১০. শ্রম-দিবস

দশম অধ্যায় — শ্রমদিবস

১০.১ শ্রমদিবসের সীমা

আমরা শুরুতে ধরে নিয়েছিলাম যে শ্রমশক্তিকে তার মূল্য অনুসারে ক্রয়-বিক্রয় কৰা হয়। অন্য সব পণ্যের মূল্যের মত, তার মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা। যদি শ্রমিকের দৈনিক জীবনধারণের উপায় উপকরণ উৎপাদন করতে গড়পড়তা ৬ ঘণ্টা লাগে, ত হলে তাকে দৈনিক শ্রমশক্তি উৎপাদন করতে বা তার বিক্রয়লব্ধ মূল্য পুনরুৎপাদন করতে তাকে প্রতিদিন গড়পড়তা ৬ ঘণ্টা করে কাজ করতে হবে। তার শ্রম-দবসের আবশ্যিক অংশ দাড়ায় ৬ ঘণ্টা এবং অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, এই আবশ্যিক অংশ দা চায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। এই সঙ্গে স্বয়ং শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য কিন্তু এখনো নির্দেশিত হয়নি।

ধরা যাক যে, ক খ রেখাটি আবশ্যিক শ্রম-সময়ের দৈর্ঘ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে, যেমন ৬ ঘণ্টা। ক খ রেখাটিকে ছাড়িয়ে যদ শ্রমকে ১, ৩, বা ৬ ঘণ্টা বাজানো যায়, তা হলে আমরা আরো ৩টি রেখা পাই :

১নং এম-দিবস     ২নং শ্রম দিবস     ৩নং শ্রম দিবস
ক—খ-গ     ক—খ—গ     ক—খ—গ

এই ৩টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রম-দিবস যথাক্রমে ৩, ৯ ও ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবসের প্রতিনিধিত্ব করছে। ক খ রেখাটির প্রসারিত অংশ খ গ প্রতিনিধিত্ব করছে উদ্ধও শ্রমে। যেহেতু এম-দিবস হচ্ছে ক + গ অর্থাৎ ক গ, সেইহেতু পরিবর্তনীয় রাশি এ গ-র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এম-দিবসেও পরিবর্তিত হয়। যেহেতু কথা হচ্ছে স্থির, সেইহেতু ক খ-র সঙ্গে এ গ-র অনুপাত সব সময়েই হিসাব করা যায়। ১নং শ্রমদিবসে, ক -র সঙ্গে এই অনুপাত দাড়ায় ৫, ২নং শ্রম-দিবস ২, ৩নং এম-দিবসে। অধিকন্তু যেহেত উদ্ধও শ্রম-সময়। আবশ্যিক শ্রম-সময়। হারটি নির্ধারণ করে, সেইহেতু এই শেষোক্তটি নির্দেশিত হয় ক -র সঙ্গে খ গ অনুপাতের দ্বারা। ৩টি ভিন্ন শ্রম-দিবসে উদ্ধও-মূল্যের হারটি দাড়ায় যথাক্রমে ১৬, ৫০ এবং ১০। অন্যদিকে উত্তমূল্যের হারটি একক ভাবেই আমাদের কাছে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য নির্দেশ করে না। যদি এই হার হত ধরা যাক, ১০০ শতাংশ, তা হলে এম-দিবস হতে পারত ৮, ১০, ১২ কিংবা আরো বেশি ঘণ্টা। তা থেকে এটা বোঝা যেত যে শ্রম-দিবসের দুটি সংগঠনী অংশ, যথা আবশ্যিক শ্রম-সময় উত্তম-সময়, দৈর্ঘ্যে সমান, কিন্তু এটা বোঝা যেত না যে এই দুটি অংশের প্রত্যেকটি কতটা দীর্ঘ।

অতএব, শ্রম-দিবস একটি স্থির রাশি নয় বরং একটি পরিবর্তনীয় রাশি। তার একটি অংশ নিশ্চয়ই নির্ধারিত হয় স্বয়ং শ্রমিকের শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। কিন্তু তার মোট পরিমাণ পরিবর্তিত হয় উত্ত শমের মেয়াদের সঙ্গে। সুতরাং এম-দিবস নির্ধারণযোগ্য কিন্তু, আপাততঃ অনির্ধারিত।[১]

যদিও শ্রম-দিবস একটি অব্যয় রাশি নয়, একটি বহতা রাশি, তা হলেও অন্য দিকে, তা কেবল কয়েকটি সীমার মধ্যেই তা পরিবর্তিত হতে পারে। ন্যূনতম সীমাটি অবশ্য অনির্দেশ্য, যাই হোক, যদি আমরা প্রসারিত অংশ খগ-কে অর্থাৎ উত্তমকে ধরি=০, তা হলে আমরা একটি ন্যূনতম সীমা পাই, যা হল দিনের সেই অংশটি যখন শ্রমিক তার নিজের ভরণপোষণের জন্য আবশ্যিক ভাবেই কাজ করবে। যাই হোক, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিতে, এই আবশ্যিক এম কেবল একটি এম-দিবসের অংশবিশেষই হতে পারে, স্বয়ং শ্রম-দিবসটিকে কখনো এই ন্যনতম সীমায় পর্যবসিত করা যায় না। অপর পক্ষে, শ্রম-দিবসের একটি উচ্চতম সীমা আছে। একটি বিন্দুর বাইরে আর তাকে দীর্ঘায়িত করা যায় না। এই উচ্চতম সীমাটি দুটি শর্তের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথমত, এম-শক্তির শারীরিক সীমাবদ্ধতার দ্বারা। একটি প্রাকৃতিক দিবসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন মানুষ তার জীবনীশক্তির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মাত্র ব্যয় করতে পারে। যেমন একটি ঘোড়া দিনের পর কেবল ৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে পারে। দিনের একটা অংশে এই শক্তিকে বিশ্রাম করতে হবে, ঘুমোতে হবে; আর এক অংশে মানুষটিকে অন্যান্য দৈহিক প্রয়োজন মেটাতে হবে, নিজেকে খাওয়াতে, খোয়াতে এবং পরাতে হবে। এই সব বিশুদ্ধ দৈহিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার পথে বিবিধ নৈতিক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক তাগিদগুলি মেটাবার জন্যও তার সময় চাই, যে-তাগিদগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় সামাজিক অগ্রগতির সার্বিক পরিস্থিতির দ্বারা। সুতরাং শ্রম-দিবসের হ্রাস-বৃদ্ধি শারীরিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ওঠা-নামা করে। কিন্তু এই উভয়বিধ সীমাগত শর্তগুলি খুবই স্থিতিস্থাপক প্রকৃতির এবং সর্বাধিক অবকাশের সুযোগ দেয়। অতএব, আমরা দেখতে পাই ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬, ১৮ ঘণ্টার অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যর শ্রম-দিবস।

ধনিক শ্রমশক্তিকে ক্রয় করেছে দৈনিক ভিত্তিতে। একটি এম-দিবসের শ্রম শক্তির ব্যবহার-মূল্য তার সম্পত্তি। সুতরাং সে শ্রমিককে দিয়ে তার জন্য একটি দিন জুড়ে কাজ করার অধিকার অর্জন করেছে। কিন্তু একটি এম-দিবস কাকে বলে?[২]

সর্বক্ষেত্রেই তা একটি প্রাকৃতিক দিবসের তুলনায় ছোট। কিন্তু কতটা ছোট? এই পরম প্রশ্নটি সম্পর্কে শ্রম-দিবসের আবশ্যিক সীমা সংক্রান্ত প্রশ্নটি সম্পর্কে ধনিকের নিজস্ব মতামত আছে। ধনিক হিসাবে সে কেবল মূলধনের ব্যক্তি-মূর্তি। তার আত্মা হচ্ছে মূলধনের আত্মা। কিন্তু মূলধনের আছে একটি মাত্র জৈব তাড়না, মূল্য এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির প্রবণত, তার স্থির উপাদানকে দিয়ে উৎপাদনের উপায়সমূহকে দিয়ে, যত বেশি সম্ভব উত্ত-শ্রমকে আত্মীকৃত করে নেওয়া।[৩]

মূলধন হল মৃত শ্রম, যা রক্তচোষা বাদুড়ের মত কেবল জীবিত শ্রমকে চুষেই বেঁচে থাকে, এবং যত বেশি বাচে তত বেশি চুষে নেয়। শ্রমিক যে সময় কাজ করে সেই সময়টা ধনিক তার কাছ থেকে ক্রয় করা শ্রমশক্তিটা পরিভোগ করে।[৪]

শ্রমিক যদি তার ব্যবহারযোগ্য এম নিজের জন্যই পরিভোগ করে, তা হলে সে ধনিককে লুণ্ঠন করে।[৫]

ধনিক তখন পণ্য-বিনিময়ের নিয়মটির আশ্রয় নেয়। অন্যান্য সকল ক্রেতার মত সে-ও তার পণ্য থেকে যথাসম্ভব সর্বাধিক সুবিধা সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়। সহসা উখিত হয় শ্রমিকের কণ্ঠস্বর, যা এতকাল রুদ্ধ ছিল উৎপাদন-প্রক্রিয়াব ঝড়ে ও তাড়নায়।

যে-পণ্যটি আমি তোমার কাছে বিক্রি করেছি, তা এই ব্যাপারে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে আলাদা যে আমরা এই পণ্যটি সৃষ্টি করে ব্যবহার-মূল্য এবং এমন একটি মূল্য যা তার নিজের মূল্যের চেয়ে বেশি। সেই কারণেই তুমি তা ক্রয় করেছ। তোমার কাছে যা দেখা দেয় মূলধনের স্বতঃস্ফুর্ত সম্প্রসারণ হিসাবে, আমার কাছে তা এম-শক্তির বাড়তি ব্যয়। তুমি এবং আমি বাজারে কেবল একটি নিয়মই জানি-পণ্য-বিনিময়ের নিবমটি। এবং পণ্যের পরিভোগের মালিক বিক্রেতা নয় যে তা হাতছাড়া করে, মালিক হল ক্রেতা-যে তা করায়ত্ত করে। সুতরাং তুমি হলে আমার দৈনিক শ্রম শক্তি ব্যবহারের অধিকারী। কিন্তু এই শ্রমশক্তির জন্য তুমি প্রতিদিন যে-দাম দেবে ত! এমন হতে হবে যা দিয়ে আমি দৈনিক তা পুনরুৎপাদন করতে পারি, এবং, আবাব তা বিক্রি করতে পারি। বয়স ইত্যাদির দরুন স্বাভাবিক ক্ষয় ছাডা, আমি যেন পবের দিন আজকের মতই স্বাভাবিক পরিমাণে শক্তি, স্বাস্থ্য ও সজীবতা নিয়ে কাজ করতে পাবি! তুমি আমার কানে নিরন্তর “ঞ্চয়” ও “ভোগ-সংবরণ’-এর বাণী শোনাও। ভাল কথা! একজন বুদ্ধিমান সঞ্চয়ী মালিকের মত আমার একমাত্র ধন যে শ্রমশক্তি তাব সাশ্রয় করব এবং বোকার মত তা অপচয় করা থেকে সব সময়ে নিজেকে সংবরণ করব। আমি প্রতিদিন ব্যয় করব, গতিশীল করব, সক্রিয় করব কেবল সেই পরিমাণ শ্রমশক্তি যা তার স্বাভাবিক স্থায়িত্ব ও স্বাস্থ্যসম্মত বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শ্রম দিবসের সীমাহীন সম্প্রসারণের দ্বার। তুমি এক দিনে এমন পরিমাণ শ্রমশক্তির ক্ষয় করে দিতে পার যা পূরণ করতে আমার তিন দিনেরও বেশি সময় লাগবে। যা তুমি এমের অঙ্কে লাভ কর, আমি তা জীবনশক্তির অঙ্কে হারাই। আমার শ্রমের ব্যবহার এবং তার বিনষ্টি সাধন দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যদি একজন গড় শ্রমিক ( যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ কাজ করে ) গড়ে ৩০ বছরকাল বাঁচে, তা হলে আমার শ্ৰম-শক্তির মূল্য যা তুমি আমাকে দিনকে দিন দাও, তা বাড়ায় তার মোট মূল্যেরতড়ত অথবা ত কিন্তু যদি তুমি ১০ বছরে তা পরিভোগ কর এবং দৈনিক তার মোট মূল্যের তত ভাগের বদলে দাও তা হলে তুমি আমাকে দিচ্ছ তার মোট মূল্যের উ ভাগ এবং প্রতিদিন লুণ্ঠন করছ আমার পণ্যের ১ ভাগ। তুমি

আমাকে দিচ্ছ এক দিনের শ্রমশক্তির দাম, অথচ ব্যবহার করছ ৩ দিনের শ্রমশক্তি। এটা আমাদের চুক্তির তথা বিনিময়-নিয়মের পরিপন্থী। সুতরাং আমি দাবি করছি একটি স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের শ্রম-দিবস এবং আমি এটা দাবি করছি তোমার সহৃদয়তার কাছে কোনো আবেদন ছাড়াই, কেননা আর্থিক ব্যাপারে ভাবাবেগের স্থান নেই। হতে পারে তুমি একজন আদর্শ নাগরিক, হয়ত পশুকেশ-নিবারণী সমিতির একজন সদস্য, অধিকন্তু, পবিত্রতার খ্যাতিতে খ্যাতিমান, কিন্তু আমার মুখোমুখি যে জিনিসটির তুমি প্রতিনিধিত্ব কর, তার বুকের ভিতরে কোনো হৃদয় নেই। সেখানে যে-জিনিসছি স্পন্দত হয় বলে মনে হয় সেটি আমারই হৃদয়-স্পন্দন। আমি দাবি করি একটি স্বাভাবিক শ্রম-দিবস, কেননা, অন্য প্রত্যেকটি বিক্রেতার মতই আমিও দাবি করি আমার পণ্য মূল্য।[৬]

আমরা তা হলে দেখছি যে, চরম নমনীয় সীমানা ছাড়া, পণ্য বিনিময়ের প্রকৃতি নিজে এম-দিবসের উপরে, উদ্ধও শ্রমের উপরে কোনো সীমা আরোপ করে না। যখন সে শ্রম দিবসকে যথাসম্ভব দীর্ঘ করতে চায় এবং যখনি সম্ভব, একটি এম-দিবস থেকেই দুটি শ্রম-দিবস আদায় করতে চায়, তখন সে ক্রেতা, হিসাবে তার অধিকার প্রয়োগ করে। অন্য দিকে বিক্রীত পণ্যটির স্ব-বিশেষ প্রকৃতিই ক্রেতা-কর্তৃক সেই পণ্যের পরিভোগর উপরে একটি সীমা টেনে দেয় এবং শ্রমিক যখন শ্রম-দিবসকে, একটি স্বাভাবিক দৈর্ঘে শ্ৰম-দিবসে কমিয়ে আনতে চায়, তখন সেও বিক্রেতা হিসাবে তার অধিকার প্রয়োগ করে। সুতরাং এখানে একটি বিরোধিতা থেকে যায়, অধিকারের বিরুৰে অধিকার—দুটিই অবশ্য বহন করে বিনিময়ের নিয়মের ছাপ। দুটি সমান অধিকারের মধ্যে এই সংঘাত শক্তির দ্বারা মীমাংসিত হয়। এই কারণেই, যাকে বলা হয় শ্রম-দিবস, তার নির্ধারণের ঘটনাটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে একটি সংগ্রামের পরিণতি হিসাবে-যৌথ মূলধন অর্থাৎ ধনিক-শ্রেণী এবং যৌথ শ্রম অর্থাৎ শ্ৰমিক-শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম হিসাবে।

————

১. একদিনের শ্রম কথাটি অস্পষ্ট; তা দীর্ঘও হতে পারে, হ্রস্বও হতে antal” (“An Essay on Trade and Commerce,” Containing Observations on Taxes &c. London, 1770, p. 73 )

২. এই প্রশ্নটি স্যার রবার্ট পীল বার্মিংহাম বণিক সমিতির কাছে যে বিখ্যাত প্রশ্নটি করেছিলেন একটি পাউণ্ড কাকে বলে? ‘র চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা গিয়েছিল কেবল এই কারণে যে অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে পীল যেমন অজ্ঞ ছিলেন, বার্মিংহামের “ক্ষুদে শিলিং-ব্যাপারীরাও তেমন অজ্ঞ ছিল।

৩. ধনিকের লক্ষ্য হচ্ছে তার ব্যয়িত মূলধনের সাহায্যে যত বেশি সম্ভব এমের পরিমাণ আয়ত্ত করা (d obtenir du capital depense la plus forte somme de travail possible ).” J. G. courcelle seneuil, “Traite theorique et pratique des entreprises industrielles” 2nd ed. paris 1857, p. 63)

৪. “এক দিনে এক ঘণ্টার এম হারানো একটি বাণিজ্যিক রাষ্ট্রের পক্ষে বিরাট ক্ষতি। এই রাজ্যের গরিব মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে কল-কারখানার শ্রমিক সংখ্যার মধ্যে বিলাস-দ্রব্যের বিপুল পরিভোগ চালু আছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের সময়ও পরিভোগ করে—যেটা হল সব রকমের পরিভোগর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পরিভোগ।” An Essay on Trade and Commerce &c.”, p. 47 and 153.

৫. “Si le manouvrier libre prend un instant de repos, l’econo mie sordide qui le suit des yeux avec inquietude pretend qu’il la vole.” N. Linguet, “Tborie des Lois Civiles &c.” London 1767, t. II p. 466.

৬. শ্রম-দিবসকে ৯ ঘণ্টায় হ্রাস করার দাবিতে ১৮৬০-৬১ সালে লণ্ডনের নির্মাণকামীরা যে বিরাট ধর্মঘট করেছিল, সেই ধর্মঘট চলাকালে তাদের কমিটি একটি ইশতাহার প্রকাশ করেছিল, যার মধ্যে বিস্তৃত হয়েছিল আমাদের শ্রমিকের এই যুক্তি। ঐ ইশতাহারটিতে পরিহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে নির্মাণ-শিল্পের মালিকদের মধ্যে যে-লোকটা সবচেয়ে বেশি মুনাফা-শিকারী, সেই লোকটিই—জনৈক স্যার এম পেটোই হচ্ছে পবিত্রতার খ্যাতিতে খ্যাতিমান। ( এই একই পেটো ১৮৬৭ সালে স্ট্রাউসবাগ এর নির্দেশিত পথে অন্তিম দশাপ্রাপ্ত হলেন।)

.

.

১০.২  উদ্বৃত্ত শ্রমের লালসা কারখানামালিক এবং বয়ার্ড

উদ্বৃত্ত শ্রম মূলধনের উদ্ভাবন নয়। যেখানেই সমাজের একটি অংশ উৎপাদনে উপায়গুলির একচেটিয়া মালিকানা ভোগ করে, সেখানেই শ্রমিককে, সেই শ্রমিক স্বাধীন বা গোলাম যাই হোক না কেন, তাকে নিজের ভরণপোষণের জন্য আবশ্যক শ্রম-সময়ের সঙ্গে উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকদের প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু উদ্ধও শ্রম-সময় দিতে হয়,[১]–এই মালিক এথেনীয় প্যাট্রিস হোন, ইট্রাস্কান, পুরোহিত, রোমের নাগরিক, নর্মান ভূস্বামী, আমেরিকার দাস-মালিক, ওয়াল্লা-চিয়ান বয়ার্ড, আধুনিক জমিদার অথবা ধনিক, যিনি হোন না কেন[২] কিন্তু এটি বেশ বোঝা যায় যে সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠনের কোন একটি বিশেষ অবস্থায় যেখানে উৎপন্ন দ্রব্যের বিনিময়মূল্য প্রাধান্য লাভ না করে ব্যবহার-মূল্যেরই প্রাধান্য আছে, সেখানে উত্ত এম বিশেষ একপ্রস্ত প্রয়োজন দ্বারা সীমাবদ্ধ, ঐ প্রয়োজনগুলির কমবেশি হতে পারে কিন্তু উৎপাদনের প্রকৃতি এমন যে সেখানে উদ্ধত্ত শ্রমের জন্য সীমাহীন লালসা দেখা যায় না। এইজন্য প্রাচীন যুগে শুধু সেখানেই উপরি-খাটুনি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্ট স্বতন্ত্র অর্থরূপে বিনিময়মূল্য হস্তগত করা, যেমন, সোনা ও রূপোর উৎপাদন। বাধ্যতামূলক আমাণ কাজ হচ্ছে এক্ষেত্রে উপরি-খাটুনির একটি প্রচলিত ধরন, এর প্রমাণ পেতে ভিয়েভোরা সিকিউলা-এর রচনা পড়াই যথেষ্ট।[৩] তবু প্রাচীন যুগে এই ব্যাপাবগুলি হচ্ছে ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু যেইমাত্র এইসব লোক যাদের উৎপাদন-প্রণালী এখনও দাস-এম চুক্তি-শ্রম প্রভৃতি নিম্নস্তরের রূপগুলির মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে, এরা যখন ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত আন্তর্জাতিক বাজারের আবর্তনের মধ্যে এসে পড়ে এবং তাদের উৎপন্ন জিনিস রপ্তানির জন্য বিক্রয় করাই মূল উদ্দেশ্য হয়েও ওঠে, তখন সভ্যযুগের উপরি-খাটুনির ভয়াবহতার সঙ্গে যুক্ত হয় দাসপ্রথা ভূমিদাসপ্রথা প্রভৃতির বর্বরোচিত ভয়াবহতা। এইজন্য দেখা যায় যে যতদিন পর্যন্ত উৎপাদনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষ স্থানীয় পরিভোগ, ততদিন পর্যন্ত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলিতে নিগ্রো শ্রমিকদের মধ্যে পিতৃপ্রধান সামাজিক চরিত্রের কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু যেমনি এই রাজ্যগুলিতে তুলোর রপ্তানি পরম স্বার্থ হয়ে উঠতে থাকল, ঠিক সেই অনুপাতেই নিগ্রোদের উপরি খাটুনি এবং মাত্র সাতবছরের পরিশ্রমে তাদের জীবনযাত্রার সমাপ্তি হয়ে উঠল একটি পরিকল্পিত পদ্ধতির হিসেবের ব্যাপার। এখন আর প্রশ্ন এই রইল না যে তার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহার-যোগ্য দ্রব্য পেতে হবে। এখন প্রশ্ন হয়ে উঠল স্বয়ং উদ্ধও শ্রমের উৎপাদন ঠিক এই জিনিসটি চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, যেমন দানিয়ুব নদীর পাশের রাজ্যগুলিতে ( বতমান রুমানিয়)।

দানিয়ুবের তীরবর্তী রাজ্যগুলিতে উদ্ধও শ্রমের প্রতি লোভের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের কারখানাগুলিতে ঐ একই লোভের তুলনা করলে একটি গুরুত্ব আছে, কারণ চুক্তিবদ্ধ শ্রমে উদ্বৃত্ত শ্রমের একটি স্বতন্ত্র ও প্রত্যক্ষ রূপ ছিল।

ধরা যাক শ্রম-দিবসের মধ্যে ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রম এব’ ৬ ঘন্ট! উদ্ধও শ্রম আছে। এই ক্ষেত্রে প্রাত সপ্তাহে একজন স্বাধীন শ্রমিক ধনতান্ত্রিক মালিককে ৬ X৬ অথবা ৩৬ ঘণ্টা উত্ত শ্রম দেয়। একই ফল হত যদি সে সপ্তাহে ৩ দিন নিজের জন্য কাজ করত এবং ৩ দিন মূলধনকে বিনামূল্যে দিয়ে দিত; কিন্তু এটি ওপর থেকে দেখলে ধরা যায় না। উদ্ধত শ্রম ও আবশ্যিক শ্রম একে অপরের সঙ্গে মিশে থাকে। অতএব, আমি ঐ একই সম্পর্ককে নিমোক্তভাবে প্রকাশ করতে পারি, যেমন শ্রমিক তার প্রতি মিনিট কাজের মধ্যে ৩০ সেকেণ্ড নিজের জন্য কাজ করে এবং ৩০ সেকেণ্ড ধনকের জন্য করে ইত্যাদি। কিন্তু কভি বা চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অন্যরকম; ওয়াল্লাচিয়ান কৃষক নিজের ভরণপোষণের জন্য যে আবশ্যিক শ্রম কবে তা স্পষ্টতঃ ভূস্বামীর জন্য করা উত্ত শ্রম থেকে পৃথক। প্রথমটি সে করে নিজের ক্ষেতে, দ্বিতীয়টি ভূস্বামীর জমিতে। অতএব উভয় প্রকারের শ্রম-সময় পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে থাকে। কবুভি-র ক্ষেত্রে উও শ্রম পরিষ্কারভাবে আবশ্যিক শ্রম থেকে পৃথক। এতে অবশ্য উদ্ধত্ত শ্রম বা আবশ্যিক শ্রমের পরিমাণগত সম্পর্কের কোন তারতম্য হয় না। সপ্তাহে ৩ দিনের উত্ত এম সেই ৩ দিনই থেকে যায় যার থেকে শ্রমিক কোন সমার্ঘ সামগ্রী, পায় না, সেই শ্রমিককে কভি অথবা মজুরি-প্রথা যে-কোন নামেই কাজ করানো হোক না কেন। কিন্তু ধনিকের ক্ষেত্রে উদ্ধও শ্রমের লালসা ফুটে ওঠে যখন শ্রম-দিবসকে সীমাহীনভাবে সম্প্রসারণের চেষ্টা চলে ভূস্বামীর ক্ষেত্রে অনেক সোজা সুজিভাবে কভির দিনের সংখ্যা বাড়াবার জন্য প্রত্যক্ষভাবে তাডা দেওয়া হয়।[৪]

দানিয়ুবের তীরবর্তী রাজ্যগুলিতে কভি-র সঙ্গে শস্যকর ও দাসত্বের অন্যান্য ব্যপারগুলি মিশে থাকত, কিন্তু কভি-ই ছিল শাসক-শ্রেণীকে দেয় সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ কর। যেখানে এই অবস্থা দেখা যেত, সেখানে কদাচিৎ ভূমিদাসত্ব থেকে করভি দেখা দিত; তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যেত যে, কবুভি থেকেই ভূমি দাসত্বের উদ্ভব হচ্ছে।[৫] রুমানিয়ার প্রদেশগুলিতেও ঠিক এই ব্যাপারটি ঘটেছিল। তাদের উৎপাদনের আদিম পদ্ধতির ভিত্তি ছিল জমির সমষ্টিগত মালিকানা, কিন্তু এই মালিকানার রূপটি স্লাভ বা ভারতীয়ের মতো নয়। জমির কিছু অংশ সমাজের লোকের। স্বাধীন স্বত্বাধিকারী হিসেবে পৃথক পৃথক চাষ করতে, আর একটি অংশ (অ্যাগার পাবলিকা) তারা সমষ্টিগতভাবে চাষ করত। এই সমষ্টিগত পরিশ্রম থেকে পাওয়া ফসল অংশতঃ অজন্ম ও অন্যান্য দুর্বিপাকের সময় ব্যবহারের জন্য সঞ্চিত থাকত, অংশতঃ একটি সাধারণ পোলায় সঞ্চয় করে যুদ্ধের খরচ, ধর্মানুষ্ঠান ও অন্যান্য সাধারণ ব্যায় নির্বাহ করা হত। কালক্রমে সময়-নায়ক ও ধর্মযাজকেরা সাধারণ জমির সঙ্গে এই এমকেও আত্মসাৎ করল। সাধারণ জমিতে স্বাধীন কৃষকের শ্রম হয়ে উঠল সাধারণ জমির অপহরণকারীদের প্রাপ্য বা কভি। শীঘ্রই এই কভি-ই হয়ে উঠল একটি দাসত্বমূলক সম্পর্ক যার অস্তিত্ব আইনের মধ্যে না থাকলেও বাস্তবে ছিল, যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর মুক্তিদাতা হিসাবে রাশিয়া ভূমিদাসত্ব রদ করার অছিলায় এটিকে আইনসঙ্গত করল। কভি সংক্রান্ত আইন যেটি রাশিয়ার সেনাপতি কিসেলের ১৮৩১ খ্ৰীষ্টাব্দে ঘোষণা করেন, ঐটি অবশ্য ভূস্বামীদের-ই নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। এইভাবে রাশিয়া এক ধাক্কায় দানিয়ুবের তীরবর্তী প্রদেশগুলির ভূস্বামীদের হৃদয় জয়। করল এবং ইউরোপের সর্বত্র উদারতার মুখোশধারীদের বাহবা পেল।

কভি সংক্রান্ত এই আইন যার নাম হচ্ছে ‘রেগ লিমেন্ট অর্গানিক’, এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ওয়াল্লাচিয়ান কৃষককে অন্যান্য বহুবিধ জিনিসপত্র দেবার বাধ্য বাধকতা ছাড়াও ভূস্বামীকে দিতে হত : (১) ১২ দিন সাধারণ শ্রম; (২) ১ দিন ক্ষেতের কাজ; (৩) ১ দিন কাঠ বহন। সর্বসাকুল্যে বছরে ১৪ দিন। অর্থততে গভীর অন্তদৃষ্টি নিয়েই এম-দিবসকে এখানে তার মামুলি অর্থে নেওয়া হয়নি, একটা গড়পড়তা দৈনিক উৎপাদন উৎপন্ন করতে যতটা সময় লাগে সেই অর্থে, এবং ঐ গড়পড়তা দৈনিক উৎপাদন এত ধূর্ততার সঙ্গে নির্ধারিত হয় যে কোন দৈত্যও ১৪ ঘণ্টা খেটে সে কাজ করতে পারে না। সাদা কথায় রেগ লিমেন্ট নিজেই খাঁটি রুশীয় পরিহাসের সঙ্গে ঘোষণা করছে যে ১২টি শ্রম-দিবস বললে বুঝতে হবে ৩৬ দিনের কায়িক শ্রমের উৎপন্ন জিনিস, ক্ষেত-খামারে একদিনের শ্রম মানে ৩ দিনের শ্রম এবং একদিনের কাঠ বওয়া ঐ একই অর্থে তার তিনগুণ। সর্বসাকুল্যে ৪২ দিনের বেগার খাটুনি বা কভি। এর সঙ্গে অবশ্য যযাগ করতে হবে তথাকথিত ‘জোবাগী অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে ভূস্বামীর জন্য যে-সব কাজকর্ম করতে হত। নিজ নিজ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যেকটি গ্রামকে বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে এই অতিরিক্ত বেগারের দরুন বছরে ১৪ দিন করে দিতে হত। এইভাবে নির্দিষ্ট কভি ছিল বৎসরে ৫৬টি শ্রম-দিবস। কিন্তু জলবায়ুর কঠোরতার জন্য ওয়াল্লাচিয়ার একটি কৃষি-বৎসরে মাত্র ২১ দিন আছে, যার মধ্যে রবিবার ও। ধর্মানুষ্ঠানে ৪ টি দিন চলে যায়, গড়ে ৩০টিতে খারাপ আবহাওয়া থাকে, সব মিলিয়ে ৭০ দিন কোনো কাজে আসে না। তাহলে থাকে ১৪ . টি শ্রম-দিবস। কবুভির সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের অনুপাত হচ্ছে ওই অথবা ৬৬ শতাংশ এতে ইংল্যাণ্ডের কৃষি শ্রমিক অথবা কারখানা-শ্রমিকের শ্রম থেকে পাওয়া উদ্বৃত্ত মূল্যের চেয়ে অনেক কমই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এইটি হচ্ছে শুধুমাত্র আইন-সম্মত কভি। এবং ইংল্যাণ্ডের কারখানা-আইনের চেয়ে অনেক উদারতার সঙ্গে, রেগ লিমেন্ট অর্গানিক এই আইন ফাকি দেবার সুবিধাজনক রাস্তা রেখেছিল। ১২ দিনকে ৫৬ দিনে পরিণত করে তারপর আবার এই ৫৬টি বেগার দিনের প্রত্যেকটি দিনের কাজ এমনভাবে করান হত যাতে একদিনের কাজ একটি অংশ পরের দিন পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ একদিনে যে পরিমাণ জমির আগাছা তুলতে হয়, তাতে, বিশেষতঃ ভুট্টার ক্ষেতে, লাগে দ্বিগুণ সময়। কৃষিতে কোন কোন গ্রমের ক্ষেত্রে আইনসঙ্গতভাবে দিনের কাজকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে শ্রমের দিন শুরু হয় মে মাসে এবং শেষ হয় অক্টোবরে। মোল্ডাভিয়ার অবস্থা আরও সাংঘাতিক। ‘বিজয়মদে মত্ত এক ভূস্বামী চিৎকার করে বলেছিলেন, যে রেগ লিমেন্ট অর্গানিকে কভি-র ১২ দিন বৎসরে ৩৬৫ দিনে দাড়ায়।[৬]

দানিয়ুবিয়ান প্রদেশসমূহের রেগ, লিমেন্ট অর্গানিক, যার প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদকে আইনে পরিণত করা হয়েছে, সেটি যদি হয় উদ্ব,ত্ত শ্রমের লালসার ইতিবাচক প্রকাশ, তাহলে ইংলণ্ডের কারখানা-আইনগুলি হচ্ছে ঐ একই লালসার নেতিবাচক প্রকাশ। ধনিক ও জমিদার শাসিত একটি রাষ্ট্রের দ্বারা প্রণীত এই আইনগুলি বলপূর্বক শ্রম দিবসকে সীমাবদ্ধ করে মূলধন কর্তৃক শ্রম শক্তিকে যথেচ্ছভাবে শোষণের লালসাকে খর্ব করে। শ্রমিক-আন্দোলন, যা প্রত্যহ অধিকতর শংকাজনক হয়ে উঠ ছিল, সেই আন্দোলন ছাড়াও কারখানায় শ্রমের ঘণ্টা সীমাবদ্ধ করায় প্রয়োজন হয়েছিল সেই তাগিদ থেকে, যার ফলে ইংল্যাণ্ডের ক্ষেতগুলি আগাছায় ভরে গিয়েছিল। লুণ্ঠনের একই অন্ধ প্রবৃত্তি প্রথম ক্ষেত্রে মাটিকে শুষে অনুর্বর করেছিল এবং অপরক্ষেত্রে জাতির প্রাণশক্তির মূল পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছিল। একদিকে যেমন মাঝে মাঝে মহামারীর প্রাদুর্ভাব অন্যদিকে তেমন জার্মানি ও ফ্রান্স সামরিক মানের অধোগতি এই এই সত্যকে প্রকট করে তোলে।[৭]

১৮৫৩ সালে কারখানা-আইন যেটি এখনো (১৮৬৭) বলবৎ আছে, তদনুযায়ী গড় শ্রম-দিবস হচ্ছে ১০ ঘণ্টা, অর্থাৎ প্রথম পাঁচ দিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যো ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা যার কাছে প্রাতঃরাশের জন্য আধঘণ্টা এবং ডিনারের জন্য আধঘণ্টা ছুটি এবং সেইজন্য শ্রম-দিবস হচ্ছে ১০ ঘণ্টা এবং শনিবারের জন্য ৮ঘন্টা বাকি থাকছে, আধঘণ্টা প্রাতঃরাশের সময় বাদ দিয়ে সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। অতএব থাকছে ৬০টি শ্রম-ঘণ্টা, প্রথম পাচদিনের প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা এবং শেষ দিনে ৭ ১/২ ঘণ্টা।[৮] এই আইনগুলির কয়েকজন অভিভাবক নিযুক্ত হলেন, এরা প্রত্যক্ষ ভাবে স্বরাষ্ট্র সচিবের অধীন কারখানা-পরিদর্শক এবং পার্লামেন্টের হুকুমে এদের যান্যাসিক রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয়। এরা উদ্বৃত্ত শ্রমের জন্য ধনিকের লালসায় নিয়মিত সরকারী তথ্য সরবরাহ করেন।

এখন একবার কারখানা পরিদর্শকদের বক্তব্য শোনা যাক।[৯] প্রতারক কারখানা মালিক সকাল ৬টার ১৫ মিনিট আগে ( কখনো বেশি, কখনো কম) কাজ শুরু করে এবং ১৫ মিনিট পরে কাজ শেষ করে। প্রাতঃরাশের আধ ঘণ্টার শুরুতে পাঁচ মিনিট এবং শেষে পাঁচ মিনিট সে কেটে নেয় এবং প্রধান আহারের জন্য নির্দিষ্ট এক ঘণ্টার শুরুতে দশ মিনিট এবং শেষে দশ মিনিট ফাকি দেয়। শনিবার বেলা ১টার পর সে আরও ১৫ মিনিট ( কখনো বেশি, কখনো কম ) কাজ করায়।

এইভাবে তার লাভ হয়,—

সকাল ৬টার আগে ——-  ১৫ মিনিট
সন্ধ্যা ৬টার পরে———১৫ মিনিট
প্রাতঃরাশের সময়——–১০ মিনিট
 মধ্যাহ্ন ভোজের সময় —-২০ মিনিট
—————————–
 মোট   ৬০ মিনিট

৫ দিনে—৩০০০ মিনিট

শনিবার সকাল ৬টার আগে ——-১৫ মিনিট
 প্রাতঃরাশের সময় ——–১০ মিনিট
বেলা ২টার পরে ———১৫ মিনিট
———————————
মোট     ৪০ মিনিট

সপ্তাহে –৩৪০ মিনিট

অথবা সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট যাতে বৎসরে ৫ টি কাজের সপ্তাহে ( দুটি সপ্তাহ ছুটি সাময়িক বন্ধের জন্য ) এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭টি শ্রম-দিবস।

“প্রতিদিন ৫ মিনিটের মাথায় বাড়তি খাটুনিকে সপ্তাহের সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে বছরের ২২ দিনের উৎপাদনের সমান হয়।

“সকাল ৬টার আগে, বিকেল ৬টার পরে এবং খাবার সময়ের আগে ও পরে অল্প অল্প সময় নিয়ে দিনে যদি বাড়তি ১ ঘণ্টা হয় তাহলে তাতে বছরে প্রায় ১৩ মাসের সমান হয়।”

সংকটের সময়ে যখন উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং কারখানাগুলি ‘কম সময় অর্থাৎ সপ্তাহের একটি অংশমাত্র কাজ চালায়, এতে কিন্তু শ্ৰম-দিবসকে বাড়াবার প্রবণতা কমে না। ব্যবসায়ে যত মন্দা আসে ততই চলতি ব্যবসায়ে বেশি বেশি লাভের চেষ্টা করতে হয়। যত কম সময় কাজ চলে তত বেশি ঐ সময় থেকে, উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বের করতে হয়।

এই জিনিসটাই ১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত সংকটের যুগে কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্টে ফুটে উঠেছে :

“এটি একটি অসঙ্গতি বলে মনে হতে পারে যে যখন ব্যবসায়ে এত মন্দা তখনো বাড়তি খাটুনি চলতে পারে। কিন্তু ঐ মন্দার জন্যই অসৎ লোকের! আইন লংঘন করে যাতে তারা বাড়তি মুনাফা পেতে পারে … পূর্ববর্তী ৬ মাসে, লিওনার্ড হনরি বলেছেন, আমার জেলায় ১২২টি কারখানা উঠে গিয়েছে; ১৪ ৩ টি মাত্র চালু ছিল তবু আইনসঙ্গত ঘণ্টার পরেও বাড়তি খাটুনি চলেছে।”[১৩]

মি: হাউয়েল বলেছেন, “বাণিজ্যে মন্দার জন্য বেশির ভাগ সময় অনেক কারখানা একেবারে বন্ধ ছিল এবং তার চেয়ে একটি বড় সংখ্যার কারখানা অল্প সময় কাজ চালাত। কিন্তু আমি ঠিক আগের মতই অভিযোগ পেয়ে চলেছি যে বিশ্রাম ও আহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় কেটে শ্রমিকদের প্রতিদিন আধ ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা বঞ্চিত করা হচ্ছে।[১৪] ১৮৬১-১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভয়াবহ তুলো-সংকটের সময় অপেক্ষাকৃত অল্প হারে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।[১৫] যখনি আহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অথবা অন্য কোন অবৈধ সময়ে দেখা যায় যে শ্রমিকরা কারখানার কাজ করছে তখন এরকম কৈফিয়তও দেওয়া হয় যে শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ে কিছুতেই কারখানার কাজ ত্যাগ করে না এবং কাজ বন্ধ করাবার জন্য { যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা ইত্যাদি) তাদের বাধ্য করতে হয়, বিশেষতঃ শনিবার বিকেল বেলায়। কিন্তু যদি যন্ত্রপাতি থেমে যাবার পরও কোন কারখানায় শ্রমিকরা থাকে তাহলে তাদের বিশেষ করে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করবার জন্য সকাল ৬টার আগে অথবা শনিবার বিকালে বেলা ২টার আগে, যথোপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট থাকত, তাহলে তাদের ঐ কাজ করতে হত না।[১৬]

এর থেকে ( আইন লংঘন করে বাড়তি খাটুনির দ্বারা) যে লাভ হয় তাতে বোঝ। যায় যে অনেকের পক্ষেই এই লোভ সংবরণ করা সম্ভব নয়, তারা হিসেব করে যে তার ধরা পড়বে না, এবং এখন তারা দেখে যে ধরা পড়ে শাস্তি হলে যে সামান্য জরিমানার খরচখরচা দিতে হয় তাতে তারা ধরা পড়লেও প্রচুর লাভ থাকে।[১৭] যেসব ক্ষেত্রে বাড়তি সময়টি সারাদিন ছোট ছোট চুরি যোগ করে পাওয়া যায়, সেইসব ক্ষেত্রে পরিদর্শকদের পক্ষে মামলা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।”[১৮]

শ্রমিকদের আহার ও বিশ্রামের সময় থেকে ধনিকদের এই ‘ছোট চুরিগুলিকে কারখানা-পরিদর্শকেরা আখ্যা দিয়েছেন, “ছোটখাটো মিনিট চুরি,[১৯] কয়েকটি মিনিট ছিনিয়ে নেওয়া’,[২০] অথবা শ্রমিকেরা নিজস্ব ভাষায় বলে খাবার সময় থেকে ঠোকর মারা।[২১]

শ্রমের প্রত্যেকটি বিরতির বিরোধিতা করে, নিচের চমকপ্রদ ঘটনাটি-এর প্রমাণ দেয়। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের শুরুতে ইয়র্কশায়ারের ডিউসবেরির ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে খবর পৌছয় যে ব্যাটলি সন্নিহিত ৮টি বড় বড় কারখানার মালিকরা কারখানা আইন লংঘন করেছে। এইসব ভদ্রলোকদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে তার। বারো থেকে পনের বছর বয়সের পাঁচজন বালককে শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে থেকে পরদিন শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করিয়েছে, খাবার জন্য এবং মধ্যরাত্রে ঘুম ছাড়া তাদের আর কোন বিরাম দেওয়া হয়নি। এবং এইসব শিশুদের ত্রিশ ঘণ্টা একটা নোংরা অন্ধ কুপে ( ঔ বদ্ধ জায়গাটির এই নাম ছিল ) অবিরাম পরিশ্রম করতে হত সেখানে পশমের ছেড়া কম্বল টুকরো টুকরো করতে হয় এবং সেখানে ধূলো, ফেসো। প্রভৃতিতে ঘরের হাওয়া এমন ঠাসা থাকে যে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকদের পর্যন্ত ফুসফুস বাঁচাবার জন্য রুমাল দিয়ে কেবলই মুখ চাকতে হয়। অভিযুক্ত ভদ্রলোকের শপথের বদলে শুধু সত্যকথা বলবার প্রতিশ্রুতি দেন কারণ ধর্মভীরু হিসেবে শপথ নেওয়া তাদের ধর্মে বাধে, এবং বলেন যে তারা এইসব অসুখী শিশুদের জন্য অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে তাদের ৪ ঘণ্টা ঘুমাবার সময় দিয়েছিলেন কিন্তু অবাধ্য শিশুরা কিছুতেই ঘুমাতে চায় না। এই ধর্মভীরু ভদ্রলোকেদের ২০ পাউণ্ড করে জরিমানা হয়। কবি ড্রাইডেন অনেক আগেই হয়ত এদের জন্যই কবিতা লিখেছিলেন : “বাইরে দেখা পবিত্র, মিথ্যা বলায় দড়।    : ঠাকুর পুজো করে, পাপ করতে দড়।”

এটি স্পষ্ট যে এইরূপ অবস্থার মধ্যে উৰও শ্রম থেকে উদ্ধ,ত্ত মূল্যের উৎপাদন গোপন ব্যাপার নয়। একজন অত্যন্ত সম্মানিত মালিক আমাদের বলেছিলেন যদি আমাকে দিনে মাত্র ১০ মিনিট উপরি সময় খাটাবার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সম্বৎসরে আমার পকেটে হাজারখানেক (পাউণ্ড) আসবে।'[২২] মুহূর্ত-ই হচ্ছে মুনাফার মৌল উপাদান।[২৩]

এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুয়ায়ী যারা পুরো সময় কাজ করে তাদের পুরো সময়ের মঞ্জুর এবং ১৩ বছরের কম বয়সের শিশু যাদের ৬ ঘণ্টামাত্র কাজ করতে দেওয়া হয় তাদের ‘অর্ধ সময়ের মজুর, শ্রমিকদের এই আখ্যার চেয়ে বৈশিষ্ট্যসূচক আর কিছু হতে পারে না। শ্রমিক এখানে শ্রম-সময়ের ঘনীভূত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘পুরো সময়ের মজুর এবং ‘অর্ধ সময়ের মজুর এই দুয়ের মধ্যে সমস্ত ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়েছে।[২৪]

————-

 ১. “যারা শ্রম করে তারা আসলে উভয়েরই ভরণপোষণ করে—অবসর ভোগীদের { যাদের ধনী বলা হয়, তাদের ] এবং নিজেদের।” (Edmund Burke : *Thoughts and Details on Scarcity,” p. 2!

২, নাইবুবর তার “রোমান হিস্টরি”-তে খুব সরল মনে বলেছেন : এটা স্পষ্ট যে ইট্রাস্কানদের স্থাপত্যসমূহের ধ্বংসস্তৃপগুলি, যা আজও আমাদের যুক্তিত করে তার পাশ্চাতে রয়েছে সামন্ত-প্রভু এবং সামন্ত-প্রজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র (!) রাষ্ট্রে। সিসমদি বলেন আরো বেশি এবং বোঝাতে চান, “সেলস লেস”-এর পশ্চাতে রয়েছে মজুরি-প্রভু এবং মজুরি-দাস।।

৩. এদের শোচনীয় অবস্থার জন্য করুণা বোধ না করে কেউ মিশর, ইথিওপিয়া ও আরবের মধ্যেকার সোনার খনিগুলির এই দুর্ভাগাদের দিকে তাকাতে পরে; যারা তাদের শরীরগুলিকে পর্যন্ত পরিস্কার রাখতে বা তাদের নগ্নতাকে ঢেকে রাখতে পারে না। রুগ্ন অশক্ত বা বৃদ্ধদের জন্য, নারীদের দুর্বলতার জন্য নেই কোনো বিবেচনা বা সহিষ্ণুতা। মার খেয়ে কাজ করতে করতে যে পর্যন্ত না তারা মারা যায়, সেই পর্যন্ত তাদের কাজ করতেই হবে।” (“Diod. sic. Bibt. Hist. lib. 2, c. 13)

৪. এর পরে যা কিছু বলা হয়েছে, তা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর থেকে রুমানিয়ার প্রদেশগুলিতে যে পরিস্থিতি দেখা দেয়, সেই সম্পর্কে।

৫. জার্মানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এলব, নদীর পূর্ব দিককার প্রুশিয়ার ক্ষেত্রে এই কথা সমান ভাবে প্রযোজ্য। পঞ্চদশ শতকে প্রায় সর্বত্রই জার্মান চাষী ছিল এমন একজন লোক, যে খাজনা হিসাবে কিছু ফসল ও শ্রম দিতে বাধ্য থাকলেও অন্যথা ছিল স্বাধীন। ব্ৰাণ্ডেনবার্গ, পোমেরানিয়া, সাইলেসিয়া ও পূব প্ৰশিয়ার ঔপনিবেশিকদের এমনকি আইনত ও স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কৃষক যুদ্ধে অভিজাততন্ত্রের জয়লাভের ফলে তার অবসান ঘটল। বিজিত দক্ষিণ-জার্মান চাষীরাই কেবল আবার ক্রীতদাসে পরিণত হল না, ষোড়শ শতকের মধ্যকাল থেকে পূর্ব প্রশিয়া ব্ৰাণ্ডেবর্গ, পোমেরানিয়া ও সাইলেসিয়ার, এবং তার অব্যবহিত পর থেকে শ্লেমউই-হলস্টেইন-এর স্বাধীন চাষীদেরও ভূমিদাসের অবস্থায় অধঃপতিত হয়। (Maurer, Fronhofe IVvol-Meitzen “Der Boden des Preussischen Staats.” -Hanssen, “Leibeigenschaft in Schleswig Holstein.” (F. Engels)

৬. আরো বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য : E. Regnault’s Histoire politique et sociale des Principautes Danubiennes,” Paris, 1855.

৭. সাধারণ ভাবে এবং কয়েকটি সীমা-সাপেক্ষ, নিজ নিজ প্রজাতির মধ্যম আকার ছাড়িয়ে যাওয়াটা হল জৈব সত্তার সংবৃদ্ধি সাক্ষ্য। মানুষের ক্ষেত্রে, তার দেহের ওজন কমে যায়, যদি তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রাকৃতিক বা সামাজিক অবস্থাবলীর দ্বারা ব্যাহত হয়। ইউরোপের যে যে দেশে বাধ্যতামূলক সৈন্য-সংগ্রহ প্রচলিত আছে, সেগুলির সব কয়টিতেই বয়স্ক মানুষের গড় উচ্চতা এবং সামরিক কার্যের জন্য তাদের যোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। বিপ্লবের আগে (১৭৮৯), পদাতিক বাহিনীর ন্যূনতম উচ্চতা ছিল ১৬৫ সেন্টিমিটার; ১৮১৮ সালে (১০ই মার্চের আইন ) তা দাড়াল ১৫৭ সেমি; ১৮৩২ সালের ২১শে মার্চ, ১৫৬ সে-মি; গড়ে ফ্রান্সে অর্ধেকেরও বেশি বাতিল হয়ে যায় দৈহিক উচ্চতা বা দৌর্বলের কারণে। স্যানিতে ১৭৮০ সালে সামরিক মান ছিল ১৭৮ সেমি। এখন তা ১৫৫ সেমি। প্রুশিয়ায় ১৫৭ সে-মি। ব্যাভারিয়ান গেজেট ই মে, ১৮৬২-এ ডঃ মেয়ার-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৯ বছরে গড়ের ফলে দেখা যায় বাধ্যতামূলক ভাবে সংগৃহীত ১০০০ সৈন্যের মধ্যে ১৬ জনই সামরিক কাজের অনুপযুক্ত-৩১৭ জন উচ্চতায় হ্রস্থতার কারণে এবং ৩৯৯ জন্য অন্যান্য দৈহিক ক্রটির কারণে।…..১৮৫৮ সালে বার্লিন তাব দেয় সৈন্যসংখ্যা সরবরাহ করতে পারেনি। ১৫৬ জন কম সরবরাহ করেছিল।” J. von Liebig : Die Chemie in ihrer Anwendung auf Agrikultur und Physiologie, 1862, 7th Ed. vol. I pp. 117, 118

৮. ১৮৫০ সালের কারখানা-আইনের ইতিহাস এই অধ্যায়ে পাওয়া যাবে।

৯. ইংল্যাণ্ডে আধুনিক শিল্পের সূচনা থেকে ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে যুগ তারই সম্পর্কে এখানে কিছু কিছু বলছি। এই যুগের ইতিহাসের জন্য আমি পাঠককে ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে লিপ জিগ থেকে প্রকাশিত ফ্রেডরিক এঙ্গে রচিত “Die Lage der arbeitenden klasse in England” পডতে বলি। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রকৃতি সম্পর্কে এঙ্গেল-এর ধারণা যে কতটা সঠিক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দের পরে প্রকাশিত কারখানা, খনি প্রভৃতির রিপোর্ট থেকে এবং সমগ্র অবস্থার কী আশ্চর্য ছবি দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন ভাসাভাসা ভাবেও তার রচনার সঙ্গে আঠারো থেকে বিশ বছর পরে (১৮৬৩-১৮৬৭) প্রকাশিত শিশু এম নিয়োগ কমিশনের সরকারি রিপোর্টগুলি তুলনা করি। এইগুলি শিল্পের সেইসব শাখা সম্পর্কে যেগুলিতে ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কারখানা-আইন প্রবর্তিত হয়নি বস্তুতঃ এখনও পর্যন্ত প্রবর্তিত হয়নি। অতএব এইখানে এঙ্গেলস-এর আঁকা চিত্র থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি অথবা সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে। আমি আমার দৃষ্টান্তগুলি প্রধানতঃ ১৮৪৮ খ্ৰীষ্টাব্দের পরবর্তী স্বাধীন ব্যবসায়ের যুগ থেকে নিয়েছি, এটি সেই স্বর্গরাজ্যের যুগ যার সম্পর্কে স্বাধীন ব্যবসায়ে অন্তভুক্ত রসিকরা রূপকথা রচনা করেছেন। অধিকন্তু এখানে ইংল্যাণ্ডকেই সামনের সারিতে আনা হয়েছে এইজন্য যে ইংল্যাণ্ড হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সর্বপ্রথম প্রতিনিধি এবং কেবলমাত্র সেখানেই আমাদের আলোচ্য বিষয়গুলি থেকে ধারাবাহিক সরকারী তথ্য পাওয়া যায়।

১০. “কারখানা-ইন্সপেক্টর মিঃ এল. হারের অভিমত প্রভৃতি কারখানা নিয়ন্ত্রণ আইনের অন্তর্ভুক্ত। হাউস অব কমন্স-এর হুকুমে মুদ্রিত, ৯ই আগষ্ট ১৮৫, পৃষ্ঠা ৪,৫।

১১. কারখানা-ইন্সপেক্টরের ষান্মাসিক রিপোর্ট, অক্টোবর ১৮৫৬, পৃষ্ঠা ৩৫।

১২. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৮, পৃষ্ঠা ৯;

১৩. রিপোর্ট ইত্যাদি পৃষ্ঠা ১০।

১৪. রিপোর্ট ইত্যাদি, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৫।

১৫. ১৫৬১ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত ৬ মাসের রিপোর্ট ইত্যাদি। দ্বিতীয় পরিশিষ্ট দেখুন; রিপোর্ট ইত্যাদি; ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃষ্ঠা ৭, ৫২, ৫৩। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের শেষ অর্ধে অনেক বেশি সংখ্যায় এই আইনগুলি ভঙ্গ হয়। ১৮৬৩ খ্ৰীষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ৭ দেখুন।

১৬. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৩, পৃষ্ঠা ২৩। আদালতে কারখানা মালিকদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে কি রকম একগুয়েমির সঙ্গে তারা কারখানার

১৭. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৩৪।

১৮. 1. c. পৃ. ৩৫

১৯. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।

২০. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।

২১. রিপোর্ট ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।

২২. রিপোর্টস-পূঃ ৪৮।

২৩. ইন্সপেক্টরের রিপোের্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০ পৃঃ ৫৬।

২৪. এটাই হচ্ছে কারখানা ও রিপোর্টে ব্যবহৃত সরকারি ভাষা।

.

.

১০.৩  ইংল্যান্ডের শিল্পে সেইসব শাখা যেখানে যেখানে শোষণের কোনো আইনগত সীমা নেই

এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করেছি শ্রম-দিবসকে প্রসারিত করার প্রবণতা নিয়ে, এমন একটা বিভাগে নর-নেকড়েদের ক্ষুধা নিয়ে যেখানকার শোষণকে—যে-কথা জনৈক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত বলেছেন—এমনকি আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানদের উপর অনুষ্ঠিত স্পেনিয়াড়দের নৃশংসতাও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি,[১] এবং তারি ফলে যেখানে শেষ পর্যন্ত মূলধনকে বাঁধা পড়তে হল আইনের শৃংখলে। এখন আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করব উৎপাদনের এমন কয়েকটি শাখার উপরে, যেখানে শোষণ আজও পর্যন্ত অবাধ রয়েছে কিংবা গতকাল পর্যন্তও অবাধ ছিল।

১৮৬০ সালের ১৪ই জানুয়ারি নটিংহাম-এর ‘অ্যাসেমরি-রুস’-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় সভাপতি হিসাবে কাউন্টি ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্রাউটন চার্লটন বলেন, “জনসংখ্যার যে-অংশ লেস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তার মধ্যে বঞ্চনা ও দুঃখ-দুর্দশা এত বেশি যা এই রাজ্যের অন্য কোনো অংশে বাস্তবিক পক্ষে, সভ্য জগতে অপরিজ্ঞাত। শেষ রাতে দুটো, তিনটে চারটের সময়ে নয়-দশ বছরের শিশুদের টেনে ভোলা হয় তাদের ছেডা নোংরা বিছানা থেকে এবং নিছক পেটের খোরাকির জন্য কাজ করতে বাধ্য করা হয় রাত দশ, এগারো, এমনকি রাত বারোটা পর্যন্ত। তাদের হাত পা শুকিয়ে যায়, তাদের বাড় কমে যায়, তাদের মুখ সাদা হয়ে যায় এবং তাদের মনুষ্য-সত্তা এমন এক পাথুরে অসাড়তায় নিঃশেষে লয় হয়ে যায় যে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আমরা মোটেই আশ্চর্য হইনা যখন দেখি মিঃ ম্যালেট বা অন্য কোনো কারখানা-মালিক উঠে পঁডিয়ে এই আলোচনায় বাধা দেন। যে কথা রেভারেণ্ড মন্টেগু ভ্যাপি বলেছেন, এই ব্যবস্থাটা সামাজিক, শারীরিক, নৈতিক ও আত্মিক—সবদিক থেকেই চরম দাসত্বের ব্যবস্থা। এমন একটা শহর সম্পর্কে কী ভাবা যায় বলুন তো, যেখানে মানুষের শ্রম দিবসকে আঠারো ঘণ্টায় নামিয়ে আনার জন্য একটি জনসভা থেকে আবেদন করতে হয়? . আমরা ভার্জিনিয়া ও ক্যারোলিনার তুলো উৎপাদকদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করি। তাদের কালোবাজার, তাদের চাবুক, তাদের নর-মাংসের লেন-দেন কি মানবতার এই ধীরে ধীরে বলি দেওয়া থেকে বেশি জঘন্য, যে-বলি দেওয়া হয়ে থাকে কেবল ধনিকদের জন্য ওড়না ও কলার তৈরি করানোর কাজে?[২]

গত ২২ বছরে স্ট্যাফোর্ডশায়ার-এর পটারি-কারখানাগুলিতে তিনটি পার্লামেন্টিয় অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়েছে। সেই সব অনুসন্ধানের ফলাফল বিধৃত হয়েছে “শিশু-নিয়োগ কমিশন”-এর কাছে মিঃ স্কাইভেন-এর ১৮১ সালের রিপোর্টে, প্রিভি কাউন্সিলের আদেশানুসারে প্রকাশিত ডাঃ গ্রীনহাউ-এর বিপোর্টে (পাবলিক হেল্ক, থাড’ রিপোর্ট, ১১২-১১৩) এবং সবশেষে, ১৮৬৩ সালে ১৩ই জুন তারিখের শিশু নিয়োগ কমিশনের প্রথম রিপোর্ট-এর অন্তর্ভুক্ত মিঃ লোগ-এর ১৮৬২ সালের রিপোের্ট। ১৮৬০ ও ১৮৬৩ সালের রিপোর্ট দুটি থেকে স্বয়ং শোষিত শিশুদের নিজেদের কয়েকটি সাক্ষ্যই আমার বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট। শিশুদের সাক্ষ্য থেকে বয়স্কদের বিশেষ করে বালিকা ও নারীদের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি, এবং সেটা শিল্পের এমন একটা শাখায়, যার পাশে সুতোকলকে মনে হবে মনোমত ও স্বাস্থ্যকর শিল্প বলে।[৩]

৯ বছর বয়সের উইলিয়াম উড প্রথম যখন কাজে ঢােকে তখন তার বয়স ছিল ৭ বছর ৩ মাম। শুরু থেকেই তার কাজ ছিল “ছাঁচ চালাচালি” (মালসুদ্ধ ছাচ শুকোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া, পরে খালি ছাচ ফিরিয়ে নিয়ে আসা)। সপ্তাহে প্রতিদিনই সে কাজে আসত ভোর ৬টায়, ছাড় পেত রাত ৯টায়। “সপ্তাহে ছয় দিন আমি কাজ করি রাত ৯টা পর্যন্ত। এইভাবে আমি কাজ করছি সাত-আট সপ্তাহ।” সাত বছরের একটি শিশুকে, কাজ করতে হয় দিনে পনেরো ঘণ্টা। ১২ বছর বয়সের জে মারে বলে, “আমি জিগ’ ঘোরই এবং ছাঁচ চালাচালি করি। আমি আসি ৬টায়। কখনো কখনো ৪টায়। গত রাতে আমি কাজ করেছি সারা রাত-সকাল ৬টা পর্যন্ত। গত পরশু রাত থেকে আমি যাইনি। গত রাতে কাজ করেছে আরো ৮-৯ জন ছেলে। একজন বাদে সকলেই আবার আজ সকালে এসেছে। আমি পাই ৩ শিলিং ৬ পেন্স। রাতে কাজের জন্য বাড়তি কিছু পাইনা। গত সপাহে আমি কাজ করেছি দু রাত।” দশ বছরের বালক ফের্নিহাফ বলে, “আমি (খাবারের জন্য) রোজ এক ঘণ্টা করে পাই না; কোন কোন দিন পাই কেবল আধ ঘণ্টা-বিষ্যৎবার, শুক্রবার আর শনিবার।”[৪]

ডাঃ গ্রীনহাউ বলেছেন, স্টোক-অন-ট্রেন্ট এবং উলস্টানটনের পটারি-অঞ্চলগুলিতে গড় আয়ু অস্বাভাবিক রকমে কম। যদিও স্টোক জেলায় ২০ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার কেবল ৩৬৬ শতাংশ এবং উলস্টানটনের কেবল ৩০৪ শতাংশ পটারিতে কাজ করে তবু প্রথম জেলাটিতে ঐ বয়সে পুরুষদের মোট মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি এবং দ্বিতীয়টিতে ৪ ভাগেরও বেশি মৃত্যু ঘটে পটারি-কর্মীদের মধ্যে ফুসফুস সংক্রান্ত রোগে। হানলির একজন চিকিৎসক, নাম ডাঃ বুথবয়ড, বলেন, “পটারি কর্মীদের পর পর প্রত্যেকটি প্রজন্ম লম্বায় খাটো এবং হীনবল হয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে মিঃ এম-বিন নামে আর একজন চিকিৎসকের বিবৃতি, “২৫ বছর আগে যখন তিনি পটারি-কর্মীদের মধ্যে চিকিৎসা করতে শুরু করেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত তার নজরে পড়েছে তাদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্তের লক্ষণীয় অবনতি।” এই বিবৃতিগুলি গৃহীত হয়েছে : গ্রীনহাউ-এর ১৮৬০ সালের রিপোর্ট থেকে।[৫]

১৮৬৩ সালে কমিশনারদের বিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে : নর্থ স্ট্যাফোর্ড শায়ার ইন ফার্মারি’র প্রবীণ চিকিৎসক ডাঃ আর্লেজ। পটারি-কমীরা পুরুষ ও নারী উভয়েই, শ্রেণী হিসাবে একটি অধঃপাতিত জনসংখ্যা-দৈহিক ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই। সাধারণ ভাবেই তাদের আয়তন বাড়েনা, আকার স্বাভাবিক হয়না এবং বুকের গঠন সুগঠিত হয় না; তারা অসময়েই বার্ধক্যে আক্রান্ত এবং অবধারিত ভাবেই স্বল্পায়ু হয় : তারা হয় নির্জীব, রক্তহীন এবং তাদের শারীরবৃত্তগত দৌর্বল্য প্রকাশ পায় অজীর্ণ রোগের দুরোগ আক্রমণে, লিভার ও কিডনীর বিশৃংখলায় এবং বাতগ্রস্ততায়। কিন্তু সব রকম ব্যাধির মধ্যে তার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় বুকের ব্যাধিতে নিউমোনিয়া যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস ও হাঁপানিতে। একটা বিশেষ ধরনের রোগ তাদের মধ্যে বিশেষভাবে দেখা যায়; তার নাম পটারি হাঁপানি’ বা ‘পটারি যক্ষ্মা। স্কুফুলা রোগ যাতে আক্রান্ত হয় গ্রন্থি, অস্থি বা শরীরের অন্য কোন অংশ, তার শিকার হয় শতকরা ৬৬ বা তারও বেশি পটারি-কর্মী। জেলার জনসংখ্যার ‘অবক্ষয় যে আরো বেশি হয়নি, তার কারণ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে নিরন্তর কর্মী সংগ্রহ এবং অপেক্ষাকৃত। স্বাস্থ্যবান নৃ-শাখাগুলির সঙ্গে এদের বৈবাহিক সম্পর্ক।[৬]

ঐ একই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ‘হাউস’ সার্জন’ মিঃ চার্লস পার্সনস কমিশনার লঙকে এর কাছে এক চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে লেখেন, “আমি পরিসংখ্যান থেকে বলতে পারি না, বলতে পারি কেবল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই; এ কথা ব্যক্তিগতভাবে আমি সজোরে বলতে পারি যে মাতা-পিতা বা নিয়োগকতাদের অর্থলালসা চরিতার্থ করার জন্য যাদের বলি দেওয়া হয়েছে, সেই হতভাগ্য শিশুদের দিকে তাকালেই আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। পটারি কর্মীদের নানাবিধ রোগের কারণগুলির তালিকা দেবার পরে তিনি এক কথায় তা প্রকাশ করেন, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ। কমিশনের রিপোর্টে এই আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে যে এমন একটি শিল্পোৎপাদন, যা সমগ্র বিশ্বে এত বিশিষ্ট একটি স্থান অধিকার করে আছে, তা দীর্ঘকাল ধরে এই মন্তব্যের লক্ষ্য হবে না যে, তার বিপুল সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেই এম-জনসংখ্যার শারীরিক অধঃপতন, ব্যাপক দৈহিক ক্লেশভোগ এবং অকালমৃত্যু, যাদের শ্রম ও কুশলতার কল্যাণেই অর্জিত হয়েছে এই বিপুল সাফল্য[৭] এবং ইংল্যাণ্ডের পটারি-শিল্প সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবটাই প্রযোজ্য স্কটল্যাণ্ডের পটারি-শিল্পের ক্ষেত্রেও।[৮]

কাঠিতে ফসফরাস লাগাবার পদ্ধতি আবিষ্কার হবার পরে, ১৮৩৩ সাল থেকেই দেশলাই শিল্পের সূচনা হয়; ১৮৪৫ সাল থেকে ইংল্যাণ্ডে এই শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে এবং এইটি বিশেষ করে প্রসারিত হয় যেমন লণ্ডনের জনবহুল অংশগুলিতে তেমনি ম্যাঞ্চেস্টার বামিহাম, লিভারপুল, ব্রিষ্টল, নরউইচ, নিউক্যাসেল ও গ্লাসগো-তে। এই শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল-লাগার ব্যাধিও ছড়িয়ে পড়েছে যেটিকে ১৮৪৫ সালে ভিয়েনার একজন চিকিৎসক দেশলাই শিল্পীদের বিশেষ ব্যাধি বলে আবিষ্কার করেন। শ্রমিকদের অর্ধেক হচ্ছে ১৩ বছরেরও কম বয়সের শিশু এবং ১৮ বছরের নীচে, তরুণ। অস্বাস্থ্যকর ও বিরক্তিকর বলে এই শিল্পটি এতই কুখ্যাত যে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে দুঃস্থ অংশ যেমন অর্ধাশন-ক্লিষ্ট বিধবা প্রভৃতিরাই কেবল তাদের অর্ধনগ্ন, অর্ধভুক্ত, অশিক্ষিত শিশুদের এতে সঁপে দিতে বাধ্য হয়।[৯]

১৮৬৩ সালে কমিশনার হোয়াইট যেসব সাক্ষীদের পরীক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে ২৭০ জন ছিল ১৮ বছরের কম বয়সের, ৫০ জন ১০ বছরের নীচে ১০ জন কেবল ৮ বছরের এবং ৫ জন মাত্র ৬ বছর বয়সের। শ্রম-দিবসের পরিমাণ ১২ থেকে ১৪ বা ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত, রাত্রিকালের শ্রম, অনিয়মিত খাবার এবং বেশির ভাগ সময়-ই খাবার খাওয়া হত ফসফরাসের দ্বারা বিষাক্ত কারখানা-ঘরের ভিতরেই। দান্তে থাকলে নিশ্চয়ই দেখতেন যে এই শিল্পের বিভীষিকা তার নরকের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।

কাগজের ঝালর তৈরির শিল্পের স্থূল নমুনাগুলি যন্ত্রে ছাপা হয়, সূক্ষ্ম নমুনাগুলি ছাপা হয় হাতে (ব্লক-ছাপাই)। সবচেয়ে কর্মচঞ্চল মাসগুলি হচ্ছে অক্টোবরের শুরু থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অথবা আরও বেশি রাত পর্যন্ত কোনো বিরতি ছাড়াই ক্ষিপ্র ও ক্ষিপ্ত গতিতে কাজ চলে।

জে. লিচ, সাক্ষ্য দিচ্ছেন : “গত বছর শীতকালে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য স্বাস্থ্যহানি হওয়ার ফলে ১৯ জন বালিকার মধ্যে ৬ জন অনুপস্থিত ছিল। আমাকে চেঁচামেচি করে তাদের জাগিয়ে রাখতে হয়।” ডব্লু, ডাফি বলেছেন : ‘আমি দেখেছি ছেলেমেয়েরা যখন আর কেউ কাজের জন্য তাদের চোখ খুলে রাখতে পারত না; অবশ্য তখন আমরা কেউই পারতাম না।’ জে. লাইটবোন বলেছেন : আমার বয়স ১৩ বছর …গত বছর শীতকালে আমরা রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতাম, তার আগের বছর রাত ১০টা পর্যন্ত। গত শীতকালে প্রত্যেক রাত্রিতে আমি পায়ের যন্ত্রণায় কঁদতাম। জি. অবস্টেন : আমার ঐ ছেলেটির বয়স যখন ৭ বছর, তখন থেকেই ওকে আমি তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে পিঠে করে নিয়ে যেতাম ও নিয়ে আসতাম এবং ও দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজ করত . ‘আমি প্রায়ই হাঁটু গেড়ে বসে তাকে খাওয়াতাম যখন সে যন্ত্রের ধারে দাড়িয়ে থাকত কারণ যন্ত্র ছেড়ে আসা বা যন্ত্র থামানো সম্ভব ছিল না। ম্যাঞ্চেস্টারের একটি কারখানার ম্যানেজার-অংশীদার স্মিথ -এর সাক্ষ্য : “আমরা (তার মানে তার। শ্রমিকরা যারা তার জন্য কাজ করে ) কাজ করে চলি, খাবার জন্য কোন বিরতি নেই, যাতে করে দিনের ১০ ঘণ্টা শ্রম বিকেল ৪-৩০ মিঃএ শেষ হয় এবং তারপরে যা কাজ হয় সেটা হচ্ছে ‘ওভার-টাইম’।[১০] (এই ভদ্রলোক মিঃ স্মিথ নিজে কি ঐ ১০ ঘণ্টার মধ্যে কোন খাবার খান না?) “আমরা (এই স্মিথের শ্রমিকরা কদাচিৎ সন্ধ্যা ৬টার আগে কাজ শেষ করি (অর্থাৎ মিঃ স্মিথের শ্রমশক্তির যন্ত্রগুলিকে ছাড়া হয় ), অতএব বাস্তবপক্ষে আমরা ( বিশেষ অর্থে) সারা বছর ধরেই ওভার টাইম কাজ করি। এরূপে শিশু ও বয়স্করা একইভাবে কাজ করে (১৫২ জন শিশু ও তরুণ এবং ১৪০ জন বয়স্ক ), গত ১৮ মাসে গড় কাজ হয়েছে কমপক্ষে ৭ দিন ৫ ঘণ্টা অথবা সপ্তাহে ৭৮ ঘণ্টা ১৮৬২ সালের ২রা মে যে ছ’ সপ্তাহ শেষ হল তাতে গড় কাজ আরও বেশি ৮ দিন অথবা সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা।” তবু এই একই মিঃ স্মিথ, যিনি বহুবচন ব্যবহার করতে এত ভালবাসেন, একটু হেসে বলেছেন, “যন্ত্রের কাজ বেশি নয়।” অতএব ছাপাখানার মালিকরা বলেন : “হাতের শ্রম যন্ত্রের শ্রমের চেয়ে অনেক স্বাস্থ্যকর।” মোটর উপর মালিকরা সক্রোধে এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। প্রস্থাবটি হচ্ছে “অন্তত খাবার সময়ে যন্ত্র বন্ধ রাখা হোক।” মিঃ অটুলি, একটি বরো-তে বলেন, ওয়ালপেপার কারখানার ম্যানেজার যে এমন একটি ধারা চালু করেন যাতে সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজের অনুমতি আছে:: এটাই আমাদের (!) পক্ষে খুব সুবিধাজনক কিন্তু সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারখানা চালান সুবিধাজনক নয়। আমাদের যন্ত্র মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য সর্বদাই থামান হয়। (কী উদারতা ! ) কাগজ ও রঙের এমন কিছু উল্লেখযোগ্য অপচয় হয় না। কিন্তু, এখানে তিনি খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলেছেন, “আমি অবশ্য বুঝতে পারি যে সময়ের অপচয় সকলে পছন্দ করেন না।” কমিশনের রিপোর্টে খুব স্পষ্ট করেই মত প্রকাশ করা হয়েছে, কয়েকজন প্রধান প্রধান মালিক সময়ের অপচয়ের যে ভয় প্রকাশ করেন অর্থাৎ অপরের সময়কে দখল করতে না পারা এবং তার জন্য মুনাফার ক্ষতি,—সেটাই যথেষ্ট কারণ হতে পারে যার জন্য ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের এবং ১৮ বছরের কম বয়সী তরুণদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা খাটতে হবে, তারা মধ্যাহ্ন ভোজও খাবে না, এমন কি স্টিম-ইঞ্জিনে যে-ভাবে কয়লা ও জল দেওয়া হয়, পশমের জন্য সাবান, চাকার জন্য তেল উৎপাদন-প্রক্রিয়া চলাকালে শ্রমের যন্ত্রপাতিগুলির সহায়ক সামগ্রী হিসাবে যা দেওয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে তাও হয় না।[১১]

ইংল্যাণ্ডে শিল্পের অপর কোন শাখাতে (খুব সম্প্রতি প্রবর্তিত যন্ত্রে রুটি তৈরির কথা বাদ দিয়ে আজ পর্যন্ত এত প্রাচীন ও অচল পদ্ধতি বেঁচে নেই -বোমক সাম্রাজ্যে কবিদের লেখাতেও যে জিনিসটি দেখি—এই খ্ৰীষ্টপূর্ব যুগের রুটি সেঁকার ব্যাপার। কিন্তু মূলধন, ইতিপূর্বেই যা উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রম-প্রণালীর কৃৎ-কৌশলগত চৰিত্ৰ সম্পর্কে শুরুতে নিস্পৃহ থাকে; হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়েই তার কাজ শুরু হয়।

রুটিতে অবিশ্বাস্য রকম ভেজাল দেওয়ার ব্যাপার, বিশেষতঃ লণ্ডন শহরে, কমন্স সভায় খাদ্য সামগ্রীতে ভেজাল সম্পর্কে নিযুক্ত কমিটি (১৮৫৫-৫৬) এবং ডাঃ সালের “ধরা-পড়া ভেজাল” নামক বইখানি সর্বপ্রথম প্রকাশ করে দেয়।[১২] এইসব প্রকাশের ফল হল ১৮৬০ সালের ৬ই আগষ্টের আইনটি—যার উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য ও পানীয় সামগ্রীতে ভেজাল নিষিদ্ধ করা—সেই আইনটি কার্যকরী হল না কারণ এতে স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেকটি স্বাধীন ব্যবসায়ীর জন্য অপরিসীম মমতা দেখানো হয়েছিল, যে ব্যবসায়ীরা ভেজাল দেওয়া পণ্যে কেনা-বেচা করে ‘সৎপথে দুটো পয়সা করতে বদ্ধপরিকর ছিল।[১৩] কমিটি নিজে মোটের উপর সরল ভাবে তাদের বিশ্বাসকে সূত্রাকারে প্রকাশ করে বললেন যে স্বাধীন ব্যবসা মানে স্বাভাবিকভাবেই ভেজাল, অথবা ইংরেজরা সুকৌশলে যে-ভাবে বলে থাকেন, পরিমার্জিত জিনিস নিয়ে ব্যবসা। বস্তুতঃ এই ‘পরিমার্জনকারীরা প্রেটোপোরাস-এর চেয়ে অনেক ভালভাবে জানে যে কেমন করে সাদাকে কাল এবং কালকে সাদা করা যায় এবং ইলিয়াটিকদের চেয়ে ভালো করে জানে কিভাবে প্রমাণ করতে হয় যে চোখে যা দেখা যায়, তা কেবল বাহ্ন ব্যাপার।[১৪]

সে যাই হোক কমিটি সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিজেদের “দৈনিক রুটি’-র দিকে এবং স্বভাবতই রুটি সেঁকার শিল্পের দিকে। ঠিক একই সময়ে জনসভা ও পার্লামেন্টে আর্জি মারফত লণ্ডনে রুটি শিল্পের ঠিকা-শ্রমিকরা তাদের অতিরিক্ত খাটুনি ও অন্যান্য দাবি নিয়ে আওয়াজ তোলে। এদের দাবি এত জরুরি ছিল যে মিঃ এইচ. এস, ট্রেমহিয়ার যিনি ইতিপূর্বে উল্লিখিত ১৮৬৩ সালে কমিশনেরও সদস্য ছিলেন ত’কেই রাজকীয় তদন্ত কমিশনার নিয়োগ করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ সমম্বিত তার এই রিপোর্ট[১৫] সাধারণের বিবেক উদ্বদ্ধ না করলেও তাদের পাকস্থলীতে আঘাত করে। ইংরেজরা বরাবরই বাইবেল সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখে, তাই তারা ভাল করেই জানেন যে ঈশ্বরের কৃপাধন্য ধনিক অথবা ভূস্বামী অথবা বিনা-পরিশ্রমের উচ্চ পদাধিকারী। ব্যক্তি ছাড়া সকল মানুষের প্রতি আদেশ আছে যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাকে দৈনিক রুটি খেতে হবে, কিন্তু তারা জানতেন না যে মানুষকে তার দৈনিক রুটির সঙ্গে খেতে হবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গায়ের ঘামের সঙ্গে মেশানো ফোড়ার পুজ, মাকড়সার জাল, মরা পোকামাকড ও জার্মানির পচা মদের গাদ, ফিটকারি, বালি ও অন্যান্য সুস্বাদু খনিজ উপাদানের তো কথাই নেই। তাই স্বাধীন ব্যবসার পবিত্রতার প্রতি মর্যাদা না দিয়ে স্বাধীন রুটি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় পরিদর্শকদের তত্ত্বাবধানে আনা হল ( ১৮৬৩ সালে পার্লামেন্টের অধিবেশনের শেষ দিকে, এবং ঐ পার্লামেন্টের ঐ একই আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের শ্রমিকদের জন্য রাত ৯টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করা নিষিদ্ধ হল। এই শেষোক্ত ধারাটিতেই প্রকাশ পাচ্ছে এই সেকেলে ঘরোয়া ধরনের শিল্পটিতে অতিরিক্ত খাটুনির বিপুল বোঝা।

 “লণ্ডনের একজন ঠিক রুটি-মজুরের কাজ শুরু হয় সাধারণত রাত এগারটার সময়। ঐ সময় মজুর ময়দাকে তাল পাকায়’-এই শ্রম-সাধ্য প্রক্রিয়াটি ময়দার পরিমাণ অথবা শ্রমের পরিমাণ অনুযাযী আধঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়। তারপর ময়দা মাখার পাত্রটির উপরে ঢাকা দেবার জন্য ব্যবহৃত ময়দা মাখার তক্তার উপর সে শুয়ে পড়ে; একটি চট পাকিয়ে সে মাথার বালিশ করে এবং আরেকটি চট পেতে শুয়ে সে প্রায় ঘণ্টা দুই ঘুমায়। তারপর তাকে প্রায় ৫ ঘণ্টা ব্যাপী দ্রুত এবং অবিরাম পরিশ্রম করতে হয়—ময়দার তাল তৈরি করা, ঘোট ঘোট টুকরা করা, ঐগুলিকে বিশেষ ছাঁচে উনুনে দেওয়া, সাধারণ ও সৌখিন ধরনের রুটি গড়ে সেঁকা, উনুন থেকে সরাসরি রুটি বের করা এবং ঐগুলি দোকানে পৌছে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। রুটি সেঁকার ঘরের তাপমাত্রা ৭৫ থেকে ৯০° পর্যন্ত এবং ছোট খাট কারখানাগুলিতে প্রায়ই তাপমা। নিচের দিকে না থেকে উচ্চতর সীমার দিকেই থাকে। যখন রুটি, রোল প্রভৃতি তৈরির কাজ শেষ হয়, তখন শুরু হয় বণ্টনের কাজ এবং রুটি কারিগরদের একটি বৃহৎ সংখ্যা রাত্রির উল্লিখিত কঠিন পরিশ্রমের পরে আবার দিনের বেলায় বার বণ্টা রুটির ঝুড়ি বয়ে অথবা ঠেলাগাড়ি ঠেলে হাঁটার উপরে থাকতে হয়, কখনো কখনো আবার রুটি সেঁকার ঘরে ফিরে আসে এবং দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত মরশুমের প্রয়োজন অনুযায়ী তারা কাজ শেষ করে; সেই সময়ে অন্যান্য শ্রমিকরা রুটি সেঁকার ঘরে কাজ করে এবং বিকালবেলার শেষ পর্যন্ত সারি সারি রুটি বের করে আনে।[১৬] যাকে বলা হয় লণ্ডন মরশুম সেই সময়ে শহরের ওয়েস্ট-এতে পুরোদামী রুটি-কারখানার মালিকদের শ্রমিকরা সাধারণতঃ রাত এগারোটায় কাজ আরম্ভ করে এবং পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত মাঝখানে একবার অথবা দুবার ( প্রায়ই খুব অল্প সময় বিশ্রাম নিয়ে রুটি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। তারপর তারা বিকেল চারটা, পাচটা, ছয়টা এবং এমনকি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রুটি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে, অথবা কখন কখন বিকেল বেলা আবার সেকবার ঘরে আসে এবং বিস্কুট তৈরির কাজে সাহায্য করে। তারা কাজ শেষ করার পরে কখন পাঁচ বা ছয়, কখন মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমায়, তারপর তারা আবার কাজ শুরু করে। শুক্রবারগুলিতে তারা সর্বদাই আগে কাজ ধরে, কেউ কেউ রাত দশটার সময় শুরু করে, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রুটি তৈরি ও বণ্টনের কাজ শনিবার রাত্রি ৮টা পর্যন্ত চলে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রবিবার ভোর চারটা বা পাঁচটায় শেষ হয়। রবিবারগুলিতে শ্রমিকদের দিনে ২/৩ বার এক থেকে দুই ঘণ্টা হাজিরা দিতেই হয়, ঐ সময়ে তারা পরের দিনের রুটি তৈরির আয়োজন করে যে সব শ্রমিক কম দামের রুটি মালিকদের দ্বারা নিযুক্ত হয় (এই মালিকরা পুরো দামের চেয়ে কমে তাদের রুটি বিক্রী করে এবং আগেই বলা হয়েছে যে এদের সংখ্যা লণ্ডনে রুটি ওয়ালাদের চারভাগের তিনভাগ ), তাদের যে শুধু গড়ে বেশি সময় কাজ করতে হয় তাই নয়, পরন্তু তাদের কাজটা হচ্ছে প্রায় সম্পূর্ণরূপে রুটি সেঁকার ঘরের মধ্যেই। কমদামের রুটিওয়ালারা সাধারণত নিজেদের দোকানেই রুটি বিক্রি করে। যদি তাদের রুটি বাইরে পাঠাতে হয়, যেটি ব্যাপারীদের দোকানে সরবরাহ করা ছাড়া সচরাচর ঘটে না, তখন তারা সাধারণত ঐ কাজের জন্য অন্য লোক নিয়োগ কৰে। এরা বাড়ি বাড়ি রুটি পৌছে দেয় না। সপ্তাহের শেষদিকে . যে লোকগুলি বৃহস্পতিবার রাত দশটায় কাজ শুরু করেছিল এবং নামমাত্র বিরতি ছাড়া এরা শনিবার সন্ধ্যার পরেও বেশ কিছু সময় কাজ করে।[১৭]

এমনকি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীও এইসব কম-দামের কটিওয়ালাদের অবস্থা বোঝেন। “শ্রমিকদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমকেই এখানে পরিণত করা হয়েছে এই প্রতিযোগিত চালাবার বৎসর।[১৮] এবং পুরো-দাম’ এর রুটিওয়ালার তদন্ত কমিশনের কাছে তাদের কম দামের প্রতিযোগীদের এই বলে নিন্দা করেন যে ওরা বিদেশীদের শ্রম চুরি করে এবং ভেজাল দেয়। তারা বেঁচে আছে শুধু প্রথমতঃ জনসাধাণকে ঠকিয়ে এবং দ্বিতীয়ত তাদের শ্রমিকদের বারো ঘণ্টার মজুরি দিয়ে আঠারো ঘণ্টা খাটিয়ে।”[১৯]

রুটিতে ভেজাল দেওয়া শুরু হয় এবং পুরোদামের চেয়ে কমে রুটি বিক্রি করে এই ধরনের এক শ্রেণীর মালিকের উদ্ভব ঘটে আঠার শতকের গোড়ার দিক থেকে, সেই সময় থেকে যখন এই ব্যবসার যৌথ চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় এবং নামেমাত্র মালিক রুটিওয়ালার পিছনে ময়দা-কলের মালিকের আকারে ধনিকের আবির্ভাব ঘটে।[২০] এই ভাবেই এই শিল্পে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তি রচিত হয় শ্রম-দিবসের অপরিমিত প্রসার ও রাত্রিকালীন শ্রম চলতে থাকে, যদিও এই শেষের ব্যাপারটি শুধুমাত্র ১৮২৪ সালের পর থেকেই পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, এমন কি লণ্ডনেও।[২১]

এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, কমিশনের রিপোর্টে রুটি ওলাদের ঠিকা-মজুরদের স্বল্পায়ু শ্রমজীবীদের শ্রেণীতে ধরা হয়েছে, যারা শ্রমিক। শ্রেণীর শিশুদের স্বাভাবিক মৃত্যুতে সৌভাগ্যক্রমে এড়াতে পারলেও ৪২ বছরের বেশি বড় একটা বাঁচে না। তবু রুটি সেঁকার শিল্পে সর্বদাই কর্মপ্রার্থীদের ভিড় থাকে। লণ্ডন শহরে এই শ্রমশক্তির যোগান আসে স্কটল্যাণ্ড এবং ইংল্যাণ্ডের পশ্চিমাংশের কৃষিজীবী জেলা এবং জার্মানি থেকে।

১৮৫৮ থেকে ৮৬০ পর্যন্ত বছরগুলিতে আয়াল্যাণ্ডের রুটিওয়ালাদের ঠিকা-মজুররা নিজেজের খরচে রাত্রিকালীন ও রবিবারের কাজের বিরুদ্ধে বড় বড় সভার অনুষ্ঠান করে। যেমন ১৮৬০ সালের মে মাসের ডাবলিন সভায় সাধারণ মানুষ আইরিশ সুলভ উদ্দীপনার সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেন। এই আন্দোলনের ফলে ওয়েক্সফোর্ড, কিলকেনি, ক্লনমেল, ওয়াটার ফোর্ড প্রভৃতি স্থানে শুধু দিনের বেলায় কাজ করার নিয়ম সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। লিমেরিকে যেখানে ঠিকা-মজুরের অভিযোগ প্রকাশ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল সেখানে রুটিকারখানা মালিকদের প্রতি বন্ধকতায় আন্দোলনে হেরে যায়, ময়দা-কলওয়ালা মালিকরাই ছিল সবচেয়ে বেশি বিরোধী। লিমেরিকের দৃষ্টান্তে এনিস ও টিপেরারি-তে আন্দোলনে ভাটা আসে। কর্ক-এ যেখানে আবেগপূর্ণ প্রতিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ হয়, মালিকরা তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগায়, লোকদের কর্মচ্যুত করতে আন্দোলনকে পরাভূত করে। ডাবলিনে বেকারী মালিকরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং আন্দোলনে অগ্রণী ঠিকা-মজুরদের যতদূর সম্ভব অপদস্থ করে শ্রমিকদের রবিবার ও রাত্রির কাজে রাজি করাতে সক্ষম হয় যদিও এটি এদের মতের বিরুদ্ধে।[২২]

ব্রিটিশ সরকারের কমিটি, যে সরকার আয়াণ্ডে সর্বদা আপাদমস্তক অস্ত্রসজ্জিত থাকে এবং সাধারণত ক্ষমতা কিভাবে দেখাতে হয় তা-ও জানে, সেই সরকার-ই অত্যন্ত মৃদু, প্রায় শবযাত্রার সুরে, ডাবলিন, লিমেরিক, কর্ক প্রভৃতি স্থানের একগুয়ে রুটিকারখানা-মালিকদের কাছে প্রতিবাদ জানান। কমিটি বিশ্বাস করে যে শ্রমের ঘণ্টা প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী সীমাবদ্ধ এবং তাকে লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়। মালিক রুটিওয়ালাদের পক্ষে শ্রমিকদের কর্মচ্যুতির ভয় দেখিয়ে রাজি করান, তাদের ধর্মীয় ও উচ্চতর অনুভূতিগুলির বিরোধিতা করা, দেশের আইন না মানা এবং জনমতকে উপেক্ষা করা (রবিবারের শ্রম সম্পর্কে ), এর ফলে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে অসম্ভাব এসে যায় …………এবং এতে ধর্ম, নীতি ও সামাজিক শৃংখলার পক্ষে বিপজ্জনক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় …… কমিটি বিশ্বাস করে যে দৈনিক বার ঘণ্টার বেশি স্থায়ী পরিশ্রম শ্রমিকের গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যাহত করে এবং প্রতিটি মানুষের ঘর-বাড়ি ও পরিবার-পরিজন সম্পর্কে পুত্র, ভ্রাতা অথবা স্বামী হিসেবে কর্তব্যপালনে বাধা দেয় এবং সেইজন্য সাংঘাতিক নৈতিক কুফল নিয়ে আসে। বার ঘণ্টার বেশি দৈনিক এম শমিকের স্বাস্থ্যহানির প্রবণতা আনে এবং অকাল বার্ধক্য ও মৃত্যু ঘটিয়ে শ্রমিকের পরিবারবর্গকে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে এইভাবে তারা সর্বাধিক প্রয়োজনের সময় পরিবারে অভিভাবকের যত্ন ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়।[২৩]

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আয়ার্ল্যাণ্ড সম্পর্কে বলছিলাম। ইংলিশ চ্যানেল এর অপর পারে স্কটল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিক, লাঙ্গল চাষী, অত্যন্ত প্রতিকূল জলবায়ুতে তের চোদ্দ ঘণ্টা শ্রম এবং রবিবারে অতিরিক্ত চার ঘণ্টা শ্রমের এই দেশে আবার রবিবারকে পবিত্র ছুটির দিন মনে করা হয় ! )[২৪] বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়; ঠিক ঐ একই সময়ে ৩ জন রেলওয়ে শ্রমিক,-একজন গার্ড, একজন ইঞ্জিন-ড্রাইভার একজন সিগন্যাল ম্যান-লণ্ডনে করনারে { মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্তকারী ) কোর্টে জুরীর সামনে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েছিল। একটি ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনায় শতশত যাত্রী মারা পড়ে। কর্মচারীদের অবহেলাই এই দুর্ঘটনার কারণ। এরা জুবীর। সামনে সমস্বরে ঘোষণা করল যে দশ অথবা বারো বছর আগে এদের দৈনিক মাত্র আট ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হত। গত পাঁচ, ছয় বছর এদের পরিশ্রমকে বাড়িয়ে দৈনিক চৌদ্দ, আঠারে? ও কুড়ি ঘণ্টা করা হয়েছে এবং যখন দীর্ঘ ছুটির সময় যাত্রীদের ভিড় খুব বেশি হয়, যখন বিশেষ বিশেষ ভ্রমণের ট্রেনগুলি চলে, তখন কোন বিরাম বিরতি ছাড়াই চল্লিশ অথবা পঞ্চাশ ঘণ্টা পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়। এরা অতিকায় মানুষ নয়, সাধারণ মানুষ মাত্র। একটা মাত্রার পরে এদের দেহ আর চলবে না। ক্লান্তিতে তারা মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তাদের মস্তিষ্ক আর চিন্তা করে না, তাদের চোখ দেখে-ও দেখে না। অত্যন্ত মান্যগণ্য’ ব্রিটিশ জুরীরা রায় দিয়ে তাদের নবৃহত্যার অপরাধে উধ্ব তম বিচারালয়ে সোপর্দ করলেন এবং রায়ে একটি মৃদু সংযোজনী মারফৎ শুধু শুভেচ্ছা প্রকাশ করলেন যে রেল কোম্পানির ধনতান্ত্রিক মালিকরা ভবিষ্যতে যেন একটি বেশি খরচ করে যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমশক্তির ক্রয় করেন এবং মজুরি-প্রদত্ত শ্রমশক্তিকে শোষণ করার ব্যাপারে আর একটু বেশি ‘সংযমী’ আর একটু বেশি স্বার্থত্যাগী, আর একটু বেশি মিতব্যয়ী হন।[২৫]

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব রকমের পেশা ও বয়সের শ্রমিকদের এই পাঁচ-মিশালি ভিড়, যা ইউলিসের উপরে নিহতদের আত্মাদের চেয়েও ঢের বেশি ব্যস্ত ভাবে আমাদের উপরে চাপ দিচ্ছে, যাদের বগলের তলায় ব্লু বুক ছাড়াও একমাত্র চেহারা থেকেই এক নজরে চোখে পড়ে অতিরিক্ত খাটুনির চিহ্ন, তাদের মধ্য থেকেই নেওয়া যাক আরো দুটি দৃষ্টান্ত, যাদের মধ্যেকার জাজ্বল্যমান প্রতিতুলনা প্রমাণ করে দেয় যে, মূলধনের কাছে সব মানুষই সমান : যেমন একজন দর্জি ও একজন কামার।

১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে লণ্ডনের সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় ‘চাঞ্চল্যকর শিরোনাম ‘শুধু অতিরিক্ত খাটুনি থেকে মৃত্যু’-এর নীচে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এতে সূচী-শিল্পী কুড়ি বৎসর বয়স্কা মেরি এ্যান ওয়ালি-র মৃত্যু সংবাদ ছিল, এই মেয়েটি একটি নামকরা পোশাক-তৈরি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত এবং সেখানে এলিস এই ঐতিসুখকর নামধারিনী এক মহিলা দ্বারা শোষিত হত। সেই পুরাতন, অনেক বার বলা কাহিনীর আরও একবার পুনরাবৃত্তি ঘটল।[২৬] এই মেয়েটি গড়ে ১৬ ঘণ্টা কাজ করত, মরশুমের সময় তাকে বিরামহীনভাবে প্রায়ই তিরিশ ঘণ্টা খাটতে হত। এবং তখন তার মুহ্যমান শ্রমশক্তিকে মাঝে মাঝে শেরি, পোর্ট অথবা কফি দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করা হত। ঠিক এই সময়টিই ছিল ওয়েলসের মরশুমের সবচেয়ে বেশি কাজের হিডিক। নূতন আমদানি করা রাজপুত্রবধূর সম্মানে আহূত অভিজাত মহিলাদের জন্য চক্ষের নিমেষে জমকালো পোশাক তৈরি করা দরকার হয়ে পড়ল। মেরি এ্যান ওয়াক্লি বিনা বিশ্রামে আরও ষাট জন বালিকার সঙ্গে সাডে ছাব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেছিল, তিরিশ জন মিলে এমন একটি ঘরে যেখানে প্রয়োজনীয় ঘনফুট হাওয়ার মাত্র এক তৃতীয়াংশ ছিল। শোবার ঘরটি বোর্ড দিয়ে ভাগ করে যে শ্বাসরোধকারী গর্তগুলি তৈরি হয়েছিল, তারই একটিতে রাত্রি বেলা তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘুমোত।[২৭] এবং এইটিই ছিল লণ্ডনে পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। মেরি এ্যান ওয়ালি শুক্রবার অসুস্থ হল এবং তার হাতের কাজ শেষ না করার দরুন মাদাম এলিসকে বিস্মিত করে রবিবারে মারা গেল। মি. কীজ, যাকে ডাক্তার হিসেবে মৃত্যুশয্যার পাশে বড় দেরি করেই ডাকা হয়েছিল, তিনি কাবোনারের আদালতে জুরির সামনে যথারীতি সাক্ষ্য দিলেন যে, ‘মেরি এ্যান ওয়ালি একটি ঠাসাঠাসি কাজের ঘরে দীর্ঘ সময় কাজ করে এবং একটি অত্যন্ত ছোট ও স্বল্প হাওয়াযুক্ত শোবার ঘরে থাকার ফলে মারা গেছে। এরও পরে কারোনারের জুরি ডাক্তারকে ভদ্র রীতি-নীতিতে শিক্ষা দেবার জন্যে রায় দিলেন যে মৃত ব্যক্তি সন্ন্যাস রোগে মারা গিয়েছে কিন্তু এমন মনে করবার কারণ আছে যে একটি ঠাসাঠাসি কাজের ঘরে অতিরিক্ত খাটুনি তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে থাকতে পারে, ইত্যাদি। স্বাধীন বাণিজ্যের প্রবক্তা করনে ও ব্রাইটের পত্রিকা ‘মর্নিংস্টার’ তীব্র ভাষায় লিখল, ‘আমাদের সাদা চামড়ার গোলামরা যারা খাটতে খাটতে মরে, এই সাদা গোলাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরবে শুকিয়ে মরে।[২৮]

শুধু পোশাক-নির্মাতাদের ঘরেই খাটতে খাটতে মরে যাওয়াটা একটা রেওয়াজ নয়, পরন্তু আরও হাজার জায়গায় একই ব্যাপার ঘটে; আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে সব ক্ষেত্রে ফলাও কারবার করতে হয় তাদের প্রত্যেকটিতেই : দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা একজন কামারের কথা বলব। কবিদের উক্তি যদি সত্যি হয়, তাহলে কামারের মতো এমন হাসি-খুশি ও সদানন্দ লোক আর নেই; সে ভোরে উঠে সূর্যোদয়ের আগেই আগুনের ফুলকি ওডায়; তার মতো করে আর কোন মানুষ-ই ভোজন ও পান করে বা নিদ্রা যায় না। বস্তুতঃ শারীরিক দিক দিয়ে কাজটা সীমাবদ্ধ থাকলে কামার অন্যান্য মানুষদের তুলনায় ভালই থাকে। কিন্তু যদি আমরা তাকে অনুসরণ করে নগরে বা শহরে যাই এবং এই শক্ত-সমর্থ লোকটির উপর খাটুনির প্রভাব লক্ষ্য করি। তাহলে দেশের মৃত্যুর হারের মধ্যে তার অবস্থান কোথায় দেখা যায়? মেরিলিবোনে কামারের প্রতি বছর মারা যায় প্রতি হাজারে একত্রিশ জন অর্থাৎ গোটা দেশে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের গড় হারের চেয়ে এগারো বেশি। এই পেশাটি, মানবিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে যা প্রায় প্রবৃত্তিগত এবং মানুষের উদ্যোগসমূহের মধ্যে যে শিল্পে আপত্তিকর কিছু নেই, সেটি কেবল অতিরিক্ত খাটুনির কারণেই মানুষের হত্যাকারী হয়ে উঠেছে। কামার দিনে নিদিষ্টসংখ্যক আঘাত করতে পারে, নির্দিষ্ট-সংখ্যক পদক্ষেপ করতে পারে, তার শ্বাস প্রশ্বাসের সংখ্যাও নির্দিষ্ট, সে এতটা কাজ করতে পারে এবং ধরা যাক গড়ে ৫৬ বছর বাঁচতে পারে, কিন্তু তাকে দিয়ে আরও বেশিবার হাতুডির আঘাত করানো হয়, আরও অনেক বেশি পদক্ষেপ করানো হয়, প্রতিদিন অনেক বেশিবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে এবং তার জীবনকে মোট এক-চতুর্থাংশ বৃদ্ধি করতে বাধ্য করা হয়। সে এই চাহিদাপূরণ করে; ফল হয় এই যে কিছুকাল পর্যন্ত এক-চতুর্থাংশ বেশি কাজ উৎপাদন করে সে ৪০ বছরের বদলে ৩৭ বছরে মারা যায়।[২৯]

————

১. কল মালিকদের অর্থ-লালসা, লাভের সন্ধানে যাদের নিষ্ঠুরতাগুলিকে সোনার সন্ধানে আমেরিকা-জয়ের পরে স্পেনিয়াতদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নিষ্ঠতাগুলিও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।” John Wade, History of the middle and working classes, 3rd. Ed. London, 1835, p 114. এটা রাষ্ট্রিয় অর্থনীতির একখানা বই; সেই সময়ের বিচারে, বইখানার তাত অংশ কতগুলি বিষয়ে, যেমন বাণিজ্যিক সংকটের বিষয়ে, মৌল চিন্তার পরিচায়ক। ইতিহাস সংক্রান্ত অংশটি অবশ্য স্যার এফ এম ইডেন-এর “The State of the poor”, লণ্ডন, ১৭৯৭, থেকে নির্লজ্জভাবে চুরি করা।

২. “Daily Telegraph”, ৭ই জানুয়ারী, ১৮০৮।

৩. cf: F. Engel’s “Lage etc”, pp. 249-51.

৪. শিশু নিয়োগ কমিশন, প্রথম রিপোর্ট, ১৮৬৩, সাক্ষ্য, পৃঃ ১৬, ১৮, ১৯।

৫. জন-স্বাস্থ্য, তৃতীয় রিপোর্ট, পৃঃ ১০২, ১০৪, ১০৫। ক্যাপিট্যান্স (১ম)-১৬

৬. শিশু নিয়োগ কমিশন, প্রথম, রিপোর্ট, পৃঃ ২৪

৭. শিশু নিয়োগ কমিশন, পৃঃ ২২ ও ii।

৮. 1. c. p. xlvii.        

৯. 1. c. p. liv.

১০. একে আমাদের উত্তম সময় হিসাবে নেওয়া চলবে না। এই ভদ্রলোকেরা ১০ ঘণ্টা শ্রমকে গণ্য করেন স্বাভাবিক শ্রম-দিবস হিসাবে, যার মধ্যে অবশ্য স্বাভাবিক উত্তমও অন্তর্ভুক্ত। তারপরে শুরু হয় ওভার-টাইম’, যার জন্য একটু বেশি মজুরি দেওয়া হয়, পরে দেখা যাবে যে একটি তথাকথিত স্বাভাবিক দিনের জন্য যে-মজুরি দেওয়া হয়, তা তার মূল্যের চেয়ে কম। সুতরাং, আরো বেশি উদ্বৃত্ত-মূল্য নিঙড়ে নেবার জন্য “ওভার টাইম” ধনিকদের একটা চালাকি ছাড়া কিছু নয়। এমনকি স্বাভাবিক শ্রম-দিবসে ব্যয়িত শ্রমের জন্য যদি যথােচিত মজুরিও দেওয়া হত, তা হলেও এটা ঐ চালাকিই থেকে যেত।

১১. l.c, সাক্ষ্য, পৃঃ ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১৪, ৫৪।

১২. ভালো ভাবে গুড়ো করা কিংবা লবনের সঙ্গে মেশানো ফিটকারি ‘রুটি ওয়ালার মাল এই অর্থবহ নামে পরিচিত। এটা একটা মামুলি বাণিজ্য-দ্রব্য।

১৩. স্কুল হচ্ছে কার্বন-এর একটি সুপরিচিত ও খুব শক্তিশালী রূপ; সার হিসাবে কাজ করে বলে ধনতান্ত্রিক চিমনি-সাফাইকাররা ইংল্যাণ্ডদের কৃষকদের কাছে এই স্কুল বিক্রি করে। এখন, ১৮৬২ সালে একটি মামলায় ইংরেজ জুরির সোকদের রায় দিতে হয় যে, ক্রেতার অজান্তে মেশানো ৯০ শতাংশ ধুলো-বালি সমেত ঝুল বাণিজ্যিক অর্থে খটি স্কুল না, আইনগত অর্থে ভেজাল স্কুল। “বাণিজ্যের ধ্বজাকারীরা” রায় দিলেন যে এটা খাঁটি বাণিজ্যিক স্কুল এবং ফরিয়াদী কৃষকটি মামলায় হেরে গেল এবং তার উপরে আবার মামলার খরচ দিতে বাধ্য হল।

১৪. ফরাসী রসায়নবিদ শেভালিয়ে পণ্যদ্রব্যে ভেজাল সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থটিতে হিসেব দিচ্ছেন যে তার দ্বারা পরীক্ষিত ৬০০ বা ততোধিক দ্রব্যের মধ্যে অনেকগুলির ক্ষেত্রে ১০, ২০ বা ৩০ রকমের ভেজালের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। তিনি আরও বলেন, সমস্ত পদ্ধতি তার জানা নেই, তা ছাড়া যেগুলি তার জানা আছে, তাদেরও সবগুলি তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি চিনির ৬ রকমের ভেজাল দেখিয়েছেন, অলিভ, তেলের ৯ রকম, মাখনের ১৩, লবনের ১৩, দুধের ১৯, রুটির ২৭, ব্রাণ্ডির ২৩, ঔ ড খাদ্যের ২৪, চকোলেটের ২৮, মদের ৩০, কফির ৩২ ইত্যাদি। এমনকি সর্বশক্তিমান ভগবানেরও এই ভাগ্য থেকে কোন নিষ্কৃতি নেই। রুয়াদস্য কাদ-এর “ধর্মানুষ্ঠানের দ্রব্যসামগ্রী সম্পর্কে মিথ্যাচার” (“De la falsification des substances Sacramentelles”, প্যারিস, ১৮৫৬ দ্রষ্টব্য।

১৫. “রুটি-কারিগরদের অভিযোগগুলি সম্পর্কে রিপোর্ট প্রভৃতি, লণ্ডন, ১৮৮২”, ও “দ্বিতীয় বিপোর্ট, ইত্যাদি, লণ্ডন, ১৮৬৩।

১৬. lc. প্রথম বিপোর্ট প্রভৃতি, পৃঃ vi।

১৭. 1.c. p. xxi.

১৮. জর্জ ব্রীড, “রুটি সেঁকার ইতিহাস”, লণ্ডন, ১৮৪৮, পৃঃ ১৬।

১৯. রিপোর্ট (প্রথম) ইত্যাদি, পুরাদামের রুটিওয়ালা, চীজম্যান-এর সাক্ষ্য, পৃ: ১৮।

২০. George Read, t.c. সতের শতকের শেষে এবং আঠারো শতকের শুরুতে যেসব এজেন্টরা প্রায় প্রত্যেকটি ব্যবসায়ে ভিড় জমাল, তখনো তাদের পাব্লিক ইন্যান্স’ বলেই নিন্দা করা হত। সমারসেট্‌ কাউন্টির বিচারকদের ত্রৈমাসিক অধিবেশনে ‘গ্রাজুরি কমন সভার কাছে একটি লিপিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলেন, ‘ব্ল্যাকৃওয়েল হলের’ এই এজেন্টরা হচ্ছে ‘পাব্লিক মইন্যান্স এবং বস্ত্র ব্যবসায়ের পক্ষে এদের এইজন্যই দমন করা উচিত। “The case of our English Wool&c,” London, 1685, pp. 6, 7…

২১. ১ম রিপোর্ট প্রভৃতি।

২২. ১৮৬১ খ্ৰীষ্টাব্দে আয়ার্ল্যাণ্ডের রুটি ব্যবসা সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট।

২৩, l.c.

২৪. ১৮৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দে ই জানুয়ারি এডিনবরার কাছে ল্যাসওয়েভ -এ কষি শ্রমিকদের জনসভা (১৮৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারির ‘ওয়ার্কম্যান অ্যাডভোকেট পত্রিকা দেখুন।) ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের শেষ থেকে কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বার্কিংহামশায়ার ছিল ইংল্যাণ্ডের সর্বাধিক অত্যাচারিত কৃষি-জেলাগুলির মধ্যে একটি; এখানে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে কৃষি-শ্রমিকরা তাদের সাপ্তাহিক মজুরি ৯-১০ শিলিং থেকে বাড়িয়ে ১২ শিলিং করবার জন্য এক বিরাট ধর্মঘট করে। (পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদটি থেকে বোঝা যায় যে ইংল্যাণ্ডে কৃষি-শ্রমিকদের আন্দোলন যেটি ১৮৩০ সালে হিংসাত্মক উপদ্রব এবং বিশেষত ‘গরিব-আইন প্রবর্তনের পর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেটি আবার সপ্তম দশকে আরম্ভ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৭২ সালে যুগান্তকরেী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় গ্রন্থে আমি এই আলোচনায় আবার ফিরে আসব এবং ১৮৬৭-র পরবর্তী ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে সরকারি পুস্তিকাগুলি নিয়েও আলোচনা করব। তৃতীয় সংস্করণের সংযোজনী।)

২৫. রেনল্ডস্ নিউজপেপার, জানুয়ারী ১৮৬৬,-এই কাগজটিতে সপ্তাহে ‘ভয়াবহ ও মারাত্মক দুর্ঘটনা’, ‘রোমহর্ষক দুর্ঘটনা, এই ধরনের চাঞ্চল্যকর শিরোনামার নীচে দেখা যায় সদ্য রেলওয়ে দুর্ঘটনার একটা গোটা তালিকা। নর্থ স্টাফোর্ডশায়ার লাইনের একজন কর্মচারী এইগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করেন। প্রত্যেকেই জানেন, যদি রেলগাড়ির ইঞ্জিনে চালক ও ফায়ারম্যান অবিরাম নজর না রাখে তাহলে কিরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু যে লোকটি তীব্র আবহাওয়ার মধ্যে বিনা বিশ্রমে একাদিক্রমে ২৯/৩ ঘণ্টা কাজ করে, তার কাছ থেকে কি তা আশা করা যায়? সচরাচর ঘটে, নীচে তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল :—একজন ফায়ারম্যান সোমবার সকাল থেকে কাজ আরম্ভ করল। যাকে বলা হয় একদিনের কাজ, সেটা যখন সে শেষ করল তখন তার ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিট কর্তব্য হয়ে গিয়েছে। চা খাবার ফুরসত পাবার আগেই তাকে আবার কাজে ডাক করা হল পরের বার চোদ্দ ঘণ্টা পনের মিনিট কর্তব্যের পরে তার কাজ শেষ হল, সর্বসাকুল্যে বিনা বিশ্রামে উনত্রিশ ঘণ্টা পনের মিনিট। সপ্তাহের বাকি কাজ চলে এইভাবে বুধবার পনের ঘণ্টা বৃহস্পতিবার পনের ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট; শুক্রবার চোদ্দ ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট; শনিবার চোদ্দ ঘণ্টা দশ মিনিট, সপ্তাহের গোটা কাজ হচ্ছে ৮৮ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। এখন মহাশয় এই গোটা কাজের জন্যে তাকে যখন ৬টু রোজের মজুরি দেওয়া হল তখন তার বিস্ময়ের কথাটা ভাবুন। ভুল হয়েছে ভেবে সে টাইম-কীপারের কাছে আবেদন করল, এবং জানতে চাইল এক দিনের কাজ বলতে তারা কি বোঝেন। তাকে বলা হল ১৩ ঘন্টা ( অর্থাৎ সপ্তাহে ৭৮ ঘণ্টা)। সে তখন ৭৮ ঘণ্টার বেশি যে-কাজ দিয়েছে, তার জন্য তার পাওনা চাইল কিন্তু তাকে তা দিয়ে অস্বীকার করা হল। শেষ পর্যন্ত তাকে বলা হয় তাকে আর এক-চতুর্থাংশ দেওয়া হবে, অর্থাৎ ১: পেন্স। 1.c., 4th. Feb., 1866।

২৬. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, l.c. pp. 253, 254।।

২৭. স্বাস্থ্য বোর্ডের পরামর্শদাতা চিকিৎসক ডাঃ লেখেবী ঘোষণা করেন : “একজন পূর্ণবয়স্কের জন্য শোবার ঘরে ৩০০ এবং থাকার ঘরে ৫০০ ঘনফুট হাওয়া থাকা দরকার।” লণ্ডনের একটি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ডাঃ রিচার্ডসন বলেন : “সব রকম সূচী-শিল্পী মেয়েদের মধ্যে যাদের মধ্যে পড়ে টুপি-নির্মাতা, পোশাক প্রস্তুতকারী ও সাধারণ দরজী—এদের তিন রকমের কষ্ট আছে–অতিরিক্ত খাটুনি, অল্প হাওয়া এবং হয় অল্প পুষ্টিকর খাদ্য অথবা অল্প হজমশক্তি সেলাইয়ের কাজটি মুখ্যতঃ পুরুষের চেয়ে মেয়েদের পক্ষে সর্বতোভাবে বেশি উপযোগী, কিন্তু বিশেষ করে রাজধানীতে এই শিল্পটির অনিষ্টকর দিকটি হচ্ছে এই যে, এটি মোটামুটি ছাব্বিশ জন ধনিকের একচেটিয়া দখল আছে যারা নিজেদের মূলধনের সুযোগ নিয়ে শ্রম থেকে যথাসাধ্য নিঙড়ে নেবার জন্য মূলধন খাটায়। মুলধনের এই ক্ষমতা গোটা শ্ৰেণীকেই নিয়ন্ত্রিত করে। যদি কোন পোশাক-বিক্রেতা কয়েকজন ক্রেতা যোগাড় করতে পারে; তাহলে প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে তার নিজের বাড়িতে তাকে টিকে থাকার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত ঘাটতে হয় এবং যে-কেউ তাকে সাহায্য করে তাকেও অতিরিক্ত খাটতে হয়। সে অকৃতকার্য হলে অথবা স্বাধীনভাবে চলতে না চাইলে তাকে কোন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়, যেখানে তাকে পরিশ্রম কম করতে হলেও টাকাটা নিশ্চিত। এখানে এসে সে হয়ে পড়ে নিছক একজন গোলাম, যার খাটুনির ওঠানামা সমাজের রুচি-পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। হয় বাড়িতে একটিমাত্র ঘরে অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকতে হয় অথবা ১৫/১৬, এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এমন এক জায়গায় যেখানকার হাওয়ায়ও নিঃশ্বাস নেওয়া শক্ত এবং খাদ্য ভাল হলেও বিশুদ্ধ হাওয়ার অভাবে হজম করার শক্তি থাকে না। এইসব হতভাগ্যকে আশ্রয় করে ক্ষয় রোগ যা নিছক দূষিত হাওয়া থেকেই আসে। ডাঃ রিচার্ডসন্ : ১০৬৩ সালের ১৮ জুলাই “সমাজ বিজ্ঞান রিভিয়ু”-তে প্রকাশিত “ওয়ার্ক অ্যাণ্ড, ওভার-ওয়ার্ক।

২৮. মর্নিংস্টার’, ২৩শে জুন, ১৮৬৩: ‘দি টাইমস পত্রিকা ব্রাইট প্রভৃতির বিরুদ্ধে আমেরিকার দাস-মালিকদের সমর্থনে এই ঘটনাটি ব্যবহার করেন। ৮৬৩ সালের ২রা জুলাই একটি সম্পাদকীর প্রবন্ধে বলা হয় “আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে, যখন আমাদের নিজেদের দেশের নাবালিকাদের খাটিয়ে মেরে ফেলি এবং বাধ্যতার হাতিয়ার হিসেবে চাবুক না উচিয়ে অনাহারের তাড়নার সুযোগ নিই তখন সেইসব পিরবার যারা দাস-মালিক রূপেই জন্মেছে এবং যারা অন্ততঃ দাসদের ভাল করে খাওয়ায় এবং কম খাটায় তখন তাদের আক্রমণ করবার নৈতিক অধিকার আমাদের সামান্যই থাকে।” ঐ একই সুরে একটি রক্ষণশীল পত্রিকা, ‘দি স্ট্যাণ্ডাড’ রেভারেণ্ড নিউম্যান হলকে আক্রমণ করেন। “ইনি দাস মালিকদের ধর্মচ্যুত করেছেন কিন্তু সেইসব সাধু ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রে বসে প্রার্থনা করতে একে বিবেকে বাধে না, যারা লণ্ডনে বাস-ড্রাইভার ও কণ্ডাক্টার প্রভৃতিদের কুকুরের মোগ্য মজুরি দিয়ে দিনে ১৬ ঘণ্টা খাটায়। সর্বশেষে বাণী উচ্চারণ করলেন বাগ্মী টমাস কার্লাইল যার সম্বন্ধে আমি ১৮৫৩ সালে লিখেছিলাম, “Zum Teufel ist der Genius, der kultus ist geblieben” uploatarea দিয়ে তিনি সমসাময়িক ইতিহাসের একটি বৃহৎ ঘটনা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধকে এই স্তরে নামালেন যে তাঁর কথামতো উত্তরাঞ্চলের পিটার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দক্ষিণাঞ্চলের পল এর মাথা ভাঙ্গতে চাইছে এইজন্য যে, উত্তরের পিটার রোজ হিসেবে শ্রমিক ভাড়া করে এবং দক্ষিণের পল সারা জীবনের মত শ্রমিক ভাড়া করে। (ম্যাকলিমান ম্যাগাজিন আগষ্ট, ১৮৬৩।) এইভাবেই শহরের শ্রমিকদের প্রতি ( গ্রামের মজুরদের ওপর মোটেই নয় ) রক্ষণশীল সহানুভূতির বুদবুদ ফুটে গেল। মোদ্দা কথা হচ্ছে গোলামি।

২৯. : Foottha, “Work and over work” In Social science Review July 18, 1863

.

.

১০.৪  দিন রাত্রির কাজ

পালাদৌড় প্রথা

উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, স্থির মূলধনের তথা উৎপাদন-উপায় সমূহের কাজ হল কেবল এমকে, এবং শ্রমের প্রতিটি বিন্দুর সঙ্গে উদ্ব-মূল্যের একটি আনুপাতিক পরিমাণকে, আত্মীকৃত করা। যখন তারা তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের নিছক অস্তিত্বই ধনিকের পক্ষে হয়ে ওঠে একটি আপেক্ষিক লোকসন, যখন তারা ‘পতিত পড়ে থাকে, তখন তারা অগ্রিম-প্রদত্ত অকেজো মূলধনের প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র এবং যখনি তাদের কর্মকালীন অন্তর্বর্তী বিরতির পরে পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, তখনি এই লোকসান হয়ে ওঠে ধন্যাত্মক ও অনাপেক্ষিক। প্রাকৃতিক দিবাভাগের সীমা ছাড়িয়ে রাত পর্যন্ত কর্ম দিবসের বিস্তার সাধন কেবল এই ক্ষতির আংশিক উপশম হিসাবে কাজ করে; শ্রমের জীবন্ত রক্তের জন্য ধনিকের রক্তপায়ী বাদুড়-সুলভ তা কিঞ্চিৎ পরিমাণে তৃপ্ত করে। সুতরাং দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়েই শ্রম আত্মস্মাৎ করাটা হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রবণতা। কিন্তু যেহেতু একই ব্যক্তির শ্রমশক্তিকে দিন এবং রাত্রি উভয় বেলাতেই নিরন্তর শোষণ করা শারীরিক ভাবে অসম্ভব, সেই হেতু সেই বাধাটিকে অতিক্রম করার জন্য যেসব কাজের লোকের শক্তি দিনের বেলায় নিঃশেষিত করা হয়—এবং যে সব। কাজের লোকের শক্তি রাতের বেলায় নিঃশেষিত করা হয়—এই দু-ধরনের কাজের লোকদের মধ্যে পালাবদলের প্রয়োজন হয়। এই পালাবদল নানা ভাবে করা যেতে পারে, যেমন, ব্যাপারটা এমন ভাবে বন্দোবস্ত করা যেতে পারে যে শ্রমিকদের এক অংশকে এক সপ্তাহে নিযুক্ত করা হয় দিনের কাজে এবং পরের সপ্তাহে রাতের কাজে। এটা সুপরিজ্ঞাত যে, এই পালা-দৌড় প্রথা ( ‘রিলে-সিস্টেম) দুই প্রস্ত শ্রমিকের এই পালাক্রমে কাজে নিয়োগ—এটাই ছিল ইংল্যাণ্ডের বস্ত্র শিল্পের ভরা-যৌবন সব-ব্যাপক ব্যবস্থা, এবং আজও পর্যন্ত এটা প্রচলিত আছে, অন্যান্য ক্ষেত্রের মধ্যে, মস্কো জেলার সুতো-কলের ক্ষেত্রে। প্রথা হিসাবে এই ২৪ ঘণ্টার উৎপাদন-প্রক্রিয়া এখনো গ্রেট ব্রিটেনের এমন অনেক শিল্প-শাখায় চালু আছে, যেগুলি স্বাধীন-ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডের স্লট-ফানেস’, ‘ফোর্জ’, ‘প্লেট-রোলিং মিল এবং অন্যান্য ধাতব শিল্পের প্রতিষ্ঠান। এখানে কাজের সময়ের মধ্যে কেবল সপ্তাহের ছ দিনে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা করেই কেল নয়, তার উপরে আবার রবিবারেও একটা বড় অংশও অন্তভুক্ত। শ্রমিকদের মধ্যে থাকে নারী-পুরুষ এবং বয়স্ক ও নাবালক ছেলে-মেয়ে সকলেই। শিশু ও তরুণ-তরুণীরা ৮ বছর থেকে ( কোন কোন ক্ষেত্রে ৬ বছর থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব বয়সেরই হয়। [১০

শিল্পের কতকগুলি শাখায় তরুণী ও বয়স্কা নারীরা সারারাত ধরে কাজ করে পুরুষদের সঙ্গে।[২]

নৈশ শ্রমের সাধারণ ক্ষতিকর প্রভাবের কথা এক পাশে সরিয়ে রাখলেও,[৩] উৎপাদন-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল-বিরতিহীন ২৪ ঘণ্টা-স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবার খুবই প্রীতিকর সুযোগ সৃষ্টি করে, যেমন উল্লিখিত শিল্পগুলিতে, যেগুলি অত্যধিক ক্লান্তিকর প্রকৃতির; প্রত্যেকটি শ্রমিকের পক্ষে একটি সরকারি এমদিবস মানে দিনে বা রাতে ১২ ঘণ্টা। কিন্তু এই পরিমাণেরও অতিরিক্ত উপরি-খাটুনি অনেক ক্ষেত্রেই, ইংল্যাণ্ডের সরকারি রিপোর্ট অনুসারেই, “সত্যিই ভয়ংকর”।[৪]

রিপোর্টে আরও আছে যে “এটা অসম্ভব যে, নীচে যে-কাজের পরিমাণের কথা বলা হয়েছে, ৯ থেকে ১২ বছরের বালকেরা তা সম্পাদন করে, এটা জানার পরে কোনো মানুষই এই সিদ্ধান্তে না এসে পারে না যে, মাতা-পিতা ও নিয়োগ-কর্তাদের হাতে এমন ভাবে ক্ষমতা অপব্যবহারের অধিকার আর থাকতে দেওয়া যায় না।”[৫]

“দিনে ও রাতে বালকদের নিয়োগের ব্যাপারটি হয় সাধারণ কাজের ধারাতেই অথবা অতিরিক্ত চাপের সময়ে প্রায়ই অবশ্যম্ভাবী তাদের দীর্ঘ সময় খাটাবার পথ খুলে দেয়। বস্তুতঃ শ্রমের এই দীর্ঘ সময় শিশুদের পক্ষে নির্মম ও অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ। প্রায়ই দেখা যায় যে কোন না বোন কারণে এক বা একাধিক বালক কাজে অনুপস্থিত থাকে। এরকম ঘটনা ঘটলে, তাদের স্থানে পরের শিফটে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে থেকে এক বা একাধিক বালককে দিয়ে কাজ চালানো হয়। এটি স্পষ্ট যে এই পদ্ধতি সম্পর্কে সকলেই ভাল করে জানেন: …… যেমন আমার প্রশ্নের জবাবে সে অনুপস্থিত বালকদের কাজ কে করে, একটি বড় রোলিং-মিলের মালিক বললেন ‘মশায়, সেকথাতো আপনি ও আমি দুজনেই ভালমত জানি’ এবং বাস্তব ঘটনাটি তিনি স্বীকার করলেন।”[৬]

 “একটি রোলিং মিলে যেখানে শ্রমের নিয়মিত সময় হচ্ছে সকাল ছ’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত, যেখানে একটি বালককে প্রতি সপ্তাহে প্রায় চার রাত্রি অন্ততঃ সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাজ করতে হত এবং এটি ছ’মাস চলে। আর একজন নবছর বয়সের বালক কখনো কখনো একসঙ্গে পর পর তিনটি বানো ঘণ্টার শিফটে কাজ করত এবং দশ বছর বয়সে সে দুদিন ও দুরাত একাদিক্রমে কাজ করে।” তৃতীয় আর একজন, “এখন বয়স দশ বছর……সে সকাল ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত তিন রাত কাজ করে এবং বাকি রাতগুলিতে রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করে।” “আর একজন তেরো বছরের বালক…….সন্ধ্যা ছটা থেকে পরদিন বেলা বারোটা পর্যন্ত কাজ করত, এইভাবে এক সপ্তাহ কাজ করতে হত এবং কখনো কখনো একাদিক্রমে তিন শিফটে কাজ করতে হত, যথা সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার রাত্রি পর্যন্ত।” “আর একজন যার বয়স এখন বারো বছর, সে স্টেভলির একটি কাউন্টিতে একাদিক্রমে একপক্ষকাল সকাল ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করে, তারপর আর তার কাজ করার ক্ষমতা ছিল না।” জর্জ অ্যালিনসওয়ার্থ, বয়স নয় বছর গত শুক্রবার এখানে সেলার বয় (celler boy) হিসাবে কাজ করতে আসে; পরদিন ভোরে রাত তিনটায় আমাদের আবার শুরু করতে হয়, সেইজন্য আমি সারা রাত ঐখানেই থাকি। আমার বাড়ি পাঁচ মাইল দূরে। উপরে চুল্লী, সেই ঘরের মেঝেতে ঘুমাই, নীচে অ্যাপ্রনটি পাতি, গায়ে শুধু জ্যাকেটটা ঢাকা থাকে। আর দুদিন আমি সকাল ছটায় এখানে এসেছি। হ্যা ! এখানে গরম। এখানে আসবার আগে আমি প্রায় এক বছর গ্রামাঞ্চলে অন্যান্য কারখানায় এই একই কাজ করেছি। সেখানেও শনিবার ভোর রাতে তিনটার সময় কাজ শুরু করতাম—সর্বদাই তাই করতে হয়। কিন্তু সেখানে বাড়ি ছিল কাছেই এবং বাড়িতে ঘুমোতে পারতাম। বাকি দিন গুলিতে সকাল ছটায় কাজ আরম্ভ করে সন্ধ্যা ছটা কিংবা সাতটায় কাজ ছাড়তে হতো।” ইত্যাদি[৭]

এখন এই চব্বিশ ঘণ্টা কাজের প্রথা সম্পর্কে ধনিকদের বক্তব্য শুনুন। এই প্রথার বাড়াবাড়ি পদ্ধতিগুলি, নির্মম ও অবিশ্বাস্য ভাবে শ্রম-দিবসকে বাড়িয়ে এর অপব্যবহার সম্পর্কে স্বভাবতই এরা একেবারেই নীরব থাকেন। ধনিকরা এই প্রথার ‘স্বাভাবিক রূপ সম্পর্কে-ই শুধু বলেন।

ইস্পাত নির্মাতা নেলর অ্যাণ্ড ভিকার্স ছশ থেকে সাতশ লোক খাটান যাদের মধ্যে শতকরা দশজনের বয়স আঠারো বছরের নীচে এবং তাদের মধ্যে আবার মাত্র কুড়ি জন আঠারো বছরের কম বয়সের ছেলে রাত্রের দলে কাজ করত, এই মালিকেরা বলছেন : “ছেলেদের উত্তাপের জন্য কোন কষ্ট পেতে হয় না। তাপমাত্রা সম্ভবতঃ ৮৬° থেকে ৯০°……ফোর্জ ও বোলিং মিলগুলিতে শ্রমিকেরা পালা করে দিনরাত কাজ করে কিন্তু বাকি সব কাজ কেবল দিনে-ই হয়, অর্থাৎ সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। ফোর্জে কাজ চলে বারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। কিছু শ্রমিক সব সময়ই রাতে কাজ করে, তাদের দিন ও রাতে পালা করে খাটানো হয় না এবং যারা নিয়মিতভাবে রাতে এবং নিয়মিতভাবে দিনে কাজ করে তাদের স্বাস্থ্যে আমরা কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিনা সম্ভবতঃ পালাক্রমে বিশ্রামের সময় বদল না হলেই ঘুম ভালো হয় প্রায় কুড়ি ‘জন আঠারো বছরের কম বয়সের বালক রাতের পালায় কাজ করে।

. ‘আঠারো বছরের কম বয়সের ছেলে ছাড়া আমরা রাতের কাজ ভালভাবে চালাতে পারি না। আপত্তির কারণ এই যে তা না হলে পড়তা বেড়ে যায়……. প্রত্যেকটি বিভাগে কুশলী শ্রমিক এবং যথেষ্ট সংখ্যক লোক পাওয়া শক্ত কিন্তু বালকদের প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায়। কিন্তু যে রকম অল্প হারে আমরা বালকদের নিয়োগ করি তাতে এই বিষয়টি। অর্থাৎ রাতের কাজে নিষেধ ) আমাদের পক্ষে বিশেষ গুরুত্ব বা চিন্তার ব্যাপার নয়।”[৮]

একটি ইস্পাত ও লোহার কারখানা যেখানে পূর্ণবয়স্ক ও বালক মিলে তিন হাজার লোক খাটে এবং যেখানকার কাজকর্ম অংশতঃ যেমন, লোহ ও ইস্পাতের ভারি ভারি কাজ, দিনরাত পালা করে চলে সেই কারখানার মালিক জন ব্রাউন কোম্পানীর মিঃ জে, এলিস বলেছেন “ইস্পাতের ভারি কাজ এক কুড়ি বা দু কুড়ি পূর্ণবয়স্ক লোকের সঙ্গে একটি বা দুটি বালক কাজ করে। তাদের কারবারে ১৮ বছরের কম বয়সের পাচশর বেশি বালক কাজ করে, যাদের তিন ভাগের এক ভাগ অথবা ১৭০ জনের বয়স তেরো-র নীচে। আইনের প্রস্তাবিত পরিবর্তন সম্পর্কে মিঃ এলিস বলেন : “আঠারো বছরের বয়সের কোন ব্যক্তিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বারো ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হবে না, এতে আপত্তি করবার বিশেষ কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু রাতের কাজে বালকদের বাদ দেওয়া সম্পর্কে আমরা মনে করি না যে বারো বছর বয়স পর্যন্ত কোন সীমা নির্দেশ করা যায়। কিন্তু রাতের কাজে একেবারে বালকদের নেওয়া যাবে না এই অবস্থার চেয়ে আমরা বরং চাই যে তেরো বছরের নীচে অথবা এমনকি চোদ্দ বছর পর্যন্ত বালকদের নিয়োগ বন্ধ করা চলতে পারে। যে-সব বালক দিনের পালায় কাজ করে তাদের সময়মত রাতের পালাতেও কাজ করতে হয়, কারণ শুধু বয়স্কদের দিয়ে রাতের কাজ চলে না, এতে তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হবে…… কিন্তু আমরা মনে করি যে এক সপ্তাহ ছাড় দিয়ে দিয়ে রাতের কাজ ক্ষতিকর নয়। (নের অ্যাও ভিকার্স’ অপরপক্ষে তাঁদের কারবারের স্বার্থেই মনে করেছেন যে অবিরাম রাতের কাজের চেয়ে পালা করে ছাড় দিয়ে রাতে কাজ করানো সম্ভবত বেশি ক্ষতিকর)। পুর্ণবয়স্ক যারা এই কাজ করে এবং অপর যারা শুধু দিনের বেলাতেই কাজ করে তাদের উভয়কেই আমরা দেখতে পাচ্ছি……..আঠারো বছরের কম বয়সের বালকদের রাতে কাজ করতে না দেওয়া সম্পর্কে আমাদের আপত্তির কারণ হচ্ছে যে এতে খরচ বাড়বে, এবং এইটাই একমাত্র কারণ। (কী নির্মম সরলতা !) আমরা মনে করি যে আমাদের কারবারকে সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে খরচের এই বৃদ্ধি আমল ঠিক ঠিক বহন করতে পারিনা। (কেমন গালভরা কথা )! এখানে শ্রমিক দুর্লভ, এবং যদি এরকম নিয়ন্ত্রণ হয় তাহলে শ্রমিকের অভাব হতে পারে।” (অর্থাৎ এলসি ব্রাউন কোং এমন মারাত্মক দুর্বিপাকে পড়তে পারেন যে-অবস্থায় শ্রমশক্তির পূর্ণ-মূল্য দিতে তারা বাধ্য হবেন)।[৯]

মেসার্স ক্যামেল এণ্ড কোম্পানির সাইক্লপস ইস্পাত ও লৌহ কারখানা হচ্ছে পূর্বোক্ত জন ব্রাউন কোম্পানি পরিচালিত কারবারের মতই বৃহৎ আয়তনের। কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর লিখিতভাবে সরকারি কমিশনার মিঃ হোয়াইট-এর কাছে তার সাক্ষ্য দাখিল করেন। পরে অবশ্য পাণ্ডুলিপিটি দেখে দেবার জন্য তাকে ফেরৎ দেওয়া হলে তিনি ঐটি লুকিয়ে ফেলাই সুবিধাজনক মনে করেন। কিন্তু মিঃ হোয়াইটের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। তিনি স্পষ্ট মনে রাখেন যে সাইক্লাপ কোম্পানিটির মতে শিশুদের ও তরুণদের রাতের শ্রম নিষিদ্ধ করা অসম্ভব ব্যাপার হবে, তাতে কার্যতঃ কারখানাই বন্ধ করে দেওয়া হবে।” তবু তাদের কারবারের নিযুক্ত লোকের মধ্যে আঠারো বছরের নীচে বয়ঃক্রম শতকরা ছজনের কিছু বেশি এবং তেরো বছরের নীচে বয়ঃক্রম শতকরা একজনেরও কম।[১০]

ঐ একই বিষয়ে এটারক্লিফের ইস্পাতের বোলিং মিল ও ফোর্জের কারবারী ‘স্যাণ্ডারস ব্রাদার্স কোম্পানির মিঃ ই. এফ স্যাণ্ডারসন বলেন : আঠারো বছরের কম বয়সের তরুণদের রাতের কাজ নিষিদ্ধ হলে মহামুশকিল হবে। সবচেয়ে বেশি মুশকিল হবে এই যে বালকের বদলে পূর্ণবয়স্কদের নিয়োগ করলে খরচ বাড়বে। এই বৃদ্ধি কতটা হবে তা আমি বলতে পারি না কিন্তু সম্ভবত এমন হবে যার দরুণ কারবারীরা। ইস্পাতের দাম বাড়াতে পারবে না এবং সেজন্য এটি কারবারীদের ঘাড়েই চাপবে, অবশ্য এই ক্ষতির জন্য কোন লোকই (কী অদ্ভুত প্রকৃতির লোক!) দাম দিতে চাইবে না।” মিঃ স্যাণ্ডারসন্ শিশুদের কত মজুরি দেওয়া হয় তা জানেন না, কিন্তু সম্ভবতঃ কম বয়সের বালকেরা সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ শিলিং পায়-বালকদের কাজের প্রকৃতি হচ্ছে এই রকম যার জন্য সাধারণত (সাধারণত মানে অবশ্য সর্বদা নয় ) বালকদের শক্তিই বেশ যথেষ্ট এবং সেইজন্য পূর্ণবয়স্কদের বেশি থেকে এমন কিছু লাভ হবে না যা দিয়ে ক্ষতিপূরণ করা যাবে অথবা এমন কয়েকটি ক্ষেত্রেই তা করা যাবে। যেখানে ধাতু খুব ভাবি। পূর্ণবয়স্করা তাদের অধীনে বালকদের না থাকা পছন্দ করে না কারণ ঐ জায়গার পূর্ণবয়স্করা ততখানি বংশবদ হবে না। তা ছাড়াও বালকদের খুব কম বয়স থেকেই শিল্পের শিক্ষা আরম্ভ হওয়া দরকার। বালকদের জন্য শুধু দিনের কাজ নির্দিষ্ট থাকলে এই উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।” কেন হয় না? কেন দিনের বেলা তাদের কাজ থেকে বালকরা শিখতে পারে না? আপনারা কারণ বলুন? “পূর্ণবয়স্করা পালা করে এক সপ্তাহে দিনে এবং পরের সপ্তাহে রাতে কাজ করার জন্য অর্ধেক সময় তাদের বালকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং তাদের দরুন প্রাপ্য অর্ধেক লাভ হারাবে। শিক্ষানবীশকে যে শিক্ষা তারা দেয়, বালকদের শ্রমের মজুরির অংশ সেদিক দিয়ে তাদের প্রাপ্য। বলে বিবেচিত হয় এবং এইভাবে পূর্ণবয়স্করা সস্তাদরে বালকদের খাটাতে পারে। প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তিই এই লাভের অর্ধেক চায়।” অর্থাৎ এই প্রথা রহিত হলে পূর্ণবয়স্কদের মজুরির একাংশ বালকদের রাতের কাজ থেকে না এসে স্যাণ্ডারসনদের-ই দিতে হবে। অতএব স্যাণ্ডারসদের লাভ কিছুটা কম হবে এবং এইটাই হচ্ছে সদাশয় স্যাণ্ডারসনদের যুক্তি, যাতে তারা বলেছেন বালকেরা দিনের বেলায় শিল্প শিক্ষা করতে পারে না।[১১] এ ছাড়াও রাতের কাজ বালকরা না করলে, সেটা যারা দিনে কাজ করে তাদেরই ঘাড়ে চাপবে এবং তারা এটি সহ্য করতে পারবে না। বস্তুতঃ অসুবিধা এত বাড়বে যে তাদের হয়ত রাতের কাজ একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে এবং ই. এফ. স্যাণ্ডারসন বলেছেন, “আমাদের শিল্পের সঙ্গে যতটা সম্পর্ক আছে, তাতে ব্যাপারটা মানিয়ে নেওয়া যেত কিন্তু।” কিন্তু স্যাণ্ডারসনদের ইস্পাত তৈরি ছাড়াও আরো কিছু করতে হয়। ইস্পাত তৈরি হচ্ছে উদ্ধও কেবল মূল্য সৃষ্টির একটি অজুহাত। লোহা গলাবার ফার্নেস, বোলিং মিল প্রভৃতিকে কারখানার বাড়ি, যন্ত্রপাতি, লোহা, কয়লা ইত্যাদিকে কেবল ইম্পাতে পরিণত করা ছাড়া নিজেদেরকে আরও কিছু করতে হয়। তার বাড়তি শ্ৰম শোষণ করার কাজে লাগে এবং স্বভাবতই চব্বিশ ঘণ্টায় বারো ঘণ্টার চেয়ে বেশি শোষণ করে বস্তুতঃ তারা ঈশ্বর ও আইনের অনুগ্রহে কিছু লোককে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই খাটানোর দরুন স্যাণ্ডারসনদের একটি টাকার অংক উপহার দেয় এবং যে মুহূর্ত তাদের শ্রম-শোষণের কাজটি ব্যাহত হয়, তখনই তারা মূলধনের চরিত্র হারায় এবং সেইজন্য স্যাণ্ডারসনদের নিছক ক্ষতি হয়। কিন্তু তাহলে অত সব দামী দামী যন্ত্রপাতি অর্ধেক সময় বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতি হবে এবং বর্তমান ব্যবস্থায় আমরা যে পরিমাণ কাজ করতে পারছি সেই পরিমাণ কাজ করতে কারখানা ও যন্ত্রপাতি দ্বিগুণ করতে হবে, যার ফলে নিয়োজিত মূলধনকেও দ্বিগুণ করতে হবে। স্যাণ্ডারসনের এমন একটি সুবিধা চাইছেন যেটি অন্যান্য ধনিক যারা শুধু দিনে কাজ চালায় এবং তার ফলে যাদের বাডি, যন্ত্রপাতি, কঁচামাল রাত্রে অলস ভাবে পড়ে থাকে, তারা পান না? ই এফ, স্যাণ্ডারসন সমস্ত স্যাণ্ডারসনদের হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন : “একথা সত্য যে-সব কারখানা শুধু দিনে চলে তাদের যন্ত্রপাতি রাতে বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতি হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ফার্নেস এর ব্যবহারে একটি ক্ষতি হয়। যদি ফার্নেসকে চালু রাখতে হয় জ্বালানির অপচয় হবে ( এখন তার জায়গায় শ্রমিকের প্রাণশক্তির অপচয় হচ্ছে মাত্র), এবং যদি চালু বাধা না হয় তাহলে নূতন করে আগুন দিযে উত্তপ্ত কবতে অনেক সময়ের অপচয় হবে (যে-ক্ষেত্রে এমনকি আট বছরের শিশুব পর্যন্ত ঘুমের সময়ের ক্ষতি হচ্ছে। স্যাণ্ডারসনদের পক্ষে শ্রম-সমযের দিক দিয়ে লাভ ) এবং ফার্নেসগুলিও তাপমাত্রার কম বেশি হওয়ার ফলে জখম হবে।’ {যেন ঐ ফার্নেসগুলি দিনরাত শ্রমের পরিবর্তনের ফলে কিছুই পরিবর্তন হয় না)।[১২]

————

১. Child Emp. Commission, Third Report, 1864, p. iv, v, vil

২. “স্ট্যাফোর্ডশায়ার এবং সাউথ ওয়েলস—উভয় জায়গাতেই শিশু ও নারীদের নিযুক্ত করা হয় খাদের পাডে ও কয়লার চিবিতে, কেবল দিনেই নয় রাতেও। পার্লামেন্টের কাছে পেশকা রিপোর্টগুলিতে দেখা যায় যে, এই ব্যবস্থার ফলে বিপুল ও দারুণ অনাচার ঘটে। পোষাকে-আশাকে পুরুষ থেকে পার্থক্য করা দুঃসাধ্য ধুলোয় ও ধোয়ায় কালিমালিপ্ত এই মেয়েরা কাজ করে এমন পেশায়, যা আদৌ নারী-সুলভ নয়; স্বভাবতই তাদের মর্যাদাবোধ নষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের চারিত্রিক-অধঃপতনের পথ খুলে যায়।” ১ম খণ্ড, ১৯৪, পৃঃ xxvi. ৪র্থ রিপোর্ট—(১৮৬৫)-৬১, xiii দেখুন)। কঁচের কারখানাগুলিতেও অবস্থা একই রকম।

৩. রাতের কাজে শিশুদের নিয়োগ করেন, এমন একজন ইস্পাত-কারখানার মালিক মন্তব্য করেন : “এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় যে রাতের বেলায় যে-বালকেরা কাজ করে, তারা রাতে ঘুমোতে পারে না এবং দিনের বেলাতেও উপযুক্ত বিশ্রাম পায় না। (l.c. Fourth Report, 63, p. xiii). দেহের পোষণ ও পরিপুষ্টির জন্য সূর্যালোকের গুরুত্ব প্রসঙ্গে, একজন চিকিৎসক বলেন, “দেহ-কলাগুলিকে দৃঢ়তর করতে এবং সেগুলির স্থিতিস্থাপকতাকে পুষ্ট করতে আলো সরাসরি সেগুলির উপরে কাজ করে। আলোর উপযুক্ত পরিমাণ থেকে বঞ্চিত হলে প্রাণীর পেশীগুলি নরম ও অস্থিতিস্থাপক হয়ে পড়ে। ত্রুটিপূর্ণ উদ্দীপনের দরুন স্নায়বিক শক্তি ক্ষুন্ন হয় এবং দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ……. শিশুদের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় প্রচুর পরিমাণ আলোর নিরন্তর (সুলভতা) এবং দিনের একটা অংশে সরাসরি সূর্যকিরণের সংস্পর্শ স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে জরুরী। আলো রক্তে ভাল প্লাজমা গঠনে সহায়তা করে এবং শরীরের তন্তুগুলিকে শক্ত করে। দর্শনেন্দ্রিয় সম্পর্কে আলো উদ্দীপকের কাজ করে এবং, ফলতঃ, মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে আরো সক্রিয় করে। ওরসেস্টার জেনারেল হাসপাতাল’ এর সিনিয়র ফিজিসিয়ান ডাঃ ডবল স্ট্রেঞ্জ-এর লেখা ‘হেলথ’ নামক বই থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি নেওয়া হয়েছে। অন্যতম কমিশনার মিঃ হোয়াইটকে তিনি লেখেন, “ল্যাংকাশায়ারে থাকাকালে শিশুদের উপরে নৈশ শ্রমের ফলাফল লক্ষ্য করার সুযোগ আমার হয়েছিল এবং কোন কোন মালিক বলে থাকেন, তার প্রতিবাদে আমার একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, রাত্রে যে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়, অচিরেই তাদের স্বাস্থ্যহানি হয়।” (l.c. 285, p. 55 )। এমন একটি প্রশ্নে যে এমন বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে তা থেকেই বোঝা যায় ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ধনিকদের এবং স্তাবকদের মাথার কাজকেও কেমন প্রভাবিত করে।

৪. l.c. 57, p. xii.

৫. l.c, Fourth Report (1865 ), 58, p. xii.

৬. l.c. রিপোর্ট।

৭. l.c. পৃ: xiii এই শ্রমশক্তিগুলির সংস্কৃতির মাত্রা স্বভাবতই কতটা তা একজন কমিশনারের সঙ্গে নীচের কথােপকথনে ফুটে উঠেছে : জেবমিয়া হেনেস, বয়স ১২-“চারকে চার গুণ করলে আট হয়; চারবার চার যোগ করলে ১৬ হয়। রাজা হচ্ছে এমন একজন যার কাছে সমস্ত অর্থ ও সোনা আছে। আমাদের একজন রাজা আছে (সে বলল যে তিনি একজন বাণী ), সকলে তাকে রাজকুমারী আলেকজান্দ্রা বলে। বলল যে ইনি রাণীর ছেলেকে বিয়ে করেছেন। রাণীর ছেলেই হচ্ছে প্রিন্সেস্ আলেকজান্দ্রা। একজন প্রিন্সে হচ্ছে পুরুষ মানুষ। উইলিয়ম টার্ণর বয়স বারো: “আমি ইংল্যাণ্ডে থাকি না মনে হয় ঐটি একটি দেশ কিন্তু আগে জানতাম না।” জন্ মরিস বয়স চোদ্দ : “শুনেছি যে ভগবান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একজন ছাড়া সব লোক ডুবে মারা যায়।” “শুনেছি সেই লোকটি ছিল একটি ছোট্ট পাখি।” উইলিয়ম স্মিথ, বয়স পনের : “ভগবান মানুষ সৃষ্টি করলেন, মানুষ স্ত্রীলোক সৃষ্টি করল।” এডওয়ার্ড টেলর বয়স পনের : লণ্ডন জানি না।” হেরি ম্যাথিউম্যান বয়স, সতের : “চ্যাপেলে গিয়েছি কিন্তু সম্প্রতি প্রায় যাওয়া হয় না। একটি নাম সেখানে প্রচার করা হত, সেটি হচ্ছে যিসাস ক্রাইষ্ট কিন্তু আমি আর কারো কথা বলতে পারি না এবং যিসাস সম্পর্কেও কিছু বলতে পারি না। তাকে হত্যা করা হয়নি, অন্যান্য লোকের মতোই তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি কোন কোন ব্যাপারে অন্য সব লোক থেকে ভিন্ন ছিলেন, কারণ তিনি কোন কোন ব্যাপারে ধার্মিক ছিলেন, অপর লোকেরা তা নয়।” (পৃ: vx) “শয়তান ভাল লোক। সে কোথায় থাকে জানি না।” “ক্রাইস্ট ছিলেন দুষ্ট লোক।” এই বালিকা গড় বানান -এর মত করল, সে রাণীর নাম জানে না।” (শিশু-নিয়োগ কমিশন ৫ম রিপোর্ট, ৮৬৬,পৃঃ ৫৫, n. ২৭৮)। ধাতুশিল্পে ইতিপূর্বে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে ঐ একই ব্যাপার কাচ ও কাগজ শিল্পে চলে। কাগজের কারখানাগুলি যেখানে যন্ত্রের সাহায্যে কাগজ প্রস্তুত হয়, সেখানে ছেড়া কাপড়-কম্বল গোছানো ছাড়া আর সব কাজ রাত্রে করাই নিয়ম। কোন কোন ক্ষেত্রে পালাক্রমে রাতের কাজ অবিরাম সারা সপ্তাহ চলে, সাধারণতঃ রবিবার রাত থেকে পরবর্তী শনিবারের মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। যারা দিনে কাজ করে; ১২ ঘণ্টা করে ৫ দিন এবং ১৮ ঘণ্টা করে ১ দিন যারা রাতে কাজ করে তারা পাঁচ রাত বারো ঘণ্টা কাজ করে এবং প্রতি সপ্তাহে একরাত ছ’ঘণ্টা কাজ করে। অপরাপর ক্ষেত্রে, প্রত্যেক দল একাদিক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা একদিন অন্তর কাজ করে, একটি দল সোমবারে ছঘণ্টা ও শনিবারে আঠারো ঘণ্টা কাজ করে চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি মাঝা-মাঝি ব্যবস্থা থাকে যাতে সব শ্রমিকই, যার যন্ত্রের সাহায্যে কাগজ তৈরি করে, তারা সপ্তাহে প্রতিদিন পনের কিম্বা ষোল ঘণ্টা কাজ করে। এই পদ্ধতিতে, কমিশনার লর্ড বলেছে : “১১ ঘণ্টা ও ২৪ ঘণ্টা পালা-দৌড়-প্রথার সমস্ত খারাপ দিক জড়ো হয়েছে।” তেরো বছরের কম বয়সের বালক-বালিকা, আঠারো বছরের নীচে তরুণ-তরুণী এবং নারীর এই প্রথায় তাদের বদলির হাজির না হলে পর পর দুই শিফটে তার চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় যে বালক-বালিকার প্রায়ই অতিরিক্ত সময় খাটে এবং মাঝে মাঝে চব্বিশ ঘণ্টা অথবা এমনকি ছত্রিশ ঘণ্টা অবিরাম কাজ করে। কাচ তৈরির একটানা ও একঘেয়ে কাজ দেখা যায় যে বারো বছরের বালিকারা সারা মাস দৈনিক চৌদ্দ ঘন্টা করে কাজ করে। “খাবার জন্য দুবার বা বড়জোর নিবার আধঘণ্টা মাত্ৰ ছুটি ছাড়া আর কোন নিয়মিত বিশ্রাম বা কর্মবিরতি পাওয়া যায় না। কোন কোন কারখানায় যেখানে রাতে কাজ একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছে, যেখানে দারুণভাবে অতিরিক্ত খাটুনি চলে, এবং প্রায়ই এটি চলে সবচেয়ে নোংরা ও সবচেয়ে উত্তপ্ত এবং সবচেয়ে একঘেয়ে যে প্রক্রিয়া তাতে (শিশু facutat fata fatto iv, bye’, : xxxviii 47. xxxix 1 )

৮. চতুর্থ বিপোর্ট ইত্যাদি ১৮৮৫, ৭৯ পৃঃ xvi।

৯. i. c. ৮০ পৃঃ xvi

১০. 1 c. ৮২ পৃঃ xvii

১১. আমাদের এই যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার যুগে যদি কোন মানুষ প্রত্যেকটি ব্যাপারে, তা সে যতই খারাপ অথবা খেয়ালীই হোক না কেন, তার কারণ দেখাতে না পারে তাহলে তার কোন মোগ্যতা নেই। পৃথিবীতে যত খারাপ কাজ হয়েছে সেই সবগুলিই হয়েছে ভাল কারণের জন্য। (হেগেল, Zyklopadie der philosophischen Wissenschaften, Berlin-140 পুঃ ২৪৯)।

১২. 1. c. 85, p. xvii। শিশুদের জন্য নিয়মিত খাবার সময় বেঁধে দেওয়া অসম্ভব কেননা তা করলে ফার্নেসে কিছু পরিমাণ তাপের “নিছক ক্ষতি” বা “অপচয়” ঘটবে-কাচ কারখানার মালিকদের এই সকাতর আপত্তির জবাব দিয়েছেন কমিশনার হোয়াইট তঁার জবাব উরে সিনিয়র এবং তাদের রশার-মার্কা জার্মান ছিচকে লেখা চোরদের জবাবের মত নয় যারা সোনা খরচের ব্যাপারে ধনিকদের “মিতাচার” “আত্ম সংবরণ” ও “সঞ্চয় বৃত্তির দ্বারা এবং মানুষের প্রাণ খরচের ব্যাপারে তাদের তৈমুর লঙ্গ-সুলভ অমিতাচারের দ্বারা অভিভূত! “এই সব ক্ষেত্রে খাবারের সময় বেঁধে দিলে কিছু পরিমাণ তাপের অপচয় হতে পারে কিন্তু সেই অপচয় সারা রাজ্য জুড়ে কাচ-শিল্পের বাড়তি বয়সের ছেলেদের নির্বিঘ্নে খাবার মত এবং তার পরে সেটা হজম করাবার মত কিছুটা সময় না দেবার দরুন যে জৈব শক্তির অপচয় হয়, তার আর্থিক মূল্যের সমান নয়।” (l. c; p, xly) এবং এই ঘটনা ১৮৬৫ সালের প্রগতিশীল। যুগের সময়কার। ভারি জিনিস তোলা ও বয়ে নিয়ে যাওয়ায় যে শক্তিক্ষয় হয় তার হিসেব বাদ দিয়েও যেসব কারখানায়, ঘরে বোতল ও ফিল্টের কাচ তৈরি হয় সেখানে এই রকম একটি বালক ও শিশু তার কাজ উপলক্ষে প্রতি ছয়ঘণ্টায় পনের থেকে রিশ মাইল হাঁটে। এবং কাজ করতে হয় প্রায়ই চোদ্দ অথবা পনের ঘণ্টা। এসব কাচ কারখানায় অনেক ক্ষেত্রে যেমন সুতা কারখানায় ছঘন্টা পালার ব্যবস্থা আছে। “সপ্তাহে কাজের সময়ের মধ্যে যেকোন সময়ে একসঙ্গে সর্বাধিক বিশ্রামের সময় হচ্ছে মাত্র ছ’ঘণ্টা এবং এই ছ’ঘণ্টার মধ্যেই কাজের জায়গায় যাতায়াত শৌচক্রিয়া ও স্নানাদি বেশভূষা ও আহারের সময় ধরতে হবে যাতে বিশ্রামের জন্য অতি অল্প সময়-ই পাওয়া যায় এবং খোলা বাতাসে থাকা অথবা খেলাধূলা করার কোন সময়ই পাওয়া যায় না; অবশ্য যদি না এরকম উত্তপ্ত আবহাওয়ায় ও ক্লান্তিকর কাজের পর ছোট ছেলেরা -ঘুমিয়ে খোলা হাওয়ায় বসতে চায় ……এই অল্প সময়ের নিদ্রাও মাঝে মাছে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য যদি রাত্রির মধ্যে বালকটিকে আবার জাগাতে হয় অথবা দিনমানে গোলমালের জন্যই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।” মি হোয়াইট দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যেখানে একটি বালক একাদিক্রমে ছত্রিশ ঘণ্টা কাজ করে; অপর কয়েকটি দৃষ্টান্তে তিনি দেখিয়েছেন যে বারো বছরের বালকেরা রাত্রি দুটো পর্যন্ত কাজ করে চলে এবং তারপর কারখানার ঘরেই সকাল পাঁচটা পর্যন্ত (মাত্র তিন ঘণ্টা!) ঘুমিয়ে আবার কাজ শুরু করে। ট্রেমন-হিয়ায় ও ট্রাফনেল যারা রিপোর্টটি লিখেছেন তারা বলেছেন যে, নাবালক ও নাবালিকা ও নারী-শ্রমিকরা দিনে বা রাতে কার্যকালে যে পরিশ্রম করে, সেটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত বেশি। (l, c. xiii ও xliv।) ঠিক যে সময় সম্ভবতঃ একটু বেশি রাতেই আত্মত্যাগী কঁাচ নির্মাতা ধনীরা মদে চুর হয়ে তাঁদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে বাড়ি যাবার পথে নির্বোধের মত গুনগুন করে গান করেন, বৃটেন কখনো হবে না গোলাম।”

.

.

১০.৫  ন্যায্য শ্রমদিবসে অন্য সংগ্রাম চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতকের শেষ পর্যন্ত শ্রমদিবসকে দীর্ঘতর করার জন্য বিবিধ বাধ্যতামূলক আইন

“একটি এম-দিবস কাকে বলব? শ্রমশক্তিকে দৈনিক ক্রয় করে ধনিক তাকে কতটা শোষণ করতে পারে? শ্রম শক্তির মূল্য পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম সময় ছাড়িয়ে শ্রম-দিবসকে কতদূর পর্যন্ত বাড়ানো যায়?” আমরা দেখেছি যে এইসব প্রশ্নের উত্তরে ধনিক বলে : শ্রম-দিবসের মধ্যে পড়ে পুরো চব্বিশ ঘণ্টা, তার মধ্যে শুধু সেই কয় ঘণ্টা বিশ্রামের জন্য বাদ রাখতে হবে যেটুকু না করলে স্বয়ং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনই একেবারে অসম্ভব হয়। অতএব এটি সুস্পষ্ট যে সারাজীবন ধরে শ্রমিক তার শ্রমশক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং সেইজন্য তার হাতের সমস্ত সময়-ই প্রকৃতি ও আইন নির্দেশে শ্রম-সমমরূপে মূলধনের আত্মপ্রসারের কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষা, মানসিক উন্নতি, সামাজিক কর্মানুষ্ঠান ও সামাজিক মেলামেশা, শরীর ও মনের স্বচ্ছন্দ বিকাশ এমনকি রবিবারের বিশ্রামের সময় পর্যন্ত (এবং যে-দেশে রবিবার পবিত্র ছুটির দিন বলে গণ্য)[১] সবই বাজে ! কিন্তু নিজের অন্ধ অসংযত আবেগ, উদ্ধত্ত শ্রমের জন্য রক্তপিপাসু নেকড়ের ক্ষুধা নিয়ে মূলধন শুধুমাত্র নৈতিকতার সীমাই লঙ্ঘন করে না,পরন্তু শ্রম-দিবসের নিছক শারীরিক সীমা অতিক্রম করে। মানুষের শরীরের বৃদ্ধি, উন্নতি ও সুস্থ অবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ও সে আত্মসাৎ করে। টাটকা হাওয়া ও সূর্যের আলো পাবার জন্য যেটুকু সময় দরকার সেটুকুও সে চুরি করে। এরা খাবার সময় নিয়ে টানাটানি করে, ঐ সময়টুকুকে যেখানেই সম্ভব উৎপাদন-প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তভূক্ত করার চেষ্টা করে, যাতে শ্রমিকদের খাদ্য হয়ে ওঠে মাত্র উৎপাদনের একটি উপকরণ ঠিক যেমন বয়লারে কয়লা সরবরাহ করা হয় এবং যন্ত্রপাতিতে চর্বি ও তেল প্রয়োগ করা হয়। যাতে ক্ষতিপূরণের পরে সতেজ হয়ে আবার শরীরের শক্তি ফিরে আসে তার জন্যে যে গভীর নিদ্রার দরকার ধনিকেরা পরে তার জায়গায় শুধু কয়েক ঘণ্টা মূহমান অবস্থায় বেহুস হয়ে পড়ে থাকতে দেয়, যা একেবারে পরিশ্রান্ত দেহ-যন্ত্রের পক্ষে আবার কাজ করতে হলে অপরিহার্য। শ্রমশক্তির স্বাভাবিক সংরক্ষণ দিয়ে শ্রম-দিবসের সীমা নির্ধারণ করা হয় না; পরন্তু প্রতিদিন শ্রমশক্তির সর্বাধিক ব্যয়, সেটা স্বাস্থ্যকে যত-ই নষ্ট করুক, যতই পীড়ন-মূলক ও কষ্টকর হোক, তাই দিয়েই নির্ধারিত হয় শ্রমিকদের বিশ্রামের সময় কিভাবে সীমাবদ্ধ করা যায়। শ্রমিক কতদিন বাঁচবে অথবা শ্রমশক্তির জীবনের মেয়াদ নিয়ে ধনিক মাথা ঘামায় না। তাদের চিন্তা কেবল এবং একমাত্র এই নিয়ে যে কিভাবে শ্রমশক্তিকে সর্বাধিক শোষণ করা যায়, শ্রম দিবসের কতখানি জুড়ে তাকে সচল রাখা যায়। এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে ধনিক শ্রমিকের আয়ু কমিয়ে দেয়, যেমন একজন লোভী কৃষক বেশি ফসল পাবার লোভে তার চাষের জমির উর্বতা নষ্ট করে ফেলে।

ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি (বিশেষ করে উদ্ব-মূল্যের উৎপাদন, উদ্বৃত্ত শ্রমের শোষণ এইভাবে শ্রম-দিবসকে বাড়িয়ে শুধু যে মানুষের স্বাভাবিক নৈতিক ও শারীরিক উন্নতি ও প্রক্রিয়ার সুযোগ-সুবিধা হরণ করে মানুষের শ্রমশক্তির অবনতি ঘটায, তাই নয়-পবন্তু এর দ্বারা শ্রমশক্তিকেও অকালে নিঃশেষ করে তার মৃত্যু ঘটায়।[২] এতে একটি নির্দিষ্ট সমযের মধ্যে উৎপাদনের কাজে শ্রমিকদেব খাটুনির সময় বাড়িয়ে তার সত্যকার আয়ুষ্কাল কমিয়ে ফেলা হয়।

কিন্তু শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে অন্তভুক্ত রয়েছে শ্রমিকের পুনরুৎপাদন অথবা শ্রমিক শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকারি পণ্যগুলির মূল্য। অতএব যদি শ্রম দিবসকে অস্বাভাবিকরূপে বাড়ানো হয় যে কাজটি ধনিকের। অত্মপ্রসারের সীমাহীন লালসার জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে, এতে ব্যক্তিগতভাবে শ্রমিকের আয়ুষ্কাল কমে যায়, ফলত শ্রমশক্তির আয়ুষ্কালও কমে, যার এলে অনেক দ্রুতগতিতে ক্ষয় পাওযা শক্তিগুলিব স্থানপূরণ করতে হয় এবং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের খরচের অঙ্ক বাড়ে; ঠিক যেমন একটি যন্ত্রের ক্ষেত্রে বেশি তাড়াতাড়ি ক্ষয় হলে তার জন্যে প্রতিদিন বেশি মূল্যের পুনরুৎপাদন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অতএব এইটাই প্রতিভাত হয় যে মূলধনের স্বার্থেই একটি স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের দিকে এগোতে হয়।

দাস-মালিক ঠিক যেমন নিজের ঘোডা কেনে, তেমনি নিজের শ্রমিককেও কেনে। যদি তার দাস মারা যায় তাহলে তার মূলধনের ক্ষতি হয় যে ক্ষতি দাস-বাজাবে আবাব নোতুন বিনিয়োগ কবে পূরণ করতে হয়। কিন্তু জর্জিয়ার ধানের ক্ষেত অথবা মিসিসিপির জল। অঞ্চল মানুষেব স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে; এইসব অঞ্চলে চাষ করতে হলে মনুষ্য-জীবনের অপচয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে কিন্তু এই অপচয় এত বেশি নয় যা ভার্জিনিয়া ও কেন্টাকির ঘন বসতি থেকে পূরণ করা যায় না। অধিকন্তু যে-কোন একটি স্বাভাবিক অবস্থায় খরচ বাঁচাবার প্রয়োজন থেকে প্রভুর স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার যে সমতা আসে, তারজন্য কিছুটা সদয় মানবিক ব্যবহারের আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু-দাস বিক্রির ব্যবসা প্রবর্তিত হবার পরে দাসকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত খাটিয়ে নেবার যুক্তি এসে যায়; কারণ যখন বিদেশের দাস-সংগ্রহের কেন্দ্র থেকে তার জায়গা পূরণ করা চলে, তখনি তার বেঁচে থাকার সময়ের কার্যকারিতার চেয়ে তার আয়ুষ্কালের পরিমাণের গুরুত্ব কমে যায়। অতএব দাস-ব্যবস্থাপনার এটি একটি মূল কথা এই যে, যে-সব দেশে দাস আমদানি করা হয় সেখানে সবচেয়ে কার্যকরী আর্থিক হিসেব হচ্ছে এই কম সময়ে গোলামকে নিঙড়ে কত বেশি কাজ পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম-প্রধান অঞ্চলের কৃষিতে যেখানে বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ প্রায় গোটা বাগিচার সমগ্র মূল ধনের সমান হয়, সেখানে নিগ্রোর সেীবনকে একেবারে যথেচ্ছভাবে বলি দেওয়া হয়। ওয়েস্ট-ইণ্ডিজ-এর কৃষি যেখানে বহু শতাব্দী ধরে রূপকথার মত ধনদৌলত সৃষ্টি হয়েছে সেখানে আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ সন্তানের সমাধি হয়েছে। বর্তমান সম (উনিশ শতক) কিউবার আয়ের পরিমাণ কোটি কোটি টাকা দিয়ে হিসাব করা হয় এবং যেখানে বাগিচার মালিকরা হচ্ছে সবাই নবাব, সেখানেই আমরা দেখি দাস শ্রেণী সবচেয়ে খারাপ খেয়ে সর্বাধিক ক্লান্তিকর ও বিরামহীন পরিশ্রম করে এবং এমনকি প্রতি বছর তাদের একটি অংশ ধ্বংস বরণ করে।[৩]

Mutato nomine de te fabulu narratur.-93 Enfoco 777-712911 জায়গায় লিখুন শ্রমের-বাজার, কেন্টাকি ও ভার্জিনিয়ার জায়গায় লিখুন আয়াাণ্ড এবং ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও ওয়েস্-এর কৃষিপ্রধান জেলাগুলি, আফ্রিকার বদলে লিখুন জার্মানি। আমরা দেখেছি যে, কিভাবে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য লণ্ডনের রুটি-সেঁকা মজুরেরা বিলুপ্ত হচ্ছে। তবু রুটির কারখানায় মৃতের জায়গা নেবার জন্য জার্মান ও অপরাপর জায়গাৰ কৰ্ম প্রার্থীদের দিয়ে লণ্ডনের শ্রমের-বাজার সদা সর্বদা ঠাসা। আমরা আরো দেখেছি যে পটারি-শিল্পে পরমাযু সবচেয়ে কম। তাতে কি পটারি-কর্মীব কোন হনটন হয়েছে? আধুনিক পটারি-শিল্পের আবিষ্কারক যোশিয়া ওয়েজউড, যিনি শুরুতে নিজে একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন, তিনি ১৮৭৫ সালে কমন্স-সভায় বলেন যে সমগ্র শিল্পে পনের থেকে বিশ হাজার লোক কাজ করে। ১৮৬১ সালে গ্রেটব্রিটেনে শুধু এই শিল্পের শহর-কেন্দ্রগুলির জনসংখ্যা দাড়ায় ১০১,৩০২। বস্ত্রশিল্প নব্বই বছর ধরে চলেছে….. এটি ইংরেজ জাতির তিন পুরুষ থেকে আছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে অনায়াসে একথা বলা যায় যে এই সময়ের মধ্যে এই শিল্প কারখানা-মজুরদের নটি পুরুষ ধ্বংস করেছে।”[৪]

একথা নিঃসন্দেহ যে অত্যন্ত কর্মচঞ্চল কোন কোন সময়ে বাজারে তাৎপর্য পূর্ণ অনটন দেখা গিয়েছে, যেমন ১৮৩৪ সালে। কিন্তু তখন শিল্প মালিকরা গরিব আইন কমিশনারদের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন যে, তাদের উচিত কৃষিপ্রধান জেলাগুলি “বাড়তি জনসংখ্যাকে উত্তরাঞ্চলে পাঠানো, তার সঙ্গে এই ব্যাখ্যা ছিল যে “শিল্প মালিকেরা তাদের সকলকে কাজ দেবেন এবং উজার করে ফেলবেন।[৫] গরিব আইন’ কমিশনারদের সম্মতি নিয়ে এজেন্টদের নিযুক্ত করা হল…ম্যাঞ্চেষ্টারে একটি অফিস খুলে সেখানে কৃষিপ্রধান জেলাগুলির কর্মপ্রার্থী শ্রমিকদের তালিকা পাঠানো হতে থাকলে এবং ঐ নামগুলি রেজিষ্টার-ভুক্ত হল। শিল্প-মালিকরা এইসব অফিসে আসতেন এবং পছন্দ মাফিক লোক বাছাই করতেন, তাদের দরকার-মত লোক বেছে তারা এদের ম্যাঞ্চেষ্ট’রে চালান করবার জন্য নির্দেশ দিতেন এবং ঠিক মালের বস্তার মত টিকিট এটে তাদের খালপথে অথবা গাড়িতে পাঠানো হত, কিছু কিছু লোক রাস্তায় হেঁটে রওনা হত এবং তাদের অনেককে রাস্তায় অর্ধাহারে পথ হারিয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখা যেত। এই প্রথাটি একটি নিয়মিত ব্যবসা হয়ে ওঠে। পার্লামেন্ট হয়ত বিশ্বাস করতে পারবে না, কিন্তু আমি তাদের বলতে পারি যে মানুষের রক্ত-মাংস নিয়ে এই ব্যবসা ভালভাবেই চলছিল, কার্যতঃ ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্প-মালিকদের কাছে এদের তেমন-ই নিয়মিতভাবে বিক্রি করা হত যেমন যুক্তরাষ্ট্রে তুলা-বাগিচার মালিকদের কাছে দাসদের বিক্রি করা হয় ….. ১৮৬০ সালে, “বস্ত্রশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতির সময়।” …শিল্প-মালিকরা আবার দেখলেন যে শ্রমিকের অভাব হচ্ছে তারা তখন আবার মাংস বিক্রেতাদের’ (এদের এই নামেই ডাকা হয়। কাছে আবেদন করলেন। এই এজেন্টরা ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে, ডরসেটশায়ারের চারণভূমিতে, ডিভনশায়ারে তৃণাঞ্চলে, উইল্টশায়ারের গো-পালকদের মধ্যে গেলেন, কিন্তু অনুসন্ধান বৃথা হল। অতিরিক্ত জনসংখ্যা উজার হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তিসম্পন্ন হবার পর ‘বেরি গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছিল যে “ল্যাঙ্কাশায়ারে দশ হাজার বাড়তি শ্রমিক কাজ পেতে পারে এবং ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজারের দরকার হবে।” কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির পর একটি প্রতিনিধিদল লণ্ডনে আসেন এবং গণ্যমান্য ভদ্র ব্যক্তি ( গরিব অইন পর্ষং-এর সভাপতি ভিলিয়ার্স ]র কাছে এই উদ্দেশ্যে ধর্ণা দেন যাতে তিনি ল্যাঙ্কাশায়ারের মিলগুলির জন্যে দরিদ্র-নিবাস থেকে গরিব ও অনাথ শিশুদের সংগ্রহ করে দেন।[৬]

ধনিকের কাছে সাধারণভাবে যে অভিজ্ঞতা প্রকট হয় তা হচ্ছে সদাসর্বদা জনসংখ্যার একটি বাড়তি অংশ, অর্থাৎ এমন একটি অংশ যা মূলধনের শ্রম-বিশোষণের সাময়িক প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি,-যদিও সেই বাড়তি জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে কয়েক পুরুষের মানুষ। যাদের দেহ খবিত, আ, লুণ্ঠিত, যারা দ্রুতগতিতে একে অন্যকে স্থান করে দেয়। বলা যায় যে বিকশিত হবার আগেই যারা মুকুলে ঝরে যায়।[৭] বস্তুতঃ বুদ্ধিমান দর্শককে বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয় যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালী যার সূচনা ইতিহাসগত ভাবে এই সেদিন মাত্র হয়েছে, এই প্রণালীটি কেমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শক্ত মুঠোয় জনগণের জীবনীশক্তির মূল পর্যন্ত ধরে ফেলেছে—দেখিয়ে দেয় কেমন করে শিল্পে নিযুক্ত জনসংখ্যার অধোগতিকে ঠেকিয়ে রাখছে গ্রামাঞ্চল থেকে আগত জনস্রোত যারা শারীরিক দিক থেকে তখনও কলুষিত হয়নি—দেখিয়ে দেয়, কেমন করে এই গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকরা টাটকা হাওয়া পেলেও এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম, যা শুধু সবচেয়ে শক্তিশালীকেই বাঁচিয়ে রাখে তার অনুকূল প্রভাব সত্ত্বেও, তারা ইতিমধ্যে লোপ পেতে বসেছে।[৮] ধনতান্ত্রিক অবস্থায় ধনিকদের স্বার্থে চারদিকের অগণিত শ্রমিকের কষ্টভোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নেওয়া হয়, এর ধ্বজাধারীরা কার্যক্ষেত্রে মনুষ্যজাতির আসন্ন অধধাগতি ও শেষ পর্যন্ত অবলুপ্তিতে ঠিক ততখানি অথবা ততটুকুই বিচলিত হন, যতটা হন এই পৃথিবীটা সুর্যের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনায়। ফাটকাবাজির প্রত্যেকটি জুয়োখেলায় প্রত্যেকেই জানে যে একদিন সর্বনাশ আসবেই, কিন্তু প্রত্যেকেই আশা করে যে সে ধনদৌলত আয়ত্ত করে নিরাপদ জায়গায় সরাবার পর তার প্রতিবেশীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। আমি যদি বাচি, তবে বিশ্ব ধ্বংস হয় হোক। Apres_moi le deluge ! এইটি হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি ধনিকের এবং সাধারণভাবে প্রত্যেকটি ধনিকজাতির মূলমন্ত্র। সেইজন্যই সমাজ বাধ্য না করলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা শ্রমিকের স্বাস্থ্য অথবা পরমায়ু সম্পর্কে কিছুমাত্র তোয়াক্কা করে না।[৯] শারীরিক ও মানসিক অপোগতি, অকালমৃত্যু, অতিরিক্ত খাটুনির যন্ত্রণা ইত্যাদি নিয়ে চীৎকারের বিরুদ্ধে এরা জবাব দেয়। ওদের থেকে আমরা মুনাফা করি বলেই কি এইসব ব্যাপারে আমাদের ঝামেলা পোয়ানো উচিত? কিন্তু সমগ্রভাবে দেখলে এইসব-ই ব্যক্তিগতভাবে ধনকের সদিচ্ছা আছে কি নেই তার উপর নির্ভর করে না। অবাধ প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে প্রকট করে,-এই নিয়মগুলি বাইরের বাধ্যতামূলক-বিধান হিসাবে প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত ধনিকের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।[১০]

স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বহু শতাব্দী ব্যাপী মালিক ও শ্রমিকদের সংঘর্ষের ফল। এই সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের যুগের ব্রিটিশ কারখানা-আইনগুলিকে চোদ্দ শতক থেকে আঠারো শতকের একেবারে মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্রিটিশ শ্রম-সম্পর্কিত বিধানগুলির সঙ্গে তুলনা করুন।[১১] আধুনিক কারখানা-অইন যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম দিবসের পরিমাণ কমিয়েছে, পুর্ববর্তী আইনগুলি বাধ্যতামূলকভাবে ঐ সময় বাড়িয়েছে। সদ্যোজাত ধনতন্ত্র আত্মপ্রসারের সূচনায় যথেষ্ট পরিমাণ উত্ত শ্রম শোষণ করবার অধিকার পেয়েছিল কেবলমাত্র তখনকার অর্থনৈতিক সম্পর্কের জোরেই নয়, পরন্তু রাষ্ট্রের সাহায্যে, কিন্তু একথা সত্য যে সেদিনকার তাদের সেই সুবিধাকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয় যখন দেখি যে উদীয়মান ও সংগ্রামশীল ধনতকে সাবালক অবস্থায় কিরকম সুবিধা ছাড়তে হয। বহু শতাব্দী কেটে যাবার পরে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রসারের ফলে স্বাধীন’ শ্রমিক তার গোট। কর্মজীবন তার নিজস্ব শ্ৰম ক্ষমতা বিক্রি করে দিতে রাজি হয়, অর্থাৎ সামাজিক অবস্থার চাপে প্রাণ ধারণের দ্রব্য-সামগ্ৰী মূল্য হিসাবে, কেবল পেটের খোরাকের জন্য নিজের জন্মগত অধিকার বিকিয়ে ঠিতে বাধ্য হয়। অতএব এটা স্বাভাবিক যে চোদ্দ শতকের মধ্যভাগ থেকে সতের শতকের শেষ পর্যন্ত ধনিকেরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাবলীর মাধ্যমে পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকদের শ্রম-দিবস দীর্ঘতর করবার যে চেষ্টা করত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এখানে-ওখানে শ্রম-দিবসের হ্রস্বতা সাধিত হল। প্রায় একইভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা, শিশুদের রক্ত থেকে ধনীর মুনাফা করা বন্ধ করবার জন্য। বর্তমান সময়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ ম্যাসাচুসেট রাজ্যে, যেটি খুব সম্প্রতিকালেও উত্তর আমেরিকার সাধারণতন্ত্রের অঙ্গ রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন ছিল, সেখানেও বারো বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য শ্রমের যে আইনগত সীমা ঘোষণা করা হয়েছে, সতেরো শতকের মধ্যভাগে ইংল্যাণ্ডে সেইটাই ছিল সবলদেহ কারিগর, সুস্থদেহ শ্রমিক, শক্তসমর্থ কর্মকারদের স্বাভাবিক শ্রম-দিবস।[১২]

প্রথম “শ্রমিক বিষয়ক আইন” (তৃতীয় এডওয়ার্ড, ১৩, ১৩৪৯,)-এর তৎকালীন অজুহাত ছিল (এটা কারণ ছিল না, কারণ এই অজুহাত চলে যাবার পরও এই ধরনের আইন বহু শতাব্দী চলতে থাকে। এই যে প্লেগ মহামারীতে এত লোক-ক্ষয় হয় যে একজন রক্ষণশীল লেখক বলেন, “যুক্তিসঙ্গত শর্তে কাজ করবার জন্য লোক পাওয়া এত শক্ত (অর্থাৎ এমন মজুরি নিয়ে তারা কাজ করবে যাতে নিয়োগ-কর্তাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রম থাকে) হয়ে উঠেছে যে তা সহ্য করা যায় না।[১৩] অতএব আইন করে সঙ্গত মজুরি ও সেইসঙ্গে শ্রম-দিবসের পরিমাণ নিদিষ্ট হল। এই শেষোক্ত বিষয়, যেটি নিয়ে এখানে আলোচনা হচ্ছে, এটি পুনরুল্লিখিত হয়েছে ১৪৯৬ সালের আইনে (সপ্তম হেনরি )। সমস্ত কারিগর ও ক্ষেত-মজুরের জন্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই আইন অনুযায়ী শ্রম-দিবস ( কিন্তু এটিকে বলবৎ করা সম্ভব হয়নি। সকাল পাঁচটা থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত চলবে। কিন্তু খাবারের জন্য প্রাতঃরাশের একঘণ্টা, ডিনারের দেড়ঘণ্টা ও মধ্যাহ্নকালীন আধঘণ্ট। ছুটি থাকবে, অর্থাৎ বর্তমান সময়ে কারখানা-আইনে নির্দিষ্ট ছুটির ঠিক দ্বিগুণ।[১৪] শীতকালে সকাল পাচটা থেকে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত কাজ চলবে স্থির হয় এবং শ্রম-বিরতি একই রকম থাকে। এলিজাবেথের ১৫ ৭২ সালের একটি আইন “দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিতে নিযুক্ত” সমস্ত শ্রমিকের দৈনিক শ্রমের সময় স্পর্শ না করে গ্রীষ্মে শ্রম-বিরতিকে আড়াই ঘণ্টা করতে চেয়েছেন অথবা শীতকালে দুই ঘণ্টা মাত্র। মধ্যাহ্নভোজন এক ঘণ্টার করতে চেখেছেন অথবা শীতকালে দুই ঘণ্ট! মাত্র। মধ্যাহ্নভোজন এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হত এবং “আধঘণ্টার বৈকালীন নিদ্রা কেবলমাত্র মে মাসের মাঝামাবি থেকে আগষ্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনুমোদিত ছিল। প্রত্যেক ঘণ্টা অনুপস্থিতির জন্য মজুরি থেকে এক পেনি কাটা যেত। কার্যক্ষেত্রে আইনের শর্তের চেয়ে শ্রমিকদের অবস্থা অনেক ভাল ছিল। উইলিয়ম পেটি যাকে অর্থবিজ্ঞানের জনক এবং কতকাংশে সংখ্যাতত্ত্বেরও প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, তিনি সপ্তদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে প্রকাশিত এক রচনায় বলেন : “মেহনতি মানুষ (তখনকার দিনে অর্থ ছিল কৃবিশ্রমিক। দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজ করে এবং সপ্তাহে কুডিবার খায়, যথা কাজের দিনে তিনবার ৩০ রবিবার দুবার; এর থেকে বোঝা যায় যে যদি তারা শুক্রবার রাত্রে উপবাস করে এবং বেলা এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত দুঘণ্টা ভোজনের সময় না নিয়ে যদি ১২ ঘণ্ট। মাত্র নেয়, অর্থাৎ ২ ভাগ বেশি কাজ করে ও ২ ভাগ কম খরচ করে, তাহলে উল্লিখিত ট্যাক্স তোলা সম্ভব।[১৫] ডাঃ এণ্ড, উরে যখন ১৩৩৩ সালের বারে। ঘণ্ট। আইনের প্রস্তাবকে নিন্দা করে বলেছিলেন যে অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের দিকে পিছিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন কি তিনি ঠিকই বলেন নি? একথা সত্য যে পেটির বর্ণিত আইনের শর্তগুলি শিক্ষা-নবীশদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতকের শেষ দিকেও শিশুদের শ্রমের অবস্থা সম্পর্কে নিম্নলিখিত অভিযোগ থেকে পাওয়া যায়। তাদের দেশে (জার্মানিতে) আমাদের এই দেশের মত শিক্ষা নবীশকে সাত বছর শত-বদ্ধ করে রাখার প্রথা নেই; ওদের দেশে তিন বা চার বছর-ই হচ্ছে চতি প্রথা এবং এর কারণ হচ্ছে এই যে এরা জন্মাবার পর থেকেই কাজ করতে শেখে যাতে তাদের নিপুণ ও আজ্ঞাবহ করে তোলে এবং ফলতঃ তারা বেশি তাড়াতাড়ি পূর্ণ কুশলতা লাভ করে ও কাজকর্মে পটু হয়ে ওঠে। আর আমাদের তরুণ বয়স্করা এই ইংল্যাণ্ডে শিক্ষা-নবীশ হবার আগে কোন শিক্ষাই না পেয়ে শেখে খুব আস্তে আস্তে এবং সেই জন্য কুশলী শিল্পীর সর্বাঙ্গীন উৎকর্য অর্জন করতে তাদের অনেক বেশি সময় লাগে।[১৬]

তথাপি আঠারো শতকের বেশির ভাগ সময়ে আধুনিক শিল্প ও যযুগের সময় পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের ধনতন্ত্র সাপ্তাহিক মজুরি দিয়ে শ্রমশক্তি শ্রমিকের গোটা সপ্তাহের পরিশ্রমের ক্ষমতা হস্তগত করতে পারেনি, শুধুমাত্র কৃষি মজুরের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম হয়েছিল। চার দিন খেটে পুরো সপ্তাহের জীবিকা হয়ে যেত কিন্তু শ্রমিক কেন যে আরও দুদিন ধনিকের হয়ে খাটবে না এইটাই তার যথেষ্ট কারণ বলে শ্রমিকের কাছে প্রতীয়মান হত না। একদল অর্থনীতিবিদ ধনতন্ত্রের স্বার্থে এই একগুয়েমির অত্যন্ত তীব্র নিন্দা করলেন, আর একটি দল শ্রমিকদের সমর্থন করলেন। এখন শোনা যাক এই দুই দলের বিতর্ক-পোষ্টলেথওয়েট যার “বাণিজ্যের অভিধানের” সে সময়ের খ্যাতি আজকের দিনে ঐ বিষয়ে ম্যাক-কুল্যক ও ম্যাকগ্রেগরের রচনার সমান ছিল, তার সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্যবিষয়ক নিবন্ধ’-এর রচয়িতার (ইতিপূর্বে এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ) বিতর্ক।[১৭]

অন্যান্য অনেক কথার মধ্যে পোষ্টলেথওয়েট বলেন : “বহুলোকের মুখে উচ্চারিত এই আলোচনা শেষ করতে পারি না; মন্তব্যটি এই যদি মেহনতি গরীব মানুষ পাঁচদিন খেটে যথেষ্ট রোজগার করে, তাহলে তারা পুরো ছদিন কাজ করবে না। এর থেকে এরা এই সিদ্ধান্ত টানছেন যে জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদির ওপরে ও ব র চাপিয়ে তাদের দাম বাড়ানো দরকার, অথবা অন্য যে কোন উপায়ে কারিগর ও কারখানা শ্রমিকদের গোটা সপ্তাহে ছ’দিন এক নাগাড়ে কাজ করতে বাধ্য করাতে হবে। এই রাজ্যে শ্রমজীবী-জনগণের অবিরাম দাসত্বের জন্য যারা ওকালতি করেন সেইসব বড় বড় রাজনীতিবিদ থেকে আমি সবিনয়ে আমার মত পার্থক্য ‘ঘোষণা করতে চাই। ওঁরা অতি সাধারণ প্রবচনটিও ভুলে গিয়েছেন : “খেলা ছাড়া কেবল কাজে, জ্যাকের বুদ্ধি যায় মজে।” ইংরেজরা কি তাদের কারিগর ও কারখানা-শ্রমিকের নিপুণতা ও কর্মকুশলতা নিয়ে গর্ব করেন না যে এইজন্যই সাধারণভাবে ব্রিটিশ পণ্যের আদর ও সুনাম? এটা কেমন করে সম্ভব হল? শ্রমজীবী-মানুষ নিজেদের খুশি মতো বিশ্রাম যাপনের সুবিধা পেয়ে এসেছে বলে-ই খুব সম্ভব এটি হতে পেরেছে। যদি সপ্তাহে ছ’দিন করে সারা বছর বিরামহীনভাবে তাদের কাজ করতে হত, একই কাজের পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠান, তাতে কি তাদের কর্মকুশলতা ভোতা হত না এবং তাতে সজাগ ও চৌকস না হয়ে তারা কি নির্বোধ হয়ে যেত না? এবং এতে কি অবিরাম দাসত্বের ফলে আমাদের শ্রমিকদের সুনাম নষ্ট হত না?….. এই ধরনের কঠোরভাবে তাড়িত প্রাণীদের কাছে আমরা কী ধরনের দক্ষতা প্রত্যাশা করি? ….. … এদের মধ্যে অনেকেই চার দিনেই যে পরিমাণ কাজ করবে, একজন ফরাসী শ্রমিকের সেই কাজ করতে পাঁচ কিংবা ছ’দিন লাগে। কিন্তু যদি ইংরেজ শ্রমিককে একটানা ক্লান্তিকর পরিশ্রমের বলি হতে হয় তাহলে ফরাসীর চেয়ে তার আরো অধোগতির আশঙ্কা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য আমাদের দেশের মানুষের খ্যাতি আছে সেই প্রসঙ্গে কি আমরা বলি না যে এর পিছনে যতটা স্বাধীনতার জন্য তাদের সহজাত নিষ্ঠা ঠিক ততটাই আছে ইংরেজের ভোজ্য উত্তম বীফ ও পুডিং? আমাদের কারিগর ও শ্রমিকদের উচ্চতর পর্যায়ের উদ্ভাবনী শক্তি ও কর্মকুশলতা কি নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করবার স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের উপরই নির্ভর করে না? এবং আমি আশা করি যে আমরা কখনই তাদের এইসব সুযোগ সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত হতে দেব না কারণ এইগুলি থেকেই যেমন আসে তাদের কর্মকুশলতা, তেমনি আসে তাদের সাহস।[১৮] এর উত্তরে “ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক নিবন্ধ” এর রচয়িতা বলছেন : “প্রত্যেকটি সপ্তম দিন যদি ছুটির দিন বলে বিশ্ববিধাতার বিধান হয়, তাহলে তার মানে হয় যে বাকি ছ’টি দিন হচ্ছে শ্রমের জন্য (আমরা শীঘ্র দেখতে পাব যে তিনি বলতে চাইছেন মূলধনের জন্য ), সে ক্ষেত্রে এটিকে কার্যকরী করার মধ্যে কোন নিষ্ঠুরতা আছে সে কথা কেউই নিশ্চয় মনে করবেন না……. সাধারণভাবে মানবজাতি যে স্বভাবগত ভাবেই আরাম ও আলস্যপ্রবণ সেটা যে সত্য তা আমাদের সর্বনাশা অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে যখন আমরা কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের দেখি যে তারা সপ্তাহে গড়ে চার দিনের বেশি পরিশ্রম করে না যদি-না খাদ্য সামগ্রীর দাম চড়ে যায় : গরিবের প্রাণ ধারণের দ্রব্য সামগ্রীকে একটি দ্রব্য হিসেবে গণ্য করুন; ধরুন সেটি গম অথবা মনে করুন………….. এক বুশেল গমের দাম পাঁচ শিলিং এবং সে ( অর্থাৎ শ্রমিক) দিনে পরিশ্রম করে এক শিলিং রোজগার করে, তাকে এখন সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করতেই হবে। যদি এক বুশেল গমের দাম চার শিলিং হয়, তাহলে মাত্র চারদিন কাজ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দামের তুলনায় মজুরি অনেক বেশি, …….. কারখানার শ্রমিক চার দিন খেটে যে বাড়তি পয়সা পায় তা দিয়ে সে সপ্তাহের বাকি কটা দিন আলস্যে কাটাতে পারে …………..আমি আশা করি যে আমি যা বলেছি তাতেই প্রমাণিত হয়েছে যে সপ্তাহের ছ’দিনের পরিমিত শ্রম মানে দাসত্ব নয়। আমাদের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ এটাই করেন এবং আপাতদৃষ্টিতে তারা আমাদের শ্রমজীবী গরীবদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী কিন্তু ওলন্দাজরা কারখানা-শিল্পেও এটা করে থাকে এবং দেখে মনে হয় যে তারা খুবই সুখী।[১৯] ফরাসীরাও কোন ছুটির দিন মাঝখানে এসে না গেলে এই ভাবেই কাজ করে।[২০] কিন্তু আমাদের জনগণের মনে একটি ধারণা জন্মেছে যে ইংরেজ হিসেবে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে যে তারা ইউরোপের অন্যান্য যে কোন দেশের লোকের চেয়ে বেশি মুক্ত ও স্বাধীন। আমাদের সৈন্য বাহিনীর বীরত্বের সঙ্গে এই ধারনার যেটুকু সম্বন্ধ আছে, সেইটুকুর কিছু কার্যকারিতা আছে; কিন্তু কারখানায় নি মুক্ত গরীবদের মনে এই ধারণা যতই কম থাকে, তাদের নিজেদের পক্ষে এবং দেশের পক্ষে ততই মঙ্গল। শ্রমজীবী মানুষের কখনও নিজেদের উর্ধ্বতম ব্যক্তিদের থেকে স্বাতন্ত্রের কথা ভাবা উচিত নয়।…….. আমাদের মত ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধান দেশে মানুষ ক্ষেপান খুবই বিপজ্জনক কারণ এখানে বোধ হয় জনগণের আট ভাগের মধ্যে সাত ভাগেরই কোন সম্পত্তি নেই। কোন ঔষধই পুরোপুরি খাটবেনা য ওক্ষণ-না পর্যন্ত কারখানায় নিযুক্ত আমাদের শ্রমিকরা। এখন চারদিনে যে রোজগার হয়, সেইটাই ছয় দিন খেটে রোজগার করতে বাধ্য হচ্ছে।[২১] এই উদ্দেশ্যেই এবং “আলস্য লাম্পট্য ও বাড়াবাড়ি নিমূল করার জন্য, পরিশ্রমের জন্য মনোভাব সৃষ্টির জন্য, কারখানায় “শ্রমের খরচ কমাবার জন্য এবং আমাদের দেশকে গরীব করের বোঝা থেকে মুক্ত করবার জন্য মূলধনের এই “ভক্ত সেবাইত” নিম্নোক্ত অনুমোদিত ব্যবস্থাটি প্রস্তাব করছেন, যেসব শ্রমিক সাধারণের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ যারা ভিখারী হয়ে গিয়েছে তাদের একটি আদশ কর্মনিবাস-এ আবদ্ধ করা হোক। এই আদর্শ কর্মনিবাসকে পরিণত করতে হবে একটি সন্ত্রাস আগারে” এবং এগুলিকে গরীবের আশ্রয়স্থল “যেখানে তারা যথেষ্ট খেতে পাবে, গরম ও ভদ্র পোষাক পাবে এবং যেখানে তাদের খুব কমই কাজ করতে হবে এমনটি করলে হবে না।[২২] এই সন্ত্রাস আগার”-এ, এই “আদর্শ স্থানে গরীবরা দিনে চোদ ঘণ্টা কাজ করবে যাতে খাওয়ার জন্যে যথাযোগ্য বিরতি দিয়েও বাবে ঘণ্টার ছকা শ্ৰম থাকে।[২৩]

দৈনিক বার ঘটা শ্রম, এই হল ১৭৭০ সালের বন্যাস অগিব আদর্শ কর্মনিবাস ! তেষট্টি বছর পরে ১৮৩৩ সালে যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শিল্পের চারটি শাখায় তেরো থেকে আঠারো বছরের তরুণদের শ্রম-দিস কমিয়ে বারে। ঘটা করলেন, তখনই ইংরেজদের ‘শলের বিচারের দিন শুরু হল। ১৮৫১ সালে যখন লুই বোনাপটি ধনিকদের সন্তুষ্ট করে নিজের প্রতিষ্টা শক্ত করার জন্য আইন-সঙ্গত শ্রম-দিবসে হস্তক্ষেপ করলেন, তখন রাসী জনগণ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল : “ধারণতন্ত্রের আইনগুলির মধ্যে একটি মাত্র ভাল ইন-ই অবশিষ্ট আছে শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখার আইনটি।”[২৪] জুরিখে দশ বছরের উর্বে শিশুদের শ্রমের ঘট। বারোতে সীমাবদ্ধ করা হল, ১৮৬২ সালে অরিগাইতে তেরো থেকে যোল বছরের তৰুণদের শ্রম ১২ থেকে বার ঘন্টা করা হল, ১৮৬০ সালে অধীয়ায় চোদ্দ থেকে ষোল বছরের তরুণদের জন্য শ্রমের ঘণ্টা। একইভাবে কমান হল।[২৫] কী দারুন অগ্রগতি’ ১৭৭০ সাল থেকে। মেকলে এই বলে উল্লাসে চেঁচাবেন !!

১৭৭০ সালে ধনতন্ত্রের আত্মা ভিক্ষুকদের জন্য সন্ত্রাস আগার সৃষ্টির যে স্বপ্ন মাত্র দেখেছিল, সেইটাই কয়েক বছর পরে শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়েই একটি বিরাট “কর্মনিবাস’-এর রূপ পরিগ্রহ করল। এরই নাম হচ্ছে কারখানা এবং এক্ষেত্রে বাস্তবের কাছে কল্পনা হার মানলো।

————

১. ইংল্যাণ্ডের গ্রামীণ জেলাগুলিতে এখনো মাঝে মাঝে শ্রমিককে তার বাড়ির সামনের বাগানে রবিবার কাজ করে পবিত্র বিশ্রামের দিনটিকে অপবিত্র করার অপরাধে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঐ একই শ্রমিককে আবার ধাতু, কাগজ অথবা কাচের কারখানায় রবিবারে কাজে হাজির না হলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে শাস্তি পেতে হয়। সনাতনপন্থী পার্লামেন্ট পর্যন্ত রবিবারের পবিত্রতা লম্বন করা সম্পর্কে কোন কথাই শুনতে চান না যদি মূলধনের প্রসারের প্রণালীর প্রয়োজনে ঐটি দরকার হয়ে পড়ে। লণ্ডনের মাছ এবং হাঁস-মুরগীর দোকানের দিন-মজুরের। ১৮৬৩ সালের আগষ্ট মাসে একটি স্মারকলিপিতে রবিবারে শ্রম নিষিদ্ধ করতে চেয়ে বলেন যে তাদের সপ্তাহের প্রথম ছ’দিনে গড়ে পনের ঘন্টা করে কাজ করতে হয় এবং রবিবারে আট থেকে দশ ঘণ্টা। ঐ একই লিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে এক্সেটার হল’-এর ভণ্ড অভিজাত সম্প্রদায়ের ভোজন-বিলাসীরাই বিশেষ করে রবিবারের শ্রমের উৎসাহ দেন। এইসব পবিত্র ব্যক্তিরা ধর্মের জন্য যাদের উৎসাহের অন্ত নাই তারা তাদের খ্ৰীষ্টান মনোভাবের পরাকাষ্ঠা দেখান অপরের অতিরিক্ত খাটুনি, দুঃখকষ্ট ও ক্ষুধাকে চোখ বুজে বিনীত ভাবে মেনে নিয়ে। “Obsequium ventrisistis (the labourers) perniciosius est.”

২. ইতিপূর্বে কয়েকজন অভিজ্ঞ কারখানা-মালিকদের বক্তব্য নিয়ে এই মর্মে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে যে, “অতিরিক্ত ঘণ্টার কাজ সুনিশ্চিতভাবে মানুষের কাজ করার ক্ষমতাকে অকালে নিঃশেষ করে।” (1. c. ৬৪, পু xiii)।

২. কেয়ানেস, (“The Slave Power”) ‘দাস শক্তি’ পৃঃ ১১০, ১১১।

৩. জনওয়া : ‘দি বয়ে অব স্টোক আপন ট্রেন্ট লণ্ডন, ১৮৪৩, পৃঃ ৪২।

৪. কমন্স সভায় ১৮৬৩ সালের ২৭শে এপ্রিল ফেণ্ড-এর বক্তৃতা।

৫, ঠিক এই শব্দগুলিই সুতোকল-মালিকরা ব্যবহার করেন, 1.c.।

৬. l.c. রিপোর্ট। নিজের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মি. ভিলিয়ার্স কারখানা মালিকদের অনুরোধ অমান্য করতে ‘আইনত বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এইসব ভদ্র লোকেরা স্থানীয় গরিব আইন পর্ষদের কর্তৃপক্ষকে বশ করে নিজেদের উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করেন। কারখানা-ইন্সপেক্টর মিঃ রেড গ্রেভ জোরের সঙ্গে বলেন যে এইবার যে প্রথা অনুযায়ী ভিখারী ও অনাথ শিশুদের ‘আইনত: শিক্ষানবীশ ধরা হয়েছিল, তাতে কিন্তু সেই পুরানো অনাচারগুলি ছিল না। (এই অনাচারগুলি সম্পর্কে এঙ্গেলস্-এর “Lage” দেখুন), যদিও একটি ক্ষেত্রে সুনিশ্চিতভাবে এই প্রথার অপব্যবহার দেখা যাব সেখানে কিছুসংখ্যক বালিকা ও তরুণীকে স্কটল্যাণ্ডের কৃষি প্রধান অঞ্চল থেকে ল্যাংকাশায়ারে ও চশারে আনা হয়েছিল। এই প্রথায় কারখানা-মালিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি করতেন। তিনি শিশুদের খাওয়া, পর ও বাসস্থান দিতেন এবং তাদের হাত-খরচার জন্য অল্প কিছু। অর্থ দিতেন। মিঃ রেড গ্রেভ -এর একটি মন্তব্য যেটা নীচে সরাসরি উদ্ধৃত করা। হয়েছে সেটা অদ্ভুত মনে হয়। বিশেষত যখন আমরা বিচার করি ইংল্যাণ্ডে বস্তু শিল্পের সমৃদ্ধির বছরগুলির মধ্যেও ১৮৬০ সাল হচ্ছে একটা ব্যতিক্রম এবং অধিকন্তু ঐ সময় মজুরিও ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশি। কারণ কাজের এই ভীষণ চাহিদার অপরদিকে ছিল আয়াল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডের কৃষি প্রধান অঞ্চলগুলি থেকে অস্ট্রেলিয়া ও নরমেনদের আমেরিকায় বিদেশ যাত্রার হিড়িক, এমনকি ইংল্যাণ্ডের কৃষিপ্রধান জেলা গুলিতে জনসংখ্যা সত্যসত্যই কমে গিয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে অংশত এই যে মানুষ ব্যবসায়ে লিপ্ত এজেন্টদের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রাণশক্তি ইতিপূর্বেই ব্যবহার যোগ্য শক্তিতে রূপান্তরিত। এইসব সত্ত্বেও মিঃ রেড গ্রেভ বলেন : কিন্তু এই ধরনের শ্রম কেবল তখনই খোঁজা হয় যখন আর সবই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, কারণ এই শ্রমের মূল্য বেশি। তেরো বছরের একটি বালকের মজুরি হচ্ছে সাধারণতঃ সপ্তাহে চার শিলিং কিন্তু পঞ্চাশ অথবা একশটি বালকের জন্য বাসস্থান, খাওয়া-পরা, চিকিৎসার সুযোেগ এবং উপযুক্ত পরিদর্শক রাখতে হয় এবং তাদের জন্য কিছু পারিশ্রমিক প্রয়োজন, যাতে মাথাপিছু সাপ্তাহিক খরচ চার শিলিং এর মধ্যে করা সম্ভব হয় না।” ( ১৮৬০ সালের ৩০শে এপ্রিল কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, পৃঃ ২৭।) মিঃ রেড় গ্রেভ, অবশ্য ভুলে গিয়েছেন যে কি করে সপ্তাহে চার শিলিং মজুরি পেয়ে শ্রমিক তার শিশু সন্তানদের জন্য এইসব করতে পারে, যখন কারখানা-মালিক পঞ্চাশ বা একশটি শিশুকে একত্রে রেখে, খাইয়ে ও তদারক করিয়ে পেরে ওঠেন না। রিপোর্ট থেকে যাতে এসব ভ্রান্ত ধারণা না হয় তার জন্য আমার এখানে বলা উচিত যে ১৮৫০ সালের কারখানা আইন মারফং শ্রম সময় নিয়ন্ত্রিত হবার পর ইংল্যাণ্ডের বস্ত্র-শিল্পকে দেশের একটি আদর্শ শিল্প বলেই ধরতে হবে। ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক সবদিক দিয়ে ইউরোপের সমদুঃখী শ্রমিকদের চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে।” “প্রুশিয়ার কারখানার শ্রমিক ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকদের চেয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে দশ ঘণ্টা বেশি কাজ করে এবং যখন সে নিজের বাড়িতে নিজের তাঁত চালায় তখন তার শ্রমের পরিমাণ এই বাড়তি ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। (কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৫, পৃঃ ১০৩।) উল্লিখিত কারখানা পরিদর্শক রেড গ্রেভ ১৮৫১ সালের শিল্প প্রদর্শনীর পর ইউরোপের ভূখণ্ডে ভ্রমণ করেন, বিশেষতঃ ফ্রান্স ও জার্মানিতে; উদ্দেশ্য ছিল, কারখানাগুলির অবস্থার অনুসন্ধান করা। প্রুশিয়ার শ্রমিক সম্পর্কে তিনি বলেন : “সে তার অত্যন্ত সাদাসিধা খাবার সংগ্রহের উপযোগী এবং তার অভ্যস্ত যৎসামান্য স্বাচ্ছন্দ্যের উপযোগী মজুরি পায়। সে মোটা খায় এবং কঠোর পরিশ্রম করে, যে বিষয়ে তার অবস্থা ইংরেজ শ্রমিকের চেয়ে খারাপ। ( কারখানা। পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৫, পৃঃ ৮৫।)

৭. যারা অতিরিক্ত খাটে তারা ‘অদ্ভূত তাড়াতাড়ি মারা পড়ে। কিন্তু যারা মারা পড়ে তাদের জায়গা তৎক্ষণাৎ পূরণ হয়ে যায় এবং মানুষের এই নিয়ত স্থান পরিবর্তনের দরুন পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটে না।” (ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকা, লণ্ডন, ১৮৩৩, ১ম ভলুম, পৃঃ ৫৫, ই. জি. ওয়েকফিল্ড-এর রচনা।)

৮. জনস্বাস্থ্য : ১৮৬৩ সালের প্রিভিকাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসারের ষষ্ঠ রিপোর্ট’ দ্রষ্টব্য। লণ্ডনে ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্টে বিশেষতঃ কৃষি শ্রমিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাদার্নল্যাণ্ডকে সাধারণত একটি অত্যন্ত উন্নত কাউন্টি বলা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে যে সেখানেও যে অঞ্চল একদা সুঠাম চেহারা ও সাহসী সৈনিকদের জন্য বিখ্যাত ছিল সেখানকার বাসিন্দারাও অধোগামী হয়ে কৃশ ও খর্বকায় মানুষে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রের উপকূলে পাহাড়ের ধারে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর এলাকাগুলিতে এদের ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখগুলি লণ্ডনের কোন গলির দূষিত আবহাওয়ার ভিতরকার শিশুদের মুখ যতটা রক্তহীন হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই। (ডব্লিউ থনটন। “ওভার পপুলেশন অ্যান্ড ইটস রেমিডি” ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৪, ৭৫।) বস্তুতঃ এদের সাদৃশ্য আছে সেই ৩০, ৩০. ‘বীর হাইল্যাণ্ডারদের সঙ্গে যাদের গ্লাসগোতে অস্বাস্থ্যকর জায়গায় চোর ও বেশ্যাদের সঙ্গে শুওরের পালের মত রাখা হয়।

৯. যদি জনসংখ্যার স্বাস্থ্য হচ্ছে জাতীয় মূলধনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার তবু আমাদের এই কপ বলতে হচ্ছে যে মালিক-শ্রেণী এই সম্পদকে রক্ষা ও লালন পালন করতে তেমন আগ্রহী নয়….. শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেবার জন্য কারখানা মালিকদের বাধ্য করতে হয়েছে। ( ‘টাইমস পত্রিকা ৬ই নভেম্বর, ১৮৬১1) ‘ওয়েষ্ট-রাইডিং-এর লোকের। সারা পৃথিবীর লোককে কাপড় যোগায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবলি দেওয়া হচ্ছিল এবং সমগ্র জনসংখ্যা অল্প কয়েক পুরুষের মধ্যে নিশ্চয়ই সর্বনাশের পথে যেত। কিন্তু একটা প্রতিক্রিয়া এল। লড’ শ্যাফটবেরির বিল শিশুদের শ্রমের ঘন্টা সীমাবদ্ধ করে দিলে।’ ইত্যাদি। (রেজিস্ট্রার জেনারেল-এ রিপোর্ট অক্টোবর, ১৮৬১।)

১০. এইজন্য আমরা দেখতে পাই, যেমন ১৮৬৩ সালে গোড়ার দিকে, স্টাফোড় শায়ারের ছাব্বিশটি প্রতিষ্ঠান, যাদের অধীনে ছিল বড় বড় পটারি কারখানা, বিশেষ করে আবার তাদের মধ্যে “জোশিয়া ওয়েজউড অ্যাণ্ড সন্স, একটা কিছু আইন প্রণয়নের জন্য স্মারকলিপির আকারে একটা দরখাস্ত করছে। অন্যান্য ধনিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য তাদের পক্ষে স্বেচ্ছামূলকভাবে শিশু প্রভৃতির শ্রমের ঘণ্টা কমান সম্ভব নয়। উল্লিখিত অনিষ্টকর ব্যাপারগুলির অমিরা যতই নিন্দা করি না কেন, কারখানা মালিকদের মধ্যে কোন আপস-চুক্তি করে ঐগুলি রদ করা যায় না…এই দিকগুলি বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তেই পৌছেছি যে কিছু একটা আইন প্রণয়ন করা দরকার (শিশু নিয়োগ কমিশন’, রিপোর্ট ১নং, ১৮৬৩, পৃঃ ৩২২) খুব সম্প্রতি আর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছে। দারুণ তেজী বাজারে তুলোর মূল্য বৃদ্ধির দরুন ব্ল্যাকবোর্ণের কারখানা-মালিকেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত করে একটি নির্দিষ্ট কালের জন্য নিজ নিজ কারখানায় শ্রমের সময় কমান। ১৮৭১ সালের নভেম্বরে এই নির্দিষ্ট কাল শেষ হয়। ইতিমধ্যে অধিকতর ধনবান মালিকেরা যারা সুতো কাটার সঙ্গে কাপড়ও বোনেন, তারা এই চুক্তি-জনিত উৎপাদন হ্রাসের সুযোগে নিজেদের কারবার বাড়ালেন এবং ছোট মালিকদের উপর দিয়ে এইভাবে প্রচুর লাভ করলেন। শেষোক্তর তাই শ্রমিকদের কাছে বিপন্ন হয়ে আবেদন করলেন এবং এইজন্য নয় ঘণ্টা প্রবর্তনের আন্দোলনে নিজেরাই চাদা দেবেন বলে স্বীকার করলেন।

১১. উৎপাদন-পদ্ধতিতে পরিবর্তনের দরুন শ্রম-আইনগুলি অকেজো হয়ে যাবার দীর্ঘকাল পরে ১৮১৩ সালে সেগুলিকে ইংল্যাণ্ডে খারিজ করে দেওয়া হয়। এই ধরনের আইন ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড এবং অন্যত্রও প্রবর্তিত হয়েছিল।

১২. বারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে কারখানায় দৈনিক দশ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো চলবে না। ম্যসাচুনেটের সাধারণ, আইন ৫৩, অধ্যায় ১২। (এই আইনগুলি ১৮৫৬ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে প্রবর্তিত হয়।) “যেকোন একটি দিনে দশ ঘণ্টার শ্রমকেই সর্ববিধ সুততা, পশম, রেশম, কাগজ, কঁাচ ও শনের কারখানায় অথবা লোহা ও পিতলের কারখানায় আইন-অনুমোদিত বলে বিবেচনা করা হবে। এবং বিধিবদ্ধ করা হয় যে আজ যে তরুণ বয়স্ক ( নাবালক)-কে দৈনিক দশ ঘণ্টা অথবা সপ্তাহে ষাট ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হবে না এবং অতঃপর দশ বছরের নীচে কোন নাবালককে এই রাজ্যে কোন কারখানায় নিযুক্ত করা চলবে না।” নিউজার্সি অঙ্গরাজ্য। শ্রমের ঘন্টা সীমাবদ্ধ করার আইন ইত্যাদি অনুচ্ছেদ ১ ও ২। (১,৫১ সালে ১৮ই মার্চের আইন। কোন নাবালক, যার বয়স বারো বছরের উপরে ও পনের বছরের নীচে, তাদের কোন কারখানায় নিযুক্ত করে দৈনিক এগারো ঘণ্টার বেশি কাজ করানো, অথবা সকালে পাঁচটার আগে এবং সাড়ে সাতটার পরে কাজ করানো চলবে না।” (বিভাইজভ স্টাটিউটস’ ইত্যাদির, ১৩৯ অধ্যায় অনুচ্ছেদ ২০ ১লা জুলাই, ১৮৫৭।)

১৩. সফিজমস অব ফ্রি ট্রেড’ সপ্তম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৫৩ পৃঃ ২৫, নবম সংস্করণ পৃঃ ২৫৩। ঐ একই রক্ষণশীল ব্যক্তিটি আরও স্বীকার করেন যে শ্রমিকের বিরুদ্ধে ও মালিক পক্ষে প্রবর্তিত মজুরি বিষয়ক পার্লামেন্টের আইনগুলি দীর্ঘ ৪৬৪ বৎসর চলে। জনসংখ্যা বেড়ে গেল। তখন দেখা গেল যে এই আইনগুলি বাস্তবক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বোঝা স্বরূপ হয়ে উঠেছে। (1,c. পৃ ২৬০ )

১৪. এই আইন সম্পর্কে মিঃ জে. ওয়েড ঠিকই মন্তব্য করেছেন, “উল্লিখিত বক্তব্য থেকে ( অর্থাৎ আইনটি সম্পর্কে) এটি প্রতীয়মান হয় যে ১৪৯৬ সালে খাদ্য ছিল একজন শিল্পীর আয়ের একতৃতীয়াংশ এবং একজন মজুরের আয়ের অর্ধেক যাতে মনে হয় যে তখনকার দিনে শ্রমজীবীদের এখনকার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ছিল; কারণ বর্তমানে শিল্পী ও শ্রমিকের খাদ্যের দাম দিতে মজুরি আরও বেশি লেগে যায়। ( ওয়েড, হিসট্রী অব দি মিডল অ্যাণ্ড ওয়াকিং ক্লাসেস পৃঃ ২৪, ২৫ ও ৫৭৭)। এই পার্থক্য যে তখনকার সঙ্গে এখনকার খাদ্য ও পোশাকের দরুন দামের পার্থক্য জনিত সেই অভিমতটি ক্রনিকন প্রেসিওসাম ইত্যাদি রচনাটি একটু চোখ বুলালেই চলে যাবে। পুস্তকটির রচয়িতা বিশপ ফ্লিটউড, প্রথম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৭০৭, ২য় সংস্করণ লণ্ডন, ১৭৪৫।

১৫. ডবল পেটি ‘অ্যানাটমি অফ আয়ার্লণ্ড’ .১৬৭২; ১৬৯১ সংস্করণ, পৃঃ ১।

১৬. “এ ডিসকোর্স অন দি নেসেসিটি অব এনকারেজিং মেকানিক ইণ্ডাষ্ট্রি”, লণ্ডন, ১৬৯০ পৃঃ ১৩। মেকলে, যিনি হুইগ এবং বুর্জোয়াদের স্বার্থে ইতিহাসকে বিকৃত করেন, লেখেন : “শিশুদের অকালে কাজে নিযুক্ত করার রেওয়াজ ….. সপ্তদশ শতাব্দীতে এতটা মাত্রা পর্যন্ত প্রচলিত ছিল যে তাকে কারখানা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। বস্ত্রশিল্পের প্রধান কেন্দ্র নরউইচে ছ বছরের একটি ছোট্ট প্রাণীকে শ্রমের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হত। ঐ আমলের অনেক লেখক যাদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট সদাশয় ব্যক্তিও ছিলেন সোল্লাসে এই ঘটনার উল্লেখ করেন যে একমাত্র সেই শহরটিতেই খুব কোমল বয়সের ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বছরে বারো হাজার পাউণ্ড বেশি ধন সম্পদ সৃষ্টি করে থাকে। যতই সযত্নে আমরা অতীতের ইতিহাস পাঠ করি, ততই আমরা এমন যুক্তি বেশি বেশি করে পাই যার ভিত্তিতে, যারা বলেন যে আমাদের এই যুগটা নোতুন নোতুন সামাজিক অনাচারের জন্ম দিয়েছে আমরা তাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে পারি।…… যেটা নোতুন সেটা হচ্ছে এমন বুদ্ধিমত্তা ও মানবিকতা যা সেগুলির প্রতিকার সাধন করে।” “হিস্ট্রি অব ইংল্যাণ্ড, খণ্ড ১, পৃঃ ৪১৭। মেকলে আরো জানাতে পারতেন যে সপ্তদশ শতাব্দীতে “পরম সদাশয়” amis du confierce’ কেমন সোল্লাসে বর্ণনা করেন কি ভাবে হল্যাণ্ডে একটি দরিদ্র-নিবাসে একটি চার বছর বয়সের শিশুকে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং “vertunise et Prutique”-এর এই দৃষ্টান্তটি মেকলে-মার্কা সমস্ত মানবিকতাবাদীদের রচনায় অ্যাডাম স্মিথের কাল পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। একথা ঠিক, হস্তশিল্পের জায়গায় কারখানা-শিল্পের প্রচলনের ফলে শিশুদের শোষণের বিভিন্ন চিহ্নগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। কৃষকদের মধ্যে এই শোষণ সব সময়ই কিছু পরিমাণে চালু ছিল, এবং কৃষি-কর্তার উপরে চাপ যত বেশি পড় ত এই শোষণের ভারও তত গুরুতর হত। মূলধনের প্রবণতা সেখানে নিভুল ভাবেই ‘ছল, কিন্তু তেমন ঘটনাগুলি ছিল দু-মাথা-ওয়ালা শিশুদের মতই বিরল ও বিচ্ছিন্ন। আর এই কারণেই দূর-দশী amis du commerce সেগুলিকে “সোল্লাসে” মন্তব্য ও বিস্ময় প্রকাশের জন্য বিশেষ ভাবে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেছিলেন এবং তাদের নিজেদের জন্য ও বংশধরদের জন্য আদর্শ হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। এই একই স্কচ মোসাহেব ও বাক্যবাগীশ মেকলে সাহেব বলেন, “আমরা এখন শুনি কেবল পাশ্চাদগতির কথা, কিন্তু দেখি কেবল অগ্রগতি।” আহা, কী চোখ, আর বিশেষ করে, কী কান !

১৭. শ্রমজীবী জনগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ কারীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হচ্ছেন “অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স…….. অবজার্ভেশনস অন ট্যাক্সেস ইত্যাদি লণ্ডন, ১৭৭০ নামক গ্রন্থটিতে যাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেই অনামী লেখকটি। “কনসিডারেশনস অন ট্যাক্সেস লণ্ডন, ১৭৬৫, নামক তার আগেকার বইটিতে তিনি বিষয়টি নিয়ে আগেই আলোচনা করেছিলেন। তারই পক্ষভুক্ত হচ্ছেন পলিনিয়াস আর্থার ইয়ং, সেই অকথ্য সংখ্যা তথ্যের বাকৃপটু পরিবেশক। শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির সমর্থকদের মধ্যে পুরোধা হলেন জ্যাকব ভাণ্ডারলিন্ট (“মানি অ্যান্ডারস অল থিংস’, লণ্ডন ১৭০৪); রেভারেণ্ড নাথানিয়েল ফস্টার ডি-ডি (“অ্যান এনকুইরি ইনটু দি কজেস অব দি প্রেজেন্ট হাই প্রাইস অব প্রভিন্স লণ্ডন ১৭৬৭; ডঃ প্রাইস এবং বিশেষ করে, পোস্টলেথওয়েট (“ইউনিভার্সাল ডিকসনারি অব ট্রেড অ্যান্ড কমার্স”, ২য় সংস্করণ, ১৭৭৫)। অন্যান্য অনেক লেখকও ঘটনাগুলিকে সমর্থন করেন, যাদের মধ্যে আছেন জোসিয়ার টাকার।

১৮. পোষ্টলেথওয়েট ফাস্ট প্রিলিমিনারি ডিসকোর্স lc. (প্রথম সমীক্ষা) পৃ ১৪

১৯. “অ্যান এসে”, ইত্যাদি। ৯৬ পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন ১৭০ সালে ইংরেজ কৃষি শ্রমিকের “সুখ” বলতে কি ছিল। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ছিল সব সময়েই চাপের মধ্যে, যত অল্প খরচে তারা জীবন কাটাতে তার চেয়ে অল্প খরচে তা করা যায় না, যত কঠোর কাজ তারা করত তার চেয়ে বেশি কঠোর কাজ কর। যায় না।

২০. প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রায় সব চিরাচরিত ছুটির দিনকে কাজের দিনে পরিণত করে মূলধন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

২১. ‘অ্যান এসে’ ইত্যাদি, পৃঃ ১৫, ৪১, ৫৫, ৫৭, ৫৯,৫৬, ৯৭-জ্যাকব ভ্যাণ্ডারলিন্ট ১৭৩৪ খ্রীষ্টাকেই বলেন শ্রমিকদের আলস্যের বিরুদ্ধে ধনীদের চীৎকারের গূঢ় রহস্য হচ্ছে তারা চার দিনের মজুরিতে ছয় দিন খাটাতে চান।

২২. l.c. পৃঃ ১:২।।

২৩. তিনি বলেন যে ফরাসীরা আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে উচ্ছ্বণপূর্ণ ধারণার কথায় হাসে 1… পৃ: ৭৮।

২৪ তার বিশেষ করে শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টার চেয়ে বেশি করতে আপত্তি জানায় কারণ এই আইনটি সাধারণতন্ত্রের একমাত্র ভাল আইন যা তখনও বেঁচে ছিল। ( ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬ পৃঃ ৮০!) ১৮৫০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরে ফরাসী দেশের বারো ঘণ্টা শ্রমের বিলটি ছিল ১৮৪৮ সালের ২রা মার্চের অস্থায়ী সরকারের আদেশের বুর্জোয়া সংস্করণ এবং এইটি সমস্ত কারখানার উপর প্রযোজ্য ছিল। এই আইন প্রবর্তনের আগে ফরাসী দেশে শ্রম-দিবসের কোন নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। বিভিন্ন কারখানায় শ্রম-দিবস ১৪, ১৫ অথবা ততোধিক ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল। ব্লাস্কির ‘১৮৪৮ সালে ফ্রান্সের শ্রমজীবী শ্রেণীগুলি পড়ুন। অর্থনীতিবিদ ব্লাস্কি, ইনি বিপ্লবী স্ল্যাক্তি নন, একে সরকার শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান করবার ভার দিয়েছিলেন।

২৫. শ্রম দিবসের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে বেলজিয়াম হচ্ছে আদর্শ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৮৬২ সালের ১২ই মে ব্রাসেলস-এ ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রদূত লড’ হাওয়াদ পররাষ্ট্র দপ্তরে রিপোর্ট করছেন। মন্ত্রী জিয়ার আমাকে জানালেন যে ওদেশে কোন সাধারণ আইন অথবা কোন স্থানীয় আদেশ অনুযায়ী শিশুদের শ্রম সীমাবদ্ধ করা হয়নি; বিগত তিন বছরে প্রত্যেকটি অধিবেশনে সরকার এই বিষয়ে আইন তৈরি করতে চেয়েছে কিন্তু প্রত্যেকবারই এরূপ আইনের বিরুদ্ধে শ্রমের পূর্ণ স্বাধীনতার নীতির ভিত্তিতে বিরোধিতা অলঙ্ঘনীয় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।

.

.

১০.৬  স্বাভাবিক শ্রমদিবসের জন্য সংগ্রাম

 আইন মারফৎ কালের ঘন্টা বাধ্যতামূলক ভাবে নিয়ন্ত্রণ, ১৮৩৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের কারখানা আইন সমূহ

শ্রম-দিবসকে তার স্বাভাবিক উচ্চতম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করতে এবং তার পরে সেই সীমা অতিক্রম করে তাকে স্বাভাবিক দিনের বারো ঘণ্টা[১] পর্যন্ত বিস্তৃত করতে ধনতন্ত্রের কয়েক শতক লেগেছিল, কিন্তু তারপর আঠারো শতকের শেষ দ্বিতীয়াংশে আধুনিক যন্ত্রবাদও আধুনিক শিল্পের প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এল এক প্রচণ্ড আক্রমণ তীব্রতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে যা হিমবাহের সঙ্গে তুলনীয়। নৈতিক বাধার অর্গল ভেঙ্গে পড়ল, বয়স অথবা স্ত্রীপুরুষের তারতম্য থাকল না, দিন ও রাত্রির পার্থক্য ঘুচে গেল। এমন কি দিন ও রাতের ধারণা পর্যন্ত যা পুরান আইনগুলিতে সরলভাবে ব্যক্ত ছিল, সেটি এমনই গুলিয়ে গেল যে এমনকি এই ১৮৬০ সালেও ইংরেজ বিচারককে আইনগতভাবে দিন ও রাত্রি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল।[২] ধনতন্ত্র তার তাণ্ডবনৃত্যে মত্ত হল।

নোতুন উৎপাদন হৈ-হুল্লোড়ে প্রথমে কিছুটা বিমূঢ় হলেও যেমনি শ্রমিক শ্রেণী কিছু পরিমাণে সম্বিৎ ফিরে পেল, তখন প্রতিরোধ শুরু হল এবং সর্বপ্রথমে শুরু হল যন্ত্রশিল্পের জন্ম ভূমি ইংল্যাণ্ডেই কিন্তু ত্রিশ বছর ধরে শ্রমিক শ্রেণীর অজিত সুবিধাগুলি কেবল নামেই ছিল। ১৮০২ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত পালমেন্ট পাঁচটি শ্রমআইন প্রবর্তন করে কিন্তু ঐ আইনগুলি কার্যকরী করবার জন্য অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে এক পাই খরচও বরাদ্দ করেনি।[৩]

তাই এই আইনগুলি শুধু খাতাপতেই থাকল। “বাস্তব ঘটনা হচ্ছে এই যে ১৮৩৩ সালের আইনের আগে পর্যন্ত তরুণ বয়স্ক এবং শিশুদের কাজ করান হত সারারাত, অথবা সারাদিন, অথবা দিন ও রাত উভয় বেলাতেই।”[৪]

আধুনিক শিল্পের জন্য স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের সূচনা হল ১৮৩৩ সালের কারখানা আইনে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় বস্ত্র, পশম, শন ও রেশমের কারখানাগুলি। ১৮৯৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত কারখানা আইনের ইতিহাসে তুলনায় মূলধনের চরিত। বৈশিষ্ট্য আর কোথাও প্রকট নয়।

:৮৩৩ সালের আই ঘোষণা করল যে সাধারণভাবে কারখানার শ্রম-দিবস স্থায়ীভাবে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত এবং এই সীমার মধ্যে, এই পনের ঘণ্টার মধ্যে দিবে যে কোন সময়ে ভিতরেই তৰুণ ব্যক্তিদের (অর্থাৎ তেরো থেকে আঠালো বছর বয়স্ক ব্যক্তিদেব !) নিয়োগ করা যাবে। অবশ্য বিশেষ ককেটি অনুমোদিত ক্ষেত্র ছাড়া, দিনে বার ঘণ্টা বেশি কেউ কাজ করবে না। আইনে ষষ্ঠ ধারায় আছে এই ধারার নির্দেশগুলির সীমার মধ্যে প্রত্যেকটি তরুণ ব্যক্তিকে প্রতিদিন আহাবের জন্য কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা সময় দিতে হবে। নয় বছরের কম বয়সের শিশুদে নিয়োগ নিম্নোক্ত ব্যতিক্রম ছাড়া নিষিদ্ধ করা হয়; নয় থেকে তেরো বছর বয়সের শিশুদের দৈনিক শ্রম আট ঘণ্টায় নিদিষ্ট হয়, রাত্রের কাজ অর্গীং আইন অনুযায়ী রাত্রি সাড়ে আটটা থেকে সকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত নয় থেকে আঠারো বছর বয়সের তরুণ ব্যক্তিদের পক্ষে নিষিদ্ধ করা হয়।

পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকদের শোষণ করবার ব্যাপারে ধনিকদের স্বাধীনতায় অথবা তারা যাকে বলেন “শ্রমের স্বাধীনতা তাতে হস্তক্ষেপ করতে আইন প্রণেতারা এত পরান্মুখ ছিলেন যে তারা এমন একটি বিশেষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করলেন যাতে কারখানা আইনগুলি মারাত্মক কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না কবে।

কমিশনের কেন্দ্রীয় পর্ষদ তার ১৮৭৩ সালের ২৮শে জুন প্রথম রিপোর্টটিতে বলেন বর্তমানে কাবখানা-ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালিত হয় তার প্রধান অভিশাপ আমাদের কাছে এটাই মনে হয় যে এতে শিশুদের শ্রমকে বয়স্বকের শ্রমের উচ্চতম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করার প্রয়োজন হয়। বয়স্কদের শ্রম সময় হ্রাস করা এব একটা প্রতিকার হতে পারে। কিন্তু তা করলে আমাদের মনে হয় উক্ত অভিশাপটির চেয়েও আরও বড় একটি অভিশাপের প্রাদুর্ভাব ঘটবে; সুতরাং একমাত্র যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে দু প্ৰস্ত শিশুকে নিয়োগ করা।”…….অতএব পালাক্রমে কাজ করাবার নামে এই প্রথাটি চালু হল যাতে ( দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়) এক প্রস্থ শিশুকে কাজ করান হত সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এবং আর এক প্রস্ত শিশুকে দেড়টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত। এই শিশুদের বয়স নয় থেকে তেরোর মধ্যে।

বিগত বাইশ বছরকাল অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে শিশুদের শ্রম-সম্পর্কিত সমস্ত আইন অবজ্ঞা করার পুরস্কার হিসেবে কারখানা-মালিকদের জন্য ব্যবস্থাটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করা হল। পার্লামেন্ট আদেশ জারি করলেন যে ১৮৩৪ সালে পয়লা মার্চের পর এগারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে, ১৮৩৫ সালে পয়লা মার্চের পর বারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে এবং ১৮৩৬ সালের ১লা মার্চের পর তেরো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে কোন কারখানায় আট ঘণ্টার বেশি খাটান যাবে না। “মূলধনের পক্ষে সহৃদয়তাপূর্ণ এই “উদারত।” খুবই উল্লেখযোগ্য এইজন্য যে ডাঃ ফারে, স্যার এ কার্লাইল স্যার বি. ব্রোডি, স্যার সি. বেল, মি. গুথ রি প্রভৃতি, এক কথায় লণ্ডন নগরীর একেবারে অগ্রগণ্য চিকিৎসক সাজেনবা কমঙ্গা সভায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে দেরী হলেই বিপদ হবে। ডা: ফারে খুব কটভাবেই বক্তব্য রেখেছিলেন। “যে-কোন প্রকারে অকলে ঘটান মৃত্যু বন্ধ করার জন্য আইন কর; দরকার একথা অনস্বীকার্য যে এই পদ্ধতিকে (অর্থাৎ কারখানা ব্যবস্থাকে মৃত্যু ঘটাবার একটি অত্যন্ত নষ্ঠর পদ্ধতি রূপেই দেখতে হবে।

এই একই “সংশোধিত” পার্লামেট এ দিকে যেখানে কারখানা মালিকদের প্রতি সুকোমল মমতাবোধ থেকে আগামী দীর্ঘকালের জন্য তেরো বছরের কম বয়সের শিশুদের কারখানা নামক নরকণ্ডে সপ্তাহে বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করল, অন্যদিকে যেখানে মুক্তিদান আইন’-এর মাধমে-ঘাতে ব্যবস্থা রয়েছে ফোটা ফোটা করে স্বাধীনতাদানের মাধ্যমে—গোড়া থেকেই নিগ্রো দাসদের দিয়ে সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো নিষিদ্ধ করে বাগিচা মালিকদের উপরে হুকুম জারি করল।

কিন্তু এই ব্যাপার আদৌ মেনে না নিয়ে ধনিকেরা শোরগোল তুলে যে আন্দোলন শুরু করল সেটি চলল অনেক বছর ধরে। এই আন্দোলনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সেই বয়ঃসীমা যার বলে শিশুদের কাজ আট ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা করা হয় এবং তাদের জন্য কিছুটা পরিমাণ শিক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাও করা হয়। ধনিকদের নৃতত্ত্ববিদ্যা। অনুযায়ী শৈশব শেষ হয় দশ বছরেই, অথবা বড় জোর এগাবে বছরে। যতই নূতন। কারখানা আইনটির পূর্ণ প্রয়োগের সময় এগিয়ে আসতে লাগল, অর্থাৎ সাংঘাতিক ১৮৩৬ সালটি ঘনিয়ে এলো ততই, কারখানা-মালিকদের দল পাগলের মতো চীৎকার করতে লাগল। বস্তুত তারা সরকারকে এতদূর এন্ত করে তুলল যে ১৮৩৫ সালেই প্রস্তাব এলো যে শৈশবের বয়ঃসীমা তেরো থেকে কমিযে বারো করা হউক। ইতিমধ্যে বাইরের চাপ-ও খুব বেশি বেড়ে উঠল। তাই কমন্স সভার সাহসে আর কুলালো না এবং তেরো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মূলধনের রথচক্রের নীচে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি পিষ্ট করতে তারা রাজী হলেন না এবং ১৮৩৩ সালের আইনটির পূর্ণ প্রয়োগ শুরু হল। ১৮৪৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই আইনটি অপরিবর্তিত ছিল।

গোড়ার দিকে আংশিকভাবে এবং পূর্ণমাত্রায় দশ বৎসর কাল কারখানার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কারখানা-পরিদর্শকের সরকারী রিপোর্টগুলি এই অভিযোগে মুখর হয়ে উঠল যে, আইনটি প্রয়োগ করা অসম্ভব। ১৮৩৩ সালের আইবটি সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি তরুণ, বয়স্ক এবং প্রত্যেকটি শিশুকে দিয়ে মূলধনের মালিকদের খুশিমতো কাজ আরম্ভ করার বিরতি দেবার, আবার কাজ আরম্ভ করার অথবা তার বাবা কিংবা আট ঘণ্টা কাজের মধ্যে যে-কোন সময় বিরতি দেবার অধিকার দিয়েছিল এবং মালিকদের এই অধিকারও দেওয়া হয়েছিন যাতে বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আহারের বিভিন্ন সময় স্থির করা চলে; মালিক ভদ্রলোকেরা শীঘ্রই এমন একটি নূতন “পালাক্রমে কাজের প্রথা আবিষ্কার করলেন যাতে তাদের মেহনতি ঘোডাগুলিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বদল না করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নোতুন করে লাগাম পরানো হত। এই পদ্ধতির গুণাগুণ নিয়ে এখন চিন্তা না করে পরে সে বিষয়ে আসা যাবে। কিন্তু একজনেরই এই জিনিষটি পরিষ্কার : এই পদ্ধতি গোটা কারখানা আইনটিকে কেবল আনুষ্ঠানিক ভাবেই নয়, একেবারে আক্ষরিকভাবেই বাতিল করে দিল। কারখানা পরিদর্শকেরা প্রত্যেকটি শিশু বা তরুণ সম্পর্কে জটিল হিসেবের মধ্যে কিভাবে আইন নির্দিষ্ট ভোজনের এবং নির্দিষ্ট শ্ৰম সময় বাধ্যতামূলক করবে? বহুসংখ্যক কারখানায় পুরাতন পাশবিকতাগুলি আবার শীঘ্রই প্রকট হয়ে উঠল এবং তার জন্য কারো কোন শাস্তিও হলনা। স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারীর সঙ্গে ( ১৮৪৪ ) সালে একটি আলোচনায় কারখানা পরিদর্শকের প্রমাণ করে দিলেন যে নব-আবিষ্কৃত পালাক্রমক শ্রমের প্রথায় নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।[৫] কিন্তু ইতিমধ্যে অবস্থার গুরুতর পরিবর্তন ঘটল। কারখানা-শ্রমিকেরা, বিশেষতঃ ১৮৩৮ সালের পর থেকে দশ ঘণ্টার শ্রমের প্রস্তাবটি অর্থনৈতিক নির্বাচন-ধ্বনি করেতুলল যেমন চার্টারকে তারা পরিণত করল রাজনৈতিক ধ্বনিতে এমনকি কোন কোন কারখানা মালিক যারা ১৮৩৩ সালে আইন অনুযায়ী কারখানা চালাচ্ছিল তারাও তাদের অসাধু সমব্যবসায়ীদের দুর্নীতিমূলক প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে একটির পর একটি স্মারকলিপি পাঠাতে লাগল,-এইসব অসাধু মালিকরা কোথাও দুঃসাহস এবং কোথাও স্থানীয় অবস্থার সুযোগে আইনটি ভেঙ্গে চলছিল। উপরন্তু কারখানা মালিক ব্যক্তিগত লাভের জন্য সীমাহীন ভাবে যতই লোলুপ হোক না কেন, তারা তাদের মুখপাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের শ্রমিকদের কাছে বক্তৃতার ভোল পাল্টে ফেলবার আদেশ দিলেন। তারা তখন শস্য আইনগুলির (corn laws) অবসানের জন্য সংগ্রামে নেমেছিল এবং তাতে বিজয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল শ্রমিকদের সমর্থন। তাই তারা শুধু দ্বিগুণ রুটির প্রতিশ্রুতি দিল না, পরন্তু স্বাধীন ব্যবসার সত্যযুগে দশ ঘণ্টার শ্রমের প্রস্তাবটিকে কার্যকরী করার প্রতিশ্রুতিও দিল।[৬] এইভাবে তারা ১৮৩৩ সালের আইনটিকে কার্যকরী করার প্রস্তাবে বাধা দান থেকে বিরত রইল। তাদের পবিত্রতম স্বার্থের জমির খাজনার উপর আঘাত আসায় ‘টোরি’ ভূস্বামীরা তাদের শত্রু কারখানা মালিকদের ‘শয়তানী আচরণের’[৭] বিপক্ষে লোকহিতায় ক্রোধ প্রকাশ করে তর্জন গর্জন শুরু করল।

এইভাবে ১৮ ৪৪ সালের সাত-ই জুনের অতিরিক্ত কারখানা আইনটির জন্ম হয়। ১৮৪৪ সালের দশ-ই সেপ্টেম্বর-এ এর প্রয়োগ শুরু হয়। এই আইনে আর একটি নূতন শ্রেণীর শ্রমিকদের অর্থাৎ আঠারো বছরের বেশি বয়সের নারী-শ্রমিকদের রক্ষণ ব্যবস্থা থাকে। প্রতিটি ব্যাপারে তাদের তরুণ বাস্কদের সমতুল্য বলে মনে করা হয়, তাদের শ্রম-সময় বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা হয়, ইত্যাদি এই সর্বপ্রথম আইন করে প্রত্যক্ষ ও সরকারীভাবে পূর্ণবয়স্কের শ্রম-নিয়ন্ত্রণ করতে হল। ১৮৪৪-৪৫-এর কারখানা রিপোর্টে বিদ্রুপের সঙ্গে বলা হয়েছে : “প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী তার অধিকার পভিঘত হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এমন কোন ঘটনা বা দৃষ্টান্ত আমার গোচরীভূত হয়নি।”[৮] তেরো বছরের কম বয়সের শিশুদের শ্রম-সময় কমিয়ে দৈনিক সাড়ে ছ’ঘণ্টা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সাত ঘণ্টা করা হল।[৯]

“প্রতারণাপূর্ণ পালা প্রথার কদাচারগুলি থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য আইনে অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাগুলি রাখা হল :—শিশু ও তরুণদের শ্রম-সময় তখনই আরম্ভ হয়েছে ধরতে হবে, সকালে যখন একটি শিশু বা তরুণ কাজ আরম্ভ করবে।” অর্থাৎ যদি ‘ক’ সকাল আটটায় কাজ আরম্ভ করে এবং ‘খ’ আরম্ভ করে ১০টায়, তাহলে ‘খ’-র শ্রম-দিবস ‘ক’-এর সঙ্গে একই সময়ে শেষ হবে। কোন প্রকাশ্য সাধারণ প্রতিষ্ঠানের ঘড়ি অনুযায়ী সময় নিয়ন্ত্রিত হবে”, যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ, সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী রেলের ঘড়ির সঙ্গে কারখানার ঘড়িকে মেলাতে হবে। মালিককে একটি পঠনযোগ্য ছাপানো নোটিশ টাঙিয়ে জানাতে হবে কখন কাজ শুরু ও শেষ হবে এবং বিভিন্ন ভোজের কতটা করে সময় দেওয়া হবে। যেসব শিশু দুপুর বারোটার আগে কাজ শুরু করেছে, তাদের আবার বেলা একটার পরে আবার নূতন করে নিয়োগ করা চলবে না। অতএব সকালের পালায় যারা কাজ করেছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের বিকালের পালায় নিযুক্ত করতে হবে। অতএব বিকালের পালায় শিশুরা সকালের শিশুদের থেকে ভিন্ন হবে। খাবার সময়ের দেড় ঘণ্টার মধ্যে ‘অন্ততঃ একঘণ্টা সময় বেলা তিনটার আগেই দিতে হবে …..এবং সকালেও অনুরূপ সময় দিতে হবে। কোন শিশু বা তরুণ-তরুণীকে বেলা একটার আগে কমপক্ষে তিরিশ মিনিট ভোজনের সময় না দিয়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি খাটানো চলবে না। কোন শিশু ব তরুণ বা তরুণীকে  (খাবার সময়ে ) কোন ঘরে যেখানে শিল্পোৎপাদন চলছে কাজ করতে বা থাকতে দেওয়াও হবে না”, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এটা দেখা গিয়েছে যে এইসব খুটিনাটি ব্যবস্থা যাতে সামরিক শৃঙ্খলানুযায়ী ধড়িব ফাটায় কাটায় কর্মবিরতির সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এগুলি পার্লামেন্টের কল্পনাপ্রসূত নয়। এগুলি অাধুনিক উৎপাদন প্রণালী থেকে উদ্ভুত প্রাকৃতিক নিয়মের মতই ঘটনাবলী থেকে ক্রমশঃ উদ্ভূত হয়েছে। এইগুলিকে সূত্রাকারে ব্যক্ত করা, এগুলি সরকারী স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষণা হচ্ছে সুদীর্ঘ শ্রেণী-সংগ্রামের ফল। এদের প্রথম ফল এই হল যে কার্যক্ষেত্রে কারখানাগুলিতে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের শ্রম-দিবস ও এইরকম নিয়মের নিয়ন্ত্রণ এল কারণ উৎপাদনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশু, তরুণ ও মহিলাদের সহযোগিতা অপরিহার্য। অতএব মোটের উপর ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে বারো ঘণ্টার এম-দিবস কারখানা আইনের মাধ্যমে শিল্পের সকল শাখায় সাধারণ ও সমভাবে প্রযোজ্য হল।

কিন্তু কারখানা মালিকেরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছুটা “প্রতিক্রিয়া না ঘটিয়ে এই “প্রগতি” হতে দেয়নি। তাদের প্ররোচনায় কমন্স সভা শোযণযোগ্য শিশুদের নিমতম বয়স নয় থেকে কমিয়ে আট করেন যাতে ধনিকরা ঐশ্বরিক ও মানবিক বিধান অনুসারে কারখানায় অধিক সংখ্যক শিশুর যোগান পেতে পারেন।[১০]

ইংল্যাণ্ডের অর্থ নৈতিক ইতিহাসে ১৮৪৬-১৮৪ ৭ বৎসরগুলি যুগান্তকারী। শস্য আইন এবং তুলল। ও অন্যান্য কাচামালগুলির উপর শুল্কের অবসান; আইন-প্রণয়নের ধ্রুব লক্ষ্য হিসেবে স্বাধীন ব্যবসা সম্পর্কিত ঘোষণা; এক কথায় নবযুগের আবির্ভাব হল। অপরপক্ষে ঐ একই বছরগুলিতে চার্চিস্ট আন্দোলন এবং দশ ঘণ্টা আইনের পক্ষে বিক্ষোভ ক্রান্তি-বিন্দুতে পৌছাল। এইগুলি প্রতিশোধকামী টোরীদের সমর্থন পেল। ব্রাইট ও কব ডেনের নেতৃত্বে স্বাধীন ব্যবসার ধ্বজাধারীদের উন্মত্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও এতকাল যে জন্য সংগ্রাম চলেছে সেই দশ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাব পার্লামেন্টে গৃহীত হল।

১৮৪৭ সালের আট-ই জুনের নূতন কারখানা আইনে স্থির হল যে ১৮৪৭-এর পয়লা জুলাই থেকে প্রাথমিকভাবে (তেবে থেকে আঠারো বছর বয়সের তরুণদের এবং সকল নারীশ্রমিকের শ্রম-দিবস এগারো ঘণ্টা করতে হবে, কিন্তু ১৮৭০-এর পয়লা মে থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম-দিবসকে দশ ঘণ্টা করতে হবে। অন্যান্য বিষয়ে এই আইনটি ১৮৩-১৮৪৪ সালের আইনগুলিকে সংশোধিত ও পূর্ণাঙ্গ আকার দান করে।

এইবার ধনিকরা ১৮৪৮ সালের পাল। মে যাতে আইনটির পূর্ণ প্রয়োগ না করা হয় তার জন্য অন্তরায় সৃষ্টির প্রাথমিক অভিযান শুরু করল। এবং শ্রমিকরা নিজেরাও অভিজ্ঞতা লব্ধ শিক্ষার অজুহাত তুলে নিজেদের আন্দোলন লব্ধ ফল নষ্ট করতে প্রবৃত্ত হল। খুবই চাতুরীর সঙ্গে সময়টি বাছাই করা হয়েছিল। “এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে (১৮৪৬-৪৭ এর ভয়ানক সংকটের দরুণ ) কারখানা শ্রমিকরা অনেক কমে কম সময়ে কাজ করার ফলে অনেক কল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দু’বছরের অধিককাল ভীষণ কষ্ট পায়। অতএব একটি বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক তখন খুব কষ্টের মধ্যে ছিল; বোঝা যায় যে অনেকে দেনাদার হয়েছিল; অতএব এটি বেশ আন্দাজ করা যায় যে তখনকার মত তারা বেশি সময় কাজ করতে চাইবে যাতে অতীতের ক্ষতিপূরণ হয়, হয়ত দেনা শোধ করা যায় অথবা মহাজনদের বন্ধক আসবাবপত্র ছাড়িয়ে আনা যায় অথবা বিক্রি করা জিনিসগুলির স্থানপূরণ করা যায় অথবা নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের জন্য নূতন পোষাক আশাক কেনা যায়।”[১১]

কারখানা-মালিক সাধারণভাবে দশ-শতাংশ মজুরি কমিয়ে ঘটনাবলীর স্বাভাবিক ফলটিকে আরও বাড়িয়ে তুলল। বলা চলে যে স্বাধীন ব্যবসার নবযুগের উদ্বোধন উৎসব এইভাবে উৎযাপিত হল। শ্রম-দিবসকে কমিয়ে এগারো ঘণ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই আরও ৮ শতাংশ মজুরি কমানো হল, এবং দশ ঘণ্টা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিগুণ পরিমাণ মজুরি কমানো হল। অতএব যেখানেই পারা গিয়েছিল মজুরি অন্ততঃ পচিশ শতাংশ কমানো হয়েছিল।[১২] এইভাবে তৈরি করা অনুকূল ব্যবস্থায় কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে ১৮৪৭ সালের আইন বাতিল করবার আন্দোলন শুরু হল। এই আন্দোলনের মিথ্যা প্রচার, ঘুষ দেওয়া, অথবা ভীতিপ্রদর্শন কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি, কিন্তু সমস্ত অপচেষ্টাই ব্যর্থ হল শ্রমিকদের কাছ থেকে যে আধ ডজন গণ-দরখাস্তে তারা “আইনটির জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ছিল, পরীক্ষার সময় দরখাস্তকারীর। নিজেরাই ঘোষণা করল যে তাদের স্বাক্ষরগুলি জোর করে নেওয়া হয়েছে। তারা অনুভব করছে যে তারা অত্যাচারিত কিন্তু সেটি ঠিক কারখানা আইনের জন্য নয়।[১৩] কিন্তু যদিও কারখানা মালিকরা যেমনটি চেয়েছিল ঠিক সেইভাবেই শ্রমিকদের দিয়ে কথা বলতে পারেনি, তবু তার শ্রমিকদের নাম নিয়ে সংবাদপত্রে ও পালামেন্টে নিজেরাই আরও বেশি জোরে চীৎকার করতে থাকল। তারা কারখানা-পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে এই বলে নিন্দাবাদ শুরু করল যে তারা নাকি ফরাসী জাতীয় কনভেশনের বিপ্লবী কমিশনারদের মত লোকহিতৈষিতার নামে দুঃখী কারখানা-শ্রমিকদের নির্মম ভাবে বলি দিচ্ছে কিন্তু এই চালও খাটল না। কারখানা-পরিদর্শক লিওনার্দ হনার নিজেও তার সাব-ইন্সপেক্টরদের মারফৎ ল্যাঙ্কাশায়ারের কারখানাগুলিতে সাক্ষীদের বহু পরীক্ষা করেন। পরীক্ষিত শ্রমিকদের শতকরা সত্তর জন দশ ঘণ্ট। আইন চান, অনেক কম শতাংশ এগারো ঘণ্টা আইন চান এবং এক নেহাৎ নগণ্য সংখ্যালঘু অংশ আগেকার বারো ঘণ্টা রাখতে চান।[১৪]

আর একটি “বন্ধুত্বপূর্ণ টোপ হল পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের দিয়ে বারো থেকে পনের ঘণ্টা কাজ করানো এবং তারপরে এই ব্যাপারটিকে শ্রমিকদের আন্তরিক ইচ্ছার প্রমাণ বলে দেশে-বিদেশে প্রচার চালানো। কিন্তু “নির্মম” কারখানা-পরিদর্শক লিওনার্দ হনরি আবার এগিয়ে এলেন। “যারা বেশি কাজ করত তাদের অধিকাংশ ঘোষণা করল “তারা কম মজুরি নিয়ে দশ ঘণ্টা কাজ বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারা নিরুপায়; এত বেশি লোক কর্মহীন ছিল (এত বেশি সংখ্যক কাটুনি ‘পিসার হিসেবে কাজ করে। এবং অন্য কাজ না পেয়ে এত কম মজুরি পাচ্ছিল) যে, যদি তারা বেশি সময় কাজ করতে অস্বীকার করত, তাহলে তাদের স্থানে অন্যদের নিয়োগ করা হত, যার ফলে তাদের সামনে প্রশ্ন ছিল, হয় বেশি ঘণ্টা কাজ করতে রাজি হও, নতুবা একেবারে বেকার হয়ে থাক।”[১৫]

এইভাবে ধনিকদের প্রাথমিক অভিযান ব্যর্থ হল এবং ১৮৪৮ সালের পয়লা মে দশ ঘন্টা আইন বলবৎ হল। কিন্তু ইতিমধ্যে চাচিস্ট পাটির বিপর্যয় এবং তার নেতাদের কারাদণ্ডের ফলে ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকশ্রেণীর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস খুবই আঘাত পেল। এর অব্যবহিত পরে জুন মাসে প্যারিসের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও তার বক্তাক্ত দমনকার্য ইংল্যাণ্ডে ও মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে শাসকশ্রেণীর সকল ভগ্নাংশকে একত্রিত করল, ভূস্বামী ও ধনিক, ফাটকা বাজারের নেকড়ে ও দোকানদার, সংরক্ষণবাদী ও অবাধ ব্যবসায়ী, সরকার পক্ষ ও বিরোধীপক্ষ, ধর্মধ্বজী ও স্বাধীন চিন্তাবাদী, তরুণী স্বৈরিণী ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী—সকলেই সম্পত্তি-ধর্ম-পরিবার ও সমাজকে বাঁচাবার একটি সাধারণ ধ্বনি তুলে একত্রিত হল। সর্বত্রই শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘোষণা জারি করা হল, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হল, কার্যতঃ তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে চিহ্নিত হয়ে তৎসংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় পড়ল। এখন আর কারখানা-মালিকদের সংযমের কোন দরকার রইল না। শুধুমাত্র দশ ঘণ্টা আইনের বিরুদ্ধে নয়, পরন্তু ১৮৩৩ সাল থেকে শুরু করে যে সব ব্যবস্থা কিছু-না-কিছু পরিমাণে শ্রমশক্তির “স্বাধীন” শোষণকে ক্ষুন্ন করেছে, তারা সেই সবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করল। দাসত্ব বজায় রাখবার জন্য এটি ছোট আকারে বিদ্রোহ,-দু’বছর ধরে নির্দয় ও বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাস চলল এবং এই সন্ত্রাস খুবই সস্তা ছিল কারণ আইনবিদ্রোহী মালিকদের শুধু “হাতের চামড়া ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতির ভয় ছিল না।

যে-সব ব্যাপার ঘটল সেগুলিকে বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে যে ১৮৩৩, ১৮৪৪ এবং ১৮৪৭ সালের কারখানা আইনগুলির যে সব অংশে একে অপরকে সংশোধিত করেনি, তাদের তখন সবটাই বলবৎ ছিল। তাদের একটিও আঠারো বছরের বেশি বয়সের পুরুষ শ্রমিকের শ্রম সীমাবদ্ধ করেনি এবং ১৮৩৩ সাল থেকেই সকাল সাড়ে পাচটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা ছিল আইনসঙ্গত “দিবস, যে সীমানার মধ্যে যথানির্দিষ্ট অবস্থায় নাবালক-বয়স্ক ও নারী শ্রমিকদের প্রথমে দিনে বারো ঘণ্টা এবং পরে দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হত।

কারখানা-মালিকরা এখানে ওখানে তাদের নিযুক্ত নাবালক ও নারী শ্রমিকদের একটি অংশকে, অনেক ক্ষেত্রে অর্ধেক সংখ্যক-কে, ছাটাই দিয়ে শুরু করত এবং তারপর বয়স্ক পুরুষদের জন্য রাত্রে কাজের লুপ্ত প্রায় প্রথার পুনঃ প্রবর্তন করত। তারা চেঁচিয়ে বলত, দশ ঘন্টা আইন এছাড়া অন্য কোন পথ রাখেনি।[১৬]

দ্বিতীয় ধাপে তারা ভোজনের জন্য আইনসঙ্গত বিরতি নিতে লাগল। এ বিষয়ে কারখানা-মালিকদের বক্তব্য কি? “শ্রমের সময় দশ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ হবার পর। কারখানা-মালিকরা কার্যত তখনো ততদূর পর্যন্ত না গিয়েও মনে করেন যে, শ্রমের সময়কে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ধরে সকাল নয়টার আগে এক ঘণ্টা এবং সন্ধ্যা সাতটার পরে আধঘণ্টা ভোজনের ছুটি দিলেই আইনের বিধান মানা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা এখন মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য একঘণ্টা অথবা আধঘণ্টা ছুটি দেন এবং জোরের সঙ্গে বলেন যে কারখানায় কাজের সময়ের মধ্যে ঐ দেড়ঘন্টা ছুটি দেবার কোন বাধ্যবাধকতা তাদের নেই।”[১৭] তাই কারখানা মালিকরা বলতেন যে, ১৮৪৪ সালের আইনের ভোজন সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট বিধানে শ্রমিকদের কেবল কাজে আসবার আগে এবং ছুটির পরে অর্থাৎ বাড়িতে গিয়ে ভোজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেনইবা শ্রমিকরা সকাল নটার আগে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেবে না? সরকার পক্ষের উকিলরা কিন্তু স্থির করলেন যে নির্ধারিত ভোজনের সময়টি কাজের সময়ের মধ্যে বিরতি দিতেই হবে এবং সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিনা বিরতিতে কাজ করানো আইনসঙ্গত নয়।”[১৮]

এইসব আলোচনার পর ধনিক এমন একটি কাজ দিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করল, যেটি আক্ষরিকভাবে ১৮৭৪ সালের আইনের সঙ্গে খাপ খায় এবং সেদিকে দিয়ে আইন-নঙ্গত।

১৮৪৪ সালের আইনে আট থেকে তেরো বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের যদি দুপুরের আগে নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাহলে বেলা একটার পরে তাদের খাটানো নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যেসব শিশুদের শ্রম-সময় বেলা বারোটা অথবা তার পরে শুরু হয় তাদের সাড়ে ছ’ঘণ্টার এম কোনক্রমেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে না। আট বছরের শিশুদের দুপুর থেকে কাজ শুরু হলে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত একঘণ্টা বেলা দু’টো থেকে চারটা পর্যন্ত দুঘণ্টা, বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত সাড়ে তিন ঘণ্টা, সর্বসাকুল্যে সাড়ে ছ’ঘণ্টা খাটানো চলত। অথবা এর চেয়েও ভাল ব্যবস্থা হতে পারত। রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুর্ণবয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবার জন্য কারখান-মালিকরা শুধু বেলা দু টো পর্যন্ত তাদের কাজ না দিলেই হত, তারা অতঃপর রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত এদের একনাগাড়ে কারখানায় রাখতে পারতেন। এবং এখন এই জিনিসটি স্পষ্টতঃ স্বীকার করা হয় যে, ইংল্যাণ্ডে দিনে দশ ঘণ্টার বেশি সময় যন্ত্রপাতিগুলি সচল রাখবার জন্য কারখানা-মালিকদের ইচ্ছা অনুসারেই তাদের খুশি-মাফিক নাবালক শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের ছুটির পরেও রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের পাশে শিশুদের কর্মরত রাখার প্রথা প্রচলিত আছে।[১৯] শ্রমিকগণ এবং কারখানা পরিদর্শকেরা স্বাস্থ্য ও নীতির কারণ দেখিয়ে প্রতিবাদ জানালেন কিন্তু ধনিকেরা জবাব দিলেন :

কাজ তো আমার প্রকাশ্য, আইন মত সৎ,
না হয় আনো দণ্ডনামা খারিজ করে খৎ!

বস্তুতঃ ১৮৫০ সালের ২৬শে জুলাই কমন্স সভায় উপস্থাপিত তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, সমস্ত প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৮৫০ সালের ১৫ই জুলাই তারিখে ৩,৭৪২টি শিশুকে ২৫৭টি কারখানায় এই প্রথায় খাটানো হয়েছিল।[২০] এইটাই যথেষ্ট নয়। ধনিকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ল যে ১৮৪৪ সালের আইনে মধ্যাহ্নের আগের পাঁচ ঘণ্টার কাজের মধ্যে অন্তত তিরিশ মিনিট বিরতি দিতেই হবে, কিন্তু মধ্যাহ্নের পরে কাজের জন্য বিরতির কোন বিধান নেই। অতএব, তারা এটাই কাজে লাগালো এবং আট বছর বয়সের শিশুদের বেলা দু’টো থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিনা বিরতিতে শুধু যে খাটাবারই সুযোগ পেল তাই নয়, পরন্তু এই সময়টুকু তাদের অনাহারেও রাখল।

“হ্যা, তার বুকের কাছ থেকেই,
এই কথাই শর্তে লেখা আছে।”[২১]

শাইলকের পদ্ধতিতে শিশুদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ১৮৪৪ সালের আইনের আক্ষরিক অনুসরণ থেকে শেষ পর্যন্ত “নাবালক এবং নারী শ্রমিকদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ঐ একই আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ এসে গেল। স্মরণ রাখা উচিত যে “প্রতারণাপূর্ণ পালা-প্রথার অবসানই ছিল ঐ আইনটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মালিকরা শুধুমাত্র এই সরল ঘোষণা দিয়ে বিদ্রোহ শুরু করলেন যে ১৮৪৪ সালের আইনের যে ধারাগুলি মালিকদের পছন্দমত পনের ঘণ্টা এম-দিবসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে নাবালক ও নারী শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিল, সেগুলি শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখা পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত নির্দোষ বলা চলত। কিন্তু দশঘণ্টা আইনে ব্যাপারটি হয়ে উঠল “ভয়ানক কষ্টকর”।[২২] তারা পরিদর্শকদের খুব ধীরস্থির ভাবে জানালো যে তার আইনের আক্ষরিক অর্থ না মেনে নিজেদের দায়িত্বে পুরানো প্ৰথার পুনঃ প্রবর্তন করবে।[২৩] কুপরামর্শে বিভ্রান্ত শ্রমিকের স্বার্থেই তারা এই কাজ করলেন “যাতে তাদের উচ্চতর মজুরি দেওয়া যায়” “এটাই ছিল এক সম্ভাব্য পথ যার সাহায্যে দশঘণ্টা আইনের আমলেও শিল্পে গ্রেট ব্রিটেনের আধিপত্য রক্ষা করা। যায়।” “সম্ভবতঃ পালা করে শ্রম করার প্রথার নিয়ম ভাঙ্গলে ধরা একটু শক্ত, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? এই দেশের বৃহৎ শিল্প-সার্থকে কি কারখানা ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টবদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করবার জন্য একটা গৌণ ব্যাপারে পরিণত কর। চলে?”[২৪]

স্বভাবতই এই সমস্ত চাল টিকল না। কারখানা-পরিদর্শকেরা আদালতে আবেদন করলেন। কিন্তু শীঘ্রই কারখানা-মালিকদের দরখাস্তগুলি এত ধূলো উড়ালো যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার জর্জ গ্রে বাধ্য হয়ে ১৮৪৮ সালের ৫ই আগষ্ট একটি সাকুলারে সুপারিশ করলেন যে পরিদর্শকরা আইনের শুধুমাত্র আক্ষরিক লঘনের ক্ষেত্রে অথবা যেক্ষেত্রে মনে করার কোন কারণ নেই যে নাবালকদের প্রকৃতপক্ষে আইন-নিদিষ্ট সীমার চেয়ে বাস্তবিকই বেশিক্ষণ খাটান হয়েছে, সেক্ষেত্রে পালা প্রথা অনুযায়ী নাবালকদের নিয়োগের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে পারবেন না। অতঃপর কারখানা পরিদর্শক জে. স্টুয়ার্ট গোটা স্কটল্যাণ্ডে ঠিক আগেকার দিনের মতই কারখানাগুলিতে পনের ঘণ্টা কার্যকালে তথাকথিত পালা-প্রথার পুনঃ প্রবর্তনে অনুমতি দিলেন। অপরপক্ষে ই ল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শকরা ঘোষনা করলেন যে আইনটিকে রদ করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন স্বেচ্ছাচারী হুকুম দেবার অধিকার নেই এবং তারা গোলামি পুনঃ প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে আইন সঙ্গত অভিযোগ চালিয়ে যেতে থাকলেন।

কিন্তু ধনীদের সমন জারি করিয়ে আদালতে হাজির করলে কি ফল হতে পারে যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের ম্যাজিষ্ট্রেটরা-কবে এর ভাষায় ‘অবৈতনিক মহৎ ব্যক্তিরা – তাদের বেকসুর ছেড়ে দিতেন? এইসব আদালতে মালিকরা নিজেরাই ছিল নিজেদের বিচারকর্তা। একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। কাশ, লিজ অ্যান্ড কোম্পানি, এই নামের সুতো তৈরি কারবারের জনৈক এক্রিগি তার জেলার কারখানা-পরিদর্শকের কাছে নিজের কারখানার জন্য একটি পালা প্রথার প্রস্তাব উপস্থিত করে। সম্মতি না পেয়ে লোকটি প্রথমে চুপচাপ থাকে। কয়েকমাস পরে রবিস নামে আর এক ব্যক্তি, সেও সুতোকল মালিক এবং এক্রিগির অনুচর না হলেও তার সঙ্গে সম্ভবত সম্পর্কযুক্ত, তিনি স্টকৃপোর্টের আঞ্চলিক ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে এক্রিগির আবিষ্কৃত পালা-প্রথাকে হুবহু প্রবর্তনের দায়ে অভিযুক্ত হল। চারজন বিচারে বসলেন, তাদের মধ্যে তিনজন হচ্ছেন সুতোকল মালিক, যাদের মধ্যে অনিবার্য ভাবেই সর্বপ্রধান ছিলেন ঐ এক্রিগি। রবিকে মুক্তি দিলেন এবং এখন এই অভিমত দাড়িয়ে গেল

যে রবিনের পক্ষে যেটি ন্যায্য এক্ৰিগের পক্ষেও সেটি নায্য। আইনের ক্ষেত্রে নিজেরই সিদ্ধান্তের সমর্থনের জোরে তিনি আর দেরি না করে নিজের কারখানায় ঐ প্রথা প্রবর্তন করলেন।[২৫] অবশ্য আইনের খেলাফ করে এই আদালতের বিচারকদের নেওয়া হয়েছিল।[২৬] পরিদর্শক হাওয়েল মন্তব্য করলেন যে, এইসব বিচার-বিভ্রাটের জন্য “এক্ষণি প্রতিকার-ব্যবস্থা চাই-হয় আইনটিকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হোক যাতে সেটিতে এইসব সিদ্ধান্তের অনুণােদন থাকে অথবা আদালতগুলি যাতে ভুলপথে না চলে সেরূপ প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা হোক, যাতে সিদ্ধান্তগুলি আইনানুগ হয় … . যখন এই ধরনের অভিযোগ আনা হল। আমি চাই যে বেতনভোগী ম্যাজিষ্ট্রেটরা বিচার করুন।”[২৭]

সরকারি আইনজ্ঞরা ১৮৪০ সালের আইন সম্পর্কে মালিকদের ব্যাখ্যাকে অজগুবি বলে ঘোষণা করলেন ! কিন্তু সমাজের রক্ষাকর্তারা নিজেদের সংকল্প থেকে সরে যাবার পাত্র নন। লিওনার্ড হর্ণার রিপোর্ট করছেন, “আইনটি কার্যকরী করতে গিয়ে সাতটি আঞ্চলিক আদালতের সামনে দশটি অভিযোগের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মাত্র আদালতে সমর্থন পেয়ে …….. আমি স্থির করলাম যে আইন লঙ্ঘন করার জন্য আরো মামলা করা নিরর্থক। ১৮৮ সালের আইনের সেই অংশটুকু যাতে কাজের ঘণ্টা একইরকম করার ব্যবস্থা ছল ……….সেটি এখন আর আমার জেলায় (ল্যাংকাশায়ার) কার্যকরী নেই। আমি অথবা সাব-ইন্সপেক্টর যখন এমন একটি কারখানা পরিদর্শন করি যেখানে পালা প্রথা আছে, সেখানে দেখি তরুণ বয়স্করা ও নারী-শ্রমিকেরা দশ ঘণ্টার বেশি কাজ করছে কি না সেটি জানবার কোন উপায় নেই ………পালা-প্রথা আছে এখন কল-মালিকদের সম্পর্কে ৩০শে এপ্রিলের এক হিসেবে সংখ্যা ছিল ১১৪ এবং কিছুকাল হল এই সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে। সাধারণতঃ কারখানার কার্যকাল বাড়িয়ে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সাড়ে তেরো ঘণ্টা করা হয়েছে: ….. . কোন কোন ক্ষেত্রে এটি দাড়ায় পনের ঘণ্টা, ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত।[২৮] ইতিপূর্কে ১৮:৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ৬৫ জন কারখানা মালিক ও ২৯ জন সুপারভাইজার এর একটি তালিশ ছিল যারা সমস্বরে ঘোষণা করেছিলেন যে, পালা প্রথা থাকলে কোন পরিদর্শন-ব্যবস্থাই প্রভৃত পরিমাণ অতিরিক্ত খাটুনি রদ করতে পারে না।[২৯] যা হয় তা যে একই শিশু ও নাবালকদের সুতোকাটার ঘর থেকে তঁত ঘরে বদল করা হয়, কখনও কখনও পনের ঘণ্টার মধ্যে এক কারখানা থেকে আর একটিতে পাঠান হয়।[৩০] কেমন করে এই ধরনের একটি বাবসাকে নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব, যাতে পাল। প্রথার আড়ালে নানা ভাবে হাতের তাস ভঁজানোর মত কোন না কোন এক ধরনের পরিকল্পনা করে, সারা দিনের মধ্যে শ্রমের ও বিরতির সময় এমন করে পাল্টানো হত, যে একই সময়ে একই ঘরে কোন একটি সম্পূর্ণ দল শ্রমিককে আপনি পেতে পারবেন না।”[৩১]

কিন্তু কার্যতঃ উল্লিখিত খাটুনির প্রশ্নটি ছেড়ে দিয়েও এই তথাকথিত পাল। প্রথাটি ধনিকদের উদ্ভট কল্পনার ফল, যাকে ফুরিযে পর্যন্ত তার ব্যঙ্গাত্মক নক্সাগুলিতে কখনো অতিক্রম করতে পারেন নি,ব্যতিক্রম শুধু এইটুকুই যে তার শ্রমের আকর্ষণ’ বদলে এখানে হয়েছে মূলধনের আকর্ষণ। যেমন মালিকদের সেইসব পরিকল্পনা সেগুলিকে “অভিজাত সংবাদপত্রগুলি “যথেষ্ট যত্ন ও শৃঙ্খলা থাকলে কতদূর এগোনো যায় তার পরাকাষ্ঠা বলে প্রশংসা করেছেন, সেগুলির দিকে একটু তাকান। শ্রমজীবী লোকগুলিকে কখনো কখনো বারো থেকে চোদ্দ ভাগে ভাগ করা হত। এই ভাগের অন্তর্ভুক্তদের কেবলই একটি থেকে আর একটিতে বদলানো হত। কারখানার শ্রম-দিবসের পনের ঘণ্টার মধ্যে ধনিক শ্রমিককে কখনো তিরিশ মিনিট, কখনো বা একঘণ্টা খাটাত এবং তারপর তাকে আবার বাইরে ঠেলে দিত, আবার তাকে কারখানায় টেনে এনে কাজ করিয়ে নূতন করে বাইরে ঠেলে দিত, খণ্ড থও সময় তাকে এইভাবে তাড়িয়ে বেড়ালেও পুরো দশ ঘণ্টা কাজ না করিয়ে তাকে কখনো ছাড়ত না। রঙ্গমঞ্চের মতই একই লোকগুলিকে বিভিন্ন অঙ্কের বিভিন্ন দৃশ্যে পালা করে আত্মপ্রকাশ করতে হত। কিন্তু অভিনেতা যেমন অভিনয়ের সমগ্র সময়টা থিয়েটারের দখলে থাকে, তেমনি শ্রমিকেরা পনের ঘণ্টাই কারখানার দখলে থাকত, তাদের যাওয়া আসার সময়ের হিসাব ছাড়াই। এইভাবে বিশ্রামের ঘণ্টাগুলিকে পরিবর্তিত করে বাধ্যতামূলক কর্মহীনতার ঘণ্টায় পরিণত করা হত, যা নাবালকদের টেনে নিয়ে যেত মদের দোকানে এবং বালিকাদের ঠেলে দিত পতিতালয়ে। দিনের পর দিন ধনিক শ্রমিকসংখ্যা না বাড়িয়ে বারো অথবা পনের ঘণ্টা পর্যন্ত তার যন্ত্রপাতি চালু রাখবার যেসব কৌশল নিত্য-নুতন আবিষ্কার করত, তাতে শ্রমিককে এইসব টুকরো টুকরো সময়ের মধ্যে কোন মতে তার খাবার গিলে নিতে হত। দশ ঘণ্টা আন্দোলনের সময় মালিকরা বলতেন যে উচ্ছঙ্খল শ্রমজীবীরা দশ ঘণ্টা থেকে বারো ঘণ্টা মজুরি পাবার আশা নিয়ে দরখাস্ত করেছে। এখন তারা চাকা ঘুরিয়ে দিলেন। তারা শ্রমশক্তির উপর বারো ঘণ্টা অথবা পনের ঘণ্টা মালিকানা করে দশ ঘণ্টার মজুরি দিতে থাকলেন।[৩২] এই হচ্ছে দশ ঘণ্টা আইন সম্পর্কে মালিকদের ব্যাখ্যার সারমর্ম। এরাই হচ্ছেন সেই একই মিষ্টভাষী স্বাধীন ব্যবসায়ী যারা মানবতার প্রেমে গলদঘর্ম হয়ে শস্য আইন বিরোধী আন্দোলনের যুগে পুরো দশ বছর কাল পাউণ্ড শিলিং ও পেন্সের হিসাব দেখিয়ে শ্রমিকদের কাছে প্রচার করেছিলেন যে স্বাধীন ভাবে শস্য আমদানি হলে ব্রিটিশ শিল্পে যতটুকু শক্তি আছে, তার জোরেই দশ ঘণ্টার শ্ৰম ধনিকদের সম্পদ-সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট।[৩৩] অবশেষে দুবছর পরে ধনিকদের এই বিদ্রোহে একটি সাফল্য লাভ হল, সেটি হচ্ছে ইংল্যাণ্ডে চারটি উচ্চতম বিচারালয়ের মধ্যে অন্যতম কোর্ট অফ এক্সচেকার’-এর একটি সিদ্ধান্ত। ১৮৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে এর সিদ্ধান্ত করেন যে কারখানা-মালিকরা নিশ্চয়ই ১৮৪৪ সালের আইনের মর্মের বিরুদ্ধে চলেছে কিন্তু এই আইনটিতেই এমন কতকগুলি কথা আছে যাতে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এই সিদ্ধান্তের দ্বারা দশ ঘন্টা আইন বাতিল হয়ে গেল।”[৩৪] মালিকের দল যারা এতদিন তরুণ-বয়স্ক ও নারী শ্রমিকদের জন্য পালা-প্রথা প্রয়োগ করতে ভয় পেত, তারা এখন এই নিয়ে উঠে পডে লাগল।[৩৫]

কিন্তু মূলধনের এই আপাতদৃশ্য চুড়ান্ত জয়ের পবেই এলো একটি প্রতিক্রিয়া। এতকাল পর্যন্ত শ্রমিকরা অনমনীয় এবং অবিরাম প্রতিরোধ করলেও তারা সক্রিয় কর্মসূচী নেয়নি। এখন ল্যাংকাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারে বিক্ষুব্ধ জনসভা থেকে তারা প্রতিবাদ জানাল। এইভাবে অবস্থা এমনি হল যেন দশ ঘণ্টার আইনটি একটি ভানমাত্র, এটি পালমেন্ট কর্তৃক একটি প্রতারণামাত্র, এর অস্তিত্ব কোনদিনই ছিল না। কারখানা পরিদর্শকেরা সরকারকে জরুরী হুশিয়ারি দিলেন যে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে শিরোধ এক অবিশ্বাস্য তীব্র স্তরে পৌঁছেছে। মালিকদের মধ্যেও কেউ কেউ গুঞ্জন শুরু করলেন : “বিচারকদের স্ববিরোধী সিদ্ধান্তের ফলে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এবং উচ্ছ,ঙ্খল একটি অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ইয়র্কশায়ারে একটি আইন খাটে, ল্যাংকাশায়ারে আর একটি; ল্যাংকাশায়ারের একটি গ্রামে এক আইন, ঠিক পার্শ্ববর্তী গ্রামে আর একটি। বড় বড় শহরে কারখানা-মালিক আইন এড়িয়ে চলতে পারেন, মফস্বল জেলাগুলির মালিকেরা পালাপ্রথার জন্য প্রয়োজনীয় লোক সংগ্রহ করতে পারেন না এক কারখানা থেকে অপর কারখানায় শ্রমিকদের বদলি করা তো দূরের কথা,” ইত্যাদি। কিন্তু মূলধনের সর্বপ্রথম জন্মগত দাবি হচ্ছে যে সকল মূলধনই সমভাবে এম-শক্তি শোষণ করবে।

এরূপ অবস্থার মধ্যে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একটা মিটমাট হল, যাকে ১৮৫০ সালের ৫ই আগষ্ট অতিরিক্ত কারখানা-আইনে পালমেন্টের ছাপ দেওয়া হল। “নাবালক এবং নারী শ্রমিকদের শ্রম-দিবসকে সপ্তাহে প্রথম পাঁচ দিনে দশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত ঘণ্টা করা হল। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ চলবে[৩৬] মাঝখানে ভোজনের জন্য কমপক্ষে দেড় ঘণ্টার বিরতি থাকবে, ভোজনের সময়গুলি সকলের ক্ষেত্রেই একই সময়ে নির্দিষ্ট হবে এবং ১৮৪৪ সালের আইনের নির্দেশ অনুযায়ী হবে। এতে চিরকালের মত পালাপ্রথা রহিত হল।[৩৭] শিশুদের পরিশ্রমের ক্ষেত্রে ১৮৪৭ সালের আইন বলবৎ থাকল।

পূর্বের ন্যায় এবারও একধরনের মালিকরা। শ্রমিক শ্রেণীর শিশু সন্তানদের ওপর বিশেষ মালিকানাস্বত্বের অধিকার পেলেন। এরা হচ্ছেন রেশম কারখানার মালিক। এরাই ১৮৩৩ সালে ভয় দেখিয়ে চীৎকার করেছিলেন, “যদি শ্রমজীবী শিশুদের দশ ঘণ্টা কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়, তাহলে তাদের কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাবে।”[৩৮] তাদের পক্ষে তেরো বছরের অধিক বয়সের যথেষ্ট সংখ্যক শিশু নিয়োগ করা অসম্ভব হয়ে উঠত। তাঁরা যে সুবিধা চেয়েছিলেন সেইটেই আদায় করলেন। পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা গেল যে তাদের অজুহাতটি ছিল একটি সুচিন্তিত মিথ্যা।[৩৯] কিন্তু যে শিশুদের টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে কাজ করাতে হত, দশ বছর ধরে দিনে দশ ঘণ্টা তাদের রক্ত জল করে রেশম তৈরি করতে এদের বাধেনি।[৪০] ১৮৪৪ সালের আইন নিশ্চয়ই এগারো বছরের কম বয়সের শিশুদের দিনে সাড়ে ছঘণ্টার বেশি খাটাবার পক্ষে তাদের অধিকার হরণ করেছিল। আইনে তারা এগারো থেকে তেরো বছর বয়সের শ্রমজীবী শিশুদের দিনে দশ ঘন্টা খাটাবার সুযোগ পেলেন এবং কারখানায় নিয়োজিত অপর সব শিশুদের পক্ষে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা বর। এদের ক্ষেত্রে রহিত হল। এইবার অজুহাত হল এই যে “তারা যে কাজে নিযুক্ত ছিল সেখানে বস্ত্রের সূক্ষ্ম প্রকৃতি অনুযায়ী খুব লঘু স্পর্শের দরকার হত, কেবলমাত্র অল্প বয়সের শিশুদের কারখানায় নিয়োগের ফলেই এই স্পর্শ আয়ত্ত করা যেত।”[৪১] শিশুদের আঙুলের কোমল স্পর্শের জন্য সরাসরিভাবে তাদের হত্যা করা হত যেমন দক্ষিণ রাশিয়ার শিংওয়ালা গোরুকে চামড়া ও চবির জন্যে হত্যা করা হত। অবশেষে ১০৫০ সালে, ১৮৪৪ সালে প্রদত্ত সুবিধাটি শুধুমাত্র রেশমের সুতো তৈরি ও সুতো জড়ানোর ডিপার্টমেন্টে সীমাবদ্ধ করা হল। কিন্তু এখানেও ধনিকদের “স্বাধীনতা” হণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এগারে থেকে তেরো বছর বয়সের শিশুদের শ্রম-সময় দশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে দশ ঘণ্টা করা হল। অজুহাত : “বস্ত্রশিল্পের অন্যান্য কারখানার চেয়ে রেশমের কারখানায় শ্রম অপেক্ষাকৃত হাল্কা এবং অন্যান্য বিষয়েও স্বাস্থ্যের পক্ষে কম ক্ষতিকর।”[৪২] সরকারি স্বাস্থ্য অনুসন্ধানের বিপোর্টে কিন্তু অপরপক্ষে এই তথ্য পরবর্তীকালে বিপরীত ব্যাপারটি প্রমাণিত করল, “মৃত্যুর গড় হার রেশম শিল্পের এলাকাগুলিতে অত্যধিক উচ্চ এবং মোট জনসংখ্যার স্ত্রীলোকদের মধ্যে এইটি ল্যাংকাশায়ারে তুলো-শিল্পের অঞ্চলগুলির চেয়ে উচ্চতর।[৪৩] কারখানা-পরিদর্শকদের ছয় মাস অন্তর বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই অনিষ্টকর প্রথা আজও পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে।[৪৪]

১৮৫০ সালের আইনটি শুধুমাত্র নাবালিকা শ্রমিকদের জন্য সকাল ছটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা কার্যকাল কমিয়ে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত বারো ঘণ্টায় পরিণত করে। অতএব এইটি সেইসব শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করেনি যাদের এই সময়ের আধ ঘণ্টা আগে এবং আড়াই ঘণ্টা পরে পর্যন্ত খাটানো যেত, অবশ্য যদি সমগ্র শ্রম-সময় সাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি না হয়। আইনের খসড়াটি আলোচনার সময় কারখানা-পরিদর্শকেরা পালমেন্টের সামনে এই গরমিলের জন্য অনিষ্টকর প্রয়োগের তথ্যগুলি উপস্থিত করেন। তাতে কোন ফল হয় না। কারণ ব্যবস্থাটির পিছনে নিহিত উদ্দেশ্য ছিল এই যে সম্পদের বছরগুলিতে শিশুদের নিয়োগের সুযোগ নিয়ে বয়স্ক পুরুষদের শ্রম-দিবসকে পনেরো ঘণ্টায় টেনে তোলা। পরবর্তী তিন বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হল যে বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের প্রতিরোধে এই চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই ১৮৫০ সালের আইনটি ১৮৫৩ সালে চূড়ান্ত রূপ নেবার সময় “নাবালক ও নারী শ্রমিকদের সকালবেলা কাজের আগে এবং সন্ধ্যাবেলা কাজের শেষে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হল। এখন থেকে অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া ১৮৫০ সালের কারখানা আইনটি তার অধীনস্থ শিল্পের শাখাগুলিতে সমস্ত শ্রমিকদের শ্রম-দিবস নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল।[৪৫] প্রথম কারখানা আইন প্রবর্তনের পর অর্ধশতাব্দী তখন অতীত হয়েছে।[৪৬]

কারখানা আইন সর্বপ্রথম তার মূল পরিধি অতিক্রম করল “১৮৪৫ সালের ছাপাখানা আইনে।” আইনটির প্রতি ছত্রে ফুটে উঠেছে যে এই নূতন “বাড়াবাড়িকে” ধনিকেরা কি রকম বিরক্তির সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। এতে শিশুদের জন্য শ্রম দিবসকে আট থেকে তেরো ঘণ্টায় নির্দিষ্ট করা হয় এবং নারীদের জন্য সকাল ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ষোল ঘণ্টা, খাবার জন্য আইনে নির্দিষ্ট কোন বিরতি ছিল না। এতে তেরো বছরের বেশি বয়সের পুরুষদের দিনে ও রাতে খুশিমত খাটানো যেত।[৪৭] এই আইনটি পার্লামেন্টের একটি গর্তস্রাব।[৪৮]

যাই হোক আধুনিক উৎপাদন-প্রণালীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সৃষ্টি হল শিল্পের বৃহৎ শাখাগুলি; সেগুলিতে জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই নীতিটির বৈজয়ন্তী ঘোষিত হল। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে এই শাখাগুলিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কারখানা শ্রমিকদের দৈহিক ও নৈতিক পুনকখান চলতে থাকে যাতে প্রায় অন্ধ ব্যক্তিরও চোখ খুলে যায়। অর্ধ শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের ফলে মালিকদের কাছ থেকে। ধাপে ধাপে শ্রমের যে-সব আইনগত সীমা ও নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে হয়েছে, এরাই ঘটা করে এখন এইসব শাখায় শোষণের দিকে যেখানে ঐ শোষণ এখনও ‘স্বাধীন’[৪৯] ছিল সেইদিকে, তুলনামূলকভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির হাতুড়ে পণ্ডিতরা এমন জ্ঞানগর্ভ ঘোষণা করলেন যে, আইন দ্বারা নির্দিষ্ট শ্রম-দিবসের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে তাদের বিজ্ঞানের”,[৫০] একটি বিশিষ্ট-নূতন আবিষ্কার। সহজেই বোঝা যায় যে কারখানা মালিকরা যখন হাল ছেড়ে দিয়ে অনিবার্যকে মেনে নিলেন, যখন ধনতন্ত্রের প্রতিরোধের ক্ষমতা ক্রমে কমে এল, একই সময়ে যখন এই প্রশ্নের সঙ্গে স্বার্থের দিক দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয় এমন সব সহযোগীদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, -সেই সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকল শ্রমিক শ্রেণীর আক্রমণের ক্ষমতা। এইজন্যই ১৮৬০ সালের পর থেকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত অগ্রগতি ঘটল।

১৮৬০ সালে রং ও ব্লিচিং কারখানাগুলি সব ১৮৫০ সালের কারখানা-আইনের অধীনে এল[৫১], লেস ও মোজার কারখানাগুলি এল ১৮৬১ সালে।

শিশু নিয়োগ কমিশনের প্রথম রিপোর্টের (১৮৬৩) ফলে সব রকমের মৃৎশিল্প (কেবল পটারিই নয়, দেশলাই, কাতুজ, কার্পেট এবং অন্যান্য আরো অনেক প্রক্রিয়ায়, এককথায় যেগুলিকে বলা হয় ফিনিশিং, সেই সমস্ত কিছুর ম্যানুফ্যাকচার কারীদের অদৃষ্টে একই ব্যাপার ঘটল। ১৮৬৩ সালের খোলা বাতাসে[৫২] ব্লিচিং এবং রুটি সেঁকার কাজকে বিশেষ বিশেষ আইনের আওতায় আনা হল যাতে করে প্রথমো ঔ কাজে নাবালক ও নারী শ্রমিকদের জন্য রাত্রে কাজ ( রাত আটটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্ত) এবং শেষেরটিতে আঠারো বছরের নিম্নবয়স্ক শিক্ষানবীশ রুটি কারিগরদের রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কাজ নিষিদ্ধ হয়। আমরা পরে ঐ একই কমিশনের পরবর্তী প্রস্তাবগুলির আলোচনা করব, যেগুলির কৃষি, খনি ও যানবাহন ছাড়া ব্রিটিশ শিল্পের সকল গুরুত্বপূর্ণ শাখায় তাদের এই “স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করবার আশংকা সৃষ্টি করেছে।[৫৩]

————

১. “এটা নিশ্চয়ই বিশেষ পরিতাপের বিষয় যে সমাজের কোন শ্রেণীর মানুষেরা দিনে ১২ ঘন্টা করে কাজ করবে আহার ও কর্মস্থলে যাতায়াতের সময় ধরে যা কার্যত দাড়ায় দিনে ১৪ ঘণ্টা। আমার বিশ্বাস, স্বাস্থ্যের প্রশ্নে না গিয়েও কেউ এটা স্বীকার করতে দ্বিধা করবেন না যে, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সেই শৈশবের ১৩ বছর বয়স থেকে এবং, যেসব শিল্পে কোনো বিধি-নিষেধ নেই, সেগুলিতে আরো অল্প বয়স থেকে, শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির সমগ্র সময় এমন ছেদহীন একটানা ভাবে আত্মসাৎ করে যে তার ব্যাপারটা এমন অনিষ্টকর যে তা দারুণ ভাবে নিন্দনীয়। ……. সুতরাং, সর্বজনিক নীতিবোধ জনগণের সুশৃংখল জীবন বিন্যাস এবং তাদের জন্য জীবন সম্ভোগের যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দানের স্বার্থে, এটা বিশেষ ভাবে বাঞ্ছনীয় যে সমস্ত শিল্পেই শ্রম-দিবসের একটা অংশকে বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। ( লিনাড’ হনরি কারখানা পরিদর্শকদের রিপোর্ট, ৩১শে ডিসেম্বর, ১৮৪১ )

২. ‘কাউন্টি অনিট্রিম, ১৮৬’তে মিঃ জে, এইচ ওটয়ে, বেলফাস্ট হিলারি সেসন কাউন্টি অ্যান্টিম বিচারের রায় দ্রষ্টব্য।

৩. বুর্জোয়া রাজা লুই ফিলিপ্পির রাজত্বের এটা একটা স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্য যে তার রাজত্বকালে ১৮২৫ সালের ২২শে মার্চ তারিখে গৃহীত কারখানা-আইনটি কখনো কার্যকরী করা হয়নি। আর এই আইনটি ছিল শিশু শ্রম সংক্রান্ত। এই আইনে ধার্য হয়েছিল যে ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুদের শ্রম-দিবস হবে ৮ ঘণ্টা ১২ থেকে ১৬ বছরের শিশুদের ১২ ঘণ্টা ইত্যাদি। এর মধ্যে ছিল আবার অনেক ব্যতিক্রম, যাতে ৮ বছরের শিশুদেরও রাতে কাজ করাবার ব্যবস্থা ছিল। যে দেশে প্রত্যেকটি ইদুরও পুলিশ প্রশাসনের অধীনে, সেখানে এই আইনের তদারকি ও প্রয়োগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘amis du combsrce’-এর সদিচ্ছার উপরে। কেবল এই ১৮৫৩ সাল থেকে একটি মাত্র বিভাগে—Department du Nord’-এ-একজন বৈজ্ঞানিক সরকারি পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়েছে। ফরাসী সমাজের বিকাশের এটাও একটা কম স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য নয় যে, ১৮৪৮ সালের বিপ্লব অবধি সর্বব্যাপ্ত ফরাসী আইন কানুনের ভিড়ের মধ্যে লুই ফিলিপ্পির এই আইনটি ছিল নিঃসঙ্গ।

৪. কারখানা পরিদর্শকদের রিপোর্ট”, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০ পৃঃ ৫০।

৫. “কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট” ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৯ পৃঃ ৬।

৬. “কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট’ ৩১শে অক্টোবর ১৮৪৮ পৃঃ ৯৮।

৭. লি নার্ড হন, তার সরকারি রিপোর্টগুলি “শয়তানি আচরণ” কথাটি ব্যবহার করেন। (কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৯, পৃঃ)।

৮. “কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট’ ৩শে সেপ্টেম্বর, ১৮৪৪ পৃঃ ১৫।

৯. এই আইনটি শিশুদের দশ ঘণ্টা কাজ করানোর অনুমতি দেয়—যদি তাদের একাদিক্রমে দিনের পর দিন কাজ না করিয়ে একদিন বাদে একদিন কাজ করানো হয়। এই আইনটি প্রধানতঃ অকার্যকরী-ই ছিল।

১০. “যেহেতু শ্রমের ঘণ্টা কমানো হলে শিশুদের বেশি সংখ্যায় নিয়োগ করতে হবে, এটা ধরা হল যে ৮-৯ বছরের শিশুদের অতিরিক্ত সরবরাহ বর্ধিত চাহিদা মিটিয়ে দেবে।” (l.c. পৃঃ ১৩)।

১১. “কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট”, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৮, পৃঃ ৬।

১২. আমি দেখতে পেলাম যে যারা সপ্তাহে দশ শিলিং পাচ্ছিল তাদের মজুরি থেকে দশ শতাংশ হ্রাসের জন্য এক শিলিং কাটা গেল, এবং বাকি নয় শিলিং থেকে সময় কমানোর জন্য দেড় শিলিং কাটা হল, দুটি মিলিয়ে ২২ শিলিং এবং এটা সত্বেও তাদের অনেকে বলল যে তারা বরং দশ ঘণ্টাই কাজ করবে। 1.c.

১৩. যদিও আমি দরখাস্তে সই দিয়েছি আমি তখনই বলেছিলাম যে, অন্যায় করেছি। তাহলে তুমি কেন সই করলে? কারণ অস্বীকার করলে আমাকে কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া হত। এর থেকে বোঝা যায় দরখাস্তকারীরা অনুভব করেছিল তার। ‘অত্যাচারিত কিন্তু ঠিক কারখানা আইনের দ্বারা নয়।_l.c. পৃ: ১১২।

১৪. রিপোর্ট, পৃঃ ১৭। মিঃ হারের জেলায় ২৮১টি কারখানায় ১৩,২৭০ জন পুর্ণবয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে এইভাবে পরীক্ষা করা হয়। ১৮৮৮ সালের অক্টোবরে যে বর্ষার্ধ শেষ হয়েছে সেই রিপোর্টে সংযোজনীর মধ্যে এই সাক্ষ্যগুলি পাওয়া যাবে। অন্যান্য ব্যাপারেও এই সাক্ষ্যগুলি খুবই মূল্যবান বলে মনে করা যায়।

১৫. l.c. লিওনার্ড হর্ণারের নিজের সংগৃহীত সাক্ষ্য নং ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৯২, ৯৩ এবং সাব-ইন্সপেক্টর এ-র সংগৃহীত সাক্ষ্য নং ৫১, ৫২, ৫৮ ৫৯, ৬২, ৭০ সংযোজনী থেকে পড়ুন। একজন কারখানা মালিকও সরল সত্যকথা বলেছিলেন। নং ১৪ দেখুন এবং ২৬৫, lc.।

১৬. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ১৩৩, ১৩৪।

১৭. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে এপ্রিল, ১৮৪৮, পৃঃ ৪৭।

১৮. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ১৩০।

১৯. রিপোর্ট ইত্যাদি .c. পৃঃ ১৪২।

২০. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৩, পৃঃ ৫, ৬।

২১. অপরিণত অবস্থায় যেমন, পরিণত অবস্থাতেও তেমনি মূলধনের প্রকৃতি একই রকম থাকে। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাধাবার অল্প কিছুদিন আগে নিউ মেক্সিকোর ভূখণ্ডে দাস-প্রভুরা তাদের প্রভাব অনুযায়ী যে বিধি প্রয়োগ করেন তাতে বলা হয়েছে ‘যেহেতু ধনিক শ্রমিকদের শ্রমশক্তি ক্রয় করেছে, সেজন্য সে হচ্ছে (ধনিকের) নিজস্ব সম্পত্তি। রোমের প্যাট্রিসিয়ানদের মধ্যে ঐ একই ধারণা প্রচলিত ছিল। তারা প্লিবিয়ান দেনাদারদের যে টাকা ধার দিত, সেই টাকা খাদ্যসামগ্রী মারফৎ দেনাদারদের রক্ত ও মাংসে পরিণত হত। অতএব এই ‘রক্ত ও মাংস’ হত তাদের সম্পত্তি। তাই রচিত হয়েছিল শাইলকমার্কা দশটি ধারার আইন। লিঙ্গুয়েথ কল্পনা করেছিলেন যে টাইবার নদীর ওপারে অভিজাত মহাজনরা মাঝে মাঝে দেনাদারদের মাংস দিয়ে ভোব করতেন। সেটি অবশ্য খ্রীস্টান ইউকারিস্টদের সম্পর্কে ডুমারের বক্তব্যের মতই অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে।

২২, ‘রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, পৃঃ ১৮৪৮ ২৮।

২৩. এইসব অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে পড়ে জনহিতৈষী অ্যাশওয়ার্থ কর্তৃক লিওনাড হর্ণারের কাছে লিখিত কোয়েকার-সূলভ (নৈষ্ঠিক খ্ৰীষ্টান) একটি বিরক্তিপূর্ণ চিঠি। ( বিপোর্ট ইত্যাদি এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৪)।

২৪. l.c. পৃ: ১৪।

২৫. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ২১, ২২। অনুরূপ দৃষ্টান্ত ঐ রিপোর্টেই পৃ: ৪, ৫।

২৬. স্যার জন হবহাউস-এর নামে পরিচিত কারখানা-আইনের ১, এবং ২ এর। চব্বিশ অধ্যায়ের দশম ধারায় বলা হয়েছে। কোন সুতোকল বা কাপড়ের কলের মালিক অথবা এমন কোন মালিকের পিতা, পুত্র কিংবা ভ্রাতা কারখানা-আইন সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে অবৈতনিক ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কাজ করতে পারবে না।

২৭. l.c.।

২৮. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৫।।

 ২৯. বিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৯, পৃঃ ৬।

৩০. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ২১।

৩১. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ৯৫।

৩২. ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯-এর রিপোর্ট প্রভৃতি পৃষ্ঠা ৬ দেখুন এবং ১৮৪৮ সালের ৩১শে অক্টোবরের রিপোর্ট-এ কারখানা পরিদর্শক হাওয়েল এবং সণ্ডার্স-এর পালা-প্রথা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পড়ন। পালা-প্রথার বিরুদ্ধে ১৮৪৯ সালে বসন্তকালে মহারাণীর নিকট অ্যাসটন ও সন্নিহিত অঞ্চলের যাজক সম্প্রদায়ের আর্জি পড়ন।

৩৩. যেমন উদাহরণস্বরূপ কারখানা সমস্যা ও দশ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাব। আর. এইচ. গ্রেগ, ১৮৩৭।

৩৪. এফ. এঙ্গেলস : ইংলিশ টেন আওয়ার্স বিল’ (Neue Rheinische Zeitung Politisch-ockonomische Revue” মার্কস সম্পাদিত, এপ্রিল সংখ্যা, ১৮৫৩, পৃঃ ১৩)। ঐ একই ‘উচ্চ বিচারালয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এমন একটি দ্ব্যর্থবাচক শব্দ আবিষ্কার করলেন যাতে বোম্বেটে জাহাজগুলিকে অস্ত্র সজ্জিত করার বিরুদ্ধে আইনটির অর্থ একেবারে উল্টে গেল।

৩৫. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি’, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৩।

৩৬. শীতকালে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এর বিকল্প হতে পারে।

৩৭, বর্তমান আইনটি (১৮৫০ সালে) একটি আপোষ-মীমাংসার ফল যাতে শ্রমিকেরা দশ ঘণ্টা আইনের সুবিধা ছেড়ে দিল এইজন্য যে, যাদের শ্রমের ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাদের শ্রমেরও শুরু এবং শেষ যাতে একই সময়ে হয়।” ( বিপোর্ট, ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫২ সালে, পৃঃ ১৪)।

৩৮. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি’, সেপ্টেম্বর, ১৮৪৪, পৃঃ ১৩।

৩৯. l.c.

৪০. l.c.

৪১. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৬, পৃঃ ২০।

৪২. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর ১৮৬১, পৃ: ২৬।

৪৩. মোটামুটি কারখানা-আইনের অধীনস্থ শ্রমজীবী জনসংখ্যা শারীরিক দিক দিয়ে অনেকটা উন্নত হয়েছে। সমস্ত ডাক্তারি সাক্ষ্য প্রমাণ এই বিষয়ে একমত এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে আমারও এই বিশ্বাস হয়েছে। তৎসত্বেও এবং জীবনের সূচনায় ভয়াবহ শিশু-মৃত্যুর হারের কথা ছেড়ে দিলেও ডাঃ গ্রীনহাউ-এর সরকারি রিপোর্ট থেকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য-সম্পন্ন বিভিন্ন কৃষিপ্রধান অঞ্চল-এর তুলনায় শিল্প প্রধান অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্যের প্রতিকূল অবস্থা দেখা যায়। প্রমাণ স্বরূপ ১৮৬১ সালের রিপোর্ট থেকে পরপৃষ্ঠার সারণীটি দেওয়া যায় :  

৪৪. সকলেই জানেন যে, ‘অবাধ ব্যবসার পুজারী’ ইংরেজ ব্যাপারীরা রেশম শিল্পের উপর প্রতিবোধ-ব্যবস্থা তুলে দেবার সময় কী রকম অনিচ্ছা দেখায়। ফরাসী পণ্য আমদানির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের বদলে এখন কার্যকরী হল কারখানায় নিযুক্ত ইংরেজ শিশুদের রক্ষাকবচের অভাব।

৪৫. ১৮৫৯ এবং ১৮৬০ সালে ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রশিল্প যখন শীর্ষে উঠেছে, তখন কযেকজন কারখানা-মালিক বাড়তি খাটুনির জন্য বাড়তি মজুরি লোভজনক টোপ ফেলে বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের দিয়ে শ্রম-সময়ের বৃদ্ধি মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন ! যন্ত্র-ব্যবহারকারী কাটুনিরা এবং অপরাপর শ্রমিকগণ মালিকদের কাছে একটি আর্জি করে এই পরীক্ষাটি শেষ করে দিলেন, আর্জিতে তারা বললেন, ‘সোজা কথা বলতে গেলে, আমাদের কাছে আমাদের জীবনযাত্রা বোঝা স্বরূপ; এবং দেশের অন্যান্য শ্রমিকদের চেয়ে যখন আমরা সপ্তাহে প্রায় দু’দিন বেশি কারখানার মধ্যে আবদ্ধ থাকি, তখন আমাদের মনে হয় যে আমরা আমাদের দেশের গোলাম এবং আমরা এমন একটি প্রথাকে স্থায়ী করছি যেটি আমাদের পক্ষে এবং ভবিষ্যৎ-বংশীয়দের পক্ষে ক্ষতিকর….. অতএব এতৎদ্বারা আপনাদের কাছে বিজ্ঞপিত করছি যে ক্রিস ও নববর্ষের ছুটির পরে যখন আমরা আবার কাজ শুরু করব; তখন আমরা সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করব এবং তার বেশি করব না। অথবা সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত, মাঝে দেড় ঘণ্টা ছুটি।” (রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০, পৃ: ৩০)।

৪৬, এই আইনের শব্দ-বিন্যাসের মধ্যে একে লঙ্ঘনের যে সুযোগ-সুবিধাগুলি ছিল তার জন্য কারখানা নিয়ন্ত্রণ আইন (৬ই আগস্ট, ১৮৫৯) সম্পর্কে পার্লামেন্টের রিটার্ণ দেখুন, এবং এর মধ্যে বিশেষ করে লির্ড হর্ণারের ‘অবৈধ কাজকর্ম, অধুনা। যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে সেগুলি বন্ধ করবার জন্য পরিদর্শকদের হাতে ক্ষমতা দেবার উদ্দেয়ে কারখানা আইনগুলির সংশোধনের প্রস্তাবাবলী’ দেখুন।

৪৭. ‘আমার জেলায় গত ছয় মাসে আট বছর বয়স ও তদূর্ধ বয়সের শিশুদের সত্যসত্যই সকাল ছয়টা থেকে রাত্রি নয়টা পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়েছে। ( “রিপোর্ট” ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৭, পৃ: ৩৬)।

৪৮. স্বীকার করা হয়েছে যে ছাপাখানা আইনটি তার শিক্ষামূলক এবং রক্ষণমূলক উভয়বিধ ব্যবস্থার দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। {“রিপোর্ট” ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫২)।

৪৯. এইজন্য উদাহরণস্বরূপ ই. পটার ১৮৬৩ সালের ২৪শে মার্চ টাইমস পত্রিকায় লেখেন। পত্রিকাটি তাকে ১০ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শিল্পপতিদের বিদ্রোহের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

৫০. অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে মি. ডবলু নিউমার্ক যিনি ‘টুকে’ (Tooke) প্রণীত “দামের ইতিহাস গ্রন্থের সহযোগী এবং সম্পাদক ছিলেন, তিনি বলেন : জনমতের কাছে কাপুরুষের মত আত্মসমর্পণকে কি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বলা যায়?

৫১. ১৮৬০ সালের আইনটিতে বলা হল যে ডাইং এবং ব্লিচিং কারখানাগুলিতে ১৮৬১ সালের ১লা আগষ্ট থেকে অস্থায়ীভাবে বারো ঘণ্টা শ্রম-দিবস চালু হবে এবং চূড়ান্তভাবে ১৮৬২ সালের ১লা আগষ্ট দশ ঘণ্ট! প্রবর্তিত হবে। অর্থাৎ অন্যান্য দিনে সাড়ে দশ ঘণ্টা এবং শনিবারে সাড়ে সাত ঘণ্টা। কিন্তু যখন ঐ বিপজ্জনক ১৮৬২ সাল এল, তখনই পুরানো প্রহসনের পুনরাবৃত্তি হল। উপরন্তু শিল্পপতিরা পালামেন্টের কাছে দরখাস্তে জানালেন যে আরও এক বছর নাবালক ও স্ত্রীলোকদের বারো ঘণ্টা খাটানো হোক। “ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থায় ( তথন তুলো সংকট চলছে) বারো ঘণ্টার কাজ শ্রমিকেরই পক্ষে যায় যতদিন সম্ভব তারা কিছু বেশি রোজগার করুক-না-কেন, এই মর্মে একটি বিলও অনা হয় কিন্তু প্রধানতঃ স্কটল্যাণ্ডের ব্লিচিং শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিলটি পরিত্যক্ত হয়। (“রিপোর্ট” ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ১৫-১৬) এইভাবে যে শ্রমিকদের স্বার্থের ধুয়ো ধরে ধনিকের দাবি করছিলেন, তাদেরই দ্বারা পরাজিত হয় এখন তারা উকিলের চোখ দিয়ে লক্ষ্য করলেন যে পালামেন্টের অন্যসব আইনের মতো ১৮৬০ সালের আইনটিও তার আওতা থেকে ফিনিশিং ও ক্যালেণ্ডারিং শ্রমিকদের বাদ রেখেছিল। মূলধনের চিরকালের বিশ্বস্ত ভৃত্য, ব্রিটিশ আইন-প্রণালী সাধারণ আদালতে ধূর্ততাকে অনুমোদন করল ‘শ্রমিকরা খুবই হতাশ হয়েছে তার অতিরিক্ত খাটুনির অভিযোগ করে এক খুবই পরিতাপের বিষয় যে আইনের ভুল সংজ্ঞার জন্য তার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। (1.c. পৃ: ১৮)।

৫২. ‘খোলা হাওয়ায় ব্লিচিং’-এর মালিকপক্ষ এই মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে ১৮৬০ সালের আইন এড়িয়ে যেতে চাইত যে কোনো স্ত্রীলোকই রাত্রে ঐ কাজ করত না। কারখানা-পরিদর্শকেরা এই মিথ্যাটি ধরিয়ে দিলেন এবং ঐ একই সময়ে শ্রমজীবীদের বিভিন্ন আর্জি মারফৎ পালমেন্টের সদস্যদের মন থেকে স্নিগ্ধ ও সুগন্ধ তৃণপূর্ণ মাঠে, খোলা হাওয়ার পরিবেশে ব্লিচিং চলার কাহিনী দূরীভূত হল। এই খোলা হওয়ায় ব্লিচিং-এ যে সব শুকাবার ঘর ব্যবহৃত হত সেগুলির তাপমাত্রা ছিল ১০ থেকে ১০০° ফারেনহি এবং এখানে কাজটি করত প্রধানতঃ বালিকারা। ঠাণ্ডা হওয়া’-এই পারিভাষিক কথাটি তারা এই অর্থে ব্যবহার করত যে, তারা শুক্রবার ঘর থেকে পালিয়ে মুক্ত টাটকা হাওয়ায় যেত। স্টোভের কামরায় পনেরটি বলিকা। লিনেনের জন্য ৮০ থেকে ৯০ তাপমাত্রা এবং কেম্বিকের জন্য ১০০ বা ততোধিক। আড়াআড়ি দশ ফুটের মত একটি ছোট ঘরে বারোজন বালিকা ইস্ত্রি ও অন্যান্য কাজ করে, ঐ ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি ক্লোজ স্টোভ। স্টোভটা নিদারুণ তাপ ছড়ায় এবং তার চারপাশে বাড়িয়ে বালিকারা তাড়াতাড়ি কেম্বিকগুলি শুকিয়ে ইস্ত্রিওয়ালাদের হাতে দেয়। এইসব শ্রমজীবীদের শ্রমের ঘণ্টার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। কাজ থাকলে এরা পরপর রাত নয়টা অথবা এমনকি বারোটা পর্যন্ত কাজ করে। ( রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩:শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৬ ) একজন চিকিৎসক উক্তি করেন : ‘ঠাণ্ডা হবার জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট করা নেই কিন্তু যদি তাপমাত্রা ভয়ানক উচু হয়ে যায় অথবা যদি কারিগর দের হাত ঘামে নোংরা হয়ে যায় তবেই তাদের অল্প কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে। যেতে দেওয়া হয় ….. আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, যার পরিমাণ বড় কম নয়, এই স্টোভের কারিগরদের রোগ-চিকিৎসা আমাকে এই মত প্রকাশ করতে বাধ্য করছে যে, এদের স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা কোনক্রমেই একটি সুতোকলের শ্রমিকদের ‘সমান পর্যায়ের নয় (এবং ধনিকরা পালমেন্টের কাছে পাঠানো তাদের স্মারক লিপিতে এদের বর্ণোজ্জ্বল স্বাস্থ্যের ছবি একেছিল প্রায় চিত্রশিল্পী রুবেন্স-এব অনুকরণে )। তাদের মধ্যে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল, সেগুলি হচ্ছে যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, জরায়ুর অনিয়মিত ক্রিয়া, অত্যন্ত উগ্ৰধরনের হিষ্টিরিয়া এবং বাত। আমি মনে করি যে, এই সবগুলিই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এসেছে ঐ সব ঘরে এই কারিগরেরা কাজ করে সেখানকার দূষিত ও অত্যন্ত গরম হাওয়া থেকে এবং যখন তার বিশেষতঃ শীতকালে বাইরের ঠাণ্ডা ও ভিজে বাতাসের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তখন তাদের রক্ষার উপযুক্ত যথেষ্ট গরম পোশাকের অভাব থেকে। (1c. পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭ )। ১৮৬০ সালের পরিপূরক আইন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐ আইনের সংরক্ষণের বাইরের এই খোলা হাওয়ায় ব্লিচিং কারিগরদের সম্পর্কে বলেন : “যে রক্ষাব্যবস্থা করবার কথা শুধু যে সেই ব্যবস্থা করতে আইনটি অক্ষম হয়েছে তাই নয়, পরন্তু এতে একটি ধারা আছে তদনুযায়ী তার শব্দবিন্যাস বাহত এমনই যে যদি না রাত্রি আটটার পরে কাজ করছে এমন অবস্থায় হাতে নাতে ধরা হয় তাহলে তাদের জন্য কোনো রক্ষণ-ব্যবস্থাই নেই এবং তেমন ক্ষেত্রেও প্রমাণের পদ্ধতি এমনই যে তাতে কোনো সাজা হতে পারে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।”…..(1. c. পৃঃ ৫২) “অতএব, সবদিক দিয়ে দেখা যায় যে আইন হিসেবে কোন সদুদ্দেশ্য সাধনে অথবা শিক্ষার মাধ্যমরূপে এটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ যেহেতু এই ব্যবস্থাকে সদাশয় বলা যায় না যাতে কার্যক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে নারী ও শিশুকে দিনে চোদ্দ ঘন্টা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেয়ে-না-খেয়ে কাজ করতে হয়, এবং হয়ত তার চেয়েও বেশি ঘণ্টা,—যেখানে বয়সের কোন সীমা নেই, নারী-পুরুষ বিচার নেই, এবং সন্নিহিত এলাকার বাসিন্দাদের সামাজিক অভ্যাস ও রীতি সম্পর্কে কোন ক্ষেপ নেই যে জায়গায় ঐসব (ব্লিচিং ও রংএর) কারখানাগুলি অবস্থিত।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০ এপ্রিল, ১৮৬৩, পৃঃ ৪০)।

৫৩. ২য় সংস্করণের নোট। ১৮৬৬ সাল থেকে অর্থাৎ আমি উপরের অধ্যায়গুলি লেখার পরে আবার এক প্রতিক্রিয়া এসেছে।

.

.

১০.৭  স্বাভাবিক শ্রমদিবসে জন্য সংগ্রামঅন্যান্য দেশে ইংল্যাণ্ডের কারখানাআইনগুলির প্রতিক্রিয়া

পাঠক মনে রাখবেন যে, মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা থেকে যার উদ্ভব ঘটতে পারে, উৎপাদন-পদ্ধতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে, উত্তমূল্যের উৎপাদন অথবা বাড়তি শ্রমের নিষ্কর্ষণই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তার মর্মসত্তা। পাঠক মনে রাখবেন যে, আমরা এখনো পর্যন্ত যতটা এগিয়েছি তাতে কেবল স্বাধীন শ্রমিক অর্থাৎ কেবল সেই শ্রমিক, যে আইনত: নিজের পক্ষে কাজ করতে আইনতঃ যোগ্যতাসম্পন্ন, একমাত্র সে-ই একটি পণ্যের ফেরিওয়ালা হিসাবে ধনিকের সঙ্গে চুক্তিতে প্রবেশ করে। অতএব আমাদের এই ঐতিহাসিক বিবরণে যদি একদিকে আধুনিক শিল্প এবং, অন্যদিকে, যারা শারীরবৃত্ত ও আইন—দুদিক থেকেই যারা নাবালক, তাদের শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, তা হলে প্রথমটিকে আমরা দেখেছি উৎপাদনের একটি বিশেষ বিভাগরূপে এবং দ্বিতীয়টিকে শ্রম-শোষণের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্তরূপে। যাই হোক, আমাদের পরবর্তী অনুসন্ধান সম্পর্কে আগে থেকে কোন অনুমান না করে, শুধু আমাদের হাতে মজুদ ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ থেকেই এটা বেরিয়ে আসে।

প্রথমতঃ, শ্রম-দিবসকে সীমাহীন ও বেপরোয়াভাবে বাড়াবার জন্য ধনিকদের আবেগ প্রথমে তৃপ্ত হয় সেইসব শিল্পে, যেগুলিতে জল-শক্তি, বাষ্প ও যন্ত্র প্রবর্তনের ফলে বিপ্লবী রূপান্তর এসেছিল—যেগুলি হচ্ছে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতির প্রথম সৃষ্টি, যেমন, তুলো, শন, পশম ও রেশমের সুতোকাটা ও বোনা। উৎপাদনের বাস্তব পদ্ধতিতে পরিবর্তন এবং তদনুযায়ী উৎপাদকদের সামাজিক সম্পর্কসমূহের পরিবর্তনই[১] প্রথমে একটা সীমাহীন বাড়াবাড়ির উদ্ভব ঘটালো এবং পরে তারই প্রতিবাদে সমাজের পক্ষ থেকে আরোপিত হল একটি নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা যাতে শ্রম-দিবস এবং তার বিরতিগুলি নির্দিষ্ট, নিয়মিত ও অভিন্ন হল। তাই প্রথমে এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটিকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কেবল ব্যতিক্রমমূলক আইন হিসাবে দেখা যায়।[২] নোতুন উৎপাদন পদ্ধতি শিল্পের এই অংশে প্রথমে আধিপত্য বিস্তার সম্পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল যে, ইতিমধ্যে উৎপাদনের অন্যান্য শাখাতেই যে শুধু এই উৎপাদন-পদ্ধতি প্রসারিত হয়েছে তাই নয়, উপরন্তু কম-বেশি সেকেলে কায়দায় চালিত বহু শিল্প, যেমন মৃৎশিল্প ও কাচ শিল্প প্রভৃতি, একেবারে সাবেকি হস্তশিল্প, যেমন রুটি তৈরি, এবং শেষ পর্যন্ত এমনকি সেইসব তথাকথিত ঘরোয়া শিল্প যেমন পেরেক তৈরি,[৩]-এই সবগুলি শিল্পই, কারখানা-ব্যবস্থার মত, ধনতান্ত্রিক শোষণের সম্পূর্ণ শিকারে পরিণত হয়েছে। তাই আইনের বিধানে ব্যতিক্রমমূলক চরিত্রটি ক্রমেই বাদ দেওয়া প্রয়োজন হল, অথবা ইংল্যাণ্ডের মত দেশে, রোমান ক্যাস্টদের অনুকরণে ঘোষণা করা হল যে, যে-কোন বাড়ি যেখানে কাজ করা হয়, তাকেই বলা হবে কারখানা।[৪]

দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের কয়েকটি বিশেষ শাখায় শ্রম-দিবস নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সংগ্রাম এখনো চলছে তার থেকে চূড়ান্তভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি বিচ্ছিন্ন শ্রমিক যে নিজের শ্রমশক্তির স্বাধীন বিক্রেতা তার পক্ষে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন একটি বিশেষ স্তরে পৌছবার পরে বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সেইজন্যই স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ধনিক-শ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী একটি মোটামুটি ছদ্মবেশী গৃহযুদ্ধের ফল। যেহেতু এই সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে আধুনিক শিল্পের বঙ্গমঞ্চে, সেইহেতু এর সূচনা হয় এই শিল্পের আবাসভূমি ইংল্যাণ্ডে।[৫] ইংল্যাণ্ডের কারখানা-শ্রমিকেরা কেবল ইংল্যাণ্ডের নয়, পরন্তু সাধারণভাবে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীরই প্রবক্তা এবং তাদের মতবাদের প্রবর্তকরূপে এরাই প্রথম ধনতন্ত্রের মত বাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণ করল।[৬] এইজন্যই মূলধন যখন ‘শ্রমের পূর্ণ স্বাধীনতা”-র জন্য পৌরুষ সহকারে সংগ্রাম করছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে যে পতাকা শ্রমিকেরা উড্ডীন করেছিল, তার উপরে কারখানা আইনের গোলামি” কথাটি খচিত করাকে কারখানার দার্শনিক, উরে, তীব্র ভাষায় নিন্দা করে বলেছেন যে এটা ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে অনপনীয় কলংকস্বরূপ।[৭]

ফ্রান্স ইংল্যাণ্ডের পিছনে পিছনে খুড়িয়ে চলে। ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের প্রয়োজন হয় বারো ঘণ্টার শ্রম-দিবস আইন প্রবর্তনের জন্য,[৮] যদিও মূল ব্রিটিশ আইনের চেয়ে এটা অনেক বেশী ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সে যাই হোক, ফ্রান্সের বিপ্লবী পদ্ধতির কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। ইংল্যাণ্ডের আইন ঘটনাবলীর চাপে যে ব্যবস্থা অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে বাধ্য হয়, প্রথমে একটি জায়গায়, পরে আর একটি জায়গায় এবং এইভাবে পরস্পর-বিরোধী আইনের ধারাগুলির এক বিভ্রান্তিকর ও হতাশা জনক জট পাকিয়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে ফরাসীরা সর্বত্র, সমস্ত কারখানা ও কর্মশালায় বিনা ব্যতিক্রমে একই সঙ্গে একই শ্রম-দিবসের অধীনে এনে ফেলল।[৯] অপরপক্ষে, ফরাসী আইন যে জিনিসটিকে নীতি হিসেবে ঘোষণা করল, সেটি ইংল্যাণ্ডে

প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কেবল শিশু, নাবালক ও নারী শ্রমিকদের জন্য এবং মাত্র সম্প্রতি এই সর্বপ্রথম তাকে দাবি করা হচ্ছে সকলের অধিকার বলে।[১০]

উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যতদিন দেশের একটি অংশ ছিল দাসপ্রথার দ্বারা বিকলাঙ্গ, ততদিন শ্রমিকদের প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আন্দোলন হয়ে যেতে অসাড়। সাদা চামড়ার শ্রম ততদিন মুক্ত হতে পারে না, যতদিন পর্যন্ত কালো চামড়ার এম থাকে গোলাম। কিন্তু দাসত্বের সমাধি থেকে অচিরে ঘটল নব-জীবনের অভ্যুদয়। গৃহযুদ্ধের প্রথম ফল হল আট ঘণ্টার জন্য আন্দোলন যা ইঞ্জিনের মতই দ্রুতগতিতে অতলান্তিক উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং নিউ ইংল্যাণ্ড থেকে ক্যালি ফোর্ণিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। বাল্টিমোরে শ্রমিকদের সাধারণ কংগ্রেস ( ১৬ই আগষ্ট, ১৮৬৬ ) ঘোষণা করল : “বর্তমান সময় সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য আমেরিকার সকল অঙ্গরাজ্যে আট ঘণ্টা শ্রমের স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের একটি আইন প্রবর্তন করে শ্রমিককে বনিকদের গোলামি থেকে মুক্ত করা। আমরা সঙ্কল্প করছি যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমরা এই গৌরবময় লক্ষ্য সাধন করবই।”[১১] ঐ একই সময়ে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তজাতিক শ্রমিক সংঘের ( ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেস্ অ্যাসোসিয়েশন-এর ) কংগ্রেস লণ্ডনের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের উপর সিদ্ধান্ত করলেন : “শ্রম দিবসকে সীমাবদ্ধ করাই হচ্ছে প্রাথমিক পূর্বশর্ত যেটি না হলে প্রগতি ও মুক্তির জন্য সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল হতে বাধ্য…… কংগ্রেসের মতে আট ঘণ্টাই এম-দিবসের আইন সঙ্গত সীমা।”

এইভাবে অতলান্তিক মহাসাগরের উভয় কৃলে যে-শ্রমিক-আন্দোলন উৎপাদনের অবস্থাবলী থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম গ্রহণ করল, তা ইংল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক সণ্ডার্সের উক্তিকেই প্রতিপন্ন করল : “সমাজ-সংস্কারের পরবর্তী কোন পদক্ষেপ করতে গিয়ে সফলতার কোনো আশা করা যাবে না, যতদিন পর্যন্ত শ্রমের ঘণ্টা সীমাবদ্ধ না করা যায় এবং অনুমোদিত সীমাকে কঠোরভাবে কার্যকরী না করা যায়।[১২]

এটা স্বীকার করতেই হবে যে উৎপাদন-প্রক্রিয়া থেকে আমাদের শ্রমিক যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে আর ঐ প্রক্রিয়াটিতে প্রবেশের আগেকার ব্যক্তিটি নেই। বাজারে যখন সে নিজের পণ্য “শ্রমশক্তির” মালিকরূপে অন্যান্য পণ্যের মালিকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, এখন সে ছিল অপর বিক্রেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একজন বিক্রেতা। কিন্তু যে-চুক্তি মারফৎ সে নিজের শ্রমশক্তি ধনিককে বিক্রি করে, সেইটি বলা যায়, কাগজে-কলমে প্রমাণ করে যে সে নিজেকেই স্বাধীনভাবে বিক্রি করে দিয়েছে। কেনা বেচা সমাপ্ত হলে দেখা যায় যে সে “স্বাধীন বিক্রেতা” নয়, যতটা সময়ের জন্য সে শ্রম শক্তি স্বাধীনভাবে বিক্রি করে, ঠিক ততটা সময়ের জন্যই সে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।[১৩] অর্থাৎ বাস্তবিক পক্ষে রক্তচোষা ততক্ষণ তাকে ছাড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও পেশী, একটি স্নায়ু, একবিন্দু রক্তও শোষণ করা বাকি থাকে।”[১৪] “তাদের যাতনা আশীবিষের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য শ্রমিকগণকে একত্র হয়ে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে এবং শ্রেণীগতভাবে এমন একটি আইনের প্রবর্তন করাতে হবে, যে আইনটি হবে একটি সর্বশক্তিসম্পন্ন সামাজিক নিষেধাজ্ঞা, যাতে ধনিকদের কাছে স্বেচ্ছামূলক চুক্তির দ্বারা ঐ একই শ্রমিকরা নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে বিক্রি করে গোলামী ও মৃত্যুর বলি হওয়া থেকে বাঁচে।[১৫] “মানুষের অলংঘনীয় অধিকারের আড়ম্বরপূর্ণ তালিকার জায়গায় এল এই আইনতঃ সীমাবৰ শ্ৰম-দিবসের বিনম্র মহাসনদ; যেটি স্পষ্ট করে দেবে যে “কখন থেকে শ্রমিকের আত্মবিক্রয়ের সময় শেষ হয়ে শুরু হবে তার নিজস্ব সময়।”[১৬] Quantum mutatus ab illo!

————

১. “এই শ্রেণীগুলি ( ধনিক ও শ্রমিক) যে আপেক্ষিক পরিস্থিতিতে স্থাপিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের আচরণ সেই পরিস্থিতিরই ফল।” ( রিপোের্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টেবের, ১৮৪৮, পৃঃ ১১৩)।

২. শ্রমিক নিয়োগের যে ক্ষেত্রে নিষেধ আরোপিত হল, সেটি বাষ্প বা জল শক্তির সাহায্যে চালিত বস্ত্র শিল্প। পবিদর্শকদের আওতায় আসতে হলে কোন কারখানার পক্ষে দুটি পূর্বশর্ত ছিল আবশ্যিক: বাষ্প বা জলশক্তির ব্যবহার এবং কয়েকটি বিশেষ ধরনের তন্তু উৎপাদন। (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৪, পৃঃ ৮)

৩. তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পগুলির ব্যবস্থা সম্পর্কে শিশু নিয়োগ কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টগুলিতে বিশেষ মূল্যবান তথ্য আছে।

৪. “গত অধিবেশনের (১৮৬৪) আইনগুলি এমন বিভিন্ন বৃত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যাদের রীতিনীতি বিপুলভাবে বিভিন্ন; আগে আইনের চোখে ‘কারখানা বলে গণ্য হতে হলে প্রতিষ্ঠানটি এমন হতে হত যেখানে মেশিনারিতে গতি সঞ্চার করতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার করতে হত, কিন্তু এই আইনে এই শর্তটি বাদ দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৪ পৃঃ ৮)

৫. ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে উদার নীতিবাদের স্বর্গ বেলজিয়ামে এই আন্দোলনের চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। এমনকি কয়লাখনি ও লোহার খাদে সব বয়সের নারী ও পুরুষ শ্রমিক, পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যেই যে কোন সময়ে এবং যতঘণ্টা খুশি ব্যবহৃত হয়। নিযুক্ত হাজার জনের মধ্যে ৭৩৩ জন পুরুষ, ৮ জন নারী এবং ১৩৫ জন বালক এবং ৪৪ জন ১৬ বছরের কম বয়সের বালিকা। ব্লাস্ট ফানেসে প্রতি হাজার জনে ৬৬৮ পুরুষ, ১৪৯ নারী, ৮ বালক ও ৮৫ জন ষোল বছরের কম বয়সের বালিকা। এর সঙ্গে যোগ করুন পরিণত ও অপরিণত শ্রমিকদের অল্প মজুরির দরুন বিরাট শোষণের হিসাব। একজন পুরুষের গড় দৈনিক মজুরি দুই শিলিং আট পেনি, নারী শ্রমিকের এক শিলিং আট পেনি, বালকের মজুরি এক শিলিং ২২ পেনি। এর ফলে ১৮৬৩ সালে ১৮৫০ সালের তুলনার বেলজিয়াম প্রায় দ্বিগুণ মূল্যের ও পরিমাণের কয়লা, লোহা প্রভৃতি রপ্তানি করে।

৬. ১৮১০ সালের ঠিক পরে রবার্ট ওয়েন শুধু যে নীতির দিক দিয়েই শ্রম দিবসের নিয়ন্ত্রণ সমর্থন করেন, তাই নয়, পরন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি নিউ লানাকে তার কারখানায় দশ ঘণ্টা এম-দিবস প্রবর্তন করেন। একে কমিউনিস্ট-কল্পনা বিলাস আখ্যা দিয়ে উপহাস করা হয়। তার পরিকল্পিত শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের সমন্বয় সাধনের পদ্ধতি এবং তার দ্বারা সর্বপ্রথম গঠিত শ্রমিকদের সমবায় সমিতি নিয়েও হাসাহাসি চলে। বর্তমান সময়ে প্রথম নম্বর কল্পলোকটি (ইউটোপিয়া) রূপ নিয়েছে কারখানা-আইনে, দ্বিতীয়টি সমস্ত কারখানা-আইনের বয়ানে সরাসরি স্থান পেয়েছে, তৃতীয়টি ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়াশীল ভণ্ডামীর আবরণ রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৭. উরে : “Philosophie des Manufactures” প্যারিস, ১৮৩৬ ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৯, ৪০, ৬৭, ৭৭ ইত্যাদি।

৮. ১৮৫৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান কংগ্রেসের রিপোর্টে বলা হয়েছে : ফরাসী আইনে কারখানাগুলিতে দৈনিক শ্রমের ঘণ্টাকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তাতে কোন সময়ের ধরাবাধা নেই। শুধু শিশুদের শ্রমের ক্ষেত্রে সময় নির্দিষ্ট হয়েছে সকাল পাচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। সেইজন্য এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে কোন কোন মালিক তাদের কারখানা প্রত্যহ অবিরাম দিনরাত চালাত, কেবল রবিবারের ছুটিটা সম্ভবতঃ বাদ দিয়ে। এইজন্য তারা দু’দল শ্রমিক নিয়োগ করত যাদের কেউই বারো ঘণ্টার বেশি। একাদিক্রমে কাজ করত না কিন্তু কারখানা দিনরাত চলত। আইন এতে সন্তুষ্ট, কিন্তু মানবতা? তাছাড়া মানুষের শরীরের উপর রাত্রের শ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব বিচার করুন। তারপর জোর দেওয়া হয় “স্বল্প আলোকিত একই কারখানা ঘরে রাত্রে স্ত্রী পুরুষের একত্র অবস্থানের মারাত্মক কুফলের উপরে।”

৯. “উদাহরণস্বরূপ, আমার জেলায় একজন লোক থাকে যে একাধারে ব্লিচিং ও ডাইং কারখানা-আইন অনুযায়ী হচ্ছে ব্লিচার ও ডায়ার, ছাপাখানা আইন-অনুযায়ী একজন ফিনিশার।” ( মিঃ বেকারের রিপোর্ট : ‘রিপোর্ট’, ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬১, পৃঃ ২৩)। এই আইনগুলির বিভিন্ন ব্যবস্থার বিবরণ দিয়ে এবং তার থেকে উদ্ভূত জটিলতা দেখিয়ে মিঃ বেকার বলেছেন: “অতএব, বেশ বুঝা যায় যেখানে মালিক আইনকে ফাকি দিতে চায় সেখানে পার্লামেন্টের এই তিনটি আইনকে কার্যকরী করা খুবই শক্ত।” কিন্তু উকিলরা এই জটিলতা থেকে পায় মামলা।

১০. এইভাবে কারখানা পরিদর্শকের। শেষ পর্যন্ত বলতে সাহসী হলেন : (শ্রম দিবসের সীমা নির্দেশের বিরুদ্ধে মূলধনেব এই প্রতিরোধ ) শ্রমিকদের অধিকারের মূলনীতির কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য… একটা সময়ে শ্রমিকের উপর মালিকের আর অধিকার থাকে না এবং তখন সেই সময়টি হয় শ্রমিকের নিজস্ব, এমনকি যদি তখন শ্রমিক ক্লান্ত হয়ে না-ও পড়ে তাহলেও।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃ: ৫৪)।

১১. আমরা ডানকার্কের শ্রমিকরা ঘোষণা করছি যে বর্তমান ব্যবস্থায় আমাদের যে দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করতে হয়, সেটা বড় বেশি এবং তাতে আমাদের বিশ্রাম ও অবসরের সময় তো দূরের কথা, এতে এমনই একটি কঠোর বন্ধনে পড়তে হয় যে আমাদের অবস্থা হয়ে পড়ে প্রায় গোলামির মত। তাই আমরা সিদ্ধান্ত করছি যে আট ঘণ্টাই শ্রম-দিবস হিসেবে যথেষ্ট এবং এইটাই আইনের দ্বারা মানাতে হবে। অতএব আমরা এই উদ্দেশ্যে আমাদের সাহায্য কল্পে শক্তির আধার সংবাদপত্রের সহায়তা চাই….. এবং এইজন্য যারা আমাদের সাহায্য করতে চাইবে না তাদের শ্রমের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের শত্রু বলেই মনে করব।” (ডানকার্ক শ্রমিকদের প্রস্তাব নিউইয়র্ক রাজ্য, ১৮৬৬)।

১২. বিপোর্টন ইত্যাদি অক্টোবর ১৮৪৮ পৃঃ ১১২।

১৩. প্রায়ই যুক্তি দেওয়া হয়, শ্রমিকদের রক্ষণব্যবস্থার কোনো দরকার নেই, তাদেরকে গণ্য করা উচিত তার একমাত্র যে সম্পত্তিটির অধিকারী, গায়ের খাটুনি ও মাথার ঘাম, সেই সম্পত্তিটির স্বাধীন কারবারি হিসাবে—এই যুক্তিটি যে কত অসার, তার তর্কাতীত প্রমাণ পাওয়া যায় কার্যবিবরণীগুলিতে (১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ পর্যন্ত মূলধনের কলাকৌশলগুলিতে) ( বিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৩, পৃ: ৪৫)। “স্বাধীন শ্রম (যদি এরকম আখ্যা দেওয়া চলে), স্বাধীন দেশেও তার রক্ষার জন্য আইনের সবল হস্তের প্রয়োজন।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৮ পৃঃ ৩৪)। “অনুমতি দেওয়া মানে শ্রমিকদের কার্যত দিনে চোদ্দ ঘণ্টা খেয়ে, কিংবা না খেয়ে কাজ করতে বাধ্য করা।” ( বিপোর্ট, ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৪ . )।

১৪. ফ্রেন্ড রিক এঙ্গেলস,l.c.পৃ: ৫।

১৫. শিল্পের যে যে শাখায় দশ ঘণ্টার আইন প্রবর্তিত হয়, সেখানেই ‘দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রমে শ্রমিকদের অকাল-পঙ্গুত্ব বন্ধ হয়। (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৯, পৃঃ ৪৭ )। (কাবখানায় নিয়োজিত) মূলধন কথনও কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নৈতিক জীবনের কিছুটা অনিষ্ট না ঘটিয়ে যন্ত্রপাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সক্রিয় রাখতে পারে না এবং শ্রমিকরা নিজেদের রক্ষা করার মত অবস্থায় নেই। (1.c. পৃঃ ৮) ১৬. আর একটি বড় আশীর্বাদ লাভ এই যে, এইবার শ্রমিকের নিজের সময় এবং তার মালিকের সময়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট হল। এখন থেকে শ্রমিক বুঝতে পারল যে, সে যা বিক্রি করেছে কখন তা শেষ হচ্ছে এবং কখন তার নিজস্ব সময় শুরু হচ্ছে এবং আগে থেকে জানতে পারার জন্য সে এখন থেকে নিজের উদ্দেশ্য মতে এই সময়টা ব্যবহার করতে পারে। (tc. পৃ: ৫২) “শ্রমিকদেরকে নিজেদের সময়ের মালিক হিসাবে স্বীকার করে ( কারখানা আইনগুলি) তাদের যে নৈতিক শক্তির যোগান দিল তার বলে তারা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের দিকে এগোয় !” (1.c. পৃঃ ৪৭ ) খুব সংযত শ্লেষের সঙ্গে একেবারে ওজন-করা কথায় কারখানা পরিদর্শকরা ইঙ্গিত করেছেন যে, যে-মানুষ মূলধনের মূর্ত বিগ্রহ ছাড়া আর কিছু নয়; তার পক্ষে যে পশুবৃত্তি স্বাভাবিক। সেই পশুবৃত্তি থেকে এই আইন ধনিকদেরও কিঞ্চিৎ মুক্তি দিল, তারা কথঞ্চিৎ মানসিক কৃষ্টির অবসর পেল। “আগে মালিকদের টাকা করা ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না আর গোলামদের শ্রম করা ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না।” (l.c. পৃঃ ৪৮ }! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *