১০. সময় ঘনিয়ে এসেছে

অধ্যায় ১০

তিনি জানেন, সময় ঘনিয়ে এসেছে। বয়স তো আর কম হলো না। কতোদিন বাঁচে মানুষ, টেনেটুনে সত্তুর-আশি? বড়জোর নব্বই। শতবর্ষী হবার সাধ সবারই থাকে, কিন্তু ক’জনের ভাগ্যে জোটে সেটা?

আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডসাইড টেবিলের ঘড়ির দিকে তাকালেন। একটু আগে চোখ বন্ধ করার পর যখন খুলেছিলেন, ভেবেছিলেন কয়েক ঘণ্টা পার করে ফেলেছেন। আদতে পনেরো মিনিটের বেশি অতিবাহিত হয়নি। তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার। আজকাল সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে এই সময়টাই! মানুষের গতি যতো শ্লথ হতে থাকে সময়ও পাল্লা দিয়ে ধীরগতিতে বইতে শুরু করে। ব্যস্ত মানুষের সময় এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো দৌড়ায়।

আবারো চোখ বন্ধ করলেন। শৈশবের কথা মনে পড়লো। সেই সময়গুলো আজব ছিল। এক বছরকে মনে হতো অনেক বছর! সারাদিনে কতো কিছুই না করতো। বড়দের মতো ব্যস্ততা ছিল না, ছিল নিষ্পাপ সময়ের অখণ্ড অবসর। তার দাদা বলতেন, মানুষের শেষ বয়স আর শিশুকাল নাকি প্রায় একই রকম হয়, দুটো সময়েই মানুষ বড্ড বেশি অসহায় থাকে, মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, নির্ভরশীল থাকে আশেপাশের মানুষের উপরে। এখন তিনিও দেখতে পাচ্ছেন, শৈশবের মতো এই শেষ বয়সে সময়টা কেমন বড় হয়ে গেছে, সহজে ফুরোতেই চায় না। আর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

গত বছর একটা স্ট্রোক হবার পর থেকে শরীরের নিমাংশ অচল হয়ে পড়েছে তার। বলতে গেলে, মানবেতর জীবনে নিপতিত হয়েছেন। এই শয্যাই এখন তার বিছানা আর শৌচাগার।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডসাইড টেবিলের দিকে তাকালেন। চোখে পড়লো একটা মোবাইলফোন। অবাকই হলেন। হাসপাতালে কেউ কি তাকে দেখতে এসে ফেলে গেছে ফোনটা?

না। স্পষ্ট মনে আছে, মুনেমের বউ আর তার স্ত্রী এসেছিল, ওরা চলে যাবার পর বেডসাইড টেবিলে কিছু দেখেননি।

তাহলে কি নার্স মেয়েটি ভুল করে ফেলে গেল?

আগে এই জিনিসটা ভীষণ অপছন্দ ছিল, দিন-রাতের বিশাল একটা সময় খেয়ে ফেলতো। রাজনীতি করার কারণে প্রচুর ফোন পেতেন তিনি, নিজের মতো করে সময় পেতেন খুব কমই। তখন তার ফোনের রিংটোন সারাদিনভর বেজে চলতো। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের মতো করে, পরিবারের জন্যে সময় বের করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন এই জিনিসটার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছেন। তার স্ত্রীকে বলেওছিলেন, ফোনটা দিয়ে যেতে, একা একা হাসপাতালে সময় কাটে না। কিন্তু ডাক্তার ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।

প্রথম প্রথম যখন শয্যাশায়ী হলেন, সবাই আসততা, খোঁজ-খবর নিতে। তার কর্মিদের ভিড় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এমন অসুস্থ মানুষের সাথে এতো বেশি লোকজন দেখা করতে পারবে না-ডাক্তারের এই নিষেধও মানা হতো খুব কমই। কিন্তু এখন সেইসব কর্মিরাও আসে না। তারা বুঝে গেছে, তিনি অচল হয়ে গেছেন। তার আসনে অন্য কেউ নির্বাচন করবেন। এরইমধ্যে তার নিজের এলাকায় চার-পাঁচজন তোড়জোর করতে শুরু করে দিয়েছে। যেন ধরেই নিয়েছে, তিনি যেকোনো দিন মারা যাবেন, তার আসন অচিরেই খালি হয়ে যাবে।

আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাইরের মানুষের কথা না-হয় বাদই দেয়া গেল, তার একমাত্র সন্তান মুনেম কি করছে? প্রথম দিকে অফিসে যাবার আগে তার সঙ্গে দেখা করে যেত, কিন্তু কয়েক দিন ধরে তারও দেখা পাচ্ছেন না। তার স্ত্রী বলেছে, কী একটা জরুরি কাজে বিদেশে গেছে মুনেম। আশ্চর্য হয়েছিলেন তিনি। যতো জরুরি কাজেই বিদেশ যাক, তাকে বলে যাবে না? যদিও তার স্ত্রী বলেছে, বিদেশ যাবার আগে মুনেম এসেছিল, তখন নাকি তিনি ঘুমাচ্ছিলেন।

ঠিক আছে, তাই বলে এই যুগে একটা ভিডিও কল দেয়া এমন কী? ফোন দিয়েও তো বাবার খোঁজ নিতে পারে? স্ত্রী তাকে প্রবোধ দিয়েছে, ছেলেমানুষি না করার জন্য। ডাক্তার তো বলেছেন, ফোন যেন ব্যবহার না করেন।

আবারো ফোনের দিকে তাকালেন। এটা নিশ্চয়ই ওই নার্সের ফোন। আইসিউ থেকে কেবিনে আনার পর মেয়েটাকে তিনি প্রতিদিনই দেখছেন, সুযোগ পেলেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরেকটা ব্যাপারেও খটকা লাগছে। তার স্ত্রী-কন্যা, এমনকি মুনেমের স্ত্রীর মুখও থমথমে দেখেছেন। অথচ এর আগে যতোবারই হাসপাতালে এসেছে, সবার মুখগুলো ছিল উজ্জ্বল আর হাসি হাসি।

মুনেমের সাথে তার স্ত্রীর কি সমস্যা চলছে?

সমস্যা যে আছে তিনি আঁচ করতে পারেন। কিন্তু কী এমন সমস্যা যে নিজের বাপকে বিদেশে যাবার আগে বলে গেলে না তার ছেলে? মুনেমের এমন আচরণে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। বিশেষ করে তার ছেলে যখন স্পষ্ট করে জানালো রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই, পিতার সংসদীয় আসন থেকে সে দাঁড়াবে না, এসব এমপি-টেম্পি হবার কোনো বাসনা তার নেই, তখন যে কষ্টটা পেয়েছিলেন, তারচেয়ে অনেক বড় কষ্ট।

বেডটা সামান্য বেন্ড করে দেয়া হয়েছে এখন, নার্সকে না ডেকেই সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেলেন। গ্লাসটা রাখতে যাবেন, অমনি বেজে উঠল সেই ফোনটা। রিংটোনের ভলিউম একদমই কমানো। ফোনটার ডিসপ্লের দিকে তাকাতেই চমকে গেলেন তিনি।

মুনেম কল করেছে?!

সাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিলেন, কলটা রিসিভ করে কানে দিলেন তিনি।

“হ্যালো!”

আস্তে করে ফোনের ওপাশ থেকে যে কণ্ঠটা বলে উঠল সেটা মুনেমের নয়। কিন্তু কণ্ঠটা তার কাছে পুরোপুরি অপরিচিতও লাগছে না। মনে হচ্ছে, দূর অতীত থেকে কথা বলছে।

“কে, বলছেন?”

ওপাশে নিরবতা।

“হ্যালো?”

“তুই আমার জমি কেড়ে নিয়েছিলি…আমি তোর সব কিছু কেড়ে নিলাম!”

বজ্রাহত হলেন মাহবুব চৌধুরী। “হ্যালো? হ্যালো! কে? কে বলছেন!”

কিন্তু আর কোনো কথা না বলে কলটা কেটে দেয়া হলো।

তার চোখের মণিদুটো অস্থির হয়ে উঠল। ছটফট করতে শুরু করলেন তিনি। দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, কোন কথার কী মানে, ভালো করেই জানেন। কয়েক মুহূর্ত লাগলো কথাটার মানে বুঝতে, তারপরই আর্তনাদ করে উঠলেন : “খোকা”

অধ্যায় ১১

হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। টিভি-সিনেমায় সাধারণত যে রকমটি দেখা যায় সে রকম নয়।

লম্বা টেবিলের এক পাশে বসে আছে দু-জন মানুষ। একজনের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো, অন্যজনের পঞ্চাশের কোঠায়। তাদের হাতে হাতকড়া নেই।

একটু উসখুস করছে পঁয়ত্রিশের লোকটা, সে তুলনায় বয়স্কজন নির্বিকার। তাদের কেউই হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের নাম খুব একটা শোনেনি, এমন জায়গাও তাদের কাছে নতুন। রিমান্ডে কখনও এ রকম ঘর দেখেনি। এখানে আসার পরই একটা মেশিন থেকে বের হওয়া কী সব তার টার তাদের দুজনের হাতে লাগিয়ে দিয়েছে এক লোক। এ রকম জিনিসও কখনও দেখেনি, তাই একটু ভয়ে আছে এই যন্ত্রটা নিয়ে। অল্প বয়স্ক লোকটি আবার এই ইলেক্ট্রিক শকে খুব ভয় পায়।

কিন্তু বয়স্কজনের জন্যে এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এ জীবনে তিন-চার বারেরও বেশি ধরা খেয়ে রিমান্ডে গেছে। তার ধারনা, এই যন্ত্রটা দিয়ে তাদেরকে ইলেক্ট্রিক শক দেবে। এই ইলেক্ট্রিক শকের সবচেয়ে বাজে দিক হলো, গোপনাঙ্গে শক দিলে প্রস্রাব-পায়খানা বের হয়ে যায়, নইলে পুরো ব্যাপারটা দাঁতমুখ খিচে সহ্য করতে পারে সে।

এসবে কোনো কাজই হবে না। সে যেটা জানে না সেটা কেমনে বলবে এদেরকে? খুব বেশি মারপিট করলে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করবে। কারণ সে জানে, কান্নাকাটি না করলে পুলিশের লোকগুলো অমানুষের মতো মারতে শুরু করে, তখন আর আসামিকে মানুষ ভাবে না তারা, ভাবে জন্তু জানোয়ার। কিংবা ইট-পাথরের টুকরো! কান্নাকাটি করলে মারের তীব্রতা একটু কমে আসে। এক সময় তাদের পাষাণ হৃদয়ও গলতে শুরু করে। কিন্তু নির্বিকার থাকলে মাঝেমধ্যে এদের মাথায় খুন চেপে যায়। কত্তো বড় আস্পর্ধা, পুলিশকে ভয় পাচ্ছে না! উন্মাদ হয়ে যায় একেবারে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনেক সময়। বহুকাল আগে ইসমাইল নামে এক চ্যালা ছিল তার, খুবই সাহসি, ভয়ডর বলে কিছু ছিল না ছেলেটার মধ্যে। আজ থেকে বিশ বছর আগে ডিবির হাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিল ইসমাইল আর সে। রিমান্ডে মার খেয়ে একটুও কাঁদেনি ছেলেটা, আহ্-উঁহুও করেনি, সব সহ্য করে গেছিল নির্বিকারভাবে। এটা দেখে এক ডিবি অফিসারের মাথায় রক্ত উঠে যায়। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মারতে শুরু করে ছেলেটাকে, মারতে মারতে মেরেই ফেলে।

ইসমাইল মরে যাবার পর সে ভেবেছিল, এই ঘটনার প্রমান মুছে ফেলার জন্য তাকেও বুঝি মেরে ফেলা হবে, তাই হাউমাউ করে কেঁদেকেটে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তখনই ভড়কে যাওয়া অফিসার তাকে একটা প্রস্তাব দেয়-ইসমাইল হার্ট ফেইল করে মরেছে; তার হার্টে সমস্যা ছিল আগে থেকেই; তাকে এখানে এনে কোনো রকম মারপিট করা হয়নি; আনার পর পরই মারা যায় সে-ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এ কথা বললে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কোনো ঘটনা না। এ দেশে এমন রিপোর্ট আঙুল নাচিয়ে তৈরি করা হয়।

সঙ্গির দিকে তাকালো। এই ছেলেটাও ইসমাইলের মতো। পুলিশ তাকে কাল থেকে অনেক মেরেছে কিন্তু খুব একটা আহ-উঁহু করেনি। টর্চারের মধ্যে একটু বিরতি দিলে সে তাকে বলেছিল একটু কান্নাকাটি করার জন্য, নইলে তার কপালে খারাবি আছে। শেষ পর্যন্ত তার কথা শুনেছে বলেই সম্ভবত বেঁচে আছে এখনও।

কিন্তু এখানকার সব কিছু নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছে তারা দুজনেই। এটা আবার কেমন রিমান্ড? আর তাদেরকে কোর্টে হাজির না করে এখানে নিয়ে এসেছে কেন? শুয়োরের বাচ্চা-হারামজাদা-কুত্তারবাচ্চা-গালিগুলো তো দূরের কথা, একটা ধমকও দেয়নি। মেশিনের তারগুলো যখন হাতে লাগাচ্ছিল, তখনও না। পুলিশ তো কথাই শুরু করে গালি দিয়ে, চর-থাপ্পড় মেরে।

এরা আসলে কারা?

ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবে অমনি দরজা খুলে গেল, ঘরে ঢুকল দু-জন মানুষ। একজন বেশ মার্জিত, ভদ্রগোছের। নিলচে-কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে। পরিপাটি চুল তার, দেখতেও বেশ সুদর্শন। বয়স আন্দাজ করতে না পারলেও, বুঝতে পারলো তার সঙ্গে ত্রিশোর্ধ যে যুবক আছে, তার চেয়ে বড় হবে। তাদেরকে দেখে পুলিশ বলে মনে হয় না, কেমনজানি অফিসার অফিসার লাগছে।

সুদর্শন আর ভদ্রগোছের লোকটার হাতে একটা ফাইল। চুপচাপ তাদের বিপরীতে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সির হাতে একটা ল্যাপটপ, সেটা টেবিলের উপরে রেখে ফ্যাক্স মেশিনের মতো একটা যন্ত্রের সাথে কানেক্ট করে চেয়ারে বসে পড়লো সে।

“আমি জেফরি বেগ, হেমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর,” ফাইলটায় চোখ বুলিয়ে বলল লোকটা। “আর আপনি হলেন ইকরাম হোসেন।”

পঞ্চাশোর্ধ লোকটি ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল। ইন্সপেক্টর শব্দটি সে শুনেছে কিন্তু ইনভেস্টিগেটর? এ রকম কিছু শোনেনি কখনও।

“অনেক বার ধরা পড়েছেন, জেলও খেটেছেন দেখছি।”

ইকরাম হোসেন কিছুই বলল না। আপনি করে সম্বোধন করায় বেশ অবাক হয়েছে।

“বয়স তো পঞ্চাশের উপরে, এখনও অপরাধ জগত ছাড়ছেন না,” আক্ষেপে মাথা দোলাল জেফরি।

“স্যার, আমি এহন এই লাইনে নাই,” যথাসম্ভব মোলায়েম কণ্ঠে বলল ইকরাম। “বহুত আগেই ছাইড়া দিছি।”

জেফরি কিছু বলল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেয়া যায়, সন্ত্রাসি দলের কেউ ধরা পড়লে এমন কথা বলে। তার কাছে পুলিশের যে রিপোর্ট আছে তাতে এই দু-জন সম্পর্কে লেখা আছে, এরা রঞ্জু গ্রুপের অনেক পুরনো সদস্য। এখনও সক্রিয় আছে কি না সেটা অবশ্য উল্লেখ করেনি।

এবার অন্যজনের দিকে ফিরলো জেফরি। “নজরুল ইসলাম…কতোদিন ধরে এই লাইনে আছেন? প্রথম বার ধরা পড়েছিলেন দশ বছর আগে, তার মানে, বিশ-বাইশ বছর বয়সের আগেই এসব শুরু করেছেন?”

নজরুল ঢোক গিলল। সে-ও জেফরি বেগের আচার-ব্যবহারে অবাক হচ্ছে।

ফাইলটা বন্ধ করে আসামি দু-জনের দিকে অভেদী দৃষ্টিতে তাকাল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আপনাদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে শুধুমাত্র একটা কথা জানার জন্য, আশা করি সত্যিটা বলবেন।”

“দেখেন, আমি পুলিশরে হাজার বার কইছি, রঞ্জু কই থাকে আমি জানি না,” ইকরাম হোসেন আগেভাগেই বলে দিলো। গতকাল থেকে এই এক প্রশ্ন শুনতে শুনতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে সে, আর ভাল্লাগছে না। “ওর শুরুপে আমি কামও করি না এহন।”

“আমিও জানি না, স্যার,” বয়োজ্যেষ্ঠের সাথে তাল মেলাল নজরুল। “আমিও এইসবে নাই। আমাগো টর্চার কইরা কুননা লাভ হইবো না।”

জেফরি বেগ মুচকি হাসল। “রঞ্জু কোথায় থাকে সেটা আমি জিজ্ঞেস করবো না, আর এখানে আপনাদেরকে কোনো রকম টর্চারও করা হবে না। তবে মনে রাখবেন, মিথ্যে বললেই ধরা পড়ে যাবেন।” পলিগ্রাফ মেশিনটার দিকে তাকালো সে।

আসামি দু-জনও যন্ত্রটা দেখে একে অন্যের দিকে তাকাল। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়। যন্ত্র ধরবে মিথ্যে, বাপের জনমে এমন কিছু দেখেনি।

আপনি পুলিশকে বলেছেন, ব্ল্যাক রঞ্জু বেঁচে আছে?”

ইকরাম চোখ পিট পিট করল। শুধু এটা জানার জন্য তাদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে? “হ, স্যার।”

“আপনি তাকে দেখেছেন?”

“না, স্যার।”

অবাক হলো জেফরি বেগ। “কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট বলছে, আপনারা দুজনেই স্বীকার করেছেন, রঞ্জুকে দেখেছেন।”

“যে মাইর দিছে, স্যার…হেরা যদি কইতো আমি মইরা গেছি, হেই কাগজেও সাইন কইরা দিতাম।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি। পুলিশের এই নির্যাতন করার বিষয়টি সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। বুঝতে পারলো, উপর মহল থেকে চাপ দেয়ায় রঞ্জুর পুরনো দু-জন লোককে ধরে এনে পুলিশ নিজেদের মুখ রক্ষা করেছে। ফোনে কথা বলেছে, এটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রমান, তাই চাক্ষুস সাক্ষি বানিয়ে দিয়েছে।

সামনে রাখা ল্যাপটপের দিকে তাকাল, এরপর তাকালো জামানের। দিকে। পলিগ্রাফ জানাচ্ছে, এরা সত্যিই বলছে।

“তার মানে আপনার সঙ্গে রঞ্জুর কথা হয়েছে?”

“হ, স্যার…ফোনে কথা হইছে, মাগার ওরে আমি দেহি নাই।”

অবিশ্বাসে মাথা দোলালো জেফরি। “ফোনে কণ্ঠ শুনে বুঝে গেলেন ওটা রঞ্জু? অন্য কেউও তো হতে পারে, নাকি?”

ইকরাম হোসেন কিছুই বলল না।

একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজরুলের দিকে তাকালো জেফরি বেগ। “আর আপনি?”

“আমিও ফুনে কথা কইছি।”

“আপনারা কবে কথা বলেছেন?”

জবাবটা প্রথমে ইকরাম হোসেনই দিলো, “তিন-চাইর মাস আগে অইবো।”

পলিগ্রাফের রেজাল্ট না দেখেই জেফরি বেগ বুঝতে পারছে, লোকটা সত্যি না কি মিথ্যা বলছে। গত বছর ব্রাসেলসে ইন্টারপোলের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স করেছে সে-মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিশ্লষণ করে মিথ্যে বলা ধরে ফেলা। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য ল্যাপটপের দিকে তাকাল। মিথ্যে ধরতে সে কতোটুকু দক্ষ সেটা ধরতেই পলিগ্রাফের রেজাল্টের সাথে মিলিয়ে নেয়-এটা এখন তার হবিতে পরিণত হয়েছে। মোটামুটি আশি শতাংশেরও বেশি সফল হয় সে।

“রঞ্জু বেঁচে আছে শুনে আপনি অবাক হননি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। “হইছি, স্যার কিন্তু রঞ্জু তো এর আগেও দুই তিন বার মরছে, পরে দেহি আবার ফিরা আইছে, তাই বিশ্বাস করি নাই।”

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। “দু-তিন বার মরেছে? জিশুও তো এতোবার মরেনি!”

ইকরাম হোসেন শ্লেষটা ধরতে পারলো না। “সবৃতে কইতো মইরা গেছে, পরে দেখি বাঁইচা আছে। কইমাছের জান, সহজে মরে না।”

মাথা দোলালো জেফরি বেগ। সন্ত্রাসি দলে এইসব মিথ জারি রাখা হয় নেতাকে মহিমান্বিত করার জন্য, সুপারম্যান হিসেবে দেখানোর জন্য। অজেয়-অপরাজেয়-অস্পর্শী! তিক্তমুখে জামানের দিকে তাকালো। সে-ও এসব শুনে হতাশ।

“কয়েক বচ্ছর আগে হুনলাম রঞ্জু আবার মইরা গেছে। কেউ কয় দিল্লিতে, কেউ কেউ কয় কইলকাতায়…ঠিকঠাক কইরা কেউ কিছু কইতে পারে নাই।”

“কে মেরেছে তাকে, কেন মেরেছে, সেটা জানতেন?”

ইকরাম ঠোঁট ওল্টালো। “কিলিয়ার কইরা কিছু জানতাম না। হুনছি, লগের কেউ বেঈমানি কইরা হেরে আর ঝন্টুরে মাইরা ফালাইছে।”

জেফরি বেগ জানে, সন্ত্রাসিচক্রে এমন ঘটনা নিত্যই ঘটে–নিজ দলের লোকদের হাতেই মৃত্যু হয় অনেকের। ফলে এ রকম ভাবাটা খুবই স্বাভাবিক। ঝন্টু ছিল রঞ্জুর খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষদের একজন, তবে দিল্লিতে রঞ্জুর সাথে সাথে যে ঝন্টুকেও হত্যা করেছে বাস্টার্ড, এটা তার জানা নেই।

“আচ্ছা, এবার বলুন, রঞ্জু কেন আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিল? আপনি তো অনেক আগেই এসব লাইন ছেড়ে দিয়েছেন, আপনার সাথে কেন কথা বলতে চাইলো সে?”

“ওয় পুরানা সবতেরেই ফোন দিছিল।”

“কী কথা হলো আপনার সঙ্গে?”

“…আমারে কইলো আমি যে আবার জয়েন করি…ওরে কইলাম, মামুরে, এই লাইন ছাইড়া দিছি, তিন-তিনটা মাইয়া…বড়টার বিয়ার কথা চলতাছে, আমারে মাফ কর।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আপনি এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের একটি বাস কোম্পানিতে আছেন?”

“হ, স্যার, সুপারভাইজারের কাম করি।”

“আর আপনি?” এবার নজরুলকে জিজ্ঞেস করলো।

“আমিও ইকরাম ভায়ের লগেই কাম করি, ছার।”

“আমিই ওরে চাকরিটায় ঢুকাইছি,” বলল ইকরাম। “ওয় এহন আমার অ্যাসিসটেন্ট…এইসব ছাইড়া দিছে ম্যালা আগে।”

স্থিরচোখে তাকালো জেফরি। “আপনি কেরাণীগঞ্জের লোক?”

ইকরাম হোসেন একটু অবাকই হলো। সত্যিটা বলার আগে সময় নিলো সে। “হ, স্যার।”

ইকরাম হোসেনের ঠিকানা হিসেবে অবশ্য গেন্ডারিয়ার সাধনা এলাকা লেখা আছে ফাইলে।

“কেলাস সিক্সে পড়ার সময় আমার বাপে মইরা যায়, হের পর থিকা গেন্ডারিয়ায় নানার বাড়িতে চইল্যা আহি।”

পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজে পড়াশোনা করেছে জেফরি। জীবনের দীর্ঘ একটি সময় কাটিয়েছে সেখানে, ভালো করেই জানে, নদীর এ পাড়ের ঢাকায়াইরা ম্যালা’ শব্দটা ব্যবহার করে না, ওটা করে ওপাড়ের কেরাণীগঞ্জের লোকজন।

“আপনি যে রঞ্জুর প্রস্তাবে রাজি হলেন না, ও খেপে যায়নি?”

“ভালা কইরা বুঝায়া কইছি, হেয় বুঝবার পারছে।”

“ওর কণ্ঠ শুনে কি রঞ্জু বলেই মনে হয়েছে আপনার কাছে?”

ইকরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “হ, স্যার। তয় একটু বদলাইছেও।”

“কী রকম?” কৌতূহলি হয়ে উঠল হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

“কিমুন জানি…মনে লয়, কথা কইতে খুব কষ্ট অয়। পুরা শরীর আগুনে পুইড়্যা এক্কেরে শ্যাষ, হের লাইগা কথা কইতে পবলেম হয়। চেহারা দেইখ্যা নাকি চিনন যায় না। ঠিকমতোন চলতে ফিরতেও পারে না।”

লোকটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল জেফরি বেগ। রঞ্জু চলতে ফিরতে পারে না! দিল্লিতে যে রঞ্জুকে হত্যা করেছিল বাস্টার্ড, সে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতো। ঐ বাস্টার্ডকে মারতে গিয়েই দোতলা থেকে পড়ে কোমর ভেঙে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সন্ত্রাসিটা।

“বিশ্বাস করেন, আমি এহন রঞ্জুর লগে নাই, অনেক আগেই ছাইড়া দিছি।” জোর দিয়ে বলল ইকরাম।

জেফরি বেগ স্থিরচোখে চেয়ে বলল, “কিভাবে বিশ্বাস করি, প্রমান তো নেই।”

ইকরাম হোসেন ঢোক গিলে নিলো, যেন সাহস সঞ্চয় করলো কিছুটা। “আমরা যদি রঞ্জুর হইয়া কাম করতাম তাইলে আমাগো পুলিশ ধরবারই পারতো না।”

ভুরু কুঁচকালো জেফরি। “পুলিশ ধরতেই পারতো না?”

“ধরবার পারতো, মাগার খাতায় এন্ট্রি করবার আগেই ছাইড়া দিতো।”

মুচকি হেসে মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “তাই নাকি।”

একটু চুপ থেকে ইকরাম হোসেন আবার বলল, “আপনেরে হেয় ফোন দিছে? দেয় নাইক্কা। দিলে বুঝতেন, আমরা ওর কাম করি এহন।”

আমাকে ফোন দিতো? রঞ্জু! “আপনি কী বলতে চাইছেন?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো ইকরাম। “রঞ্জুর লোকজরে পুলিশে ধরলে এটু বাদেই রঙ্গু হেগোরে ফোন দেয়, তহন পুলিশ ছাইড়া দেয়। আমাগোর লাইগা কইলাম পুলিশরে ফোন দেয় নাই, আপনেরেও দেয় নাই, স্যার।”

“পুলিশ ওর ভয়ে ছেড়ে দেয়?” জেফরি বেগ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল।

“হ, স্যার।”

“আপনাকে কে বলল এটা? রঞ্জু?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো জেফরি। কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। এটাকেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেকটি মিথ বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। এমন মিথ ছড়িয়ে দিয়েই সন্ত্রাসি দলগুলো নিজ দলের লোকজনকে এক ধরণের আস্থায় নেয়।

“ইদ্রিস নামের রঞ্জুর এক পুরানা লোকের লগে আমার দেহা হইছিল, হেয় আমারে কইছে, ওরে পুলিশ ছিল মাগার এক ঘণ্টা বাদে ছাইড়া দিছে। এহন আর পুলিশ রঞ্জুর পোলাপাইন ধইরা রাখবার পারে না।”

ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হলো জেফরি বেগের কিন্তু রঞ্জু গ্রুপের কাউকে পুলিশ ধরতে পারে না–এ কথাটার সাথে খাপ খেয়ে যায় এটা।

“রঞ্জুর দলটা তাহলে কে চালায় এখন?” জেফরি বেগ প্রসঙ্গ পাল্টালো, যেন জোর করে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইছে, রঞ্জু বেঁচে নেই, অন্য কেউ তার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে।

ইনভেস্টিগেটরের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ইকরাম। “রঙুই তো চালায়।”

মাথা দোলালো জেফরি। “আপনার কথা সত্যি ধরে নিলে রঞ্জু এখন ঠিকমতো চলতে ফিরতে পারে না…এ রকম কেউ দলটা চালায় কী করে?”

জেফরির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ইকরাম।

এর আগে রঞ্জু যখন আহত হয়ে জেলে গেল তখন তার দলটির হাল ধরেছিল আরেক সন্ত্রাসি মিলন, জেফরির সঙ্গে তার ভয়ঙ্কর মোকাবেলা হয়েছিল, অল্পের জন্য সে বেঁচে গেছিল মিলনের হাত থেকে। শেষে অবশ্য তার হাতেই ঐ সন্ত্রাসির মৃত্যু হয়।

অনেকক্ষন চুপ থাকার পর ইকরাম হোসেন আড়চোখে পাশে বসা সঙ্গির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এইটা তো স্যার জানি না।”

জেফরি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত, এরপর আর কিছু না বলে নজরুলের দিকে ফিরল। “আপনি কেন ওর দলে যোগ দিলেন না?”

“আমি তো গত বচ্ছরই এইসব ছাইড়া ভালা হইয়া গেছি, স্যার। মায়ের মাথা ছুঁইয়া কসম খাইছি।”

“রঞ্জু আপনার এ কথা শুনে কি বলল?”

“কইছে, ঠিক আছে…ভালা থাকিস।”

গাল চুলকে নিলো জেফরি বেগ। জামানের দিকে তাকাল। “ওকে নিয়ে যেতে বলো, পাশের চেম্বারে থাকুক আপাতত।”

জামান টেবিলের নিচে একটা সুইচ টিপে দিলে একটু পরই রুমে ঢুকলো দু-জন লোক, তারা নজরুলের হাত থেকে পলিগ্রাফের সেন্সরগুলো খুলে রুম থেকে তাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।

“এবার বলুন,” ইকরাম হোসেনের দিকে ফিরে বলল জেফরি। “আপনি সম্ভবত কিছু বলতে চান।”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো লোকটা। “আমি যে এইটা কইছি কেউ যেন জানবার না পারে। জানলে আমারে মাইরা ফালাইবো রঞ্জু।”

“আপনারা দেখি নিজের লোকজনকেও বিশ্বাস করেন না,” বাঁকাহাসি দিয়ে বলল জেফরি বেগ।

“কোনো সম্পর্কই জিন্দেগির টিকা থাকে না, স্যার,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ইকরাম। “কার লগে কখন কী হইবো কেউ কইতে পারে না।”

প্রশংসার দৃষ্টিতে ইনভেস্টিগেটরের ভুরু কপালে উঠে গেল। “কেউ কিছু জানবে না, আপনি আমাকে বলুন।”

“জেলখানায়ও রঞ্জুর লোকজন আছে, কথাটা জানাজানি হয়া গেলে ওইখানেও আমারে ধরবো।”

“আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, কেউ এসব জানতে পারবে না। আর আপনি তো এই লাইনে নেই এখন, জেলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না, কালই জামিন পেয়ে যাবেন।”

ইকরাম নামের লোকটা গভীর করে দম নিয়ে নিলো। সম্ভবত আশ্বস্ত হয়েছে। “রঞ্জুর বইন আমারে ফোন দিছিল। সতেরে ওর বইনেই ফোন দেয়।”

অবাক হলো জেফরি। তার কাছে যে তথ্য রয়েছে সেখানে কোনো বোনের উল্লেখ নেই। এমন কি মা-বাবার কথাও জানে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনি। হোমিসাইডে যে তথ্য আছে, তা-ও অপ্রতুল। যেন র নামের লোকটা ভুস করে ঢাকা শহরে চলে এসেছিল একদিন। কোন জেলা, কোন গ্রাম…এ রকম কোনো তথ্যই নেই।

“আপনা বইন না মনে লয়,” বলল ইকরাম। “হুনছি, রঞ্জুর বাপে যেহানে যাইতো একটা কইরা বিয়া করতো। অন্য ঘরের বইনও হইবার পারে। তয় রঞ্জু ওরে খুব মোলাজা করে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি বেগ। মোলাজা?

বুঝতে পারলো ইকরাম হোসেন। “মায়া-মহব্বত করে।”

“আপনি রঞ্জুর বোনকেও চেনেন!” ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরির। “ঐ বোনই তাহলে দলের হাল ধরছে?”

“হইতে পারে, স্যার…ওর বইনেই আমারে ফোন দিছিল, পরে রঞ্জুর লগে কথা কওয়াইয়া দিছে। হুনছি, সবতেরে ওর বইন-ই ফোন দেয়।”

“নাম কি তার?”

“কিসমত আরা।”

“একটা মেয়েমানুষ রঞ্জুর দলটা চালায়?” মাথা দোলালো জেফরি। কথাটা বলেই মনে মনে নিজেকে ভসনা করলো। এখন যদি কোনো নারীবাদী উপস্থিত থাকতো, তাহলে কষে একটা গালি দিতো তাকে–মেলশোভিনিস্ট পিগ! তবে সত্যিটা হলো, সে পুরুষপ্রজাতির একজন হিসেবে মেয়েমানুষকে খাটো করে দেখার মানসিকতা থেকে এটা বলেনি। এই মানসিক সমস্যাটা আসলে রঞ্জুর দলের লোকদের হবার কথা। তারা নিশ্চয় একজন নারীকে মেনে নেবে না। যদিও ঢাকার কিছু বস্তিতে, ইয়াবা ব্যবসায় দুয়েকজন নারী গ্যাং-লিডারের তথ্য জানা আছে তার। কিন্তু ঐসব ছিঁচকে মাদকব্যসায়িদের সঙ্গে রঞ্জুর দলটার বিস্তর ফারাক আছে।

“বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল জেফরি বেগ। “ও রকম একটা দল কোনো মেয়েমানুষ চালাতে পারে না।”

“স্যার, কিসমত আরা খুবই ডেঞ্জারাস মাইয়া, ইকরাম হোসেন বলল।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি। “কি রকম?”

“জামাইরে বটি দিয়া কোপাইয়া মারছে কিসমত।”

জেফরির ভুরু কপালে উঠে গেল। যেমন ভাই তেমনই বোন! “কেন মারলো?”

“তা তো জানি না, স্যার।”

“তাহলে খুন করার কথা জানলেন কী করে?”

রঞ্জুর দলের সাবেক লোকটি হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “রঞ্জু তহন কইলকাতায়,” বলতে শুরু করলো সে। “আমারে ফোন দিয়া কইলো, কিসমতুরে যেন কয়টা দিন লুকায়া রাখি। আমি গিয়া দেহি, জামাইরে মাইরা-কাইটা শ্যাষ…বটি বটি কইরা ফালাইছে।”

আবারো ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরির। “আসলেই ডেঞ্জারাস মনে হচ্ছে।”

ইকরাম হোসেন বুঝতে পারলো না, কথাটা টিটকারি মেরে বলেছে কি না। “যহন হুনলাম রঞ্জু মইরা গেছে, এরপরই এই লাইন ছাইড়া দিছি আমি। তিন-চাইর মাস আগে কিসমত আমারে ফোন দিয়া কইলো, রঞ্জু বাঁইচা আছে, অনেক দিন নাকি বিদেশের হাসপাতালে আছিল…এহন এটু ভালা, ঢাকায় ফিরা আইছে।”

“এর মধ্যে আর ওদের কারোর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়নি?”

“বেশির ভাগ পুরানা লোকজন রঞ্জুর দলে আবার ফিরা গেছে, তাগোর অনেকের লগে মাজেমইদ্যে দেখা হয়।”

“কি বলে তারা?” জানতে চাইলো জেফরি।

মনে হলো একটু গুছিয়ে নিচ্ছে ইকরাম হোসেন। “পুরানা যারা জয়েন করছে তারা কইছে, রঞ্জুর হয়া কাম করলে অনেক টাকা-পয়সা পাওন যায়। পুরানারা দলে থাকলেও কাম-কাইজ বেশি করে নতুন পোলাপাইন। এইসব পোলাপাইন যদি ধরাও পড়ে, কিছুই কইতে পারে না। কারোর লগে কারোর খাতির নাই জানাশোনা নাই। কারা যে রঞ্জুর হয়া কাম করে এইটা বোঝা যায় না।”

মুনেম চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডেও দেখা গেছে অল্পবয়সি ছেলেপেলেদেরকেই। “পুরনোরা তাহলে করে কী? বসে বসে খায়?”

মাথা দোলালো ইকরাম হোসেন। “মনে লয়, ওগোরে দলে ভিড়াইছে এলাকা দখলে রাখার লাইগা। যারা যে এলাকায় আছিল তারা আবার ফিরা গেছে, এলাকার দখল নিছে। কিন্তু আগের মতো খুনখারাবি আর ওগোরে দিয়া করায় না।”

“শুধু চাঁদাবাজি করায়?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ইকরাম।

“এখন বলুন, কিসমত আরাকে কিভাবে পাওয়া যাবে?”

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইকরাম। “এইটা তো স্যার আমি জানি না। কিসমত আমারে যে নম্বর থেইকা ফোন দিছিল ওই নম্বরটা আর চালু নাই।”

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। “আপনি ঐ নম্বরে ফোন দিয়েছিলেন?”

ঢোক গিলল ইকরাম হোসেন, একটু কাচুমাচু খেলো যেন। “বড় মাইয়াটার বিয়ার কথা চলতাছে…টাকার দরকার পড়ছিল, স্যার।”

“আপনার ধারনা রঞ্জুর হয়ে কাজ না করলেও আপনাকে টাকা দিতো?”

“হুনছি, পুরানা যারা আছে তারা বিপদে-আপদে পড়লে ট্যাকা-পয়সা দিয়া সাহায্য করে রঞ্জু।”

আলতো করে মাথা দোলালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। এ রকম সন্ত্রাসি দলে এমনিতেই ভালো টাকা না পেলে কেউ যোগ দেয় না। কিন্তু এই লোক যা বলছে, তার অর্থ, রঞ্জুর দলে এখন যারা কাজ করে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পায়। রঞ্জুর দলের হাল ধরেছে নতুন একজন- হয়তো আছে নামেমাত্র, কিন্তু সব কিছুর দেখভাল করে রঞ্জুর বোন। স্বাভাবিকভাবেই দলের ভেতরে নিজের অবস্থান সুসংহত করার জন্য একটু বেশিই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। সম্ভবত এই মহিলা অথর্ব রঞ্জুর জায়গা নেবার পায়তারা করছে। মেয়েটা শুধু খুনিই না, অনেক বেশি ধূর্তও। নিজেকে সফলভাবেই পর্দার আড়ালে রাখতে পেরেছে এখন পর্যন্ত। পুলিশ কিংবা ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে এর সম্পর্কে কোনো কথা নেই।

মাথা থেকে ভাবনাটা ঝেড়ে গভীর করে শ্বাস নিয়ে ইকরামের দিকে তাকালো সে। “আপনি আমাকে এসব বললেন কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইকরাম হোসেন। “সবখানে রঞ্জুর ট্যাকা খাওয়া পুলিশ আছে, স্যার। মাগার আপনেরে আমার পুলিশ বইলা মনে হয় নাই।”

পরিহাসের হাসি দিলো জেফরি বেগ। হোমিসাইডে যারা কাজ করে খুব কম লোকজনই তাদেরকে পুলিশ বলে মনে করে। হয়তো পোশাক নেই বলে, হয়তো তাদের ভালো ব্যবহারের কারণে-যদিও তারা পুলিশেরই একটি ডিপার্টমেন্ট।

“আপনে আমাগো লগে অনেক ভালা ব্যবহার করছেন, আপনেরে দেইখা ভরসা পাইছি, স্যার।”

জেফরি বেগ লোকটার দিকে চেয়ে রইলো। তার কাছে মনে হলো, এই লোক সত্যি কথাই বলছে।

অধ্যায় ১২

আকিল আহমেদ শিষ বাজাতে বাজাতে হোটেলে ঢুকতেই ম্যানেজার এনামুল হকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

সর্বনাশ! এই সাংঘাতিকটা কেন তার হোটেলে ঢু মারতে এসেছে? আর এলোই যখন তার সঙ্গে হাই-হ্যালো না করে সোজা লিফটের দিকে চলে যাচ্ছে কেন? নিজেকে কী ভাবে সে? কোন মতলবে এসেছে এখানে?

ম্যানেজারের সাথে চোখাচোখি হলেও আকিল আহমেদ সেকেন্ডের জন্যেও না থেমে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে গট গট করে চলে গেল লিফটের দিকে। এনামুল হক ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে দ্রুত বের হয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল হন হন করে।

“এই যে…দাঁড়ান!” বেশ জোরেই বলল সে।

লিফটের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো আকিল।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“উপরে…” তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিলো সাংবাদিক। “…আপনাগো একজন গেস্টের সাথে দেখা করতে।”

মহাকাল-এর এই কক্সবাজার প্রতিনিধির আস্পর্ধা দেখে অবাক হলো এনামুল হক। হোটেল ব্যবসা করতে গেলে থানা-পুলিশের সাথে সাথে এরকম কিছু খুচরা সাংবাদিকও ম্যানেজ করে রাখতে হয়, সে-ও করে কিন্তু তাই বলে গটগট করে তার হোটেল ঢুকে যাবে? এটা কি ভাতের হোটেল পেয়েছে নাকি!

‘আপনি ভালো করেই জানেন গেস্টের সাথে দেখা করতে হলে আমাদের কাছে আগে বলতে হয়। আমরা ইন্টারকমে জানাবো গেস্টকে, উনি চাইলে দেখা হবে, নইলে হবে না।”

আকিল দাঁত বের করে হাসলো। “হুম, এইসব তো জানিই।”

“তাহলে আপনি সোজা উপরে চলে যাচ্ছেন যে?”

লিফটের বাটন প্রেস করে বলল আকিল, “আমি যে-গেস্টের সাথে দেখা করতে যাইতাছি তিনি আমারে বলছেন আমি যে ডাইরেক্ট উনার রুমে চইলা আসি।”

ভুরু কুঁচকে ফেলল ম্যানেজার। “আপনি কার কাছে যাচ্ছেন?”

“৭০৭-এর গেস্টের কাছে।”

সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠল এনামুল। “উনার সাথে আপনার কি কাজ?”

“কাজ আছে বইলাই তো আসছি, হাওয়া খাইতে তো আসি নাই, ভাই।”

এনামুল হক একটু চিন্তায় পড়ে গেল। আকিল তাকে পাত্তা না দিয়ে সোজা লিফটে ঢুকে বোতাম চাপতে যাবে অমনি হুট করে সে-ও ঢুকে পড়লো ভেতরে।

“আপনেও উপরে যাইবেন নাকি?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো। মহাকাল-এর প্রতিনিধি।

“হুম।”

দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলো আকিল।

“হাসছেন কেন?” এনামুলের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। লিফটটা চলতে শুরু করেছে এখন।

“নতুন মাল আসছে নাকি?” এক চোখ টিপে বলল সাংবাদিক।

বিব্রত হলো এনামুল। এই খচ্চরটা কী ইঙ্গিত করছে ভালো করেই জানে। অনেক হোটেলের ম্যানেজারই এরকম নতুন মাল’ সবার আগে পরখ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সে পুরোপুরি ব্যতিক্রম।

“কিছু নতুন মাল আনেন, পুরানা মাল দিয়া আর কতো? বিচ হ্যাঁভেন তো ঢাকা থিকা নতুন নতুন সব মাল আনতাছে…এই অফ সিজনেও হেভি কাস্টমার টানতাছে। খবর কিছু রাখেন?”

এনামুল না পারছে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে না পারছে মেনে নিতে। হোটেল ব্যবসায় কিছু কাজ করতে হয় যা ভদ্রসমাজে আলোচনা করার মতো নয়। তার হোটেলেও এসব চলে কিন্তু তাই বলে এগুলো নিয়ে যেখানে সেখানে আলোচনা করতে হবে??

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর আকিল আবার বলল, “আপনে মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই, তাই না?”

“আপনার মুখটা দয়া করে একটু বন্ধ রাখুন, আমাকে আমার কাজ করতে দিন, আপনি আপনার কাজ করুন।”

“ওকে,” মুচকি হেসে বলল আকিল আহমেদ। “আমি তো তাই করতাছি…দেখি, উনার ক্যান আমারে এতো দরকার হইলো।”

কথাটা শুনে গা জ্বলে গেল এনামুলের। তার হোটেলের অন্যতম একজন মালিক নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছে না এম্পুয়িদের কাছে অথচ এরকম টাউট-বাটপার সাংবাদিককে রুমে ডেকে নিয়ে জরুরি আলাপ করবে! কেন, এই সব ছেচরের চেয়ে কি তারা কম বিশ্বস্ত?

কয়েক মুহূর্ত তারা দু-জন আর কোনো কথা বলল না। লিফটের দরজা খুল গেলে মহাকাল-এর সাংবাদিক বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে ৭০৭ নাম্বার রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

এনামুল হক লিফটের বাইরে এসে দেখতে লাগলো সাংবাদিক কী করে। আকিল আহমেদ ৭০৭-এর দরজায় দুটো টোকা মারতেই দরজাটা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার আবার ঢুকে পড়লো লিফটের ভেতরে। আর কিছু না করাই ভালো। সে শুধু একটু খতিয়ে দেখতে চেয়েছিল। হাজার হলেও সাংবাদিক, এরা মিথ্যে কথা বলে এখানে-ওখানে ঢুকে পড়ে।

লিফট দিয়ে নিচে নামতে নামতে একটু অবাকই হলো এনামুল হক। আকিলের মতো পুচকে সাংঘাতিকের সাথে তাদের মালিকের কি কাজ? এই ব্যাটাকে তো সে নিজেও পাত্তা দেয় না। শুধু ঝামেলার হাত থেকে বাঁচার জন্য পুলিশের পাশাপাশি তাকেও হাতে রাখে, নিয়মিত মাসোহারা দেয়।

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে ফ্রন্ট ডেস্কে আসতেই জাফর নামের এক ফ্রন্টডেস্ক ক্লার্ক জানালো ৭০৭ থেকে চা আর স্ন্যাসের অর্ডার দেয়া হয়েছে এইমাত্র। কথাটা শুনে এনামুল আবারো বিস্মিত হলো। এরকম একজন মানুষ এইসব ফালতু লোকজনের সাথে বসে চা-নাস্তা করবে! ওই সাংঘাতিকের সাথে কী এমন কাজ?

অধ্যায় ১৩

কিছুদিন আগে মুনেম চৌধুরীকে ফোন দিয়ে নিজেকে ব্ল্যাক রঞ্জু দাবি করে চাঁদা চেয়েছিল কেউ। এমন ফোন পেয়ে সঙ্গত কারণেই মুনেম চৌধুরী খুব রেগে গেছিলেন। তার বাবা ক্ষমতাসীন দলের একজন সাংসদ, তিনি নিজেও কাজ করতেন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে, আদতে যেটা আমেরিকান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান-এ রকম একজন মানুষের কাছে কোনো সন্ত্রাসি চাঁদা চাইবে, ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানেই লেগেছিল। তিনি কালক্ষেপন না করেই পুলিশকে সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরই তাকে বাড়ির সামনে গুলি করা হয়।

জেফরি বেগ এখন সন্দিহান, আসলেই রঞ্জু গ্রুপ এ কাজটা করেছে কি না। কারণ যে ফোনে রঞ্জু চাঁদা চেয়ে কল দিয়েছিল, সেটাতে মাত্র একটি নাম্বারই সেভ করা আছে-এসএসবি ব্যাঙ্কের কাস্টমার সার্ভিসের নাম্বার। ফোনে অনেকগুলো মেসেজ আছে, তার সবটাই ঐ ব্যাঙ্কের একটি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা আর তোলার নোটিফিকেশন মেসেজগুলো। এ কাজের জন্য কেউ আস্ত একটা ফোন ব্যবহার করতে পারে, তাতে অবাক হয়নি সে, কারণ তিনি আইফোন ব্যবহার করতেন। কিন্তু যে নাম্বারটার কথা মুনেম চৌধুরীর স্ত্রী পর্যন্ত জানতেন না, সেটা ব্ল্যাক রঞ্জুর দল কিভাবে পেয়ে গেল?

এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আরেকটু পরই। সহকারি জামানকে ঐ সিমটার কল ডিটেইলস রেকর্ড অর্থাৎ সিডিআর বের করতে বলেছিল। আগের দিন হলে কাজটা করতে এক-দুদিন সময় লেগে যেত, কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন সেটা কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“স্যার?”

সহকারির আগমণে ভাবনায় ছেদ পড়লো তার। “কি পেলে?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো সে।

ডেস্কের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো জামান। তার হাতে একটা কম্পিউটার প্রিন্ট। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে চমকপ্রদ কিছু পাওয়া গেছে। “এই নাম্বার দিয়ে মাত্র একটা নাম্বারেই কল করতেন মুনেম সাহেব।”

অবাক হলো জেফরি। শুধু একজনকে?

হাতের কাগজটা দেখে বলল জামান, “রেহনুমা নাসরিন নামের একজনের সঙ্গে। নাম্বারটা এই নামেই রেজিট্রেশন করা। আমি রেজিট্রেশনের ফর্ম থেকে মহিলার এনআইডি নাম্বার আর আঙুলের ছাপও কালেক্ট করেছি।”

“এই মহিলার সাথে কথা বলতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “উনার ফোনটা অ্যাক্টিভ আছে। জিপিএস বলছে, উনি এখন সেগুন বাগিচায় আছেন। সম্ভবত ওখানেই থাকেন। ওটা একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। হোমিসাইড থেকে যোগাযোগ করবো, স্যার?”

একটু ভেবে নিলো জেফরি বেগ। এই মহিলা যদি মুনেম হত্যার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত হয়ে থাকে, তাহলে সাধারণভাবে দেখলে নিজের ফোনটা বন্ধ করে রাখার কথা। অন্যদিকে ঘাগু অপরাধীরা এমন বোকামি করবে না। তারা জানে, ফোন বন্ধ করে রাখার একটাই মানে-সন্দেহের তালিকায় ঠাঁই পাওয়া। তবে ফোন করে এমন একজনের সঙ্গে মুনেম হত্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে ঝুঁকি আছে। মহিলা পালিয়ে যেতে পারে, চলে যেতে পারে আত্মগোপনে। তখন তাকে খুঁজে বের করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এতো সময় তার হাতে নেই।

“না,” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। “সামনাসামনি কথা বলবো ওই মহিলার সঙ্গে।”

জামানও উঠে দাঁড়ালো।

অধ্যায় ১৪

আকিল আহমেদ অবাক হয়ে বসে আছে। তার সামনে সৌম্যকান্তির স্যুরোর্ধ ভদ্রলোকের নামটা ছাড়া আর কিছু সে জানে না। ঢাকা থেকে তার চিফ রিপোর্টার যখন নিজে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন তখন ধরে নিয়েছিল, এই লোক হোমড়া চোমড়া একজনই হবে। হোটেল ম্যানেজারের সতর্ক আচার আচরণ দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল সে।

কিন্তু যার সামনে বসে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে না বড় কোনো ব্যবসায়ি কিংবা ভিআইপি কেউ। সহজ-সরল একজন মানুষ। নির্মেদ শরীর, খুবই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। কথা বলছে আস্তে আস্তে। দরকারের বেশি একটা শব্দও বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। তবে আচার-আচরণে এমন একটি ব্যক্তিত্ব আছে যেন সে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

চিফ রিপোর্টারের নিষেধ আছে বলে কোনো রকম প্রশ্নও করতে পারছে, শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে এই লোক যে কাজ করতে বলছে সেটা খুবই অভিনব। তবে যেরকম ভেবেছিল কাজটা আদতে সেরকম কঠিন কিছু নয়। তার জন্য এটা খুবই মামুলি একটি কাজ, কারন স্বয়ং চিফ রিপোর্টারের সায় আছে এতে।

রুমের দরজায় টোকা পড়তেই অমূল্যবাবু কথা বলা বন্ধ করে দিলো। “আসো।”

রুমসার্ভিসের ছেলেটা ঢুকলো ট্রে হাতে নিয়ে। চুপচাপ ঘরের দু-জন মানুষের মাঝখানে কফি টেবিলের উপরে ট্রে থেকে চা আর স্ন্যাক্সগুলো রেখে বিদায় নিলো সে।

চায়ের কাপটা তুলে নিলো অমূল্যবাবু। “নিন।”

আকিল আহমেদ বুঝতে পারলো না স্ন্যাকসের দিকে হাত বাড়াবে কি না।

“আমি একটু আগে খেয়েছি, আপনি খান।”

বাবুর কথায় স্বস্তি পেলো মহাকাল-এর কক্সবাজার প্রতিনিধি। একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিলো সে।

“হকারের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

“জি,” মুখে স্যান্ডউইচ পুরে বলল সাংবাদিক। হাসার চেষ্টা করলো একটু। “এইটা আমার জন্য ডাইল-ভাত। এইটা নিয়া একদম চিন্তা করবেন না।”

“ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।”

তার মুখভর্তি খাবার, তাই মাথা নেড়ে সায় দিলো কেবল।

বাবু পাশ থেকে একটা সাদা খাম হাতে নিয়ে বাড়িয়ে দিলো লোকটার দিকে। “এটা রাখুন।”

ঢোক গিলল আকিল। খামটা হাতে নিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

“আপনাদের চিফ রিপোর্টারকে কিছু বলার দরকার নেই, ঠিক আছে?”

“কোন্ ব্যাপারে, স্যার?” বুঝতে না পেরে বলল আকিল।

“এই খামের ব্যাপারটা।”

আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সাংবাদিক। “ঠিক আছে, স্যার।”

স্যান্ডউইচটা দ্রুত খেয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিলো আকিল আহমেদ। অমূল্যবাবু আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখতে লাগলো তাকে। চুকচুক শব্দ করে দ্রুত চা-টা শেষ করে খামটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাংবাদিক।

“আমি তাহলে আসি, স্যার?”

বাবু কেবল মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আদাব।”

আকিল আহমেদ রুম থেকে বের হবার পর পরই বাবু তার ফোনটা বের করে কল করলো।

“সব রেডি তো?” ওপাশ থেকে কথা শুনে গেল সে। “আমি কিন্তু খুব সকালেই আসছি হাসপাতালে।”

ফোনটা রেখে ব্যালকনিতে চলে গেল। চোখের সামনে বিস্তৃত সমুদ্র, পড়ন্ত বিকেল, সূর্য এখন সমুদ্রে ডুবতে বসেছে। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে উদাস হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলো অমূল্যবাবু।

অধ্যায় ১৫

সেগুন বাগিচার চট্টগ্রাম রেস্টুরেন্টের খুব কাছেই একটি বহুতল ভবনের সামনে এসে থামলো জামানের বাইকটা। বেইলি রোডের হোমিসাইডের অফিস থেকে জায়গাটা খুব কাছেই। বাইকে করে এখানে আসতে বড়জোর সাত-আট মিনিট লেগেছে।

বাইক থেকে নেমে ভবনের সামনে চলে এলো জেফরি বেগ। তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো দারোয়ান। নিল রঙের ইউনিফর্ম পরে আছে লোকটা। বয়স ত্রিশের কোঠায়।

“কী হইছে, স্যার?”

“আমরা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি,” বলল জেফরি। স্বল্পশিক্ষিত লোকজনকে হোমিসাইডের পরিচয় দেয় না সচরাচর। এরা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের নাম খুব একটা শোনে না, আর শুনলেও বুঝতে পারে না এটা পুলিশেরই একটি বিভাগ। এটাকে হোমিসাইডের দুর্বল পিআর হিসেবে দেখা যেতে পারে।

যেমনটা ভেবেছিল জেফরি, পুলিশের পরিচয় পেয়ে দারোয়ান একটু নড়েচড়ে উঠল। “বলেন, কী করবার পারি?” বিনয়ের সাথে বলল সে।

“সবার আগে মেইনগেটটা খোলো, বাইকটা ভেতরে রাখবো।”

জেফরির কথা শুনে দারোয়ান গেটটা খুলে দিলো। জামান তার বাইকটা নিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

“একটা কাজে এসেছি এখানে,” বলল জেফরি। “রেহনুমা নাসরিনের কাছে।”

দারোয়ানের চেহারা দেখে বোঝা গেল নামটা শুনে চিনতে পারেনি। “এইটা আবার কে?”

“চেনো না তাকে?”

“এই নাম তো শুনি নাই,” আমতা আমতা করে বলল লোকটা।

বাইকটা পার্ক করে জামান চলে এসেছে ততক্ষণে। মোবাইল ফোন থেকে রেহনুমা নাসরিনের এনআইডি কার্ডে দেয়া ছবিটা এনলার্জ করে দেখালো। “এই যে, এই ম্যাডামের কথা বলছেন আমার স্যার।”

ছবিটা ভলো করে দেখলো দারোয়ান। চিনতে কষ্ট হচ্ছে সম্ভবত।

“আমাদের কাছে খবর আছে, উনি এখানেই থাকেন।”

ঢোক গিলল দারোয়ান।

“তুমি অবশ্যই তাকে চেনো,” জোর দিয়ে বলল জামান। “ছবিটা বাজেভাবে তোলা হলেও চেনার কথা।”

আবারো ঢোক গিলল লোকটা। “কি নাম কইলেন যে?”

“রেহনুমা নাসরিন।”

ছবিটা আরো ভালো করে দেখলো দারোয়ান, তারপর মাথা নেড়ে সায় দিলো। “মনে হইতাছে সাত তালার ম্যাডাম। কিন্তু উনার নাম তো…” মনে

করার চেষ্টা করলো লোকটা। “…কী জানি?”

“সাত তলার কোন ফ্ল্যাটে থাকেন উনি?” জেফরি তাড়া দিলো।

“লিফটের ডাইন দিকে, স্যার।”

জামানকে নিয়ে লিফটের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালো জেফরি। “ওকে মুনেম চৌধুরীর ছবিটা দেখাও, চিনতে পারে কি না দেখি।”

জামান তার ফোন থেকে মুনেম চৌধুরীর ছবি বের করে দেখালো দারোয়ানকে। “উনাকে চেনো? এখানে প্রায়ই আসেন।”

চোখ কুঁচকে ছবিটা দেখে ঢোক গিলল লোকটা। “হ, চিনি মনে হয়। ঐ ম্যাডামের কাছেই আসেন মাঝেমইদ্যে।”

“গুড,” দারোয়ানের পিঠে আলতে করে চাপড় মারলো জেফরি, তারপর পা বাড়ালো লিফটের দিকে।

লিফট দিয়ে সাত তলায় উঠে আসার পর ডান দিকের ফ্ল্যাটের দরজার পাশে কলিংবেলের সুইচ টিপে দিলো জামান। পর পর তিন বার বাজালো বেল। কিছুক্ষণ পরই পিপহোল দিয়ে তাদেরকে যে কেউ দেখছে বুঝতে পারলো কিন্তু ভেতর থেকে কোনো জবাব এলো না। আবারো বেল বাজানোর জন্য জামানকে ইশারা করলো জেফরি বেগ।

চতুর্থ বারের মতো বেল বাজাতেই ভেতর থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলে উঠল, “কে?”

কণ্ঠটা অবশ্যই ভীত-সন্ত্রস্ত। গৃহকর্মি হবে হয়তো।

“আমরা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি,” জামান বেশ জোরে বলল।

কথাটা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ভড়কে গেছে নিশ্চয়।

“এটা পুলিশেরই একটি ডিপার্টমেন্ট, হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট যদি চিনতে না পারে তাই বলল জামান।

এবার নারী কণ্ঠটা ভেতর থেকে বলে উঠল, “আইডি কার্ড দেখান।”

জামান আর কোনো কথা না বলে পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করে পিপহেলের সামনে মেলে ধরতেই দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে খুলে গেল, তবে পুরোপুরি খুলল না, চেইন দিয়ে আটকানো রইলো।

এক তরুণীর মুখের অর্ধেক অংশ দেখা গেল দরজার ফাঁক দিয়ে। দেখে অবশ্য গৃহকর্মি বলে মনে হচ্ছে না।

“কার কাছে আসছেন আপনারা?” মেয়েটা জানতে চাইলো।

“রেহনুমা নাসরিন এখানে থাকে না?” বলল জামান। এনআইডি কার্ডে যে ছবিটা আছে তার সাথে এই মেয়ের চেহারার কোনো মিলই নেই।

নামটা শুনে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মেয়েটি। যেন বুঝতে পারছে না, এই রেহনুমা নাসরিনটা আবার কে!

“এইখানে এই নামে কেউ থাকে না, মেয়েটা জানালো বিরক্ত হয়ে।

“তাহলে কে থাকে এখানে?”

“শায়লা মির্জা।”

পেছনে ফিরে জেফরির দিকে তাকালো জামান।

“উনাকে ডাকুন, জেফরি বলল এবার। “দরকার আছে।”

মেয়েটা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার দরজাটা ফাঁক হলো একটু, সেই ফাঁক দিয়ে যে মুখটা দেখা গেল সেটা তাদের দুজনের কাছেই বেশ পরিচিত ঠেকলো। তবে জামান নিশ্চিত, এনআইডি কার্ডের বাজেভাবে তোলা ছবির সাথে এই মুখটার বেশ মিল রয়েছে।

“কাকে চাইছেন আপনারা?” মেয়েটি জানতে চাইলো। তার চোখেমুখে বিপর্যস্ততার ছাপ প্রকট। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।

“রেহনুমা নাসরিনকে চাচ্ছিলাম,” জামান বলল।

ভুরু কুঁচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো তরুণী। “কী জন্যে এসেছেন আপনারা?”

“একটা কেসের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি…খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিশ্চয়ই রেহনুমা নাসরিন?”

“না, আমার নাম শায়লা মির্জা। রেহনুমা নাসরিন নামে কেউ এখানে থাকে না, তারপরই দরজাটা বন্ধ করে দিলো মেয়েটি।

জেফরি আর জামান একে অন্যের দিকে তাকালো। ন্যাশনাল আইডি কার্ডে রেহনুমা নাসরিনের যে ছবিটা আছে সেটা যথারীতি বাজেভাবে তোলা, কিন্তু এতোটা বাজে নয় যে বাস্তবে মুখটা দেখলে চেনা যাবে না। এনআইডি কার্ডের ছবির সাথে এই মেয়েটার চেহারা মিলে যায়। তারপরও বলছে সে রেহনুমা নাসরিন না!

“স্যার?” জামান বলল।

“বেল বাজাও।”

জামান আবারো কলিংবেল বাজালো।

“বললাম তো রেহনুমা নাসরিন নামের কেউ এখানে থাকে না,” ভেতর থেকে বলে উঠল একটু আগের মেয়েটি।

“আমরা আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছি মুনেম মার্ডার কেসটা নিয়ে। দয়া করে দরজা খুলুন।”

কয়েক মুহূর্ত নিরব, তারপরই খুট করে শব্দ হলো, খুলে গেল দরজাটা। তাদেরকে বসতে দেয়া হলো ড্রইংরুমে। মিনিটখানেক পরই সেখানে হাজির হলো রেহনুমা নাসরিন কিংবা শায়লা মির্জা গায়ে একটা ওড়না চাপিয়ে এসেছে এবার। মহিলা প্রচণ্ড নাভাস হয়ে পড়েছে জেফরি বেগ আর জামানের আগমণে। নাভাসভাবে সোফায় বসলো। তার হাতদুটো রীতিমতো কাঁপছে। পুলিশ কিভাবে তার এবং এই ফ্ল্যাটের সন্ধান পেলো সেটা ভেবে পাচ্ছে না হয়তো। আরো ভেবে পাচ্ছে না, তার পিতৃপ্রদত্ত নামটাই বা কী করে জানলো পুলিশ।

“আপনি রেহনুমা নাসরিন না?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো জামান। “জু-জি…” ঢোক গিলল মহিলা। “…আমিই…”

জেফরি আর জামান মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“রেহনুমা নাসরিন আমার আসল নাম,” গভীর করে শ্বাস নিলো মহিলা। “তবে মিডিয়াতে আমি শায়লা মির্জা নামে পরিচিত।”

“মিডিয়ায় কাজ করেন?” জেফরি বলে উঠল।

“জি। নাটক আর মডেলিংয়ে কাজ করি…মানে, করতাম।”

শায়লা মির্জাকে দেখেই মনে হচ্ছে, একটু অগোছালো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। সম্ভবত ঘুম হয়নি কয়েক রাত। একটা টি-শার্ট আর ঢোলা পাজামা পরে আছে। চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখা। মিডিয়াতে কাজ করার সময় নিজের নামটা বদলে শায়লা মির্জা করে নিয়েছে রেহনুমা নাসরিন। জেফরি বেগ বুঝতে পারলো, তসলিমা এবং নাসরিন-এ দুটো নাম সম্ভবত অপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই দেশে।

“মুনেম চৌধুরীর মার্ডার কেসটা নিয়ে আমরা তদন্ত করছি,” বলল জেফরি বেগ।

ভড়কে গেল শায়লা মির্জা।

এই মেয়ে অভিনেত্রী হলো কী করে! মনে মনে বলল জেফরি। “তাকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন?”

প্রায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলবে এমন ভঙ্গিতে মাথা দোলালো সাবেক মডেল-অভিনেত্রী।

“কিভাবে চেনেন, সেটা কি জানতে পারি?”

জেফরির দিকে ফোলা ফোলা লালচে চোখে তাকালো শায়লা মির্জা। “অ-অনেক আগে থেকে…” নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। “প্রায় চার বছর ধরে।”

লম্বা করে শ্বাস নিলো জেফরি। যে প্রশ্নটা সে করতে সঙ্কোচ বোধ করে সব সময় সেটাই এখন করতে হচ্ছে। আপনাদের মধ্যে সম্পর্কটা কি, জানতে পারি?”

এবার শায়লা মির্জার ঠোঁটদুটো কাঁপতে শুরু করলো। কথা বলতে বেগ পেলো সে। হাতদুটো শুরু থেকেই কাঁপছে। হুট করে দু-হাতে মুখটা ঢেকে মাথা নিচু করে ফেলল, সেই সাথে চাপা কান্নার দমক।

জেফরি আর জামান অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালো।

“স্যারের প্রশ্নের জবাব দিন,” জামান কাটাকাভাবে বলল। তার কণ্ঠে অধৈর্যের ছাপ।

হাত তুলে সহকারিকে বিরত থাকার ইশারা করলো জেফরি। মেয়েটাকে সময় দিতে চায় সে।

কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কান্না করার পর শায়লা মির্জা মুখ তুলে তাকালো। চোখদুটো লালচে, যেন রক্ত জমে গেছে। দু-গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রুজল। ঠোঁটদুটো এখনও কাঁপছে।

সোফার পাশে সাইড টেবিলের উপর একটা টিসু বক্স, সেখান থেকে একটা টিসু বের করে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো জেফরি।

“থ্যাঙ্কস, টিসুটা হাতে নিয়ে বলল শায়লা। চোখটা মুছে গভীর করে শাস নিয়ে তাকালো ইনভেস্টিগেটরের দিকে।

“মুনেম চৌধুরীর মার্ডার কেসটা এখন হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট দেখছে,” বলল জেফরি বেগ। “আমাদেরকে আপনার কো-অপারেট করা উচিত।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো অভিনেত্রী-কাম-মডেল।

“আপনার সাথে মুনেম সাহেবের সম্পর্কটা কি?”

“ও আমার…” পরের কথাগুলো গলায় আটকে গেল যেন। ঢোক গিলল সে। “আমি ওর ওয়াইফ।”

জামান এবং জেফরি অবাক হয়ে তাকালো একে অন্যের দিকে।

অধ্যায় ১৬

অভিনেত্রী শায়লা মির্জা দাবি করছে, সে মুনেম চৌধুরীর স্ত্রী!

চার বছর আগে উঠতি অভিনেত্রী শায়লার সাথে এক পার্টিতে পরিচয় হয় মুনেম চৌধুরীর, তারপর গড়ে ওঠে সখ্যতা। সেই সখ্যতা খুব দ্রুতই সম্পর্কের দিকে মোড় নেয়। এক সময় শায়লা গর্ভবতী হয়ে পড়লে বিপাকে পড়ে যায়। কিন্তু মুনেমকে গর্ভপাত করার কথা বললে তাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, বাচ্চাটা রেখে দিতে। কথাটা শুনে বিস্মিত হয়েছিল শায়লা। তার ধারনা ছিল, মুনেমই গর্ভপাতের পক্ষে বলবে, তাকে কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাবে।

কিন্তু বিয়ে না করে বাচ্চা নেয়া? অসম্ভব! শায়লা এমন প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপরই মেয়েটাকে আরো বিস্মিত করে দিয়ে মুনেম জানায়, আজই বিয়ে করবে তারা, যদি শায়লা চায়।

অনেক আলাপ আলোচনা করার পর ঐদিনই তারা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। অবশ্যই কাজীর কাছে প্রথম বিয়ের কথা স্বীকার করেনি মুনেম। সেটা করলে আইনগত জটিলতায় পড়তো, বিয়ে পড়াতেও রাজি হতো না কাজী। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে রাজি করানো যেত অবশ্য কিন্তু মুনেম সেটা করেনি। নিজের দুশ্চিন্তার কথা সে মুনেমকে জানিয়েছিল। তাকে অভয় দিয়ে মুনেম চৌধুরী বলেছিল, এ নিয়ে যেন চিন্তা না করে। তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। তারপর সবাইকে জানাবে এটা। তার প্রথম স্ত্রী এই বিয়ে মেনে নিক বা না নিক, তার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার অপরাধে আর যা-ই করুক, মামলা করতে যাবে না। প্রথম স্ত্রীর প্রতি এটুকু আস্থা ছিল তার।

তবে দুঃখজনক হলো, তিন মাসের মাথায় শায়লার মিসক্যারেজ হয়ে যায় বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে। এ ঘটনায় খুবই কষ্ট পেয়েছিল তারা দু-জন। কিন্তু মুনেম তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসততা-একটা সন্তানের জন্য তাকে যে বিয়ে করেনি তার প্রমান পেয়ে যায় তখনই। সব সময় শায়লার খোঁজ রাখতো, মাঝেমধ্যে রাতে এসেও থাকতো সে। দু-জনে স্বপ্ন দেখতো, খুব জলদিই তারা একসাথে থাকবে।

এই দ্বিতীয় বিয়েটা মুনেম যে কাউকে জানায়নি তার কারণ একটাই-তার বাবা মাহবুব চৌধুরী। আরেক ঝাণু পলিটিশিয়ান বন্ধুর মেয়েকে খুব শখ করে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মুনেমের স্ত্রীকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। সত্যি বলতে, মুনেমের সাথে ওর স্ত্রীর সম্পর্কটা শুরু থেকেই এক তালে চলে আসছিল-তাতে না ছিল উদ্দামতা, না ছিল শীতলতা। একেবারেই নিয়মে বাধা সংসার যাকে বলে। কিন্তু বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে মুনেম, তার চাইতেও বেশি করে শ্রদ্ধা। অসুস্থ আর শয্যাশায়ী বাবাকে কষ্ট দিতে, চায়নি বলেই সিদ্ধান্ত নেয়, বাবা যততদিন বেঁচে আছেন, এই বিয়ের কথা গোপনই রাখবে।

কিন্তু জেফরি বেগ বুঝতে পারছে না, মেয়েটা সত্যি কথা বলছে না কি অভিনয় করছে। জামানকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মেয়ের সব কিছুই নাটক মনে হচ্ছে তার কাছে। চোখমুখ শক্ত করে এমনভাবে ক্রন্দনরত অভিনেত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এক্ষুণি ধমক দিয়ে বলবে, এসব নাটক বন্ধ করুন।

“আপনি যে এ কথা বলছেন, তার কী প্রমান আছে?” দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলো জামান।

শায়লা মির্জা আবারো দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। “আমি কেন মিথ্যে বলবো…মিথ্যে বলে কী পাবো আমি?”

