১০. সালমা বানু

সালমা বানু লজ্জা লজ্জা চোখে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। কেন এমন লজ্জা লাগছে নিজেও বুঝতে পারছেন না। ত্রিশ বছর বিবাহিত জীবন যাপনের পর স্বামীকে দেখে তরুণী বয়সের লজ্জা পাবার কোন অর্থ হয় না। অসুখের পর অনেক অর্থহীন ব্যাপার তাঁর মধ্যে ঘটছে। গল্প করার মত কেউ থাকলে এইসব নিয়ে তার সঙ্গে গল্প করতেন। মিলি আসে খুব অল্প সময়ের জন্যে। এসেই কেবিন গোছানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আয়াদের অসুখের কথা জিজ্ঞেস করে, তারপর যায় ডাক্তারের খোঁজে। তার সঙ্গে গল্প করার মত সময় বের করা যায় না। মাঝে মাঝে মিলি গভীর হয়ে পা ঝুলিয়ে তাঁর পাশে বসে। তখন মেয়েটার গম্ভীর মুখ দেখেই সালমা বানু কোন কথা শুরু করতে পারেন না। মেয়েটার কি অন্য কোন ঝামেলা হয়েছে? সে এত গভীর কেন? মেয়েটার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে–কোন সম্মন্ধ আসছে না। মিলিকে নিয়ে তাঁর ইদানীং খুবই দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।

রশীদ সাহেব ও ঠিক মিলির ভঙ্গিতেই বসেছেন। পা বুলিয়ে বসেছেন, পা দুলাচ্ছেন। হাসপাতালের কেবিনের বেড়গুলি উঁচু উঁচু, বসলেই পা ঝুলে থাকে। রশীদ সাহেবের মুখ গভীর। এই গান্তীর্যের কারণ সালমা জানেন। ত্রিশ বছর পাশাপাশি ব্যাস করলে একটা মানুষের সব কিছু জানা হয়ে যায়। সালমা বানু জানেন তার স্বামী গভীর হয়ে আছে কারণ বেচারা অনেকক্ষণ সিগারেট খেতে পারছে না। রশীদ সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সালমা, তোমাদের এইসব ঘরে সিগারেট খাওয়া যায় না?

সালমা বললেন, খেয়ে ফেল কিছু হবে না।

রশীদ সাহেব পকেটে হাত দিলেন। আবার হাত সরিয়ে নিলেন। তার গভীৰ্য আরো বাড়ল। হাসপাতাল তিনি সহাই করতে পারেন না। ফিনাইলের গন্ধ, তার কাছে মৃত্যুর গন্ধের মত লাগে। মৃত্যুর গন্ধ মনের উপর চাপ ফেলে। এমিতেই তিনি নানান ধরণের চাপের মধ্যে থাকেন। বাড়তি চাপ নেয়ার মত অবস্থা এখন তাঁর না।

সালমা বানু ক্ষীণ স্বরে বললেন, চা খাবে?

রশীদ সাহেব বিরক্ত মুখে তাকালেন। সালমা বললেন, চা খেলে বারান্দায় একটা ছেলে আছে তাকে বল, সে চা এনে দেবে।

হাসপাতালের জীবাণু মাখা চা খাব কেন?

হরলিক্স খাবে? ফ্লাস্কে গরম পানি আছে। হরলিক্স বানিয়ে খাও।

রশীদ সাহেব কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়েও বললেন না। তিনি কি হরলিক্স খাওয়ার জন্যে হাসপাতালে এসেছেন? আর এত মেহমানদারিাইবা কি আছে? চা খাও–হারলিক্স খাও। তার বসে থাকতে অসহ্য লাগছে। এতদিন পর এসেছেন। এসেই চলে যেতেও মায়া লাগছে। আরো কিছুক্ষণ থাকা দরকার।

সালমা বললেন, বাসার খবরাখবর কি?

