সালমান রুশদির লেখা ইংরেজি উপন্যাস মিডনাইট চিলড্রেনস ঢাকার বাজারে এসেছে। স্যার এক কপি কিনেছেন। পড়া শুরু করার পর থেকেই ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন। পড়ছেন এবং তারিফ করছেন। ইংরিজি ভাষার ইডিয়াম ব্যবহারের পদ্ধতিটাই এক্কোরে পাল্টাইয়া ফেলাইছে। এই এতদিন পরে ইন্ডিয়ানরা ইংরেজগো উপর প্রতিশোধ লইবার লাগছে। ইংরাজ আমলে ইন্ডিয়ায় যারাই ইংরেজি লিখছেন, তার মধ্যে একমাত্র গান্ধী ছাড়া আর কারও লেখাই টিকব না।
আমি জওহরলাল নেহরুর কথা বললাম। স্যার মাথা নাড়লেন, উঁহুঁ টিকবি না। তারপর মুলুকরাজ আনন্দের কথা বললাম। তার ইংরেজি গদ্যের ব্যাপারেও স্যার দেখলাম আশাবাদী নন। সালমান রুশদির নাম উল্লেখ করে বললেন, এইরকম একজন ইংরেজি প্রোজ রাইটারের জন্ম কলোনিয়াল আমলে সম্ভব আছিল না। পইড়া ইংরেজদেরও নইড়্যাচাইড়া বইতে অইব। সালমান রুশদির উপন্যাস নিয়ে যতোখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন, অন্য কোনো লোকের উপন্যাস সম্পর্কে স্যারকে অতোটা মুখর হতে আমি দেখিনি।
স্যার কয়েকদিন পরে মফিদুল হকের বইয়ের দোকান জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীতে ঘনঘন যাওয়া আসা করছেন। আমার কৌতূহল জাগলো, তাই একদিন জিগ্গেস করলাম, স্যার, আপনাকে ঘনঘন মফিদুলের দোকানে যাওয়া-আসা করতে দেখছি, নতুন বই আসার সম্ভাবনা আছে কি?
স্যার বললেন, মফিদুল আমারে দুই খণ্ড হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা অভিধান আইন্যা দেওনের কথা দিছে। অভিধানটা আইল কি না খবর লইবার যাই। একদিন সত্যি স্যার অভিধান দু খণ্ড নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। তারপর দেখা গেলো, শেলফ থেকে আরও পাঁচ-সাতটা অভিধান নামিয়ে এনে হরিচরণের অভিধানের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছেন। স্যারের নিবিষ্ট অভিধানচর্চা দেখে আমার কেমন জানি মনে হতে লাগলো, স্যার নিজেই একটা অভিধান রচনা করতে বসে যাবেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেখলাম অভিধান দুটো শেলফে চলে গেছে। স্যার অন্য বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
অনেক পরের ঘটনা। তবু এখানে বলে ফেলি। কবি সমর সেন মারা গেছেন। সমর সেন তরুণ বয়সে কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে তিনি কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ফ্রন্টিয়ার নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদনা করে গেছেন। মতামতের ব্যাপারে সমরবাবু কারও সঙ্গে আপোস করেননি। তার জন্য তাঁকে কম বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়নি। সমরবাবুর মৃত্যুর পর তার ওপর তার গুণমুগ্ধ বন্ধুবান্ধবেরা একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সমর সেনের পুরোনো লেখাগুলোও একটি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া সমর সেনের আত্মজৈবনিক রচনা বাবু বৃত্তান্ত বইটিও তিনি কিনে এনেছেন। কয়েকদিন দেখলাম স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে সমরবাবুর লেখা, তার ওপর লিখিত রচনাগুলো পড়ছেন। এবার স্যারের বাড়িতে যেতে কিছুদিন দেরি হলো। মাঝখানে অসুখে পড়েছিলাম। স্যার আমাকে দেখামাত্রই সমর সেনের নিজের লেখা এবং তার ওপর লেখা বই শেলফ থেকে এনে টেবিলে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্গেস করলেন, আপনে সমর সেনের লেখা পড়ছেন?
