১০. সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারত

দশম অধ্যায় – সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারত

আমরা আলোচনার সুবিধার্থে সপ্তদশ শতককে দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। প্রথমার্ধে। যেখানে জাহাঙ্গির (১৬০৫-২৭) ও শাহজাহানের (১৬২৭-৫৮) দাপট বর্তমান ছিল, সেখানে দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) প্রভাব। সাধারণভাবে প্রথমার্ধকে বলা যায় অভ্যন্তরীণ শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পর্ব আর দ্বিতীয়ার্ধে বিবেচিত হতে পারে রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি একাধিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় স্থবিরতা ও আর্থিক অবক্ষয়ের পর্ব হিসাবে। যদি এই যুক্তি স্বীকার নাও করি তাহলেও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির আলোচনার সুবিধার্থে আমরা সপ্তদশ শতককে এই দুই ভাগে ভাগ করতেই পারি। তবে অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশের আলোচনাকে আলাদা করলে সপ্তদশ শতক একটি সমন্বয়ী শতক হিসাবে পরিচালিত হতে পারে নিঃসন্দেহে।

জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেক—প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা

১৬০৫ সালে আকবরের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিম সিংহাসনে বসেছিলেন এবং জাহাঙ্গির উপাধি ধারণ করেছিলেন। তাঁর আর দুই ভাই মুরাদ ও দানিয়াল অনেক আগেই অত্যধিক মদ্যপানের কারণে মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু তাই বলে জাহাঙ্গিরের সিংহাসন আহরণের পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। তার পিতার খুব প্রিয় একজন অভিজাত যিনি নিজে হাতে জাহাঙ্গিরকে রাজতিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে তিনি অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন মেবার জয়ের সময়। আগে তিনি কয়েক বার ট্রানঅক্সিয়ানায় কিংবা দাক্ষিণাত্যে যেতে অস্বীকারও করেছিলেন। আকবর তার অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যেস নিয়েও চিন্তায় ছিলেন। যদিও এই মদ্যপানের নেশা করা যেন তৈমুরীয়দের মজ্জাগত পাপ ছিল। জাহাঙ্গিরকে এই নেশা ও খারাপ সঙ্গীসাথীদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ আকবর পেয়েছিলেন। ১৫৯৯ সালে আকবর যখন দাক্ষিণাত্যে ছিলেন, তখন সেলিমকে তার কয়েকজন সঙ্গীসাথী আগ্রা গিয়ে রাজকোষ লুঠ করার কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। কিন্তু সে কাজ করেননি সেলিম। যুমনা নদী পার করে তিনি এলাহাবাদে থেকে গিয়েছিলেন। তিনি কল্পি, জৌনপুর ও বিহারে প্রাদেশিক শাসক নিয়োগ করেছিলেন এবং বিহারের রাজকোষ থেকে ত্রিশ লক্ষ টাকা লুঠ করেছিলেন।

আকবর দ্রুত আগ্রায় ফিরে এসেছিলেন। তাঁর প্রিয় সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক যাতে খারাপ না হয়ে যায় সেই কারণে তাঁকে বাংলা ও উড়িষ্যা শাসন করার দায়িত্ব। দিয়েছিলেন। কিন্তু সেলিম এলাহাবাদ ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না এবং সেখানে। নিজের নামে মুদ্রাও চালু করে দিয়েছিলেন। আকবরের আদেশে আবুল ফজল যখন দাক্ষিণাত্য থেকে আগ্রা ফিরছিলেন, তখন পথে বুন্দেলা প্রধান বীর সিং দেও বুন্দেলাকে দিয়ে তাকে খুন করানোর পিছনেও বড়োসড়ো হাত ছিল সেলিমের। আকবর এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং বীর সিং দেওকে যেভাবে তোক খুঁজে বের করে চরম শাস্তি দেবার আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু বীর সিং দেও জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। এর মধ্যে আকবরের জননী হামিনা বানু আকবরের গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে বাবা ও ছেলের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। সে অনুরোধে কাজও দিয়েছিল। সেলিম ১৬০৩ সালে এলাহাবাদ থেকে ফিরে এসে আগের মতো কাজে মন দিয়েছিলেন।

এই ভাবে যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করে আকবর তার দুই সেরা অভিজাত রাজা মান সিংহ ও খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকার মাধ্যমে সেলিমকে তার অন্য পুত্র খসরুর থেকে আলাদা করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। মান সিংহ ছিলেন খসরুর মামা এবং আজিজ কোকার কন্যাকে খসরুর সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। সেলিম যখন লজ্জাজনক কাজে মত্ত ছিলেন তখন খসরু আকবরের খুব কাছে চলে এসেছিলেন। তাছাড়া খসরু অনেক বেশি সংস্কৃতিমনস্ক ও রুচিসম্পন্ন ছিলেন এবং সেলিমের মতো দুশ্চরিত্রের অধিকারী তিনি ছিলেন না। তাই যখন সেলিম মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরি হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাননি মান সিংহ ও আজিজ কোকা, কারণ তারা আকবর যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে, তখন অভিজাতদের একটি আলোচনাসভা ডেকে পরবর্তী মুঘল উত্তরসূরি প্রায় মনোনীত করেই ফেলেছিলেন। তাই সেলিমের প্রস্তাব যে খারিজ হয়ে যাবে তা বোঝাই যাচ্ছিল। যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে পিতার জীবিত অবস্থায় উত্তরসূরি নির্বাচন ‘চাঘতাই তাতারদের আইন ও রীতিবিরুদ্ধ এবং তা কখনোই কাম্য নয়।’

তবে এই পদক্ষেপ যেখানে আকবরের কোনো নজরদারি ছিল না তা যে ভেস্তে যাবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আকবরের অভিজাতদের ষড়যন্ত্র রুখতে শেখ ফরিদ বুখারি বারহার সৈয়দ ও সেলিমের অন্যান্য সমর্থকদের ডেকে পাঠান সেলিমের দাবিকে শক্তিশালী করার জন্য এবং তাকে সমস্বরে তুলে ধরা হয় ইসলামের রক্ষাকারী হিসাবে। এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা সে নিয়ে সন্দেহ আছে। এই ঘটনাকে এভাবে ধর্মীয় রং লাগানোও বোধ হয় ঠিক হবে না, কারণ ঘটনাচক্রে জাহাঙ্গির খসরুর বিরুদ্ধে বা মান সিংহ ও আজিজ কোকার বিরুদ্ধে কোনোরকম পদক্ষেপ নেননি। বরং তিনি পুরোনো আকবরশাহী অভিজাতদের ব্যাপারে চিন্তিতই ছিলেন এবং খসরুকেও আধা-আটক করে রেখে দিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু খসরু স্বাধীন হওয়ার বাসনা ছেড়ে দিতে পারেননি, তাই তিনি ছয় মাস পর আগ্রা থেকে ৩৫০ জনের একটা দল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। লাহোর যাওয়ার পথে তিনি কয়েকজন বদাখাসানীয়, আফগান ও ভারতীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে তার বাহিনীকে ১২,০০০-এ রূপান্তরিত করে লাহোর পৌঁছেছিলেন। কিন্তু লাহোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক দিলওয়ার খান তাঁকে শহরে প্রবেশ করার অনুমতি দেননি। জাহাঙ্গির দ্রুত সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি কিন্তু তখনও সম্পূর্ণ ভাবে আকবরশাহী অভিজাত ও রাজপুতদের বিশ্বাস করতে পারেননি বোধ হয়, না হলে তিনি তুজুক-এ এটা বলতেন না যে, কয়েকজন। ‘অদূরদর্শী মানুষ স্বপ্ন দেখছে, খসরুকে হাতিয়ার করে তার রাষ্ট্রের কাছে দাদাগিরি করবে। জাহাঙ্গির এই ভেবে স্বস্তিতে ছিলেন যে খসরু বাংলার দিকে এগোবে না কারণ সেখানে তার মামা মান সিংহ দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক। জাহাঙ্গির বদাখাসানীয়দের। ওপর খুব একটা নির্ভর করতে পারছিলেন না কারণ তার মতে এদের মেজাজ ছিল ‘রাজদ্রোহাত্মক ও দাঙ্গাপ্রবণ। তিনি বলেছিলেন যে তার রাজকীয় বাহিনীতে থাকা বহু আইমক ও তুর্কি উপজাতির সেনা নাকি ভিতরে ভিতরে খসরুর সঙ্গে জোট বেঁধেছে। তিনি রাজপুতদের আনুগত্য নিয়েও সন্দিগ্ধ ছিলেন, মান সিংহকে তিনি পোড় খাওয়া নেকড়ে’বলে ডাকতেন। এমনকি আকবরের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিকানেরের শাসক রাই সিংহ রাজ মর্যাদা ছেড়ে লাহোর চলে গিয়েছিলেন এক জ্যোতিষীর ভবিষ্যত্বাণী শুনে যে জাহাঙ্গিরের রাজত্বের মেয়াদ নাকি খুব অল্প।

জাহাঙ্গির কতটা কঠোর হতে পারেন তার প্রমাণ মেলে যখন তিনি খসরুকে ভাইরোয়ালের একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন এবং আফগানিস্তান পালানোর সময় আটক করেছিলেন। লাহোরের কাছে দুই ধাপের ফাঁসিকাঠ নির্মাণ করে খসরুর অনুগামীদের সেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বৈরাম খাঁর পুত্র আবুর রহিমকে নৃশংস ভাবে অত্যাচার করার পর ক্ষমা করা হয়েছিল। নূরজাহানের পিতা ইতিমাদ-উদ-দৌলাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং দুই লক্ষ টাকা জরিমানার বিনিময়ে ছাড়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ শরিফকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। থানেশ্বরের শাসক তথা খসরুর ঘনিষ্ঠ শেখ নিজামকে মক্কায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। খসরুর কপালে টিকা দেওয়া ও কিছু আর্থিক সাহায্য করার অপরাধে শিখ গুরু তথা অমৃতসরের হরমন্দির (স্বর্ণ মন্দির) নির্মাণের কাণ্ডারি অর্জুনকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছিল, কিন্তু গুরু সেই জরিমানা দিতে অস্বীকার করলে তাকেও হত্যা করা হয়েছিল।

এর কিছুদিনের মধ্যে যখন জাহাঙ্গির কাবুলে অবস্থান করছিলেন তখন তার কনিষ্ঠ। সন্তান খুররম একটি ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেখিয়েছিলেন যে খসরু নাকি জাহাঙ্গিরকে হত্যা করার অভিসন্ধি করছিলেন। জাহাঙ্গির এটা শুনে খসরুকে অন্ধ করে দেবার আদেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি আর কখনো সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখতে না পারেন।

এর পর খসরুকে কি পরিমাণ কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল তা আর উল্লেখ নাই-বা করলাম, শুধু এইটুকু বলতে পারি যে ১৬২০ সালে তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাকে একাধিক ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল। তবু এটা জেনে ভালো লাগে যে এই সময়ে তার পক্ষে অন্তত একটা বিক্ষোভ হয়েছিল।

খসরুর বিরুদ্ধে জাহাঙ্গিরকে সন্দেহবাতিক ও অসহিষ্ণু করে তুলেছিল যা আদৌ তার স্বাভাবিক চরিত্র ছিল না। এর ফলে তিনি সেইসব মানুষের সামনে এনেছিলেন। যারা তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং যাদের তিনি সবথেকে বেশি বিশ্বাস করেন। এই ভাবে তিনি শরিফ খানকে উজির-পদ ও আমির-উল-উলেমা উপাধি দান করেছিলেন। জাহাঙ্গিরকে শান্ত করতে আকবর খাজা আবদুস সামাদ নামে এক চিত্রশিল্পীকে পাঠিয়েছিলেন যার পুত্র ছিলেন এই শরিফ খান। তার কোনো যোগ্যতাই ছিল না এই পদের জন্য এবং রাজপুরুষদের কাছে তিনি খুব একটা প্রিয়পাত্র ছিলেনও না। কিন্তু তিনি কেবল জাহাঙ্গিরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে উজির পদে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাহাঙ্গির একই ভাবে মির্জা গিয়াস বেগকেও তুলে এনেছিলেন যুগ্ম উজির পদ ও ইতিমাদ-উদ-দৌলা উপাধি দান করে।

সাম্রাজ্যের এলাকাভিত্তিক বিস্তার ও সুদৃঢ়করণ : মেবার, পূর্ব ভারত ও কাংড়া

সিংহাসনে নিজের অবস্থানকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করলেও জাহাঙ্গিরের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল আকবরের রেখে যাওয়া বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। এই কাজে তাঁকে প্রথমেই আগের দীর্ঘদিন ধরে চলা বিবাদগুলোর মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, বিশেষ করে মেবারের রানার সঙ্গে বিবাদ এবং মালিক অম্বর কর্তৃক দাক্ষিণাত্যে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাকে। সেই সঙ্গে বাংলার আফগান বিপদ সামলানোও বাকি ছিল তাঁর।

আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি কীভাবে ১৬১৫ সালে জাহাঙ্গির অদম্য প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক নমনীয়তায় মেবারের সঙ্গে চলা বিবাদের একটা সুরাহা বার করেছিলেন। এই ঘটনা তাকে রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করতে উৎসাহ দিয়েছিল। ১৬২০ সালে তিনি মালিক অম্বরের দাক্ষিণাত্যে মুঘল-বিরোধী শক্তি জোট গড়ে তোলার অভিসন্ধি ভেস্তে দিতে এবং ১৬০০ সালে আহমেদনগরের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে প্রাপ্ত এলাকার ওপর মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে তৈরি হওয়া বিবাদের আপাত একটা মীমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই বলা হয় যে মুঘলদের সীমিত শক্তি নিয়ে দাক্ষিণাত্যে মুঘল কর্তৃত্ব বিস্তারের আর প্রচেষ্টা না চালানো মুঘল সামরিক শক্তির দুর্বলতা ছিল না, বরং তা ছিল জাহাঙ্গিরের তুখোড় একটি নীতি।

মেবারে বিবাদের মীমাংসা ও মালিক অম্বরকে সংযত রাখা ছিল জাহাঙ্গিরের দুই বলিষ্ঠ কৃতিত্ব, যদিও ঐতিহাসিকরা জাহাঙ্গিরকে এই ব্যাপারে কৃতিত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত একটু সাবধানতা অবলম্বন করে থাকেন।

জাহাঙ্গিরের তৃতীয় কৃতিত্ব ছিল বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করা। যদিও আকবর সেখানকার আফগান শক্তির শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলেন, তবুও পূর্ববাংলার বিভিন্ন অংশে তখনও আফগান প্রধানদের হম্বিতম্বি বজায় ছিল। সেখানকার বহু হিন্দু রাজারা আফগানদের সাহায্য করত। যশোর, কামরূপ (পশ্চিম অসম), কোচর, তিপেরা প্রভৃতি এলাকার রাজাদের এভাবে আফগান প্রধানদের সাহায্য করতে দেখা গিয়েছিল। আকবর তার শাসনের শেষ দিকে বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক মান সিংহকে দরবারে ডেকে নিলে তার অনুপস্থিতিতে আফগান নেতা উসমাদ খান ও অন্যান্যরা সেখানে বিদ্রোহ সংগঠিত করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে জাহাঙ্গির মান সিংহকে বাংলায় পুনরায় প্রেরণ করলেও কোনো কাজ হয়নি, অবস্থা আরও খারাপ হয়ে ওঠে। ১৬০৮ সালে জাহাঙ্গির বাংলার দায়িত্ব দেন মুঘলদের প্রিয় সুফি সন্ত সেখ সালিম চিশতীর পৌত্র তথা জাহাঙ্গিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইসলাম খানের হাতে। তরুণ ও অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম খান যেভাবে বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন তা অবশ্যই ছিল প্রশংসনীয়। তিনি যশোরের রাজা সহ বাংলার বহু গুরুত্বপূর্ণ জমিদারের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কৌশলগত ভাবে, গুরুত্বপূর্ণ ঢাকায় মুঘলদের প্রধান কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। তিনি প্রথমে সোনারগাঁও জয় করার চেষ্টা করেছিলেন যা মৌসা খান ও তার দল বারা (বারো) ভূঁইয়াদের অধিকারে ছিল। তিন বছর ধরে অভিযান চালিয়ে সোনারগাঁও দখল করা সম্ভব হয়েছিল। তার অব্যবহিত পরে মৌসা খান আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং তাঁকে আটক করে দিল্লি দরবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পর মুঘল কোপ পড়েছিল উসমান খানের ওপর। তাকে এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধে পরাজিত করা হয়েছিল। এই ভাবে প্রধান প্রধান আফগান নেতার শক্তি দুর্বল করার পর বাদবাকি আফগান ও অন্যান্য বিদ্রোহীরা একে-একে আত্মসমর্পণ করেছিল। যশোর, সিলেট, কোচর ও কামরূপ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এইভাবে মুঘল সাম্রাজ্য পূর্বদিকে একেবারে সমুদ্র উপকূল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এই নব অধিকৃত অঞ্চলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যে প্রাদেশিক রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এলাকাটির ব্যাপক উন্নতি ঘটানো হয়। এ সময় অসমের অহম শাসক একটা আক্রমণ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা দমন করতে মুঘলদের খুব বেশি সময় লাগেনি।

আকবরের মতো জাহাঙ্গিরও বুঝেছিলেন যে কেবলমাত্র সামরিক শক্তির দ্বারা সাম্রাজ্য ধরে রাখা সম্ভব নয়, তার জন্যে দরকার স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। তাই তিনি পরাজিত আফগান নেতা ও তাদের অনুগামীদের সঙ্গে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল আচরণ করেছিলেন। কিছুদিন দরবারে আটক করে আনা বাংলার বহু রাজা ও জমিদারদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তারা বাংলায় ফিরে এসেছিলেন। এমনকি মৌসা খানকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে তার এলাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলায় সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি ফিরে এসেছিল। এই প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে গিয়েছিল যখন আফগানদের মুঘল অভিজাততন্ত্রে বিশাল সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ পদ দান করা হয়েছিল। জাহাঙ্গিরের আমলে প্রধান আফগান অভিজাত ছিলেন খান-ই-জাহান লোদি যাকে দাক্ষিণাত্যে মুঘল অভিযানের নেতৃত্ব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি জাহাঙ্গিরের আমলে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন বলে জানা যায়।