রশীদ সাহেব জবাব দিলেন না। চুপচাপ বসে থাকতে খারাপ লাগছে বলে সালমা খবরাখবর জানতে চাচ্ছে। জানার কিছু নেই, মিলি রোজ আসছে। খবরাখবর যা আছে মিলি বলে যাচ্ছে। মেয়েদের কাজই হল। খবর চালাচালি করা। সালমা বললেন, ফরহাদকে তুমি বকা ঝকা করনিতো?

করেছি। জুতা-পেটা যে করিনি এটা তার ভাগ্য। জুতা পেটা করা দরকার ছিল। বাটা কোম্পানীর জুতা দিয়ে শক্ত পেটা।

তারতো দোষ কিছু না। ফন্ট করে মাথা ঘুরে গেছে।

সহজ প্রশ্ন দেখে যার মাথা ঘুরে যায়, প্রশ্ন কঠিন হলে মাথা কি করত বুঝতে পারছ? মিল্লাত পাখার মত ভন ভন করে ঘুরত।

সালমা হেসে ফেললেন। রশীদ সাহেব কঠিন গলায় বললেন, হাসবে না। হাসার কথা আমি বলি না! তোমার সব কটা ছেলেমেয়ে চতুষ্পদ মাকা। একজন সহজ প্রশ্ন দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যায়, একজন তিন বছরেও একটা দারোয়নের চাকরি জোগার করতে পারে না। মেয়ে একই রকম। মেয়েদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি একটু ইতঃস্তত করলেন। দুটা মেয়েই তার অতি প্রিয়। এদের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে অস্বস্তি লাগে। যদিও অস্বস্তি লাগার কিছু নেই, মেয়ে দুটিও হাঁদারাম–কিংবা স্ত্রী লিঙ্গে হাঁদিরাম। বড়টা–বিরাট বড় হাদি। ছোটটাকে বুদ্ধিমতী মনে হলেও সে আসলে হাদি। প্রথম বার বি এ পরীক্ষায় থার্ড ক্লাস পেয়ে কেঁদে বুক ভাসাল। পরের বছর ইমপ্রক ভমেন্ট দিয়ে–ফেল। তখন আর চোখে পানি নেই। সে হ্যাদিরাম না হলে কে হবে। রিটায়ারমেন্টের পর লোকজন আরাম করে। ইজিচেয়ারে শুয়ে ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ে। ছেলের বউ এসে জিজ্ঞেস করে–বাবা, চা খাবেন না কফি খাবেন। আর তার সংসারে সব কটা হীদারাম আর হ্যাদিরাম জোটায় বিশ্রাম মাথায় উঠেছে। তিনি এখন চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নানান অফিস-টফিসে যাচ্ছেন। পার্টটাইম চাকরি কিছু পাওয়া যায় কি-না।

সালমা বললেন, হাসপাতালে বসে থাকতে তোমার বোধ হয়। ভাল লাগছে না। চলে যাও।

রশীদ সাহেব একটু নড়েচড়ে উঠলেন–সালমা তাঁর মনের কথা বলছে। রোগীর পাশে খাটে বসে থাকতে তার অসহ্য লাগছে। সালমা বললেন–

না।

তুমিও তো কোন চেষ্টাচরিত্র করছ না।

আমি কি চেষ্টা করব? মাইক নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যাব?

তোমার কাছে মেয়েরা পড়তে আসে, ওদের বললে–ওরা খোঁজ খবর করবে।

ওদের তো কোন কাজকর্ম নেই বাজে কথা বন্ধ করা তো। আমি উঠি। মাথা ধরে গেছে।

রশীদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সালমা বললেন, ফরহাদকে আমার কাছে পাঠিও। আতাহারকেও আসতে বলে। দুজনের কেউই তো আসে না।

না আসাই ভাল। এদের মুখ যত কম দেখবে ততই শূভ। The less you see their faces the better.

তোমার চুল এত লম্বা হয়েছে, চুল কাটনা কেন?

রশীদ সাহেব তিক্ত গলায় বললে, আর চুল কাটাকাটি, মাথাই কেটে ফেলে দিব। যাই সাল্মা।

আচ্ছা।

তোমার শরীর তো আগের চেয়ে অনেক ভাল, তাই না?

সালমার শরীর আগের চেয়ে মোটেই ভাল না–তবু তিনি বললেন, হ্যাঁ। রশীদ সাহেব বললেন, খামাখা হাসপাতালে থেকে লাভ কি? ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বাসায় চলে আস। দেখি কাল সকলে আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলব।

সালমা বললেন, আচ্ছা।

তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন, কাল থেকে কেবিনে চায়ের ব্যবস্থা রাখবেন। আয়াকে বলে রাখবেন–সে যেন চট করে চা বানিয়ে দেয়। চা, মিষ্টি পান। কাচা সুপারি দিয়ে মিষ্টি পান। রশীদ সাহেবের দীতে সমস্যা হয়েছে। শক্ত সুপারি চিবুতে পারেন না। নরম কাঁচা সুপারি ছরতা দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে দিতে হয়। মিলিকে বার বার বলে দিয়েছেন। মিলি এইসব দেখছে কি-না কে জানে। সংসারের শতেক ঝামেলা মেয়েটার উপর পড়েছে। এরমধ্যে ছোটখাট সমস্যা কি মনে থাকবে। বড় সমস্যার দিকে সবার চোখ থাকে। সেইসব সমস্যার সমাধান হয়। ছোট সমস্যা চোখ এড়িয়ে যায়। অথচ সংসারে ছোট সমস্যাগুলিই আসল সমস্যা। যেমন ফরহাদ বেগুন খেতে পারে না। বেগুন খেলেই তার সারা গা চাকা চাকা হয়ে ফুলে ওঠে। শুধু বেগুন না, বেগুনের তরকারীর ঝোল খেলেও এ রকম হবে। রশীদ সাহেবের অতি পছন্দের তরকারী কচুর লতি। সেই কচুর লতি যদি গরম পানি দিয়ে কয়েকবার ধোয়া না হয় তাহলে রশীদ সাহেবের গলা চুলকায়। কাশি হয়। বারান্দায় ফুলের টবগুলিতে পানি দেবার ব্যাপার আছে। একটা ক্যাকটাসের টব আছে, সেখানে সপ্তাহে একদিন পানি দেয়ার নিয়ম। তিনি শুক্রবার সকালে দিতেন। মিলি কি এইসব মনে করে রেখেছে? বাচ্চা মেয়ে, এত কিছু তার মনে থাকার কথা না। তিনি বাসায় ফিরে যেতে পারলে সব ঠিকঠাক করে ফেলতে পারবেন। ফিরে যেতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

এখন হাসপাতালে এই কেবিনটাকেই তার ঘর বাড়ি বলে মনে হয়। আয়াকে দিয়ে একটা মানিপ্লেন্টের চারা এনে পানির বোতলে রেখেছেন। বোতলটা জানালার কাছে লোহার শিকের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাধা। চারা থেকে শিকড় ছেড়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি নতুন শিকড় দেখতে পান। তার ভাল লাগে। বিকেলে জানোলা দিয়ে আলো এসে তেড়ছা করে দেয়ালে পড়ে। সেই আলোও দেখতে ভাল লাগে। গভীর রাতে বারান্দা নিয়ে টুলি টেনে নেবার শব্দ, নাস এবং ইন্টানি ডাক্তারদের ব্যস্ত চলাফেরা কানে আসে। এই সব শব্দ তার শুনতে ভাল লাগে। আধো ঘুম আধো জাগরণে মনে হয়–আহা করি আবার কি হল? সকালবেলা আয়ার কাছ থেকে বিস্তাবিত শোনেন। হাসপাতালটাকেই এখন তাঁর নিজের ঘর সংসার মনে হয়। এটা বড় ধরনের অলক্ষণ। কোন জায়গাকে ঘর সংসার মনে হলে সেই জায়গায় সংসার হয়ে যায়। এই সত্য পরীক্ষিত সত্য। তিনি ছোটবেলায় তার মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কংশ নদীর তীরে মোহনগঞ্জে তার মামার বাড়ি। দুই মামা, নানা-নানী থাকেন। চার পাঁচদিন মহানন্দে কেটে গেল। একদিন দুপুরে পড়ার ছোটছোট মেয়েদের সঙ্গে ফুলগুটি খেলছেন। পাঁচটা গুটি দিয়ে খেলা। সুর করে ছড়া পড়তে হয়। তার দান যখন এল তিনি গুটি হাতে নিয়ে ছড়া পড়লেন–