আমি বললাম, কবিতা তো অবশ্যই পড়েছি অনেক আগে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ‘বাবু বৃত্তান্ত’ এই সবে শেষ করেছি।
স্যার বললেন, আটাশ, উনত্রিশ বছর বয়সের পর এই ভদ্রলোক আর বাংলা ভাষায় কিছু লিখেন নাই। যে বয়সে সমর সেন বাংলা লেখা ছাড়ছেন, ওই বয়সের রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে মিলাইয়া দেখবেন, কোনো তুলনা চলব না। দুঃখের কথা অইল সমর সেন তিরিশ বছর বয়সের পর আর কোনোকিছু বাংলা ভাষায় লিখেন নাই। যাও লিখছেন ইংরেজিতে। এইডা বাংলা ভাষার জন্য একটা গ্রেট লস। এই একটা মানুষ যার চিন্তাভাবনার রেঞ্জ আছিল অনেক বড়।
টাঙ্গাইলের থেকে আসা স্যারের এক পূর্বপরিচিত প্ৰবীণ ভদ্রলোককে দেখলাম স্যারের সঙ্গে আলাপ করছেন। পুরোনো দিনের প্রসঙ্গ সব। আবদুল হালিম গজনভির কথা উঠলো, সেই সূত্র ধরে এলেন ওয়াজেদ আলি খান পানী। একসময় মওলানা ভাসানীর কথাও উঠলো। স্যার বললেন, একসময় মওলানা ভাসানী মেডিক্যাল কলেজে ভরতি অইছিলেন। তার ত আবার দুই রকমের অসুখ আছিল। পলিটিক্যাল অসুখ আর আসল অসুখ। সেইবারের অসুখটা মনে অইল আসল অসুখ। আমি তারে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। আমারে দেইখ্যা মওলানা সাহেব খুশি অইল। এই কথা সেই কথা নানান কথা কইবার লাগল। মওলানা কথা কইবার শুরু করলে অন্য মানুষের শুইন্যা যাওন ছাড়া গতি আছিল না। মওলানা এক পর্যায়ে কইলেন, আমি একটা কলেজ দিছি, একটা মাদ্রাসা দিছি। তারপর কইলেন দুইডা হাই স্কুল দিছি, একটা ব্যাটাছেলেদের একটা মেয়েদের। আমি কইলাম। এই কামডা ভালা করছেন। মওলানা সায়েব শুইয়া শুইয়া কথা কইতে আছিলেন। আমার কথা শুইন্যা উইঠ্যা বাইলেন। আমার চৌকের ওপর চৌক রাইখ্যা কইলেন তুমি কী কাইবার চাও। আমি জবাব দিলাম স্কুল দুইডা কইর্যা ভালা করছেন। মওলানা সাহেবের সেন্স আছিল খুবই কীন। আকারে ইঙ্গিতে কথা কইলেও ঠিক বুইঝ্যা নিতে পারতেন।
তারপর স্যার বেঙ্গলের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আলোচনা করতে লেগে গেলেন। তিনি বললেন, বেঙ্গলের এন্টায়ার এড়ুকেশন সিসটেমটাই টপ হেভি। এইখানে সাপোর্টিং কোনো কলেজ তৈয়ার করনের আগে এইটিন ফিফটি এইটে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তৈয়ার অইছে। একই রকম সাপোর্টিং স্কুল ছাড়া কলেজগুলা তৈয়ার অইছে। অখন গ্রামেগঞ্জে যেখানে যাইবেন দেখবেন কলেজ অইতাছে। এইগুলা কোনো কামে আইব না। আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল। শিক্ষার আসল জায়গাটাতেই নজর পড়ছে না কারও। বাঙালিদের যেরকম ডিগ্রির ক্রেজ, এইডা নতুন কোনো কিছু নয়। কলেজ তৈরি করার আগে ইউনিভার্সিটি তৈয়ার করার কারণে এই ক্ৰেজ জন্মাইছে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাইরে ইন্ডিয়ার অন্য কোনো অঞ্চলে এই ক্রেজ পাইবেন না।
স্যারের শিক্ষাসম্পর্কিত আলোচনা শেষ হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে স্যারের মতামত জানতে চাইলাম। তখনও শেখ সাহেব বেঁচে আছেন। স্যার একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন নাইন্টিন সিক্সটি নাইন থেইক্যা সেভেন্টি ওয়ান পর্যন্ত সময়ে শেখ সাহেব যারেই স্পর্শ করছেন, তার মধ্যে আগুন জ্বালাইয়া দিছেন। হের পরের কথা আমি বলবার পারুম না। আমি গভর্নমেন্টের কারও লগে দেখাসাক্ষাৎ করি না। সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তার লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন ত আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায়-কথায় আমি জিগাইলাম, আপনের হাতে তা অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। আপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে। জওহরলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গাইড়া তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশানে অপজিশান পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সীট পাইব না। আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম, আপনে অপজিশনরে একশো সিটি ছাইড়া দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেট্সম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।
দিন তারিখ সাল এসব আমার মনে থাকে না। আর আমি স্মৃতি থেকেই এসব কথা লিখছি। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মজহারুল হক মারা গেছেন। ড. হকের মৃত্যু রাজ্জাক স্যারকে খুব জখম করেছে। বারবার স্যার অর্থনীতি সম্মেলনে দেয়া তার ভাষণটির কথা বলছিলেন। সেই সময়ে সাহস করে ড. হক অনেকগুলো সত্য কথা বলেছিলেন, যা সকলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পেরেছিল। ড. হক রাজ্জাক স্যারের সতীর্থ কি ছাত্র ছিলেন সে খবর আমি কখনো তাকে জিগ্গেস করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতেও তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে উঠতে দেখিছি। মোজাফফর সাহেব ছিলেন রাজ্জাক স্যারের ছাত্র। অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। অন্য মানুষের কাছে আমি শুনেছি মোজাফফর সাহেব যখন উনিশশো বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে জেলে গিয়েছিলেন, রাজ্জাক স্যার তার পরিবারের আংশিক দায়দায়িত্ব বহন করতেন।
উনিশশো আটাত্তর কি উনআশি সালের দিকে হবে। কানাডার টরেন্টো কী অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক প্রফেসর ওয়াহিদুল হক রাজ্জাক স্যারের বাড়ির নিচতলায় থাকতে আরম্ভ করেন। তিনি জিয়া সরকারের মন্ত্রী-টন্ত্রী কিছু একটা হয়ে যাবেন। এরকম গুজব শোনা যাচ্ছিলো। পরে অবশ্য তিনি এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে অনেক পরের ব্যাপার। জিয়ার আমলে তিনি যখন এসেছিলেন, রাজ্জাক স্যারের বাড়িতে থাকতেন এবং আহারাদি করতেন। স্যারের বাসায় যাওয়া-আসা করতে গিয়ে ওয়াহিদুল হক সাহেবের সঙ্গে আমারও একরকম চেনাজানা হয়েছিল। সেবার তিনি দুমাসের মতো ছিলেন। ওয়াহিদুল হক সাহেব চলে যাওয়ার পর স্যারের কাছে একটা তদবির নিয়ে গেলাম। আমাদের চেনাজানা একটি ছাত্র কানাডার কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হওয়ার চেষ্টা করছিলো। ওয়াহিদুল হক সাহেবের মতো একজন নামকরা প্রফেসরের কাছ থেকে যদি একটা সুপারিশপত্র আদায় করা যায়, ছাত্রটির ভরতি হওয়ার পথ সহজ হয়। স্যারকে সমস্ত ব্যাপারটি খুলে বলেছিলাম। শুনেই স্যার মাথা দুলিয়ে বললেন, আমি পারুম না।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না স্যার এরকম অস্বীকার করলেন কেনো। তাঁর একটা অনুরোধে যদি ছাত্রের উপকার হয়। স্যার সে কাজটি করতে অসম্মত হবেন কেনো? অতীতে আমি অনেককেই এরকম সাহায্য করতে দেখেছি। আমার ধারণা হলো, স্যার না বললেও ভালো করে চেপেচুপে ধরলে শেষ পর্যন্ত তিনি ওয়াহিদুল হক সাহেবকে একটা চিঠি লিখবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে অনুরোধটা আমি তিন-চারবার করলাম। একদিন স্যার মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, এইখান থেইক্যা যাওনের পর ওয়াহিদুল হক আমার কাছে একখান পোষ্টকার্ডও লেখেন নাই। এইবার আসল ব্যাপার বুঝলাম।
প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ মরহুম ড. আবু মাহমুদও লিবিয়া থেকে আসার পরে রাজ্জাক স্যারের বাড়িতে থাকতেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মাহমুদের চাকুরি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক উপাচার্য ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে ড. আবু মাহমুদকে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করার আবেদন জানান। সেই আবেদনের কারণেই ড. আবু মাহমুদকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র দেয়া হয়। নতুনভাবে চাকুরিতে যোগ দেয়ার পর ড. আবু মাহমুদকেও রাজ্জাক সাহেবের নামে অনেক আজেবাজে কথা বলতে শুনেছি। প্রফেসর ওয়াহিদুল হক কিংবা ড. আবু মাহমুদকে অহেতুক খাটো করে দেখানো অথবা প্রফেসর রাজ্জাককে তাঁদের তুলনায় মহৎ করে দেখানোর জন্য এ বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হচ্ছে না। রাজ্জাক স্যারের কাছাকাছি থাকার সময় যেসব ব্যাপার আমি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি এবং যেগুলো স্মৃতি থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি, সেগুলো প্রকাশ করা আমার একটা দায়িত্বও বটে। মুখ্যত সে কারণেই প্রফেসর ওয়াহিদুল হক এবং ড. আবু মাহমুদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। স্যারকে এ নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করতে আমি শুনিনি।