কংড়া

বর্তমান হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত কাংড়া দুর্গ সে সময় ওই অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী একটা ঘাঁটি ছিল। ধীরে ধীরে অথচ দৃঢ় ভাবে পার্বত্য এলাকায় মুঘল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল এবং কুমাউনের মতো বহু পার্বত্য এলাকার রাজা মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিয়ে নজরানা প্রদানে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এটা মনে করা হয়েছিল যে কাংড়ার রাজা যতদিন না তার পাহাড়ি দম্ভ ত্যাগ করে মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করবেন, ততদিন পর্যন্ত ওই অঞ্চলের অন্যান্য রাজারাও মুঘল পদানত হবে না। ১৬১৫ সালে পাঞ্জাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক মুরতাজা খানের নেতৃত্বে কাংড়ার বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালানো হলেও তা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৬২০ সালে সেখানকার দূর্গ কাংড়া দখলের জন্য রাজা বিক্রমজিৎ বাঘেলাকে পাঠানো হয়। কয়েকদিন অবরোধ করে রাখার পর দুর্গের সেনাপতি অস্ত্রসমর্পণ করেন। এরপর দুর্গে মুঘল সেনাধিপতি ও ফৌজদার নিয়োগ করা হয় দুর্গ সহ সমগ্র এলাকার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৬২২ সালে অসুস্থ থাকা জাহাঙ্গির সমতলের দম বন্ধ করা উষ্ণ আবহাওয়া থেকে কিছুদিনের জন্য শান্তি পেতে যখন পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণ করছিলেন, তখন তিনি কাংড়া সফর করেছিলেন। এই দুর্গ যে এবার থেকে ইসলামিক শক্তির দখলে চলে এসেছে তা বোঝানোর জন্যই জাহাঙ্গির সেখানে নিজের নামে খুৎবা পাঠ করেছিলেন এবং একটি বলদের বলি দিয়ে সেখানে এক ঝাঁ-চকচকে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন।

কাংড়া দুর্গ দখলে রাখার সুবাদে অচিরেই ওই অঞ্চলের সবথেকে শক্তিশালী চাম্বার রাজা মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন এবং তারপরেই জাহাঙ্গির বলেছিলেন যে, তাঁর সাম্রাজ্য যেন ‘এই অঞ্চলের সব জমিদারের (রাজা) মিলন আশ্রম’–আর তাই এখন থেকে তার আর কোনো রাজাকে মান্য করবার বা উপহার প্রেরণ করবার দরকার নেই।

নূরজাহান এবং নুরজাহান ‘চক্র’ (Junta)

তিনি মেহেরুন্নিসা, ১৬১১ সালে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে বিবাহ সংগঠিত হবার পর যিনি নূরজাহান উপাধি লাভ করেছিলেন, তিনি ছিলেন পারস্যের শাসক শাহ তাহমাসপের নেতৃত্বাধীন সাফাভিদ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আর্থিক আধিকারিক হিসাবে কাজ করা খাজা মহম্মদ শরিফ তেহরানির পৌত্রী। তার মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়ের কালো ছায়া, আর তাই তাঁর পুত্র খাজা গিয়াস বেগ (যিনি পরে ইতিমাদ-উদ-দৌলা নামে পরিচিত হয়েছিলেন) ভাগ্য অন্বেষণের জন্য ভারতে চলে অসেন। কিন্তু ভারত আসার পথেই তার সর্বস্ব লুঠ হয়ে যায় এবং ১৫৭৭ সালে কান্দাহারে জন্মগ্রহণ করেন গিয়াস বেগের দ্বিতীয় কন্যা মেহেরুন্নিসা। তাঁদের ক্যারাভান দলের নেতা গিয়াসের অবস্থা দেখে খুব কাতর হয়ে পড়েন এবং তিনিই তাদের ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের কাছে নিয়ে আসেন। গিয়াস বেগকে মুঘল দরবারে চাকরি দেওয়া হয় এবং দ্রুত তিনি তাঁর কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে ১৫৯৫ সালে কাবুলের দিওয়ান পদে উন্নীত হন। ক্রমে তাঁর আরও পদোন্নতি ঘটে এবং অচিরেই তাকে কারখানা দেখাশোনা করার জন্য দিওয়ান বুয়ুদত পদে নিয়োগ করা হয়।

গিয়াস বেগের প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গির ১৬০৫ সালে তাকে তার সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলের দিওয়ান পদে বসিয়েছিলেন এবং ইতিমদ-উদ দৌলা’ উপাধি দান করে মনসব তার ৫০০০-এ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যখন খসরু কর্তৃক জাহাঙ্গিরকে হত্যা করার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গিয়েছিল তখন দোষ গিয়ে পড়েছিল ইতিমাদ-উদ-দৌলা ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শরিফের ওপর। দিওয়ান পদ থেকে অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং কিছুদিন পর জরিমানা দিয়ে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। দুই বছর পর (১৬০৯) ইতিমাদকে তার পূর্ব পদ ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে মেহেরুন্নিসাকে সতেরো বছর বয়সে এক ইরানীয় যোদ্ধা তথা ১৫৭৬ সাল থেকে ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় শাহ ইসমাইলের সহকারী হিসাবে কাজ করা আলি কুলি ইসতাজলুর সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। পৃষ্ঠপোষক দ্বিতীয় শাহ ইসমাইলের মৃত্যুর পর আলি কুলি দরবার ছেড়ে চলে আসেন এবং সময়ের হাত ধরে এক সময় তিনি খান-ই-খানান আবদুর রহিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এর পর তিনি শাহজাদা সেলিমের মেবার আক্রমণের দলে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে তার সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখে তাকে শের আফগান নামে এক অদ্ভুত উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।

শের আফগানের মুঘল শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হবার সুবাদে মেহেরুন্নিসা আগ্রায় আসতে পেরেছিলেন এবং এখানেই জাহাঙ্গিরের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। কীভাবে তা প্রায় সকলেই জানে। সেলিম যখন আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তার ঠিক পরেই শের আফগানের সঙ্গে সেলিমের বিবাদ শুরু হয়। তবে সিংহাসনে বসার পর তিনি শের আফগান সহ আর যারা যারা তার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের সকলকেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে এবার তিনি শের আফগানকে পুর্ব বাংলার বর্ধমান নামে একটি জায়গার দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ করেন, এখানে তখনও মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া জায়গাটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও আফগান বিদ্রোহীতে ভরা ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই কাজে মনোযোগের অভাব ও আফগান বিদ্রোহীদের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগে শের আফগানকে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। জাহাঙ্গির তার বৈমাত্রেয় ভাই কুতুবুদ্দিন খানকে বাংলার নতুন সুবেদার নিয়োগ করে শাহ আফগানকে বদলি করার আদেশ কার্যকর করার দায়িত্ব দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে যায় আর এক যুদ্ধে উভয়েই প্রাণ হারান। পরবর্তীকালে এক কালপঞ্জি থেকে জানা যায় যে জাহাঙ্গির নাকি মেহেরুন্নিসার প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, তাই পথের কাটা হিসাবে শাহ আফগানকে সরিয়ে। দিতেই এই ষড়যন্ত্র তিনি করেছিলেন। কিন্তু সচেতন ঐতিহাসিকরা এই গল্পকে মেনে নিতে চান না।

এর পর চার বছর ধরে মেহেরুন্নিসা আগ্রাতে ছিলেন সালিমা সুলতানা বেগমের দেখাশোনায়। মিনাবাজারে একদিন হঠাৎ জাহাঙ্গির তাকে দেখেন ও প্রথম দেখাতেই তাঁর প্রেমে পড়ে যান। উভয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয় ১৬১১ সালে। সেই সময় মেহেরুন্নিসা একজন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি পরিণত মহিলা হলেও তার হাসিখুশি মনোভাব, কথোপকথনে মিষ্টতা, তার জ্ঞান ও অবশ্যই তার অপরূপ লাবণ্য তাঁকে সবসময় সুন্দরী করে রেখেছিল। প্রথমে জাহাঙ্গির তার নাম দেন নূরমহল, তারপরে নূরজাহান এবং সব শেষে বাদশা বেগম। কিন্তু ইতিহাসে তিনি নূরজাহান নামেই পরিচিত হয়ে আছেন।

জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের শেষ ষোলো বছরে নূরজাহানের ভূমিকা এবং দরবারের রাজনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে একাধিক বিতর্ক রয়েছে। শাহজাহানের আমলের প্রথম দিকে লেখা মুতাম্মেদ খানের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে নূরজাহানের পিতা ইতিমাদ-উদ-দৌলা এবং ভাই আসফ খান এ সময় ধাপে ধাপে ওপরে উঠে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে সাম্রাজ্যের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং নিজেদের পছন্দের লোকজনদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার ব্যাপরে তাদের ছিল জুড়ি মেলা ভার। মুতাম্মেদ খানের গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায় যে, তাদের পরিবারের এমন কোনো আত্মীয়, দাস বা আশ্রিত ব্যক্তি ছিলেন না যারা এ সময় বেশ ভালোমতো জায়গির বা মনসব লাভ করেনি। মুতাম্মেদ খানের মতে, বিশাল বিস্তৃত হিন্দুস্তানের মধ্যে এই মহিলার সব থেকে পছন্দের জায়গা বোধ হয় ছিল তার সম্পর্কের লোকজনদের দেওয়া জায়গির এলাকাগুলিই।

এখানে উল্লেখ্য যে নূরজাহানের সঙ্গে মুঘল সম্রাটের বিবাহ হওয়ার কারণে মূলত সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইতিমাদ-উদ-দৌলা এবং আসফ খান লাভবান হলেও তারা কিন্তু প্রাথমিকভাবে এ ব্যাপারে নূরজাহানকে কৃতিত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। তাই জাহাঙ্গির তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন, “একজন বরিষ্ঠ হিসাবে প্রশাসনের কাজে বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আমি ইতিমাদ-উদ-দৌলাকে সাম্রাজ্যের উজিরতের উচ্চ পদে বসিয়ে ছিলাম। ১৬১১ সালে তার নিয়োগের সময়ে তাঁর পদ ছিল কেবল ১৫০০, কিন্তু এক বছরের মধ্যে তিনি ৪০০০ জাট ও ১০০০ সাওয়ার পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র আসফ খানও যথেষ্ট জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও কর্মঠ ছিলেন এবং মির বকশির পদ লাভ করেছিলেন। তার পদমর্যাদা আরও শক্তিশালী হয়ে যায় শাহজাদা খুররম (পরে শাহজাহান)-এর সঙ্গে নিজ কন্যা আরজুমন্দ বানুর বিবাহ দেওয়ার পরে।

আধুনিক ঐতিহাসিক ডঃ বেণী প্রসাদপ্রথম নূরজাহান চক্র’ বা ‘Junta’র নূর তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন। এখানে বলা হয় যে এই চক্র গড়ে উঠেছিল নূরজাহান, পিতা ইতিমাদ-উদ-দৌলা, ভ্রাতা আসফ খান এবং শাহজাদা খুররমকে নিয়ে এবং তা জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নূরজাহানের বিবাহের পর থেকে ১৬২০ সালে পর্যন্ত যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। বেণীপ্রসাদের মতে, পছন্দের লোকজনদের দরবারি কাজে নিয়োগ করে এই ‘চক্র এমন ভাবে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল যে এই চক্রের আনুকুল্যেই মিলে যেত যাবতীয় পদ ও সম্মানের ছাড়পত্র। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রবণতা অন্যান্য অভিজাতদের মধ্যে ঈর্ষা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। ফলে তাঁর মতে, মুঘল দরবার এই সময় দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল–একদিকে ছিলেন নূরজাহান ‘চক্র’-র অনুগামীরা ও অন্যদিকে ছিল বিরোধী গোষ্ঠী যারা খসরুকে সিংহাসনে বসানোর পক্ষপাতী ছিলেন।

ডাঃ বেণীপ্রসাদ একই সঙ্গে ১৬২২ সালে শাহজাহানের বিদ্রোহ এবং ১৬২০ সালে ‘চক্র’ ভেঙে যাওয়া থেকে শুরু করে নূরজাহানের ষড়যন্ত্র সবই তুলে ধরেছেন। ক্ষমতা দখলের ক্ষুধা থেকে নূরজাহান এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রভাবশালী চরিত্রের অধিকারী শাহজাহান (খুররম) একবার সিংহাসন দখল করতে পারলে পিছন দিক থেকে তার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বিন্দুমাত্র দেরি করবে না। তাই তিনি খুররমকে সরিয়ে তার জায়গায় অনেক বেশি অনুগত ভাই শাহরিয়ারকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। এই শাহরিয়ারের সঙ্গে নূরজাহান ও তার প্রথম স্বামী শের আফগানের কন্যা লাডলি বেগমের বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। জাহাঙ্গিরের শাসনের শেষ সাত বছর কেটে গিয়েছিল নূরজাহানের পছন্দের প্রার্থীর জন্যে পথ পরিষ্কার করার নানা রকম চেষ্টার মধ্য দিয়ে’ (বেণীপ্রসাদ)।

বেণীপ্রসাদের এই নূরজাহান ‘চক্র’-র তত্ত্ব নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিক নুরুল হাসান বলেন যে ইতিমাদ-উদ-দৌলা ও তার পরিবারের আসল উত্থান ঘটেছিল ১৬১৬ সালের পরে। আর এই সময় এরকম অনেক পরিবারই মুঘল দরবারে উচ্চ মনসক ভোগ করত, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকা, আবদুর রহিম খান-ই-খানান, আবদুল্লাহ খান ফিরোজ জং প্রমুখদের পরিবার। তফাতটা শুধু এটাই ছিল যে এই সকল পরিবার কথাকথিত নূরজাহান ‘চক্র’র-বিরোধী গোষ্ঠী ছিল বা এই চক্রের সঙ্গে তারা। কোনোরকম ভাবে যুক্ত ছিল না। মহব্বত খান ছিলেন এমন একজন অভিজাত যিনি ব্যক্তিগত ভাবে ৪০০০/৩৫০০ মনসবের অধিকারী হয়েও ১৬১২ সালের পর থেকে ‘চক্র’-র বিরোধিতা করার কারণে আর তার পদোন্নতি হয়নি। যদিও ১৬১৪ সালে মহব্বত খান তিন কোটি দাম মূল্যের একটি জায়গির লাভ করেছিলেন এবং ১৬১৫ সালে তাকে দেওয়া হয়েছিল ৩৫০০-র দুআসপা সিহ আসপা পদ। তবে সেনাধিপতির কাছে ঠিক সময়ে বাহিনী এনে হাজির করতে না পারার কারণে মহব্বত খানের কাছ থেকে এই পদ পরে কেড়েও নেওয়া হয়েছিল। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে মনসব লাভের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না ঘটলেও মহব্বত খান কিন্তু জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিলেন। মহব্বত খানের মতো অনেক অভিজাতই ‘চক্র’-র সাহায্য ছাড়াও দরবারে জাহাঙ্গিরের অনুগ্রহ পেয়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। তাই নুরুল হাসানের মতে, পদোন্নতি প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবেই সবার জন্য প্রযুক্ত হত এবং এটা কখনোই বলা ঠিক হবে না যে ‘চক্র’ র অনুগ্রহ ছাড়া পদোন্নতির ছাড়পত্র পাওয়া যেত না।

নূরজাহান ও খুররমের মধ্যে আঁতাতের কথা বলা হলেও এমন কোনো সমকালীন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না যা থেকে জোর দিয়ে এটা বলা যাবে যে ১৬১১ সাল থেকে ১৬২০ সালের মধ্যে উভয়ের মধ্যে একপ্রস্থ সমঝোতা হয়েছিল। এই আঁতাতের অভিযোগ করা হয় মূলত ইউরোপীয় সূত্র থেকে, বিশেষ করে জাহাঙ্গিরের দরবারে আসা ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি স্যার টমাস রো সাহেবের বক্তব্য এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে ফারসি ভাষা না জেনে ইউরোপীয়রা নিছক কিছু লোকমুখে প্রচারিত গুজবের ওপর বড্ড বেশি নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু তারা এটাও বলেছিলেন যে ১৬১৬ সালের পর নূরজাহান ও খুররমের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল।

বস্তুত নূরজাহান ও খুররম (শাহজাহান)-এর মধ্যে স্বার্থের কাকতালীয় যোগ ছিল। বলে মনে হয় না। নূরজাহানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাহাঙ্গিরের ক্ষমতাকে বিরোধী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করা ও ধরে রাখা। আর শাহজাহানের নজর ছিল মুঘল সিংহাসনে। তাই তাঁর স্বার্থ ও জাহাঙ্গিরকে সামনে রেখে ক্ষমতা ভোগকারী মানুষগুলোকে স্বার্থ ছিল ভিন্ন প্রকৃতির।

