দশম অধ্যায় – সম্মানীয় ম্যাগলোয়া
নতুন বছর শুরু হয়েছে, কিন্তু থিবল্ট কী করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সরাইখানা থেকে দ্বিগুণ লাভের আশায় বেশি করে শিকার করাতে লাগল ও।
থিবস্টের শরীর ঠিক থাকলেও আত্মা বদলে যাচ্ছে। দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে মাথার লাল চুল। ভাল পোশাক, পকেটে পয়সা, সব মিলে এখন আর ওকে জুতো-কারিগর মনে হয় না। মনে হয় অবস্থাপন্ন কৃষক বা সচ্ছল নাগরিক, কোন ব্যবসার কাজে এসেছে।
একটা গ্রামের উৎসবে যোগ দিল ও। সেখানে বিল পেঁচার আয়োজন ছিল। বিল সেঁচার বিষয়টা বেশ উত্তেজনাকর। দূর দূরান্ত থেকে লোকে দেখতে আসে। অনেক আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া হয়। এক থেকে তিন মাইল লম্বা বিলে একদিক থেকে পানি ছাড়া হয়, আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে যায় সেই পানি। শুধু মাছ থেকে যায়। সেই খালি বিলে ছোট বড় সব মাছ ধরার নামই বিল পেঁচা। এই কাজ সমাধা হতে অনেক সময় সাত দিনও লেগে যায়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী এবং দর্শকদের সবাই প্রস্তুত হওয়ার আগে মাছ ধরা শুরু হয় না।
অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দর্শকেরা এসে হাজির হয়। যে যেখানে পারে, জায়গা করে নেয়। তারপর বিলে পানি ছাড়া শুরু হয়। প্রথমে পরিষ্কার পানি, তারপর একটু ময়লা, তারপর আরও ময়লা। একসময় মাছের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরাতে থাকে মাছ। তখন একদল লোক নেমে সেই মাছ তুলতে শুরু করে। জীবিত মাছগুলো ঝুড়িতে ভরে ট্যাংকে জমা করা হয়; আর মরা মাছ ঘাসে ফেলা হয় দিন শেষ হবার আগেই বিক্রি করার জন্য।
সুইসগেট দিয়ে পানি বেরোতে থাকে। আসল খেলাটা শুরু হয় যখন মাছের চাপে পানি বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়। মাছ তোলার দলকে তখন বিশাল সব মাছের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়! দর্শকরা এসময় এসে হাততালি দিতে থাকে।
এভাবে চলে পাঁচ-ছয় দিন। তারপর কাদার ভেতর থেকে বেয়োয় ঈল মাছগুলো। ওগুলোর জন্য পিস্তলধারীরা ঘুরে বেড়ায় পুকুরের কাছে।
থিবল্টও হাত-পা চালিয়ে বিলের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল। পথে এক মহিলার জামা কুঁচকে দিল ও। মহিলা পরিপাটি জামা পরতে পছন্দ করে, তাই ঘুরেই একটা ঝাড়ি মেরে বসল। পাল্টা জবাব দিতে তাকিয়ে থিবল্ট আবিষ্কার করল, মহিলা খুবই সুন্দরী। পিছিয়ে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল ও।
সৌন্দর্যের জয় সবসময়। এমন যদি হত যে মহিলা খুব ক্ষমতাশালী, কিন্তু দেখতে সুন্দর না-তাহলেও থিবল্ট পাল্টা জবাব ঠিকই দিত। আবার এটাও হতে পারে, মহিলার সঙ্গীকে দেখে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্যবান, ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ। কালো রঙের পোশাক পরা। লম্বায় এতই খাটো, মাথাটা কোনমতে মহিলার কনুই পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভালই হয়েছে-লোকটার হাত ধরে রাখা মহিলার জন্য হত শাস্তির নামান্তর। লোকটার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে আছে সে। বেখাপ্পা ধরনের কিছু আধুনিক চীনা মূর্তি আছে না? ছোট পা, বিশাল ভূঁড়ি, মোটা হাত, সুন্দর করে ঝুঁটি বাধা চুল? সেগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে লোকটা। কিছু পোকাও আছে, যেগুলোর পা শরীরের তুলনায় এতই ছোট যে হাটার বদলে গড়িয়ে যাওয়াটাই তাদের জন্য সুবিধাজনক। সেই পোকাগুলোর আকৃতির সাথেও কেমন একটা সাদৃশ্য আছে লোকটার। তবে এসব সত্ত্বেও হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি দেখে তার প্রতি যে কেউ আকর্ষণ বোধ করবে। লোকটা যেন জীবনটা উপভোগ করতেই ধরাধামে এসেছে। মহিলাকে থিবল্টের উপর ক্ষেপে উঠতে দেখে বাধা দিল সে।
ধীরে, মাদাম ম্যাগলোয়া, ধীরে। এই বেচারাকে এত কঠিন কথা বলার দরকার নেই, ও নিজে থেকেই যথেষ্ট দুঃখিত।
আমার এত সুন্দর জামাটা নষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ দেব, তাই না? পায়ে পাড়া দেয়ার কথা তো বাদই দিলাম।
থিবল্ট বলল, ক্ষমা করবেন, মাদাম। আপনি যখন তাকালেন, এত সুন্দর মুখ দেখে খেয়াল করতে পারিনি কোথায় পা দিচ্ছি।
তিন মাস থিবল্ট নেকড়েদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে। সে হিসেবে প্রশংসার ভাষাটাকে খারাপ বলা যাবে না। অবশ্য প্রশংসায় মহিলা গলল না। থিবল্ট ভাল পোশাক পরে আছে। কিন্তু তারপরও মেয়েদের কৌতূহলী অন্তদৃষ্টি দিয়ে সে বুঝে ফেলেছে-থিবল্ট তাদের সমপর্যায়ের মানুষ নয়।
মহিলার সঙ্গী অবশ্য তার খাটো হাতে হাততালি দিয়ে বসল।
বাহ! তোমাকে বেশ বুদ্ধিমান বলেই মনে হচ্ছে বন্ধু। মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তুমি জানো। মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কত সুন্দর করে তোমার প্রশংসা করল। আমাদের উচিত ওকে ড্রিংকের দাওয়াত দেয়া।
নেপোমুশেন, তোমাকে আমি চিনি। সবসময় তুমি ড্রিংক করার তালে থাকো। উপলক্ষ না থাকলে সুযোগ তৈরি করে নাও। ভুলে গেছ, ডাক্তার তোমাকে মদ খেতে নিষেধ করেছে?
তা ঠিক। তাই বলে তো ভদ্রতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেনি। সুজান, এই রুক্ষ মনোভাবটা তোমাকে মানাচ্ছে না। বাইরের কেউ শুনলে ভাববে একটা গাউন নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছ। এই ভদ্রলোককে আমাদের সাথে বাড়ি যেতে রাজি করাও। যদি পারো, বাড়িতে পা দেয়া মাত্র তোমার পছন্দের সিল্কের জামা কেনার টাকা আমি দেব।
এই কথায় জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। মাছ ধরার পালাও শেষের পথে। মহিলা থিবল্টের বাড়িয়ে দেয়া হাত জড়িয়ে ধরল।
ওদিকে থিবল্ট তো মহিলার রূপে মুগ্ধ। স্বামী-স্ত্রীর কথা থেকে বুঝতে পারল, মহিলা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী। বেরোবার সময় ভিড় আলগা করার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করল ও।
থিবল্ট ভাবছে এই বেইলিফের স্ত্রীর পছন্দের লোক হিসেবে কী কী সুবিধা ও ভোগ করতে পারবে। মহিলা তার নিজের সুখ কল্পনায় বিভোর। থিবল্টের দিকে তেমন একটা মনোযোগও দিচ্ছে না। মহিলার ক্ষুদে সঙ্গী ওদের পাশে হাস্যকর ভঙ্গীতে হাঁটছে আর গল্প করছে। বলতে গেলে যাত্রাপথটা সেই জমিয়ে রেখেছে।
একাদশ অধ্যায় – ডেভিড আর গোলাইয়াথ
ওরা হেঁটে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত গেল। বেইলিফ সাহেব সিঁড়ি টপকে গিয়ে বেশ কষ্ট করে ঘণ্টা বাজাল। বাড়ির কর্তা অতিথিসহ বাড়ি ফিরেছে। এক সুবেশী গৃহপরিচারিকা এসে দরজা খুলে দিল। তাকে নিচু কণ্ঠে খাবার আয়োজনের নির্দেশ দিয়ে ঘুরল ছোটখাটো মানুষটা। আসুন, বেইলিফ নেপোষুশেন ম্যাগলোয়ার বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।
মাদামকে আগে যেতে দিল থিবল্ট। তারপর ও ড্রইংরুমে ঢুকল।
থিবল্ট মুগ্ধ হয়ে ঘরের চাকচিক্য লক্ষ করছিল। এমন সুযোগ এর আগে কখনও পায়নি ও। মাদাম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লক্ষ করল ওর মুগ্ধতা। কিন্তু স্বামীর মন রক্ষার্থে অতিথিকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। একটু পর অবশ্য ক্লান্তির কথা বলে ঘরে চলে গেল সে। যাওয়ার আগে, থিবল্ট যেন ওদের বাড়িতে আবার আসে, এই আশা ব্যক্ত করে হাসিমুখে বিদায় নিল।
মাদাম চলে যেতেই মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া সে উপলক্ষে পান করার তোড়জোড় শুরু করল। কোন জমায়েতে বা বল-রুমে মেয়েরা আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু মদের আসরে, পুরুষের চেয়ে উত্তম সঙ্গী আর হয় না। কী বলে?
পরিচারিকা পেরিন এসে জানতে চাইল কোন ওয়াইনটা আনবে। কিন্তু ওয়াইনের ব্যাপারে কোন মেয়েকে বিশ্বাস করতে রাজি নয় বাড়ির কর্তা। তাই জবাবে পেরিনকে নিচু হতে বলল ম্যাগলোয়া। ও ঝুঁকতে একটা চুমু খেল ওর গালে। কিন্তু মোটেই লজ্জা পেল না মেয়েটা। সম্ভবত এটা অভিজাতদের স্বাভাবিক আচরণ।
মেয়েটা হাসিমুখে আবার জানতে চাইল, স্যার, কোটা আনব?
কোনটাই না, পেরিন। ভাল ব্র্যান্ড সংখ্যায় এত আছে, যে সঠিকটা তুমি খুঁজেই পাবে না। তাই আমিই সেলারে যাচ্ছি। ছোট ঘোট পায়ে দম দেয়া খেলনার মতো করে হেঁটে সেলারের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল সে। পার্থক্য, এই পুতুলটার দম ঈশ্বর নিজে দিয়েছেন! থিবল্ট নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। নিতান্ত কপালগুণেই এমন বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাসরত সৌহার্দ্যপূর্ণ স্বামী এবং সুন্দরী স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয়েছে ওর। মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে বেইলিফ দুহাতে আর দুবগলে দুটো দুটো চারটা বোতল নিয়ে ফেরত এল।
এরইমধ্যে সাপারের সময় হয়ে গেছে। যে সময়ের কথা, তখন ডিনার হত মধ্য দুপুরে এবং সাপার ছটা নাগাদ। ছটা বাজার আগেই অবশ্য সন্ধ্যা নেমে গেছে। তা ছটাই বাজুক কি বারোটা, যদি আলো জ্বালিয়েই খেতে বসতে হয়, তাহলে সেটাকে সাপার বলাই ভাল!
বোতল নামিয়ে ঘন্টা বাজাল বেইলিফ। পেরিন আবার এসে ঢুকল।
খাবার কখন সাজানো হবে? ম্যাগলোয়া প্রশ্ন করল।
যখন আপনি চাইবেন। জানি আপনি দেরি পছন্দ করেন না, তাই আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি।
তাহলে যাও, মাদামকে জিজ্ঞেস করো আসবে কি না। এটাও বলল, আমরা অপেক্ষা করছি।
পেরিন চলে গেল।
চলো বন্ধু, খাবার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করি। নিশ্চয়ই তোমার ক্ষুধা পেয়েছে। আর ক্ষুধা পেলে পেট ভরাবার আগে চোখ ভরাই আমি!
মনে হচ্ছে আপনি বেশ পেটুক মানুষ!
ভোজনরসিক…ভোজনরসিক, পেটুক না! দুটোকে গুলিয়ে ফেলো না। আমি আগে যাচ্ছি, পেছন পেছন এসো।
মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া তার অতিথিকে খাবার ঘরে নিয়ে এল। তারপর থিবল্টের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল, রাধুনী হিসেবে মেয়েটাকে তোমার কেমন মনে হচ্ছে? আয়োজনটা দেখো, খুবই সাধারণ। কিন্তু আমার মন ভরে গেছে। আমার বিশ্বাস, বালশাজারের ভোজও সামলাতে পারবে ও।
আপনি ঠিকই বলেছেন, মাননীয় বেইলিফ। দেখেই যে কারও মন ভরে যাবে। থিবল্টের চোখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
খুব জমকালো আয়োজন না হলেও, দেখে মনে হচ্ছে বেশ উপাদেয় হবে। টেবিলের এক মাথায় রাখা আছে নানা রকম মসলা দিয়ে সিদ্ধ করা বড়সড় একটা মাছ। অন্য প্রান্তে শোভা পাচ্ছে বন্য শূকরের মাংস আর পালং শাক দিয়ে প্রস্তুত করা সুস্বাদু চেহারার ঝোল। এছাড়াও রয়েছে দুটো তিতির পাখি দিয়ে বানানো একটা মাংসের পাই এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক ডিশ। থিবল্ট খাবার দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল, পেরিনের ফিরে আসাটা লক্ষই করেনি। মাদাম অতিথির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে এই বলে যে তার খুব মাথা ধরেছে। পরেরবার এলে অতিথির উপযুক্ত সত্ত্বার করবে।
বেইলিফ দৃশ্যতই খুশিতে হাততালি দিল।
ওর মাথা ধরেছে। চলো, বসে পড়ো। টেবিলে আগে থেকে রাখা কয়েকটা বোতলের পাশে সেলারের বোতলগুলোও জায়গা করে নিল।
দুজনেই বেশ ক্ষুধার্ত। দ্রুতই খাবার শেষ হতে লাগল। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কথা হচ্ছে।
মাছটা ভাল, তাই না?
খুব!
আর ওয়াইনটাও বেশ।
চমৎকার।
খেতে খেতে নেপোষুশেন ম্যাগলোয়ার ইতিহাস জানা হয়ে গেল থিবল্টের।
অর্লিয়ন্সের ডিউক লুই-এর চার্চের আসবাবপত্র তৈরি করত ম্যাগলোয়ার বাবা। লুইয়ের ছেলের প্রধান রাধুনী ছিল ম্যাগলোয়া। ছোট থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ তার। রান্নায় দক্ষতার কারণে অভিজাতমহলে প্রবেশাধিকারও ছিল। পঞ্চান্ন বছর বয়সে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ম্যাগলোয়া।
ডিউক তাকে ডেকে পাঠায়। জানতে চায় কী পরিমাণ সঞ্চয় করেতে পেরেছে ম্যাগলোয়া তার চাকরি করে। ওর সঞ্চয়ের পরিমাণ শুনে প্রিন্স অসম্ভষ্ট হয়, যে লোক তিরিশ বছর তাকে সেবা করেছে, তার এত কম সঞ্চয় থাকলে সেটা তাকে অপমানেরই নামান্তর। তাই ম্যাগলোয়াকে আরও অর্থ দেয় সে চলার জন্য এবং বেইলিফের পদটাও তার জন্য বরাদ্দ করে, যাতে করে একটা মোটা অংকের বাৎসরিক আয় হয় ম্যাগলোয়ার। তার উপর ডিউক ওর বাড়িও সাজিয়ে দেয় বিলাসবহুল ভাবে।
থিবল্ট আরও জানল, মাদাম ম্যাগলোয়া হচ্ছে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার চতুর্থ স্ত্রী। বিয়ে করেছে স্ত্রীর রূপের জন্য। বয়স যতই হোক না কেন, স্ত্রী মারা গেলে আবার বিয়ে করতে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার আপত্তি নেই।
এরপর ম্যাগলোয়া শুরু করল স্ত্রীর গুণকীর্তন। স্বামীর মদ খাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করা এবং জামাকাপড়ের প্রতি দুর্বলতা ছাড়া, পৃথিবীতে এমন কোন গুণ নেই, যা মাদামের নেই। একসময় ম্যাগলোলায়ার নিজের এবং স্ত্রীর গল্প বলা শেষ হলো। এবার সে আশা করল থিবল্ট ওর গল্প বলবে। সত্য গোপন করে থিবল্ট বলল যে ও একজন ধনী খামার মালিক। নিজের এলাকায় বিশাল বন রয়েছে ওর। বনে শিকার উপযোগী প্রচুর পশুও আছে। শুনে খুব খুশি হলো ম্যাগলোয়া। হরিণের মাংস খুব পছন্দ করে সে। নতুন বন্ধুর মারফত শিকার করা হরিণ খাওয়ার সুযোগ পাবে।
সাত-সাতটা বোতল শেষ করার পর থামার সিদ্ধান্ত নিল ওরা দুজনে।
থিবল্ট যখন বিদায় নিয়ে বেরোল তখন মাঝরাত। খোলা বাতাসে আসার সাথে সাথে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফল টের পেল ও। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, কোনমতে গিয়ে একটা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করল। এসময় মাথার ছয় কি আট ফুট উপরে একটা জানালা খোলার আওয়াজ পেল ও। মনে হয় ম্যাগলোয়া তার নতুন বন্ধুকে আরেকবার বিদায় জানাতে চাইছে। তারপর হঠাৎ করেই ওর ডান কাঁধে বাড়তি ওজন এসে পড়ল! এরপর বাম কাঁধে। ভারের চাপে ধীরে ধীরে বসে পড়তে বাধ্য হলো থিবল্ট। কেউ একজন ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানুষটা বলে উঠল, ঠিক আছে, লেভিলি! ঠিক আছে। উপরে জানালা বন্ধের শব্দ হলো।
দুটো জিনিস থিবল্ট বুঝতে পারল। এক, কেউ ওকে লেভিলি বলে ভুল করেছে। আর দুই, কোন প্রেমাস্পদ ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুটোই ওর কাছে অপমানজনক মনে হলো।
মাতালের মতো হাত বাড়িয়ে আগন্তুকের জামা চেপে ধরল ও। কী করছ, বুদ্বু? কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগল থিবল্টের কাছে, কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারল না ও, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করছ?
অবশ্যই, আমি জানতে চাই কে আমাকে মই হিসেবে ব্যবহার করল?
তারমানে তুমি লেভিলি নও?
না।
যে-ই হও, তোমাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ! তোমার কী ধারণা ধন্যবাদ বললেই ব্যাপারটা চুকে যাবে?
সেরকমটাই আশা করছি।
ভুল আশা করেছ।
ছাড়ো আমাকে! মাতাল কোথাকার!
মাতাল! মাত্র সাত বোতল খেয়েছি আমরা। এরমধ্যে বেইলি নিজেই চার বোতল খেয়েছেন।
ছাড়ো বলছি আমাকে! ব্যাটা মদখোর কোথাকার!
মদখোর! তিন বোতল ওয়াইন খেয়েছি বলে আমাকে মদখোর বলছ?
তিন বোতল খাওয়ার জন্য বলিনি। তিন বোতলে মাতাল হওয়ার জন্য বলেছি। আবারও নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল লোকটা, এই গর্দভ, তুই আমাকে ছাড়বি কি না বলু?
এমনিতেই লোকের মুখে গালমন্দ শোনা পছন্দ করে না থিবল্ট, আর এখন মাতাল অবস্থায় তো সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না।
শয়তানের দিব্যি, তুমিই হচ্ছ আসল গর্দভ। আমাকে ব্যবহার করে আমাকেই অপমান করছ। তোমার নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়া উচিত।
বলার সাথে সাথে চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি খেল থিবল্ট। এই নে, একজন সৎ ইহুদীর মতো পাওনা চুকিয়ে দিতে জানি আমি! কাকে কী বলছিস বুঝে বলিস!
থিবল্টও জবাব দিল প্রতিপক্ষের বুক বরাবর ঘুষি হাঁকিয়ে। ফলাফল দেখে মনে হলো, একটা ছোট বাচ্চা আঙুল দিয়ে কোন ওক গাছে ধাক্কা মারার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তে আগের চেয়েও জোরদার আরেকটা ঘুষি খেল থিবল্ট। প্রমাদ গুনল ও। এভাবে ঘুষির জোর বাড়তে থাকলে, ভূমিশয্যা নেবার বেশি বাকি নেই।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল থিবল্ট। হাতে একটা পাথর ঠেকতে সেটা তুলে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে শত্রুর মাথা বরাবর হাকাল ওটা। এবারে কাজ হলো! গোড়া-কাটা ওকের মতো সটান মাটিতে পড়ে গেল ওর প্রতিপক্ষ।
ঝেড়ে দৌড় দিল থিবল্ট। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে দেখার জন্য পেছন ফিরে একবার তাকালও না।
দ্বাদশ অধ্যায় – ভেড়ার পালে নেকড়ে
বেইলিফের বাড়ি থেকে বন বেশি দূরে ছিল না। সেই বনে ঢুকতেই নেকড়ের দল লেজ নেড়ে খুশি প্রকাশ করে ঘিরে ধরল থিবন্টকে। দুয়েকটা কথা বলে, কাছের নেকড়েটাকে একটু আদর করে, পথ চলতে চলতে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল থিবল্ট।
সন্ধ্যাটা নেহাত মন্দ যায়নি ওর। নিমন্ত্রণদাতার সাথে তাল মিলিয়ে মদ খেয়েছে। হাতাহাতিতে একজনকে পরাজিত করেছে। নিজেকেই বলল, থিবল্ট, স্বীকার করতেই হবে, তোমার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। মাদাম সুজানের মতো কাউকেই তুমি এতদিন খুঁজছিলে। বেইলিফের স্ত্রী! স্ত্রী হিসেবে এমন মেয়ে আর পাওয়া যাবে না, এখন শুধু বেইলিফ মারা গেলেই হয়। স্ত্রী তোক বা প্রেমিকা, মেয়েটা পাশে থাকলে তোমাকে ভদ্রলোক না ভেবে কারও কোন উপায় থাকবে না। যদি কোন ভুল না করো, তাহলে সবই তোমার হবে। প্রথম পরিচয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিল মেয়েটা। তবে বাড়ি যাবার পর কত ভাল ব্যবহারই না করল। সময়মতো ব্যবস্থা নিলেই আর কোন সমস্যা হবে না। যদিও বেচারা ম্যাগলোয়ার মৃত্যু আমি চাই না। চাওয়া উচিতও না। স্বাভাবিকভাবে মারা গেলে ঠিক আছে, কিন্তু হত্যার চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। হাজার হোক ওয়াইন আর প্রচুর সুস্বাদু খাবার খাইয়েছে। তারপর একটা রহস্যময় হাসি হেসে যোগ করল, তবে যে হারে মদ আর খাবার খায় নোকটা, ওপারে যেতে বেশি সময় লাগার কথা না। কোন অসুস্থতা বা অস্বাভাবিক মৃত্যু চাই না আমি ওর। আর দশজনের ভাগ্যে যা জোটে, ওর ভাগ্যে যেন তার চেয়ে একটু বেশি জোটে!
খুশিতে হাত ঘষতে লাগল ও। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে শহরে চলে এসেছে। টেরই পায়নি। এখন ব্যাপারটা লক্ষ করে ইশারায় নেকড়েগুলোকে চলে যেতে বলল। নেকড়ের পাহারায় কেন বা কীভাবে চলাফেরা করছে এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। তাছাড়া কোন কুকুর দেখে ফেললে ডেকে ডেকে লোকের ঘুম ভাঙিয়ে ফেলবে।
বাড়ি ফিরে থিবল্ট দেখল, নেকড়েগুলো তখন বিদায় নিলেও, ঠিকই ওর ঘরের সামনে এসে অপেক্ষা করছে। ওগুলোকে পরের রাতে একই সময়ে আবার আসতে বলল ও।
বাড়ি পৌঁছতে যদিও রাত দুটা বেজেছিল, থিবল্টের ঘুম কিন্তু সকাল সকালই ভাঙল।
ম্যাগলোয়াকে যে জমির কথা বলেছে ও, সেটা আসলে অর্লিয়ন্সের ডিউকের। ও একটা পরিকল্পনা করছে। বেইলিফ শিকারের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সেকারণেই সকাল সকাল ওঠা। সারাদিন ঘুরে হরিণ, বুনো শুয়োর, খরগোশ এগুলোর ডেরা খুঁজে বের করল থিবল্ট। অন্ধকার নামলে নেকড়েদের মতো ডাক ছাড়ল ও। সেই ডাক শুনে বুড়ো, বাচ্চা সমেত নেকড়ের দল আরও ভারি হয়ে ছুটে এল।
থিবল্ট নিজেও ওদের সাথে শিকারে যাবে।
সে রাতে শিকার যেটা হলো তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারারাত বন জুড়ে হুটোপুটির আওয়াজ শোনা গেল।
নেকড়েরা দলবদ্ধ হয়ে শিকার করছে আর থিবল্ট তাদের সাথে ছুরি হাতে কাটাকাটি করছে। হরিণ, শুয়োর, খরগোশ সবরকম শিকারই হলো সে রাতে।
থিবল্টের ঘরের সামনে শিকারের স্তূপ জমে গেল। সকালে একটা ঠেলা ভর্তি করে মাংস নিয়ে গেল ও বিক্রি করতে। আর সেরা মাংসগুলো রেখে দিল মাদাম ম্যাগলোয়ার জন্য।
নিজে না গিয়ে আগে উপহার পাঠানোর বুদ্ধিটা মাথায় এল ওর। এক লোককে টাকা দিল শিকারগুলো বেইলিফের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। একটা কাগজে লিখে দিল, মঁসিয়ে থিবল্টের পক্ষ থেকে। একটু পরেই ও রওনা হলো। যখন পৌঁছল ততক্ষণে শিকারের মাংস টেবিলে রাখা হয়েছে।
খুশির চোটে হাত মিলিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল বেইলিফ। যদিও উচ্চতার স্বল্পতা এবং স্বাস্থ্যের আধিক্যের কারণে ব্যর্থ হলো চেষ্টাটা। তারপর হয়তো ভাবল, যে কাজ সে নিজে পারেনি, সে কাজে মাদাম ম্যাগলোয়া হয়তো সাহায্য করতে পারবে! দরজার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে ডাকল, সুজান, সুজান!
স্বামীর ডাক শুনে উপর থেকে নেমে এল সুজান। এসে দেখল তার স্বামী ঘুরে ঘুরে টেবিলে রাখা শিকারগুলো দেখছে। দেখো, দেখো সুজান! হাতে তালি দিয়ে বলল ম্যাগলোয়া, দেখো থিবল্ট কী করেছে! ও এমন একজন লোক যে জানে কীভাবে কথা রাখতে হয়। সেদিন কথা দিয়েছিল আমাদের শিকারের মাংস খাওয়াবে। আজ গাড়ি ভর্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সাথে হাত মেলাও, ধন্যবাদ জানাও ওকে।
স্বামীর কথা অনুযায়ী হাত মেলাল মাদাম। চুমু খাবার জন্য গাল এগিয়ে দিল। টেবিলের শিকারগুলোর দিকে তাকাল সে।
কোনটা দিয়ে কী রান্না হবে সে নির্দেশনা দিল ম্যাগলোয়া। স্বামীর এই উচ্ছ্বাসের তুলনায় স্ত্রীকে কিছুটা ম্লান মনে হলো। তবে মাদাম জানাতে ভুলল না-থিবল্টকে শুধু খেয়েই না, থেকেও যেতে হবে। এই আমন্ত্রণে থিবল্টের খুশি সহজেই অনুমেয়। যতক্ষণে মাদমোয়াজেল পেরিন উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করছে, ততক্ষণ থিবল্ট একসাথে গলা ভেজানোর প্রস্তাব রাখল।
থিবল্ট রাধুনীর নামও মনে রেখেছে দেখে মাদাম ম্যাগলোয়া একটু অবাকই হলো। সেলার থেকে ফ্রান্সে কম পরিচিত ডাচ ভারমুথ আনা হলো গলা ভেজানোর জন্য।
তৈরি হবার জন্য নিজের ঘরে ফিরে গেল সুজান। ফেরার পর তার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে কষ্ট হলো থিবল্টের। চোরা দৃষ্টি হানছে ও সুজানের দিকে, শুধু তাই নয়, দুঃসাহস দেখিয়ে টেবিলে তলা দিয়ে হাঁটুর গুতো দিচ্ছে মহিলার হাঁটুতে। সুজান এক সময় চোখ তুলে থিবল্টের দিকে তাকাল। তারপর হঠাই ফেটে পড়ল হাসিতে। বেইলিফও একটু চমকে উঠল। থিবল্টের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল হঠাৎ কী ঘটল। তারপর চেঁচিয়ে উঠে বলল, বন্ধু! আগুন লেগে গেছে তো!
দাঁড়িয়ে পড়ল থিবল্ট, কোথায়? কীভাবে? তোমার চুলে। বলেই জরুরি ভঙ্গিতে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে গেল সে। হাত তুলে নিষেধ করে বসে পড়ল থিবল্ট। বুঝে ফেলেছে কী ঘটেছে। গত দুদিনের দৌড়াদৌড়িতে ভুলেই গিয়েছিল আজ চুল ঢেকে আসার কথা। তাছাড়া বিগত দিনগুলোতে ছোটখাটো অনেক ইচ্ছাও পূরণ করেছে। তাতে লাল চুলের সংখ্যা আরও বেড়েছে ওর। অস্বস্তি ঢাকার চেষ্টা করল থিবল্ট। আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন!
কিন্তু, কিন্তু… এখনও কিছুটা ভয় মেশানো দৃষ্টিতে চুলের দিকে তাকিয়ে আছে বেইলিফ।
এটা কিছু না। চুলের এই রং দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একবার গরম কয়লা ভর্তি একটা পাত্রের কারণে মায়ের চুলে প্রায় আগুন লেগে গিয়েছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল মা। আমার জন্মের আগের কথা। সে কারণেই রংটা এমন হয়েছে।
হাসি থামাবার জন্য পানি খেল মাদাম সুজান। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আজই প্রথম এটা চোখে পড়ল।
তাই? বলার মতো কোন উত্তর খুঁজে পেল না থিবল্ট।
আগেরদিন আমি আপনাকে ভালমতোই লক্ষ করেছি। সেদিন কিন্তু আপনার চুল কালোই ছিল।
এই কথায় থিবল্টের আশার পালে হাওয়া লাগল।
আহ! মাদাম! আপনি নিশ্চয়ই এই প্রবাদগুলো শুনেছেন-রক্তিম চুল, উষ্ণ হৃদয়, আর এটা, কিছু মানুষ বাজে জুতোর মতো-বাইরে সুন্দর, ভেতরে ক্ষত।
জুতোর উদ্ধৃতি শুনে মুখ কোঁচকাল মাদাম সুজান। কিন্তু তার স্বামী, স্ত্রীর সাথে একমত হতে পারল না।
থিবল্ট একেবারে খাঁটি কথা বলেছে।
এরপর থিবল্টের চুল নিয়ে আর কোন কথা হলো না। তবে মাদাম সুজানের চোখ বারবার ওর চুলের দিকে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা থিবকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। হাত দিয়ে চুল ঠিক করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু চুলগুলো তো আর মানুষের চুল নেই। ঘোড়ার চুলের মতো খাড়া হয়ে গেছে। কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছে না। তবে আশার কথা, হাঁটুর ব্যাপারে মাদাম সুজান কোন অভিযোগ করেনি। এতে করে থিবল্টের ধারণা হলো, কিছুটা অগ্রসর হওয়া গেছে।
অনেক রাত পর্যন্ত ওরা বসে ছিল। এর মাঝে বেশ কয়েকবার সুজান অন্য ঘরগুলোয় ঘুরে এসেছে। সেই ফাঁকে ম্যাগলোয়াও সেলারে ঢু মেরে এসেছে।
গোপনে আনা অনেক বোতল জমে গেল বেইলিফের ওভারকোটের ভেতরে, পুরাদস্তুর নেশার ঘোরে ডুবে আছে সে। মাদাম সুজানকে প্রেম নিবেদনের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। থিবল্ট রাতের মতো ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করল। সে রাতের পানাহার পর্বের ওখানেই যবনিকা পড়ল। পেরিন থিবকে নিয়ে গেল তার ঘরে। ওকে জিজ্ঞেস করে থিবল্ট জেনে নিল কার ঘর কোনটা।
মাদাম সুজান তার স্বামীকে ঘরে যেতে সাহায্য করছে। এদিকে পা টিপে টিপে নিজের ঘর থেকে বেরোল থিবল্ট। মাদাম সুজানের ঘরের দরজার কাছে এসে কান পাতল। ভেতরে কোন শব্দ শোনা গেল না। চাবিটা দরজার তালার সাথেই লাগানো। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তারপর চাবি ঘোরাল ও।
ঘরটা অন্ধকার। তবে সেটা কোন সমস্যা না-নেকড়েদের সাথে থেকে থেকে থিবল্ট এখন অন্ধকারেও দেখতে পায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথায় কী আছে দেখে নিল ও। তারপর সবচেয়ে দূরের জানালার পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। ওর হৃদপিণ্ড ধুকধুক করছে। সুজান ঘরে ঢুকল। দরজার আওয়াজটা ক্রয়োলের সেই মিলের চাকার অশুভ আওয়াজের কথা মনে করিয়ে দিল থিবল্টকে। ওর প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল-মাদাম সুজান ঘরে ঢোকা মাত্র বেরিয়ে আসা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তাতে সুজান চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। তারচেয়ে সুজান ঘুমিয়ে পড়লে নাহয় বেরোনো যাবে।
ও সুজানকে ভালবেসে ফেলেছে-এই কথাটা নিজেকে বোঝাতে গিয়ে সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে ফেলেছে থিবল্ট। কালো নেকড়ের ছত্রছায়ায় থাকলেও, নতুন প্রেমিকের মতোই নার্ভাস বোধ করছে ও। সুজান আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর শুরু করল সাজতে। মনে হচ্ছে কোন একটা ভোজ বা উৎসবে যাবে। খুব যত্নের সাথে কাপড় বাছাই করছে সে, গলায়-হাতে গহনা পরছে, চুল ঠিক করছে।
এসবের মানে খুঁজে পেল না থিবল্ট। জানালায় শব্দ হতে চমকে উঠল ও। সুজানও আলো নিভিয়ে জানালায় উঁকি দিল। ফিসফিস করে কথা শোনা গেল কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। পর্দা একটু সরাতে দেখতে পেল কেউ একজন জানালা বেয়ে উঠে আসছে।
আগের রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল থিবল্টের। এই জানালা থেকেই সম্ভবত ওর দুকাধকে মই বানিয়ে নেমেছিল লোকটা। তাই যদি হয়ে থাকে, তারমানে সে মাদাম ম্যাগলোয়ার পরিচিত। এখন যে উঠছে, সম্ভবত সেই একই লোক।
সুজান হাত বাড়িয়ে আগন্তুককে উঠতে সাহায্য করল। বিশালদেহী একটা লোক আসবাবপত্র কাঁপিয়ে লাফ দিয়ে এসে ঢুকল ঘরর ভেতর।
সাবধানে, মাই লর্ড, সুজানের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। আমার স্বামী ঘুমাচ্ছে। এত শব্দ হলে জেগে যাবে ও।
কিন্তু সুন্দরী, আমি তো আর পাখির মতো হালকা নই। কণ্ঠ শুনে থিবল্ট বুঝল এ আগের রাতের সেই নোকটাই। অবশ্য নিচে যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল পাখির মতো ডানা থাকলে ভাল হত, উড়ে চলে আসতে পারতাম।
আমারও, মাই লর্ড, আপনাকে শীতের রাতে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করব, আমাদের অতিথি এই আধঘণ্টা আগে ঘুমোতে গেল।
আর গত আধঘণ্টা কী করেছ?
মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া যেন রাতে আর আমাদের বিরক্ত করতে না আসেন তার ব্যবস্থা করছিলাম।
হৃদয়েশ্বরী, সবদিকে তোমার খেয়াল থাকে।
কী যে বলেন না, মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কথাটা শেষ করতে পারল না। সুজান। শব্দ শুনে কী কারণে তার মুখ বন্ধ হয়েছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না থিবল্টের। আবারও ওকে হতাশ হতে হচ্ছে। কাশির শব্দ শুনে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ল।
কাশি থামার পর লোকটা বলল, জানালাটা মনে হয় বন্ধ করা উচিত।
ওহ, মাই লর্ড, আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। মাদাম উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে ভাল মতো পর্দা টেনে দিল। আগন্তুক এরপর একটা চেয়ার নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ ঠাণ্ডার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। সুজান তার চেয়ারের পেছনে হাত রেখে দাঁড়াল। দেখে বাড়তে লাগল থিবল্টের রাগ। শরীর কিছুটা গরম হওয়ার পর আগম্ভক জিজ্ঞেস করল, তা এই লোকটা, মানে তোমাদের অতিথিটা কে?
মাই লর্ড, আমার তো ধারণা আপনি ওকে খুব ভাল করেই চেনেন।
কীবলতে চাইছ সেই রাতের ওই মাতালটা?
সে-ই।
ওকে যদি হাতে আরেকবার পাই না…
সঙ্গীতের মতো মধুর সুরে সুজান উত্তর দিল, এমন অশুভ চিন্তা মনে ঠাই দেবেন না। পবিত্র ধর্মের উপদেশ অনুসারে শত্রুকে ক্ষমা করতে শেখা উচিত আমাদের।
আরও একটা ধর্ম অবশ্য আছে, তুমি সেই ধর্মের দেবী আর আমি সামান্য এক অনুসারী। ওই বদমাশটার ক্ষতির চিন্তা করা অবশ্য আমার উচিত না। ওর অন্যায়ভাবে করা আঘাতে আমি জ্ঞান হারাই। আমাকে অজ্ঞান দেখে তুমি তোমার স্বামীকে ডেকে তুললে। সে এসে আমাকে তোমার জানালার নিচে আবিষ্কার করে ভেতরে নিয়ে গেল। তুমি দয়াপরবশ হয়ে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হলে। সেভাবে চিন্তা করলে ওর কারণেই তোমার বাড়িতে প্রবেশের আমার এতদিনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তারপরও, ব্যাটাকে যদি আমার চাবুকের নাগালে পাই, সেটা ওর জন্য মোটেই সুখকর হবে না।
দেখা যাচ্ছে আমার ইচ্ছা আবারও একজনের সুবিধা করে দিয়েছে। নেকড়ে সাহেব, আমার এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আমি এমনভাবে ভেবেচিন্তে চাইব, যাতে ছাত্রই তখন শিক্ষক হয়ে উঠবে। থিবল্ট মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু কণ্ঠটা কার, খুব চেনা চেনা লাগছে?
একটা কথা বলতে পারি, যেটা শুনলে বেচারার উপর আপনার রাগ আরও বেড়ে যাবে!
কী সেই কথা?
আপনার ভাষায় সেই অকর্মার টেকি, আমার সাথে প্রেম করতে চাইছে।
ফুঃ!
সুজান হাসতে হাসতে বলল, সত্যি কথা।
কী! কোথায়, ওই বজ্জাতটা কোথায়? বিলজেবাবের দিব্যি! ওকে আমার কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেব! বলতে বলতে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল লোকটা।
এবং এই কথা শোনার সাথে সাথেই লোকটাকে চিনে ফেলল থিবল্ট। আহ, লর্ড ব্যারন, আপনিই তাহলে এসেছেন?
ওকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই, মাই লর্ড। প্রেমিকের কাঁধে হাত রেখে আবার বসিয়ে দিল সুজান। আপনিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি ভালবাসি। আর তা যদি নাও হত, অমন কপালের মাঝে লাল চুলওয়ালা লোককে ভালবাসতে আমার বয়েই গেছে! ডিনারের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার হাসতে শুরু করল সে।
বেইলিফের স্ত্রীর প্রতি একটা ভয়ঙ্কর রাগ জমে উঠল থিবল্টের মনে।
বিশ্বাসঘাতিনী! এই মুহূর্তে এই ঘরে তোর ভাল, সৎ, দয়ালু স্বামীর প্রবেশের বিনিময়ে বিসর্জন দিতে রাজি নই-এমন কিছু নেই আমার।
থিবল্ট ইচ্ছাটা পোষণ করার সাথে সাথেই খুলে গেল ঘরের দরজা। হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া। মাথার লম্বা টুপিটার কারণে তাকে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা মনে হচ্ছে।
আহহা! চমৎকার! মাদাম ম্যাগলোয়া, এবার হাসার পালা আমার, নিচু স্বরে বলল থিবল্ট।
ত্রয়োদশ অধ্যায় – মুখরা অপেক্ষা জিভ সংবরণ করে চলা নারীর ভাষ্য যে অনেক বেশি পরিষ্কার, তার একটা উদাহরণ
সুজান ব্যারনকে ফিসফিস করে কী বলেছে খেয়াল করতে পারেনি থিবল্ট। শুধু দেখল টলে উঠে অজ্ঞানের মতো করে ব্যারনের উপর পড়ে গেছে মাদাম।
ম্যাগলোয়া মোম হাতে বিস্মিতভাবে দৃশ্যটা দেখল। ব্যারনও বেইলিফের মধ্যে বিস্ময় ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে স্বাভাবিক সুরে প্রশ্ন করল, আরে, ম্যাগলোয়া, কী অবস্থা আপনার?
আপনি নাকি, মাই লর্ড? বেইলি চোখ বড় বড় করে পাল্টা প্রশ্ন করল।
আপনাকে এখানে দেখতে পাব জানলে এই পোশাকে আসতাম না।
আরে ছাড়ুন!
না, না, মাই লর্ড। অনুমতি দিন জামাটা পাল্টে আসি।
ব্যস্ত হওয়ার কোন দরকার নেই। মাঝরাতে বন্ধুর সাথে যে কোন পোশাকেই দেখা করা যায়। তাছাড়া এখন আরও জরুরি বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।
কী বিষয়ে, মাই লর্ড?
মাদাম ম্যাগলোয়া অজ্ঞান হয়ে গেছেন। ওনার জ্ঞান ফেরানো দরকার।
সুজান অজ্ঞান হয়ে গেছে। ঈশ্বর। মোমটা চিমনির উপর নামিয়ে রাখল বেইলিফ। কীভাবে হলো?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া। আগে মাদামকে একটু ভাল ভাবে আরামকেদারায় বসিয়ে দিই।
ঠিক বলেছেন। সুজানকে আগে ভালভাবে শুইয়ে দিই। বেচারি সুজান। কিন্তু এমনটা হলো কীভাবে?
এত রাতে আমাকে আপনার বাড়িতে আবিষ্কার করে দয়া করে খারাপ কিছু ভাববেন না।
প্রশ্নই আসে না, মাই লর্ড। আপনার বন্ধুত্ব পেয়ে আমরা গর্বিত। আর মাদাম ম্যাগলোয়ার বিশ্বস্ততার ওপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা আছে। যে কোন সময় আপনার উপস্থিতি আমাদের বাড়িকে সম্মানিতই করবে।
বিড়বিড় করল থিবল্ট, লোকটা কি আসলে উজবুক, না চালাক…হবে কিছু একটা! দেখা যাক ব্যারন কীভাবে বেরোয় এই পরিস্থিতি থেকে।
একটা ভেজা কাপড় দিয়ে স্ত্রীর কপাল মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল ম্যাগলোয়া, যা-ই হোক। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, কীভাবে আমার স্ত্রীর এই অবস্থা হলো?
বলছি। এক বন্ধুর সাথে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা জানালায় এক মহিলা ইশারায় সাহায্যের আবেদন করছেন।
ঈশ্বর!
তারপর আমার মনে পড়ল যে এটা আপনার বাড়ি। এমন কী হতে পারে যে মাদাম ম্যাগলোয়া কোন বিপদে পড়েছেন?
আপনি ভাল মানুষ, মাই লর্ড। আশা করি সত্যি সত্যি তেমন কোন বিপদ হয়নি।
ঠিক তার উল্টো।
উল্টো? কী বলছেন?
শুনুন।
মাই লর্ড, আমাকে আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন। আপনি বলতে চাইছেন, সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, অথচ আমার স্ত্রী আমাকে ডাকেনি?
প্রথমে আপনাকেই ডাকবেন ভেবেছিলেন। পরে চিন্তা করলেন, এখানে আসলে আপনিও বিপদে পড়তে পারেন। এমনকি আপনার জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে!
ফ্যাকাসে হয়ে গেল বেইলিফ, আমার জীবন, আপনার ভাষ্যমতে বিপন্ন?
এখন যেহেতু আমি আছি তাই আর বিপদ নেই।
দয়া করে বলুন, মাই লর্ড। স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করতাম, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, সে জবাব দেয়ার মতো অবস্থায় নেই।
উনার বদলে উত্তর দেয়ার জন্য আমিও কি নেই?
বলুন, মাই লর্ড, বলুন, আমি শুনছি।
ব্যারনও মাথা নেড়ে আবার বলতে শুরু করল, আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মাদাম ম্যাগলোয়া, কী হয়েছে, আপনি এমন করছেন কেন? উনি উত্তর দিলেন, মাই লর্ড, গতকাল এবং আজ, পর পর দুদিন এক লোকের আতিথেয়তা করছেন আমার স্বামী। লোকটা সন্দেহজনক। আমার ম্যাগলোয়ার বন্ধু সেজে আছে। কিন্তু সে আমার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছে…
ও আপনাকে বলেছে এই কথা?
হুবহু এই কথাই বলেছেন। আমরা কী বলছি সেটা আশা করি উনি শুনতে পাচ্ছেন না।
কীভাবে শুনবে? অজ্ঞান হয়ে আছে তো।
ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করবেন নাহয়। যদি আমার কথা না মেলে, আমাকে আপনি যা খুশি বলতে পারেন।
এসব লোক খুবই ভয়ঙ্কর দেখছি!
সাপের মতো। আরও শুনতে চান?
অবশ্যই!
আমি মাদামকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন সে আপনার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছে?
হ্যাঁ, বেইলিফ বলল। কীভাবে বুঝল? আমি নিজেই তো কিছু টের পাইনি।
টেবিলের নিচে তাকালেই বুঝতে পারতেন। টেবিলের ওপর আর নিচ, দুজায়গায় তো একসাথে তাকানো সম্ভব না।
সত্যি কথা বলতে কি, মাই লর্ড, আমরা চমৎকার সাপার করেছি। খালি একবার চিন্তা করুন, কচি বুনো-শুয়োরের কাটলেট…
আমার গল্পের সাথে আপনার স্ত্রীর জীবন এবং সম্মান জড়িত! সেই গল্প শোনার বদলে আপনি কী এখন আমাকে সাপারের গল্প শোনাবেন?
সত্যিই তো, বেচারি সুজান। ওর হাতটা বের করতে সাহায্য করবেন? তালুটা ঘষে দিতাম। স্ত্রীর হাত ঘষতে ঘষতে গল্পের বাকিটা শুনতে চাইল ম্যাগলোয়া।
কোথায় থেমেছিলাম?
বলছিলেন, বেচারি সুজান, যাকে সতী-সাধ্বী সুজানও বলা চলে…
তা তো বলতেই পারেন!
অবশ্যই বলি! বেচারি সুজান বুঝতে পেরেছিল…
ওহ হ্যাঁ, আপনার অতিথি, প্যারিসের মতো আপনাকে মেনেলাউস১০ বানাবার চেষ্টা করছিল। মনে আছে, কখন আপনার স্ত্রী টেবিল ছেড়ে উঠে যান?
ঠিক মনে নেই… তখন আমি কিছুটা…
ঠিক আছে। তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে বলেন যে বিছানায় যাওয়ার সময় হয়েছে।
আমি সর্বশেষ এগারোটার ঘণ্টা বাজতে শুনেছি।
তখনই আড্ডাটা ভাঙে।
আমি বোধহয় টেবিল ছাড়িনি তখনও।
না, মাদাম আর আপনার অতিথি ছেড়েছিলেন। মাদাম সুজান পেরিনকে বলেন অতিথিকে ঘরে নিয়ে যেতে। তারপর বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো আপনাকে বিছানায় শুইয়ে নিজের ঘরে চলে আসেন।
আবেগ ভর করল বেইলিফের কণ্ঠে, আমার লক্ষ্মী সুজান!
ঘরে একা হঠাৎই ভয় পেয়ে যান মাদাম সুজান। জানালাটা খুলে দেন। তিনি। বাতাস এসে মোমটা নিভিয়ে দেয়। হঠাৎ একটা আতঙ্ক পেয়ে বসলে কেমন লাগে, নিশ্চয়ই জানেন আপনি?
হ্যাঁ, আমি নিজেও একটু ভীতু।
উনাকেও হঠাৎ আতঙ্ক পেয়ে বসে। আপনাকে ডাকার সাহস পেলেন না। প্রথম যে ঘোড়সওয়ারকে দেখলেন, ভাগ্যক্রমে সেটা আমি ছিলাম। সাহায্যের জন্য ডেকে বসলেন।
আসলেই সৌভাগ্য, মাই লর্ড।
তাই না? আমি দৌড়ে এসে আমার পরিচয় দিলাম। উনি বললেন, উপরে আসুন, মাই লর্ড, উপরে আসুন! তাড়াতাড়ি, আমি নিশ্চিত আমার ঘরে কেউ ঢুকেছে।
আপনিও নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।
একদম না! সদর দরজার ঘন্টা বাজিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে সময়ের অপচয় হবে ভেবে লেভিলিকে আমার ঘোড়াটা রাখতে দিলাম। ভেতরের লোকটা যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য বারান্দা দিয়ে উঠে ভিতরে ঢুকে জানালা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দে আর সহ্য করতে না পেরে মাদাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
মাই লর্ড! কী ভয়ঙ্কর সব কথা আপনি আমাকে বললেন।
আমি কোন কিছুই বানিয়ে বলিনি। মাদাম উঠলে আপনি উনাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন।
দেখুন, মাই লর্ড, ও একটু একটু নড়ছে। খুশির স্বরে বলে উঠল বেইলিফ।
তাই তো দেখছি! একটা পালক পুড়িয়ে নাকের নিচে ধরুন।
পালক?
হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে খুব কাজের। নাকের নিচে ধরুন, সাথে সাথে জ্ঞান ফিরবে।
এখন পালক কোথায় পাব?
আমার হ্যাট থেকে নিন। হ্যাট থেকে একটা উটপাখির পালক ভেঙে ম্যাগলোয়াকে দিল ব্যারন। সেটা পুড়িয়ে ধোঁয়া মাদামের নাকের নিচে ধরল বেইলিফ। সাথে সাথে ফল পাওয়া গেল। হচি দিয়ে উঠল সুজান।
বেইলিফের খুশি আর দেখে কে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ফিরছে। আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরছে!
মাদাম ম্যাগলোয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মাই লর্ড! মাই লর্ড! ও বেঁচে গেছে! বেঁচে গেছে! চেঁচিয়ে বলল বেইলিফ।
মাদাম ম্যাগলোয়া চোখ খুলে প্রথমে বেইলিফের দিকে তাকাল। ব্যারনের দিকে ফিরতে বড় হয়ে গেল তার চোখ। তারপর আবার বেইলিফের দিকে তাকাল সে।
ম্যাগলোয়া, সত্যিই তুমি তো? ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর তোমাকে দেখে কী যে ভাল লাগছে!
থিবল্ট বিড়বিড় করল, অসতী রমণী! যাক গে যেসব মহিলাদের পেছনে ছুটেছি, না পেলেও অন্তত তাদের মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা খুঁজে পেয়েছিলাম!
আমার মিষ্টি, সুজান! ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না, যা দেখেছ সবই ছিল সত্যি।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তারপর এমনভাবে ব্যারনের দিকে তাকাল যেন তাকে প্রথমবারের মতো দেখছে! বলল, মাই লর্ড, আপনার কাছে অনেক বাকোয়াজ করেছি। আশা করি আমার স্বামীকে সেসব কিছু বলেননি।
কেন বলব না, বলতে পারেন?
একজন সতী নারীর জানা উচিত, নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়। সেজন্য তার স্বামীকে এতসব কিছু বলে বিব্রত করারও কোন মানে হয় না।
আমি আমার বন্ধুকে সবই জানিয়েছি।
আপনি কি এ-ও বলেছেন, যে সাপারের পুরোটা সময় ওই লোকটা থেকে থেকে আমার হাঁটু স্পর্শ করছিল?
অবশ্যই বলেছি।
ইতর! বেইলিফ বকে উঠল।
তারপর ন্যাপকিন তুলতে গিয়ে টেবিলের নিচে তার হাত পেয়েছিলাম?
আমার বন্ধুর কাছ থেকে আমি কিছুই লুকোইনি।
বদমাশ! চেঁচিয়ে উঠল বেইলিফ।
ঘোরগ্রস্ত ম্যাগলোয়ার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছিল সে, এটাও বলেছেন?
আমার মতে একজন স্বামীর সব সত্য জানা উচিত।
চরিত্রহীন! আবারও চেঁচিয়ে উঠল বেইলিফ।
আপনি কী এটাও বলেছেন, ঘরে আসার পর বাতাসে মোম নিভে গেল। তখন পর্দা নড়ে ওঠায় আমি ভেবেছিলাম লোকটা আমার ঘরে ঢুকেছে। তাই সাহায্যের জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম?
না, বলতে যাচ্ছিলাম। তখনই আপনি হচিটা দিলেন।
শয়তান! গর্জে উঠে টেবিলের ওপর রাখা ব্যারনের তলোয়ারটা নিয়ে স্ত্রীর নির্দেশ করা জানালার দিকে ছুটল বেইলিফ। ও যদি পর্দার আড়ালে থাকে, আমি ওকে দুটুকরো করে ফেলব। বলে বার কয়েক তলোয়ার চালাল সে।
তলোয়ারের আঘাতে পর্দা সরে যেতে থিবন্টের ওপর চোখ পড়ল বেইলিফের। সে আশা করেনি পর্দার আড়ালে কেউ থাকবে। একটু আগে হম্বিতম্বি করলেও ওকে দেখে পিলে চমকে গেল বেইলিফের। হাত থেকে শব্দ করে পড়ে গেল তলোয়ারটা। ঘরের বাকি দুজনও চমকে উঠল থিবন্টকে দেখে। তাদের বলা গল্পটা সত্যের এত কাছে ছিল ওরা ধারণা করেনি। ব্যারনও চিনতে পারল থিবল্টকে।
ওর কাছে গিয়ে ব্যারন বলল, নিকুচি করি। আমার ভুল না হলে এ সেই শুয়োর-মারা বর্শাওয়ালা লোকটা।
শুয়োর-মারা বর্শাওয়ালা লোক? বেইলিফের দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে। এখন অবশ্য মনে হয় না ওর কাছে কোন বর্শা আছে। বলে দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর পেছনে লুকিয়ে পড়ল খর্বাকায় ভীতু লোকটা।
ভয় পাবেন না। বর্শা নিয়ে আসলেও কথা দিচ্ছি ওর হাতে বেশিক্ষণ থাকত না ওটা। তো, জনাব চোরাশিকারি, থিবল্টকে উদ্দেশ্য করে বলল ব্যারন, ডিউকের এলাকায় শিকার করেই ক্ষান্ত হওনি, এখন ম্যাগলোয়ার এলাকায়ও হানা দিয়েছ?
চোরাশিকারি? উনি ভূ-স্বামী আর অনেক খামারের মালিক নন? শত শত একর জমি থেকে উনার আয় হয় না?
কী? আপনাকে এই সব আজগুবি গল্প শুনিয়েছে ও? মুখ আছে বলতে হবে ওর। ভূ-স্বামী! হুহ! খাবার জোটে না। সামান্য একজন স্যাবট-কারিগর ও। আমার লোকেরা যেসব কাঠের জুতো পরে, ওগুলোই ওর সম্পত্তি। ওগুলোই বানায় ও!
ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল মাদাম ম্যাগলোয়া। বেইলিফের মুখও লাল হয়ে গেল। ক্ষুদে ভালমানুষটা দাম্ভিক বা উদ্ধত হয়তো নয়, কিন্তু প্রতারণা সে পছন্দ করে না। একজন জুতোর কারিগরের সাথে ওয়াইন পান করতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু একজন মিথ্যাবাদী এবং বিশ্বাসঘাতকের সাথে আছে।
এতসব অপমানের মুখেও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে থিবল্ট। ওর কথা বলার পালা এসেছে এবার। ও এখন প্রতিশোধ নিতে পারবে। ওর চেয়ে উঁচু অবস্থানের লোকের সাথে কথা বলায় এখন অভ্যস্ত সে। বলতে শুরু করল ও, শয়তান আর তার শিং-এর দিব্যি, মাই লর্ড, আমি যদি আপনার মতো অন্যকে নিয়ে গল্প বানাতে পারতাম, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এখন কী বলতে হবে, সে নিয়ে আমাকে কোন চিন্তাই করতে হত না।
এই কথার ভেতরের আক্রমণটুকু ভেযের লর্ড আর বেইলিফের স্ত্রী দুজনেই টের পেল। জ্বলন্ত চোখে থিবল্টের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাদাম বলল, ও নিশ্চয়ই এখন আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মুখরোচক কোন গল্প বলবে।
আত্মসংযমের সাথে থিবল্ট বলল, ভয়ের কোন কারণ নেই, মাদাম, আমাকে বানিয়ে কিছুই বলতে হবে না।
বদমাশ! দেখেছ, আমি ঠিকই বলেছি। আমার নামে ও আজেবাজে কথা বলবে। আমি ওর আহ্বানে সাড়া দেইনি, তার শোধ নেবে।
এই ফাঁকে ব্যারন তলোয়ার নিয়ে এগোচ্ছিল। মাঝপথে বেইলিফ বাধা দিল। তাতে থিবল্টের ভালই হলো। নয়তো শেষ মুহূর্তে ওকে আরও একটা ইচ্ছা খরচ করতে হত।
মাই লর্ড, শান্ত হোন। আপনার ক্রোধের যোগ্য নয় ও। আমি খুবই সাধারণ একজন নাগরিক। ওর বক্তব্যের উপর আমার আর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই আর আমার আতিথেয়তার যে অন্যায় সুযোগ ও নিয়েছে, সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি আমি।
পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার জন্য এবারে কাঁদতে শুরু করল মাদাম।
কেঁদো না, সুজান, সদয় কণ্ঠে বলল বেইলিফ। তোমার নামে কী অভিযোগ সে আনবে? আমাকে ধোকা দেয়ার? আমাকে যে সুখ তুমি দিয়েছ, তারজন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমি শেষ করতে পারব না। ওর কথায় তোমার প্রতি আমার ভালবাসার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। আমি আমার বন্ধুদের জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু তোমার জন্য হৃদয়ের দরজা কখনও বন্ধ করব না। মানুষ খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। নিজের ক্ষুদ্রতা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করাটাই ভাল। খারাপ মানুষদের নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস ওদের সংখ্যাও অনেক কম। দুর্ভাগ্য যদি কখনও দরজা বা জানালা দিয়ে ঢেকেও, উফুল্ল গান-বাজনা আর গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দে পালাবার পথ পাবে না সে।
বিষণ্ণ দর্শন মিশ্রিত বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই সুজান বেইলিফের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল, ওর হাতে চুমু খেতে লাগল। বিদগ্ধ পাদ্রীর গভীর ধর্মবোধ সম্পন্ন বক্তব্যও মাদামের ওপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারত কি না সন্দেহ। ভেযের লর্ডের চোখের কোণেও জল জমল। সেটা মুছে হাত বাড়িয়ে দিল ব্যারন, বন্ধু, আপনি আসলেই সৎ এবং দয়ালু একজন মানুষ। আপনাকে কোন কষ্ট দেয়াটাও পাপ। অতীতে আমি যদি কখনও আপনার সাথে কোন অন্যায় করার চিন্তাও করে থাকি, ঈশ্বর যেন আমাকে ক্ষমা করেন। তবে এটুকু বলতে পারি, যা-ই ঘটুক, ভবিষ্যতে কখনও এমন চিন্তা আমার মনেও আসবে না।
বিবল্ট বুঝতে পারছে না-ওর মনে অন্ধকারের রাজত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ক্রমেই ও স্বার্থপর, খারাপ একটা মানুষে পরিণত হচ্ছে। ওর রাগ বাড়তে লাগল। চিৎকার করে বলল, বুঝতে পারছি না, কেন আমি এই নাটকটা বন্ধ করছি না!
বিপদ বুঝতে ব্যারন আর সুজানের দেরি হলো না। ব্যারন আরও একবার তলোয়ার বাগিয়ে এগোতে গিয়ে বেইলিফের বাধার সম্মুখীন হলো।
মাই লর্ড ব্যারন, এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আপনি মনে মনে আমাকে খুন করলেন। চিন্তার দিক দিয়ে আপনি একজন খুনি। সাবধান! পাপ জমাবার অনেক রাস্তা কিন্তু আছে।
শয়তানের দিব্যি! বজ্জাতটা আমাকে নীতিশিক্ষা দিচ্ছে। আপনি একটু আগেও ওকে দ্বি-খণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন। এখন আমাকে একবার অন্তত মারতে দিন।
আপনার অনুগত হিসেবে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, মাই লর্ড। ওকে নিরাপদে যেতে দিন। ও আমার অতিথি, আমার এই গরীবখানায় যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়।
তবে তাই হোক। কিন্তু ওর সাথে আমার আবার দেখা হবে। ওর নামে অনেক কথা কানে আসছে। শুধু শুধু চোরাশিকারই ওর একমাত্র অপরাধ নয়, একদল বাধ্যগত নেকড়ের সাথে ঘুরতেও নাকি দেখা গেছে ওকে। আমার ধারণা মাঝরাতে ও জাদুটোনা করে বেড়ায়। ক্রয়োলের মিল মালকিন এরইমধ্যে ওর জাদুটোনার ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। ওর ঘর খুঁজে সন্দেহজনক কিছু পেলে জ্বালিয়ে দেয়া হবে। এই এলাকায় জাদুকরের কোন জায়গা নেই। এখন এখান থেকে ভাগ, জলদি!
অন্ধকারেও দেখতে পায় তাই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে কোন সমস্যা হলো না থিবল্টের। বাড়ি কাঁপিয়ে ওর পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অহেতুক ইচ্ছা খরচ করে লাল চুলের সংখ্যা বাড়ানোর কোন মানে হয় না, তাই পুরো বাড়িটা জালিয়ে দেয়ার ঝোঁকটা কোনমতে দমন করল বিল্ট। বৃষ্টি শুরু হলো। যদিও বরফ শীতল, তবু ভালই লাগল ওর-মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল।
বেইলিফের বাড়ি পেছনে ফেলে এগোতে লাগল থিবল্ট। একা থাকা দরকার। কখন যেন ক্রয়োলের মিলের কাছে চলে এল। বাড়িটা চোখে পড়তে মিলের মালকিনকে একটা অভিশাপ দিয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও।
চতুর্দশ অধ্যায় – বিয়ের অনুষ্ঠান
কিছুদূর যাওয়ার পরই নেকড়েরা ঘিরে ধরল। খুশি হয়ে ওদের কাছে ডেকে আদর করে দিল থিবল্ট। ওরাই হচ্ছে ওর খাস শুভাকাঙ্ক্ষী, ওর আগুনচোখা শিকারি দল। মাথার ওপর রাত-পেঁচার দল ডালে ডালে ডেকে চলেছে। ওদের চোখগুলোও জ্বলন্ত কয়লার মতো। আর এই অশুভচক্রের ঠিক মাঝেই অবস্থান থিবল্টের।
নেকড়েদের মতো পেঁচারাও ওর কাছে উড়ে আসতে লাগল। ওর মাথা ছুঁয়ে কাঁধে বসতে লাগল।
মানুষ আমাকে ঘৃণা করলে কী হবে, পশুপাখি ঠিকই আমাকে ভালবাসে।
সৃষ্টির মধ্যে এই প্রাণীগুলোর অবস্থান কোথায়-সেটা ওর মাথায় নেই। ও ভুলে গেছে-যে প্রাণীগুলো ওকে ভালবাসে, তারা মনুষ্যত্বকে ঘৃণা করে।
প্রাণীজগতের মধ্যে এরা হচ্ছে অন্ধকারের জীব। মানুষের মধ্যে থিবল্টও অন্ধকারের জীবে পরিণত হচ্ছে। তাই ওরা থিবকে ভালবাসছে। এসব প্রাণীর সান্নিধ্যে থেকে ক্ষতি ছাড়া ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। ক্ষতি করার কী ভীষণ ক্ষমতা ওর আছে ভেবে হাসল থিবল্ট।
বাড়ি এখনও অনেক দূর। ক্লান্ত লাগছে থিবল্টের। কাছেই একটা কয়েকশো বছরের প্রাচীন ওক গাছ আছে। সেখানে রাতটা কাটানো যেতে পারে। নেকড়েগুলো ওর মন বুঝে পথ না দেখালে পৌঁছতে পারত কি না সন্দেহ। যে গাছ মানুষের আয়ুর চেয়ে দশ, বিশ বা এমনকি তিরিশ গুণ লম্বা সময় ধরে টিকে থাকে, তাদের বয়স দিন-রাতে না…ঋতুতে হিসাব করা উচিত। শরৎ হবে গোধূলি, শীত হলো রাত, বসন্ত ভোর আর গ্রীষ্ম হচ্ছে দিন। চল্লিশ জন মানুষ মিলেও হয়তো প্রাচীন ওক গাছটার বেড় পাবে না।
গাছের গুঁড়ির গর্তটা অনেকটা আরামকেদারার মতো। থিবল্ট সঙ্গী-সাথীদের শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নেকড়েরা গাছের চারপাশে আর পেঁচারা ডালে জায়গা করে নিল।
সকালে ঘুম ভাঙল থিবল্টের। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগে। ওর সঙ্গী সাথীরাও যার যার ডেরায় চলে গেছে।
দূর থেকে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রমেই কাছে চলে আসছে সেই শব্দ। বাজনা শুনে একটা পাখি ডেকে উঠল। মানুষের সুরের জবাবে সৃষ্টিকর্তার সুর। এই শীতে বসন্তের মতো উত্সবের মানে কী?
পাখির ডাক এই উজ্জ্বল, সুন্দর সকালকে স্বাগত জানাচ্ছে। ফুল ওকে দেখতে আসার জন্য সূর্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তা-ও নিজে উজ্জ্বলতা দিয়ে। প্রকৃতির সাথে মিলে আনন্দ করছে মানুষ। ওদিকে থিবল্টের রাগ আর তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। ওর মনের মতো সব যদি অন্ধকার আর বিষণ্ণ হত, তাহলে হয়তো ভাল লাগত থিবল্টের। চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কী একটা শক্তি যেন ওকে আটকে রাখল। গাছের গর্তে লুকিয়ে থাকল ও। আনন্দিত হৈ-চৈ শোনা যেতে লাগল আশপাশ থেকে। কেউ বাজি ফোঁটাল বা বন্দুক ছুঁড়ল। নিশ্চয়ই কোন বিয়ের অনুষ্ঠান। একদল সুসজ্জিত নারী-পুরুষ যাচ্ছে। এর মাঝে লর্ড ভেযের লোকদেরও দেখতে পেল থিবল্ট। এনগুভা, লর্ড ভেযের দ্বিতীয় শিকারি, এক অন্ধ বৃদ্ধাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্ট বিস্মিত চোখে কনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজেকে বোঝাতে চাইল ভুল দেখেছে। কিন্তু কাছে আসার পর বুঝতে পারল ভুল দেখেনি। কনে হচ্ছে অ্যানলেট।
অ্যানলেট!
ওর অপমানের মুকুটে আরেকটা পালক। ওর গর্বে বিশাল একটা ধাক্কা। কেউ টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাচ্ছে না। অ্যানলেট হাসি মুখে, খুশির সাথে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
লেডি ভেযের দেয়া পোশাক এবং গহনায় সজ্জিত হয়ে আছে মেয়েটা।
অ্যানলেটের খুশির কারণ তার হবু স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম নয়। ও এমন একজনকে চেয়েছিল যে ওর সাথে ওর অন্ধ দাদীর দায়িত্ব ভাগাভাগি করবে। থিবল্ট সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বটে, কিন্তু মন থেকে নয়। এখন দেখা যাচ্ছে দায়িত্ব ভাগাভাগি করার মতো মানুষ পেয়ে গেছে অ্যানলেট। ধীরে ধীরে মিছিলটা দূরে চলে যাচ্ছে। সাথে নিয়ে যাচ্ছে বাজনার শব্দ। বেশ অনেকক্ষণ পর বনটা আবার শান্ত হয়ে গেল। কিন্তু থিবল্টের হৃদয়ে আগুন জ্বলছে-ঈর্ষার আগুন।
অ্যানলেটের নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যে সুখের ছোঁয়া লেগেছে। গত তিনটা মাস অ্যানলেটের কোন খোঁজ রাখেনি ও। আজ যখন দেখল তখন সে অন্য কারও স্ত্রী হতে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখার কোন রকম অভিপ্রায় থিবল্টের ছিল না। তারপরও সিদ্ধান্তে আসল, অ্যানলেটকে ও সবসময়ই ভালবেসেছে।
নিজেকে বোঝাল, অ্যানলেট ওর প্রতিশ্রুত বাগদত্তা ছিল। এনগুভা ওর অ্যানলেটকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু হলে ছুটে যেত ওদের পিছু। এখন। যখন অ্যানলেট আর ওর নয়, তখন মেয়েটা যেন নতুন করে তার সব সৌন্দর্য্য আর গুণ নিয়ে ওর চোখের সামনে হাজির হচ্ছে। শুধু চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। অথচ তখন ও বুঝতেই পারেনি।
এতবার প্রতারিত হওয়ার পর নিজের বলতে যে সম্পদটুকু ছিল, তা-ও খুইয়ে বসেছে থিবল্ট। ভেবেছিল যে কোন সময় ফিরতে পারবে আনলেটের কাছে। অন্য কেউ যে সেই সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে পারে তেমন ধারণাও কখনও ওর মাথায় আসেনি। দুর্ভাগ্যের চূড়ান্ত ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যায়? হাত কামড়াল থিবল্ট, গাছে মাথা ঠুকল। শেষে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু এ কান্না হৃদয় দ্রবীভূত করার কান্না নয়। হৃদয় থেকে ঘৃণাকে তাড়ানোর ক্ষমতা চোখের এই জলের নেই।
থিবল্ট এখন নিশ্চিত যে অ্যানলেটকে ও ভালবাসে। মেয়েটাকে হারিয়ে ও রাগান্বিত হয়ে উঠেছে। স্বামীসহ মেয়েটার মৃত্যু কামনা করারইচ্ছা ওর ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোধহয় অন্যরকম। তাই থিবল্টের মনে চিন্তাটা এল না।
কিছুক্ষণ পর কেঁদে ফেলার জন্য লজ্জা বোধ করল থিবল্ট। কান্না সামলানোর চেষ্টা করল। গর্ত থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ঘরের উদ্দেশে ছুট লাগাল। তাতে মন কিছুটা শান্ত হলো। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল ও।
অতীতে যেমন অনেক মানুষ দুঃখে-কষ্টে জীবন কাটিয়েছে, ভবিষ্যতেও কাটাবে। কেন কিছু মানুষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে আর কিছু মানুষ অভাবে?
এত অসাম্য কেন যখন জন্ম সবার একইরকম ভাবে হয়?
প্রকৃতির এই খেলার কোন্ নিয়মে কারও ভাগ্যে সুতো হেঁড়ে, আর কারও ভাগ্যে ছেড়ে না?
একজন ওস্তাদ খেলোয়াড় কি ভাগ্যকে পক্ষে আনার জন্য শয়তানের সাহায্য নেয় না? ও-ও তো সেভাবেই ভেবেছিল।
আর খেলায় চুরির কথা? নিয়ম ভেঙ্গে খেলার চেষ্টা তো করেছিল ও। তাতে কী লাভ হয়েছে? যতবার ভেবেছে এবার ও জিতবে, ততবার জিতে গেছে শয়তান।
অন্যদের ক্ষতি করার এই ক্ষমতা থেকে ও কী পেয়েছে?
কিছুই না।
অ্যানলেটকে হারিয়েছে। মিল মালকিন ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বেইলিফের স্ত্রী খেললছে ওকে নিয়ে।
ওর প্রথম ইচ্ছার কারণে বেচারা ম্যাকোট মারা গেল। এমনকি যে হরিণের জন্য এত কাহিনী, সেই হরিণটাও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এখান থেকেই ওর হতাশার শুরু। কালো নেকড়ের জন্য হরিণটাকে কুকুরগুলোর কাছে ছেড়ে দিতে হলো।
তার উপর চুলের ব্যাপারটা তো রয়েছেই! সেই যে এক দার্শনিকের গল্প শুনেছিল। দাবার প্রতি ঘরের জন্য আগের ঘরের দ্বিগুণ গমের দানা চেয়েছিল লোকটা। শেষ ঘরের হিসাব মেলানোর জন্য হাজার বছর ধরে গম চাষ করতে হত। ওর আর কটা ইচ্ছা বাকি আছে? বেশি হলে সাত-আটটা হবে। নিজের দিকে তাকাতে ভয় হলো ওর। অনিশ্চিত ভোরের চেয়ে অনন্ত রাতই ভাল।
ওর যদি ভাল পড়াশোনা থাকত, তাহলে হয়তো অন্যের দুর্ভাগ্য থেকে কীভাবে নিজের সুখ আর সম্পদ অর্জন করা যায় তা বের করতে হবে। শিক্ষিত হলে ডক্টর ফাউষ্টের গল্পটা ওর জানা থাকত। মেফিস্টোফিলিসের কাছ থেকে এত ক্ষমতা পাওয়া সত্বেও তার মতো জ্ঞানী চিন্তাবিদের এই পরিণতি হলো কেন? ভ্যালেন্টিনকে১৩ হত্যা! মার্গারেটের আত্মহত্যা! ট্রয়ের হেলেনের১৫ পেছনে, মিথ্যে ছায়ার পেছনে ছোটা কেন?
থিবল্ট ঈর্ষায় জ্বলছে। অ্যানলেট যখন চিরজীবনের জন্য অন্যের হয়ে যাচ্ছে, তখন যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা কি ওর পক্ষে সম্ভব?
তা-ও কার? না, এনওভার। যার কারণে গাছের ওপর ধরা খেয়েছিল ও। যে ঝোঁপ থেকে ওর বর্শাটা খুঁজে বের করেছিল।
আহ! আগে যদি জানত তাহলে ম্যাকোটের বদলে এনগুভার ক্ষতি চাইত থিবল্ট। চাবুকের জ্বালাও এই জ্বালার কাছে কিছু নয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা এভাবে পেয়ে না বসলে, সুখের একটা জীবন হত ওর। দিনে ছয় ফ্রা আয় করত, আর অ্যানলেটের মতো একটা মেয়ে হত ওর ঘরণী। তখন নিশ্চয়ই অ্যানলেট ওকেই বেশি ভালবাসত। অন্যকে বিয়ে করলেও, অ্যানলেট এখনও হয়তো ওকেই ভালবাসে।
দিন শেষ হয়ে রাত নামতে লাগল।
নবদম্পতির সামর্থ্য যা-ই হোক, এখন নিশ্চয়ই বর-কনে আর অতিথিরা সবাই একসাথে আনন্দ করছে।
আর থিবল্ট এখন একা। খাবার তৈরি করে দেবার মতোও কেউ নেই। খাবার মতোই বা কী আছে? সামান্য রুটি আর পানি। আর যাকে লোকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে, সে-ই ভগ্নি, প্রেমিকা বা স্ত্রীর বদলে আছে একরাশ নীরবতা!
তবে সম্পূর্ণ অসহায় নয় থিবল্ট। কে বলেছে ও মন ভরে খেতে পারবে না? মন যা চায়, চাইলেই তা খেয়ে আসতে পারে ও। শিকার বিক্রির টাকাটা তো এখনও ওর কাছেই আছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ওরা যা খরচ করছে, তার চেয়ে বেশিই ও খরচ করতে পারবে। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে খুশি করার প্রয়োজন ওর নেই।
আমি একটা গাধা! পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঈর্ষায় জ্বলার কোন মানেই হয় না। ভাল খাবার আর দু-তিন বোতল ওয়াইন হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব জ্বালা ভুলে যাওয়া যাবে।
ফের্তে-মিলোর পথ ধরল থিবল্ট। ওখানে দোফা-দেঁ নামে একটা চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। ওদের খাবার ডিউকের প্রধান রাধুনীর রান্নার সাথে তুলনা করার মতো।
পঞ্চদশ অধ্যায় – লর্ড ভোপাফে
রেস্তোরাঁয় পৌঁছে ডিনার অর্ডার করল থিবল্ট। চাইলে প্রাইভেট রুম নিতে পারত। কিন্তু ও সবাইকে শুনিয়ে অর্ডার দিল। দামী খাবার, তিন রকমের ওয়াইন। জাহির করতে চাইল নিজেকে।
সামনে আধ বোতল ওয়াইন নিয়ে ঘরের কোনার দিকে একটা লোক বসে ছিল। থিবল্টের গলা শুনে পরিচিত মনে হওয়ায় ঘুরে তাকাল সে। আসলেই থিবল্টের মুখচেনা। একটা গুঁড়িখানায় আলাপ হয়েছিল।
জুতো বানানো ছেড়ে দেয়ার পর থেকে এমন অনেক লোকের সাথেই আলাপ-পরিচয় হয়েছে থিবল্টের। ওকে চিনতে পেরে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল লোকটা। কিন্তু ততক্ষণে লর্ড ভোপাফোঁর চাকর অগাস্ত ফনগোয়াঁ লেভাসোকে চিনে ফেলেছে থিবল্ট।
আরে ফনগোয়াঁ! কোনায় একা বসে কী করছ? এসো, সবার সাথে বসে ডিনার করা।
কোন জবাব না দিয়ে ইশারায় থিবকে চুপ থাকতে বলল।
আমি কথা বলব না? বলব না কথা? কিন্তু যদি আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে? একা একা খেতে ভাল না লাগে, তাহলেও বলতে পারব না-ফনগোয়াঁ, বন্ধু আমার, এখানে এসো। আমার সাথে ডিনার করো। করবে না? সত্যিই করবে না? তাহলে আমিই তোমার কাছে আসছি। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের জায়গা ছেড়ে বন্ধুর কাছে গেল থিবল্ট। সজোরে একটা চাপড় বসিয়ে দিল ফনগোয়াঁর কাঁধে।
ভাব দেখাও তুমি ভুল করেছ, থিবল্ট, নয়তো আমার কাজটা মাটি হবে। দেখছ না, আমি ধূসর কোট পরে আছি? মনিবের হয়ে প্রক্সি দিতে এসেছি আমি। এক মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি আসার কথা।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তারপরও আপনার সাথে ডিনার করতে পারলে আমার ভাল লাগবে।
ঠিক আছে। আপনি বরং অন্য একটা ঘরে আপনার খাবার দিতে বলুন। আমি রেস্তোরাঁর মালিককে বলে দিচ্ছি, আর কোন ধূসর কোট পরা লোক এলে উপরে পাঠিয়ে দেবে। ওনার সাথে আমার ভাল আলাপ আছে, আশা করি সমস্যা হবে না।
বেশ, থিবল্ট ওর খাবার ওপরে একটা ঘরে নিয়ে যেতে বলল, যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়।
ওপরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল থিবল্ট। ও যে খাবার অর্ডার দিয়েছে তা দুজনের জন্য যথেষ্ট। আরও এক বোতল ওয়াইন অর্ডার দিল। এই সময়ে ওয়াইনে ডুবে থাকার পাশাপাশি একজন বন্ধুর সাথে কথা বললে ভাল লাগবে।
ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। হ্যাটটা মাথায় চেপে বসিয়ে দিল। থিবল্ট। চায় না ফনগোয়াঁ ওর মাথার লাল চুল দেখতে পাক।
বন্ধু, এখন আমাকে বুঝিয়ে বলো তখন কী বললে। আমি পুরোটা বুঝিনি।
তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, চেয়ারে হেলান দিল ফনগোয়াঁ। লর্ডদের চাকরি করতে গেলে দরবারি ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করতে হয়। সে ভাষা আবার সবাই বোঝে না।
হয়তো না, তবে তুমি বুঝিয়ে বললেই তোমার বন্ধুরা বুঝবে।
তা ঠিক। বলো কী জানতে চাও।
ঠিক আছে। প্রথম প্রশ্ন, ধূসর কোট পরেছ কেন?
বন্ধুর অজ্ঞতায় হাসল ফনগোয়াঁ। ধূসর ওভারঅল পরে তুমি ভেতরের পোশাকটাকে ঢেকে রাখতে পারো। অনেকটা প্রহরীর মতো কাজ করে ওটা।
তারমানে তুমি প্রহরীর কাজ করছ? কে আসবে?
কোতেস দু মন-গুবেরের পক্ষ থেকে চিঠি নিয়ে শস্পেন আসবে।
আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। লর্ড ভোপাফোঁ, তোমার মনিব, কোঁতেস দু মন গুবেরকে ভালবাসেন। মাদামের পক্ষ থেকে শস্পেন চিঠি নিয়ে আসবে, তুমি তার অপেক্ষায় আছ।
মঁসিয়ে রাউলের ছোট ভাই বলে, শিক্ষক হিসেবে আমি খারাপ নই।
লর্ড রাউল সৌভাগ্যবান।
তা বটে।
কাউন্টেস অনেক সুন্দরী।
তুমি চেন?
ডিউক আর মাদাম দু মতির সাথে শিকার করতে দেখেছি।
ওয়াইন খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখল দুজনে। তখনই আরেকজন ধূসর কোটকে আসতে দেখল ওরা। ওদের ডাক শুনে সে উপরে চলে এল। তার সাথে একটা চিঠি আছে।
তাহলে আজ রাতে কি সাক্ষাত হচ্ছে? ফনগোয়াঁ জানতে চাইল।
হ্যাঁ, আনন্দের সাথে জবাব দিল শস্পেন।
বেশ, ফনগোয়াও খুশি।
মনিবের খুশিতে চাকরদেরও খুশি হতে দেখে অবাক হলো থিবল্ট।
তোমরা এত খুশি হচ্ছ কেন? দেখ তো মনে হচ্ছে মনিব না, বরং তোমাদের নিজেদের ইচ্ছাই পূরণ হতে যাচ্ছে?
ব্যাপারটা তা নয়। মনিব ব্যস্ত মানে আমাদের ছুটি।
ফনগোয়া বলল, ভৃত্য হতে পারি, কিন্তু সময় কীভাবে উপভোগ করা যায় সেটা ভালই জানা আছে আমার।
শস্পেন, তুমি?
শস্পেন গ্লাসটা আলোতে ধরে বলল, আমিও সময়টা উপভোগ করতে চাই।
থিবল্ট বলল, সবার ভালবাসার উদ্দেশে পান করা যাক। দেখা যাচ্ছে সবারই কেউ না কেউ আছে।
আর আমরা পান করছি তোমার ভালবাসার উদ্দেশে।
জুতো কারিগরের চোখে ঘৃণার দৃষ্টি ফুটল। আমার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব-আমি কাউকে ভালবাসি না, আমাকেও কেউ ভালবাসে না।
ওর সঙ্গীরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।
তাহলে তোমার সম্বন্ধে যেসব কথা ভেসে বেড়াচ্ছে তা কি সত্যি?
আমার ব্যাপারে কথা?
হ্যাঁ, তোমার ব্যাপারে। শস্পেন বলল।
ভোপাফোর মতো মন-বেতেও আমার ব্যাপারে কথা শোনা যায়?
শস্পেন মাথা নেড়ে সায় জানাল।
তা, কী শোনা যায়?
তুমি একটা নেকড়ে-মানব।
থিবল্ট হেসে উঠল। আমার কি কোন লেজ দেখতে পাচ্ছ? নেকড়ের মতো থাবা বা লম্বা নাক?
আমরা বলিনি। লোকে যা বলছে তাই বললাম।
তবে এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, নেকড়ে-মানবের ওয়াইনের রুচি খুবই উন্নত।
কোন সন্দেহ নেই। দুই ভৃত্য একই সাথে জবাব দিল।
যে এসব সম্ভব করেছে, সেই শয়তানের উদ্দেশে, থিবল্ট গ্লাস উঁচু করল।
বাকি দুজন গ্লাস নামিয়ে রাখল।
কী হলো?
শয়তানের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে পান করতে চাইলে অন্য কোন সঙ্গী খুঁজে নাও, আমি নেই, ফনগোয়াঁ বলল।
আমিও না, শস্পেনও যোগ করল।
ঠিক আছে, আমি একাই তিন গ্লাস পান করব তাহলে, বলে হাত বাড়াল থিবল্ট।
থিবল্ট, এখন আমার যেতে হবে, ফনগোয়াঁ বলল।
এত তাড়াতাড়ি?
লর্ড অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, শস্পেন… চিঠিটা?
এই যে।
আমরা বিদায় নিয়ে যে যার কাজে যাই। থিবল্ট এখানে সময়টা নিজের মতো উপভোগ করুক। বলে ফনগোয়াঁ শস্পেনের উদ্দেশে চোখ টিপ দিল।
শেষ আরেকবার খেয়ে তারপর যাও।
খেতে পারি, তবে ওই গ্লাসে নয়।
তোমরা বড় খুঁতখুঁতে। এখন তাহলে হোলি ওয়াটার দিয়ে এই গ্লাসগুলো ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তা নয়। বন্ধুর অনুরোধকে উপেক্ষা করার চাইতে আমরা ওয়েটারকে ডেকে নতুন গ্লাস দিতে বলব।
থিবল্টের ওপর মদের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই তিনটা গ্লাস তাহলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া উচিত? গোল্লায় যা! বলে একে একে তিনটা গ্লাসই জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ও। আশ্চর্য ব্যাপার, অন্ধকারে হারিয়ে যাবার আগে পেছনে বিদ্যুতের মতো আলোর রেখা তৈরি করল গ্লাসগুলো। আর শেষ গ্লাসটা নিচে পড়ার পরপরই শোনা গেল বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ।
জানালা বন্ধ করে ফিরে এসে থিবল্ট দেখল ওর সঙ্গী দুজন চলে গেছে।
কাপুরুষের দল! বিড়বিড় করল থিবল্ট, তারপর গ্লাস খুঁজতে গিয়ে দেখল আর কোন গ্লাস অবশিষ্ট নেই। আজব! বোতল থেকেই খেতে হবে দেখছি। যেই ভাবা সেই কাজ, গলায় ঢেলে বোতলটা খালি করে ফেলল ও। তাতে করে মস্তিষ্কের স্থিরতা অবশ্য আরও কমে গেল ওর।
রাত নটার দিকে বিল মিটিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল থিবস্ট। পুরো দুনিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছে ও। যে যন্ত্রণা থেকে পালাতে চাইছিল সেটাই বারবার ফিরে আসছে। যত সময় যাচ্ছে অ্যানলেট ওর কাছ থেকে তত দূরে চলে যাচ্ছে। অথচ সবারই হয় স্ত্রী আছে, নয় প্রেমিকা। আজ ওর এই দুর্দশা। কিন্তু জগতের আর সবাই খুশি। লর্ড ভোপাফো, দুই ভৃত্য ফনগোয়াঁ আর শস্পেন, সবাই আনন্দিত। ও-ই শুধু একা অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর ওপর কোন অভিশাপ আছে।
আকাশের দিকে হাত নাচিয়ে ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরের কাছে চলে এল থিবল্ট। পেছনে ঘোড়র ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পেল।
নিজের মনেই বলল থিবল্ট, লর্ড ভোপাফোঁ, প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। স্যার রাউলকে লর্ড মন-গুবে যদি ধরতে পারেন, কী যে হবে ভেবেই হাসি পাচ্ছে। সবাই তো আর ম্যাগলোয়া নয় যে সহজেই পার পেয়ে যাবে। এই বেলা ঠিকই অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাবে।
পথের মাঝে উটকো এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘোড়সওয়ার চাবুক নাচাল। ঘোড়র পায়ের নিচে পড়তে না চাইলে সামনে থেকে সরে যা!
থিবল্ট অর্ধ মাতাল হয়ে আছে। চাবুকের বাড়ি আর ঘোড়ার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে কাদায় গড়াগড়ি খেল ও। ততক্ষণে ঘোড়সওয়ার সামনে এগিয়ে গেছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে অপস্রিয়মাণ আকৃতির দিকে আঙুল তুলে বলল থিবল্ট, যদি জুতোর কারিগর থিবল্ট না হয়ে, শুধু একদিনের জন্যও আপনাদের মতো লর্ড হতে পারতাম। পায়ে হাঁটার বদলে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে কেমন লাগে, পথচারীদের চাবুকপেটা করতে কেমন লাগে, কোতেস দু মন-গুবের মতো স্বামী প্রবঞ্চক স্ত্রীদের সাথে প্রেম করতে কেমন লাগে জানতে পারতাম।
সঙ্গে সঙ্গে দূরবর্তী ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠে পিঠের আরোহীকে মাটিতে ফেলে দিল!
ষষ্ঠদশ অধ্যায় – প্রেয়সী
তরুণ ব্যারনকে পড়ে যেতে দেখে খুশি হলো থিবল্ট। দৌড়ে দেখতে গেল কী অবস্থা। চাবুকের বাড়ির কারণে কাঁধ এখনও জ্বলছে ওর। পড়ে থাকা শরীরটার পাশে ঘোড়াটা ঘুরছে। কাছে গিয়ে দেখল, একটু আগেই ঘোড়ায় চড়ে ওর পাশ দিয়ে যে ছুটে গেছে, সে লোক এ নয়। এর পরনে এক দরিদ্র পথিকের পোশাক। উত্তরোত্তর ওর বিস্ময় বাড়তেই থাকল। আরও অবাক হলো যখন দেখল-অজ্ঞান শরীরটা হুবহু ওর মতো দেখতে, ওরই পোশাক পরা! নিজের দিকে তাকাল থিবল্ট। ওর পোশাকও পাল্টে গেছে। দামী শিকারি বুট ওর পায়ে, দামী কোটে সোনার কারুকাজ করা, ওয়েস্টকোটটা সুন্দর সাদা জিনসের, শার্টটাও অভিজাতদের উপযোগী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওর বেশভূষা পাল্টে গেছে। হাতে একটা চাবুকও চলে এসেছে। ওটা দিয়ে বাতাসে একবার বাড়ি মেরে শব্দ শুনল থিবল্ট। কোমরে ওর শোভা পাচ্ছে বড় একটা শিকারি ছুরি, যেটাকে তলোয়ারও বলা চলে।
নিজের পরনে এই চমৎকার পোশাক দেখে প্রচণ্ড খুশি হলো ও। এই পোশাকে ওকে কেমন মানিয়েছে দেখতে অধীর হয়ে উঠল। আর তখনই মনে পড়ল, বাড়ির বেশ কাছেই চলে এসেছে ও। আহ! আমার ঘরেই তো আয়না আছে!
ছুটে গেল থিবল্ট নিজের ঘরের দিকে, নার্সিসাসের মতো নিজের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে। কিন্তু ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। চাবির জন্য পকেট হাতড়াতে লাগল ও। টাকা ভরা পার্স, চকলেট, ছোট পেন-নাইফ এসব খুঁজে পেল। কিন্তু দরজার চাবিটা কোথায় গেল? হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল ওর। চাবিটা হয়তো রাস্তায় শুয়ে থাকা থিবল্টের পকেটে আছে। ফিরে গিয়ে পকেট থেকে উদ্ধার করল ওটা। ঘরের ভেতরটা বাইরের চাইতেও অন্ধকার। দিয়াশলাই খুঁজে নিয়ে মোম জ্বালাতে জ্বালাতে বলে উঠল, শুয়োরগুলো এই নোংরার মধ্যে কীভাবে থাকে কে জানে!
আলো জ্বালিয়ে আয়নাটা নামিয়েই চমকে উঠল ও। আত্মাটা থিবল্টের হতে পারে, কিন্তু শরীরটা কোনমতেই থিবল্টের নয়। আয়নার ভেতর পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের এক সুদর্শন তরুণ তাকিয়ে আছে। নীল চোখ, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, সাদা দাঁত। থিবল্টের আত্মা ব্যারন রাউল দু ভোপাফোর শরীরে প্রবেশ করেছে। এখন বুঝতে পারছে কেন জ্ঞান হারা মানুষটা ওর পোশাক পরে, ওর চেহারা নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে।
একটা জিনিস ভুললে চলবে না-যদিও মনে হচ্ছে আমি এখানে, কিন্তু আমি আসলে বাইরে রাস্তায় শুয়ে আছি। সাবধান থাকতে হবে যেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আমার কোন ক্ষতি না হয়। মঁসিয়ে দু ভোপাফোঁ, বেশি চিন্তা না করে বেচারাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দাও। মঁসিয়ের অভিজাত অনুভূতির কাছে কাজটা অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে হলেও, থিবল্ট রাস্তা থেকে নিজের দেহটাকে তুলে ঘরে নিয়ে এল, সাবধানে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। একটা গাছের খোড়লে লুকিয়ে রাখল চাবিটা।
পরের কাজ হচ্ছে ঘোড়াটাকে ধরে চড়ে বসা। সারাজীবন হেঁটেই চলাফেরা করেছে থিবল্ট, ভাল ঘোড়সওয়ার ও নয়। ঘোড়া ঠিকমতো চালাতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো না। রাউলের শরীরের সাথে সাথে শারীরিক দক্ষতাগুলোও আয়ত্তে চলে এসেছে ওর। পিঠে সওয়ারি টের পাওয়া মাত্র ঘোড়াটা লাফাতে শুরু করল। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী হয়েই রাশ চেপে ধরল ও। দুপা দিয়ে ঘোড়ার দুপাশ চেপে ধরে স্পার দাবাল। দুচারটা চাবুকের বাড়ি মেরে জটাকে বশে আনার প্রয়াস পেল।
ওর অবশ্য পরিষ্কার ধারণা নেই এরপর কী করবে। শুধু জানে কোতেফসের চিঠি অনুযায়ী মন-গুবেতে যেতে হবে। চিঠিতে কী লেখা? ঠিক কখন দেখা করার কথা? দুর্গে কীভাবে ঢুকবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর একটা একটা করে ওকে আবিষ্কার করতে হবে। আচ্ছা, চিঠিটা তো এখন ওর কাছেই থাকতে পারে। হাতড়াতে হাতড়াতে ভেতরের পকেটে চিঠির মতো একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। ঘোড়া থামিয়ে একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ বের করল ও। ব্যাগের এক পকেটে কয়েকটা চিঠি আর এক পকেটে একটা চিঠি। এটাই সম্ভবত সেই চিঠি। পড়তে হলে আলো দরকার। কাছের একটা লোকালয়ে গেল থিবল্ট। কোন ঘরে আলো চোখে পড়ল না। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ডাক দিল। বাতি হাতে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ আলো ধরে রাখতে পারবে? খুব উপকার হত।
এরজন্যই ঘুম ভাঙিয়ে বিছানা থেকে ডেকে তুললেন? খুব রুক্ষ স্বরে বলল ছেলেটা। মানুষ বটে আপনি! বলে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। ভুলভাবে ছেলেটার সাথে কথা শুরু করেছে, বুঝতে পারল থিবল্ট। এবার তাই গলা চড়িয়ে বলল, এই ছেলে! চাবুকের বাড়ি খেতে না চাইলে আলোটা নিয়ে এদিকে এসো!
ক্ষমা করবেন, মাই লর্ড! অন্ধকারে বুঝতে পারিনি কার সাথে কথা বলছি। কাছে এসে বাতিটা উঁচু করে ধরল ছেলেটা।
চিঠির ভাঁজ খুলল থিবল্ট, লেখা:
প্রিয় রাউল,
ভালবাসার দেবী নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষে আছে। আগামীকাল একটা বড় শিকারের আয়োজন হয়েছে। সেটায় যোগ দিতে আজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে যাচ্ছে ও। তুমি নটার দিকে রওনা দিলে সাড়ে দশটার মধ্যে চলে আসতে পারবে। কোন দিক দিয়ে আসবে সেটা তো তুমি জানোই। পরিচিত একজন তোমাকে আনতে যাবে। তোমার দোষ ধরছি না, তবে মনে হলো গতবার তুমি করিডোরে অনেকক্ষণ ছিলে।
নিচে কোন সই নেই।
কপাল! স্বগতোক্তি করল থিবল্ট।
কিছু বললেন, মাই লর্ড?
কিছুই না, তোমার কাজ শেষ তুমি এখন যেতে পারো।
শুভ যাত্রা, মাই লর্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল ছেলেটা।
কপাল! প্রেমের দেবী আমাদের পক্ষে আছে, কোতেসের খ্রিষ্টান নাম জেন, জেনের স্বামী সন্ধ্যায় বেরিয়ে যাচ্ছে, আর ও আমাকে সাড়ে দশটায় আশা করছে। এর বাইরে, কোন পথে যেতে হবে সেটা আমার জানা থাকার কথা। পরিচিত কেউ একজন এসে আমাকে নিয়ে যাবে। দুশ্চিন্তায় কান চুলকাতে লাগল থিবল্ট। ওর শরীরে বন্দী লর্ড ভোপাফোঁকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? নাহ, তাতে ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। ব্যাটা নিজের শরীরের সাথে যোগ দিতে চাইলে মারামারি লেগে যাবে। তাতে ওর শরীরের কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। অন্য কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ও বহুবার শুনেছে ঘোড়ার ইন্দ্রিয় খুব প্রখর। ঘোড়াটাকে নিজের মতো চলতে দিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রধান সড়কে এসে তাই মন-গুবের দিকে মুখ করে ঘোড়াটাকে ইচ্ছামতো চলতে দিল ও। ঘোড়াটাও বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করল। পার্কের কোনার কাছে এসে ঘোড়াটা ইতস্তত করতে শুরু করল। কান খাড়া করে ফেলেছে। থিবল্টের মনে হলো দুটো ছায়া দেখতে পেয়েছে। ঘোড়া থামিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে অবশ্য আর কিছু দেখতে পেল না ও। সম্ভবত কোন চোরাশিকারি হবে। ঘোড়াটা আবার চলতে শুরু করল। দেয়ালের গা ঘেঁষে নরম মাটির ওপর দিয়ে, যাতে শব্দ না হয় বা খুব কম হয়। বুদ্ধিমান প্রাণীটা জানে এখানে কীভাবে চলতে হবে।
একপর্যায়ে দেয়ালে একটা ভাঙা অংশ চোখে পড়ল। ঘোড়াটা সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা সমস্যার সমাধান হয়েছে। চেনা পথে এসে পড়েছে প্রাণীটা। এরপর ওর পরিচিত লোককে খুঁজে বের করতে হবে। আরও মিনিট পাঁচেক চলার পর দুর্গ থেকে একটু দূরে অমসৃণ কাঠ, খড় আর কাদা দিয়ে বানানো একটা কুঁড়ের সামনে এসে দাঁড়াল থিবল্টের বাহন। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনে খুলে গেল দরজা। একটা সুন্দর মেয়ে বেরিয়ে এল, কে, মঁসিয়ে রাউল?
হ্যাঁ, আমি, ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বলল থিবল্ট।
মাদাম ভয় পাচ্ছিলেন, মাতাল শস্পেন আপনাকে চিঠিটা ঠিকমতো দিতে পেরেছিল কি না ভেবে।
ভয় নেই। শস্পেন সময়মতোই চিঠি পৌঁছে দিয়েছে।
ঘোড়াটা রেখে চলে আসুন।
ঘোড়াটা দেখবে কে?
খামোজি। ও-ই তো সবসময় দেখে।
ও আচ্ছা, খামোজি দেখবে, এমনভাবে বলল থিবল্ট যেন এটা ওর আগে থেকে জানা।
তাড়াতাড়ি আসুন, নইলে মাদাম আবার অভিযোগ করবেন আমরা করিডোরে বেশি সময় কাটিয়েছি।
রাউলকে লেখা চিঠিতে এ ধরনের একটা কথা ছিল। মনে পড়ল ওর। মেয়েটা মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বের করে হাসল। তাই দেখে থিবল্টের ইচ্ছা করল করিডোরে ঢোকার আগে পার্কেই কিছু সময় কাটায়।
হঠাৎ থেমে গেল মেয়েটা। ঘাড় কাত করে কী যেন শোনার চেষ্টা করল।
কী হলো?
কারও পায়ের চাপে ডাল ভাঙার শব্দ শুনলাম বলে মনে হলো।
হয়তো খামোজি।
সে কারণেই, এখানে যা-ই করুন খুব সাবধানে করবেন।
মানে?
আপনি কি ভুলে গেছেন যে আমি খামোজির বাগদত্তা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যইতোমার সাথে একা থাকলেই এসব ভুলে যাই রাণী।
রাণী! এখন আমার নাম হয়ে গেল রাণী? জানতাম না আপনি এতটা ভুললামনের মানুষ, মঁসিয়ে রাউল।
তোমাকে রাণী ডাকলাম কারণ, তুমি মহিলা পরিচারিকাদের রাণী!
সত্যি কথা বলতে কী, মাই লর্ড, আপনাকে সজীব, বুদ্ধিমান একজন মানুষ বলেই জানি। তবে আজ আপনি সব ধারণা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
এই মন্তব্যে খুশি হলো থিবল্ট।
আশা করি, তোমার মালকিনও তেমনটাই ভাববেন।
সে ব্যাপারে এটুকু বলতে পারি, জিভ সংবরণ করতে পারলেই এইসব কেতাদুরস্ত মহিলারা, পুরুষদের চালাক-চতুর ভাবে।
ধন্যবাদ, পরামর্শটা মনে রাখব।
চুপ! ড্রেসিং রুমের পর্দার আড়ালে মাদাম দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পেছন পেছন আসুন।
পার্কের প্রান্ত থেকে দুর্গের সিঁড়ি পর্যন্ত একটা খোলা জায়গা আছে। থিবল্ট সেদিকে এগোতে যেতেই মেয়েটা বাধা দিল।
হাত চেপে ধরে বলল, বোকার মতো কী করছেন?
কী করছি আমি? সুযেত, স্বীকার করছি। আমি আসলেই জানি না কী করছি!
সুযেত! এখন আমার নাম, সুযেত! মঁসিয়ে বোধহয় আমাকে একের পর এক সব রক্ষিতাদের নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছেন। রিসেপশন রুম দিয়ে নিশ্চয়ই যাওয়ার চিন্তা করছেন না? তাহলে লর্ড কাউন্টের হাতে ধরা খেতে সময় লাগবে না। এদিক দিয়ে আসুন।
মেয়েটা ছোট একটা দরজা পেরিয়ে প্যাচানো সিঁড়িতে তুলল ওকে। অর্ধেক উঠতেইথিবন্ট সঙ্গীর সরু কোমর জড়িয়ে ধরল।
আমরা করিডোরে চলে এসেছি তাই না? মেয়েটার সুন্দর গালে চুমু খাবার চেষ্টা করতে করতে বলল থিবল্ট।
এখনও না। তবে তাতে কিছু যায় আসে না।
বিশ্বাস করো, আজ সন্ধ্যায় আমার নাম রাউল না হয়ে যদি থিবল্ট হত, তোমাকে তুলে নিয়ে দোতলায় না থেমে সোজা চিলেকোঠায় চলে যেতাম।
এ সময় একটা দরজার কবাট নড়ার শব্দ ভেসে এল।
তাড়াতাড়ি মঁসিয়ে, মাদাম অধৈর্য হয়ে পড়ছেন।
থিবল্টকে টেনে নিয়ে করিডোর পেরোল মেয়েটা। তারপর একটা দরজা খুলে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল। এই ভেবে আশ্বস্ত হলো সে যে ব্যারন রাউল দু ভোপাফোঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে ভুললামনা মানুষটাকে নিরাপদে নিয়ে আসতে পেরেছে!
সপ্তদশ অধ্যায় – ব্যারন দু মন-গুবে
কাউন্টেসের কামরায় নিজেকে আবিষ্কার করল থিবল্ট। বেইলিফের বাড়িতে অনেক দামী দামী আসবাব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ও। আর এখানে যা দেখল তাতে বিস্মিত হলো। একজন মানুষ যা কখনও দেখেনি, যা সে কখনও কল্পনাও করতে পারে না।
ওর মনের চোখে একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল। অ্যানলেটের ছোট্ট কুঁড়ে, মাদাম পুলের খাবার ঘর, বেইলিফের স্ত্রীর শোবার ঘর। কিন্তু এই ঘরের তুলনায় সেগুলো কিছুই নয়। যা দেখছে তা সত্যি, না কোন জাদুকরের প্রাসাদে চলে এসেছে-বুঝতে পারছে না থিবল্ট। কেন ও চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ব্যারন হতে চাইল? এরচেয়ে সারাজীবনের জন্য মাদামের কুকুর হতে চাইলেও তো পারত। এইসব অকল্পনীয় আসবাব দেখার পর আবার থিবল্ট হিসেবে কীভাবে ও জীবন কাটাবে?
ড্রেসিংরুমের দরজা খুলে কাউন্টেস হাজির হলো। এমন ঘরে এমন নারীকেই মানায়! মাথায় হীরের পিন লাগানো। লেসের কাজ করা গোলাপি গাউন শরীরের কোন আকর্ষণকেই ঢাকতে পারছে না। পায়ে রূপোর জুতো। গলায় মুক্তোর একটা হার ছাড়া আর কোন গহনা নেই। আর সে মুক্তোও বোধকরি শুধু রাজার ঘরেই শোভা পায়!
এই বিলাসী সৌন্দর্য্যের ভারে যেন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিল্ট।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিচু হও। আরও নিচু। আমার পায়ে চুমু খাও। কার্পেটে, তারপর মেঝেতে। তা-ও আমি তোমাকে ক্ষমা করব না। তুমি একটা অসুর।
সত্যি কথা বলতে কী মাদাম, তোমার তুলনায় আমি তার চেয়েও অধম।
হ্যাঁ, ভাব দেখাও যেন তুমি আমার কথার ভুল মানে করছ। ভাবছ, আমি তোমার বেশভূষা আর চেহারা নিয়ে কথা বলছি? কিন্তু না, আমি কথার বিষয়বস্তু তোমার চরিত্র। তোমার ভেতরের চেহারাটা যদি বাইরেও দেখা যেত, তাহলে তোমার দিকে আর তাকানো যেত না। শত দোষ থাকার পরও, তুমি সবচাইতে সুদর্শন পুরুষ। কিন্তু মঁসিয়ে, এটা তো স্বীকার করবে যে তুমি লজ্জিত?
লজ্জিত, কারণ আমি সবচেয়ে সুদর্শন? কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারছে থিবল্ট, অপরাধ যা-ই করে থাকুক ব্যারন, সেটা ক্ষমার অযোগ্য নয়।
না, কারণ হাসিখুশি মুখের আড়ালে তোমার মনটা কালো, আর তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। এখন ওঠো। কাউন্টেস তার হাত বাড়িয়ে দিল। সে হাত একই সঙ্গে ক্ষমা নির্দেশ করছে আবার চুম্বনও আশা করছে।
থিবল্ট নরম, মিষ্ট হাতটায় চুমু খেল। একটা সোফায় বসে পড়ল কাউন্টেস। রাউল রূপী থিবকে ইঙ্গিত করল পাশে বসার।
এবার বলল, শেষবার দেখা হওয়ার পর কী কী করেছ?
তার আগে মনে করিয়ে দেবে, শেষ কখন এসেছিলাম?
ভুলে গেছ? নাকি ঝগড়া করতে চাইছ? নইলে এসব কথা কেউ বলে না।
ঠিক তার উল্টো। শেষবারের কথা এখনও এত তাজা মনে হচ্ছে, যেন গতকালের ঘটনা। তারপর যে কী করেছি, মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস করো, গতকালের পর থেকে, তোমাকে ভালবাসা ছাড়া আর কোন অপরাধ আমি করিনি।
মন্দ বলোনি। তবে প্রশংসা দিয়ে পদস্থলনের দোষ থেকে মুক্তি পাবে না।
জবাবদিহির কাজটা অন্য কোন সময়ের জন্য তুলে রাখি?
না, আমার এখনই জবাব চাই। শেষবার দেখা হওয়ার পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তুমি কী করেছ?
কাউন্টেস, তুমি না বললে আমি কীভাবে জানব? আমি তো জানি, আমি নির্দোষ।
বেশ! করিডোরে তোমার কালক্ষেপণ নিয়ে কোন কথা শুরু করব না আমি।
এটা দিয়েই শুরু করি! তোমার মতো সেরা হীরের টুকরো পাওয়ার পর, নকল মুক্তো নিয়ে আমি কী করব?
হুঁহ! পুরুষের স্বভাব আমার জানা আছে। তাছাড়া লিযেট যথেষ্ট সুন্দরী।
ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, জেন। লিযেট আমাদের সব জানে। ওকে ঠিক পরিচারিকা হিসেবে ভাবাটা ঠিক হবে না।
কী যুক্তি! আমি কোতেস দু মন-গুবের সাথে প্রতারণা করছি, আবার আমি মঁসিয়ে খামোজির প্রতিদ্বন্দ্বীও।
ঠিক আছে তাহলে। করিডোরে আর দেরি হবে না। বেচারি লিযেট আর কোন চুমুও পাবে না, যদি বা কখনও পেয়েও থাকে!
যা-ই হোক, তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
তার মানে আমি এরচেয়েও খারাপ কিছু করেছি?
তোমাকে যে রাতে এনেভিলা আর ভিলারস-কটেরেটের মাঝের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল, সে রাতে কোথায় ছিলে?
কেউ আমাকে দেখেছিল?
হ্যাঁ। এনেভিলার রাস্তায়। কোথা থেকে আসছিলে?
মাছ ধরে ফিরছিলাম।
মাছ ধরে?
পুকুর খালি হচ্ছিল।
তুমি কত বড় জেলে সেটা আমার খুব ভাল জানা আছে। তা রাত দুটোর সময় কোন্ মাছটা তুমি ধরে আনছিলে?
ব্যারন, আমার বন্ধু, ভেযে ওর সাথে খাওয়া-দাওয়া করছিলাম।
তোমার বন্ধু যে সুন্দরীকে বন্দী করে রেখেছে, নিশ্চয়ই তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছ। কিন্তু সেটাও আমি ক্ষমা করে দিতে পারি।
কী, এরচেয়েও খারাপ অপরাধ থাকতে পারে? অপরাধ যত বড়ই হোক, তারপরই ক্ষমা আসতে দেখে থিবল্ট আশ্বস্ত হতে শুরু করেছে।
হ্যাঁ, ডিউক অফ অরলিয়ন্সের দেয়া নাচের আসরে।
কোন্ নাচের আসর?
কেন, গতকালেরটা? অনেকদিন আগের কথা তো নয়।
ওহ, গতকালেরটা? তোমার রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
তাই বুঝি, কিন্তু আমি তো সেখানে ছিলাম না।
তোমার রূপে মুগ্ধ হওয়ার জন্য তোমার থাকাটা কি জরুরি? মনের চোখে তোমাকে দেখে কি আমি মুগ্ধ হতে পারি না? তুলনা করতে গেলে, না গিয়েও তো তুমি জিতে গেছ।
সেই তুলনার সর্বোচ্চ চূড়াটা কী, মাদাম দু বোনোইয়ের সাথে চারবার নাচা? চড়া সাজগোজ করা কালো মেয়েগুলো দেখতে খুব সুন্দর, তাই না?
ওই চারটা নাচে আমরা কী নিয়ে কথা বলেছি জানো?
তাহলে স্বীকার করছ চারবার নেচ্ছে?
তুমি যখন বলছ তখন কোন সন্দেহ নেই এটা সত্যি।
এটা কি ভাল উত্তর হলো?
আর কী উত্তর দেব? এমন সুন্দর একটা মুখের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে? এই মুখ আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেও, আমার পক্ষে সম্ভব না।
কথাটা বলেই থিবল্ট কাউন্টেসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর তখনই দরজা ঠেলে ঢুকল লিযেট।
মঁসিয়ে, মঁসিয়ে, নিজেকে বাঁচান! লর্ড কাউন্ট চলে এসেছেন।
কাউন্টেস বিস্মিত হলো, কাউন্ট!
সাথে ওঁর শিকারি লেস্টকও আছে।
অসম্ভব!
বিশ্বাস করুন, মাদাম; খামোজি, নিজের চোখে দেখেছে। ভয়ে ও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
তারমানে শিকারের ব্যাপারটা ভান ছিল। আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য?
কে জানে, মাদাম? পুরুষেরা এত প্রবঞ্চনা করতে পারে!
এখন কী করা যায়?
আবার সৌভাগ্য হাতের মুঠোয় এসে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে ক্ষেপে গেল থিবল্ট। কাউন্টের জন্য অপেক্ষা করি, তারপর ওকে মেরে ফেলব!
মেরে ফেলবে, কাউন্টকে? রাউল, তুমি কি পাগল হয়েছ? না না, তুমি পালাও, নিজেকে বাঁচাও। লিযেটা ব্যারনকে আমার ড্রেসিংরুম দিয়ে বাইরে নিয়ে যাও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিফেটের হাত ধরে নিরাপদে বেরিয়ে এল থিবল্ট। অল্পের জন্য রক্ষা পেল ও। অন্যদিকে কাউন্টেস তার শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল। অনেক ঘর ঘুরে যে সিঁড়ি দিয়ে প্রাসাদে উঠেছিল সেখানে চলে এল থিবল্ট। দোতলার অফিসের মতো একটা ঘরের জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে লিযেট। লাফ দিয়ে নিচে নামল থিবল্ট।
ঘোড়া কোথায় আছে তা তো জানেনই। ভোপাফো না পৌঁছানো পর্যন্ত থামবেন না।
আস্তাবলের কাছে এসে ঘোড়ার আওয়াজ পেল থিবল্ট। জটার পিঠে উঠে বসল ও। কিন্তু ঘোড়াটা খোঁড়াতে লাগল। ও তাড়া দিতে সোজা হওয়ার চেষ্টা করেও কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা। কিন্তু ও নেমে যেতেই ঘোড়াটা আবার দাঁড়াতে পারল। কোন সন্দেহ নেই, ব্যারন যাতে পালাতে না পারে তাই ঘোড়ার পা খোঁড়া করে দিয়েছে মঁসিয়ে কোঁত দু মন-গুবে। থিবল্ট প্রতিজ্ঞা করল, যদি আপনার সাথে কখনও দেখা হয়, যেভাবে এই অসহায় প্রাণীটাকে খোঁড়া করেছেন, সেভাবে আপনাকেও খোঁড়া করে দেব আমি!
যে পথে ঢুকেছিল সেদিক দিয়েই বেরিয়ে এল ও। আর বেরিয়েই দেখল কোঁত দু মন-গুবে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টও ওকে রাউল দু ভোপাফো বলে চিনতে পারল।
তলোয়ার হাতে নাও, ব্যারন! আহবান জানাল কাউন্ট। প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ক্ষিপ্ত থিবল্টও হাতে শিকারের ছুরি তুলে নিল। শুরু হলো অস্ত্রের ঝনঝনানি।
থিবল্ট তলোয়ারবাজি জানে না। কিন্তু দেখা গেল দিব্যি তলোয়ার চালাতে পারছে ও। এবং বেশ ভালই লড়ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কাউন্ট বলল, শুনেছিলাম, সেইন্ট-জর্জেসকে ধুলোয় গড়াগড়ি খাইয়েছিলে তুমি!
জর্জেস কে থিবল্ট জানে না। তবে এই মুহূর্তে নিজের কব্জির শক্তি আর ক্ষিপ্রতা সম্বন্ধে ও ওয়াকিবহাল। স্বয়ং শয়তানের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে। সুযোগমতো ফাঁক পেয়ে কাউন্টের কাঁধে ছুরি বিধিয়ে দিল ও। কাঁধ চেপে ধরে তলোয়ার ফেলে দিল কাউন্ট। হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে উঠল, লেস্টক, বচাও!
তখন ছুরিটা ঢুকিয়ে রেখে পালিয়ে গেলেই ভাল করত থিবল্ট। কিন্তু অবলা খোঁড়া ঘোড়াটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়ে গেল প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞার কথা। অস্ত্র ধরা হাতটা কাউন্টের ভাঁজ করা হাঁটুর নিচে ঢুকিয়ে টান দিল ও। ব্যথায় আর্ত-চিৎকার ছাড়ল কাউন্ট। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই থিবল্টও পিঠে তীব্র ব্যথার অস্তিত্ব টের পেল। বুকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করল। ওর বুক ভেদ করে একটা অস্ত্রের মাথা বেরিয়ে এসেছে। প্রচুর রক্ত বেরোচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। মনিবের ডাক শুনে লেস্টক ছুটে এসেছিল। থিবকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ওর পিঠে শিকারের ছুরি বসিয়ে দিয়েছে ভৃত্য।
অষ্টাদশ অধ্যায় – মৃত্যু এবং পুনরুত্থান
সকালের ঠাণ্ডা বাতাসে জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে কিছুই মনে পড়ল না থিবল্টের। শুধু অনুভব করল তীব্র ব্যথা, আর দেখল মাটিতে প্রচুর রক্ত। দেয়ালের ফাঁকটা চোখে পড়ল তারপর ধীরে ধীরে আগের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল। কাউন্টকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোন সন্দেহ নেই লেস্টক তার মনিবকে নিয়ে গেছে। ওকে ফেলে রেখে গেছে মরার জন্য। চাইলে একটা ইচছার জোরে ওদের শেষ করে দিতে পারে থিবল্ট। কিন্তু করল না। কারণ যা-ই করে থাকুক, সেটা ওরা থিবল্টের সাথে করেনি, করেছে রাউলের সাথে।
ওর হাতে নটা পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু ততক্ষণ টিকবে তত? তার আগেই যদি ও মারা যায়, তাহলে আসলে কে মারা যাবে? ও, না ব্যারন? সম্ভবত ব্যারনের শরীর আর ওর আত্মা মারা যাবে। এই দুর্ভাগ্যের জন্য আসলে ও-ই দায়ী। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পাল্টাপাল্টির আগের ইচ্ছাটার পরিণাম ছিল কাউন্টের হাতে ব্যারনের ধরা পড়া এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
অনেক পরিশ্রমের পর, অনেক ব্যথা সহ্য করে থিবল্ট হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠতে পারল। একটু দূরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুখে রক্ত চলে আসায় ডাকতে পারল না। হ্যাট খুলে সেটা ছুরির আগায় ধরে উঁচু করার চেষ্টা করল। তাও শক্তিতে কুলালো না। আবার অজ্ঞান হয়ে গেল ও। একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরল। টের পেল ওর শরীরটা এপাশ-ওপাশ দুলছে। কিছু পথিক ওকে দেখতে পেয়েছে শেষ পর্যন্ত। এই সুদর্শন তরুণটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভিলারস-কটেরেটে। পিউযো পর্যন্ত গিয়ে আহত মানুষটা আর পারল না। কাতর অনুনয় করল কাছাকাছি কোন বাড়িতে ওকে রেখে ডাক্তার ডেকে আনতে। গ্রামের পাদ্রীর বাড়িতে ওকে রেখে গেল ওরা। বিল্ট পার্স থেকে ওদের সোনা বের করে দিল এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল। পাদ্রী তখন বাড়িতে ছিল না। ফিরে এসে রাউলকে দেখে প্রচণ্ড দুঃখ প্রকাশ করল সে। রাউল নিজেও হয়তো এরচেয়ে ভাল হাসপাতাল খুঁজে বের করতে পারত না। পাত্রী একসময় রাউলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। আঘাতটা ভাল করে দেখল পাদ্রী। ছুরিটা ডানদিকের ফুসফুসটা ফুটো করে পাজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়েছে।
আঘাতের গুরুত্ব বুঝলেও ডাক্তার না আসা পর্যন্ত কিছু বলল না পাদ্রী। ডাক্তার এসে দেখে মাথা নাড়তে লাগল।
ওর রক্ত বের করবেন?
কী লাভ? আঘাত পাওয়ার পরপরই যদি বের করা যেত, হয়তো উপকার হত। কিন্তু এখন নাড়াচাড়া করাও বিপজ্জনক।
ওর বাঁচার কোন সম্ভাবনা আছে? ডাক্তার যদি হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে পাদ্রীর চেষ্টা করার সুযোগ বাড়বে।
ডাক্তার নিচু গলায় বলল, যদি এভাবে চলে, তাহলে আজকের দিনটাও যাবে না।
তারমানে আপনি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন?
একজন ডাক্তার কখনও রোগীর ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় না। দিলেও এই বিশ্বাসটুকু রাখে যে প্রকৃতি রোগীর প্রতি দয়া দেখালেও দেখাতে পারে। ভেতরে কিছু জমাট বাঁধলে রক্তক্ষরণটা বন্ধ হবে। কাশলে আর জমাট বাঁধবে না, তাতে রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হবে।
তাহলে আপনার মতে আমার এখন এই যুবককে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা উচিত?
ডাক্তার কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, সবচেয়ে ভাল হয় ওকে একা থাকতে দিলে। প্রথমত-এখন ও ক্লান্ত এবং ওর শরীরে শক্তি নেই তেমন; আপনার কথায় মনোযোগ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত-পরে ও পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে যাবে, আপনার কথা কিছুই বুঝবে না। কিন্তু থিবল্ট সবই শুনতে পাচ্ছে। লোকে একটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকে-মনে করে যে খুব অসুস্থ মানুষ কিছু শুনতে পায় না, কিন্তু মানুষটা সবই শুনতে পায়। অবশ্য থিবল্টের আত্মাটা এই শরীরের নয়। হয়তো এ কারণেই শারীরিক দুর্বলতা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না ওর ওপর।
পেছনের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করলেও সামনেরটাতে শুধু ঠাণ্ডা পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে রাখতে নির্দেশ দিল ডাক্তার। একটা পানির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মেশাল সে। পাদ্রীকে বলল পানি চাইলে রোগীকে যেন এটা দেয়। পরের দিন সকালে আবার আসবে বলল। যদিও আশঙ্কা করল আসাটা বৃথাই হবে।
থিবল্ট কিছু বলতে চাইলেও শরীরের দুর্বলতার জন্য পারল না। পাদ্রীও ওকে ঝাঁকিয়ে ওঠাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। পাদ্রীর চেষ্টাটা থিবল্টের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। পাদ্রীর ভাগ্য ভাল থিবল্টের অতিমানবীয় ক্ষমতা এখন কাজ করছে না। নয়তো বেচারাকে বহুবার নরক ঘুরে আসতে হত।
একসময় ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গরম লাগতে শুরু করল। শরীরের রক্ত যেন গরম পানির মতো ফুটতে শুরু করেছে। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আটকে থাকা চোয়াল খুলে গেল। অসার জিভে সার ফিরল।
ডাক্তার যেই ঘোরের কথা বলেছিল, সম্ভবত সেই ঘোরে চলে যাচ্ছি। বেশ অনেকটা সময়ের জন্য এটাই ছিল ওর শেষ স্বাভাবিক চিন্তা।
হরিণের পিছু ধাওয়া থেকে শুরু করে গত রাত পর্যন্ত সব ঘটনা একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে থিবল্টের। কাউন্টেসের হাতে চুমু খাওয়ার পর ও পালাচ্ছে। একটা তেরাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিন রাস্তার মাথায় তিনজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে। প্রথমজন ডুবন্ত ম্যাকোট। দ্বিতীয়জন হাসপাতালে জ্বরের ঘোরে মৃত্যুপথযাত্রী ল্যান্ড্রি। তৃতীয়জন আহত বিধ্বস্ত এক পা নিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকা একজন মানুষ, কোত দু মন-গুবে।
ও এক এক করে সবার গল্প বলতে থাকল। এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে একপর্যায়ে আহত লোকটার চেয়েও ফ্যাকাসে হয়ে গেল পাদ্রীর চেহারা। মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার চেয়েও বেশি কাঁপছে সে। পাদ্রী ওকে পাপমুক্ত করতে এগোতে চাইলে থিবল্ট তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বিচিত্র এক হাসি হেসে উচ্চস্বরে বলল, আমার কোন পাপমুক্তি নেই! আমি অভিশপ্ত। আমার নিয়তি নির্ধারিত!
এই ঘোরের মধ্যেও থিবল্ট ঘড়ির ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। ঘণ্টা বাজছে আর ও গুনছে। ঘড়িটার আকৃতি হয়ে গেছে বিশাল সংখ্যাগুলো যেন আগুনের শিখা। ঘড়িটা হচ্ছে অনন্তকাল। প্রকাণ্ড পেন্ডুলামটা যেন এপাশ ওপাশ দুলছে আর বলছে, কখনও না। সবসময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে ও এই লম্বা দিনটা পার করল। এক সময় নটার ঘণ্টা বাজল। সাড়ে নটায় আবার যে যার শরীর ফিরে পাবে। ঘণ্টার শেষ ধ্বনিটা মিলিয়ে যেতেই জ্বরটা চলে গেল। তার পেছন পেছন এক শীতলতার অনুভব। শীতে কাঁপতে লাগল থিবল্ট। চোখ খুলল। পাদ্রী বিছানার পায়ের কাছে বসে প্রার্থনা করছে। ঘড়ির কাটা সময় সোয়া নটা নির্দেশ করছে। সাড়ে নটা বাজতেই প্রবলভাবে শরীরটা কাঁপতে শুরু করল ওর। পা থেকে ধীরে ধীরে সারা শরীর অসাড় হয়ে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম জমছে। না ও নিজে মুছতে পারছে, না কাউকে বলতে পারছে মোছার কথা। অদ্ভুত সব আকৃতি দেখতে পাচ্ছে ও। কোনটাই মানুষের নয়। চোখের আলো মরে আসছে। বাদুড়ের মতো ডানা বের হয়ে ওর যেন শরীরটা উড়ে গেল কোন এক অদ্ভুত জায়গায়, যেখানে গোধূলির মতো আবছা আলো বিরাজ করছে। সেটা না জীবন, না মৃত্যু, দুটোরই অংশ যেন। ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়ছে। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে ও। ডুবে যাচ্ছে কোন এক অন্তহীন গহ্বরে। শুনতে পাচ্ছে কোথাও একটা ঘণ্টা বাজছে।
ঘণ্টাটা একবারই বাজল। শব্দটা মিলিয়ে যেতেই আহত লোকটা কাতর আওয়াজ করে উঠল। পাদ্রী উঠে বিছানার পাশে গেল। সাড়ে নয়টা বাজার ঠিক এক সেকেন্ড পর ব্যারন রাউল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
উনবিংশ অধ্যায় – মৃত এবং জীবিত
ব্যারন যে মুহূর্তে মারা গেল, সেই একই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল থিবল্ট। চারদিকে আগুন জ্বলছে। কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? চারপাশে থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, নেকড়ে-মানব মরে যাক! জাদুকর নিপাত যাক! না কোন দুঃস্বপ্ন নয়, ওর বাড়ির ওপর আক্রমণ এসেছে।
আর বেশি দেরি করলে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হবে। শুয়োর-মারা-বর্শাটা হাতে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিল থিবল্ট। ওকে দেখার সাথে সাথে আরও জোরে রব উঠল, মারো ওকে! মারো! ওর পাশ দিয়ে কয়েকটা গুলি ছুটে গেল। এরা যে লর্ড ভেযের লোক তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আইন আর ওর জন্য প্রযোজ্য নয়। ওকে শেয়ালের মতো আগুন জ্বেলে গর্ত থেকে বের করা যায়। হরিণের মতো ওর উদ্দেশে গুলি ছোঁড়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে আগুনটা বেশি ছড়ায়নি, আর কোন গুলিও ওর গায়ে লাগেনি। ছুটে বিশাল অন্ধকার অরণ্যে হারিয়ে গেল ও। দূরে উন্মত্ত জনতার চিৎকার ছাড়া পুরো বন শান্ত। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় এ ঘটনা ঘটেছে, চিন্তা করার মতো বিষয়ের কোন অভাব নেই।
গত চব্বিশটা ঘণ্টা যেন স্বপ্ন ছিল। শপথ করে বলতে পারবে না ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটেছে কি না। দশটার ঘণ্টা বাজতেই চমকে উঠল থিবল্ট। মাত্র আধঘণ্টা আগেও ও রাউলের শরীরে ছিল। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেছে।
পিউযো এখান থেকে তিনমাইল। যেতে আধঘণ্টা লাগবে। জানা দরকার, ব্যারন শেষ পর্যন্ত বাঁচল না মরল। ওর কথার জবাবেই বাইরে থেকে ভেসে এল বিষণ্ণ ডাক। ওর বিশ্বস্ত অনুচর নেকড়ের দল আবার হাজির হয়েছে।
আয়, আমাদের যেতে হবে। লর্ড ভেযের এক লোক দেখল একজন মানুষ পেছনে ডজনখানেক নেকড়ে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। থিবল্ট যে আসলেই জাদুকর সে বিষয়টা এতে করে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। আরও কেউ যদি থিবকে নেকড়েদের সাথে নিয়ে ওদেরই গতিতে ছুটে যেতে দেখত, তারাও তবে একই কথা ভাবত।
গ্রামের কাছে এসে থামল থিবল্ট। নেকড়েদের দিকে ঘুরে বলল, বন্ধুরা, আজ রাতে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই। আমি একটু একা থাকতে চাই। আশপাশের আস্তাবলগুলোতে যা খুশি করতে পারো। দুপেয়ে জীব, যারা নিজেদের মানুষ বলে, দাবি করে তারা ঈশ্বরের প্রতিরূপ; সেসব দাবির কথা ভুলে যাও, যদি কোনটার দেখা পাও, ভয় পেও না। ইচ্ছামতো তোমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করো! খুশিতে ডাকাডাকি করতে করতে ছড়িয়ে পড়ল নেকড়ের দল। পাদ্রীর বাড়ি গির্জার সাথেই। ক্রুশটাকে এড়ানোর জন্য ঘুরপথে তার বাড়ি গেল থিবল্ট। জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। ঘরে মোম জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে আছে সাদা চাদরের নিচে ঢাকা একটা মানুষ। পাদ্রী সম্ভবত মৃত্যুর খবর কর্তৃপক্ষকে জানাতে গেছে। ঘরে ঢুকল থিবল্ট। বিছানার চাদরটা তুলল। হ্যাঁ, রাউল দু ভোপাফো, কোন সন্দেহ নেই। প্রথম দর্শনে মনে হবে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু একটু ভাল মতো দেখলেই মৃত্যুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
খোলা দরজা দিয়ে পায়ের শব্দ ভেসে এল। ঘরের পেছনদিকের দরজার সামনে পর্দা ঝুলছে। মৃতদেহটা আবার চাদর ঢাকা দিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা এক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ঢুকতে ইতস্তত করছে। আরেক মহিলা উঁকি দিয়ে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করল।
মাদাম, ভেতরে যেতে পারেন। কেউ নেই মনে হচ্ছে। আমি পাহারায় আছি।
বিছানার দিকে এগোল মহিলা। তাকে চিনতে পারল থিবল্ট, এ আর কেউ নয়, গত রাতে দেখা কাউন্টেস স্বয়ং! কপালের ঘাম মুছতে একবার থামল সে। তারপর তুলে ধরল চাদরটা।
ঈশ্বর! ওরা তাহলে সত্যি কথাই বলেছে! হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল কাউন্টেস। কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল এভাবে। অবশেষে দীর্ঘ প্রার্থনার পর সে উঠে দাঁড়াল। উবু হয়ে চুমু খেল মৃত ব্যারনের ক্ষতস্থানে আর কপালে। ওই, রাউল, কে আমাকে তোমার হত্যাকারীর সন্ধান দেবে? কে আমাকে প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করবে? কথাটা শেষ করেই শুনতে পেল, আমি করব! চেঁচিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল কাউন্টেস। সবুজ রঙের পর্দাটা দুলে উঠল। কাউন্টেস ভীতু নয়। বিছানার মাথার কাছে রাখা মোমটা তুলে নিয়ে পর্দাটা সরাল সে। আড়ালে কেউ নেই, শুধু ওপাশের দরজাটা খোলা। পকেট বাক্স থেকে কেঁচি বের করল মাদাম। তারপর কেটে নিল প্রেমিকের মাথার এক গোছা চুল। বুকের কাছে ঝুলে থাকা ভেলভেটের থলেটায় রাখল গোছাটা। শেষ একটা চুমু খেয়ে চাদর টেনে বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। চৌকাঠ পেরোবার সময় পাদ্রীর সাথে দেখা হয়ে গেল। পিছিয়ে গিয়ে মুখের নেকাব ভাল করে টেনে দিল। সে।
কে আপনি?
আমি শোক, জবাব দিয়ে পাদ্রীকে কাটিয়ে চলে গেল কাউন্টেস।
পায়ে হেঁটেই এসেছিল কাউন্টেস আর তার সঙ্গী-আবার পায়ে হেঁটেই ফিরে যাচ্ছে। গির্জা থেকে মন-গুবে মাত্র আধ-মাইল। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর আড়াল থেকে হঠাৎ তাদের পথ আটকে দাঁড়াল এক লোক। লিযেট চেঁচিয়ে উঠলেও কাউন্টেস জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
আপনি হত্যাকারীর হদিশ জানতে চাওয়ার পর যে বলেছিল আমি করব, সে।
তুমি আমাকে শোধ নিতে সাহায্য করবে? যখন আপনি চান।
এই মুহূর্তে?
এখানে ঠিকমতো কথা বলা যাবে না।
কোথায় যাবে?
আপনার ঘরে বলা যেতে পারে।
কিন্তু একসাথে দুর্গে ঢাকা ঠিক হবে না আমাদের।
না। তবে পার্কের ভাঙা অংশটা দিয়ে যেতে পারি। মঁসিয়ে রাউল যেখানে তার ঘোড়া রাখতেন, মাদমোয়াজেল লিযেট সে ঘরটার কাছে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। প্যাচানো সিঁড়িটা দিয়ে আমাকে ওপরে, আপনার ঘরে নিয়ে যেতে পারেন। আপনি যদি ড্রেসিংরুমে থাকেন, গতরাতে মঁসিয়ে রাউলের মতো আমিও অপেক্ষা করতে পারি।
দৃশ্যত দুই মহিলাই কেঁপে উঠল।
এতসব খুঁটিনাটি আপনি কীভাবে জানলেন? প্রশ্ন করল কাউন্টেস।
সময়মতো সব বলব আপনাকে। কাউন্টেস একটু ভাবল। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, বেশ, ওভাবেই আসুন। লিযেট আপনার অপেক্ষায় থাকবে।
লিযেট বলল, ওহ, মাদাম, এই লোকটাকে আপনার কাছে নেয়ার সাহস আমার কখনও হবে না।
সেক্ষেত্রে আমি নিজেই যাব।
ভাল বলেছেন! মন্তব্য করল থিবল্ট। সত্যিকারের নারী বলতে হলে আপনার কথাই বলতে হয়। তারপর রাস্তার পাশে নেমে গেল ও। লিযেটকে দেখে মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে।
কাউন্টেস লিযেটকে বলল, আমার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটো। আমার জানতে হবে, লোকটা কী বলতে চায়।
খামার হয়ে দুর্গে প্রবেশ করল দুই মহিলা। কেউ ওদের বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি। ঘরে পৌঁছে লোকটাকে আনার জন্য লিযেটকে পাঠিয়ে দিল কাউন্টেস। মিনিট দশেক বাদে ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে ফিরে এল লিযেট। মাদাম, লোকটাকে আনার জন্য আমার যাবার কোন দরকার ছিল না।
কী বলছ তুমি!
লোকটা উপরে ওঠার রাস্তা চেনে। আর সে আমাকে কী বলেছে যদি শুনতেন! আমার মনে হচ্ছে লোকটা সাক্ষাত শয়তান!
ওকে ভেতরে নিয়ে এসো।
আমি এখানে? ঘোষণা করল থিবল্ট।
তুমি এখন যেতে পারো, লিযেটকে উদ্দেশ্য করে বলল কাউন্টেস। থিবল্টের সাথে একা হয়ে গেল সে। থিবল্টের বেশভূষায় আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু নেই। ওর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, চোখে অশুভ একটা দ্যুতি খেলা করছে। লাল চুল ঢাকার কোন চেষ্টাই আজ করেনি ও। মাথার ওপর অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে ওগুলো। তারপরও কাউন্টেস কোনরকম ভাবান্তর ছাড়াই ওর মুখের দিকে তাকাল। আমার পরিচারিকা বলল, তুমি আমার ঘরের রাস্তা চেনো। আগে কখনও এসেছিলে?
হ্যাঁ, মাদাম, একবার।
সেটা কবে?
গত পরশু।
কখন?
সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।
কাউন্টেস কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল।
মিথ্যে বলছ।
জানতে চান আর কী কী ঘটেছে সে রাতে?
যে সময়ের কথা বললে, সে সময়ের মধ্যে?
সে সময়ের মধ্যে।
বলো।
থিবল্ট বলতে শুরু করল, মঁসিয়ে রাউল এই দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন। করিডোরের দিকের দরজা দেখাল থিবল্ট। লিযেট তাকে এখানে একা ছেড়ে গিয়েছিল। ড্রেসিংরুমের দরজা দেখিয়ে বলল, আপনি এই দরজা দিয়ে এসে তাকে হাটু গেড়ে থাকতে দেখেন। আপনার চুলে হীরার পিন লাগানো ছিল। সিল্কের গোলাপী একটা গাউন পরে ছিলেন আপনি। গলায় ছিল মুক্তোর মালা।
আমার জামার বর্ণনা তো ঠিকমতোই দিলে। বলতে থাকো।
মঁসিয়ে রাউলের সাথে ঝগড়া করার চেষ্টা করলেন আপনি। প্রথমে করিডোরে আপনার পরিচারিকাকে চুমু খাওয়া নিয়ে, পরে এনেভিলা আর ভিলারস-কটেরেটের রাস্তায় অনেক রাতে কার সাথে দেখা হয়েছিল তা নিয়ে, শেষে নাচের আসরে মাদাম দু বোনোইয়ের সাথে চারবার নাচা নিয়ে।
তারপর…?
জবাবে আপনার প্রেমিক ভাল-মন্দ কিছু অজুহাত দাঁড় করাতে লাগল। আপনিও খেলাচ্ছলে তাকে ক্ষমা করতে লাগলেন। আর এমনি সময় লিযেট দৌড়ে এসে মঁসিয়ে রাউলকে পালাতে বলল। জানাল, আপনার স্বামী আসছে।
লিযেট ঠিকই বলেছে, তুমি সাক্ষাৎ শয়তানই হবে, তিক্ত একটা হাসি দিল কাউন্টেস। আমার মনে হচ্ছে আমরা একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারব…তোমার কথা শেষ করো।
ব্যারন রাউলের প্রস্থান থেকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ঘটনা বর্ণনা করল থিবল্ট। এ পর্যায়ে কাউন্টেস জানতে চাইল, কাউন্ট একা ছিল?
দাঁড়ান…কাউন্টকে একাই মনে হয়েছিল। কিন্তু কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, লেস্টক, বাঁচাও বলে। তারপর ব্যারন তার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে কাউন্টের পায়ে আঘাত করলেন, যেমন তার ঘোড়াকে করা হয়েছিল। কাউন্টকে খোঁড়া করে দিয়ে ব্যারন উঠে দাঁড়াতেই লেস্টক পেছন থেকে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তার শরীরে। পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায় ফলাটা। ক্ষতটা কোথায় আপনি জানেন্য সেখানে আপনি চুমু খেয়েছেন।
তারপর?
ব্যারনকে মরার জন্য ফেলে রেখে কাউন্ট আর তার সঙ্গী দুর্গে ফিরে গেলেন। ব্যারনের জ্ঞান ফিরলে বহু কষ্টে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি। পথচারীরাই তাকে বয়ে নিয়ে যায় পাদ্রীর কাছে। যেখানে আপনি আজ তাকে দেখেছেন, সেখানেই ঠিক সাড়ে নটার পর পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়াল কাউন্টেস। গহনার বাক্স খুলে মুক্তোর মালাটা বের করে থিবল্টের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।
এটা কেন?
নাও, এর দাম পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর উপর হবে।
এখনও প্রতিশোধ নিতে চান?
হ্যাঁ।
তাহলে আরও বেশি লাগবে।
কত? আগামীকাল রাতে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, আমি জানাব।
কোথায় অপেক্ষা করব?
এখানেই, নিচু স্বরে বলল থিবল্ট, ওর চোখে বুনো পশুর দৃষ্টি।
আমি অপেক্ষা করব।
আগামীকাল তাহলে দেখা হচ্ছে।
হ্যাঁ, আগামীকাল। থিবল্ট চলে গেল। মালাটা রেখে দিল কাউন্টেস। তারপর খুলে ফেলল বাক্সের নিচের লুকানো একটা ঢাকনা। রঙিন তরল ভরা একটা ছোট বোতল আর খাটো একটা ড্যাগার বের করল। রত্নখচিত হাতল আর স্বর্ণালী ফলা ড্যাগারটার। দুটোই বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল সে। তারপর প্রার্থনা সেরে পোশাক পাল্টে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়।