দশম পরিচ্ছেদ
শ্যামার ইচ্ছা ছিল সাধের পর বৌকে বাপের বাড়ি পাঠাবেন। সাধের পর এই জন্যে যে–নইলে সাধের তত্ত্ব করতে হয়। সাধের খরচা আইনত শ্বশুরবাড়িরই। এখানে তিনি কোন মতে একখানা মিলের শাড়ি এবং পুকুরের মাছ ধরে পাঁচ ব্যঞ্জন ভাত দিয়ে সারতে পারেন কিন্তু কুটুমবাড়িতে তা চলবে না। দিতে গেলে একটু গুছিয়ে দিতে হয়। পাঁচজনে দেখবে, যেমন-তেমন করে দিলে নিন্দে হবে।
কিন্তু সাধের পর আর না। বাপের বাড়ির সাধ খেতে তো যেতেই হবে–অমনি ছেলে হয়ে আসবে একেবারে। প্রথম প্রসব হবার খরচটা বাপেরই করা উচিত–এই ওঁর ধারণা। যদিও সে কথা প্রত্যক্ষভাবে বলেন না। সামনে অন্য ওজর দেন, ‘ছেলেমানুষ–এই প্রথমবার, মা-বাপের কাছে থাকে, সেই-ই ভাল। নইলে ভয় পাবে। তাছাড়া–আমার এখানে কে-ই বা আছে বলো। এত কন্না কে করবে এখানে? খেঁদিটা থাকলেও না হয় কথা ছিল!’
তবে আসল কারণটা পরোক্ষে বলেন বৈকি!
অপরকে উপলক্ষ ক’রে বলেন।
‘সে কথা একশ’বার। মেয়ের বিয়ে দেবার সময় প্রথম বেন তোলার খরচটাও ধরে রাখতে হয়। শ্বশুরবাড়ির খরচা তো পড়েই রইল–বাপ মিসে প্রথমবারটাও করবে না! মেয়ে যখন হয়েছে তখন তো এসব খরচা ধরে রাখাই উচিত।’
কনক শোনে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। সে সাহস তার নেই। তবে উত্তরটা তার মুখের কাছে ঠেলাঠেলি করে। শ্যামা নিজে কোন মেয়েরই বেন তোলেন নি। মহাশ্বেতার প্রথম ছেলে হওয়ার সময় তার শাশুড়ীও এই মতলব এঁটেছিলেন, কিন্তু শ্যামা উচ্চবাচ্য করেন নি। হয়ত তবুও বাঁচতেন না, নিহাৎ ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, সাধের আগেই ছেলে হয়ে গিয়েছিল মহার। এ গল্প শ্যামাই করেছেন কতবার–হেসেছেন বলতে বলতে। কেমন জব্দ মহার শাশুড়ী, সে হসির এই অর্থ। ঐন্দ্রিলার বেলায় আনবার কোন কথাই ওঠে নি। তরুর তো এই সেদিন ছেলে হ’ল, কনকের সামনেই বলতে গেলে, কৈ, তাও তো শ্যামা তাকে আনবার নাম করেন নি। সে বেচারার শ্বশুরবাড়িতে তো তবু কেউ ছিল না। এমন কি সতীনও না–সেও সে সময় প্রসব হ’তে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। দাই আর পাড়ার লোকের ওপর ভরসা করে ছিল তরু।
কিন্তু শ্যামার ইচ্ছা যা-ই থাক–দেখা গেল ভগবানের ইচ্ছা অন্যরকম। মহাশ্বেতা তবু সাধের খরচাটা করায় নি কিন্তু এ বৌ সেটিও ষোল আনা করিয়ে নিয়ে শ্যামাকে বৃহত্তর খরচার মধ্যে ফেলে দিলে।
শ্যামার তরফ থেকে চেষ্টা ও যত্নের কোন ত্রুটি ছিল না, হিসাবমতো ন’ মাস পড়তেই প্রথম যে দিনটি পাওয়া গেল সাধের, তিনি সেইদিনই তাড়াহুড়ো ক’রে সেরে নিয়েছিলেন যজ্ঞির ব্যাপার কিছু নয়, বাইরের এয়োও কাউকে বলেন নি–মহাদের তিন জাকেই শুধু বলেছিলেন। মহা পাঁচটা এয়োর ধুয়া তুলেছিল, তাকে ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘পাঁচটাই যে করতে হবে, কে বললে? বেজোড় হলেই হ’ল!’
মহাদের বলার সুবিধা আছে। ওরা ঘরের লোক, তাঁর হালচাল অনেকটা জানে, খুব একটা নিন্দা করবে না। কাজটা সেরেছিলেনও যতদূর সম্ভব কম খরচে। পুকুরে ছিপ ফেলিয়েছিলেন আগের দিন কান্তিকে দিয়ে, একটা মাঝারি কালবোশ আর গোটা দুই বাটা মাছ উঠেছিল। তাইতেই কাজ চলে গিয়েছিল। পায়েসের জন্যে বাজার থেকে এক পো মাত্ৰ দুধ আনিয়েছিলেন–ইচ্ছে ছিল তাইতেই ফুটন্ত ভাত থেকে দুহাতা ফ্যানে-ভাতে ঢেলে দিয়ে গোটাকতক কুণ্ডুবাড়ির বাসি সন্দেশ গুঁড়িয়ে দেবেন; তার সঙ্গে খানকতক বাতাসা আর একটু কর্পূর দিলে কেউ টেরও পাবে না। সন্দেশগুলোয় একটু গন্ধ হয়ে গেছে সেইজন্যেই কর্পূর দেওয়া
কিন্তু অতকাণ্ড করতে হয় নি। মহাশ্বেতা মাকে ভাল ক’রেই চেনে, পাছে জায়েরা বাড়ি এসে টিটকিরি দেয় তাই ভোরবেলাই এক ছেলেকে দিয়ে লুকিয়ে একপোটাক দুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল। একটু একটু ক’রে সকলের দুধ থেকে কেটে নিলে কেউ টেরও পায় না–অথচ কাজ চলার মতো বেশ খানিকটা দুধ পাওয়া যায়। এ মহাশ্বেতার বহুদিনের অভ্যাস। জায়েরা যে জানে না তাও না, কারণ কোন কাজটাই সে গোপনে করতে পারে না, সে বুদ্ধিই তার নেই। আস্তে কথা বলতে পারে না–কাজেই কোন কথা কি কাজ লুকোবার চেষ্টা করলে আরও হাস্যাস্পদ হয়ে পড়ে। জায়েরা তাই জেনেও, কতকটা দয়া করেই, কিছু বলে না আজকাল। নিতান্ত ওর গায়েপড়া ঝগড়া খুব অসহ্য হ’লে মেজবৌ এক-আধাদিন বলে ফেলে। জোঁকের মুখে নুন দেবার মতোই চুপ করিয়ে দেয় এই খোঁটাটা দিয়ে। তারপর কেঁদে-কেটে চেঁচিয়ে লাফিয়ে যত প্রতিবাদই করুক মহাশ্বেতা, সেদিনের মতো ঝগড়াটা চাপা পড়ে যায়, এ চেঁচামেচিও বেশিক্ষণ থাকে না। অভিযোগটা এতই সত্য যে বেশিক্ষণ প্রতিবাদ করতে বোধ হয় নিজেরই লজ্জা হয় তার
অবশ্য অল্পস্বল্প খোঁচা দিতে কেউই ছাড়ে না। সেদিনও, কনকের সাধে খেতে বসে ভালমানুষ তরলাও বলেছিল, ‘দিদি, পায়েসটা ঠিক আমাদের বাড়ির মতোই হয়েছে, না?’
তাতে প্রমীলা মুখ টিপে হেসে বলেছিল, ‘কেন লো– আমাদের বরদা গয়লানীর দুধের বাস্ পাচ্ছিস নাকি?’
মহা তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘তোর যেমন কথা ছোট বৌ! অল্প দুধে পায়েস করা– তা আবার সেদ্ধ চালের, ও সব-বাড়িই এক রকম হয়।’….
এ পর্যন্ত ভালয় ভালয় কাটলেও বৌকে পাঠাতে একটু দেরি হয়ে গেল। পরের দিনই পড়ল গ্রহণ, গ্রহণের পর আট দিন যাত্রা নেই। তারপরই সংক্রান্তি মাস-পয়লা বৃহস্পতিবার– পরপর পড়ে গেল! শ্যামার ভাষায় ‘আমার কপালে যেন ভগবান সার সার সাজিয়ে রেখেছিলেন দিনগুলি!’ তার পরদিন পাঠাবেন সব ঠিক, বেয়াই-বাড়িও সে কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে– কিন্তু সেই বৃহস্পতিবারই হঠাৎ কনকের ব্যথা উঠল, আর সারা দিনরাত ব্যথা খেয়ে শুক্রবার ভোরে ছেলে হয়ে গেল তার।
অগত্যা পাড়ার দাইকে ডাকতে হল, আনুষঙ্গিক যা কিছু খরচ তাও করতে হল। শ্যামার ভাষায়– ‘এতটি গলে গেল। ছেলে এলই আমার সঙ্গে আচা-আচি করে– যেন মতলব এঁটে ঠাকুমার খরচ করাবে বলে। ও ছেলে যা হবে তা বুঝতেই পারছি। উঠন্তি মূলো পত্তনেই বোঝা যায়। হাড়-মাস ভাজা-ভাজা করে যদি না খায় তো কী বলেছি আমি। কে জানে, সেই মিন্সেই আবার আমাকে জ্বালাতে ফিরে এল কিনা। এদান্তে বেটার বৌকে খুব পছন্দ হয়েছিল তো– সেই বোয়ের কোলেই ফিরে এল বোধ হয়।’
শাশুড়ী যা-ই বলুন, কনকের কোন ক্ষোভ হয় না। কোন কথাই আর যেন তার গায়ে লাগে না।
ছেলে সুন্দর হয়েছে। কনকের মনে হয় বাপের মতোই সুন্দর হয়েছে। এক এক সময় মনে হয় আরও সুন্দর হবে। কান্তির কথা মনে পড়ে যায়, ওর বিয়ের সময় যেমন কান্তিকে দেখেছিল। শিউরে উঠে উপমাটা মন থেকে তখনই আবার যেন দু-হাতে ঠেলে সরিয়ে দেয়। বাপ্ রে, ও চেহারায় কাজ নেই তার। ঐ রকম বরাত পেলেই তো হয়েছে। ছেলের রূপ নিয়ে কি হবে, গুণটাই বড়। মূর্খ অকর্মণ্য না হয় ছেলে। সে যেমন করে হোক– ভিক্ষে দুঃখ করেও ছেলেকে মানুষ করবে, লেখাপড়া শেখাবে।….
শ্যামাও, বধূর সম্বন্দে মনে যতই বিদ্বেষ থাক, এই সব খরচপত্রের জন্য যত পরিতাপই হোক্– নাতি দেখে মন জুড়িয়ে যায়। তাঁর গর্ভের সন্তানরা বেশির ভাগই সুন্দর– তেমনিই হয়েছে এও। কান্তির মতো, ঐন্দ্রিলার মতো না হোক, বংশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যাবে। মনে মনে বার বার বলেন, ‘বাঁচুক, মানুষ হোক।… কপাল ভাল নিয়ে এলে থাকে তবে তো– আমার ছেলেমেয়েদের মতো কপাল না হয়!’
কিন্তু ভাগ্য যেমনই হোক, ছেলের আয়পয় যে ভাল না– সেটা বোঝা গেল শীগগিরই।
যষ্ঠীপূজো শেষ হ’তেই বৌকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন শ্যামা। বললেন, ‘এখন কিছুদিন নিয়মে থাকা দরকার। এখানে থাকলে অনিয়ম হবেই। আর বিশ্রামও পাবে না, কে করবে বলো? আমি না হয় রেঁধে ভাতটা যোগালুম, কাঁথাকানি তো আর কাঁচতে পারব না। সেখানে পাঁচটার ঘর– বোনরা আছে, পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকতে পারবে। আর খাওয়া-দাওয়াই বা আমার ঘরে কী আছে, ভাত হাঁড়ির ভাত, আলাদা কিছু করে দোব সে ক্ষমতা কৈ?…. তার চেয়ে মা-বাপের কাছে যাক, তাদের মেয়ে তারা যেমন করেই হোক একটা ব্যবস্থা করবে।…. আমি তো একটা দিক টানলুম– তারা এবার করুক না!’
সেইটেই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। এই ‘এতটি টাকা’ খরচ হয়ে গেল– আবার যদি পোয়াতিকে সারিয়ে তুলতে হয় তো রক্ষে নেই। কোন্ না অন্তত এক পো দুধ জোগানি করতে হবে– পোয়াটাক ঘিও চাই। লুচি হালুয়া না হোক, কদিন ভাত-পাতে একটু না দিলে লোকেই বা বলবে কি! তার চেয়ে ওদের ওপর দিয়েই যাক– চাই কি, মাস-দুই যদি চেপে থাকে তো তাঁর এদিকের খরচও খানিকটা উশুল হবে। হাজার হোক, একটা পেট তো বাঁচবে।
কিন্তু বৌকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে খবর এল হারানের খুব অসুখ– এদের কারুর যাওয়া দরকার। খবরটা দিলে চিরদিনের ভগ্নদূত মহাশ্বেতাই। ছোট ছেলেটাকে পাঠিয়েছিল গাছ-কতক নাজনে-ডাঁটা দিয়ে বোনের খবর নিতে তার মুখেই বলে পাঠিয়েছে তরু। কী অসুখ তা ছেলেটা ঠিক বলতে পারে নি তবে দেখে এসেছে মেসোমশাই শুয়ে আছেন, অসাড় অনড় হয়ে, মাসীমা কান্নাকাটি করছে।
খবরটা এল দুপুরে, তখন হেম অফিসে। কান্তি বাড়িতেই থাকে বটে, এখনও সে পড়াশুনোর চেষ্টা করে খানিকটা কিন্তু মার তাড়নায় কিছুই হয় না। মা তাকে সারাক্ষণই বাগানে খাটাতে পারলে বাঁচে। এদিকে বইও সব হাতে নেই, তার ওপর মাথাটাও কেমন হয়ে গেছে অসুখের পর থেকে– মাথায় যেন কিছু ঢুকতে চায় না। মুখস্থ করলেও দুদিন পরে ভুলে যায়। সে জন্যে শ্যামার যেমন দুশ্চিন্তারও অন্ত নেই, তেমন গঞ্জনারও না। সে গঞ্জনার ভাষা কানে না গেলেও আকারে-ইঙ্গিতে তার তীব্রতা বুঝতে পারে কান্তি, ফলে আরও যেন দিশাহারা হয়ে যায়। আরও অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে।
শ্যামা একবার ভাবলেন ওকেই পাঠাবেন, বললেনও ইশারায় কিন্তু তারপর নিজেই আবার বারণ করলেন। কোন লাভ নেই। ওঁরা দুজনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, উনি আর কনক– ওকে ঠোঁট নেড়ে কথাগুলো মোটামুটি বোঝাতে পারেন। এখনও হেমই পারে না– তরু তো পারবেই না। এই অবস্থায় ঠিক কতটা কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না তো, যদি বাড়াবাড়িই কিছু হয়ে থাকে তো তরু লিখে জানাবে সব কথা– সে সম্ভব নয়। তাছাড়া তরু তেমন লেখাতে পটুও নয়। মিছিমিছি কান্তিকে পাঠানো মানে তাদের উদ্ব্যস্ত করা তার চেয়ে হেমই আসুক। আজকাল ‘ওপর–টাইম’ না থাকলে সে সকাল করেই ফেরে প্রায়। সন্ধ্যার পরই পৌঁছে যায়। ঠাকুর ঠাকুর করতে লাগলেন শ্যামা, যাতে সকাল করেই ফেরে হেম। ওপর-টাইমে সামান্য, কিছু পয়সা আসে বটে, তা হোক, তবু আজ তা না থাকাই বাঞ্ছনীয়।…
ওভার-টাইম না থাকলেও– সেদিনই হেম ফিরল সামান্য একটু রাত করে। পোস্তায় গিয়েছিল, সস্তায় এটা-ওটা বাজার করতে। অবশ্য তাতে আটকাল না– তখন সবে আটটা, সিদ্ধেশ্বরীতলায় ঘড়ি দেখে এসেছে হেম– গিয়ে খবর নিয়ে আসতে সাড়ে দশটা এগারোটার বেশি হবে না। সে পুঁটলিটা নামিয়েই রওনা হয়ে গেল। অন্ধকার রাত– পথটাও খারাপ। কিছুদিন আগেই সামান্য কটা পয়সার জন্যে মানুষ খুন করেছে ডাকাতরা ঐ পথেই। মন চায় না পাঠাতে। বললেনও একবার শ্যামা, ‘এখন না হয় থাক, ভোরে তুলে দিলে– পারবি না ঘুরে আসতে?’
‘পাগল! তিন কোয়ার্টার এক ঘণ্টার পথ ভোরে গিয়ে আসব কেমন করে আফিসের আগ? কাল কামাই করাও চলবে না, কোন মতেই–বড়সাহেব আসবে আমাদের সেকশ্যানে। ও কিছু হবে না, আমি ঘুরে আসছি চট করে।
যেতে দিতেও যেমন ইচ্ছা করে না– বাধা দেবারও শক্তি নেই। শেষ পর্যন্ত শ্যামা জোর করে কান্তিকেও সঙ্গে দিলেন। শুনতে না পাক– দোসর তো থাকবে অন্ততঃ।
‘তুমি একা থাকবে?’ আপত্তি করে হেম।
সে আমি বেশ থাকব’খন– আমার জন্যে ভাবতে হবে না। তোরা ঘুরে আয়। দুগ্গা দুগ্গা!’
সদর দরজা ভাল করে বন্ধ হয় না, খিলটা কোনমতে ঠেকানো থাকে শুধু। একটা লোহা দা না কিনলে ওর কোন উপায়ও হবে না। কাঠটাও গেছে পচে, বহুকালের দোর জলে-রোদে জীর্ণ হয়ে এসেছে। নতুন লোহা লাগবেও না হয়ত। একেবারে দরজাটা পাল্টাবেন এই মনে করেই কিছু করা হয়নি। রাত্রে খিল বন্ধ করার পরও খান-দুই ইট নিচে ঠেকিয়ে রাখা হয়– কেউ ঠেলে ঢুকলে তবু আওয়াজ হবে। এখনও তেমনিভাবে বন্ধ করে রান্নাঘর আর বাইরের ঘরে শেকল তুলে দিয়ে দালানে এসে বসলেন শ্যামা। অন্যসময় কাজ না থাকলে আলো নিভিয়েই বসেন–অকারণে তেল পোড়ান না, আজ কুপিটা জ্বালিয়েই রাখলেন। যাবার সময় হেম একটু টুকে দিয়ে গেল বলেই– নইলে তাও রাখতেন না।
না, ভয় তাঁর শরীরী অশরীরী কোন প্রাণীকেই নেই। দীর্ঘকাল একা থেকেছেন, কাটিয়েছেন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে। হেম যখন হয়– গুপ্তিপাড়ার অতবড় বাড়িটায় সাতাশ বিঘে বাগানের মধ্যে বলতে গেলে একাই থাকতে হত। বুড়ো শাশুড়ী– সন্ধ্যেবেলাই ঘুমিয়ে পড়তেন। বড় বড় আমগাছ আর কালোজামের গাছে বাতাস লেগে চৈত্র-বৈশাখ মাসে যখন সোঁ সোঁ আওয়াজ করত, উঁচু তালগাছগুলোর পাতায় আপনা- আপনি কটকট শব্দ উঠত– কত কী নাম-না জানা প্রাণীর বিচিত্র গতিবিধির আভাস পাওয়া যেত বাইরের অন্ধকারে– তখন ভয়ে বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে আসত এক-একদিন। প্রাণপণে ছেলেকে বুকে চেপে ধরে তাকে কাঁদিয়ে দিতেন, সেই কান্নার শব্দে শাশুড়ী যদি সজাগ হন, দুটো কথা বলেন এই আশায়।
হয়ত সব শব্দই সত্যও নয়, হয়ত অনেকখানিই কল্পনা– কিন্তু সেদিন অত বুদ্ধি হয় নি। নানারকম শব্দ পেতেন সত্যি সত্যিই। অন্ধকারে জানলার সামনে বড় বড় গাছগুলো আকাশ আড়াল করে যেন কী এক বিভীষিকার মতোই দাঁড়িয়ে থাকত। তার ওপর তার কন্দরে কন্দরে যখন জোনাকিগুলো দপদপ করে জ্বলত আর নিভত, যেন আরও ভয়ঙ্কর মনে হত সেগুলোকে। মনে হত– এত গাছপালা কী করতে হতে দেয় মানুষ? ফল খেয়ে কাজ নেই, তাঁর নিজের বাড়ি হলে জন ডেকে কালই গাছগুলো কাটিয়ে দিতেন!
তবু অন্ধকার একরকম। তাঁর আরও ভয় করত চাঁদনী রাত হলে। অসংখ্য পত্রপল্লবের ছায়ায় যেটুকু আলো নামত বাগানে, তাতে সবটা পরিষ্কার দেখা যেত না, খানিকটা আবছায়ার সৃষ্টি করত শুধু। গাছের ডালপালা কাঁপার সঙ্গে তাদের ছায়াও কাঁপত, মনে হত কত কী অশরীরী প্রাণী যেন চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক এক সময় আলোছায়ার বিচিত্র যোগাযোগে সত্যিই মনে হত একটা কে লোক দাঁড়িয়ে আছে– আর একটু পরে কিম্বা কাছে গেলে দেখা যেত না, ভূত দেখেছেন মনে করে কতদিন দৌড়ে পালিয়ে এসে ঘরের দোর দিয়েছেন কিম্বা আলো ছুঁয়ে বসে থেকেছেন। লোহা ছুঁলেও নাকি অপদেবতারা কিছু করতে পারে না, আর হাতেই লোহা আছে তাঁর– একথাটা সেদিন কিছুতে মনে পড়ত না। আজ দেখে দেখে বুঝেছেন ওগুলো শুধুই আলো-আঁধারির মায়া– অশরীরী কিছু আছে কিনা তা তিনি জানেন না, থাকলেও তারা শরীর ধরে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে না।
ও বাড়িটায় আবার এমন ব্যবস্থা, রাত্রে কোন প্রাকৃতিক কাজের দরকার পড়লে বাগানে বেরোনো ছাড়া উপায় থাকত না। সহজে শ্যামা বেরোতেন না, কিন্তু অসুখবিসুখ করলে বেরোতেই হত। সেই সময়গুলো যেন কান্না পেত তাঁর। শাশুড়ী দাঁড়াতেন ঠিকই– কিন্তু সেটা শুধুই দাঁড়ানো– তিনি প্রায়ই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলতেন আমি এই চেয়ে রয়েছি বৌমা, ভয় নেই, তুমি নির্ভরসায় চলে যাও!’
কিন্তু ভয়টা তা শুধু অশরীরী প্রাণীরই নয়–শরীরী প্রাণীরাও তো নেহাৎ কম যেতেন না! সাপ-খোপ তো আছেই, বাঘ বেরোনোও তখন ও অঞ্চলে খুব অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। একবার মনে আছে– উনি পাইখানায় গিয়েছেন বাগানের মধ্যে––ফেউ ডেকে উঠল একেবারে পাশেই। শাশুড়ী চেঁচাচ্ছেন– ‘বৌমা পালিয়ে এস, পালিয়ে এস’–তাঁর একবারও মনে হচ্ছে না যে পালিয়ে আসতে গেলে অন্তত বিঘে দুই জমি পেরিয়ে আসতে হবে– হয়ত বা বাঘের সামনে দিয়েই। তবু যেতেই হয়েছিল তাই– ডাক ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঐ পথটা ছুটে গিয়েছিলেন, হয়ত তাঁর চিৎকারেই বাঘ সরে গিয়েছিল।
তারপর পদ্মগ্রামে এসেও কম সইতে হয় নি তাঁকে। রাতের পর রাত ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেখানে দাঁড়াবারও লোক ছিল না কেউ, তাঁকেই দাঁড়াতে যেতে হত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। সরকারবাড়ির বাগানের মধ্যেই ছিল বটে ঘরখানা, তবু ওঁদের মূল বাড়ি থেকে একেবারে আলাদা– অনেকটা দুরে। মন্দিরের গায়ে পূজুরীর ঘর– এইভাবেই করানো; ব্রাহ্মণদের দূরেই রাখতে চেয়েছিলেন কর্তারা– যাঁরা ঘর তৈরি করিয়েছিলেন। মঙ্গলা স্পষ্টই বলতেন, ‘বাপরে, বামুন হল গে জাতসাপ, ওদের নেপ্চোয় কি থাকতে আছে। কত কি কথা ওঠে, কথার পিঠে কথা– কী বললুম না বললুম– অমনি হয়তো মন্যি দিয়ে বসে রইল। এক বাড়িতে থাকতে দুরন্ত ছেলেপুলে ঘরে-দোরে ঢুকবে কী সব অত্যাচার করবে, হয়ত হুঁশ রইল না গায়ে পা-ই লাগিয়ে বসল– সে পাপের বোঝা কে বইবে বলো? না, ও ঐ দূরে দুরে থাকাই ভাল।’
তারপর মুচকি হেসে, কৃষ্ণযাত্রায় শোনা গানের একটা কলি গেয়ে উঠতেন হয়ত ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় ‘দূরে রহু দুরে রহুঁ প্রণাম হামার!
সেই ঘরে, সেই বিজন অরণ্যের মধ্যে বলতে গেলে দীর্ঘকালই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এতটুকু এতটুকু বাচ্ছা নিয়ে, একদিনে ওরা বড় হয় নি, তিল-তিল সংগ্রাম করতে হয়েছে ওদের বড় করতে। দিনের পর দিন যখন অন্ন জুটত না, তখন একা ঐ অন্ধাকার বাগানে ঘুরে বেড়াতে হত যদি একটা পাকা তাল কি একটা ঝুনো নারকেল কুড়িয়ে পাওয়া যায়–এই আশায়। গন্ধ শুঁকে শুঁকে আতা-পেয়ারা গাছে পেকেছে টের পেয়ে অন্ধকারেই হাড়ে হাড়ে পেড়ে এনেছেন। অথচ কী না ছিল সে বাগানে, সাপ, গোসাপ, শিয়াল, বিছে– আরও কত কী। কিন্তু সেদিন ভয় করলে চলত না বলেই বেরোতে হয়েছে। এমন কিছু দুঃসাহসী তিনি ছিলেন না, মানুষ, বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ– সকলকেই ভয় করতেন, ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করত, তবু যেতে হ’ত। আর সেই ভাবে যেতে যেতেই ভয়টা কমেছে তাঁর– কেমন একটা ভরসা এসেছে মনে– তাঁর কিছু হবে না।
ভয় তাঁর কাউকেই নেই আজ– অদৃষ্টকে ছাড়া। অদৃষ্ট খারাপ বলেই– বহু দুর্ভোগ কপালে লেখা আছে বলেই জেনেছেন যে, তাঁর কিছু হবে না। সহজে অন্তত মরবেন না তিনি। মানুষ, জানোয়ার, ভূত– কেউই কিছু করতে পারবে না। তাঁর ভয় তাঁর এই কপালটাকেই, কে জানে আরও কী আছে অদৃষ্টে! আরও কী দুর্দিন কী দুর্ভাগ্য তোলা আছে তাঁর জন্যে।…..
চুপ করে বসেই রইলেন শ্যামা। দালানের দরজা বন্ধ করেন নি বটে কিন্তু সামনেই কুপির আলো, সেটা ডিঙ্গিয়ে অন্ধকার উঠোনে কিছুই ঠাওর হয় না। তা না হোক, তার জন্য ব্যস্তও নন তিনি। তিনি স্থিরভাবে চেয়ে আছেন কুপির ঐ কম্পমান শিখাটার দিকেই।
বাইরে নিশুতি হয়ে এল ক্রমে। মল্লিকবাড়ির ঝি-চাকররা এ সময়টা প্রায়ই কলহ- কেজিয়া করে রান্নাঘরে বসে– ওঁদের পিছন দিকেই ওদের রান্নামহল– তারাও চুপ করে গেছে– বোধহয় শুয়েই পড়ল। ভূতি মল্লিকদের মাতলামির দাপাদাপি চিৎকারও স্তিমিত হয়ে এল একটু একটু করে। মহাদেবের দিদিমা ঘাটে বাসন মাজতে এসেছিল– জলের ছপছপ আওয়াজে টের পেয়েছিলেন শ্যামা– সেও সম্ভবত বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ল এতক্ষণে। এ পথে পথিক কেউ হাঁটে না রাত আটটার পর এ পাড়ায় তাঁর ছেলেই সবচেয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে– সুতরাং কারুর হাঁটার শব্দ পাবেন সে সম্ভাবনা নেই।
তবে মানুষের প্রাণলক্ষণ না থাক– অন্য জীবিত প্রাণীর অস্তিত্বের অভাব ছিল না। শব্দেরও না। মানুষ যখন নিস্তব্ধ হয় তখনই বোধহয় ওরা বেশি করে কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। এইটেই বোধ হয় ওদের নিশ্চিন্ত হয়ে বিচরণ করার অবসর, জীবনটা উপভোগ করার সময়। এখনই ওরা যেন বাঁচার মতো বাঁচে।
ঝিঁ ঝিঁ-পোকা সন্ধ্যে থেকেই ডাকে, অশ্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন, কিন্তু তখন কানে লাগে না, এখন মনে হচ্ছে অসহ্য। বাগানের শুকনো পাতার ওপর দিয়ে একাধিক গো-হাড়গেল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাপের সামান্য শব্দ এ নয়, রীতিমত ভারী কিছু যাওয়ার মড়মড় শব্দ। শিয়াল ডেকে উঠছে থেকে থেকে। অনেকের ধারণা ওরা শুধুই প্রহরে প্রহরে ডাকে, এখানে বাস করলে সে ভুল ভাঙ্গত তাদের। প্রায়ই ডাকে ওরা, সময়ে অসময়ে। মল্লিকদের বাড়ির কার্নিসের কোণ থেকে পেঁচা-দুটোর কর্কশ কণ্ঠস্বর উঠছে– বোধহয় এখন কী একটা ছোট পাখি ধরেছে ওরা, তার করুণ চিঁচিঁ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটু পরে থেমে গেল আবার। মরে গেছে পাখিটা। কোথায়– দূরে কোথাও দুটো বেড়ালে ঝগড়া করছে, তারও শব্দ শুনছেন শ্যামা। মাছে ঘাই দিচ্ছে মধ্যে মধ্যে পুকুরের জলে আলোড়ন জাগিয়ে। হয়ত ভামে খাচ্ছে মাছ। কে জানে!
এই সব শব্দই অন্য দিন হয়। বেশি রাত অবধি জেগে থাকা শ্যামার কাছে নূতন নয় কিছু, অন্যদিন এমনভাবে তাঁর কানে যায় না। সে সব দিনে অন্য চিন্তা থাকে, সেই চিন্তাতেই জেগে থাকেন। আজও চিন্তা আছে– কিন্তু সেই চিন্তাটাকেই তাড়াতে চাইছেন তিনি মন থেকে, মাথা থেকে। সেই জন্যেই প্রাণপণে কান পেতে আছেন বাইরের দিকে, কোথায় কি শব্দ হচ্ছে শোনবার চেষ্টা করছেন। চিন্তার সঙ্গে তিনি যেন ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছেন তাঁর ভাগ্যকেও।
তাঁর কপালে ভাল কিছু নেই তা তিনি জানেন। খবর যা আসবে তাও আঁচ করতে পারছেন। কিন্তু সে যখন আসবে তখন আসবে– এখন থেকে সে কথা ভাবতে চান না।
হঠাৎ কী একটা দমকা বাতাস উঠল। একেবারে আকস্মিক। মা বলতেন নিস্তব্ধ রত্রিতে এমনি দমকা হাওয়া তুলে পরিচিত মানুষের আত্মা চলে যায়। যাওয়ার পথে আত্মীয়-বন্ধুকে জানিয়ে দিয়ে যায় তাদের অস্তিত্ব। কে জানে কার আত্মা, চলে গেল এ বাড়ির ওপর দিয়ে। মার? নরেনের? তাঁর শাশুড়ীর? কী বলতে চাইল সে আত্মা, কোন্ নূতন বিপদের আভাস দিয়ে গেল, সতর্ক থাকতে বলল!…..
সে মর্মর শব্দ যেমন হঠাৎ উঠেছিল তেমনি হঠাৎই থেমে গেল। গাছপালাগুলো কিছুক্ষণ পত্রপল্লব নেড়ে স্থির হয়ে গেল আবার। শুধু বাঁশগাছের ডগাগুলো অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাদের কান্ডে কান্ডে কটকট শব্দ তুলে আন্দোলিত হতে লাগল।
॥২॥
ছেলেরা ফিরল রাত বারোটারও পর।
বিপদ একটা নয়– অনেকগুলো।
হারানের অসুখটাও বাঁকা। হঠাৎ পাঁচ-ছয় দিন আগে খেয়ে উঠে কী একটা ব্যাপার নিয়ে বড়বৌয়ের সঙ্গে চেঁচামেচি করতে গিয়ে মাথায় খুব যন্ত্রণা টের পায়। দুহাতে মাথাটা ধরে বসে পড়ে উঠোনেই। সেদিন নাকি অফিস থেকে ফিরেও রাগারাগি করেছিল। কিছু না খেয়েই ক্লাবে গিয়েছিল রিহার্সাল দিতে। সেখানেও চেঁচাতে হয়েছে অনেকক্ষণ, ফিরে এসে ভাত খাওয়ার পর হঠাৎ চেঁচাতে গিয়েই এই বিপত্তি। কিন্তু শুধু মাথার যন্ত্রণাই নয়। ওকে বসে পড়তে দেখে ছুটে এসে দুই বৌ ধরতে গিয়ে দেখে নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। খুব বেশি নয়– তবে নাকি নিতান্ত দু-এক ফোঁটাও নয়। তখন আর কিছুই করা যায় নি, ঘরে এনে শুইয়ে মাথায় জল দেওয়া ও বাতাস করা ছাড়া। অত রাত্রে কে-ই বা ডাক্তার ডাকতে যাবে। নিবড়েয় তেমন কোন ডাক্তারও নেই। এখানকার কোন ডাক্তারকে খবর দিলেও যেত না সে সময়ে।
যাই হোক– সে রাত্রে হারান আর কোন উচ্চবাচ্য করেনি, একটু অস্ফুট গোঙানি ছাড়া। ওরা প্রশ্ন করে উত্তর পায় নি, ভেবেছে মাথার যন্ত্রণার জন্যই উত্তর দিচ্ছে না। সকালে বুঝেছে যে তা নয়, অজ্ঞানের মতো হয়ে আছে। তখন বড় বৌ কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি গেছে খবর দিতে, তরু পাড়ার লোক ডেকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছে।
ডাক্তার আর শ্বশুর একসঙ্গেই এসেছেন। শ্বশুর দেখেশুনে মুখের ওপরই বলেছেন, সন্ন্যাস রোগ– ও আর বাঁচবে না। ডাক্তার অতটা হতাশ করেন নি, তবে তাঁরও মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। কী সব ওষুধ দিয়ে কতকটা জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছেন কিন্তু দেখা গেছে যে হাত- পা আর কিছু নাড়তে পারছে না, কথাও কইতে পারছে না। কথা কারও বুঝতেও পারছে কিনা সন্দেহ। পক্ষাঘাতের মতোই সব লক্ষণ। ডাক্তার বলেছেন যে, সন্ধ্যা থেকে রাগারাগি করে আর চেঁচিয়ে মাথায় রক্ত চড়ে ছিল, তার ওপর আবার চেঁচাতে গিয়ে এই বিপত্তি মাথার কোন শির ছিঁড়ে গেছে, এই তাঁর বিশ্বাস। বলেছেন প্রাণের ভয় এখনও যায় নি। তবে হয়ত বাঁচিয়ে দিতে পারবেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু আগের মতো সহজভাবে আর চলে- ফিরে বেড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ।
বিপদের ওপর বিপদ– শ্বশুর এসে জামাইবাড়িতে জেঁকে বসে আছেন, সুতরাং তিনিই এখন অভিভাবক। খরচপত্র সব তাঁর হাতে, তিনিই সব করছেন। তরুর বিশ্বাস বুড়ির সিন্দুকে আর হারানের আলমারীতে নগদ টাকা ঢের ছিল, বুড়ির দরুন কিছু গয়না তো ছিলই– সেই জন্যেই হারান কোনদিন বাড়িতে চাবি রেখে যেত না। বুড়ি মরার পর থেকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরত। শ্বশুর এসে প্রথম দিনই চাবির গোছা হস্তগত করেছেন। এবং প্রকাশ্যে মেয়ের গহনা সব নিজের বাড়িতে রেখে এসেছেন বাক্স সুদ্ধ। কিন্তু তরু বলে যে, তার মধ্যে ওর সতীনের গহনা ছাড়াও অনেক জিনিস তিনি বই করেছেন। বুড়ির দরুন যা কিছু ছিল সবই। এ-ছাড়াও অফিস থেকে ওর বন্ধুদের সাহায্যে টাকাকড়ি নিয়ে এসেছেন খানিকটা, অসুখের অজুহাতে। সকলেই যথাসাধ্য সাহায্য করেছে। তরু একেই ভীতু আর লাজুকে, তবু সর্বনাশ হয় দেখে একটু মৃদু প্রতিবাদ করতে গিছল। তিনি চাবির গোছা ফেলে দিয়ে বলেছেন, অফিসের টাকা না পেলে তো চিকিচ্ছেই চলত না, ঘরে তো কিছুই ছিল না। সিন্দুক আর আলমারী তো নামেই– ভেতরে তো ঢু-ঢু, অষ্টরম্ভা। বিশ্বাস না হয় খুলে দ্যাখো না।’
মরিয়া হয়ে তবু বলতে গিছল তরু যে, সে নিজে দেখেছে সিন্দুকে নগদ টাকা আর গিনি ছিল, আলমারীতেও কিছু কিছু টাকা রাখত হারান। এরই মধ্যে সব ফুরিয়ে যাবার কথা নয়– কিন্তু কথা শেষ করার আগেই ওর সতীন তেড়ে এসেছে, তবে কি তার বাবা মিছে কথা বলছেন? তরু কি বলতে চায় তিনি চুরি করেছেন সে টাকা?
তেড়ে এসেছেন সতীনের বাবাও। তাঁর সে সময়কার ভয়ঙ্কর চোখমুখের চেহারা দেখে তরুর মনে হয়েছে যে তিনি হয়ত ওকে মারধোরই করবেন।
শুধু তাতেই ক্ষান্ত হন নি, আজই নাকি বিকেলে ওকে শুনিয়েছেন, ‘যে রকম ঘটায় চিকিৎসা হচ্ছে, টাকা যা পেয়েছি, তাতে আর কদিন? এরপর তো তোমার গয়না বেচতে হবে। তোমার ছেলে হয়েছে, বিষয়-সম্পত্তি তো সবই সে পাবে। ওর তো মেয়ে আশাভরসা বলতে তো ওর কিছুই নেই, ঐ গয়না কখানা ছাড়া। সেও তো আমারই দেওয়া। ওতে তো আর হাত দিয়ে বলতে পারি না! ওরও তো সারা জীবন পড়ে রইল। মেয়েটা যদি বাঁচে, তার বিয়েও দিতে হবে।…. না, ওর কাছ থেকে কিছু পিত্যেশ করো না। সোয়ামীকে যদি বাঁচাতে চাও তোমাকেই টাকা বার করতে হবে!’
এ-ও সব নয়, ছেলেটা নাকি গত দুদিন একজুরী হয়ে আছে। জ্বর বাড়ছেও না কমছেও না– ছাড়বারও কোন লক্ষণ নেই। তার কোন ওষুধের কথা তো কেউ চিন্তাই করছে না– এখন আরও কিছু খারাপ না হলে হয়। তরু ঠিক মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি– কিন্তু হেমের মনে হল সে একটু কিছু ভয় করছে। তার মনে হচ্ছে হয়ত যে সতীনের দিক থেকে ছেলেটাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করাও বিচিত্র নয়।
দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে হেম চুপ করল। তার বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে যে সে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ভোর ছটায় খেয়ে গেছে, এখনও পেটে কিছু পড়ে নি। অফিসে সে কোনদিন কিছু খায় না, জলখাবারের বিলাসিতা এখনও অভ্যাস হয় নি তার। দুবেলা দুমুঠো ভাত ছাড়া নিজে থেকে কিছু খায় না। বড় মাসীমার বাড়ি গেলে তিনি হয়ত কিছু খেতে দেন। আজ তাও যায় নি, উল্টে বাজারে বাজারে ঘুরছে। তার ওপর এই দীর্ঘ পথ হাঁটা। কিন্তু শুধু শারিরীক ক্লান্তিই নয়– মনে মনেও আজ যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সেটা ওর মুখের চেহারা দেখেই টের পাচ্ছেন শ্যামা। মনের জোর আর কিছুমাত্র নেই, শরীরের চেয়েও মনই বেশি অবসন্ন হয়ে পড়েছে।
কান্তিরও দুই চোখ ছলছল করছে, সামান্য আলোয় ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু তাঁর মনে হল চোখ দুটো অস্বাভাবিক লালও হয়ে উঠেছে। হয়ত পথে আসতে আসতে কেঁদেছে কিম্বা প্রাণপণে কান্না চাপার ফলেই অত লাল। এসে পর্যন্ত আলোটার দিকে চেয়ে বসে আছে চুপ করে। আরও ওকে যেটা পীড়ন করছে সেটা ওর উপায়হীনতার লজ্জা– এবং গ্লানিও। ওর মনের মধ্যেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শ্যামা।…. কিছুই করতে পারছে না সে, কিছুই করবার নেই। কোন কাজেই লাগাতে পারছে না এদের, আর হয়ত পারবেও না কোন দিন……
এরা সকলেই মুহ্যমান, এরা সকলেই বিচলিত কিন্তু শ্যামা সে রকম কিছু বোধ করছেন না কেন! খুব যে একটা দুশ্চিন্তা, একটা দুঃখ–কৈ, তেমন মনে হচ্ছে না তো। বরং বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন ওদের, লক্ষ করছেন। মনে হল এদের অলক্ষে একবার বুকটা টিপে দেখেন–ভেতরের মতো বাইরেটাও পাথর হয়ে গেছে কিনা।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা বলে ফেললেন শ্যামা, ‘অনেক রাত হয়ে গেল তো, বোধহয় বারোটা একটা হবে– মুখ হাত ধুয়ে নে, তোদের ভাত দিই। হেম চমকে উঠল ওঁর কথা শুনে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে দেখল মার মুখের দিকে। এতক্ষণ কি এসব কথা কিছুই শোনেন নি? না, বহু আঘাতে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? অমন নির্বিকারভাবে বসেই বা আছেন কী করে? যেন অপর কারও কথা বলা হচ্ছে! ওর নিজের মেয়ে নয়– পরস্যাপি পর কেউ!
শ্যামা কিন্তু প্রস্তাব করেই দাঁড়িয়েছেন। ওঁর কথা শোনে নি কান্তি– হঠাৎ ওঁকে সহজভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে সেও চমকে উঠল। অবাক হয়ে মুখের দিকে চাইল সেও।
শ্যামা হাতটা মুখে তোলার ভঙ্গি করে ইশারায় ওকেও বললেন, ‘হাত-পা ধুয়ে নে ভাত দিই।’
হেম যেন একটু বিরক্ত কণ্ঠেই বলল, ‘তোমার তো সেই সকালের ভাত-ব্যান্নন, সে কি এখনও আছে? সে-তো পচে বজ্কে উঠেছে এতক্ষণে। আর থাকলেও এত রাত্রে খেতে পারব না। এক গ্লাস জল দাও, তাহলেই হবে।’
কনক চলে যাওয়ার পর থেকে দুবেলা আর রাঁধেন না শ্যামা– বেলায় যা রাঁধেন তাই এই দু’ভায়ের জন্যে রেখে দেন। সন্ধ্যাবেলা এসে হেমকে প্রত্যহই কড়কড়া ভাত খেতে হয়। আজ সে ভাতের কী অবস্থা হয়েছে তা বুঝতে পারছে সে।
শ্যামাও তা বুঝলেন। তিনি আর দ্বিরুক্তি করলেন না। আগের দিন মল্লিকরা কী উপলক্ষে হরির লুঠ দিয়েছিল– তারই কখানা বাতাসা দিয়ে গেছে। সেই বাতাসা কখানা বার করে দিয়ে দু’ঘটি জল গড়িয়ে দিলেন ঘড়া থেকে। একহাতে সব কাজ সারতে হয় বলে খুদ ভাজার লাডুও করতে পারেন নি কদিন– ফলে খাবার মতো আর কিছু ঘরে নেই।
হেম মুখ-হাত না ধুয়ে সেই অবস্থাতেই দুখানা বাতাসা মুখে দিয়ে ছোট ঘটির পুরো একটি ঘটি জল খেল। এত যে তেষ্টা পেয়েছে তা সে নিজেও এতক্ষণ বোঝে নি।
জল দিয়ে শ্যামা দাঁড়িয়েই আছেন। অর্থাৎ শুয়ে পড়তে চান এবার। হেম চলে গেলে দোর দিয়ে শুয়েই পড়বেন হয়ত।
সে আবারও মার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। সত্যিই কি মার মাথার গোলমাল হয়ে গেল?
একটু ইতস্তত করে আবার সে নিজেই কথাটা পাড়ল, ‘কান্তি একটা কথা বলছিল আসতে আসতে বলছিল এখানে এ রোগের যে ঠিক ঠিক চিকিৎসা হচ্ছে তা তো মনে হয় না। তার চেয়ে, খরচ তো হচ্ছেই পাল্কী করে এনে ট্রেনে তুলে কোন মতে ধরাধরি করে কলেজে নিয়ে গিয়ে ফেললে কি হয়?’
এবার শ্যামা কথা কইলেন। মনে হল যেন একটা অন্ধ আক্রোশে দুই চোখ জ্বলে উঠল তাঁর। সে আক্রোশ তাঁর ভাগ্যবিধাতার ওপর। সামনে পেলে বাঘিনীর মতোই নখে- দন্তে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন হয়ত–
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘এসব করবে কে? তুমি তো আপিস নিয়ে আছ, আর ও তো ঐ– না মনিষ্যি না জানোয়ার। যা পার করো– আমি আর ও নিয়ে মাথা ঘামাতে পারব না। ঢের মাথা ঘামিয়েছি, ঢের ভেবেছি। আর না। আর আমি ভাবতে পারি না। ভেবেই বা কি হবে?…. যতই যা করো– ও যা হবে তা তো আমি জানিই। আমার ভাল কিছু হয় না কোন দিন। এও হবে না। কেউ থাকবে না আমার, কেউ না–। শুধু আমি রাক্ষুসী চারযুগ বসে থাকব সবাইকে খেতে, সকলের সর্বনাশ দেখতে–’
বলতে-বলতে এতক্ষণ পরে দুই চোখ ছাপিয়ে হু-হুঁ করে জল নামে তাঁর। ললাটে করাঘাত করতে থাকেন সজোরে। হাহাকার করে কেঁদে ওঠেন।
হেম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
পরের দিন ভোরবেলা অফিস যাবার পথে হেম ডাক্তারের বাড়ি হয়ে গেল। পাড়ারই ডাক্তার–বড় ডাক্তারের ছেলে, ভাল প্র্যাকটিস। এত ভোরে দেখা পাবার কথা নয়– তবে সে শুনেছিল ডাক্তারের পূজোপাঠের অভ্যাস আছে, হয়ত ভোরেই ওঠেন। দেখা পেয়েও গেল সে। অত সকালেই ঘাটে স্নান করতে যাচ্ছিলেন ডাক্তার–দেখা হয়ে গেল। তিনি প্রস্তাবটা শুনে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘আমার তো মনে হয় না এ ঝুঁকি আপনাদের নেওয়া উচিত। হার্টের অবস্থা খুব ভাল নয় এখনও– অত টানা-হেঁচড়া কি সইবে? এখান থেকে একেবারে গাড়িতে নিয়ে যেতে পারতেন কিম্বা পাল্কীতে– সে আলাদা কথা। তাও রাস্তা যা, গাড়িতেও নিয়ে যেতে বলি না। ঝাঁকানিতেই দফা রফা। পাল্কীও বোধহয় কলকাতা পর্যন্ত যেতে রাজি হবে না। তাছাড়া সেও পাল্কীতে তোলা নামানো কম কাণ্ড নয়– ও-তো হাত-পা কিছুই নাড়তে পারছে না। কলকাতা হলে র্যাম্বুলেন্স ডাকতে পারতেন। এখানে তো সে ব্যবস্থা নেই!’
তবু হেম বাড়ি ফিরে সন্ধ্যাবেলা অনেক ঘুরে দেখল। কোন পাল্কীওলাই রাজি হল না যেতে। কলকাতায় গেলে নাকি পুলিশে বড় দিক্ করে, সে হ্যাঁঙ্গামে ওরা যেতে রাজি নয়। তাছাড়া রুগী নিয়ে যাওয়া–যদি পাল্কীতেই মরে যায়? তাহলে ওদের পাল্কীতে কেউ চড়বে না।
খুব পীড়াপীড়ি করতে একজন পঞ্চাশ টাকা হেঁকে বসল।
অর্থাৎ না যাওয়ারই মতলব। সুতরাং কিছু করা গেল না।
রাত্রে হেম গিয়ে কান্তিকে রেখে এল তরুর কাছে। তবু একটা দোসর। আর কিছু না হোক, ছুটে এসে খবরটাও দিতে পারবে। ওকে কাগজে লিখে ওখানের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে দিলে একটু, যাতে একটু নজর রাখতে পারে হারানের শ্বশুরের ওপর। ছেলেটাকেও একটু দেখতে পারবে কান্তি
খানিকটা ইতস্তত করে শ্যামার কাছেও কথাটা পাড়ল, ‘তুমি একবার গেলে বোধহয় ভাল হত। অতটা পারত না ওরা।…. বিপদের সময় জামাইবাড়ি বলে সঙ্কোচ করতে গেলে চলে না।’
কিন্তু শ্যামা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, না। আর পারাপারির কিছু নেইও। যারা জামাইয়ের মরণ টেঁকে আগেই টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করে, তারা এত বোকা নয় যে রয়ে-বসে নেবে। যা করবার তা করেই ফেলেছে। হরিনাথের বেলা নিজের মা-ভাইই ঠকিয়ে নিলে এ তো শ্বশুর। …. মিছিমিছি আমি গিয়ে নিমিত্তের ভাগী হতে চাই না, ওরা মজা পেয়ে যাবে, বলবে ও মাগীও সরিয়েছে।’
অগত্যা হেমকে চুপ করে যেতে হয়।
অভয়পদকে বলতে হবে কথাটা। তার একটা পরামর্শ নেওয়া দরকার।
॥৩॥
শরৎ খবরটা পেলেন গোবিন্দর কাছ থেকে। ওদের বাড়িও আসতে পারে নি হেম, কাকে দিয়ে যেন খবর দিয়েছে। গোবিন্দ আপিস থেকে ফেরার পথে বলে গেল।
তখন উমা ছিলেন না। ফিরে এসে স্বামীর মুখে শুনলেন সব। আগে বলেন নি শরৎ, রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বললেন।
উমা শুনে চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘যা শুনছি তাতে তো আশা-ভরসা বিশেষ আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদি বা অন্য লোকের ক্ষেত্রে বাঁচত, ছোড়দির যা বরাত।….ঐ মেয়েটাও না আবার ঘাড়ে চাপে!…কেউ তো নেই শুনেছি জামাইয়ের তিন কুলে, আর কে-ই বা দেখবে?… যদি অমনি অনড় হয়ে পড়ে থাকে, সে তো আরও বিপদ। তখন ওকে সুদ্দু টেনে এনে তুলতে হবে। যা পিশাচ শ্বশুর প্রথম পক্ষের– সে ঘেঁষ নেবে না।… তাই তো!’
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘আহা, বড্ড ভালমানুষ মেয়েটা, সাত চড়ে রা করে না। ওর কপালেই কি যত দুর্ভোগ!…. একে তো ঘাড়ে একটা সতীন চাপল, আগেকার কালে ওটা গা-সওয়া ছিল, এখন তো সতীন নিয়ে ঘর করা শোনাই যায় না, ওর কপালে তাও হল। তার ওপর–’
তার ওপর কি সেটা আর বলতে পারেন না উমা, মধ্যপথেই থেমে যান। কন্যা- স্থানীয়া সম্বন্ধে সে দারুন সম্ভাবনার কথাটা মুখে উচ্চারণ করতে পারেন না। শরৎ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করেন, ‘যাবে নাকি?’
‘না, না। আর না।’
প্রবলবেগে মাথা নাড়েন উমা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ লাল হয়ে ওঠেন। সে অকারণ লজ্জা ঢাকতেই বোধহয় মুখটা ফিরিয়ে বসেন একটু।
আগের সে উজ্জ্বল কান্তি আর নেই, রোদে রোদে ঘুরে মুখখানা তো রীতি-মতো তামাটে হয়ে উঠেছে, তবু সে বর্ণান্তর টের পান শরৎ। এ লজ্জার কারণটাও মনে পড়ে যায় তাঁর। তিনিও মাথাটা নামান একটু।
অনেকদিনের কথা হল। তবু মনে আছে। স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছেন যেন।
হরিনাথের অসুখের খবর পেয়ে উমা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন। ঐন্দ্রিলা তাঁর কাছেই মানুষ বলতে গেলে, তাই তার আসন্ন বৈধব্যের সম্ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। অন্য কোন লোক না পেয়ে শরতের প্রেসে ছুটে এসেছিলেন সঙ্গে যাবার জন্যে। তখন কোন সম্পর্কই ছিল না, যেটুকু ছিল সেটুকু অভিমানেরই, তার আগে কোন ।দিন নিজে থেকে এসে কিছু চান নি উমা, বোধহয় সুদূর কল্পনাতেও ভাবতে পারেন নি যে কোনদিন কোন সাহায্য চাইতে হবে এই স্বামীর কাছে–যে স্বামী একদিনও গ্রহণ করেন নি তাঁকে, যে স্বামী পরের প্রেমে উন্মত্ত। তবু এসেছিলেন, প্রেস কোন্ দিকে তা ধারণা ছিল না– গোবিন্দ এসে দেখিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে স্বামীকে ডেকে বাইরে এনে মিনতি করেছিলেন– কোনমতে একটু সঙ্গে যাবার কি সুবিধা হবে? হরিনাথ মরণাপন্ন, ঐন্দ্রিলা একা অসহায়– তিনি এখনই একবার ওদের দেখতে যেতে চান।
খুবই বিব্রত বোধ করেছিলেন শরৎ। অনুরোধটা অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক বলেই শুধু নয়, বিব্রত হবার আরও কারণ ছিল। তাঁর রক্ষিতা গোলাপীর কাছে তিনি আমরণ বিশ্বস্ত ছিলেন, কিন্তু সে তাঁকে সম্পূর্ণ পেয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারত না, তার সংশয় কখনও যায় নি। সে টের পেলে কী পরিমাণ অশান্তি করবে তা তিনি জানতেন– আর করেও ছিল তা– তবু সেদিন শরৎ তাঁর কর্তব্যই পালন করেছিলেন, এক মুহূতাঁর বেশি ইতস্তত করেন নি।
সেদিনের কথা মনে আছে বৈকি। ট্রেনের পথটুকু একরকম, যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে যাওয়া যায়, স্টেশনে নেমে অপরিসর পাল্কীতে ঘেঁষাঘেঁষি বসে যাওয়া– অন্ধকার নির্জন পথ দিয়ে– সেই বয়সেও একটু মোহ, খানিকটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। তারপর সেখানে নেমেও, হরিনাথের মার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও সন্দিগ্ধ প্রশ্নে দুজনেই যথেষ্ট অসুবিধায় পড়েছিলেন।
‘আর না।’ কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বোধ করি সচেতন হয়ে উঠেছেন উমা। সেদিনের স্মৃতিটই মনে পড়ে গেছে তাঁর।
তাই এ সুগভীর লজ্জা।…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়লেন শরৎ।
উমাও বোধ করি সেই বিশেষ দিনটার স্মৃতিতেই ডুবে গিয়েছিলেন– শরতের নিঃশ্বাসের শব্দে সম্বিৎ ফিরল তাঁর। তিনিও একটা নিঃশ্বাস ফেলে নড়ে চড়ে বসলেন। বললেন, ‘আমার দ্বারা আর ওসব খবরদারী করা সম্ভব নয়। আমার শরীরে আর বয় না। তার ওপর একটু উদ্বেগ দুশ্চিন্তা হলেই যেন মাথার মধ্যে কেমন করে– শরীর আরও দুর্বল বোধ হয়।… আর কেনই বা, ভগবান যখন দিলেনই না– তখন পরের ঝঞ্ঝাট বইতে যাই কেন শুধু শুধু।’…..
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন উমাও।
কিন্তু শোওয়া আর ঘুমনো এক কথা নয়। উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই তার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। উমাও পেলেন না। বহুরাত্রি পর্যন্ত এপাশ ওপাশ করলেন, মধ্যে একবার উঠে গিয়ে মাথায় জল দিয়েও এলেন, তবু তাঁর চোখে তন্দ্রা নামল না।
দুটো বিছানার মধ্যে ব্যবধান সামান্যই। একজন জেগে থাকলে আর একজনের সেটা অগোচর থাকা কঠিন। শরতেরও তা অজানা রইল না।
তার কারণ তিনিও জেগেই ছিলেন। ইদানীং হাঁপানিটা কম ছিল, রাত্রে ঘুমও হচ্ছিল কদিন। তাঁর অনেক সাধনার ঘুম বলেই উমারও সতর্কতার অন্ত ছিল না। পাছে তাঁর ঘুম ভেঙে যায় বলে অতি সন্তর্পণে পাশ ফিরছিলেন– যতটা সম্ভব নিঃশব্দে বাইরে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু সেদিন শরৎ ঘুমোন নি। বহু রাত্রিই অনিদ্রায় কাটাতে হয় বলে স্থির হয়ে থাকাটা অভ্যেস হয়ে গেছে। স্থির হয়েই শুয়েছিলেন বলে উমা তাঁর জেগে থাকাটা টের পান নি। নইলে তন্দ্রা নামে নি তাঁর চোখের পাতাতেও।
তিনিও ভাবছেন আকাশ-পাতাল। ভাবছেন উমার কথাই।
অনেকদিন ধরেই ভাবছেন।
উমা মিছে বলেন নি, কথার কথা নয়। সত্যিই উমা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। শরৎ কিছুদিন থেকেই লক্ষ করছেন সেটা। সুগভীর ক্লান্তি ফুটে উঠেছে মুখেচোখে।
হয়ত সবটাই তার কায়িক দুর্বলতা নয়– দীর্ঘদিন ধরে একঘেয়ে পরিশ্রমে হয়ত মানসিক অবসাদও এসেছে একটা। কিন্তু সেটাও তো কম কথা নয়; মানসিক ক্লান্তি যখন মুখের ভাবে চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে, তখন সেটা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া প্রয়োজন বুঝতে হবে।
আর শারীরিক ক্লান্তিরই বা অপরধাধ কি। হলও তো বহুদিন– প্রায় ত্রিশ বৎসর হতে চলল। এই একই কর্মসূচি। বেলা বারোটা না বাজতে বাজতে বেরিয়ে যাওয়া– রাত আটটা নটায় বাড়ি ফেরা। এক টাকা দু’টাকা– বড় জোর চার টাকার টিউশ্যনি, বহু বাড়িতে অনেক মেয়েকে না পড়ালে একজনের খরচ চলে না। টাকা যা-ই দিক, সকলেই ঘড়ি মিলিয়ে নেয়। দেড় ঘণ্টার আগে উঠলে মুখ ভার হয় মেয়ের মায়েদের। এখন ইংরেজি পড়ার রেওয়াজ হয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় মেয়ে-ইস্কুল সেখানকার মাস্টারনীরাও টিউশ্যনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রতিযোগিতা খুব বেশি। উমার মতো শুধু ফার্স্ট বুক পড়া শিক্ষয়িত্রীর টিউশ্যনি জোটাও আজকাল কঠিন। সেজন্যে ভয়ে ভয়েই থাকেন উমা।… এসব কোনদিন খুলে না বললেও কথায় বার্তায় বেরিয়ে আসে। কতকটা শুনলে বাকিটা অনুমান করে নেওয়া চলে।
শুধু অবিশ্রাম বকাই নয়– হাঁটতেও হয় অনেক। শ্যামবাজার, আহিরীটোলা, বিডন স্ট্রিট, –এক এক জায়গায় এক একজন। পুরনো বাড়ি খুব বেশি নেই। বছর দুই পড়লেই ওঁর বিদ্যা শেষ হয়ে যায়– শুধু প্রাথমিক পাঠ ছাড়া ওঁকে দিয়ে পড়াবে কে? যে বাড়িতে অনেকগুলি বোন পর পর সাজানো থাকে, সে বাড়িতেই টিকে থাকেন উমাও। কিন্তু সে রকম বাড়ি এখন একটিই আছে বিডন স্ট্রীটে। ইদানীং অনেক মেয়ে হাতছাড়া হওয়ায়, জানাশুনোর মধ্যে ভাল কাজ না পেয়ে উমা ভদ্র গৃহস্থ বাড়ি থেকে একটু নামতেও বাধ্য হয়েছেন। খারাপ পাড়ায় না, ভদ্র পাড়ায় ভদ্রলোকের মতোই বাস করে, অথচ পরিচয়টা গোলমেলে বিবাহিত দম্পতি নয়– জেনে শুনেই এমন বাড়িতে পড়ানো ধরতে হয়েছে তাঁকে। এরা মাইনে ভাল দেয়, টাকা ছাড়াও অন্য জিনিস দেয়– যত্ন করে সম্মান করে তবু, উমার অপমান বোধ হয় বৈকি। প্রথম যেদিন এইরকম বাড়িতে কাজ নিতে হয়েছে- বেশিদিনের কথা নয়–শরৎ আসার পরের কথাই– সেদিন বাড়ি ফিরে অবসন্নভাবে বসে পড়াটা শরৎ কোন দিনই ভুলবেন না। কী সুগভীর লজ্জা আর অবসাদই না ফুটে উঠেছিল মুখে মনে হচ্ছিল বোতল ভরা কালি কে ঢেলে দিয়েছে।
গোপন করেন নি– সবই বলেছিলেন উমা। গত তিন চার মাস ধরেই আয় কম হচ্ছে– কিছুতেই কোন ভদ্রবাড়িতে আর কাজ যোগাড় করতে না পেরেই এ কাজ নিতে হয়েছে তাঁকে। বাজারে দেনা হয়ে গেছে–মুদির দোকানে, এমন কি সবজি বাজারেও বাকি পড়েছে– আর অপেক্ষা করবার সাহস নেই তাঁর।
বহুদিন ধরেই ভাবছিলেন– কিন্তু সাহস হয় নি। সেদিন বোধ করি উমার ঐ প্রায়- ভেঙ্গে-পড়া মূর্তি দেখেই মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন।
গোলাপী মরার পর যখন নিজের স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে পড়ল তখন প্রেস লীজ দিয়েছিলেন। সেই লীজই আছে এখনও, সব মাসে টাকা আদায়ও হয় না। তিন-চারদিন ঘুরে বকাঝকা করে আদায় করতে হয়। যে মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন সে মাসে আদৌ কিছু পাওয়া যায় না। তবে সে-ই সব নয়, তাঁর হাতেও কিছু আছে। যত কমই হোক, কষ্ট করে চলে যায়। আর কদিনই বা বাঁচবেন তাঁরা!
সেই কথাই বলেছিলেন, ‘কিন্তু কেন এত কষ্ট করছই বা তুমি– আমার যা আছে তাতে কোনমতে শাকভাত আমাদের দুজনের চলেই যাবে। কিছু ছিল হাতে, এই কবছরে কিছু জমেওছে, তুমি তো আমার খোরাকির বেশি এক পয়সাও নাও না– যা নাও তাতে আমার খোরাকিও বোধহয় চলে না পুরো–কাজেই আর যত কমই হোক, কিছু কিছু তো জমেছেই।… আর না হয় ছাপাখানাটা বেচে হাতে নগদ টাকা নিয়ে চলো কোন তীর্থস্থানে চলে যাই। কাশীতে শুনেছি খুব সস্তা-গন্ডা–বহু বুড়ি মাসে দু’টাকা তিন টাকা আয়ে চালায় সেখানে– কাশীতে গিয়েও থাকতে পারি। কদিনই বা আর বাঁচব আমরা, যা আছে দুটো পেট চলেই যাবে!’
‘না!’
কথাটার গতি কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে প্রথম থেকেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন উমা–প্রতিবাদ করার জন্য কথর ফাঁক খুঁজছিলেন শুধু– এবার একেবারে যেন ফেটে পড়লেন।
‘না। এ যত দুঃখই পাই না কেন, যত নীচু দোরেই ঢুকতে হোক না কেন–এতে আমার লজ্জার কোন কারণ নেই। নিজের কাছে নিজের মাথা উঁচু আছে। তোমার ভাতের চেয়ে এ ঢের ভাল। এতকাল যদি তোমার ভাত না খেয়ে কেটে থাকে তো বাকি কটা দিনও কাটবে।… মা সতীরাণীর কাছে এই প্রার্থনাই করি অহরহ– অনেক দুঃখ অনেক অপমান জীবনে দিয়েছ–এই অপমানটা আর দিও না। তোমার ভাত যেন না খেতে হয়। তার আগে যেন আমার মৃত্যু হয় অন্তত!’
বলতে বলতে যেন হাঁপাতে থাকেন উমা। উত্তেজনায় মুখচোখ আরক্ত হয়ে ওঠে তাঁর।
এর উত্তর দেবার শক্তি নেই শরতের, এরপর আর কথা বলার সাহস নেই।
তিনি মাথা হেঁট করে বসে রইলেন।
এ উমার আর এক মূর্তি। আর কোন কারণে কোন প্রসঙ্গেই এত উত্তেজিত হন না উমা। এত কঠিন কথাও অন্য সময় তার মুখ দিয়ে বেরোয় না।
ব্যথা পান শরৎ, ব্যথা পান এই দুর্বাক্যের জন্য নয়, ভর্ৎসনার জন্যও নয়– ব্যথা পান উমার জন্যই।
প্রথম জীবনে যেন অন্ধ হয়েই ছিলেন। অত্যন্ত স্বার্থপর ও আত্মসর্বস্ব মায়ের কাছে মানুষ হয়েছিলেন বলে বাপের কাছ থেকে পাওয়া স্বাভাবিক ভদ্রতা নিয়ে জন্মেও অপর মানুষের দিকটা ঠিক দেখতে শেখেন নি। ওর বাবার অকালমৃত্যু হয়েছিল– কিন্তু তাকে আত্মহত্যা বলাই উচিত। প্রবল জ্বরের ওপরও বারবার স্নান করে নিমোনিয়া ডেকে এনেছিলেন তিনি– আজ শরৎ বুঝতে পারেন– সে ঐ স্ত্রীর জন্যেই।
শরতের বহু গুণ ছিল কিন্তু বিবাহিতা স্ত্রীকে গ্রহণ না করলে তার জীবনে কী হতে পারে, সে-কথাটা ভাববার মতো মানসিক গঠনই তাঁর ছিল না। লেখাপড়া শেখেন নি, ভদ্রসমাজে মেশেন নি– তাই কোন কথা গুছিয়ে ভাবতেও পারতেন না সেদিন।
প্রথম যৌবনের সুতীব্র আবেগে গোলাপীকে ভালবেসেছিলেন– তার কাছে শপথ করেছিলেন যে, সে জীবিত থাকতে অন্য স্ত্রীলোককে কামভাবে স্পর্শ করবেন না। মার কথায় তিনি বিবাহে সম্মত হয়েছেন শুনেই সে শপথ করিয়ে নিয়েছিল– অন্যথায় আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। পতিতার কাছে করা শপথ রাখতেই তিনি উন্মুখযৌবনা বিকশিত পদ্মের মতো স্ত্রীকে গ্রহণ করেন নি সেদিন। আজ সে-কথা মনে হলে হাসি পায়। দুঃখের হাসি। সে শপথ এমনভাবে রক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। আজ বুঝতে শিখেছেন যে, এ-শপথ রক্ষা করতে গিয়ে বৃহত্তর শপথ ভঙ্গ করেছেন তিনি- অগ্নি ও নারায়ণের কাছে করা শপথ!
আশ্চর্য। এসব দিকে চোখ খুলে দিয়েছে কিন্তু সে-ই। সে-ই বলতে গেলে ওকে মানুষ করেছে। গোলাপী ছোট জাতের মেয়ে, তায় অতি নীচু ঘরের পতিতা কিন্তু অসামান্য রূপলাবণ্যের আকর্ষণে বহু সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক তাঁর ঘরে এসেছেন। শরতের সংস্পর্শে আসার আগে তো বটেই, পরেও। শরৎকে জেনে-শুনেই সে প্রস্তাবে রাজি হ’তে হয়েছে– সময়ে সময়ে তার জন্য ঈর্ষার জ্বালাও ভোগ করতে হয়েছে কিছু কিছু। তার কারণ ঈশ্বর-দত্ত রূপ ছাড়া তাঁর আর কিছুই ছিল না, এক পয়সাও দেবার সঙ্গতি ছিল না তাঁর। বরং গোলাপীই ‘ তাঁকে দিয়েছে ঢের। ছাপাখানা করেছিলেন, সে-ও তারই পয়সায়। অর্থাৎ গোলাপী তাঁর রক্ষিতা ছিল বলা ভুল–তিনিই তার রক্ষিত ছিলেন।
হয়ত সেই জন্যেই গোলাপীর কথাবার্তা আচার-আচরণ ভদ্রঘরের ময়ের মতোই ছিল। তার সংস্পর্শে এসেই শরৎ অনেক ভদ্র হয়েছিলেন। অবশ্য ব্যবসার কল্যাণেও বহু ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে– জেনেছেন-শিখেছেন ঢের। নইলে তাঁর বাল্যের পরিবেশ ও শিক্ষাদীক্ষা ভদ্রলোক ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেবার মতো নয়।
ভুল বুঝতে পেরেও তা সংশোধনের চেষ্টা করেন নি কেন? শুধুই কি গোলাপীর প্রতি প্রেম, কৃতজ্ঞতা, সেই ছেলেমানুষী শপথের ভয়– নাকি আরও ছেলেমানুষী সংকোচ একটা, বৃথা চক্ষুলজ্জা? কে জানে– আজও ঠিক মনের এ-খবরটা পান নি শরৎ– আজও প্রশ্নের কোন উত্তর নিশ্চিত করে দিতে পারেন না।
কে জানে– যখন সামান্য একটু পরিচয় হয়েছিল ওঁদের– যখন কিছুটা কাছাকাছি এসেছিলেন, তখন এ পক্ষ থেকে যদি একটু জোর দেওয়া হ’ত–এদিক থেকে যদি সঙ্কোচ ভাঙ্গবার চেষ্টা করা হত, তাহলে কী করতেন উনি। আজ ঠিক করে বলা শক্ত! কে জানে তখনও শপথের ভয় থাকত কি না।
কিন্তু সে কিছুই হয়ে ওঠে নি। কিছুই করা হয় নি। শুধু দুহাতে এই জীবনটা উড়িয়ে দিয়েছেন, নষ্ট করেছেন। নিজেরই শুধু নয়– এঁরও। দুটি দুর্লভ জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
আজ তার জন্য অনুতাপ হয় বৈকি। আজ মনে হয় তিনিও ঠকেছেন। সে যতই ভালবাসুক, তার কাছ থেকে যতই পান– দাম্পত্য-সুখ সেখানে পান নি তিনি। এ আলাদা জিনিস। ঘর-সংসার করেছেন, সন্তানও হয়েছে– তবু গৃহ-সুখে বঞ্চিতই থেকে গেছেন চিরকাল। ছোট একটি নিজস্ব সংসারে সর্বময় কর্তা, একেশ্বর হয়ে থাকার যে তৃপ্তি, তা অনাস্বাদিতই রয়ে গেল এ-জীবনে। ভদ্রসমাজে সাধারণ গৃহস্থ হয়ে বাস করার মধ্যে যে সম্মান, তারও কি মূল্য কম?
না, অনেক কিছুই হারিয়েছেন তিন। অনেকখানি। আজ মনে হয়, কোনমতে যদি জীবনের এই কটা বছর ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করা যেত! অন্তত কিছুটা সময় যদি পিছিয়ে যাওয়া যেত– যখন স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি এতটা কঠিন হতে পরতেন না, সে-ক্ষমা পাওয়া যেত।
এখন এই স্ত্রীর সামান্য কিছু প্রয়োজনে লাগতে পারলেও ধন্য হয়ে যান তিনি, কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়। কিন্তু আজ বুঝি কোথাও কোন পথ খোলা নেই তার।
স্ত্রীর প্রিয়-সাধনের জন্যেই তিনি খোকাকে এনে রেখেছেন, কান্তিকে সাহায্য করেন। কিন্তু সে আর কতটুকু?
বরং মনে হয় এখানে এসে এই চোখের সামনে থাকাটাই উমার পক্ষে আরও যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছে। কোন দিন সামান্য কোন যত্ন করলে, কোন মিষ্টি কথা বললে, কি ওর কাজে কোন সাহায্য করতে গেলে উমার চোখে জল এসে যায় তা তিনি লক্ষ্য করেছেন বহুদিন। যেদিন ঐ কাজ ছেড়ে দেবার কথা তোলেন সেদিন শেষ রাত্রে ঘরের বাইরে
উঠোনের দিক থেকে চাপা কান্নার আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল– খুবই সামান্য শব্দ– কিন্তু তাঁরও হাঁপানির টানের মধ্যে বসে বসে ঘুম– ভাঙ্গতে দেরি হয় নি। অন্ধকারেই উঠে এসে দেখেছেন রকের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছেন উমা। মুখে কাপড় গোঁজা– তবু সে কান্নার শব্দ সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নি, এমনই আকুল সে-কান্না।
এক একবার মনে হয় এর চেয়ে তিনি দূরে কোথাও চলে যাবেন– বহু দূর কোন দেশে– সেখানে তাঁর অদৃষ্টে যা হয় হবে, উমাকে তো মুক্তি দেওয়া যাবে। কিন্তু তা-ও পারেন না, বড় বেশি মায়া পড়ে গেছে। লোভও হয়– যদি কোনদিন কোনকাজে লাগতে পারেন, যদি কোন একটি সামান্যতম বেদনার কাঁটাও তুলে দিতে পারেন ওর এই বিড়ম্বিত জীবন থেকে। সেই তো পরম লাভ। সে সম্ভাবনাটুকু নষ্ট করতে মন চায় না।
॥8॥
গলির ওপাশে ঘোষেদের বাড়ির সাদা দেওয়ালটায় ভোরের আভাস লাগামাত্র উমা উঠে পড়লেন। এমনিই ওঠেন তিনি প্রত্যহ। কোন কোন দিন আরও আগে ওঠে। বেশ খানিকটা রাত থাকতেই উঠতেন এতকাল কিন্তু তাতে আলো জ্বেলে ঘরের কাজ সারতে হয়। শরৎ আসার পর সে-ব্যবস্থায় একটু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। দেশলাই জ্বালার আওয়াজে ওঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়, চোখে আলোটাও লাগে। শরতের যেদিন হাঁপানির টান ওঠে, সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকেন, ভোরের দিকেই যা একটু তন্দ্রা আসে। সেটুকু ভাঙ্গাতে মায়া হয় উমার। আর সেই জন্যই– একটু অন্তত আবছা আলো আসার অপেক্ষা করতে হয়।
তা নইলে রাত থাকতে ওঠাই সুবিধা তাঁর। গঙ্গাস্নানের অভ্যাস করেছেন মার মতো। তাতে নাকি মাথা ঠাণ্ডা হয়, শরীরটাও ভাল থাকে। আসলে, শরতের বিশ্বাস, মার মতোই নিরিবিলিতে চোখের জল ফেলে মনটা হালকা করতে যান ওখানে– গঙ্গাজলে চোখের জলে একাকার হয়ে যায়, সে-কান্না কেউ টের পায় না।
গঙ্গাস্নানের জন্যই এত ভোরে উঠতে হয় তাঁকে। আরও ভোরে উঠলেই ভাল হয়, ফরসা হলে ভিড় বেড়ে যায়, সে বড় অসুবিধা। পাঁচটা মেয়ে এক জায়গায় হলেই পাঁচটা বাজে প্রসঙ্গ– ও আর উমার ভাল লাগে না। অথচ এক ঘাটে যাঁরা প্রত্যহ স্নান করতে আসেন, তাঁদের সঙ্গে একটু মুখচেনা গোছেরও পরিচয় হয়ে যায়– তাঁরা কথা কইলে মুখ ফিরিয়ে চলে আসা যায় না, দুটো কথা ওঁকেও বলতে হয়। এইটেই এড়াতে চান উমা অথচ এখানেও কিছু কাজ থাকে– বিছানা ঠিক করা, দুটো ঘর বাইরের রকটুকু মোছা নিজের প্রাতঃকৃত্য সারা– খুব কম করেও এক-ঘণ্টার ধাক্কা। একটু রাত থাকতে না উঠলে সবদিক সামলাতে পারেন না।
আজও উঠে ঠাকুরদের নাম সেরে বিছানা থেকে নামতে যাবেন, হঠাৎ শরতের বিছানার দিকে চোখ পড়ে গেল। মনে হল শরৎ তাঁর দিকেই চেয়ে আছেন। শরৎ জানলার দিকটায় শোন্, যেটুকু আলো ঐদিক থেকেই আসে। তাই আলো-আঁধারিতে স্পষ্ট কিছু বোঝা আগেই উঠেছেন। নেমে কাছে এসে দেখলেন সত্যিই চেয়ে আছেন শরৎ, চোখে ঘুমের লেশ মাত্র নেই, সম্ভবত অনেক আগেই উঠেছেন।
‘ওমা তুমি জেগে আছ! আমি বলি ঘুমোচ্ছ। পাছে ঘুম ভেঙ্গে যায় বলে —
শরৎ তেমনি স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ আর গঙ্গাচানে না-ই বা গেলে। সারা রাত তো ঘুমোও নি– এখন একটু ভোরাই হাওয়ায় ঘুমিয়ে নাও না!
‘সারারাত যার ঘুম হয় নি– এখন এই সকালের আলোয় শুলে তার ঘুম হবে? তোমার কি বুদ্ধি!…. কিন্তু তুমি জানলে কি করে আমার ঘুম হয় নি? তুমিও কি জেগে ছিলে? কৈ, আমি তো টের পাই নি।’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চান উমা।
‘তুমি ঘুমোও নি কেন? শরীর খারাপ করেছে?’
কাছে এসে কপালে হাত দেন।
হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ওর হাতখানা ধরে ফেলেন শরৎ। খুব কোমলকণ্ঠে বলেন, ‘আমার কিছু হয় নি, বেশ আছি। কিন্তু তোমার শরীর সত্যিই খারাপ হয়েছে। আজ আর বেরিও না, ঘুম না হয়, এমনিই একটু বিশ্রাম কর।’
‘হ্যাঁ, শুয়ে থাকলেই আমার চতুবর্গ হবে! ছাড় ছাড়, অসুমর কাজ পড়ে– এমনিই বেলা হয়ে গেছে। গঙ্গায় গিয়ে সেই মাগীর দঙ্গলে পড়তে হবে।’
তবু হাতটা ছাড়েন না শরৎ। বলেন, ‘একদিন গঙ্গায় না গেলে কি হয়?’
‘তা কিছু হয় না। এই তো কতদিন যাই না। তবে সারারাত না ঘুমিয়ে আজ এখন মাথা আগুন হয়ে আছে, গঙ্গায় না গেলে ভীষণ মাথা ধরবে, কোন কাজ করতে পারব না।’ আর বাধা দিলেন না শরৎ। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে হাতখানা ছেড়ে দিলেন।
বাধা দেবার কোন অধিকারই রাখেন নি তিনি। এ হাত ধরারও কোন যোগ্যতা নেই।
এটুকু সময়ও যে সহ্য করেছে, কটু কথা বলে নি এই ঢের।…
বালতি-ন্যাতা এনে ঘর মুছতে মুছতে ঈষৎ অপ্রতিভভাবে হেসে উমাই আবার কথাটা তুললেন।
‘আমি ভাবছি আজ পড়িয়ে আসবার সময় খোকাটাকে নিয়ে আসব। কাল তো বড় বৌমার আসবার কথা গেছে– আর না এলেও, একটা দিন বড়দি বেশ চালিয়ে নিতে পারবে।’
খোকা এক মাসেরও ওপর কমলার বাড়ি আছে। গোবিন্দর বৌ বাপের বাড়ি, ছেলেমেয়েসুদ্ধ নিয়ে গেছে সে– কমলা টিকতে না পেরে খোকাকে নিয়ে গিয়ে রেখেছেন। নাতি-নাতনি হবার পর আজকাল আর একা থাকতে পারেন না তিনি। গোবিন্দ কোনদিনই রাত নটার আগে আসে না, এক-একদিন আরও দেরি করে– কমলার বড় কষ্ট হয় অত রাত অবধি একা একা বসে থাকতে।
‘একটা দিন আমিও চালিয়ে নিতে পারব–তার জন্যে নয়। কিন্তু একদিনের অত চিন্তা কেন? তরুর ওখানে যেতে হবে বুঝি?’
সলজ্জ হেসে উমা বলেন, ‘হ্যাঁ– ভাবছিলুম কাল রবিবার আছে, পড়ানো নেই, একটু ঘুরেই আসি।’
‘তা খোকাকে আনবার কী দরকার– আমার জন্যে? না সঙ্গে নিয়ে যাবে?’
‘না, তোমারই জন্যে। আজকাল ও তো সব পারে, তোমার অনেক সুসার হবে।’
‘আমার জন্যে অত কাণ্ড করবার দরকার নেই। আমি বেশ থাকব। তুমিই বরং নিয়ে যাও– একলা গিয়ে পথঘাট খুঁজে পাবে না– আতান্তরে পড়বে।’
‘না, না। সে আমি একরকম করে খুঁজে নেব এখন। তোমার কাছেই একজন থাকা দরকার। সারাদিনের ফের, কখন ফিরব–মানে ফিরতে পারব তারও তো ঠিক নেই। তুমি অসুস্থ মানুষ– কখন শরীর খারাপ হয়ে পড়বে কি হবে, হাঁপ শুরু হলে তো নড়তে পারো না। খোকা থাকলে এদিকে তোমার ফাই-ফরমাশ খাটা কি বুকে একটু মালিশ করা– এগুলো তো পারবে, উনুন জ্বেলে চা-টাগুলোও করে দিতে পারবে।’
‘এখন ভালই আছি, সে সব কিছু হবে না। সে যেদিন শুরু হবে আগে থাকতেই টের পাই।… এই তো কদিন একা রয়েছি, তুমি তো রাত আটটার আগে ফেরো না। তা যদি পারি তো আরও না হয় দুটো ঘণ্টা পারব ‘খন থাকতে। তা অতশতরই বা দরকার কি, চল না আমিও যাই তোমার সঙ্গে–’
‘তুমি যাবে? যেতে পারবে অতটা? ট্রেন থেকে নেমে অনেকটা হাঁটতে হয় শুনেছি–’ মুখচোখ যেন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে উমার।
‘তা পারব না কেন? এখন তো শুনেছি গাড়ি হয়েছে। স্টেশনে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।’
‘হ্যাঁ, তা হয়েছে বটে, খোকা বলছিল। তা তাই চল তাহ’লে। সেই বেশ হবে। তাহলে আর কোন পেছটান থাকে না। তোমাকে রেখে গেলে ঐ একটা দুর্ভাবনা থাকবে–’ কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ গাঢ়স্বরে শরৎ বললেন, ‘তুমি আমার জন্যে এত ভাব–? সত্যি? এইটে শুনলে মনে বড় বল পাই। আমার তো কোন জোরই নেই– এই কথা শুনলে তবু মনে হয়– আমি যত অপরাধই করে থাকি না কেন তুমি শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখবে, তাড়িয়ে দেবে না। আজকাল বড় ভাবনা হয় জান– যতদিন একা ছিলুম সে একরকম সয়ে গিয়েছিল, এখন মনে হয়, তুমি ছেড়ে দিলে আমার একদিনও চলবে না। আর অমন করে থাকতে পারব না আমি– একা একা ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে হয়ে–’
আজ আবার সকাল থেকে কী আদিখ্যেতা শুরু হল তোমার!’ ঝঙকার দিরে ওঠেন উমা। কণ্ঠস্বরে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রূঢ়তা আনবার চেষ্টা সত্ত্বেও আশা ও আশ্বাসের সঙ্গে লক্ষ করেন শরৎ– মনের আবেগটা ধরা পড়ে যায়। তাতেই একটু বেশি রূঢ় শোনায় যেন। তারপর যখন কথা বলেন তখন আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় সেটা।– ‘তোমাকে ছেড়ে দিতে আর পারলুম কৈ? তাহলে আর যেচে ঘরে নিয়ে আসব কেন? এখন একবার যখন বোঝা ঘাড়ে নিয়েছি তখন আর নামাব কি করে? কার ঘাড়ে চাপাব আর? এক
‘হ্যাঁ’, শরৎ তাড়াতাড়ি ওরই কথার সূত্র ধরে যেন বলেন, ‘সেইদিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা ক’রো– দোহাই তোমার! একেবারে যমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিও, তাহলেই তোমার ছুটি। সেইটুকুই আমি চাইছি!’
‘ও আবার কি কথা! বলে এত দুঃখ দিয়েও আশ মিটল না বুঝি? দেবার মধ্যে দিয়েছ তো এই লোহা আর সিঁদুরটুকু– সেটাও সইছে না?…. ও আশীর্বাদে আর কাজ নেই
‘কিন্তু তুমি গেলে আমার কি গতি হবে?…. এই তো– একবেলা কে দেখবে সেই ভাবনায় অস্থির হচ্ছ– তখন কে দেখবে?’
অনেকক্ষণ উমা কোন উত্তর দেন না, নীরবে বাকি ঘরটুকু মুছে নেন। তারপর মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘তা যম এলে তাকে কি বলব শিখিয়ে দিও।…. কখনও তো আমার হয়ে কাউকে কিছু বললে না– পারো তো তাকে বলে ব্যবস্থা করো– যাতে দুজনেই এক সঙ্গে যেতে পারি।… না কি, সেখানে তো আবার আর একজন বসে আছেন! আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আবার ফ্যাসাদে পড়বে না তো?’
শরৎ প্রবলবেগে ঘাড় নেড়ে গাঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘না না, আর কেউ নেই। সে যা ঋণ ছিল তার কাছে এ জন্মেই শোধ হয়ে গেছে, পরকালে আর কোন দাবি তার নেই। আর যদিই বা বসে থাকে, দাবি করে– তোমার হক্ তুমি ছাড়বে কেন? তোমার তো জোরের জিনিস– এবার জোর ক’রেই তোমার পাওনা আদায় করবে, এমন ভাল মানুষের মতো ছেড়ে দিও না–’
‘তবু ভাল!’ বলে উমা আর একটু হেসে বাতি হাতে কলতলায় চলে যান।
খেয়ে দেয়ে পান মুখে দিয়ে বেরোবার সময় হাসিহাসি মুখে এসে দাঁড়ান উমা।’দ্যাখো গো, গোটা-দুই টাকা হবে তোমার কাছে?’
‘তা হবে।… হঠাৎ টাকা চাইলে যে?’
‘মাসের শেষ, হাতে যে কিছু নেই। ধারই চাইতুম, তা তুমি মেসো সঙ্গে যাচ্ছ– তোমারও তো কিছু কর্তব্য আছে। একটু লেবুটেবু কিনে নেবো আর কি।’….
‘তা সে আজ কি–?’ শরৎ টাকা দুটো বালিশের তলা থেকে বার করে দিতে দিতে প্রশ্ন করেন, যাবে তে কাল?’
‘আজই এনে রাখব মনে করছি। কাল ভাবছি রাত থাকতে উঠে যা হয় দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খেয়ে নটা দশটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। নইলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আর না খেয়ে গেলে সে বড় পীড়ন করা হয়– তার যা অবস্থা শুনছি– মেয়েটা তো জ্যান্তে মরা হয়ে রয়েছে– সেখানে না খেয়ে গিয়ে হাজির হওয়া– সে বড় লজ্জা করে!’
‘না না–খেয়েই যাব। তা দু’টাকাতেই হবে?’
‘ঢের ঢের। বইবে কে অত?…. তাছাড়া খরচাও তো হবে ঢের। … ট্রেন-ভাড়া আছে, গাড়ি-ভাড়া আছে–একগাদা খরচা। তোমার তো আর কুবেরের ভাণ্ডার নয়– ধর যদি কাল আমি মরেই যাই– তখন তো মাইনে করে লোক রাখতে হবে, এমন আপ-খোরাকী বিনে-মাইনের ঝি আর মিলবে না তো!’
‘আবার ঐ কথা? বললুম না যে তোমাকে আমি ছাড়ব না?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা– ধরেই রেখো। যতদিন পারো খাঁটিয়ে নিও–আর কি! তবে
যমরাজের সঙ্গে ব্যবস্থাটা করে নিও কিন্তু–’
টাকা দুটো আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে যান উমা।
খবরটা পেলেন পাড়ার দু-তিনটি ছেলের মুখে। বাড়িওলাদের একটি ছেলেও ছিল তাদের মধ্যে। ছুটতে ছুটতে এসেছে তারা। বোধ হয় ঊর্ধ্বশ্বাসেই ছুটে এসেছে।
উমার আসবার সময় হয়েছে আন্দাজ করেই– তাঁকে একটু চমক লাগাবার জন্যে শরৎ তখন গুলের উনুনটায় আঁচ দিয়ে সাগু চাপিয়ে দিয়েছেন। উমা বারোমাসই রাত্রে দুধসাগু খান। একা থাকার সময় ঐ অভ্যাস করেছেন। এখন আর কিছু সহ্য হয় না। আগে সকালেই করে রেখে দিতেন, এখন ফিরে এসে এই উনুনটা জ্বেলে করে নেন। শরৎ যেদিন ভাল থাকেন সেদিন রুটি কিংবা পরোটা খান দুখানা– সেও এই উনুনেই হয়। নইলে তিনিও সাগু খান। তার সঙ্গে হয় কোন সস্তা দামের মিষ্টি, কি দুটো নারকোল নাড়ু– কিংবা নিদেনপক্ষে বাতাসা। সকালের তরকারি একটু-আধটু রাখা থাকে, সেটাও গরম করে নেওয়া হয় একবার। শরৎ রুটি না খেলে সাগুর সঙ্গেই খান দুজনে।
অন্যদিন উমা ফিরলে এই উনুনে আঁচ পড়ে। তিনিই এসে দেন। একটা কেরোসিনের পলতে দেওয়া পুরনো আমলের স্টোভ আছে, সেইটে জ্বেলে শরৎ শুধু একবার নিজের মতো চা করে নেন বিকেলে। আজই হঠাৎ খেয়াল হয়েছে; কালকের ঐ সারারাত জাগার পর আজ তো অনুষ্ঠানের কোন ত্রুটিই হয় নি, গঙ্গাস্নান, বাজার, রান্না– তারপর সারাদিন হাঁটা আর বকুনি– সবই তো চলেছে। আসবে তো মড়ার মতো হয়ে। আবার এইসব করবে– তার চেয়ে তিনিই করে রাখবেন। ওরও সুসার হবে খানিকটা, এসে একটু স্থির হয়ে বসতে পারবেন– বিশ্রাম পাবেন, আর শরতেরও একটু বাহাদুরী নেওয়া হবে, দেখিয়ে দেবেন উমাকে যে, তিনি যতটা অকর্মণ্য ভাবেন স্বামীকে ততটা অকর্মণ্য উনি নন।
ভেতরে উনুনের ধারেই বসে ছিলেন– ছেলেরা এসে দোর ঠেলে এক সঙ্গে ‘মেসোমশাই’ বলে ডাকতেই চমকে উঠেছেন শরৎ। উমা সকলেরই মাসীমা, সেই সূত্রে তিনি মেসোমশাই ঠিকই–কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো ওদের বিশেষ আলাপই নেই বলতে গেলে। কথা-বার্তা বলে ওরা কদাচিৎ। উনি অধিকাংশেরই নামটাও জানেন না। ওরা কেন আমন ভাবে ডাকবে ওঁকে এত ছেলে এক সঙ্গে —
তাড়াতাড়ি দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে আরও চমকে উঠলেন। আগে যেটা ছিল শুধুই বিস্ময় সেটা এবার আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠল।
ওরা সবাই ওঁকে দেখে অমন মাথা নামিয়ে দাঁড়াল কেন? কেউই যেন কিছু বলতে পারছে না–?
‘কি–কী হয়েছে বিমু? ব্যাপার কী?’ একমাত্র যে ছেলেটিকে চেনেন এদের মধ্যে, তাকেই জিজ্ঞাসা করেন। এক পা আরও এগিয়ে আসেন ওদের দিকে।
‘তোমাদের মাসীমা– তাঁর কিছু হয় নি তো?’
এইবার ওরা মাথা তুলল। না বললেও নয় আর। কিন্তু বলাও কঠিন। বিমুর চোখ ছলছল করছে, রাস্তা থেকে আসা গ্যাসের আলোতেও তা লক্ষ করলেন শরৎ, চোখের কোণে কোণে চিক্ চিক্ করছে জলের আভাস
‘আপনি– আপনি একটু এই মোড়ে চলুন মেসোমশাই, এই বড় রাস্তার মোড়ে–। একটা– একটা য়্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’
‘য়্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? তা বেশ তো তা আমি যাব কেন? কি য়্যাক্সিডেন্ট?’
ছেলেমানুষের মতোই প্রশ্ন করেন শরৎ। আর করতে করতেই বুঝতে পারেন যে, ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে খুব। কী হয়েছে, কার হয়েছে–য়্যাক্সিডেন্ট তাও বুঝতে পারেন, তবু সেই বুঝতে পারাটাকেই যেন যতক্ষণ সম্ভব উপলব্ধি থেকে সরিয়ে রাখতে চান। যতক্ষণ না পরিষ্কার শুনছেন ততক্ষণই যেন বাঁচোয়া। যেটুকু সময় পান সেইটুকুই লাভ।
ওরা তাঁর আসল প্রশ্নটা এড়িয়ে আবারও বলে, ‘আপনি একটু চলুন মেসোমশাই। আপনার যাওয়া দরকার।’
‘দরকার? অ। তা চল। দরজাটা দিয়ে যাব না খোলাই থাকবে?’
একেবারে বুঝি ছেলেমানুষ হয়ে পড়েছেন শরৎ। কি বলছেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না বাধ হয়।
ভাবছেন, প্রাণপণে ভাবছেন সকালের কথাগুলো। সে ছেড়ে যাবে না কোথাও, যেতে পারে না। তাহলে তাঁকে দেখবে কে?
বাড়িওলাদের ছেলে বিমু আর একজনকে ইশারা করলে। সে ওঁর একটা হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বলল, ‘আসুন মেসোমশাই, আমি নিয়ে যাচ্ছি– ‘
বিমু বলল, ‘আপনি চলুন, আমি মাকে বলে যাচ্ছি দরজা বন্ধ করে দেবে–’
কেমন একরকম অসহায় ক্ষীণকণ্ঠে বললেন শরৎ, ‘উনুনে সাবু চড়ানো ছিল মানে তোমার মাসীমা খাবেন– তা–’
কথা শেষ করতে পারেন না; ছেলেটি টেনে নিয়ে যায়।
ওঁদের গলি ছাড়িয়ে রামহরি ঘোষ লেন। তারপর বিডন স্ট্রিট। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা?
কোথায়, কোথায় হল য়্যাক্সিডেন্টটা?’
‘ঐ হেঁদোর মোড়টায়– এই কাছেই। আর দূর নেই।’
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যান শরৎ। এতক্ষণের অভিভূত ভাবটা যেন কেটে যায়। সবল সুস্থ মানুষ হয়ে যান যেন অকস্মাৎ। অনেকটা সহজ কণ্ঠে বলেন, ‘এখনও বেঁচে আছে তো? হ্যাঁ বাবারা–?’
‘বোধহয় আছেন।’ আস্তে আস্তে বলে বিমু। সে মাকে বলে ছুটে এসে ওঁদের ধরে ফেলেছে।
আর কোন প্রশ্ন করেন না শরৎ। সহজভাবেই হেঁটে যান। একটু জোরেই চলেন বরং। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। ভিড় জমে গিয়েছে। বহুলোক ঘিরে রয়েছে কিছু একটা। ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে একটা। তার পিছু পিছু আরও অনেকগুলো ট্রাম। পুলিশও এসেছে–
হেঁদোর ওদিক থেকে আসছিলেন উমা। হঠাৎ একটা মোটরগাড়ি এসে পড়ে উল্টো দিক থেকে– সেইটে বাঁচাতে গিয়ে ট্রামে ধাক্কা খেয়েছেন। হাতপা কেটে বেরিয়ে যায় নি কোনটা, থেঁতলে গেছে বেশি। মাথাতেও নাকি চোট লেগেছে। রাস্তাতেই পড়ে আছেন, এখনও।
শরতের ভালো করে দেখা হল না। তাঁরও দুর্বল দেহ– মাথা ঘুরে উঠল, সেইখানেই তিনি বসে পড়লেন।
কে একজন যেন বলল, ‘ওরই স্বামী।’
‘তাই নাকি!’ ফিস ফিস করে বলল আর একজন, ‘আহা আহা– তাই মাথা ঘুরে উঠেছে অমন করে–। বুড়োমানুষ, দ্যাখো দিকি, এই বয়সে এ শক্! বেচারি।’
এই সবই যেন কত দূর থেকে ভেসে আসছে–এই গলার আওয়াজগুলো। যেন দূরে কোথাও কারা বলাবলি করছে!
কারা সব ওঁকে হাত ধরে তুলে এনে একটা বাড়ির সদরে বসিয়ে দিল।
শুধু একটাই প্রশ্ন করলেন শরৎ, এতক্ষণ চেষ্টা করে করতে পারলেন ‘প্রানটা প্রাণটা আছে বলে কি মনে হল? তাহলে একবার হাসপাতালে পাঠাবার চেষ্টা–মানে যদি বাঁচত এখনও–’
ভিড়ের মধ্যে থেকেই কে একজন বললে, ‘বুকের কাছটা বোধহয় ধুকধুক করছে এখনও। প্রাণটা এখনও আছে বলেই মনে হচ্ছে। আপনি ভাববেন না কিছু– টেলিফোন করা হয়েছে– য়্যাম্বুলেন্স এতক্ষণে এস যাবারই কথা। ঐ বোধহয আসছেও– যা ভিড়
হঠাৎ শরতের মনে হল–সাগুটা? নামিয়েছে তে ওরা? সবসুদ্ধ যদি পুড়ে যায় উমা এসে রাগারাগি করবে–
য়্যাম্বুলেন্সটা সত্যিই এগিয়ে এল। স্ট্রেচার নিয়ে কারা নামছে?
একবার দেখে নিলে হত। তখন তো ভাল করে চাওয়াই হল না– সব যেন ঝাপসা একাকার হয়ে গেল। শুধু নজরে পড়েছিল চওড়া লাল শাড়ির পাড়টা, আর হাতের সাদা শাঁখাটা। সেও চকিতে, তারপর আর কিছু দেখতে পান নি।
কে একজন এসে একটা পুঁটুলি রেখে দিল ওঁর পাশে।
‘ওনার হাতেই বোধহয় ছিল পুটুলিটা। দেখুন তো… কী ছিল তা তো জানি না, খুলে ছড়িয়ে গিয়েছিল। যতটা পেরেছি কুড়িয়ে এনেছি–‘
পুঁটুলির গেরোটা খোলে নি– এদিকেটা বোধহয় রাস্তায় ঘষড়ে ছিঁড়ে গেছে। কাদা- মাখামাখি– তবু ঝাড়নটা ওঁদের বলেই মনে হল। নতুন ঝাড়নটা, মাত্র কদিন আগে এনেছেন উমা। কে এক ছাত্রীর মা দিয়েছে– ওঁর ঝাড়নটা ছিঁড়ে গেছে দেখে। সেই ঝাড়নের এই অবস্থা দেখলে উমা হায়-হায় করবেন–
কতকটা যেন যন্ত্রচালিতের মতোই পুঁটুলি খুলে দেখলেন শরৎ, ছেঁড়ার দিকটাই খুলে দেখলেন। একটা গোল কাঠের বাক্স– আঙুর নিশ্চয়ই, গোটা দুই বেদানার মতোও মনে হচ্ছে, আরও সব কী রয়েছে। একটা খালি শালপাতার ঠোঙ্গা–খালি কেন? ও–এই যে ক্ষীরের বরফি ছিল, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেছে–এক-পয়সানে চিনি-কচকচে বরফি, যা পূজোয় দেয় সাধারণতঃ, শরৎ ভালবাসেন এগুলো খেতে। দুধসাগু কি পরোটার সঙ্গে খাবেন মনে করেই নিয়েছিল বোধহয়–
চুপ করে বসে রইলেন শরৎ। য়্যাম্বুলেন্সে তোলা হল, একটু পরে তা চলেও গেল। পাহারাওলা ভিড় ঠেলে এসে ওঁর নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলো। ভাগ্যে বিমু কাছে ছিল, সেই বলে দিলে। উনি হয়ত বলতে পারতেন না। নম্বরটা আজও জানেন না বাড়ির, কাউকে কোনদিন ঠিকানা দেবার তো দরকার হয় নি।
পাহারাওলা ঠিকানাটা নিয়ে বোধহয় য়্যাম্বুলেন্সকেই দিলে। কে জানে–য়্যাম্বুলেন্স চলে যেতেই ট্রাম ছেড়ে দিল। পর পর ট্রামগুলো চলল সার বেঁধে। এইবার ভিড়ও হাল্কা হয়ে গেল, মজা দেখা মিটে গেছে, অনেকেরই এবার বোধহয় মনে পড়েছে বাড়ির কথা, কাজের কথা। যেটুকু ভিড় রইল এখন ওঁকে ঘিরে।
কে একজন এসে ওঁর হাত ধরল, ‘উঠুন মেসে মশাই। বাড়ি চলুন।’
‘বাড়ি?…হ্যাঁ, যাব বৈকি। কোন্ হাসপতালে নিয়ে গেল ওরা বাবা–জান কেউ? একটু খবর পাওয়া যাবে না?
‘বিমু গেছে মেসোমশাই। বিমু আর তারক। ওরা ফিরলেই সব খবর পাবেন। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনি…. আপনি এখন বাড়িতেই যাবেন তো?’
‘আর কাউকে খবর-টবর দিতে হবে?’ বাড়িওলাদেরই আর একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করে। তার মুখটা এতক্ষণে চিনতে পারেন শরৎ।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,– খবর দিতে হবে।…এই কাছেই মদন মিত্তিরের লেনে আমার বড় শালি থাকে। কিন্তু নম্বর জানি না… আমার সঙ্গে যাবে কেউ বাবা? তাদেরই খবর দিতে হবে। তারাই ওর আপন–
‘চলুন চলুন, আমরা সবাই সঙ্গে যাচ্ছি।’
উঠে দাঁড়িয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে একবার পুঁটলিটার দিকে হাত বাড়ালেন।’
আমরা নিচ্ছি মেসোমশায়। আপনি চলুন।’
মাথাটা এখনও ঘুরছে। একজনের কাঁধে হাত রেখে সামলে নিলেন টালটা। তার কাঁধটা ধরেই চললেন ধীরে ধীরে।… সাগুটা ওরা নামাবে তো? কড়াসুদ্ধ যদি ধরে যায়– উমা বড় বকাবকি করবে–