১০. সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
এ পর্যন্ত আমরা অসুখী মানুষদের সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এখন আমরা সুখী মানুষদের নিয়ে আরো মনোরম আলোচনা করব। আমরা কয়েকজন বন্ধুর সাথে মত বিনিময় করে এবং তাঁদের বই পড়ে আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে যে, বর্তমান পৃথিবীতে সুখলাভ অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করে, বিদেশে ভ্রমণ করে এবং উদ্যানপালকের সাথে আলোচনা করে অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখেছি এই ধারণার কোনও অস্তিত্ব নেই। এর আগের একটি অধ্যায়ে আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে আমি কিছু বলেছি। এই অধ্যায়ে আমি জীবনে যে সব সুখী লোকের সংস্পর্শে এসেছি তাদের নিয়ে সমীক্ষা করব।
সুখ দু’রকমের, যদিও এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে বেশ কটা পর্যায় রয়েছে। যে দু’রকমের সুখের কথা বলছি, তা হচ্ছে রূপহীন এবং রূপময় অথবা দৈহিক এবং আত্মিক অথবা হৃদয়-উৎসারিত এবং মস্তিষ্ক-জাত। এতসব বিকল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় করা নির্ভর করবে কী প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে তার ওপর। আমি কোনও পূর্বপরিকল্পিত বিশ্বাস প্রমাণ করতে যাচ্ছি না, আমি শুধু বলে যাব। দু’রকমের সুখের পার্থক্য বর্ণনার সহজতম উপায় হচ্ছে একটি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারেন, অন্যটি শুধু যারা লিখতে পড়তে পারেন তাদের জন্যেই এই কথাটি বলা। আমি যখন বালক ছিলাম, তখন আমি আনন্দে ভরপুর একটি লোককে জানতাম যার কাজ ছিল কূপ খনন করা। অতি দীর্ঘ দেহ, অবিশ্বাস্য রকম পুষ্ট পেশী, সে পড়তে বা লিখতে জানত না। ১৮৮৫ সালে যখন সে পার্লামেন্টের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার পেল তখন প্রথম জানতে পারল এই ধরণের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। তার সুখ মস্তিষ্ক উৎসারিত কোন কিছুর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এই সুখ, প্রকৃতির আইন অথবা প্রাণীজগতের প্রজাতিদের পূর্ণতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা অথবা সাধারণের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্বত্ব অথবা যীশুখ্রিস্টের পুনরাবির্ভাবে বিশ্বাসীদের জয়, অথবা বুদ্ধিজীবীদের কাছে জীবনকে উপভোগ করতে অন্য যেসব মতবাদ প্রয়োজন তার কোনওটার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়নি। তার সুখের ভিত্তি ছিল দৈহিক শক্তি, পর্যাপ্ত কাজ এবং পাথরের অলঙঘনীয় বাধাকে পরাজিত করা। আমার উদ্যানপালকের সুখের প্রজাতি একই। ছোট জাতের খরগোশের সাথে তার নিত্যদিনের সগ্রাম, আর তাদের সম্বন্ধে সে বলশেভিকদের সম্পর্কে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা যেভাবে বলে সেও ঠিক সেভাবেই বলে। সে মনে করে ঐ খরগোশগুলি কুটিল, চতুর এবং হিংস্র এবং তার মতে ওদের সমান ধূর্ততা না থাকলে ওদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন। নরওয়ের উপকথায় বর্ণিত ভ্যানথালার নায়কেরা প্রতিদিন একটি বিশেষ বন্যবরাহ শিকার করত এবং প্রতি সন্ধ্যায় তাকে হত্যা করত। কিন্তু কোনও অলৌকিক কারণে সে প্রতিদিন সকালে প্রাণ ফিরে পেত। আমার উদ্যানপালকও ঠিক একইভাবে একদিন তার শত্রুকে বধ করতে পারে নির্ভয়ে কারণ পরদিন সে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে এমন ভয় তার নেই। তার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে তবু সে সারাদিন কাজ করে এবং এই কাজের জন্যে সাইকেলে ষোল মাইল পাহাড়ি পথ প্রতিদিন তাকে আসা-যাওয়া করতে হয়। কিন্তু তার আনন্দের উৎস নিঃশেষ হয় না কখনো, আর তা যোগান দেয় ঐ খরগোশ।
কিন্তু আপনারা বলতে পারেন, আমাদের মতো উচ্চপর্যায়ের মানুষের জন্যে এইরূপ সহজ আনন্দ উন্মুক্ত নয়। খরগোশের মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা আর কতটুকু আনন্দ পেতে পারি? আমি মনে করি এটা খুব দুর্বল যুক্তি। পীত জ্বরের জীবাণু থেকে খরগোশ অনেক বড় কিন্তু তবুও উচ্চস্তরের লোক তার সাথে যুদ্ধ করে আনন্দ পেতে পারে। আনন্দের মধ্যে আবেগের যে উপাদান, সেখানে আমার উদ্যানপালক এবং একজন উচ্চশিক্ষিতের যে আনন্দ তা আলাদা করা যায় না। যেসব কাজের ভিতর দিয়ে আনন্দ পাওয়া যায় শিক্ষা শুধু সেখানে পার্থক্য তৈরী করে। কোনও কিছুতে সার্থকতা লাভের আনন্দ এমনই যে, আগে সাফল্য অনিশ্চিত বলে মনে হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত তাতে সফলতা লাভ হয়। এই কারণে সম্ভবত নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ না করাই সুখের একটি উৎস। যে মানুষ নিজের ক্ষমতাকে কম করে দেখে সে সবসময় সাফল্যে অবাক হয়, আর যে তার ক্ষমতাকে বেশি করে দেখে, সে সবসময় ব্যর্থতায় অবাক হয়। প্রথম রকমের অবাক হওয়া আনন্দের, পরেরটি বেদনার। তাই নিজের সম্বন্ধে অহংকার পোষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যদিও নিচু ধারণা পোষণ করে উৎসাহহীন হওয়াও উচিত নয়।
সমাজের উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে বর্তমানে যে বিজ্ঞানসেবকরা সবচেয়ে সুখী, তাঁদের মধ্যে যারা অতি বিখ্যাত তাঁদের অনেকেই আবেগের দিক থেকে খুব সরল । তাঁরা তাঁদের কাজের ভিতর যে তৃপ্তি পান, তা এতই গভীর যে, ভোজনে এমন কী বিবাহ থেকেও আনন্দ লাভ করতে পারেন। শিল্পী এবং সাহিত্যিকরা বিবাহে অসুখী হওয়াকে পালনীয় কর্তব্য বলে ভাবেন। কিন্তু বিজ্ঞানসেবীরা প্রায়ই পুরানো প্রথার গৃহী জীবনে পরম সুখ লাভ করেন। এর কারণ হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠ অংশ তাঁদের নির্দিষ্ট কাজে নিমগ্ন থাকে এবং যেখানে তার কোনও কাজ নেই, সেখানে তাকে অনধিকার প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কারণ আধুনিক পৃথিবীতে বিজ্ঞান প্রগতিশীল এবং ক্ষমতাশীল। এবং তার গুরুত্বে তাঁরা অথবা সাধারণ লোক, কারো সন্দেহ নেই। সুতরাং তাঁদের কাছে জটিল আবেগের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ সরল আবেগ কোনও পথেই বাধা পায় না। আবেগের জটিলতা নদীর জলের ফেনার মত। ফেনার জন্ম হয় নদীর চলমান স্রোতধারা বাধা পেলে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মূল শক্তি অব্যাহত থাকে ততক্ষণ উপরিভাগে কোনও আলোড়ন থাকে না এবং অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে যে শক্তি ধরাও পড়ে না।
বিজ্ঞানীর জীবনে সুখের সকল শর্তই পাওয়া যায়। তার কাজেই তাঁর পূর্ণশক্তি ব্যবহৃত হয় এবং তিনি যে সাফল্য অর্জন করেন তার গুরুত্ব শুধু তাঁর নিজের কাছেই নয়, জনসাধারণের কাছেও গৃহীত হয়। এমনকী তাদের কাছে তা বিন্দুমাত্র বোঝার মতো না হলেও। এক্ষেত্রে তিনি শিল্পী অপেক্ষা বেশি ভাগ্যবান। জনসাধারণ যখন কোনও ছবি বা কবিতা বুঝতে না পারে, তখন তারা ধরেই নেয় যে ছবিটি খারাপ বা কবিতাটি ভাল নয়। যখন তারা বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বুঝতে না পারে, তখন তা মনে করে (ঠিকই করে) যে তাদের শিক্ষা অপ্রতুল। কাজেই আইনস্টাইন(১) সম্মানিত হন এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা ছাদের চিলেকোঠায় অনাহারে, অবহেলায় পড়ে থাকেন এবং সেজন্যে বিজ্ঞানীরা সুখী এবং চিত্রশিল্পীরা অসুখী। খুব কম মানুষই যথার্থ সুখী যাকে অবিরাম জনসাধারণের সংশয়বাদের বিরুদ্ধে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। যদি না তিনি নিজেকে একটি গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ করে বাইরের জগতের শীতলতাকে ভুলে থাকতে পারেন। বিজ্ঞানীদের এই ধরনের দল গঠনের প্রয়োজন হয় না কারণ তাঁর সহকর্মী ছাড়া আর সকলেই তাকে সম্মান করেন। অপরদিকে, চিত্রশিল্পী নিন্দিত হবেন না নিন্দার্য হবেন, এই দুইয়ের মাঝখানে এক বেদনাময় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে থাকেন। তার ক্ষমতা যদি প্রথম শ্রেণীর হয়, তা হলে তাঁকে এটা বা অপরটা যে কোনও একটা দুর্ভাগ্যে ভুগতেই হবে। যদি তিনি তার ক্ষমতা ব্যবহার করেন তা হলে নিন্দিত হবেন এবং যদি না করেন তা হলে নিন্দাহ হবেন। অবশ্য সবসময় সব জায়গায় এরকম ঘটেনি।
এমন সময় ছিল যখন গুণী শিল্পীরা তাদের তরুণ বয়সে পর্যন্ত প্রশংসা পেয়েছেন। দ্বিতীয় জুলিয়াস(২) মাইকেল এঞ্জেলোর(৩) প্রতি দুর্ব্যবহার করলেও তিনি যে দক্ষ শিল্পী নন, তা কখনো ভাবেন নি। বর্তমান যুগের ধনপতিরা প্রধান শিল্পীদের তাদের সৃজন ক্ষমতা চলে গেলে তাঁদের প্রচুর অর্থ দান করতে পারেন, কিন্তু কখনো তাদের সৃষ্টিকে নিজের চেয়ে বড় বলে ভাবেন না। সম্ভবত শিল্পীরা গড়ে বিজ্ঞানীদের চেয়ে যে কম সুখী তার পিছনে এইসব ঘটনার অবদানও রয়েছে।
আমার নিশ্চিত ধারণা, পশ্চিমের স্বদেশের তরুণরা তাদের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার উপযুক্ত প্রয়োগক্ষেত্র না পাওয়ার কারণে অসন্তোষে ভুগছে। পূর্বদেশসমূহে অবস্থা কিন্তু এরকম নয়। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্ভবত রাশিয়াতে তরুণরা বেশি সুখী। সেখানে তারা এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করছে এবং তা করার জন্যে তাদের রয়েছে এক উদ্দীনাময় বিশ্বাস। প্রাচীনদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনাহারে রাখা হয়েছে, নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে অথবা অন্য কোনওভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে যাতে প্রত্যেক পশ্চিম দেশে তারা তরুণদের ক্ষতি করার অথবা কিছু করার মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বাধ্য করে, তেমন কিছু করতে না পারে। জ্ঞানাভিমানী পাশ্চাত্যবাসীদের কাছে তরুণ রাশিয়ানদের বিশ্বাস অমার্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু এর বিরুদ্ধেই বা বলবার কী আছে? সে সত্যি নতুন এক পৃথিবী সৃষ্টি করছে, তার মনের মতো পৃথিবী। যখন তার কাজ শেষ হবে, তখন রাশিয়ার মানুষ বেশি সুখী হবে। পশ্চিমের অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা এই নতুন পৃথিবীতে সুখী না হতে পারেন, কিন্তু তাদের তো সেখানে বাস করতে হবে না, তাই যে কোনও বাস্তবধর্মী বিচারে তরুণ রাশিয়ানদের বিশ্বাসকে সমর্থন করা যায় এবং তত্ত্বভিত্তিক কারণ ছাড়া একে অমার্জিত বলে নিন্দা করাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না।
ভারত, চীন এবং জাপানে রাজনৈতিক অবস্থার ওপর বাইরের প্রভাব তরুণ শিক্ষিতদের সুখে অন্তরায় হয়, কিন্তু সেখানে ভিতরের কোনও বাধা নেই যা রয়েছে পশ্চিমের দেশে। এমন অনেক কাজ রয়েছে যা তরুণদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এবং এইসব যতটা সফল হয় ততটাই তারা সুখী হয়। তারা মনে করে জাতীয় জীবনে তাদের একটা গুরুত্ববহ ভূমিকা রয়েছে এবং এমন সব লক্ষ্য রয়েছে যা অনুসরণ করা কঠিন হলেও তা অর্জন করা অসম্ভব নয়। পাশ্চাত্যের উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বনিন্দুকতা বোধ দেখা যায়, যার সৃষ্টি আরাম এবং ক্ষমতাহীনতার যোগফল থেকে। ক্ষমতাহীনতা মানুষকে অনুভব করতে শেখায় যে, কোনও কিছুই কাজের নয় এবং আরাম এইসব বেদনাদায়ক অনুভূতিকে কোনওভাবে সহনশীলতার মধ্যে ধরে রাখে। প্রাচ্য দেশসমূহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জনমতের ওপর আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করার আশা করে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশের ছাত্ররা তা পারে না। কিন্তু পাশ্চাত্যের ছাত্রের মতো প্রচুর উপার্জন করার সুযোগ তাদের অনেক কম। ক্ষমতাহীন অথবা অসচ্ছল হওয়ার কারণে সে হয় সংস্কারক অথবা বিপ্লবী, কিন্তু বিশ্বনিন্দুক হয় না। জনগণের ব্যাপার কোন পথে চলবে তার ওপর সংস্কারক অথবা বিপ্লবীর আনন্দ নির্ভর করে। কিন্তু সম্ভবত সে যখন ফাঁসির দড়ি পরতে চলেছে, তখন একজন স্বাচ্ছন্দ্যভোগী বিশ্বনিন্দুকের চেয়ে বেশি বাস্তব আনন্দ অনুভব করে। এক চীনা যুবকের কথা মনে পড়ছে আমার যে আমার স্কুল দেখতে এসেছিল। সে চীনের প্রগতিবিরোধী অঞ্চলে এইরকম একটি স্কুল স্থাপন করবে বলে দেশে ফিরে যাচ্ছে। সে জানে এর ফলে তার হয়তো শিরচ্ছেদ হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে এমন এক শান্ত আনন্দ অনুভব করছিল যার জন্যে আমি তাকে ঈর্ষা করি।
আমি এমন মন্তব্য করতে চাই না যে এ ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ সুখই হচ্ছে সম্ভাব্য একমাত্র সুখ। বাস্তবে এই সুখের পথ যাদের জন্যে খোলা, তারা হচ্ছে সংখ্যালঘু কারণ তার জন্যে প্রয়োজন এক ধরণের বিশেষ দক্ষতা এবং স্বার্থের প্রসারতা, যা খুব সাধারণ নয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাই শুধু তাদের কাজে আনন্দ পেতে পারেন তা নয়। নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনেতারাও যে শুধু কোনও মতকে সমর্থনের ভিতর আনন্দ পেতে পারেন তাও নয়। কাজের আনন্দ যে কোনও মানুষের জন্যে উন্মুক্ত, যদি তিনি বিশেষ দক্ষতার অধিকারী হন, যদি না তিনি সাধারণের প্রশংসা পাওয়ার জন্যে তা করেন তাহলে তিনি তার দক্ষতা প্রয়োগের মধ্যেই তৃপ্তি পেতে পারেন। আমি একজনকে জানতাম, যিনি শৈশবেই দুই পায়ের ব্যবহার-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তবু তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবন অবিচলিত সুখে অতিবাহিত করেছেন। এই সুখ তিনি লাভ করেছিলেন পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ একটা গ্রন্থ রচনা করে, যার বিষয়বস্তু ছিল গোলাপের কীট। এই বিষয়ে সবসময় তাঁকেই আমি প্রধান বিশেষজ্ঞ বলে মনে করি। অনেক সংখ্যক শখ-বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমি পাইনি। কিন্তু যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, তাদের কাছে সব সময় শুনেছি যারা শঙ্খ বিষয়ে গবেষণা করেন তাঁরা এর মধ্যে একধরণের পরিতৃপ্তি খুঁজে পান। একসময় আমি একজনকে জানতাম প্রেসের কম্পোজিটর হিসাবে পৃথিবীতে তাঁর তুলনীয় কেউ ছিল না এবং যারা সুন্দর সুন্দর হরফ তৈরী করতেন তারা তাঁর সাহায্য চাইতেন। তিনি সবার কাছ থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা পেতেন। যাদের শ্রদ্ধাকে কখনো কোনও ভাবে লঘু করে দেখা যায় না। কিন্তু তিনি যে আনন্দ লাভ করতেন তা সেই শ্রদ্ধালাভ থেকে ততটা নয়, যতটা পেতেন তার নিজের নৈপুণ্য প্রয়োগ থেকে এবং এই সেই আনন্দ যা লাভ করেন একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী তার নৃত্য থেকে, যার সাথেই শুধু তুলনীয় তা কাজ থেকে পাওয়া আনন্দ। আমি আরো অনেক কম্পোজিটরকে জানি যারা গণিতবিদ্যার বিভিন্ন হরফ, প্রাচীন নেস্টেরিয়ান হরফ অথবা কিউনিফর্ম হরফ এবং যা কিছু ভিন্নধর্মী এবং কঠিন তা সাজিয়ে দিতে পারদর্শী ছিলেন। তাদের পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল কিনা তা আমি জানতে পারিনি। কিন্তু কাজের সময় তাদের সৃজনদক্ষতা পূর্ণ চরিতার্থতা লাভ করত।
এটা বলা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে পুর্বে শিল্পীরা তাদের কাজের দক্ষতায় যে আনন্দ পেতেন আমাদের এই যন্ত্র-যুগে শিল্পীরা সেই আনন্দ পাবেন তেমন সুযোগ নেই। একথা সত্য যে মধ্যযুগের শিল্পীমহল যে ধরনের কাজ করতেন, বর্তমানের কারিগরদের কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু যান্ত্রিকযুগের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্ব এবং প্রয়োজন রয়েছে। একদল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং সূক্ষ্ম কলকজা তৈরী করে, একদল নকসা তৈরী করে, একদল বিমান যান্ত্রিকের কাজ করে, একদল গাড়ি চালায় এবং আরো নানা ধরনের কাজে বহু কারিগর নিয়োজিত। যাদের ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রকাশ একেবারেই সীমিত। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন যুগে ফসলের মাঠে মজুর এবং কৃষক, যতদূর আমি দেখেছি, মোটরচালক অথবা ইঞ্জিন চালকের মতো সুখী নয়। তবে একথা সত্যি যে কৃষক নিজের জমি আবাদ করে, তার কাজে বৈচিত্র্য আছে। সে নিজে চাষ করে, বীজ বোনে, ফসল কাটে, কিন্তু সে প্রকৃতির অধীন এবং এ বিষয়ে সে সচেতন। অন্যদিকে যে মানুষ আধুনিক যন্ত্র চালায় সে নিজের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন, সে জানে মানুষই হল প্রকৃতির প্রভু, দাস নয়। তবে একথাও অবশ্য সত্যি যে শুধুমাত্র যারা যান্ত্রিক মনের, যারা দিনের পর দিন বৈচিত্র্যহীন একই যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে তাদের কাজে কোনও স্বাদ নেই এবং সেই কাজ যতই স্বাদহীন হোক, ততই তা যন্ত্রের সাহায্যে করা যাবে। যান্ত্রিক উৎপাদনের চরম লক্ষ্য, এ কথা সত্যি যা থেকে আমরা অনেক দূরে, সেটা হচ্ছে একটা পদ্ধতি যাতে প্রত্যেকটি অনাকর্ষণীয় কাজ যন্ত্রের সাহায্যে করা যাবে। আর সেখানে যে কাজে বৈচিত্র্য এবং প্রেরণা আছে সে কাজের জন্যে মানুষকে আলাদা করা যেতে পারে। এইরকম পৃথিবীতে কাজে একঘেয়েমি কম হবে এবং অবসাদও কমে যাবে যা কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে কখনো হয়নি। চাষব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষ অনাহারের কবল থেকে বাঁচার জন্যে একঘেয়েমি ও ক্লান্তিকে মেনে নিয়েছে। যখন শিকারের সাহায্যে মানুষ খাদ্য সগ্রহ করত এবং তখন কাজই ছিল তার কাছে আনন্দ। তার প্রমাণ ধনবানরা এখনও আনন্দ উপভোগের জন্যে পূর্বপুরুষদের এই শিকার বৃত্তিকে অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু কৃষিকাজ প্রবর্তনের পর থেকে মানুষ নীচতা, দুর্ভোগ এবং উন্মত্ততার এক সুদীর্ঘ যুগে প্রবেশ করেছে। যা থেকে মাত্র এখন তারা মুক্ত হয়ে যন্ত্রের কল্যাণময় কাজের সাথে যুক্ত হতে চলেছে। মাটির স্পর্শের যে অনুভূতি তা শুনতে ভাল লাগে অনুভূতিপ্রবণদের মুখে, ভাল লাগে হার্ডির(৪) সৃষ্টি, দার্শনিক কৃষকদের পক্ক জ্ঞানের কথা, কিন্তু গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকটি তরুণের একমাত্র কামনা শহরে কাজ পাওয়া, যেখানে সে মুক্তি পাবে জল-হাওয়ার দাসত্ব এবং আলোহীন দীর্ঘ শীতের সন্ধ্যার একাকীত্ব থেকে এবং কলকারখানা এবং প্রেক্ষাগৃহের মানবিক পরিবেশে প্রবেশ করতে পারবে। সাধারণ মানুষের সুখের প্রথম উপাদান হল সাহচর্য এবং সহযোগিতা এবং তা কৃষি থেকে শিল্পে অনেক পূর্ণতার সাথে পাওয়া যায়। আমি শুধু নির্যাতিত দেশসমূহের বিপ্লবী, সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদীদের কথা বলছি না, আমি অনেক অবনমিত ধরণের বিশ্বাসের কথাও চিন্তা করছি। আমি এমন কয়েকজন লোককে জানি যারা বিশ্বাস করতেন ইংরেজরা ইফ্রেইম ও মানাস(৫) উপজাতির বংশধর, তাদেরও আনন্দের কোনও সীমা নেই। আমি এই কথা বলছি না যে পাঠক এইসব ধারণা বিশ্বাস করুন, কারণ যে বিশ্বাসের কোনও ভিত্তি নেই, যা আমার কাছে ভুল বিশ্বাস বলে মনে হয় তা থেকে সুখ লাভ করতে। এই একই কারণে আমি পাঠককে এই কথা বিশ্বাস করতে জোর দিচ্ছি না যে, মানুষ একমাত্র বাদামের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকুক। যদিও যতদূর পর্যন্ত আমার পর্যবেক্ষণ পৌঁছায়, আমি দেখেছি এই ধরণের বিশ্বাসে নিশ্চিন্ত আনন্দ লাভ হয়, যা বিশুদ্ধ। সুখের জন্যে কোনও কোনও বিশ্বাসে যাদের উৎসাহ যথার্থ, তারা এর মধ্যেই তাদের অবসর সময়ের একটা কাজ পেয়ে যান এবং জীবনটা শূন্য– এই যাদের অনুভূতি তারাও তাদের মনোরোগের এক পূর্ণ প্রতিকার পেয়ে যান। কোনও একটা শখে ডুবে থাকা, অজ্ঞাত বিশ্বাসে আনুগত্য পোষণ করা থেকে খুব দূরে নয়। একজন প্রখ্যাত জীবিত গণিতবিদ তাঁর সময়কে গণিত চর্চা এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ এই দুই কাজের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। আমি মনে করি প্রথমটাতে যখন তিনি অগ্রসর হতে পারেন না, সেইসব মূহুর্তে দ্বিতীয়টার মধ্যে তিনি সান্ত্বনা পেতেন। গণিতের প্রতিপাদ্য প্রমাণে দূরূহতা একমাত্র দুঃখ নয়, যা ডাকটিকিট সংগ্রহ দূর করতে পারে অথবা ডাকটিকিটই একমাত্র জিনিস নয় যা সগ্রহ করা যায়। একবার বিবেচনা করে দেখুন, পুরোনো চিনেমাটির জিনিস, নস্যির কৌটো, রোমান মুদ্রা, তীরের ফলা, প্রস্তরযুগের যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কল্পনার ভিতর কী বিশাল উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে মানসপটে। একথা সত্যি যে আমাদের মধ্যে অনেকেই এত উচ্চস্তরের যে এইসব সরল আনন্দে কোনও মূল্য পায় না। এসব আনন্দ আমরা সকলেই ছোটবেলায় উপভোগ করেছি, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক এসবকে এখন বয়স্কদের জন্যে অনুপযুক্ত মনে করছি। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, অপরের পক্ষে অনিষ্টকর নয়, এমন যে কোনও আনন্দকেই মর্যাদা দেওয়া। উচিত। আমি নিজে নদীর তথ্য সগ্রহ করি। ভলগা নদীর ভাটি এবং ইয়াংসি নদীর উজান বেয়ে চলার পথে আনন্দ পেয়েছি এবং আমাজন ও ওরিনোকো নদী কখনো দেখিনি বলে আমার খুব দুঃখ। এই ধরণের সব আনন্দের অনুভূতি খুব সরল। আমি তার জন্যে লজ্জিত নই। অথবা বেসবল খেলায় উৎসাহীদের কথা বিবেচনা করুন, প্রবল আগ্রহের সাথে তারা সংবাদপত্র পড়েন আর রেডিওর ধারা বর্ণনা তাদের মনে দারুণ রোমাঞ্চ জাগায়। আমেরিকার এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁর বই পড়ে আমার মনে হয়েছিল তার মন বিষাদময়তায় ভরা, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই সময়ে রেডিওতে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বেসবল খেলার ফল ঘোষিত হচ্ছিল। তিনি সেই মুহূর্তে আমার কথা ভুলে গেলেন, ভুলে গেলেন সাহিত্য এবং আমাদের জাগতিক জীবনের সব দুঃখ-যন্ত্রণা। তাঁর প্রিয় দলের জয়লাভে তিনি আনন্দে চিৎকার করতে লাগলেন। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর বই পড়ার সময়, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের দুর্ভাগ্যে আর কষ্ট পাইনি।
খেয়াল এবং শখ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবত অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌল আনন্দের উৎস নয়, কিন্তু শুধু বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর একটা উপায়। কোনও কোনও কঠিন বেদনার মুখোমুখি হওয়াকে মুহূর্তের জন্যে ভুলে থাকা, মৌল আনন্দ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল যার ওপর, যাকে বলা হয় মানুষ এবং বস্তুর ওপর। সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহল।
মানুষের বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহল স্নেহময় আবেগের একটি ধরণ। কিন্তু এই রূপে নয়, যার মধ্যে কর্তৃত্ব বা অধিকারের ভাব থাকে অথবা কাছ থেকে জোর সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা। শেষোক্ত ধরণটি প্রায় ক্ষেত্রে দুঃখের কারণ হয়। যে ধরণটি সুখের কারণ ঘটায় তা হচ্ছে মানুষকে গভীরভাবে লক্ষ্য করা, তা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে আনন্দ পাওয়া, যারা সংস্পর্শে আসবে তাদের কৌতূহল বা আনন্দ প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা, তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে না চাওয়া অথবা তাদের কাছ থেকে উৎসাহজনক প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করা। যে ব্যক্তি অন্যদের সম্পর্কে আন্তরিকভাবে এইরকম ভাবেন তিনি যেমন অন্যদের কাছে আনন্দের উৎস, বিপরীতভাবে তারাও তার কাছে মমতার গ্রাহক। তার সাথে অন্যদের সম্পর্ক হালকা অথবা গভীর হোক তার কৌতূহল এবং মমতা দুয়েরই জন্যে তৃপ্তিকর, অকৃতজ্ঞতায় বিষময় নয়। কারণ অকৃতজ্ঞতা তিনি পাবেন না এবং পেলে তা খুব কম লক্ষ্য করবেন যে মেজাজ-বৈশিষ্ট্য অন্য লোকের স্নায়ুর ওপর চাপ দিয়ে তাকে প্রায় ক্রুদ্ধ করে তোলে, সেই একই মেজাজ-বৈশিষ্ট্যতার কাছে মৃদু আমোদের উৎস হয়ে উঠবে। অন্য লোক কঠিন পরিশ্রম করেও যা পান না, তা তিনি বিনা শ্রমে পেয়ে যাবেন। নিজেকে নিয়েই নিজে সুখী থাকাতে তিনি একজন মনোরম সঙ্গী হবেন এবং এতে তাঁর সুখ আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু এর সবই যেন নির্ভেজাল হয়,এসব যেন কর্তব্যবোধের তাগিদ থেকে এক ধরণের আত্মত্যাগের ধারণা থেকে না আসে। কর্তব্যবোধ কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কে আক্রমণাত্মক, মানুষ অন্যের কাছে পছন্দের হতে চায়, করুণার পাত্র হতে চায় না, অনেক লোককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং চেষ্টাবিহীন পছন্দ করা মনে হয় ব্যক্তিগত আনন্দের সব উৎসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
পূর্ব অনুচ্ছেদে আমি বিভিন্ন জিনিসে সৌহার্দ্যপূর্ণ কৌতূহলের কথা বলেছি। কথাটি আরোপিত মনে হতে পারে। কোনও জিনিসের বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভব করা অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু ভূতত্ত্ববিদ পাথর নিয়ে, পুরাতত্ত্ববিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন কীর্তি নিয়ে যে বন্ধুত্বভাব ধারণ করেন তা ঐ কৌতূহলের অনুরূপ। আর এই কৌতূহল ব্যক্তি বা সমাজের যে মনোভাব তারই একটি উপাদান হতে পারে। কোনও জিনিস যদি বন্ধুভাবাপন্ন না হয়ে শত্রু ভাবাপন্ন হয়, তাহলে তার প্রতিও কৌতূহল বজায় রাখা সম্ভব। কোনও মানুষ মাকড়সার স্বাভাবিক বাসস্থান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন কারণ তিনি মাকড়সাকে ঘৃণা করেন এবং সেখানেই বাস করতে চান যেখানে তারা সংখ্যায় কম। এই কৌতূহল সে তৃপ্তি দেবে না, যা লাভ করেন ভূতত্ত্ববিদ পাথর থেকে। আমাদের চতুষ্পর্শ্বের অবস্থানরত জীবদের চেয়ে অব্যক্তিগত জিনিসে কৌতূহল দৈনন্দিন সুখের উপকরণ হিসাবে সম্ভবত কম মূল্যবান, তবুও এর গুরুত্ব কম নয়। পৃথিবীর বিস্তৃতির যেন সীমা নেই কিন্তু আমাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। যদি আমাদের সুখ ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ রাখা যায়, তাহলে জীবন যেটুকু দিতে পারে তার থেকে বেশি না করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এবং বেশি দাবি করার অর্থই হল যা পাওয়া সম্ভব তার চেয়ে কম পাওয়া। যে মানুষ নিজের দুঃখ ভুলে থাকতে পারেন, খ্রিস্টিয়ে ট্রেন্টের কাউন্সিল বা নক্ষত্রের জন্ম ইতিহাস নিয়ে খাঁটি কৌতূহলের কারণে, তিনি যখন নৈর্ব্যক্তিক পৃথিবী-পরিক্রমণ শেষে নিজের পরিবেশে ফিরে আসেন তখন তিনি দেখতে পান এমন একটি ভারসাম্য ও প্রশান্তি তিনি লাভ করেছেন যাতে সব দুঃখকে জয় করা সহজতম পথেই সম্ভব হয়েছে এবং এর মধ্যেই নশ্বর হলেও তিনি এক নির্ভেজাল আনন্দ লাভ করেছেন।
সুখলাভের গোপন সূত্রটি হচ্ছে এই আপনার কৌতূহলকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর সীমায় ছড়িয়ে দিন। আপনার যেসব ব্যক্তি বা বিষয়ে কৌতূহল তাদের প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া বৈরীভাবাপন্ন না হয়, বন্ধুসুলভ হোক। পরবর্তী অধ্যায়সমূহে সুখলাভের সম্ভাব্য উপায়গুলির এই প্রাথমিক সমীক্ষাটি আরো বিস্তারিত করা হবে এবং তার সাথে দুঃখের মনস্তাত্ত্বিক উৎসসমূহের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় এবং সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।
——
১. আইনস্টাইন, Albert Einstein (১৮৭৯-১৯৫৫)। অপেক্ষিকতাবাদের (Theory of relativity) জনক। দক্ষিণ জার্মানীতে জন্ম। তার তত্ত্ব প্রভাবিত করেছে আধুনিক দর্শন ও বিজ্ঞানের সব শাখাকে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে ‘বোস-আইনস্টাইন’ সংজ্ঞার উদগ্যাতা। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মানুষ ছিলেন, শান্তি আন্দোলনে তার অবদান অসামান্য। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন ও সুস্পষ্ট। এই বিজ্ঞান সাধক বলেছিলেন, ‘The most beautiful thing we can experience is teh mysterious.’
২. দ্বিতীয় জুলিয়াস, Pope Julius II (১৪৪৩-১৫১৩)। তিনি বিখ্যাত রোমান রাজা এবং ধর্মগুরু ছিলেন। তখনো চার্চ এবং রাষ্ট্র আলাদা হয়নি। তাঁর বীরত্বের খ্যাতি এবং যোদ্ধা পোপের জন্যে তিনি ‘Papa Terrible’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
৩. মাইকেল এঞ্জেলো, Michael Angelo (১৪৭৫-১৫৬৪)। ইটালির নবজাগরণের যুগের (Renaissance) বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী, তার চিত্রকলা আধুনিক মানুষদের কাছে বিস্ময়।
৪. হার্ডি, Thomas Hardy (১৮৪০-১৯২৯)। ভিক্টোরীয় যুগের কবি এবং ঔপন্যাসিক। তাঁর সাহিত্যে নিষ্ঠুর নিয়তি এবং জীবনের গভীর দুঃখবাদের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁকে ‘English Author of the naturalist movement’ রূপে অভিহিত করা হয়। ৫. ইফ্রেইম ও মানাস, Ephraim and Manasseh, বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament)– এ বর্ণিত যোসেফের দুই পুত্র। সুসমাচারের (Gospel) অন্তর্লীন সত্যের আবিষ্কর্তা, যাতে নির্দেশিত হয়েছে খ্রিস্টবাদীদের জীবনযাপনের বিধি এবং অনন্ত জীবনের কথা।