শাহজাহানের ক্ষমতা দখলের জন্য নূরজাহানের সহযোগিতা ও শক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না। জাহাঙ্গির প্রথমে পারভেজকে মেবার ও দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু পারভেজের ব্যর্থতা ও সেই স্থানে খুররমকে পাঠিয়ে মেবার অভিযানে সাফল্য লাভের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে যুবরাজ খুররমের। ফলে স্বাভাবিকভাবে দাক্ষিণাত্যে মুঘল অভিযানে নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সবার প্রথম পছন্দ। মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে ১৬১৮ সালে তার সাফল্যের পর তার মনসবের পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩০,০০০ জাট ও সাওয়ারে। তিনি শাহজাহান উপাধি লাভ করে দরবারে একেবারে মুঘল সিংহাসনের পাশের আসনে বসার অধিকার লাভ করেছিলেন। অনেক আগেই ১৬০৮ সাল নাগাদ খুররমের জন্য হিসার-ফেরৌজার জায়গির বরাদ্দ করা হয়েছিল যা কিনা রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী শাহজাদার জন্য সংরক্ষিত করা থাকত। ১৬১৮ সালে খুররমের ক্ষমতা। আকাশছোঁয়া পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

১৬২০ সালে শাহজাহানকে (খুররম) পুনরায় দাক্ষিণাত্যের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। এবার তিনি বন্দি শাহজাদা খসরুকেও তার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। শাহরিয়ার ও লাডলি বেগমের বাগদান পর্ব প্রায় এই সময়েই সম্পন্ন হয় যা শাহজাহান ও দরবারি চক্রের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। বস্তুত এটা বলা হয়ে থাকে যে এই বিবাহ সংগঠিত করার ব্যাপারে। ইতিমাদ-উদ-দৌলাহের হাত ছিল।

সুতরাং শাহজাহান ও নুরজাহানের মধ্যে কোনো আঁতাত হবার পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হতে পারে বলে মনে হয় না। নুরুল হাসানের এ বিষয়ে মত হল, ‘অভিজাতদের মধ্যে প্রচুর বিরোধিতা ও মতভেদ ছিল যার ফলে এরা একে অপরের বিরুদ্ধে সদাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত, কিন্তু কোনো গোষ্ঠীই অন্য গোষ্ঠীকে ক্ষমতা বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে উৎখাত করতে সফল হয়নি।

তাই আমাদের ‘চক্র’–র তত্ত্ব নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না করাই ভালো। তবে তাই বলে নূরজাহানের ক্ষমতা ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। নূরজাহান জাহাঙ্গিরের একেবারে ছায়াসঙ্গী ছিলেন বলা যায়, এমনকি তুখোড় লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা থাকায় তিনি সম্রাটের সঙ্গে শিকারেও যেতেন। তিনি সম্পূর্ণ ভাবে হারেম নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং বস্ত্রের নানা ধরনের নকশা প্রচলন। করেছিলেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে তাঁর মাতা গোলাপের আতর আবিষ্কার করেছিলেন। জনসমক্ষে নূরজাহানের প্রকৃত ভূমিকা ঠিক কী ছিল তা নিয়ে আমাদের একটু ভালো করে বিশ্লেষণ করা দরকার। আমরা জানি যে তিনি মাঝেমধ্যেই ঝরোকা জানালায় এসে বসতেন এবং আধিকারিকদের নানা আদেশ দিতেন ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা গ্রহণ করতেন। অনেক সময় তার নামে ফরমানও জারি হত। তার নামে তামার দাম মুদ্রা ও রুপোর সিক্কা মুদ্রাও উৎকীর্ণ হত। মুদ্রায় তার সরকারি উপাধি বাদশা বেগম উল্লেখ করা থাকত। এই ব্যাপারটি অনেক পর্যবেক্ষক বুঝতে ভুল করেন এবং বলেন যে তার এই উপাধিই প্রমাণ করে যে তিনি সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করতেন। অবশ্যই তিনি এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছিলেন যেখান থেকে রাজকীয় সবরকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করার কোনো বাধা ছিল না কিন্তু এটা বোধ হয় ঠিক হবে না যে ১৬১১ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। এমনকি বেণীপ্রসাদ বলেন যে এই সময়ে জাহাঙ্গিরের সকল দেশীয় ও বৈদেশিক নীতির ধারা এবং প্রশাসনের সকল প্রতিষ্ঠান একই ভাবে কাজ করছিল। আসলে নূরজাহান ও তার সহযোগীরা জাহাঙ্গিরের ধাত ভালো করে বুঝে নিয়েছিলেন এবং তার দেখানো পথেই রাষ্ট্রশাসনকে ভালো করে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন শাসন ক্ষমতা দখল করে নিতে চাননি। জাহাঙ্গির রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে তদারকি করতেন বলে জানা যায় তার স্মৃতি গ্রন্থ থেকে। ১৬২২ সালের পর থেকে যখন জাহাঙ্গিরের শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে শুরু করে, যখন মনোনীত ভবিষ্যতের সম্রাট যুবরাজ শাহজাহান সরাসরি বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যখন দক্ষ অভিজাত ইতিমাদ-উল-দৌলা আর বেঁচে ছিলেন না পরিস্থিতি সামলানোর জন্য এবং যখন মহব্বত খানের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতরা জাহাঙ্গিরকে পুতুল শাসক বানিয়ে স্বার্থ সিদ্ধির অভিসন্ধি করতে শুরু করেছিলেন, তখনই একমাত্র নূরজাহান সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যদিও বেণীপ্রসাদ অভিযোগ করে বলেন যে এই সময় (১৬২২-২৭) নূরজাহানের শাসনে ভারতে রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল এবং চারিদিকে বিবাদ ও বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে এতে নূরজাহানের খুব একটা দোষ ছিল না। ১৬২২ সালের পর তাকে খুব কঠিন একটা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাঁর স্বামীর জীবন ও সম্মান রক্ষা করা। এই কাজ তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করেছিলেন এবং যখন সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকার মনোনীত হয়ে গিয়েছিল তিনি হাসি মুখে হারেম-এ অবসর নিয়েছিলেন।

নূরজাহানের পরিবারের ওপর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ইরফান হাবিব ইমাদ-উদ-দৌলা ও তাঁর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের ওপর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে ১৬১১ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ইতমাদ-উদ-দৌলা উজির পদে থাকার পাশাপাশি লাহোরের শাসকের পদ লাভ করেছিলেন এবং তাঁর পুত্র আসফ খান কিছুদিনের জন্য ওয়াকিল পদ সামলেছিলেন। ১৬২২ সালে ইতিমাদ-উদ-দৌলার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পরিবারের প্রতিপত্তি কমতে শুরু করেছিল এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বেশিরভাগ সময়েই ওয়াকিল পদ ধরে রেখেছিলেন আসফ খান এবং মির বকশির পদ দেওয়া হয়েছিল নূরজাহানের আত্মীয় ইরাদত খানের হাতে। এছাড়া লাহোর, কাশ্মীর, মুলতান, থাট্টা, আগ্রা, গুজরাট ও উড়িষ্যা–এই সাত প্রদেশের প্রাদেশিক শাসনের দায়িত্বও ছিল নূরজাহানের পরিবারের লোকজনদেরই হাতে।

এই কারণেই হয়তো মুতাম্মদ খান নূরজাহানের পরিবারের এই উত্থানকে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ইরফান হাবিব যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল এ সময় মুঘল অভিজাততন্ত্রের সবাই একদিকে নূরজাহানের আশ্রিত ও সমর্থক এবং অন্যদিকে ধনী ও উঁইফোড় শক্তি বিরোধী পুরোনো অভিজাত–এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এমনকি যখন মহব্বত খান চরম ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন তখনও নুরজাহানের পরিবারের হাত থেকে প্রদেশ শাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আসলে এটা বলা যায় যে নূরজাহানের পরিবার মুঘল অভিজাততন্ত্রে প্রধান পারসিক (খুরাসানি) উপাদান উঠে এসেছিল এবং এদের উত্থানের মধ্য দিয়েই মুঘল অভিজাততন্ত্রের এই অংশের প্রভাব বেড়েছিল। তবে পারসিক অভিজাতরা এ সময় নূরজাহানের পরিবারের নেতৃত্বে একটা শ্রেণি হিসাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে খুব একটা তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। মোট কথা, মুঘল অভিজাততন্ত্রের চরিত্র ছিল বহুমুখী এবং রাজনৈতিক কারণে সেখানে সর্বদাই পারিবারিক বিবাদ ও আন্তঃগোষ্ঠী শত্রুতা লেকেই থাকত। নূরজাহানের সময়েও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

শাহজাহানের বিদ্রোহ ও মহব্বত খানের আকস্মিক আক্রমণ

১৬২১ সালে জাহাঙ্গির তার ক্ষমতায় অবস্থান করছিলেন। মেবার, বাংলা ও দাক্ষিণাত্যের মতো প্রবল ঝঞ্ঝাটপূর্ণ এলাকাগুলো ব্যাপক সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল। ইরানের শাহের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল এবং মনে হচ্ছিল যেন দিগন্ত পারে কোনো বিপদের মেঘ জমে নেই। জাহাঙ্গিরের বয়স তখন সবে একান্ন বছর এবং তখনও তার সামনে শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ দেখার অনেক সময় বাকি ছিল। কিন্তু দুটি ঘটনা এই সব ছবি নিমেষে বদলে দিয়েছিল–এক, কান্দাহারে পারস্য আক্রমণের আশঙ্কা এবং দুই, জাহাঙ্গিরের ক্রমশ স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে তার পুত্রদের মধ্যে শুরু হওয়া উত্তরাধিকার নিয়ে তুমুল লড়াই। ১৬২২ সালের শুরুর দিকে যোগ্য উজির ইতিমাদ-উদ-দৌলার মৃত্যু অভিজাতদের মধ্যেও ষড়যন্ত্র-প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এইসব দেখেশুনে নূরজাহান রাজনীতির জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

জাহাঙ্গিরের পুত্রদের মধ্যে খুররম (শাহজাহান) ছিলেন সবথেকে যোগ্য এবং তাকে ১৬১৯ সালে পরবর্তী উত্তরসূরি হিসাবে চিহ্নিতও করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনে হয় তার ওপর এই যে ভরসা করা হয়েছিল তাতে তিনি নিজেকে বড্ড বেশি শক্তিশালী ভেবে ফেলেছিলেন। তাছাড়া ওই বছরেই খসরু কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং শাহজাহানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা পারভেজের মনসব বাড়িয়ে ২০,০০০ করা হয়েছিল। শাহজাহান দাক্ষিণাত্য অভিযানে যাওয়ার আগে খসরুকে তার হাতে তুলে দেবার দাবি করেছিলেন। আগেও,এইরকম দাবি করেছিলেন তিনি, এবারের দাবিটা এই কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যে এবার সে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। আমরা জানি যে শাহজাহানের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে রোধ করার জন্য এরপর নূরজাহানের প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমের সঙ্গে যুবরাজ শাহরিয়ারের বাগদান পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শাহজাদাকে যোগ্য জবাব দিতে তার সহযোগী খসরুকে বুরহানপুরে গলা টিপে খুন করা হয়েছিল (ফেব্রুয়ারি, ১৬২১) এবং বলা হয়েছিল যে তিনি নাকি শারীরিক অসুস্থতার কারণে মারা গেছেন।

নাটকের পরের দৃশ্য শুরু হয় ১৬২২ সালে সাফাভিদ শাহ আব্বাস কর্তৃক কান্দাহার দুর্গ অবরোধের মধ্য দিয়ে। জাহাঙ্গির তড়িঘড়ি শাহজাহানকে সমন পাঠিয়ে দাক্ষিণাত্য থেকে ডেকে পাঠালেন কান্দাহার দুর্গ রক্ষা করার জন্য। শাহজাহান ভয় পেয়েছিলেন যে এই কান্দাহার অভিযান বোধ হয় খুব দীর্ঘ ও কঠিন হবে আর তাই তিনি যখন দরবারে ছিলেন না তখন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শাহজাহান এবার একাধিক দাবি জানালেন। যেমন–তাকে যেন পরিবারের সঙ্গে মাণ্ডুতে সমগ্র বর্ষাকাল থাকতে দেওয়া হয়, তিনি যখন কান্দাহার অভিযান চালাবেন তখন যেন সমগ্র সেনাবাহিনীর ওপর কেবল তাঁরই হুকুম চলে ও পাঞ্জাব তার দখলে দেওয়া হয়, এবং রনথম্বরের দুর্গ তার হাতে যেন তুলে দেওয়া হয় যাতে তার পরিবার-পরিজন সেখানে নিরাপদে থাকতে পারে। দাবিগুলির কোনো যুক্তি না থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করা জাহাঙ্গিরের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ একটু দেরি করলেই কান্দাহারের অধিকার চলে যাবে পারস্যের হাতে। একটা রাস্তা বেরোতে পারত যদি জাহাঙ্গির মুলতানের মুঘল দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক খান-ই-জাহান লোদির পরামর্শ মেনে নিয়ে কান্দাহারের উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ একটি সাহায্যকারী সেনাদল প্রেরণ করে দিতেন। শাহজাহানের মনোভাব যে সোজাসাপটা ছিল না তার প্রমাণ মেলে তখন যখন তিনি ইরানের শাহের দরবারে তাঁর নিজের একজন প্রতিনিধি জাহিদ বেগকে পাঠিয়ে কান্দাহার আক্রমণের জন্য আগাম শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। আবার তিনি মাণ্ডুতে দীর্ঘদিন থাকার জন্য দাক্ষিণাত্যের শাসক ও গণ্ডোয়ানার জমিদারদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ আনানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন।

জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের মধ্যে তিক্ত পত্র চালাচালি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। জাহাঙ্গির শাহজাহানকে বলেন যে যদি তিনি বর্ষাকাল পর্যন্ত তিনি সেখানে কাটিয়ে আসার পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে তার সঙ্গে যাওয়া রাজকর্মচারী ও বাহিনী–বিশেষ করে বারহা ও বুখারার সৈয়দ, শেখজাদা, আফগান ও রাজপুতদের যত শীঘ্র সম্ভব যেন দরবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শাহজাহান বিশেষ অনুচর নিয়োগ করে সেনাপ্রধানদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে লাহোরে জাহাঙ্গিরের কাছে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে শাহরিয়ারের হাতে কান্দাহার অভিযানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে তুলে দেওয়া হয়। জাহাঙ্গির আদেশ জারি করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে শাহজাহানকে প্রদত্ত হিসার ও দোয়াব অঞ্চলের জায়গির থেকে আয় দিয়েই এই কান্দাহার অভিযানের বিশেষ বাহিনীর বেতন দেওয়া হবে এবং সেই সঙ্গে শাহজাহানকে তার পছন্দমতো দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, মালব বা খান্দেশের কোনো এলাকা জায়গির হিসাবে বেছে নিতে বলা হয়।

ঢোলপুরে শাহজাহানের লোকজনদের সঙ্গে সেই অঞ্চলের জায়গিরের নতুন অধিকারী শাহরিয়ারের লোকজনদের মধ্যে লড়াই শুরু হলে আরও তিক্ততার পরিবেশ তৈরি হয়। শাহজাহান বিদ্রোহ করার আগে পর্যন্ত জাহাঙ্গির ভাবতেই পারেননি যে তিনি বিদ্রোহ করবেন। তাই আগেই দাবি মেনে আদেশনামা জারি করা হয়, যেখানে বলা হয় যে শাহজাহানকে গুজরাট, মালব, দাক্ষিণাত্য এবং খান্দেশ সুবা হস্তান্তর করা হবে, আর এর মধ্যে যেখানে খুশি গিয়ে তিনি থাকতে পারবেন ও ‘সেখানের প্রশাসনিক কাজে নিজেগে নিযুক্ত করতে পারবেন।

সম্রাটের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে শাহজাহান পাশে পেয়েছিলেন দাক্ষিণাত্য, গুজরাট ও মালবে নিযুক্ত বহু বড়ো আমির ওমরাহদের। এছাড়া কয়েকজন শক্তিশালী অভিজাত যেমন আবদুর রহিম খান-ই-খানান ও তার পুত্র এবং মেবারের রানা করণ বা কাংড়া-জয়ী রাজা বিক্রমজিৎ বাঘেলার মতো উল্লেখযোগ্য সামরিক নেতা প্রমুখের সাহায্যও তিনি লাভ করেছিলেন। রাজদরবার থেকে উজির আসফ খান ও আবদুল্লাহ খান ফিরোজ জং-এর পাশে থাকার আশ্বাসও তিনি পেয়েছিলেন। সর্বোপরি তিনি তার পক্ষে পেয়ে গিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্য অভিযানে নিযুক্ত পোড়-খাওয়া মুঘল সৈন্যদের।

নিজের প্রাধান্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে এবং জাহাঙ্গিরের শারীরিক দুর্বলতা ও নূরজাহানের পক্ষে প্রয়োজনীয় সেনা পাঠিয়ে মোকাবিলা করার অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে শাহজাহান মাণ্ডু অভিমুখে যাত্রা করেন এবং আগ্রার দিকে অতর্কিত আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা করেন। আগ্রা আক্রমণ জরুরি ছিল কারণ সেখানে রাজকোষে ভরা ছিল আকবরের জমানো প্রচুর ধনসম্পদ। এসব দেখে নূরজাহানও চুপ করে বসে। থাকেননি। তিনি বিহার থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে পারভেজকে অন্বর, মাড়ওয়ার, কোটা ও বুন্দির শাসকদের সমন পাঠিয়ে দ্রুত ডেকে পাঠালেন মুঘল সিংহাসন রক্ষা করার জন্য, সেই সঙ্গে পোড়-খাওয়া সামরিক নেতা মহব্বত খানকেও কাবুল থেকে ডেকে পাঠানো হয় শাহজাহানকে আটকানোর জন্য তৈরি হওয়া মুঘল বাহিনীর নেতৃত্ব দেবার জন্য। রাজকোষের বিশাল ধনসম্পদ লাহোরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করায় আসফ খানকে দরবার থেকে তাড়ানো হয়। জাহাঙ্গির স্বয়ং এই সময় ভগ্ন শরীরে লাহোর থেকে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন।

আগ্রার কাছে বিলোচপুর নামে একটি জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধে (মার্চ, ১৬২৩) শাহজাহান অবধারিত ভাবে পরাজিত হন, যদিও এখানে তিনি আবদুল্লাহ খান ফিরোজ জংকে তার পক্ষে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহজাহান পালিয়ে যেতে শুরু করেন। ফলে সব অভিজাত ও সেনা প্রধানরা একে একে তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান। সাফল্য পাওয়ার আর কোনো সুযোগই শাহজাহানের কাছে ছিল না, তবে পরবর্তী তিন বছর তিনি এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে ঘোরাঘুরি করে মুঘল সাম্রাজ্যকে বিব্রত করতে ছাড়েননি। প্রথমে তিনি গোলকুণ্ডার শাসকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সেখান থেকে উড়িষ্যা চলে যাবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় গোলকুণ্ডায় কিছুদিন থাকার সুযোগ পান তিনি। উড়িষ্যায় গিয়ে তিনি প্রাদেশিক প্রশাসন তদারকি করার কাজ শুরু করেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে সেখানকার প্রশাসন ও কর্তাব্যক্তিরা যুবরাজের বিরোধিতা করার তেমন ইচ্ছুক ছিলেন না। ক্রমেই উড়িষ্যাসহ বাংলা ও বিহার শাহজাহানের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। শাহজাহানের শক্তিবৃদ্ধি প্রতিরোধ করার জন্য আবার মহব্বত খানকে নিয়োগ করা হয়। এলাহাবাদের ঠিক উলটোদিকে ঝাসির কাছে এক যুদ্ধে উভয়ে মুখোমুখি হলেন। শাহজাহানের তড়িঘড়ি জড়ো করা সেনাবাহিনী মহব্বত খানের বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। পুনরায় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন। আহমেদনগর ও বেরারে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে রত মালিক অম্বরের কাছে গিয়ে তিনি আশ্রয় পান। অম্বর জাহাঙ্গিরকে বুরহানপুর থেকে মুঘলদের উৎখাত করার কাজে নিয়োগ করেন। কিন্তু দু’বার চেষ্টা করেও শাহজাহান শক্তিশালী মুঘল বাহিনীকে দুর্গ থেকে সরাতে পারেননি। অবশেষে বিপাকে পড়ে শাহজাহান জাহাঙ্গিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি অনুনয়মূলক পত্র লেখেন। জাহাঙ্গিরও চাননি তার সবথেকে যোগ্য সন্তানকে আর এভাবে দুরে সরিয়ে রাখতে, তাই পত্র পেয়েই তিনি শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন। শাহজাহানকে তার দুই পুত্র দারা ও ঔরঙ্গজেবকে জামিন হিসাবে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। ১৬২৬ সালের। শুরুর দিকে তাকে জায়গির হিসাবে বালাঘাট অঞ্চল দান করা হয়।

শাহজাহানের বিদ্রোহের কারণে টানা চার বছর সাম্রাজ্যে অচলাবস্থা চলেছিল। এর ফলে মুঘলদের কাছ থেকে কান্দাহার হাতছাড়া হয় এবং ১৬২০ সালে মালিক অম্বর দাক্ষিণাত্যের যেসব অঞ্চল মুঘলদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তা আবার। পুনরুদ্ধার করার একটা সুযোগ দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর সামনে এনে দিয়েছিল। আসলে পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই একটা ত্রুটি লক্ষ করা গিয়েছিল–একজন সফল শাহজাদা সাম্রাজ্যের শত্রুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে তখন, যখন এটা মনে হচ্ছিল যে রাজতন্ত্র ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যাপারে কোথাও যেন তারা অপারগ বা অনিচ্ছুক। শাহজাহানের ক্রমাগত অভিযোগ ছিল যে জাহাঙ্গিরেরর শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার পর সব ক্ষমতা নূরজাহান বেগমের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে–যদিও এই অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন, কারণ শাহজাহানের শ্বশুর আসফ খান ছিলেন সে সময় রাজ দিওয়ান। তাছাড়া শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও জাহাঙ্গির মানসিক ভাবে সজাগ ছিলেন এবং তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হত না।

সম্ভবত নূরজাহানের বিরুদ্ধে প্রচারিত কুৎসা এবং তার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে সাম্রাজ্যে একাধিক ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের যেসব কথা শোনা যায় তা আসলে সমকালীন বহু ঐতিহাসিকদের নারীবাদ-বিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন ছিল যা সঞ্চারিত হয়েছিল কোনো কোনো আধুনিক ঐতিহাসিকের মধ্যেও।

মহব্বত খানের আকস্মিক আক্রমণ

রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতদের অনেক সময় ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ এনে দেয়। এ সময়েও ঠিক তাই হয়েছিল। রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের মধ্যে আদি অনন্ত সংঘাতের প্রবণতা আবার সজীব হয়ে উঠেছিল মুঘল দরবারে। এই প্রবণতা যার হাত ধরে আবার ফিরে এসেছিল তিনি হলেন মহব্বত খান, শাহজাহানকে শায়েস্তা করার জন্য যার সাহায্য বারবার নিয়েছিল মুঘল কর্তৃপক্ষ। তার প্রভাব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও যুবরাজ পারভেজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আঁতাত মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে কোথাও-না-কোথাও বিপদের কারণ হয়ে উঠেছিল। শুরু থেকে দেখলে দেখা যাবে যে যুবরাজ পারভেজের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মহব্বত খানকে খান-ই-জাহান লোদির সঙ্গে বাংলার যৌথ সুবেদার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু তার গতিবিধি সুবিধের বলে মনে না হওয়ায় প্রতিদানে তাঁর থেকে ক্ষতিপূরণ ও হাতিয়ে নেওয়া যোদ্ধা হাতি ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। আহদিদের একটা শক্তিশালী দলকে পাঠানো হয় তাকে দরবারে আটক করে নিয়ে আসার জন্যে। মহব্বত খান দরবারে আসেন তবে একটি বিশ্বস্ত রাজপুত বাহিনী সমেত এবং যখন রাজ শিবির ঝিলাম নদী পেরিয়ে কাবুল যাচ্ছিল, তখন তার সুযোগ নিয়ে তিনি আক্রমণ করে সাম্রাজ্য। দখল করে নেন। নূরজাহান ধরা না দিয়ে নদী ধরে পালিয়ে যান এবং মহব্বত খানকে শায়েস্তা করার একটা চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নূরজাহান এবার বিকল্প উপায় অবলম্বন করলেন। তিনি জাহাঙ্গিরের ঘনিষ্ঠ হিসাবে মুঘল সম্রাটের পক্ষ থেকে মহব্বত খানের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু সমস্যা যেটা ছিল তা হল মহব্বত খান একজন দক্ষ সামরিক নেতা হলেও কোনোমতেই একজন বিচক্ষণ প্রশাসক বা কূটনীতিক ছিলেন না। তাই যত সময় যেতে থাকে তার প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে তার রাজপুত সেনাবাহিনী। ছয় মাসের মধ্যে মহব্বত খানের একের-পর-এক করা ভুলের সুযোগ নিয়ে নূরজাহান তার পক্ষে থাকা জাহাঙ্গিরের দরবার ত্যাগ করে পালিয়ে যান। কয়েকদিন পর তিনি এসে শাহজাহানের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন।

মহব্বত খানের পরাজয় নূরজাহানের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য ছিল বলা যায়। তিনি এখানে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু নূরজাহানের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, খুব জোর হলে এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই জাহাঙ্গির তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান (১৬২৭)। ধূর্ত ও সুযোগসন্ধানী আসফ খান যাকে উজির পদে নিয়োগ করে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গির, তিনি এবার ঠান্ডা মাথায় তার পৌত্র (কন্যার সন্তান) শাহজাহানকে মুঘল সিংহাসনে বসানোর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। দিওয়ান, প্রধান অভিজাত ও সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে তিনি নূরজাহানকে কার্যত গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন এবং দাক্ষিণাত্য থেকে তড়িঘড়ি শাহজাহানকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তারপর বিপুল আনন্দোৎসবের মধ্য দিয়ে শাহজাহান মুঘল সিংহাসনে বসেন। আগেই তার সমস্ত শত্ৰু, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের হত্যা করা হয়েছিল। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সিংহাসন দখল করার যে ধারা জাহাঙ্গির শুরু করেছিলেন রাজবংশের তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকার ছিলেন শাহজাহান, এবং এই ধারা পরবর্তীকালে মুঘল রাজবংশের ইতিহাসে এক দুঃখজনক অধ্যায় রচনা করেছিল বলা যায়। শাহজাহান যে তিক্ত বীজ বপন করেছিলেন তার তিক্ততার ফল তাকেও আস্বাদন করতে হয়েছিল পরবর্তীকালে। সিংহাসনে বসে শাহজাহান নূরজাহানের জন্যে স্থায়ী ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আরও আঠেরো বছর অবসর জীবনযাপন করেছিলেন হারেমে।

শাসক হিসাবে জাহাঙ্গির

জাহাঙ্গিরের রাজনৈতিক কৃতিত্ব এবং আকবরের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রনীতিকে সুদৃঢ়করণে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকাকে ঐতিহাসিকরা সাধারণত উপেক্ষা করে যান। সেই সঙ্গে তার সুযোগ্য ও বিশ্বস্ত অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে নূরজাহানের অবদানকেও পণ্ডিতরা প্রায়শ ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। জাহাঙ্গিরের রাজনৈতিক নমনীয়তার কারণেই মেবারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল, আফগান ও বাংলার গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী জমিদারদের সঙ্গে তার উদার সম্পর্ক বাংলার বিকাশ ও অগ্রগতির নতুন পথ রচনা করেছিল এবং দাক্ষিণাত্যে তার সাবধানী পদক্ষেপ বিজাপুরের সঙ্গে মুঘলদের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল ও পাশাপাশি সেখানকার রাজ্যগুলির মুঘলবিরোধী নীতিতে রদবদল আনতে বাধ্য করেছিল।

জাহাঙ্গির মুঘল রাষ্ট্রনীতিকে আরও সম্প্রসারণ ঘটিয়ে অন্যান্য রাজপুত শাসকদের সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। তাই তার আমলের শুরুর দিকে বিকানেরের শাসক রাই রায়ান রাই সিংহ, যোধপুরের রাজা সুর সিংহ (ও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজা গজ সিং) ও মেবারের রাজা রাও করণ–এদের সকলকেই পাঁচ হাজারি মনসব প্রদান করা হয়েছিল। রাজা মান সিংহ নিজে ৭০০০/৭০০০ পদের মনসব ভোগ করলেও ১৬১৪-১৫ সালে তার মৃত্যুর পর পুত্র ভাও সিংহকে মির্জা রাজা উপাধি ও ৪০০০ মনসব প্রদান করা হয়েছিল, পরে যদিও তা ৫০০০ করে দেওয়া হয়েছিল।

তিনি খান-ই-জাহান লোদির মতো প্রথম সারির আফগানের প্রশাসনের উচ্চপদে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাজকীয় পরিষেবায় খেলোজি, মেলোজি, উদয়জি রাম প্রমুখের মতো মারাঠা সর্দারদেরও টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি মোটামুটিভাবে আকবরের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই বজায় রেখেছিলেন। দরবারের গোঁড়া উলেমাদের ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা ভেস্তে দিতে তিনিও তাঁর পিতার মতো সচেষ্ট হয়েছিলেন।

জাহাঙ্গিরের সৌন্দর্য বোধ ছিল দারুণ এবং তার উদ্যোগে সৃষ্ট মুঘল স্থাপত্য, চিত্রকলা বা বাগান ছিল এক কথায় অনন্য ও উচ্চমানের। তিনি মুঘল দরবার ও ব্যক্তিগতভাবে মুঘল সম্রাটের পদকে ভাগ্যনিয়ন্তার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই কাজে তিনি যোগ্য সহযোগিতা লাভ করেছিলেন নুরজাহানের, যার নিজের মধ্যে যথেষ্ট পরিমার্জিত সংস্কৃতি বোধ ছিল।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুঘল সম্রাটের ভূমিকা অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে সম্রাটের নিবিড় যোগসূত্র স্থাপনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। আল বা সুবিচারের ধারণা যেভাবে জাহাঙ্গিরের আমলে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তাতে এটা বলতেই হবে যে তার সময় রাজতন্ত্র অনেক বেশি করে জনগণের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।

বাবরের মতো জাহাঙ্গিরও এ দেশের পশুপাখি ও প্রকৃতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন প্রচণ্ড ভাবে এবং তিনি একজন অভিজ্ঞের মতো সে সবের বর্ণনা দিয়েছিলেন। কাশ্মীরের কিছু অপরূপ ফুলের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, লাল গোলাপ, পাহাড়ি বেগুনি ফুল ও নার্গিস যেন এক সঙ্গে ফুটেছে, আরও বলেন “আমি বিভিন্ন রকম লাল গোলাপ দেখেছি, একটা তো তার মধ্যে বেশ মিষ্টি দেখতে, আর অন্য একটা ঠিক হালকা হলুদ রঙের ও তার কি অপরূপ সৌরভ। তিনি কালো টিউলিপ ফুলের উল্লেখ করেছিলেন। তিনি দরবারি চিত্রকর মনসুরকে এই ধরনের কিছু ফুলের ছবি। আঁকার কথা বলেছিলেন। জাহাঙ্গির বিভিন্ন ধরনের পাখির (অনেকগুলি কাশ্মীরের বাইরে দেখেছেন) একটা তালিকা দিয়েছিলেন।

১৬২১ সালের পর থেকে যখন তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই তার পতন সূচিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে শাহজাহানের বিদ্রোহ ও অভিজাতদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দলাদলি তার পতনকে তরান্বিত করেছিল বলা যায়।

সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে রাষ্ট্র ও ধর্ম

রাষ্ট্রের উদারনৈতিক চরিত্রের যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছিলেন আকবর, সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে তা মোটামুটিভাবে বজায় ছিল। এর মধ্যে অবশ্যই জাহাঙ্গিরের আমলে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটেছিল এবং শাহজাহান এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রদবদল এনেছিলেন।

জাহাঙ্গিরের শাসনের প্রারম্ভিক পর্বে গোঁড়া ইসলামীয় গোষ্ঠী মনে করেছিল যে আকবরের সুলহ-ই-কুলনীতি ও ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি মুঘল সম্রাট ঝেড়ে ফেলবেন এবং শরিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গিরের কিছু কাজকর্ম দেখে দরবারের কট্টরপন্থী গোষ্ঠী এই রকম মনে করতে শুরু করেছিলেন। তিনি উলেমা ও ইসলামের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আল্লাকে ডাকার পৃথক পৃথক প্রার্থনা পত্র চেয়েছিলেন যাতে তিনি নামাজ পড়ার সময় সেগুলো বারংবার পড়তে পারেন। প্রত্যেক শুক্রবার তিনি একসঙ্গে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি, ধর্মীয় গুরু, দরবেশ ও সন্তদের সঙ্গে প্রার্থনা করতেন। অভিষেকের পর প্রথম রমজান ঈদে তিনি ইদগাহ-তে গিয়েছিলেন কয়েক লক্ষ দাম অর্থ দান করেছিলেন। আসলে এই ধরনের কাজকর্মের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, আর গোঁড়া লোকজন এসব দেখে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করলেও ক্রমে তাদের সব আশা ভেঙে যায়। মনোভাব বা শিক্ষা কোনো দিক থেকেই জাহাঙ্গির গোঁড়া ছিলেন না। তার মদ্যপানের নেশা ছিল যা মাঝে মাঝেই মাত্রা ছাড়িয়ে যেত–তবে তিনি জানিয়েছিলেন যে সিংহাসনে বসার পর তিনি প্রত্যহ কুড়ি পেয়ালা সুরা পান করার অভ্যেস কমিয়ে কেবল মাত্র রাতে পাঁচ পেয়ালা পান। করতেন। যখন তিনি কাবুলে বাবরের সমাধি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তখন তিনি সেখানে একটি সুরাপাত্র নির্মাণের ও তাতে প্রত্যেক দিন সুরা পূর্ণ করে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন যাতে ওখানে কাজ করা সকল কর্মচারী পর্যাপ্ত সুরা পেতে পারে। তিনি নাচ গান খুব ভালোবাসতেন। তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে এরকম প্রচুর জলসার কথা উল্লেখিত আছে যেখানে তিনি অভিজাতদের আমন্ত্রণ জানাতেন।

সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গির এক অধ্যাদেশ জারি করে সপ্তাহের দুই দিন–তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ও আকবরের জন্মদিন তথা সূর্যের দিন (খ্রিস্টীয় মতে ওই দিন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল) অর্থাৎ রবিবার খাদ্যের জন্য কোনো রকম পশুহত্যা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এর ঠিক পরেই যাকে আমরা আইন-ই-জাহাঙ্গিরী বা জাহাঙ্গিরী আইন বলতে পারি, সেই বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের আইন তুলে নেওয়া হয়েছিল।

আকবরের সুলহ-ই-কুলনীতি সম্পর্কে জাহাঙ্গিরের মনোভাব এবং সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সর্বধর্ম স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে। আকবরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন :

‘এ সময় বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রচারকরা বৃহত্তর পরিসরে এক কক্ষে বসে তাদের প্রভূত ভাবের আদান-প্রদান করত। অন্যত্র এই ছবি দেখা যেত না, পারস্যে শিয়াদের জন্য কক্ষ থাকত, তুরস্ক, ভারত ও তুরানে শুধুমাত্র সুন্নিদের প্রচারকদের জন্য কক্ষ সংরক্ষিত থাকত।’ তিনি আরও বলেন, কীভাবে তার সাম্রাজ্য ‘কেবল সমুদ্র ছাড়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।’ ‘অন্য ধর্মের প্রচারকদের জন্য যেমন কক্ষ রাখা থাকত, তেমনি ভালো মন্দ সব বিশ্বাসীদেরও জায়গা দেওয়া হত, তবে তাদের বাকবিতণ্ডার কোনো রাস্তা খোলা রাখা হত না। শিয়া ও সুন্নিরা এক মসজিদে এবং ইউরোপীয় (ফিরিঙ্গি) ও ইহুদিরা এক গির্জায় মিলিত হয়ে নিজেদের মতো করে পরমেশ্বরের আরাধনা করত।’

জাহাঙ্গির যে কেবল আকবরের সুলহ-ই-কুলনীতি অনুসরণ করেছিলেন তা নয়, আকবরের নীতি মেনে তিনিও মুরিদ (শিষ্য) নিয়োগ করে প্রত্যেককে অঙ্গীকারপত্র বা শস্ত ও শাবি বা সম্রাটের স্বীকৃতিপত্র দান করেছিলেন। প্রথম দিকে মুরিদদের সব রকম সাম্প্রদায়িক বিবাদ থেকে দূরে থাকার ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সার্বজনীন শান্তি বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া তাদের নিজের হাতে কোনো জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকা, সূর্য, আলো ও অন্যান্য প্রভাবশালী গ্রহ নক্ষত্র যেগুলি পরমেশ্বরের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয় সেগুলি মেনে চলার এবং আল্লার উপাসনায় অবিরত ডুবে থাকার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল।

অভিজাতদের সম্রাটের সঙ্গে জুড়ে রাখার জন্যে এই শিষ্য তৈরির পদ্ধতি অপব্যবহারের ফলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল মনে হয়।

জাহাঙ্গির তার দরবারে দেওয়ালি, হোলি, দশেরা, রাখী, শিবরাত্রি প্রভৃতি হিন্দু উৎসব পালন করেন। জাহাঙ্গির নিজেও এই সব উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন এবং অনেক অভিজাতদেরও অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। বলা হয় যে দেওয়ালি পালনের সময় জাহাঙ্গির নাকি তিন রাত ধরে চলা এক জুয়ার আসরে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জাহাঙ্গির পাঞ্জাবে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং সম্ভবত এই নিষেধাজ্ঞা গুজরাটেও বলবৎ করা হয়েছিল। প্রাচীন মধ্য-এশীয় উৎসব যা পারসিদেরও উৎসব, সেই নওরোজও উদ্যাপন করা হত ধুমধাম করে ও সঙ্গীত সহযোগে টানা উনিশ দিন ধরে। খ্রিস্টানদেরও ইস্টার, ক্রিসমাস ও অন্যান্য উৎসব পালন করার অধিকার ছিল। এসবের মাধ্যমে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র কার্যত স্বীকৃতি দিত। রাষ্ট্র শাসক ও তার আধিকারিকদের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বৃহত্তর সামাজিক মেলবন্ধনের সুযোগ তৈরির চেষ্টাও করত।

সে সময় সব ধর্মের স্বাধীনতা সম্বন্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান ঠিক কি ছিল তা তুজুক-এর প্রথম খসড়াতে খুব পরিষ্কার করে বলা আছে। সেখানে জাহাঙ্গির বলছেন, “আমি আদেশ দিয়েছি যে কয়েকটি ব্যতিক্রম (যেমন জোর করে সতী বানানোর প্রথা নিষিদ্ধ) ছাড়া তারা (হিন্দুরা) তাদের নির্ধারিত আচার-বিচার, রীতি-নীতি পালন করতে পারবে এবং কেউ কারও ওপর জোর, নিষেধাজ্ঞা বা নিপীড়ন চালালে রাষ্ট্র কিন্তু রেয়াত করবে না।

হিন্দুদের নতুন মন্দির নির্মাণে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মথুরায় বীর সিংহ দেও বুন্দেলার বানানো চোখ ধাঁধানো একটি মন্দির ছাড়াও বেনারসে এ সময় অসংখ্য নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টানদেরও এ সময় গির্জা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি ও সঙ্গে জমি দান করা হয়েছিল।

আকবরের নীতি অনুসরণ করে জাহাঙ্গির মন্দির ও ব্রাহ্মণদের উপহার ও জমি দান করতেন। তার রাজত্বের প্রথম বর্ষে (১৬০৫-০৬) তিনি যখন খুরাসান অভিযানে অগ্রসর হয়েছিলেন, তখন তিনি প্রচুর অর্থ ফকির ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। চৈতন্য সম্প্রদায়ের বৃন্দাবন এলাকায় জমি অধিকার করার সময়কালের কিছু নথি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তাদের ভক্তবৃন্দ ও মন্দিরের জন্য জাহাঙ্গির কীভাবে অতিরিক্ত জমি দান করেছিলেন। এইভাবে ১৬১২ সাল থেকে ১৬১৫ সাল পর্যন্ত তিনি বৃন্দাবনে চৈতন্য অনুরাগীদের অন্তত পাঁচ বার জমি দান করেছিলেন বলে জানা যায়।

১৬২১ সালে কাংড়া যাবার সময় জাহাঙ্গির হরিদ্বার হয়ে গিয়েছিলেন। তার। ভাষায় এই হরিদ্বার ছিল হিন্দুদের ঈশ্বর আরাধনার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত পীঠস্থান, যেখানে ব্রাহ্মণ ও সন্ন্যাসীরা থেকে নিজেদের মতো করে ঈশ্বরের পুজো করে। যাবার। সময় এদের অনেককেই তিনি নগদে ও জিনিসপত্রে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর এই উদারতার পাশাপাশি জাহাঙ্গিরের কিছু কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েক বার সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচয়ও পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো হয়তো তার দরবারের প্রভাবশালী গোঁড়া কর্মচারীদের খুশি করার জন্যে বা হয়তো তাদের কাছে নিজেকে গোঁড়া মুসলিম শাসক হিসাবে তুলে ধরার জন্যে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছিল। তাই তিনি মেবারের সঙ্গে যুদ্ধকে জেহাদবলে ঘোষণা করেছিলেন, যদিও তা ঘোষণা করার খুব বেশি দরকার ছিল বলে মনে হয় না। এই অভিযানের সময় অনেক হিন্দু মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এটাও অনাবশ্যক একটা.কাজ ছিল কারণ জাহাঙ্গির যুবরাজ খুররমকে বলে দিয়েছিলেন যে যদি রানা বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে যেন তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা হয়। একই ভাবে ১৬২১ সালে কাংড়া অভিযানকেও জেহাদ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল অথচ সেই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন একজন হিন্দু, রাজা বিক্রমজিৎ। আমরা আগেই জানিয়েছি যে কাংড়া দুর্গ জয় করার পর এক দল ধর্মগুরুর উপস্থিতিতে সেখানে একটি বলদ বলি দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কাংড়া থেকে জাহাঙ্গির জ্বালামুখীর দুর্গামন্দিরে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি দেখেছিলেন মুর্তি পুজো করে এমন মানুষের পাশাপাশি ইসলামে বিশ্বাসী মানুষও দলে দলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অর্ঘের ডালি নিয়ে এসে কালো (পাথরের) মূর্তিকে পুজো করছে। এই প্রথাকে বন্ধ করার জন্যে কোনো উদ্যোগ কিন্তু নেওয়া হয়নি। এর আগে পুষ্কর ভ্রমণের সময়ে জাহাঙ্গির হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণুকে বরাহ (শূকর) রূপে পুজো করতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এই কারণ দেখিয়ে এই মূর্তি ভেঙে দেবার আদেশ দিয়েছিলেন যে হিন্দুদের এই দশাবতার তত্ত্ব তিনি মানেন না, তাঁর মতে এভাবে ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করে রাখা যায় না। কিন্তু তাই বলে অন্য সকল বিষ্ণু মন্দিরের কোনোরকম ক্ষতি করা হয়নি। আজমেরে জাহাঙ্গির সমগ্র পুষ্কর গ্রামকে মদদমাশ হিসাবে সেখানকার ব্রাহ্মণদের দান করেছিলেন। র ১৬১৭ সালে জাহাঙ্গির নৈতিক কারণ দেখিয়ে গুজরাটের সব জৈন মঠ বন্ধ করে দেবার ও সাম্রাজ্য থেকে সকল জৈন সাধককে বিতাড়িত করার আদেশ জারি করেছিলেন। কিন্তু এই আদেশ মনে হয় কার্যকর করা হয়নি, কারণ আমরা গুজরাট থেকে পাওয়া লেখমালার দৃষ্টান্ত তথা জৈন গ্রন্থ থেকে প্রমাণ পাই যে এই আদেশ জারি হওয়ার সময়ে জাহাঙ্গির অন্য সব বিরোধী সম্প্রদায়ের (গচ্ছ) তুলনায় জৈন সাধকদের সঙ্গে অনেক বেশি ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং জৈন মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য উদার হস্তে জমি দানও করেছিলেন। যা শিখদের সম্পর্কে জাহাঙ্গিরের মনোভাব তথা শিখ গুরু অর্জুনের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের সম্পর্ক ঠিক কী ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তার স্মৃতিগ্রন্থে জাহাঙ্গির বলেছেন যে বিয়াস নদীর তীরে গোবিন্দওয়ালে গুরু অর্জুন ‘একজন ধর্মীয় পদপ্রদর্শক হিসাবে বসে’ বহু হিন্দু ও মুসলিমদের নিজ অনুরাগী। করে দলে টানছিলেন। তারা তাকে গুরু বলে ডাকছিল এবং বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সম্পূর্ণ বিশ্বাসে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করছিল। জাহাঙ্গির বলেন যে এই ধারা প্রায় তিন চার প্রজন্ম ধরে চলছিল। গুরুর এই ভক্তদের নির্বোধ ও ভণ্ড’ বলে তিরস্কার করে। জাহাঙ্গির বলেছিলেন যে ‘অনেক সময় আমার মনে হয়েছে এদের এই অমূলক। কাজকর্মের ইতি টেনে দিই বা ইসলামে বিশ্বাসী লোকজনদের জমায়েতের মধ্যে এদের নিয়ে আসি।

এই মন্তব্য জাহাঙ্গির সিংহাসনে বসেই করেছিলেন এবং তখন তিনি খসরুর বিদ্রোহে ভীষণ রকম বিব্রতও ছিলেন। তবে তিনি ঠিক কবে শিখদের বিরুদ্ধে এ রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন তা পরিষ্কার করে জানা যায় না। যদি তা আকবরের রাজত্বকালে হয় তাহলে বলতে হবে যে এই সময় আকবরের সঙ্গে গুরু অঙ্গত ও গুরু রামদাসের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল এবং তাদের আকবর পাঁচ বিঘা জমি ও একটি পুষ্করিণীও দান করেছিলেন যেখানে হরমন্দির তথা অমৃতসর শহর গড়ে উঠেছে। আর যদি সিংহাসনের বসার পরে হয়, তাহলে এটা মাথায় রাখতে হবে যে জাহাঙ্গিরের রাজ্যাভিষেকের পরে মাত্র ছয় মাস খসরু বিদ্রোহ চালিয়েছিলেন। তাই হয়তো তখন দরবারে তাঁর গোঁড়া মুসলিম সমর্থকদের আস্থা অর্জনের জন্যেই এই কাজ তিনি করে থাকতে পারেন।

তবে এটা স্পষ্ট যে জাহাঙ্গির কেবল গুরু অর্জুন ছাড়া সামগ্রিক ভাবে শিখদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। গুরু অর্জুনের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গিরের ক্ষোভ এই কারণে দানা বেঁধেছিল যে তিনি খসরুকে কপালে রাজটিকা পরিয়ে “আশীর্বাদ করেছিলেন এবং কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। জাহাঙ্গিরের নজরে এই কাজ ছিল রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তাই তিনি গুরুকে সমন জারি করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর ঘোড়াগুলি হস্তান্তর করতে, কোতোয়াল মুরতাজা। খানের কাছে তাঁর পত্নী ও সন্তানদের জমা রাখতে, গুরুর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে ও মৃত্যুদণ্ড দিতে আদেশ দিয়েছিলেন।

খ্রিস্টান ও শিখ ছাড়াও অন্যান্য তথ্য প্রমাণ থেকে মনে হয় যে জাহাঙ্গির গুরুর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেননি, বরং প্রচুর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন যা গুরু দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গিয়ে যে নিপীড়ন করা হয়েছিল তাকে, তাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে একজন শ্রদ্ধেয় সাধককে এভাবে নির্যাতন করার আদেশ দিয়ে সেটা নিছক অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে জাহাঙ্গির পার পেয়ে যেতে পারেন না। ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামে পাঁচ বছর ধরে গুরুর পুত্র তথা উত্তরাধিকারী হরগোবিন্দকে আটক করে রাখার মতো যে কাজ জাহাঙ্গির করেছিলেন তা মোটেই সমর্থনযোগ্য ছিল না।

তাছাড়া তিনি যে কেবল খসরুকে বাহ্যিক সমর্থন করার দায়ে শিখ গুরুকে শাস্তি দিয়েছিলেন তাই নয়, খসরুকে কিছুদিন সঙ্গ দেওয়ার অপরাধে শেখ নিজাম নামে এক সুফি সাধককেও ছেড়ে কথা বলেননি। তবে তাঁকে কেবল মক্কায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল যাতায়াতের খরচ সমেত।

আকবরের মতো জাহাঙ্গিরও সবসময় দরবেশ, সন্ত ও অন্যান্য ধর্মীয় চিন্তাবিদদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এবং তাঁদের উপাসনা স্থলে ভ্রমণ করতে। ভালোবাসতেন। সেই সঙ্গে সেসব জায়গায় বেশ মোটা অঙ্কের দান ধ্যান করতেন। ১৬১৩ সালে তিনি একটি নিয়ম চালু করেছিলেন যেখানে যোগ্য মানুষদের প্রত্যেক রাতে সম্রাটের কাছে হাজির করা হত এবং তার প্রকৃত অবস্থা সরেজমিনে পরীক্ষা করে সম্রাট নিজে তার জন্য যথাযথ জমি বা সোনা বা বস্ত্র দানের ব্যবস্থা করতেন। আর এখানে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই নিয়ম কেবল মুসলমানদের জন্য ছিল।

জাহাঙ্গির আকবরের মতো ধর্মীয় গুরুদের ব্যক্তিগত আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ। জানাতেন। মনে হয় যে জাহাঙ্গির মূলত একেশ্বরবাদ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে চাইতেন বেশি। তাই তিনি লাহোরের বিখ্যাত কাদিরী সুফি সাধক মিয়া মির এবং গুরু অর্জুনের এক বন্ধুর সাহচর্য লাভ করতে আগ্রহী ছিলেন। মুঘলদের দরবারি সন্ত মইনুদ্দিন চিশতীরও পরম ভক্ত ছিলেন জাহাঙ্গির। ১৬১৩ সালে তিনি আজমেরে গিয়ে চিশতীর দরগায় প্রবেশের জন্য খালি পায়ে এক কোশ পথ হেঁটেছিলেন। তিনি আর-এক সুফি শেখ আহমেদ শিরিনদিকে সহ্য করতে পারেন না কারণ তিনি ওয়াহদত-অওয়াজুদ বা একেশ্বরবাদ বিরোধী ছিলেন। জাহাঙ্গিরের বক্তব্য অনুসারে, তাকে কিছু সময়ের জন্যে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল যাতে তার মত পরিবর্তন হয়, তার মস্তিষ্কে যে বিভ্রান্তি আছে তা দূর হয় এবং তাকে ঘিরে মানুষের যে উচ্ছ্বাস তা প্রশমিত হয়। জাহাঙ্গির তার মনের কৌতূহল অনেকটাই মিটিয়ে নিয়েছিলেন বেদান্তবাদী মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, বেদান্তকে তিনি তাসাওউফ-এর বিজ্ঞান (the science of tasawwuf) বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তার রাজত্বকালের একাদশতম বর্ষে (১৬১৬) উজ্জয়নীতে গিয়ে যাদরূপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পরবর্তী তিন বছরে তিনি যাদরূপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে আরও সাত বার সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে জানা যায়। যাদরূপ একটি পাহাড়ের গায়ে খোঁড়া গুহার ভিতরে বসবাস করতেন। তার সুনামের কথা শুনে জাহাঙ্গির তাঁকে আগ্রায় আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিন্তু তিনি এসে জাহাঙ্গিরের বিড়ম্বনা বাড়াতে চাননি। জাহাঙ্গির তখন নিজ পায়ে হেঁটে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যাদরূপ তার অসীম জ্ঞান ও সরলতায় জাহাঙ্গিরকে মুগ্ধ করেছিলেন। জাহাঙ্গির বলেছেন তিনি (যাদরূপ) বেদান্তের বিজ্ঞানে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এবং তার ওপর পরমেশ্বরের অপার কৃপা আছে, ঈশ্বর তাকে অমোঘ বিশ্বাস, মহৎ চরিত্র ও তীক্ষ্ণ বৌদ্ধিক ক্ষমতা দান করেছেন। জাগতিক বিষয় থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে তিনি ‘জগৎ ও জগতের যা কিছু আছে সব কিছুকে পিছনে ফেলে নিঃসঙ্গতা ও চাওয়া-পাওয়াহীন এক রাজ-সিংহাসনে বসে আছেন। পরে যখন যাদরূপ মথুরা চলে গিয়েছিলেন, তখন সেখানেও দু’বার ভ্রমণ করেছিলেন জাহাঙ্গির। মথুরার দায়িত্বে থাকা নূরজাহানের দেবর হাকিম বেগ যাদরূপের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে জাহাঙ্গির তাকে মথুরার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

আমরা জাহাঙ্গিরের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতে পারি না। ইসলামের পরিচিত কাঠামোর মধ্যে থেকেও তার অন্যান্য ধর্ম বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদ ও খ্রিস্টীয় মতবাদের সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। ভারতে প্রচলিত বহু হিন্দু আচার উপাচার তিনি মেনে চললেও মূর্তি পুজোর তিনি বিরোধী ছিলেন আর সেই সঙ্গে আগেই উল্লেখ করেছি তিনি অবতার তত্ত্বেও বিশ্বাস করতেন না।

রাজার মহৎ কর্তব্য সম্পর্কে জাহাঙ্গির সচেতন ছিলেন। আবুল ফজলের মতকে সমর্থন করে তিনি বলেন যে, সৃষ্টিকর্তা তাকে সার্বভৌমত্বের যে ক্ষমতা প্রদান করেছেন তার ফলে তাকে কিছু মহৎ ও গৌরবোজ্জ্বল কর্তব্য পালন করতে হবে। তাই আল্লা তাকে যে রাজমুকুট ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন তা উপেক্ষা করে নিজের মতো শাসন করার চেষ্টা বৃথা ও অদূরদর্শিতার লক্ষণ।

জাহাঙ্গিরের কাছে রাষ্ট্র কেবল একটি উদার প্রতিষ্ঠান ছিল না, রাষ্ট্র ছিল তার কাছে পরোপকার ও সুবিচারের কেন্দ্র। সিংহাসনে বসার পর উত্তীর্ণ দ্বাদশ লেখমালাতে তিনি রাষ্ট্রের এই পরোপকারী দিকের কথা তুলে ধরেছিলেন। ফলে জায়গিরদাররা নিজেদের মুনাফার জন্য সড়ক ও নদীপথে যে অতিরিক্ত কর আদায় করত তা তুলে দেওয়া হয়েছিল; উচ্চস্তরের অনুমতি ছাড়া নিচুতলার কর্মচারীরা আর বাণিজ্য করতে যাওয়ার পথের মধ্যে কোনো বণিকের বস্তা খুলতে পারত না; যদি কোনো মুসলিম বা অ-মুসলিম মারা যায় তাহলে তার সব সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের হাতেই তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, আর যদি তার কোনো উত্তরাধিকার না থাকে তাহলে সে সম্পত্তি মসজিদ, সরাই ইত্যাদি নির্মাণ, ভেঙে যাওয়া সেতু মেরামতি এবং কূপ ও জলাধার তৈরির কাজ অর্থাৎ নাগরিক পরিষেবামূলক উদ্যোগে ব্যবহার করতে বলা হয়। বণিকদের জন্যে পরিকাঠামো উন্নত করার জন্যে খালিসা জমির জায়গিরদার ও আধিকারিকদের সরাই নির্মাণ। করতে বলা হয়েছিল। স্থানীয় আধিকারিকদের কোনো গৃহের বেআইনি দখল নিতে ও জোর করে তোলা আদায়ে নিষেধ করা হয়েছিল। বড়ো শহরে হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল ও সেখানে চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছিল। এ সবের খরচ আসত খালিসা জমির আয় থেকে। আকবরকে অনুসরণ করে জাহাঙ্গিরও কাউকে শাস্তি দেবার উপায় হিসাবে তার কান বা নাম কাটার প্রথা তুলে দিয়েছিলেন।

জাহাঙ্গিরের বিচার চক্রের কথা এত সুবিদিত যে তা আর এখানে নতুন করে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। শুধু একটা নমুনা দেওয়া যাক। এক বিধবা অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে গুজরাটের সুবেদার মুকারব খান ক্যাম্বেতে তার মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে আটক করে রেখেছেন এবং যখন তিনি খোঁজ করতে সেখানে যান তখন তাকে বলা হয় যে তার মেয়ে এক কঠিন অসুখে মারা গেছে। তদন্তের পর জানা যায় সুবেদারের এক সঙ্গী ওই মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক দুর্ব্যবহার করেছেন। তখন শাস্তিস্বরূপ ওই অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি মুকারব খানের মনসব অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছিল এবং ওই বিধবাকে ভাতা দানের জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

মানব কল্যাণের এই সব কাজ করা সত্ত্বেও জাহাঙ্গির একজন স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। তিনি নির্বিচারে এক অশ্ব পালককে হত্যা করেছিলেন এবং দুই কাহারকে (জল বহনকারী) মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন কারণ তারা সম্রাটের নীলগাই শিকারের সময় আচমকা ভুলবশত চলে আসায় শিকার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

উদারনৈতিক ও কর্তৃত্ববাদী জনকল্যাণের অবস্থান আসলে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী নীতির একটা অংশ ছিল যেখানে সব ধর্মের ও সব জায়গার মানুষ রাষ্ট্রকে নিজের বলে মনে করতে পারত। এই নীতি শুধু স্থাপত্য ও বাগান তৈরিতে, প্রতিফলিত হয়নি, এই নীতি ছুঁয়ে গিয়েছিল সঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্য ইত্যাদিকে । রামায়ণ-এর মতো হিন্দু ধর্মীয় পুঁথিকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার কাজ এ সময়েও চলেছিল। হিন্দি কবিদের দরবারি কবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। আবদুর রহিম। খান-ই-খানানের হিন্দি কবিতার মধ্যে নতুন ধরনের আমেজ দেখা দিয়েছিল যেখানে নীতি বা রাষ্ট্রনীতি ওপর পুস্তিকা লেখা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির গীতিকবিতা ও কৃষ্ণ সহ নানা অবতারের অপরূপ বন্দনা।

শাহজাহানের ধর্মীয় নীতি

এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে শাহজাহান কি তার ধর্মীয় নীতির ক্ষেত্রে আকবরের উদার পন্থাকেই কিছু রদবদল করে বজায় রেখেছিলেন না তিনি তার শিক্ষাদীক্ষা ও বিশ্বাসের দিক থেকে এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে তার নেওয়া কিছু পদক্ষেপ দেখে মনে হয়েছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে’ (আই. এইচ. কুরেশি)। তিনি ধর্মগুরুদের সিজদা বা জমিনবোস প্রথা মানা থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। সিজদা ছিল শাসককে সেলাম জানানোর একটা পদ্ধতি আর জমিনবোস ছিল দুই হাত মাটিতে রেখে তারপর সেই হাত দুটোকে মাথায় ঠেকিয়ে কুর্নিশ করার একটা প্রথা। এটা জানিয়ে রাখা ভালো যে জাহাঙ্গিরও কিন্তু উচ্চপদের ধর্মগুরুদের সিজদা করা থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। শাহজাহান কাশ্মীরে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে মুসলিম নারী বা পুরুষ এই বিবাহের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে ফেলছে। আগে জাহাঙ্গিরও এই প্রথা তুলে দিয়েছিলেন কিন্তু একেবারে বন্ধ করতে পারেননি।

শাহজাহান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন তার রাজত্বকালের ষষ্ঠ বর্ষে (১৬৩৩)। তিনি এক আদেশ জারি করে বলেছিলেন যে কোনো মন্দির যার নির্মাণকার্য জাহাঙ্গিরের আমলে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি সেগুলো আর নির্মাণ। করা যাবে না। এই হিসাবে বেনারসের প্রায় ৭৬টি মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের সময়েও বহু মন্দির ও গির্জা ধ্বংস করা হয়েছিল। বুন্দেলা বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ওর্চায় বীর সিংহ দেও-এর একটি মন্দির ভেঙে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় হুগলির একটি খ্রিস্টান গির্জা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে এটা মনে হয় না যে শাহজাহান নতুন করে কোনো মন্দির নির্মাণ করতে না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ১৬২৯ সালে তিনি আহমেদাবাদের প্রথম সারির জৈন অলংকার ব্যবসায়ী শান্তিদাসকে জৈন সন্তদের থাকার অন্য বিশ্রামাগার (পোশালা) নির্মাণের জন্য জমি দান করেছিলেন। আহমেদাবাদে শান্তিদাস একটি সুন্দর জৈন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যার কোনোরকম বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি মুঘল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। ১৬৫৪ সালে যখন গুজরাটের সুবেদার ছিলেন ঔরঙ্গজেব, তখন তিনি এই মন্দিরের ভিতরে নামাজ পড়ার জন্যে একটি মিহরব (কুলুঙ্গি) তৈরি করে মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। আসলে এই ঘটনা গুজরাটে ঔরঙ্গজেবের নতুন তৈরি মন্দির ভেঙে ফেলার কর্মসূচির একটা অংশ ছিল। তবে শান্তিদাস ও মোল্লা আবদুল হাকিম নামে এক বিদ্বজ্জনের মিলিত অভিযোগের ভিত্তিতে শাহাজাহান ওই মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার্থে নব নির্মিত কুলুঙ্গি সরিয়ে শান্তিদাসকে পুনরায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিয়েছিলেন। রাজকীয় ফরমান জারি করে বলা হয়েছিল যে এই মন্দিরের কোনো জিনিস যদি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে আর যদি কিছু ক্ষতি হয় তো তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হবে। একই ভাবে জাহাঙ্গিরের আমলে মথুরায় নির্মিত বীর সিংহ দেও বুন্দেলার অপরূপ মন্দিরের ব্যাপারেও এসময় কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি।

পাকিস্তানের প্রথম সারির ঐতিহাসিক আই. এইচ. কুরেশির মতে নতুন মন্দির নির্মাণে শাহজাহান যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তা নিছকই প্রতীকী ছিল এবং এই উদ্যোগ কার্যত একটা নিয়ম ছিল যার কার্যকারিতা প্রায় ছিলই না…(এটি) এমন কোনো প্রভাবশালী ঘোষণা ছিল না যা দেখে মনে হবে যে হিন্দুত্ববাদকে নির্মূল করার অভিসন্ধি ছিল, বরং রাষ্ট্রে ইসলামকে যে আবার প্রধান ধর্ম হিসাবে দেখা হচ্ছে তা বোঝানোর জন্য এসব করা হয়েছিল।

এ সময় নির্মিত দিল্লির জামা মসজিদ ও আগ্রার তাজমহলের মতো একাধিক চোখ ধাঁধানো মসজিদ বা স্থাপত্য মুসলিম জন্নতের ধারণার বহিঃপ্রকাশ ছিল বলা যায় এবং তা সম্ভবত শাহজাহানের তরফ থেকে নেওয়া ইসলামের ক্ষমতা ও মহিমার প্রদর্শনের নীতির একটা অংশও ছিল। এ ধরনের মসজিদ নির্মাণ মুঘল আমলে নতুন কিছু ছিল না। এ সময় আগের মতোই বৃহত্তর সহিষ্ণুতার নীতিও বজায় ছিল যার প্রমাণ মেলে শাহজাহান কর্তৃক বৃন্দাবনে বৈষ্ণব মন্দির নির্মাণের জন্য জমি দানের স্বীকৃতি দেওয়ায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল তার একটি আদেশ যেখানে হিন্দুদের একাধিক পূজনীয় ঈশ্বর থাকার কারণে এবং পূজারিরা তাদের ধর্মমত ও উপাচার অনুসারে সেই সকল ঈশ্বরের আরাধনায় সদা ব্যস্ত থাকার জন্যে মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো মঞ্জুর করা হয়েছিল। এটা আকবরের সুল-ই-কুল নীতির যথার্থতা ছাড়া আর কি?

শাহজাহান শিখ গুরু হরগোবিন্দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং উভয়ের মধ্যে করতারপুরে তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল (১৬৩১) যেখান পরাজিত হয়ে শিখ গুরু কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকায় পলায়ন করেছিলেন। আমরা যখন পৃথক ভাবে মুঘলদের সঙ্গে শিখদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব তখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।

এই সময় দিল্লির শেখ আবদুল হক এবং ইসলামের দু’হাজার বছরে মুজাদ্দিদ বা নবরূপ দানকারী (renovator) হিসাবে সম্মানিত শেখ আহমেদ শিরিনদির নেতৃত্বে মুসলিমদের কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলো একজোট হচ্ছিল। এঁরা দুজনেই মুসলিম আইন, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন এবং শরিয়ার কড়াভাবে প্রয়োগের ব্যাপার। দাবি তুলেছিলেন। উল্লেখ্য যে এঁরা দুজনেই চিঠি লিখে দরবারের প্রধান প্রধান অভিজাতদের নিজ পক্ষে টানার রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে এগোচ্ছিলেন। তাঁরা তাঁদের ধর্মসভায় ছাত্র অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের চিঠিপত্রগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তাদের প্রধান দাবিগুলো ছিল :

ক. হিন্দুদের দুর্বল করে দেওয়া অর্থাৎ তাদের মন্দির ভেঙে দিয়ে, তাদের সঙ্গে সমস্ত রকম সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে, সরকারি কাজে দিতে অস্বীকার করে এবং যদি এগুলি সম্ভব না হয় তাদের কোনোভাবে বিশ্বাস না করে তাদের শেষ। করে দেওয়া।

খ. জিজিয়া করের পুনর্বহাল করা– যে জিজিয়া কর হল মুসলিমদের কর্তৃত্বের প্রতীক এবং তা কাফেরদের দুর্বল করার একটা সেরা অস্ত্র। আর

গ. যে সব উপাচার বিদাত অর্থাৎ শরিয়া-র সীমার মধ্যে পড়ে না, তা সে যতই সংস্কৃতির সঙ্গে (সঙ্গীত ও চিত্রকলা নিষিদ্ধকরণ), নৈতিকতার সঙ্গে (মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা) বা সামাজিক আচারের সঙ্গে (তুলাদান, ঝরোকা দর্শন ইত্যাদি)

জড়িত হোক না কেন তা উঠিয়ে দেওয়া। জাহাঙ্গিরের মতো শাহজাহানও এসব দাবির প্রায় কোনোটাই মেনে নেননি। এমনকি গুজরাটের সুবেদার থাকাকালীন ঔরঙ্গজেব দেখেছেন নতুন মন্দির নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি। উদারনৈতিক ভাবনার সঙ্গে এসেছিল ওয়াহাদত-অওয়াজুদবা একেশ্বরবাদের ধারণা। চিশতী সাধক, দারা ও জাহানারার সমর্থনপুষ্ট লাহোরের কাদিরী সাধক মিয়া মির এই ধারণাকে শাহজাহানের আমলে সজীব করে তুলেছিলেন। এই সব ধারণাকে সমর্থন করেননি শাহজাহান, এমনকি সমকালীন কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাকে মুজাদ্দিদ বা ইসলাম ধর্মের নবরূপ দানকারী হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর দরবারের কোনো অভিজাতই সরাসরি উদারপন্থী গোষ্ঠী বা মৌলবাদী গোষ্ঠী–কোনো দলেই নাম লেখাননি, তারা নিজেদের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কোন পক্ষে যাওয়া সুবিধের হবে তা ঠিক করে নিতেন।

আমরা এই বলে এই আলোচনার উপসংহার টানতে পারি যে শাহজাহান কোথাও-না-কোথাও একটা সমঝোতার জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। শরিয়ার প্রতি। শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং তার নিয়মকানুন ব্যক্তিগত জীবনে পালন করে তিনি সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরতে চাইলেও তিনি আকবরের আমলে নেওয়া কোনো উদারনৈতিক পদক্ষেপ তা সে ঝরোকা দর্শন হোক বা নিজেকে ওজন করে উপহার দেবার প্রথা (তোলাদান) হোক-কোনো কিছুই অগ্রাহ্য করেননি। সব সমঝোতার মতো শাহজাহানের এই সমঝোতাও নীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল না, ছিল বাস্তব-নির্ভর ও কৌশলী। এর ফলে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট হতে পারেনি আর। গোঁড়া মুসলিম গোষ্ঠী নিজেদের অবস্থান আগের থেকে অনেক ভালো বুঝে রাষ্ট্রে শরিয়ার কঠোর প্রয়োগের দাবি জোরালো করেছিল।

শাহজাহান—সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণ ও বিস্তার

১৬২৭ সালে অভিষেকের পর শাহজাহান দ্রুত বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যাতে তিনি নিজে বিদ্রোহের ফলে যে জটিলতার সৃষ্টি করেছিলেন তার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ও জাহাঙ্গিরের শারীরিক অবস্থার ক্রম-অবনতির আশঙ্কাকে পাশে রেখে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সুদৃঢ়করণ প্রক্রিয়ায় গতি আনা যায়। তিনি প্রথমে যে বিষয়ে নজর দিয়েছিলেন তা হল দাক্ষিণাত্য প্রশ্ন যেখানে মুঘলরা ১৬২১ সালে জাহাঙ্গিরের হাত ধরে যা যা লাভ করেছিল সব হারাতে হয়েছিল। আমরা ইতিমধ্যেই শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি নিয়ে আলোচনা করেছি এবং দেখেছি কীভাবে ১৬৩৬ সালে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন তিনি ও তার সাম্রাজ্যের শেষ দিকে আবার তাদের সঙ্গেই নতুন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে আধুনিক মধ্য ভারতের বুন্দেলখণ্ড ও গণ্ডোয়ানা এলাকার ওপর মুঘল নিয়ন্ত্রণ অনেক শক্তিশালী হয়েছিল। এই অঞ্চলের সবথেকে শক্তিশালী রাজা ছিলেন বীর সিংহ দেও বুন্দেলা। ১৬২৮-২৯ সালে জাহাঙ্গিরের প্রিয়পাত্র বীর সিংহ দেও বুন্দেলার (মৃত্যু ১৬২৭ সালে) পুত্র জুঝর সিংহ-এর বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়েছিল এবং ইরিজের শক্তিশালী দুর্গ। দখল করে নিলে জুঝর সিংহও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। যুদ্ধ হারের পর ক্ষতিপূরণ হিসাবে তিনি পনেরো লক্ষ টাকা ও প্রচুর হাতি মুঘলদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এর প্রতিদানে তার কিছু জায়গির বাজেয়াপ্ত করা হলেও তার যে ৪০০০/০০০ পদের মনসব ছিল তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০০০ অশ্বারোহী ও ২০০০ পদাতিক সৈন্য সহ তাকে দাক্ষিণাত্যে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়।

১৬৩৪ সালে জুঝর সিং ফিরে আসেন অনেক শক্তি নিয়ে এবং দাক্ষিণাত্যে সাহায্য করার জন্য রেখে আসেন তাঁর পুত্রকে। তিনি গণ্ডোয়ানা অঞ্চলের গণ্ডদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তিনি চৌরাগড়ের গণ্ড শাসক প্রেমনারায়ণকে আক্রমণ করেছিলেন। প্রেমনারায়ণ মুঘলদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেও সাহায্য না পেয়ে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে জুঝর সিংহ তাঁকে পুনরায় আক্রমণ করে হত্যা করেন। এরপর জুঝর সিংহ গণ্ড শাসকের জমানো সব ধন-সম্পদ লুঠ করে নেন। প্রেমনারায়ণের পুত্র মালবে গিয়ে মহব্বত খানের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। এদিকে শাহজাহানের সঙ্গে জুঝর সিংহ-এর সমঝোতার আলোচনা শুরু হয়। শাহজাহানের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রেমনারায়ণের বিপুল ধনভাণ্ডারের যতটা পারা যায় ভাগ নেওয়া এবং বুন্দেলা শাসক যেসব এলাকা দখল করেছিলেন তার সাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ আদায় করা। তাই জুঝর সিংহকে প্রথমে গণ্ডোয়ানায় যতটুকু অঞ্চল তিনি দখল করেছিলেন তা সবটাই মুঘলদের হাতে তুলে দিতে বলা হয়েছিল। তারপর যখন মুঘলদের সামরিক প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছিল তখন শাহজাহান চৌরাগড়ের বদলে বিয়ানওয়ান সরকার ও ত্রিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। মুঘলদাবি পূরণে অস্বীকার করায় জুঝর সিংহ-এর সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধ চলাকালীন গণ্ডদের হাতে জুঝর সিংহ মারা যান। জুঝর সিংহ-এর মৃত্যুর পর ওরাচ রাজ্য রাজা দেবী সিংহকে দান করে দেওয়া হয়। এই দেবী সিংহ-এর পরিবারকে এক সময় বীর সিংহ দেওকে টিকা পরানোর অপরাধে জাহাঙ্গির বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। জুঝর সিংহ-এর পরিবারকে একেবারে সরিয়ে দিয়ে দেবী সিংহ-এর পরিবারকে ওরাচ রাজ্যের গদ্দিতে বসিয়ে তাদের সকলকেই ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

সুতরাং শাহজাহানের বুন্দেলা নীতি ছিল কার্যত এক প্রকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। সেখানে ইসলামের জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওরাচে বীর সিংহ দেও যে মনোরম মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন তা ধ্বংস করে একটি মসজিদ গড়ে তোলা হয়।

শাহজাহান চিতোর দুর্গ পুনরায় দখল করার জন্য মেবারের রানা রাই সিংহের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এই পদক্ষেপের গুরুত্ব আমরা পরবর্তীকালে। ঔরঙ্গজেবের রাজপুতদের সঙ্গে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।

মুঘল রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির ফলে এবার সেইসব জমিদারদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু হয়েছিল যারা বেশ ধনশালী অথচ দূরবর্তী স্থানে থেকে রাষ্ট্রকে সামান্য কিছু রাজস্ব পাঠিয়ে বেশিরভাগটা আত্মসাৎ করত। তাই গণ্ডোয়ানার প্রধান জমিদার হিসাবে পরিচিত চন্দর কিপাকে আট লাখ টাকা নিতে বলা হয়েছিল। একই ভাবে বক্সারের কাছে উজ্জয়িনীর জমিদার, আধুনিক ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত রত্নাপুরের জমিদার, পালামৌ-এর জমিদার প্রমুখদের শায়েস্তা করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছিল।

আগের একটি অভিযানে গাড়োয়ালের রাজধানী শ্রীনগর দখল করার উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও ১৬৫৪ ও ১৬৫৬ সালের পর পর দুই অভিযানে শাহজাহান কুমায়ুন ও গাড়োয়ালের রাজাদের মুঘল কর্তৃত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলেন।

চম্বার কাছে পাঞ্জাবের পাহাড়ি এলাকার মৌরপর অঞ্চলের শাসক রাজা বাসুর পুত্র জগৎ সিংহ জাহাঙ্গিরের খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি ও তার পিতা এক সঙ্গে মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিলেন এবং তাঁদের কাংড়ায় ফৌজদার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু ক্রমেই তারা শাহজাহানের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিলেন। বুন্দেলখণ্ডের মতো এখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রয়োগ করে আক্রমণ করেননি। কয়েক বার শক্ত যুদ্ধে লড়াই করার পর ও বেশ কয়েকটি দুর্গ ধ্বংস করার পর জগৎ সিংহ বাগে আসেন এবং পুনরায় মুঘল মনসবদারে পরিণত হন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে নতুন পরিবেশেও যেসব জমিদাররা আগে মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিলেন তারা অনেক তাড়াতাড়ি বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল।

আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাশ্মীরের বলতিস্তান অঞ্চল যা আগে পরিচিত ছিল বৃহত্তর তিব্বত নামে (লাদাখকে বলা হত ক্ষুদ্র তিব্বত) তা মুঘল নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা। ১৬৩৪ সালে ও আবার ১৬৩৭ সালে মুঘল বাহিনী সেখানকার শাসক আবদলকে আক্রমণ করেছিল এবং তাকে রাজধানী স্কারদু পর্যন্ত তাড়া করে আত্মসমর্পণ করতে ও জোর করে দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছিল। মুঘল শিবিরে এ সময়। অত্যন্ত দক্ষ ও অনুগত সেনাপতি ও সৈন্যবাহিনী থাকার সুবাদেই তারা অনায়াসে এই সব দুর্গম ও দুরূহ অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সাফল্য পেয়েছিল। এই সব অভিযানের মাধ্যমে ইয়ারকান্দ, খোটান প্রভৃতি অঞ্চলের বাণিজ্য পথগুলো আরও বেশি করে। মুঘল নিয়ন্ত্রণে আনার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল।

পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলগুলি দখল করার যে চেষ্টা করেছিলেন শাহজাহান তারও যথেষ্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল। জাহাঙ্গিরের আমলে মুঘলরা যশোর ও বাকলা নামক দুই উপকূলবর্তী জেলা দখল করলেও পর্তুগিজ ও আরাকানদের বলিষ্ঠ উপস্থিতির কারণে সেখানকার বাণিজ্য ও কৃষিকাজ থেকে মুনাফা করতে পারছিল না। মুঘল কর্তৃপক্ষ। বাণিজ্যিক কাজকর্ম করা ছাড়াও পর্তুগিজরা উপকূলবর্তী নগর ও গ্রামগুলিতে অতর্কিত হানা দিয়ে বন্দি মানুষদের নিয়ে গিয়ে বাইরে বিক্রি করে দিত এবং অনেকজনকে খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিতও করেছিল।

পর্তুগিজদের প্রধান কেন্দ্র ছিল হুগলিতে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ ছিল না। এই কারণেই শাহজাহান ১৬৩২ সালে হুগলি আক্রমণ করেছিলেন। পর্তুগিজরা ভালো যুদ্ধ করলেও মুঘল বাহিনীর তারা ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারেনি। হুগলিকে পর্তুগিজ মুক্ত করে শাহজাহান সমুদ্র পর্যন্ত সামগ্রিক উপকূলবর্তী এলাকাকে জলদস্যু মুক্ত করেছিলেন। বন্দি পর্তুগিজদের সঙ্গে মুঘল কর্তৃপক্ষ যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল তা এককথায় মর্মান্তিক। তাদের কাছে দুটো বিকল্প দেওয়া হয়েছিল–ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা আর না হলে কারাদণ্ড। বহু পর্তুগিজ বন্দিই ধর্মান্তরিত হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাদের দীর্ঘ দিন কারাগারের গহন অন্ধকারে পচে মরতে হয়েছিল।

সিন্ধু অঞ্চল ও নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলেও মুঘল প্রভাব বিস্তারে ইচ্ছুক ছিলেন শাহজাহান। এই উদ্দেশ্যে ওই অঞ্চলের উপজাতীয় মানুষদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যের সময় লুঠতরাজ করার অভিযোগে অভিযান চালানো হয়েছিল এবং সেখানে মুঘল থানা গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই সব সামরিক কীর্তি ছাড়াও মুঘল শক্তি, বৈভব ও আভিজাত্য বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল ময়ূর সিংহাসন (তখত-ই-তাউস), আগ্রায় তাজমহলের নির্মাণ এবং দিল্লিতে সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপনের মধ্য দিয়ে। সে-সময় মুঘল দরবারে ভ্রমণ করতে আসা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ময়ূর সিংহাসন এবং অনেকেই তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তৎকালীন ঐতিহাসিক লাহোরির বর্ণনা অনুযায়ী মুঘল-রাজ অলংকার ভাণ্ডারের মধ্যে থেকে ছিয়াশি লক্ষ টাকা মূল্যের অলংকার নির্বাচন করে এবং এক লক্ষ ভোলা নিখাদ সোনা যার দাম চোদ্দো লক্ষ টাকা তা ওজন করে স্বর্ণকারের দফতরের আধিকারিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সিংহাসনের সামনের শামিয়ানা বা চাঁদোয়াটিতে ছিল কিছু মণিমাণিক্য সমেত এনামেলের কাজ, ভিতরের দিকে ছিল রুবি, মণি ও অন্যান্য অলংকারের হালকা আস্তরণ এবং তা চারটি পান্না খচিত স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথায় দুটি করে ময়ূরের মেলা পেখমের নকশা মণিমাণিক্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রত্যেক ময়ূর জোড়ার মাছে ছিল রুবি, হিরে, মুক্তো, চুনি ও অন্যান্য পাথরের নকশা।

সিংহাসনটি দৈর্ঘ্যে ছিল তিন গজ, প্রস্থে আড়াই গজ আর উচ্চতায় ছিল পাঁচ গজ যা নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল সাত বছর। শাহজাহান এই সিংহাসনে প্রথম বসেছিলেন ১৬৩৫ সালে।

শাহজাহানের প্রিয়তমা মুমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল বিখ্যাত তাজমহল। মুমতাজ ১৬৩০ সালে সন্তান প্রসবের সময় মারা গিয়েছিলেন। এই তাজমহল নির্মাণ করতে বারো বছর সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা যা সেই সময়ে ছিল বিরাট অঙ্ক। দিল্লিতে শাহজাহানদের নামে নতুন রাজধানী নির্মাণ করার কাজ শুরু হয় ১৬৩৮ সালে যা শেষ করতে সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর এবং খরচ হয়েছিল ষাট লক্ষ টাকা। আধুনিক ঐতিহাসিক শিরিন মুসভি হিসাব করে দেখিয়েছেন যে এই সমস্ত স্থাপত্য ও বাগান, আগ্রা ও লাহোর দুর্গের মেরামতি ও জাহাঙ্গিরের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ বাবদ শাহজাহানের ২৮ বছরে মোট খরচ হয়েছিল ২৮৯ লক্ষ টাকারও বেশি। সে সময় রাষ্ট্রের বাৎসরিক আয় ছিল ১০,৩২, ১৪৩/-টাকা। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সাম্রাজ্যের মোট আয়ের ৮২.৯ শতাংশ আসত জায়গির জমি থেকে। বাদবাকি ১৭ শতাংশ আয় সাম্রাজ্যের নিজস্ব খালিসাজমি বা সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে হত বলে মনে করেন তৎকালীন সরকারি ঐতিহাসিক কাজইনি (Qszwini) এবং তার পরিমাণ প্রায় বাৎসরিক ৬০ কোটি দাম ছিল। এসব ছাড়াও বাৎসরিক ব্যয় হত ১০০ থেকে ১২০ লক্ষ টাকা। সুতরাং কাজইনি-র দেওয়া তথ্য অনুসারে স্থাপত্য নির্মাণে বাৎসরিক যা খরচ হয়েছিল। তা ছিল প্রায় সাম্রাজ্যের বাৎসরিক মোট খরচের ১০.৩৩ শতাংশ বা বাৎসরিক মোট আয়ের ৬.৪৫ শতাংশ। এখান থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত হল এইরূপ :

‘স্থাপত্য নির্মাণের খরচ আসলে সাম্রাজ্যের নিজস্ব খালিসা ব্যয়ের একটা বড়ো অংশ ছিল। তবে তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই খরচ এত বেশি ছিল যে তা মেটাতে রাজকোষ বা সামরিক খাতে হাত দিতে হয়েছিল। (শিরিন মুসভি)

মুঘল শাসকশ্রেণির বিবর্তন ও মনসবদারি ব্যবস্থা

প্রথম সারণি থেকে স্পষ্ট হয়ে যাবে কীভাবে সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে মুঘল শাসকশ্রেণির বিকাশ ও বৃদ্ধি ঘটেছিল। সারণিতে ১৫৯৫ সাল থেকে তালিকা শুরু করা হয়েছে কারণ এই বছর থেকে তথ্য আইনআকবরী থেকে পাওয়া যায়।

দেখা যাচ্ছে যে সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ইরানি ও তুরানি অভিজাতদের সংখ্যার অনুপাত যেখানে ৬২.৬০ শতাংশ থেকে কমে ৫২.১২ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আফগান ও ভারতীয় মুসলিমদের সংখ্যা ১৯.৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ২৭.৪১ শতাংশ। আমরা ঠিক জানি না এই ‘অন্যান্য মুসলিমদের উৎসটা কী, এদের মধ্যে অনেকে ইরান ও তুরান থেকে আসতে পারে অথবা তারা হয়তো ভারতীয় কোনো জনজাতিরই বংশধর ছিলেন। হালকা ভাবে হিন্দুদের সংখ্যা বেড়ে ১৭.৮৮ থেকে ২০.৪৬ শতাংশ হয়েছিল।

ইরানি ও তুরানিদের মধ্যে জাহাঙ্গিরের আমলে ইরানিরাই সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছিলেন এবং শাহজাহানের আমলেও তাদের প্রাধান্য বজায় ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে জাহাঙ্গির ও শাহজাহান উভয়ের আমলে ইরানি অভিজাতরা দিওয়ান, মির বকশি, মির সমন-এর মতো প্রশাসনের প্রায় সব কটা উচ্চ পদ দখল করে বসেছিলেন এবং ধীরে ধীরে প্রদেশিক প্রশাসনের পদগুলোর দিকেও থাবা বসাচ্ছিলেন। সুতরাং তুরানিদের তুলনায় ইরানিরা বেশি ভালো প্রশাসক এই মতকে সামনে রেখে তাদের প্রশাসনে বেশি করে নিযুক্ত করার যে নীতি আকবর নিয়েছিলেন তা জাহাঙ্গির ও ‘শাহজাহান উভয়ের আমলেই অব্যাহত ছিল। যদিও ইরানি ও তুরানি অভিজাতদের সেই অর্থে ‘বিদেশি বলা ঠিক হবে না, কারণ তারা তাদের ঘরদোর ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিলেন ও দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন, এবং তারা কোনো বিদেশি শক্তি বা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বও করছিলেন না। তারা তাদের সম্মান ও নিরাপত্তা সঙ্গে নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে দূরে রেখে এদেশে এসেছিলেন। মুঘলরা তাদের নিজেদের প্রশাসনের কাজে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু মুঘল প্রশাসনে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই তাদের উন্নতি করতে হয়। এই প্রক্রিয়ার আদর্শ উদাহরণ হলেন ইতিমাদ-উদ-দৌলা।

আফগান ও ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে আফগানদের সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না কিন্তু জাহাঙ্গির তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের মুঘলদের নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ইরানি বা তুরানিদের মতো এদেরকে কিন্তু প্রশাসনিক পদ বা প্রদেশের শাসনভারের দায়িত্ব দেওয়া হত না। ধর্মীয় বাদবিচারের পাশাপাশি আর যে কারণটা এ সময় আফগানদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল তা হল এদের সঙ্গে অনেক আফগান ভুম্যধিকারী শ্রেণি ও জমিদারদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখজাদারা, এরা সরকারের দেওয়া মদদমাশ ভোগ করতেন ও জমিদারি স্বত্বের অধিকার তৈরি করে ফেলেছিলেন। ভারতীয় মুসলিম বা শেখজাদাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন শের শাহের বিখ্যাত উজির সদুল্লাহ খান।

যদিও হিন্দুদের মধ্যে রাজপুতরা মুঘল প্রশাসনে সবথেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল, তবুও ১৬০৭ সালে মান সিংহের সুবেদার পদের মেয়াদ শেষ হবার পর আকবর বা জাহাঙ্গিরের মতো আর কোনো মুঘল শাসকনতুন করে কোনো রাজপুত অভিজাতকে প্রাদেশিক শাসকের পদে নিয়োগ করেননি। যদিও একজন ব্রাহ্মণ, রাই রায়ান পাত্র দাস গুজরাটের যুগ্ম সুবেদার ও পরে প্রধান সুবেদার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৬১৩-১৪ সালে। ১৬১৩-১৪ থেকে ১৬১৭ সাল পর্যন্ত উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসকের দায়িত্ব সামলেছিলেন রাজা টোডর মলের পুত্র রাজা কল্যাণ। শাহজাহান এই নীতির কিছু সংশোধন করেছিলেন। ১৬৩১ সালে আগ্রার প্রাদেশিক হিসাবে। নিয়োগ করা হয়েছিল জয় সিংহকে এবং ১৬৪৫ সালে যশোবন্ত সিংহকে আজমেরের কার্যকরী শাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। শাহজাহানের আর-এক প্রিয়পাত্র রাজা বিঠল দাস গৌরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছিল এবং অবশেষে তাকে আজমেরের প্রাদেশিক শাসকের পদে নিয়োগ করা হয়েছিল ১৬৩৩-৩৫ সালের জন্য। তবে এই প্রবণতা ছিল সীমিত। কিন্তু বলা যায় যে রাজপুতদের মর্যাদা বেশি উচ্চই ছিল কারণ দাক্ষিণাত্য’ হোক বা বালখ, বদাখাসান হোক বা কান্দাহার, মুঘলদের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল না যেখানে বাহিনীতে রাজপুতদের নিয়োগ করা হয়নি ও সেনা নিয়ন্ত্রণের গুরুদায়িত্ব কোনো রাজপুত সেনাপতিকে দেওয়া হয়নি। জাহাঙ্গিরের প্রিয়পাত্র রানা জগৎ সিংহের পুত্র রানা রাজ সিংহের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল শাহজাহানের। তাই ১৬১৫ সালের চুক্তির শর্ত ভাঙা ও চিতোর দুর্গের প্রাচীর মেরামত না করার অভিযোগে তিনি রানার বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেছিলেন। ১৬৫৪ সালে। সেই অভিযানে চিতোরের প্রাচীরগুলি ধ্বংস করার পাশাপাশি সেখানকার পুর, মণ্ডল, মণ্ডলগড় প্রভৃতি পরগনা দখল করে নিয়েছিল মুঘল বাহিনী। উল্লেখ্য যে চিতোর দুর্গের প্রাচীরগুলি রানা জগৎ সিংহের সময়ে মেরামতি করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু জাহাঙ্গির সে ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি।

এইভাবে শাহজাহানের আমলের শেষের দিক থেকে রাজপুতদের একটা অংশ ও মুঘলদের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছিল।

দাক্ষিণাত্যে মুঘল প্রশাসনে স্থানীয় লোকজনদের অন্তর্ভুক্তি ও নানা সম্প্রদায়ের মানুষদের এক প্রশাসনে যুক্ত করে একটি মিশ্র শাসকগোষ্ঠী গড়ে তোলার যে নীতি আকবর নিয়েছিলেন তা এই সময়েও বজায় ছিল এবং হাবসি, দক্ষিণী ও মারাঠাদের দাক্ষিণাত্যের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সময় নানা কারণে মারাঠাদের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।

মিশ্র শাসকগোষ্ঠীর আর-একটি বৈশিষ্ট্য ছিল প্রশাসনিক কাজে নানা জাতির মানুষকে নিয়ে আসা। মুঘল প্রশাসনে ক্ষত্রী ও কায়স্থ জাতের মানুষরা যেমন ছিল তেমনই কয়েকজন ব্রাহ্মণও ছিল। আকবর ও জাহাঙ্গিরের আমলে যেমন মুঘল শাসকগোষ্ঠীতে রাজা টোডর মল, রাই পাত্র দাস, রাজা বিঠল দাস গৌর প্রমুখের মতো নানা জাতির মানুষ ছিলেন তেমনই শাহজাহানের সময়ে ছিলেন রাই রঘুনাথ ও ঔরঙ্গজেব। এঁরা কেবল সবাই যোগ্য মানুষ ছিলেন বলে নয়, এদের অন্তর্ভুক্তি মুঘল শাসকগোষ্ঠীকে একটি বৃহত্তর সামাজিক চরিত্র প্রদান করেছিল।

আমরা দেখেছি যে জাহাঙ্গিরের আমল থেকে শাহজাহানের আমলে মনসবদারদের সংখ্যা ৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর মূল কারণ হল এই সময় মনসব একটি মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছিল এবং চিকিৎসক, চিত্রকর, এমনকি কুস্তিগিরদেরও মনসব প্রদান করা শুরু হয়েছিল। জাহাঙ্গিরের বড্ড বেশি দানশীলতার কারণেও এদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছিল বলা যায়। জাহাঙ্গির আমাদের জানান যে তিনি তার রাজ্যাভিষেকের পর অভিজাতদের পদ তাদের অবস্থা অনুসারে ২০ শতাংশ থেকে ৩০০ বা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিলেন। জাহাঙ্গির এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন খসরুর বিদ্রোহ ও তাঁর নিজের অনুগত একটি বিশাল অভিজাতগোষ্ঠী গড়ে তোলার বাসনা থেকে। কারণ তিনি আকবরের সময়ের কয়েকজন অভিজাতের ওপর বিশ্বাস করতে পারেননি। বড়ো বড়ো পদোন্নতি মঞ্জুর করেছিলেন তিনি। কিন্তু নতুন কোনো এলাকা মুঘল সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে সাম্রাজ্যের আর বাড়ানোর কোনো চেষ্টা করেননি তিনি। তাই শাহজাহানের সরকারি জীবনীকার কাজইনির মতে, আকবর যে সাত কোটি টাকা রেখে গিয়েছিলেন তার মধ্যে থেকে ছয় কোটি টাকা জাহাঙ্গির খরচ করে ফেলেছিলেন এবং রাজকীয় প্রতিষ্ঠান বা খালিসার পরিমাণ কুড়ি ভাগের এক ভাগে বা পাঁচ শতাংশে কমে এসেছিল। আকবরের আমলে খালিসার পরিমাণ অনেক বড় ছিল, যদিও ঠিক কত পরিমাণ ছিল তা জানা যায় না।

একথা ঠিক যে তার প্রভুর কৃতিত্বকে অনেক বেশি করে তুলে ধরার জন্যে পূর্বের শাসকের দোষত্রুটি সম্পর্কে কিছু অতিশয়োক্তি করেছিলেন কাজইনি, কিন্তু তাই বলে এ কথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে সিংহাসনে বসার পর শাহজাহান। যথেষ্ট আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। এই কারণেই সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে মনসবদারি ব্যবস্থায় কিছু রদবদল জরুরি হয়ে পড়েছিল।

এই সময় জাট ও সাওয়ার উভয় পদের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিন্তু ঠিক কবে থেকে এই বেতন হ্রাস কার্যকর হয়েছিল সে ব্যাপারে বেশি কিছু জানা যায় না। ১৬১৫ সালে মেবারের শাসক করণ সিংহকে পাঠানো ফরমান (যার হিন্দি অনুবাদটুকুই পাওয়া গিয়েছে) থেকে জানা যায় যে ৫০০০ জাট/৫০০০ সাওয়ার মনসবের জন্যে তার বেতন ধার্য হয়েছিল মাসিক ৩০,০০০ টাকা যা আন-এ দেওয়া অঙ্কের সঙ্গে মিলে যায়। তার সাওয়ারের বেতন ৯৬০০ দাম বা বার্ষিক ২৪০ টাকা হিসাবে ধার্য করা হয়েছিল যা আকবরের আমলে দাগ ব্যবস্থা প্রচলনের আগে যে ১০-২০-র অনুপাতে (অর্থাৎ ১০ সাওয়ার, ২০ টি অশ্ম) সাওয়ারের বেতন দেওয়া হত তার সমান ছিল। মনে হয় ১৬০৫ সাল বা তার পরে জাট বেতনে হ্রাস করা হয়েছিল কিন্তু সেই হ্রাস কার্যকর হত কেবল ৪০০ থেকে ১০০ মনসবদারদের ক্ষেত্রে। জাট বেতনে সবথেকে বেশি হ্রাস ঘটেছিল ১৬১৬ থেকে ১৬৩০ সালের মধ্যে। ১৬৩০ সালের কিছু নথি থেকে জানা যায় যে সর্বক্ষেত্রে জাট বেতন ৩৭% কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ১৫০০-৭০০০ পদের মনসবদারদের জাট বেতন ২৬% থেকে ৪২%-এ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর ১৫০০-র নিচের মনসবদারদের বেতন ৩২% থেকে ৬০% কমে হয়েছিল। তাই দেখা যাচ্ছে যে নিচু পদের মনসবদারদের কপালেই জুটেছিল অত্যধিক বেতন হ্রাসের ফাঁড়া।

সাওয়ার বেতনও এই সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে তা কমিয়ে ৮৮০০ দাম বা বার্ষিক ২২০ টাকা করা হয়েছিল এবং পরে তা আরও কমিয়ে ৮০০০ দাম বা বার্ষিক ২০০ টাকা করা হয়েছিল। এখানে দুটি জিনিস বলা দরকার। প্রথমত, এই বেতনগুলি কিন্তু প্রত্যেক সাওয়ার পদধারীকে নগদ অর্থে দেওয়া হত না, এগুলি ছিল চুক্তি দর’ অর্থাৎ এই দরে ওই সাওয়ারভোগী মনসবদারদের সাওয়ার দেওয়া হত। ঘোড়াদের অবস্থা ও তাদের জাত বিচার করে তার বরাদ্দ সাওয়ার নির্ধারিত হত। ইরানি, তুরানি, আফগানদের তুলনায় রাজপুতরা অপেক্ষাকৃত কম সাওয়ার লাভ করত। দ্বিতীয়ত, দাগ প্রথা প্রচলনের পর রাষ্ট্র সাওয়ার পদের বেতন স্থায়ী করে। দিয়েছিল।

জাহাঙ্গিরের সময় যে ব্যাপারটা নতুন দেখা গিয়েছিল তা হল দুসপা সিআসপা বা আক্ষরিক অর্থে দুই-তিন অশ্ব পদের প্রচলন। এই পদ যারা লাভ। করতেন তাদের সাওয়ারের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যেত এবং সেই অনুপাতে বেতনের পরিমাণও বেড়ে যেত। তাই একজন ২০০০ জাট/২০০০ সাওয়ার দু-আসপা সিআসপামনসবদারের মোট সাওয়ারের পরিমাণ হবে ৪০০০ এবং সেই অনুপাতে। তিনি বেতন পাবেন, অর্থাৎ ২০০০ সাওয়ারের যে বেতন হত তার দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থার সুবিধা যেটা ছিল তা হল সম্রাট একজন যোগ্য অভিজাতের জাট পদ না বৃদ্ধি করেই অনায়াসে সাওয়ারের পদ বৃদ্ধি করে তাকে আরও বেশি সেনাবাহিনী ও ঘোড়া ভরণপোষণের জন্য বলতে পারত। তবে সব সাওয়ার পদকেই দুআসপা সিআসপাতে উন্নীত করার দরকার পড়ত না। তাই ২০০০/২০০০ মনসবদারের চাইলে ১০০০ সাওয়ারকে দু-আসপা সিআসপাতে উন্নীত করে সেই অনুপাতে মোট সাওয়ারের পরিমাণ ৩০০০ করা যেত। অর্থাৎ আসল সাওয়ার থেকে যেত ১০০০ আর বাকি ১০০০ সাওয়ার (যাকে বলা হত বারাওয়ারদি) দ্বিগুণ হয়ে হত। ২০০০, মোট ৩০০০ সাওয়ার।

দুআসপা সিআসপা হারের সঙ্গে মনে হয় আরও একটা হিসাব জড়িয়ে ছিল যার কথা প্রথম আমরা জানতে পারি শাহজাহানের আমলে। বলা হয় যে এটা ‘অধিকৃত অঞ্চলের (দৌলত) একটা নিয়ম ছিল যেখানে উত্তর ভারতের প্রদেশগুলোতে যাদের যে অঞ্চলে নিয়োগ করা হত যদি সেই অঞ্চলেই জায়গির থাকত তাদের সাওয়ার পদ দুই তৃতীয়াংশ, যাদের সেই অঞ্চলের বাইরের কোনো প্রদেশে জায়গির থাকত তাহলে তাদের সাওয়ারের এক চতুর্থাংশ কমিয়ে দেওয়া হত। পরবর্তীকালে যারা বালখ ও বদাখাসান অভিযানে মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিল তাদেরও সাওয়ার পদের পরিমাণ এক পঞ্চমাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই এক পঞ্চমাংশ সাওয়ার হ্রাসের নিয়ম দাক্ষিণাত্যে থাকা জায়গিরের অধিকারীদের জন্যেও বলবৎ ছিল।

সুতরাং একজন ২০০০/২০০০ (১০০০ দুআসপা সিআসপা) মনসবদারের যদি। নিযুক্ত প্রদেশের বাইরের কোনো এলাকায় জায়গির থাকত তাহলে তার সাধারণ সাওয়ার থেকে ১০০০x১/৪= ২৫০ কমে যেত, আর ১০০০ দ্বিগুণ হয়ে যেত তাই তা থেকে এক চতুর্থাংশ কমে যেত ৫০০, অর্থাৎ মোট কমে যেত ৭৫০ সাওয়ার।

এই পরিমাপ পদ্ধতি ছিল নিঃসন্দেহে শাহজাহানের উদ্ভাবন। আকবরের সময়েও বদায়ুনি আমাদের জানিয়েছিলেন যে কোনো মনসবদারের ১০০ পদ থাকলে তা থেকে ২০ পদও কমত না। শাহজাহান এই নতুন নিয়ম প্রচলন করার আগে পর্যন্ত এই নিয়মই বলবৎ ছিল।

এই নতুন নিয়মের প্রভাবে মনসবদারদের অনেক লাভ হয়েছিল। তাদের এবার থেকে মোট সাওয়ারের অনেক কম রাখতে হত কিন্তু পুরো সাওয়ার রাখার বেতন পেয়ে যেতেন। এ সময় আর-একটা হিসাবের কথা জানা যায়। মনসবদারদের বেতন জায়গিরের নির্ধারিত রাজস্ব দাবির (জমা) সাপেক্ষে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় (হাসিল) হত তার উপর নির্ভর করে বারো মাত্রায় বেড়ে যেত। এই বেতন বৃদ্ধির সুযোগ কেবলমাত্র শাহজাদা ও উচ্চপদাধিকারী দু’জন অভিজাত পেতেন। বাকিরা পুরো বেতন বা তার কম মাসের বেতন পেতেন।

দাক্ষিণাত্যের পরিস্থিতি আরও জটিল ছিল। আকবরের সময় সেখানে নির্ধারিত রাজস্ব দাবি বা জমার পরিমাণ ওঠানামা করত। তাই সেখানে নিযুক্ত মুঘল মনসবদাররা বেতন হিসাবে কম জায়গির লাভ করতেন।

মাসে মাসে বেতন দেওয়ার পদ্ধতি জাট ও সাওয়ারধারী মনসবদারদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে সাওয়ার পদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে একটু আলাদা হিসাব থাকত। ১২ মাসের সাওয়ার বেতনের জায়গির মাসিক ৪০ টাকা হিসাবে ধার্য হত এবং এর পরিমাণ প্রতিমাসে কমে যেত। তাই ৮ মাসের জায়গির প্রাপ্ত সাওয়ারের বেতন হিসেব হত মাসিক ৩০ টাকা ধরে আর ৬ মাসের জায়গির বেতন হিসাবে যারা পেতেন তাদের সাওয়ার ও অশ্বের সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যেত। এই ভাবে আকবরের ১০-২০ পদ্ধতি উঠে গিয়েছিল।

১৫৯৫ থেকে ১৬৫৬-৫৭ সালের মধ্যে জমার খুব একটা বৃদ্ধি ঘটেনি। ১৬২৭ সালে সাম্রাজ্যের মোট জমা ৫১৬.২৫ কোটি দাম (১২.৯১ কোটি টাকা) থেকে বেড়ে হয়েছিল ৬৩০ কোটি দাম (১৫.৭৫ কোটি টাকা) এবং ১৬৪৭-৪৮ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৮৮০ কোটি দাম। এখান থেকে আমরা বালখ ও বদাখাসানের জমা হিসাবে ১৮ কোটি দাম বাদ দিলে মোট জমা দাঁড়ায় ৮৬২ কোটি দাম অর্থাৎ ১৬.৫৫ কোটি টাকা। ১৬৫৬ সালে জমা বেড়ে হয়েছিল ৯১২ কোটি দাম, অর্থাৎ ২২.৮০ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে যদি ১৫৯৫-৯৬ সালে জমা বৃদ্ধি ১০০ হয় তাহলে ১৬২৭ সালে তা হয়েছিল ১২২, ১৬৪৭-৪৮ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ১৬২ এবং ১৬৫৬-৫৭ সালে তা পৌঁছেছিল ১৭৬-তে।

সুতরাং জমা-র বৃদ্ধির তুলনায় মনসবের বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্যেই সময়ে সময়ে জাট ও সাওয়ার বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি সাওয়ারের অনুপাতে সেনা ও অশ্বের পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উত্তর ভারতে তখন অপেক্ষাকৃত অনেক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল বলে মনসবদারদের সামরিক শক্তির এই হ্রাস খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি মুঘল সাম্রাজ্যকে। কিন্তু দাক্ষিণাত্যের শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা তখনও বাকি ছিল এবং সেখানে মারাঠাদের উত্থানের ফলে পরিস্থিতি এমনিতেই ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। ফলে সেখানে মনসবদারদের অধীনে থাকা অশ্ব ও সেনা কমিয়ে দেওয়ার ফলে মুঘলদের পরবর্তীকালে ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছিল।

তাই পর্যাপ্ত সম্পদ ও মনসবদারদের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে যে ফাঁকটা ছিল, যাকে মনসবদারি ব্যবস্থার রদবদল ঘটিয়ে চাপা দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেখান থেকেই ‘জায়গিরদারি ব্যবস্থার সংকট’-এর প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল যা সম্পূর্ণরূপে মুঘল সাম্রাজ্যকে গ্রাস করেছিল পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেবের আমলে।

১. কোনো কোনো হিসেবে বেরার খান্দেশের জমা বাদ দেওয়া হয়েছিল, কারণ এই অঞ্চল দুটি ১৫৯৫-এর পরে মুঘল সাম্রাজ্যর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। যদিও এই অঞ্চল দুটির জমা জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমলে হিসাবে যুক্ত করা হয়েছিল। আমরা এখানে। তুলনামূলক বিকাশের ছবি তুলে ধরতে চেয়েছি বলে ১৫৯৫ সালের বেরার ও খান্দেশের জমার পরিমাণও যুক্ত করেছি আমাদের হিসাবে।

বি. দ্র. (১ টাকা = ৪০ দাম)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *