১০. সবকিছুর অবসান
অধিকাংশ পদার্থবিদের এখন দৃষ্টিভঙ্গি হলো, সত্যিকার বিশাল বস্তু সূর্যের ভেতর প্রবল বেগে নিক্ষিপ্ত না হলে সব গ্রহসহ সূর্য একসময় প্রাণধারণের জন্য খুবই শীতল হয়ে যাবে। এতে নতুন জীবন ফিরে পাবে সূর্য। আমার বিশ্বাস, সুদূর ভবিষ্যতে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত প্রাণী টিকে থাকবে। চিন্তা করাও অসহনীয়, এ রকম দীর্ঘমেয়াদি ধীর প্রক্রিয়ার পর ওই প্রাণী ও অন্য সব বুদ্ধিমান প্রাণী অনিবার্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে।
—চার্লস ডারউইন
.
নর্স পুরাণমতে, বিচারদিনের শেষ দিবসের নাম র্যাগনারোক। সেদিন সংঘটিত হবে প্রচণ্ড এক বিপর্যয়। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় মিডগার্ড বা মধ্য পৃথিবীর পাশাপাশি স্বর্গও জমাট বেঁধে যাবে। তীক্ষ্ণ বাতাস, ভয়ংকর ও প্রবল তুষারঝড়, ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প এবং দুর্ভিক্ষ ছেয়ে যাবে স্থলভূমি। বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষ ধ্বংস হয়ে যাবে অসহায়ভাবে। পরিত্রাণহীন এমন ভয়াবহ তিনটা শীত পৃথিবীকে পঙ্গু করে ফেলবে। রাক্ষুসে নেকড়েরা সূর্য ও চাঁদ গিলে খাবে। শিগগিরই গাঢ় কালো অন্ধকারে ডুবে যাবে গোটা বিশ্ব। আকাশ থেকে নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে, প্রচণ্ডবেগে কাঁপতে থাকবে পৃথিবী। একে একে ভেঙে পড়তে থাকবে পাহাড়-পর্বতগুলোও। দানবেরা মুক্ত হয়ে যাবে। পালিয়ে যাবে বিশৃঙ্খলার দেবতা যার নাম লোকি। জনহীন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে যুদ্ধ, বিভ্রান্তি আর বিরোধ।
দেবতাদের পিতা ওডিন চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য শেষবারের মতো ভালহাল্লায় তার সাহসী যোদ্ধাদের একত্র করবে। ক্রমান্বয়ে একের পর এক দেবতা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন আর গন্ধকের নিশ্বাস ফেলতে থাকবে শয়তানদের দেবতা সারচার। তাতে এক বিশালাকৃতির নরকের অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠবে। স্বর্গ ও পৃথিবী দুটোই গ্রাস করবে সেই লেলিহান আগুন। গোটা মহাবিশ্ব আগুনে ডুবে যাবে। পৃথিবী ডুবে যাবে মহাসাগরে। থেমে যাবে স্বয়ং সময়ও।
তবে এই বিশাল ছাইয়ের স্তূপ থেকেই একদিন জেগে উঠবে নতুন একটা সূচনা। সমুদ্র থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকবে এক নতুন পৃথিবী, যা আগের পৃথিবীর মতো হবে না। উর্বর মাটি থেকে অঙ্কুরিত হবে পর্যাপ্তসংখ্যক নতুন ফলমূল ও বিচিত্র গাছপালা। এভাবে জন্ম নেবে নতুন এক মানবজাতি।
ভাইকিং পুরাণে বিশ্বের সমাপ্তির সময় নিয়ে ভয়াবহ কাহিনিতে অগ্নিশিখা ও একটা চূড়ান্ত লড়াই শেষে এই সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে হিমশীতলতার কথা বলা হয়। প্রায় একই ধরনের আখ্যান খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্বের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিতেও। বিশ্বের শেষ দিবসে ভালো ও মন্দের মধ্যে চূড়ান্ত লড়াইয়ের পর চরম বিপর্যয়, সাধারণত বিশাল অগ্নিকুণ্ড, ভূমিকম্প বা তুষারপাতের কথা বলা হয়। কিন্তু এরপরই থাকে একটা আশার বার্তাও। ধ্বংসস্তূপের ছাই থেকেই আসে নবজীবন।
পদার্থবিদ্যার নিরুত্তাপ সূত্রগুলোর মুখোমুখি হয়ে এখন প্রায় একই ধরনের আখ্যানের মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিজ্ঞানীদেরও। সেগুলো ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে ফিসফিস করে বলা পৌরাণিক কাহিনি নয়, বরং শক্তপোক্ত তথ্য-উপাত্তই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত সমাপ্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন—তার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জগতেও প্রায় একই ধরনের আখ্যান হয়তো প্রচলিত হয়ে উঠতে পারে। আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর সমাধানের মধ্যে, আমরা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দেখতে পাই, যার সঙ্গে হিমশীতল ঠান্ডা, আগুন, চরম বিপর্যয় এবং মহাবিশ্বের একটা সমাপ্তি জড়িত। কিন্তু তারপর সবশেষে মহাবিশ্বের কি কোনো পুনর্জন্ম আছে?
ডব্লিউএমএপি (WMAP) স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি অনুযায়ী, মহাবিশ্বের প্রসারণকে ত্বরান্বিত করছে রহস্যময় এক অ্যান্টিগ্র্যাভিটি বা প্রতিমহাকর্ষ বল। কয়েক বিলিয়ন বা ট্রিলিয়ন বছর এটি চলতে থাকলে অনিবার্যভাবে একটা বিগ ফ্রিজে (মহা হিমশীতলতা) পৌঁছাবে মহাবিশ্ব। এর সঙ্গে দেবতাদের অনিশ্চিত সময়ের পূর্বাভাসের মতো এই প্রবল তুষারঝড়ের বেশ মিল আছে। ফলে আমাদের জানা সব প্রাণের অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে। মহাবিশ্বকে ঠেলে আলাদা করে ফেলা এই প্রতিমহাকর্ষ বল হলো মহাবিশ্বের আয়তনের সমানুপাতিক। কাজেই মহাবিশ্ব যত বড় হতে থাকবে, তত বেশি প্রতিমহাকর্ষ বল ছায়াপথগুলোকে দূরে ঠেলে দেবে। ফলে বাড়তে থাকবে মহাবিশ্বের আয়তন। মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা রান অ্যাওয়ে মোডে প্রবেশ না করা পর্যন্ত এবং সূচকীয় হারে তার গতি না বাড়া পর্যন্ত এই জঘন্য চক্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বারবার ঘটতে থাকবে।
চূড়ান্তভাবে এর মানে দাঁড়ায়, গ্যালাক্সিদের লোকাল গ্রুপের ৩৬টি ছায়াপথ আমাদের গোটা দৃশ্যমান মহাবিশ্ব রচনা করবে। কারণ, আমাদের দিগন্ত পেরিয়ে আরও দূরে চলে যাবে প্রতিবেশী কোটি কোটি ছায়াপথ। দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে থাকবে ছায়াপথগুলোর মাঝখানের স্থান। এর গতি হবে আলোর চেয়েও বেশি। তখন মহাবিশ্ব হয়ে উঠবে ভয়ংকর রকম নিঃসঙ্গ। এর তাপমাত্রাও কমে যাবে। কারণ, স্থানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হালকা থেকে হালকাতর হয়ে যাবে মহাবিশ্বের অবশিষ্ট শক্তি। তাপমাত্রা পরম শূন্যের কাছাকাছি নেমে যাওয়ার পর বুদ্ধিমান প্রজাতিগুলো চূড়ান্ত পরিণতির মুখোমুখি হবে। সেটি হবে একটা ভয়ংকর হিমশীতল মৃত্যু।
তাপগতিবিদ্যার তিন সূত্র
শেক্সপিয়ার বিশ্বকে বলেছিলেন নাটকের মঞ্চ বা রঙ্গশালা। তাঁর কথামতো গোটা বিশ্ব একটা মঞ্চ হলে সেখানে অবশ্যই নাটকের তৃতীয় একটা অঙ্কও থাকবে। প্রথম অঙ্কে ছিল মহাবিস্ফোরণ এবং পৃথিবীতে প্রাণ ও চেতনার উত্থান। দ্বিতীয় অঙ্কে আমরা হয়তো নক্ষত্র ও ছায়াপথের অনুসন্ধান করে বেঁচে থাকব। অবশেষে তৃতীয় অঙ্কে মুখোমুখি হব বিগ ফ্রিজ বা মহাশীতলতার মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত মৃত্যুর।
শেষ পর্যন্ত, আমরা সেই স্ক্রিপ্টটা খুঁজে পেয়েছি, যেটা অনিবার্যভাবে থার্মোডায়নামিকস বা তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো মেনে চলবে। উনিশ শতকে তাপগতিবিদ্যার তিনটি আইন সূত্রবদ্ধ করেন পদার্থবিদেরা। এগুলো তাপের পদার্থবিদ্যা শাসন করে এবং মহাবিশ্বের ক্রমান্বয়ে মৃত্যু বিষয়ে চিন্তাভাবনার সূচনা করে। ১৮৫৪ সালে প্রতিভাবান পদার্থবিদ হারমান ভন হেলমোনজ বুঝতে পারেন, তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো পুরোপুরি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। সোজা কথায়, নক্ষত্র, ছায়াপথসহ আমাদের চারপাশের সবকিছুকে একসময় ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।
প্রথম সূত্রটিকে বলা হয়েছে, বস্তু ও শক্তির মোট পরিমাণ সংরক্ষিত বা অপরিবর্তিত। শক্তি ও বস্তু একটা আরেকটায় রূপান্তরিত হতে পারলেও (আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E mc^2 অনুসারে), বস্তু ও শক্তির মোট পরিমাণ কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যাবে না।
দ্বিতীয় সূত্রটি সবচেয়ে রহস্যময় ও সবচেয়ে গভীর। এ সূত্রটি বলে, মহাবিশ্বে এনট্রপির বা বিশৃঙ্খলার মোট পরিমাণ সব সময় বাড়ছে। অন্য কথায়, সবকিছুর অবশ্যই ক্রমান্বয়ে বয়স হবে ও শেষ হয়ে যাবে। বন পুড়ে যাওয়া, যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরা, সাম্রাজ্যের পতন ও মানবদেহের বয়স হয়ে যাওয়া—এ সবকিছু মহাবিশ্বের এনট্রপির বাড়ার প্রতীক। যেমন এক টুকরো কাগজ পোড়ানো সহজ। এটা মোট বিশৃঙ্খলার নিট বৃদ্ধি বোঝায়। তবে ধোঁয়াটিকে আবারও একত্র করে কাগজে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। (অতিরিক্ত যান্ত্রিক কাজের মাধ্যমে এনট্রপিকে কমানো যেতে পারে। যেমন ঘটে রেফ্রিজারেটরে। কিন্তু সেটি শুধু ছোট্ট স্থানীয় পরিসরে করা সম্ভব। গোটা সিস্টেমের মোট এনট্রপি, অর্থাৎ এই রেফ্রিজারেটর ও তার আশপাশের সবকিছুর এনট্রপি সব সময়ই বেড়ে যায়।)
আর্থার এডিংটন একবার দ্বিতীয় সূত্র সম্পর্কে বলেন, ‘যে আইনে, এনট্রপি সর্বদা বাড়ছে—অর্থাৎ তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র—একে আমি প্ৰাকৃতিক সূত্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে বলে মনে করি।…আপনার সূত্রটা যদি তাপগতিবিদ্যার বিরোধী বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে আপনাকে কোনো আশা দিতে পারব না। সে জন্য তীব্র অপমানের মধ্যে ধসে পড়া ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না।’
(আপাতদৃষ্টে মনে হয়, পৃথিবীতে জটিল জীব গঠনের অস্তিত্ব যেন দ্বিতীয় সূত্রের লঙ্ঘন। আদিম পৃথিবীর চরম বিশৃঙ্খলা থেকে অবিশ্বাস্য বৈচিত্র্যময় জটিল প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। এমনকি বুদ্ধিমত্তা ও চেতনাকেও আশ্রয় করেছে এসব প্রাণসত্তা। আপাতদৃষ্টে মনে হবে, তাতে এনট্রপির পরিমাণ কমে গেছে। অনেকে এই অলৌকিক ঘটনায় সৃষ্টিকর্তার হাত আছে বলে মনে করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বিবর্তনের প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী। মোট এনট্রপি তখনো বেড়ে যায়। কারণ, প্রাণকে টিকে থাকার জন্য সূর্য থেকে অনবরত অতিরিক্ত শক্তি নিতে হচ্ছে। সূর্য ও পৃথিবীকে এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হলে মোট এনট্রপি তখনো বেড়ে যাবে। )
তৃতীয় সূত্রটিতে বলা হয়েছে কোনো রেফ্রিজারেটর পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌছাতে পারবে না। পরম শূন্য তাপমাত্রার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে হয়তো আসা যাবে, কিন্তু জিরো মোশন বা শূন্য গতি অবস্থায় কখনো পৌঁছানো যাবে না। (কোয়ান্টাম নীতিটি অন্তর্ভুক্ত করলে বোঝা যায়, অণুগুলোতে সব সময় ছোট্ট পরিমাণ শক্তি থাকে। জিরো এনার্জি বা শূন্য শক্তির অর্থ আমরা প্রতিটি অণুর সঠিক অবস্থান ও ভরবেগ জানতে পারব। কিন্তু এটি আসলে অনিশ্চয়তার নীতির লঙ্ঘন।)
গোটা মহাবিশ্বে যদি দ্বিতীয় সূত্রটি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তার অর্থ, ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে মহাবিশ্ব। নক্ষত্রগুলো তাদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলবে, ছায়াপথগুলো আকাশকে আর আলোকিত করবে না। মহাবিশ্ব হয়ে উঠবে মৃত বামন নক্ষত্র, নিউট্রন স্টার ও কৃষ্ণগহ্বরের প্রাণহীন এক সংগ্রহশালা। চির অন্ধকারে ডুবে যাবে মহাবিশ্ব।
কোনো দোদুল্যমান মহাবিশ্বে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এই ‘তাপীয় মৃত্যুর’ হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টার কথা বলেছেন কয়েকজন কসমোলজিস্ট। মহাবিশ্ব প্রসারিত ও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এনট্রপিও অনবরত বাড়বে। কিন্তু বিগ ক্রাঞ্চের পর, মহাবিশ্বের এনট্রপির অবস্থা কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ ধারণা করেন, হয়তো মহাবিশ্ব সরলভাবে নিজেকে পরবর্তী চক্রের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা হলো, এনট্রপি পরের চক্রটিতেও নিয়ে যাবে। সোজা কথায়, মহাবিশ্বের জীবনের মেয়াদ প্রতিটি চক্রে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। কিন্তু প্রশ্নটি যেভাবেই করা হোক, উন্মুক্ত ও বদ্ধ মহাবিশ্বের মতো দোদুল্যমান মহাবিশ্বও ধীরে ধীরে হয়ে দাঁড়াবে সব বুদ্ধিমান প্রাণের ধ্বংসের কারণ।
বিগ ক্রাঞ্চ বা মহাসংকোচন
মহাবিশ্বের সমাপ্তি ব্যাখ্যার জন্য পদার্থবিজ্ঞান প্রয়োগের প্রথম প্রচেষ্টার অন্যতম ছিল স্যার মার্টিন রিজের লেখা একটা গবেষণাপত্র। ১৯৬৯ সালে লেখা ওই পেপারটির শিরোনাম ছিল, ‘দ্য কলাপ্স অব দ্য ইউনিভার্স : এন এসকাটজিক্যাল স্টাডি’। ওমেগার মান তখনো অনেকাংশে অজানা ছিল। তাই এর মান দুই অনুমান করেন তিনি। এর মানে, মহাবিশ্বের প্রসারণ ধীরে ধীরে থেমে যাবে। আবার মহাবিশ্বের মৃত্যু কোনো বিগ ফ্রিজে নয়, বরং সেটা ঘটবে একটা বিগ ক্রাঞ্চে বা মহাসংকোচনে।
তিনি গণনা করে দেখেন, ছায়াপথগুলো যখন আজকের তুলনায় দ্বিগুণ দূরত্বে থাকবে, তখন মহাবিশ্বের প্রসারণ ধীরে ধীরে থেমে যাবে। শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের আদি প্রসারণকে কাটিয়ে উঠবে মহাকর্ষ। মহাকাশে আমরা এখন যে লোহিতবিচ্যুতি দেখি, তা পরিণত হবে নীলবিচ্যুতিতে। কারণ, তখন ছায়াপথগুলো আমাদের দিকে ছুটে আসার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে।
এই সংস্করণ অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ৫০ বিলিয়ন বছর পর বিপর্যয়কর ঘটনাগুলো ঘটবে, যা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়। চূড়ান্ত ক্রাঞ্চের এক শ মিলিয়ন বছর আগে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিসহ মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে একীভূত হয়ে যাবে ছায়াপথগুলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রিজ আবিষ্কার করেছেন, প্রতিটি আলাদা নক্ষত্র বিলীন হয়ে যাবে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে আসার অনেক আগেই। এমনটি ঘটবে দুটি কারণে। প্রথমত মহাবিশ্ব সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশের অন্যান্য নক্ষত্র থেকে আসা বিকিরণের শক্তি বাড়তে থাকবে। কাজেই তখন অন্যান্য নক্ষত্রের তীব্র নীলবিচ্যুতি হওয়া আলোতে ভাসতে থাকবে নক্ষত্রগুলো। দ্বিতীয়ত মহাবিশ্বের তাপমাত্রা আকাশচুম্বী হওয়ার কারণে ব্যাকগ্রাউন্ড মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে ব্যাপকভাবে। এই দুয়ের মিলিত প্রভাবে এমন তাপমাত্রার সৃষ্টি হবে, যা ছাড়িয়ে যাবে নক্ষত্রপৃষ্ঠের প্রচণ্ড তাপমাত্রাকেও। নক্ষত্রগুলো পরস্পরের কাছে পৌছানোর আগেই নক্ষত্রপৃষ্ঠ অতি দ্রুত এই তাপমাত্রা শোষণ করবে। তাই নক্ষত্রগুলো সম্ভবত ভেঙেচুরে সুপারহট গ্যাস ক্লাউডে পরিণত হবে।
এ পরিস্থিতি বুদ্ধিমান প্রাণীরা পার্শ্ববর্তী নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলো থেকে আসা মহাজাগতিক তাপমাত্রার কারণে অনিবার্যভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। এখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। ফ্রিম্যান ডাইসন লিখেছেন, ‘আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে আমাদের ভাজা ভাজা হওয়া অবস্থা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। নীলবিচ্যুতি হওয়া পটভূমি বিকিরণ থেকে রেহাই পেতে আমরা পৃথিবীর যত গভীরেই আশ্রয় নিই না কেন, তাতে আমাদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি স্থগিত করা যাবে কেবল কয়েক মিলিয়ন বছর।’
মহাবিশ্ব যদি একটা বিগ ক্রাঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, মহাবিশ্ব কি চুপসে যাবে আর তারপর আবার ফিরে আসবে, যেমনটি দোদুল্যমান মহাবিশ্বে ঘটে। পল অ্যান্ডারসন এমনই একটা দৃশ্য তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা টাও জিরো উপন্যাসে। মহাবিশ্ব যদি নিউটোনিয়ান হয়, তাহলে এটা হয়তো সম্ভব যে ছায়াপথগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংকুচিত হওয়ার সময় সেখানে পর্যাপ্ত পার্শ্বগতি থাকবে। সে ক্ষেত্রে নক্ষত্রগুলো হয়তো কোনো একক বিন্দুতে সংকুচিত হয়ে যাবে না, বরং পরস্পরকে সর্বোচ্চ সংকোচন বিন্দুতে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। তারপর নিজেদের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষ না ঘটিয়ে আবারও ফিরে আসবে আগের অবস্থায়।
অবশ্য মহাবিশ্ব নিউটোনিয়ান নয়। মহাবিশ্ব আইনস্টাইনের সমীকরণ মেনে চলে। রজার পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং প্রমাণ দেখিয়েছেন, অতি সাধারণ অবস্থায় সংকোচনের মধ্যে পড়া এক গুচ্ছ ছায়াপথ অনিবার্যভাবে একটা পরম বিন্দুতে চুপসে যাবে। (এর কারণ হলো, ছায়াপথগুলোর পার্শ্বগতিতে শক্তি রয়েছে। কাজেই তা মহাকর্ষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। তাই চুপসে যাওয়া মহাবিশ্বের জন্য আইনস্টাইনের তত্ত্বের মহাকর্ষীয় টান নিউটনীয় তত্ত্বের চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়। তাতে মহাবিশ্ব একটা একক বিন্দুতে চুপসে যাবে। )
মহাবিশ্বের পাঁচটি পর্যায়
ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক ডেটা বিগ ফ্রিজের পক্ষে রয়েছে। মহাবিশ্বের জীবন ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেড অ্যাডামস এবং গ্রেগ লাফলিনের মতো বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বয়সকে পাঁচটি আলাদা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। আমরা যেহেতু সত্যিকার অ্যাট্রোনমিক্যাল টাইম স্কেল নিয়ে আলোচনা করছি, তাই লগারিদমিক টাইম ফ্রেম ব্যবহার করব এখানে। কাজেই ১০০ বছরকে আমরা ২০ বছর হিসেবে প্রকাশ করব। (এই সময়সূচিটি তৈরি করা হয়েছিল প্রসারণশীল মহাবিশ্বের উপলক্ষটা পুরোপুরি বুঝে ওঠার অনেক আগেই। তবে এখনো মহাবিশ্বের এই অবস্থাগুলোর সাধারণ বিভাজন একই রকম রয়ে গেছে।)
একটা প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরেফিরে আসে : বুদ্ধিমান প্রাণ কি তার উদ্ভাবনী কুশলতা ব্যবহার করে ধারাবাহিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এমনকি মহাবিশ্বের মৃত্যুর ঘটনার মতো এসব অবস্থার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে?
প্রথম পর্যায় : আদিম যুগ
প্রথম পর্যায়ে (-৫০ ও ৫-এর মধ্যবর্তী বা ১০^-৫০ও ১০^৫ সেকেন্ডের মধ্যবর্তী সময়) দ্রুত প্রসারণশীল অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল মহাবিশ্ব। একই সঙ্গে দ্রুত ঠান্ডাও হয়ে উঠেছিল। ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বলগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। একসময় বলগুলো একত্র অবস্থায় বিরাজ করছিল সুপারফোর্স হিসেবে। সেগুলো আলাদা হয়ে আজকের পরিচিত চারটি বলে রূপ লাভ করেছে। প্রথমে আলাদা হয়েছিল মহাকর্ষ। এরপর সবল নিউক্লিয়ার বল এবং সবশেষে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল অস্বচ্ছ। মহাকাশ ছিল সাদা। কারণ, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার পরপরই আলো শোষিত হয়েছিল। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের ৩৮০,০০০ বছর পর মহাবিশ্ব হয়ে গেল যথেষ্ট ঠান্ডা। তাতে তীব্র তাপে আর ভেঙে না গিয়ে পরমাণু গঠিত হতে পেরেছিল। এরপর মহাকাশ হয়ে গেল কালো। মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা পটভূমি বিকিরণ এই সময়কালের।
আদিম হাইড্রোজেন ফিউজ বা একত্র হয়ে হিলিয়াম গঠন করেছিল এই যুগে। এভাবে নাক্ষত্রিক জ্বালানি বর্তমান মিশ্রণ তৈরি করেছিল, যা গোটা মহাবিশ্বে এখনো ছড়িয়ে আছে। মহাবিশ্বের বিবর্তনের এই পর্যায়ে আমরা পরিচিত প্রাণের পক্ষে টিকে থাকা এককথায় অসম্ভব। এ সময় তাপ খুব তীব্র ছিল। কোনো ডিএনএ বা অন্যান্য অটোক্যাটালাইটিক অণু যদি গঠিত হতো, তবে সেগুলো অন্যান্য পরমাণুর সঙ্গে এলোমেলো সংঘর্ষে ভেঙে যেত। তাতে জীবনের জন্য জরুরি স্থিতিশীল রাসায়নিক গঠিত হওয়াও অসম্ভব ছিল।
দ্বিতীয় পর্যায় : স্টেলিফেরাস যুগ
আমরা বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস করি (৬ থেকে ১৪ পর্যন্ত, বা ১০^৬ থেকে ১০^১৪ সেকেন্ডের মধ্যে)। এ সময় হাইড্রোজেন গ্যাস সংকুচিত হয়ে নক্ষত্রগুলো জ্বলে ওঠে। ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে আলোকিত আকাশ। এই যুগে আমরা হাইড্রোজেনসমৃদ্ধ নক্ষত্রগুলো খুঁজে পাই, যা কয়েক বিলিয়ন বছর আগে জ্বলে উঠেছিল। তাদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এভাবেই থাকবে নক্ষত্রগুলো। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ নক্ষত্রদের বিবর্তনের সব পর্যায়ের ছবি তুলেছে। এর মধ্যে রয়েছে ধূলিকণা ও ভগ্নাংশাবেশের ঘূর্ণমান ডিস্ক দিয়ে ঘিরে থাকা তরুণ নক্ষত্র। এগুলোই সম্ভবত গ্রহসমূহ এবং একটি সৌরজগতের পূর্বসূরি।
এই পর্যায়ের শর্তগুলো ডিএনএ ও প্রাণ গঠনের জন্য আদর্শ। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে বিপুলসংখ্যক নক্ষত্রগুলোর অন্যান্য গ্রহব্যবস্থায় বুদ্ধিমান প্রাণের উদ্ভবের বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সে জন্য আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর ওপর ভিত্তি করেছেন। কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান প্রাণের ধরনকে অনেক মহাজাগতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। এসব বাধার মধ্যে বেশ কিছু তার নিজের তৈরি। যেমন পরিবেশগত দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পারমাণবিক অস্ত্র। যদি ধরে নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে বুদ্ধিমান জীব নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবে না, তাহলেও তাদের অনিবার্যভাবে একগাদা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখিও হতে হবে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যেকোনো একটির কারণেই বিরাট এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারে বুদ্ধিমান জীব সম্প্রদায়।
হাজার হাজার বছরের কালের পরিসরে একটা বরফ যুগও থাকতে পারে। অনেকটা উত্তর আমেরিকা একসময় প্রায় এক মাইল বরফের নিচে ঢেকে যাওয়ার মতো। এর কারণে একসময় সেখানে মানবসভ্যতার বিকাশ অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ১০ হাজার বছর আগে, নেকড়েদের মতো বিচ্ছিন্ন উপজাতি হয়ে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত আদিম মানুষ। সামান্য খাবারের খোঁজে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করত তারা। সেকালে জ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোনো সংগ্রহ ও ছিল না। ছিল না লিখিত কোনো শব্দও। মানবজাতি কেবল একটা লক্ষ্য নিয়েই বেঁচে ছিল। সেটি হলো স্রেফ বেঁচে থাকা, টিকে থাকা। এরপর একসময় শেষ হয়ে আসে আইস এজ বা বরফ যুগ। তবে এর পেছনের কারণটা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। এবার দ্রুতবেগে বেড়ে উঠতে লাগল মানবজাতি। বরফ থেকে নক্ষত্রের পানে তাদের দৃষ্টি গেল। তবে এই সংক্ষিপ্ত আন্তবরফ যুগ চিরকাল স্থায়ী হতে পারে না। সম্ভবত আরও দশ হাজার বছরে আরেকটা বরফ যুগ বিশ্বের সিংহভাগ কম্বলের মতো ঢেকে দিয়েছিল। ভূতাত্ত্বিকেরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারপাশে তা ঘূর্ণনের অতি ক্ষুদ্র কম্পনের প্রভাব ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠতে থাকে। ফলে আইস ক্যাপগুলো থেকে জেট স্ট্রিম বা বায়ুপ্রবাহ নিম্ন অক্ষাংশে চলে যায়। এভাবে পুরু জমাট বাঁধা বরফের স্তরে ঢেকে যেতে পারে গোটা পৃথিবী। এই অবস্থায় নিজেদের উষ্ণ রাখতে হলে আমাদের হয়তো ভূগর্ভস্থে যেতে হবে। পৃথিবী একবার পুরোপুরি বরফে ঢেকে গিয়েছিল। সেটা ঘটতে পারে আবারও।
হাজার থেকে লাখ বছরের কালের পরিসরে, আমাদের অবশ্যই উল্কা ও ধূমকেতুর প্রভাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। খুব সম্ভবত কোনো উল্কা বা ধূমকেতুর প্রভাবে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসররা ঝাড়ে-বংশে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা সম্ভবত ১০ মাইলের কম লম্বা বস্তু বিধ্বস্ত হয়েছিল মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে। ফলে সেখানে বিশাল একটা খাদের সৃষ্টি হয়েছে ১৮০ মাইলজুড়ে। পাশাপাশি সূর্যালোক ঢেকে দিয়ে পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেওয়ার মতো বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে। তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নিচে। পৃথিবীতে সে যুগের গাছপালা ও প্রভাবশালী জীব ডাইনোসর মারা পড়ে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায় ডাইনোসর ও পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রজাতি।
অতীতের প্রভাবগুলোর হার বিবেচনা করলে, পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে গ্রহাণুর সংঘর্ষে বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে ১০ হাজারের ভেতর একবার। অন্যদিকে কয়েক লাখ বছরের মধ্যে এই আশঙ্কার হার বেড়ে যাবে ১০০ শতাংশে।
(সৌরজগতের ভেতরের দিকে, অর্থাৎ যেখানে পৃথিবী আছে, সেখানে এক কিলোমিটার বা তারও বেশি দৈর্ঘ্যের ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০টি গ্রহাণু থাকতে পারে। অন্যদিকে ৫০ মিটার বা তারও বেশি দৈর্ঘ্যের গ্রহাণু থাকতে পারে প্রায় ১০ লাখ। কেমব্রিজের স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজারভেটরিতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজারটি করে গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করা হয়। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, আমাদের জানা এসব গ্রহাণুর মধ্যে মাত্র ৪২টি ছোট হলেও তা পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিরূপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। অতীতে এসব গ্রহাণু নিয়ে অনেকবার ভুয়া বিপদের আশঙ্কা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতটি হলো গ্রহাণু 1997XF11। এ গ্রহাণুটি ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ভুলবশত সতর্কতা জারি করেন জ্যোতির্বিদেরা। সেটি সংবাদপত্রের শিরোনামেও পরিণত হয় তখন। কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে 1950DA নামের একটা গ্রহাণুর কক্ষপথ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেন, এটি ২৮৮০ সালের ১৬ মার্চ পৃথিবীতে হয়তো আঘাত হানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্রুজের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে দেখা গেছে, গ্রহাণুটি যদি মহাসাগরে আঘাত হানে, তাহলে ৪০০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের সৃষ্টি হবে। তাতে মহাসাগরবর্তী উপকূলীয় এলাকার বেশির ভাগ অংশ বিধ্বংসী বন্যায় জলাবদ্ধ হয়ে যাবে।)
কোটি কোটি বছরের কাল পরিসরে, আমাদের উদ্বেগের বিষয় হবে, পৃথিবীটাকে গ্রাস করবে সূর্য। এরই মধ্যে সূর্য তার শৈশব অবস্থার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কম্পিউটার গবেষণায় দেখা গেছে, ৩.৫ বিলিয়ন বছরে আমাদের সূর্য আজকের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এর মানে, ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকবে আমাদের সাধের পৃথিবী। দিনের আকাশে সূর্য আগের চেয়ে ধীরে ধীরে বড় থেকে আরও বৃহত্তর হতে থাকবে। একসময় তা আকাশের বেশির ভাগ অংশ দখল করবে। স্বল্প মেয়াদে, জীবিত প্রাণীরা মরিয়া হয়ে সূর্যের ঝলসে দেওয়া উত্তাপ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজবে। হয়তো সাগর-মহাসাগরেও ফিরে যেতে বাধ্য হবে জীবিত প্রাণীরা। ক্রমান্বয়ে সাগর-মহাসাগরগুলোও ফুটতে শুরু করবে। কাজেই সেখানেও জীবের পক্ষে টিকে থাকা হয়ে উঠবে অসম্ভব। প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছরের মধ্যে সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন গ্যাসের জ্বালানির জোগান ফুরিয়ে যাবে। তাতে একটা লোহিত দানব নক্ষত্রে পরিণত হবে আমাদের সূর্য। কিছু লোহিত দানব নক্ষত্র অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। এসব বিশালাকৃতির লোহিত দানবকে যদি সূর্যের জায়গায় বসানো যায়, তাহলে তা মঙ্গল গ্রহকেও গিলে খাবে। তবে আমাদের সূর্য সম্ভবত প্রসারিত হবে পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত। ফলে বুধ ও শুক্র গ্রহ গ্রাস করবে সূর্য। পৃথিবীর পাহাড়-পর্বতগুলো গলে যাবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর মৃত্যু সম্ভবত তুষারে নয়, আগুনের মধ্য দিয়ে হবে। ফলে তখন সূর্যের চারপাশের ঘুরতে থাকবে দগ্ধ কয়লার মতো মৃত এক পৃথিবী।
কয়েকজন পদার্থবিদ যুক্তি দেখান, এটা ঘটার আগে, আমরা হয়তো অতি বিশাল আকৃতির নভোজাহাজে চেপে অন্য কোনো গ্রহে স্থানান্তরিত হতে পারব। তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো আমরা এমন কোনো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হব, যা দিয়ে সূর্যের চারপাশে বড় কোনো কক্ষপথে পৃথিবীকে সরিয়ে নিতে হবে। জ্যোতির্বিদ ও লেখক কেন ক্রসওয়েল মন্তব্য করেছেন, ‘সূর্যের উজ্জ্বল হয়ে ওঠার চেয়ে মানুষ যত দিন স্মার্ট হতে থাকবে, তত দিন পৃথিবীর সমৃদ্ধি হওয়া উচিত।’
সূর্যের চারপাশের বর্তমান কক্ষপথ থেকে পৃথিবীকে সরাতে বেশ কয়েকটি উপায়ের প্রস্তাব করেছেন বিজ্ঞানীরা। একটা সহজ উপায় হতে পারে, গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে সাবধানে বেশ কিছু গ্রহাণুকে সরিয়ে আনা, যাতে সেগুলো পৃথিবীর চারপাশে ক্ষিপ্রবেগে চলতে থাকে। পৃথিবীকে তার কক্ষপথ থেকে ঠেলে দেবে এই স্লিংশটের প্রভাব। ফলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বাড়তে থাকবে। প্রতিটি বুস্টে ক্রমবর্ধমানভাবে সরে যেতে থাকবে পৃথিবী। কিন্তু এই কাজটি করতে শত শত গ্রহাণুর গতিমুখ বদলানোর জন্য প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত সময়। ‘সূর্য লোহিত দানবে স্ফীত হয়ে ওঠার বেশ কয়েক বিলিয়ন বছর আগে, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা হয়তো কোনো নক্ষত্রকে ফাঁদ পেতে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে আনতে পারবে। এরপর সৌর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে পৃথিবীকে আনতে পারবে নতুন নক্ষত্রটির চারপাশে।’ যোগ করেন ক্রসওয়েল।
পৃথিবীর চেয়ে ভিন্ন ভাগ্য বরণ করবে আমাদের সূর্য। এর মৃত্যু হবে আগুনে নয়, তুষারিত অবস্থায়। ৭০০ মিলিয়ন বছর লোহিত দানব হিসেবে হিলিয়াম জ্বালানি পোড়ানোর পর অবশেষে সূর্য বেশির ভাগ নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলবে। এরপর মহাকর্ষ একে সংকুচিত করে একটা শ্বেতবামনে পরিণত করবে, যার আকৃতি হবে প্রায় পৃথিবীর মতো। সুপারনোভার মতো বিপর্যয়ের দিকে যাওয়ার জন্য আমাদের সূর্য বেশ ছোট। তাই ক্রমান্বয়ে ঠান্ডা হতে থাকবে সূর্য। ফলে ম্লান লাল রঙের দীপ্তি ছড়াবে নক্ষত্রটি, এরপর বাদামি এবং সবশেষে তা কালো রঙের হয়ে যাবে। এটি মহাজাগতিক শূন্যতায় এক টুকরো মৃত নিউক্লিয়ার ছাইয়ের মতো ভাসতে থাকবে সূর্য। আমাদের নিজেদের দেহে ও আমাদের প্রিয়জনদের দেহের পরমাণুসহ আমাদের চারপাশে আমরা যেসব পরমাণু দেখি, তার প্রায় সবগুলোই ভবিষ্যৎ পরিণতি হলো একটা কালো বামন নক্ষত্রের চারপাশে দগ্ধ ছাইয়ের মতো ঘুরতে থাকা। কারণ, এই বামন নক্ষত্রটির ওজন হবে ০.৫৫ সৌরভর। পৃথিবী তখন ঘাঁটি গাড়বে আজকের তুলনায় ৭০ শতাংশ দূরের এক কক্ষপথে।
এই কাল পরিসরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া মাত্র বিলিয়ন বছর ধরে চলবে (এবং বর্তমানে আমরা এই স্বর্ণযুগের অর্ধেক পেরিয়ে এসেছি)। জ্যোতির্বিদ ডোনাল্ড ব্রাউনি বলেন, ‘প্রকৃতিকে আমাদের আনন্দিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি।’ গোটা মহাবিশ্বে জীবনকালের সঙ্গে তুলনা করলে জীবনের ফুলগুলোর স্থায়িত্ব সংক্ষিপ্ততম কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র।
তৃতীয় পর্যায় : অবক্ষয়ের যুগ
তৃতীয় পর্যায়ে (১৫ থেকে ৩৯) এই মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলোর জ্বালানি অবশেষে ফুরিয়ে যাবে। আপাতদৃষ্টে হাইপ্রোজেন পোড়ানোর চিরন্তন প্রক্রিয়া এবং তা থেকে হিলিয়াম উৎপাদন প্রক্রিয়া থেমে যাবে এ সময়কালে। তাতে মৃত নিউক্লিয়ার পদার্থের টুকরোগুলো পড়ে থাকবে বামন নক্ষত্র, নিউট্রন নক্ষত্র ও কৃষ্ণগহ্বর মতো প্রাণহীন টুকরোর মতো। আকাশের নক্ষত্রগুলো আর ঝকমক করবে না, মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে ডুবে যেতে থাকবে অন্ধকারে।
তৃতীয় পর্যায়ে তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। কারণ, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিন হারাতে থাকবে নক্ষত্রগুলো। মৃত নক্ষত্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকা গ্রহগুলোও হয়ে যাবে হিমশীতল। যদি ধরে নেওয়া হয় পৃথিবী তখনো অক্ষত থাকবে, তাহলেও তার ভূপৃষ্ঠ জমাটবাঁধা বরফের আস্তরণ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে থাকা বুদ্ধিমান প্রাণীকে তাই খুঁজে নিতে হবে নতুন কোনো আবাস।
দানবীয় আকৃতির নক্ষত্রগুলো কয়েক মিলিয়ন বছর টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সূর্যের মতো হাইড্রোজেন পোড়ানো নক্ষত্রগুলো টিকে থাকতে পারে কয়েক বিলিয়ন বছর। আর ক্ষুদ্র লোহিত বামন বা রেড ডোয়ার্ফ নক্ষত্রগুলো আসলে কয়েক ট্রিলিয়ন বছরও টিকে থাকতে পারে। এই কারণে একটা লোহিত বামনের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথ স্থানান্তরের চেষ্টা বোধগম্য হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নাক্ষত্রিক প্রতিবেশী হলো প্রক্সিমা সেন্টুরি। এটি একটি লোহিত বামন। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪.৩ আলোকবর্ষ। আমাদের নিকটতম এই প্রতিবেশীর ওজন সৌরভরের মাত্র ১৫ শতাংশ। এটি সূর্যের চেয়ে চার শ ভাগ ম্লান। কাজেই এর মৃদু নাক্ষত্রিক আলো থেকে সুবিধা নিতে চাইলে এর চারপাশে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোকে অবশ্যই খুব কাছে থাকতে হবে। সূর্য থেকে পৃথিবী যে পরিমাণ সূর্যালোক পায়, ওই নক্ষত্রটি থেকেও তা পেতে চাইলে আমাদের সৌরজগতে সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান বর্তমানে যেখানে, তার চেয়েও ২০ গুণ ওই নক্ষত্রটির কাছে থাকতে হবে। কিন্তু একবার কোনো লোহিত বামন নক্ষত্রের চারপাশের কক্ষপথে গেলে আমাদের গ্রহটি কয়েক ট্রিলিয়ন বছর ধরে শক্তি পেতে থাকবে।
সবশেষে একমাত্র সেসব নক্ষত্রই নিউক্লিয়ার জ্বালানি পোড়াতে থাকে, যারা লোহিত বামন। তবে ঠিক সময়মতো তারাও অন্ধকার হয়ে যাবে। এক শ ট্রিলিয়ন বছরে অবশেষে নিঃশেষ হয়ে যাবে বাকি থাকা লোহিত বামনগুলোও।
চতুর্থ পর্যায় : কৃষ্ণগহ্বর যুগ
চতুর্থ পর্যায়ে (৪০ থেকে ১০০) শক্তির একমাত্র উৎস হয়ে উঠবে কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসা ধীরগতির বাষ্পীভূত শক্তি। জ্যাকব বেকেস্টাইন এবং স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন, কৃষ্ণগহ্বর আসলে কালো নয়। সেগুলোও ক্ষীণ শক্তি নিঃসরণ করে। এই শক্তিকে বলা হয় ইভাপোরেশন বা বাষ্পীভবন। (বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বরের বাষ্পীভবন এত অল্প যে তা পরীক্ষামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে দীর্ঘকাল পরিসরের বাষ্পীভবন অবশেষে কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভাগ্য নির্ধারণ করে। )
বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ারত কৃষ্ণগহ্বরের জীবনকাল বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রোটন আকৃতির কোনো মিনি ব্ল্যাকহোল সৌরজগতের জীবনকালে ১০ বিলিয়ন ওয়াট শক্তি বিকিরণ করতে পারে। সূর্যের মতো ওজনের একটা কৃষ্ণগহ্বরের বাষ্পীভূত হতে সময় লাগে ১০^৬৬ বছর। অন্যদিকে একটা গ্যালাকটিক ক্লাস্টারের মতো ওজনের একটা কৃষ্ণগহ্বর বাষ্পীভূত হতে সময় লাগবে ১০^১১৭ বছর। তবে জীবনকালের একদম শেষ পর্যায়ে এসে একটা কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে আসতে হুট করে সেটা বিস্ফোরিত হয়। গৃহহীন লোকজন যেমন মৃতপ্রায় ম্লান আগুনের চারপাশে গাদাগাদি করে ঘিরে থাকে, সেভাবে বুদ্ধিমান প্রাণীরাও হয়তো বাষ্পীভবনরত কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা মৃদু উত্তাপের চারপাশে জড়ো হবে। সেগুলো পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটু উষ্ণতার খোঁজে হয়তো সেখানে থেকে যাবে বুদ্ধিমান প্রাণীরা।
পঞ্চম পর্যায় : অন্ধকার যুগ
পঞ্চম পর্যায়ে (১০১ ছাড়িয়ে) আমরা মহাবিশ্বের অন্ধকার যুগে প্রবেশ করব। তখন তাপের সবগুলো উৎস চূড়ান্তভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই পর্যায়ে এই মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে ধাবিত হবে চূড়ান্ত তাপীয় মৃত্যুর দিকে। কারণ, তখন তাপমাত্রা নেমে যেতে থাকবে পরম শূন্যে। এই পর্যায়ে পরমাণুগুলো নিজেরাই প্রায় থেমে যাবে। সম্ভবত প্রোটনগুলোও ক্ষয় হয়ে যাবে। ফোটনের প্রবহমান সাগর ও দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার কণাগুলোর (নিউট্রিনো, ইলেকট্রন ও তাদের প্রতিকণা পজিট্রন) একটা পাতলা স্যুপ পড়ে থাকবে চারপাশে। এই মহাবিশ্বে তখন হয়তো নতুন ধরনের প্রোটন দেখা যাবে, যার নাম পোজিট্রোনিয়াম। এতে ইলেকট্রন ও পজিট্রন থাকে, যারা পরস্পরের চারদিকে ঘুরতে থাকবে।
কয়েকজন পদার্থবিদ অনুমান করেছেন, ইলেকট্রন ও প্রতি ইলেকট্রনের এসব ‘পরমাণু’ হয়তো এই অন্ধকার যুগে বুদ্ধিমান প্রাণের জন্য নতুন গাঠনিক একক তৈরি করতে সক্ষম হবে। তবে এই ধারণায় কিছু ভয়াবহ অসুবিধাও আছে। সাধারণ অবস্থায়, পোজিট্রোনিয়ামের পরমাণুর আকার একটা সাধারণ পরমাণুর আকারের সমতুল্য। কিন্তু অন্ধকার যুগে একটা পোজিট্রোনিয়ামের পরমাণুর আকার হয়ে উঠতে পারে প্রায় ১০^১২ মেগাপারসেক, যা কিনা বর্তমানে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন গুণ বড়। কাজেই এই অন্ধকার যুগে কোনো পরমাণু গঠিত হলেও, তাদের আকার হবে গোটা একটা মহাবিশ্বের মতো। অন্ধকার যুগে মহাবিশ্ব যেহেতু বিপুল দূরত্বে প্রসারিত হবে, তাই সেখানে খুব সহজে এই দানবীয় পোজিট্রোনিয়াম পরমাণু জায়গা করে নিতে পারবে। তার মানে, এই পরমাণুদের সঙ্গে জড়িত যেকোনো রসায়ন হবে আমাদের এই সময়ের জানা জ্ঞানের পুরোপুরি বাইরের কোনো কিছু।
কসমোলজিস্ট টনি রথম্যান লিখেছেন, ‘এবং অবশেষে ১০^১১৭ বছর পরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু কিছু ইলেকট্রন ও পজিট্রন থাকবে। সেগুলো আটকে থাকবে নিজেদের নীরস কক্ষপথে। ব্যারিয়ন ক্ষয়ের থেকে বেরিয়ে আসবে নিউট্রিনো ও ফোটন। পোজিট্রোনিয়াম ধ্বংস ও কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসবে পথভ্রষ্ট প্রোটন। বুক অব ডেসটিনিতেও এ কথা লেখা আছে।
বুদ্ধিমত্তা কি টিকে থাকতে পারবে
বিগ ফ্রিজের শেষ পর্যায়ে মনকে দমিয়ে দেওয়া অবস্থাগুলো দেখে তর্কযুদ্ধে নামেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের তর্কের বিষয় হলো, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণরূপ এ অবস্থায় টিকে থাকতে পারবে কি না। মহাবিশ্বের পঞ্চম পর্যায়ে বুদ্ধিমান প্ৰাণ টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে আলোচনা করাটা শুরুতে অর্থহীন মনে হতে পারে। এ সময়ে তাপমাত্রা কমে প্রায় পরম শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। তবু বুদ্ধিমান প্রাণ এ রকম একটা সময়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে পদার্থবিদদের মধ্যে চলা বিতর্কটি বেশ জবরদস্ত।
এ বিতর্ক মূলত দুটি প্রধান প্রশ্নকে ঘিরে। প্রথমটি হলো : তাপমাত্রা পরম শূন্যের দিকে চলে গেলে বুদ্ধিমান প্রাণী কি তাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলো চালাতে পারবে? তাপগতিবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী, শক্তি উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রার দিকে প্রবাহিত হয়। তাই শক্তির এই চলাচল ব্যবহার করে যান্ত্রিক কাজ করা যাবে। যেমন দুটি ভিন্ন তাপমাত্রা অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত একটা তাপীয় ইঞ্জিন দিয়ে যান্ত্রিক কাজ বের করে আনা যায়। তাপমাত্রার এই পার্থক্য যত বেশি হবে, ইঞ্জিনের কর্মদক্ষতাও হবে তত বেশি। শিল্পবিপ্লবের কালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও লোকোমোটিভ জাতীয় যন্ত্রগুলোর শক্তির জোগান দেওয়ার ভিত্তি ছিল এটিই। শুরুতে মহাবিশ্বের পঞ্চম পর্যায়ে কোনো তাপীয় ইঞ্জিন থেকে কোনো কাজ আদায় করা অসম্ভব বলে মনে হয়। কারণ, তখন সব তাপমাত্রা সমান বা একই রকম।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো : বুদ্ধিমান প্রাণীরা কি তখন কোনো তথ্য পাঠাতে ও গ্রহণ করতে পারবে? ইনফরমেশন থিওরি বা তথ্য তত্ত্বমতে, সর্বনিম্ন যে এককের তথ্য পাঠানো ও গ্রহণ করা সম্ভব, তা তাপমাত্রার সমানুপাতিক। তাপমাত্রা যখন পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি নেমে যাবে, তখন তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। মহাবিশ্ব শীতল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের বিটগুলোও ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে।
একটা মৃত্যুমুখী মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণী যেসব বিষয় মোকাবিলা করবে, তার পদার্থবিজ্ঞান পুনর্বিশ্লেষণ করেছেন পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন ও অন্য বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, তাপমাত্রা পরম শূন্যের কাছাকাছি চলে গেলেও বুদ্ধিমান প্রাণীদের জন্য কি কোনো দক্ষ উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে?
গোটা মহাবিশ্বের তাপমাত্রা নেমে যেতে শুরু করলে, প্রথমেই জীবজন্তুরা হয়তো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে নিজেদের দেহের তাপমাত্রাও কমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। ক্ষীণ শক্তির জোগান ব্যবহার করতে এই পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি দক্ষ। কিন্তু ক্রমান্বয়ে পানির হিমাঙ্কের কাছে নেমে যাবে দেহের তাপমাত্রা। এ সময় বুদ্ধিমান প্রাণীরা হয়তো তাদের রক্ত-মাংসের পলকা দেহ বাদ দিয়ে ধারণ করবে রোবটিক দেহ। রক্ত-মাংসের তুলনায় যান্ত্রিক দেহ ঠান্ডা বেশি প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু যন্ত্রকেও তথ্য তত্ত্ব আর তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তাই রোবটের জন্য তখন জীবনধারণ হয়ে উঠবে খুব কঠিন।
এমনকি বুদ্ধিমান প্রাণীরা যদি তাদের রোবটিক দেহগুলো ত্যাগ করে আর নিজেদের বিশুদ্ধ চেতনায় রূপান্তর করে ফেলে, তাহলেও সে সময় তথ্য প্রক্রিয়াকরণে সমস্যা দেখা দেবে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকে থাকার একমাত্র উপায় হবে ধীরগতিতে চিন্তা করা। বিজ্ঞানী ডাইসন সবশেষে বলেছেন, কোনো সুদক্ষ বা কৌশলী প্রাণীর রূপ তখনো একটা অনির্দিষ্টকালের জন্য চিন্তাভাবনা করতে পারবে। সেটি করতে পারবে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সময়সীমা বাড়িয়ে ও সংরক্ষিত শক্তি হাইবারনেট করে। চিন্তাভাবনার জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত সময় ও তথ্য প্রক্রিয়াকরণ কয়েক বিলিয়ন বছরে বিস্তৃত হয়ে গেলেও বুদ্ধিমান প্রাণীদের চোখে ‘সাবজেক্টিভ টাইম’ একই থেকে যাবে। কিন্তু এই পার্থক্য তারা বুঝতে পারবে না কখনো। তখনো গভীরভাবে চিন্তা করতে পারবে বুদ্ধিমান প্রাণিসত্তা। কিন্তু তা শুধু অনেক অনেক ধীরগতির কাল পরিসরে সম্ভব হবে। একটা অদ্ভুত, কিন্তু আশাবাদী উপসংহারে ডাইসন বলেন, এভাবে বুদ্ধিমান প্রাণীরা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারবে আর অনির্দিষ্টকাল ধরে চিন্তাও করতে পারবে। একটা মাত্র চিন্তা প্রক্রিয়াকরণে হয়তো লেগে যাবে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর। কিন্তু সাবজেক্টিভ টাইমের সাপেক্ষে চিন্তা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাবে।
কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণীগুলো যদি ধীরগতিতে চিন্তা করে, তাহলে হয়তো তারা মহাবিশ্বে সংঘটিত মহাজাগতিক কোয়ান্টাম ক্রান্তিকাল বা এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোর সাক্ষী হবে। স্বাভাবিকভাবে এ রকম মহাজাগতিক ক্রান্তিকাল, যেমন শিশু মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা অন্য কোনো কোয়ান্টাম মহাবিশ্বের ক্রান্তিকাল সংঘটিত হয় কয়েক ট্রিলিয়ন বছরে। কাজেই সেগুলো সত্যিকার অর্থেই তাত্ত্বিক। মহাবিশ্বের পঞ্চম পর্যায়ে সাবজেক্টিভ টাইমে ট্রিলিয়ন বছর সংকুচিত হয়ে যাবে। হয়তো তা মাত্র কয়েক সেকেন্ড হিসেবে ধরা দেবে ওই সব প্রাণীর কাছে। এই প্রাণীরা এতই ধীরগতিতে চিন্তাভাবনা করবে যে তারা হয়তো সব সময়ই অদ্ভুত কোয়ান্টাম ঘটনাগুলোও ঘটতে দেখতে পাবে। হয়তো দেখতে পাবে নিয়মিত শূন্য থেকে উদ্ভব হওয়া বুদ্বুদ মহাবিশ্ব কিংবা বিকল্প মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম লাফও।
কিন্তু মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হচ্ছে, সাম্প্রতিক এই আবিষ্কারের আলোকে ডাইসনের গবেষণা আবারও পরীক্ষা করে দেখেছেন পদার্থবিদেরা। তাতে নতুন একটা বিতর্ক উসকে দিয়েছে। পাশাপাশি বিপরীত সিদ্ধান্তও পাওয়া গেছে এ পরীক্ষা থেকে। সেটি হলো : একটা প্রসারণশীল মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীরা অনিবার্যভাবে ধ্বংসের মুখে পড়বে। পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস এবং প্লেন স্ট্যাকম্যান সিদ্ধান্তে এসেছেন, ‘কোটি কোটি বছর আগে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর টিকে থাকার পক্ষে মহাবিশ্ব ছিল অতি উত্তপ্ত। অসংখ্য যুগ পেরিয়ে মহাবিশ্ব একসময় এতই ঠান্ডা ও শূন্য হয়ে যাবে যে বুদ্ধিমান প্রাণীরা যতই সুদক্ষ বা কৌশলী হোক না কেন, তারা ধ্বংস হবেই।’
নিজের এই মৌলিক গবেষণায় ডাইসন অনুমান করেন, মহাবিশ্বের ২.৭ ডিগ্রি মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ কমে যেতে থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। কাজেই বুদ্ধিমান প্রাণীরা হয়তো এই অতি অল্প তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে তাদের ব্যবহারযোগ্য কাজ বের করে আনতে পারবে। তাপমাত্রা কমে যাওয়া যতক্ষণ অব্যাহত থাকবে, ততক্ষণ ব্যবহারযোগ্য কাজ সব সময় বের করে আনা যাবে। কিন্তু ক্রাউস ও স্ট্যাকম্যান উল্লেখ করেছেন, মহাবিশ্বের যদি একটা মহাজাগতিক ধ্রুবক থাকে, তাহলে ডাইসনের অনুমান মতো, তাপমাত্রা চিরতরে কমে যাবে না। বরং একটা নিম্নতর সীমায় বা গিবসন-হকিং তাপমাত্রায় (প্রায় ১০^-২৯ ডিগ্রি) পৌঁছাবে। একবার এই তাপমাত্রায় নেমে গেলে, গোটা মহাবিশ্বের তাপমাত্রা একই হয়ে যাবে। তখন তাপমাত্রার পার্থক্যের কৌশল খাটিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীরা ব্যবহারযোগ্য শক্তি আহরণ করতে পারবে না। মহাবিশ্ব একবার সুষম কোনো তাপমাত্রায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবে সব রকম তথ্য প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণ।
(১৯৮০-এর দশকে দেখা গিয়েছিল, কোনো তরলে ব্রাউনিয়ান চলনের মতো নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম সিস্টেম কম্পিউটারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। বাইরের তাপমাত্রা কতটা ঠান্ডা, সেটা এখানে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। কাজেই তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গেলেও এসব কম্পিউটার অল্প শক্তি ব্যবহার করে গণনা করতে পারে। ডাইসনের জন্য এটা বেশ ভালো সংবাদ। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা আছে। এই সিস্টেমকে দুটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে: একে অবশ্যই তার পরিবেশসহ সাম্যাবস্থায় থাকতে হবে। আবার কখনো তথ্য বাদ দেওয়া যাবে না এই সিস্টেমে। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি প্রসারিত হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে সাম্যাবস্থা থাকা অসম্ভব। কারণ, বিকিরণ অস্পষ্ট বা ক্ষীণ হয়ে যাবে এবং প্রসারিত হয়ে যাবে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও। প্রসারণশীল কোনো মহাবিশ্ব এত দ্রুত পরিবর্তিত হয় যে এই সিস্টেম সাম্যাবস্থা পৌঁছাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, কখনো কোনো তথ্য বাদ না দেওয়ার প্রয়োজনীয় শর্তের মানে হলো, বুদ্ধিমান প্রাণী অবশ্যই কখনো ভুলে যেতে পারবে না। ক্রমান্বয়ে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী পুরোনো স্মৃতিগুলো বাদ দিতে অক্ষম হবে। হয়তো নিজেকে পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়তে দেখবে। ‘অনন্তকাল সৃজনশীলতা ও অন্বেষার দিকচিহ্নহীন দিগন্তের বদলে একটা জেলখানা হয়ে উঠতে পারে। এটা নির্বাণও হতে পারে, কিন্তু তাকে কি বেঁচে থাকা বলে?’, প্রশ্ন তুলেছেন ক্রাউস ও স্ট্যাকম্যান।)
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা দেখতে পাই, মহাজাগতিক ধ্রুবক যদি শূন্যের কাছাকাছি হয়, তাহলে মহাবিশ্ব শীতল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমান প্রাণীরা হাইবারনেট করে ও ধীরগতির চিন্তা প্রক্রিয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য চিন্তাভাবনা করতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো একটা প্রসারণশীল মহাবিশ্বে তা অসম্ভব। পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুসারে, সব বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংসের মুখে পড়তে হবে।
এই মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রাণের টিকে থাকার জন্য আমরা যেসব শর্তের কথা জানি, তা অনেক বড়সড় নকশাবোনা কাপড়ের মধ্যে একটা ক্ষণস্থায়ী পর্ব মাত্র। গোটা কাপড়ের অতিক্ষুদ্র একটা অংশ। সেখানে কেবল তাপমাত্রা জীবনের উপযোগী, যা খুব ঠান্ডাও নয়, আবার খুব গরমও নয়।
মহাবিশ্ব ছাড়িয়ে
মৃত্যুকে সব তথ্য প্রসেসিংয়ের চূড়ান্ত অবসান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলো বুঝতে সক্ষম মহাবিশ্বের যেকোনো বুদ্ধিমান প্রজাতি মহাবিশ্ব ও তাতে থাকা সব বুদ্ধিমান প্রাণীর চূড়ান্ত মৃত্যুর মুখোমুখি হতে বাধ্য হবে।
সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, এ ধরনের যাত্রার জন্য শক্তি জড়ো করার পর্যাপ্ত সময় রয়েছে এবং সেখানে বেশ কিছু বিকল্পও রয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে সেগুলো দেখব আমরা। সেখানে একটা প্রশ্নের অনুসন্ধান করে দেখা হবে : পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো কি আমাদেরকে কোনো প্যারালাল মহাবিশ্বে পালিয়ে যাওয়ার অনুমোদন করে?
তথ্যনির্দেশ
তাপগতিবিদ্যা : কোনো গতিশীল ভৌত সিস্টেমে শক্তি, কাজ, তাপ ও এনট্রপির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা। তাপগতিবিদ্যা আসলে গ্যাসের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। বড় পরিসরে গ্যাসের অণুগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যে তাপমাত্রা ও চাপের সৃষ্টি হয়, তার ব্যাখ্যা করে এটি। এই বিষয়টি প্রকৃতির একগুচ্ছ সূত্র দিয়ে শুরু হয়, যাদের সঙ্গে তাপমাত্রা, চাপ ও আয়তন জড়িত। তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র আছে।
এনট্রপি : এনট্রপি হচ্ছে একটি সিস্টেমের এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। যে সিস্টেম যত এলোমেলো, তার এনট্রপি তত বেশি। তাপগতিবিদ্যার সূত্রমতে, মহাবিশ্বের সব বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু এনট্রপি জড়িত। এতে যখনই কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে, তখনই তার এনট্রপি বেড়ে যায়। এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো বস্তুর ভেতরের অণু, পরমাণুগুলো আর এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হওয়া। বিজ্ঞানী বোলজম্যানের মতে, এনট্রপি একটি সম্ভাবনা। এনট্রপি এবং সম্ভাব্যতার মধ্যে লগারিদমিক সংযোগ প্রথম উত্থাপন করেছিলেন বোলজম্যান। তখনকার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তাপগতিবিদ্যায় সম্ভাব্যতার ধারণা সংযোজন করা উচিত। এভাবে তার হাত ধরে পরিসাংখ্যিক তাপগতিবিদ্যারও জন্ম হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে এনট্রপি নামক একটি গাণিতিক রাশির মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব।
পরম শূন্য : সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ তাপমাত্রায় বস্তুতে কোনো তাপশক্তি থাকে না। প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কেলভিন স্কেলে শূন্য।
প্রতিকণা : প্রতিটি ধরনের পদার্থ কণার একটি বিপরীত প্রতিকণা থাকে। একটি কণা যখন তার প্রতিকণার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন দুটিই ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু শক্তি অবশিষ্ট থাকে।
কোয়ান্টাম লাফ : বোরের পরমাণু মডেলমতে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে এক কক্ষপথ থেকে আরেকটি কক্ষপথে ইলেকট্রন হঠাৎ লাফ দেয়। একেই বলে কোয়ান্টাম লাফ। বিভিন্ন পরমাণু কেন বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ বা নিঃসরণ করে, এই কোয়ান্টাম লাফের মাধ্যমেই তা ব্যাখ্যা করা যায়।
পজিট্রন (Positron) : ধনাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনের প্রতিকণা।