ফুলনা ফুলনা ফুলনা
এক হাতে দুলনা—তেলনা
সুষম সুষম সুষম
আঁটি আঁটি আঁটি
লঙ্গনা লঙ্গনা লঙ্গনা

ছড়া পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল–এটাই তার ঘর সংসার। গ্রামের এই বাড়ি, কংশ নদী, বাড়ির পেছনের তেতুল গাছ, সকালবেলা হাসের ঝাকের পুকুরের দিকে যাত্রা এই সব নিয়েই তার সংসার। হয়েও গেল তাই।

তারা ঢাকা চলে আসবে, রাতের ট্রেন। সন্ধ্যা থেকে গোছগাছ হচ্ছে। তখন তাঁর নানাজান তাঁর মাকে বললেন—সালমা ছিল বাড়িটা আলো হয়ে ছিল—মেয়েটা আরো কয়েকদিন থাকুক। চিন্তা করিস না, আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব। তার মা নিতান্ত অনিচ্ছায় বললেন, আচ্ছা। বেশি দেরি করবেন না বাবা।

আমি এক সপ্তাহের মধ্যে দিয়ে আসব রে বেটি।

তিনি থেকে গেলেন। তিন দিনের দিন মার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে টেলিগ্রাম এল। তাঁর আর ঢাকা যাওয়া হল না। নানার বাড়ি থেকে মেট্রিক পাশ করলেন।

তারপর একবার ছোট মামার সঙ্গে বেড়াতে গেলেন–দুর্গাপুর। দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসার কথা। পৌঁছার পর এমন ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। রাস্তাঘাটে পানি জমে গৈল। বাস বন্ধ। তারা আটকা পড়ে গেলেন। তিনদিন তিন রাত অপরিচিতি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকতে হল। ভদ্রলোক বুড়ো, সাবরেজিস্টার। ঘোরতর ধরনের নামজ্বি মানুষ। বাড়িতে কঠিন পর্দা প্রথা। মেয়েদের উঁচু গলায় কথা বলার পর্যন্ত নিয়ম নেই। উঁচু গলায় কথা বললে পুরুষ মানুষ শুনে ফেলবে। তার অস্বস্তির সীমা রইল না। বেড়াতে এসে একি বিপদে পড়া গেল। দ্বিতীয় দিনে হঠাৎ করে অস্বস্তি কেটে গেল। সংসারটাকে খুব আপন মনে হতে লাগল। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির বারান্দায় জলচৌকি পেতে তিনি বসে আছেন। তখনো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। উঠানে কল কল করছে পানি। ছেলেরা কলাগাছ কেটে–কলাগাছের ভোড়া বানিয়ে উঠোনে নিয়ে এসেছে–তিনি দেখে খুব মজা পাচ্ছেন–এই বাড়ি, বাড়ির মানুষজন, কলাগাছের ভোড়া সবই খুব আপন মনে হচ্ছে, নিজের মনে হচ্ছে। তখন সাবরেজিস্টার নিয়ামত হোসেন মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যে ঘর থেকে বের হলেন, তাকে দেখে বিরক্ত মুখে বললেন–মা, শোন। সন্ধ্যাবেলা মাথায় কাপড় না দিয়ে বসে আছ। এটা ভাল না। মাথায় কাপড় দাও।

