দশ
শ্রাবণ আসার আগেই এবার বর্ষা হঠাৎ উধাও। মাসখানেক বন্দিদশায় কাটানোর পর জলদশৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলেছেন সূর্যদেব, এখন তাঁর তেজ দেখে কে! এক আধটা মেঘের আনাগোনাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না, আর্দ্র তাপে সেদ্ধ করছেন শহরটাকে। সজল মেঘেরা নাকি দিগ্ভ্রান্ত হয়ে চলে গেছে পশ্চিমে, কোন এক নিম্নচাপের তাড়নায়। কবে যে আবার ফিরবে তারা কে জানে!
এই ভ্যাদভেদে গরমটা ঋতমের পছন্দ নয়। নিজের গুহায় বসে পেন চিবোচ্ছে ঋতম, মাঝে মাঝেই ক্রূর দৃষ্টি হানছে প্রাগৈতিহাসিক স্ট্যান্ডফ্যানের দিকে। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, শব্দে মাথা ধরে যায়, হাওয়া হয় না। বাজার থেকে সেই যে চুপচুপে হয়ে ফিরেছিল, কিছুতেই ঘাম শুকোচ্ছে না!
ঋতম মন থেকে গরমটাকে তাড়াতে চাইল। শীত গরম বোধ অনেকটাই তো মনের ব্যাপার। ভাবা যাক না সে এখন বসে আছে খোদ সাইবেরিয়ায়। আকাশ থেকে তুষার ঝরছে, পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো বরফে ঢেকে গেছে গাছপালা পথঘাট। বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে বটে, সেগুলোও সাদায় মাখামাখি। আপাদমস্তক ফারকোটে ঢাকা মানুষরা হাঁটছে দ্রুত, সেঁধোতে চাইছে যে যার ঘরে। দস্তানা পরা হাতে বরফের গোলা বানিয়ে লোফালুফি খেলছে বাচ্চারা। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া নাকে এক বৃদ্ধ বরফ তুলে ঘষল। ঋতম হি হি কাঁপতে কাঁপতে হাঁটছে বৃদ্ধের পাশে পাশে। দৃশ্যে একটা পোলার বেয়ার এসে গেলে কেমন হয়?
নাহ্, ভাবনার গুণ আছে। গরমটা সত্যিই কমে এল। ঋতম চোখ নামাল কাগজে। সিগারেট ধরিয়ে এবার লেখায় মনঃসংযোগের চেষ্টা করছে। টানা দু দিন বাড়ি থেকে না বেরিয়ে গল্পটা আবার লিখেছে, কিন্তু দাঁড়াল কই! ফুটছে না, ফুটছে না…ঠিক চার্জটা আসছে না। মেয়েটার মনোবেদনার অম্লমধুর রূপটা ফুটছে না কিছুতেই। করুণ রসের দিকে সরে যাচ্ছে। শালা, কলমটা কিছুতেই যে কেন কনট্রোলে থাকে না? আবার ভাঙতে হবে, আবার ধরতে হবে, আবার ছিঁড়তে হবে।
বাইরে বামাকণ্ঠের কলরোল। না চাইতেই ঋতমের কান চলে গেল। দিদি এসেছে। যাহ্ শালা, হয়ে গেল। লেখা চৌপাট। সঙ্গে গুড়মও আছে, মা ছেলে গলা বাজানোর কম্পিটিশান দিচ্ছে। কোনও মানে হয়? এই রোববারেই দিদিকে আসতে হল?
ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই দড়াম। গুড়ুম দরজা হাট করে তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছে, —এই তো মামা! এই তো মামা!
বেশ শীত শীত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, নিমেষে চৌচির। ঋতম কপালের ঘাম মুছল, —কী রে, তোরা কী করতে?
সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে রুণু। চোখ পাকিয়ে বলল, —কী করতে মানে? বাপের বাড়ি এসেছি মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
—তার মানে মার সঙ্গে দেখা করতে বাপের বাড়ি এসেছিস!
বছর পঁয়ত্রিশের রুণু সামান্য থতমত। ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, —হ্যাঁ এসেছি।…তুই মনে হচ্ছে খুশি হোসনি?
—সে কথা কখন বললাম? জাস্ট বলতে চাইছি, আট বছর আগে বাবা মারা যাওয়া সত্ত্বেও এটা তোর কাছে এখনও বাপেরই বাড়ি। মার বাড়ি নয়।
—মানে?
-—মানে মা হল একটা ননএনটিটি। ভেবে দ্যাখ, যেটা মার নিজের বাড়ি ছিল, সেটাও আমাদের চোখে মার বাড়ি নয়, মামার বাড়ি। মা বিয়ে হয়ে যেখানে এসেছে, সেটাও মার নিজের বাড়ি নয়, বাবার বাড়ি। আই মিন তোর বাপের বাড়ি।…এবার তুই মার জায়গায় নিজেকে প্লেস কর। বলেই ঋতম দাঁত ছড়িয়ে গুড়ুমকে জিজ্ঞেস করল, —গুড়ুম, তুমি এখন কোথায় এসেছ?
সাড়ে পাঁচ বছরের গুড়ুমের তুরন্ত্ জবাব, —মামার বাড়ি।
—শুনলি? তুই এখানে ননএনটিটি। আবার তুই তোদের বাগবাজারের বাড়িতে যা, সেখানেও সেটা তোর শ্বশুরবাড়ি। অথবা গুড়ুমের বাপের বাড়ি। অর্থাৎ সেখানেও তুই ননএনটিটি। আমি কি ভুল বলেছি?
রুণু চোখ বড় বড় করল, —হঠাৎ এত প্যাঁচ কষছিস কেন?
—আমি জাস্ট বোঝাতে চাইছি, নারী তুমি কেউ নও। যতই তুমি আধুনিকা সাজো, তুমি সেই একটি খোঁটায় বাঁধা গোরু। ঋতম ভুরু নাচাল, —কী বুঝলি? এটাই আমার নেক্সট গল্পের মূল থিম। পিতৃতন্ত্রটা যে কীভাবে মজ্জার ভেতর ঢুকে আছে, সেটা মেয়েরাই বুঝতে পারে না। আই মিন তোদের মতো মেয়েরাও।
রুণু মুখ বেঁকাল, —থাক, গর্তে বসে আর লেকচার ঝাড়তে হবে না। বাইরে আয়।
ঋতম কাঁধ ঝাঁকাল। হার ম্যাজেস্টির যখন আবির্ভাব হয়েছে, তখন আর উপায় কী। না বেরোলে অন্য বিপদও আছে, গুড়ুম এক্ষুনি লিখতে চাইবে। ঋতমের সাহিত্য আর গুড়ুমের বিদ্যে তখন একাকার। গত বার যখন গুড়ুম এসেছিল, ঋতমের একটা ফেয়ার করা গল্পের পাতায় ইয়া বড় সূর্য এঁকে রেখেছিল। পাছে ঋতম দেখে চিনতে না পারে, তলায় বড় বড় করে লিখে দিয়েছিল, সান!
কাগজ কলম ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বাইরে এসে দরজায় শিকল তুলে দিল ঋতম। দিদি এলে বাড়িতে বেশ একটা জমজমাট আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায়। মা খুশিতে ঝলমল করবে, শ্রাবণী মনের প্রাণের কথা শোনাবে ননদকে, টুসকিকে নিয়ে লোফালুফি করবে দিদি, অনর্গল দস্যিপনা করে বাড়ি মাত করে রাখবে গুড়ুম…। কাল্পনিক দুঃখের ভারে মুহ্যমান সংসার যেন তখন খুশির প্রস্রবণ। প্রায় নিখুঁত সুখী সংসারের ছবি। লেখা বন্ধ হয়ে গেলেও দেখতে বেশ লাগে ঋতমের।
এখন সকলেই অতসীর ঘরে। টুসকির আহারপর্ব চলছে, তাকে ঘিরে আছে দর্শকমণ্ডলী। দুরূহ কাজ, শ্রাবণী সাপটে পেড়ে ফেলেছে মেয়েকে, চোয়াল ফাঁক করিয়ে সেরেল্যাক গেলাচ্ছে। টুসকি মহা শাহেনশা, এক চামচ সেরেল্যাক মুখে নিয়ে গোটা জীবনটাই সে কাটিয়ে দিতে পারে। জোর করে পরবর্তী চামচ ঢোকাতে গেলেই ফুর্র্র্। তার সব চেয়ে প্রিয় খাদ্য এখন চটি আর জুতো। ইদানীং সে তির বেগে হামা টানছে, তার বিচিত্র আহারপ্রবণতার জন্য বাড়ির যাবতীয় পাদুকা এখন লুকিয়ে রাখতে হয়।
এই মাত্র আবার একটা ফুর্র্র্ করল টুসকি। গুড়ুম হাততালি দিয়ে উঠল। উৎসাহিত করছে বোনকে। শ্রাবণীর মুখ সেরেল্যাকে মাখামাখি। রুণু বিমোহিত।
কটাক্ষ হেনে রুণু ভাইকে বলল, —তোর মেয়ে তোর মতোই হয়েছে। কোনও সুখাদ্যই পছন্দ হয় না।
ঋতম বলল, —ভুলভাল বকিস না দিদি। খাওয়ার ব্যাপারে আমার কক্ষনও না নেই।
—নেই? ভাল ভাল চাকরিগুলো উগরে দিল কে?
—মাইরি, ওগুলো আমার গলা দিয়ে নামল না।
—ব্যবসাটার কথাও তো ভাবলি না!
—ও বিজনেসটা একটু রিসকি হয়ে যেত রে। পেটের বারোটা বেজে যেত। চানাচুর আলুভাজা কত খাওয়া যায়, তুইই বল?
অতসী ঝাপটে এল, —কেন ওকে রোজগারের কথা আর বলছিস রুণু? যে নিজের ভাল বোঝে না, তার পেছনে লেগে থাকা মানে নিজেরই আয়ুক্ষয়।
—আর আমি ওকে কিছু বলবই না। তোমার জামাই স্ট্রিকটলি বারণ করে দিয়েছে। বলেছে, বাবুয়ার যদি কখনও চৈতন্য হয়, যদি মনে হয় রোজগার করা উচিত, তাহলে যেন সে অম্বরদার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ও প্রতিজ্ঞা করেছে নিজে থেকে আর কিছু করবে না।
শেষপর্যন্ত অম্বদাই তাহলে রণে ভঙ্গ দিল! বেচারা অম্বরদা। মানুষটা কিন্তু বেশ। বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করেও এখনও অম্বরদার হৃদয়টা পাষাণ হয়ে যায়নি। অম্বরদার গুণও আছে অনেক। একজন মাঝারি মাপের মন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হয়েও অম্বরদা এখনও যথেষ্ট সৎ, ফ্ল্যাট বাগায়নি, গাড়ি হাঁকায়নি, ছক্কাপাঞ্জা করারও অভ্যেস নেই। তবে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতাও কি বলা যায়? বেকার শ্যালককে বার বার চাকরিতে ঢোকানোও তো কারোর না কারোর কাছ থেকে সুবিধাগ্রহণ! শ্যালকের হবু বউ কলকাতার কলেজেই পোস্টিং পেল, তার মূলেও তো ছিল অম্বরদার কলকাঠি নাড়া! শ্রাবণীকে নিয়ে ঋতমই তো তখন অম্বরদার কাছে দরবার করেছে! তবে হ্যাঁ, খাঁটি দুধে ওইটুকু চোনা না থাকলে অম্বরদা তো স্বর্গ থেকে খসে পড়া দেবদূত হত। অম্বরদা যেটুকু করেছে, ঋতমকে ভালবাসে বলেই না করেছে।
তবু ঋতম রুণুকে একটু না খুঁচিয়ে পারল না। হাসতে হাসতে বলল, —তুই শিওর, অম্বরদা আর আমার জন্য কিছু করবে না?
—আর মুখ পোড়াতে ওর বয়েই গেছে।
—দেখিস বাবা, পলিটিকসের লোকরা কিন্তু বেশিদিন প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারে ফের হয়তো একটা যুক্তি খাড়া করে ফেলবে, কেন বাবুয়ার জন্য তার চেষ্টা করা উচিত…
—দেখেছ মা? দেখেছ মা, কীভাবে কথা বলে!
অতসী নয়, এবার শ্রাবণীর চোখ ঝলসাল ঋতমকে। বউয়ের ওপর রাগ ঝির ওপর ফলাচ্ছে! জোর একটা ঠোনা মারল টুসকির গালে, টুসকি কঁকিয়ে উঠেছে।
রুণু আহাহা করে উঠল, —ইস, ওইটুকু বাচ্চাকে মারছিস কেন?
—না, মারবে না!..! বুদ্ধিমতী শ্রাবণী চকিতে সংযত করেছে নিজেকে, —এইটুকু একটু সেরেল্যাক খাওয়াতে প্রাণ বেরিয়ে গেল!
অতসীও তাড়াতাড়ি হাওয়া ঠাণ্ডা করল, —টুসকি কিন্তু আজকাল খিচুড়িটা বেশ খায়। চালে ডালে মিশিয়ে বেশি করে আনাজপাতি দিয়ে প্রেশারে বসিয়ে দিই, আর খাওয়ার সময়ে এক চিলতে ঘি…কুপ কুপ করে খেয়ে নেয়।
রুণু কোলে তুলে নিয়েছে টুসকিকে। আহার থেকে মুক্তি পেয়ে টুসকিরও মুহূর্তে কান্না ভ্যানিশ। দেয়ালা চলছে পিসির সঙ্গে। গুড়ুমের প্রবল ইচ্ছে বোনকে কোলে নেয়, অতি কষ্টে তার হাত থেকে টুসকিকে বাঁচিয়ে রেখেছে রুণু।
ভাইঝিকে আদর করতে করতে রুণু বলল, —মুখে এখন স্বাদ আসছে, টুসকিকে এখন অ্যানিমাল প্রোটিন ট্রাই করতে পারো। পোনা মাছ, চিকেন…
শ্রাবণী বলল, —খায় তো, তবে বেশি দিই না।
কথার মোড় ঘুরে গেছে। পুনরায় বাড়ি সরগরম। নানা রকম কচকচি চলছে। টুসকি, গুড়ুম, গুড়ুমের স্কুল, রুণুর অফিস, শ্রাবণীর কলেজ, আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে ঘোঁট…
এক ফাঁকে অতসী উঠে গেল ভেতর বারান্দায়। ইশারায় ডাকল ঋতমকে। কাছে আসতেই চাপা স্বরে বলল, —বসে আছিস যে বড়? যা, একটু মাংস নিয়ে আয়।
—কী আনব? মুরগি?
—না, খাসি নিয়ে আয়। রুণু ভালবাসে।
—আবার খাসি খাবে? এতক্ষণ ধরে তো একটা খোদার খাসিকে চিবোল!
অতসী এমন কটকট তাকাল, মনে হল ঋতম এক্ষুনি ভস্ম হয়ে যাবে।
ঋতম ফিক করে হাসল, —তুমি কাকে বেশি ডরাও মা? শ্রাবণীকে? না দিদিকে?
—চুপ করবি তুই? যাবি?
রুণুর চোখ কান অতি প্রখর, দেওয়াল ফুঁড়েও সে দেখতে পায়। ঘর থেকে চেঁচাচ্ছে, —বাবুয়া কি বাজার যাচ্ছিস?…আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যা, বেশি করে মিষ্টি দই নিয়ে আয়। বহুকাল সত্যনারায়ণের দই খাইনি।
শ্রাবণীর গলা শোনা গেল, —তুমি কেন দই আনাবে দিদি? আমি টাকা দিচ্ছি।
—আহা, আসার পথে তো আমি আনব ভেবেইছিলাম। ভুলে গেলাম…
—না না, তুমি টাকা রাখো। আমি তোমায় খাওয়াব।
ননদ ভাজে অধিকারবোধ আর লৌকিকতার প্যাঁচপয়জার চলছে। ঋতম দরজায় এল,—কাউকে দিতে হবে না। আমার কাছে টিউশ্যনির টাকা আছে, আজ আমি সবাইকে দই খাওয়াব। উইথ একটা করে সত্যনারায়ণের কমলাভোগ। একটার বেশি কেউ চাইবে না। ঠিক হ্যায়?
বাজার থেকে ফিরে ঋতম দেখল বাড়ি অস্বাভাবিক রকমের নিঝুম। টুসকি গুড়ুমকে ট্যাঁকে নিয়ে রুণু গেছে ওপরে, জ্যাঠা কাকার কাছে। ঋতমদের সঙ্গে কাকা জ্যাঠাদের সম্পর্ক তিক্ত নয়, দরকারে অদরকারে আসাযাওয়াও আছে, বাড়িতে কোনও কাজকর্ম হলে হাঁড়িও এক হয়ে যায়, তবু দূরত্ব একটা তৈরি হয়েই গেছে। সবাই কেমন আলগা আলগা। অবশ্য সেনগুপ্তবাড়ির মেয়েরা বাপের বাড়ি এলে একবার না একবার সব ঘরে ঢুঁ মারবেই। রুণুর তো আবার বিশেষ খাতির। মন্ত্রীর ডানহাতের বউ বলে কথা।
রুণু ফিরল ঘণ্টাখানেক পর। আরও খানিক কলকল করে, গুড়ুমকে খাইয়ে, টুসকিকে ঘুম পাড়িয়ে, একটা নাগাদ সবাই মিলে বসেছে খাবার টেবিলে। জব্বর মেনু। ডাল, বেগুনি, মাছের কালিয়া, মাংস, চাটনি, দই, মিষ্টি।
খেতে খেতে রুণুই প্রসঙ্গটা তুলল, —হ্যাঁরে বাবুয়া, সেই মেয়েটার কী হল রে?
ভোজনরসিক ঋতম আহারে মগ্ন ছিল। ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করল, —কোন মেয়েটা?
—সেই যে রে, বড়পিসির বাড়ির…যাকে তোরা উদ্ধার করেছিল?
—ও, শিউলি? সে তো এখন দেয়াদের বাড়ি।
—কেন? এখনও কোনও হোম টোম পাওয়া যায়নি?
—মেয়েটা গেল না রে। দেয়াকে ও কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না।
—দেয়া ওই মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেবে?
—না তো কী করবে!…দেয়াও মেয়েটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে।
—মাঝখান থেকে তোমার ভায়ের পরিশ্রমটা বৃথা গেল! শ্রাবণী ফস করে বলে উঠল, —সেই রাত থাকতে উঠে কোথায় না কোথায় ছুটল, একটা জায়গা খুঁজে বার করল, থাকার অ্যারেঞ্জমেন্টও করল, কিন্তু ওই মেয়ে নড়ল না! ওর বান্ধবী আর তিনি পুরো সেঁটে গেছেন!…এখন তোমার ভায়ের কাজ আরও বেড়েছে। উনি মেয়েটাকে শিক্ষাদানের ব্রত নিয়েছেন! রোজ ছুটছে, বোজ ছুটছে ও বাড়ি!
—ফালতু কথা কেন বলছ? শ্রাবণীর শ্লেষ বিধল ঋতমকে। সে আহত মুখে বলল, —আমি রোজ যাই? কাল পরশু গেছি? সারাদিন বাড়িতে ছিলাম না?
—ও, দুদিন যাওনি বলে আফসোস হচ্ছে? যাও না, রোজই যাও, দু বেলা যাও। কে তোমাকে বারণ করেছে?
এ কী শুরু করল শ্রাবণী? ঋতম রীতিমতো অস্বচ্ছন্দ বোধ করল। মেয়েটার ওপর বিরাগ থাকার কোনও কারণ নেই শ্রাবণীর, সুতরাং ঝাঁঝটা যে দেয়ার কারণে তা টের পেতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু ঋতম তো দেয়ার কারণে যায় না। সে শিউলির জন্য যা করছে, সেটুকু করা তো তার কর্তব্য। নইলে যে ঋতম মানুষ হিসেবে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবে! শ্রাবণীর ঘটে কি এটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই? নাকি মিথ্যে ঈর্ষায় শ্রাবণী অন্ধ হয়ে যাচ্ছে?
ঋতম ভার গলায় বলল, —তুমি কী বলছ তুমি নিজেই জানো না শ্রাবণী।
শ্রাবণী ততোধিক ভার গলায় বলল, —খুব জানি। কোনও কিছুতেই বাড়াবাড়িটা ভাল নয়।
রুণু সরু চোখে ঋতমকে দেখছে। শ্রাবণীকেও। গলায় দিদি দিদি ভাব এনে বলল, —শ্রাবণী তো খুব একটা ভুল কথা বলেনি বাবুয়া। একটা মেয়ে বিপদে পড়েছিল, তুমি তাকে উদ্ধার করায় হেল্প করেছ, ঠিক আছে। কিন্তু মেয়েটা তো এখন একটা বাড়িতে সেটল করেছে, এখন তো আর তোমার তাকে নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। তারা লেখাপড়া শেখালে শেখাবে, ঝিগিরি করালে করাবে, সে তাদের ব্যাপার। তোমার আর তাকে নিয়ে উতলা হওয়া সাজে না। মেয়েটার অতীতটাও তো পুরোপুরি ভুললে চলবে না।
—কিন্তু মেয়েটাকে তার অতীত ভুলিয়ে দেওয়াটাই তো আমাদের মরাল ডিউটি।
—সেটা যারা ওকে রাখছে, তাদের ভাবনা।…শোন বাবুয়া, পৃথিবীর তো কিছুই দেখিসনি। নিষিদ্ধ জীবন যতই অপছন্দের হোক, তার একটা মোহও আছে। মেয়েটা কুসঙ্গে পড়েছিল…এটা তো মানবি? সুসংসর্গ থেকে কুসংসর্গ ত্যাগ করা অনেক বেশি কঠিন। মেয়েটার হয়তো ভাল হওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু ভাল হতে পারবে কিনা সেটা বলা অত সহজ নয়। ওর ভেতরের স্বভাবটাই ওকে খারাপ দিকে টানবে…মানে টানতে পারে।
—সেই জন্যই তো আমারও ভয়। অতসীও আর শ্রোতা হয়ে থাকতে পারল না, —মেয়েটা কোন দিন কী নষ্টামো করে বাবুয়াকে ফাঁসিয়ে দেবে…!
—মা প্লিজ,তোমরা এসব কথা বোলো না। আমার শুনতে খুব খারাপ লাগে। শিউলি একদমই বাচ্চা মেয়ে। সে একটা পরিবেশের শিকার।
—তাই তো বলছি বাবুয়া, ওর ব্যাপারে তোর অ্যালার্ট থাকা উচিত। ও যে পরিবেশের মেয়ে, সেখান থেকে নিজেকে আমূল বদলে ফেলা…। রুণু ঘাড় নাড়ছে দুদিকে, —মেয়েটাকে যে তুই বাচ্চা বললি, ওটাও তো মনকে চোখ ঠারা। যে প্রসেসের মধ্যে দিয়ে ও গেছে, তারপর ও আর বাচ্চা নেই। থাকতে পারে না।…আমার তো মনে হয় তোমার একটা নিরাপদ দূরত্বে থাকাই ভাল। নমাসে ছমাসে গেলে, দেখে এলে, ব্যস্ ওইটুকুই।
কী অসার যুক্তি সব! নিজস্ব নিরাপদ গণ্ডিতে বসে দূরের মানুষকে পড়ে ফেলার কী হাস্যকর প্রচেষ্টা! ছেঁদো মধ্যবিত্ত মানসিকতা!
ভীষণ বিরক্ত হলেও ঋতম আর হাঁ হাঁ করে তর্ক জুড়ল না। এদের বুঝিয়েও লাভ নেই। শ্রাবণীর তিরের অভিমুখ যে এরা ধরতে পারেনি, এটাই যথেষ্ট।
ভোজনে মন দিল ঋতম। মাংসের হাড় ঠুকে ঠুকে শাঁস বার করছে। মাংস রান্নাটা বেশ কষকষে হয়েছে, ভাত নিল একটু। বাকিরাও খাচ্ছে নীরবে। রুণু আর অতসীর মুখের ভাব এমন, যেন বাবুয়াকে একটা খাদের মুখ থেকে সরে আসার পরামর্শ দিতে পেরে তারা বেশ তৃপ্ত।
শ্রাবণীও খাচ্ছিল। ঈষৎ থমথমে মুখে। আবার পুট করে বলে উঠল, —আমার আরও কী খারাপ লাগে জানো দিদি, ওকে সবাই প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে, কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদাটা দেয় না। দেখেছ কি, ওর বান্ধবীকে নিয়ে আলাদা করে কাগজে কেমন লেখা হয়েছিল?
—তাই নাকি? কোথায় বেরিয়েছে?
—নবপ্রভাতে। দশ বারো লাইন ধরে শুধু দেয়া সিংহরায়ের প্রশস্তি!
—দেয়া নবপ্রভাতেই কাজ করে না?
—তা ছাড়া আর কোথায়। নিজের কাগজেই তো নিজেকে নিয়ে লিখিয়েছে। অথচ গোটা ব্যাপারটাতেই তোমার ভাই ওই দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। খবরটা সাপ্লাই করা থেকে শুরু করে…যেদিন মেয়েটার মা মরল, সেদিনও তো তোমার ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছিল…তারপর শ্মশান, মর্গ, থানা কোথায় না ছোটাছুটি করে…কিন্তু নাম কেনার বেলায় শুধুই দেয়া সিংহরায়! কোথাও কিন্তু ঋতম সেনগুপ্তর উল্লেখটা পর্যন্ত নেই! হুঁহ্, এই না হলে বন্ধু!
ঋতম হাঁড়িমুখে বলল, —আমি নামের জন্য কোনও কাজ করি না।
—বটেই তো। তোমার তো নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান…! শুনছ দিদি, ঢঙের কথাবার্তা?
এতক্ষণে রুণুর মুখে চোরা হাসি। যেন এবারে বুঝে ফেলেছে শ্রাবণীর ক্ষোভের গৃঢ় রহস্য। হাসিটাকে চওড়া করে বলল, —কী করবি বল। তোর বরের নেচারটাই এমন, তোর পতিগর্বে গরবিনী হওয়ার কোনও সুযোগই নেই। বাবুয়া চিরকালই বন্ধুদের জন্য নিঃস্বার্থে করে মরে, ওর কাছে ওসব নাম টাম নেহাতই তুচ্ছ।
—নামের জন্য আমার আলাদা স্ফিয়ার আছে রে দিদি। সঙ্গে সঙ্গে ঋতমের তির্যক মন্তব্য, —আমার নামও ছাপার অক্ষরে বেরোয়, তবে সেটা আর সেভাবে কারুর নজরে আসে না। …শ্রাবণীকে বলে দে, ওই নামের কদরটাই আলাদা। সমাজসেবী হিসেবে আমার বিখ্যাত না হলেও চলবে।
—তুমিও ভাইকে বলে দাও দিদি, আমারও নজর খুব কড়া। সবই খেয়াল করি।
—আমার লেখাও?
শ্রাবণীর এবার আর কোনও উত্তর নেই।
রুণু খিলখিল হেসে উঠল, —কী আরম্ভ করলি রে তোরা দুটিতে? ঢের হয়েছে, থাম এবার। বলেই অতসীর দিকে ঘুরেছে, —কী অতসীদেবী, এবার পুজোয় রাজস্থান যাবে?
অতসী চট করে কথাটা বুঝতে পারল না, —রাজস্থান? হঠাৎ!
—যে কারণে লোকে রাজস্থান যায়। বেড়াতে। আমার প্ল্যান প্রোগ্রাম সব ছকা হয়ে গেছে, এখান থেকে ট্রেনে জয়পুর, দুদিন জয়পুরে হল্ট করব, তারপর একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। আজমের, জয়সালমের, যোধপুর, মাউন্ট আবু, উদয়পুর, চিতোর, রন্থম্বোর, তারপর আবার জয়পুর ব্যাক। মোটামুটি তিন সপ্তাহের ট্যুর।
অতসী হাসি হাসি মুখে বলল, —রাজস্থান আমি কখনও যাইনি রে। তোর বাবার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল, কী জন্যে যেন হয়ে ওঠেনি।
—সে বছর আমার মাধ্যমিক ছিল মা।
—হ্যাঁ, আমার মনে আছে। সেই যে ব্যাগড়া পড়ল, তারপর আর তোমার…
—কিন্তু অত দিনের জার্নি… খুব ধকল হবে না তো রে রুণু? আমি পারব?
—তোমার কী এমন বয়স হয়েছে বলো তো? সবে তো ষাট। এই বয়সে লিজ টেলার আবার বিয়ে করেছিল। নিজেকে যত বুড়ো বুড়ো ভাববে…
—কিছু সমস্যা হবে না মা। যাও। ঋতম বলল, —দিদি তো গাড়ি নেবে। রাজস্থানের রাস্তাঘাটও নাকি চমৎকার।
—তোরাও যাচ্ছিস কিন্তু। আমি সবারই টিকিট কাটতে দিচ্ছি।
—গেলেই হয়। লোভে ফেলে দিলি। দা ল্যান্ড অফ ফোর্টস। প্রেম, বীরত্ব, মরুভূমি, আরকিটেক্চার…। ঋতমের চোখ স্বপ্নমেদুর, —একটা ভাল ক্যামেরা নিতে হবে।
—তোর অম্বরদারটাই তো নেব। ভাল এস এল আর ক্যামেরা, তেমন পুরনোও নয়…
—তুই অম্বরদাকে জপালি কী করে? অম্বরদা তো আজকাল কোথাও যেতে চায় না?
—ও তো যাচ্ছে না। ওর সময় কোথায়! নভেম্বরে পার্টির কন্ফারেন্স। বোলপুরে। অক্টোবরে ওর নাওয়া খাওয়ার সময় থাকবে?
—হুম্। সে তো রাজসূয় যজ্ঞ,
—যাবে না বলেই তো আমি তোকে সিলেক্ট করেছি।
—কেন? আমি কীভাবে অম্বরদার সাবসটিটিউট হচ্ছি?
—অত দূরে যাব, সঙ্গে একটা পুরুষমানুষ লাগবে না? তিনটে মেয়েছেলে ট্যাং ট্যাং করে বেরিয়ে পড়ব?
—অ। তার মানে আমি বডিগার্ড? ঋতম চোখ টিপল, —কিন্তু তোর হাতের কাছে তো আর একটা পুরুষ ছিলই।
—কে?
—গুড়ুম। তোদের পাহারা দেওয়ার পক্ষে ওই তো যথেষ্ট। …তোরা কী রে দিদি? চাকরি বাকরি করছিস, শরীরস্বাস্থ্য মজবুত, ভাল ডমিনেটিং পাওয়ারও আছে, তবু তোদের একটা পাহারাদার দরকার?
—বকিস না। কোথায় কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়ব…
—আমি কি ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাব? নো চান্স। সর্বস্ব কেড়ে নিলেও আমি টুঁ শব্দটি করব না, লেংটি পরে দৌড়ব। বরং শ্রাবণী যদি একটু স্মাইল টাইল দেয়, ডাকাতরা গললেও গলতে পারে।
—বুঝেছি। তুমি একটি ঢ্যাঁড়োশ। দইটা সাপটে সুপটে শেষ করল রুণু। শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করল, —তোর কলেজ তো পঞ্চমীর দিন থেকে ছুটি পড়ছে? নাকি মহালয়া?
শ্রাবণীকে ঈষৎ ম্রিয়মাণ দেখাল। নিস্তেজ স্বরে বলল, —আমি যেতে পারব না দিদি।
একসঙ্গে তিনটে মুন্ডু ঘুরেছে শ্রাবণীর দিকে। রুণুর গলা থেকে শব্দ ছিটকে এল, —সে কী? কেন?
—আমার এবার হবে না গো। মাকে কথা দিয়েছি এবার পুজোর ছুটিটা পুরো ওখানেই থাকব। বিয়ের পর থেকে সেভাবে গিয়ে তো থাকা হয়ে ওঠেনি। বাবাও খুব করে বলছিল…
রুণু অস্ফুটে বলল, —এই জন্য তুই যাবি না? ডিসেম্বরে গিয়ে থাকিস। এখনও গিয়ে থাকতে পারিস। ওখান থেকে কলেজ করবি।
—হয় না গো দিদি। সেই চন্দননগর থেকে আসা যাওয়া…। এই সময়ে কলেজের চাপও বেশি।
—তাহলে যাওয়াটা বাতিল করে দিই?
—ওমা, না না। সে কী…ছি ছি। তুমি মাকে নিয়ে যাও। তোমার ভাইও তো যাচ্ছে। আমি কটা দিন একটু বাপের বাড়ির আদর খাই।
—আমি যদি মাসিমা মেসোমশায়ের সঙ্গে কথা বলি?
—প্লিজ বোলো না। মুখে তোমায় না বলতে পারবে না। কিন্তু মনে মনে খুব হার্ট হবে। ভাববে আমি তোমাকে দিয়ে বলিয়েছি। শ্রাবণী ঋতমের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল, —বাবা মা ভীষণ আশা করে বসে আছে গো দিদি।
শ্রাবণীর দিকে তাকাতে তাকাতে টেবিল ছাড়ল রুণু। বেসিনে হাত ধুল, একটি কথাও আর না বলে চলে গেছে অতসীর ঘরে। সটান শুয়ে পড়ল মার বিছানায়, ছেলের পাশে।
বাড়ি জুড়ে থমথমে নৈঃশব্দ্য। অতসীও ফোলা ফোলা মুখে মেয়ের কাছে গেছে। শ্রাবণী টেবিল পরিষ্কার করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ঋতম বাইরের ঘরে গিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। সিগারেট টেনে যাচ্ছে। শ্রাবণী হঠাৎ এরকম আচরণ করল কেন? অভিমান? বিরক্তি? নাকি তাদের সম্পর্কে যে একটা চিড় দেখা দিয়েছে সেটা সবার সামনে প্রকট হয়ে যাবে, এই আশঙ্কা? উঁহু, তাহলে দিদির সামনে শ্রাবণী ওভাবে ঝগড়া করত না। চন্দননগর গিয়ে পুরো ছুটি কাটাবে? ওখানে বাবা মার সঙ্গে শ্রাবণীর দুই বউদির সম্পর্ক রীতিমতো তিক্ত, অশান্তি লাগে বলে শ্রাবণী ও বাড়িতে এক রাতও থাকতে চায় না। বলে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। না না, ছুতো ছুতো। আরও গোপন কিছু আছে, আরও গোপন কিছু।
গোটা দুপুরটা শ্বাস বন্ধ করে রইল ঋতম। বিকেলে রুণু চলে যাওয়ার পর শ্রাবণীকে ধরেছে। নীরস গলায় জিজ্ঞেস করল, —তুমি দিদিকে ওভাবে হার্ট করলে কেন?
শ্রাবণী বিছানায় বসে খাতা দেখছিল। শান্ত গলায় বলল, —আমার কি বাবা মার কাছে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না?
—মিথ্যে কথা। ওটা একটা অজুহাত।
—বুঝেই যখন গেছ, আর প্রশ্ন করছ কেন?
—কিন্তু দিদিকে আঘাত করার মানেটা কী?
—আমি কাউকে আঘাত করিনি। আমার সে ক্ষমতা কোথায়? তবু দিদি যদি আহত হয়ে থাকে, দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।
—কিন্তু কেন তুমি বললে? কেন তুমি যাবে না?
শ্রাবণী লাল কলম বন্ধ করল। ঘুরে বসেছে। ঋতমের চোখে চোখ রেখে বলল, —একটু কমনসেন্স খাটালেই বুঝতে পারবে কেন যাব না। তিন সপ্তাহের ট্যুর, এক একজনের কত লাগবে হিসেব আছে? দিদির পয়সা আছে, ব্যাংকে চাকরি করে, এল টি সি আছে…দিদি বেড়াতে গেলে ভাল হোটেলে আরাম করে থাকতে চায়…অর্থাৎ মাথা পিছু দশ হাজার টাকার ধাক্কা। আমার অত পয়সা নেই।
—আশ্চর্য, এই একটা সিলি কারণে তুমি…!
—তোমার কাছে কারণটা সামান্য হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে অনেকখানি। এই মুহূর্তে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা ওড়ানোর বিলাসিতা আমার সাজে না। তা ছাড়া অত টাকা আমার নেইও। বেড়ানোর জন্য কি ধার করব?
—দিদি তো টাকার কথা তোলেনি।
—সেটাই তো আমার খারাপ লেগেছে। কেন বলল না?
—দিদি বেড়াতে নিয়ে যাবে, দিদি আমাদের অবস্থার কথা জানে, টাকার কথা দিদি ভাববে।
—দিদির টাকায় আমি বেড়াতে যাব কেন? আমি শব্দটায় অস্বাভাবিক জোর দিল শ্রাবণী, যেন আমিত্ব ছাড়িয়েও আরও কিছু বোঝাতে চাইল। স্বরে সামান্য ভেজা ভাব, —আমার কোনও আত্মসম্মান নেই?
—অ৷ ঋতম ভুরু ওঠাল, —কথাটা দিদিকে খোলাখুলি বলে দিতে পারতে।
—বলা যায় না। অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
—কেন? এ কী এমন ভয়ংকর কথা?
—তুমি বুঝবে না।
—বোঝাও। বোঝালেই বুঝব।
হঠাৎই শ্রাবণীর মুখ চোখ যেন কেমন হয়ে গেল। গলার নীলচে শিরা ওঠানামা করছে, দাঁতে কামড়ে আছে ঠোঁট, নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।
ঋতম হাত উলটে বলল, —যাচ্চলে, হলটা কী?
উদগত অশ্রু দমন করতে করতে মাথা ঝাঁকাল শ্রাবণী, —তুমি কিছু বুঝবে না। মেয়েদের যে কোথায় লাগে…!
ঋতম বিমূঢ়। বিড়বিড় করে বলল, —অ্যাই…শ্রাবণী…আমাদের যে কথা হয়েছিল…?
—তাই তো তোমাকে জোর করতে আমার খারাপ লাগে। চোরা কান্নার দমকে একটু বুঝি কেঁপে উঠল শ্রাবণী। আঙুলে চোখ মুছছে, —চন্দননগরে গিয়ে থাকতে পারি না…বাবা দাদাদের মুখে সব সময়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে..কলেজ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, কত জায়গায় যে কত রকম মিথ্যে বলি…!
—কেন মিথ্যে বলো? সত্যি বলতে কী হয়, শ্রাবণী?
বৃষ্টির পাশাপাশি শ্রাবণীর চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, —তুমি কী ঋতম? তুমি গল্প লেখো? তুমি মেয়েদের মন বোঝো না?
শ্রাবণীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঋতম। এত বড় ভুল হয়ে গেল বুঝতে? বার বার তার চাকরি ছাড়া নিয়ে শ্রাবণীর রাগকে এতদিন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে ঋতম, ভেবেছে ওটা সাময়িক, ওটা শ্রাবণীর মনের কথা নয়, অথচ শ্রাবণী যে ভেতরে ভেতরে…! ঈর্ষাকাতর শ্রাবণীকে তাও চেনা যায়। ঈর্ষা তো ভালবাসারই নামান্তর। কিন্তু এই মেঘলা শ্রাবণী যে তার একেবারেই অচেনা!
হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে, একটা বিশ্রী কষ্ট দানা বাঁধছিল ঋতমের। চক্রাকারে ঘুরছে কষ্টটা। নাহ্, মেয়েরা পারে না! মেয়েরা এখনও পারে না!
সৌম্য যদি ঋতম হত, দেয়াও কি একই হীনম্মন্যতায় ভুগত? হয়তো।
নিঃশব্দে নিজস্ব কুঠুরিতে চলে এল ঋতম। কাগজ কলম নিয়ে বসেছে। এবার বোধহয় লেখাটা ঠিক ঠিক এসে যাবে।
এগারো
অফিস বেরোনোর আগে ব্রেকফাস্ট সারছিল সৌম্য। আজ রুটিনটা একটু বদলেছে দেয়া, ডিমে পাঁউরুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে ভেজে দিয়েছে। ফ্রেঞ্চ-টোস্ট। এটা সৌম্যর মোটামুটি পছন্দসই। সঙ্গে সসের বোতল উপুড় করে দিতে হয় প্লেটে, ফ্রেঞ্চ-টোস্টের সঙ্গে সৌম্যর অনেকটা সস চাই। অবশ্য আজ কর্নফ্লেক্স না খেলেও সৌম্যর জন্য দুধ বরাদ্দ আছেই। বড় এক গ্লাস। সৌম্য চা ছোঁয় না। কচিৎ কখনও ছুটির সকালে মর্জি হলে কফি খায় এক আধ কাপ, তাও প্রচুর দুধ মিশিয়ে। দুধের জন্য কফি, না কফির জন্য দুধ, ওই উষ্ণ মিশ্রণ খেয়ে বোঝা মুশকিল।
ডিপ ফ্রিজ থেকে হিমায়িত মুরগি বার করে সেদ্ধ করছে লক্ষ্মী। এইমাত্র সবিতা বাসন মেজে দিয়ে গেছে, শুকনো কাপড়ে মুছে মুছে বাসনগুলোকে র্যাকে সাজাচ্ছে শিউলি। দেয়া নিজের ডিশ নিয়ে টেবিলে বসে গেল, —তোমার আর লাগবেনা তো? আমি কিন্তু যা ছিল সব ডিস্ট্রিবিউট করে দিলাম।
—লাগবে না।
—টিফিনে চিকেন স্যান্ডুইচ দিয়ে দিচ্ছি।…একটা কলাও দেব?
—দাও।
—স্যালাড?
—না। আগের দিন পেঁয়াজটা গেঁজে গেছিল। দিলে শুধু শশা…
দেয়া গলা ওঠাল, —লক্ষ্মীদি, শুধু শশা কেটো আজ, পেঁয়াজ টোম্যাটো লাগবে না। আর শোনো, পাঁউরুটিতে মেয়নিজ মাখিয়ে রাখো, আমি গিয়ে স্যান্ডুইচ করছি। বলতে বলতে কামড় দিয়েছে ফ্রেঞ্চটোস্টে। হাত দেখিয়ে বলল, —প্লিজ, একটু আচারটা এগিয়ে দাও না।
টোম্যাটো সস দেয়ার তেমন পছন্দ নয়। সে ভালবাসে লংকার আচার। খেতে খেতে সৌম্য বাড়িয়ে দিল আচারের শিশিটা। জিজ্ঞেস করল, —আজ সারাদিন তোমার কী প্রোগ্রাম?
—বাড়িতেই আছি। রেস্ট। খাব ঘুমোব গড়াব…দুপুরে একটু লেখাটা নিয়েও বসতে পারি।
—সেই তোমার কন্যাভ্রূণ হত্যা?
—হুঁ। অনসূয়াদি তাড়া লাগাচ্ছে। মোটামুটি স্টেটওয়াইজ ডাটা কালেকশান করে ফেলেছি। এই কম্পিউটার এজেও পিকচারটা যা হরিবল না!
—দেখো, এই সব লিখে লিখে তোমার গায়ে না আবার ফেমিনিস্ট স্ট্যাম্প পড়ে যায়। সৌম্যর ঠোঁটে চিলতে হাসি।
দেয়া চোখ পাকাল, —আশ্চর্য, হিউম্যান রেসের অর্ধেকই তো মেয়ে। অন্তত প্রকৃতিতে ব্যালান্স রাখতে গেলে তাই তো থাকা উচিত। মেয়েগুলোকে জন্মানোর আগেই মেরে ফেলছে, জন্মে গেলে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, সভ্য সমাজে এর প্রতিবাদ হবে না? আর প্রতিবাদটা যদি কোনও মেয়ে করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে ফেমিনিস্ট?
—কেন মেরে ফেলে সেটা ভেবেছ? মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মানে বাপ মার ভিখিরি হয়ে যাওয়া। সেই আতঙ্কেই…
—এমনটাই বা চলবে কেন? সিস্টেমটাই বদলানো দরকার। পণপ্রথার এগেনস্টেও আমি লিখব।
—লিখলেই সিস্টেম বদলে যাবে? সৌম্য তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, —দূর দূর, ওসব লিখে ফিখে কিস্যু হয় না।
—তা কীসে হয়? লিখতে লিখতেই না জনমত তৈরি হবে। রামমোহন বিদ্যাসাগর লেখালেখি করেছিলেন বলেই তো সতীদাহ বন্ধ হয়েছিল, বিধবাবিবাহ চালু হয়েছে…
—শুধু জনমতে হয়নি, তার জন্য আইন লেগেছিল।
—জনমতের চাপেই তো আইন।
—সে আইন তো এখনও আছে। পণপ্রথা, ডাউরি সিস্টেম, সবই তো ইললিগাল। তাহলে আবার নতুন করে জনমত তৈরি করতে হবে কেন?
—কারণ সমাজের একটা সেকশান আইনগুলো মানছে না।
—তোমার লেখা পড়েই তারা বদলে যাবে, এটাই বা ভাবছ কেন?
—কিন্তু নানান ফর্মে পাবলিক ওপিনিয়ান তৈরি হলে তারা কিছুটা হলেও তো মেন্টাল চাপে পড়বে।
—কাম অন ইয়ার, ফেস দা ট্রুথ। এটা রামমোহন বিদ্যাসাগরের যুগ নয়। এখন লাইফ ইজ ফাস্ট। একটা আর্টিকেল পড়ে হাল্লা মাচানোর সময় আর কারুর নেই। সৌম্য দুধে চুমুক দিল, জিভে পরখ করে নিল মিষ্টি মাপ মতো আছে কিনা। দুধ গিলে নিয়ে বলল, —এখনকার লোক লেখাটা দেখবে, পড়বে, একটু আহা উহু করবে, বড় জোর বলবে মেয়েটা তো খাসা লিখেছে, এমনটা তো হওয়া উচিত নয়…ব্যস্, তারপরেই সব ভুলে যাবে। সুতরাং তোমার লেখার যত মহৎ উদ্দেশ্যই থাক, আলটিমেটলি লেখাটা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো।
দেয়া চুপ মেরে গেল। সৌম্যর কথাগুলো পুরোপুরি ফেলতে পারছে না, আবার মন থেকে মানতেও পারছিল না। কিছুতেই যদি কিছু না হয়, তা হলে এই সব জঘন্য কাণ্ডগুলো বন্ধ করার উপায় কী? কলম কি কোথাও একটুও ঢেউ তোলে না? পাহাড় ধসাতে একটা কুড়লের ঘা যথেষ্ট নয়, তা বলে কি আঘাতটা মিথ্যে হয়ে যায়? প্রকৃতিতে কোথাও না কোথাও তার অস্তিত্ব তো থেকেই যায়।
সৌম্যর দুধ শেষ। ঠোঁট মুছছে। হাসিটাকে বিস্তৃত করে বলল, —শোনো সাংবাদিক, ওসব নোংরামি রোখাটা গভর্নমেন্টের ডিউটি। তুমি লিখছ, লেখো। মন দিয়ে লেখো। তোমাদের সাপ্লিমেন্টের পাতাও ভরবে, টপিকটাও ইন্টারেস্টিং হবে…রেজাল্ট আশা কোরো না। …অফিস যাওয়ার আগে অনেক বকালে, জল খাওয়াও তো একটু।
টেবিলের জগ ফাঁকা। ফ্রেঞ্চ-টোস্টের শেষটুকু মুখে পুরে রান্নাঘরে উঠে গেল দেয়া। ঢিমে তেতালায় পাঁউরুটি তেকোনা করে কাটছে লক্ষ্মী, তার হাত থেকে নিয়ে নিল ছুরি। আলগাভাবে শিউলিকে বলল, —দাদাকে এক গ্লাস জল দিয়ে আয়। ঠাণ্ডা দিস না, ঠাণ্ডা গরম মিশিয়ে দিবি। বলেই লক্ষ্মীকে তাড়া লাগিয়েছে, —এই—লক্ষ্মীদি, চটপট চটপট। তাড়াতাড়ি মুরগির পিসগুলো ছিড়ে দাও। সওয়া আটটা বাজে, এক্ষুনি তোমার দাদার চেল্লানি শুরু হবে।
যন্ত্রের মতো হাত চলছে দেয়ার। শশা চাকা চাকা করল, স্যান্ডুইচ বানাল, টিফিনকৌটো সাজাল। সন্তর্পণে কলা ভরে দিল বাক্সে, যেন চাপ না খায়।
প্লাস্টিকের প্যাকেটে টিফিনকৌটো মুড়ে তুরতুরে পায়ে শোওয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল দেয়া, পথে থমকেছে। টেবিলে জলভর্তি গ্লাস পড়ে!
তুলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে দেয়া ঘরে এল, —কী হল, জল না খেয়ে উঠে এলে?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে সৌম্য। যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে বলল, —আমার তোয়ালে রুমালটা কোথায়?
—দিচ্ছি। ড্রেসিংটেবিলে গ্লাস রাখল দেয়া, —জলটা খেয়ে নাও।
সৌম্য টেরিয়ে একবার গ্লাসটাকে দেখল শুধু।
নিলামঘর থেকে কেনা সুদৃশ্য কাঠের ওয়ার্ড্রোব খুলে রুমালখানা এনে দেয়া গুঁজে দিল সৌম্যর পকেটে। অবাক গলায় বলল, —কী হল, খেলে না?
সৌম্য চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, —ও ঘর থেকে আমার ব্রিফকেসটা এনে দাও, না, প্লিজ।
দু পা গিয়েও দাঁড়িয়ে গেছে দেয়া। কপালে বিস্ময়ের রেখা। পায়ে পায়ে ফিরল। আয়নায় দেখছে সৌম্যকে। চোখাচোখি হতেই সৌম্য চোখ সরিয়ে নিল। রুমালখানা বের করে শুঁকছে।
দেয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, —জলটা খাচ্ছ না কেন? শিউলি দিল বলে?
—জলটা আমি তোমায় দিতে বলেছিলাম। সৌম্য গম্ভীর,—অন্যকে যদি হুকুম করতে হয়, তা হলে বলে দিও পারবে না।
—লক্ষ্মীদি দিলে নিশ্চয়ই আপত্তি হত না?
জবাব না দিয়ে সৌম্য পাশের ঘরে চলে যাচ্ছিল, দেয়া খপ করে সৌম্যর হাত চেপে ধরেছে, —দাঁড়াও। আমার কথার উত্তর দিয়ে যাও। শিউলিকে তোমার এত ঘেন্না কেন?
—প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে দেয়া।
—এ তো আমাকে অপমান করা। আমিই শিউলিকে জোর করে এখানে রেখেছি।
—সে তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। আমার লাইকিং ডিজলাইকিং খুব ক্লিয়ার। অ্যান্ড ইউ নো ইট।
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কয়েকটা ছবি ভেসে উঠল দেয়ার চোখে। টুকরো টুকরো ছবি। রাত্রে গরম রুটি সেঁকে দিয়েছে লক্ষ্মীদি, শিউলি ক্যাসারোলে রুটিগুলো নিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, পেট ভরে গেছে বলে উঠে গেল সৌম্য…! ওয়াশিংমেশিনে সৌম্যর শার্ট ট্রাউজারস দেবে বলে নিয়ে যাচ্ছে শিউলি, সৌম্য ধমকে উঠল, রেখে দে, আমার জামাকাপড় আমিই…! কম্পিউটারে কাজ করছে সৌম্য, বেশ খানিকটা তফাত থেকে মনিটারের ছবি গিলছে শিউলি, সৌম্য খেঁকিয়ে উঠল, এখানে কী…! সৌম্য টিভিতে ক্রিকেট দেখছে, শিউলির উপস্থিতি টের পেয়েই টিভি অফ…!
এ ধরনের ছেলেমানুষি কি সৌম্যর মতো প্রাপ্তবয়স্ককে শোভা পায়?
দেয়া ঝগড়া করল না। সৌম্যকে বোঝাতে চাইল। নরম করেই বলল, —তুমি এরকম করছ কেন বলো তো? মেয়েটাকে তো আমি আর ঋতম হোমে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলাম। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে, যেতে চাইছে না, কীভাবে কান্নাকাটি করছিল তুমি দেখেছ তো…। দু চার মাস যাক, মোটামুটি মনের জোর ফিরে পেলে তখন না হয় ওকে…
—তুমি ওকে কোনও দিনই কোথাও পাঠাবে না। ও আমি বুঝে গেছি।
—দেখো পাঠাই কিনা।
—আমার দেখাদেখির কিছু নেই। ও যদি এখানে না থাকে, তুমি লোকের কাছে কী করে প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করবে তুমি মহৎ? ও তোমার গ্রেটনেসের জ্যান্ত অ্যাডভার্টাইজমেন্ট।
কথাটা তীক্ষ্ণ শরের মতো ফুটে গেল বুকে। তবু দেয়া উত্তেজিত হল না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, —বেশ, নয় তাই হল। কিন্তু মেয়েটা বিপন্ন, এটা তো তুমি মানবে। ওকে থাকতে দিয়ে আমি খারাপ কাজ কিছু করিনি। করেছি কি?
—খারাপ ভালর কথা তো ওঠেনি। কথা হচ্ছে পছন্দ অপছন্দর। মহৎ কারণে যে কোনও কাজই করা হোক, তা আমায় পছন্দ করতেই হবে? আজ যদি থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টদের সাহায্য করার জন্য কেউ বক্সিং কম্পিটিশান অ্যারেঞ্জ করে, আমাকে কি গিয়ে বসে বসে ঘুষোঘুষি দেখতে হবে? দুজনের নাক দিয়ে রক্ত ঝরলে আমায় হাততালি দিতে হবে? আহা কী মহৎ কারণ, আহা কী মহৎ কারণ বলে?
দেয়া থতমত মুখে বলল, —তুলনাটা কি ঠিক হল? আমি কি অমন বীভৎস কিছু করেছি?
—তোমার হয়তো মনে হচ্ছে না। আমার ওরকমই লাগছে। তুমি কাজটাকে মহৎ ভাবতে পারো, কিন্তু আমাকে পছন্দ করানোর জন্য জোর করছ কেন? সহ্য করছি, এটাই কি যথেষ্ট নয়? কটা বর করবে, অ্যাঁ?
দেয়ার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল সৌম্য। পাশের ঘর থেকে ব্রিফকেস এনে টিফিন বক্স ভরছে, শব্দ করে। ওয়ার্ড্রোবটা একবার অকারণে খুলল, বন্ধ করল, তারপর ড্রয়িং হলের সোফায় বসে জুতো মোজা পরছে।
তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল দেয়া। শিউলি আর লক্ষ্মীদি রান্নাঘরে, একবার তাকিয়ে দেখে নিল তাদের। নাহ্, দেয়া সৌম্য কারোরই তেমন গলা চড়েনি, ওরা টের পায়নি কিছুই।
নিজের অসহজ ভাবটা কাটাতেই সৌম্যর সঙ্গে কথা বলল দেয়া। স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, —ফিরছ কখন?
—দেখি।
—পারলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো।
—কেন?
—এমনিই। কোথাও একটু বেরোতে পারি।
—চেষ্টা করব। কথা দিতে পারছি না।
সৌম্য বেরিয়ে যেতেই একটা টুকরো হাসি ভেসে উঠল দেয়ার মুখে। উফ্, কী রাগ! কাজটাকে ভাল বলে মানবে, কিন্তু কিছুতেই পছন্দ করবে না। নাহ্, দেয়াকেই আরও উদ্যোগী হতে হবে, গলাতে হবে সৌম্যকে। কিংবা হয়তো তারও দরকার নেই। কটা দিন গেলে সৌম্য হয়তো নিজে থেকেই আস্তে আস্তে মেনে নেবে শিউলিকে। বাড়িতে কুকুর বেড়াল থাকলেও তো মানুষের মায়া পড়ে যায়, এ তো একটা আস্ত মানুষ।
মাথাটা ধরছে অল্প অল্প। লক্ষ্মীদি এখনও চা দিল না কেন? লক্ষ্মীকে হুকুম ছুড়তে যাচ্ছিল দেয়া, কলিংবেলের টুং টাং।
সৌম্যই ফিরল নাকি কিছু নিতে ভুলে গেছে?
দেয়া দরজা খুলতেই সামনে দুজন মহিলা। অপরিচিত। একজনের বয়স বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ, অন্য জন আর একটু বড়।
অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মহিলা হাতজোড় করে নমস্কার করল, —আপনিই নিশ্চয়ই দেয়া সিংহরায়?
—হ্যাঁ। নমস্কার। বলুন?
—আমরা উইমেনস ওয়েলফেয়ার সোসাইটি থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে একটু বিশেষ দরকার ছিল।
দেয়া সপ্রতিভ মুখে বলল, —আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।
সোফায় বসে দ্বিতীয় মহিলা বলল, —আমি আপনাদের অফিসের অশেষ দাশগুপ্তর মামাতো বোন। আমার নাম মল্লিকা দাশগুপ্ত। আর ইনি আমাদের সেক্রেটারি। বাসন্তীদি। বাসন্তী পাল।
কী আশ্চর্য, অশেষদার বোন! দেয়া ব্যস্ত হল, —চা বলি? কী খাবেন? চা, না কফি?
—আহা, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? বসুন, কাজের কথা বলি।
—তা বললে কি হয়? এক সেকেন্ড।
রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে ভাল করে কফি বানাতে বলল দেয়া। সঙ্গে সুন্দর করে সাজিয়ে কাজুবাদাম চানাচুর নোন্তা-বিস্কুট। ফিরে এসে বলল, —অশেষদাই বুঝি ঠিকানা দিলেন?
—না, দাদা ঠিকানা দিতে পারেনি। কাল রাতে ফোন করেছিলাম, মোটামুটি একটা ডিরেকশান দিয়ে দিল। বলল সন্তোষপুর লেকের ঠিক পেছনটায়…
দেয়া আরও চমকিত। গোমড়াথেরিয়াম তার এত খবর রাখে?
বাসন্তী বলল, —খুব একটা অবশ্য খুঁজতে হয়নি। আপনাকে তো দেখলাম অনেকেই চেনে। মোড়ের মাথায় নবপ্রভাতের নাম বলতেই…। নীচে লম্বা মতন ফর্সা মতন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। মোটরবাইক বার করছিলেন। উনিই বললেন তিনতলায়…
দেয়া ফিক করে হাসল, —উনি আমার হাজব্যান্ড।
—ও আচ্ছা, তাই নাকি? মল্লিকারও মুখ জুড়ে হাসি, —তাই জিজ্ঞেস করছিলেন কোথ্থেকে আসছি…!
বাসন্তী বলল, —ইস্, আগে জানলে ওঁর সঙ্গেও দু মিনিট কথা বলা যেত।
—কী ব্যাপারে বলুন তো?
—না মানে আপনারা যে জেসচারটা দেখিয়েছেন… মানে দুজনেই যে মানসিক উদারতার পরিচয় দিয়েছেন…
দুজনের উদ্দেশেই নিবেদিত স্তুতি স্মিত মুখে মেখে নিল দেয়া। সলজ্জ ভাবে বলল, —না না, কী এমন করেছি? ওর থাকার জায়গা ছিল না তাই…
—এটাই বা কজন করে এখন? ওইরকম একটা মেয়েকে ঘরে এনে ভোলার মতো মনের জোরই বা কটা মানুষের আছে?
‘ওরকম একটা মেয়ে’ বাক্যবন্ধটি পছন্দ হল না দেয়ার। শিউলির সম্পর্কে আলটপকা মন্তব্য তার মোটেই আর ভাল লাগে না। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল শিউলিকে সে দেখছে অতি কাছ থেকে, শিউলিকে কি অন্যরকম বলে মনে হয়েছে কখনও? হয়তো তাদের সমান সমান নয়, তবে লক্ষ্মীদির মেয়ে টেয়ে বলে তো স্বচ্ছন্দে ভেবে নেওয়া যায়। দারিদ্রের কারণে মেয়েটা লোভী হয়েছিল, প্রেমের ফাঁদে পড়ে একটা বড় বিপদ ঘটে গেছে—কোনওটা হওয়াই তো অস্বাভাবিক নয়।
দেয়া বিনয়ের সঙ্গে বলল, —আপনাদের প্রয়োজনটা কিন্তু এখনও বলেননি।
—হ্যাঁ, বলি। বাসন্তী গুছিয়ে বসল, —আমরা সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রতি বছরই দু তিনটে সেমিনারের আয়োজন করি। এ বছরও করছি, স্বাধীনতা দিবসের দিন। এবারের বিষয়, বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান। আপনি একজন বক্তা হিসেবে থাকবেন।
—আমি? দেয়া প্রায় আঁতকে উঠেছে, —আমি বক্তৃতা টক্তৃতা দিতে পারি না। তার ওপর ওই সব গুরুগম্ভীর বিষয়…ও বাবা, ও আমি পারব না।
—আপনিই তো পারবেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কী অবস্থায় থাকে, তাদের কীভাবে এক্সপ্লয়েট করা হয়, তাদের কত ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, অসহায় মেয়েদের পুনর্বাসনের সমস্যা… আপনি নিজে একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, আপনার এক্সপিরিয়েন্সটাই আপনি আপনার মতো করে বলবেন। মেয়েটির মা যে ভাবে মারা গেল… আপনি সবাইকে শোনাবেন সে কথা।
মল্লিকা বলল, —আরও অনেক স্ফিয়ার থেকে প্রখ্যাত মহিলারা আসবেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজসেবী… আমরা আপনাকে সংবাদপত্রকার হিসেবে চাইছি।
—এবং তার সঙ্গে ওই মেয়েটির আশ্রয়দাত্রী হিসেবেও।
দেয়া ফাঁপরে পড়ে গেল। জন্মে সে কখনও এ ধরনের সভাসমিতিতে যায়নি। বক্তা হিসেবে তো নয়ই। কত জ্ঞানী গুণী মহিলা থাকবেন। তাঁদের সামনে দেয়ার মতো এক অর্বাচীন কী বলবে? চিন্তা করলেই হাঁটু কাঁপছে।
আবার ভেতরে ভেতরে একটু উদ্দীপনাও বোধ করছিল দেয়া। লম্বা চওড়া কথা বলার কী দরকার, সে যা দেখেছে, যা বুঝেছে, সেটাই বলবে গুছিয়ে গাছিয়ে। ওটুকু তো সে বলতেই পারে। নয় কি? ইস্, সৌম্য শুনলেই খুব খেপাবে। ফেমিনিস্ট আখ্যাটা কি লেগেই গেল?
বাসন্তী বলল, —তাহলে আমরা কার্ডে আপনার নামটা ছাপিয়ে ফেলছি?
—কিন্তু…
—কোনও কিন্তু নয়। আমরা আপনাদের মতো ইয়াং মেয়েদেরই চাই। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আপনাদের চিন্তাধারারও প্রতিফলন চাই আমরা।
কফি এসে গেছে। শিউলিই নিয়ে এসেছে। সেন্টারটেবিলে যত্ন করে রাখল কাজূ চানাচুরের ট্রে। কাপ প্লেট ধরিয়ে দিচ্ছে বাসন্তী মল্লিকার হাতে।
বাসন্তী চোখের ইশারায় বলল, এই কি সেই?
দেয়া মাথা নাড়ল।
বাসন্তী জিজ্ঞেস করল, নাম কী তোমার?
শিউলি এখন আর তত জড়ভরতটি নেই। ঝরঝরে গলায় বলল, —শিউলি। শিউলি চক্রবর্তী।
—ওমা, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে? …পড়াশুনা কদূর করেছ?
—ক্লাস এইট।
দেয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —আমি আবার ওর পড়াশুনো শুরু করিয়ে দিচ্ছি। এখনই বাড়িতে বসছে বই নিয়ে…
—বাহ্। বাহ্।
শিউলি মৃদু হাসল, —আমি যাই?
—হ্যাঁ, এসো৷ শিউলি সরতেই বাসন্তী গলা নামিয়ে বলল, —ওকে স্কুলে ভর্তি করতে পারবেন তো?
—দেখি। কথা বলব। নইলে প্রাইভেটেই পড়বে।
মল্লিকা বলল, —সত্যিই, আপনার গাট্স আছে। নাড়ুদা… আই মিন অশেষদাও আপনার খুব প্রশংসা করে। বলে খুব কাজের মেয়ে, কক্ষনও প্যানপ্যান করে না, সব সময়ে চনমন করছে…
দেয়া চমৎকৃত অশেষদার আর একটা নাম জানার জন্য নয়, তার সম্পর্কে অশেষদার প্রশস্তি শুনে। রাগুদাদার অন্য একটা চেহারাও আছে তাহলে?
মল্লিকা বাসন্তী চলে যাওয়ার পর প্রফুল্ল চিত্তে কিছুক্ষণ এঘর ওঘর করল দেয়া। হাতে ডাস্টার নিয়ে ঝাড়াঝুড়ি করছে যাবতীয় আসবাব। সদ্য তিনটে পাতাবাহারের টব কিনে এনেছে গড়িয়াহাট থেকে, গাছগুলোকে পর্যবেক্ষণ করল মন দিয়ে। দুটো বাথরুমের আয়নাতেই জলের দাগ ধরে গিয়েছিল, ভিজে নিউজপ্রিন্ট দিয়ে ঘষে চকচকে করল।
সঙ্গে লেজুড়ের মতো ঘুরছে শিউলি। একেবারে পায়ে পায়ে। দেয়ার প্রতিটি কাজেই তার বেজায় উৎসাহ, কী ভাবে সাহায্য করবে দিদিকে ভেবে পাচ্ছে না। এই পালকের ঝাড়ন আনতে ছুটছে, এই কাপড়, টবগুলোকে একবার এদিকে রাখছে তো একবার ওদিকে…।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুখ চলছে দুজনের।
—ওরা কে এসেছিল গো দিদি? তোমার বন্ধু?
—তুস্, বন্ধু কেন হবে? দেখলি না, একজন আমার থেকে বয়সে কত বড়! ওরা আমায় নেমন্তন্ন করতে এসেছিল।
—বিয়ে বাড়িতে…?
—দূর বোকা। এ অন্য রকম নেমন্তন্ন। আমায় গিয়ে এক জায়গায় লেকচার দিতে হবে।
—তুমি লেকচার দেবে কেন? তুমি তো দিদিমনি নও!
—দিদিমনি ছাড়া বুঝি কেউ আর লেকচার দেয় না? …সে যাব এক জায়গায়। তুই আমার সঙ্গে যাবি?
—হুঁউ। তুমি নিয়ে গেলেই যাব।
—ভয় করবে না?
—তুমি সঙ্গে থাকলে আমার ভয়ই নেই।
—ভয় ব্যাপারটাই মন থেকে ঝেড়ে ফ্যাল। বললাম না, আমি লালবাজারে গিয়েছিলাম! পুলিশের সব বড় বড় কর্তাকে বলে এসেছি। ওরা বলে দিয়েছে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ওই মেয়ের কেশাগ্রও কেউ ছুঁতে পারবে না। …মনে থাকবে?
—হুঁ। …তবু তুমি না থাকলে…
—অ্যাই হাঁদি, আমার ওপর তোর এত ভরসা এল কী করে? জানিস কোনও দিন রাগ হলে আমি তোকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে পারি?
—ইস্, তুমি তা পারবেই না।
—যদি হোমে রেখে দিয়ে আসি?
—আবার তুমি কেন আমায় ভয় দেখাচ্ছ?
—অ্যাই অ্যাই, ফের লেবুর জল? ফের লেবুর জল? চোখ মোছ।
—আমি হোমে যাব না।
—কেন? হোমে যেতে তোর এত ভয় কেন?
—সেখানে তুমি থাকবে না যে।
—তা বললে হয়? তোর বাবুয়াদা তোর জন্য কী সুন্দর একটা জায়গা বার করেছিল, এখানকার থেকে তুই অনেক ভাল থাকতিস।
—না দিদি, সেখানে কাউকে চিনি না, কার মনে কী আছে জানি না, যদি আবার কেউ জোর করে… আমার বড় বুক কাঁপে দিদি।
—নেকু। বললাম না, সব তোর মতো মেয়েরাই থাকে…। তোর বাবুয়াদা তোর ওপর খুব রাগ করেছে।
—হি হি, বাবুয়াদাটা একদম পাগল, জানো! সেদিন আমি একটা অঙ্ক পারছিলাম না। সুদের অঙ্ক। বাবুয়াদা দু হাতে চুল ছিঁড়ছিল আর বলছিল, তুই এই অঙ্কটা না পারলে আমি তিনতলা থেকে ঝাঁপ দেব।
—বাবুয়াদাকে খুব ভাল লাগে, আাঁ?
—হুঁ।
—আর দাদাকে?
সৌম্যর প্রসঙ্গ উঠতেই শিউলির মুখে কুলুপ।
দেয়া মজা পেল, —তুই দাদাকে খুব ভয় পাস, তাই না?
শিউলি ভয়ে ভয়ে মাথা দোলাল।
দেয়া হাসছে, —না রে। দাদা রাগী নয়। একটু অন্য রকম। খুব কাজের চাপে থাকে তো, সবসময়ে তাই মাথার ঠিক রাখতে পারে না। দাদার মেজাজমর্জি বুঝে দাদার সামনে যাবি। বুঝলি?
শিউলি ঢক করে ঘাড় নাড়ল।
—এবার আমি চান করতে যাব। তুই যা, লক্ষ্মীদির সঙ্গে হাত লাগা।
—লক্ষ্মীমাসি আমায় রাঁধতে দেয় না। বলে তোর রান্না দাদা খাবে না।
সৌম্যর বিসদৃশ আচরণ কি লক্ষ্মীদিরও নজরে পড়েছে? শিউলির সঙ্গে লক্ষ্মীদি খারাপ ব্যবহার করে না, তবু তার এখানে থেকে যাওয়াটা তেমন ভাল মনে নিতে পারেনি লক্ষ্মীদি। দেয়া টের পায়। ছোটখাটো কারণে লক্ষ্মীদি অভিযোগও জানায় যখন তখন। শিউলিকে আঘাত করার জন্যই কি কথাটা বলেছে লক্ষ্মীদি? নাতনির বয়সি মেয়েকে এসব কেউ বলে?
দেয়া কথা ঘুরিয়ে দিল, —তুই রাঁধতে পারিস নাকি?
—বাড়িতে কে রাঁধত? মার সময় ছিল? আমিই তো বেঁধে বেড়ে ইস্কুল যেতাম।
—কী কী পারিস?
—ডাল, লাউঘণ্ট, চচ্চড়ি…। বলতে বলতে শিউলির গলা ধরে এল, —আমার মা খুব ভাল রাঁধত।
—আবার কান্না? বলেছি না, পুরনো কথা আর একদম নয়!
—আমার মা-টা কোনওদিন শান্তি পেল না গো দিদি। বাবা মরার পর মা যখন লোকের বাড়ি কাজ নিল, রোজ ফিরে কাঁদত…
—তুই তো তখন খুব ছোট। তোর মনে আছে?
—মা তো পরেও কতবার বলেছে, দাসীবৃত্তি করে খেতে হবে এ আমি জম্মেও ভাবিনি রে শিউলি। তুই পড়াশুনো শিখে আমার দুঃখ ঘোচা। সেই মাকে আমি…
কথায় কথায় তৈরি হচ্ছে বন্ধন। মায়া। স্নেহ। শিউলির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে দেয়া, নিজের অজান্তেই।
শিউলির বিনুনি নেড়ে দিয়ে দেয়া বলল, —হয়েছে। থাম। যা, আমার তেলটা এনে দে। কিছুক্ষণ তেল মেখে থাকি, তারপর শ্যাম্পু করব।
শিউলি চোখ মুছল, —আমি তেল লাগিয়ে দেব মাথায়?
—ম্যাসাজ করতে পারবি? ঘষে ঘষে?
আবার একটা নতুন কাজ। শিউলি দিব্যি উৎফুল্ল। দেয়ার বাথরুম থেকে দৌড়ে নারকেল তেল এনেছে। দেয়ার চুলের গুছি ফাঁক করে করে ডলছে তেল।
আরামে দেয়ার চোখ বুঁজে এল, —বাহ্, তোর তো ফার্স্টক্লাস হাত! তোকে তো বিউটি পার্লারেই ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
—আমার মা আমায় এ ভাবে তেল লাগাত। বলত, তেল হল চুলের প্রাণ।
আবার অতীত প্রসঙ্গ। দেয়া ফের কথা পালটাল, —দ্যাখ তো, আমার চুল পেকেছে কিনা।
—তুৎ। তোমার মাথায় পাকা চুল কোথ্থেকে আসবে,
—আসতেই পারে। চিন্তায় চিন্তায়।
—কীসের চিন্তা?
—তোর। আবার কার!
—আমি তোমায় খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি, না দিদি?
—ফের ফোঁপানি? এই জ্ঞানপাপী, তুই কিন্তু আমার হাতে মার খাবি। নে চুল বাছ।
পলিত কেশের সন্ধানে একাগ্র দৃষ্টিতে দেয়ার মাথায় চিরুনিতল্লাশ চালাচ্ছে শিউলি। ঝানু ডিটেকটিভের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে সরু সরু আঙুল। শিরশির করছে দেয়ার মাথা, সত্যি সত্যি ঘুম এসে যাচ্ছে।
শিউলিকে নিয়ে প্রথম কদিন ভারী ভাবনা ছিল দেয়ার। ঠিক কী মর্যাদায় সে বাড়িতে রাখবে শিউলিকে? কাজের মেয়ে? না অসহায় আত্মীয়া? শিউলিকে দিয়ে কাজ করাতে বেশ বাধো বাধো ঠেকত, মনে হত সে বুঝি অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। শিউলি নিজেই খুঁজে দিল সমাধান। মাঝামাঝি একটা স্থান তৈরি করে নিয়েছে নিজের।
ভাবনার মাঝেই চুলে পটাং টান। টুটেনখামেনের গুপ্তধন আবিষ্কার করার ভঙ্গিতে উল্লসিত শিউলি, —পেয়েছি দিদি। এই যে একটা।
মাথা চুলকোতে চুলকোতে দেয়া চুলটা দেখল। পুরো পাকা নয়, সাদা কালো মেশানো।
দেয়ার মুখে কপট শোক, —এখন কী হবে? বাচ্চাকাচ্চা হল না, এর মধ্যেই বুড়িয়ে গেলাম? তোর দাদা যদি তাড়িয়ে দেয়!
শিউলির মুখ শুকিয়ে আমসি, —কাউকে বলতে হবে না দিদি। লক্ষ্মীমাসিকেও না। আমি চুপি চুপি ফেলে দিচ্ছি।
দৌড়ে জানলা দিয়ে চুল ফেলতে যাচ্ছে শিউলি। দেয়া শিউলিকে দেখছিল। জীবনের চরমতম নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতাও শিউলির সবটুকু সরলতা হরণ করতে পারেনি, দেয়ার মনে হচ্ছিল।
লক্ষ্মী আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসেছে। দেয়া শিউলির মাখামাখি দেখে মুখ যেন ঈষৎ ভার ভার। বলল, —তোমায় একটা কথা সকাল থেকে বলব ভাবছি।
দেয়া গ্রীবা হেলাল, —উঁ?
—কাল সুভাষ এসেছিল।
—তাই নাকি? এবার কী কিনতে চায়? দেয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসি, —ট্যাক্সি? বাস? মিনিবাস?
—টাকার জন্য আসেনি। আমায় একদিন সোনারপুরে নিয়ে যেতে চায়।
—রিকশা চড়াবে? যেও। সামনের বৃহস্পতিবার আমি বাড়ি আছি, ওই দিন চলে যেও।
—সোমবারই যেতে বলেছে। ওই দিনই সুভাষের সুবিধে।
এবার দেয়ার খটকা লেগেছে। গোঁসা দেখাচ্ছে নাকি লক্ষ্মীদি?
দেয়ার ভুরুতে ভাঁজ, —সোমবার কী করে হবে? শিউলি একা একা থাকবে নাকি?
—ও কি কচি খুকি? সবই তো পারে। একদিন সামলে দেবে।
—ও কথা হচ্ছে না। …তুমি তো জানো ওকে একা বাড়িতে রাখতে চাই না!
—তার জন্য আমি চিরতরে বন্দিনী হয়ে থাকব নাকি?
লক্ষ্মী মাঝে মাঝেই বিশুদ্ধ ব্যাকরণসম্মত শব্দ উচ্চারণ করে। অন্য সময়ে হেসে ফেলে দেয়া, এখন হাসি এল না। রাগ, ঈর্ষা, অভিমান যাই থাক মনে কথাটা কিন্তু লক্ষ্মীদি ভুল বলেনি। শিউলির জন্য লক্ষ্মীদিও আটকে থাকবে নাকি? কদ্দিন চলবে এভাবে? কদ্দিন চলতে পারে? ক্রমে ক্রমে শিউলিকে তো একা থাকার অভ্যেস করতেই হবে।
দেয়া ভাবলেশহীন মুখে বলল, —ঠিক আছে। যেও। কিন্তু মঙ্গলবার আমার তিনটেয় ডিউটি, তার আগে চলে আসার চেষ্টা কোরো।
এত সহজে অনুমতি মিলে যাবে বুঝি ভাবতে পারেনি লক্ষ্মী। দাঁড়িয়ে আছে ঠায়।
দেয়া প্রশ্ন করল, —আর কিছু বলবে?
—কাল সন্ধেয় তোমার মা তোমার খোঁজ করছিল। তাকে ফোন কোরো।
মার সঙ্গে এখন কথা বলা মানেই ভাঙা রেকর্ড শোনা। ওরে, তুই মেয়েটাকে রেখেছিস কেন! ওরে, তুই মেয়েটাকে ভাগাচ্ছিস না কেন! ওই মেয়ে সূচ হয়ে ঢুকেছে ফাল হয়ে বেরোবে, সাবধান সাবধান! ও বাড়িতে এখন ফোন করতেই ইচ্ছে করে না। দাদা পর্যন্ত সেদিন শুনিয়ে দিল, কেন অশান্তি বাড়াচ্ছিস মিমি! বাবা কিন্তু খুব টেনশান করছে! এ কী অদ্ভুত ব্যাপার, আপনজনরাও বুঝতে চায় না দেয়ার ভালমন্দ বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে! বিচ্ছিরি। বিচ্ছিরি।
মার সঙ্গে লক্ষ্মীদির মনের প্রাণের কথা হয়। শিউলিকে নিয়েই। দেয়া জানে। নিজের সাহস নেই বলে মাকে দিয়ে বকুনি খাওয়াতে চায় কি লক্ষ্মীদি?
দেয়া গম্ভীর মুখে বলল, —করব ফোন।
উঠে বাথরুমে ঢুকল দেয়া। অনেকটা সময় নিয়ে শ্যাম্পু ঘষল মাথায়। আজ চুল শুকোনোর তাড়া নেই, আজ তার মানবিলাসের দিন। ঝর্নাধারার নীচে দাঁড়িয়ে দেয়া ভেঁজে নিল, ঋতমকে বলে দিতে হবে সোমবার যেন ঋতম অবশ্যই আসে। এবং তাড়াতাড়ি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে কাজ নিয়ে বসল দেয়া। সবিতা বাসন মেজে দিয়ে গেছে, লক্ষ্মী শুয়ে পড়েছে ড্রয়িংরুমে, শিউলি ঘুমোচ্ছে ছোটঘরের মেঝেয়। আগে ই-মেল খুলে দেয়া দেখল কোনও চিঠিপত্র আছে কিনা। আছে। ইউনিভার্সিটির বন্ধু এণাক্ষীর। বিয়ে করে কানাডায় গিয়ে এণাক্ষী খুব ঘুরছে এন আর আই বরের সঙ্গে, ভ্রমণের লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছে। পালটা উত্তর পাঠিয়ে দিয়ে নিজের লেখাটা শুরু করল দেয়া। সাজাচ্ছে। ডুবে গেছে তথ্য আর পরিসংখ্যানে। পুরনো নিউজকাটিং থেকে খবর সংগ্রহ করেছে বেশ কয়েকটা, পড়ল মন দিয়ে।
একটানা বেশিক্ষণ বসে থাকলে শিরদাঁড়া কনকন করে। উঠে ফ্রিজ খুলে জল খেল দেয়া। এসে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। আকাশ আজ গাঢ় নীল, মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। দেখে মনেই হয় না শ্রাবণ এসেছে। তবে বাতাস বেশ ভারী ভারী। জলীয় বাষ্প বলে দিচ্ছে, আছে আছে, বর্ষা এখনও আছে।
অদূরে বাসরাস্তায় যথারীতি যানবাহন, সামনের রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকা। দেয়ার আনমনা চোখ কখনও দূরে, কখনও সামনে। সবিতার কথা কি সত্যি? কেউ কি সত্যিই এসে দাঁড়িয়ে থাকে মাঝে মাঝে? অত সোজা নয়। থানা থেকে সেদিন তো বললই, গুণ্ডা বদমাশদেরও জানের মায়া থাকে ম্যাডাম! ধরা পড়লে ধোলাই খেয়ে মরবে না!
আলগাভাবে সকালের দুই মহিলাকেও মনে পড়ল দেয়ার। সৌম্য শুনে যা খেপাবে আজ!
ফের ছোটঘরে পা রাখতেই দেয়া চমকে গেছে। ঘুমন্ত শিউলি ছটফট করছে মেঝেয়। স্বপ্ন দেখছে? হাত পা কুঁকড়ে নিজেকে যেন বাঁচাতে চাইছে কারুর হাত থেকে, বোবায় ধরার মতো একটা আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে! বোধহয় সেই ভয়ংকর দিনগুলোর স্মৃতি…।
দেয়া কেঁপে উঠল। ওই সব দিন কি মোছে কিছুতেই? আহা রে শিউলি!
বারো
সকাল থেকেই কাজে মন বসছিল না সৌম্যর। চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। দুপুরে অমিতাভ, দীপাঞ্জন আর সুতনুকার সঙ্গে গ্রুপ ডিসকাশন ছিল, নতুন প্রকল্প নিয়ে। আলোচনার মাঝে ঘন ঘন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল সৌম্য। এমনটা তার কদাচিৎ ঘটে।
কী আরম্ভ করল কী দেয়া? লক্ষ্মীদি যে কাল হুট করে সোনারপুর চলে যাবে, দেয়া তাকে জানাল না পর্যন্ত? কী, না ভুলে গেছে! যুক্তিও কী অদ্ভুত! আমি যখন অফিস থেকে ফিরি, হয় তুমি ঢুলছ, নয় নেশাড়ুর মতো কম্পিউটারে বসে আছ, আর সকাল হওয়া মানেই তো তোমার ছোটা, সাংসারিক কথা বলবটা কখন! অথচ পরশু রোববার ছিল, গোটা সকালটা সেদিন দেয়া হাহা হিহি করে কাটিয়েছে। দেয়ার ভুলটাকে সৌম্য যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে, তবে কি সেটা অন্যায় ভাবা হবে? দেয়া জানে না লক্ষ্মীদি না থাকলে সৌম্য অসুবিধেয় পড়বে?
বোঝে সৌম্য। সব বোঝে। সৌম্যর ওপর চাপ তৈরি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে দেয়া। ভাবছে লক্ষ্মীদি না থাকলে সৌম্য ওই মেয়ের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হবে। তুমি এখনও সৌম্যকে চেনোনি দেয়া, সৌম্যর সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়া এত সহজ নয়। আশ্চর্য, সৌম্যকে জানাতে ভুলে যায়, কিন্তু ঋতমকে নয়। ওই মেয়েকে পাহারা দেওয়ার জন্য ঋতম এসে বসে থাকে, এবং সৌম্যকে সেটা দেখতে হয়! এটা সৌম্যকে অপমান করা নয়?
কাল রাতে সৌম্য নিজেই খাবার গরম করে নিয়েছিল। তাতেও দেয়া কী ক্ষিপ্ত। মাংসটা ধরিয়েই ফেললে? ছি ছি, গ্যাস সিম করে গরম করতে হয় তাও জানো না? আলুর দমের বাটিটা তো পুড়ে ঝুল, সবিতা কাল ওটা মাজতে পারবে? কথার ফাঁকে ফাঁকে আবার সূচ বেঁধানো টিপ্পনি! কবে স্কুলজীবনে একবার সৌম্য ক্লাসের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিল, ডিম কি এমনিই সেদ্ধ করে, না খোলা ছাড়িয়ে সেদ্ধ করে—কোন কুক্ষণে বুঝি দেয়াকে গল্পটা করে ফেলেছিল সৌম্য, সেই উদাহরণ তুলে চিমটি কাটা কাটা মন্তব্য! দেয়া কি সৌম্যর সহ্যশক্তির সীমা দেখতে চায়? হুঁহ্, জীবনে জেদের লড়াই কম লড়েনি সৌম্য, নয় আর একবার হবে।
চিন্তা মাথায় নিয়ে আঙুল চলছে সৌম্যর। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলেও মস্তিষ্ক তপ্ত হয়ে উঠছে। সামনে লজিক-গেট, সিগনাল, আর ওয়েভফর্মের কারিকুরি। দেখতে ভাল্লাগছে না আজ। মাইক্রোচিপের নকশা বানানোর প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ আরও খানিকটা এগিয়ে যাবে ভেবেছিল। হচ্ছে না কিছুতেই। চাকরির প্রথম দিনই স্বর্ণকমলদা বলেছিল, জীবনে যদি সফল হতে চাও তাহলে কয়েকটা শর্ত তোমায় মেনে চলতেই হবে। অফিস আর বাড়িকে কক্ষনও একসঙ্গে মেশাবে না। সর্বদা সতর্ক থাকবে যেন তোমার পারিবারিক জীবন তোমার কাজের ওপর ছায়া না ফেলে। কর্মকুশলতার জন্য ইন্ফোক্যাল তোমায় মোটা দাম দেবে, তোমার মেটিরিয়াল প্রয়োজন মেটাতে কোম্পানি যথাসাধ্য করবে, কিন্তু বিনিময়ে তোমাকে তোমার হানড্রেড পারসেন্ট দিতে হবে। মনে রেখো, অফিসে ঢোকার আগে পারিবারিক জীবনকে যদি অফিসগেটের বাইরে না রেখে আসতে পারো, ইউ উইল নেভার রাইজ।
নাহ্, সৌম্যর সব উলটোপালটা হয়ে যাচ্ছে। উঠে পড়ল সৌম্য, টয়লেটে গিয়ে ঘাড়ে মুখে ভাল করে জল দিয়ে এল। মস্তিষ্ককে কেন্দ্রীভূত করছে যন্ত্রগণকে। প্রোগ্রাম তৈরি করছে নকশার। কম্পিউটারের চেনা ভাষাকে প্রয়োজন মতো বদলে নিচ্ছে সামান্য। জাপানি সংস্থারই কাজ, ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তা সংক্রান্ত। চালু ব্যবস্থাকে আরও উন্নত, আরও নিখুঁত করতে হবে।
সুতনুকা বোধহয় বাইরে গিয়েছিল। দরজা থেকে ডাকছে,—সৌম্য, সামবডি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।
সৌম্য মুখ তুলল। চোখে প্রশ্ন।
সুতনুকাই আবার বলল, —বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। লিটল বিট এজেড।
কাজ বন্ধ করে এসে সৌম্য চমকেছে। বাবা!
অবাক মুখে বলল, —তুমি? এখানে?
লম্বা রোগা দেবব্রতর কপালে বলিরেখার আঁচড়। মাত্র দু বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন দেবব্রত, কিন্তু এখনই যেন তাকে বেশ বুড়োটে দেখায়। পরনে ধূসর রং বুশশার্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল প্রায় সাদা হয়ে এসেছে।
কুণ্ঠিত স্বরে দেবব্রত বলল, —ব্যস্ত ছিলি?
—একটু।… হঠাৎ অফিসে কেন?
—এলাম। তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
—তুমি আমাদের বাড়ি আসছ না কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
—আছি একরকম। তোদের ওখানে কদিন ধরেই যাব যাব ভাবছি। তোরা কখন থাকিস, কখন থাকিস না… আজ সল্টলেকে এসেছিলাম, পুরনো অফিসে। ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখাটা করেই যাই।
—ও। সৌম্য একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল। ইন্ফোক্যালের ভাড়াটে প্রহরী নির্বিকার দাঁড়িয়ে। তাদের অফিসে অতিথি নিয়ে গিয়ে বসানোর প্রথা নেই, এই প্যাসেজে দাঁড়িয়েই কথা বলবে বাবার সঙ্গে? দু এক সেকেন্ড ভাবল সৌম্য, তারপর বলল,চলো, নীচে যাই।
দোতলায় ছোট একটা মার্কেট মতন আছে। কাজ চলা গোছের একটা রেস্টুরেন্টও। সৌম্য বাবাকে নিয়ে বসল সেখানে। বাবার জন্য কফির অর্ডার দিল, নিজের জন্য কোল্ডড্রিঙ্কস।
গুছিয়ে বসে বলল, —কী বলছিলে বলো? কী কথা?
—বলছি। দেবব্রত সিগারেট ধরাল,—দেয়ার কী খবর? কেমন আছে?
—ভালই। এখন ইভনিং চলছে।
—সেই মেয়েটি তো এখনও তোদের বাড়িতে?
—হুঁ।
—আর কোনও প্রবলেম হয়নি তো? দেয়া বলছিল কোন লোক নাকি এসে দাঁড়িয়ে থাকত…!
—তা হবে। আমি বলতে পারব না।
—সে কী রে? তুই কিছু জানিস না?
—তুমি কি এই দরকারে এসেছ?
দেবব্রত একটুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল। গভীর চোখে দেখছে ছেলেকে। আপন মনে মাথা নাড়ল দুদিকে। ছোট্ট একটা শ্বাসও যেন পড়ল। তারপর স্যাঁতসেতে গলায় বলল, —তোর মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেছি রে।
সৌম্যর মন বলছিল, এবার এরকমই কিছু বলবে বাবা! মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটল না তার। সহজ গলায় বলল, —মা তো চিরকালই প্রবলেম-উওম্যান। নতুন কী করল? এবার কি খাট বিছানা বিলি করছে?
—তোর মা-র শরীরটা ভাল যাচ্ছে না রে।
—ডাক্তার দেখাও।
—ডাক্তার কী করবে? ভেতর থেকে ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কোনও কাজে উৎসাহ নেই, চুপচাপ শুয়ে থাকে, কথা বলতে চায় না, কিছু বললে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়…
—আমি কী করতে পারি?
—ব্যাপারটা খুব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে রে। হঠাৎ ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিচ্ছে। অফিসে অলরেডি নোটিসও দিয়ে দিয়েছে।…
—ভাল তো। অনেক চাকরি হয়েছে, এবার বাড়িতে রেস্ট করুক।
—মেন্টাল প্রবলেম কি শুধু রেস্টে সারে রে?
—সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাও।
—তুই এভাবে কথা বলছিস? দেবব্রত আহত মুখে বলল, —আমি বাইরের কাউকে নিয়ে তোর সঙ্গে আলোচনা করছি না। সে তোর মা। তার ভালমন্দর ব্যাপারে তোর কি কোনও দায়িত্ব নেই?
—কাছে থাকলে তার খারাপ লাগে বলেই তো দূরে থাকি বাবা।
—তোর মা যা বলে তুইও তাই বলবি? তোরা দুজন আমার কথা একটুও ভাববি না? দেবব্রতর গলায় কাতর মিনতি। সৌম্যর হাতটা ধরেছে,—আমার কথা শোন সোমু, একবার অন্তত মার কাছে চল। তুই একবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই সুপ্রিয়া ঠিক হয়ে যাবে।
—প্রয়োজন মনে হলে তুমিই মাকে নিয়ে এসো। আমার বাড়ির দরজা সবার জন্যেই খোলা।
—সোমু প্লিজ, একটু রিজনেবল হ। একবারটি আমার কথা শোন। …ঠিক আছে, না যেতে চাস, মাকে অ্যাটলিস্ট একটা ফোন কর। ফোনে তোর গলা পেলেও…
—মাও তো ফোন করতে পারে।
—ওফ্। দেবব্রত মাথা ঝাঁকাল, —আমি আর পারছি না। আমি আর পারছিনা। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি রে সোম।
হঠাৎই ছোটবেলার একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল সৌম্যর। প্রায়ই সে দেখত স্বপ্নটা। হিন্দি ফিল্মের ভিলেনের মতো প্রকাণ্ড এক উঁচু বাড়ির কার্নিশ থেকে ঝুলতে ঝুলতে আর্তনাদ করছে বাবা, সৌম্য আর মা ওপর থেকে হাততালি দিচ্ছে, হাসছে। একসময়ে হাত ছেড়ে গেল, পড়ে যাচ্ছে বাবা, স্লো মোশানে শূন্যে ভাসতে ভাসতে নেমে যাচ্ছে নীচে।
ওরকম একটা বিটকেল স্বপ্ন কেন দেখত সৌম্য? দেবব্রতর অসহায় দশা দেখে সৌম্য সুপ্রিয়া মজা পাচ্ছে এটা নয় বোঝা গেল। কিন্তু দেবব্রত ভিলেন কেন? কেন ট্রাজিক হিরো নয়? সৌম্যর অবচেতন কি বলে দিয়েছিল তার আর মার মাঝে যে-ই থাকবে সে মন্দ লোক?
কফি আর ঠাণ্ডা পানীয় এসে গেছে। স্ট্র ঠোঁটে লাগিয়ে বোতলে চুমুক দিল সৌম্য। বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে হাসল নরম করে,—তুমি হঠাৎ এত ইমোশনাল হয়ে পড়ছ কেন? এটা তো চিরাচরিত ব্যাপার। ইট্স বিটুইন মি অ্যান্ড মা।
—বটেই তো। চিরকাল তো তোরা দুজনেই শুধু আছিস। আমি তো নেই। আমার তো অস্তিত্বই নেই। দেবব্রতর স্বর তেতো হয়ে গেছে, —তোর মার লেটেস্ট কী খেয়াল চেপেছে জানিস? কলকাতায় থাকবে না। শান্তিনিকেতনে বাড়ি কিনছে। ওখানেই কাটাবে বাকি জীবনটা।
সৌম্য এতক্ষণে যেন ধাক্কা খেল একটা। ফ্যালফ্যাল চোখে বলল,—ফার্ন রোডের বাড়ির কী হবে?
—জানি না। আপাতত হয়তো তালাবন্ধ থাকবে। ছেড়েও দিতে পারে।
সৌম্যর বুকে যেন চিড় ধরেছে। শৈশবের কত লাখো লাখো স্মৃতি জমে আছে ওই বাড়িতে। সৌম্যর রক্তে মজ্জায় মিশে থাকা বাড়িটাকে পরিত্যাগ করে সব কিছু নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় মা? কাকে যন্ত্রণা দিতে চায়? সৌম্যকে? না নিজেকে? নাকি ভাবছে এটাই তার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়?
নীরস গলায় সৌম্য বলল, —চিন্তা করছ কেন? শান্তিনিকেতন তো খুব সুন্দর জায়গা।
—তুই এ কথা বলতে পারলি সোমু?
—না বলার কী আছে? অনেকেই তো এখন ওখানে গিয়ে বাড়ি করে থাকছে। তোমার তো ভালই। ওখানেও থাকবে, মাঝে মাঝে কলকাতায় আমাদের বাড়িতেও আসবে…
দেবব্রত স্থির হয়ে গেল। মুখমণ্ডলে ভাঙচুর হচ্ছে, ওঠানামা করছে গলার শিরা উপশিরা। আঙুলে কপাল টিপে ধরল। কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে, তাকিয়েও দেখল না। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,—চলি রে।
—যাচ্ছ?
—কী করব বসে থেকে? বলেও খানিকটা গিয়ে ফিরে এসেছে দেবব্রত। তর্জনী তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, —শোন সোমু, বাবা হয়ে সন্তানের অমঙ্গল কামনা করা ঠিক নয়। তাই আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, তোর যেন ছেলেপিলে না হয়। হলেও তোকে যেন কখনও আমার দশায় পড়তে না হয়।
প্রার্থনা? না অভিশাপ? ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল শেষ করতে পারল না সৌম্য। হতবুদ্ধির মতো বসে আছে। গত তিন বছরে একদিনও বাবা তার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি। মা-র প্রসঙ্গ যেচে কখনও তোলেইনি বাবা। দেয়া জিজ্ঞেস করলেও দায়সারা উত্তর দিয়ে গেছে। বাড়িতে না গিয়ে আজ হঠাৎ অফিসেই বা এল কেন বাবা? দেয়ার সামনে কথাগুলো বলতে চায় না? কেন চায় না? দেয়াকে কি এখনও বাবা পরিবারের একজন বলে মনে করে না? নাকি কথাগুলো দেয়ার সামনে বলে দেয়াকে আহত করতে চায়নি?
বিস্বাদ মেজাজে সৌম্য ফিরল অফিসে। কাজ শুরু করতে চাইছে। কম্পিউটার চালু করল, তাকিয়ে আছে পর্দার দিকে, শুধু তাকিয়েই আছে। অক্ষর আর পরিসংখ্যানের মাঝে বার বার চলে আসে বাবার মুখ। বাবা আজ প্রায় কেঁদে ফেলেছিল! সৌম্য কি পাষাণ হয়ে যাচ্ছে?
নাহ্, আজ আর কাজে মন বসবে না। সব গোছগাছ করে সৌম্য উঠে পড়ল। অফিস ছাড়তে গিয়েও ফিরে এসেছে টেবিলে। টেলিফোনে নাম্বার টিপল ফার্ন রোডের।
বেজেছে! বাজছে!
বার কয়েক রিং হওয়ার পর ও পারে সুপ্রিয়া,—হ্যালো?
সৌম্য খপ করে রিসিভারের মুখটা চেপে ধরল। দম বন্ধ করেছে।
—হ্যালো? হ্যালো?… কে? কে বলছেন?
সৌম্যর চোয়াল শক্ত। আরও জোরে চেপে ধরেছে রিসিভারের মুখ, যেন নিঃশ্বাসের কণাটুকুও না পৌঁছোয়। ওপারে অধৈর্য হাতে টেলিফোনে খট খট আওয়াজ করছে সুপ্রিয়া, শব্দগুলো দ্বিগুণ চতুর্গুণ হয়ে ধাক্কা মারছে সৌম্যর কানের পর্দায়।
হঠাৎই ও প্রান্ত নিশ্ৰুপ। সতর্ক হাতে ফোন নামিয়ে রাখল সৌম্য। শেষ মুহূর্তে একটা ভারী নিঃশ্বাসপতনের শব্দ শোনা গেল কি? সৌম্যই ফোনটা করেছে, মা কি টের পেল? পরাজয়…পরাজয়!
সৌম্যর বুকটা আরও ভারী হয়ে গেল। নীচে নেমে বেরিয়ে পড়েছে মোটরসাইকেল নিয়ে। কিছু দূর গিয়ে মনে হল গাড়িটা যেন সেভাবে ছুটছে না। অ্যাক্সিলেটার ঘোরাল, বাড়ছে না গতি। হলটা কী তেঁএটে যন্ত্রটার? ফের পিক্আপ নিচ্ছে না আজ?
মোটরসাইকেল এরকম টিকটিক করে চললে ভয়ংকর মেজাজ খিঁচড়ে যায় সৌম্যর। কোনও রকমে সন্তোষপুর পৌঁছে সোজা চেনা গ্যারেজে।
মদন দৌড়ে এসেছে, —কী প্রবলেম দাদা?
সমস্যা শুনে গাড়িটাকে পরীক্ষা করল মদন। অভিড মিস্ত্রি, কয়েক মিনিটেই সারিয়ে দিল গলদটা। তেলকালি মাখা হাত ন্যাকড়ায় মুছতে মুছতে বলল, —আবার স্পার্কপ্লাগেই গড়বড় দাদা।
সৌম্য বিরক্ত হল, —সে কী? এই তো কদিন আগে নতুন লাগালাম!
মদন দাঁত ছড়িয়ে হাসছে,—আপনার গাড়ির সঙ্গে স্পার্কপ্লাগের বনিবনা হল না দাদা।
—স্ট্রেঞ্জ! সৌম্যর মুখে সন্দেহের ভ্রূকুটি, —আমি তো অরিজিনালই লাগিয়েছিলাম, দু নম্বরি নয়! তুমিই তো দিয়েছিলে!
—আপনার আস্লি জায়গাটাই তো দুব্লা হয়ে গেছে। ইঞ্জিনে আর জোশ নেই। নামিয়ে পুরো কাজ করতে পারলে হয়তো আবার…। মদন স্লাইডিং রেঞ্চ টুলবক্সে রাখল,—টাইম লাগবে। রেখে যেতে হবে।
—পড়বে কী রকম?
—দেখতে হবে। না খুলে বলতে পারছি না।
—হুম।
—একটা কথা বলি দাদা? কবছর হল গাভির? দশ?
—একটু বেশিই হবে। মনে মনে হিসেব করল সৌম্য,—এই ধরো, তেরো বছর।
—তা হলে তো ভালই চলেছে। এবার একে ছুটকারা দিন। এই সব টু হানড্রেড সিসি মডেল আজকাল আর কে চড়ে? এত ওয়েটি মাল…! এখন বাজারে কত আচ্ছা আচ্ছা হানড্রেড সিসি এসে গেছে, একটা নিয়ে নিন।
সৌম্য কথাটা শুনেও শুনল না। পার্স বার করে বলল, —কত দেব?
—দিন, পঞ্চাশ দিন।
মজুরি একটু বেশিই নেয় মদন। সৌম্য জানে। কাজ তো ছিল সামান্যই, প্লাগ পরিষ্কার করা। অন্য কোথাও তিরিশের ওপরে নিত না। সৌম্য ধমক দিলে মদনও ওরকমই নেবে, তবে আজ সৌম্যর দরাদরি করার মুড নেই। টাকা মিটিয়ে সৌম্য মোটরবাইকে স্টার্ট দিল,—ইঞ্জিনে কাজ করালে বলে যাব। যা সময় বলবে, তার মধ্যেই শেষ করবে। ভোগাবে না।
—মদন নস্কর জবান কা পাক্কা। গাড়িটায় হাত বোলাল মদন, —বেচে দিন দাদা। আট দেব। ক্যাশ ডাউন।
এবারও সৌম্য কথাটা কানে তুলল না। গাড়ি কিনলেও মোটরসাইকেলটা বেচার তার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই। কারণও আছে। এ মোটরসাইকেল তার নিজের কেনা নয়। উপহার। কিংবা উপহারও নয়, একটা শর্ত পূরণের দাম। হায়ার সেকেন্ডারির সময়ে মার সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল যদি সে মার কাঙিক্ষত নম্বর পায়, তবে যা চাইবে তাই পাবে। সৌম্য আশাতীত মার্কস পেয়েছিল হায়ার সেকেন্ডারিতে, প্রায় নশো। বিনিময়ে এই দ্বিচক্রযান। ছেলেকে এই দুর্দম গতিময় যান কিনে দেওয়ার একটুও ইচ্ছে ছিল না সুপ্রিয়ার, কিন্তু সৌম্যর তখন ওই জিনিসটাই চাই। মার আপত্তি ছিল বলেই আরও বেশি করে চাই। আমি তোমাকে খুশি করেছি, তোমাকেও কথার দাম রাখতে হবে। প্রথম বছরেই মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে মাঝারি অ্যাক্সিডেন্ট করল। তীব্র বেগে বাঁক নিতে গিয়ে পিছলে গিয়েছিল চাকা, প্রাণপণ চেষ্টা করেও সৌম্য সামাল দিতে পারেনি, একটা মোষকে ধাক্কা মেরেছিল। ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল মোষের মালিককে, সৌম্যও পা ভেঙে বিছানায়। মা তখন বেচে দেবেই ওই হতচ্ছাড়া রথ, সৌম্য কিছুতেই তা হতে দিল না। সাফ জানিয়ে দিল, মোটরসাইকেল বেচে দিলে সেও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দেবে।
হ্যাঁ, এইরকমই সম্পর্ক ছিল মা ছেলের। প্রতি পদে চুক্তি, প্রতি পদে জেদ, প্রতি পদে যুদ্ধ। আজ তুমি পাঁচখানা রাইমস মুখস্থ করবে সৌম্য, তাহলে ক্রিকেটব্যাট পাবে। করব মুখস্থ, তবে ব্যাট নয়, ফুটবল নেব। তিরিশটা সাম্স করে রাখলে তোমায় দুটো ক্যাডবেরি দেব। না, আমার আইসক্রিম চাই। পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে এবার কাশ্মীর নিয়ে যাব। উঁহু, গোয়া যেতে হবে। প্রতিটি ধাপে ইচ্ছে পূরণ করেও ইচ্ছেকে অগ্রাহ্য করা। দিবে আর নিবে নীতিতে মার পাল্লা যতটা ভারী, ছেলেরও ততটাই।
অত লড়াই করে টিকিয়ে রাখা সেই বাহনকে কী করে হাতছাড়া করে সৌম্য?
তা ছাড়া মোটরসাইকেলটাকে ঘিরে অনেক মধুর স্মৃতিও তো আছে। এই রথেই দেয়াকে নিয়ে কোথায় না কোথায় ঘুরেছে সৌম্য। নদী দারুণ টানত দেয়াকে। কোলাঘাট, . ডায়মন্ডহারবার, বসিরহাট, ক্যানিং, সর্বত্র তারা তিনজন। সৌম্য, দেয়া আর কার্ল। হ্যাঁ, দেয়া ওই নামেই ডাকত মোটরসাইকেলটাকে। রেমার্কের থ্রি কমরেডস উপন্যাসের সেই বিখ্যাত গাড়িটার নামে। এই কার্লের পিঠে বসেই দেয়া প্রথম তার কানে গুনগুন করেছিল, আমি তোমায় ভালবাসি। সৌম্য শুনেও না শোনার ভান করেছিল। বলেছিল, একটু জোরে বলল। দেয়া অল্প গলা তুলল, সৌম্য বলল, আরও জোরে। দেয়া দুহাত ছড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল, আআমিইই তোওওমাআআকে ভালওবাআআসি। সেদিন তারা প্রথম যাচ্ছিল দূরে, ইছামতীর পথে। দুপাশে অনন্ত ভেড়ি। জল, শুধু জল। স্থির জল তিরতির দুলে উঠেছিল দেয়ার ঘোষণায়, গাছের পাতারা নেচে উঠেছিল, আকাশ গাঢ় নীল, পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অপরূপ এক সুগন্ধ।
সেই কার্লকে সে বেচে দেবে? কক্ষনও না।
অতীত বিষন্নতাকে ঘন করে। সৌম্যর মনটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মার সঙ্গে অত লড়াই, কী হল লাভ? মা হয়তো জানল না, কিন্তু সৌম্য তো নিজেই নিজের কাছে হেরে গেল। যে বাবাকে সে কোনওদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না, সেই বাবা আজ তার বুকে কুশ বিঁধিয়ে দিয়ে গেল। কী করতে পারল সৌম্য, মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া? দেয়ার সঙ্গে এত ভালবাসা, এত মন জানাজানি, শরীর চেনাচিনি, তার কী পড়ে আছে এখন? দেয়া আর সৌম্যর ইচ্ছেকে পাত্তাই দেয় না। দেয়া বদলে গেছে। দেয়া বদলে গেছে।
ম্লান মনে মোটরসাইকেল গ্যারেজ করল সৌম্য। মন্থর পায়ে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। দোতলার ল্যান্ডিং-এ তড়িৎ পাইন। নামছিল তড়িৎ, সৌম্যকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে।
বছর চল্লিশের তড়িৎ-এর ঠোঁটে ইলাস্টিক হাসি, —ফিরছেন অফিস থেকে?
সৌম্য ভদ্রতা করে দাঁড়াল, —হুঁ।
—আকাশে আজ আবার একটু মেঘ করেছে না?
—বোধহয়। খেয়াল করিনি।
—বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। আবার ঢালবে। এবার তেড়েফুঁড়ে এলেই বন্যা।
—হুঁ।
—মিসেস কোথায়? ডিউটিতে?
—হুঁ।
—উনি কিন্তু আমাদের খুব প্রাউড করেছেন। আমি তো সর্বত্র ওঁর কথা বলি। ভদ্রবাড়িতে একজন প্রস্টিটিউটকে আশ্রয় দেওয়া…
—মেয়েটা প্রস্টিটিউট নয়। সৌম্য প্রসঙ্গটাকে যথেষ্ট ঘৃণা করে, তবুও বলতে বাধ্য হল, —মেয়েটি ফোর্সড হয়েছিল।
—সে তো ভাই সব প্রস্টিটিউটকেই জোর করে লাইনে নামানো হয়। কটা মেয়ে আর শখ করে বেশ্যাবৃত্তিতে আসে বলুন! অনেকেই পালিয়ে আসতে চায়, পারে না। ও পেরেছে। শি হ্যাজ ডেভিলস লাক। কেমন একটা সুন্দর ফ্যামিলিতে ওর জায়গা হয়ে গেল…
আরও কী সব বলছে তড়িৎ, সৌম্যর কানে যাচ্ছিল না। কেমন যেন বমি বমি লাগছে। চোখ বুজে লোকটাকে ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছে একটা। উফ্, সহ্যশক্তির কত পরীক্ষায় যে সৌম্যকে এখন উতরোতে হবে!
বাকি সিঁড়ি কটা লম্বা পায়ে টপকাল সৌম্য। সমস্ত ক্ষোভ জড়ো হয়ে আছড়ে পড়েছে কলিংবেলে।
শিউলি খুলেছে দরজা খুলেই সরে দাঁড়াল।
সৌম্য গনগনে চোখে তাকাল, —লক্ষ্মীদি কোথায়?
—আসেনি। শিউলির মিহি জবাব।
এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সোকা থেকে ঋতমের গলা, —গুড ইভনিং কম্পিউটার। আজ এত জল্দি জল্দি?
সৌম্যর ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে গেল। আজও সাঁকো নাড়ানো পাগলাটা বসে! বইখাতা ছড়ানো রয়েছে কার্পেটে। পড়ানোর ঢং চলছিল এতক্ষণ? বাড়িটা দিনকে দিন কী হচ্ছে? একটা সন্দেহজনক চরিত্রের মেয়ের সঙ্গে ঋতমের এত কীসের ঢলাঢলি?
স্নায়ুটাকে অনেক কষ্টে বশে রাখল সৌম্য। দেঁতো হেসে বলল, —তুমি কতক্ষণ?
—বহুক্ষণ। শিউলি কত কী খাওয়াল। পরোটা, আলুচচ্চড়ি, আচার, সন্দেশ…। কফি খাবে নাকি? তাহলে আমারও এক কাপ হয়।
—নাহ্, তুমি একাই খাও। আমি একটু পরেই ডিনার করব।
—একদিন নিয়ম ভাঙলে কী হয় ভাই?… অ্যাই শিউলি, বইখাতাগুলো নিয়ে যা। আজ একটু তোর কম্পিউটারদাদার সঙ্গে আড্ডা মারি।
শিউলি রান্নাঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছিল, ছুটে এসে বইপত্র তুলে নিয়ে ধাঁ।
সৌম্য জুতো মোজা ছেড়ে সোফায়।
শার্টের বোতাম আলগা করতে করতে বলল, —তোমার দেখছি সন্ধেটা আজকাল ভালই কাটছে।
—ঠাট্টা করছ? আমার বলে একেবারে ওষ্ঠাগত প্রাণ! ঋতম একটা বিড়ি ধরাল, —এত নিরেট মাথা, অঙ্ক মাথায় ঢোকাতে জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে!
বিড়ির কটু গন্ধে বিবমিষাটা ফিরে আসছে। সৌম্য অপাঙ্গে লক্ষ করল দামি কাট্গ্লাসের ছাইদান পোড়া বিড়ির টুকরোয় টইটুম্বুর। নাহ্, দেয়ার এই বন্ধুটার জন্যই সৌম্যকে গৃহত্যাগ করতে হবে।
মুখের হাসি অম্লান রেখেই সৌম্য বলল, —তবুও তো তুমি বেশ এন্জয় করছ বলেই মনে হয়।
—একটা চ্যালেঞ্জিং জব তো বটেই। …তবে হিস্ট্রি, জিওগ্রাফিতে ওর বেশ ইন্টারেস্ট আছে দেখছি। আগ্রহটা জাগাতে পারলেই আমার ছুটি। তারপর তো ও নিজে নিজেই এগোতে পারবে।
—অর্থাৎ তোমার মহৎ কার্য সমাধা হবে, তাই তো?
—হ্যাঁ। মানে…। সৌম্যর বাচনভঙ্গিতে এবার যেন ঋতম একটু থতমত খেল।
—একটা কথা বলব ভাই? যদি কিছু মনে না করো…। ভাল কাজে তোমার খুব উৎসাহ, তাই না?
—ভাল মন্দ বুঝি না। ঋতম খাড়া হয়ে বসেছে, —একটা পাঁকে পড়ে যাওয়া মেয়েকে যদি একটুও সাহায্য করতে পারি…
—সাহায্য তো তুমি আরও বেশি করতে পারতে ভাই।
—কী ভাবে?
—মেয়েটাকে তোমার কাছেই রেখে। চব্বিশ ঘণ্টা তোমার অমূল্য গাইডেন্স দিয়ে।
ঋতম চোখ ছোট করল। সৌম্যর কথার অন্তর্নিহিত শ্লেষটুকু এতক্ষণে বুঝি ধরতে পেরেছে। সৌম্যকে চমকে দিয়ে হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠল, —আরে ভাই, আমার কি সে জোর আছে? না আমার কথা বাড়িতে চলে? নিজেই হার ম্যাজেস্টির কৃপায় আছি। বোঝার ওপর শাকের আঁটি নিয়ে গেলে গিন্নি আমায় গলাধাক্কা দেবে না?
—তাই তুমি নিপুণভাবে শাকের আঁটিটা বান্ধবীর ঘাড়ে চালান করেছ! আই মিন, ভেরি ক্লেভারলি!
—আমি তো…মানে আমি তো…। ঋতুম আমতা আমতা করল, —আমি তো জোর করে কিছু দেয়ার ওপরে চাপাইনি!
—আমি কি বলেছি তুমি জোর করেছ? বললাম তো, ক্লেভারলি। চতুর ভাবে ইউ হ্যাভ ডান ইট। এই না হলে প্রিয় বন্ধু? প্রথমে দেয়াকে উসকোলে নিউজপেপারে স্টোরি করার জন্যে। দেয়াও রাতারাতি ফেমাস হওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে, সেও টোপটা গিলে নিল। সামান্যতম গলা না চড়িয়ে, মুখের হাসি অবিকৃত রেখে, হিমেল স্বরে বিষ উগরে যাচ্ছে সৌম্য, —তুমি একটি সাত ঘাট চরে খাওয়া ঘুঘু, তুমি ভাল মতোই জানতে আর্টিকেলটা বেরোলে ওই মেয়ে কোনও না কোনওভাবে গাড্ডায় পড়বে। পড়লও। এবং তখনই শুরু হল তোমার সেকেন্ড কোর্স অফ অ্যাকশান। দেয়ার উইকনেসের সুযোগ নিয়ে তুমি তার কনসেন্সে প্রিক করতে আরম্ভ করলে, আর দেয়াও হাউমাউ করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে এল। একটা সেন্টেন্সও ভুল বলেছি?
ঋতমের মুখ পাংশু হয়ে গেছে। অস্ফুটে বলে উঠল, —নাহ্, তুমি বোধহয় একটু বেশিই ঠিক বলছ। তোমার শিক্ষাদীক্ষা যে স্তরের, তোমার তো ভুল হওয়ার কথা নয়।
—বোঝো সেটা? ডিফারেন্সটা বুঝতে পারো?
শিউলি ঋতমের কফি এনেছে। কাপ প্লেট টেবিলে রেখে যেমন এসেছিল চলে গেল, কিছুই বুঝতে পারল না। সে লোকগীতি শুনে অভ্যস্ত, ধ্রুপদের আলাপ তার বোধবুদ্ধির অতীত।
ঋতম ঝলক দেখল শিউলি কোথায়। তারপর প্রায় বিড়বিড় করে বলল, —তুমি কী চাও বলো তো? আমি আর না আসি?
—আমি তোমাকে না করার কে! সৌম্যর স্বরে মসৃণ রূঢ়তা, —তুমি তোমার বান্ধবীর কাছে আসবে, দুজনে মিলে প্রাণের সুখে নাচানাচি করবে, মহৎ সাজার কম্পিটিশান চালাবে…। অফকোর্স নিজের গলায় কাঁটাটি না ফুটিয়ে। নিজের বেণীটা না ভিজিয়ে। অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এমন ফোকটে গ্রেট বনার অপারচুনিটি কেউ ছাড়তে পারে!
ঋতম কালো মুখে উঠে দাঁড়াল, —আয়াম সরি সৌম্য। আমি বুঝতে পারিনি তোমাদের এত ডিসটার্বড করে দিয়েছি। আমি দেয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।
—প্লিজ। দেয়াকে প্রোভোক করে আর তুমি আমাদের শান্তি নষ্ট কোরো না। যাই করো, যে উদ্দেশ্যেই করো, তুমি নিশ্চয়ই আমাদের শত্রু নও! অ্যাম আই রাইট?
টুঁ শব্দটি না করে হেঁটমাথা ঋতম দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
সৌম্য পাথরের মতো বসে। কাজটা কি ভাল হল? এতটা অপমান বোধহয় না করলেও চলত। উপায়ই বা কী? চারদিকে কেমন ঢি ঢি পড়ে গেছে নিজের কানেই তো শুনল। ঋতমই দেয়ার প্রধান মন্ত্রণাদাতা। ঋতমের আসা বন্ধ হলে দেয়ার একটা ডানা তো কাটা পড়বে।
সামনে শিউলি। স্থানকালপাত্র ভুলে মেয়েটা অবাক প্রশ্ন করে ফেলেছে, —একী, বাবুয়াদা কফি না খেয়েই চলে গেল যে?
গুমরোনো রাগটা ঠেলে উঠল। সৌম্য খেঁকিয়ে উঠেছে, —তাতে তোর কী? নিয়ে যা কাপ ডিশ।
তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালাল শিউলি।
সৌম্য দুপদাপ শোওয়ার ঘরে। রুক্ষ গলায় হাঁক ছেড়েছে, —অ্যাই, শুনে যা।
শিউলি কাঁপতে কাঁপতে এসেছে দরজায়।
—দিদির লিপস্টিক টিপস্টিক এমন ছড়ানো কেন?
—আমি জানি না। শিউলি মিউ মিউ করল।
—একদম মিথ্যে কথা বলবি না। তুই ড্রেসিংটেবিলে হাত দিসনি?
—না দাদা। দিদিই তো ওভাবে…
—ফের মুখে মুখে তর্ক? খুব স্পর্ধা বেড়েছে, অ্যাঁ? আমি জানি না তোর দিদি কোন জিনিস কী ভাবে রাখে?
ধমকের দাপটে শিউলির চোখ ছলছল।
সৌম্য আগুন চোখে শিউলিকে দেখল। সেই ভিখিরি ভিখিরি ক্ষয়টে ভাবটা আর নেই, দিব্যি চকচকে হয়েছে কদিনে। ঠোঁটে লালচে আভা আছে কি? গালে কস্মেটিক্সের প্রলেপ? বুঝতে পারল না বলে আরও খেপে গেল সৌম্য। ক্রুদ্ধ চোখ ঘোরাফেরা করছে শিউলির পরিধানে। পিংক এই সালোয়ার কামিজটা দেয়া হানিমুনে গিয়ে কিনেছিল না?
সৌম্য দাঁত কিড়মিড় করল, —ভাগ। ভাগ এখান থেকে। ফের কখনও যদি আমরা না থাকলে ঘরে ঢুকেছিস! কেন যে দেয়া চাবি বন্ধ করে যায় না!
শিউলি ছিটকে চলে গেছে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে থর থর।
পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধে সৌম্য বাথরুমে ঢুকে গেল। আগুন ছুটছে মাথায়, শাওয়ার চালিয়েও সুখ নেই, জল যেন শরীর অবধি পৌঁছচ্ছে না। লক্ষ্মীদিকে সোনারপুর পাঠিয়ে মজা দেখছে দেয়া! দেখুক। সৌম্যও ছাড়বে না ওই মেয়েকে। ঝড়ের চোটে অন্ধকার দেখিয়ে দেবে। দেখা যাক, কতক্ষণ আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখতে পারে দেয়া!
সুপ্রিয়া সিংহরায়ের ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছিল সৌম্যর মধ্যে। সেই সুপ্রিয়া, যে কখনও হারতে শেখেনি। এবং শেখায়ওনি।
তেরো
এক দিনের নাম করে গিয়েছিল লক্ষ্মী, ফিরল চার দিন কাটিয়ে। সোনারপুরে গিয়ে নাকি ভারী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল লক্ষ্মী। শাশুড়ির জন্য ভালবেসে কাঁঠাল এনেছিল জামাই। ইয়া বড়, রসা রসা। লোভে পড়ে খেয়ে লক্ষ্মী নাকি বিছানায় কুপোকাৎ। দুদিন ধরে পেটফাঁপা বাহ্যিবমি…। মেয়ে নাকি হাতে ধরে বলেছিল আরও দুটো দিন জিরিয়ে যেতে, ওই শিউলির কথা ভেবেই তার নাকি থাকা হল না।
তা যাই হোক, লক্ষ্মী ফিরে আসা মানেই স্বস্তি। সৌম্য নয়, যেন দেয়াই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শিউলিকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা নেই, সৌম্যর জন্য ভাবনা নেই, নিজেকেও হুটোপুটি করে রান্নাবান্না করতে হচ্ছে না, সংসার ফের মোলায়েম ভাবে চলমান।
সৌম্যও এখন আর শিউলিকে নিয়ে তেমন খিটখিট করছে না। সিলিকন ভ্যালি থেকে সৌম্যর বুগিদার ই-মেল এসেছে, সৌম্যর মনমেজাজ ঈষৎ প্রফুল্ল এখন। বুগিদা নাকি পুজোর আগেই আসবে, মাথায় তাই নতুন চিন্তা ঢুকেছে সৌম্যর। বুগিদা আসার আগেই এখানে একটা ভাল অফিসস্পেসের সন্ধান চাই। সৌম্য এখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বেজায় মশগুল।
দেয়াও মাঝে একদিন চেতলা থেকে ঘুরে এল। ঠাকুরমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, শ্বাসকষ্ট মতন হচ্ছিল, দেখে এল ঠাকুমাকে। শিউলিকে নিয়ে মার ট্যাকট্যাক, বাবার গজগজ, এ কান দিয়ে ঢোকাল, ও কান দিয়ে বার করে দিল। আসন্ন বিবাহবার্ষিকীর মেনু নিয়ে জোর আলোচনা করল মহুয়ার সঙ্গে। সৌম্য যে বাবা হওয়ার ডেটলাইন এগিয়েও আনতে পারে, মজা করে বলেও এল সে কথা।
সৌম্য দেয়ার ফ্ল্যাটে এখন আবার অভ্যস্ত গৃহছন্দ। পুরো নয়, প্রায়। সূক্ষ্ম একটা করকরে ভাব আছেই। সৌম্য শিউলিকে সাধ্য মতো এড়িয়ে চলছে, লক্ষ্মীও যেন শিউলির ওপর পুরোপুরি প্রসন্ন নয়…। তা হোক, কদিনেই কি আর সব কিছু দেয়ার মনের মতো হয়ে যাবে? সময় দিতে হয়। সময় দিতে হয়।
সামনের সোমবারই দেয়াদের বিবাহবার্ষিকী। কেনাকাটা এখনও কিছুই হয়নি। বৃহস্পতিবার দুপুরে খেয়ে উঠে বেরিয়ে পড়ল দেয়া।
মধ্যাহ্নের গড়িয়াহাট আজ ফাঁকা ফাঁকা। পথ ভুলে চলে যাওয়া মেঘেরা আবার ঘুরে এসেছে শহরে। দখল নিচ্ছে আকাশের। সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ। গায়ে লাগে না তেমন, আবার যেন লাগেও। রাস্তাঘাটে অদ্ভুত এক ঘুমপাড়ানি আলো, ভারী মিঠে লাগে আলোটাকে। পুজোর বাজার এখনও শুরু হয়নি, দোকানদাররা ঝিমোচ্ছে বসে বসে, আর হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠে কাউন্টারের মাছি তাড়াচ্ছে। এমন দিনে ক্রেতাদেরই পোয়াবারো, যেমন খুশি দরদাম করা যায়।
দেয়া ঘুরে ঘুরে সওদা সারছিল। সুতোর সুন্দর কাজ করা হালকা চাঁপাফুল রঙের বেডশিট কিনল একটা, সঙ্গে ঝালর দেওয়া মানানসই বালিশের ওয়াড়। বিয়ের দিন পাতবে। নতুনের গন্ধ বেরোবে চাদর থেকে। ওই দিন সব পর্দাগুলোও বদলানোর ইচ্ছে, চেনা দোকানে গিয়ে দৃষ্টিনন্দন থান কিনল মাপ মতো। দোকানের নিজস্ব ওস্তাগর আছে, অর্ডার মাফিক পর্দা বানিয়ে রবিবারের মধ্যেই বাড়িতে ডেলিভারি দিয়ে আসবে। চার্জ একটু বেশিই নিচ্ছে, তা নিক, বয়ে নিয়ে যাওয়ার হ্যাপাটা তো নেই। চোখে লেগে যাওয়া লাল টুকটুকে কফিমগও কিনে ফেলল গোটা চারেক। কাপডিশেই কফি দেওয়া হয়, দেখতে বিচ্ছিরি লাগে। মশলাপাতি রাখার কৌটোর জন্য লক্ষ্মীদি ঘ্যানর ঘ্যানর করছিল, খুঁজে পেতে গোটা কয়েক প্লাস্টিকের কৌটোও কিনল। নিজের জন্য কিনল টিপের পাতা, শেড মিলিয়ে লিপস্টিক, কমপ্যাক্ট, নেলপালিশ। শিউলি নাকি দেয়ার ড্রেসিংটেবিলে হাত দেয়, সৌম্য সেদিন গজগজ করছিল, এর মধ্যে একদিন নাকি শিউলিকে বকেছে। দিতেই পারে হাত, ইদানীং মেয়েটার সাজগোজের দিকে একটু একটু ঝোঁক হয়েছে। দেয়া যখন প্রসাধনে বসে, তখনও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে শিউলি। আহা রে, এই বয়সেই তো সাধ হয়! শিউলির জন্য সস্তা দেখে ঈষৎ চড়া রঙের লিপস্টিক কিনল একটা, সঙ্গে কম দামি নেলপালিশ আর গোটা কয়েক রংচঙে বাহারি ক্লিপ। বিয়ের দিন সে নিজে সাজবে, শিউলিও একটু সাজুক। ফুটপাথে হ্যাঙারে সালোয়ার কামিজ ঝুলছে। দাম শ দুয়েকের মধ্যে। ঘেঁটে বেছে শিউলির জন্য একটা চন্দনরঙা পছন্দ করেছিল, খানিক ভেবে নিল না সেটা। মেয়েটা ঝকঝকে জামাকাপড় বেশি ভালবাসে, আর একটু ঘুরে একখানা লাল হলুদ নকল সিল্কের সেট কিনে ফেলল। কামিজটা একটু বেশি চিকচিক করছে, সঙ্গে ওড়নাও নেই… থাক গে, শিউলি এটা পেলেই বেশি খুশি হবে। কিন্তু শুধু শিউলির জন্য তো নিলে চলবে না। লক্ষ্মীদি আছেন, তিনি আবার গোঁসা করবেন। রং নিয়ে লক্ষ্মীদির তেমন প্যাখনা নেই, লক্ষ্মীদির জন্য সবুজের ওপর ডুরে শাড়িও কিনল একখানা।
এবার সৌম্য। ঘুরে ঘুরে দেয়া ক্লান্ত বোধ করছিল, একটা কোল্ডড্রিঙ্কস কিনে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে সৌম্যর জন্য কী কেনা যায়। প্যান্ট শার্ট? গাদা হয়ে গেছে, ওয়ার্ড্রোবে আর ধরছে না। দামি পারফিউম কিনবে? কোলন? দুৎ, মার্চে ওর জন্মদিনেই তো পারফিউম দিয়েছিল, রিপিট হয়ে যাবে না! ফেডেড জিন্স কেমন হয়? থাক বাবা, দেয়ার পছন্দর শেড সৌম্যর আবার মনে লাগে কি লাগে না…! ভাল টাই? হ্যাঁ, টাই। এক জোড়া দামি কণ্ঠলেংগুটি দেওয়া যেতেই পারে। সঙ্গে রুমালের সেট প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়? হিহি, উপহার হাতে ধরিয়ে দিয়েই একটা টাকা নিয়ে নেবে। রুমাল তো আর এমনি এমনি দিতে নেই!
শীতল পানীয় শেষ করেই দেয়া আবার দোকানে। নামী কোম্পানির বিশাল শোরুম। টাই বাছতে বাছতে হঠাৎ চোখ গেল ক্যাশকাউন্টারে। এক যুবক বিল মেটাচ্ছে। ভীষণ চেনা চেনা যেন! কোথায় দেখেছে? যাদবপুরে? সৌম্যর বন্ধু না?
ছেলেটাও দেখছিল দেয়াকে। স্মিত মুখে।
দেয়া এগিয়ে গেল,—আপনি সৌম্যর…?
—হ্যাঁ। আমি সৌম্যর ব্যাচমেট। দীপ।… ইউ ওয়্যার হিজ ফিঁয়াসেঁ, আই প্রিজিউম?
—আমরা তিন বছর হল বিয়ে করেছি।
—ইজ ইট? কন্গ্র্যা্টস।…সৌম্য তো কলকাতা ছেড়ে নড়েনি, তাই না?
—উঁহু। নড়ার ইচ্ছেও নেই। দেয়া লক্ষ করল দীপ বেশ মোটাসোটা হয়েছে। আগে একেবারে প্যাংলা মতন ছিল। সৌম্যর সঙ্গে কার্লে চড়ে দেয়া যখন হুশ করে উড়ে যেত, কেমন জুলজুল করে তাকিয়ে থাকত দীপ। স্মৃতিটায় হাসি পেয়ে গেল সামান্য। হাসিটা মুখে ধরে রেখেই দেয়া জিজ্ঞেস করল,—আপনি এখন কোথায়?
—নিউ জার্সি। কাউন্টার থেকে প্যাকেট তুলে নিল দীপ,—বলবেন সৌম্যকে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাই।
দীপ বেরিয়ে যাওয়ার পর একটু যেন খারাপ লাগল দেয়ার। সৌম্যর সঙ্গেই তো খুব ঘোরাফেরা করত ছেলেটা, অথচ সৌম্যর সম্পর্কে তেমন কোনও কৌতুহলই নেই? সৌম্য কোথায় থাকে, কেমন আছে, কিছুই জানতে চাইল না? নিজের সম্পর্কেও তো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না কোনও! চার বছর এক সঙ্গে পড়ার পরেও সৌম্য শুধুই দীপের ব্যাচমেট? বন্ধু নয়? ইউনিভার্সিটিতে দেয়াদের ক্লাসে আশিজন ছিল, কলেজে অনার্স ক্লাসে তারা ছিল পঁয়তাল্লিশজন, অনেকের সঙ্গেই তেমন ঘনিষ্ঠতাও ছিল না, তবু কদাচিৎ দেখা হয়ে গেলে মিনিট কয়েক বকবক তো হয়ই। ঋতমের কথা আলাদা, ঋতমের সঙ্গে বরাবরই যোগাযোগ আছে। দেবাশিস, সংঘমিত্রা, পিয়ালিদের সঙ্গেও তো মাঝেমধ্যেই টেলিফোনে আড্ডা হয়। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ওরা ডাকে দেয়াকে। দেয়াও সোমবার ওদের নেমন্তন্ন করছে। কিন্তু এই তিন বছরে সৌম্যর ওরকম একটা বন্ধুরও তো দেখা পাওয়া গেল না?
একরোখা জিদ্দি বলেই কি সৌম্যর বন্ধু নেই? নাকি বন্ধুহীন বলেই সৌম্য ওরকম? বন্ধুদের সঙ্গে একটু হ্যাহ্যা হিহি না করতে পারলে জীবনটা কেমন মরুভূমি মরুভূমি লাগে না? বন্ধু নেই বলে সৌম্যর কি কোনও দুঃখ আছে? মনে তো হয় না।
কেনাকাটার পালা সাঙ্গ করে দেয়া ফিরল প্রায় পাঁচটায়। বাড়ি ঢুকতেই শিউলি শালিখের মতো ঝাপটে এসেছে, —কী কিনলে গো দিদি? দেখি কী কিনলে?
দেয়া ফ্যানের তলায় বসে ঘাড় গলা মুছল,—আগে এক গ্লাস জল খাওয়া।
এরোপ্লেনের গতিতে জল এনেছে শিউলি, —দেখাও। দেখাও।
দেয়া মিটিমিটি হাসল, —এবার এক কাপ গরম গরম চা করে নিয়ে আয়।
লক্ষ্মী চোখ ঘোরাল,—আহা, তুমি ঘরে থাকলে ইনি যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। একটুখানি বেরিয়েছ…খালি ঘর আর বার! দিদি কখন ফিরবে? দিদি কখন ফিরবে?
দেয়া ঠোঁট টিপল, —উপমাটা কিন্তু তোমার লাগসই হল না লক্ষ্মীদি। বলতে পারতে আমি থাকলে হাতে স্বর্গ পায়।
—ওই হল। …এখন দেখাও দিকি কী এনেছ। অ্যাই ছুঁড়ি, দাঁড়িয়ে রইলি যে? যা, চা বসা।
চা খেতে খেতে একটা একটা করে মণিমুক্তো উদঘাটিত করছে দেয়া। শিউলি ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখছে। সালোয়ার-কামিজখানা বার করার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠল। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে পরে এসেছে। টান টান হয়ে দেখছে নিখুঁত ফিট করেছে কিনা।
চোখ টেরিয়ে দেখল দেয়া, —একেবারে অপ্সরীর মতো লাগছে! রূপ খুলে গেছে!
শিউলি লজ্জায় গা মুচড়োচ্ছে।
লক্ষ্মী মুখ বেঁকিয়ে বলল,—আ মোলো যা! ঢং দেখে আর বাঁচি না! যা, এবার খুলে রাখ।
দেয়া বলল,—হ্যাঁ, ভাল করে ভাঁজ করে রাখ। সোমবার এটাই পরবি।
তক্ষুনি তক্ষুনি খুলল না শিউলি। বাবু হয়ে দেয়ার পায়ের কাছে বসেছে,—সোমবার অনেক লোক আসবে, না গো দিদি?
—বেশি কোথায়? এই ধর জনা কুড়ি।
—লক্ষ্মীমাসি অত লোকের রান্না করবে? পারবে?
লক্ষ্মী নিজের শাড়িখানা বগলদাবা করে দুলে দুলে চলে যাচ্ছিল। ঘুরে বলল,—আমি কেন করব? তুই তো আছিস।
—ওরে বাবা, আমি পারব নাকি?
—পারলেও তোর হাতের রান্না কেউ খেত ভেবেছিস?
—আহ্, লক্ষ্মীদি। দেয়া আলগা ধমক দিল। শিউলির মাথায় চাঁটি মেরে বলল, —শোন হাঁদি, রান্না সেদিন কেউই করবে না।
শিউলি লক্ষ্মীর কথা গায়ে মাখেনি। বোধহয় এরকম শুনে শুনে সয়ে গেছে। দাঁত বার করে হাসল,—তাহলে কী হবে? সবাইকে চ্যানাচুর মিষ্টি খাওয়াবে?
—ওরে না রে না। বাইরে থেকে খানা আসবে। মাটন বিরিয়ানি, চিকেন চাপ, ফিশ ব্যাটারফ্রাই, কেক, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্কস।
—বিরিয়ানি বাবুয়াদা খুব ভালবাসে। সেদিনও বলছিল তোর দিদির ঘাড় ভেঙে একদিন বিরিয়ানি খেতে হবে।
—হুঁহু্, তোর বাবুয়াদার জিভ ভেবেই তো করা।
বলতে বলতে দেয়া সামান্য অন্যমনস্ক। ঋতমটা কদিন হল আসছে না। পরশু না তার আগের দিন দেয়া ফোন করেছিল। শ্রাবণী ধরল, ঋতম বাড়ি ছিল না তখন। পই পই করে দেয়া শ্রাবণীকে বলে দিল ঋতম যেন ফিরেই দেয়াকে রিংব্যাক করে… শ্রাবণী নিশ্চয়ই বলেছিল… ব্যাটা খ্যাপা নির্ঘাৎ ভুলে মেরে দিয়েছে। কখন যে কোন তালে ঘুরে বেড়ায় পাগলটা!
শ্রাবণী ঋতমকে তো নেমন্তন্নও করা হল না!
ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই হ্যান্ডসেট নিয়ে বসেছে দেয়া,—মাসিমা, ঋতম আছে?
—না তো। কে বলছ?
—আমি দেয়া, মাসিমা।
—ও। বাবুয়া তো সেই সকালে বেরিয়ে গেছে। ওর আজ একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে।
—তাই নাকি? কখন ফিরবে?
—তা তো বলতে পারছি না।
—শ্রাবণী আছে?
—শ্রাবণীর তো এসে যাওয়ার কথা। কলেজে কী একটা মিটিং আছে বলছিল। কিছু বলতে হবে?
ঋতমের মার মাধ্যমে কি ঋতমশ্রাবণীকে বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন করা যায়। শ্রাবণী খুব স্পর্শকাতর মেয়ে, আত্মসম্মানজ্ঞান অত্যন্ত প্রখর, হয়তো কিছু মনেও করতে পারে। ঋতম অবশ্য শুনলেই তিন পায়ে দৌড়ে আসবে। ঋতমের কি দেয়ার বিয়ের দিনটা স্মরণে আছে?
ঈষৎ দোনাশোনা করে দেয়া বলল, —না মাসিমা, তেমন কিছু নয়, আমি পরে আবার ফোন করব।
রিসিভার অফ করে দুমিনিট এমনি বসে রইল দেয়া। তারপর সাইডটেবিল থেকে সরু ডায়েরিটা টেনেছে। পিয়ালিকে বাড়িতে পেয়ে গেল। সংঘমিত্রাকে তার বাপের বাড়িতে। দেবাশিস নেই, দেবাশিসের বউকে বলে দিল। মাসতুতো দিদি চিনিদিকে বলে দিল জামাইবাবুকে নিয়ে যেন অবশ্যই আসে। গজা নিমকি সহ।
গোটা ছয়েক টেলিফোনেই দেড় ঘণ্টা কাবার। বকতে বকতে মুখের ফেনা উঠে গেছে। ক্লান্ত দেয়া ঘরে গিয়ে সৌম্যর প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রাখছিল, সোমবারের আগে সৌম্যকে দেখাবে না, শিউলি এসে এক গোছা চিঠি ধরিয়ে দিল, —সবিতামাসি নীচ থেকে এনে দিয়েছিল, তোমায় দিতে ভুলে গেছি।
দেয়া খামগুলোতে চোখ বোলাল। সবই তো সৌম্যর। গত বছর পুজোর আগে ক্রেডিট কার্ড করিয়েছে, গাদা গাদা চিঠি পাঠায় ব্যাংক। বিটকেল বিটকেল প্রলোভন। ফোন করলেই লাখ টাকা বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি! ঘরবাড়ি সারান, গ্যাজেটস কিনুন, বেড়াতে গেলে এই হোটেলে উঠুন, অমুক এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করুন…! হোটেলে খেয়ে বিল পেমেন্ট করা ছাড়া সৌম্য ক্রেডিট কার্ড উলটেও দেখে না। সৌম্য কিপটে? না মিতব্যয়ী? উঁহু, হিসেবি।
খান উলটোতে উলটোতে টেলিফোন বিল। দুহাজার চারশো অষ্টআশি টাকা। অনেকটাই ইন্টারনেটের কল্যাণে। আরও বাড়বে। বুগিদা যা ভর করেছে।
একদম নীচে একটা পোস্টঅফিসের খাম। দেয়ার নামে। চিঠি খুলে মুখ হাসিতে ভরে গেল দেয়ার। খুড়তুতো বোন হিয়া লিখেছে, সিমলা থেকে। গত অঘ্রানে বিয়ে হয়েছে হিয়ার, বর সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অফিসার, স্বামীর কর্মস্থলেই হিয়ার অনন্ত হানিমুন। সৌম্য আর দেয়াকে একবার সিমলা ঘুরে যাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছে হিয়া। সামনের বছর হিয়ার বর বদলি হয়ে যেতে পারে, তার আগেই যেন…।
গেলে হয়। কতকাল বেড়াতে যাওয়া হয়নি দেয়ার। সেই হানিমুনে গিয়েছিল কোড়াইকানাল, তারপর একবার সাত দিনের জন্য লাভা লোলেগাঁও, ব্যস্। দিনরাত তো শুধু কাজ কাজ আর কাজ। সৌম্যর কাজ। দেয়ার কাজ। সিমলা যাওয়ার জন্য সৌম্যকে একবার পটিয়ে দেখবে? বুগিদার এখানে কোম্পানি খুলে বসতে বসতে নিশ্চয়ই সামনের বছর… তার আগে যদি দুজনে দুটি নিয়ে…? শীতকালে যাওয়া যায়। হিমাচল প্রদেশ একটুও দেখেনি দেয়া। পাহাড় চিরে বয়ে যাচ্ছে বিপাশা নদী…। প্রচণ্ড শীতে কেমন দেখায় নদীকে?
ধুস, দেয়া কী করে বেরোবে? শিউলির কী হবে? তারা সিমলা ছুটলে লক্ষ্মীদি থোড়াই পড়ে থাকবে বাড়িতে! এবার ছোটজামাই-এর বাড়ি গিয়ে কাঁঠাল খেয়ে পেট ছেড়েছে, বড়জামাই-এর বাড়ি গিয়ে সুদে আসলে পুষিয়ে নেবে না?
শিউলি জ্বালাল তো! দূর, আর নো মায়া। এবার কাটাও। এখন অনেকটাই থিতু হয়েছে, হোমে যাওয়ার কথা শুনে আর তো ওই মেয়ের কান্নাকাটি করা উচিত নয়। দরকার হলে একটু জোরাজুরিই করতে হবে। দেয়া তো শিউলির খারাপ চাইছে না। শিউলির মঙ্গলের জন্যই শিউলির চলে যাওয়া প্রয়োজন।
বিছানায় এসে শুল দেয়া। চোখ বুজেছে, শ্রান্তি কাটাতে। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই, তবু বলতে ইচ্ছে করছে না, মড়ার মতো পড়ে থাকতেই আরাম লাগছে। সৌম্য আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে কি? পর পর দুটো বৃহস্পতিবার বৃথা গেছে আজ, ট্যাংরায় চাইনিজ খেতে গেলে হয়।
দূরাগত ধ্বনি। ড্রয়িংহলে ফোন বাজছে। শিউলি দৌড়ে এসে হ্যান্ডসেট দিয়ে গেল। শুয়ে শুয়েই দেয়া বোতাম টিপল, —হ্যালো?
—দেয়া সিংহরায় আছেন কি?
—বলছি।।
—ওফ্, বাঁচালেন। নবপ্রভাতে ফোন করে করে তো আমার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। লাইন যাও পেলাম, শুনলাম আপনার আজ ছুটি।
পুরুষ কণ্ঠ। কেজো গলা।
দেয়া ফিরে শুল, —আপনি কে বলছেন?
—বেলেঘাটা পি এস। সেকেন্ড অফিসার বলছি। আপনার সঙ্গে খুব আরজেন্ট দরকার ম্যাডাম।
দেয়া টান টান, —কেন? কী হয়েছে?
—শিউলি চক্রবর্তী মেয়েটা তো আপনার কাছেই?
—হ্যাঁ।
—ওকে যে একবার থানায় আনতে হবে।
—কেন?
—দুটো লোককে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। মনে হয় ওর মধ্যে আপনার শিউলির নটবরটি আছেন।
দেয়া ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, —তাই? কোথ্থেকে পেলেন?
—একটা জুয়ার ঠেক থেকে। আমাদের সোর্স ওর পুরনো আড়াটার খবর দিয়েছিল। আপনারা তো আমাদের নির্মাই ভাবেন, আমরা কিন্তু চোখ রেখেছিলাম। বাবাজীবন ভেবেছিল হাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, আবার এসে এখানে আস্তানা গাড়ছিল।
—আপনারা শিওর ও সেই লোক?
—কনফার্ম হওয়ার জন্যই তো আপনাকে ফোন করা। মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসুন, আইডেন্টিফাই করে যাক।
—এখন? এই রাত্তিরে?
—আপনাদের সময় অসময় আছে ম্যাডাম। আমাদের নেই। আমরা তো চব্বিশ ঘণ্টার চাকর। কাল সকাল নটার মধ্যে উইদাউট ফেল চলে আসুন। ওসি সাহেবও সামনে থাকবেন। কাল আবার আমাদের কোর্টে প্রোডিউস করারও ব্যাপার আছে তো।
—হুম্। সে তো বটেই।
—তাহলে সকালেই চলে আসছেন? …আজ ব্যাটাকে একটু রগড়ে দেখি পেট থেকে কিছু মাল বেরোয় কিনা। পুরো গ্যাংটাই বোধহয় এবারে…।
—আমি অবশ্যই চলে যাব। এ তো আমার কর্তব্য।
—সব নাগরিক যদি কর্তব্য বুঝত তাহলে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই প্রয়োজন হত না। হা হা হা। …রাখছি।
দেয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ গিঁট খুলছে? না গিট পাকাচ্ছে? শিউলিকে থানায় নিয়ে গেলে উলটো কোনও প্রতিক্রিয়া হবে না তো? শিউলি এখন অনেকটাই ভুলে গেছে, নতুন করে ভয়টা ফিরে আসবে কি? বোঝাতে হবে শিউলিকে, ভাল করে বোঝাতে হবে। লোকটা যদি সত্যিই শ্যামচাঁদ হয়, তাহলে অন্য একটা সম্ভাবনাও কি থাকে না? হোক না নকল বিয়ে, একটা বিয়ে তো হয়েছিল। কদিনের জন্য হলেও শ্যামচাঁদকে ভালবেসেছিল শিউলি। লোকটাকে দেখে শিউলি এখন কী ধরনের আচরণ করতে পারে? ফেটে পড়বে? ভেঙে পড়বে? নাকি আতঙ্কে গুটিয়ে যাবে শামুকের খোলে? থানা থেকে ফেরার পরেই বা তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? দেয়া সামলাতে পারবে তো?
নাহ্, ঋতমকে একটা ফোন করা দরকার। এক্ষুনি।
দ্রুত হাতে হ্যান্ডসেটের বোতাম টিপল দেয়া, —মাসিমা? ঋতম ফিরেছে?
—না। এখনও ফেরেনি। …শ্রাবণীকে দেব?
—থাক। আমি আবার পরে…
দেয়া দূরমনস্কভাবে ফোন কেটে দিল।
চোদ্দো
চাকরি একটা পেয়ে গেছে ঋতম। সেল্সে। ছোটখাটো আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানিতে। প্রথমে পনেরো দিনের ট্রেনিং। ওষুধগুলোকে চিনতে হবে, তাদের গুণাগুণ বুঝতে হবে, তার পর ঘুরে ঘুরে বোঝাতে হবে ডাক্তারদের। দোকান বাজারেও ছোটাছুটি আছে নিয়মিত, অর্ডার সংগ্রহ করাটাও তার কাজ। কোম্পানিটার ওষুধ মূলত গ্রামেগঞ্জেই চলে, শহরাঞ্চলে এদের মালের তেমন কদর নেই। কাজটা ঋতম নিজেই জোগাড় করেছে, অম্বরদা দেয়নি, এটাই ঋতমের একটা বড় তৃপ্তি।
তা বলে কি ঋতম চাকরিটা পেয়ে আনন্দিত? না। বিষন্ন? তাও না। ফের হালে যুতে যাওয়ার জন্য শ্রাবণীকে কি সে মনে মনে দায়ি করছে? বলা কঠিন। প্রাণপণে নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক রাখার চেষ্টা করছে ঋতম। ভেতরের আমিটাকে সমঝাচ্ছে অনুক্ষণ, চাকরিটার তার সত্যিই প্রয়োজন ছিল। আর্থিক? উহুঁ। জীবনের সব প্রয়োজন কি টাকাপয়সার মাপকাঠিতে মাপা যায়? এই যে ঋতম মাঠেঘাটে ঘুরবে, কত অজস্র মানুষকে দেখবে, মিশবে তাদের সঙ্গে, তাদের চিনবে জানবে, এরও তো একটা মূল্য আছে। আগের চাকরিগুলো কি তাকে কিছুই দেয়নি? ছোট্ট একটা গণ্ডির মধ্যে ক্রমশ বদ্ধ হয়ে পড়ছিল সে, শব্দের কারিকুরির নেশায় মেতে ছিল, এখন টের পাচ্ছে সেগুলোও ধীরে ধীরে পানসে হয়ে আসছে। জীবনকে আঁকতে গেলে মানুষকে অনেক বড় চালচিত্রে দেখতে হবে। তার লেখায় সেভাবে জীবনবোধ কোথায়? দর্শন কোথায়? তেমন কোনও গভীর বিশ্বাসের ভিতও তো তার মধ্যে গড়ে ওঠেনি। অবিশ্বাসেরও না। শ্রমহীন পরজীবীর জীবন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার কে কতটা পুষ্ট করতে পারে? কলম কি তার শখশৌখিনতা? তার বেশি কিছু নয়?
মনে মনে এসব ভাবছে বটে ঋতম, আবার মাঝে মাঝে সমস্ত যুক্তিকেই নিছক অসার মনে হচ্ছে তার। কানের কাছে অবিরাম ঘণ্টাধ্বনির মতো বেজে চলে, ঋতম তুমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ। ঋতম, তুমি তোমার নিকটতম জনকেও চিনতে পারোনি। লেখালেখি তোমার কম্মো নয়, কলমটাকে ছুড়ে ফেলে দাও নর্দমায়, ঘাড় গুঁজে লেগে পড়ো কাজে। বউবাচ্চাকে ঠিক মতো প্রতিপালন করো, এর বেশি তোমায় কিছু মানায় না। চোখ বুজে শুধু সাহিত্য করতে চাও, এ তোমার কেমন আবদার?
সকালবেলা চায়ের দোকানে বসে এভাবেই নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই চালাচ্ছিল ঋতম। যুক্তি গড়ছে, যুক্তি ভাঙছে। চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে শোনার পর থেকেই শ্রাবণী কেমন ধন্দ মেরে গেছে। মুখে সর্বক্ষণই একটা অপরাধী অপরাধী ভাব। সম্ভবত ধরেই নিয়েছে এটা তার কোপের প্রতিক্রিয়া। ঋতমের ঠিক কোন জায়গাতে যে শ্রাবণী আঘাত হেনেছে, শ্রাবণী কি বুঝতে পারে?
—এই যে বাবুয়া, বসে বসে কী ধ্যান করছ?
দোলাচল ছিঁড়ে ঋতম মাটিতে নামল। বিশুদা। বিশ্বনাথ হালদার। বয়স পঁয়তাল্লিশও হতে পারে, পঁয়ষট্টিও। জ্ঞান হওয়া ইস্তক বিশুদার চেহারায় ঋতম কোনও পরিবর্তন দেখেনি। শুধু সিড়িঙ্গে মুখখানায় কয়েকটা বলিরেখা বেড়েছে, এই যা।
ঋতম চোয়াল ফাঁক করল, —একটা কঠিন জিনিস ভাবছিলাম। পৃথিবী ডানদিক থেকে বাঁয়ে ঘোরে, না বাঁদিক থেকে ডাইনে!
—অ্যাঁ?
—আমিও বুঝছি না। বোধি লাভের চেষ্টা করছি।
—কী যে আজগুবি সব কথা বলো না! বিশ্বনাথ বেঞ্চিতে বসে পড়ল, —একটা চা বলো দিকিনি।
নির্দেশ ছুড়তে হল না ঋতুমকে, গ্লাস এসে গেছে। গোপালদা ঝানু দোকানদার, এই টি-স্টল চালাচ্ছে প্রায় কুড়ি বছর, পাড়ার সব লোককেই সে হাতের তালুর মতো চেনে। যার পাশেই এসে বসুক বিশ্বনাথ, তার জন্য এক গ্লাস চা বরাদ্দ থাকবেই।
সাড়ে নটা বাজে। শনিবারের সকাল, চায়ের দোকানে তেমন একটা ভিড় নেই। মন দিয়ে কাগজ পড়ছে একজন, নিজের মনে টিপ্পনি কাটছে মাঝে মাঝে। সামনের বেঞ্চিতে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি চারটে ছেলে গুলতানি মারছে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে এক রিকশাচালক। আকাশে আজ মেঘ আর রোদুরের লুকোচুরি। বিশ্রী একটা তাপ আছে, গা জ্বালা জ্বালা করে।
গরম চায়ে চুমুক মেরে বিশ্বনাথ চাপা গলায় বলল, —খবরটা আমার কাছে চেপে গেলে বাবুয়া?
—কী খবর?
—তোমরা নাকি বাড়ি বেচে দিচ্ছ?
—যাহ্। কে বলল?
—কেন লুকোচ্ছ ভাই? তোমার জেঠার সঙ্গে নাকি পিসিদের কথা হয়ে গেছে… সবাই মিলে নাকি প্রোমোটারকে বাড়িটা দিয়ে দিচ্ছ…?
—এসব গুলগাপ্পি তোমায় কে মারে, অ্যাঁ? গলির মধ্যে বাড়ি, পাঁচ শরিককে দিয়ে থুয়ে কিছু থাকবে প্রোমোটারের?
—তাহলে কি ভুল শুনলাম! বিশ্বনাথ ঈষৎ চিন্তিত মুখে বলল, —পন্টু যে সব্বাইকে বলে বেড়াচ্ছে ফ্ল্যাট উঠবে? আমাকেও বলেছে।
পন্টু মানে ঋতমের খুড়তুতো ভাই। মহা বিচ্ছু। নির্ঘাৎ বিশুদার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরেছে। জমি বাড়ির দালালি করে খায় বিশুদা। অভাবি মানুষ। এ ধরনের খবর শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই বিশুদা তিড়িং বিড়িং নাচে।
ঋতম হেসে বলল, —পন্টুর কথা ছাড়ো তো। আমাদের ওরকম কোনও প্ল্যান নেই।
বিশ্বনাথ শুনলই না। পালটা প্রশ্ন করল, —তোমাদের জমি যেন ক’কাঠা?
—পাঁচ কাঠা মতন।
—প্রোমোটার ফোমোটার ফোটাও। আমার হাতে একটা পার্টি আছে। বিশ লাখ দেবে। আউটরাইট পারচেজ। তুমি কাকা জেঠাদের সঙ্গে কথা বলে রাখো, আমি একদিন এনে দেখিয়ে দিই।
সর্বনাশ, পল্টু তো বেশ ভালই নাচিয়ে দিয়েছে! ঋতম তড়িঘড়ি বলল, বিশ্বাস করো, বিক্রির কথা আমাদের কেউ ভাবছে না। অন্তত তাহলে আমি তো জানতাম।
—হয়তো তোমার মার সঙ্গে কথা হয়েছে।
—মা তাহলে বলত না? তুমি আমার কথা শোনো, হচ্ছে না বিক্রি।
বিশ্বনাথের চোখে তবু ঘোরতর অবিশ্বাস! গোমড়া মুখে বলল, গরিব মানুষ দুটো পয়সা পাই, তাতেও তোমাদের আপত্তি?
নাহ্, বিশুদা বুঝবে না। ঋতম তরল গলায় বলল, তোমার কত পারসেন্ট থাকবে?
—যা রেট আছে। টু পারসেন্ট।
—তার থেকে আমায় কত দেবে?
বিশ্বনাথ নড়েচড়ে বসেছে। দৃষ্টি উজ্জ্বল, নেবে তুমি? বলো, কত চাও? এইট্টি টোয়েন্টি?
একটু আগের বিষাদটুকু পুরোপুরি কেটে গেল ঋতমের। মজা করে বলল, তাহলে তো তোমার অনেকটাই চলে যাবে?
—সে কত টাকাই তো চোট যাচ্ছে। বলেই অস্বাভাবিক গলা নামাল বিশ্বনাথ, এই যে মাধুরী সিনেমা হলটা বেচে দিলাম…এক কালোয়ার কিনল। ঘুসুরির।…হিসেব মতো আমার পাওনা হয় আশি হাজার, একটা পয়সাও ছোঁয়াল না! কত ধানাইপানাই, তুমি তো পার্টির সঙ্গে কথা বলাওনি, রতন নিয়ে গেছে…! অথচ ভেবে দ্যাখো, রতন কিন্তু খবরটা আমার মারফতই পেয়েছিল।
—তুমি রতনকে চেপে ধরো।
—ও শালা জালি করছে। বলছে পার্টি নাকি আগেই লোক দেখতে বলেছিল! ডাহা মিছে কথা। কী করব, সত্যের তো আর জয় নেই। বলেই টেবিলে পড়ে থাকা ঋতমের সিগারেট থেকে একটা তুলে নিল বিশ্বনাথ। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখ সরু করেছে, তোমরা তাহলে এখনও কারওর সঙ্গে সেভাবে কথা বলনি? প্রোমোটার তাহলে নিচ্ছে না?
—নাহ্। প্রশ্নই ওঠে না।
—তাহলে পার্টিকে একবার নিয়ে আসি? যদি বলো তো আর একটু ওপর থেকেও শুরু করতে পারি। পঁচিশ…
—ওফ্, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। আচ্ছা বাবা কথা দিচ্ছি, একশো বছর পরেও যদি বেচি, তোমাকেই ফাস্ট খবরটা দেব। হল তো?
বিশ্বনাথের মুখে গাল এঁটো করা হাসি, তুমি আমার ভায়ের মতো। টুপি দিও না কিন্তু।…তুমি সের’ম করবেও না। সেই যখন ছোট্ট ছিলে, তখন থেকে তোমায় দেখছি। তোমার মনটা ভাল।…পাঁচটা টাকা দেবে? একশো টাকার নোট র্যাশন দোকানে ভাঙিয়ে দেবে না। চিনি তুলব।
বিশ্বনাথকে দেখে ভারী মায়া হয় ঋতমের। কী বিচিত্র জীবন! জমিবাড়ির দালালি করে মোটা দাঁও মারবে এই আশায় আশায় উঞ্ছবৃত্তি করেই চুল পাকিয়ে ফেলল। স্বপ্ন দেখে আশি হাজারের, পায় বড় জোর আটশো। স্বপ্ন, না খুড়োর কল? বেঁচে থাকার রসদ?
টাকা হাতে পেয়ে বিশ্বনাথ পলকে উধাও।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর একজন। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, মাথায় জটার মতো চুল, গা-ময় চাপ চাপ ময়লা, পরনে শতচ্ছিন্ন প্যান্ট আর পাঞ্জাবি। এ পাড়ার ভোলাপাগলা।
ঋতম গলা ওঠাল, গোপালদা, পাগলার পাওনাটা দিয়ে দাও।
—প্লেন নেই আজ। স্লাইজ দিই?
—দাও।…পকেট আজ শর্ট আছে, খাতায় লিখে রাখে।।
হাতে পাঁউরুটি নিয়ে পা ঘষে ঘষে চলে যাচ্ছে ভোলাপাগলা। ভদ্রবাড়ির ছেলে, ঋতমের জাঠতুতো দাদার সঙ্গে স্কুলে পড়ত এক সময়ে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এখন পেট ছাড়া কোনও বোধ নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, ঋতম চায়ের দোকানে পা রাখলেই কোত্থেকে যেন উদয় হয় ঠিক। কথা বলে না একটাও, চোখে শুধু ফুটে থাকে এক নীরব প্রার্থনা। একখানা কোয়ার্টার পাউন্ড পাঁউরুটির। পেলেই পাগল আবার নিজস্ব ভুবনে।
ঋতম ভোলাপাগলার চলে যাওয়াটা দেখছিল। যে মেয়েটার প্রেমে পাগল হয়েছিল ভোলা, সে হয়তো সুখে ঘরকন্না করছে কোথাও। দিনান্তে তার কি একবারও ভোলার কথা মনে পড়ে? নাকি সংসারের গোলকে আটকে পড়ে সেও এখন স্মৃতিহীন? ভোলার মতোই?
সহসা ঋতমের দৃষ্টি স্থির। একটা ট্যাক্সি ঢুকেছে গলিতে, ঋতমদের বাড়ির সামনেই থামল। দেয়া নামছে না?
বার বার ফোন করছে দেয়া। যে কোনও মুহূর্তে হাজির হবে, অনুমান করছিল ঋতম। তবু ঋতমের শরীর শক্ত সহসা। সেদিনের অপমানটা এখনও বিষ্ঠার মতো লেগে আছে গায়ে। একা একাই দুর্গন্ধটা হজম করে চলেছে ঋতম। কাউকে বলতে পারেনি। শ্রাবণীকেও না। মনে হয়েছিল সৌম্য নয়, দেয়াকেই তাহলে ছোট করা হবে।
এক্ষুনি দেয়ার মুখোমুখি হওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই ঋতমের। কী করবে? উঠে সরে পড়বে এখান থেকে?
ঋতম নড়তে পারল না। ঠিকে কাজের মেয়েটি চেঁচিয়ে ডাকছে, আপনার কাছে কে একজন এসেছে দাদা। বউদি বাড়ি আসতে বলল।
বড় একটা শ্বাস ফেলে ঋতম গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথে। দেয়ার সামনে এসেই আমূল বদলে ফেলেছে মুখচ্ছবি। রগুড়ে ভঙ্গিতে বলল, মহারানি কি দিক ভুলে গরিবের কুটিরে?
—শুনছিস শ্রাবণী? ডায়ালগটা শুনলি? দেয়া রে রে করে উঠল, বারবার ফোন করেও বাবুর পাত্তা পাওয়া যায় না…!
শ্রাবণী বলে উঠল, আমি কিন্তু বলেছি তোমার ফোন এসেছিল।
অতসী বলল, আমিও বলেছি, জিজ্ঞেস করো।।
—ব্যাপারটা কী তোর? এমন কী রাজকার্য করছিস, একটা ফোন করারও সময় পাস না?
—রোষানল সংবরণ করো দেবী। অধীনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিও না। ঋতম খ্যাকখ্যাক হাসছে, কাজ থাকে ম্যাডাম। রাজকার্যের মতো অত ইম্পর্ট্যান্ট কাজ না থাকলেও কিছু থাকে।
—বুঝলাম।…আজ কাগজে খবরটা দেখেছিস? শিউলির সেই কালপ্রিট তো কট।
শিউলি প্রসঙ্গ থেকে দূরে থাকবে ভেবেছিল ঋতম, কিন্তু চমকটা লুকোতে পারল না। টানটান হয়ে বলল, তাই নাকি? কবে?
—পরশু। কাল সকালে শিউলিকে নিয়ে আমি থানায় গিয়েছিলাম। ও আইডেন্টিফাই করেছে লোকটাকে।
এত বড় সংবাদটা ঋতমের নজরে এল না কেন? অবশ্য সেভাবে এখনও খুঁটিয়ে পড়াও হয়নি কাগজ।
ঋতম উৎসুক মুখে বলল, তারপর? শিউলির কী রিঅ্যাকশান?
—প্রচণ্ড ঘাবড়েছে। থানায় গিয়ে একেবারে ভোঁদা মেরে গিয়েছিল। আমার তো ভয় হচ্ছিল কোল্যাপ্স না করে যায়। সেই জন্যই তো তোকে আরও খুঁজছিলাম।
—ও।…এখন ঠিক আছে তো শিউলি?
—অনেকটা কুল ডাউন করেছে। কাল আর আমার অফিস যাওয়া হল না। সারাদিন ধরে ওকে বুঝিয়েছি।..পুলিশ বলছিল গ্যাংটা নাকি পুরনো। পুলিশের রেকর্ডে নাকি শ্যামচাঁদের নাম আছে। অবশ্যই অন্য নাম। ওরা তো জামাকাপড়ের মতো নাম বদলায়। এইসব নারীঘটিত কেসই ছিল ওর এগেন্সটে। এইসব মেয়ে চালান টালান। আগেরবার পুলিশ নাকি তেমন যুৎ করে পাকড়াতে পারেনি। এবার গোটা রিংটাকেই..মুম্বই পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। অন্য অ্যাকমপ্লিশরাও এবার বাঁচবে না।
ঋতম প্রচণ্ড খুশি। বলল, গ্র্যান্ড নিউজ। এই খবরটার অনারেই এক কাপ করে কফি হয়ে যাক মা।
অতসী শ্রাবণীও শুনছিল মন দিয়ে। অতসী ফস করে বলল, সবই হল, মাঝখান থেকে কাননটা মরে গেল।
—ওটা আর ভেবে কী হবে মাসিমা? পাস্ট ইজ পাস্ট। তবে আমি তো কাননকে বলেছিলামই আমি পাশে আছি। আমাকে যদি একবারও জানাত…। ইনফ্যাক্ট, আমি তো তখনই ওর মেয়ের জন্য হোমের ব্যবস্থা করছিলাম। একটু আর সহ্য করে থাকলে…
—না, তুমি তো খুবই করেছ। তুমি না থাকলে ওই মেয়ে…। তবে বাপু আর ওকে কাছে রেখো না, এবার ওর কোথাও একটা ব্যবস্থা করে ফ্যালো।
দেয়া উত্তর দিল না। কী যেন ভাবছে।
অতসী ভুরু কুঁচকে একটু দেখল দেয়াকে। ভেতরে যেতে যেতে বলল, তোর বড়পিসিকে একটা ফোন করে দে বাবুয়া। ইন্দিরা সেদিনও মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করছিল…
শিউলি সমাচারে হাওয়া বেশ ভারী। শ্রাবণী পর্যন্ত কথা বলছে না।
ঋতম মনে মনে ধমকাল নিজেকে। শিউলি নিয়ে আর ভাবাভাবি তাকে মানায় কি? সৌম্য রূঢ় সত্যিটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। পুরোপুরি দায়িত্ব নেওয়ার যখন তার মুরোদ নেই, ওপরপড়া সমবেদনা দেখানোও তার সাজে না।
দেয়ার মুখ থেকে মেঘ সরে গেছে। হাসি হাসি মুখে বলল, যাক গে, কাজের কথা শোন। তোরা দুজনে পরশু সন্ধেবেলা আমাদের বাড়ি আসবি।
ঋতম শ্রাবণী চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। ঋতম অস্ফুটে বলল, কেন? শ্যামচাঁদের ধরা পড়া সেলিব্রেট করছিস?
দেয়া মুচকি হাসল, উঁহু। সৌম্য সিংহরায়ের ধরা পড়া।
—ও। হ্যাঁ। তাই তো! তোদের তো বিয়ের দিন!
—ইয়েস। তোর মনে রাখা উচিত ছিল। ওরকম একটা ম্যাগনাম সাইজের বোকে প্রেজেন্ট করেছিলি…! শোন, তুই আর শ্রাবণী কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি চলে যাবি। আমায় হাতে হাতে হেল্প করবি।
বেশ কর্তৃত্বের সুরে কথা বলছে দেয়া। ঋতুমের ক্ষণিকের জন্য মনে হল, তার আর শ্রাবণীর বিয়ের দিনের কথা কি দেয়ার স্মরণে থাকে? অবশ্য আশা করাও অন্যায়। ঋতম সৌম্যর বউ-এর কে?
ঋতম কিছু বলার আগেই শ্রাবণী বাহানা জুড়েছে, যেতে তো ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু টুলকিকে নিয়ে খুব ঝামেলা হয় গো। মেয়েটা লোকজন দেখলে এমন কান্না জোড়ে!
—আই অ্যাই, নো এক্সকিউজ। লাস্ট ইয়ার টুসকি হবে বলে তুই যাসনি, এবার কোনও অজুহাত শুনব না।
—সত্যি বলছি, মেয়েটাকে নিয়ে বড় প্রবলেম।
—মাসিমার কাছে রেখে যাবি। তুই কলেজ গেলে কে সামলায়, অ্যাঁ?
ঋতম তাড়াতাড়ি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ হ্যাঁ, যাবে না কেন? নিশ্চয়ই যাবে। সেদিন কোন শাড়িটা পরবে বলো তো? নেভিব্ল সাউথ ইন্ডিয়ান?
শ্রাবণী ঈষৎ অপ্রস্তুত যেন, তখন দেখা যাবে।
—উঁহু। ডিসিশানটা আগে নিয়ে রাখো। ঠিক বেরোনোর মুখে মুখে বলবে, এটা ভাল্লাগছে না, ওটার ইস্ত্রি নেই, ম্যাচিং ব্লাউজ পাচ্ছি না… তখন কিন্তু নো ভ্যানতাড়া। আমরা কাঁটায় কাঁটায় ছটায় বেরোব। কী রে দেয়া, ছটায় গেলে চলবে তো?
—এক্সেলেন্ট। চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে। দেবাশিস, পিয়ালিরাও আগে আগে চলে আসবে বলেছে।
—এবারও বিরিয়ানি হচ্ছে তো? আমার কিন্তু ডবল প্লেট চাই। বলতে বলতে ঋমের নজরে এল শ্রাবণী যেন কেমন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চটপট একটা সিগারেট বার করে ধরাল ঋতম। যেন আঙুলে তামাক-যষ্টি থাকলে কৃত্রিম খুশিকেও স্বাভাবিক করে তোলা যায়। চোখ টিপে বলল, একটু ইয়েটিয়ে রাখিস। আনন্দের দিনে শ্রাবণীকেও একটু টেস্ট করিয়ে দেব।
অতসী কফি এনেছে। সঙ্গে ঘরে ভাজা আলুর চপ।
কাপে চুমুক দিতে গিয়ে কী যেন মনে পড়ে গেছে দেয়ার। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, এতক্ষণ বসে আছি, পুচকিটাকে দেখলাম না?
ঢাউস ব্যাগ খুলে একটা পুতুল বার করেছে দেয়া, সঙ্গে চকোলেট। পুতুলটা বেশ দামি। ঋতম লক্ষ করল, পলকে শ্রাবণীর মুখে যেন আবার ছায়া। তবে পলকের জন্যই।
বলল, আবার ওসব এনেছ কেন?
—ইচ্ছে। কোথায়, পুচকিটা গেল কোথায়?
—ঘুমোচ্ছে।
—এখন? বেলা দশটায়?
—ও এই সময়েই একটু ঘুমোয়।
-—বুঝলি না, আমার মেয়ে আগের জন্মে সিধেল চোর ছিল। ঋতম অকারণে জোরে হাসল, আমার কন্যা রাতে জাগে, দিনে ঘুমোয়। যত খেলাধুলো চিল্লামেল্লি সব গভীর নিশীথে।
—সাধে বললাম, খুব জ্বালায়!
টুসকির গুণকীর্তন চলছে জোর। প্রসন্নমুখে শুনছে দেয়া। কফি চপ খেয়ে উঠে পড়ল, আজ তবে চলি? ইভনিং শিফট, বাড়ি গিয়েই আবার দৌড়তে হবে।…পরশু তাহলে দেখা হচ্ছে?
—ও শিওর। যুগলে যাচ্ছি।
দরজায় গিয়েও থামল দেয়া, ঋতম আমার সঙ্গে মোড় অবধি চল তো, ট্যাক্সি ধরে দিবি।
দেয়ার সঙ্গে একা বেরোতে হবে ভেবে অসহায় বোধ করল ঋতম। তবে মুখ ফুটে না-ও বলতে পারল না।
গলিতে বেরিয়েই দেয়া চেপে ধরেছে, অ্যাই, তুই ঠিক করে বল তো, আসছিস না কেন?
ঋতম আন্দাজ করার চেষ্টা করল সৌম্য দেয়াকে কিছু বলেছে কিনা। বুঝতে পারল না। এড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, কাজ ছিল বললাম তো।
—গুল মারিস না। দশ দিনে একদিনও তোর টিকি দেখা গেল না…! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।
—কী হবে?
—তুই-ই জানিস। কেউ হয়তো তোকে বারণ করেছে।
—আমাকে বারণ করবে? কে? কেন? ঋতম গলা কাঁপতে দিল না।
—আমাকে যে কারণে সবাই বারণ করছে। কম তো শুনছি না, শিউলিকে অফ করো, শিউলিকে ভাগাও…! দেয়া অল্প ইতস্তত করে বলল, ভাবলাম হয়তো তোকেও মাসিমা কিংবা শ্রাবণী…!
—মা খুচখাচ হয়তো কমেন্ট করে, কিন্তু কক্ষনও নাক গলায় না। আর শ্রাবণী? শ্রাবণী অত মিন নয়। শ্রাবণীর সম্পর্কে কথাটা বলতে পেরে মনে মনে একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করল ঋতম। মনে হল যেন কথাটা দিয়ে সৌম্যকেই সে আঘাত করতে পেরেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, বিশ্বাস কর, আমি একটা চাকরির ব্যাপার নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। যোগাযোগ করা, ইন্টারভিউ…কদিন খুব দৌড়তে হয়েছে।
—হয়েছে চাকরি?
—হুঁ। লেগে গেল।
—বাহ্, গুড। এবার তাহলে সন্ধেবেলা চলে আয়। শিউলির দেখাশোনাটা কর।
—শিউলিকে নিয়ে আর ভাবছিস কেন? ল্যাটা তো মোটামুটি চুকে গেল। এবার ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে হোমে দিয়ে আয়। দরকার হলে জোর কর। সারাজীবন তোর বাড়িতেই পড়ে রইল, এটা তো কোনও কাজের কথা নয়। এবার নিজের পায়ে দাঁড়াক।
—সেটা হলে তো সব থেকে ভাল হত। দেয়া ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল—শ্যামচাঁদ ধরা পড়ে তো সমস্যা আরও বেড়ে গেল। এখন সে চলবে, ওই তো মেন উইটনেস, ওকে নিয়ে রেগুলার কোর্টে ছুটতে হবে…প্রাইভেট হোম কি এসব ঝামেলা নিতে চাইবে?
—হুম্। তাও তো বটে।
—তুই ছাড়া আমার গতি নেই রে ঋতম। তোকেই আমার পাশে থাকতে হবে।
ঋতম একটুক্ষণ দম বন্ধ করে রইল। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার যে সময় হবে না রে। নতুন চাকরিটায় আমায় খুব ছুটতে হবে, একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। অর্ধেক দিন কলকাতাতেই থাকতে পারব না।
—বাকি দিন তো থাকবি। তখন আসবি।
—মনে হয় পারব না রে।
দেয়া ঝট করে ঘুরে তাকাল, তার মানে তুই আর আমার পাশে থাকতে চাস না, তাই তো?
—দ্যাখ দেয়া, রাগ করিস না, কখনও কখনও মানুষকে একা একাই চলতে হয়। তোকে ধরেই নিতে হবে তোর পাশে কেউ কোনও দিন ছিল না। থাকবেও না। ভাল কাজ কি লোকের ভরসায় হয়? যদি কেউ সাহায্য করেও, সেটা উপরি পাওনা।
দেয়া চড়াং করে রেগে গেল, জ্ঞান দিবি না, জ্ঞান দিবি না।…তোকে আমি একটু অন্যরকম ভেবেছিলাম। হাহ, তুইও তাহলে শেষ পর্যন্ত একজন অ্যাভারেজ মানুষ!
—আমি কি দাবি করেছি আমি উচ্চস্তরের মানুষ?
—চুপ কর। তুই না সাহিত্যিক? তুই না সেন্সেটিভ? কলমের ডগায় তুইনা দরদ ঝরাস?
—দেয়া শোন…আমার সিচুয়েশানটা বোঝার চেষ্টা কর।
—থাক। আমি বুঝে গেছি। তোদের সবারই কাজ আছে, আমার নেই! ঠিক আছে, ঠিক আছে, কাউকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে না। শিউলির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ি, আমাকেই শিউলির সব করতে হবে।
হনহন করে চলে যাচ্ছে দেয়া। ঋতমের পা আটকে গেল মাটিতে। চিৎকার করে বলতে চাইছে, দাঁড়া দেয়া, যাস না। সত্যি কথাটা তবে শুনে যা দেয়া…
একটি শব্দও ফুটল না গলায়। কবেই বা সে মনের কথা বলতে পেরেছে দেয়াকে?
খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে ঋতম অসাড় পায়ে ফিরল। সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। চোখ ঢেকেছে হাতের পিঠে।
হঠাৎই হাতে শ্রাবণীর ছোঁয়া, কী হল? মন খারাপ?
ঋতম হাত সরাল চোখ থেকে, নাহ। কীসের মন খারাপ?
—আমি সব বুঝতে পারি।
ঋতম নিষ্প্রভ হাসল, তুমি কিছুই বুঝতে পারো না শ্রাবণী।
—পারি পারি। যেমন ধরো, এই মুহুর্তে বুঝতে পারছি তুমি পরশু দেয়াদের বাড়ি যাবে না।
ঋতম কেঁপে গেল। আপনাআপনি চোখ সরে গেছে শ্রাবণীর চোখ থেকে।
শ্রাবণী ফিসফিস করে বলল, আরও বুঝতে পারছি তুমি আর কোনও দিনই দেয়ার বাড়ি যাবে না। কষ্ট পাচ্ছ কেন? তুমি সেখানে কেন অপমানিত হতে যাবে?
শ্রাবণী কি অন্তর্যামী? ঋতম ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল। ঈর্ষা নয়, অন্য এক সুর যেন বাজছে শ্রাবণীর গলায়! ঋতমের অপমানটা কী করে টের পেল শ্রাবণী? নিজে নিজেই কি একটা হিসেব মিলিয়ে নিয়েছে?
নিবিড় চোখে শ্রাবণীকে দেখছিল ঋতম। মাত্র আড়াই বছরেই প্রেমিকা থেকে বউ হয়ে গেছে শ্রাবণী। সাদায় কালোয় মেশানো এক রক্তমাংসের প্রতিমা। ঋতমের আশ্রয়। ঋতমের দুঃখ। সুখ।
এই বুঝি তবে দাম্পত্য!