সন্ধ্যাবেলা সোমা চা বানাচ্ছিল। ঊর্মি এসে বলল, আপা একটু বাইরে যাও তো।
সোমা বলল, কেন?
কে যেন এসেছে। তোমাকে চাচ্ছে।
সোমা পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল। আচমকা বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। উনি কি এসেছেন?
বসতে বলেছিস?
না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
বসতে বললি না কেন? বসতে বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারি নি।
তুমি গিয়ে বল।
সোমা বাইরে এসে দেখে উনি আসেন নি। কামাল দাঁড়িয়ে। সোমা শুকনো গলায় বলল, কি ব্যাপার?
আধা ঘন্টা ধরে এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করছি। বাসা চিনতে পারছি না। অথচ এর আগে তিন বার এসেছি।
এখানে দরকারটা কি?
দরকার নাই কিছু, তোমার টব দুটা নিয়ে আসলাম। রেখেছি ঐ কোণায়। লাল রঙের পাতা ছেড়েছে। আমার ধারণা ছিল এই গাছগুলো ফাল্গুন মাসে পাতা ছাড়ে, এখন ছাড়ল কেন বুঝলাম না।
সোমা বিরক্ত গলায় বলল, এগুলো আমার দরকার ছিল না।
বাসা ছেড়ে দিচ্ছি তো। না এনে করব কি? হোটেলে গিয়ে উঠব। একা মানুষ।
সোমা কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, তোমার জন্যে হোটেলে থাকাই ভালল। ঘন ঘন বদলাতে পারবে।
তা ঠিক। তোমাকে এমন রোগা লাগছে কেন? অসুখ বিসুখ না-কি?
না অসুখ বিসুখ হবে কেন?
খুব রোগা লাগছে এই জন্যে বলছি।
আমার স্বাস্থ্য নিয়ে তোমার চিন্তিত হবার দরকার আছে কি?
সোমা লক্ষ করল লোকটা লজ্জা পেয়ে কেমন বিব্রত ভঙ্গিতে হাসছে। এই লোক বিব্রত ভঙ্গিতে হাসতেও পারে না-কি? আশ্চর্য তো!
কামাল পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বিড়ালটা বাচ্চা দিয়েছে। চারটা বাচ্চা। তিনটা খুব হেলদি। আর রোগা যেটা ঐটাকে তার মা দুধ খেতে দিচ্ছে না। ব্যাপারটা কিছু বুঝলাম না। আদর-যত্ন এটাকেই করা উচিত, অথচ…..
সোমা চুপ করে রইল। কি বলবে সে? ভাগ্যিস বিজু বাসায় নেই। বিজু থাকলে নিৰ্ঘাত হৈ চৈ চেঁচামেচি শুরু করত।
বুঝলে সোমা, আমি ন্যাকড়ায় দুধ ভিজিয়ে ঐ বাচ্চাটার মুখের সামনে ধরেছিলাম, এক বার শুধু চুক-চুক করে খেয়েছে। এখন আর খাচ্ছে না। বিরাট প্রবলেম।
আমাকে এসব বলছ কেন? ফুলের টব দিতে এসেছিলে, দেওয়া হয়েছে। এখন চলে যাও।
কামাল নিচু গলায় বলল, তুমি চলে আসায় খুব খারাপ লাগছে। এতটা খারাপ লাগবে বুঝতে পারি নি।
কিছুদিন খারাপ লাগবে তারপর আর লাগবে না।
তা ঠিক, নিজের বাপ-মার কথাই এখন আর মনে হয় না। সোমা তা হলে যাই।
আচ্ছা-যাও।
তোমাদের বাসার সামনে একটা গাছ ছিল না, বিরাট গাছ। কেটে ফেলেছ না-কি?
হ্যাঁ।
উচিত হয় নি। গাছ কাটা ঠিক না। যাই তা হলে সোমা। ইয়ে, শোন—একদিন এসে কি বিড়ালগুলোকে দেখে যাবে?
না। কেন শুধু কথা বাড়াচ্ছ।
আচ্ছা, আচ্ছা, তা হলে যাই।
যাই বলেও সে দাঁড়িয়ে রইল। সোমা বলল, চোখের অবস্থা তো মনে হচ্ছে খুব খারাপ। ডাক্তার দেখিয়েছ?
না।
না কেন?
যাব একদিন। সব শালা ফক্কড়। যেতে ইচ্ছে করে না।
সবাই ফক্কড়। আর তুমি হচ্ছ ভালো মানুষ?
না। তা না।
যাও, চলে যাও, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আচ্ছা তা হলে যাই।
কামাল যাচ্ছে কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। ওকে ডেকে বসিয়ে এক কাপ চা খাইয়ে দিলে খুব কি অন্যায় হয়? হা হয়। কেন শুধু শুধু চা খাওয়াবে?
সোমা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে গেল।
জাহানারা কঠিন স্বরে বললেন, ও এসেছিল কেন?
ফুলের টব দিতে এসেছিল।
সাহস তো কম না। ছোটলোক।
সোমা শান্ত স্বরে বলল, কেন শুধু গালাগালি করছ মা। গালাগালির দরকারটা কি তা তো বুঝছি না।
তোর কাকারখানা তো কিছু বুঝছি না। এত কি কথা তোর?
আমার কোন কথা নেই মা। ওর কিছু কথা ছিল শুনেছি। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তো বের করে দিতে পারি না।
ওর কি কথা ছিল?
তেমন জরুরি কিছু না। বিড়াল চারটা বাচ্চা দিয়েছে এইটাই বলল।
জাহানারা অবিশ্বাসী গলায় বললেন, বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে এই খবর দেবার জন্যে এখানে এসেছে?
হ্যাঁ। পাগল না-কি?
হ্যাঁ মা পাগল। পাগলের সঙ্গে থেকে-থেকে আমিও খানিকটা পাগল হয়ে গেছি। কারণ ঐ শয়তানটার জন্য আমার খারাপ লাগছে।
সোমার গলা কেমন যেন ভারি শোনা গেল।
সে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। না নিজের ঘরে নয়। এই বাড়িতে তার নিজের কোনো ঘর নেই। একলা হতে ইচ্ছা করলেও এ-বাড়িতে সে উপায় নেই। অথচ এখন তার একা থাকতে ইচ্ছা করছে। সোমা হাত বাড়িয়ে চা নিল।