তিনি লজ্জিত হয়ে দ্রুত মাথায় কাপড় দিলেন। সেই রাতেই নিয়ামত হোসেন তার মামাকে ডেকে বললেন–আল্লার ইশারা ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। এই যে আপনি অচেনা অজানা একজন মানুষ মেয়েটাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন এটাও আল্লাহর ইশারা।

তাঁর মামা লজ্জিত মুখে বললেন, জ্বি জ্বি।

নিয়ামত হোসেন বললেন, আপনার ভাগ্নিকে আমাদের সবার খুবই পছন্দ হয়েছে। অতি সুলক্ষণা মেয়ে। আমি লোক মারফত আপনাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছি। খবর যা পেয়েছি তাতেও অতি আনন্দিত হয়েছি। আপনাদের শরাফত ভাল।

তাঁর মামা, কিছু না বুঝেই আবারো বললেন, জ্বি জ্বি।

নিয়ামত হোসেন বললেন–এখন আপনার ভাগ্নির বিষয়ে আমার একটা আব্দার আছে : রাখা না রাখা আপনার ব্যাপার। আমার বড় ছেলের নাম রশীদ। ভাল ছেলে বলে আমার বিশ্বাস। এ বছর বি এ পাশ করেছে। চাকরি বাকরি কিছু পায় নাই। তবে ইনশাল্লাহ পেয়ে যাবে। ছেলে থাকে ময়মনসিংহ। তাকে আসতে খবর পাঠিয়েছি। ছেলেটাকে দেখেন। যদি পছন্দ হয় তাহলে ভাগ্নিকে আমার ছেলের সঙ্গে বিবাহ দেন। আমাদের কোন দাবি নাই। এক হাজার একটাকা কাবিনে বিবাহ হবে। কন্যার নামে আমি দশ একর ধানী জমি রেজিস্ট্রি করে দিব। এখন আপনাদের বিবেচনা।

মামার চোখ মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, জ্বি জ্বি। রাতে মামা ভাগ্ন এক ঘরে শুয়েছে। মামা থমথমে এবং চাপা গলায় বললেন, ফাজলামার জায়গা পায় না। জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। সালমা তুই কোন চিন্তা করিস না। বাস চালু না হলেও–নৌকা চলাচল শুরু হয়েছে। আমি খোঁজ নিয়েছি। কাল সকালে নৌকা করে চলে যাব। জোর করে মেয়ে রেখে দেয়া—বদমায়েশের বদমায়েশ। মোহনগঞ্জের বাজারে পেলে জুতাপিটা করুম। শালা ধান্ধবাজ।

সালমা বলল, জোর করে তো বিয়ে করিয়ে ফেলতে চাচ্ছে না। তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাব অপছন্দ হলে তুমি বলবে–না।

প্রস্তাবই বা দিবে কেন? প্রস্তাব দিতে হলে–মোহনগঞ্জ যাবে–তারপর প্রস্তাব দিবে। বদমায়েশের দল।

সালমা হাসতে হাসতে বলল–কথায় কথায় তুমি বদমায়েশ বলছ কেন? এত রাগ করছি কেন?

রাগ করব না। শেষ রাতে বলতে গেলে ঘাড় ধরে ঘুম থেকে তুলে দেয়। ফজরের নামাজ পড়তে হবে। নামাজ পড়ি না পড়ি সেটা আমার ব্যাপার। তুমি জোর করার কে? তাও ঘরে নামাজ পড়লে হবে না–পাক, কাদা, পানি পার হয়ে তিন মাইল দূরের মসজিদে যেতে হবে। আমি মরে গেলেও এই বাড়িতে তোর বিয়ে দেব না। এইখানে বিয়ে দিলে এরা তোর জীবন শেষ করে দেবে। সকালটা হোক–বিদায় হয়ে যাব। নৌকা না পাওয়া যায় সাতরে চলে যাব।

সকালবেলা হোসেন আলি সাহেবের বড় ছেলে, সুটকেস হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে উপস্থিত। সালমা টেকি ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে প্রথম দেখল। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার চোখ নামিয়ে নিতে পারল না। মুহুর্তের মধ্যে বুক ব্যথা শুরু হল। কোথেকে একটা কান্নার দলা গলার কাছে এসে মাছের কাঁটার মত আটকে গেল। সুখের মত ব্যথা বোধ হতে লাগল। তার মনে হল–না থাক, কি মনে হল তা তিনি এখন আর ভাবতে চান না। তার বড়ই অস্বস্তি লাগে। মাত্র ষোল বছর বয়সে তিনি যে কাণ্ডকারখানা করেছেন তা ভাবলে তাঁর লজ্জায় গায়ে কীটা দেয়। এ যুগে মেয়েদের নানান সাহসিকতার গল্প তিনি শোনেন। শুনতে শুনতে মনে হয়–তাঁর নিজের সাহসও তো এদের তুলনায় কম ছিল না। বরং অনেক বেশীই ছিল।

মামা তখন সুটকেস গুছিয়ে ফেলেছেন। চলে যাবেন। দুর্গাপুর-ধিরাই লঞ্চ সার্ভিস শুরু হয়েছে। দুপুর বেলাতেই লঞ্চ ছাড়বে। হোসেন সাহেবকে বলেছেন–বিয়ের আলাপ তো এভাবে হুট করে হয় না। দিন তারিখ ঠিক করে মোহনগঞ্জ আসেন। কথাবার্তা হবে। কপালে থাকলে বিয়ে হবে। মানুষের ইচ্ছায় তো বিয়ে শাদী হয় না। আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।

সালমার মামা যখন চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত তখন একটা কাণ্ড হল। তিনি ভাগ্নিকে বললেন, যাও বাড়ির মেয়ে ছেলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা। সালমা ইতঃস্তত করে বলল, মামা একটা কথা।

সালমার মামা ভ্ৰ কুঁচকে বললেন, কি কথা?

ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়েছে?

কি বললি?

সালমা কোন রকম লজ্জা বা সংকোচ না করে আবার বলল–ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে।

সালমার মামা হতভম্বর গলায় বললেন, আমার তো মনে হয় এরা তোকে তাবিজ করেছে। অবশ্যই তাবিজ করেছে। না হলে নিজের মুখে কোন মেয়ে এ কথা বলতে পারে। পছন্দ হলে পরে দেখা যাবে। যা, অন্দরের মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আয়।

সালমা অন্দরে গেল। হোসেন আলি সাহেবকে কদমবুসি করল।

হোসেন আলি সাহেব বললেন, তোমাকে মা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এত পছন্দ এই জীবনে কাউকে হয় নাই। যাই হোক, আমি যাতে তোমাকে এই বাড়িতে রেখে দিতে পারি। সেই চেষ্টা করব। প্ৰস্তাব নিয়ে যাব–বাকি আল্লাহর ইচ্ছা

সালমা তখন বলল, বেশ স্পষ্ট করে বলল–আমি মামার সঙ্গে যাব না। আমি এই বাড়িতে থাকব।

সেই রাতেই কাজি ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হল। বাসর রাতে সালমা স্বামীর সঙ্গে যে সব কাণ্ডকারখানা করল এই যুগের অতি আধুনিক অতি সাহসী মেয়েরাও তা করতে লজ্জা পাবে।

বিয়ের পর মামার বাড়ির সঙ্গে তার সব রকম সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। মামাদের ধারণা সালমা পরিবারের মাথা হেট করেছে। পরিবারের সম্পমান ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে। তার মামারা জানিয়ে দিলেন, সালমা যেন আর কোনদিন মোহনগঞ্জ ফিরে না আসে।

সালমা ফিরে যায়নি। সে তার শ্বশুরের মৃত্যু পর্যন্ত দুর্গাপুরেই ছিল। এখন জীবনের শেষ অংশ কাটাচ্ছে হাসপাতালে। হাসপাতালটাকে ঘরবাড়ি মনে হচ্ছে। এই ঘর বাড়ি ছেড়ে তিনি তাঁর আগের বাড়িতে ফিরে যাবেন তা মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *