস, ইজ ব্যাড।” মতামত দিলেন বিশুবাবু। তোমার ক্লাবকে তোমার সাপোর্ট করবার রাইট আছে, কিন্তু গায়ে-পড়া অপয়া ছেলেকে অন্য ক্লাবের সাপোর্টে পাঠিয়ে তাদের পয়েন্ট খাওয়া মোটেই স্পোর্টসম্যান-লাইক নয়।”

অন্য সময় হলে ফিক করে হেসে ফেলতে সোমনাথ। এমনকি বিশবার সঙ্গে তক করে বলতো শত্রকে হারাবার জন্যে কোনো চেষ্টাই অন্যায় নয়। সত্যি কথা বলতে কি, সুকুমারের প্ররোচনায় সোমনাথ একবার ইস্টবেঙ্গলের পয়েন্ট খেয়ে এসেছে। আজকে এসব প্রসঙ্গের অবতারণা করবার মতো মনের অবস্থা নেই সোমনাথের।।

পান চিবোতে চিবোতে বিশদ জানতে চাইলেন, “হোয়ার ইজ ইওর ফ্রেন্ড সুকুমার?”

সুকুমার গোল্লায় যেতে বসেছে। আজ সকালেও বাসস্ট্যান্ডের কাছে সুকুমারকে দেখতে পেয়েছে সোমনাথ। এক ভদ্রলোককে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করছে, পৃথিবীর ওজন কত?

সোমনাথ চটে না-এলে ভদ্রলোক হয়তো বেচারা সুকুমারকে মেরে বসতেন। মারের হাত থেকে বেঁচে সুকুমার বললো, “দেখছিস তো, কোনো লোক জেনারেল নলেজে হেল্প করতে চায় না। আমার চাকরি হলে তোমার কি ক্ষতি বাবা?” কোনোরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সোমনাথ ওকে যাদবপরের বাসে তুলে দিয়েছিল। কন্ডাকটরের হাতে বাসের ভাড়া দিয়ে বলেছিল লেখা স্টপেজের পরেই নামিয়ে দিতে।

বিশুবাবুর কাছে সোমনাথ এসব কিছুই বললো না। “তোমার খবর কী?” বিশুবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

সঙ্কোচ কাটিয়ে সোমনাথ এবার জিজ্ঞেস করলো, “বিশুদা, যাদের চাকরি-বাকরি হয় না তাদের কী করা উচিত?”

পানের পিচটা হজম করে নিয়ে জাঁদরেল বিশুদা বললেন, “ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সামনে যা পাওয়া যায় তাই পাকড়ে ধরতে হয়।” একটু ভেবে একগাল হেসে বিশুদা বললেন, “এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লাইন মেরে বিরক্তি ধরে গিয়েছে বুঝি? বোম কালী কলকাত্তাওয়ালী বলে ঝাঁপিয়ে পড়ো!”

“কোথায় ঝাঁপাবো?” সোমনাথ একটু ঘাবড়ে যায়।

“ঘাবড়াবার কিছুই নেই,” বিশুদা সোমনাথের পিঠে এক আলতো চাপড় লাগালেন। “চলো আমার সঙ্গে।

বিশুবাবুর সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করলো সোমনাথ। জি পি ও, রাইটার্স বিল্ডিংস এবং লালবাজার পেরিয়ে ওরা দুজনে এবার চিৎপুর রোডে পড়লো। আরও একটু এগিয়ে ডানদিকে পোন্দার কোর্ট। তারপরে বাগড়ি মারকেট। বিশুবাবু বললেন, “ব্যাটাছেলের কোনো ইচ্ছে হলে সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়তে হয়।”

সোমনাথ বললো, “আচ্ছা বিশুদা, বিজনেস করতে হলে কত টাকা লাগে?”

বিশুদা হেসে ফেললেন। বললেন, “হোল বিজনেস লাইফে এমন ডিফিকাল্ট কোশ্চেন আমাকে কেউ করেনি। এর উত্তর হলো—দশ পয়সা থেকে দশ কোটি টাকা। ঐ যে কলাওয়ালা দেখছো ওর দু টাকাও পজি নেই। আর সামনে পোন্দার কোর্ট দেখছো, বুঝতেই পারছো কত টাকা খরচ হয়েছে বাড়িটা করতে। টাটা-বিড়লাদের টাকার যদি হিসেব চাও তাহলে মাথায় হাত দিয়ে বসবে। ওদের কোম্পানিগুলোর ব্যালান্সসীট থেকে ফিগার বার করে যোগ দিতে গেলে স্রেফ হেদিয়ে যাবে।”

“টাকা না-হলেও বিজনেস হতে পারে?” সোমনাথ একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো।

“আলবৎ হয়! এই যে কলকাতার সব লক্ষপতি, কোটিপতি গোয়েঙ্কা, জালান, থাপার, কানোরিয়া, বাজোরিয়া, সিংহানিয়া দেখছো এরা সব কি রাজস্থান, হরিয়ানা থেকে লাখ লাখ টাকা পকেটে নিয়ে কলকাতায় বিজনেস করতে এসেছিল? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, মূলধন বলতে অনেকেরই আদিতে রয়েছে ওয়ান লোটা এবং ওয়ান কম্বল।”

বিশুদা বললেন, “অন্য লোক কেন? আমার নিজেরই কেস দ্যাখো না। পার্টিশনের সময় যশোর থেকে চলে এসেছিলাম। ক্যাপিটাল বলতে পৈতৃক এই গতরটি। বিদ্যেরও জাহাজটি টি এম পি অর্থাৎ কিনা টেনে-টুনে-ম্যাট্রিক পর্যন্ত। কলকাতায় হাইকোর্ট বিল্ডিং ছাড়া কিছুই চিনি না। ওই বাড়িটা নেহাত প্রত্যেক বাঙালকেই তখন চিনতে হতো, ঘটিরা প্রথম চান্সেই বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিতো। এই শহরে কে তখন আমাকে চাকরি দেবে! তাই জয়-মা-কালী কলকাত্তাওয়ালী বলে ব্যবসায় লেগে গেলম। তারপর কোয়ার্টার-অফ-এ সেঞ্চরি তো ম্যানেজ হয়ে গেলো।”

বিশুদা এরপর সোমনাথকে কানোরিয়া কোর্টে তাঁর অফিসে নিয়ে গেলেন। বললেন, এ আর-এক অজানা জগৎ, বুঝলে ব্রাদার। সত্তর-আশিখানা ঘর আছে এই বাড়িতে। আবার প্রত্যেক ঘরে যে কতগুলো করে কোম্পানি আছে তা ভগবানই জানেন। পনেরো বছর আগে তখন আমার রমরমা অবস্থা চলছিল, সেই সময় ছ’তলার বাহাত্তর নম্বর ঘরখানা বাড়িওয়ালার দরোয়ানকে আড়াই হাজার টাকা সেলামী দিয়ে ম্যানেজ করেছিলাম। এখনও চালাচ্ছি সেই অফিস থেকে।

এই বাড়িতে একটা প্রাগৈতিহাসিক লিফট আছে। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। বিশুদা বললেন, “সর্বদাই ভিড় লেগে রয়েছে। আগে দিনকাল ভালো ছিল। মাসে পাঁচ টাকা বকশিশ পেলে লিফটম্যান সুন্দরলাল প্রেফারেন্স দিয়ে নিয়ে যেতে। বলতো মালিকের অদমী। এখন সে-উপায় নেই। বাবু থেকে আরম্ভ করে বেয়ারা পর্যন্ত সবাই আপত্তি তোলে। সুতরাং লাইনে দাঁড়াতে হয়। অনেক সময় লেগে যায়।”

সোমনাথ অবাক হয়ে শুনছিল বিশুদার কথা। বিশুবাবু বললেন, “জানো ব্রাদার, বিজনেসম্যান হলেই সোজা পথে কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করবার জন্যে ছটফটানি লেগে থাকে! হয় লাইন ভেঙে এগিয়ে যাবো, দু-চার পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করবো—আর তা যদি সম্ভব না হয় সিড়ি বেয়েই উঠবো।”

এরপর সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন বিশুদা। সোমনাথের আপত্তি নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে ছ’তলায় উঠে বিশুবাবু বললেন, “বুঝতে পারছি বয়স হচ্ছে এখন ছ’তলায় উঠতেই কষ্ট হয়। তোমাদের আর কি ইয়ংম্যান–কেমন তরতর করে উঠে এলে।”

ছ’তলাটাও একটা ছোটোখাটো পাড়ার মতো। অসংখ্য সর, গলি এদিক-ওদিক চলে গিয়েছে। সোমনাথ বললো, “এর মধ্যে লোকে নিজেদের অফিস খুঁজে পায় কী করে?”

বিশুবাবু হেসে উত্তর দিলেন, “প্রথম প্রথম আমারও তাই মনে হতো। নিজের অফিসই খুঁজে পেতাম না। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলো।”

বাহাত্তর নম্বর ঘরের সামনে এসে বিশুবাবু বললেন, “এই আমার অফিস।”

বিশুবাবু আরও যা বললেন তার থেকে জানা গেলো অফিসটা একসময় পুরোপুরি বিশুবাবুর ছিল। এখন তিনি অনেককে সাবলেট করেছেন। এই ঘরখানার মধ্যেই গোটা কুড়ি কোম্পানি চালু রয়েছে। এরা কিছু কিছু, ভাড়া দেয় বিশুদাকে। তার থেকে বাড়িওয়ালার পাওনা চুকিয়েও বিশুবাবুর সামান্য লাভ থেকে যায়।

বিশুবাবু বলছেন এতোগুলো অফিস। কিন্তু ঘরে লোকজন তেমন দেখা গেলো না। গোটা দশেক টেবিল অবশ্য রয়েছে। বিশুবাবু হাসলেন। বললেন, “প্রত্যেক টেবিলে দুখানা করে কোম্পানি। এক কোম্পানি এধারে এবং আরেক কোম্পানি ওধারে। অফিসে বসে থাকলে তো পেট চলবে না। মালিকরা সবাই বাজারে মাছ ধরতে বেরিয়েছেন।”

বিশুবাবুর ওখানেই আর একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। বিশুবাবু বললেন, “ইনিই আমাদের কমান্ডার-ইন-চীফ ফকিরচন্দ্র সেনাপতি। নামে সেনাপতি কাজেও সেনাপতি। আমার সঙ্গে লাস্ট বাইশ বছর আছে। বাবা সেনাপতি, সোমনাথবাবু নতুন এলেন, একটু চা খাওয়াবি নাকি?”

কসেনাপতি এতোক্ষণ পিটপিট কবে সোমনাথের দিকে তাকাচ্ছিল। সে ময়লা একটা ধুতি পরেছে, তার ওপর ঘরে-কাচা পরিষ্কার কিন্তু ইস্তিরিবিহীন খাকি কোট। সেনাপতির ঠোঁট লাল, দাঁতে পানের ছোপ। ফকিরচন্দ্র কেটলি হাতে নিয়ে বিশুবাবুর দিকে ইঙ্গিত করে কী যেন জানতে চাইলো।।

বিশুবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “ও-হরি ভুলেই গিয়েছিলুম। তিন নম্বর চা নিয়ে আয়।”

সেনাপতি চলে যেতেই বিশুবাবু বললেন, “এই নম্বরের ব্যাপারটা বুঝলে না নিশ্চয়। তিন নম্বর হলো ভালো চা উইথ ওমলেট অ্যান্ড টোস্ট। দু নম্বর হলো ভালো চা উইথ বিস্কুট। এবং এক নম্বর হলো স্রেফ অর্ডিনারি চা। যে-কোনো ভদ্র জায়গায় হলে অর্ডিনারি চায়ের নম্বর হতো তিন। কিন্তু এটা বিজনেসের জায়গা। কাস্টমার বা গেস্ট কিছুই বুঝতে পারবে না—ভাববে মিস্টার বোস এক নম্বর কায়দাতেই আপ্যায়ন করছেন।”

ফকির সেনাপতি চা ও খাবার নিয়ে আসতেই বিশুবাবু বললেন, “এই শ্ৰীমানকেই দেখো। আগে যেখানে কাজ করতো সেখানে সবাই ফকির বলে ডাকতো। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগলো না। বিজনেসে আমরা কেউ ফকির হতে আসিনি। এখানে সব সময় ঐ অপয়া ডাক মোটেই ভালো লাগলো না। তখন থেকে শ্রীমানকে সেনাপতি করে দিলাম।”

লাজুক-লাজুক মুখভঙ্গিতে ফকিরচন্দ্র ফিক করে হাসলো। বিশুবাবু বললেন, “শ্রীমানের গণের শেষ নেই। সব ক্রমশ জানতে পারবে। মিঃ সেনাপতি এই ঘরে রাত্রে থাকেন এবং এই অফিসের দণ্ডমুণ্ডের কত।”

ফকির সেনাপতি আবার ফিক করে হাসলো।

বিশুবাবু এবার সোমনাথকে বললেন, “তোমার যদি ইচ্ছে হয় বিজনেসে লেগে যাও। আমার ঘরটা তো রয়েছে। ছ’নম্বর টেবিলের এগারো নম্বর সীট খালি পড়ে আছে। নোপানি নামে এক ছোকরা ভাড়া নিয়েছিল। মাস তিনেক তার কোনো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। খবর নেবার জন্যে নোপানির বাড়িতে সেনাপতিকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকেও শ্রীমান কেটে পড়েছেন। সুতরাং তুমি ইচ্ছে করলে শনা চেয়ারে বসে পড়তে পারো।”

বিশুবাবু বললেন, “আমার খুব ইচ্ছে বাঙালীরা বিজনেস লাইনে আসুক। কিন্তু আসে কই? তুমি যদি সাহস দেখাতে পারো খুব খুশী হবো। তিনটে মাস ট্রাই করে দ্যাখো না? ওই তিন মাস আমি ভাড়া চার্জ করবো না। কিন্তু তারপর আশি টাকা করে নেবো। আশি টাকা ড্যাম চিপ বলতে পারো। এর মধ্যে বাড়ি ভাড়া, ফার্নিচার ভাড়া, সেনাপতির সার্ভিস এবং আলো-পাখার সব খরচ থাকবে। বাইরে থেকে কল এলে টেলিফোনও ফ্রি। শুধু এখান থেকে ফোন করলে কল পিছ, চল্লিশ পয়সা চার্জ। সঙ্গে সঙ্গে পয়সা দিতে হবে না, সেনাপতি খাতায় লিখে নেবে। টেলিফোনে চাবি মারা থাকে-সেনাপতিকে বললেই খুলে দেবে।”

সোমনাথ একটু ভরসা পাচ্ছে। চাকরি পাবার ইচ্ছেটা যদিও পুরোপুরি মন থেকে মুছে যাচ্ছে না, তবু সে ভাবছে ব্যবসা জিনিসটা মন্দ কি?

বিশুবাবু বললেন, “বসে থেকো না ব্রাদার। বসে থাকলেই মরচে পড়ে। বিবেকানন্দ স্বামী বলতেন, মরচে পড়ে পড়ে খতম হওয়ার থেকে ঘষে ঘষে শেষ হয়ে যাওয়া শতগুণে ভালো।”

ঘড়ির দিকে তাকালেন বিশুবাবু। বললেন, “আজ আমার বাজারে একটু কাজ আছে। তুমি যদি কালকে এখানে মুখ দেখাও তাহলে বুঝবো বিজনেসে ইচ্ছে আছে। না হলে যেমন মাঠে দেখা হচ্ছে তেমন হবে।”

 

কানোরিয়া কোর্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডালহৌসি স্কোয়ারে এসেছে সোমনাথ। পথের দুধারে অনেক লোককে দেখে সে একটু ভরসা পাচ্ছে। এরা সবাই তো চাকরি করে না, কিন্তু মোটামটি খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। তাহলে সোমনাথের একবার চেষ্টা করে দেখতে আপত্তি কি?

পাঁচ নম্বর বাসে বসেও সোমনাথ ভেবেছে। ওর মনে পড়ে গেলো, কিছুদিন আগে কমলা বউদিকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে শ্রীরামপুর গিয়েছিল। ফেরবার পথে ইলেকট্রিক ট্রেনে এক ছোকরা চিল্কার করে ভারি মজার কথা বলেছিল : “আমার নাম নিশীথ রায়। বয়স তেইশ। পড়াশোনা স্কুল ফাইনাল। আমি নিজের চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে নিজে সই করেছি অ্যাজ ম্যানেজিং ডিরেকটর। আমার কর্মচারি হিসেবে আমার মাইনে ঠিক করি। গত মাসে দিয়েছি ছিয়াশি টাকা। নিশীথ রায় যদি খাটতে পারে তাহলে তাকে ঠকাবো না। দেড়শ-দশ-আড়াইশ পর্যন্ত মাইনে করে দেবো।” এরপর ছোকরা পকেট থেকে কিছু, ফাউনটেনপেন বার করেছিল বিক্রির জন্যে।

বাড়ি ফিরে এসে চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়লো সোমনাথ। কমলা বউদি চা নিয়ে এলেন। বললেন, “বাবা চিতা করছিলেন। নিশ্চয় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে বিরাট লাইন পড়েছিল?”

“না, ওখানে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে কাজ শেষ,” সোমনাথ বললো।

কমলা বউদি খবরের কাগজ থেকে দখনা কাটিং দিলেন, “বাবা আজ কেটে রেখেছেন।” কাটিং দুটো সোমনাথ হাতে নিলো, কিন্তু তাকিয়েও দেখলো না।

বউদি জিজ্ঞেস করলেন, “রোদে ঘুরেছো নাকি? মুখ শুকিয়ে গেছে।” দেওরের জন্যে বউদির যে খুব মায়া হচ্ছে তা যে-কেউ বলে দিতে পারে।

সোমনাথ বউদির মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।

বউদি বললেন, “দুপুরে সুকুমার এসেছিল। তোমার জন্যে দুখানা জেনারেল নলেজের কোশ্চেন রেখে গেছে, সঙ্গে চিঠি। বলেছে যেখান থেকে পারো উত্তর যোগাড় করে রাখবে।”

সুকুমারের ইংরেজী চিঠিটা পড়লো সোমনাথ। সুকুমার অত্যন্ত জরুরীভাবে জানতে চেয়েছে, সমুদ্রের জল কেন লোনা? এবং ফরাসী বিপ্লবের সময় কোন নেতা স্নানের টবে খুন হয়েছিলেন।

বউদি বললেন, “বেচারা। ওর কী হয়েছে বলো তো? আমাকেও একটা কোশ্চেন জিজ্ঞেস করলো। বললো, আমাকে উত্তর যোগাড় করে দিতেই হবে।”

বেশ উদ্বিগ্নভাবে সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “কী প্রশ্ন?”

কমলা বউদি বললেন, “সুকুমার জিজ্ঞেস করলো, দশরথের চার পুত্র রাম, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্নোর নাম সবাই জানে, কিন্তু তাঁর মেয়ের নাম কী?”

“আপনাকে এভাবে জ্বালাতন করার মানে?” সোমনাথ একটু চিন্তিত হয়ে উঠলো।

কমলা বউদি বললেন, উত্তরটা আমার জানা ছিল, মায়ের কাছে শুনেছিলাম, রামচন্দ্রের বোনের নাম শান্তা। সেই শুনে খুব খুশী হলো সুকুমার। বললো, আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দেবো।”

বদ্ধ পাগল হয়ে উঠেছে সুকুমারটা। কিন্তু কী করতে পারে সোমনাথ? আপনি পায় খেতে আবার শঙ্করাকে ডাকে।

সোমনাথ বললো, “আপনাকে তাহলে খুব জ্বালিয়ে গেছে।’

বউদি চুপ করে রইলেন। কারুর সমালোচনা করা তাঁর স্বভাব নয়। সোমনাথ বললো, “আমি কিন্তু পাগল হচ্ছি না, বউদি।”

“বালাই-ষাট। তুমি কোন দুঃখে পাগল হতে যাবে? মা নিজে বলে গেছেন, তোমার ভাগ্য খুব ভালো।”

“কবে কে একজন কী বলে গেছে, তা আপনি বিশ্বাস করেন বউদি?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“কেন করবে না। মায়ের কোনো কথা তো মিথ্যে হয়নি,” বউদি বললেন।

বউদির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সোমনাথ। তারপর গভীর কৃতজ্ঞতায় বললো, “আমি যদি শরৎ চাটুজ্যে হতাম তাহলে আপনাকে নিয়ে মস্ত একখানা নবেল লিখতাম।”

“থাক! আগে তবু বউদির জন্যে দু-একটা কবিতা লিখতে—এখন তাও বন্ধ করে দিয়েছো!” বউদি দেওরকে বকুনি লাগালেন। বাবা ডাকছেন। কমলা বউদি এবার ওপরে গেলেন।

এ-বাড়িতে কমলা বউদিই একমাত্র সোমনাথকে অ্যাডমায়ার করতেন। মা তখনো বেচে। অঙ্কের খাতায় সোমনাথ একটা কবিতা লিখেছিল। তার জন্যে মায়ের কি বকুনি। “অঙ্কের খাতায় কবিতা লিখে তুমি রবিঠাকুর হবে?”।

বউদি কিন্তু ছোট দেওরকে তুচ্ছ করেননি। গোপনে দাদাকে দিয়ে অক্সফোর্ডের দোকান থেকে নরম চামড়ায় মোড়া কালো রংয়ের একটা সুন্দর খাতা কিনে আনিয়েছিলেন। তার প্রথম পাতায় নিজের হাতে লিখেছিলেন একজন তরণ কবিকে—তার বউদি, খাতাটা হাতে দিয়ে সোমনাথকে বউদি অবাক করে দিয়েছিলেন। বউদি বলেছিলেন, “কবিতা আমার খুব  ভালো লাগে, ঠাকুরপো। যত তাড়াতাড়ি পারো ভরিয়ে ফেলবে, তারপর আবার খাতা দেবো।”

সোমনাথের দুঃখ, কমলা বউদি অপাত্রে আস্থা স্থাপন করেছিলেন এবং আজও অপাত্রে নিজের ভালোবাসা অপচয় করে চলেছেন।

ছোটবেলায় সেই খাতাটা সোমনাথ দ্রুত বোঝাই করে ফেলেছিল। অনেকগুলো কবিতা লিখেছিল সোমনাথ। দুপুর বেলায় সবাই যখন শুয়ে পড়তো তখন বউদির সাথে সোমনাথের কাব্য আলোচনা চলতো। সোমনাথ বলতো, “স্কুলে দু-একটা কবিতা শুনিয়েছি বউদি। কিন্তু মাস্টারমশাই বললেন কিসস, হয়নি।” বউদি দমতেন না——”বলক গে যাক। তোমার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। লিখতে লিখতে তোমার কবিতা নিশ্চয় আরও ভালো হবে। তখন দেশের সবাই তোমার নাম করবে।”

খাতাটা যত্ন করে রাখতে বলেছিলেন বউদি। বউদি কোথায় শুনেছিলেন, কবিদের প্রথম কবিতার খাতা পরে অনেক দামে বিক্রি হয়।

সোমনাথ কিছু বলেনি। কিন্তু খাতার এক কোণে তার অলিখিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গটা লিখে রেখেছিল। যদি কখনও বই ছাপা হয়, তাহলে প্রথমেই লেখা থাকবে—যিনি আমাকে কবি বলে প্রথম স্বীকার করেছেন তাঁকে।

বউদি বলেছিলেন, “এর মানেটা সন্দেহজনক। কারণ মোক্ষদাও হতে পারে। তুমি যখনই মোক্ষদাকে কবিতা শুনিয়েছে সে শুনেছে। ঐতিহাসিকরা প্রমাণ করে দেবে তখন এ-বাড়িতে আমার বিয়ে হয়নি।”

সোমনাথ হেসেছিল। বলেছিল, “ঐতিহাসিকদের কে পাত্তা দিচ্ছে? নিজের জীবনস্মৃতিতে সমস্ত গোপন কথা ফাঁস করে দেবো, মোক্ষদার স্বীকৃতির পিছনে রীতিমতো লোভ ছিল। দ-আনা পয়সার পান-দোক্তা প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি না পেলে সে কিছুতেই কবিতা শুনতে বসতো না। অথচ বৌদির স্বীকৃতিতে কোনো স্বার্থ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কাব্যলক্ষ্মী এবং সোমনাথের কাব্যকমলা।”

বউদি তখনও ছোট্ট মেয়ের মতো সরল ছিলেন। জিনিসটাকে রসিকতা ভেবে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি। আন্তরিক বিশ্বাস ছিল দেওরটির ওপর। বলেছিলেন, “তুমি বিখ্যাত কবি হলে গ্র্যান্ড হয়। কবি, সোমনাথের সঙ্গে আমারও নাম হয়ে যাবে।”

কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময়েও কবিতা লিখেছে সোমনাথ। কবিতার নেশা না থাকলে সে হয়তো পরীক্ষায় ভালো করতে পারতো। কারণ ইনটেলিজেন্সের কোনো অভাব ছিল না সোমনাথের। কলেজে ঢুকেও অজস্র কবিতা লিখেছে সোমনাথ। বেশ কয়েকটা খাতা কখন যে কবিতায় বোঝাই হয়ে উঠেছে তা সোমনাথ নিজেই বুঝতে পারেনি।

কিন্তু কলেজ থেকে বেরিয়ে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের খাতায় নাম লেখানো মাত্রই কবিতার ধারা অকস্মাৎ শুকিয়ে গেলো। সোমনাথ আর খাতা-কলম নিয়ে বসে না। বউদি কতবার অভিযোগ করেছেন, কিন্তু সোমনাথ লিখতে পারে না। বেকার সোমনাথের জীবন থেকে কাব্যলক্ষ্মী বিদায় নিয়েছেন। যে বেকার এ-সংসারে তার কিছুই মানায় না।

কেন এমন হলো, সোমনাথ ভেবেছে। যেসব মানুষের আত্মপ্রত্যয় থাকে সোমনাথ তাদের দলে নয়। যতটকু আত্মবিশ্বাস ছিল, হাজারখানেক চাকরির চিঠি লিখে তা উধাও হয়েছে। যে-মানুষের আত্মবিশ্বাস নেই সে কেমন করে কবি হবে?

সোমনাথের এই মানসিক অবস্থার কথা একমাত্র সুকুমার জানতো। সুকুমার বলেছিল, “দাঁড়া না। চাকরি যোগাড় করি আমরা—তখন ম্যাজিকের মতো আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। তখন তুই কিন্তু কুড়েমি করিস না—আমাকে নিয়েও একটা কবিতা লিখিস। বাবা, মা, ভাই, বোন সবাইকে শুনিয়ে দেবো–চড়চড় করে প্রেস্টিজ বেড়ে যাবে!”

বাবার সঙ্গে কথা বলে বউদি আবার ফিরে এলেন। সোমনাথ বললো, “বউদি, আপনার সঙ্গে খুব গোপন কথা আছে।”

বউদি হেসে ফেললেন, “গোপন কথা শুনতে আমার ভয় হয়। যা পেট-আলগা মানুষ, শেষে যদি কাউকে বলে ফেলি?”

সোমনাথ বললো, “আপনাকে ছাড়া আর কাউকে বলবো না, বউদি। আপনিও চুপচাপ থাকবেন। তারপর বিজনেসের ব্যাপারটা সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে সোমনাথ বললো, “ট্রেনের সেই ছোকরার মতো নিজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিজেই সই করে দেখি।”

বউদি বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “বাবাকে বলতে আপত্তি কী।”

সোমনাথ রাজী হলো না। “কি হয় তার ঠিক নেই। আবার হয়তো লোক হাসাবো। আগে নেমে দেখি, ভালো করলে তখন বাবাকে জানাবো।”

বউদি রাজী হয়ে গেলেন। হেসে বললেন, “তোমার দাদার কাছে মিথ্যে কথা বলা মশকিল। কিন্তু সে-সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। উনি আরও মাসখানেক বম্বেতে থেকে যাচ্ছেন। কে একজন ছুটিতে যাবেন, তাঁর কাছে ট্রেনিং নিচ্ছেন।”

বউদি বললেন, “বাবার কথাও শুনো কিন্তু। যেখানে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে বলেন, পাঠিয়ে দিও। আর বাকি সময়টা নতুন লাইনে যথাসাধ্য চেষ্টা কোরো।”

“জানেন বউদি, ব্যবসা জিনিসটা অনেকটা লটারির মতো। অনেকে তাড়াতাড়ি বড়লোক হয়ে যায়।”

প্রবল উৎসাহে বউদি বললেন, “তুমি হঠাৎ বিজনেসে দাঁড়িয়ে গেলে বেশ মজা হবে! বাবা তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। আমাকেই তখন বকুনি খেতে হবে। বলবেন, বউমা সব জেনে-শুনে আমার কাছে চেপে গেলে কেন?”

ভবিষ্যতের রঙীন কল্পনায় দুজনে একসঙ্গে খুব হাসলো। বউদি জানতে চাইলেন, “বিজনেস করতে গেলে টাকার দরকার হয় না, খোকন?

এ-ব্যাপারটা এখনও পর্যন্ত খেয়ালই হয়নি সোমনাথের। মাথা চুলকে বললো, “আগে হতো। এখন সম্ভবত দরকার হয় না। শিক্ষিত বেকারদের ধার দেবার জন্যে ব্যাঙ্কগুলো উঁচিয়ে বসে আছে।”

কমলা বউদির বিশ্বাস এতো বেশি যে ওসবের মধ্যে তেমন ঢুকলেন না। শুধু বললেন, মায়ের টাকাটা তো তোমার এবং আমার জয়েন্ট নামে বঙ্কে পড়ে আছে। পাশ বইটা দেখবে? তা তিন হাজার টাকা তো হবেই!”

এই টাকার কথা সোমনাথের খেয়ালই ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *