১০. সমকালীন প্রতিক্রিয়া
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর পরে প্রায় প্রতিটি পত্রিকাই গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করে। কোনো-কোনো পত্রিকায় সম্পাদকীয়, স্মৃতি-নিবন্ধ এবং শোকসভার বিবরণও ছাপা হয়। এছাড়া প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় এবং মিঠেখালিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘রুদ্রমেলা’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের পর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নামে মেলা অনুষ্ঠানের রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অকালপ্রয়াত কবির জন্যে তথা বাংলা কবিতার জন্যে এটি কম গৌরবের নয়।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে নিয়ে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’-এর সাহিত্য সাময়িকী পৃষ্ঠা একটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। সত্তর দশকের অন্যতম কবি আবু হাসান শাহারিয়ারের উদ্যোগে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত এই বিশেষ সংখ্যায় স্মৃতিকথা ও নিবন্ধ রচনা করেন শান্তনু কায়সার (রুদ্র ও মিলনের স্মৃতি), রণজিৎ বিশ্বাস (রুদ্র’র মৃত্যুতে অনুভূতির একটি দুটি), তসলিমা নাসরিন (রুদ্র ফিরে আসুক), খসরু চৌধুরী (রুদ্র মুহম্মদ
হ), রিশিত খান (আমার প্রিয় রুদ্রদা), সৈয়দ তারিক (রুদ্রদা’, প্রশান্ত মৃধা (নিজভূমে পরবাসী রুদ্র) এবং ইমতিয়ার শামীম (ভুল মানুষের অরণ্যে)। কবির স্মরণে কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্র গোপ (এক নীহারিকার গল্প, রেজা সেলিম (যখন দেখবে তুমি) এবং সঞ্জীব চৌধুরী (ল্যাম্পপোস্ট)। এছাড়া এ-সংখ্যায় শিল্পসংস্কৃতি-অঙ্গনের বিভিন্ন ব্যক্তির শোকপ্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করেছেন ব্রাত্য রাইসু। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী, শহীদুজ্জামান ফিরোজ, মাহবুব বারী, মঈনুল আহসান সাবের, মনিরা কায়েস, মিনার মাহমুদ, আমান-উদ-দৌলা, আহমেদ ফারুক হাসান, ফরিদ কবির, আবু হাসান শাহরিয়ার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ইস্তেকবাল হোসেন, রহীম শাহ প্রমুখ। উল্লেখযোগ্য। এ-সংখ্যার সম্পাদনা-সহযোগী ছিলেন শুচি সৈয়দ। বলা যেতে পারে, আবু হাসান শাহরিয়ারই প্রয়াত কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সংখ্যাটি বেরিয়েছিল ৪ জুলাই ১৯৯১ রণজিৎ বিশ্বাস লিখেছেন–
রুদ্রের এই ত্বরিত গমনের জন্যে কবিতাকেন্দ্রের ওদের দুঃখ হবে না। এক পলিতকেশ বৃদ্ধের অভিভাবকত্বে তাকে সংস্কৃতির কাস্টোডিয়ান মেনে যারা কবিতার ব্যভিচার মচ্ছবে জমা হয়েছিল তারা বরং তাদের সাথে যাদের ভেদাভেদ বড় সামান্যই–যারা সবকিছুতে ধর্ম টানে, যারা প্রগতির শত্রু, তারা স্বস্ত হবে। হবে এ জন্যে যে, তারা ও তাদের পোষকরা জানে না, এই উপকূলে ওদের মৌলিক মুখোশ তুলে নিয়ে ছোবল হানার জন্যে ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ দাবি উত্থানের জন্যে যে রুদ্র জন্ম নেয়, সে রুদ্র মৃত্যুতে হারায় না, শুধু বহু ভাগে ভাগ হয়ে যায়।(৫৩)
এছাড়া ‘কবিতার দশদিক’ ও ‘কিছুধ্বনি’ নামের দুটি কবিতাপত্র রুদ্রসংখ্যা প্রকাশ করে। ‘কবিতার দশদিক’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১-এর সেপ্টেম্বর মাসে। এর সম্পাদক ছিলেন সমরেশ দেবনাথ এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন তপন বাগচী। এ-সংখ্যায় রুদ্র-সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সমরেশ দেবনাথ, কাজল চক্রবতী, ফেরদৌস নাহার ও তপন বাগচী। ‘কিছুধ্বনি’ প্রকাশিত হয় অক্টোবর মাসে। এটি প্রকাশিত হয় ‘মিলন মাহমুদ ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’-সংখ্যা হিসেবে। এতে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই পুনর্মুদ্রিত। রুদ্র সম্পর্কে যাদের লেখা মুদ্রিত হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শামসুর রাহমান, আহমদ রফিক, সুশান্ত মজুমদার, ফরহাদ মজহার, বজলুল করিম বাহার, রবিউল হুসাইন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আশরাফ আহমদ, প্রশান্ত মৃধা, বনজীর আহমদ, আনওয়ার। আহমদ, কাজী রব, শান্তনু কায়সার, অসীম সাহা, জুলফিকার মতিন, মুজিবুল হক কবির, নাসিমা সুলতানা, জরিনা আখতার, ফেরদৌস নাহার, মোহাম্মদ সাদিক, অশীষ উর রহমান, মারুফ রায়হান, রশীদ হায়দার, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইকবাল আজিজ, তসলিমা নাসরিন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আলমগীর রেজা চৌধুরী, নাসির আহমেদ, সাজেদুল আউয়াল প্রমুখ।
রুদ্রের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে কলকাতা থেকে রুদ্রের বন্ধু কবি কাজল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে প্রামাণ্য রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’ শীর্ষক গ্রন্থ। এটি নিঃসন্দেহে একটি মহতী উদ্যোগ। কাজল চক্রবর্তীর রুদ্র-প্রেমের পাশাপাশি কবিতা-প্রেমও এখানে বেশি সক্রিয় বলে ধারণা করতে পারি। রুদ্রকে নিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক স্মৃতিনিবন্ধ লিখেছেন তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু-কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান ও কবি কামাল চৌধুরী। আর রুদ্রের কবিতা বিশ্লেষণ করে ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন তপন বাগচী।
রুদ্রের কবিতা ও সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সংক্ষেপে যথার্থ মূল্যায়ন করতে এগিয়ে এসেছেন দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান–
অনেক বছর আগে আমরা ক’জন টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেয়ে। পথে বেশ হৈ-হল্লা করে, কোনোরকম অশালীন আচরণ থেকে নিজেদের বিরত রেখে, একটি শুশানের ধারে তৃষ্ণা মিটিয়ে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছলাম টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলেই তো? না কি অন্য কোনো জায়গায়? যাক, তাতে কিছু আসে যায় না। স্মৃতি প্রতারণা করতেই পারে। পথে প্রচুর সময় কাটিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম। আমাদের দেখে, বলা যেতে পারে, অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাগণ যুগপৎ আনন্দিত এবং আশ্বস্ত হলেন। যথারীতি উদ্বোধনী সঙ্গীতের পরে কবিতাপাঠ শুরু হলো। তরুণ, অনতি তরুণ অনেকেই কবিতা পড়লেন। একজন তরুণ কবি, শুশ্রুমণ্ডিত, কিঞ্চিৎ খর্বকায় কিন্তু স্বাস্থ্যবান, মুখস্থ পড়ে গেলেন নিজের দীর্ঘ কবিতা। চমৎকার উচ্চারণ, সংগীতময় আবৃত্তির ঢঙ। কবিতাটিতে ছিল দেশজ উপাদান, গ্রামীণ জীবনের ছাপ। তার আবৃত্তি আমার ভালো লাগলো, কবি করতালিও পেলেন প্রচুর। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে সেবারই প্রথম দেখলাম। সেই সন্ধ্যার আগে তার কবিতার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। পরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কোনো-কোনো কবিতা পড়ার সুযোগ পাই। তাঁর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতাটি প্রথম আমার মনে দাগ কাটে। সেই কবিতাটি পড়ে আমার মনে হয়, আমাদের কাব্যক্ষেত্রে আরেকজন নতুন কবির আবির্ভাব ঘটলো। সেই কবিতার ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ-নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান’ এবং ’চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়’ সহজে ভোলার নয়। ক’দিন আগে জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত রুদ্রের স্মরণসভায় আমাদের অগ্রজ কথাশিল্পী একটি অনুধাবনযোগ্য মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মতে, কখনো কখনো একটি কি দুটি পংক্তি একজন কবিকে স্মরণীয় করে রাখে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সন্দেহ নেই, সেই স্মরণীয়তা অর্জন করেছেন।
দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই রুদ্রের প্রেরণার উৎস। এই তরুণ নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম উচ্চারণে। দুঃখের বিষয়, সেই প্রতিবাদী কণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল; এতে তার মিত্ররা, সহযোদ্ধারা শোকাহত এবং শত্রুরা, অনুমান করি, পুলকিত।
আমার সঙ্গে বহু তরুণ কবির পরিচয় আছে, তাদের কয়েকজনের হৃদ্যতাও লাভ করেছি। আমি যখন বিষণ্ণ, মনমরা হয়ে থাকি, তখন তাদের কেউ কেউ আমাকে চাঙা করে তোলেন নানা ধরনের অনুপ্রেরণাময় কথা বলে। আমার প্রতি তরুণদের এই ভালোবাসাকে আমি অত্যন্ত মূল্যবান জ্ঞান করি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল সত্য; কিন্তু আমাদের মধ্যে জানি না কেন, ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি তিনি আমার বাসায় এসেছেন কয়েকবার, একাধিকবার নিজের কবিতার বই উপহার দিয়েছেন, কবিতা বিষয়ে ক্ষণস্থায়ী আলাপ-আলোচনা করেছেন। আমাদের কথাবার্তায় কখনো কোনো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে বলে মনে পড়ে না। নিজে থেকে কেউ কিছু না-বললে কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার কৌতূহল গ্রীবা বাড়ায় না কখনো। নিজের জীবনযাত্রা বিষয়ে তিনি আমাকে কিছুই বলেন নি, যদিও কেউ কেউ, রুদ্রের সুহৃদ তারা, তার জীবনের কিছু তথ্য আমার কাছে পরিবেশন করেছেন। এই তরুণ কবির মধ্যে একধরনের বাউণ্ডুলেপনা ছিল যা তাকে সুস্থির হতে দেয় নি, নিজেকে পুড়িয়েছেন আতশবাজির মতো। যারা এই দৃশ্য দেখে তাদের কাছে সেটা মনোহর, চিত্তাকর্ষক মনে হয়, কিন্তু যে পোড়ে তার পক্ষে এই জ্বলতে থাকা অত্যন্ত যন্ত্রণাময়। আমার মনে পড়ছে আমাদের অকালমৃত আরেক কবির কথা। সেই অসুস্থ, ক্ষীণায়ু কবি তিনটি কাব্যগ্রন্থে তার প্রতিভার নির্ভুল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আমি আবুল হাসানের কথা বলছি। তরুণদের অত্যন্ত প্রিয় এই কবি, যার কবিতার বহু পংক্তি তরুণ কবিদের কণ্ঠস্থ, আবুল হাসানের মধ্যেও ছিল একধরনের বাউণ্ডুলেপনা, অস্থিরতা। আমার বিবেচনায়, আবুল হাসান রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী কবি, যদিও রুদ্র তার প্রতিভাবান অগ্রজ কবির তুলনায় ছন্দের দিক থেকে অধিক দক্ষ, কিছু কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও। রুদ্রকে ছন্দ বিষয়ে বেশি ভাবতে দেখেছি, শেষের দিকে তিনি মাত্রাবৃত্তের দিকে প্রবল ঝুঁকেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, তার সাম্প্রতিক কবিতা-সিরিজ ‘খুঁটিনাটি খুনসুটির’ আগাগোড়া মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এই সিরিজ কি তিনি শেষ করে যেতে পেরেছেন? তার ঘনিষ্ঠ কবি-বন্ধুরা বলতে পারবেন।
মনে পড়ে ১৯৮৭ সালের এক সন্ধ্যেবেলা, তখন আমি ‘দৈনিক বাংলা’ এবং ‘বিচিত্রা’ থেকে পদত্যাগ করেছি, রুদ্র টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বললেন। জানালেন, তিনি এবং তার বন্ধু মোহন রায়হান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, প্রগতিশীল কবিদের একটি মিলনক্ষেত্র থাকা দরকার। আমি যেন তাদের সঙ্গে থাকি, দাবি জানালেন অকুণ্ঠিত কণ্ঠে। এই দাবিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় নি আমার। যদিও আমি সব সময় সংগঠনে অনাগ্রহী, তবু তখন রুদ্রের ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করি নি। তখন আমাদের কাব্যক্ষেত্রে চলছিল একধরনের তাবেদারিপ্রিয়, অশ্লীল অনাচার। এই অনাচার প্রতিরোধের জন্য, কিছু একটা করা দরকার, এরকম ইচ্ছা আমিও মনে লালন করছিলাম। কবিদের প্রতিবাদী মিছিলের পুরোভাগে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো অভাজনকে। গঠিত হলো জাতীয় কবিতা পরিষদ। এই উপলক্ষে রুদ্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কবিদের পক্ষে দীর্ঘকাল কোনো সংগঠনবদ্ধ হয়ে থাকা মুশকিল, এই ধারণা আমার দৃঢ়মূল। গোড়ার দিকে রুদ্র জাতীয় কবিতা পরিষদ নিয়ে। মেতে থাকলেও তিনি প্রায়শই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতেন, ডুব দিতেন বহু দিনের জন্য; মাসের পর মাস তার দেখা মিলতো না। শুনেছিলাম, তিনি চিংড়ির কারবারি হতে চেয়েছিলেন। সেই কারবারে প্রচুর টাকা গচ্চা দেন তিনি। এ-বছর হঠাৎ তিনি, কারণ আমার অজ্ঞাত, রুদ্র জাতীয় পরিষদ বিষয়ে অত্যুৎসাহী হয়ে ওঠেন। আমি নিজে এখন পরিষদক্লান্ত। প্রৌঢ়ত্বের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছি, জানি না কতদিন আর বাঁচব। জীবনের শেষপর্বে শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলম চালাতে হয় প্রায় সর্বক্ষণ; কবিতার সংসর্গ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। এরকম পরিস্থিতি আমার পক্ষে কল্যাণকর নয়। কোনো কবির পক্ষেই নয়।
ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হলো। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সত্তর দশকের অন্যতম বিশিষ্ট কবি, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে লোকান্তরিত হলেন। আবুল হাসান মারা যান আরো কম বয়সে, তখনও তিনি তিরিশের কোঠায় পা রাখেন নি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আমার যৌবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্রত্যেক যুগেই কবিতা ভোগ নেয়। একদা-উজ্জ্বল, অধুনা বিস্মৃত সুকুমার সরকার নামের এক তরুণ কবির অকালমৃত্যু উপলক্ষে বুদ্ধদেব এই উক্তি করেন। মাত্র পনেরো বছরের ব্যবধানে আমাদের দু’জন কবি আবুল হাসান এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে ভোগ নিলো কবিতা। এই নাতিদীর্ঘ রচনায় আমি রুদ্রের কাব্যক্ষমতা নির্ণয়ের কোনো চেষ্টা করি নি। এটা এখনও সম্ভব নয়; কারণ এই মুহূর্তে আমরা শোকার্ত, আবেগতাড়িত; মূল্যায়ন বিষয়ে অন্যমনস্ক। প্রতিশ্রুতিশীল এই কবির কাব্যক্ষমতা পূর্ণ বিকশিত হবার আগেই মৃত্যু লোভাতুর তস্করের মতো চুরি করে নিয়ে গেল তাকে। তার শেষের দিকের কবিতা পড়ে মনে হচ্ছিলো, তাঁর কাব্য নতন বাক নিতে যাচ্ছে, অন্তত আজকের কাগজে সদ্য প্রকাশিত কবিতাটি পড়ে আমি বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি, রুদ্র তার প্রাক্তন কাব্যভাবনা থেকে কিছুটা হলেও সরে যাচ্ছিলেন। রুদ্র বলেছেন, ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম। আমরা কি কোনোদিন ফিরে পাবো সেই স্বর্ণগ্রাম, যার জন্যে এত ব্যাকুলতা ছিল সেই তরুণ কবির মর্মমূলে?(৫৪)
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের তারুণ্যের অহংকার। তরুণদের পাশাপাশি এই কবি প্রবীণ এবং প্রতিষ্ঠিত কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। রুদ্র সম্পর্কে তরুণ, অতিতরুণরা যেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তেমনি সমকালীন এবং অগ্রজ কবিরা ও জানিয়েছেন অকুণ্ঠ ভালোবাসা। পঞ্চাশের কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘স্বপ্নচারী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর জন্যে কে দায়ী?’ শীর্ষক রচনায় আমরা পাই–
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আসল নাম শেখ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কিন্তু সে লিখতো না সেই নাম। আমি ওর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর ডাক নাম কি ছিলো রুদ্র? বন্ধুটি জানালো, না রুদ্র ওর ডাক নাম ছিলো না–ও নিজেই নিজের নামের সঙ্গে যোগ করেছে রুদ্র এবং নিজের বানানপদ্ধতি অনুসারে লিখেছে শহিদুল্লাহ–শহীদুল্লাহ নয়। কেমন অদ্ভুত না? ঠিক আর দশজনের মতো ও নয়, এমনকি আর দশজন কবির মতোও নয়–ও যেন ছিলো ঠিক ওর নিজের মতোই। রুদ্র। রুদ্র এই শব্দটি ওর নামের সঙ্গে গেঁথে দিয়ে ও বুঝি খুব ভালোই করেছিলো। নইলে আমরা ওকে বুঝি যথাযথ শনাক্ত করতে পারতাম না। নইলে বুঝি ওর চেহারার সঙ্গে ওর স্বভাবের সঙ্গে ও কবিতার সঙ্গে ওই নামটি মোটেই মানানসই হতো না। রুদ্রের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা তেমন ছিল না। ওর সঙ্গে আমার যে আত্মীয়তা ছিলো তা কবিতার। ওর কবিতার মধ্যে রাজনীতি ভীষণভাবে ছিলো কিন্তু তবু ওর কবিতাকে আমি বরাবরই। পছন্দ করে এসেছি। কেননা আমার সব সময়ই মনে হয়েছে ও যা লিখছে সেই সব পংক্তিমালার কাছে ওর একটা কমিটমেন্ট আছে। যা আমাদের অনেক তথাকথিত বিপ্লবী কবির মধ্যেই নেই।
‘যে যুবক মিছিলে নেমেছে, বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে, আকণ্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে, অনাহারে উড়নচণ্ডি ঘুরেছে–ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে। যে পুরুষ এক শ্যামল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে, যে পুরুষ ক্ষুধা মৃত্যু আর বেদনার কবিতা লিখেছে। এখনো লিখছে বিক্ষোভ আর স্বপ্নের কবিতা–সে আমি।
আমি একা। এই ব্রহ্মাণ্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা। আমার অন্তর রক্তাক্ত। আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত। আমার শরীর লাবন্যহীন। আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত। আমার জিভ কাটা। তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে। আমাকে তাড়ায়…।’
উপরে উল্লেখিত উদ্ধৃতি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার বই ‘মানুষের মানচিত্রের প্রারম্ভের স্বীকারোক্তি’ থেকে নেয়া। আমার একান্ত ধারণা এই বাক্যগুলো শুধু কাব্য করে বলা নয়–শুধু কবিতার মতোন করে উচ্চারিত নয়। এগুলো রুদ্রের অন্তর্গত বিশ্বাসের লিপিবদ্ধ ধ্বনি। এই কথাগুলোর সঙ্গে তার জীবনের, তার কবিতার এবং তার কমিটমেন্টের একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কোথাও মিথ্যে ভাষণ নেই। জীবন তাকে নির্মমভাবে তাড়িত করেছে প্রতিমুহূর্তে–বিশ্বাস তাকে শক্তি যুগিয়েছে অফুরন্ত, প্রেম তাকে নিয়ে গেছে শ্যামল নারীর কাছে। কিন্তু রুদ্র শেষপর্যন্ত তার পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা ‘বিট্রেইড’ হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সে ভেবেছে তারা ওর মতোই সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী নির্মাণের সৈনিক, তারা তাকে অবলীলাক্রমে ‘বিট্রে’ করেছে। জীবনের কাছে তার যেন প্রার্থনা ছিলো সেই এক পৃথিবীর যা তার একান্ত নিজস্ব নির্মাণ–বাস্তবে যার অবস্থান প্রায় অসম্ভব। কিন্তু রুদ্র ছিলো স্বপ্নচারী, তাই সত্যবাদীও। সেই স্বপ্নের পৃথিবীকে নির্মাণ করাকে সে তার জাগতিক দায়িত্ব বলে মনে করেছিলো–সংগ্রাম করেছিলো। ভেবেছিলো ওর সহযাত্রীরাও সব সংগ্রামী। কিন্তু তারাতো ছিলো না। এই ‘বিট্রেয়াল’ তাকে এক অচিন্ত্যনীয় মনোকষ্টের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলো। এবং এই মনোকষ্টকে সে ভুলে থাকতে চেয়েছে সর্বক্ষণ। প্রকৃতির সঙ্গে, রমণীর সাহচর্যে এবং আকণ্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে পরিণামে নিজের অজান্তেই সে নিজেই নিজকে ‘বিট্রে’ করে ফেলেছে।
রুদ্র তার গ্রন্থের স্বীকারোক্তিতে কিছু লাইন লিখেছে, যাকে অনায়াসে একটি স্বপ্ন বলে উল্লেখ করা যায়। রুদ্র লিখেছে সেই এক পৃথিবীর কথা যখন, মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায় নি।
‘আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায় আর আমাদের পুরুষরা শিকার করে ঘাই হরিন, সীল আর খরগোশ। আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি। জলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি আর প্রশংসা করি পৃথিবীর। আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি, পৃথিবীর পূনিমা রাতের ঝলোমলো জ্যোৎস্নায়, পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা সবুজ পাহাড়ের অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে। তখন কী গৌরব আমাদের মৃত্যু!’
কী অদ্ভুত সুন্দর এক স্বপ্নের মধ্যে ডুবেছিলো রুদ্র! স্বপ্নের মধ্যেই এক নির্মম মৃত্যু হল তার!
কে দায়ী তার মৃত্যর জন্যে? তার স্বপ্নচারিতা? তার বাস্তব সংগ্রাম? তার আকণ্ঠ পান? তার শ্যামল রমণীর কাছ থেকে নির্মম নির্বাসন? নাকি সেই ‘বিট্রেয়াল’ যা তার সব কিছুকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল। কে জবাব দেবে?(৫৫)
রুদ্রের ‘মানুষের মানচিত্র’ প্রকাশের পর খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ মে ১৯৮৭ তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবিতায় নব্য জসীমিজম’ শীর্ষক একটি রচনায় এই বইটি এবং সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’ বইটির একটি তীর্যক সমালোচনা প্রকাশ পায়। রাশেদ মিনহাজ ছদানামে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের সেই সমালোচনাটি ‘বাংলাদেশের কবিতা : অন্তরঙ্গ অবলোকন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রবন্ধে লেখা হয়েছে—
*****
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষের মানচিত্র’ ‘নব্য জসীমীয়’ কাব্যভাষা ব্যবহারের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। গ্রন্থের ভূমিকায় এ-বিষয়ে তার প্রতীতি স্পষ্ট, নির্দ্বিধ। রুদ্র লিখেছেন, আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের কবিতায় এক নোতুন বলদীপ্ত তাজা কোমল ভাষার নির্মান হতে চলেছে। প্রচলিত অভিজাত ভাষার ক্রিয়াপদ অক্ষুণ্ণ রেখে লোকজ শব্দের মিশালের মধ্যেই রয়েছে অই নোতুন ভাষার প্রানশক্তি। লক্ষ্যণীয় যে, রুদ্র যে ‘তাজা কোমল নোতুন ভাষার কথা বলেছেন তা সৃষ্টি হচ্ছে স্বাভাবিক প্রচলিত কাব্যভাষার মধ্যে লোকজ শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে অধিক পরিমাণে শব্দ আহরণ করে। আল মাহমুদ যে পথ অনুসরণ করেছিলেন, রুদ্র তারই অনুসারী, যদিও মাত্রাগতভাবে তিনি আল মাহমুদের তুলনায় লোকজ উচ্চারণের অনেক বেশি কাছাকাছি। ক্রিয়াপদ-সম্পর্কিত তার অচেতনতাও তাকে বেশি লগ্ন করেছে আল মাহমুদের সাথে, সৈয়দ শামসুল হকের সাথে ততটা নয়। কেননা রুদ্রের নিজেরই অনুভব–’সম্প্রতি কেউ কেউ অবিকল আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। কাজটি ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এতে ব্যাপক সাহিত্যিক। অরাজকতার সষ্টি হতে পারে। স্পষ্ট যে, তিনি সৈয়দ হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’ এর দিকেই আঙুলি তুলেছেন। যদিও কালপরম্পরার বিচারে মনে হয় ‘মানুষের মানচিত্রের’ প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ও প্রাণস্পন্দন প্রথমোক্ত গ্রন্থ থেকেই আহৃত।
কিন্তু তবু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, সৈয়দ হকের তুলনায়, অনেক বেশি জসীমীয়। তাঁর মানচিত্রগুলোর ভাষা, বিষয়বস্তু ও প্রকরণ বিচার করে তাদের জসীমউদ্দীনের রচনা বলে চালিয়ে দেয়া যেত, যদি (পাঠকবৃন্দ পরবর্তী বাক্যাংশ সবিশেষ লক্ষ্য করুন) সেখানে প্রাগ্রসর সামাজিক অঙ্গীকারের স্পষ্ট অনুভবের যোজনাটি না থাকতো। রুদ্র প্রকরণে জসীমীয়, অনুভবে আধুনিক; মূলত হয়ত সচেতনভাবেই ঐ কথিত পল্লিকবির সহজ সার্থকতার এবং হৃদয়গামিতার উদারহণ রুদ্রকে উৎসাহিত করেছে। এবং সম্ভবত তার সাথে রয়েছে জনগণের কবি হওয়ার জন্য জনগণের অভ্যস্ত ও পরিচিত কাব্যরীতির সাহায্য নেয়ার ইচ্ছা। সন্দেহ কি, আমাদের ক্ষুদ্র সাক্ষর সমাজের বৃহত্তর অংশ এখনো পাঠাভ্যাসে জসীমউদ্দীন কিংবা নজরুলের বাতাবরণ থেকে উত্তরণের রুচি আয়ত্ত করে নি। সেই সঙ্গে আছে Bardic quality অর্জনের সচেতন প্রয়াস, মুকন্দ দাস প্রমুখ কিংবদন্তির চারণদের দীপ্র সংগ্রামিতার পুনরাবাহন। বত্রিশটি কবিতার সংগ্রন্থনা এই কাব্যটি। প্রতিটি কবিতা বিশপংক্তির, যা চার সমান স্তবকে বিন্যস্ত। কোন কোন কবিতায় অন্ত্যমিলের বিন্যাস রয়েছে, কখকখ কিংবা কখখক। আবার অনেক কবিতায় তদ্রপ বিন্যাস রক্ষিত হয় নি। বিষয়বস্তু গ্রামীণ অন্ত্যজ জীবনের বিবিধ সুখদুঃখ, বঞ্চনা ও সামাজিক পীড়ন-নির্যাতনের চিত্র। পংক্তিগুলোর দৈর্ঘ্য একটি আত্যন্তিক হাহাকারের সুর যুক্ত করেছে কবিতায় এবং তা উচ্চারণে হৃদ্যতা ও কারুণ্য যতটা দিয়েছে, দার্চ দেয় নি ততটা।
*****
আলোচিত দুটি গ্রন্থের বিশিষ্ট কাব্যভাষা সম্পর্কে উপসংহারে উৎসাহ প্রকাশ করা যাচ্ছে না। সম্ভবত সংশ্লিষ্ট কবিদ্বয় কাব্যের নতুন ভাষা সম্পর্কে কোন স্থির প্রতীতিতে নিষ্ঠাবান নন। সৈয়দ হক পুরো ব্যাপারটিকে নিয়েছেন খেলা হিসাবে; তিনি এই ভাষাভঙ্গিকে প্রচলিত ভাষারূপের বিকল্প ভাবেন না, শুধু কদাচিৎ ব্যতিক্রমের চটকদার বাহন করতে চান। তাঁর নিজের কথায়–একজন মার্কিন নিগ্রো কবি, একজন স্কটিশ কবি, একজন আফ্রিকান কবি যদি লৌকিক বাগভঙ্গি, শব্দ এবং উচ্চারণ ব্যবহার করে সার্থক ও স্মরণীয় কবিতা লিখতে পারেন, আমরাই বা বাংলায় সে সম্ভাবনা পরীক্ষা করে কেন দেখব না? কখনো কখনো?–পাশাপাশি?–অথবা একই সঙ্গে?’ (ভূমিকা)।
সৈয়দ হক এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর এই দুটো পরীক্ষার পর আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি যে, এই লৌকিক ভাষাভঙ্গির প্রকাশক্ষমতা খুব সীমিত। শুধুমাত্র গ্রামীণ লোকজীবনের কিছু কিছু বিষয় এই ভাষায় হার্দ্য-কারুণ্য কিংবা চটুল বিভা ঠমকের জননী হতে পারে; আধুনিক নগর-কেন্দ্রিক ও জটিল জীবনের সহগামিনী। হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোন কবি যদি আধুনিক জীবনযন্ত্রণার প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে এই ভাষাকে বেছে নেন তবে তা হবে সলাজ অপ্রতিভ গ্রাম্যবালাকে দিয়ে টুইস্ট নাচানোর মতো হাস্যকর ও করুণ। ফলত ‘নব্য জসীমীয়’ কাব্যভাষার সীমাবদ্ধতা ও অতিসারল্যই এর সম্ভাবনাকে সীমিত করে এবং খুব বেশিসংখ্যক কবি যে এই সংশয়াকুল সাফল্যের পথে এগুবেন না, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমনকি সৈয়দ হক কিংবা রুদ্রও বিল্ববৃক্ষের প্রতারক ছায়া দ্বারা পুনর্বার প্রলুব্ধ হবেন, এমন ধারণা করি না।(৫৬)
কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের এই ছদ্মবেশী আলোচনার জবাবে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নব্য জসীমিজম ও বহমান লোককাব্যধারা’ শীর্ষক একটি রচনা লিখেছিলেন, যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াও বিরূপ মন্তব্যের একটি কড়া জবাব রয়েছে। রচনাটি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর গদ্যরচনার নিদর্শন হিসেবে এ-গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। তবে আমার কথা এই যে, রুদ্রের মৃত্যুর পরে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন তার বক্তব্য থেকে সরে এসে এই বইটির প্রশংসায় বলেছেন–
আমাদের কবিতার মানচিত্রে কোথায় স্থান হবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর? প্রশ্নটির নিরাবেগ উত্তর খোঁজা সম্ভব নয় এই মুহূর্তে। মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তাকে, অসময়ে। এক-অর্থে রুদ্র ভাগ্যবান; পৃথিবীর তাবৎ অকালপ্রয়াত কবিদের মতো তিনিও ঝরে গেলেন বার্ধক্যের আগে, জরাগ্রস্ত তিগোনাসের দীর্ঘজীবন তার নাই-বা হলো। অকালমৃত্যু স্বয়ং অবশ্য কোন অম্লান মহিমার নিয়ামক নয়, যেমন নয় অতিদীর্ঘ আয়ুষ্মানতাও। আমাদের দেশে, ষাট পেরিয়ে ভালো কবিতা লিখেছেন এমন উদাহরণ বিরল। বেশিরভাগ কবি, তাদের আয়ুবিষুব অতিক্রমণের পরই হয় লেখা ছেড়ে দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, অকাব্যিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন, নয়তো নিজেরই পূর্বরচনার অনুকরণে নিরত হন। রুদ্র মরে গিয়ে রেখে গেলেন তার যৌবমূর্তি, যা কখনো ম্লান হবে না। ডোরিয়ান গ্রে তার নিজের তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলেন যেন তিনি প্রাপ্ত হন ঐ চিত্রের অনশ্বর যৌবন আর চিত্রটি যেন তার বয়স, তার প্রৌঢ়ত্ব শরীরে তুলে নিয়ে বুড়ো হতে থাকে। কিন্তু রুদ্র’র শুশ্রুমণ্ডিত যৌবমূর্তি আর তার কবিতা কখনও জরার বলিরেখায় কলঙ্কিত হবে না–এটি তার সৌভাগ্য। মৃত্যু কোন দুর্ঘট নয়, দুর্ঘট হলো বেঁচে থেকে মরে যেতে থাকা। আমাদের প্রধান কবিদের কাউকে কাউকে দেখে আজ একথা মনে হয়। কেন মৃত্যু হলো না একজন আল মাহমুদের, ‘সোনালী কাবিন’ লেখার পর?
*****
রুদ্রের ‘মানুষের মানচিত্র’ গ্রন্থটিকে আমি একটি ব্যতিক্রমী কাব্যপ্রয়াস বলে মনে করি। সত্তরের দশকের অন্য কারো হাতে তুলনাযোগ্য একটি রচনা আমরা পাই নি। মানুষের মানচিত্র’-এর শিল্পসাফল্য এখানে বিবেচনা করছি না। এর আঙ্গিক পরীক্ষামূলক। আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের পালাগান, কথকতা এবং হার্দ জীবনাবেগকে মিশিয়ে রুদ্র যে কাজটি উপস্থাপন করেছেন এই কাব্যে, তা প্রশংসনীয় ও একক। অন্যত্র আমি এই আঙ্গিকের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে, অন্য কবিগণ রুদ্র প্রদর্শিত গাথা-কবিতার ফর্মকে অবলম্বন না করলেই ভালো করবেন। কিন্তু তাতে রুদ্রের কৃতিত্বের কোন ব্যত্যয় হবে না। সোনালী কাবিনের’ ঢঙে আরেকটি সনেটবন্ধ কেউ কি রচনা করতে চাইবেন? মানুষের মানচিত্রের’ সমাজভাবনা পরিশীলিত, হৃদ্য, মর্মস্পশী ও আন্তরিক। রুদ্র ভবিষ্যতে স্মৃত হবেন ঐ একটি কাব্যগ্রন্থের জন্যে –অকালপ্রয়াত একজন কবির জন্য সেটিও কম সৌভাগ্যের নয়।(৫৭)
জীবদ্দশায় তীর্যক মন্তব্য কিন্তু মৃত্যুর পরে প্রশংসা–এ-থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, প্রয়াত রুদ্র জীবিত রুদ্রের চেয়ে কম শক্তিশালী নন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা-জীবনের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। তার ‘রুদ্র অমলিন স্মৃতি’, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : দ্রোহ নিয়ে ঘুমিয়ে’, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ : সময়ের কবিতা স্মরণীয় কবিতা’, ‘এই শহরের তুর্যবাদক’ শীর্ষক রচনায় রুদ্র-সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার চেষ্টা রয়েছে। কামাল চৌধুরীর রচিত এই শহরের তুর্যবাদক’ লেখাটির পুরোটাই উদ্ধৃতিযোগ্য :
কবিতার সঙ্গে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মেলবন্ধনের শুরু অভিমান দিয়ে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’-এর প্রথম কবিতা ‘অভিমানের খেয়া’-র বিংশতি পঙক্তি বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন’। এই গভীর, অন্তর্ভেদী, ক্ষতার্ত, বিষাদিত ও আবেগময় উচ্চারণ তাঁর অভিমানের সারাৎসার। নীল অভিমানে পুড়ে একা একা কতটা জীবন? এই জিজ্ঞাসার অন্তর্দাহে ক্লিষ্ট, চাবুকের নির্মম অথচ মোহন আঘাতে জর্জরিত গ্লানিময় জীবনের ক্লেদে মাথা রেখেও প্রার্থনা করেছেন অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাই।’ এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই শোণিতের তীব্র আলোড়ন ও বিক্ষোভে ডেটলের শিশি, সাদা তুলো, পৃথিবীর রক্তমাখা করুণ কাপড় তছনছ করে জন্মের প্রথম চিৎকারের মতো বেরিয়ে আসে তার অন্তহীন আকুতি প্রকৃত কবির প্রবহমানতা ‘আমি সেই নতমুখ, পাথরের নিচের করুন বেদনার জল। আমি সেই অভিমান, আমাকে গ্রহন করো। (আমি সেই অভিমান)।
কিন্তু কার প্রতি এই অভিমান? সেই প্রথম নারী যার বিরহে দগ্ধ হয়েছে কবিতার প্রথম মসলিন, একাকীত্বের বেদনা দিয়ে যে তাকে ঋদ্ধ করেছে, সমর্পণ করেছে বিশাল বিপুল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য এক স্বপ্নলোকে? নাকি সমুদ্রের গর্ভজাত এক মানুষ, বন্দরের ভেঁপু শুনতে শুনতে উন্মুখর ফেনিল জলরাশির প্রমত্ত ঢেউয়ে ভেসে উপদ্রুত যে জনপদে এসে পড়লো সেই জনপদের মানুষের প্রতি? হয়তো দুটোই সত্য, কিন্তু প্রথম ধারণা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়–কারণ আমরা দেখেছি অভিমানের নির্যাস সীমাবদ্ধ থাকে নি ব্যক্তিসত্তায় বরং স্বদেশ ও স্বকালের উৎসঙ্গে পরিব্যাপ্ত হয়ে দ্রবীভূত হলো বাঙালির স্বাভাবিক চেতনাগত অভিমানের ধারায়। এভাবেই অঙ্কুরিত হলো কবিতার স্বপ্ন ডালপালা ছড়িয়ে শাখায় শাখায় রুক্ষ শীত আর বাহারী বসন্তের মিশেল দিয়ে পাতা ঝরানো এবং পাতা গজানোর বন্দনা শুরু হলো। এই অভিযাত্রা অনায়াস ছিলো না। প্রথাগত সমাজের বিরুদ্ধতা, তারুণ্যের বেহিসেবিপনা, দুর্বিনীত বেপরোয়া জীবন প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সবগুলো প্রকরণ অনুসন্ধান করে সব গরল আত্মসাৎ করার বোদলেয়ারীয় অনুষঙ্গ রুদ্র’র জন্য তৈরি করেছিলো একটি গোলাপ-সড়ক। একই সঙ্গে কাটা আর ফুলের আঘাত, সুন্দর ও অসুন্দরের উল্লাস, জ্যোৎস্না ও অন্ধকারের কোলাহল, অমৃত ও গরলের সুধাসিন্ধু তার জীবনকে তছনছ করে, ভাসিয়ে নিয়ে মাঝপথে ডাহুকের মতো নিঃশব্দ নীল অভিমানে চেনা জগৎ থেকে সরিয়ে অদৃশ্য ও নিভৃত এক জ্যোৎস্নার কাছে সমর্পণ করলো তাকে। এভাবেই ১৯৫৫ সালের ১৬ অক্টোবর জন্ম নেওয়া, মংলা বন্দরের কাছে মিঠেখালি গ্রামে বেড়ে-ওঠা বেপরোয়া, দ্রোহী, অস্থির, রোমান্টিক ও আশাবাদী এক কবি ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত হলেন। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে কাব্যলক্ষীর অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগের তালিকায় আবুল হাসান, হুমায়ুন কবির, মিলন মাহমুদ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহরও নাম।
দুই.
আমাদের সাহিত্যে রুদ্র’র আগমন সত্তরের দশকে। নানা কারণে এই দশক বাংলাদেশের কবিতার পালাবাদলের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্ন এই দশকে রূপ নিয়েছে বাস্তবে। আমরা পেয়ে গেছি একটি সার্বভৌম দেশ, নিজস্ব একটি মানচিত্র, একটি স্বাধীন পতাকা। একদিকে প্রাপ্তির আনন্দ, নতুন প্রত্যাশা, সম্ভাবনায় উন্মুখর সময়–অন্যদিকে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অস্থিরতা, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শোকাবহ ঘটনা, পরাজিত শক্তির পুনরাবিভাব, স্বৈরশাসন–সময়ের এই দ্বৈরথে ছিন্নভিন্ন যখন দেশের আতা তখন কবিরাই যেন হয়ে উঠলেন জাতির বিবেক। ফরাসি বিপ্লবউত্তর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সামাজিক স্থিতি ও সংহতি রক্ষার্থে যেমন এগিয়ে এসেছিলেন লেখককুল–সেরকম আমাদের লেখকরাও এগিয়ে এলেন দ্বিধাহীন চিত্তে। এই সময়ে আমাদের কাব্য-অঙ্গন উদ্ভাসিত হলো সংখ্যাতীত নক্ষত্রের আগমনে। কবিতার শিল্প-সত্যকে অস্বীকার না-করে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে শোক, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের অগ্নিগর্ভ চরণ ছড়ালেন তারা সবখানে। সময়ের প্রয়োজনে সংহত ও নির্ভীক কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত ও মহিমান্বিত প্লাবনে সত্তর দশক হয়ে উঠলো যেন সকল দশকের কবিদের মিলনমেলা। আত্মজিজ্ঞাসার নিবিড়তম মুহূর্তটিকে তারা বিলিয়ে দিলেন দেশপ্রেমের শাশ্বত আকুতিতে। এই সময়ে রুদ্র আর্বিভূত হলেন ‘উপদ্রুত উপকূল’ নিয়ে। উৎসর্গপত্রে লিখলেন এক মানবীয় উচ্চারণ–’থামাও এই মর্মঘাতী করুন বিনাশ/এই ঘোর অপচয় রোধ করে হত্যার প্লাবন। রবীন্দ্রনাথের ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’-এর মতোই দীপ্রকণ্ঠে আমাদের শোনালেন ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরানো শকুন’ (বাতাসে লাশের গন্ধ)–সময়ের এই সত্য। আর একের পর এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের তূর্যাদনে ভরে তুললেন আকাশ।
রুদ্রকে তাই বলা যায় সময়ের সন্তান। কবির জন্য সময় এক প্রপঞ্চ–একে হয়তো অতিক্রম করা যায় কিন্তু এক দূরপনেয় স্পর্শ লেগে থাকে চরণরেখায়। কবি আকাশচারী নন–হ্যাঁেমারের অডিসিয়াসের মতো ক্যালিপসোর মায়াবি দ্বীপের বন্দীও নন। কবি বাস্তব মানুষ, পসিডনের দৈব ঝঞ্ঝা পেরিয়ে নয়, বাস্তব জীবনের সংক্ষুব্ধ সমুদ্রতরঙ্গ পাড়ি দিয়ে তাঁকে পৌঁছতে হয় উদ্দিষ্টে। রোমান্টিকেরা প্রেরণাবাদী–এই প্রেরণা অতীত অভিজ্ঞতা ও দৃশ্যমান জগৎ থেকে আহরিত। রুদ্র’র ক্ষেত্রেও তার প্রেরণার উৎস স্বদেশ ও সমাজ। রুদ্র একাধারে রোমান্টিক ও আধুনিক। নগরজীবনের ক্লেদ ও গতিময়তা, গ্রামজীবনের সরল বিস্তার একই সঙ্গে উঠে এসেছে তাঁর সংবেদী ও স্বতঃস্ফূর্ত কবিতায়। যা কিছু কবিতার নয়, তা থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে–এই অনুভব থেকে তিনি হতে চান নি ‘অলৌকিক শুদ্ধতা’-সম্পন্ন, যদিও বোদলেয়ারীয় অনুযঙ্গ থেকে মুক্ত নয় তাঁর কবিতা। বিশেষত প্রথম দিকের রচনায়, যখন তার সম্পাদনায় ‘অনামিকার অন্য চোখ ও চয়াত্তোরের প্রসব যন্ত্রণা’ সংকলনটি বেরোয়, তখন তা ছিলো স্পষ্ট। কারণ বুদ্ধদেব বসুর কল্যাণে বিষাদ ও হতাশা, ক্লেদ ও কালিমা, পাপ ও পতন এই ধরনের অতি নারকীয়, গরলদুষ্ট শব্দরাজিকে আমরা মেনে নিয়েছি বোদলেয়ারীয় চৈতন্যের অভিজ্ঞান হিসেবে। কিন্তু বোদলেয়ার কথিত ‘পরম ড্যান্ডি’ তিনি ছিলেন না। বরং কবিতায় স্বাভাবিক লাবণ্য ও স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিলো অভিপ্রেত। কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে কবিতাকে তিনি করতে চান নি প্রস্তরময়। লুটাই গুটাই ফুটাই পাথরে প্রথাসিদ্ধির ফুল/ আমার এখন ডানা মেলবার মুহূর্ত শেষতম/ অথচ অবাক চুলের শাখায় ধরেছে আমার দেখি/ খুব সকালের আকাশের মতো অম্লান আমলকি’ (অবচেতনের পথঘাট)–কবিতায় এই সারল্যই ছিলো তার আকাঙ্ক্ষিত। আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার লক্ষণ থেকেও মুক্ত তার কবিতা।
তবে, জাপানি হাইকু কবিতার মতো পুকুরে ব্যাঙের লাফিয়ে পড়ায় পানিতে যে ক্ষীণ আলোড়ন ওঠে–এ রকম তাৎক্ষণিক আবেগ উদ্দীপক হিসেবে খুব কমই এসেছে তার কবিতায়। রুদ্র’র কবিতার উদ্দীপক, প্রেরণা বা সম্বন্ধ আমাদের অতি চেনা। তাতে দেশ হয়েছে সমগ্র সত্তা, অন্তহীন আবেগ। নেরুদা, আরাগ, এলুয়ার কিংবা সুভাষ, সুকান্ত’র মতো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য তিনি ছিলেন না কিন্তু তাদের মতোই সমাজ ও রাজনীতির যোগাযোগের বিষয়টিকে মূল্য দিতেন। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখাল’ নামে যে কবি-লেখক গোষ্ঠীর সদস্য তিনি ছিলেন কবিতা ও রাজনীতিকে মেলাবার একটা উদযোগ তাদের ছিলো। কিন্তু শেষাবধি এই উদ্দীপ্তি রুদ্র আর দু’একজন ছাড়া কাজ করে নি সবার মধ্যে। সমাজকে ভেঙে সর্বমানবের আত্মপ্রকাশের উপযোগী করে তুলতে চেয়েছেন রুদ্র–সাম্য, স্বাধীনতা, মানবতার জয়মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, সম্মিলিত সাম্য জীবন খুঁজে/ আমরা সরাবো ব্যক্তিক জঞ্জাল/ আমরা ছিড়বো চেতনায় শৃংখল/ মুক্তবিশ্বে পাখি হবো দুইজনে’ (পাখিদের গল্প)। এভাবে শব্দকে শাণিত করেছেন সর্বপ্রকার শৃংখলমুক্তির লক্ষ্যে। নিজেকে আখ্যা দিয়েছেন ‘শব্দ-শ্রমিক হিসেবে–যে শব্দ-শ্রমিক চেতনার হাতুড়ি পেটায়, মানুষের রক্তমজ্জায় শব্দ-প্রেরণা বুনে দেয়। সমাজটাকে বদলানোর কবির কাজ নয়, রাজনীতিকের বা সমাজ সংস্কারকের কাজ–একথা জানতেন তিনি কিন্তু বিশ্বাস করতেন কবিতা সমাজ-পরিবর্তনের প্রেরণা হতে পারে, পারে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বহন করে নিয়ে যেতে ‘হাত ধরো হাত ধরো/ আমি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তে এনে দেব তৃতীয় পৃথিবীর শ্রেণীহীন কবিতার ভুবন’ (প্রত্যাশার প্রতিশ্রুতি)–এই আপাত ইউটোপিয়ান প্রতিশ্রুতি এই বোধ থেকেই উৎসারিত।
অনেকটা শেলির মতো বেপরোয়া ও অস্থির, সংসারে অতৃপ্ত সন্ন্যাসী, ঝড়ো বাতাসের এই কবি একপর্যায়ে কবিতাকে বানাতে চেয়েছেন অস্ত্র–’শুধু রক্ত দিয়ে আজ পাল্টানো যাবে না জীবন/ শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না ডালে/ শুধু মৃত্যু দিয়ে পাল্টানো যাবে না আঁধার। শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না। দেশে/…অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই স্বপ্নবান অস্ত্র চাই হাতে’ (অস্ত্র চাই)। বিশেষত আশির স্বৈরশাসনের দিনগুলোতে সুতীব্র চরণে জাগাতে চেয়েছেন মানুষকে। মিছিলে নেমেছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই সময়ের কবিতায় কখনো কখনো তাকে মনে হয়েছে উচ্চকিত স্লোগানমুখর–কবিতার নান্দনিকতাও যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হয় নি তা নয়–কিন্তু এসব তিনি করেছেন সচেতনভাবেই, কারণ বিপ্লবের জন্য স্লোগানের প্রয়োজন রয়েছে–লেনিনীয় এই অনুভবে তার বিশ্বাস ছিলো। সমাজবদলের স্বপ্নে তাই ‘ইশতেহার’ রচনা করেছেন, তাতে বন্দনা করেছেন আদিম কৌম সমাজের, সাহস ও সরলতাকে ফিরে পেতে চেয়েছেন, কামনা করেছেন ‘আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষদের মতো/ স্বাস্থ্যবান কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরুষদীপ্ত হবে। আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী/ আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদ’ (ইশতেহার)। মৌলিক মুখোশ ছেড়ে সত্যিকারের মানুষের উন্মোচন চেয়েছেন। দেশ ও সমাজ-বিচ্ছিন্ন কবিদের ভর্ৎসনা করেছেন নপুংসক বলে।
বাংলা কবিতায় এই প্রতিবাদী ধারার উদগাতা নজরুল ইসলাম। ’রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা’–তিনি এক থেকে বহুজনে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের এই মন্ত্র। চল্লিশে এসে সুভাষ, সুকান্ত’র হাতে এই ধারা আরো বেগবান হয়েছে। এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন মঙ্গলাচরণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, আহসান হাবীর, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদও কখনো কখনো এসে মিলেছেন এই প্রবাহের মোহনায়। ষাটের নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, আবুল হাসান, ফরহাদ মযহার ও মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ ষাট ও সত্তরের অনেক কবিই এই ধারার সঙ্গে কমবেশি সম্পৃক্ত। রুদ্র পূর্ববর্তীদের কর্ষিত ভূমিখণ্ডে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা–প্রতিবাদের নতুন বীজ।
তিন.
বিষয়বস্তু বা প্রকরণের নতুন কোনো দ্যোতনায় নয়, অভূতপূর্ব কণ্ঠের তুর্যভেরিতে নয়, বরং একধরনের সরল ও সপ্রাণ কবিতার অস্তিত্ব, তারুণ্যের অপরিমেয় এক দীপ্তি ও ওজস্বিতার এক সদম্ভ উপস্থিতি তাকে আলাদা করেছে সামসময়িকদের কোলাহল ও ভিড় থেকে। প্রথম দিকের কবিতায় জীবনানন্দ উপস্থিত ছিলেন, এমনকি ষাটের আবুল হাসান কিংবা নির্মলেন্দু গুণের প্রভাবও ছিল কিছুটা। বাংলাদেশের কবিতার চল্লিশ, পঞ্চাশ কিংবা ষাটের ধারা থেকে আলাদা হয়ে যান নি তিনি। তবে পূর্ববর্তীদের প্রভাব একসময় কাটিয়ে ওঠেন। ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ গ্রন্থে তিনি ব্যক্ত করেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য, শৌর্যবীর্য ও সুন্দরের কাছে প্রত্যাবর্তনের আকাক্ষা–যার প্রবাহ শেষাবধি অব্যাহত ছিলো। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ, ‘মানুষের মানচিত্র’ যাকে বলা হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজ, এতে তিনি মানসজগতে কবিতার নতুন এক মানচিত্রের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন। কবিতায় নিরীক্ষাপ্রবণতাও দেখা দেয়। এই গ্রন্থের সিরিজ কবিতাগুলো এর স্বাক্ষরবাহী, এতে বিশ লাইন ও বাইশ মাত্রার সমিল পয়ারে লেখা বত্রিশটি কবিতায় তুলে এনেছেন দক্ষিণাঞ্চলীয় গ্রামজীবনের অনুষঙ্গ। তালাক হয়েছে তার আশ্বিনের শেষদিন অপর বেলায়/ অকারনে। লোকে বলে সোয়ামির দিকে তার ছিলো না নজর/ পাড়া বেড়ানিয়া মাগি যার-তার ঘরে গেছে সন্ধ্যা কি ফজর/ অপরাধ বড়ো তার, পাথর ভেঙেছে সে যে মাটির ডেলায়। (দশম কবিতা)। অন্ধকার পৃথিবীকে শুধু কিছু তারা জ্বলে, দূরের নক্ষত্র/ ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। পাটের পচানি থেকে গন্ধ আনে রাতের বাতাস/ পুরোনো কবর খুঁড়ে শেয়ালেরা বের করে আধ-পচা লাশ/ হোই কে যায়? কে যায়? পৃথিবীর অন্ধকারে চৌকিদার চলে।’ (সপ্তম কবিতা)।’ভাসান যে দিতে চাও, কোন দেশে যাবা? যাবা সে কোন বন্দরে/ আমারে একলা থুয়ে? এই ঘর, যৈবনের কে দেবে পাহারা? / এমন কদম ফুল-ফোঁটা ফুল থুয়ে কেউ পরবাসে যায়!/ তুমি কেন যেতে চাও বুঝি সব, তবু এই পরান মানে না’ (চতুর্থ কবিতা)।
এভাবে স্তবকের পর স্তবক সাজিয়েছেন, একটি অতিক্রম করে গেছে আরেকটিকে, সমুদ্র থেকে উঠে এসে মিশে গেছে জনপদের কোলাহলে, ঢেউয়ের পর ঢেউ ভেঙেছে ভেতরের লিরিকটানে, কখনো হয়ে উঠেছে অভাবী মানুষের ছবি, কখনো বাউলের একতারা, কখনো ক্ষোভের উদ্গার।
আঞ্চলিক ভাষা ও ক্রিয়াপদের ব্যবহারে, কাঠামোগত বিন্যাসে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভেতর’-এর কবিতাগুলির সঙ্গে ‘মানুষের মানচিত্রে’র সাযুজ্য রয়েছে। গ্রামচেতনায় ও ভাষাগত প্রক্ষেপণে মিল রয়েছে আল মাহমুদের সঙ্গেও কিন্তু তারপরও এর অস্তিত্ব আলাদা, স্বাতন্ত্র সামগ্রিকতায়। এতে কোথাও কোথাও পূর্ববর্তীদের প্রতিধ্বনি আছে, শব্দের পুনরাবৃত্তি আছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সুলতানের ছবির মতো বিশাল ক্যানভাসে উঠে এসেছে অন্তরঙ্গ জীবনের চালচিত্র। একটি কবিতাকে আলাদা করা যায় না অন্যটি থেকে, একটি উঠে এসেছে অন্যটির পরিপূরক হিসাবে। এভাবে তৈরি হয়েছে এক অখণ্ড সত্তা। রুদ্র’র কবিসত্তার যথার্থ স্ফুরণ ঘটেছে এই সিরিজের কবিতাগুলোতে।
রুদ্র সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছেন, সেই সঙ্গে কবিতারও। পঁয়ত্রিশ বছরের নাতিদীর্ঘ ঝড়ো জীবনে লিখেছেনও প্রচুর। জীবদ্দশায় সাতটি কবিতার বই বেরিয়েছে, মৃত্যুর পরে আরো দুটি। কাব্যনাট্য লিখেছেন, গল্প লিখেছেন–বেশ কটি গানও লিখেছেন। একটি গানের দলও প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজ গ্রামে ‘অন্তর বাজাও’ নামে। বৈষয়িক সংসারে থিতু হতে পারেন নি। গড়ে তুলেছিলেন কবিতার সংসার। রুদ্র নেই, তার অতৃপ্ত কবিতাগুলো আছে–তারাই জ্বেলে রেখেছে আজ দীপাধার।(৫৮)
সত্তর দশকের আরেক কবি-প্রাবন্ধিক তুষার দাশ রুদ্রের ব্যক্তিসত্তা ও কবিসত্তা সম্পর্কে জানিয়েছেন একটি আন্তরিক রচনায়–
One sails to understand why in this death-cluttered world, the death of a poet–at a young and early age–should evoke so much frustration, so much grief. With what yarn does the poet weave the fine fabric of his personal relationship? Why does it seem that a very near one passes away with the death of a poet?
And if that poet happens to be a friend, class-mate and the companion of many a day and night addas? A splattering of instant adjectives will not define the situation. Silence, then, becomes more expressive.
I did not intend to write anything about Rudra for it would have taken volumes. The vivid, glowing memories of 13/14 years spent together can only be written down in a series, over a long period. Only then perhaps, a glimpse of Rudra, a fragment of him, a brief profile can be given.
A few words should be put forward instantly–if memorable lines can be termed poetry, some of Rudra’s lines can be recalled best among our contemporary writers and poets.
Rudra was a friend. But as a person he was on a higher plain because he had all the courage which we never had. From the stage of Jatiya Kabita Parishad he spoke out in the face of numerous adversaries : ‘I am reading out my poeins in defiance of the autocratic government and all the autocracies inside this very Kabita Parishad.’ It was not possible for us to protest as he did. There, Rudra was the most courageous soul of our brave tiine. To call him a friend is a source of pride.
He possessed a natural simplicity. We came to the city at a much later age and yet we were consumed by an urban crookedness, inferiority complex, deception and slyness. But nothing could destroy his simplicity. His smile reflected his simple personality and was familiar lo all acquaintances.
Rudra the poet had tremendous confidence and conviction in his own creative self. This carned him the honour of a poet. He considered himself a writer and was always very vocal about the payment of a writer’s honorarium. He gathered many young writers to form a union, though unfortunately the unity lasted a very short time.
He had an unusual organisational capability. He had formed many organisations in his lifetime. Unfortunately, many of these had a short life while from some others he himself was ousted. His simplicity and gullibility were the reasons.
It is amazing how quickly a dear friend turns into a memory. Bits of images gradually compose a collage and that’s all that is left of a friend in the end. ‘I’m Rudra,’ eager bright eyes shining in a bearded face, shoulder length shock of unruly hair, an impressive figure in red punjabi holds out his hand–late 1977. The face reappears in the pages of Chitrali, accompanied by poems and several months later in liefum, with his Dhabuman Trainer Galpo. At the mufassiltown we excitedly pore over the literary page of Ittefaq, which printed Rudra’s Poems– a regular member of our haunts!
We become constant companions. inseparable from morning till night. He would give odd accounts of his daily activities. ‘I have started practising yoga every night.’ We laughed. But he went on ‘No, No, it’s not a matter of Joke. One has to take care of oneself.’ One sighs at such remembrance.
Everday, washing upto his knees and elbows twice in the afternoon. he would smilingly inform us, ‘This keeps the mind fresh.’ His habitual routine of keeping the body and soul fit seems strange now. None of us bothered to do such things.
Believing in the clairvoyance of poets. We wonder whether he knew about his own physical decay which would eventually kill him. To be valued through death seems to be a practice in bad taste. Death is a mere passing incident, a genius should be recognised regardless of it. Noble works should be evaluated on their own account. Our tendency to decide such things instantly creates complexities.
After Ruda’s first book of verses Upadruta Upakul came out. I did a number of reviews of that. I will hold my comments on Rudra’s complete works till our emotions subside. I would not go for evaluation engulfed with emotions. That woid be the best way of honouring him.
I wrote on him at the beginning of his creative journey and am writing now when that journey has ended. Now I wish to touch him in his entirety. Rudra the man is no longer, but a greater truth is, the poet can be found in his works, the Rudra who is more true than when he was alive, the real him.(৫৯)
কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান ছিলেন রুদ্রের অকৃত্রিম সহচর। তার স্মৃতিচারণাও রুদ্র সম্পর্কে অনেক কৌতূহলের মীমাংসা দেয়–
কোনো কোনো সংবাদ এতই বেদনাক্রান্ত যে শোনামাত্র বুকে খিল ধরে যায়। বিশ্বাস হতে চায় না। যেমন বিশ্বাস হয় নি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর সংবাদ। শোনামাত্র থমকে যেতে হল। কাব্যমহল যেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে নড়ে চড়ে উঠল। রুদ্রের চরম শত্রুও হল স্তম্ভিত। সবারই এক কথা ‘কী হল! রুদ্র মরে গেল! সত্যি সত্যি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পৃথিবী থেকে বিদায় নিল!’
অনেকেরই রুদ্রের অকালমৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে নি। কেউ কেউ বলছে প্রচণ্ড আত্মঅভিমানেই রুদ্র আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল। কেউ কেউ আবার রুদ্রের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার আবেগে রুদ্রের অকালমৃত্যুর জন্যে তার সাবেক জীবনসঙ্গিনীকে দায়ী করছে। তাদের ভাষ্য, ‘রুদ্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী তার প্রেম। অন্তর্ঘাতী প্রেমই রুদ্রকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। একজন তরুণ কবি সেদিন টিএসসিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘রুদ্ররা মরে কেন? কেন। রুদ্রদের মতো প্রতিবাদী কবিদের এভাবে মরতে হয়?’
তরুণ বন্ধুটির কথার কী জবাব দেব আমি? জবাব দেবার স্বাভাবিক ভাষা কে যেন কেড়ে নিয়ে গেছে। আমি নির্বাক নিষ্পন্দন শুনছিলাম শুধু। হয়তো এভাবেই শুনতে হবে আজীবন।
যখনই ভাবি, রুদ্র নেই, ঠিক তখনই অতীত এবং বর্তমান এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমি যে আরও বিমূঢ় হয়ে পড়ি। নিজেকে মনে হয় জোসনাহীন চাঁদ, পৃথিবী অভিমান করে তার সমস্ত আলো কেড়ে নিয়ে গেছে। আর আমি গহীন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি একা। কী বেদনাদায়ক এই একাকিত্ব! কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা! এর চেয়ে মৃত্যু অনেক সুখের, অনেক আনন্দের!
সবাই বলছে, আমার বন্ধুকে তার প্রেম শুষে নিয়েছে। যুক্তি দিয়ে কথাটি উড়িয়ে দেয়া যায়। আমি অবশ্য যুক্তি অযুক্তি কোনোটাতেই আপাতত যাব না। আমার বন্ধু মারা গেছে, এই সত্যই চিরসত্য। সেই বেদনা আমার সমগ্র জীবনের উপহার। আমার আর কী বলার আছে!
রুদ্রের মরদেহ দেখতে গিয়েছিল তার সাবেক স্ত্রী। পরদিন সেই প্রসঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে ওর পরিবারের একজন সদস্যা আমার কাছে অভিযোগ করেছিল। বলেছিল, ‘সে কেন এসেছিল? সেই তো আমার দাদাকে তিলে তিলে হত্যা করেছে। আবার কেন আসে সে?’
আমি তাকে কোনো জবাব দিতে পারি নি। জবাব দেবার কিছু ছিলও না। রুদ্র নিজেই তখন সব জবাবের ঊর্ধ্বে।
তাই বলে প্রশ্ন থেমে যায় নি। আচ্ছায়-আসরে সর্বত্র একই প্রশ্ন। সবারই এককথা, রুদ্রের মৃত্যুর জন্য তার অশান্ত প্রেমই বহুলাংশে দায়ী?
কথাটা কি ঠিক?
সবাই বলছে ঠিক। আমি অবশ্য তাদের কথার সঙ্গে সুর মেলাই নি। কিছুই বলি নি। একদিনে একই কথা বারবার শুনতে শুনতে আমি নিজেই হাঁফিয়ে উঠেছি। একা একা ভেবেছি, সত্যি কি তাই? রুদ্রকে তার প্রেমই এমন এলোমেলো করে দিয়েছিল? সত্যি সত্যি প্রেমই কি তাকে ঘরবিমুখ করেছিল?
এ প্রসঙ্গে আমি বোধ করি কিছু কিছু তার ভেতরের খবর জানি। জানার ব্যাপারটা অবশ্য অনেকেই জানেন। তবে ভেতরের কথাগুলো হয়তো অনেকেই জানেন না রুদ্র তার কষ্টের কথাগুলো কখনই কাউকে বলতে চাইত না। অনেক সময় দেখেছি, কেউ যদি তার ঘর ভেঙে যাওয়া নিয়ে কথা তুলত, বেশির ভাগ সময়ই রুদ্র এড়িয়ে যেত,–হয় বলত, ‘ঘর নেই বলেইতো পৃথিবী আমার ঘর।’ কখনই রুদ্র তার সাবেক স্ত্রী সম্পর্কে কোনো আক্ষেপ, বেদনা বা অভিযোগ করত না। একান্তে যখন দু’জন বসতাম, তখন কিছু কিছু কথা কিছু কিছু ঘটনা সে আমাকে বলত। কিংবা কখনও পাশাপাশি শুয়ে দু’চারটে বিক্ষিপ্ত ঘটনা সে বলেছে। তাতেই বুঝেছি, কী ভয়াবহ বেদনা-কষ্টের পাহাড় ওর বুকে অহর্নিশি জমাট বেঁধে থেকেছে। ওর দীর্ঘশ্বাসে আমি কষ্টের হাহাকার–ধ্বনি শুনতে পেতাম। কখনও কখনও বিমর্ষ গলায় বলে উঠত, একজীবনে বোধ হয় সব পাওয়া হয় না।
আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ তাইতো, একজীবনে কি সব পাওয়া যায়? তবুও তো তুই কম পাস নি। তোর কি জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে?’
সঙ্গে সঙ্গে বলত, ‘না, নেই। সবার কি সব হয়? আমার না-হয় ঘর না-ই হল।’
রুদ্র এমনই। সে কখনও মচকাতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্টের পাড় ভাঙত, এটা সে অন্যের কাছে লুকিয়ে রাখতে পারলেও আমার কাছে লুকিয়ে রাখতে পারত না। ধরা পড়ে যেত। কিংবা হয়তো বলার জন্যই সে আমার কাছে ধরা দিত। আমি যে কাছে থেকে ওর প্রেম দেখেছি, ওর বিয়ে দেখেছি, কাবিননামায় স্বাক্ষী হয়েছি, ঘর দেখেছি, আবার সেই ঘর ভেঙে যেতেও দেখেছি। খুবই কাছে থেকে, খুবই খোলাচোখে দৃশ্যগুলো আমার সামনে ঘটতে দেখেছি। কী করে রুদ্র আমাকে এড়িয়ে যাবে? তার অব্যক্ত বেদনার কাতরধ্বনি কী করে আমার কাছে চেপে রাখে? আমি যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলাম। এমনভাবে জড়িয়ে ছিলাম কষ্টগুলো ওর নয়, আমার। আমার বুকেই। বেজে চলত ওর কষ্টের সুর। না বলে ও-ই বা থাকে কী করে? ওর ছিন্নভিন্ন হৃদয় নিজে থেকেই কথা বলে উঠত। যেন কথাগুলো কথা নয়, বুক ছিঁড়ে যাওয়া কষ্টের নহর।(৬০)
রুদ্র-সম্পর্কে আরো একটি স্মৃতিচারণমূলক রচনা উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি বিচিন্তা পত্রিকার জন্যে লিখেছিলেন কথাসাহিত্যিক রিশিত খান–
যদি কেউ এসে বলে রুদ্রদা’কে এই ক্ষণিক আগে সেই দেখলাম নীলক্ষেতের ‘ইত্যাদি’র সামনে, মুখভর্তি দাড়ি, ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে চিরপরিচিত ব্যাগ, চকরা-বকরা শার্ট, জিন্সের প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে, হাসছে প্রাণখুলে, উচ্ছল হাসিতে আশপাশ মাতিয়ে তুলেছে। যদি কেউ বলে টিএসসি থেকে এলাম রুদ্রদা’র আড্ডা হয়ে–এই উঠেই সরাসরি এসেছি। কাফেটারিয়ার সবুজ চত্বরে রুদ্রদা আড্ডা দিচ্ছে। অসংখ্য তরুণদের নিয়ে আসর জমিয়েছে। বড় জমকালো সে আসর। ঝাকড়া চুলে ঝুটি বেঁধে অসম সাহসী এই তরুণ কবি গান গাইছে, তার নিজের লেখা গান–
‘ভেতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…
ভাল আছি, ভাল থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো…’
*****
প্রিয় পাঠক, কেউ কি বিশ্বাস করবেন? বিশ্বাস করবেন কি রুদ্রদা’ সত্যি সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একেবারেই যে চলে যাওয়া–যেখানে গেলে মানুষ আর কখনোই ফেরে না। জানি, বিশ্বাস না-করলেও বিশ্বাস যে করতেই হবে। এই চুড়ান্ত; এটাই সত্য।
বিশ্বাস না-করে উপায় নেই–সত্যি সত্যি আমাদের সবার প্রিয় এই কবিমানুষটি শেষপর্যন্ত চলে গেলেন মাত্র ৩৪ বছর কয়েক মাস বয়সে।
*****
‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে পুরনো সেই শকুন’–সেই ১৯৭৬-এ লেখা। কবির বয়স তখন সবে ২০। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখছেন মাত্র। দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কবিতার অসাধারণ এই পংক্তিগুলো রাজধানীসহ দেশের আনাচে-কানাচে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে। কবিতার লাইন পোস্টার হচ্ছে। মিছিলে-মিছিলে স্লোগান হয়ে ফিরছে।
*****
কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্যের দিকেও ঝুঁকে পড়েন। একেবারে শেষের দিকে ঝুঁকে পড়েন গান রচনায়ও। সঙ্গীত পরিষদ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈকালিক সময়গুলো ওখানটাতেই ব্যয় করতেন। পাকস্থলীতে এবং পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে লিখে গেছেন অনবরত। ছুটেছেন অহর্নিশ, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। আকস্মিক হারিয়ে গেছেন, নিখোঁজ থেকেছেন দীর্ঘদিন। ক্লান্ত হয়েছেন–আবার নতুনভাবে ফিরে এসেছেন। তাঁর প্রাণের এই শহরে, রাজধানীতে।
আড্ডা জমিয়েছেন। আসর মাত করেছেন। বুক টান করে ঝাকড়াচুলের বাবরি দুলিয়ে দরাজ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
রুদ্রদা’ চলে গেলেন। বড়ই নিঃশব্দে এ চলে-যাওয়া। বড়ই অসময়ে। একটি সুন্দর ও স্বপ্নময় দিনের কল্পনা করে তিনি ঘুম থেকে জেগেছিলেন খুব ভোরে। এ-জাগাই ছিল তার শেষ জাগা। তিনি আর কোনোদিন জাগবেন না। অনন্তকালের জন্য ঘুমের রাজ্যে চলে গেছেন। কী পরম শন্তিতে ঘুমোচ্ছেন–ছায়া সুনিবিড় মিঠেখালি গ্রামের সোদা মাটির গন্ধে!
এই কোলাহলমুখর পৃথিবীতে রুদ্রদা আর আসবে না–আর কোনোদিন শুনতে পাবো তার কবিতা, গান, আবৃত্তি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া অসাধারণ সব সৃষ্টি, সেইসব কীর্তিগুলো? সেগুলো তো থাকবে। সে-সব তো হারিয়ে যাবার নয়, সে-সব তো মরে যাবার নয়, সে-সব তো জীবন্ত, অমর!
সেগুলোই রুদ্রদা’র কণ্ঠে একসময় কথা কয়ে উঠবে। বলবে, ‘রুদ্র, মরে নি, রুদ্র আছে, রুদ্র এভাবেই থাকবে অনন্তকাল।(৬১)
রুদ্রের মৃত্যুতে বিভিন্ন পত্রিকায় নানা রকমভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একটি সাপ্তাহিকে তরুণ সাংবাদিক পীর হাবীবুর রহমানের প্রতিবেদনটি ছিল এরকম–
শোকার্ত স্মরণ
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : অকালে হারানো এক অহংকারের ফুল
যে মানুষ খুব সহজেই তার লেখনির গুণে রৌদ্রের উত্তাপের মতো ঝলসে দিতো তারুণ্যেকে, তার নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। ৭০ দশকের এক তুখোড় কবি। আগুনের মতো যিনি লিখতেন, মানুষকে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে রাজপথে ঐক্যের মিছিলে নামাতেন, সেই প্রিয়তম মানুষ, সাহসী যৌবনের প্রতীক, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের মাঝে আর নেই।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মূলত স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী হিসেবে ছিলেন আপোষহীন। রুদ্রের এটা শুধু নিজের অহংকার নয়, এ অহংকার আমাদের সমস্ত প্রগতিশীল সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক মানুষের।
****
তোমার মৃত্যুতে যতটুকু দুঃখবোধ জন্মেছে ভেতরে, কবিতা উৎসব মঞ্চে এ-জাতির অহংকার কামরুল হাসানকে হারিয়েও আমি এতটুকু দুঃখবোধ অনুভব করি নি। কারণ সর্বজন শ্রদ্ধেয় কামরুল হাসানের বয়স আর তোমার মৃত্যুকালীন বয়সের তফাতই আমাদের বেশি শোকাহত করেছে। তোমার মৃত্যুতে কলাভবন, মধুরক্যান্টিন, টিএসসি, মতিহারের মায়াবি চত্বরে আজ শোকের ছায়া। এই তো তুমি বাংলা একাডেমীর বইমেলায় কী প্রাণোচ্ছল জীবনের আড্ডায় মেতে উঠেছো! এ সবকিছুই আজ শুধু স্মৃতি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তোমার সাথে পরিচিত হবার একটা ইচ্ছে সব সময় ছিল, এ আমার অবচেতন মনের তোমার প্রতি আকর্ষণ ছাড়া কিছু ছিল না। তোমার মৃত্যুসংবাদ আমাকে অনুভব করিয়েছে কতটুকু ভালোবাসা ছিল তোমার প্রতি। কতদিন তোমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম, তোমার চোখের দিকে কতদিন তাকালাম তবুও কথা বলা হলো না। আমার কলম যদি কবিতার জন্ম দিতে জানতো তাহলে হয়তো তোমার সাথে আমার খুব চমৎকার সম্পর্ক হতো।
তোমার স্বৈরাচারবিরোধী আর সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কবিতাই তোমার প্রতি এ ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে তোমার কবিতা বাতাসে লাশের গন্ধ আমাদেরকে সাহসী করে তুলতো। আমাদের অস্তিত্বের শেকড় মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তোমার নৈতিক সংহতির কারণে আজ তোমার মৃত্যুতে প্রতিটি শহরেই মানুষ শোকাহত হয়েছে। সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মের জন্য তোমার মেধা প্রতিনিয়ত কাজ করেছে। কলম চলেছে অবিরত একটি ভালো কবিতা লেখার জন্য। তোমার তারুণ্যের সহযাত্রী কবি কামাল মাহমুদের সাথে তোমার মৃত্যুর কদিন পূর্বেও তোমাকে নিয়ে আমার সামান্য আলাপ হয়েছে। তার কাছেই জেনেছি বন্ধুমহলে তুমি ছিলে উচ্ছল প্রাণবন্ত। তোমার এ উচ্ছল তারুণ্যের উত্তরাধিকার হোক আগামী প্রজন্ম। যে নারী শেষ সময়গুলোতে তোমাকে নিঃসঙ্গ জীবনে যন্ত্রণা দিয়েছে, যে তার কবিতায় তোমাকে অপমান করেছে, সে নারীর প্রতি তোমার ভালোবাসার পরিধি কতটুকু জানি না, তবে এটুকু জানি আমাদের কাছ থেকে ঘৃণা আর করুণা ছাড়া আর কিছু পাবার কথা নয়। তোমার শেষ কবিতার একটি লাইন–’নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর নিজেকে দ্যাখা হয় না। নিজেকে তুমি দেখতে না পারলেও তুমি দেখেছো এদেশ, দেশের মাটি, মানুষ এবং তার সংস্কৃতিকে। আর তাই বলা যায়, এ-দেশকে যে ভালোবাসে সে তোমাকে ভালোবাসবেই। জীবনধারণের জন্য যে চায় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সে তোমাকে লালন করবেই। এ-জনপদের মাটি ও মানুষের সাথে যে মানুষ মিশে গেছে, তার হৃদয়ে তোমার অস্তিত্ব অমলিন।
তোমার মৃত্যুতে আয়োজিত শোকসভায় আমাদের সাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ, সতোর প্রতীক শওকত ওসমান ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। তোমার আত্মার শান্তির জন্য এরচে বড় কী হতে পারে!
কাগজকে দেয়া কথায় শওকত ওসমান বলেন,–’অকালমৃত্যু-অপমৃত্যু তো বাংলাদেশের দৈনন্দিন কাহিনী। সেখানে কবির সহসা প্রয়াণ আরো মর্মন্তুদ। কারণ, তাদের বাণী–এমনকি একটি পংক্তি আমাদের হাজার মৃত্যুর মুখে জীবনের চিত্রকল্প সৃষ্টি করে। ‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’। এমন মাভৈ বাণীর জন্যই তো আমরা কবির শরণাপন্ন হই। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আকস্মিক তিরোধান আমাকে বহুদিন স্বস্তি দেবে না কোনো কাজে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর যখন চাপাইনবাবগঞ্জে ওরা জাতীয় পতাকা পোড়ায়, নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা জালালকে, দুরন্ত নামের ভাস্কর্য ভেঙে দেয় রাতের আঁধারে, সেই সময় তোমার কবিতার পংক্তি তোমাকে মুনীর চৌধুরী, শহিদুল্লাহ কায়সারের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে দাঁড় করায়।
তুমি সাহসী, প্রতিবাদী হলেও তোমার কবিতার পংক্তি শুধু স্লোগান নয়। তাই এ উপমহাদেশের নন্দিত কবি শামসুর রাহমান বলেন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সত্তর দশকের একজন বিশিষ্ট জনপ্রিয় কবি। তিনি প্রতিবাদী হওয়া সত্ত্বেও তার কবিতার শরীর থেকে নান্দনিক গুণাবলী ঝেড়ে ফেলেন নি, প্রাধান্য দেন নি চিৎকারকে। ছন্দ বিষয়ে তার মনোযোগ আমাকে মুগ্ধ করেছে, কারণ এটি আমাদের তরুণ কবিদের মধ্যে একটি বিরলদৃষ্ট গুণ। তার কবিত্বশক্তি পূর্ণ বিকশিত হবার আগেই মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল–এটি শুধু অত্যন্ত শোকাবহ ঘটনামাত্র নয়, আমাদের কাব্যক্ষেত্রের জন্যে এক মস্ত ক্ষতি, যা দীর্ঘকাল অনুভূত হবে।
কবি মোহাম্মদ রফিক বলেন,-রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের সেই দু’চারজন কবির অন্যতম, যারা সম্মিলিত কবিকর্মের ভিতর দিয়ে এই ভূ-খণ্ডে, এই সময়ে কর্মে নিয়োজিত মানুষের পেশি ও শ্রমের কবিতার নন্দন তৈরি করছিলেন, তার অকালমৃত্যুতে সাহিত্যের বড় ক্ষতি হল।
আহমদ ছফা’র ভেতর থেকে মৃত্যুশোকের আবেগ-আক্রান্ত উক্তি বেরিয়ে এসেছে, ‘আহ আফশোস’।
সাংবাদিক-সাহিত্যিক সালেহ চৌধুরী বলেন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর শোকসভায় হাজির হতে হবে এমনটা কখনো ভাবি নি। অভাবিত ঘটনা যখন এমন করে ঠাই করে নেয়, নিজেকেই খণ্ডিত অনুভব করি। রুদ্রের দ্রোহ বিস্তারিত হোক তরুণতর মানসে। রুদ্রর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
রুদ্র’র মৃত্যুতে দুঃখ এবং ক্ষোভে গল্পকার ইমাদাদুল হক মিলন বলেন,–রুদ্রর আততায়ী মৃত্যুকে আমি অভিশাপ দিই।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তুমি ছিলে অকালপ্রয়াত কবি হুমায়ুন কবির বা আবুল হাসানের প্রতিনিধি। প্রাণবন্ত জীবনের ইতি ঘটিয়ে তুমি চলে গেছো। তোমার মৃত্যুতে তোমার আজ্ঞা প্রিয় জায়গাগুলোতে কেমন যেন বেদনার ছায়া। শাহবাগ এভিন্যু যেন নীরবে কাঁদে। তোমার মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। তবু চাই তোমার প্রতিনিধি হয়ে আগামী প্রজন্মের কেউ আসুক। আড্ডার আসর জমিয়ে তুলুক। তুমি অমর থাকবে চিরকালের তারুণ্যের মাঝে–এ আমাদের অঙ্গীকার।(৬২)
পত্র-পত্রিকায় রুদ্র সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও রেডিও-টেলিভিশনে রুদ্র ছিলেন অনেকটা উপেক্ষিত। রুদ্র সম্পর্কে টেলিভিশনের অবহেলার চিত্র ফুটে উঠেছে বিচিন্তা’র প্রতিবেদক সুবল বণিকের প্রতিবেদনে–
সত্তরের দশকের দ্রোহী এবং প্রতিবাদী কবিপুরুষ অকালপ্রয়াত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে নিয়ে বিটিভি যে নির্লজ্জ কার্পণ্য দেখালো তার কোনো তুলনা নেই। রামপুরার কর্তারা মানসিক দারিদ্র এবং ক্লীবতার পক্ষে এতোটাই নিমজ্জিত এবং নতশির যে, মাথা উঁচিয়ে বৃহৎকে দেখার মতো শক্তি তাদের হারিয়ে গেছে। না হলে রুদ্রের মৃত্যু এভাবে উপেক্ষিত হতো না। কতো রাম-শ্যাম-যদু-মধু টেলিপর্দায় তাদের মুখশ্রী দেখালো, উদ্যাপিত হলো কতো পাপিষ্ঠের মৃত্যু, কিন্তু রুদ্র, হায় রুদ্রের জন্য একটুখানি সময় হলো না! এমন কি গত সপ্তাহে প্রচারিত ‘শিল্প ও সাহিত্য’ নামধেয় অনুষ্ঠানটিতে রুদ্রের কথা যাও একটু বলা হলো, সেও ভীষণ কার্পণ্য করে, রুদ্র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রাজ্ঞ পণ্ডিতের সে কী সাবধানতা! ভাবখানা ছিলো এই, বেশি বলা হয়ে গেলো। রুদ্র বুঝি তার প্রাপ্যের চাইতে বেশি পেয়ে গেলেন। প্রাজ্ঞতা এবং পাণ্ডিত্য কারো চেতনায় এমন তুষার এনে জমা করে যে মৃত্যুশোকও তার গায়ে লেগে প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। হায় রুদ্র, তোমার মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারী, এতো বড় কথা অমারা বলবো না, কিন্তু যারা ভাবে, তোমার মৃত্যু পাখির পালকের চেয়েও হালকা, তাদের প্রতি আমাদের সহস্র ধিক্কার।(৬৩)
রুদ্র সম্পর্কে এ-সময়ের উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকজন লেখক-কবির প্রতিক্রিয়া এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।
.
আবুবকর সিদ্দিক
বাংলাদেশের কবিতা জন্মলগ্নেই রাজনীতির নিয়তচক্রে বাঁধা পড়ে আছে। একটি অনুন্নত দরিদ্র দেশের এটাই ভাগ্যলিপি, যার নিদর্শন আমাদের কবিতার সর্বাঙ্গে যথেষ্ট প্রকট। এবং হয় তো এই পথের কবিতাগুলিই আমাদের সাহিত্যে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ববাহী। রুদ্রের কবিতা ঠিক এই নিরিখে বিচারের দাবি রাখে। বলা যায়, সময়ের খুব জরুরি দাবি মেটায় তাঁর কবিতা। আর সঙ্গে সঙ্গে এই শঙ্কাটাও চুপিসারে চলে আসে যে, রাজনীতির চাহিদা মেটাতে গিয়ে রুদ্র কবিতার কতখানি ক্ষতি করে গেল। উত্তরটা হচ্ছে এই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলাদেশের কবিতায় আজ একটি মরণোত্তর মৃত্যুহীন নাম। কেন? কারণ রুদ্র তার কবিতার সমাজ-বাস্তবতার আর্তনাদ ও শিল্পের শালীনতা–এই দুটোকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সমন্বিত করতে পেরেছে। এইটুকু না পারলে তার বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’ আর জসীমউদদীন-এর ‘মা যে জননী কান্দে এ-দুয়ের মধ্যেকার শুধু কালিক উত্তরণ নয়, আধুনিকতার মাত্রাগত বিবর্তন চিহ্নিত হতে পারত না। কাজেই আমি বলি, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা একদিকে যন্ত্রণার বিস্ফোরণ, অন্যদিকে নান্দনিক ব্যঞ্জনার একীভূত শিল্প। রুদ্র তাই আজও ঈর্ষণীয়ভাবে জনপ্রিয় এবং প্রথম শ্রেণীর কবি হিসেবে বরণীয়।৬৪
রফিক আজাদ
এদেশের দু-ধরনের লেখক কবিতা লেখে। এক–কবি, দুই–কবিতার পাঠক। কবিতার ঘনিষ্ঠ পাঠক মোটামুটি চলনসই এবং মুদ্রণযোগ্য কবিতা লিখতে পারে। এদের সংখ্যাই অধিক। কিন্তু কবি যিনি, তার রচনা-পাঠেই বোঝা যায় যে, তিনি কবি। তিনি হয়তো কবিতার পাঠক Turned into poet-এর চেয়ে আঙ্গিকগত ত্রুটিমুক্ত কবিতা না-ও লিখতে পারেন। কিন্তু তার কবিতায় যে বিদ্যুচ্চমক থাকে, তা কোনোক্রমেই। দ্বিতীয় স্তরের কবির রচনায় থাকে না। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন সকল অর্থেই সত্যিকার কবি। তাঁর কবিতার ভেতরে পূর্বোল্লিখিত বিদ্যুচ্চমক তো ছিলই, ছিল কাব্যের মুক্তির স্বাদ। সকল প্রকার কাব্যশাস্ত্রীয় বন্ধন মেনে নিয়েও রুদ্র কাব্যের বন্ধন মুক্তির পথে সফল পদচারণা করেছিলেন। তার কবিতায় ছিল টান টান Tention, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সফল কবির কবিতায় থেকে থাকে। অকালপ্রয়াত এই কবি বহুজীবী হলে বাংলা কবিতা খুবই উপকৃত হত।৬৫
মহাদের সাহা
আমি তাকে পাশে পেয়েছি ভ্রমণে, কবিতা পাঠের আসরে, সভায়, সংগঠনে, কখনো কখনো স্বল্প সময়ের আড্ডায়। এই মেলামেশার মধ্যে একধরনের দুরত্ব ছিলই। তাই ব্যক্তিগত কথার চাইতে সেখানে স্থান পেত নানা অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ প্রসঙ্গ, কৌতুক, রসিকতা কিংবা কখনো আবার অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছুটা কম কথা বলত বলেই হয়তো রুদ্র অন্যের কথায় কৌতুক ও রসিকতার আনন্দ বেশি উপভোগ করতে পারত। রুদ্রের কবিতায় মানুষের প্রতি অকপট ভালোবাসার যে-প্রকাশ লক্ষ করি তার উৎস খুবই গভীর বলে মনে হয়।৬৬
নির্মলেন্দু গুণ
তার কবিতায় যেমন সমাজ-পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আছে, তেমনি আছে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ–যে আবেগ তার পোড়খাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উত্থিত। আমি বিশ্বাস করি, তার আবেগপূর্ণ প্রেমের কবিতাগুলি বাঙালি দীর্ঘদিন মনে রাখবে। এই দুর্ভাগা দেশে প্রকৃত কবির জন্ম না গ্রহণ করাই উচিত।৬৭
ফরহাদ মজহার
কিন্তু ও কবি ছিল। জীবনে কবি ছাড়া আর কিছুই সে হতে চায় নি। কবিতার জন্যে জান বাজি ছিল রুদ্রের। আর ঠিক এখানেই, ঠিক এই জায়গায় যেখানে রুদ্র রাজা নয়, মন্ত্রী নয়, ব্যবসায়ী নয়, স্রেফ কবি হতে চাইছে–ঠিক সেইখানে সে তার সকল কবিবন্ধুদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। সে একটা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল যাদের কাজ হচ্ছে শব্দের পশ্চাতে চলে যাওয়া। কিংবা দৌড়ে শব্দের আগে চলে যাওয়া।৬৮
মাহবুব সাদিক
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রধানত রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি কবিতার মাধ্যমে সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রাকৃত আবেগের তীব্র তাপ তার কবিতাকে কিছু উষ্ণতা বিলিয়েছিল। তাঁর স্বভাবে ছিল কবিতা এবং তার বক্তব্য ছিল বলিষ্ঠ। এজন্যে তিনি জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন। তবে তার কবিতায় আবেগের শাসন ছিল না। রুদ্রের কবিতায় ছন্দ কিছুটা এলোমেলো। প্রতীক ও সমৃদ্ধ রূপকের অভাব রয়েছে তাঁর কবিতায়। তার আবেগতাড়িত কবিতার ভাষা তেমন আধুনিক নয়। তার চিত্রকল্পও সুগঠিত হয়ে ওঠে নি। প্রকরণের প্রতি সচেতন হওয়ার আগেই মৃত্যু তাকে অপহরণ করেছে।৬৯
সাযযাদ কাদির
শেষ-সত্তরে আবির্ভূত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় ক্ষুব্ধ যৌবনের দ্রোহ ভাষারূপ পেয়েছে। বাংলা কবিতার যে বিস্ময়কর আবৃত্তিযোগ্যতা রয়েছে সেটিও রুদ্র সার্থকতার সঙ্গে প্রমাণ করেছেন। তার আরেকটি প্রতিভা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। সেই প্রতিভা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারে নি। বেঁচে থাকলে রুদ্র কবিতা, আবৃত্তি ও সঙ্গীতের জগতকে সমুজ্জ্বল করতে পারতেন।৭০
কাজী রব
তোমাকে না দেখেও পেয়েছি মানুষের মানচিত্র
খাদ্যবিহীন বিরাণ পদ্মপাতার খোলা বাতায়ন
নারীহীন কষ্টের সহস্ররাত্রি, প্রজ্জ্বলিত রান্নাঘর,
যাবে যদি প্রত্যুযে, এত আগে ঘণ্টা দিলে কেন?৭১
আবিদ আনোয়ার
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সত্তরের দশকের জনপ্রিয় কবিদের একজন। জনপ্রিয়তা কখনোই কাব্যকৃতির সাফল্যের পরিমাপকৃ নয় বরং বৃহত্তর পাঠকসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেইসব কবিতা, যাতে থাকে প্রাকৃত আবেগ, স্লোগান-ধর্মিতা ও প্রথাগত প্রকরণ। জনপ্রিয়তা অর্জনের অন্য একটি পথ বোহেমিয়ান জীবনযাপন। রুদ্র তার কবিতায় ও জীবনযাপনে কেবল এসব উপাদান যুক্ত করেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, একথা সত্য নয়। সত্তরের প্রজন্মের একজন উজ্জ্বল কবি তিনি; প্রকরণে প্রথাগত। জসীমউদদীন ও সুকান্তের শংকরায়ণ ঘটেছে তার প্রকরণ ও কাব্যভাষায়। প্রধানত ছন্দে লিখলেও ছন্দ-সচেতন ছিলেন না; প্রচুর স্থলন-পতন নিয়েও তার কবিতা যখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, তখন রুদ্র নিজেও সচেতন হয়ে উঠছিলেন এসব বিষয়ে। অকালমৃত্যুর কারণে পূর্ণাঙ্গ রুদ্রকে আমরা পাই নি। যে প্রবল স্বভাবকবিত্ব নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন, অনুশীলনের নানা পর্যায় পেরিয়ে তা আর বিকশিত হয়ে উঠতে পারে নি; একজন কিশোর-কবির যে অমিত সম্ভাবনাকে ধারণ করে সুকান্ত বেঁচে আছেন বাংলা কবিতায়, রুদ্রও বেঁচে থাকবেন সেভাবেই ../৭২
নাসির আহমেদ
আসলে রুদ্রর কবিতার মধ্যে ছিল লিরিক্যাল ব্যঞ্জনা। এমনকি তীব্র রাজনীতি-নির্ভর কবিতাও ক্রুর হয়ে ওঠে নি। আমার মনে হয় রোমান্টিক লিরিকই ছিল তার প্রকৃত ক্ষেত্র। সে কারণে তার প্রেমের কবিতাগুলি আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে।
মাহমুদ কামাল
সত্তর দশকে বাংলাদেশে কবি হিসেবে সবচে বেশি আলোচিত হয়েছেন আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। অকালপ্রয়াত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সবে শুরু করেছিলেন কাব্য-নির্মাণ এবং একটি পথও তিনি পেয়ে যেতে পারতেন। সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। মৃত্যু একটি সম্ভাবনাকে শেষ করে দিল। তার কবিতায় দুঃখ, ক্রোধ, হতাশা–সর্বোপরি মানুষের কথাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে।৭৪
আলী রীয়াজ
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বেঁচে ছিলেন সৃষ্টিশীলতায়, নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন। এক অভাবনীয় দূরদৃষ্টি, বড় কবির যা প্রধান লক্ষণ, প্রধান সম্পদ ছিল তার। সমকাল থেকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেতেন এই কবি।৭৫
শফিক আলম মেহেদী
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কাব্যকর্মে আমাদের যুগ-চেতনা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দ-বেদনা যথাযথভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। তাকে মনে করি আমাদের প্রজন্মের একজন প্রতিনিধিত্বশীল কবি। তার কবিতা আমাদের সত্তর দশককে ঋদ্ধ করেছে।
ইসহাক খান
রুদ্র মূলত কবি। তবে কাব্যচর্চার পাশাপাশি সঙ্গীত, নাটক ও গদ্যচর্চার দিকে তাঁর আগ্রহ ছিল সীমাহীন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তাঁর পাঁচটি ছোটগল্প বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ-গল্পগুলো পাঠ করলে সহজেই অনুমান হয় যে, গদ্যভাষার প্রতি তার দখল ছিল সাবলীল। তার গদ্যভাষা মোটেও কাব্যাক্রান্ত নয়। ‘ইতর’ ও ‘সোনালি শিশির’ গল্পদুটি ভিন্ন মেজাজের এবং সুখপাঠ্য। পাঠককে আকৃষ্ট করার অসাধারণ দক্ষতা তার কবিতার মতো গদ্যেও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশেষ করে বর্ণনায় ও বিশ্লেষণে তার মুন্সিয়ানা উল্লেখ করার মতো।৭৭
আবু হাসান শাহরিয়ার
কবিতার বিষয় নির্বাচনে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শুরু থেকেই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ও স্বরের স্বরভঙ্গিতে পূর্বসুরীদের প্রভাব স্পষ্ট। প্রথম দিককার রচনায় প্রভাবের এই দায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদেরও অনেককে বহন করতে হয়েছে। তবে সফল কবিমাত্রই পথের স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেন। জীবনের শেষভাগে রুদ্রও করেছিলেন। কিন্তু পরিণত ও স্বতন্ত্র এই রুদ্রের অমিত সম্ভবনা স্তব্ধ হয়ে যায় তার অকাল প্রয়াণে।৭৮
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর স্মরণে শফিকুল ইসলাম ইউনুস সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক ঢাকা’ একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে–
সম্পাদকীয়
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : শেষ অভিবাদন
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্প্রতি লোকান্তরিত হয়েছে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এই দ্রোহী ও স্বপ্নবান কবির মৃত্যু কেবল বেদনাবহ নয়–অন্তরস্থিত শূন্যতারও সৃষ্টি করে। তিনি ছিলেন আমাদের সহযোদ্ধা ও সহযাত্রী। কবিতার অঙ্গনে তাঁর ও সরব পদচারণা থাকলেও প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশে ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী কবি-সংগঠন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নিষ্ঠাবান সদস্য। মৃত্যুর পূর্বে সংগীত পরিষদের সাথেও জড়িত হন।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা ও জীবনের প্রস্ফুটন ঘটে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। যখন এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করে চরম হতাশা ও বিভ্রান্তি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দ্রুত উল্লম্ফন ও আস্ফালন জাতীয় অস্তিত্ব ধরেই টান দেয়। এ-সময়ে জামাত-শিবিরের সমর্থক কর্মীরা একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের চত্বরে নির্মিত অপরাজের বাংলা ভাঙারও হীন চেষ্টা চালায়। এই অন্যায় ও অশুভ তৎপরতা রোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। সেই প্রয়াসে ও রুদ্রের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ভিন্নধর্মী কবি-সংগঠন রাখাল-এরও তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোহিত।
বাংলা কবিতায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অবদান কতখানি তা ইতিহাসই বিচার করবে। কিন্তু তিনি একটি অবিবেকী ও আদর্শচ্যুত সময়ের বিপরীতে নিজের কাব্যকে দাঁড় করিয়েছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছিলেন : ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন। তিনি তার কবিতায় সময়কে ধারণ করেছিলেন। উপদ্রুত উপকূলের মানুষকে সংগ্রামের কাফেলায় মেলাতে চেয়েছিলেন। মৌলিক মুখোশ উন্মোচন করে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন একটি স্বর্ণগ্রাম।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নেই। অতএব স্বর্ণগ্রাম নির্মাণের দায়িত্বও তাঁর নেই। কিন্তু তার সহযাত্রীরা আছেন, সহযোগী কাব্যনির্মাতা আছেন, তাঁদেরই কর্তব্য এই অন্ধ উন্মাতাল সমাজদেহের রন্ধ্রে যে বিষাক্ত ঘা তাকে ঘুচিয়ে সুস্থ ও নিরাময় সমাজ নির্মাণে নিজেদের শ্রম ও মেধা নিয়োজিত করা। কবির প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনাকে দুই প্রচ্ছদের ভেতর বন্দী করে আজ ও ভবিষ্যৎ পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা–এই ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার কষ্ট তার শ্রম তার আবেগ সবই বিধৃত হয়েছে কবিতায়, গুটিকয়েক গল্পের স্কেচে কিংবা কাব্যনাট্যে।
রুদ্র আপনাকে যেন ভুলে না যাই। যেন বিস্মৃত না হয় আগামী দিনের পাঠক ও কবিতা-প্রেমিকরা। সাপ্তাহিক ঢাকা আপনাকে শেষ অভিবাদন জানাচ্ছে।৭৯
রুদ্রের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে গঠিত হয় রুদ্র সংসদ। সভাপতি অসীম সাহা ও সম্পাদক নিশাত খান। ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর রুদ্রের জন্মদিনে রুদ্রমেলা প্রথম উদযাপিত হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে। উদ্বোধক ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতান। রুদ্র সংসদের বর্তমান সভাপতি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী। প্রতিবছর রুদ্রমেলা হচ্ছে। উদ্বোধক হিসেবে এসেছেন সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান প্রমুখ বরেণ্য মনীষী।