জামান কিছু বলতে যাবে, জেফরি তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। “আপনাদের বিয়ের সাক্ষি ছিল?” শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।

“হুম।”

“উনি যে বিবাহিত, সেটা কি জানতেন না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো শায়লা।

“এটা জেনেও বিয়ে করলেন?” জামান বলে উঠল।

গভীর করে নিশ্বাস নিলো শায়লা। “ও আমাকে সেভ করেছে…ও না থাকলে আমি আজ…” গলার কাছে গিট পাকিয়ে গেল তার। ঢোক গিলে নিলো। “মিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে আমি বিরাট বড় একটা চক্রের খপ্পড়ে পড়ে গেছিলাম, মুনেমই আমাকে উদ্ধার করে সেখান থেকে।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর, “আপনাদের সম্পর্কের কথা আর কে কে জানে?”

মুখ তুলে তাকাল মেয়েটি। “আমার কে আছে যে জানবে!”

কথাটা দ্ব্যর্থবোধক ঠেকল জেফরির কাছে। জামানের ভুরু আরো কুঁচকে গেল।

ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভিনেত্রী। “আমার এক বোন আর বান্ধবি জানে। আর কেউ না।”

জেফরি কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সত্যি বলতে, মুনেম চৌধুরী এই মেয়েকে আদৌ বিয়ে করেছে কি না সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ঠিক করলো এবার আসল প্রসঙ্গ তুলবে।

“মুনেম চৌধুরী যে নাম্বারটা দিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সেটার কথা তার পরিবারের কেউ জানে না, শুধু আপনি জানেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো শায়লা।

“তাহলে এই নাম্বারটা ব্ল্যাক রঞ্জু…মানে, যারা উনার কাছে ফোন করে চাঁদা চেয়েছিল, তারা কিভাবে জানলো?”

কথাটা শুনে চমকে উঠল শায়লা মির্জা। “বুঝলাম না?”

“মুনেম সাহেবকে ব্ল্যাক রঞ্জুর দল ঐ নাম্বারেই ফোন করেছিল…যে নাম্বারটা উনি ব্যবহার করেন, সেই নাম্বারে না। ব্যাপারটা কি অস্বাভাবিক নয়?”

অভিনেত্রীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। “ওরা কিভাবে এই নাম্বারটা জানবে, আশ্চর্য!”

“কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপারটাই তো ঘটেছে এখানে।”

জামান বাঁকাহাসি দিলো। মেয়েটার দিকে এমন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, যেন তার সামনে বসে আছে মুনেম চৌধুরীর আসল হত্যাকারি।

শায়লা কী বলবে ভেবে পেলো না।

“এই নাম্বারটা আপনি কাউকে দিয়েছিলেন…কখনও?”

“আমি কেন এই নাম্বারটা দিতে যাবো?” আর্তনাদ করে উঠল শায়লা মির্জা।

“তাহলে ওরা…রঞ্জুর দল কিভাবে পেলো এটা?”

মাথা দোলাতে লাগলো শায়লা, যেন এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।

“ভালো করে ভেবে বলুন,” তাড়া দিলো জেফরি বেগ। “এই নাম্বারটা কাউকে দিয়েছিলেন কি না।”

সজোরে মাথা নাড়লো মুনেম চৌধুরীর স্ত্রী দাবি করা মেয়েটি। “কখনও না! নেভার! এটা আমি কেন করবো?!”

জামানের ভাবসাব দেখে মনে হলো, মেয়েটার গালে কষে একটা চড় মারতে পারলে খুশি হতো। নিদেনপক্ষে একটা ধমক। কিন্তু বসের সামনে এটা করতে পারছে না বলে নিশপিশ করছে। অবশেষে মুখ না খুলে পারলো না। “আপনি না দিলে কে দিলো এই নাম্বারটা? ওরা কি হাওয়া থেকে পেয়েছে এটা?”

কিন্তু জেফরি বেগের মাথায় চট করেই একটা চিন্তা উঁকি দিলো। তার কাছে মনে হচ্ছে, হাওয়া থেকে নয়, আরেকটা জায়গা আছে যেখান থেকে নাম্বারটা জোগাড় করা সম্ভব!

“আমাদেরকে না জানিয়ে আপনি ঢাকার বাইরে যাবেন না,” মেয়েটাকে বলে উঠে দাঁড়ালো সে। “পরে দরকার হলে আবার আপনার সঙ্গে কথা বলবো আমরা।”

সত্যি বলতে সহকারি জামান কিছুই বুঝতে পারছে না, কেন তার বস এভাবে জিজ্ঞাসাবাদের মাঝখানে উঠে গেল। শায়লা মিজাকে এভাবে ছেড়ে দেয়াটা ভালোভাবে নিতে পারলো না সে কিন্তু বস্কে এ কথা বলতেও পারছে না। সে একদম নিশ্চিত, এই মেয়েই সন্ত্রাসিদেরকে মুনেম চৌধুরীর নাম্বারটা দিয়েছে। আর কেন দিয়েছে সেটা তো দিনের আলো মতোই পরিস্কার : ধনী পরিবারের সন্তান। জীবনের হুমকি দেয়া হলে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে দিতেন, সেই টাকার ভাগ পেতো এই অভিনেত্রী।

“আমার মনে হচ্ছে না, এই মেয়ে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত,” লিফটে করে নিচে নামার সময় বলল জেফরি।

জামান জানে, তার বস কয়েক বছর আগে ইন্টারপোলের এক ট্রেইনিং নিয়েছে ব্রাসেলস থেকে, সেই ট্রেনিংটা ছিল কিভাবে মানুষের কারিরিক ভাষা দেখে মিথ্যে কথা ধরা যায় তার উপরে। সত্যি বলতে, এরপর থেকে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর সত্যি সত্যি বেশ সফলতার সাথেই মানুষের মিথ্যে কথা ধরতে সক্ষম হয়। তবে সেটা শতভাগ নয় মোটেও। প্রায় আশিভাগ ক্ষেত্রে সে সফল। জামানের অবশ্য মনে হচ্ছে, রেহনুমা নাসরিন, ওরফে শায়লা মির্জার বেলায় তার বস্ সফল হয়নি।

“মুনেম চৌধুরীকে হত্যা করলে ওর কী লাভ?” শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি।

“হয়তো ভেবেছে মুনেমসাহেব চাঁদার টাকা দিয়ে দেবেন,” বলল জামান। “আর সেই টাকার ভাগ পেতে এই নায়িকা।”

মাথা দোলাল জেফরি বেগ। “কতো টাকা হতো সেটা?”

জামান কিছু বলল না। রঞ্জুর দল ঠিক কতো টাকা চাঁদা চেয়েছিল ভদ্রলোকের কাছ থেকে সেটা মনে করার চেষ্টা করল।

“জিডিতে মুনেম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, রঞ্জুর দল তার কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। যদি এই পরিমাণ টাকা মুনেমসাহেব দিয়েও দিতেন, তাহলে এই মেয়ে আর কতো পেতো?”

কাঁধ তুলল জামান। “অর্ধেক?” মাথা দোলাল জেফরি। “এই পরিমাণ টাকার জন্য এই মেয়ে খুন করাবে।”

অবাক হয়ে তাকালো তার সহকারি। জেফরি কিছুই বলল না, লিফট থেকে বের হয়ে জামানের বাইকে ওঠার আগে হেলমেটটা তুলে নিলো সে। একই কাজ করল জামানও। হেলমেট পরে বাইকে উঠে বসল।

“হোমিসাইডে যাবো, স্যার?”

“না, মতিঝিলে…” বাইকের পেছনে বসে বলল জেফরি।

“মতিঝিল?” খুবই অবাক হলো জামান।

অধ্যায় ১৭

মতিঝিলের এসএসবি ব্যাঙ্কের হেডঅফিসে গিয়ে জেফরি বুঝতে পারছে কাজটা যতো সহজ ভেবেছিল, তত সহজে করা যাবে না।

ব্যাঙ্কের ম্যানেজার রিশাদ কবীর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর যেটা চাইছে সেটা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব। এমন আব্দার তার ব্যাঙ্ক কেন, পৃথিবীর কোনো ব্যাঙ্কই মেটাতে পারবে না। ভদ্রলোককে অনেক বোঝানোর পরও এই অনড় অবস্থান থেকে টলানো যায়নি। এক পর্যায়ে ম্যানেজার তার উপরওয়ালাকে ফোন করে জানায় ব্যাপারটা, তিনিও কথাটা শোনামাত্র না করে দিয়েছেন।

এ নিয়ে ম্যানেজারের সাথে তর্ক বাড়িয়ে জেফরি ফোন করলো হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদকে। পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে খুলে বলল তাকে। সব শুনে ফারুক আহমেদও বুঝতে পারলো এটা তারও সাধ্যের বাইরে। কাজটা করতে হলে উপর মহল থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে।

“আচ্ছা, আমি কালকের মধ্যে এটার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

“স্যার, আপনি হোমমিনিস্টারকে এক্ষুণি ফোন দিন। উনাকে বলুন, আমি এখানে থাকতেই যেন পারমিশানের ব্যবস্থা করে দেন।”

“এক্ষুণি?” মহাপরিচালক অবাক হলো।

“হ্যাঁ, স্যার। মিনিস্টারকে বলবেন, তিনি যে আলটিমেটাম দিয়েছেন, সেই সময়ের মধ্যে রেজাল্ট পেতে চাইলে একদিনও নষ্ট করা যাবে না। তদন্তের প্রয়োজনে যেখানে যেভাবে আমার অ্যাকসেস করা দরকার সেটা যদি না করতে পারি তাহলে এই তদন্ত বেশি দূর এগোবে না। এই মুহূর্তে যেটা চাচ্ছি সেটা ভীষণ জরুরি।”

“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে অপর প্রান্ত থেকে সায় দিয়ে বলল ফারুক আহমেদ। “ওয়েট, আমি দেখছি।”

“ওকে, স্যার।”

ফোনটা রেখে ডেস্কের ওপর পাশে বসে থাকা এসএসবি ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার রিশাদ কবীরের দিকে তাকালো সে। লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কপোরেট কালচারে অভ্যস্ত একজন মানুষ, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে ওঠাবসা। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনির কেউ এসে তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে, সেটা মেনে নিতে অভ্যস্ত নয়। আমলারা যেমনটা ভাবে দেশ তারা-ই চালায়, এরাও তেমনি নিজেদের বুদ্বুদের ভেতরে বাস করে ভাবে, আসলে দেশটা তারা-ই চালাচ্ছে!

“এসব করে কোনো লাভ হবে না,” বলল ম্যানেজার। “হোমমিনিস্টার বললেও আমরা সেটা শুনতে বাধ্য নই।” কথাটা বলে যেন পরিতৃিপ্তি পেল ভদ্রলোক।

ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরি বেগের। পড়াশোনা শিকেয় তোলা চাঁদাবাজ আর নেশাখোর ছাত্রনেতা নামধারী কেউ এমন কথা বললে বেশি মানাতো। কিছু বলতে গিয়েও বলল না সে।

“দিস ইজ অ্যা ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট। নোবড়ি কান্ট ট্রিট আস লাইক দ্যাট,” আরো জবরদস্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলল ম্যানেজার

মুচকি হাসলো জেফরি। এই হলো আরেক সিম : নিম্নবর্গের মানুষ খিস্তি আর গালিগালাজ করে নিজের বাহাদুরি প্রকাশ করে। উচ্চবর্গের মানুষ সেক্ষেত্রে বেছে নেয় ইংরেজি ভাষাটা! গোলামির ভাষা!

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখলো সে। কর্পোরেট জগতের মানুষদের মানসিকতার সাথে ভালোভাবেই পরিচিত। এদের ইগো একটু বেশিই স্পর্শকাতর। আপাতত সেই ইগোতে আঘাত করতে চাইছে না।

“শুনুন কবীর সাহেব,” বেশ শান্ত কণ্ঠে বলল। “হোমমিনিস্টার নিজে এই তদন্তের প্রায়োরিটি ঠিক করে দিয়েছেন, আমার চেয়ে উনার তাড়াই বেশি। উনি যদি আমাকে হেল্প করতে না পারেন তো আমি এখান থেকে চুপচাপ চলে যাবো,” ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। “কিন্তু তার আগে দশ মিনিট ধৈর্য ধরতে হবে আপনাকে,” সহকারির দিকে চকিতে তাকিয়ে আবার বলল, “এই সময়ের মধ্যে আপনি আমাদের দুজনকে দু কাপ কফি দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারেন।”

ম্যানেজার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্টারকমটা তুলে নিলো। “দু কাপ কফি…” এরপর জেফরির দিকে তাকাল।

“ব্ল্যাক…সুগার একটা,” কথাটা বলেই জামানের দিকে ফিরল।

“রেগুলার…দুটো সুগার।”

ম্যানেজার সেটা ইন্টারকমে জানিয়ে দিয়ে রিসিভারটা রেখে দিলো। “আমি কি জানতে পারি, কোন কেসটা নিয়ে আপনি ইনভেস্টিগেট করছেন?”

“আগেই বলেছি, টপ প্রায়োরিটির একটি কেস। আপাতত এর বেশি বলা সম্ভব হচ্ছে না।”

আক্ষেপে মাথা দোলাল রিশাদ কবীর। তাকে খুবই অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে শুরু থেকেই। “হোমিসাইড থেকে যেহেতু এসেছেন, ধরে নিচ্ছি ফিন্যান্সিয়াল স্ক্যামের কেস না এটা?”

হ্যাঁ-না কিছুই বলল না জেফরি, নির্বিকার থাকলো।

“মার্ডার কেস, তাই না?”

“খুন-খারাবির কেসগুলোর সাথে সব কিছুই জড়িত থাকতে পারে, মিস্টার কবীর,” বলল হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। “অলমোস্ট এভরিথিং।”

কথাটা শুনে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ভদ্রলোক। হতাশ হয়েছে মনে। হচ্ছে। “আমাদের কোনো ক্লায়েন্ট কি…?”

“হুম।”

“কে?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো ম্যানেজার।

“এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।”

নিজের রাগ কোনোমতে দমন করলো রিশাদ কবীর। “আপনি খামোখা সময় নষ্ট করছেন। বললাম তো, হোমমিনিস্টার রিকোয়েস্ট করলেও আমি পারমিশান দিতে পারবো না।”

“তার মানে আরো উপরে যোগাযোগ করতে বলছেন?…পিএমের অফিস?” মুচকি হেসে জানতে চাইলো জেফরি।

বিব্রত ভঙ্গি দেখা গেল ম্যানেজারের চোখেমুখে। “কি বলেছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।”

“বললামই তো, এটা আমার মাথাব্যথা না…উপরে জানিয়ে দিয়েছি, দেখি তারা কী করে।”

নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো ম্যানেজার রিশাদ কবীর। “ব্যাঙ্কের রেপুটেশনের ব্যাপার এটা। আপনার রিকোয়েস্টটা সেদিক থেকে দেখলে খুবই সেনসিটিভ। এটা বুঝতে হবে।”

“আপনি রেপুটেশন নিয়ে খামোখাই ভাবছেন। আমরা খুবই সিক্রেটলি কাজ করবো, কেউ কিছু জানতে পারবে না।”

আরদার্লি এসে দু-কাপ কফি দিয়ে গেল এ সময়।

কফিতে চুমুক দিলো জেফরি বেগ। এক ফাঁকে ঘড়িতে সময়ও দেখে নিলো সে। এরই মধ্যে দশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ যদি এখন তাকে জানায়, ব্যাঙ্কের কাছে সে যা চাইছে সেটা দেয়া সম্ভব হবে না, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই বলে দেবে, এই তদন্ত তার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

“আপনি কতো দিন ধরে আছেন এখানে?” কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে বলল হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

“দু’ বছর।”

“এর আগে–”

কথাটা শেষ করতে পারলো না জেফরি, ফোনের রিং টোন বেজে উঠল। তবে সেটা জেফরি কিংবা জামানের নয়। ম্যানেজার রিশাদ কবীর নিজের ডেস্ক থেকে ল্যান্ডফোনটা তুলে নিলো আস্তে করে, যদিও তার দৃষ্টি জেফরির দিকেই নিবদ্ধ।

“হ্যালো, রিশাদ কবীর বলছি?” তারপরই ভদ্রলোক নড়েচড়ে উঠল। “স্লামালেকুম স্যার…” মাথা নাড়তে লাগল ঘন ঘন। “জি, স্যার…বুঝেছি…ওকে, স্যার।” আরো কিছু কথা শোনার পর আবারো বলল, “স্লামালেকুম, স্যার।” ফোনটা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলল না।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জেফরি বেগ।

গভীর করে শাস নিয়ে নিলো রিশাদ কবীর। “আপনি তাহলে কিভাবে কাজটা করতে চাইছেন?”

স্বস্তি বোধ করল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আপনার ব্যাঙ্কের এই অ্যাকাউন্টটার যাবতীয় ইনফো লাগবে আমার,” কথাটা বলেই মুনেম চৌধুরীর গোপন ফোনটার ডিসপ্লে ম্যানেজারকে দেখাল, তাতে লেনদেনের হিসেবের একটি মেসেজ ওপেন করা আছে, সেখানে রয়েছে অ্যাকাউন্টের নাম্বারটাও।

আক্ষেপে মাথা দোলাল ম্যানেজার। নিজের ডেস্কটপ কম্পিউটারে মুনেম চৌধুরীর অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা কিবোর্ডে টাইটপ করে ইনসার্ট করলো, মনিটরটা ঘুরিয়ে দিলো জেফরির দিকে। “এই যে…”

অ্যাকাউন্টের যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে।

মুনেম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টের নমিনি হিসেবে রেহনুমা নাসরিন, অর্থাৎ শায়লা মির্জার নাম এবং ছবি দেয়া আছে।

“প্রিন্ট করে দিন এই পেইজটা,” বলল জেফরি।

ম্যানেজার সেটাই করল। মৃদু শব্দ করে প্রিন্টার থেকে বের হয়ে এলো একটা এ-ফোর সাইজের কাগজ। জেফরি বেগ সেটা হাতে তুলে নিলো।

অ্যাকাউন্টটার কারেন্ট ব্যালান্স মেসেজে যেমনটা দেখেছিল তেমনি আছে : ৮৫০৮০০২.৪১ টাকা। এরপর আর কোনো টাকা তোলাও হয়নি, জমাও দেয়া হয়নি।

“ওকে?” ম্যানেজার হাতঘড়িতে সময় দেখল। “আমাকে একটু বেরোতে হবে।”

কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকাল জেফরি। “আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি।”

হতদ্যোম হয়ে গেল রিশাদ কবীর।

“এখানকার এম্পুয়িদের মধ্যে ক্লায়েন্টের ডেটা বেইজে অ্যাকসেস আছে কাদের? “

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ম্যানেজার। বুঝতে পারছে, আজকে আর স্ত্রীকে নিয়ে কোরিয়ান রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে পারবে না। “ফন্ট ডেস্কে যারা বসে তাদের তো অ্যাকসেস আছেই, নইলে কাজ করবে কিভাবে।”

“সব এমপ্লয়ির নিশ্চয় নেই?”

“না, তা হবে কেন।”

একটু ভেবে নিলো জেফরি। “তাহলে যাদের অ্যাকসেস আছে তাদের সবার ডেটাবেইজটা ওপেন করুন।

কথাটা বুঝতে একটু সময় নিলো ম্যানেজার। “এম্পুয়িদের ডেটাবেইজ?!”

স্থিরচোখে তাকাল ইনভেস্টিগেটর। “হ্যাঁ, ওটা লাগবে আমার।”

“বলেন কি!” ভদ্রলোকের চোখদুটো বিস্ফারিত হলো যেন।

“সব কিছুই গোপন থাকবে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল রিশাদ কবীর। একবার ভাবল, উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে আবারো ফোন করে কথাটা জানাবে কি না। পরক্ষণেই বুঝে গেল, কোনো লাভ হবে না, সময় নষ্ট করা ছাড়া।

“ডেটাবেইজটা ওপেন করুন,” জামান বলল এবার।

একান্ত অনিচ্ছায় ম্যানেজার তার ডেস্কটপট কম্পিউটারের কিবোর্ডে কিছু টাইপ করলো। এলইডি মনিটরে এম্পুয়িদের লিস্টটা ভেসে উঠল। তারপর ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে যাদের অ্যাকসেস রয়েছে তাদের ফাইলগুলো এক এক করে প্রিন্ট করতে দিয়ে দিলো সে। একটু পরই মৃদু শব্দ করে উঠল প্রিন্টারটা, একের পর এক প্রিন্ট করা কাগজ বের হতে লাগলো।

রিশাদ কবীরের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে, তার ব্যাঙ্কের সমস্ত গোপনীয় তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে দু-জন অফিসার। তার মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হলেও নিজেকে বিরত রাখলো অনেক কষ্টে। খোদ পিএমের অফিস থেকে ফোনটা এসেছিল। পিএমের এক ক্ষমতাশালী পিএস অনেকটা আদেশের সুরেই বলে দিয়েছে, এই তদন্তকারি কর্মকর্তার সাথে যেন পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। এই কেসটা নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই অস্থির হয়ে আছেন!

সবগুলো কাগজ একটা বড় এনভেলপে ভরে নিলো জামান। বিমর্ষ ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে এসএসবি ব্যাঙ্ক থেকে যখন জেফরি বের হয়ে এলো, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে ঢাকা শহরে। মতিঝিলের ব্যাঙ্কপাড়া হিসেবে খ্যাত এলাকাটি জ্যাম আর হৈহট্টগোলে পূর্ণ।

জামানের বাইকটা জ্যামের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে শুরু করলে পেছনে বসা জেফরির মনে হলো, এই শহরে যারা বাইক চালায়, তাদের দক্ষতা সম্ভবত পৃথিবীর অন্য সব দেশের বাইকারদের চেয়ে একটু বেশিই।

অধ্যায় ১৮

সকাল সকাল কলাতলি বিচের কাছে একটি হোটেলের সামনে সাদা রঙের প্রাইভেটকার এসে থামলো। গাড়ির যাত্রি তিনজন, পেছনে বসে আছে তায়েব। তার পাশে সানগ্লাস পরা একজন। গতকাল মাঝরাতে ঢাকা থেকে এসেছে নিজের প্রাইভেটকারে করে। গাড়িটা যে চালাচ্ছে সে নিছক কোনো। ড্রাইভার নয়, একজন গানম্যান।

তায়েব ভেবেছিল তার ফোন পাবার পর পরই প্লেনে করে বিকেলের মধ্যেই কক্সবাজার পৌঁছে যাবে তার এই বড়ভাই, কিন্তু সেটা হয়নি। নিজের প্রাইভেটকারে করে চলে এসেছে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে মাত্র একজন গানম্যান। কারণটা সে ধরতে পেরেছে-সঙ্গে অস্ত্র বহন করছে বলে প্লেন ব্যবহার করা হয়নি। আর ওরকম এক লোকের জন্য দু-জনের বেশি দরকারও নেই!

“তোর লোক কই?” সানগ্লাস গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো।

“আসতাছে, ভাই,” জবাব দিলো তায়েব।

তায়েবের দিকে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো সানগ্লাস। “এইটা ঐ লোরে দিবি।”

টাকাটা হাতে নিতেই সে দেখতে পেলো ছিপছিপে শরীরের মাঝবয়সি এক লোক তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। “ঐ তো, ভাই…আয়া পড়ছে!”

ছিপছিপে লোকটি গাড়ির প্যাসেঞ্জার ডোরের সামনে এসে উপুড় হয়ে ভেতরের দিকে তাকালো।

“খবর কি, মন্টু মিয়া?” জানতে চাইলো তায়েব।

“ঐ গেস্ট তো এটু আগে হুটেল থিকা বাইর হইয়া গেসেগা, ভাই।”

“অ্যাতো সকালে বাইর হয়া গেছে? বিচে গেছেনি?” অবাক হলো। তায়েব। এখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। এই টুরিস্ট এলাকায় বেড়াতে আসা লোকজন এতো সকালে বিচ ছাড়া আর কোথাও যায় না সাধারণত।

“না, ঐহানে যায় নাই…অটো নিয়া বাইর হইছে।”

“লগে কুনো লাগেজ আছিল?” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো তায়েব। তার আশংকা, তাদের শিকার টের পেয়ে সটকে পড়লো কি না কে জানে।

“এইটা আমি ক্যামনে কমু? আমি তো দেহি নাই।”

“ওরে টাকাটা দে,” আস্তে করে সানগ্লাস বলল।

টাকাটা মন্টু মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। “এইটা রাখো।”

চুপচাপ টাকাটা পকেটে চালান করে দিলো মন্টু। “কই গেসে হেইটা বাইর করন যাইবো…রুমসার্ভিসের এক পোলারে দিয়া আনাইছে অটোটা, ওরে জিগাইলেই জানা যাইবো।”

“তাইলে ওর কাছ থিকা জাইনা আসো, লগে কোনো লাগেজ আছিল কি না জিগাইও। একটু তাড়াতাড়ি করো, বুঝলা?”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মন্টু। “কিন্তু পোলাটারে একটু পাত্তি-পুত্তি দিতে হইবো। গেস্টগো খবর জানানো নিষেধ আছে, পাত্তি না দিলে কিছু কইবো না। জিগাইলে কইবো, আমি কিছু জানি না।”

“এই সামান্য কামের লাইগাও পাত্তি দিতে অইবো? ওগো লগে না। তোমার খুব খাতির?” অবিশ্বাসের সুরে বলল তায়েব।

“ওরে এইটা দে,” মন্টু কিছু বলার আগেই সানগ্লাস আরেকটি পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

বিরক্ত হয়ে টাকাটা নিয়ে মন্টু মিয়াকে দিয়ে দিলো তায়েব।

“হুটেলের লোকজরে আপনে চিনেন না, পাত্তি ছাড়া ওরা কাম করে?” কথাটা বলেই মন্টু মিয়া গটগট করে হাঁটা দিলো হোটেলের দিকে।

“খাটাসের বাচ্চা আমার লগে ফাপড় মারে,” তায়েব গজরাতে গজরাতে বলল। “এই ট্যাকা ওর পকেটেই যাইবো। ওরে ট্যাকা দেওনই ভুল হইছে। একবার ট্যাকা পাইয়া ওর জিবলা বড় হইয়া গেছে, ভাই…পাত্তি ছাড়া এহন পাদও দিবো না হালারপুতে।”

“আহ্, তুই রাগ করতাছোস ক্যান? এইটা কুনো ব্যাপারই না,” সানগ্লাস বেশ শান্তভঙ্গিতে বলল। “এইসব ফালতু বিষয় নিয়া মাথা ঘামাইস না।”

তায়েব কিছু বলল না। মন্টু মিয়া কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে অবাধে যাতায়াত করে। অনেকে মনে করতে পারে সে বুঝি হোটেলের কোনো কর্মচারি, আদতে সে কারো চাকরি করে না। তার অধীনে বেশ কিছু মেয়ে আছে, তাদেরকে বিভিন্ন হোটেলে গেস্টদের কাছে সাপ্লাই দেয়। হোটেল ম্যানেজারদের সাথে রয়েছে তার চমৎকার বোঝাপড়া। ম্যানেজার আর তার ভাগের কমিশন ঠিকমতো চলে আসে। প্রতিদিন সে পাঁচ থেকে ছয়টি বড় হোটেলে ঢু মারে, সময় কাটায়। খোঁজ নেয় তার কোনো মেয়ে আবার তার অগোচরে ‘খেপ মারলো কি না। তার লাইনের মেয়েগুলো এক একটা পাক্কা ‘খানকি। এদের দুই পয়সা দিয়েও সে বিশ্বাস করে না।

এই লোকের সাথে কয়েক মাস ধরে তায়েবের বেশ খাতির। তায়েব টেকনাফের ইয়াবা-সম্রাট বইদ্যার এক ঘনিষ্ঠ লোকের কাছ থেকে সরাসরি মাল কিনে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। আগে মাসে দুয়েকদিনের জন্য আসততা কক্সবাজারে, গত মাস থেকে এখানেই নাড় গেড়েছে, মাসের বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকে। মাল ডেলিভারি দেখাশোনা করার পাশাপাশি টুকটাক ইয়াবা বিক্রিও করে এখন, আর এই ব্যবসা করতে গিয়েই মন্টু মিয়ার সাথে পরিচয়। তার মাধ্যমে প্রচুর ইয়াবা বিক্রি করে সে। মন্টু তার অধীনে থাকা মেয়েগুলোকে ইয়াবার ডিলার হিসেবে ব্যবহার করে। পটিয়ে-পাটিয়ে কাস্টমারের কাছে ইয়াবা গছিয়ে দেয় তারা।

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আবারো গাড়ির সামনে চলে এলো মন্টু মিয়া। টাকা হাতে পেয়ে তার কাজের গতি বেড়ে গেছে। মূল্যবান তথ্যটা সে হাসিমুখে জানালো : “হাসপাতালে গেসে, ভাই। লগে কুনো লাগেজ আছিল না। চিন্মর কিছু নাই, আবার ব্যাক করবো হুটেলে।”

সানগ্লাস ভুরু কোঁচকালো।

“কুন হাসপাতালে গেছে?” জানতে চাইলো তায়েব।

“নতুন যে হাসপাতালটা হইসে না, ওইহানে।”

“তুমি শিওর?”

“পুরা শিওর। স্টাফ তো তাই কইলো, অটোটা ওয়-ই ঠিক কইরা দিসে।”

তায়েবের দিকে তাকালো সানগ্লাস। “জায়গাটা তুই চিনোস?”

“চিনি, ভাই।”

সানগ্লাস আর কিছুই বলল না।

“মন্টু মিয়া, পরে কথা হইবো, এহন যাও,” তড়িঘড়ি বিদায় জানালো তায়েব। তারপর ফিরলো সানগ্লাসের দিকে। “কী করবেন এহন?”

“ঐ হাসপাতালটা এক্কেরে নয়া হইছে, না?”

“হ, ভাই। মেরিন ড্রাইভে…একদম নিরিবিলি জায়গা।”

“তাইলে চল, হাসপাতালেই যাই,” রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল সানগ্লাস। “হোটেল থিকা হাসপাতালই বেশি ভালা হইবো। রুগি-ডাক্তার আর আত্মীস্বজন ছাড়া কেউ থাকবো না।”

*

গাড়িটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলে মন্টু মিয়া মুচকি হাসলো। সামান্য একটা কাজে সকাল-সকাল পনেরো শ’ টাকা আমদানি হয়েছে। দিনটা খুবই ভালো যাবে মনে হয়। তারচেয়েও বড় কথা অপমানের প্রতিশোধ নেবার অসাধারণ সুযোগটা পেয়ে ভালোমতোই কাজে লাগাতে পেরেছে।

মাইয়াটা এই লাইনে নতুন আছিল…এটু নাইলে চিল্লাফাল্লাই করসে…এইটা কুনো ব্যাপার? তুই আইসা নাক গলাইলি, মাদারচুদ! তুই কি হুটেলের মালিক?

আবারো থুতু ফেলল মন্টু মিয়া। এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেছে। আজকের দিনটা শেষ হবার আগে আরো কয়েক হাজার চলে আসতে পারে। সে ভালো করেই জানে, তায়েবের সঙ্গে থাকা লোকজন কাম শেষে আজরাতে একটু খানাপিনা করতে চাইবে, মেয়েমানুষও লাগবে ওদের। এই লাইনের লোকগুলা কাম শেষে এরকম ফুর্তি করেই।

অধ্যায় ১৯

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা না বলে থাকতে পারে সে।

কিন্তু আজকে তার মধ্যে এক ধরণের চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে, যদিও বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। তারা শুধু দেখবে একাকি এক রোগি শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।

চোখ বন্ধ করে গভীর করে নিশ্বাস নিতে লাগলো। মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠা-নামার সাথে তার শরীরের অনেক কিছুই ওঠে-নামে। রাগ ক্রোধ, উত্তেজনা, ঘাবড়ে যাওয়া, ভয় পাওয়া এসব খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে বাগে আনা যায়। খুবই ধীরে ধীরে নাক দিয়ে শ্বাস টেনে একইভাবে ধীরগতিতে মুখ দিয়ে বের করে দিলে উদ্বিগ্নতা কমতে শুরু করে।

কিছুক্ষণ পরই অমূল্যবাবু টের পেলো তার ভেতরের অস্থিরতা কমতে শুরু করেছে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ গভীর নিশ্বাস নেবার পর পুকুরের প্রশান্ত জলের মতো স্থির হয়ে গেল তার চিন্তা-ভাবনা। কোনো আলোড়ন নেই, অস্থিরতা নেই, শুধু প্রশান্তি। শান্ত জলের মতোই টলটলে পরিস্কার। একদম তার স্বভাবের মতো। লোকজন যে অমূল্যকে চেনে ঠিক সে রকম।

কেউ যদি মনে করে তার এই স্বভাব সে পেয়েছে জন্মসূত্রে তাহলে ভুল করবে। দীর্ঘদিনের চর্চা আর একনিষ্ঠতায় এই স্বভাব অর্জন করেছে সে। বহুকাল আগেই, জীবনের কঠিনতম দিনগুলোতে জানতে পেরেছিল, রাগ ক্ষোভ-ক্রোধ মানুষের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে, কলুষিত করে। সঠিকভাবে কাজ করতে মস্তিষ্কের গতিপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। নিজেকে ঠিক রাখতে হলে, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে, সবার আগে মাথা ঠিক রাখতে হয়।

এক মহৎপ্রাণ লোকের সঙ্গে যদি ঐ সময়ে কিছু দিন না থাকতো তাহলে হয়তো নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্রোধ আর প্রতিশোধের চিতার আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতো।

জনসন চৌধুরী ছিলেন তার স্কুলের পাঁচ বছরের সিনিয়র এক ভাই, তাকে খুব স্নেহ করতেন ভদ্রলোক। খুবই প্রতিভাধর এই মানুষটি পাকিস্তান আমলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরির পেছনে না ছুটে ছোটোখাটো ব্যবসা দিয়ে বসলেন। জনসন চৌধুরীর মতো প্রতিভাবান একটি ছেলে কেন আইসিএস পরীক্ষা দিলেন না সে-প্রশ্নের জবাব তার পরিবার যেমন খুঁজে পায়নি তেমনি বুঝতে পারেনি তার বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন। কিন্তু দশ বছরের চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই সবাই জবাবটা পেয়ে গেছিল। ততদিনে জনসন চৌধুরী হয়ে গেছিলেন তাদের চেনাজানা প্রায় সব মানুষের চেয়ে ধনী এবং সম্মানিত একজন মানুষ।

অমূল্য সব সময়ই তার এই বড় ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। তাকে ডাকতো জনসনদা বলে। একাত্তরের পর যখন তার সমস্ত স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল, রক্ষিবাহিনি যখন তার পেছনে লাগলো, তখন এই লোকই তাকে আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন।

ঢাকা থেকে বহুদূরে জনসন চৌধুরীর একটি মাঝারি আকারের ইন্ডাস্ট্রি ছিল, অমূল্যকে সেখানে কর্মচারি সাজিয়ে দীর্ঘ দুই বছর আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। তা-না-হলে সহযোদ্ধাদের হারিয়ে প্রতিশোধের যে আগুনে পুড়ছিল, সে আগুনে নিজেও ধ্বংস হয়ে যেতো। অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো সে-ও সব অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দেয়নি, তখনও তার কাছে দুটো রয়ে গেছিল। যুদ্ধ শেষে এক সহযোদ্ধা তাকে বলেছিল, আগে সরকারি দলের লোকজন তাদের সব অস্ত্র জমা দিক তারপর তারা জমা দেবে, নইলে বিপদ আছে।

যুদ্ধটা হয়েছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনি আর তাদের দোসরদের সাথে। কিন্তু কবির ভাষায় নদীর ভেতরে যেমন নদী থাকে তেমনি তাদের ভেতরেও একটা প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছিল। আর গভীর পরিতাপের সাথেই তারা দেখেছে, দোর্দণ্ড প্রতাপের অনেক ছাত্রনেতা মুজিববাহিনির নেতা হয়ে বসে আছে কলকাতায় বসে আয়েশ করছে আর রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে নজরদারি করছে। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতরে দুটো দল দাঁড়িয়ে গেল মুখোমুখি-মুজিববাহিনি আর মুক্তিবাহিনি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষের দিকে এই ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ের ইতিহাস বলতে গেলে চাপা পড়ে গেছে এখন।

নতুন সরকারে মুজিববাহিনির নেতা-কর্মিরা ছিল খুবই প্রভাবশালী। স্বাধীন দেশে নব্য-ক্ষমতা পেয়ে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। খুব দ্রুতই মুজিববাহিনির ভেতরেও শুরু হয়ে যায় বিভক্তি। একদল জাসদে, অন্যরা সরকারের সঙ্গে থেকে যায়। অমূল্যের দলের কয়েকজন রক্ষিবাহিনির হাতে মারা পড়ে। অমূল্যও ধরা পড়ে যায় ওদের হাতে। মারতে মারতে প্রায় মেরেই ফেলেছিল তাকে। টর্চার সেলে তিনদিন তাকে নির্যাতন করা হয়। সেই সব ক্ষতগুলো যেন ইতিহাসের মতোই এখন তার জামার নিচে চাপা পড়ে থাকে।

সে যে সংখ্যালঘু, তার যে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি, আরেকটু বোধবুদ্ধি খাটানো দরকার ছিল, এ নিয়ে সবক দেয়া হয় তাকে। অথচ সে-ও দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে জীবনের তোয়াক্কা না করে! ভেবেছিল স্বাধীন দেশে এমন বিভেদ, অবিচার আর অন্যায় থাকবে না।

রক্ষিবাহিনি তাকে ছেড়ে দেয়নি, ছেড়ে দিয়েছিল ওখানকার ফয়ফরমাশ খাটা এক কাজের মহিলা রাহেলার মা! তার বাঁধন খুলে দিয়ে বলেছিল, দেয়াল টপকে যেন পালিয়ে যায়। ওই মুহূর্তে তেমন কেউ ছিল না সেখানে। অমূল্য নিজের জীবনটা নিয়ে পালিয়ে এসেছিল, তবে ঢাকায় আর থাকেনি, চলে যায় অনেক দূরে। ফেরারি হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় কিছুদিন, তারপরই মনে পড়ে স্কুল জীবনের সেই বড়ভাইয়ের কথা। কোনো কিছু না ভেবেই চলে যায় জনসন চৌধুরীর ইন্ডাস্ট্রিতে। ঢাকা ছেড়ে উত্তরবঙ্গে নিজের শিল্পকারখানাটা নিয়ে ব্যস্ত তখন। সব শুনে জনসন চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন নিজের কারখানায়। দুটো বছর সে কেবল জনসন চৌধুরীর আশ্রয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে টিকেই ছিল না, এই বড়ভায়ের ছায়াতলে থেকে জীবন সম্পর্কেও অনেক কিছু শিখে নিয়েছিল।

এই দেশটা আসলে কিভাবে চলে, বলতে গেলে গোটা বিশ্ব কিভাবে চলে, নিজেকে কিভাবে এর জন্য প্রস্তুত করতে হবে, সবই শিখে নেয় ওই দুই বছরে। সে যেমন শিখেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে করতে হয়, তেমনি শিখেছিল সবকিছুর মূলে থাকে ক্ষমতা। আর ক্ষমতার জগত কোনো বেশ্যাপাড়া নয় যে ও-পথে পা না বাড়িয়ে নিজেকে শুদ্ধ বলে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে। ক্ষমতা হলো টিকে থাকার চাবিকাঠি। জীবনের প্রারম্ভেই ঠিক করে নিতে হয় কিভাবে এটা অর্জন করতে হবে।

জনসন চৌধুরী একদিন তাকে এ-ও বলেছিলেন, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, নারী-পুরুষ, কালো-সাদা এসবের মধ্যে আসল সত্যটি লুকিয়ে আছে ক্ষমতায়। যে কোনো সংখ্যালঘু ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে তাকে সংখ্যাগুরুও ঘাঁটাতে সাহস করবে না, কুর্ণিশ করবে। তাকে যারা সংখ্যালঘু বলে গালি দিয়েছে, তারা আসলে তার ক্ষমতাহীনতারই সুযোগ নিয়েছে! সত্যিকারের সংখ্যালঘু হলো ক্ষমতাহীন মানুষ!

নারী যখন ক্ষমতাহীন তখনই সে পুরুষের অধীন; নগন্য একজন। ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও একজন নারী ছড়ি ঘোরাতে পারে; কালো হয়েও সাদাদের মধ্যে বাস করতে পারে নির্বিঘ্নে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু, বর্ণ, নারীত্ব, দারিদ্রতা, এসবই ক্ষমতাহীনতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ!

হঠাৎ চোখ খুলে তাকালো অমূল্যবাবু। ঠিক কতোক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে এসব কথা ভাবছিল বলতে পারবে না। হালকা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। বাইরের করিডোরে কারোর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে। এই পদক্ষেপের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে।

আর এই অস্বাভাবিকতা তাকে মোটেও বিস্মিত করলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *